সৌভিক ঘোষ
১
কলকাতার সকালটা সেদিন একটু মেঘলা ছিল। আকাশটা ধূসর পট্টবস্ত্রের মতো ঝুলে ছিল শহরের উপর, আর অমিতের পা তখন হাঁটছিল বউবাজারের সরু গলিগুলোর ভেতর দিয়ে। হাতে ক্যামেরা, চোখে সেই চিরচেনা অনুসন্ধান—একটা ছায়া, একটা টেক্সচার, একটা গল্প। এই শহরটাই তার মিউজ, তার প্রেম, তার চিত্রনাট্য। একেকটা পুরনো বাড়ির জানালা, ধুলোমাখা গম্বুজ, ভাঙা ল্যাম্পপোস্ট—সব কিছুতেই সে খোঁজে সময়ের হারিয়ে যাওয়া সুর। কলেজ স্ট্রিট থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত তার রুটিনে পড়ে পুরনো বুকস্টল, প্রাচীন ছাপাখানা, ট্রামের লাইন বরাবর দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্পপোস্টগুলো। ক্যামেরার লেন্স যেন সময়কে আটকে রাখে। সে জানে, কলকাতা এক জীবন্ত মূর্তি, আর প্রতিটি ছবিতে তার মুখ বদলায়। কিন্তু আজকের দিনে কিছু একটা ছিল অস্বাভাবিক। ছবি তুলতে তুলতে অমিত আচমকাই থমকে গেল এক জায়গায়—একটা পিচঢালা রাস্তার ঠিক বাঁদিকের প্রাচীরের গায়ে সে দেখে একটা অবয়ব। ছবির মধ্যে সেই অবয়বটা এতটাই নিখুঁত, এতটাই জীবন্ত, যেন ক্যামেরার ফ্রেমে ঢুকে পড়েছে কোনো মানুষ—একজন মেয়ে, সাদা শাড়ি, লাল পাড়, মাথার পেছনে বিনুনি। চোখে মুখে এক অপূর্ব শান্তি আর দৃষ্টি যেন সোজা তাকিয়ে রয়েছে ক্যামেরার দিকে। অমিত বিস্ময়ে চোখ কচলায়, ছবি জুম করে দেখেও বিশ্বাস করতে পারে না। শুটিংয়ের সময় সে কাউকে দেখতে পায়নি, রাস্তাও ছিল একেবারে ফাঁকা। তা হলে এই মেয়েটা এল কোথা থেকে?
সে রাতে ঘুম আসেনি অমিতের। তার পুরনো ডেস্কটপে সে ছবিটা বারবার খুলে দেখে। লাইটিং চেক করে, ফ্রেমের এঙ্গেল মিলিয়ে দেখে, এমনকি সোশ্যাল মিডিয়ায়ও পোস্ট করে দেয় একটা ঝাপসা ভার্সন, ক্যাপশন দেয়—“Who is she?” পরের দিন ইনবক্স ভর্তি হয় কমেন্টে—“Is it a model?” “Love the vibe!” “Is this staged?”—কিন্তু সত্যি বলতে অমিত জানে, ওটা না মডেল, না সাজানো দৃশ্য। এটা যেন এক অনিচ্ছাকৃত রহস্য, এক রহস্যময় হস্তক্ষেপ যা তার ক্যামেরায় ঢুকে পড়েছে। পরের ক’দিনেও ছবি তুলতে বের হয় সে। এবারে কলেজ স্কোয়ার, উত্তর কলকাতার গলি, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউর পাশের পাটীগলি—প্রতিটি ছবিতে মেয়েটির উপস্থিতি ধরা পড়ে। কখনো ট্রামের জানালার ধারে বসে, কখনো রিকশার পিছনের আয়নায় প্রতিফলিত হয়ে, কখনো ধু ধু ছাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে—সেই একই মুখ, সেই একই শাড়ি। একটা অস্থিরতা গ্রাস করে অমিতকে, একটা আকর্ষণও বটে। এই মেয়েটা কে? কোথা থেকে এলো? আর কেনই বা তার ক্যামেরা ছাড়া কোথাও দেখা যায় না? তার ছবি তোলার ধরণ বদলে যায়। আগে সে শহরকে খুঁজত আলো আর ছায়ার খেলা দিয়ে, এখন সে খোঁজে সেই মেয়েটির ছায়া—যে আসলে একটা চরিত্র, একটা অলীক প্রেম, এক অদ্ভুত আকর্ষণ।
অমিত বুঝতে পারে, এটা নিছক প্রযুক্তিগত বিভ্রান্তি নয়। ক্যামেরার সেন্সর, আলো, ISO সব কিছু খুঁটিয়ে দেখে নেয় সে—সবই ঠিকঠাক। একদিন পুরনো ক্যাফেতে বসে, কফির কাপে ঠোঁট ছুঁইয়ে, সে বন্ধু রোহনের কথা ভাবে। রোহন হয়তো এটাকে নিছক প্যারানয়া বলে উড়িয়ে দেবে, কিন্তু অমিত জানে—তার ভেতরে কিছু পাল্টাচ্ছে। সে রাতের পর রাত কাটিয়ে দেয় ছবিগুলোর মধ্যে ওই মেয়েটিকে বিশ্লেষণ করে। তার হাঁটার ভঙ্গি, চুলের বাঁধন, চোখের রেখা—সব এক। কিন্তু প্রতিবার, একেকটা ভিন্ন ভঙ্গিতে সে আসে, যেন শহরের সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠেছে। যেন শহরই তাকে পাঠাচ্ছে অমিতের কাছে। অমিতের মন বলে, এ কেবল ছবি নয়—এ প্রেম। হয়তো কল্পনার প্রেম, হয়তো এক অতীতের টান, হয়তো সে-ই সেই মেয়ে, যার জন্য শহরটা তাকে এতদিন ধরে ডাকছিল। শহরটার মধ্যে কিছু আছে, যেটা তাকে খুঁজে নিতে বলছে সেই মেয়ের গল্প। অমিত ঠিক করে, সে থামবে না। সে আবারও যাবে গলিগুলোর মধ্যে, আবারও ছবি তুলবে, আর খুঁজবে তাকে—সেই মেয়েটিকে, যে আসলে একটা ছায়া, একটা অভিমান, আর হয়তো… এক অলীক ভালোবাসা।
২
বৃষ্টির গন্ধে শহরটা আরও বেশি করে পুরনো হয়ে ওঠে। অমিতের মতে, কলকাতা যখন ভিজে যায়, তখন তার রংগুলো সজীব হয় না—বরং আরও বিবর্ণ, আরও প্রাচীন হয়ে যায়। সেই বিকেলে, গঙ্গার ধারে রূপচাঁদ মিত্র ঘাটে বসে, সে ক্যামেরা হাতে ঝড়ো আকাশের নিচে একের পর এক ক্লিক করে চলছিল। জল আর আকাশের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা গঙ্গার ঘাট, নৌকার বৈঠা, ছিঁড়ে যাওয়া গামছা—সবকিছু যেন এক বিষণ্ণ সংগীতের মতো। কিন্তু প্রতিটি ছবির মধ্যেই আবার সেই মেয়েটি। এইবার, সে সিঁড়ির শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে, এক হাতে চুড়িদার ছাতা, অন্য হাতে ছোট্ট একটা পুঁতির ব্যাগ। তার চোখ যেন সোজা অমিতের দিকে তাকানো, কিন্তু অমিত তোলার সময় কোনো মেয়েকে তো দেখেইনি! সে আবার ছবিগুলোর ডেট দেখে—সবই সঠিক। কোনো সফটওয়্যারের গ্লিচ? কিন্তু DSLR-এ তো AI নেই, কোনো Filter-ও প্রয়োগ করেনি। তাহলে কীভাবে, কীভাবে সেই মেয়েটি… ঠিক একইভাবে আবার এসেছে, আরও স্পষ্ট, আরও জীবন্ত?
পরদিন রোহনের সঙ্গে দেখা হয় কফিহাউসে। অমিত তার ক্যামেরা ব্যাগ থেকে একটা পেনড্রাইভ বের করে দেয় রোহনের হাতে—“দেখবি এটা। সব ছবি একই মাসে তোলা, অথচ প্রতিটায় সেই একই মেয়ে।” রোহন প্রথমে হেসেই ফেলে, বলে, “তোকে বলেছিলাম না, একা থাকিস বেশি দিন, মাথার উপর দিয়ে যাবে একদিন।” কিন্তু তার মুখের হাসি জমে যায় যখন সে ছবিগুলো দেখে। একটার পর একটা ছবি, কোনোটা হাতিবাগানের বইপাড়ায়, কোনোটা শোভাবাজার মেট্রো স্টেশনের ওপরে, আবার একটা ছবিতে—যেখানে অমিত শুধু একটা ধূলিধূসরিত দেয়াল তুলেছিল, সেখানে রঞ্জার ছায়ামূর্তি জানালার ফ্রেমে। রোহন ঠোঁট চেপে বলে, “তোর কেউ যদি পুরনো ছবি হ্যাক করে এমন করে রাখে?” কিন্তু অমিত জানে, এমন কিছু হয়নি। রোহনের গলায় নেমে আসে কিছুটা ভয়—“তোর ক্যামেরা কি কেউ আগেই ইউজ করছিল?” অমিত চুপচাপ মাথা নাড়ে। সে জানে, ব্যাখ্যা খোঁজা এখন অর্থহীন। এই মেয়েটিকে সে খুঁজে পাচ্ছে শুধু ক্যামেরার মধ্যেই। না তার চারপাশে, না শহরের ভিড়ে—শুধু সেই মুহূর্তে, যখন সে ছবির শাটার টিপে।
রাত বাড়তে থাকে, কিন্তু অমিতের ঘুম আসে না। তার মাথায় ঘুরতে থাকে একটাই প্রশ্ন—এই মেয়েটা কে? তার চেহারার মধ্যে কোনও অতিপ্রাকৃত ছায়া নেই, বরং সে খুবই বাস্তব—একটা নিখুঁত বাস্তবতা যার মধ্যে ঢুকে আছে নিরবধি কোনো অভিমান। তার হাসিটা অনেকটা পুরনো দিনের, যেন হারিয়ে যাওয়া রেকর্ড প্লেয়ারের গানের মতো। অমিত প্রতিবার তাকানোর সময় নিজের ভেতরে একটা অচেনা আকর্ষণ অনুভব করে—যা কল্পনার নয়, বরং ঠিক যেন চেনা। এমন এক চেনা, যা হয়তো কোনো জন্মের, হয়তো কোনো পুরনো গল্পের, বা কোনো স্বপ্নের। অমিত তখনই সিদ্ধান্ত নেয়—সে মেয়েটিকে খুঁজবে। বাস্তবে না হোক, ছবির মধ্যেই। ক্যামেরা তখন শুধুমাত্র স্মৃতি ধারণ করার যন্ত্র নয়, বরং এক দরজা, যেখান দিয়ে সময়ের বাইরে যাওয়া যায়। রঞ্জার প্রতিটি উপস্থিতি যেন একটি সংকেত, একটা ম্যাপ, এক প্রেমপত্র, যা শহরের অলিগলির মধ্যে রেখে গেছে কেউ। অমিত তখন বোঝে, সে শুধু ছবি তুলছে না—সে খুঁজছে নিজের অজানা কোনো হারানো অংশকে।
৩
কলেজ স্ট্রিটের সেই তিনতলা দালানটা বরাবরই একটা অদ্ভুত গন্ধ ছড়ায়—পুরোনো কাঠ, ধুলো, ছাপাখানার কালি আর বৃষ্টিতে ভেজা শ্যাওলা। অমিত এখানে থাকে তিন বছর ধরে। তার ঘরটা একপাশের রেলিং-ঘেরা ছোট্ট চিলেকোঠা—যেখানে জানালা খুললেই দেখা যায় অজস্র পুরনো ছাদ, জলজমা কার্নিশ, আর দূরে কলেজ স্ট্রিট মোড়ের বইওয়ালাদের ছোট ছোট ছাউনি। আজ সন্ধেবেলা অমিতের মনটা অস্থির। বিছানার ওপরে ছড়িয়ে আছে ছয়-সাতটা প্রিন্টেড ফটো—সবগুলোতেই রঞ্জা। সে যেন একেকবার একেক মনোভাব নিয়ে আসে—কখনো উদাস, কখনো খানিকটা হাসি-মাখা, আবার কখনো এমন চাহনি যেন কিছু বলতে চায়। হঠাৎ করেই দরজায় কড়া নাড়ে কেউ—অমিত গিয়ে দেখে, মাসিমা দাঁড়িয়ে আছেন, একটা মাটির বাটিতে ভেজা চানাচুর নিয়ে। “তোর আবার টং থেকে কিছু আনার সময় ছিল না, তাই ভাবলাম…” তিনি হেসে বলেন। অমিত তাঁকে ঘরে বসতে বলে, আর ছবি গুলো গুছিয়ে ফেলার চেষ্টা করে। কিন্তু মাসিমার চোখ আটকে যায় টেবিলের এক ছবিতে—যেটা কলেজ স্কোয়ারের, আর যেটার ঠিক মাঝখানে রঞ্জার মুখ। “এই ছবিটা কোথায় তুললি রে?” মাসিমার গলা কেমন যেন বদলে যায়। অমিত বলে, “গত সপ্তাহে। কিন্তু আপনি কী চিনতে পারলেন?” মাসিমা চেয়ারটায় বসে, দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। তারপর নিচু গলায় বলেন, “এই মুখ আমি অনেক বছর আগে দেখেছি, এই দালানেই।”
মাসিমার কণ্ঠে ঝুলে থাকা অতীতের ভার যেন ঘরটাকে আরও অন্ধকার করে তোলে। “তখন আমি সদ্য এসেছি কলকাতায়, সদ্য স্কুলে জয়েন করেছি। এই দালানে এক পরিবার থাকত, তিন নম্বর ঘরে—মাথায় চুল বেঁধে রাখা শান্ত, ধীর একটা মেয়ে ছিল তাদের মেয়ে। নাম ছিল রঞ্জাবতী। সবাই ডাকত ‘রঞ্জা’। সে খুব অদ্ভুত ছিল, জানিস তো? বৃষ্টির মধ্যে ছাদে উঠে বই পড়ত, রোদ উঠলে ছাদের এক কোণায় দাঁড়িয়ে ট্রামের শব্দ শুনত। কোনো বন্ধু ছিল না, কিন্তু একবার চোখে পড়লে ভুলতে পারবি না—ওর সেই চাহনি, সেই হাসি… ঠিক তোর ছবির মতো।” অমিত স্তব্ধ হয়ে শোনে, যেন তার ভিতরে কিছু গলতে শুরু করেছে। “একদিন সে হঠাৎ হারিয়ে গেল। কাউকে কিছু না বলে, কোনো চিঠি না রেখে। বহু খোঁজাখুঁজির পর তার বাড়ির লোক থানায় জানায়, পরে শুনি, একটা পুরনো বইয়ের দোকানদার বলেছিল—‘শেষবার ওকে দেখেছে কলেজ স্ট্রিটের মাঝের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে, রিকশার পেছনে চড়ে যাচ্ছিল কোনো অজানা দিকে’। তারপর আর খোঁজ মেলেনি।” মাসিমার গলা ভারী হয়ে আসে। “তোর ছবির মেয়েটা ওর মতনই দেখতে রে অমিত। না, একেবারে হুবহু। শুধু পোশাক বদলায়নি, মুখও বদলায়নি। সেই একই রঞ্জা।”
অমিত জানে না কী বলবে। তার ভিতরে ঝড় বয়ে যায়। তার হাতে তখন সেই ছবিটা—রঞ্জার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি, চোখে সেই চেনা উদাসিনী। সে কি তবে পুরনো কোনো আত্মা? সময়ের গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া এক মেয়ে? না কি সে শুধু অমিতের কল্পনা? মাসিমা উঠে পড়েন, আর চলে যাওয়ার আগে বলেন, “যদি রঞ্জাকে আবার দেখিস, তাকে বলিস—এই শহর আজও তাকে ভুলতে পারেনি।” দরজা বন্ধ হয়ে যায় ধীরে, আর অমিত চুপচাপ বসে থাকে। ছবিটা হাতে নিয়ে সে একটানা তাকিয়ে থাকে রঞ্জার মুখের দিকে, যেন বোঝার চেষ্টা করে সে কি শুধুই এক মুখ—না কি একটা জীবন, এক প্রেম, যে ফিরে আসছে শহরের স্মৃতিতে, প্রতিটি ইট, প্রতিটি ভিজে দেওয়ালে। চিলেকোঠার জানালা দিয়ে তখন বাইরের ঝিরঝিরে বৃষ্টি আর ট্রামের টিংটিং শব্দ মিলে এক সুর বেঁধে দেয়, ঠিক যেন রঞ্জার ফিসফিসে কণ্ঠস্বর—যেটা কেবল অমিতই শুনতে পায়।
৪
সন্ধ্যা নামছিল ধীরে ধীরে। শহরের মাথায় নেমে এসেছিল একপ্রকার বেগুনি আলো, ঠিক যেন ক্লান্ত দিনটা রঙে রঙে ঘুমোতে যাচ্ছে। অমিত সেই সময় দাঁড়িয়ে ছিল মহাত্মা গান্ধী রোড মেট্রো স্টেশনের গেটের সামনে, হাতে তার প্রিয় ক্যানন ক্যামেরা। নিচে নামবার আগেই সে ছবিটা তুলেছিল—স্টেশনের সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসা অসংখ্য মুখের ভিড়ে হঠাৎ যেন আবার চোখে পড়ে সেই মুখটা। এক মুহূর্তের জন্য তার নিঃশ্বাস আটকে যায়। হ্যাঁ, সে—মেয়েটি—ছবির মতোই নিখুঁত, অচেনা অথচ চেনা, দূরের অথচ অনেক কাছের। তবু সমস্যা হলো এই যে, সে ছিলও না, আবার ছিলও। অমিত ছুটে নামল নিচের দিকে, মেট্রোর প্ল্যাটফর্ম অবধি। চোখের সামনে সে চলে এল, লোকালয়ের মধ্যে হেঁটে চলেছে ধীরে ধীরে, কাঁচের দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। মেয়েটি একবার তাকিয়েছিল, কিন্তু কোনো অভিব্যক্তি ছিল না চোখে—শুধু চুপচাপ স্থির, যেন কোনও প্রাচীন ফ্রেমে আঁকা ছবি।
সেই রাতটা অমিতের ঘুমোতে যায়নি। বাড়ি ফিরে সে আবার ল্যাপটপ খুলে ছবিগুলো দেখতে বসেছিল। আজকেরটাও তোলা হয়েছিল। সেই ছবিতেও, আশ্চর্যের বিষয়, মেয়েটি স্পষ্ট—আর পাঁচজন যাত্রীদের ভিড়ে একেবারে প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে, তাকিয়ে আছে ক্যামেরার লেন্সের দিকেই। তবে আশ্চর্য এই যে, মেট্রোতে ঢোকার আগে সে ছবিটা তুলেছিল, আর মেয়েটিকে দেখেছিল তোলার পরে। এমন অসময়ের মিল কোথা থেকে আসে? অমিত ছবির জুম করে দেখে, তার শিরদাঁড়ায় হিমস্রোত বয়ে যায়—মেয়েটির চোখ যেন বুঝে বুঝে তাকিয়ে আছে তার দিকে, জানে সে এখানে ছবি তুলছে। অতীত আর বর্তমানের গণ্ডি কি এমনভাবে মিশে যেতে পারে? কে সে? কেন তার প্রতিটি ছবি যেন তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে? অনেকগুলো প্রশ্ন মাথায় ঘুরতে থাকে, আর সে নিজেকে প্রশ্ন করে—‘আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি?’ এরপর রাতে, ঘুমের ভিতরেও, স্বপ্নে বারবার ফিরে আসে সেই স্টেশন, সেই চোখ, সেই চেনা মুখ, আর তার চারপাশে অন্ধকারে ঢেকে যাওয়া শহরের ছায়া।
পরদিন সকালে সে ঠিক করল—আর অপেক্ষা নয়। তাকে খুঁজে বার করতেই হবে। হয় বাস্তব, নয় কল্পনা—কিন্তু সীমানা পরিষ্কার করতে হবে। ক্যামেরা নিয়ে সে আবার বেরিয়ে পড়ে, এইবার সোজা চলে যায় দমদম মেট্রো স্টেশন থেকে মহাত্মা গান্ধী রোড পর্যন্ত সমস্ত স্টপগুলোর ছবি তুলতে। প্রতিটা জায়গায় সে ক্যামেরা তাক করে রাখে, চোখ খোলা রাখে, আর অপেক্ষা করে সেই মেয়েটির দেখা মেলার। কিন্তু আজ যেন শহর চুপচাপ, যেন সে জানে না এই অমিতের প্রশ্নগুলো। অথচ, স্টেশনের যাত্রীদের ভিড়ের মধ্যে, কোথাও না কোথাও, তাকে মনে হয় আবার এক ঝলক দেখেছে—মেয়েটিকে, দূরে দাঁড়িয়ে, চোখে চিরপরিচিত বিষণ্ণতা নিয়ে তাকিয়ে আছে। প্ল্যাটফর্মে সে ছুটে গেল, কিন্তু সেখানে কেউ ছিল না, শুধু হাওয়ায় দুলছিল এক নারকেল তেলের গন্ধ, আর কাগজে মোড়া এক বেগুনির ঠোঙা। হঠাৎ মনে হলো, শহরটা যেন অদ্ভুতভাবে জ্যান্ত হয়ে উঠেছে, যেন সেই মেয়েটিকে লুকিয়ে রাখছে—কিন্তু কোথায়? কিভাবে? অমিতের মধ্যে সেই মুহূর্তে জন্ম নিল এক নতুন মুগ্ধতা—এখন সে শুধু একজন ফটোগ্রাফার নয়, সে এক প্রেমিক, এক অনুসন্ধানকারী, আর তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক অদৃশ্য সময়ের দরজা।
৫
ভোরের কলকাতা যেন অন্য এক শহর—যেখানে পুরনো রাজবাড়ির ছায়া মিশে থাকে রাস্তাঘাটের গায়ে, আর কুয়াশার চাদরে ঢাকা থাকে প্রাচীন অলিগলি। সেই সকালেই অমিত পা রেখেছিল হেদুয়া লেনে, যেখানে একবার গিয়ে ছবি তুলেছিল তিন মাস আগে। তখনকার তুলনায় আজ একেবারে অন্যরকম লেগেছিল—বাড়ির দেয়ালে সাদা রঙের ছোপ, জানালায় পুরনো গ্রীলের ফাঁক দিয়ে হাওয়া ঢুকছে আর হঠাৎ একটা পেছনের বারান্দা থেকে ভেসে এলো গানের সুর—আবছা এক নারীকণ্ঠ, যেন রবীন্দ্রসঙ্গীত, আবার যেন নিঃশব্দ আর্তি। সে থেমে গেল, ক্যামেরা ঝুলছে গলায়, অথচ লেন্সে ফোকাস নেই তার—মনে হচ্ছে, সব ভুলে গিয়েছে সে, শুধু শোনার মধ্যে ডুবে আছে। গলা যেন চেনা, যেন বহুদিন ধরে সে শুনে এসেছে সেই কণ্ঠস্বর—কিন্তু কোথায়, কবে? ছবিতে? স্বপ্নে? অমিত জানে না।
একটু সাহস করে সে এগিয়ে গেল গলির ভেতরে, পেছনের দরজা দিয়ে উঠল সিঁড়ি। সবকিছু অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিল—কে যেন অদৃশ্য কোনো যাদুতে টেনে নিয়ে চলেছে তাকে। ছাদে উঠে সে খালি চেয়ারে বসে থাকা এক নারীমূর্তিকে দেখতে পেল। হালকা কুয়াশার চাদরে মোড়া সেই মুখ, ঢেকে থাকা চুল, চোখে মুগ্ধতা আর যন্ত্রণার মিশেল। অমিত কিছু বলার আগেই, মেয়েটি ঘুরে তাকাল—চোখে চেনা আকুতি, মুখে নির্লিপ্ত হাসি। “তুমি অনেক খুঁজেছ, তাই না?”—কণ্ঠস্বর ঠিক সেই, যেটা সে শুনেছে প্রায় প্রতিটি ছবির ভিতর, প্রতিটি নিস্তব্ধ দুপুরে, প্রতিটি স্বপ্নের রাতে। কিন্তু প্রশ্নটা যেন উল্টোভাবে আঘাত করল অমিতকে—এই মেয়েটি জানে যে সে খুঁজেছে? সে আবার প্রশ্ন করে, “তুমি কে?” মেয়েটি দাঁড়িয়ে রেলিং-এর পাশে যায়, নিচের রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলে, “আমার নাম অন্বেষা। কিন্তু তুমি আমায় ‘ছবির মেয়ে’ বলেই ডাকতে চাও, তাই না?” অমিত কিছু বলার আগেই সে হেসে ওঠে, যেন সব উত্তর তার জানা।
কিন্তু মুহূর্তেই সেই দৃশ্য মিলিয়ে গেল। কুয়াশা ঘন হল, অমিতের দৃষ্টিতে আবছা হয়ে গেল সবকিছু। ছাদের দিকে তাকিয়ে সে দেখে, কেউ নেই—কোনো চেয়ার নেই, কোনো ছায়াও নেই। ঘড়িতে সকাল সাড়ে ছ’টা। বুক ধকধক করছে, ঠোঁট শুকিয়ে গেছে। এই তো দেখল—কথাও হল। তাহলে? সে নিচে নেমে আসে, বারান্দার কাছে এসে দাঁড়ায়। দরজা বন্ধ, তালাবদ্ধ। বাইরে পোস্টারের কাগজে লেখা—”এই বাড়িটি পরিত্যক্ত, কলকাতা পৌরসভার আওতাধীন।” সে স্তব্ধ দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ, ক্যামেরার ভিতরের ছবি খুলে দেখে—হেদুয়ার সেই বাড়ির ছাদে সে এক মেয়ের ছবি তুলেছে। স্পষ্ট, রক্তমাংসের মতনই। কিন্তু বাস্তবের চোখে? সেখানে শুধু শূন্যতা।
৬
অমিতের মাথাটা যেন ধোঁয়ায় মোড়া। শোভাবাজার মেট্রো থেকে উঠে সে হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছেছে রাজবাড়ির সামনে। বিকেলের শেষ আলোয় রাজবাড়ির পোড়া দেওয়ালের ছায়া পড়েছে সামনের লাল ইটের পথজুড়ে। সে জানে না কেন এখানে এসেছে—কেবল বুকের গভীর একটা টান তাকে বারবার এই শহরের পুরনো অলিগলির দিকে টেনে নিয়ে যায়। রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সে আবার সেই অদ্ভুত অনুভূতিটা পায়—ক্যামেরার লেন্সে দেখা মেয়েটির উপস্থিতি যেন চারপাশের বাতাসেও মিশে আছে। এক সময় তার চোখ পড়ে পাশের টঙ দোকানের চায়ের কাপের ধোঁয়ার দিকে—ধোঁয়ার ভেতরও যেন খুঁজে পায় সেই চোখ দুটো, যেগুলোর মুখ সে আজও বাস্তবে পায়নি। হঠাৎ পিছন থেকে একটা হালকা গলা ভেসে আসে—“তুমি কি এখানে আগেও এসেছিলে?” অমিত চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়ায়। সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে—সাদা কুর্তি, মাথায় খোঁপা, চোখে অপার গভীরতা। সে কিছু বলতে চায়, কিন্তু গলার স্বর শুকিয়ে আসে।
মেয়েটি আবার বলে, “তুমি আমার ছবি তোলো কেন?” এবার অমিতের হঠাৎ মনে পড়ে—শোভাবাজার রাজবাড়ির পেছনের জানালার একটা ফ্রেমে সে একটি মেয়ের অবয়ব তুলেছিল, বহুদিন আগে। সেদিন বৃষ্টির পর ছিল, ক্যামেরায় ক্লিক করার মুহূর্তে এক ঝলক যেন কাউকে দেখতে পেয়েছিল সে। অমিত হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, “তুমি… তুমি কি সত্যি?” মেয়েটির মুখে এক রহস্যময় হাসি খেলে যায়। “তুমি বিশ্বাস করবে না, কিন্তু আমি তোমার ক্যামেরার মধ্যেই বাস করি। ছবির মধ্যেই আমার জায়গা। কিন্তু কিছু কিছু মুহূর্তে আমি বাইরে আসতে পারি—যখন কেউ আমাকে সত্যি করে দেখতে চায়।” অমিত চুপ করে যায়। তার মাথা ঘুরতে থাকে। এটা কি স্বপ্ন? নাকি কোনও মানসিক বিভ্রম? তবু, চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই মেয়েটির উপস্থিতি এতটাই বাস্তব যে নিজের যুক্তিবুদ্ধিরও সে ঠিক ঠিক খোঁজ পাচ্ছে না।
তারা দুজনে ধীরে ধীরে হেঁটে যায় রাজবাড়ির পাশের গলিতে। অমিত চায় না এই মুহূর্তটা শেষ হোক। সে জানতে চায় মেয়েটির নাম, পরিচয়, অতীত। কিন্তু মেয়েটি শুধু বলে, “আমার কোনও নাম নেই। তবু তুমি চাইলে একটা নাম দিতে পারো।” অমিত বলে, “তোমাকে আমি নাম দেবো আলো। কারণ তুমি যেন আলোই, তবে সেই আলো যা ছায়ার নিচে লুকিয়ে থাকে।” মেয়েটি হাসে, “তুমি জানো না, আমি আসলে কে।” হঠাৎ করেই চারপাশের আলো ম্লান হয়ে আসে। মেয়েটি ফিসফিস করে বলে, “শহরটা জানে না, আমার মতো অনেকেই আছে এই কলকাতায়—ছবির ভেতর বেঁচে থাকা, স্মৃতির ক্যানভাসে আটকে পড়া আত্মারা, যারা খোঁজ করে ভালোবাসার, স্বীকৃতির। তুমি আমাকে দেখেছ, ডেকেছ—তাই আমি আসতে পেরেছি।” অমিত এবার থেমে দাঁড়ায়। তার মনে পড়ে যায় বহু পুরোনো ছবি, কলকাতার ছায়াময় অলিগলি, প্রতিটি ছবিতে ধরা পড়া এক ঝলক কৌতূহল। সে বুঝতে পারে, তার যাত্রাটা শুধু একজন মেয়েকে খুঁজে পাওয়ার নয়, এই শহরের গভীর ইতিহাস আর বিস্মৃত আত্মাদের চোখে চোখ রাখার।
৭
চৈত্র মাসের শেষ দিকে কলকাতার আকাশে এক অদ্ভুত রকমের নীলেমি থাকে। ধুলো জমা হাওয়ার মধ্যে দিয়েও এক স্বচ্ছ, অলীক আলো ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। অমিত সেদিন গিয়েছিল গড়িয়াহাট ফ্লাইওভারের নিচে পুরনো ক্যামেরা মেরামতির দোকানে। একটা লেন্সের ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া ফোকাস রিং ঠিক করাতে হবে। ফেরার সময় সে ট্রাম লাইনের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে হিন্দু স্কুলের সামনে পৌঁছে গেল—কেন, সে নিজেও জানে না। যেন পা-দুটো নিজের ইচ্ছেতে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কোনো দিকচিহ্নহীন অভিমুখে। পেছনে একবার তাকিয়ে দেখে নিল, আর কেউ তাকে অনুসরণ করছে কি না। সামনের রাস্তা পেরিয়ে সে পৌঁছোল প্রেসিডেন্সি কলেজের পিছনদিকের গলি, যেখানে একটা পুরনো সাদা বাড়ি আছে—যার দরজার সামনে পিলারের গায়ে ছোট করে লেখা ‘নন্দিনী লজ’। অমিত জানে, এই বাড়ির গায়ে সে একবার ছবিতে দেখেছিল সেই মেয়েটিকে—যার মুখ মনে পড়লে আজও শিউরে ওঠে তার স্নায়ু।
অমিত ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে আসে, বাড়ির পাশে রাখা ভাঙা চেয়ারটার ওপর বসে পড়ে। তার মনে পড়ে, এইখানে বসেই সে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছিল—যেখানে মেয়েটি সাদা শাড়িতে দাঁড়িয়ে ছিল, হাতে ছিল একটি জলরঙের খাতা। সেই খাতার পাতাগুলোয় ছিল অমিতেরই তোলা ছবি—কিন্তু প্রত্যেকটি ছবির মধ্যে সে মেয়েটি নিজের হাতে রঙ করে ঢুকিয়ে দিয়েছিল নিজের অবয়ব। “আমাকে তুমি বানিয়েছ, আমি কিন্তু ঠিক বানিয়েছি আমার মতো করে,” স্বপ্নে মেয়েটি বলেছিল। তখনও সে জানত না, এ স্বপ্ন না বাস্তব। এখন সেই কল্পনার বৃত্তে ঢুকে পড়ে অমিত টের পাচ্ছে, মেয়েটি শুধু তার তোলা ছবির অংশ নয়—তার স্মৃতির রংতুলিও ওই মেয়েটির হাতে। অথচ মেয়েটি তো বাস্তবে নেই—নাকি আছে? এই দ্বিধার মাঝখানে দাঁড়িয়ে অমিতের শরীর ঘামে ভিজে উঠল, অথচ বাতাস ঠান্ডা। হঠাৎ সে শুনল কারো পায়ের শব্দ—জলপত্রে ভেজা পদক্ষেপ। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে, মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক সেইরকমই, যেমন করে সে ছবির ফ্রেমে তাকে দেখেছে—না এক ফোঁটা বেশি, না একচুল কম। কাঁধে সাদা ব্যাগ, চোখে এক অনন্ত নীরবতা। দু’জনের চোখ আটকে যায়। অমিত দাঁড়িয়ে পড়ে, কিছু বলার আগেই মেয়েটি বলে ওঠে—“তুমি কি এবার আমার ছবিটা তুলবে, নাকি তোমার ফ্রেমেই আটকে রাখবে আমায়?”
চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে অমিত, গলার শব্দ শুকিয়ে গিয়েছে। তার হাতে ক্যামেরা নেই, কাঁধে নেই ব্যাগ। এই প্রথমবার সে বুঝল, এই মেয়েটির উপস্থিতি কোনো যান্ত্রিক চিত্রগ্রহণে ধরা পড়ে না। তাকে দেখতে হলে নিজের হৃদয়ের ভেতরের লেন্স ব্যবহার করতে হয়। মেয়েটি ধীরে ধীরে হেঁটে চলে যায় রাস্তার অন্য প্রান্তে, যেখানে দিনের আলো গলা টিপে ধরে রেখেছে রাতের ছায়া। অমিত তার দিকে হাঁটা শুরু করে—কিন্তু যেন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তার ছায়া। এক মুহূর্তে সে টের পায়, এই যে শহর কলকাতা, এই রাস্তাগুলো, এই অলি-গলি—সবই কোনো জলরঙের পাতার মধ্যে আঁকা। তার সমস্ত বাস্তব, সমস্ত প্রেম—এই মেয়েটির সৃষ্টি। নাকি সে-ই অমিতের? কে কার সৃষ্টি—এই প্রশ্নের উত্তরে একমাত্র কলকাতা নিজেই জানে উত্তর।
৮
একটা শীতল সন্ধ্যা। অক্টোবরের শেষ ভাগ, কলকাতার আকাশটা ঝাপসা বৃষ্টি আর মেঘে ঢাকা। অমিত তখন শ্যামবাজার থেকে ফিরে এসেছিল, ক্লান্ত মন আর হাতভর্তি ছবি নিয়ে। মেট্রোর গম্ভীর গর্জনে ভেসে আসা অস্পষ্ট কথাবার্তা, রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের অসাড় দৃষ্টির ভিড়ে একটা অদ্ভুত খাঁ খাঁ ভাব ঢুকেছিল তার ভেতরে। বাসায় ফিরে ল্যাপটপে ছবিগুলো তুলছিল—পুরনো ফাইলগুলো খুলেই সে চমকে উঠেছিল। আগের দিনের বউবাজারের যে ছবিটা তুলেছিল, তাতে মেয়েটা নেই—অথচ আগের রাতে সে তো পরিষ্কার দেখেছিল মেয়েটা ওই ভাঙা দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। চোখে চোখ রেখেছিল অমিতের ক্যামেরার লেন্সের সঙ্গে। কণ্ঠ শুকিয়ে আসে তার—কে এই মেয়ে? শুধুই কল্পনা, নাকি এই শহর তাকে কোনো উত্তর দিতে চাইছে?
রাতে ঘুম এলো না। বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালো অমিত। বাইরের রাস্তায় একটা কুকুর ডাকছিল, হাওয়ায় ডানাকাটা খবরের কাগজ উড়ছিল। তার মাথায় একটা নাম ঘুরছিল—‘উত্তর কলকাতা’। মনে হচ্ছিল, উত্তর কলকাতার পুরনো গলিগুলো যেন তাকে ডাকে, সেইসব খোলা জানালার ভেতর থেকে কেউ যেন তাকিয়ে থাকে। শেষরাতের দিকে, দোতলার ঘুমন্ত শহর হঠাৎ জীবন্ত হয়ে উঠল। অমিত যেন শুনতে পেল ঘন্টাধ্বনি, পায়রার ডানা ঝাপটানো, আর তার ঘাড়ের পেছনে কারও নিঃশ্বাস। সে ধীরে ধীরে ঘুরে তাকাল—কেউ নেই। তবু, বুকের ভেতরে অদ্ভুত এক অনুভূতি জমছিল—এই মেয়েটি, যাকে সে খুঁজছে, তাকে শহর লুকিয়ে রেখেছে, আবার শহরই তাকে এনে দিচ্ছে নতুন করে।
পরদিন সকালে সে বের হলো, গন্তব্য চুড়িবাজার। কিছুদিন আগেই সেখানকার একটা পুরনো লোহার ফটকের ছবি তুলেছিল, যেটাতে মেয়েটার ছায়া দেখা গিয়েছিল—মাথায় নীল ওড়না, চোখে দৃষ্টির ঝলক। আজ সেখানে গিয়ে সে একা দাঁড়িয়ে ছিল অনেকক্ষণ। পেছন থেকে ভেসে এল এক মেয়েলি কণ্ঠ, “অমিত?”—একটা নিঃশব্দ বিস্ফোরণের মতো শব্দটা তার কানে পৌঁছাল। সে ঘুরে তাকালো—আর চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল এক অবিশ্বাস্য আলো। মেয়েটি সামনে দাঁড়িয়ে ছিল—একদম ছবির মতো, একদম আগের মতো নিখুঁত। নীল ওড়নায়, ম্লান হাসিতে, শান্ত চোখে তাকিয়ে সে যেন বলল—“তুই খুঁজছিলিস তো?” অমিত কোনো কথা বলতে পারল না। শুধু একবার ক্যামেরার শাটার টিপে দিল—শহর, মেয়ে আর সময়ের প্রতিটি স্তর মিশে গিয়ে তৈরি করল এক অনির্বচনীয় প্রতিচ্ছবি।
৯
বিকেলটা মেঘলা। আকাশের ধূসর মেঘে ছেয়ে আছে গোটা শহরটা, যেন কলকাতার আত্মাও আজ বোঝার অপেক্ষায়। অমিত ক্যামেরা হাতে শিয়ালদহ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে। হাজারো মুখ, অজস্র কণ্ঠ, ছুটন্ত মানুষেরা—এই কোলাহলকেই তার পছন্দ। কিন্তু আজকের সন্ধ্যা অন্যরকম। এক অদ্ভুত অস্থিরতা ছেয়ে আছে তার মনে। অমিত জানে, মেয়েটি—যে তার প্রতিটি ছবিতে নিখুঁতভাবে ধরা পড়ে—আজ আবার দেখা দেবে। হয়তো ভিড়ের মধ্যেই থাকবে, আবার হয়তো দূরে কোনো ধোঁয়াটে ট্রেনের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে। এমনই এক মুহূর্তে হঠাৎ তার চোখ যায় একটা পুরনো দেওয়ালের দিক। সাদা-কালো পোস্টারের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির মুখটা তার হৃদয় ছিঁড়ে ফেলে—এ তো সেই মুখ, সেই চাহনি। কিন্তু ভিড়ের আবরণে সে মুহূর্তে মেয়েটি মিলিয়ে যায়।
মন খারাপ করে সে চিৎপুরের দিকে পা বাড়ায়। পুরনো কসাইপট্টি, ভাঙা রাস্তা, ধূসর আলোয় ছেয়ে থাকা গলি। অমিত আগে কখনো এই জায়গাটায় আসেনি। তবে আজ যেন এই পথই তাকে ডাকছে, অনন্ত কোনো রহস্যের দিকে। হঠাৎ এক পুরনো বইয়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায় সে। দোকানটা যেন এককালে বেশ জমজমাট ছিল, এখন কেবল ধুলো আর স্মৃতির পাহাড়। দোকানের কোণায় ঝুলে থাকা একটি ফটো তাকে আকর্ষণ করে—এক পুরনো থিয়েটারের ছবি, যেখানে মেয়েটি একটা চরিত্রে অভিনয় করছে। ছবির নিচে লেখা—“নবনীতা – ১৯৪৬”। অমিত থমকে যায়। নবনীতা? এটা কি তার নাম? সে কি তাহলে কোনো এক পুরনো সময়ের চরিত্র? কিন্তু কিভাবে তার ছবিগুলোতে সে এভাবে ফুটে ওঠে? উত্তর খোঁজার আগেই পেছনে কারো পায়ের আওয়াজ। সে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখে মেয়েটি, ধুলোঢাকা ট্র্যাঞ্চকোট পরে, চোখে এক অদ্ভুত বিস্ময় আর ব্যথা।
“তুমি আমাকে খুঁজছো, অমিত?” মেয়েটি হেসে বলে। অমিত এক মুহূর্তের জন্য নিঃশ্বাস নিতে ভুলে যায়। মেয়েটির মুখ, চোখ, ঠোঁট—সব কিছু বাস্তবের থেকেও স্পষ্ট। কিন্তু গলার স্বরটা যেন সময়ের ভেতর দিয়ে ভেসে আসছে। “তুমি কোথা থেকে এসেছো?” জিজ্ঞেস করে সে। মেয়েটি উত্তর দেয় না, শুধু বলে, “চলো, আমার একটা জায়গা দেখাতে হবে।” সে এগিয়ে যায়, আর অমিত যেন কোন অদৃশ্য সুতোর টানে অনুসরণ করে। হঠাৎ তাদের চারপাশের দৃশ্য পাল্টে যেতে থাকে। ঝাপসা আলো, পুরনো ট্রামলাইন, ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা সেপিয়ারঙা শহর—কোলকাতার একটা প্রেতময় চেহারা যেন ফিরে আসে। অমিত টের পায়, এই সফর কেবল ছবির মধ্য দিয়ে নয়—একটা সময়ের ভেতর দিয়ে। আর সেই সময়ের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই রহস্যময়ী নবনীতা, যে তাকে নিয়ে যেতে চায় নিজের গল্পের কেন্দ্রে।
১০
শহরের আকাশ আজ অন্যরকম নীল। গঙ্গার ধারে বসে অমিত বুঝতে পারছিল, এতদিন যে প্রতিটি দৃশ্য, প্রতিটি আলোকছায়া তার ক্যামেরায় বন্দি হত, সেগুলো শুধু শহরের অঙ্গ ছিল না—ছিল একটা আত্মা, একটা নিঃশব্দ গানে মোড়া গল্প। সেই গল্পের চরিত্র যে ছিল রূপসী মেয়েটি—যাকে সে ছবি তুললেই আবিষ্কার করত, অথচ খুঁজে পেত না বাস্তবের রাস্তায়। আজ, দশটি অধ্যায় পেরিয়ে, কত পেছনে ফিরে তাকালে বোঝা যায় যে, গল্পটা সবসময় তার চারপাশেই ছিল, কেবল সে দেখেনি। চারু মেট্রোর স্টেশনের ছায়া, বা বিকেল বেলায় বউবাজারের গলির গা ছুঁয়ে যাওয়া হাওয়ায়, সেই মেয়েটি তার ছায়া ফেলেছিল। কিন্তু বাস্তব আর কল্পনার যে রেখা, তা এত সূক্ষ্মভাবে ছিন্ন হয়ে যাবে, তা কি ভেবেছিল সে?
আজ, যে বেলি ফুলের গন্ধে সে রাত্রির কলকাতা চিনত, সেই একই গন্ধে হঠাৎ করে তার কাঁধে এসে পড়ে এক আলতো হাত। অমিত চমকে উঠে পেছনে ঘোরে—সামনে দাঁড়িয়ে ঠিক সেই মুখ, যা এতদিন শুধুই ছবি ছিল। ঠিক একই ছায়া, একই ভঙ্গিমায় দাঁড়ানো, একই চোখে গভীর এক ব্যাখ্যাতীত দৃষ্টি। সে বলে—”তুমি তো আমায় খুঁজছো অনেকদিন। অথচ আমি তো ছিলাম, ঠিক এখানে—এই শহরের প্রতিটি চিরচেনা কোণে। তুমি শুধু তোমার কল্পনায় আমায় আঁকছিলে, আর আমি বাস্তবে তোমায় ছুঁয়ে থাকছিলাম।” অমিত কিছু বলার আগেই, মেয়েটি এগিয়ে এসে তার হাত ধরে। ছায়া আর আলো মিলে সে মুহূর্তে শহরের শব্দ যেন থেমে যায়। গঙ্গার জলে পড়ে থাকা আলো, বাতাসে মেশা চেনা রিকশার ঘণ্টা—সব কিছু নিঃশব্দ সাক্ষী হয়। তারা হাঁটতে থাকে—চুপচাপ—নেমে আসে মেটিয়াবুরুজের পুরনো ঘাটে, যেখানে অমিত প্রথমবার তার কল্পনার চরিত্রটিকে দেখেছিল একটি ধোঁয়াশাময় চিত্রের মধ্যে।
রাত গভীর হতে হতে, তারা পৌঁছে যায় সেই পুরনো বাড়িটার সামনে, যেখানে দেওয়ালে এক প্রাচীন ফ্রেমে বাঁধানো সেই প্রথম ছবিটি ঝুলছে—যেখানে মেয়েটি প্রথম ধরা দিয়েছিল। অমিত ফ্রেমের দিকে তাকিয়ে বুঝে যায়, ছবির ওপারেই সে ছিল। আসলে, সব কিছুরই একটা সীমান্ত থাকে—বাস্তব আর কল্পনার, স্বপ্ন আর জেগে থাকার, শহরের আলোর আর ছায়ার। সেই সীমান্তের গা ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে ছিল মেয়েটি—যার নাম সে এখনও জানে না, কিন্তু অনুভবে চেনে বহুদিন। মেয়েটি হেসে বলে—”আমি নাম নই অমিত, আমি অভিজ্ঞান। তুমি দেখেছিলে বলে আমি জন্মেছি।” সে মুহূর্তে অমিত বুঝে যায়—কলকাতা তার কাছে আর শুধু শহর নয়, সে এখন একজন সঙ্গী—রক্তমাংসের নয়, কিন্তু গভীর অনুভবের। আর মেয়েটি? সে তো ছিল সব সময়—ছবির ওপারে।
____