দীপান্বিতা মাহাতো
১
পুরুলিয়ার বাঁশডাঙা গ্রামে ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়তেই পাখির ডাকে জেগে ওঠে পাহাড়-জঙ্গলের বুক চেরা গ্রামটা। মাটির বাড়ির চালের নিচে কুয়াশার কুয়াশা, আর তার মাঝখান দিয়ে হেঁটে চলে যায় একটা কিশোরী—ঝুমরি হাঁসদা। তার পরনে হালকা লাল পাড়ের ধবধবে সাদা শাড়ি, হাতে জলভরা কলসি, কিন্তু ঠোঁটে একটানা চলতে থাকা সুর—”গেলি চলে পাহাড়ি পথে, কাহার ডাকে রে মন।” সে একা, কিন্তু একলা নয়। ঝুমরির কণ্ঠে যেন গমগম করে ওঠে পুরো বাঁশডাঙার ঝরা পাতা, মাঠঘাট, আর সেই পাহাড়ের পেছনের রক্তিম সূর্য। ছোট থেকেই ঝুমরির গলার জোর ছিল গ্রামের অন্যসব মেয়েদের চেয়ে আলাদা। মা পূর্ণিমা হাঁসদা ছোটবেলায় নিজের ঠাকুমার কাছ থেকে যে গান শিখেছিলেন, তা ঘরের কাজ করতে করতেই মেয়েকে শেখাতে শেখাতে একদিন নিজের অজান্তেই বুঝে গিয়েছিলেন—মেয়েটা একদিন খুব বড় কিছু করবে। তবে বাঁশডাঙা গ্রামে বড় কিছু করতে গেলে সবার আগে লড়তে হয় প্রথার সঙ্গে, রেওয়াজের সঙ্গে, আর কখনো কখনো নিজের বাবার রোষের সঙ্গেও।
ঝুমরির বাবা সুনীল হাঁসদা ছিলেন পেশায় হাল চাষি আর মনেপ্রাণে কুসংস্কারাচ্ছন্ন। তার মতে, মেয়েরা গান গায় শুধু বিয়েতে বা রাধাকৃষ্ণের নাটকে, আর সে-ও চুপি চুপি, পর্দার আড়ালে। মেয়ের গলা নিয়ে কেউ কথা বললেই তিনি মুখ ঝামটিয়ে বলতেন, “এইসব গানের পাট তুলে দে, মেয়ে মানেই সংসার, আর সংসার মানেই চুপ থাকা।” ঝুমরি প্রথম গানের চেষ্টা করেছিল গ্রামের পুজোয়, যখন সে আট বছর। তখন সে রাধার ভূমিকায় গেয়েছিল “কানাইরে তুই কোথায় গেলি”—সেই গান শুনে গ্রামের কিছু প্রবীণ কাঁদতে বসে, আবার পঞ্চায়েতপ্রধান বিনোদ ঘোষাল বলেছিল, “এই মেয়েটা বেশি সাহসী হয়ে উঠছে, সাবধান করো ওকে।” সেই থেকে ঝুমরি বুঝে গিয়েছিল, তার কণ্ঠ শুধু গান নয়, প্রতিবাদের অস্ত্র। স্কুলে পড়ার সময় ঝুমরি আরও অনেক মেয়েকে দেখেছে যাদের গলায় সুর ছিল, কিন্তু ভয় আর সমাজের চোখরাঙানিতে তারা গান ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। তখন থেকেই সে ঠিক করে, একদিন সে একটা গানের দল গড়বে—যেখানে শুধু মেয়েরা থাকবে, তারা গাইবে লোকগান, ঢোল বাজাবে, আর সমাজকে দেখাবে, মেয়েরাও পারে।
বাঁশডাঙা গ্রামের এক কোণায় ছিল একটা শুকনো বাঁশবাগান, যেখানে দিনের শেষে কেউ যেত না। ঝুমরি সেই জায়গাটাকেই বেছে নেয় গানের ঘাঁটি বানানোর জন্য। প্রথমে রেণু নামে এক মেয়ে আসে—বিধবা মায়ের মেয়ে, জীবনে অনেক অপমান সহ্য করা মুখচোরা কিশোরী। তারপর আসে সোনালী, যে সবার অলক্ষে ঢোল বাজাতে শিখেছে ভাইয়ের হাত থেকে। তাদের সাথেই জুটে যায় কুসুম আর মধু, যারা খুপরি বাঁধার ফাঁকে ফাঁকে সুর মিলিয়ে গান গায়। প্রত্যেকেই ভীত, দোল খায় সমাজের চোখে, কিন্তু ঝুমরির আগুনভরা চোখ তাদের সাহস দেয়। তারা একজোট হয় গুনু মাসির কাছে—যিনি একসময় নিজের স্বামীর সঙ্গে নাট্যগান করতেন, কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পর সমাজ তাকে গান ছেড়ে দিতে বাধ্য করেছিল। গুনু মাসির চোখে তারা দেখতে পায় সেই হারানো স্বপ্ন, আর মাসিও বুঝে যান—এই মেয়েগুলোর মধ্যে লুকিয়ে আছে তার নিজের ফেলে আসা জীবন। বাঁশবনের নিচে, শুকনো পাতা মাড়িয়ে শুরু হয় প্রথম চর্চা—”চল চল রে বাউল মনের মানুষ খুঁজিতে”, আর সেই গানে ধীরে ধীরে প্রতিধ্বনিত হয় মুক্তির আশ্বাস।
তবে গ্রামের বাতাস এত সহজে বদলায় না। পঞ্চায়েতপ্রধান বিনোদ ঘোষাল খবর পেয়ে একদিন দলবল নিয়ে বাঁশবনে গিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে—”মেয়েরা কি রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঢোল বাজাবে? সংস্কার কোথায়? মর্যাদা কোথায়?” ঝুমরির মা, পূর্ণিমা হাঁসদা, বাড়ি ফিরে মেয়ে কেঁদে ফেললে কপালে হাত দিয়ে বলেন, “তুই জানিস না মেয়ে হয়ে কীরকম কষ্টে চলতে হয়?” কিন্তু তার চোখে ছিল একটা অস্পষ্ট গর্বের রেখা। ঝুমরি কাঁদেনি। পরদিন আরও জোরে গেয়েছিল সে—”আমি মাটির কন্যা, আমি হার মানি না রে ভাই।” আর সেই সুর কানে গিয়ে পৌঁছায় চায়ের দোকানের শ্যামল কাকার, যে ঠিক সেই মুহূর্তে ফোন করে বসায় কলকাতার এক লোকসংস্কৃতি কর্মী তর্পণ সরকারকে। ঝুমরির গান পাড়াগাঁ ছাড়িয়ে এবার পৌঁছবে শহরের স্টেজে, কিন্তু তার আগে তাকে লড়তে হবে গ্রামের রীতিনীতি আর নিজস্ব ভয়কে পেরিয়ে—যেখানে কণ্ঠ শুধুই গান নয়, এক বিপ্লব।
২
পুরুলিয়ার বাঁশডাঙার দক্ষিণ প্রান্তে এক পুরনো, প্রায় ভেঙে পড়া ঝুপড়ি ঘর, যেখানে একসময় শুকনো পাট রাখা হতো—সেইখানেই এক সন্ধ্যায় বসেছিল পাঁচটি মেয়ে, চোখে অদ্ভুত দীপ্তি, আর ঠোঁটে একটি নির্ভীক গান। ঝুমরি হাঁসদা, মাঝখানে বসে, ছাদ থেকে ঝুলে থাকা একমাত্র হ্যারিকেনটার নিচে দলকে তাল দিচ্ছিল। পাশেই রেণু খুপরি হাতে তালি দিচ্ছে, সোনালী নিচু গলায় গুনগুনিয়ে তালের ভেতর ঢোলের ছন্দ অনুশীলন করছে, আর মধু আর কুসুম নতুন গান তুলছে—একটা সাঁওতালি লোকগান, যেটা ঝুমরি তার দিদিমার কাছ থেকে শুনেছিল। গানটির কথা ছিল বৃষ্টিতে হারিয়ে যাওয়া এক মেয়ের কথা, যে পাহাড় পেরিয়ে গান খুঁজতে গিয়েছিল। সেই মেয়েটি যেন ঝুমরি নিজেই। ভাঙা মাটির মেঝেতে গড়াগড়ি করে বসে মেয়েরা গাইছিল আর হাসছিল, ভয় আর লজ্জা যেন কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গিয়েছিল তাদের কণ্ঠে। ঝুপড়ির বাইরের অন্ধকার আর কুয়াশা যেন তুচ্ছ হয়ে উঠেছিল এই অদ্ভুত আগুনমাখা গানের উষ্ণতায়।
তবে এই গান শুধুই গান ছিল না, ছিল একরকম অস্ত্র—বাঁশডাঙার মতো গ্রামে, যেখানে মেয়েদের কণ্ঠ মানেই শোভা, গান মানেই সাজসজ্জা, সেখানে এই নির্লজ্জভাবে ঢোল বাজিয়ে গেয়ে ওঠা মানে ছিল নিয়ম ভাঙা। সেই ঝুপড়ির আশেপাশে সারাক্ষণ যে ছেলেরা ঘোরাঘুরি করত, তাদের হাসিঠাট্টার শব্দ মাঝেমধ্যেই ভেসে আসত ভিতরে। “ও ঝুমরি, এবার বিয়ে থেমে যাবে রে তোদের গান শুনে!”—এমন খ্যাপানো আওয়াজে সোনালী একবার ঢোল ফেলে দিয়েছিল, মধুর চোখে জল এসে গিয়েছিল, কিন্তু ঝুমরি সেদিন বলেছিল, “যাদের নিজের কণ্ঠ নেই, তারাই অন্যের গান থামাতে চায়। তোরা কানে তুলো দে, আমি গাইব।” সেই কথা যেন আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল দলটায়। সেইদিনই দল ঠিক করে, এখন থেকে নিয়মিত রিহার্সাল হবে, আর গুনু মাসিকে তাদের গানের দিশারী হিসেবে আনতে হবে। গুনু মাসি প্রথমে রাজি হননি, ভয় ছিল সমাজের, কিন্তু ঝুমরির চোখ দেখে বলেছিলেন, “এই চোখ অনেকদিন আগে আমি আয়নায় দেখতাম, একসময় আমারও স্বপ্ন ছিল। আমি আসব।”
গুনু মাসি এলেন পরদিন, হাতে তার পুরোনো এক ঢাক আর কাঁধে বেঁধে রাখা তাল-খঞ্জনি। ঝুপড়ির ভিতর ঢুকেই তিনি বললেন, “তোমরা গান করছো, ঠিক করছো, কিন্তু তাল নেই, ছন্দে ভুল, আর গলার জোর এখনো ভিতর থেকে আসে না।” মেয়েরা চুপ করে গেল। ঝুমরি বলল, “আপনি শেখান মাসি, আমরা সব শিখব।” সেই থেকে শুরু হলো আসল চর্চা। গুনু মাসি প্রতিদিন বিকেলবেলা এসে গান শেখাতে লাগলেন—শিখালেন আদিবাসী লোকগান, পটুয়া গানের সুর, শারদীয়া বিজয়ার পরের পালা, আর শিখালেন আত্মবিশ্বাস। তিনি বারবার বলতেন, “তোমাদের গান শুধু গান না, এটা হচ্ছে প্রতিবাদ, চিৎকার নয়, অহংকার নয়, কিন্তু দৃঢ়তা—যেটা থামানো যায় না।” মেয়েরা গাইতে গাইতে বদলে যাচ্ছিল—রেণু আর লজ্জায় মুখ লুকাত না, মধুর গলা অনেক শক্ত হচ্ছিল, সোনালী এখন ঢোলের মার দিতে দিতে ছন্দে হাঁটত। আর ঝুমরি? সে যেন হয়ে উঠেছিল আগুনে পোড়া মাটি—যত দমিয়ে রাখার চেষ্টা হতো, তত সে জ্বলত।
কিন্তু ঝুমরিরা যত এগোচ্ছে, তত তাদের দিকে বাঁকা চোখে তাকাচ্ছে গ্রাম। গানের শব্দ ভেসে আসছিল রাতের মধ্যে, আর লোকজন বলছিল, “এই মেয়েরা আর মেয়ের মতো নেই”, “ছোট ছোট মেয়ে কীসব ঢোল বাজাচ্ছে”, “কাল যে ওদের কেউ বিয়ে করতে চাইবে না।” একদিন রাতে ঝুমরি বাড়ি ফেরার সময় দেখে, তার দরজার সামনে কেউ একটা পঁচা ফল ছুঁড়ে রেখে গেছে। মা কিছু না বললেও বুঝে যান, তার মেয়ে সমাজের নিয়মে থেমে থাকছে না। পরদিন সকালে মা বলল, “যা করার কর, কিন্তু শক্ত থাকিস। একদিন এই গানই তোকে রক্ষা করবে।” আর সেই রাতেই ঝুমরি ওদের অনুশীলনের ভিডিও মোবাইলে তুলে দেয় শ্যামল কাকার কাছে। শ্যামল কাকা সেটা পাঠায় তর্পণ সরকারের কাছে—কলকাতা থেকে আসা এক লোকসংস্কৃতি গবেষক, যিনি গ্রামীণ সংস্কৃতির ভিডিও ও তথ্য সংগ্রহ করেন। তিনি প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেননি—পুরুলিয়ার এক মাটির ঘরে মেয়েরা ঢোল, খুপরি আর কণ্ঠে এমন গান গাইছে! তিনি উত্তর দেন: “আমি আসছি বাঁশডাঙায়। এই মেয়েদের গান শহর শুনবে, এটা আমি নিশ্চিত করব।” ঝুপড়ির ভিতর ছড়িয়ে পড়ে এই খবর—গান এবার শুধু বাঁশডাঙায় নয়, পৌঁছবে বহুদূর।
৩
ঝুমরিদের গান এখন শুধু ঝুপড়ির দেওয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সন্ধ্যার বাতাসে, বাঁশডাঙার নরম মাটিতে, ধানের গন্ধ আর গানের সুর একসঙ্গে মিশে যেতে লাগল। গ্রামের বয়স্ক নারীরা চুপিচুপি হাটবারে বলাবলি করত—”ঝুমরি হাঁসদার মেয়েটা গান গাইছে শহরের মতো”, কেউ কেউ আবার ছেলেমেয়েকে বলে দিত—”তোরা ওই মেয়েদের সঙ্গে মিশবি না।” তবু এক অদ্ভুত টান তৈরি হচ্ছিল গ্রামের ভিতর। মাঠের কাজ শেষে বা গরুদের গোয়ালঘরে বেঁধে রাখার পরে, অনেক কিশোর-কিশোরী দূরে দাঁড়িয়ে শুনত ঝুপড়ি থেকে ভেসে আসা গান—“তালতলে নদীর পারে, বাঁশিতে বাজে বাউল গান”—এই গান যেমন ছিল সুরের, তেমনই ছিল অভিমানের। কিন্তু এই বিপ্লবের আগুনে ঘি ঢালল এক খবর: শহরের লোকসংস্কৃতি গবেষক তর্পণ সরকার বাঁশডাঙা আসছেন, এবং তিনি চাইছেন ঝুমরিদের গান কলকাতার লোকসংস্কৃতি উৎসবে শোনাতে।
খবরটা পঞ্চায়েত প্রধান বিনোদ ঘোষালের কান পর্যন্ত পৌঁছতে সময় লাগল না। তিনি রেগে গিয়ে বললেন, “এ আবার কী নতুন রেওয়াজ? মেয়েরা গাইবে শহরের লোকের সামনে? লোক দেখবে মুখ, শুনবে গলা? এত বড় স্পর্ধা কে দিল?” তার সঙ্গে বসেছিল গ্রামের আরও কিছু পুরুষ, যারা সমাজের বিধান রক্ষা করার নাম করে আসলে মেয়েদের গলায় তালা বসাতে চায়। সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো—পরদিন পঞ্চায়েত অফিসে এই ব্যাপারে সভা হবে। সেই রাতে ঝুমরি জানল সবকিছু। গুনু মাসি বললেন, “তুই ভয় পাবি না, তোর গলা সত্যির সুরে ভরা। ওরা যত বেশি চেঁচাবে, তত তোর সুর দূর যাবে।” মা পূর্ণিমা হাঁসদা তখন মেয়েকে কপালে টিপ দিয়ে বললেন, “আজ তুই আমার মা, আমি তোর মেয়ে। আমি ভয় পাব, কিন্তু তুই পাস না।”
পরদিন গ্রামের মাঝখানে গাছতলায় জমল পঞ্চায়েত সভা। শ্যামল কাকার চায়ের দোকানের পাশে চৌকাঠে দাঁড়িয়ে শুনছিল লোকজন। বিনোদ ঘোষাল গম্ভীর গলায় বললেন, “আমরা কি পশ্চিমি আদর্শে চলব? মেয়েরা ঢোল বাজাবে, লোকের সামনে নাচবে—এ কেমন সংস্কৃতি? এই মেয়েরা সমাজের শত্রু।” কেউ মুখ না খুললেও চোখে চোখে চলছিল কথোপকথন। ঠিক তখনই ঝুমরি সামনে এগিয়ে আসে, পাশে রেণু, সোনালী, মধু আর কুসুম। সে বলল, “আমরা গান গাইছি আমাদের ঠাকুমার শেখানো সুরে, আমাদের মাটির ভাষায়। আমরা নাচছি, যেমন আমাদের মা-কাকিমারা করত চাষের মাঠে। আপনি যদি বলেন, এটা সমাজবিরোধী—তবে সমাজটাই বদলাতে হবে।” কথাটা শুনে একটা নিঃশব্দ তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ল জনতার মধ্যে।
বিনোদ ঘোষাল রেগে গিয়ে বলল, “তোর বাবার মেয়েটা মুখের ওপর কথা বলে? মেয়েদের নিয়ে গান গাইবি শহরে? তোদের বিয়ের কথা কেউ ভাববে না।” তখন গুনু মাসি এগিয়ে এসে বললেন, “আমার গান থামাতে পারেনি কেউ, মেয়েগুলোকেও পারবে না। আপনি চাইলে পঞ্চায়েত করুন, কিন্তু সুর থামবে না।” আর তখনই সামনে এসে দাঁড়াল এক অপ্রত্যাশিত মুখ—শ্যামল কাকা। তিনি বললেন, “আমি লোকসাহিত্য পড়ি না, গাই না, কিন্তু আমি কানে শুনি। এই মেয়েগুলোর গান আমাদের মুখের ইতিহাস, মাটির গল্প। আমি তর্পণ সরকারকে ডেকেছি, আমি বলছি—এই মেয়েদের কেউ থামাতে পারবে না।” গ্রামের অর্ধেক লোক সেই প্রথমবার প্রকাশ্যে ঝুমরির পক্ষে মুখ খুলল। পরাজয়ের ছায়া পড়ল পঞ্চায়েত প্রধানের মুখে। সেই সন্ধ্যায় ঝুমরির ঝুপড়ির সামনে মাটি বসানো হলে দল বসে গাইল—“যে বাঁশি একদিন থেমে গিয়েছিল, আজ সে আবার বেজে ওঠে।” আর সেই গান যেন আকাশ ছুঁয়ে পৌঁছাল শহরের দিকে, যেখানে তর্পণ সরকার তাঁর ক্যামেরা হাতে পৌঁছে যাচ্ছেন বাঁশডাঙায়—এক দল মেয়ের কণ্ঠে হারানো ইতিহাস ফিরিয়ে আনতে।
৪
তর্পণ সরকার বাঁশডাঙা গ্রামে পা রাখলেন এক বিকেলের শেষে, যখন ঝুমরি আর তার দল অনুশীলন করছিল সেই পুরনো ঝুপড়ির ভেতরে। তাঁর গায়ে ছেঁড়া ধুতি-কুর্তা নয়, বরং নীল শার্ট আর কাঁধে লম্বা ঝোলানো ক্যামেরাব্যাগ। কিন্তু মুখে ছিল গ্রামদর্শনের ক্লান্তি মেশানো একরাশ উচ্ছ্বাস। শ্যামল কাকা তাকে নিয়ে এলো, আর গুনু মাসি চমকে উঠে বললেন, “কলকাতা থেকে কেউ আসবে, তা ভাবিনি।” তর্পণ হেসে উত্তর দিলেন, “গান যদি শহর থেকে আসতে পারে, তবে শহরও তো গান খুঁজে আসতে পারে মাটির কাছে।” সেই প্রথমবার তিনি ঝুমরিদের গান শুনলেন চোখে চোখ রেখে। ঢোল, খুপরি, করতাল আর সাঁওতালি ভাষায় গাওয়া সেই গান যেন শহরের ছকে বাঁধা গানের জগত থেকে অনেক দূরের কিছু—এটা ছিল কাঁচা, কিন্তু প্রাণবন্ত। তিনি সেই মুহূর্তেই জানলেন, এই মেয়েদের গলা শুধু গ্রাম নয়, শহরও শুনবে। তার ক্যামেরায় ঝুমরিদের রিহার্সালের ভিডিও ওঠে, চোখে পড়ে গুনু মাসির হাতের মৃদু তাল, আর মেয়েদের মুখে একরাশ জেদ। তার ক্যামেরা যেন সেই সুরকেই বন্দি করে নেয়, যে সুর কোনও মঞ্চে নয়, জন্মায় মাটির গন্ধ থেকে।
পরদিন তর্পণ সেই ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেন একটি ক্যাপশন দিয়ে—“When voices rise from soil, even silence listens.” ভিডিওটি ভাইরাল হতে সময় নেয়নি। শহরের সংস্কৃতিমনা মানুষেরা বিস্মিত—পুরুলিয়ার এক অখ্যাত গ্রামের কিশোরীরা এমন শক্তিশালী, আত্মবিশ্বাসে ভরপুর লোকগান গাইছে! বেশ কয়েকটি লোকসংস্কৃতি মঞ্চ থেকে তর্পণকে যোগাযোগ করা হয়, তাদের উৎসবে ঝুমরিদের গান চাই। কলকাতার “চৈত্র সম্মিলনী লোকস্বর উৎসব”-এর তরফ থেকে সরাসরি আমন্ত্রণ আসে ঝুমরির গানের দলের কাছে। এই খবর প্রথমে পৌঁছায় শ্যামল কাকার দোকানে, তারপর ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে বাঁশডাঙার গলি গলি। কেউ আনন্দে মুখ খুলতে না পারলেও চোখে মুখে ছিল বিস্ময়, অভিমান আর কিছুটা স্বীকারোক্তি। গ্রামের পুরুষেরা তবু নাক সিঁটকোয়, বলে, “শহরে গিয়ে কী দেখাবে? গরিবি?” কিন্তু নারীরা, বিশেষত তরুণীরা, মনে মনে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে—সাজপোশাক নয়, গান দিয়েও উঠে আসা যায়।
ঝুমরির দল এই প্রথমবার গ্রামের বাইরে যাবে, শহরে যাবে গাইতে, তার আগে প্রস্তুতিতে মেতে ওঠে গুনু মাসি। তিনি প্রতিদিন নতুন তাল শেখাতে থাকেন, পটগান থেকে শুরু করে চৌতাল পর্যন্ত। কুসুমের কণ্ঠে একটু বাউল ঢুকে যায়, রেণুর খুপরির বোল নিখুঁত হয়, সোনালীর ঢোল এখন মঞ্চমুখী, আর ঝুমরির গলা যেন আগুন ছুঁয়ে আসে। কিন্তু তার সঙ্গে বাড়ে ভয়। কেউ কেউ বলে, “শহরে গিয়ে কেউ অপমান করলে?” মা পূর্ণিমা হাঁসদা তখন শুধু বলেন, “চোখ তুলে তাকিয়ে গা। তোরা শহরের কেউ নয়, তোরা নিজের গান নিয়েই শহরের লোক।” আর সেই রাতে ঝুমরি একা বসে থাকে ঘরের পেছনের আমগাছটার নিচে, চোখে চাঁদের আলো আর মনে গান—“এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে সুর যাবে কত দূর?”
অবশেষে যাত্রার দিন আসে। ঝুমরিদের গলায় গুনু মাসি সাদা গামছা বেঁধে দেন, যেন আশীর্বাদের মতো। তারা বাসে ওঠে—প্রথমবার শহরের দিকে, পেছনে রেখে বাঁশডাঙার খোলা মাঠ, পাখির ডাক, কাঁঠালতলা আর সেই ঝুপড়ি ঘর। বাস যখন বাঁকুড়ার পথ ধরে এগোয়, তখন ঝুমরি শেষবারের মতো জানালার ধারে বসে গুনগুন করে গায়—“আমার গানের পালা, চলেছে দূর-পথে”—তাঁর পাশে সোনালী ঢোল ধরে বসে, আর রেণু খুপরি আঁকড়ে ধরে। শহরের মানুষ জানে না, কী আসছে। কিন্তু গ্রামের মেয়ে ঝুমরি জানে—ওর কণ্ঠে শুধু গান নয়, ইতিহাস আর প্রতিবাদের সুর লুকিয়ে আছে। শহর এবার শুনবে সেই শব্দ, যাকে এতদিন গ্রাম চুপ করে রেখেছিল।
৫
চৈত্রের শেষ দিকটা পড়তেই পুরুলিয়ার আকাশ যেন অন্যরকম হয়ে ওঠে। খেজুরগাছের মাথায় গুনগুন করে বাতাস, আর মাটির গন্ধে থাকে রুক্ষ অথচ আত্মার কাছের এক টান। এমনই এক গোধূলি বেলায় ‘ঝুমরির গানের দল’ পৌঁছে গেলো বহুল প্রতীক্ষিত বাউল উৎসবে। এ উৎসব শুধু গান বা সুরের জন্য নয়, গ্রামীণ নারীদের কণ্ঠকে মঞ্চ দেওয়ার প্রথম সাহসী প্রয়াস হিসেবেও পরিচিত হয়ে উঠেছিল। ঝুমরি পরেছে তার মায়ের পুরনো লাল পাড়ের সাদা শাড়ি, গলায় হাতে বানানো পুঁতির মালা আর চুল বাঁধা আছে ঢিপ করে। তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বেণী, ঝুলন, অঞ্জলী, ও মিনতি— প্রত্যেকেই পরিপাটি। নারকেল তেলের গন্ধ, ফুলের গন্ধ, আর রক্তিম আলোয় মঞ্চের পেছনে তৈরি হচ্ছিল এক নবজাগরণের স্বপ্ন।
মঞ্চের সামনে জমে উঠেছে দর্শক— গ্রাম পেরিয়ে পাশের জঙ্গল মহল থেকেও মানুষ এসেছে, কেউ বাউল গানে বিভোর হতে, কেউ শুধুই দেখতে মেয়েরা কী গায়! একটা চাপা বিদ্রূপ আর স্নায়ুর টান অনুভব করছিল মেয়েরা। ঝুমরি বুঝতে পারছিল— এটা কেবল গান গাওয়ার মুহূর্ত নয়, এটা যেন নিজের স্বরকে সামাজিক বাধার ওপরে প্রতিষ্ঠা করার সময়। একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রদীপ মেসো, যিনি ঝুমরির বাবার বন্ধু, হেসে বললেন, “তোর মা আজ থাকলে গর্ব করত তোকে নিয়ে, ঝুমরি।” কথাটা ঝুমরির মনে রক্তের মতো ছড়িয়ে গেল। মঞ্চে ওঠার সময় ঝুলন চাপা গলায় বলল, “ভয় করছে, ঝুমরি। যদি ভুল হয়ে যায়?” ঝুমরি জবাব দিল, “ভুল তো হবেই। কিন্তু ভুল করেই তো আমরা শিখি। ভয় কেবল বাধা— গান তার চেয়েও বড়।”
মঞ্চের আলো জ্বলতেই সারা মাঠ নিস্তব্ধ। প্রথমে গাইল মিনতি— বাউলগান ‘মন রে, কাহার সাধন ফল’। তার কণ্ঠে ছিল একটা ব্যথা, যেন পুরনো অভাবের কাহিনি। তারপর একে একে গান গাইল বেণী, অঞ্জলী আর ঝুলন। কিন্তু সবচেয়ে অপেক্ষিত ছিল ঝুমরির গান। সে গাইল নিজের লেখা গান— ‘মাটির ঘ্রাণে গড়া মেয়ে আমি, শিকল ছিঁড়ে এলাম গানে’। সারা মাঠ কেঁপে উঠল। কারও চোখে জল, কারও ঠোঁটে হাসি। এক বৃদ্ধ বললেন, “এই মেয়েটা তো আগুন!” ঝুমরির চোখে জল এসে গেল। কোনো বিচারকের নম্বর নয়, এই মুহূর্তটাই তার কাছে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। গান শেষে মুহূর্তখানেকের নীরবতা— তারপর তালির ঢেউ। পুরুষতান্ত্রিক চোখে ভরা সভায় সেই তালি যেন ছিল সম্মতির, সমর্থনের।
রাত বাড়ল। তারা সবাই একটা ছোট পাটের চাটাইতে বসে খিচুড়ি আর আলুভাজা খাচ্ছিল। ঝুমরি বলল, “আজ যা করলাম, সেটা একা আমার নয়— আমরা সবাই মিলে করলাম।” ঝুলন হেসে বলল, “তুই না থাকলে সাহস জুটত না রে!” হঠাৎ একজন ছেলে এগিয়ে এসে বলল, “আপনাদের গান শুনে মনে হলো— এই গাঁয়ে সত্যি কিছু বদল হচ্ছে।” মেয়েরা তাকিয়ে রইল। একজন ছেলে, এই সমাজে, এমনটা বলছে— এটাও কি কম জিনিস? ঝুমরি তার দিকে তাকিয়ে বলল, “এটাই তো আমাদের স্বপ্ন। মেয়েরা শুধু রান্না বা ঘর নয়— তারা গান গায়, স্বপ্ন দেখে, আর সমাজ বদলাতেও পারে।” দূরে মঞ্চের আলো ধীরে ধীরে নিভে আসছিল। কিন্তু ঝুমরির চোখে যেন আগুন জ্বলছিল— নতুন ভোরের, নতুন লড়াইয়ের, আর একটি গানের দলের গল্পের যে সবে শুরু।
৬
আষাঢ়ের বৃষ্টিভেজা ভোরে ঝুমরির দল যখন rehearsal করছিল, তখন গ্রামের মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে গোবিন্দ পাণ্ডে গোঁফে তেল দিয়ে বলেছিল, “এসব গানবাজনার ফল ভালো হয় না মেয়েদের জন্য। ঘরের কাজ ফেলে বাইরে ঘোরা—ধর্মের চরম অবমাননা।” তার কথায় অনেকের সায় ছিল, কিন্তু কিছু পরিবার মেয়েদের স্বাধীনতা দেখে গোপনে গর্বিতও ছিল। এই বিরুদ্ধ হাওয়ার মধ্যেই শুরু হয় ঝুমরিদের প্রস্তুতি—জেলার লোকগান প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের। প্রত্যেকটা মেয়েই নতুন উদ্দীপনায় ভরে ওঠে, তারা গান বেছে নেয়—‘ঝুমুরের ঝংকারে মাতলো মাটির ধ্বনি।’ গান বাছা, তালের অনুশীলন, বাদ্যযন্ত্রে হাত খাপ খাওয়ানো—সব কিছু একসঙ্গে চলতে থাকে, আর সেই সুরের ভেতর দিয়ে এক নতুন আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠে মেয়েদের ভিতর।
ঝুমরি জানে, এই প্রতিযোগিতায় শুধু জয়লাভ করাই লক্ষ্য নয়, বরং নিজেকে প্রমাণ করার বড় মঞ্চ এটা। তার গলা আগের চেয়ে আরও শক্তিশালী, শব্দ উচ্চারণে একটা গ্রাম্য দীপ্তি। অঞ্জলি এখন ঢোল বাজায় অসম্ভব দক্ষতায়, আর রূপা শিখে নিয়েছে করতাল আর বাঁশির দিশা। গানের মাঝখানে তারা নিজস্ব গল্পও বসিয়ে দেয়—যেমন ‘চাষার বউয়ের কান্না’ বা ‘জলের দেবীর ডাক’। এইভাবেই তাদের গান এখন শুধু গান নয়, এক একটা জীবন্ত কাহিনি। অথচ গ্রামের পুরনো চিন্তাভাবনা তাদের সামনে নতুন বাধা হয়ে দাঁড়ায়—মিলনসংগীতের রাতে মন্দির কমিটির সিদ্ধান্ত হয়, ঝুমরি ও তার দল মন্দির প্রাঙ্গণে গান গাইতে পারবে না, কারণ তা ‘বেশি ছেলেদের আকর্ষণ’ করছে। এই সংবাদ দলকে ভেঙে দিতে চায়, কিন্তু ঝুমরি এককথায় বলে, “আমরা গান গাইব, খোলা মাঠে। দেখব কে আটকায়।”
মধ্যরাতে ঝড় ওঠে—একদিকে প্রকৃতির, আরেকদিকে সমাজের। সেই রাতে খোলা মাঠে দল যখন গান শুরু করে, প্রথমে মাঠ ফাঁকা ছিল। একটু পরেই ছেলেমেয়ে, বৃদ্ধ, গৃহিণী—সবাই এসে দাঁড়ায়, ছাতা মাথায়, কাঁথা গায়ে। তাদের গান আকাশে উড়ে যায়—‘আমরা মাটির মেয়ে, বৃষ্টির গানে ভিজি’। ঝড়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে সেই গান, আর ঝুমরি দেখে, মন্দির কমিটির কিছু প্রবীণ সদস্যও পেছনে দাঁড়িয়ে কান পাতছে। সেই রাতের শেষে, ঝড় থেমে গেলে, সবাই দাঁড়িয়ে তালি দেয়। এমন প্রশংসা তারা কখনও পায়নি, এমন স্বীকৃতি শুধু কল্পনায় ছিল।
পরদিন সকালে গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মেঝেতে বসে ঝুমরির দল প্রতিযোগিতার জন্য শেষ অনুশীলন করছিল। হঠাৎ পঞ্চায়েত থেকে চিঠি আসে—“আপনাদের দলকে পুরুলিয়া জেলা লোকসংস্কৃতি সংস্থার পক্ষ থেকে বিশেষ অভিনন্দন ও প্রণোদনা প্রদান করা হবে, এবং তারা চায় আপনারা রাজ্য পর্যায়ে জেলা প্রতিনিধিত্ব করুন।” কিশোরী ঝুমরির চোখে জল আসে না, সে একরাশ হাওয়া টেনে নেয় বুক ভরে—এই প্রথমবার, তারা শুধু গান নয়, একটা প্রতিবাদকে শিল্পে রূপ দিতে পেরেছে। কিন্তু ঝুমরি জানে, সব পথ সহজ নয়, রাজ্য পর্যায়ে পৌঁছাতে গেলে আরও বহু বাধা পেরোতে হবে। তবু সেই মুহূর্তে সে মনে মনে বলে ওঠে, “গানের দিশা তো ঠিক করেছি আমরা, এবার দেখব কোন পথ পেরিয়ে কোথায় পৌঁছই।”
৭
পুরুলিয়ার আকাশে তখন শরতের আলো—সোনালি রোদের মাঝে ধুলোয় ধূসর গ্রামজীবন যেন হঠাৎ ঝলমল করে উঠেছিল। জগদ্ধাত্রী পুজোর ঠিক আগেই ব্লক কালচারাল সেন্টারের পক্ষ থেকে আয়োজন হয়েছিল এক গ্রামীণ সাংস্কৃতিক উৎসবের, যেখানে বিভিন্ন গ্রামের লোকগানের দল, নৃত্যদল, নাট্যগোষ্ঠী নিজেদের পরিবেশনার মাধ্যমে তুলে ধরবে নিজেদের ঐতিহ্য। ঝুমরির দলের প্রথম বড় সুযোগ—তাদের নাম উঠেছে শেষদিনের শেষ পরিবেশনায়, যা মানে উৎসবের সর্বোচ্চ গৌরবের স্থান।
সেই দিনটির প্রস্তুতি চলেছিল অনেক দিন ধরে। পুঁথিভরা ভোর থেকে ঝুমরির দল মাঠে গিয়ে রেওয়ালস করে, প্রাচীন পালা থেকে নতুন রচনায় নিজেদের গানের তাল কাটে, ছন্দে ঝালায় কণ্ঠ। গ্রামের মানুষজনও এই মেয়েদের উত্সাহ দিতে শুরু করেছে। বয়স্কা পিসিমারা বলেন, “এই রকম মেয়েদের দেখে ভালো লাগে—মুখে হাসি, গলায় গান, আর চোখে আগুন।” একদিন সকালে ঝুমরির মা গরুর ঘাস কেটে ফেরার পথে চুপিচুপি বলেন, “তুই যা করছিস, ঠিক করছিস রে মেয়ে। আমি তো পারিনি কখনো।” সেই প্রথম ঝুমরি মায়ের চোখে দেখেছিল লুকোনো গর্ব আর হালকা কুয়াশার মতো একটা অতৃপ্তি।
উৎসবের দিন এলে পুরুলিয়া শহরের কালচারাল মাঠে সাজানো হয়েছিল অস্থায়ী মঞ্চ, যার পাশে বাঁশের খুঁটির ওপর টাঙানো ঝাণ্ডায় লেখা—‘লোকগানের উৎসব ২০২৫’। ঝুমরি আর তার দল লাল পাড় সাদা শাড়িতে সেজে উঠেছিল। মঞ্চে ওঠার আগে ঝুমরি একবার চোখ বুলিয়ে নেয় তাদের সবার মুখে—রুনু, যার বিয়ে হয়তো এই বছরেই; মালা, যে স্কুল ফেলে গান বেছে নিয়েছে; আর ছোট্টো গোবিনার বোন নীলা, যার চোখে এখনো স্বপ্ন জমে উঠছে। সবার চোখে যেন একটাই ভাষা—ভয় নেই, আমরা একসাথে। ঝুমরি ভেতর থেকে গেয়ে ওঠে, “জাগরে মেয়ে জাগ, জাগোরে ঘুম পাড়ানি দেশ।”
তাদের পরিবেশনা শুরু হতেই মাঠ স্তব্ধ হয়ে যায়। প্রথম গান, এক পুরোনো পালা—“চাঁদের গানের মেয়ে”—যার কথা ও সুর ঝুমরি নিজে নতুনভাবে গেঁথে নিয়েছিল। ঝুমরির কণ্ঠে ছিল আগুন আর মায়ার মিশেল। মঞ্চের নিচে তখন শহরের কাগজের সাংবাদিক, কালচারাল অফিসার, এবং বহু দর্শক হাততালি দিচ্ছেন, আবার ফিসফিস করছেন, “এই মেয়েগুলো কোথা থেকে এল!” উৎসবের সেই রাত যেন ইতিহাস হয়ে রইল ঝুমরিদের জীবনে। মেয়েরা গান গাইল—নিজেদের কথা, নিজেদের ঘরের কথা, শেকড়ের কথা। আর সেই গানে জেগে উঠল পুরুলিয়ার মাটির গন্ধ, রক্তে গাঁথা সংস্কৃতি। ঝুমরিরা বুঝল, এ শুধু গান নয়—এ যেন প্রতিবাদের আর প্রেরণার এক ভাষ্য।
৮
শীতল ভোরের আলো গায়ে মেখে ঝুমরি দুধ সাদা শাড়ি পরে উঠোনে এসে দাঁড়াল। চারপাশে এখনও হালকা কুয়াশা, কিন্তু সেই কুয়াশার চাদর ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছিল আলোর কিরণ। আজ পুরুলিয়া জেলা উৎসব। সারাবছরের অপেক্ষার পরে এই একটি দিন – যেখানে সব গ্রাম একত্রে আসে, তাদের লোকসংস্কৃতি, গানের দল, নৃত্যদল, আর নিজস্ব শিল্প নিয়ে। ঝুমরির দল এবার প্রথমবারের মতো জেলার মঞ্চে গান গাইবে। পাড়ার সকলেই সকালে জল দিয়ে উঠোন ঝাড়ছে, মেয়েরা সবার চুল বেঁধে দিচ্ছে, আর ঝুমরির মা চোখে জল নিয়ে রুটি বেলছেন, যেন নিজের মেয়ের বিয়ের দিনের মতো আবেগে ভরে উঠেছে তাঁর মন। ঝুমরির ঘর থেকে বেরোনোর মুখে দাঁড়িয়ে ছিল মাধব, কাঁধে বাঁশি। সে হাসল—“ঝুমরি, গান দিয়ে আজ পুরুলিয়াকে জাগিয়ে দিস।”
উৎসবের মঞ্চে পৌঁছাতে ঝুমরি ও তার দলের মেয়েরা হাত ধরাধরি করে চলছিল। তারা গিয়েছিল লোকাল ট্রাকে চেপে—পেছনে কাঁথা পাতা, সঙ্গে ঢোল, খঞ্জনি, বাউল-তানপুরা। গাড়ির ঝাঁকুনির মধ্যেও গান গেয়ে উঠেছিল একেকজন, গলার রেওয়াজ যেন নিজের মধ্যে নিজেই হয়ে যাচ্ছিল। ঝুমরি জানত, আজ শুধু গান নয়, তার দলের প্রতিটি পদক্ষেপ যেন সেই গ্রামের মুখ। মঞ্চের পেছনে দাঁড়িয়ে তারা যখন শেষ প্রস্তুতিটুকু নিচ্ছিল, তাদের চোখে-মুখে ছিল এক ধরণের নিঃশব্দ প্রতিজ্ঞা—নারী হয়ে, গরিব হয়ে, সংস্কারের শেকল ভেঙে কীভাবে তারা নিজেদের গান দিয়ে পরিচয় তৈরি করেছে, তা আজ যেন প্রমাণ হবে এই কয়েকটি মিনিটে। পিছনের ব্যাকড্রপে বড় হরফে লেখা ছিল, “পুরুলিয়ার হৃদয়, তার গান।”
যখন ঝুমরি আর তার দল মঞ্চে উঠল, দর্শকাসনে ছিল হাজার হাজার চোখ। প্রথমে নিঃশব্দ, তারপর সেই পরিচিত ঝুমুর ঢোলের শব্দ শুরু হতেই এক আকুল আবেশ ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে। ঝুমরির কণ্ঠে ঝুমুর, পালা, প্রেম আর প্রতিবাদের সুর মিশে তৈরি করল এক এমন আবেগ যা মঞ্চ আর মাঠের সীমানা ভেঙে সবদিক ছড়িয়ে পড়ল। সে গাইছিল সেইসব গানের কথা, যা বলে “মেয়ে হওয়া দুর্বলতা নয়, শক্তি”, যে গান বলে “গলা দিয়েই রুখে দাঁড়ানো যায় সিস্টেমের বিরুদ্ধে।” ঝুমরির চোখে তখন জল, মঞ্চের পেছনে মাধব তার বাঁশির সুরে মিলিয়ে দিল ঝুমরির কণ্ঠস্বরকে। সেই সুর যেন শুধু গান নয়, একটি আন্দোলনের প্রতিধ্বনি, এক জীবন্ত শপথ।
অনুষ্ঠান শেষে উপস্থিত বিচারকরা উঠে এসে ঝুমরির দলকে জড়িয়ে ধরলেন। সবার কাঁধে বেজে উঠল ঢোলের গর্ব, আর মঞ্চের মাঝখানে ঝুমরি দাঁড়িয়ে ছিল, চোখে আনন্দ আর গর্বের জল। ঘোষিত হল—ঝুমরির দল “পুরুলিয়া জেলা উৎসবের শ্রেষ্ঠ গানের দল”। গ্রামে ফেরার পথে, ঝুমরি মাথায় সেই পদকের মুকুট নিয়ে ট্রাকে বসেছিল, তার পাশে বসা ছোটি, পুঁটি আর অন্য মেয়েরা, যারা আজ আর “মেয়ে” নয়, এক একটা অনন্য শিল্পী। গ্রামের লোকেরা মিছিল করে তাদের স্বাগত জানাল। সেদিন রাত্তিরে ঝুমরির মা তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “তুই শুধু গান শেখাস নি, ঝুমরি, তুই আমাদের বিশ্বাস শিখিয়েছিস। তুই পুরুলিয়ার কন্যা, কিন্তু তোর কণ্ঠ সব বাউড়ির কণ্ঠ।” ঝুমরি জানত, গল্পের মতো যে জীবন শুরু হয়েছিল, সে আজ এক অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি নয়, বরং শুরু—এক উজ্জ্বল সকালের গান।
শেষ




