রজত চক্রবর্তী
১
কলকাতার উত্তর প্রান্তের একটি পুরনো অলিগলি দিয়ে হেঁটে হেঁটে অধ্যাপক ঋণুতোষ সেন বাড়ি ফিরছিলেন। তাঁর চশমার কাচে কুয়াশার মতো জমে ছিল ধুলো, আর জামার পকেটে গুঁজে রাখা ছিল কয়েকটি পুরনো বই—তার মধ্যে একটিতে পাতার মাঝখানে শুকিয়ে যাওয়া পাতাবাহার ফুল। বছর পঞ্চান্নর ঋণুতোষ এখন সিটি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, যিনি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন এবং এখনও প্রতিটি শব্দকে প্রাণের মতো ভালোবাসেন। স্ত্রী শ্রেয়শীর মৃত্যু তাকে আরও নিঃসঙ্গ করে তুলেছে। একটা সময় ছিল, যখন তারা মিলে কবিতার বই পড়তেন, সন্ধ্যাবেলায় কোলাহলময় শহরের মাঝখানে এক কাপ লেবু চা নিয়ে আলোচনায় মশগুল থাকতেন, আর এখন? এখন তার একমাত্র সঙ্গী—এক ভাঙা রেডিও আর ধুলো জমা বইয়ের তাকে থাকা পুরনো বইগুলি। এমনই এক বিকেলে, যখন আকাশের ছায়া কিছুটা নীলচে ধূসর আর বাতাসে ভেসে আসছে ছেঁড়া উলের গন্ধ, তিনি ডাকবাক্স খুলে একটি হলুদাভ খাম পান। খামের ওপর তাঁর নাম লেখা—“Professor Rinutosh Sen”—কিন্তু কোনো প্রেরকের নাম নেই। তাতে কোন স্ট্যাম্প নেই, নেই কোনো পোস্টমার্ক, যেন কেউ নিজে হাতে রেখে গেছে তা। খামটি খুলে দেখেন এক ছোট চিরকুট: “তুমি যদি সত্যিই জানতে চাও, চাবিটা খুঁজো পৃষ্ঠা তেত্রিশে।”
প্রথমে বিষয়টিকে ছেলেমানুষি মনে করে তিনি চিরকুটটা পকেটে ঢুকিয়ে দেন। তারপর সিগারেটের শেষ টান দিয়ে ব্যাগ থেকে একটি বই বের করেন—বইটি ছিল রবীন্দ্রনাথের “কবিতাবলী”—যা তাঁর স্ত্রীর সবচেয়ে প্রিয় ছিল। বাড়িতে ফিরে চা খেতে খেতে তিনি হঠাৎ খেয়াল করেন, চিঠিটা তাঁর স্ত্রীর লেখা হাতের লেখার সঙ্গে অনেকটাই মেলে। অস্বস্তিকর একটা কাঁপুনি নামল পিঠের নিচে। সেদিন রাতে তিনি বহুদিন পর সেই বইটি হাতে নিয়ে আবার পড়া শুরু করেন। পৃষ্ঠা তেত্রিশ খুলতেই একটি পাতলা কাগজ মৃদু শব্দ করে পড়ে যায়। কাগজে লেখা, কালি কিছুটা মুছে যাওয়া—“আমি যমিনী… আমি কোথাও হারিয়ে যাইনি।” এই ‘যমিনী’ নামটা তার কানে বাজল অন্যরকম করে। এমন এক নাম, যেটা তিনি চিরকাল শুধুই বইয়ের পাতায় পড়েছেন, জীবনে কখনো শোনেননি কারো মুখে। কৌতূহল মিলিয়ে গেল এক অদ্ভুত শীতলতায়। তিনি জানতেন না, এই এক লাইনের বাক্য তাঁকে নিয়ে যাবে এমন এক অন্ধকার অভ্যন্তরে, যেখানে আলো খুঁজতে গেলে আগে নিজেকে খুলে ফেলতে হয়। তিনি রাতে বহুবার উঠে উঠে খেয়াল করেন, সেই পাতায় লেখা কবিতাটি আগে কখনো ছিল না। স্ত্রীর অনুপস্থিতির মধ্যে, এই কথাগুলির উপস্থিতি যেন এক আত্মিক ফাঁক ভরাট করতে চাইছে। যমিনী নামক এই ছায়ামূর্তির মধ্যে কি লুকিয়ে আছে তাঁর স্ত্রীর কোনো অতীত? না কি এ শুধুই তাঁর মনোবিভ্রম?
পরদিন সকালে অধ্যাপক গন্তব্য স্থির করেন—কলকাতার সেই পুরনো রেফারেন্স লাইব্রেরি, যেখানে শহরের হারিয়ে যাওয়া কাগজপত্র ও দস্তাবেজদের ঠিকানা পাওয়া যায়। সেই লাইব্রেরি তিনি বহুদিন যাননি, শেষবার গিয়েছিলেন যখন শ্রেয়শী তাঁর সঙ্গে ছিল, হাতে ছিল একখানা কবিতার খাতা, আর চোখে ছিল দীপ্তি। আজ সেই জায়গায় যাচ্ছেন একা, পকেটে এক রহস্যময় নোট আর হাতে স্ত্রীর প্রিয় বই। লাইব্রেরির সামনে দাঁড়িয়ে এক মুহূর্ত থেমে যান তিনি—দালানের গায়ে লতা-পাতা জড়ানো, কাঠের দরজায় লোহালক্কড়ের তালা। কেরানির সামনে নাম বলতেই তিনি বলেন, “অভিরূপাদির কাছে যান, ওঁরা এখন পুরনো ফাইল ঘাঁটছেন।” অধ্যাপক ধীর পায়ে এগিয়ে যান সেই অচেনা নামের খোঁজে, কিন্তু জানতেন না, তাঁর পায়ের নিচে সময়ের যে গোলকধাঁধা বিছিয়ে আছে, তা তাঁকে নিয়ে যাবে যমিনীকুমার নামের এক মৃত লেখকের ছায়ায়, আর সেই ছায়ার ভিতরই খুঁজে পাবেন নিজের হারিয়ে যাওয়া প্রেম, নিজেরই অতীত, এবং এক রহস্য, যার চাবি শুধু তাঁর হাতেই ছিল—যার খোঁজ তিনি এতদিন পাননি।
২
রেফারেন্স লাইব্রেরিটা যেন শহরের বুকে এক নীরব সন্ন্যাসী—সময়ের কোলাহল থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখা, পুরনো দেওয়ালের ফাঁকে জমে থাকা সোঁদা গন্ধ আর কাঠের তাকের ওপর থমকে থাকা ধূলোর স্তর। অধ্যাপক ঋণুতোষ সেন ধীরে পা রাখেন সেই শীতল প্রবেশপথে, যেখানে আলো যেন ফিল্টার হয়ে আসে ছাঁকনি জানালার গ্লাস ভেদ করে। অভিরূপা লাহিড়ী নামটি শুনেই এক তরুণী এগিয়ে এলেন, তাঁর চোখে হালকা বাকা দৃষ্টি, পরনে মলিন সালোয়ার আর গলায় পাতলা লাল ওড়না। “আপনি অধ্যাপক সেন তো?” তাঁর স্বর সজীব, কিন্তু ভেতরে একরকম ক্লান্তি জড়িয়ে। অধ্যাপক মাথা নেড়ে বলেন, “আমি একটি লেখকের খোঁজে এসেছি, যমিনীকুমার বসু।” অভিরূপা একটু থেমে বলেন, “এই নামটা… বহুদিন কেউ উচ্চারণ করেনি।” কিছু না বলে তিনি অধ্যাপককে অনুসরণ করেন, লাইব্রেরির দোতলায়, এক কাঠের দরজা ঠেলে ভেতরে নিয়ে যান, যেখানে পুরনো ফাইল আর দস্তাবেজে ঠাসা তাকগুলোর ফাঁকে দাঁড়িয়ে একজন বৃদ্ধ পুরুষ ধূসর কোট পরে নথি উল্টাচ্ছেন। অভিরূপা ফিসফিস করে বলেন, “ওই ভদ্রলোক হলেন অলিন্দ বসু—আমাদের প্রধান গ্রন্থপাল। আপনি যমিনীকুমার প্রসঙ্গে বললে উনি হয়তো…” কথাটা শেষ করার আগেই অলিন্দ বসু তাদের দিকে ফিরে তাকান, চোখে একরকম শীতলতা।
অলিন্দ বসু চশমা সরিয়ে অধ্যাপকের দিকে তাকিয়ে বলেন, “এই নাম আবার উঠে এল কেন? যে লেখক নিজের জীবনের দরজা নিজে বন্ধ করেছে, তার পেছনে কেন খোঁজ?” অধ্যাপক উত্তরে কিছু বলেন না, শুধু পকেট থেকে সেই ছোট্ট নোটটা বের করে দেন। অলিন্দ বসু তা এক ঝলক দেখে ধীরে মাথা নেড়ে বলেন, “আপনি যা খুঁজছেন, তা খুঁজে পেলে আপনি হয়তো ফিরে যেতে পারবেন না। আবার নিজের মধ্যেও থাকতে পারবেন না।” এরপর তিনি চুপ করে দরজার দিকে ইশারা করেন, অভিরূপা মৃদু কণ্ঠে বলেন, “আমাকে অনুসরণ করুন।” তারা এক সরু করিডোর ধরে এগিয়ে যান লাইব্রেরির দক্ষিণ-পূর্ব কোণে, যেখানে জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ। সেখানে একটি ছোট ঘর—ভেতরে কাঠের টেবিল, একটা প্রাচীন টাইপরাইটার, এবং একপাশে একটা ডালা খোলা বুকশেলফ। অভিরূপা বলেন, “এই ঘরটা আগে যমিনীকুমারের লেখা রেকর্ড করতেই তৈরি হয়েছিল। কেউ জানে না সে এখানে কী লিখত। কিন্তু আমি কিছু কিছু বইয়ের মধ্যে তার হাতে লেখা নোট পেয়েছি। আপনি যদি সাহসী হন, তাহলে পড়ুন।” তিনি একটি পাতলা খাতা অধ্যাপকের হাতে দেন—তাতে লেখা একটি অদ্ভুত কবিতা: “অক্ষরের ছায়ায় যাকে পাবে, তার মুখে কথা থাকবে না, শুধু চোখে এক চাবির ছবি।”
অধ্যাপক সেই কবিতাটি পড়ার সময় যেন হিমশীতল বাতাস ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। যেন সময় এক মুহূর্তের জন্য থেমে যায়। তিনি বুঝতে পারেন, এটি নিছক কবিতা নয়—এ এক ধাঁধা, এক সাংকেতিক আহ্বান, যা তাকে বইয়ের পাতার গহিনে, অতীতের অন্ধকারে টেনে নিয়ে যেতে চায়। অভিরূপা তখন বলে ওঠেন, “এই কবিতাগুলো আমি অনেকবার পড়েছি। যমিনীকুমার যেন কিছু লুকিয়ে রেখে গেছেন আমাদের জন্য। একটা কিছু খুঁজতে হবে—কিন্তু কী?” অধ্যাপক ধীরে বলেন, “একটি চাবি।” শব্দটা যেন ঘরে প্রতিধ্বনিত হয়, যেন বাতাসও কান পেতে শুনতে থাকে। তখনই তাকের এক কোণে রাখা পাতলা বইয়ের মাঝখান থেকে বেরিয়ে পড়ে আরেকটি নোট। তাতে লেখা: “চাবি পেলে ভুলেও দরজা খোলো না, যদি না তুমি জানো, কাকে ডাকবে ভিতর থেকে।” অধ্যাপক তাকিয়ে থাকেন অভিরূপার দিকে, আর অভিরূপা তাঁর দিকে—দুজনেই জানতেন, তারা এমন কিছুতে পা দিয়েছেন, যেখান থেকে আর ফিরে আসা সহজ হবে না। তাঁদের সামনে এখন শুধু বইয়ের পাতার গোপন গলি, কবিতার ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকা সত্য, আর এক হারিয়ে যাওয়া লেখকের নিশ্বাস, যিনি হয়তো এখনো লাইব্রেরির স্তব্ধ দেওয়ালে ঘোরেন নিজের অজানা পাঠকের অপেক্ষায়।
৩
সেই রাতটায় অধ্যাপক ঋণুতোষ সেন নিজের খাটে বসে খুলে রাখেন লাইব্রেরি থেকে আনা পাতলা খাতাগুলো। প্রতিটি পাতায় যমিনীকুমার বসুর হাতে লেখা শব্দগুলোর মধ্যে লুকিয়ে আছে এক অদ্ভুত সুর—কখনো করুণ, কখনো বিদ্রোহী, আবার কখনো যেন কারও অদৃশ্য আর্তনাদ। তাঁর চোখ আটকে যায় একটি লাইনে—“আমি চলে যাইনি, আমি রেখে গেছি পথ, শুধু আলো নিভিয়ে।” এই বাক্যটা তাঁর বুকের মাঝে হঠাৎ একটা শীতল ভার ফেলল। একে একে তিনি খুঁজে বের করতে লাগলেন পুরনো বই, যেগুলোর ভিতরে অভিরূপা ইঙ্গিত দিয়েছিলো নোট থাকতে পারে। প্রথমটি ছিল একটি অখ্যাত কাব্যসংকলন—“অরণ্যের আত্মা”—খুব পুরনো ছাপা, পাতায় পাতায় পোকা কাটা দাগ। পৃষ্ঠা একত্রিশে ভাঁজ করে রাখা ছিল এক পত্র—তাতে লেখা, “আমার মৃত্যু নয়, আমার অনুপস্থিতি পরিকল্পিত। আমার শব্দগুলো বেঁচে থাকবে, যদি কেউ চোখে না পড়ে, শুধু অনুভবে।”
এরপর অধ্যাপক পায় আরও দুটি নোট, একটিতে লেখা, “যাকে তুমি খুঁজছ, সে শুধু লেখক নয়, সে এক প্রতিবিম্ব। তার যন্ত্রণার রূপ বুঝতে গেলে তোমাকে ফিরে যেতে হবে নিজের শুরুতে।” দ্বিতীয়টি ছিল কিছুটা বিভ্রান্তিকর—“তুমি যদি চাবির খোঁজ পাও, তবে বোঝো, তুমি নিজেই তালা।” এই বাক্যগুলো অধ্যাপককে ধীরে ধীরে নিজের জীবনের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। স্ত্রীর মৃত্যুর আগে কত কথা বলা হয়নি তাঁর, কত ইচ্ছা অপূর্ণ থেকে গেছে। শ্রেয়শী এক সময় যমিনীকুমারের লেখা খুব ভালোবাসতেন, বিশেষ করে তাঁর কিছু গোপন কবিতা, যেগুলো কখনো ছাপা হয়নি। অধ্যাপক বুঝতে পারেন, হয়তো শ্রেয়শী জানতেন কিছু, যেটা তিনি তখন গুরুত্ব দেননি। হয়তো তিনি এই রহস্যের একমাত্র জীবন্ত সূত্র।
পরদিন অভিরূপা লাইব্রেরিতে তাঁকে অপেক্ষা করছিলেন হাতে একটি পুরনো তালিকা নিয়ে—সেই সব বইয়ের নাম যেগুলোর মধ্যে কোনো না কোনো সময়ে নোট পাওয়া গিয়েছে। তালিকার একেবারে শেষে একটি বইয়ের নাম দেখে থমকে যান অধ্যাপক—“চিরন্তন সন্ধ্যা”—এই বইটি শ্রেয়শীর প্রিয় ছিল এবং তাদের বাড়ির বইয়ের তাকেই বহু বছর ধুলো জমে আছে। সেই মুহূর্তে অধ্যাপকের মনে হলো যেন সমস্ত পথ তাঁকে নিজের ঘরের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে, বাইরের রহস্য আসলে তাঁর ভিতরেরই প্রতিবিম্ব। তিনি অবাক হয়ে খেয়াল করেন, যমিনীকুমারের কাব্য আর শ্রেয়শীর ব্যক্তিগত নোটে কোথাও একধরনের মিল, যেন এক ভাষা, এক যন্ত্রণা, এক ভাঙনের সুর। তখনই অভিরূপা তাঁকে জিজ্ঞেস করে, “আপনি কি কখনো ভেবেছেন, এই লেখকটা শুধুই লেখক নয়, হতে পারে… এক হারিয়ে যাওয়া আত্মা, যাকে আপনার জীবনে কেউ চিনতেন খুব ভালো করে?” অধ্যাপক কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন, তারপর মাথা নাড়িয়ে বলেন, “হয়তো এ কেবল একজনের গল্প নয়, হয়তো এ গল্প আমাদের সকলের—যারা ভিতরে ভিতরে কিছু একটা খুঁজে বেড়াই, অথচ জানি না ঠিক কী, জানি শুধু—সেই খোঁজেই আমাদের বেঁচে থাকা।” লাইব্রেরির জানালার বাইরে তখন সন্ধ্যার আলো ঢলছে, আর কাচের ওপারে ধরা পড়ছে এক ছায়ামূর্তি—যেন সময় নিজেই দাঁড়িয়ে শুনছে তাদের কথা।
৪
সন্ধ্যেবেলায় অধ্যাপক ঋণুতোষ সেন ফিরে যান নিজের বইয়ের ঘরে—এক সময় যেখানে শ্রেয়শী সারি সারি বই গোছাতেন, এখন সেখানে শুধুই নিস্তব্ধতা। তাকের এক কোণে ধূলিধূসরিত অবস্থায় পাওয়া যায় সেই বই—“চিরন্তন সন্ধ্যা”, যার ভেতরে তিনি খুঁজে পান পাতার মধ্যে ভাঁজ করা এক চিঠি। চিঠির উপরে লেখা ছিল একটাই নাম—চপলিকা। নামটা তাঁকে চমকে দেয়, কারণ চপলিকা ঘোষ ছিলেন একজন সাহিত্য গবেষক যিনি হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন বছর দশেক আগে। তিনি শ্রেয়শীর কলেজ সহপাঠী ছিলেন, এবং যমিনীকুমার বসুর উপর একটি জীবনী লিখছিলেন—যা রহস্যজনকভাবে প্রকাশিত হয়নি। চিঠির ভাঁজে ছিল একটি পাতলা ডায়েরির ফটোকপি, যা দেখে মনে হয় শ্রেয়শী নিজের কাছে মূল কপি থেকে এটি তুলে রেখেছিলেন। ডায়েরির শুরুতে লেখা, “আমি চপলিকা। আমি জানি আমার চারপাশে যা ঘটছে তা অনেকে বিশ্বাস করবে না। কিন্তু আমি জানি, যমিনীকুমার মরেননি, তিনি চলে গেছেন অন্য এক পাঠক খুঁজতে। তাঁর নোট, তাঁর শব্দ, তাঁর চাবি—সব এখনও এখানে, আমাদের মধ্যে।”
অধ্যাপক কাঁপা হাতে ডায়েরির পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকেন। প্রতি পাতায় লেখা চপলিকার ভয়, উন্মাদনার মতো অনুভূতি—তিনি বিশ্বাস করতেন, যমিনীকুমার শুধু একজন কবি নন, তিনি এমন একজন যিনি তাঁর শব্দ দিয়ে বাস্তবকে পাল্টাতে পারতেন। এক পৃষ্ঠায় লেখা, “তিনি বলেন, শব্দের ভিতরেই আত্মা থাকে। যদি কেউ সত্যি বোঝে কবিতার অর্থ, সে কবির স্মৃতি হয়ে ওঠে।” আরেক পৃষ্ঠায় চপলিকা লিখেছেন যে তিনি লাইব্রেরির গোপন ঘরে যমিনীকুমারের টাইপরাইটারে শেষ যে কবিতাটি পেয়েছিলেন, সেটির শেষ লাইনে লেখা ছিল, “আমি কাউকে রেখে যাচ্ছি, যে আমাকে আবার লিখবে।” অধ্যাপক স্তব্ধ হয়ে পড়েন। চপলিকা লিখেছেন, তিনি শ্রেয়শীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন, শ্রেয়শী তাঁকে সাবধান করেছিল এই ‘শব্দের ধাঁধা’ থেকে দূরে থাকতে। কিন্তু চপলিকা বিশ্বাস করতেন—শ্রেয়শী নিজেই যমিনীকুমারের ভাষায় ঘেরা, আর তাই তিনি একদিন ডায়েরিটি শ্রেয়শীর হাতে দিয়ে চলে যান একরাশ আতঙ্ক নিয়ে, এরপর আর তাঁকে কেউ খুঁজে পায়নি।
অধ্যাপক বুঝতে পারেন, এই গোটা রহস্যের গভীরে শ্রেয়শীর ভূমিকা রয়েছে, হয়তো এমন কিছু সে জেনে গিয়েছিল যা তাকে চিরকাল নিঃশব্দ করে দেয়। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, পরদিন আবার যাবেন রেফারেন্স লাইব্রেরিতে—চপলিকার ডায়েরির কপি নিয়ে, কারণ তার ভিতরে এমন অনেক নাম, স্থান, এবং সংকেত আছে, যা তিনি একা মেলাতে পারবেন না। অভিরূপাকে এই ধাঁধার দ্বিতীয় পাঠক হিসেবে পাশে দরকার। ডায়েরির একেবারে শেষ পাতায় চপলিকা লিখেছেন—“যদি আমি হারিয়ে যাই, কেউ যেন খোঁজে এই কবিতার ছায়া। চাবি থাকবে সেখানেই, যেখানে আমি রেখে যাব এক অনুবীক্ষণ সূচনা।” অধ্যাপক অনুভব করেন, এই লেখাগুলো শুধু ধাঁধা নয়, এগুলো একেকটি দরজা, যেগুলো খুললে তাঁর সামনে বেরিয়ে আসবে অতীতের গোপন এক মানচিত্র—যেখানে হারিয়ে গেছে একজন লেখক, একজন প্রেমিকা, একজন অনুসন্ধানী, আর হয়তো তিনিও নিজেই। বাইরের অন্ধকার জানালায় প্রতিবিম্ব ফেলে, আর তিনি অনুভব করেন, যেন নিজের ছায়া তাকিয়ে আছে তাঁর দিকেই, প্রশ্ন করছে—“তুমি প্রস্তুত তো?”
৫
পরদিন সকালে অধ্যাপক ঋণুতোষ সেন ডায়েরির কপি আর নিজের স্ত্রীর পুরনো কিছু চিঠি নিয়ে রওনা দিলেন লাইব্রেরির দিকে, যেন হাঁটতে হাঁটতে তিনি পার হচ্ছেন শুধুই শহরের রাস্তা নয়, বরং নিজের জীবনের অনুচ্চারিত অধ্যায়গুলোর ওপরে ছায়া পড়ে থাকা এক দীর্ঘ করিডোর। অভিরূপা অপেক্ষা করছিলেন আগের সেই গোপন ঘরে, জানালার ফাঁক দিয়ে আলো এসে পড়েছিল টেবিলের ধুলোয়, যেন রোদ নিজেই খুঁজে ফিরছে কিছু। অধ্যাপক ডায়েরিটা সামনে রাখেন, আর অভিরূপা উৎসাহভরে পাতাগুলো পড়তে শুরু করে। মাঝপথে থমকে গিয়ে সে বলে, “আপনার স্ত্রীর সঙ্গে চপলিকার এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল?” অধ্যাপক ধীরে মাথা নেড়ে বলেন, “হয়তো আমি কখনও জানতাম না শ্রেয়শী ঠিক কতটা গভীরে জড়িয়ে গিয়েছিল যমিনীকুমারের লেখায়। ও আমাকে বলত, কিছু শব্দ মানুষকে বদলে দেয়। আমি হেসে উড়িয়ে দিতাম।” অভিরূপা একটা লাল কালি দেওয়া চিহ্ন দেখিয়ে বলেন, “এই জায়গায় চপলিকা লিখেছেন—‘শ্রেয়শী জানে শেষ কবিতাটি কোথায় লুকোনো আছে।’ আপনি কি জানেন, ও কিছু লুকিয়ে রেখেছিল?”
অধ্যাপক কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন, তারপর ব্যাগ থেকে স্ত্রীর চিঠির বান্ডিলটি বের করে একটি পত্র দেন অভিরূপার হাতে। সেই চিঠিতে শ্রেয়শী লিখেছেন—“তুমি জানো না, তুমি যাকে শুধু কবিতা হিসেবে পড়ো, সে কতটা সত্যি। আমি চাইলেই বলতে পারতাম, আমি কাকে ভালোবেসেছিলাম, কিন্তু সেটা কখনো বলা যেত না, কারণ তুমি তখন তাকে কল্পনা বলে মেনে নিয়েছিলে।” এই বাক্যগুলো যেন ছুরি হয়ে কেটে যায় অধ্যাপকের মনে। চিঠির পরের অংশে লেখা—“আমি হয়তো নিজেই একসময় শব্দের ছায়ায় গিয়েছিলাম। আমি নিজেই হয়তো চাবির প্রহরী।” এই চিঠিগুলো এখন আর শুধুই স্মৃতিচিহ্ন নয়, বরং ধাপে ধাপে এক জটিল ছক তৈরি করছে, যেখানে শব্দ, সম্পর্ক ও সময় পরস্পরের মধ্যে গলে গেছে। অভিরূপা থেমে বলেন, “আপনি জানেন কি, আপনি কী খুঁজছেন? লেখক? স্ত্রী? উত্তর? নাকি ক্ষমা?”
ঋণুতোষ এবার সত্যিই চুপ করে যান। মনে পড়ে শ্রেয়শীর সেই শেষ সন্ধ্যা, যেদিন সে বিছানায় বসে একটি ছোট নীল খাম খুলছিল, যেটা অধ্যাপক আগে কখনো দেখেননি। তখন প্রশ্ন করেছিলেন—“নতুন কিছু?” শ্রেয়শী বলেছিল, “পুরনো জিনিসই নতুন করে ফিরে আসছে।” সেদিন কথাটা নিয়ে ভাবেননি তিনি, কিন্তু আজ যেন শব্দগুলো ফিরে ফিরে আসছে, অন্য অর্থে। অভিরূপা বললেন, “আমাদের চুপ করে বসে থাকা যাবে না। চপলিকা বারবার যেসব জায়গার উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে একটা জায়গা বারবার এসেছে—হেডেন রোডের পুরনো ছাপাখানা।” অধ্যাপক হাল্কা করে হাসলেন—“সেই জায়গাটার নাম আমি বহু বছর শুনিনি। কিন্তু হ্যাঁ, শ্রেয়শী একবার নিয়ে গিয়েছিল সেখানে। বলেছিল, সেখানে যমিনীকুমারের অপ্রকাশিত কবিতাগুলো একবার ছাপানোর চেষ্টা হয়েছিল।” অভিরূপা চুপ করে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর ধীরে বলল, “চলুন, খুঁজে বের করি। কেউ একজন আপনাদের গল্প শেষ করতে চেয়েছিলেন না, শুরু করতে।” জানালার বাইরে তখন এক পশলা হাওয়া ঢুকে আসে, পাতার মৃদু ঝিরঝির শব্দে যেন কেউ ফিসফিস করে বলে ওঠে—“তালা খুলছে, কে জানে ভিতরে কী অপেক্ষা করে আছে।”
৬
অধ্যাপক সমরেশ বসুর মনে হঠাৎই যেন একটা গুমোট ধোঁয়া জমে উঠল। ‘চাবির খোঁজে’ প্রতিটি ধাপে, যে রহস্য ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে, তা তাকে আরও গভীরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। রেফারেন্স লাইব্রেরির পুরনো কাঠের টেবিলের ওপর ছড়িয়ে থাকা পাণ্ডুলিপি, আর তার মাঝখানে পাওয়া ছোট্ট এক টুকরো কাগজ—”বিলুপ্ত কাব্যসন্ধ্যা, ১৯৭৮, দক্ষিণ-পূর্ব করিডোর”। এই করিডোরের অস্তিত্ব কি আদৌ আছে? লাইব্রেরির তৃতীয় তলার পুরনো মানচিত্রে কেবলমাত্র পূর্ব করিডোর ও দক্ষিণ করিডোরের উল্লেখ আছে, কিন্তু দক্ষিণ-পূর্ব? তিনি লাইব্রেরির পুরাতন কেয়ারটেকার গিরিধারীকে জিজ্ঞেস করতেই সে একটু চুপ করে রইল, তারপর বলল, “সেই জায়গাটাকে তো আমরা বন্ধ করে দিয়েছি অনেক বছর আগে, সাহেব। কেউ আর যায় না ওদিকে। ভাঙাচোরা হয়ে গেছে, ফাইলপত্রে নামটাও উঠেনি।” উৎসাহী হয়ে সমরেশ বললেন, “আমাকে সেখানে নিয়ে যেতে পারবে?” গিরিধারী একটু ইতস্তত করেও রাজি হল। পুরনো আলোর নিচে হাঁটতে হাঁটতে তারা এসে পৌঁছাল একটি অন্ধকার করিডোরের সামনে। দরজাটা সাদাটে ধুলোয় মোড়া, তালাচাবি তেমন শক্ত না হলেও কষ্টে খোলা গেল। ভেতরে ঢুকে সমরেশ দেখলেন ধুলোয় ঢাকা একটি রিডিং ডেস্ক, এক কোণে ভাঙা চেয়ার, আর কিছু পুরনো কাগজপত্র ছড়ানো অবস্থায়। কিন্তু ঠিক মধ্যিখানে রাখা ছিল একটি কাঠের বাক্স—পুরোনো, ছত্রাক-ধরা, কিন্তু অদ্ভুতভাবে যত্নে রাখা।
সমরেশ বাক্সটা খোলার আগে একটু থমকালেন। যেন অনুভব করলেন, এই বাক্সের ভেতরে কেবল কিছু কাগজ বা পাণ্ডুলিপি নেই—আছে এক সময়ের সত্তা, এক আত্মার স্পর্শ। ধীরে ধীরে বাক্সটা খুলতেই তার চোখ স্থির হয়ে গেল। ভিতরে পাওয়া গেল এক নোটবই, যার পাতাগুলোতে হাতের লেখা কবিতা আর ডানদিকের কোণে একটি নাম—’শ্রীজাতি সেন’। এই নামটা আগে কোথাও শুনেছেন কিনা তিনি নিশ্চিত নন, কিন্তু নোটবইয়ের শেষ পাতায় যে কথাটা লেখা ছিল, তা তার শিরদাঁড়া দিয়ে কাঁপুনি তুলে দিল—”সমরেশ, যদি তুমি এটা পড়ছো, তার মানে তুমি এখনও খুঁজে চলেছ। কিন্তু প্রশ্ন হল, তুমি কি নিজেকে খুঁজছো না আমাকে?” সমরেশ স্তব্ধ হয়ে গেলেন। কে এই শ্রীজাতি সেন? তিনি কবে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন? এই চিঠির ভাষা এমনভাবে লেখা যেন সমরেশকেই উদ্দেশ্য করে লেখা। কিন্তু তৎক্ষণাৎ তিনি মনে করার চেষ্টা করলেন, এমন কোনও নাম, এমন কোনও স্মৃতি তার জীবনে নেই। কিন্তু যদি এই নামটাই ভুলে যাওয়া অতীতের একটি কক্ষের চাবি হয়?
তিনি বাড়ি ফিরে এসেই তার পুরনো নোটবুক, ছাত্রজীবনের ডায়েরি আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবিতা সংগঠন ‘কাব্যনিবাস’-এর আর্কাইভ ঘাঁটতে লাগলেন। এক জায়গায় থেমে গেলেন তিনি—১৯৭৮ সালের একটি পত্রিকা ‘আলোকধারা’-র একটি সংখ্যায় লেখা ছিল এক তরুণী কবির নাম—শ্রীজাতি সেন, যিনি হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়ে যান এবং তার লেখা শেষ কবিতাটি একটি চিঠির আকারে প্রকাশিত হয়েছিল যেখানে লেখককে দায়ী করার মতো সূক্ষ্ম ইঙ্গিত ছিল। তার নিচে ছোট হরফে লেখা ছিল: “সূত্র: অধ্যাপক স. বসু-এর ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে পাওয়া নোট।” সমরেশ যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলেন। এটা কীভাবে সম্ভব? তিনি তো এই নামটিই মনে করতে পারছিলেন না এতদিন, অথচ সেই সময় তিনি নিজেই এক সাক্ষাৎকারে শ্রীজাতির কথা বলেছিলেন? স্মৃতির এই গভীর গলিতে এমন কী আছে, যা তিনি নিজেও ভুলে গেছেন? কেবল কী সময়ের দোষ, নাকি ইচ্ছাকৃত বিস্মৃতি? তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, এই স্মৃতির ভাঁজে ঢুকে তাকে আবার খুঁজে বার করতে হবে শ্রীজাতির উপস্থিতি, তার কবিতা, তার আত্মহননের নেপথ্য কারণ—আর সবচেয়ে বেশি, নিজের সেই হারিয়ে যাওয়া অংশটিকে, যা হয়তো এই গোটা গল্পের চাবিকাঠি।
৭
লাইট গ্যালারির পুরনো কাঠের জানালার ফাঁক গলে দুপুরের রোদ এসে পড়েছিল অধ্যাপক অরিত্র সান্যালের কাঁধে, যেভাবে ছেলেবেলায় দাদুর গ্রামবাড়ির ঘরে আলো এসে পড়ত। কিন্তু সেই আলোয় আজ অস্বস্তি ছিল—মনে হচ্ছিল যেন কেউ বা কিছু তাঁকে দেখছে। লাইব্রেরির আধা-অন্ধকার কোণায় আজকের সন্ধ্যার লেকচারের জন্য নোট নিচ্ছিলেন তিনি, কিন্তু মাথা কাজ করছিল না। মনটা পড়ে ছিল গতকাল পাওয়া নোটটার উপর, যেটা কোনো এক ‘অমৃতা’ লিখেছিল—”তুমি জানো না, তুমি কোথা থেকে এসেছো। ওঁর খোঁজ পেতে গেলে নিজের ছায়ার ভিতর ডুবতে শেখো।” কে এই অমৃতা? কেন যেন নামটা অদ্ভুতভাবে পরিচিত লাগছিল—একটা নস্টালজিয়া, অথবা ভুলে থাকা কোনো দিনের আওয়াজ। সেই ভাবনার মধ্যেই তপন এসে জানালো, নীচের কাঠের সিঁড়ির নিচে এক পুরনো ট্রাঙ্ক পাওয়া গেছে, তালা দেওয়া। অরিত্রর মনে পড়ে গেল সেই চাবি, যেটা দ্বিতীয় বইয়ের নোটের পাশে পাওয়া গিয়েছিল—পুরনো, কালচে লৌহচাবি। হঠাৎ মনে হল, এই লাইব্রেরির মধ্যেই হয়তো ছড়িয়ে আছে এমন অনেক তালা, যেগুলো কেবল সঠিক সময়ে খুলে দেয় অতীতের গোপন ইতিহাস।
সিঁড়ির নিচে গিয়ে তপনের হাতে সেই ট্রাঙ্কটা দেখে অরিত্রর বুক ধক করে উঠল—ওটা অবিকল সেই ট্রাঙ্ক, যেটা তিনি বাল্যকালে তাঁর কাকার বাড়িতে দেখেছিলেন। চোখে যেন ভেসে উঠল পুরনো কাশ্মীরি কাঠের কাজ করা ঢাকনাটা, আর পাশের কোণে একটি অদ্ভুত দাগ—একটি অর্ধেক চাঁদ। চাবিটা হাতে নিয়ে তালায় ঢুকাতেই ক্লিক করে একটা শব্দ হলো—যেন অতীত হঠাৎ করে ফেটে পড়ল এখনকার সময়ে। ভিতরে পুরনো চিঠির গুচ্ছ, কিছু সাদা-কালো ছবি আর একটা ছোট্ট নীল ডায়েরি—ডায়েরিটার ভিতরে লেখা, ‘অমৃতা সেনগুপ্ত, ১৯৮২, কলকাতা’। এবার অরিত্র জানলেন, নামটা কেন এত চেনা লাগছিল—এই নাম তিনি একবার একটি পত্রিকার সাহিত্য সংখ্যায় পড়েছিলেন, যেখানে একজন স্বঘোষিত লেখিকা তার লেখার জন্য প্রচণ্ড ট্রোলিংয়ের শিকার হয়ে আত্মগোপন করেছিলেন। কিন্তু কেউ জানত না, তাঁর লেখাগুলি কেন এত স্পর্শকাতর আর বাস্তব, যেন কারও ব্যক্তিগত জীবনের অন্তরতম কথা। ডায়েরি খুলতেই অরিত্রর মাথার মধ্যে যেন ঘণ্টাধ্বনি বাজল—লেখার প্রথম লাইন ছিল, “তোমার লেখা আমার জীবন বাঁচিয়েছিল।”
দিন ফুরিয়ে এলো, লাইট গ্যালারির হলঘরে ধীরে ধীরে আলো জ্বলল, লোকজন আসতে শুরু করল। অরিত্র ডায়েরি আর নোটগুলিকে পরপর সাজিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিলেন, কোথায় কোথায় তাঁর নিজের জীবনের ছায়া মিশে আছে এই রহস্যে। সন্ধ্যার আলোয়, তিনি বুঝতে পারলেন—এই কাহিনি কেবল একটি লেখিকার নয়, এটি তাঁর নিজেরও হতে পারে। কারণ ‘অমৃতা’র লেখা কোনো এক বর্ণনায় এমন একটি ঘটনার উল্লেখ ছিল, যা একমাত্র অরিত্র আর তাঁর মা জানতেন। তাহলে কি এই লেখিকা, এই ‘অদৃশ্য’ আত্মা, অনেকদিন ধরেই তাঁকে জানতেন? কিংবা তাঁর অতীতেরই কোনো ছায়া হয়ে ফিরে এসেছেন এই অমৃতা? লাইব্রেরির জানালার বাইরে সন্ধ্যার আলো ক্রমশ মিশে যাচ্ছিল অন্ধকারে। আর জানালার ওপারে কোনো এক পুরনো মুখ যেন অপেক্ষা করছিল—অরিত্রর মুখোমুখি হওয়ার জন্য।
৮
বৃষ্টি থেমেছে। শহরের চারপাশে জমে থাকা কাদা আর ঝিরঝিরে জলধারায় কলকাতা যেন এক পুরনো প্যালেটের ছবির মতো লাগছিল—স্মৃতিতে লেগে থাকা রঙ, যেগুলোর আসল রঙ আজ আর বোঝা যায় না। সুমিত্র বসু আজ লাইব্রেরিতে পৌঁছেছিল আরও তাড়াতাড়ি। বুকের ভিতরে একটা চাপা উথালপাথাল চলছে—কাল রাতে যে স্বপ্নটা দেখেছে, তার রেশ যেন এখনো কানে বাজছে। স্বপ্নে সে নিজেকে দেখেছিল এক পুরনো কুঠির ঘরের ভেতর, চারদিকে বইয়ের স্তূপ, আর একটা আয়নার ভিতরে থেমে থাকা একটা ছায়া তাকে কেবল তাকিয়ে দেখছে। সে ছায়াটা তারই মতো দেখতে, কিন্তু চোখদুটি যেন কারও আর। আজ লাইব্রেরির দরজায় ঢোকার মুখেই, চিরদিনের মতোই, পেছনের পুরনো কাঠের সিঁড়ির ধারে একটা নীল খামে মোড়া নোট পায় সে—“তুমি যতই খুঁজো, গল্পটা শেষ হবে না। কারণ গল্পটা এখনও শুরুই হয়নি।” কে এই অদৃশ্য লেখক? সময়ের গভীরে লুকিয়ে থাকা কোন কণ্ঠস্বর এত স্পষ্ট হয়ে ধরা দিচ্ছে তার কাছে?
আজকের তালিকায় ছিল ‘স্মৃতি ও সন্ধানের ছায়া’—একটি পুরনো মনোবিজ্ঞানের বই, যা কেবল অভ্যন্তরীণ গবেষণা রেফারেন্সে থাকে। বইটি লাইব্রেরির ‘D-6’ সেকশনের সব শেষে, ধূলিমাখা এক তাকে পড়ে ছিল। ধুলো সরিয়ে বইটা যখন খুলল, ঠিক মাঝখানে একটা পুরনো পাতার ভিতর থেকে মলিন হয়ে যাওয়া পেন্সিল লেখা কিছু উঠে এল—“মানুষ যে সময়কে টুকরো টুকরো করে দেখে, তা সত্যি নয়। সময় একটা আয়না, আর আয়নাতে যা পড়ে, তা তুমি নিজে। আত্মহত্যা কোনো শেষ নয়, বরং সেটা একটা উপন্যাসের প্যারাগ্রাফ বদলের মতো মাত্র।” সুমিত্রর শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। লেখার হাতের অক্ষর যেন কোথায় দেখেছে আগে। নিজের পুরনো কোনো খাতা? না কি সেই লেখক… যার পরিচয় এখনও অস্পষ্ট? মনে পড়ে গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই হারিয়ে যাওয়া ছাত্রটির কথা—সৌভিক কর। যার লেখালেখির প্রতিভা ছিল ব্যতিক্রম, কিন্তু একদিন হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল।
বইটা নিয়ে বসার পর একটা অদ্ভুত বিষয় ঘটে—বইয়ের প্রতিটি পাতায় লাল কালিতে ছোট ছোট মার্কিং, যেন কেউ তার পড়ার পথে পথনির্দেশ দিচ্ছে। সেই নির্দেশগুলো অনুসরণ করে সে দেখতে পায় বইয়ের ফ্ল্যাপে লুকানো আরও একটি চিরকুট—“তুমি কি জানো, এই লাইব্রেরির ভেতরেও একটা আয়না আছে, যেখানে সময় উল্টো পথে চলে?” উত্তরের কোনো শব্দ ছিল না, কেবল একটা নীরব উত্তেজনা, যা সুমিত্রর মনে প্রশ্নের পাহাড় তৈরি করে। লাইব্রেরির ভিতরে পুরনো নকশার ঘড়ি টিক টিক করে চলেছে, অথচ তার কাঁটা যেন এগোচ্ছে না। পেছনের রিডিং রুমে যাওয়ার সময় আচমকা সে খেয়াল করে—দেয়ালের উপর ঝোলানো সেই ঘড়িতে আজও আটকে আছে সেই সময়, যেদিন সৌভিক কর নিখোঁজ হয়েছিল। সময়, স্মৃতি, আয়না, মৃত্যু—সবকিছু যেন একসাথে জট পাকিয়ে যাচ্ছে। সুমিত্র বুঝতে পারছে, এই রহস্য কেবল একটি আত্মহননের নয়—এটা তার নিজের জীবনের এমন কোনো অধ্যায়ের, যা সে হয়তো ভুলে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু সেই অধ্যায়ই এখন ধূলোর নিচে জমে থাকা গল্প হয়ে ফিরে এসেছে, নতুন করে শুরু করার অপেক্ষায়।
৯
জাদুঘরের নির্জন কাচঘেরা ঘরে বসে, অর্ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনে হচ্ছিল যেন তার চারপাশে বইয়ের নয়, শব্দহীন অতীতের আত্মারা দাঁড়িয়ে আছে। রত্নাবলী সেনগুপ্তের নোটবইয়ের সেই শেষ পৃষ্ঠায় আঁকা কুঞ্জবনের ছায়ামূর্তি এবং নিচে লেখা ছয়টি নাম—তাদের প্রত্যেকের জীবনের কোনও না কোনও ভাবে সম্পর্ক ছিল ‘ছায়ার চাবি’ নামক অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপির সঙ্গে। অর্ক এখন জানে, এই পাণ্ডুলিপির রচয়িতা ছিল না কেবল রত্নাবলী, বরং সেই ছয়জনের সম্মিলিত ভেতরের অন্ধকার, ভয় ও প্রলোভনের অভিব্যক্তি ছিল এটি। তার ভিতরে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সত্যটি ছিল—এই চাবি দিয়ে খোলা যায় শুধুমাত্র স্মৃতির দরজা, যেখানে মানুষ নিজেকে যেমন দেখতে চায় না, সেই রূপে ধরা পড়ে। রত্নাবলীর বন্ধুরা—দীপাংশু, মণিমালা, কৌশিক, বিভাস, নীলা ও প্রভাস—যারা এক সময় রত্নাবলীর সঙ্গে সাহিত্যচর্চার ভেতর নিজেদের ‘সাহিত্যিক বিপ্লব’ মনে করত, তারা প্রত্যেকেই কোনও না কোনও ভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। রত্নাবলীর আত্মহত্যা ছিল সেই বিশ্বাসঘাতকতার চরম পরিণতি, যার দায় নিতে চায়নি কেউ। তারা সবাই তাকে ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু চাবি তো তেমন জিনিস নয় যা একবার হারালে হারিয়েই যায়। কোনও না কোনও বইয়ের ভাঁজে, পত্রিকায়, ফুটনোটে, কারও মনে—সেই চাবি বেঁচে থাকে, এবং অপেক্ষা করে, যেন সত্য আবার আলোয় ফিরে আসে।
কলেজ স্ট্রিটের এক পুরনো কফিহাউসে বসে বিভাস চক্রবর্তী চুপ করে চায়ের কাপে চামচ ঘুরিয়ে চলেছিল। তার সামনেই অর্ক বসে আছে, টেবিলের উপর রাখা রত্নাবলীর শেষ চিঠি, এবং সেই পাণ্ডুলিপির এক কপি। অর্ক বলল, “আপনারা কেউ কি ভাবেননি, এই পাণ্ডুলিপিটা একদিন কাউকে খুঁজে পাবে?” বিভাস হেসে বলল, “আমরা ভেবেছিলাম, কেউ খুঁজে পেলেও কিছু বুঝবে না। কিন্তু তুমি তো কেবল অধ্যাপক নও, তুমি তো নিজের ভেতরেও একটা চাবি নিয়ে ঘুরো।” অর্কের মুখ কাঁপল, কিন্তু সে কোনও কথা বলল না। বিভাস আবার বলল, “রত্নাবলী লিখেছিল, ‘যে চাবি হারায়, সে কেবল খোঁজে না—সে নিজেকেও হারায়।’ তুমি কি নিজেকে খুঁজে পেয়েছো, অর্ক?” সেই প্রশ্নে অর্কের মন ফিরে গেল নিজের ছাত্রাবস্থায়—তার প্রথম প্রেম, যার নাম ছিল নীলা, যার লেখা কবিতা পড়েই সে প্রথম সাহিত্যকে ভালোবেসেছিল, আর যাকে হারিয়ে সে ভুলে গিয়েছিল নিজের লেখক-সত্তাকে। এখন অর্ক বুঝতে পারছে, রত্নাবলীর এই পাণ্ডুলিপি কেবল একটি আত্মহত্যার উপাখ্যান নয়, বরং সেই প্রেম, সেই বিশ্বাসঘাতকতা এবং আত্ম-অনুসন্ধানের দার্শনিক নথি, যা পাঠককে নিজের গোপন দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়।
কফিহাউস থেকে বেরিয়ে অর্ক হাঁটছিল কলেজ স্ট্রিটের ভিড়ে, হাতে সেই পাণ্ডুলিপি। মাথার উপর রোদ পড়ে আসছে, বাতাসে পুরনো কাগজের গন্ধ। হঠাৎ তার মনে হল, এই রাস্তাগুলো, এই দোকান, এই প্রাচীন রেফারেন্স লাইব্রেরির ধুলো জমা আলমারিগুলো—সব যেন মিলে একটা বড় বই হয়ে উঠেছে, যার প্রতিটি পাতায় আছে চাবির খোঁজ। আর সে নিজে? সে তো সেই পাঠক, যে ভুল করে একদিন একটা দরজা খুলে ফেলেছিল, যেটা সে খুলতে চায়নি। সেই দরজা থেকে বেরিয়ে এসেছিল তার নিজের স্মৃতির রাক্ষস। এখন, তার কাজ, শুধু লেখকের খোঁজ নয়, নিজেরও। কারণ প্রতিটি লেখকের মধ্যে একটু করে বাস করে পাঠক, আর প্রতিটি পাঠকের মধ্যে একটি অদৃশ্য লেখক। সেই লেখকই কি তবে রত্নাবলীর ছায়া? নাকি তার নিজেরই ছায়া? প্রশ্নগুলো ঘুরতে থাকে তার মাথায়। উত্তর নেই। শুধু রয়ে যায় এক টুকরো চাবি, আর এক পাণ্ডুলিপি, যার শেষ পাতায় লেখা—“এই গল্পে কেউই কেবল পাঠক নয়। সবাই কোনও না কোনও ভাবে লেখক। আর প্রত্যেক লেখকের ছায়া একদিন নিজের গল্পই লিখে ফেলে।”
১০
বৃষ্টিভেজা কলকাতার বিকেলটায় রেফারেন্স লাইব্রেরির জানালাগুলো যেন দুনিয়ার একমাত্র প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছিল, যেখানে শহরের কোলাহল থেমে ছিল শব্দহীন কোনও সংকেতে। অভীক আজ অনেকটা আগেভাগেই এসে বসেছিল ‘কলোনিয়াল নন-ফিকশন’ অংশের ভেতরের কাঠের টেবিলটায়, যেখান থেকে ‘অন্তর্জাল’-এর লেখা হাতে পাওয়া শেষ চিঠিটা উদ্ধার করা গিয়েছিল। তার চোখের নিচে ঘুমহীনতার কালি, কিন্তু চোখে একরকম অস্থির স্পষ্টতা। তার হাতের মধ্যে ছিল সেই ‘অদৃশ্য লেখক’-এর শেষ চিঠির অনুলিপি—যেটা সে আগের দিন রাতে একটা পুরনো বইয়ের ভিতর খুঁজে পেয়েছিল। সেই চিঠিতে লেখা ছিল—“যদি তুমি সত্যিই বুঝতে চাও, আয়নার পেছনে তাকাও।” এই একটিমাত্র লাইন যেন অভীককে ঘুমাতে দেয়নি, মনে হচ্ছিল কেউ তাকে চোখের সামনে ইশারা দিয়ে কিছু বলতে চাইছে, আর সেই ইশারার সূত্রটা হারিয়ে যাচ্ছে পেছনের কোনও আয়নার দিকে। সে জানত, এবার তাকে খুঁজতে হবে বইয়ের বাইরের ‘আয়না’, খুঁজতে হবে নিজেকে।
লাইব্রেরির দক্ষিণ-পূর্ব কোণার দেয়ালে লাগানো একটি দীর্ঘ আয়না—যেটা এতদিন কেবল সাজসজ্জার অংশ বলে ভেবেছিল—সেইটা আজ অভীককে অন্য চোখে দেখতে হলো। আয়নাটার দিকে তাকিয়ে সে একটা অদ্ভুত অস্বস্তি টের পেল। আয়নার প্রতিবিম্বে টেবিল, আলমারি সবকিছু ঠিকঠাক ছিল, শুধু সে নিজে যেন কিছুটা ঝাপসা, যেন অর্ধেক দেখা যাচ্ছে, অর্ধেক লুকানো। আচমকা মনে পড়ল, এই আয়নাটার পাশেই আগে একটা কাঠের তাক ছিল, যেটা একদিন সে সরাতে বলেছিল পুরনো নাড়িভুঁড়ির জায়গায় বই সাজানোর জন্য। লাইব্রেরিয়ান বলেছিল, “ওটা সরালে বেমানান লাগবে।” এখন বুঝল, হয়তো ওই তাকের ভেতরেই কিছু ছিল, যেটা ‘অদৃশ্য লেখক’ রেখে গিয়েছিল। সে আয়নাটা ধীরে ধীরে টেনে সরাতেই খুলে পড়ল একটা কাঠের খাঁজ, আর তার ভেতরে ছোট্ট একটি মেটাল বক্স, যার গায়ে লেখা ছিল—“R.K.B. 1949।” অভীক জানে এই নামটা, তার ঠাকুরদা রবীন্দ্র কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামের আদ্যক্ষর, যার লেখাগুলি কখনো প্রকাশিত হয়নি, কিন্তু একসময় একটি গোত্রবদ্ধ বুদ্ধিজীবী মহলের অংশ ছিলেন তিনি। সে ধীরে ধীরে বক্সটা খুলে দেখতে পেল একমুঠো চিঠি, কিছু হাতে লেখা খসড়া কবিতা, আর একটা ছবি—এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে এই একই আয়নার সামনে, চোখে ঘোর লাগা চাহনি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মানুষটা তার ঠাকুরদা ছিল। অভীক এবার নিশ্চিত, গল্পটা শুধু কোনও লেখকের নয়, এ আসলে তার নিজের রক্তের ইতিহাস, আত্মজৈবনিক প্রশ্নের উত্তর খোঁজার এক অদ্ভুত যাত্রা। সে জানে, আয়নার পেছনেই লুকানো ছিল সত্য, যেটা কখনো বইয়ের পাতায় আসেনি, কেবল উত্তরসূরির চোখের আলোয় জেগে ওঠে।
সমাপ্ত