Bangla - ভূতের গল্প

পূর্ণিমা ডায়েরি

Spread the love

দেবযানী মিত্র


নদীয়ার ‘গিরিজামোহিনী বালিকা বিদ্যালয়’ বরাবরই শান্ত, ছায়াস্নাত পরিবেশে গড়া একটি পুরনো স্কুল, যার পেছনে ছড়িয়ে আছে রহস্যে মোড়া এক আভা। বারো মাসে একদিন, পূর্ণিমা রাতে, হঠাৎ যেন স্কুলের প্রাচীরের আড়ালে নেমে আসে এক অদৃশ্য ছায়ার করাল উপস্থিতি। মেয়েরা জানে, কোনো অলীক কথা নয়, কেউ বা কিছু ওই স্কুলের পেছনের বিশাল বটগাছটিকে ঘিরে জেগে থাকে। দশম শ্রেণির ছাত্রী রিমা সাহা এই ধরনের গুজবে বিশ্বাস করে না, বরং হাসি ঠাট্টায় উড়িয়ে দেয় সবকিছু। কিন্তু সেই রাতটা ছিল আলাদা—পূজা ছুটি শেষে স্কুলে ফেরার আগের সন্ধ্যা, আকাশে টানা মেঘের ছায়া, তবু এক নিখুঁত গোল চাঁদ ঝলসে উঠেছে পশ্চিমের আকাশে। বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে সে যেন হঠাৎ দেখল—বটগাছের নিচে একটা মেয়ে বসে আছে। ধবধবে সাদা ইউনিফর্ম, হাতদুটি গুটিয়ে রাখা, মাথা নিচু। প্রথমে মনে হল কেউ হয়তো ভুল করে স্কুলে রয়ে গেছে। কিন্তু ছায়াটা খুব ধীর, খুব স্থির, তার শরীরের রেখাগুলোও যেন কুয়াশার মতো ঝাপসা। পরদিন স্কুলে ফিরে সেই কথাটা মনে রাখতে চাইল না রিমা। কিন্তু সকাল থেকেই মেয়েদের মধ্যে চাপা গুঞ্জন—“বটগাছের নিচে নাকি কারও কান্না শোনা গেছে, কাকভোরে কেউ দেখেছে সেই মেয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে খেলার মাঠ পেরিয়ে।” নতুন গুজব নয়, এসব হরহামেশাই হয়, রিমা ভাবে। কিন্তু ওই বটগাছটা নিয়ে সত্যিই যেন কিছু একটা আছে। অদ্ভুতভাবে, সেই দিনই রিমা তার বেঞ্চের নিচে পায় একটি পুরনো নীল খাতার ছেঁড়া পাতা—হাতের লেখা কাঁপা কাঁপা, কালির দাগ ছড়িয়ে রয়েছে: “ওরা বলে আমি মরে গেছি। আমি জানি, আমার কণ্ঠ এখনো কেউ শোনে না। আমি ফিরবো। আমি ফিরেই এসেছি।”

রিমা পাতাটা হাতে নিয়ে চমকে উঠেছিল, কারণ সেই লেখার নিচে নাম লেখা ছিল—তিথি দে। এই নাম সে আগে শুনেছে, ভাসাভাসা মনে পড়ে স্কুলে একবার একটি পুরনো দেয়াল পত্রিকায় তিথির কবিতা ছাপা হয়েছিল। আরেকটু খোঁজ করতেই সে জানল, ছয় বছর আগে এই স্কুলেরই নবম শ্রেণির ছাত্রী তিথি রহস্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেছিল। পুলিশ বলেছিল, আত্মহত্যা। পরিবার কিছু বলেও উঠতে পারেনি। কিন্তু স্কুলের মধ্যে এই মৃত্যু নিয়ে এক অদ্ভুত নীরবতা আছে। কেউ বলেনা কিছু, শুধু নতুন মেয়েরা গুজব রটায়—তিথির আত্মা ফিরে আসে পূর্ণিমায়, সে কাঁদে, হাঁটে, আবার ফিরে যায় সেই বটগাছের নিচে। রিমার মনে একটা প্রশ্ন উঠে আসে—যদি সে স্বপ্নে দেখা মেয়েটিই তিথি হয়? আর এই চিঠি, এই লেখা—এটা কি তিথির নিজের লেখা, নাকি কেউ বানিয়ে রাখল তার নামে? সে ঠিক করে, একবার পুরনো রেজিস্টার খুঁজবে লাইব্রেরিতে। স্কুলের রেকর্ড রুমে পুরনো নাম-নথি রাখা থাকে। পরের লাঞ্চ ব্রেকে চুপিসারে লাইব্রেরিতে ঢুকে রিমা বের করে নবম শ্রেণির ছয় বছর আগের রেজিস্টার। তিথি দে—রোল নম্বর ১৬, বিভাগ ‘সি’, জন্ম ২০০৮ সাল। পাশে লেখা আছে: “Deceased – Suicide, incident recorded under Nadia P.S. – 134/2019″। রিমার বুকের ভেতর যেন এক কাঁপুনি বয়ে যায়। ‘আত্মহত্যা’ লিখেছে, কিন্তু ডায়েরির পাতা বলছে, “আমি মরে যাইনি… আমাকে কেউ ঠেলে দিয়েছে”—এই সম্ভাবনা যদি সত্যি হয়? রিমা বিষয়টা নিয়ে কাউকে বলতে চায় না। বন্ধু সায়নীকে বলেও আবার চুপ করে যায়। কারও কাছে নিজেকে পাগল প্রমাণ করতে চায় না। কিন্তু সেই রাতেই আবার এক ভয়ানক ঘটনা ঘটে—রিমার স্বপ্নে বটগাছটা ফিরে আসে। সে দেখে, গাছের নিচে একটি মেয়ে বসে কাঁদছে, এবং মাথা তুলে তাকিয়ে বলছে—“তুই শুনছিস না রিমা? আমি তোকে বেছে নিয়েছি।”

স্বপ্ন থেকে উঠে রিমা দেখল, তার টেবিলের উপর সেই ডায়েরির ছেঁড়া পাতাটা নেই—কিন্তু জানালার বাইরে ঝুলছে আরেকটি পৃষ্ঠা। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে গিয়ে সে দেখে, নতুন পাতায় লেখা: “স্কুলের কেউ আমাকে চুপ করিয়ে দিয়েছে। আমি একা ছিলাম না সেদিন। আমি দেখতে পেরেছিলাম ওকে।” এই ‘ও’ কে? সে কি কোনো শিক্ষক? সহপাঠী? রিমা এবার আর চুপ থাকতে পারল না। সে ঠিক করল, আগামী পূর্ণিমা রাতেই সে স্কুলে যাবে। যেভাবেই হোক, সে জানবে সত্যি কী ঘটেছিল। কিন্তু এতসব রহস্যের ভেতরেও একটা বিষয় তাকে সবচেয়ে বেশি ভাবিয়ে তোলে—কে সেই, যে বারবার তার নাম ধরে ডাকছে, তাকে বেছে নিচ্ছে নিজের প্রতিশোধের যন্ত্র হিসেবে? তিথি কি শুধুই সাহায্য চায়, না কি কিছু ভয়ঙ্কর কিছুর জন্য রিমাকে টানছে? আর এই সবের মাঝেই, হঠাৎই স্কুলের এক পুরনো শিক্ষিকা, মীনাক্ষী মিস, রিমার দিকে একদিন ক্লাসে হঠাৎ তাকিয়ে বললেন, “তিথির ব্যাপারে বেশি কৌতূহলী হওয়া উচিত না রিমা। সব প্রশ্নের উত্তর জানাটা ভালো নয়।” সেদিনই প্রথম, রিমার মনে হয়—এই স্কুলে শুধু এক আত্মার নয়, জীবিত কেউ কেউও লুকিয়ে রেখেছে অন্ধকারের গোপন দরজা।

রিমার মাথার মধ্যে একদম পরিষ্কার হয়ে উঠল, যে প্রশ্নটা তাকে বিভ্রান্ত করছে—কেন, কেনই বা তিথি তাকে বেছে নিয়েছে? আর সে যদি সত্যিই আত্মহত্যা করে থাকে, তবে এই পর্বতপ্রমাণ রহস্যের মধ্যে তাকে কেন ঠেলে দেওয়া হয়েছে? তার মনে হল, কিছুটা অদ্ভুত, আবার কিছুটা কৌতূহলভরা এক অজ্ঞাত যাত্রায় পা রাখতে চলেছে সে। পূর্ণিমার রাতে ঘটে যাওয়া অভিজ্ঞতাগুলো তাকে আরও গভীরে প্রবেশ করার জন্য তাড়া দিচ্ছিল। সায়নীও যেন সেভাবেই নীরব, শুধু এক দৃষ্টিতে রিমাকে দেখছিল। সে জানত, এই ঘটনার পরিণতি অন্ধকারে আবৃত, কিন্তু বন্ধুর কাছে সহযোগিতার প্রয়োজন ছিল—এটা এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে। রিমা যখন ভাবছিল, সে কীভাবে এই ভয়ংকর রহস্যের শেষ খোলসটুকু খুলবে, তখনই স্কুলের মাঝখানে হঠাৎ নজর পড়ল এক পুরনো ডেস্কের দিকে, যেখানে প্রায় পাঁচ বছর আগে রাখা এক পুরনো ডায়েরি চোখে পড়ল। সেই ডায়েরি যে তিথির, সে নিশ্চিত ছিল না, কিন্তু তার মধ্যে ছিল কিছু লেখা, যা যেন রিমার ভাগ্যকেই টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। ডায়েরির পাতাগুলো ছেঁড়া এবং কিছু জায়গায় কালি পড়া, কিন্তু কিছু অংশ পরিস্কার ছিল—”আমি জানি, তারা আমাকে চুপ করে থাকতে বলেছে। আমি জানি না কীভাবে আমার মৃত্যুতে সবাই এত নিশ্চুপ। কিন্তু, আমি জানি, আমি মরে যাইনি।” এর পরের বাক্যগুলো এমনকি আরও বিভ্রান্তিকর, কারণ এগুলোর মধ্যে লেখা ছিল—”তারা সবাই জানত, কিন্তু কেউ কিছু বলেনি।”

অদ্ভুতভাবে, রিমা বুঝতে পারল যে এই ডায়েরি এখন এক গভীর রহস্যের দরজা খুলে দিয়েছে। সায়নীকে সে ডায়েরি পড়তে বলল। সায়নী কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছিল, কিন্তু রিমার চোখে এক ধরনের অদ্ভুত দৃঢ়তা দেখল। সে জানত, একবার যদি ডায়েরির এই অন্ধকার অংশগুলো প্রকাশ পায়, তাহলে তারা আর ফিরতে পারবে না। ডায়েরির দ্বিতীয় পাতায় লেখা ছিল, “মীনাক্ষী মিস—এটাই তার প্রথম মুখোশ। আমি জানি, সে আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, যখন আমি নিঃশব্দে চলে যাচ্ছিলাম। সে জানত, আমি জানি, কিন্তু সে আমাকে বাধা দেয়নি।” সায়নীকে অবাক হয়ে শুনতে হচ্ছিল, কারণ মীনাক্ষী মিস—যার উপর অনেক দিন থেকেই একটা অস্বাভাবিক রহস্য ঘিরে ছিল, সে এর আগে কোনোভাবে নাম আসেনি এই রহস্যে। রিমা তখন বুঝতে পারে, তিথির সত্যি আত্মহত্যা ছিল না, বরং এটা ছিল এক সঙ্গবদ্ধ অপরাধ, যা অনেকে মিলে রচনা করেছিল। এর মধ্যে মীনাক্ষী মিসের হাত থাকতে পারে—অথবা তার কোনো সঙ্গী থাকতে পারে। কিন্তু রিমা সঠিকভাবে কিছু বুঝতে পারেনি, কারণ অদৃশ্যভাবে ডায়েরি থেকে আরও একটা নতুন প্রশ্ন উঠে আসে—“তিথির মৃত্যুর পর কেন সবাই এত নিশ্চুপ ছিল?”

ডায়েরি শেষ হওয়ার আগেই রিমা সায়নীকে আশ্বস্ত করল যে, তাদের এখন স্কুলের সবচেয়ে বড় অধ্যায়ের মুখোমুখি হওয়া দরকার—মীনাক্ষী মিসকে খুঁজে বের করা, তার চেহারায় কোনো অস্পষ্টতা না থাকলে, তিথির সত্যি হত্যাকারী কে তা জানা। রিমা জানত, এর জন্য তাকে আরও কিছু করতে হবে—এবার স্কুলের প্রাচীন লাইব্রেরির গোপন সেকশনে যেতে হবে, যেখানে তিথির সব পুরনো কাগজপত্র রাখা আছে। ঠিক তখনই, রিমা খেয়াল করে, তার চোখের সামনে আরেকটা নোট পড়ে আছে—”তিথির অমীমাংসিত অবস্থান, মীনাক্ষী মিসের শিকল—সত্যি উদ্ধার হবে।” এটা কি সত্যি ছিল, নাকি ডায়েরির আরেকটি ইঙ্গিত ছিল যা রিমাকে আরও ডুবিয়ে দেবে? রিমা তখন এক ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নেয়—তাকে সমস্ত প্রমাণ জড়ো করতে হবে। রিমা পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে যায়, যদি তারা মীনাক্ষী মিসের বিরুদ্ধে কোনো শক্ত প্রমাণ না পায়, তবে তিথির আত্মা চিরকাল তাদের পিছু তাড়া করবে। আর এজন্যই তাদের পুরো স্কুলটিকে জীবন্ত প্রমাণে পরিণত করতে হবে, যাতে ইতিহাস ভুলে না যায়—তিথি দে মরে যায়নি, সে মারা গেছে, এবং সে ফিরে এসেছে তার প্রতিশোধ নেবার জন্য।

রিমা ও সায়নী ডায়েরির পাতাগুলোর ছেঁড়া ছেঁড়া শব্দগুলোকে জোড়া লাগানোর চেষ্টা করছিল। মাঝে মাঝে বাক্যগুলো অসম্পূর্ণ, কিন্তু ইঙ্গিত স্পষ্ট—তিথির মৃত্যু কোনও আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছিল না, বরং তা ছিল এক চক্রান্তের ফল। এবং এই চক্রান্তের ছায়া পড়ে আছে ঠিক তাদের চারপাশে, সেই স্কুলের গায়ে, সেই ক্লাসরুমে, এমনকি প্রতিটি করিডোরে—যেখানে একসময় তিথি পা ফেলেছিল। কিন্তু সবচেয়ে বড় ইঙ্গিত ছিল একটি নাম—মীনাক্ষী মিস। ইতিহাস শিক্ষিকা হিসেবে তাঁর ভাবমূর্তি বরাবরই কঠোর ও দুর্ভেদ্য। ছাত্রীদের মধ্যে ভয় ও শ্রদ্ধার সংমিশ্রণে গড়া এক সম্মান ছিল তাঁর প্রতি, কিন্তু রিমা এখন অন্য কিছু খুঁজে পাচ্ছে তাঁর চোখে—একটা চাপা ভয়, একটা কৃতঘ্ন অস্থিরতা। মীনাক্ষী মিসের গতিবিধি লক্ষ্য করতে গিয়ে রিমা বুঝতে পারে, তিনি প্রায়ই স্কুলের পুরনো রেজিস্ট্রি রুমে যাচ্ছেন, তালাবদ্ধ কাগজপত্র ঘাঁটছেন, আবার অনেক সময় একা ক্লাসরুমে বসে কিছু খাতার মধ্যে চোখ গুঁজে থাকেন। সেদিন লাঞ্চের সময়, রিমা ও সায়নী লাইব্রেরি থেকে চুপিচুপি গিয়ে দাঁড়ালেন ওই পুরনো রেজিস্ট্রেশন রুমের জানালার পাশে। ভেতরে দেখা গেল, মীনাক্ষী মিস একটি পুরনো খাতা খুলে কিছু একটা ছেঁড়া কাগজ ঢুকিয়ে পকেটে রাখছেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল, যেন কেউ তাঁকে অনুসরণ করছে এই আতঙ্কে বারবার পিছন ফিরে তাকাচ্ছেন।

রিমার বুকের ভেতর তখন কেবলই বাজছিল একটাই শব্দ—”প্রমাণ, প্রমাণ চাই।” ডায়েরির পাতায় লেখা আছে যে তিথি শেষ ক’দিনে কিছু লিখেছিল, যা সে মীনাক্ষী মিসের বিরুদ্ধে রাখতে চেয়েছিল, কিন্তু তা হারিয়ে যায়। রিমা ভাবে, যদি মীনাক্ষী মিস সেই প্রমাণ এখনো নিজের কাছে রেখে থাকেন, তবে সেটা হয়তো তাদের শেষ ভরসা। একদিন সুযোগ বুঝে রিমা ও সায়নী মীনাক্ষী মিসের ডেস্কে ঢুকল, ঠিক তখনই ক্লাসে কেউ ছিল না। বইয়ের স্তূপ, প্রশ্নপত্রের খাতা, পুরনো ম্যাপ, সব ঘেঁটে কিছু পাওয়া যায়নি, কিন্তু একটি ছোট খামের ভিতর পায় একটি অডিও ক্যাসেট—তাতে লেখা, “T.D Confession – Keep Safe”। সায়নী প্রথমে ভয় পায়, কারণ ক্যাসেটটা অনেক পুরনো, বাজানোর যন্ত্র কোথায় পাওয়া যাবে তা নিয়েও সন্দেহ। তারা সেই রেকর্ডিং বাজানোর জন্য স্কুলের পুরনো মাল্টিমিডিয়া রুমে ঢোকে। ঝাঁপসা শব্দ, বিকৃত কণ্ঠস্বরের ফাঁকে তারা শুনতে পায়—“তুই এটা কাউকে বললে তোর পরিণতি ভালো হবে না তিথি… তুই যা শুনেছিস, সেটা ভুলে যা। না হলে তোর গলায় দড়ি পরবে।” রিমা ও সায়নী একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে। কণ্ঠটি স্পষ্ট নয়, কিন্তু ভাষা এবং ভয় দেখানোর ভঙ্গি ছিল ভয়াবহ। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে তিথির ভয় পাওয়া শোনা যাচ্ছিল, তার অস্পষ্টভাবে বলা—“আমি কাউকে বলব না… কিন্তু আপনার ভয় করছে কেন?” এই কথার পর এক মুহূর্তের নীরবতা, তারপর টেপ কেটে যায়।

এই রেকর্ডিং তাদের কাছে ছিল এক বিস্ফোরক অস্ত্র, কিন্তু কণ্ঠস্বরের সত্যতা প্রমাণ করা কঠিন। রিমার মনে হলো, প্রমাণ হাতের মুঠোয়, কিন্তু তবু সে অদৃশ্য। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, এবার একমাত্র উপায় মীনাক্ষী মিসকে মুখোমুখি প্রশ্ন করা। পরদিন ক্লাস শেষে রিমা একা গিয়ে দাঁড়ায় তাঁর সামনে। “মিস,” সে বলে, “তিথি দে-র নামটা আপনার পরিচিত তো?” মীনাক্ষী মিসের মুখে মুহূর্তে কৃত্রিম প্রশান্তির মুখোশ ভেঙে পড়ে, চোখ ঘোলা হয়ে যায়। তিনি সংযতভাবে বলেন, “হ্যাঁ, আমি মনে করি ও একজন মেধাবী ছাত্রী ছিল। আত্মহত্যা করেছিল, তাই তো?” রিমা চুপচাপ ক্যাসেটটা তাঁর টেবিলে রাখে। “এটা কী?” প্রশ্ন করেন মীনাক্ষী মিস। রিমা আর কিছু না বলে ঘর ছেড়ে চলে আসে। সেদিন রাতেই, পূর্ণিমার আলোয় বটগাছের নিচে ফের এক ছায়া দেখা যায়। কিন্তু এবার ছায়াটি কেবল বসে থাকে না—হেঁটে যায় স্কুল ভবনের দিকে, এবং ভেতরে কারও চিৎকার শোনা যায়। ঠিক পরদিন সকালে স্কুলে আসে পুলিশ, কারণ মীনাক্ষী মিস নিজেই হেডমিস্ট্রেসের কাছে গিয়েছেন এক স্বীকারোক্তির অংশ নিয়ে। কিন্তু তিনি বলেছেন—“আমি কিছু করিনি, আমি শুধু দেখেছিলাম। আমি তাকে রক্ষা করতে পারিনি। আমি ভুল করেছি, কিন্তু আমি খুনী নই।” তাহলে কি সত্যিই মীনাক্ষী মিস শুধু একজন সাক্ষী ছিলেন? নাকি তাঁর এই স্বীকারোক্তির আড়ালে আরও ভয়ঙ্কর কিছু লুকিয়ে আছে?

রিমা ঠিক করেছিল, সে এবার ভয় পাবে না। ক্যাসেটের রেকর্ডিং, মীনাক্ষী মিসের স্বীকারোক্তি, তিথির ডায়েরির ছেঁড়া পাতা—সব যেন তাকে একটা যাত্রার কেন্দ্রে এনে ফেলেছে, যেখান থেকে আর পেছনে ফেরা যায় না। সায়নী প্রথমে কিছুটা পিছিয়ে ছিল, কিন্তু পূর্ণিমার আগের রাতে, তারা যখন দুজনে বটগাছের সামনে গিয়ে দাঁড়াল, আকাশে তখন ফিকে চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ছে মাঠের ওপরে। স্কুল ছুটির পর, তারা লুকিয়ে পড়েছিল লাইব্রেরির ছাদে, অপেক্ষা করছিল রাত নামার। মাঠের বাতিগুলো নিভে যাওয়ার পর, সবকিছু এত নিস্তব্ধ হয়ে গেল যে নিজেদের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ পর্যন্ত স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল। বটগাছ যেন এই নিস্তব্ধতা গিলে নিচ্ছিল, তার ঝাঁকড়া ডালপালা ধীরে ধীরে নড়ছিল, অথচ বাতাস একটুও ছিল না। হঠাৎই রিমা দেখল—একটি ছায়া, সাদা পোশাকে, ধীরে ধীরে গাছের নিচে এসে দাঁড়াল। মেয়েটির মুখ দেখা যাচ্ছে না, সে শুধু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তারপর যা ঘটল, তা ছিল তাদের জীবনের সবচেয়ে অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। ছায়াটি হঠাৎ করেই পেছন ফিরে তাকাল। সেই চোখদুটো—মুহূর্তে জ্বলে উঠল ক্ষোভে, কান্নায়, অভিযোগে। রিমার মনে হল, কেউ যেন ভেতর থেকে তাকে চিৎকার করে বলছে, “তুই তো শুনছিলি আমাকে… এবার তুই বল।”

সেই মুহূর্তে ছাদে ঠাস করে হাওয়া উঠল। সায়নী কাঁপতে কাঁপতে বলল, “চল যাই রিমা, প্লিজ চল।” কিন্তু রিমা তখন পা সরাতে পারছিল না, তার দৃষ্টি আটকে গেছে বটগাছের নিচে বসে পড়া সেই ছায়ায়। মেয়েটি এবার মাথা নিচু করে হাত দিয়ে মাটি কুড়োচ্ছে, যেন কিছু খুঁজছে। পরক্ষণেই তারা দেখতে পেল, স্কুলের পুরনো লাইব্রেরির দিকটা যেন কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে। ছায়াটি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে লাইব্রেরির দিকে এগিয়ে গেল। রিমা ও সায়নী সাহস করে তাকে অনুসরণ করল। স্কুলের লাইব্রেরি অনেক বছর আগে অন্য ভবনে স্থানান্তরিত হয়েছে, কিন্তু পুরনো অংশটা এখন তালাবদ্ধ—অথবা তেমনটাই বলা হয়। কিন্তু তারা গিয়ে দেখে, দরজার তালা খোলা, এবং ভিতরে অদ্ভুত ঠান্ডা। ঘরে ঢুকেই তারা দেখে, একটি টেবিলের ওপর ধুলো পড়ে থাকা পুরনো খাতা, কিছু পোস্টার, আর এক কোণায় পড়ে আছে একটি অডিও রেকর্ডার। রিমা সাহস করে গিয়ে তা হাতে তোলে—ডিভাইসটি পুরনো, কিন্তু এখনও সচল। তার ডায়ালের পাশে ছোট হাতে লেখা—“Confession 2: M”। সায়নী উত্তেজনায় কেঁপে ওঠে—এটাই কি দ্বিতীয় ক্যাসেট? প্রথমটি যেটি তারা মীনাক্ষী মিসের ডেস্ক থেকে পেয়েছিল, সেটার পর এই ক্যাসেটই কি তিথি তাদের শোনাতে চায়?

সেই রাতেই, তারা ক্যাসেটটি বাজায়। শব্দ আসে খুব অস্পষ্টভাবে, কিন্তু একসময় একটা স্পষ্ট বাক্য ভেসে ওঠে—“আমি জানি মীনাক্ষী একা নয়। আমি জানি, তিথি আমাকে বলেছিল কী দেখেছে… কিন্তু আমি চুপ করেছিলাম।” এ কণ্ঠ যে একজন শিক্ষিকার, তা বেশ বোঝা যায়। কে ছিল এই দ্বিতীয় ব্যক্তি? হেডমিস্ট্রেস? অন্য কেউ? রিমা ও সায়নী হঠাৎ বুঝতে পারে, কেবল মীনাক্ষী মিস নয়, আরও কেউ এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত। রিমা অস্থির হয়ে ওঠে—তার মনে হচ্ছে, তিথি এখন আর কেবল সাহায্য চাইছে না, সে একে একে তার পাশে দাঁড়ানোদের মুখোশ খুলে দিতে চাইছে। সেই রাতেই রিমা বাড়ি ফিরে দেখে, তার পড়ার টেবিলের ওপর একটা পুরনো নীল রিবনের ফিতে রাখা। যেটা সে আগে কখনো দেখেনি। পাশে ছোট করে লেখা—“তুই শোন, আমি বলেছিলাম তোকে।” তার মাথার ভেতর তখন গুঞ্জন করছে তিথির কান্নাভেজা কণ্ঠস্বর, যেন ছাদের ফাঁক দিয়ে তা ঢুকে পড়ছে ভিতরে। রিমা বুঝতে পারে, পূর্ণিমার রাত শেষ হয়ে এলেও সত্যের যাত্রা এখনো শুরু হয়নি। কেউ একজন এখনো চুপ করে আছে। কেউ একজন ভয় পাচ্ছে মুখ খুলতে। আর সেই ভয়ই তিথিকে বারবার ফিরিয়ে আনছে—নিঃশব্দে, চোখের কোণে জমে থাকা কান্নার মতো, আকাশজোড়া বিস্তৃত আলোর নিচে দাঁড়িয়ে প্রতিশোধের আশায়।

আকাশটা মেঘলা, যেন সন্ধ্যের আগেই রাত নামতে চাইছে। নদীয়ার সেই পুরনো বালিকা বিদ্যালয়টি আজ আবার অস্বাভাবিক নিস্তব্ধ। মাধবীলতা তার বাইরের জগৎ ভুলে গিয়েছে, কেবল চিন্তা করছে পূর্ণিমার ডায়েরির কথা। প্রতি রাতে পূর্ণিমা এসে যেভাবে কথা বলছে, যেভাবে তার মৃত্যুর আড়ালের রহস্য উন্মোচনের অনুরোধ করছে—তা আর উপেক্ষা করা যায় না। মাধবীলতা আর মেঘলা মিলে খোঁজ চালাতে শুরু করেছে স্কুলের পুরনো রেকর্ড, পুরনো শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সম্পর্কে। একদিন হঠাৎ তারা আবিষ্কার করে স্কুল লাইব্রেরির পাশের পুরনো গুদামঘরের পেছনে একটি বন্ধ দরজা—ধুলো, জাল ও মাকড়সার ঘরে ঢাকা। ওই জায়গাটি বহু বছর ধরে অচল ছিল, কেউ যায় না, এমনকি রক্ষকেরাও না। কিন্তু মাধবীলতার মনে পড়ে, পূর্ণিমা বলেছিল, “সত্যি লুকিয়ে আছে এক দরজার ওপারে, যেটা খুলতে কেউ সাহস পায়নি…”—এটাই কি সেই দরজা?

মেঘলা কিছুটা ভয় পেয়েছিল, কিন্তু মাধবীলতার দৃঢ়তা ও বিশ্বাস তাকে সাহস জুগিয়েছে। তারা রাতে স্কুলে ফিরে আসে, যখন সকলেই চলে গেছে, শুধু কাকের ডাক আর ঝিঁঝিঁর কান্না যেন সঙ্গী। তারা টর্চের আলোয় গুদামঘরের পেছনের দেয়াল স্পর্শ করে খুঁজতে থাকে—হঠাৎ এক পুরনো কাঠের প্যানেলে হাত পড়তেই, সেটা একটু নড়ে ওঠে। প্যানেলের পেছনে ধাতব এক দরজা—তাতে তালা ঝুলছে, মরচে পড়ে গেছে। অনেক চেষ্টা করে, ধাতব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে, শেষ পর্যন্ত তালা ভাঙে। দরজাটা খোলার সাথে সাথে ধুলো ও পচা কাঠের গন্ধে শ্বাসরোধ হতে চায়। ভিতরে এক ছোট ঘর, দেওয়ালে পুরনো নোটিস, মেয়েদের আঁকা ছবি আর কোণে রাখা একটি ট্রাঙ্ক। মাধবীলতা ট্রাঙ্ক খুলে দেখে, তার ভিতরে কাগজে মোড়ানো একটি ফাইল, যার গায়ে লেখা “সিক্রেট রিপোর্ট: পূর্ণিমা মল্লিক”। দু’জনেই থমকে যায়।

মাধবীলতা ফাইল খুলে দেখে একের পর এক হস্তলিখিত নোট, স্কুলের চিকিৎসা রিপোর্ট, শ্রেণিশিক্ষিকার চিঠি, এমনকি পূর্ণিমার নিজের লেখা ডায়েরির কিছু পাতা। সেখানে লেখা রয়েছে, কিভাবে পূর্ণিমা নিজে শিক্ষিকা সুনন্দা সেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিল—একাধিকবার তাকে মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছিল। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ সেটা চেপে যায়, মিথ্যে প্রচার করে যে পূর্ণিমা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে আত্মহত্যা করেছে। মেঘলার হাত কাঁপে, চোখে জল আসে—এতদিন ধরে সত্য লুকিয়ে ছিল, একটা মেয়ের আত্মা শান্তি পায়নি, কেবল একজন শিক্ষিকার ক্ষমতা ও স্বার্থরক্ষার জন্য। মাধবীলতা বলে, “পূর্ণিমার আত্মা মিথ্যে বলে না। এখন সময় হয়েছে ওর সত্যিটা প্রকাশ করার।” সেই রাতে তারা প্রতিজ্ঞা করে, পূর্ণিমার সত্যি সব ছাত্রীর সামনে আনবে, সে যতই ভয়ঙ্কর হোক না কেন। বাইরে তখন পূর্ণিমার আত্মা জানালার ওপার থেকে তাকিয়ে, তার মুখে এক প্রশান্তির ছোঁয়া।

পূর্ণিমার আলোয় ভিজে থাকা আকাশের নিচে নদীয়ার বালিকা বিদ্যালয়ের আঙিনা যেন আরও রহস্যময় হয়ে উঠেছে। স্কুল বিল্ডিংয়ের পুরনো করিডোরে এক অজানা শীতলতা নেমে এসেছে—যা একমাত্র অনুভব করা যায়, ব্যাখ্যা করা যায় না। সেই রাতে, শ্রেয়া, রিন্তি আর মধুপর্ণা লুকিয়ে থেকে অপেক্ষা করছিল একটা বিশেষ সময়ের জন্য। ঘড়ির কাঁটা যখন ঠিক বারোটার ঘরে এসে থামে, তখনই আচমকা হাওয়ার দমকে জানালার পর্দা উড়ে ওঠে। পেছনের ক্লাসরুম থেকে এক হালকা কণ্ঠস্বর ভেসে আসে—”আমার ডায়েরি কে নিয়েছে?” তিনজনেই মুহূর্তে স্থির হয়ে যায়। মধুপর্ণা ধীরে ধীরে জানালার দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখে, পূর্ণিমার আলোয় একটা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে—যার চুল খোলা, চোখে অসীম বিষাদ আর ঠোঁটে একটা চাপা আর্তনাদ। শ্রেয়া ফিসফিস করে বলে, “ওই তো অরুন্ধতী…” নামটা উচ্চারণ করতেই বাতাস যেন ভারী হয়ে ওঠে, জানালার কাচে যেন জমে ওঠে শ্বাস।

পরদিন সকালবেলা, শিক্ষিকা মালবিকা দাশ ক্লাসে এসে লক্ষ্য করেন—বোর্ডে কেউ যেন চক দিয়ে লিখে রেখেছে: “সত্য গোপন করলে সে ফিরে আসে।” এই লেখা দেখে শিক্ষিকাদের মধ্যে কোলাহল শুরু হয়ে যায়, কেউ ধরে নেয় ছাত্রীরいたাজত্ব, কেউ আবার পুরনো কাহিনী মনে করে গা ছমছম অনুভব করে। মালবিকা দাশ, যিনি এই ঘটনায় একমাত্র সত্য জানেন, মুখ লুকিয়ে নেন। কিন্তু শ্রেয়ারা থেমে থাকে না। স্কুল লাইব্রেরির পুরনো খাতায়, তারা পায় ২০০২ সালের একটি রিপোর্ট—যেখানে লেখা ছিল, “অরুন্ধতী সেন: আত্মহত্যা, কারণ অজানা।” কিন্তু এই রিপোর্টে ভুলভাল তথ্য ছিল—অরুন্ধতী নাকি এক অজানা চিঠি পাওয়ার পরই গলায় দড়ি দেয়। শ্রেয়া ও রিন্তি তখন শুরু করে পুরনো আলমারি খোঁজা, আর এক রাতে, তারা পায় অরুন্ধতীর ছেঁড়াখোঁড়া ডায়েরির কিছু অংশ—যেখানে বারবার একটি নাম উঠে এসেছে: “মালবিকা ম্যাডাম”। এই আবিষ্কারে তিনজনের হৃদয় ধুকপুকিয়ে ওঠে।

এই ডায়েরির পাতা ঘেঁটে শ্রেয়া বুঝতে পারে—অরুন্ধতী আত্মহত্যা করেনি। তাকে মানসিক চাপে ফেলে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল আত্মহননের দিকে। তার প্রিয় ছবি আঁকার খাতা ছিঁড়ে ফেলা, তার গানের ক্লাস বন্ধ করে দেওয়া, এমনকি তার মায়ের চিঠিগুলো লুকিয়ে ফেলা হয়েছিল। এই সব কিছুর পেছনে ছিল একজন শিক্ষিকা—যিনি নিজের অতীত রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কেন? অরুন্ধতীর মা কি কিছু জানতেন? নাকি অরুন্ধতী জেনে ফেলেছিলেন এমন কিছু যা জানার কথা ছিল না একজন ছাত্রীর? শ্রেয়ারা ঠিক করে, তারা পরবর্তী পূর্ণিমায় আরও গভীরে যাবে, কারণ অরুন্ধতীর আত্মা শুধু ফিরে আসে না, সে ডাক দেয়, চায় তার ডায়েরি ফিরে পেতে—যার মধ্যে লুকিয়ে আছে সেই অন্ধকার সত্য, যা একদিন উজ্জ্বল আলোয় আসবেই।

পূর্ণিমার রাতে আবারও ঢেকে এল নদীয়ার আকাশ। চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে স্কুলের চারপাশে, যেন তারই আলোকচ্ছটা উদ্ঘাটিত করতে চলেছে বহুদিনের চাপা এক সত্য। স্কুলের পিছনের পুরনো অডিটোরিয়ামের ধারে বসেছিল ঋতুপর্ণা, তমা আর অনন্যা। তাদের সঙ্গে ছিল নতুন সদস্য সুহৃতা, যার সাহস আর যুক্তিবোধ গত কয়েক দিনে দলটিকে অনেক এগিয়ে নিয়ে গেছে। মেয়েরা জানে আজ রাতেই পূর্ণিমার ডায়েরির সপ্তম পাতাটি খোলার সময় এসেছে—যেখানে হয়তো পাওয়া যাবে সেই রাতের ঘটনার শেষাংশ, যেদিন রিমঝিমের দেহ ঝুলে পাওয়া গিয়েছিল ঘড়ি ঘরের পেছনের নারকেল গাছটিতে। বাতাসে ছড়িয়ে ছিল অদ্ভুত একটা গন্ধ, যেন পুরনো ভেজা কাগজ আর ধূলিধুসর স্মৃতির। অডিটোরিয়ামের ছায়াঘেরা মেঝেতে পেতেছিল তারা গোল হয়ে বসার স্থান, মাঝখানে রাখা একটি ছোট্ট প্রদীপ, যেন কোনো প্রাচীন তান্ত্রিক অনুষ্ঠানের আয়োজন। ঋতুপর্ণা ডায়েরির সপ্তম পাতাটি খুলতেই চারদিকে অদ্ভুত শীতলতা ছড়িয়ে পড়ে। অক্ষরগুলি নিজেরাই যেন চেঁচিয়ে উঠছে—“আমি দেখেছিলাম… ও কি করেছিল…”

রিমঝিমের কণ্ঠস্বর আবার ধরা পড়ল বাতাসে—কিন্তু এবার স্বর আগের চেয়ে ভারী, দুঃখে ভারাক্রান্ত নয়, বরং প্রতিশোধে দীপ্ত। “সেই রাতে আমি একা ছিলাম না,” বাতাসে ভেসে এল আওয়াজ। “আমি এসেছিলাম ফারহানা ম্যামের ঘরে… তিনি বলেছিলেন, আমাকে সাহায্য করবেন আমার স্কলারশিপ নিয়ে… কিন্তু হঠাৎ আমি তার হাতে দেখি কিছু কাগজ… আমার মেডিকেল রিপোর্ট… আমার মা’র সিগনেচার করা মিথ্যা স্বীকারোক্তি… আর তখন আমি বুঝতে পারি, সবকিছু একটা ষড়যন্ত্র…” সবাই স্তব্ধ, হাওয়ার মাঝে যেন রিমঝিমের নিঃশ্বাস ধরা পড়ছে। তমা কাঁপা কণ্ঠে বলে, “তাহলে আত্মহত্যা নয়?” রিমঝিমের আত্মা যেন চিৎকার করে উঠল, “আমি মরিনি নিজের ইচ্ছায়… আমাকে ঠেলে দিয়েছিল… এক মহিলা, যার হাসির আড়ালে লুকিয়ে ছিল এক নরখাদকের মুখ!” সেই মুহূর্তেই অডিটোরিয়ামের এক কোণ থেকে ভেসে এল পায়ের শব্দ। ফারহানা ম্যাম—কালো ওড়নায় মোড়া, হাতে একটা পুরনো রেকর্ড বই। চোখে আতঙ্ক, কণ্ঠে কৃপা নেই। “তোমরা যা করছো, সেটা বন্ধ করো,” তিনি ফিসফিস করে বলেন, “সব মিথ্যে… সব কিছু ভুল বোঝা…”

কিন্তু অনন্যা উঠে দাঁড়ায়, চোখে আগুন। “মিথ্যে?” সে বলে, “তাহলে কেন তুমি বছরের পর বছর ধরে ডায়েরিটা অফিস রুমে লুকিয়ে রেখেছিলে? কেন রিমঝিমের কেসটা বন্ধ হয়ে গেল প্রমাণ ছাড়াই?” ফারহানা ম্যাম কিছু বলার আগেই ডায়েরির পাতা উড়ে যেতে থাকে বাতাসে, একটার পর একটা পৃষ্ঠা যেন জেগে উঠেছে শত সহস্র স্মৃতির ভাণ্ডার নিয়ে। আর শেষ পাতায় লেখা—“ওরা সবাই জানে… কিন্তু মুখ বন্ধ করে আছে…” হঠাৎ অডিটোরিয়ামের ঝাড়বাতি দপদপ করে জ্বলে ওঠে, আর সেই আলোতে ফারহানা ম্যামের মুখে দেখা যায় কুৎসিত বিকৃতি—ভয় নয়, বরং অপরাধের স্বীকারোক্তি। “হ্যাঁ, আমি করেছিলাম… কারণ ও যদি কথা বলত, আমিই ধরা পড়তাম… আমার চাকরি, আমার সম্মান, সব চলে যেত…” তাঁর কণ্ঠে হাহাকার নেই, বরং এক অসুস্থ গর্ব। আর তখনই ছায়া থেকে বেরিয়ে এল রিমঝিমের আত্মা, এবার আর শুধু চোখ নয়—তার চারপাশে জ্বলছে অদৃশ্য আগুন। বাতাস থমকে যায়, আর সব মেয়েরা একযোগে বলে ওঠে, “তুমি শুধু একজনকে মারনি… তুমি মারছো মেয়েদের বিশ্বাস… সেই বিশ্বাসকে, যে বিশ্বাসে শিক্ষিকা শব্দটা তৈরি হয়েছে…” আর ঠিক তখনই, অডিটোরিয়ামের ছাদ থেকে চাঁদের আলো সোজা এসে পড়ল রিমঝিমের ওপর, আর তার আত্মা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল সেই আলোতেই—এক চিরন্তন শান্তির দিকে।

শীতল এক পূর্ণিমা রাত। আকাশে মেঘ নেই, চাঁদের আলো একটানা ঢেলে যাচ্ছে গোটা নদীয়ার উপর। আজই সেই রাত, যখন শ্রেয়া ফিরে আসে। তবে এবার পরিস্থিতি অন্যরকম। নন্দিনী, রূপসা, মৌসুমী আর ইলা—এই চারজন ছাত্রী এখন একজোট। তারা জানে, শ্রেয়ার আত্মা শুধু প্রতিশোধ চাইছে না—সে চায় মুক্তি। এই মুক্তির পথ সত্য উদঘাটনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। কিন্তু এর মধ্যেই স্কুলে শুরু হয়েছে ‘পূর্ণিমা উৎসব’, যেটা আগে কখনও হত না। হঠাৎ করেই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মালবিকা দেবী এই উৎসব শুরু করেছেন। কচিকাঁচা মেয়েরা নাচে-গানে মেতে উঠেছে, কিন্তু শ্রেয়ার দল বুঝতে পারছে কিছু একটা গলদ আছে। সন্ধ্যার পর স্কুল বিল্ডিং অন্ধকারে ঢেকে যায়, আর উৎসবের মাঝে একটা নাটক শুরু হয়—নাটকের কাহিনি হুবহু শ্রেয়ার আত্মহত্যার ঘটনার সঙ্গে মিলে যায়। কে লিখেছে এই নাটক? কে অনুমতি দিয়েছে এটা মঞ্চস্থ করতে? প্রশ্ন জমতে থাকে চারপাশে, কিন্তু উত্তর মিলছে না।

নাটক চলাকালীন রূপসা টের পায়, স্কুলের লাইব্রেরির পুরনো তালা খোলা। তার সাহসী মন কৌতূহল সামলাতে পারে না—সে চুপিচুপি ঢুকে পড়ে ভেতরে। নীচু আলোর নিচে সে দেখতে পায় এক পুরোনো রেজিস্টার—শ্রেয়ার নাম লেখা আছে সেখানে, তার পাশে বড় করে লেখা ‘সাসপেন্ডেড ফর ইন্ডিসিপ্লিন’। অথচ এ কথা কখনও বলা হয়নি! শ্রেয়াকে তো বলা হয়েছিল ‘অত্যন্ত নম্র ও মেধাবী’। রূপসা আরও কয়েকটা পৃষ্ঠা উল্টে পায় শ্রেয়ার এক হ্যান্ডনোট—যেখানে লেখা, “আমার সত্যিটা কেউ বিশ্বাস করবে না, কিন্তু একদিন সবাই জানবে।” ঠিক তখনই পেছন থেকে একটা কণ্ঠ—“তুই জানতিস না, আমি আবার আসব।” রূপসা ঘুরে দেখে শ্রেয়া দাঁড়িয়ে আছে, তার চোখে আগুনের মতো জ্বলছে প্রতিশোধ। কিন্তু এইবার শ্রেয়া রূপসাকে ভয় দেখাতে আসেনি, সে চায় রূপসা ও বাকিরা তার হয়ে লড়ুক। “আজকের নাটকে একজন আসল খুনি আছেন… ওঁর মুখোশ আজ খুলবে,” শ্রেয়া বলে।

রাত বাড়তেই উৎসবের রঙ বদলাতে থাকে। নাটকের শেষ দৃশ্যে শ্রেয়ার আত্মহত্যার চিত্র তুলে ধরা হয়, আর তখনই রূপসা, নন্দিনী, মৌসুমী ও ইলা একসাথে মঞ্চে উঠে পড়ে। তারা মাইক্রোফোনে ঘোষণা করে—“এই নাটকটি মিথ্যে, এবং আজ আমরা আপনাদের সত্যিটা জানাব।” দর্শকদের মধ্যে ফিসফাস শুরু হয়। মালবিকা দেবীর মুখ থেকে হাসি উধাও। তখনই শ্রেয়ার আত্মা ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হয় মঞ্চের এক কোণে, এবং বলে ওঠে—“আমার মৃত্যুর পেছনে যিনি রয়েছেন, তিনি এখনো এই স্কুলে আছেন… এক শিক্ষিকা… যিনি আমার বিশ্বাস ভেঙেছিলেন।” সবাই স্তব্ধ। মালবিকা দেবীর গলায় কাঁপুনি শুরু হয়। এমন সময় লাইব্রেরি থেকে রূপসা সেই রেজিস্টারটা নিয়ে আসে, দেখায় সেই সাসপেনশন এন্ট্রি। ছাত্রীরা একজোট হয়ে দাবি করে তদন্ত। পুলিশের কাছে খবর যায়। শ্রেয়ার কণ্ঠে যেন শান্তি ফিরে আসে—সে বলে, “তোমরা যদি সত্যি খুঁজতে চাও, তবে শেষের পূর্ণিমা আসবে আলোর মতো।” আর তারপরই চাঁদের আলোতে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় সে। বাকিদের চোখে জ্বলজ্বল করে অদম্য প্রতিজ্ঞা—এখন সত্য উন্মোচন শুধু সময়ের অপেক্ষা।

গভীর রাত। পূর্ণিমার আলোয় নদীয়ার আকাশ আজ অদ্ভুতভাবে নির্মল, কিন্তু সেই নির্মলতায় যেন মিশে আছে অতল আঁধারের কান্না। বিদ্যালয়ের পুরনো ক্লাসঘরগুলোর জানালা দিয়ে জ্যোৎস্না ঢুকেছে, ছায়াপাতের মতো আলোর রেখা ছড়িয়েছে মেঝেতে, আর সেই মেঝের মাঝখানে বসে আছে পিয়ালী, অঞ্জনা ও রাধিকা—হাতের মাঝে রাখা সেই পুরনো ডায়েরি, যেটি একসময় রুম্পা লিখত। রুম্পার আত্মা আজ তাদের সামনে ধরা দিয়েছে আরও স্পষ্টভাবে। তার কণ্ঠস্বরে ছিল এক অভিশাপের প্রতিধ্বনি, আবার ছিল এক শান্ত কাতরতা। “আমি চাই না আর কোনো মেয়ে আমার মতো শেষ হোক। কিন্তু যতক্ষণ না সত্যটা সামনে আসে, ততক্ষণ আমি মুক্ত হব না।” ডায়েরির একেকটা পাতায় একেকটা ভয়াবহ সত্যের ইঙ্গিত—যে সত্য এতদিন কেউ মুখ ফুটে বলেনি। সেই সত্যের কেন্দ্রে আছে একজন—শিক্ষিকা শালিনী মেম।

পরদিন দুপুরে তিনজনেই গেলেন সেই পুরনো লাইব্রেরিতে, যেখানে রুম্পা শেষবারের মতো দেখা গিয়েছিল। লাইব্রেরির ধুলো জমা তাকের মাঝে, একটি পুরনো বইয়ের ভাঁজে পাওয়া গেল একটি ছেঁড়া নোট—রুম্পার শেষ লেখা, যা ডায়েরিতে ছিল না। সেখানে লেখা ছিল, “আমার সত্যি কোনো অপরাধ ছিল না, আমি শুধু জানতাম এমন কিছু, যা জানার কথা ছিল না… আর তাই…” বাকিটুকু অস্পষ্ট, কালি ছড়িয়ে গেছে। পিয়ালীরা নিশ্চিত—এইখানেই কিছু লুকানো। পরদিন স্কুল শেষে তারা গিয়ে মুখোমুখি হলেন শালিনী মেমের সঙ্গে। তার চোখে ছিল এক অস্বস্তিকর স্তব্ধতা। যখন রুম্পার নাম উত্থাপন করল পিয়ালী, তখন শালিনী মেমের মুখের হাসি জড়সড় হয়ে গেল। “তোমরা যা খুঁজছ, সেটা খুঁজে পাওয়া তোমাদের পক্ষে ভালো হবে না,” গলা নামিয়ে বললেন তিনি। অথচ তার কণ্ঠে ছিল না কোনো দৃঢ়তা—বরং একরকম ভয়, যেন বহুদিন চাপা দেওয়া কোনো পাপ আজ ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে।

সন্ধ্যার পর আবার সেই পূর্ণিমার রাত। স্কুলের পেছনের সেই তালা দেওয়া সাইকেল স্ট্যান্ডের ঘর, যেখানে কেউ যায় না, সেখানেই রুম্পা তাদের নিয়ে গেল। ঘরের এক কোনায় মাটির নিচে পাওয়া গেল কিছু পুরনো কাগজপত্র—স্কুলের প্রশাসনিক রিপোর্ট, মেডিকেল সার্টিফিকেট, এবং শালিনী মেমের সই করা একটি ‘বয়ান’—যেটি বলছে রুম্পা মানসিক ভারসাম্যহীন ছিল। কিন্তু ডায়েরি বলছে ভিন্ন কথা। রুম্পা কাউকে লক্ষ্য করেছিল—একটি ‘অবৈধ সম্পর্ক’, যা একজন শিক্ষকের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল অন্য এক ছাত্রীর। সেই সত্য প্রকাশ পাওয়ার ভয়েই, তাকে চিরতরে থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। শালিনী মেম তখন সেই শিক্ষকের ঘনিষ্ঠ ছিলেন, এবং নিজের সম্মান বাঁচাতে, ওই ঘটনা ধামাচাপা দেন। পিয়ালীদের চোখের সামনে সত্য একে একে উঠে আসছে, কিন্তু প্রশ্ন একটাই—এই ভয়ানক সত্য সামনে আনলে, তার ফলাফল কী হবে? রুম্পা কি সত্যিই শান্তি পাবে? নাকি আর কেউ হারিয়ে যাবে এই নিষ্ঠুর ষড়যন্ত্রের ছায়ায়?

১০

রাতের আকাশে পূর্ণ চাঁদ ঝলমল করছে। স্কুল চত্বর যেন সেই চাঁদের আলোয় এক অন্যরকম মায়াজালে ঢাকা পড়েছে। কনখালি বালিকা বিদ্যালয়ের ঘড়িতে বাজে বারোটা। ছাত্রীদের ডরমেটরিতে নিঃস্তব্ধতা, কিন্তু পুরোনো লাইব্রেরি ঘরের দিকে এক অচেনা আলো টিম টিম করে জ্বলছে। রূপসা, অনুরাধা, চৈতালি আর মীনাক্ষী—চুপচাপ পা টিপে টিপে এগিয়ে যায় সেই দিকেই। আজই সেই রাত—শেষ পূর্ণিমা, যখন চাঁদনী আত্মা হিসেবে ফিরে আসে শেষবারের মতো। ভেতরের ঘরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে চাঁদনী, তার চোখে গভীর ক্লান্তি, কিন্তু ততধিক জেদ। হাতে একটি পুরোনো খাম—যার ভেতর রয়েছে তার ডায়েরির সেই শেষ পৃষ্ঠা, যে পৃষ্ঠাটি এতদিন গায়েব ছিল, যেটি আজ উন্মোচিত হলে স্কুলের গোপন চেহারাটা প্রকাশ্যে আসবে। তারা জানে, আজকের রাত তাদের শেষ সুযোগ। কারণ স্কুল কর্তৃপক্ষ আগামীকাল চিরতরে বন্ধ করে দিতে চলেছে লাইব্রেরি ঘরটি, সেখানেই লুকিয়ে আছে চাঁদনীর অতীত।

চাঁদনীর নির্দেশে মেয়েরা একত্রে মেঝে খুঁড়ে বের করে একটি ছোট লোহার বাক্স। বাক্স খুলতেই বেরিয়ে আসে একটি ধূলিধূসর ডায়েরি, যার শেষ পৃষ্ঠায় লেখা—”আমার মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলা হলেও, আমি মরিনি নিজের ইচ্ছায়। স্কুলের বাংলা শিক্ষিকা রঞ্জিতা মিস—তিনিই আমাকে সেই রাতে ডাকঘরে ডেকে পাঠান। আমি তো শুধু জানিয়েছিলাম ওনার বিরুদ্ধে অভিযোগ পৌঁছেছে প্রধান শিক্ষিকার কাছে। উনি ভয় পেয়েছিলেন। আমি বেরিয়ে আসতেই আমাকে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয় ছাদের ধার থেকে। আমি চেঁচিয়েছিলাম—কিন্তু রাত গভীর ছিল, আর কেউ জানল না। আমার মৃত্যু যে খুন, সেই প্রমাণ আছে এই ঘরে ক্যামেরার রেকর্ডিংয়ে, যেটা ছাদে লাগানো ছিল।” মেয়েরা বিস্ময়ে দেখে, সেই ডায়েরির নিচে লুকিয়ে রাখা একটি ছোট পেনড্রাইভ, যা চাঁদনীর মৃত্যুর মূল ভিডিও ধারণ করেছিল।

পরদিন সকালে কনখালি স্কুলে নতুন এক ভোরের সূচনা। স্থানীয় থানায় খবর দেওয়া হয়। পেনড্রাইভ জমা দেওয়া হয় প্রমাণ হিসেবে। রঞ্জিতা মিস ধরা পড়েন, তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে স্কুলের আর একাধিক গোপন সত্য। চাঁদনীর বাবা-মা যাদের একসময় বলা হয়েছিল তাদের মেয়ে আত্মহত্যা করেছে, আজ সেই অন্যায়ের প্রতিবাদে গলা তোলে গোটা গ্রাম। চাঁদনীর আত্মা আজ শান্তি পায়, সে আর ফিরে আসে না। কিন্তু তার ডায়েরি, তার সাহসী সহপাঠিনীরা, এবং সেই এক রাতের পূর্ণিমা—চিরকাল থেকে যায় স্কুলের ইতিহাসে। নতুন মেয়েরা আজ কনখালির সেই পুরোনো স্কুলের লাইব্রেরিতে বসে বলে, “তুমি ভুলে যেও না, সত্য কখনো চাপা পড়ে না। একটা পূর্ণিমা ঠিক ফিরে আসবেই।”

***

1000044249.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *