মোহনা বসু
উত্তর কলকাতার পুরনো এক গলিতে দাঁড়িয়ে থাকা তিনতলা বাড়িটার নাম ‘শ্রীনিবাস’। বয়স প্রায় একশো বছরের কাছাকাছি। দরজার কাঠে হাত রেখে চোখ বন্ধ করলে এখনও মনে হয় যেন কেউ আঙিনায় রাঁধুনি দিদার হাঁকডাক দিচ্ছে, ভিতরে কেউ রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছে, আর পেছনের জানালা দিয়ে ভেসে আসছে ফুলকোচুর গন্ধ। এই বাড়িরই বড় কন্যা রোহিনী সেন, বয়স একুশ, প্রেসিডেন্সি কলেজের দর্শনের ছাত্রী। জন্ম থেকে বড় হওয়া এই বনেদি পরিবারে, যেখানে মেয়েরা কথা কম বলে, হাঁটে মেপে মেপে, হাসে মাথা নিচু করে। রোহিনীর বাবা অশোক সেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, মুখে মেপে কথা বলা, চোখে ঠাণ্ডা নিয়ন্ত্রণের রোশনাই। মা বাণী সেন, সমাজে পরিচিত এক ‘আদর্শ স্ত্রী ও মা’ হিসেবে। আর ঠাকুমা বীণাপাণি সেন, যিনি এখনো বিশ্বাস করেন যে নারীর কাজ রান্নাঘর আর ঠাকুরঘরের মাঝামাঝি সীমাবদ্ধ থাকা। কিন্তু রোহিনী সেই শিখনগুলো মানে না, অন্তত তার ভিতরের মেয়েটা মানে না। বাইরের রোহিনী চুপচাপ, নম্র, আদবকায়দা মেনে চলা মেয়ে, কিন্তু তার ভিতরের রোহিনী প্রশ্ন করে, কাঁদে, বিদ্রোহ করে, আর কখনও কখনও আয়নার দিকে তাকিয়ে বলে— “আমি কে? আমি কি কেবল কারো মেয়ে, নাকি আরও কিছু?”
বাড়ির পরিবেশে প্রত্যেকটি মানুষ যেন একেকটা ভূমিকা পালন করে। দাদু না থাকলেও তাঁর ছায়া এখনো রয়ে গেছে পারিবারিক রেওয়াজে— ‘মেয়ে মানেই ঘরের শোভা, বাইরের নয়।’ প্রতি রবিবার দুপুরে পরিবারের সব সদস্য বসে একসঙ্গে খায়— যদিও খাবার পরিবেশনে থাকে শুধু মেয়েরাই। এমনকি ছুটির দিনেও রোহিনীকে ঠাকুমার পায়ের কাছে বসে থাকতে হয়, তার কলেজের গল্প না বলে, বরং রান্না শেখার কথা শুনে যেতে হয়। মা বলেন, “বাড়ির নিয়ম মানতে হয়, সবাইকে। মেয়েদের বেশি না ভাবাই ভালো।” এই ‘ভালো’ শব্দটা রোহিনীকে ভিতর থেকে তাড়িয়ে বেড়ায়, কারণ তার চোখে যা ভালো, তার মায়ের চোখে তা বেয়াদবি। একবার সে সাহস করে প্রশ্ন করেছিল, “মা, তুমি নিজের জন্য কবে কী চেয়েছিলে?” মা একটু থেমে বলেছিলেন, “তোমরা বুঝবে না। আমাদের সময়ে প্রশ্ন করার সুযোগ ছিল না।” এই ‘সুযোগ না থাকা’র গল্প শুনে রোহিনী একরকম অভিমানে ডায়েরির পাতায় লেখে, “আমার মা হয়তো আমার চেয়ে বেশি বন্দি। আমি শুধু শিকল দেখছি, উনি তো ওই শিকলেই নিজেকে সাজিয়ে নিয়েছেন।” প্রতিদিন কলেজ যাওয়ার পথে গলির মোড়ে এক কাঠের দোকানের ফাঁকে দাঁড়িয়ে থাকা নীলপদ্ম ফুলটাকে রোহিনী দেখে। কোনো দিন পাঁপড়ি ঝরছে, কোনো দিন ঝলমল করছে— ঠিক তার নিজের মনের মতো। তাই সে ঠিক করেছে, নিজের লেখা ডায়েরির নাম দেবে— “নীলপদ্মর ডায়েরি”।
কলেজ ছিল তার মুক্তির জায়গা। দর্শনের ক্লাসে সিমোন দ্য বোভোয়া আর কামুর কথা শুনে তার বুকের ভেতর ঝড় ওঠে। সেসব ভাবনা সে বলতে পারে না ঘরে ফেরার পর— কারণ বাড়িতে মেয়েদের ভাবার অধিকার নেই। ক্লাসে সহপাঠীদের সঙ্গে সে কথা বলে, বিতর্ক করে, হাসে, আর একটু একটু করে নিজের ভিতরের বন্ধ জানালাগুলো খুলে দেয়। একদিন লাইব্রেরিতে বসে ‘The Second Sex’ পড়তে গিয়ে একটি পাতার মধ্যে রাখা একটা ছোট্ট চিরকুট পায়— “একদিন আমিও উড়তে চাইছিলাম, কিন্তু ডানা ভেঙে দিয়েছিল বাবারাই।” চমকে ওঠে সে। কে লিখেছে এটা? কে সেই মেয়ে, যাকে উড়তে দেওয়া হয়নি? সেই দিন রাতেই সে তার ডায়েরিতে প্রথম লেখে— “আমি এখনো উড়িনি, কিন্তু জানি আমারও ডানা আছে।” সেই রাতটা ছিল বৃষ্টিভেজা, খোলা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সে বুঝেছিল— শুধু বইয়ের পৃষ্ঠা না, তার নিজের জীবনও লেখার মতোই একটা ক্যানভাস। সে প্রথমবার অনুভব করেছিল— তার মধ্যেই আছে একটা অন্য রোহিনী, যে কোনো একদিন এই ‘শ্রীনিবাস’ বাড়ির গণ্ডি পেরিয়ে অন্য কোথাও নিজের মতো বাঁচবে, হাঁটবে, উড়বে, ভালোবাসবে নিজের স্বরকে। আর সেই স্বরেরই নাম— নীলপদ্ম।
–
জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ। কলেজ লাইব্রেরির জানালার বাইরে তুমুল বৃষ্টি, কাঁচের গায়ে বিন্দু বিন্দু জল জমে এক চিত্রকরের মতো খেলছে আলোছায়া। ভিতরে বসে রোহিনী গম্ভীর মুখে পড়ছিল এক পুরনো সংস্করণের বই— সিমোন দ্য বোভোয়ার-এর The Second Sex। পৃষ্ঠা উল্টাতে গিয়েই নজরে আসে পাতার ফাঁকে আটকে থাকা একটা হলুদ হয়ে যাওয়া চিরকুট, যেটা কে যেন সেখানে রেখে গেছে অনেক আগে। কাগজে হাতে লেখা কালি— “একদিন আমিও উড়তে চাইছিলাম, কিন্তু ডানা ভেঙে দিয়েছিল বাবারাই।” রোহিনী কেঁপে ওঠে। কে এই লেখিকা? কেন সে লিখেছিল এই কথা? কী হয়েছিল তার সঙ্গে? কয়েক মুহূর্তের জন্য ঘরের সব শব্দ থেমে যায় রোহিনীর কানে। নিজের বুকের মধ্যে যেন একখানা বাজ পড়েছে— এ তো তার নিজের কথাও হতে পারত! ডায়েরি লেখার কথা তার মাথায় বহুবার এসেছিল, কিন্তু আজ যেন এই চিরকুটটাই তার ভিতরের নীলপদ্মকে জাগিয়ে দিল। বিকেলে বাড়ি ফিরে সে তার রোজকার ব্যাগ খুলে, পুরনো একটা কাঁথার মোড়কে পেঁচানো নীল মলাটের খাতা বের করল। তার ঠাম্মার দেওয়া একটা ফাঁকা খাতা— এখন তার নাম পাবে “নীলপদ্মর ডায়েরি”। সে প্রথম পৃষ্ঠায় লিখল— “এই ডায়েরি শুধুই আমার নয়। যারা কোনোদিন প্রশ্ন করতে পারেনি, যারা চুপ থেকেছে, যারা চুপ করানো হয়েছে— তাদের সকলের জন্য। নীলপদ্ম শুধু ফুল নয়, সে ডানা মেলতে চাওয়া এক চিন্তা, এক স্বপ্ন।”
রোজ রাতে বাড়ির সকলে ঘুমিয়ে পড়লে, চুপিচুপি টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে রোহিনী লিখে চলে ডায়েরির পাতায়। প্রথম প্রথম সে নিজের মনোভাব নিয়ে লেখে— কীভাবে সে বুঝে গিয়েছিল যে তার পরিবারে ‘নারী’ মানেই নীরবতা, পোশাকে পরিমিতি, আচরণে অনুগততা। কীভাবে সে ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছে, “মেয়ে হয়ে বেশি জিজ্ঞেস করিস না”, “বেশি জানলে সমস্যা বাড়ে”, “চুপ থাকাই নারীর সৌন্দর্য।” কিন্তু তার ভিতরের আগুনকে কখনোই সেভাবে দমিয়ে রাখা যায়নি। সে ডায়েরিতে লেখে: “আজ স্কুল থেকে ফিরেই কাকিমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম— আপনি গান শিখতেন না? উনি হেসে বললেন, ‘তা হ্যাঁ, খুব গাইতাম একসময়, এখন তো সময় হয় না।’ কিন্তু আমি জানি, এটা সময়ের অভাব নয়, ইচ্ছেটাই মরে গেছে সমাজের নিয়মে।” সেই দিনগুলোতে রোহিনী একদম অন্য এক মানুষ হয়ে ওঠে— সে শুধু কলেজে পড়া ছাত্রী নয়, সে এক লেখক, এক প্রত্যক্ষদর্শী, এক প্রশ্নকর্তা। প্রতিটি পাতায় সে ছোট ছোট বাক্যে রচনা করে তার নিজস্ব মহাকাব্য— যেখানে বন্দি জীবনকে সে মুক্তির ছাঁচে ঢালতে চায়। মাঝে মাঝে লেখে কবিতার মতো— “নীল শাড়ির ভাঁজে লুকিয়ে ছিল বৃষ্টির স্বপ্ন / সে স্বপ্ন রোজ শুকিয়ে নেয় কারো আদেশে।”
ডায়েরি লেখার অভ্যেস ধীরে ধীরে তার বেঁচে থাকার অবলম্বন হয়ে ওঠে। আর সেই ডায়েরির সাথে সাথে তার ভিতরের আত্মবিশ্বাসও বাড়ে। কলেজে সে সেমিনারে অংশ নেয়, সহপাঠীদের সামনে দাঁড়িয়ে আলোচনা করে “নারী ও আত্মপরিচয়” নিয়ে, আর বুঝতে পারে— সে একা নয়। আরও অনেকে আছে যারা এই সমাজের দমবন্ধ নিয়মে বড় হয়েছে, কেউ কেউ সেই নিয়ম ভেঙেছে, কেউ আবার এখনো ভয় পায়। কিন্তু রোহিনীর ভয় কাটে। একদিন, কলেজের এক বিতর্ক সভায় সে বলে ওঠে— “পিতৃতন্ত্র আসলে এক নিঃশব্দ শিকল। যাকে আমরা অলঙ্কার ভেবে গলায় পরেছি, অথচ সে আমাদের হাঁটতে শেখায় না— টেনে রাখে এক জায়গায়।” এই কথা বলার পর, কলেজের শিক্ষিকা মালবিকা সেন তাকে ডেকে বলেন, “তোমার ডায়েরির কথা শুনেছি তোমার বন্ধু রিমির কাছ থেকে। একদিন পড়ে দেখতে চাই।” রোহিনী প্রথমে দ্বিধায় পড়ে, কিন্তু আবার মনে পড়ে চিরকুটের লেখাটি। সেই অচেনা মেয়েটি যদি একদিন তার কথা বলতে পারত, আজ সে রোহিনীর কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতে পারত। তাই সে ডায়েরির কয়েকটি অংশ কপি করে শিক্ষিকাকে দেয়। মালবিকা বলেছিলেন, “তুমি শুধু লিখছো না, তুমি ইতিহাসের বিপরীতে হাঁটছো। এগিয়ে যাও, রোহিনী।” সেই রাতে, জানালার পাশে বসে, ডায়েরির পাতায় সে লেখে— “নীলপদ্ম কখনো কাঁটায় কাঁটায় বাঁধা থাকে না। সে যেখানে পায় জল আর আলো— সেখানেই গড়ে তোলে নিজস্ব জগত।”
–
শ্রাবণের একদম শেষ বিকেল, জানালার ধারে বসে রোহিনী দেখে তার ঠাকুমা কীভাবে দাসী সরস্বতীকে নির্দেশ দিচ্ছেন— “এই বাসন আলাদা করে রাখিস, সন্ধ্যারত্নের বিয়েতে যাবো। ও বাড়ির সামনে আমাদের মান রাখতে হয়।” ‘মান রাখা’— শব্দটা যেন একটা অদৃশ্য আতঙ্ক হয়ে ঘুরে বেড়ায় এই শ্রীনিবাস বাড়ির চারপাশে। রোহিনী উপলব্ধি করে, তার বাড়ির প্রতিটি মানুষ একটা করে মুখোশ পরে বাঁচে। মুখোশের নিচে হয়তো ক্লান্তি, বিরক্তি বা দীর্ঘশ্বাস— কিন্তু বাইরের মানুষ দেখে ‘বনেদি ঐতিহ্য’। তার কাকিমা শমিতা সেন, যিনি মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েও এখন রান্নাঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে শ্বশুরের মধুমেহের ডায়েট মেনে রান্না করেন। একদিন কাকিমাকে প্রশ্ন করেছিল, “আপনি আবার লেখালেখি শুরু করবেন না?” শমিতা হেসে বলেছিলেন, “এই বাড়িতে? তুমি আমার ঠাকুরমার মুখ চাওনি বোধহয়।” অথচ রোহিনী জানে, তার কাকিমা একসময় কলেজ ম্যাগাজিনে নিয়মিত গল্প লিখতেন। বিয়ে হয়ে এই বাড়িতে আসার পর ধীরে ধীরে সেই খাতা বন্ধ হয়ে গেছে। সন্ধ্যায় ঠাকুমার পায়ের কাছে বসে রোহিনী বুঝতে পারে, এখানে সবাই ‘ভদ্রতা’ আর ‘রেওয়াজ’-এর দোহাই দিয়ে মেয়েদের আত্মাকে নিঃশব্দে হত্যা করে। ঠাকুমা বলে ওঠেন, “আমার সময় তো মুখে কালী মেখে থাকতে হতো, মেয়েরা কথায় বেশি এগিয়ে গেলে গৃহিণীর মর্যাদা কমে যায়।” এসব শুনে মাঝে মাঝে রোহিনী চুপ করে থাকলেও, ভিতরে ভেতরে ডায়েরিতে জ্বলতে থাকে প্রশ্ন— “ভদ্রতা কি কেবল মেয়েদের একতরফা দায়? আর ভদ্রতার মুখোশের আড়ালে যদি অভিমানের জমে থাকা হয়— তবে সে জীবন কি সত্যি সম্মানের?”
সেই সময় থেকেই রোহিনীর চোখে ধরা পড়ে, এই বনেদিয়ানার মধ্যে কী ভয়ংকর অসমতা কাজ করে। যেমন, বাড়ির প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত নেয় পুরুষেরা। কে কবে কোথায় যাবে, কাকে বাড়িতে ডাকতে হবে, মেয়েরা কোথায় পড়বে বা পড়বে না— সবই পরিবারের কর্তা অর্থাৎ অশোক সেন-এর মতামতের উপর নির্ভর করে। এমনকি একদিন রোহিনী শুনে ফেলে, তার বিয়ের কথাও চলছে চুপি চুপি। এক বনেদি ঘরের ছেলে, ভালো চাকরি, মার্কিন ডিগ্রি— সব কিছু ঠিকঠাক। শুধু রোহিনীর মতামতটাই কেউ জানতে চায়নি। বাড়ির লোকজন ধরে নিয়েছে, রোহিনী যেহেতু ‘ভালো মেয়ে’, তাই সে কোনো প্রশ্ন করবে না, মুখ বুজে মেনে নেবে। কিন্তু তাদের অজান্তেই রোহিনী তার ডায়েরিতে লেখে— “আমি কিছুই ঠিক করিনি এখনও। আমার জীবন আমি বেছে নেব। যে সমাজ কেবল জন্মসূত্রে সিদ্ধান্ত দেয়, আমি সেই সমাজকে অস্বীকার করি।” তার মধ্যে তখন এক দ্বন্দ্ব— একদিকে পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতা, আরেকদিকে নিজের স্বপ্নের প্রতি আনুগত্য। দুপুরবেলা যখন ঠান্ডা বাতাসে পত্রিকার পাতাগুলো উলটে যায়, তখনই রোহিনীর মনে হয়, সেই উলটে যাওয়া পাতাগুলোর মতোই একদিন তার জীবনও পালটে যাবে। যদি সে সাহস রাখে।
একদিন কলেজ থেকে ফিরে দরজার সামনে দাঁড়াতেই দেখে, বাবা বসে আছেন আঙিনার কেদারায়, মুখে গম্ভীরতা। দরজা খুলেই বলেন, “আজই বললাম তোমার প্রিন্সিপ্যালকে, তুমি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারো, কিন্তু অত মিটিং-মিছিল নয়।” রোহিনী হতবাক হয়ে যায়— বাবা কলেজে গিয়েছিলেন! সে কিছু বলতে গেলে বাবা বলে ওঠেন, “মেয়েদের বেশি পড়াশোনা করানো মানেই দিগভ্রান্ত হওয়া। এই বয়সে মেয়েরা নরম হতে হয়। তুমি এখনো বোঝ না, তুমি সেন বাড়ির মেয়ে— দায়িত্ব আছে তোমারও।” সেই রাতে রোহিনী তার ডায়েরি খুলে বসে, আর লেখা শুরু করে— “এই মুখোশ আমি আর পরতে পারবো না। আমার কণ্ঠস্বর থাকলেও, আমি যদি নীরব থাকি, তাহলে সেই নীরবতাই একদিন আরও অনেক রোহিনীর আত্মাকে মেরে ফেলবে। আমি এই মুখোশ খুলে ফেলবো— একদিন, একেবারে সবার সামনে।” নীলপদ্মের পাতাগুলোতে তখন ভেসে বেড়ায় তার স্বপ্ন, তার ব্যথা, তার যুদ্ধ। আর সেই ডায়েরির প্রতিটি পৃষ্ঠা তার ভিতরের মেয়েটাকে ক্রমশ শক্তিশালী করে তোলে। ‘শ্রীনিবাস’ তখন শুধু তার বাড়ি নয়, হয়ে ওঠে এক অন্ধকার গুহা— যার ভিতর থেকেও সে নীল আলোয় নিজেকে গড়ে তোলে। যেদিন সে মুখোশ ছিঁড়বে— সেদিন তার জন্ম হবে নতুনভাবে।
–
ভাদ্র মাসের এক গরম দুপুরে রোহিনী তার মায়ের হাত ধরে দক্ষিণেশ্বর মন্দির থেকে ফিরছিল। রোদের তাপে পথ ধুধু করছিল, আর ট্রামলাইনের গায়ে জমে থাকা ঘাম-ভেজা ধুলোয় যেন কেমন একটা ক্লান্তির ছাপ পড়েছিল চারপাশে। কিন্তু রোহিনীর ক্লান্তি ছিল অন্য জায়গায়। গতকাল রাতেই সে overheard করেছে— তার বাবা, কাকা এবং ঠাকুমা বসে আলোচনা করছেন এক সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী পরিবারের পাত্রর সঙ্গে রোহিনীর বিয়ের ব্যাপারে। “ছেলেটার চাকরি চমৎকার, দমদমে ফ্ল্যাট, গাড়ি আছে, আর সবথেকে বড় কথা, একেবারে আমাদের মতো সংস্কৃতির ছেলে,” ঠাকুমা গলায় গর্ব নিয়ে বলেছিলেন। রোহিনী জানত না কেন, কিন্তু এইসব কথায় তার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল। সে ভাবছিল, তার জীবন নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কেউ তাকে একবার জিজ্ঞাসাও করল না। কলেজ থেকে ফেরার পথে রিমি তাকে জানিয়েছিল, আগামী সপ্তাহে একটি গুরুত্বপূর্ণ সেমিনার হচ্ছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে— বিষয়: নারীর আত্মপরিচয় এবং সমাজের প্রতিক্রিয়া। রিমি বলেছিল, “তুই ওখানে বলবি, প্লিজ। তোকে ছাড়া ওই আলোচনা অসম্পূর্ণ।” কিন্তু সেই দিনই পরিবার থেকে বলা হয়, “শুক্রবার তোর পাত্রপক্ষ আসবে চা খেতে।” রোহিনীর ভেতরে যেন একটা আগুন জ্বলে উঠল— কোনো কথাই না বলে সে শোবার ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দেয়, জানলার পাশের চেয়ার টেনে নেয়, আর খুলে বসে তার প্রিয় “নীলপদ্মর ডায়েরি”। সে লেখে, “এই প্রথমবার আমার জীবন নিয়ে তারা আমার অনুমতি ছাড়াই এমন এক পথে এগোচ্ছে, যেটা আমি চাই না। যদি এই মুহূর্তে আমি চুপ থাকি, তবে আমিই আমার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলব।”
পরদিন, অনেক ভেবেচিন্তে সে সিদ্ধান্ত নেয়— সে ওই সেমিনারে যাবে, যেভাবেই হোক। মাকে সরাসরি না জানিয়ে সে বলে, “কলেজে একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস আছে, রিমির সঙ্গে যাব।” মা কিছু বলেন না, কিন্তু বুঝতে পারেন, মেয়ের চোখে কিছু একটার রং বদলে গেছে। দুপুরে সে ট্রামে করে চলে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশাল হলঘরে বহু ছাত্রী-ছাত্র, গবেষক, বক্তা এসে জড়ো হয়েছেন। রোহিনী মঞ্চে ওঠে, গলা শুকনো, হাতের তালু ঘেমে ভিজে, তবু কণ্ঠে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা। সে বলে— “আমাদের সমাজ মেয়েদের বড় হতে শেখায় না, তাকে শেখায় কেবল ‘ঠাকুর ঘরের প্রদীপ’ হয়ে থাকতে। কিন্তু প্রদীপ কখনো আলো দিতে পারে না যদি তার সলতে বারবার কেটে ফেলা হয়। আজ আমরা মেয়েরা কেবল আলো চাই না, আমরা নিজের আগুন নিজেরা জ্বালাতে চাই।” সেই কথাগুলি শ্রোতাদের বুক ছুঁয়ে যায়। কেউ হাততালি দেয়, কেউ উঠে দাঁড়িয়ে সম্মতি জানায়। কিন্তু যখন সে বাড়ি ফেরে, তখন তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন পরিণতি অপেক্ষা করে তার জন্য। অশোক সেন রাগে কাঁপছেন, ঠাকুমার মুখ লাল, মা মাথা নিচু করে বসে আছেন। বাবা একটানা বলে যান— “আমরা তোমার ভালো চাই, আর তুমি বাড়ির মান খারাপ করে বাইরে গিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছো? পাত্রপক্ষ ফিরিয়ে দিল— তোমার কথা শুনে তারা বলেছে, ‘এমন মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক নয়’।” হঠাৎই অশোক সেনের হাত উঠে আসে— এবং রোহিনীর গালে পড়ে এক নিঃশব্দ থাপ্পড়।
ঘরের চারদিকে তখন নিস্তব্ধতা। কেবল কাঁপতে থাকা নীলপদ্মর খোলা পাতাগুলো ধীরে ধীরে উড়ছিল বাতাসে। রোহিনী মুখ নামিয়ে নেয়, কোনো কথা বলে না। কিন্তু তার চোখের ভিতর সেই আগুন আরও জ্বলে ওঠে। সে ডায়েরির নতুন পৃষ্ঠায় লেখে— “আজ আমার মুখে ব্যথা, কিন্তু গলায় নেই একটুও ভয়ের। আমি এই পরিবারের মেয়ে, কিন্তু সেই পরিবারের নয় যারা আমাকে থামাতে চায়। আমি আজই জানলাম, আমার অগ্নিপরীক্ষা শুরু হলো। হয় আমি নিজেকে পুড়িয়ে মারব, নয়তো এই আগুনেই গড়ে তুলব নতুন এক রোহিনী।” এরপর সে কয়েকদিন কারো সঙ্গে কথা বলে না, কিন্তু তার আচার-আচরণ, হাঁটাচলা, চোখের দৃষ্টি— সবকিছুর মধ্যে এক ধরনের নির্ভীকতা ফুটে ওঠে। সে ধীরে ধীরে সিদ্ধান্ত নেয়— এই গৃহবন্ধনের বাইরে গিয়ে যদি সে নিজেকে খুঁজে না পায়, তবে বাকি জীবন শুধু এক কাঠের পুতুল হয়েই কাটবে। আর সে চায় না, তার ভবিষ্যতের কোনও রিমি, কোনও শমিতা কাকিমা, কোনও মেয়ে— তাদের ডানা ভাঙা অবস্থায় বেড়ে উঠুক। নীলপদ্ম এখন শুধু ডায়েরির নাম নয়— তার রক্তে বয়ে চলা এক জীবন দর্শন। এবং এই দর্শন তাকে নিয়ে যাবে এমন এক যাত্রায়, যার পথে যতই কাঁটা থাকুক, সে আর পিছু ফিরবে না।
–
নিমগ্ন দুপুর, কলকাতার আকাশে ঘন বাদলের মেঘ। প্রাচীন সেন বাড়ির বারান্দায় বসে রোহিনী তার ডায়েরির পাতাগুলো ওলটাচ্ছিল। বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ যেন ডায়েরির প্রতিটি লাইনের সঙ্গে মিশে গিয়ে আরও গভীর করে তুলছিল তার আত্মানুসন্ধান। “আমি কে?”—প্রশ্নটা অনেক দিন ধরে তার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে, কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার পথটা যে এতটা কণ্টকাকীর্ণ হবে, তা হয়তো সে ভাবেনি। আজ পাঁচ মাস হয়ে গেল বাড়ির সঙ্গে তার লড়াই শুরু হয়েছে—তার নিজের পছন্দ, নিজের জীবনযাপন, এমনকি নিজের কাপড় পরার অধিকার নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে সমাজ ও পরিবার। বনেদি পরিবারের একমাত্র কন্যা হয়ে স্বাধীনচেতা হওয়াটা যেন অপরাধ। পিসিমা আজও বলেছিলেন, “মেয়েদের অমন স্বাধীন মতামত রাখা মানায় না রে, রোহিনী। সব কিছু নিয়মে চলা শিখে নে।” কিন্তু রোহিনী জানে, সে নিয়মভাঙার জন্যই জন্মেছে।
কলেজে সাহিত্য বিভাগের ক্লাসে আজ রবীন্দ্রনাথের ‘নারীর অধিকারে’ নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। প্রফেসর চক্রবর্তী বললেন, “নারীর ভূমিকা পরিবারে নয়, কেবলমাত্র ব্যক্তি হিসেবে সমাজে। নিজের পরিচয়ের খোঁজে সে পথচলা শুরু করে।” রোহিনীর মনে হল এই লাইনটা যেন তার জন্যই লেখা। ক্লাস শেষে ক্যাম্পাসের বইমেলার স্টলে ঢুকে সে কিনল একটি বই—সীমান্ত মিত্রের ‘নারীর অস্তিত্বচর্চা’। কলেজ থেকে বেরিয়ে আসতে আসতেই আবার ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে। মেট্রো স্টেশনের নিচে দাঁড়িয়ে সে ডায়েরি খুলে লিখল, “আজ আমি নিজেকে আর কোনো ছাঁচে ফেলতে চাই না। আমি আমার মতো। মেঘের নিচে, বৃষ্টির ছায়ায়, আমি নিজেকে খুঁজে নিচ্ছি। সমাজের দেওয়াল আমাকে বাঁধতে পারবে না।” হঠাৎই, মেট্রোর নিচু ছাদের পাশে এক ভেজা কুকুর এসে বসে। রোহিনী তার নিজের গায়ে থাকা ওড়নাটা নামিয়ে তার গায়ে জড়িয়ে দেয়। ঐ মুহূর্তটা যেন প্রতীকময় হয়ে উঠল—স্নেহ, যত্ন, সাহস—সবকিছু যেন একসঙ্গে ধরা দিল।
সন্ধ্যাবেলায় বাড়ি ফেরার পর দেখা গেল, রোহিনীর বাবার মুখ গম্ভীর। তার ডায়েরির একটি পাতা কোনওভাবে তার মায়ের হাতে পড়েছে, আর সেখানে লেখা ছিল, “আমি আর এই দেওয়ালের ভেতর বাঁচতে পারছি না।” বাবার চোখে চোখ রাখতেই তিনি বললেন, “তুই এসব লেখালিখি বন্ধ কর। অনেক হয়েছে স্বাধীনতা খেলা। এবার ঠিকঠাক করে চল। না হলে কলেজ ছাড়িয়ে দেব।” রোহিনী চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তার চোখে জল নয়, এক অদ্ভুত দৃঢ়তা। সে নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। জানালার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে বাইরের বৃষ্টি থেমেছে। কিন্তু তার মন জানে, এই থেমে যাওয়ার মধ্যেই আসছে নতুন ঝড়—যে ঝড় রোহিনীর ভিতর থেকে সমাজের কাঠামো ভাঙার আর্তনাদ। সেই রাতেই সে ডায়েরির পাতায় লিখে রাখল, “যুদ্ধ শুরু হয়েছে। আমি হয়তো হেরে যাব, কিন্তু হার মানব না।”
–
তখন পূজোর ঠিক পরদিন, কলেজ ছুটি, রোহিনী ঘরে বসে সিঁড়ির ধাপে পা মেলে রোদ পোহাচ্ছে। বুকের কাছে চেপে ধরা ডায়েরিটা আজকাল তার একমাত্র সঙ্গী হয়ে উঠেছে। তার মনের ভিতর যেন দুটো রোহিনী বাস করছে—একটা পরিবারের বাধ্য, ভদ্র, বনেদি রমণী হওয়ার দিকে টানছে, আরেকটা নিজের পথ নিজে গড়ার জন্য উন্মুখ, সাহসী ও প্রশ্নবোধক। সেই দুপুরে, রোদে ঝিলিক খাওয়া পুরনো বারান্দার খিলানে বসে, ডায়েরির পাতায় সে লেখে—”আমি আর কারো ছায়া হয়ে বাঁচব না।” তার কলম যেন আজ আগুনের মতো চালিত হচ্ছে, শব্দে শব্দে উঠে আসছে চেপে রাখা অভিমান, দীর্ঘদিনের না-পাওয়ার বেদনা, আর এক অদ্ভুত মুক্তির আকাঙ্ক্ষা।
হঠাৎ করেই বাড়ির পুরনো আলমারির নিচের তাকে রাখা একটা নীল কাঁসার বাক্স মনে পড়ে যায় রোহিনীর। বহুদিন আগে দিদিমা বলেছিলেন, ওতে তার কিছু লেখা, কিছু ছবি আর এক পুরনো শাড়ি আছে। কৌতূহল আর টানেই সে বাক্সটা নামায়, ধুলো ঝেড়ে খুলতেই চোখ আটকে যায় একখানা নীল শাড়ির ওপর। তা যেন তার মনের সঙ্গেই কথা বলে ওঠে। শাড়ির ভাঁজে পাওয়া যায় এক পুরনো চিঠি—দিদিমার লেখা, যেখানে তিনি এক অপূর্ণ জীবনের কথা লিখেছেন, যেটা সংসারের দায় আর সমাজের চোখে পড়ার ভয়ে থেমে গিয়েছিল। সেই চিঠি রোহিনীর মনে আগুন জ্বালায়। সে বুঝে যায়, তার মধ্যে সেই একই রক্ত বইছে—যে রক্ত সাহসী, প্রশ্ন করে, লড়তে জানে। নীল শাড়িটা পরে আয়নার সামনে দাঁড়ায় রোহিনী, যেন এক নতুন রূপে নিজেকে দেখে। সে আর সেই রোহিনী নেই, যে কেবল অন্যের ইচ্ছায় চলে। এই শাড়ি তার জন্য এক প্রতীক—প্রাচীন বনেদিয়ানার ছায়া, আর তার মধ্যেই নতুন জীবনের ছন্দ।
এই রূপান্তরের দিনেই সে সিদ্ধান্ত নেয়, বাড়ির অগোচরে নিজের লেখা নিয়ে আরও বড় কিছু করার। কলেজে যারা ‘ক্রিয়েটিভ উইমেন সার্কেল’ চালায়, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তাদের একটা ছোট পত্রিকায় নিজের নাম না দিয়ে একটি আত্মজৈবনিক লেখা পাঠায় সে—‘নীলপদ্মর ডায়েরি’ নামে। লেখা ছাপা হয়, সাড়া পড়ে যায় সার্কেলের মধ্যেই। কেউ জানে না লেখক কে, কিন্তু সকলেই অনুভব করে, এই লেখা যেন তাদের নিজস্ব বেদনার ভাষা। রোহিনী ভিতরে ভিতরে নিজেকে আর একটু চিনতে শেখে। পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর মাঝে দাঁড়িয়ে সে তার অস্তিত্বের জয়গান শুরু করে দেয়। আর বারবার ফিরে আসে সেই নীল শাড়ির দিনটায়, যখন সে নিজের প্রতিচ্ছবিতে এক নতুন পৃথিবীর দ্বার খুলেছিল—যেখানে সে নিজেই তার ভবিষ্যৎ গড়ার কারিগর।
–
কলেজের চত্বরে বসন্ত এসে গিয়েছে। কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়ার লাল-হলুদ ফুলে ছেয়ে গেছে ক্যাম্পাস। আর সেই রঙের মাঝে রোহিনীর ভিতরে চলছে অন্য এক যুদ্ধ। সদ্য লেখা ‘স্বাধীনতা আমার শব্দ’ কবিতাটি কলেজ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হওয়ায় শিক্ষক-বন্ধুদের প্রশংসা যেমন এসেছে, তেমনি বাড়ি থেকে এসেছে একরাশ তিরস্কার। পিতামহ অমিয় সেন রীতিমতো রেগে গিয়ে বলেছেন, “নারী হয়ে এমন কথা লেখা কি শোভা পায়?” রোহিনী কোনো উত্তর দেয়নি সেদিন, শুধু চোখ নামিয়ে বসেছিল নিজের ঘরে। কিন্তু সেই নীরবতা ছিল অগ্নিচরণ। সে জানে, আর থেমে থাকা নয়। নিজের অস্তিত্ব খোঁজার পথ একা হেঁটে যেতে হবে তাকে। মায়ের অসহায়তা, বড় পিসির চোরা দৃষ্টির অবহেলা, এইসব অভ্যন্তরীণ যুদ্ধের মাঝে কবিতা হয়ে উঠেছে তার অস্ত্র।
একদিন সকালে কলেজে যাওয়ার সময় রোহিনী হঠাৎ লক্ষ্য করল—গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে মেহুল। ছেলেটি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, সমাজবিজ্ঞান পড়ে এবং স্বাধীনচেতা চিন্তাধারার অধিকারী। আগেও দু-একবার কলেজ সেমিনারে দেখেছে তাকে, কিন্তু এইভাবে সামনে এসে কথা বলা হয়নি। “তোমার লেখা ‘স্বাধীনতা আমার শব্দ’— অসাধারণ,” বলল মেহুল। রোহিনী একটু চমকে গেল। “তুমি পড়েছ?” — “হ্যাঁ, শুধু পড়িনি, সংরক্ষণ করে রেখেছি।” সেই মুহূর্তে কিছুটা অপ্রস্তুত হলেও রোহিনীর ভিতরে কোথাও যেন একটা নরম আলো জ্বলে উঠল। এরপর মাঝে মাঝে দেখা হতে লাগল দু’জনের। কখনও কলেজের লাইব্রেরিতে, কখনও কফির দোকানে, আবার কখনও নীলাচলে—রোহিনীর প্রিয় গলির মোড়ে। মেহুলের কথা, তার সমাজ নিয়ে ভাবনা, নারীর স্বাধীনতা নিয়ে স্পষ্ট উচ্চারণ—সব কিছুই রোহিনীর মনে প্রবল আলোড়ন তুলতে লাগল। তার মনে হচ্ছিল, এই প্রথম কেউ বুঝতে পারছে তাকে, তার ভেতরের ‘আমি’কে।
কিন্তু সমাজ থেমে থাকে না। কলেজে কেউ কেউ ফিসফিস করতে শুরু করল রোহিনী আর মেহুলকে নিয়ে। সেই গুঞ্জন একদিন পৌঁছে গেল রোহিনীর বাড়িতে। বাবার রাগ, ঠাকুর্দার মুখের ‘পতিত’ শব্দটা, মায়ের কান্না—সব মিলিয়ে আবার যেন দম বন্ধ করা একটা ঘর। রোহিনী প্রথমবার গলা তুলে বলেছিল—“আমি অপরাধ করিনি, নিজের মতো করে ভাবছি, ভালোবাসছি।” কথাটা শোনার পর ঠাকুর্দার মুখ শক্ত হয়ে গিয়েছিল, তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন—এই ধরনের মেয়ে সেন পরিবারে স্থান পায় না। সেদিন রাতে রোহিনী নিজের ঘরে বসে ডায়েরি লিখেছিল—“আমার পথ আলাদা, আমার ভাবনা আলাদা। যদি এই বাড়ি আমাকে না মানে, তবে আমি নিজেকে মানব, নিজের নতুন ঠিকানা গড়ে নেব।” সেই রাতের পরে সে কাঁদেনি। আর পরদিন সকালে, বই, কবিতা, মায়ের দেয়া ছোট্ট মাটির প্রদীপ আর একটা লাল ওড়না নিয়ে রোহিনী বেরিয়ে পড়েছিল—নিজের ‘নীলপদ্মর’ খোঁজে।
–
সকালটা ছিল অসাধারণ নিস্তব্ধতায় মোড়া। চৈত্রের রোদ জানালার কাচ ছুঁয়ে পড়ছিল রোহিনীর টেবিলের ওপর রাখা পুরোনো ডায়েরির পাতায়, যেটা আজ তার অস্তিত্বের গহীন থেকে উঠে আসা প্রতিটি লড়াই, প্রতিটি প্রশ্ন, প্রতিটি সাহসী সিদ্ধান্তের সাক্ষ্য বহন করে। ডায়েরির প্রতিটি শব্দ যেন আজ তার ব্যক্তিত্বের একেকটা ইটের মতো – যা দিয়ে সে গড়ে তুলেছে নিজের স্বাধীনতার অট্টালিকা। কলেজের চূড়ান্ত বর্ষের শেষ সেমিস্টার, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ইন্টারভিউ, নারী অধিকারের বিষয়ে তার প্রকাশিত প্রথম নিবন্ধ, আর তার নিজের চয়েসে গৃহত্যাগ—সব মিলিয়ে সে যেন এক নবজন্মের প্রান্তে দাঁড়িয়ে। রোহিনী জানে এই লড়াই এখনও শেষ নয়, তবে সে আর নিজের অস্তিত্ব লুকিয়ে রাখবে না। মা এখন আর মুখ ঘুরিয়ে থাকেন না, ঠাকুরদা হয়তো কিছু বলেন না, কিন্তু চোখের কোনে যে গর্ব লুকিয়ে থাকে, সেটা রোহিনী স্পষ্ট টের পায়।
সন্ধ্যেবেলা রোহিনী গিয়েছিল কলেজের অডিটোরিয়ামে, যেখানে তাকে ভাষণ দিতে বলা হয়েছিল “নারী ও স্বাধীনতা” নিয়ে। প্রায় তিনশো জন ছাত্রী, আর কয়েকজন শিক্ষক শ্রোতা। রোহিনীর গলা থরথর করছিল প্রথমে, কিন্তু সে শুরু করল নিজের গল্প দিয়ে—এক বনেদি উত্তর কলকাতার বাড়ির গল্প, এক কিশোরীর গল্প যে ডায়েরিতে নিজের কান্না, প্রশ্ন আর আশার কথা লিখত, যে শিখেছে দাঁড়াতে, বলতে, রুখে দাঁড়াতে। “আমাদের ঘরেই বিপ্লব শুরু করতে হয়,” বলেছিল সে, “প্রতিবার আমাদের চুপ করিয়ে দেওয়া হয়, সেটা চ্যালেঞ্জ করাটাই স্বাধীনতা।” অডিটোরিয়ামে তখন স্তব্ধতা, এরপর ফেটে পড়েছিল করতালিতে। সেই মুহূর্তে রোহিনী প্রথমবার বুঝেছিল, তার লড়াই শুধু তার একার নয়—তার কণ্ঠে আরও অনেক রোহিনীর না বলা স্বপ্নের প্রতিধ্বনি আছে।
রাতে ডায়েরির শেষ পাতাটা খুলে সে লিখেছিল—“আমি এখন আর পাপিয়া, পিউ, কারও ছোট্ট মেয়ে নই। আমি রোহিনী সেন। আমি একা নই, কারণ আমার চারপাশে হাজার রোহিনী জেগে উঠছে। এই ডায়েরি বন্ধ করলাম, কিন্তু আমার কণ্ঠ থামছে না। আমি লিখব, বলব, এগোব।” জানালার বাইরে একফোঁটা বৃষ্টির শব্দ, আর আকাশে ধীরে ধীরে ভাসতে থাকা পূর্ণিমার আলোয়, তার মুখের ছায়া জানালার কাচে পড়ে। সে যেন নিজের প্রতিচ্ছবিকেই বলছিল—”তুই হারিস না।” এই ছিল রোহিনীর মুক্তির প্রথম রাত। নীলপদ্মের শেষ পাতায় লেখা থাকল তার আত্মপরিচয়ের গল্প।
—–
				
	

	


