সম্বিত দাশগুপ্ত
অধ্যায় ১: সংকেত
চাঁদের প্রান্তরের সেই গভীর নিশুতি ভেদ করে যখন ‘অরোরা-১’ গবেষণা কেন্দ্রের অ্যান্টেনা প্রথমবারের মতো এক অদ্ভুত কম্পনধর্মী সংকেত ধরা পড়ল, তখন কেউই তা গুরুত্ব দিতে চায়নি। মহাকাশে এমন ইন্টারফেরেন্স হরহামেশাই দেখা যায় — সৌরঝড়, উপগ্রহের প্রতিধ্বনি, কিংবা অজানা মহাজাগতিক কণার ছোটাছুটি। কিন্তু ড. অনিরুদ্ধ সেনের অভিজ্ঞ চোখ বুঝে ফেলল, এতে আছে কিছু ভিন্নতা। সংকেতটি ছিল ছন্দোময়, নির্দিষ্ট বিরতিতে ফিরে আসছিল। সময়মতো পুনরাবৃত্তি, নির্দিষ্ট উচ্চতা ও কম্পাঙ্কে শব্দের মতো কিছু… যা প্রাকৃতিক নয়, বরং কৃত্রিম। তারপরে আরও অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল — সেই সংকেতের তরঙ্গবিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিস্তা রায় বললেন, “এটা যেন কারও নিঃশব্দ আর্তি… যেন কেউ অন্ধকারের আড়াল থেকে ডাকছে।” এই কথাটুকু শোনামাত্র কর্নেল সামীর ভট্ট মুখ শক্ত করে বলেছিলেন, “ভুলেও ভাববেন না, এটা সাহায্যের ডাক। হতে পারে এটা আমাদের দিকেই টেনে নেওয়ার ফাঁদ।” বাইরে তখন চাঁদের নিঃস্তব্ধ প্রান্তরে রোভার ধীর গতিতে চলছে, যেন মাটির ভেতর থেকে কিছু অনুসন্ধান করছে, আর ঘন অন্ধকারে ধীরে ধীরে সক্রিয় হচ্ছে কিছু — অদৃশ্য, অথচ সজীব।
রাফি আহমেদ সেই রাতে রোভার নিয়ন্ত্রণে ছিল। সংকেতের উৎস বুঝতে গিয়ে সে রোভারকে পাঠায় ‘ওমেগা-ক্রেটার’-এর প্রান্তদেশে। সেই অঞ্চল আগে কখনও বিশ্লেষণ করা হয়নি, কারণ সেটি ছিল একধরনের মৃতভূমি — কোনও প্রতিফলন নেই, কোনো চৌম্বকীয় বিকিরণ নেই, এমনকি তাপমাত্রাও স্থির। কিন্তু এবার সেখানে পাওয়া গেল এক সূক্ষ্ম চৌম্বকদৈর্ঘ্য, যা সংকেতের মতোই সময় ধরে পুনরাবৃত্তি হচ্ছিল। রোভার ধীরে ধীরে এগোতে থাকল — তারপর হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। ক্যামেরার ফিডে দেখা যায়, জমিনে এক গোলাকৃতি অবয়ব, যেন পাথরের গায়ে খোদাই করা চক্রাকারে আবদ্ধ দরজা। তার ঠিক মাঝখানে এক গোল পাথর বসানো, যাতে খোদাই আছে অজানা প্রতীক — তিস্তার ভাষায়, “এগুলো যেন ধ্বংস হওয়া কোনো ভাষার লিপির মতো।” অনিরুদ্ধ নির্দেশ দিলেন ওটা নাড়ানোর, কিন্তু রোভার যতবারই পাথর স্পর্শ করে, ততবারই তার সেন্সর কাজ বন্ধ করে দেয় — মনে হচ্ছিল দরজাটি নিজে থেকেই কিছু রক্ষা করছে। হঠাৎ, সংকেতের কম্পাঙ্ক এক ধাক্কায় দ্বিগুণ হয়ে গেল, এবং সেন্ট্রাল কমিউনিকেশন ডিভাইসে এক বিকট শব্দ শোনা গেল — যেমনটা আগুনে লোহা ফাটলে হয়। তিস্তা কিছুক্ষণের মধ্যে বলে ওঠে, “এখন এটা শুধু সংকেত নয়, এটা এক মস্ত বড় তথ্য প্যাকেট… সম্ভবত একটি স্মৃতি!”
ফেরার সময় কর্নেল সামীর মুখে চিন্তার রেখা, “এই জায়গা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।” অনিরুদ্ধ কিছু বলেননি, কিন্তু তাঁর চোখ ছিল উত্তপ্ত — কৌতূহল আর দ্বিধার মিশেল। তখন কেউই জানত না, চাঁদের বুকের ওই দরজার নিচে ঘুমিয়ে আছে এক অস্তিত্ব, যাকে মানুষের ইতিহাস ভুলে গেছে। অরোরা-১ কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিকরা সংকেত বিশ্লেষণ করে আবিষ্কার করলেন, এটি শুধুমাত্র এক সুনির্দিষ্ট তরঙ্গই নয় — বরং এক সংগঠিত মনোজাগতিক ছন্দ, যেটা শুধু যন্ত্রে নয়, মানুষের মস্তিষ্কেও প্রতিধ্বনিত হতে পারে। তাদের চোখে তখনও ‘নুয়ান’ নামটা আসেনি, কিন্তু দূরে কোথাও, সেই গুহার গভীরে, এক সত্তা ধীরে ধীরে জেগে উঠছিল — তার চেতনার আলোতে আলোড়িত হচ্ছিল চাঁদের মৃতপ্রায় বুক। গবেষণা এখন আর শুধুই বৈজ্ঞানিক নয়, তা হয়ে উঠেছে অস্তিত্বের প্রশ্ন, ইতিহাসের পুনর্জাগরণ, এবং ভবিষ্যতের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া এক অনিশ্চিত প্রশ্ন — আমরা কি একা? নাকি কেউ অপেক্ষা করছে, আমাদের খুঁজে পাওয়ার?
অধ্যায় ২: ভাষাহীন বার্তা
তিস্তা রায় চন্দ্রগবেষণা কেন্দ্রের সিগন্যাল অ্যানালাইসিস কক্ষে একটানা আট ঘণ্টা বসে সংকেতটির প্রতিটি দিক বিশ্লেষণ করছিলেন। ধাতব একপ্রকার ধ্বনি, তাতে বারবার ফিরে আসে এক ছন্দ — উচ্চ, নিম্ন, নিম্ন, উচ্চ — এইভাবে। শব্দ নয়, বরং শব্দের স্পন্দন। তার ঘরে ছড়িয়ে ছিল ছাপা তরঙ্গরেখার অজস্র কাগজ। মস্তিষ্কে যেন জমাট বাঁধছিল শব্দহীন এক সংলাপ। তিস্তার চোখে তখন ঘুম নেই, কিন্তু তীক্ষ্ণ এক জেদ। ওর মন বলছিল, এটি কেবল মাত্র র্যান্ডম সিগন্যাল নয়। এক ধরণের কমিউনিকেশন কোড — ঠিক যেমন প্রাচীন সভ্যতার মানুষ গুহাচিত্রে ছবি আঁকতো তাদের মনের ভাব প্রকাশের জন্য, তেমনই। হঠাৎই একটি স্পন্দনের ধারায় সে খেয়াল করল — প্রতি দশটি সংকেত পরে, একবার এক অদ্ভুত বিকিরণ তৈরি হচ্ছে। যেন কিছু মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে, কোনো স্মৃতি, কোনো পুরনো ইতিহাস। “এটা যেন গানের মতো গঠিত,” সে চিৎকার করে ওঠে। ড. অনিরুদ্ধ তখন পাশেই ছিলেন। তিনি স্নায়ুবিজ্ঞানের দিক থেকে বলেন, “হয়তো এটি কোনো প্রজাতির স্মৃতি-সংগ্রহের পদ্ধতি — যারা কথা বলত না, ভাব আদানপ্রদান করত তরঙ্গের মাধ্যমে।”
এদিকে কর্নেল সামীর ভট্ট দিনদিন আরও অস্বস্তি অনুভব করছিলেন। এই সংকেত যদি শত্রুপক্ষের প্রযুক্তিগত ফাঁদ হয়, তবে পুরো মিশন ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। কেন্দ্রের নিরাপত্তা বাড়ানো হল, সব মডিউলে রেড অ্যালার্ট চালু। রাফি তখনও ক্রেটার এলাকার বাইরে থাকা রোভার ঠিক করতে ব্যস্ত। সংকেত আসছে একইভাবে, কিন্তু রোভার সিস্টেমে বিচ্ছিন্ন ঝাঁকুনির মতো কিছু ঘটছে, যা রাফি বোঝাতে পারছিল না। রোভারকে যতবারই সেই গোল দরজার সামনে আনা হচ্ছিল, ততবারই তার ক্যামেরা ঝাপসা হয়ে আসছিল, যেন জায়গাটা নিজেই লুকাতে চাইছে নিজেকে। রাফি এক নতুন ট্রিক ব্যবহার করে — রোভারকে পিছনের দিকে রাখা ক্যামেরা দিয়ে ঘোরানোর আদেশ দেয়, যেন একপ্রকার সরাসরি যোগাযোগ না রেখেও পর্যবেক্ষণ করা যায়। তাতে তারা দরজার প্রান্তে কিছু নতুন রূপ দেখতে পায় — সূক্ষ্ম রেখায় খোদাই করা কিছু আকৃতি, যেগুলো দেখতে অনেকটা DNA-র ডাবল হেলিক্স কাঠামোর মতো। বিজ্ঞানীদের মনে তখন এক প্রশ্ন — এটা কি জীবিত কিছু রক্ষার ব্যবস্থা? না কি মৃত কিছু?
রাতে, তিস্তা ও অনিরুদ্ধ একসঙ্গে বসে সংকেতের ছন্দ বিশ্লেষণ করছিলেন। তিস্তার হিসাব অনুযায়ী, প্রতিটি সংকেত একরকম ভাবনার প্রতিনিধিত্ব করছে। সেগুলোর ছন্দকে মানুষের মস্তিষ্কে ইমেজ রূপে কল্পনা করে দেখলে দেখা যায় — কিছু প্রতীক, কিছু ছায়া, এবং মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা এক সত্তা, যার চোখ নেই, মুখ নেই — কিন্তু আছে অস্তিত্ব। সে যেন ডাকছে, জানাচ্ছে তার বন্দিদশার কথা, অথবা ইতিহাসের ভার সহ্য করতে না পারার আকুতি। অনিরুদ্ধ বললেন, “তুমি কি বুঝেছো, এই সংকেত একটি প্রাণের নয়, একটি সভ্যতার আত্মার মতো?” তিস্তা চুপ। তার চোখ শুধু মনিটরে থাকা সেই আবছা তরঙ্গরেখার দিকে। এ সংকেত ভাষাহীন, তবুও কথায় ভরা। এ ভাষা বোঝার জন্য দরকার সেই অনুভূতির শক্তি, যা মানুষ প্রায় ভুলে গেছে। এই সময় কর্নেল সামীর একবার এসে দরজায় দাঁড়িয়ে বলেন, “আপনারা যে-ই হোন, বিজ্ঞানী হোন বা দার্শনিক — মনে রাখবেন, এই গবেষণাকেন্দ্র ভারত সরকারের অধীনে, আপনারা যতদূর যেতে পারবেন, তার সীমা আছে।” অনিরুদ্ধ তখন ধীরে বললেন, “কিন্তু এই সংকেতের কোনও সীমা নেই, কর্নেল। এটা কোথা থেকে এসেছে জানলে, আমাদের নিজের অস্তিত্বকেই নতুনভাবে বুঝতে হবে।” বাইরে তখন চাঁদের নির্জন প্রান্তর আলোকিত হচ্ছিল দূরবর্তী সূর্যের আলোয় — আর সেই অদৃশ্য দরজার নিচে যেন কিছু একটার নড়াচড়া শুরু হয়েছিল।
অধ্যায় ৩: ভেতরের খোঁজ
চাঁদের অন্ধকার এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে ‘অরোরা-১’ গবেষণা কেন্দ্র তখন যেন দুই ভাগে বিভক্ত — একদিকে বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস, সংকেতটি একটি প্রাণ কিংবা প্রাচীন সভ্যতার চিহ্ন বহন করছে; আর অন্যদিকে সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে কর্নেল সামীর ভট্টের চিন্তা, এটি একটি অজানা শত্রুর সুকৌশল। কিন্তু বিভাজন সত্ত্বেও, সবাই একমত ছিলেন — সংকেতের উৎসস্থল, সেই গোলাকার পাথরের দরজার নিচে কি রয়েছে তা জানতেই হবে। অনিরুদ্ধ এবং তিস্তা সিদ্ধান্ত নেন এক exploratory মিশন পাঠানো হবে, যেটি সরাসরি পাথরের নিচে ঢুকতে পারবে। রাফি আহমেদ তখনই প্রস্তাব দেন, তার হাতে থাকা নতুন মডেলের রোভার — “সার্বারাস” — ব্যবহার করা যেতে পারে। এই রোভারটিতে ছিল লেজার কাটা ও ভূগর্ভ চিত্রগ্রহণের সুবিধা। তিনদিনের প্রস্তুতির পর চাঁদের সেই নির্জন ক্রেটারে “সার্বারাস” নেমে যায়, তার ক্যামেরায় দেখা যায় — দরজার ঠিক চারপাশে সূক্ষ্ম আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে, যেমনটা সাধারণত জৈবিক পদার্থের কাছাকাছি দেখা যায়। তখন রাফির এক নির্দেশে রোভার দরজার ঠিক কেন্দ্রের পাথরে হালকা চাপ দেয় — সঙ্গে সঙ্গে এক বিকট শব্দে দরজার চারপাশের ধূলিকণা ঘূর্ণি হয়ে উড়ে যায়, এবং স্লো-মোশনের মতো করে দরজাটি নিচের দিকে সরে যেতে শুরু করে।
ভিতরে এক শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্য। অন্ধকার সুড়ঙ্গপথ, যেটি প্রাকৃতিক গুহার মতো নয় বরং স্পষ্টভাবে কৃত্রিমভাবে নির্মিত। দেয়ালে সূক্ষ্ম খোদাই, দেখতে অনেকটা পাথরের গায়ে গলানো ধাতুর মতো, কিন্তু তাতে প্রাণ রয়েছে। রোভার ধীরে ধীরে এগোতে থাকল — তার লাইটে দেখা গেল, পথের দু’পাশে খাড়া করে বসানো রয়েছে পাথরের ভাস্কর্য — মানুষের মতোই, কিন্তু তাদের চোখ নেই, মুখও অবয়বহীন — যেন নিঃশব্দ পাহারাদার। তিস্তা তখন বলেন, “এরা সম্ভবত প্রতীক — হয়তো ইতিহাসের অভিভাবক।” সুড়ঙ্গ শেষে এক গোলাকৃতি কক্ষে রোভার প্রবেশ করল, যার মধ্যভাগে রাখা এক স্বচ্ছ গম্বুজ, তার ভেতরে যেন আবছা কিছু নড়ছে। ক্যামেরা জুম করলে দেখা গেল — এক মানবাকৃতি সত্তা, নিঃসাড়, চোখ বন্ধ, অথচ পাঁজরের ভেতর থেকে নিঃস্পন্দ আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। এটা দেখতে ঠিক মানুষ না, কিন্তু মানুষের ছায়ার মতো — গায়ের গঠন পাতলা, মাথার উপর অদ্ভুত আর্ক-আকৃতির হাড়ের গঠন, আর চোখের জায়গায় দুটি স্বচ্ছ পাথর। সবাই চুপ। তিস্তা প্রথম বলে ওঠে, “এটাই হয়তো আমাদের সংকেত পাঠাচ্ছিল — টেলিপ্যাথির মাধ্যমে।”
রোভার যখন ধীরে ধীরে তার দিকে এগোচ্ছে, তখন হঠাৎ সেই সত্তার শরীর থেকে এক তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে, যা অরোরা-১ কেন্দ্রের সমস্ত যন্ত্রপাতিকে মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ করে দেয়। কেন্দ্রের আলো নিভে যায়, কন্ট্রোল রুমে এক মুহূর্তের নিঃশব্দতা নেমে আসে। তিস্তা ঘাড় ঘুরিয়ে অনিরুদ্ধের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমরা এক জীবন্ত বুদ্ধির মুখোমুখি।” কর্নেল সামীর তৎক্ষণাৎ গবেষণা বন্ধ করার আদেশ দেন — কিন্তু তখন অনিরুদ্ধ বলেন, “এই মুহূর্তে যদি কিছু বন্ধ করা হয়, সংকেত হয়তো চিরতরে হারিয়ে যাবে।” সেই মুহূর্তেই গবেষণা কেন্দ্রের মনিটরে ফুটে ওঠে এক নতুন সংকেত — গাণিতিক ভাষার ছায়া, এবং তার নিচে একটি অনুবাদযোগ্য প্রতীক, যেটি শুধু একটাই শব্দ বহন করছে: “স্মরণ”। রাফি তখন বলে ওঠে, “তাহলে এটি মানুষ নয়, ইতিহাস — আর এটা এখনও আমাদের মনে রাখতে চাইছে।” গবেষণা কেন্দ্রের সবাই তখন বুঝতে পারে — এই আবিষ্কার শুধু বৈজ্ঞানিক নয়, এটা এক মহাসভ্যতার চিহ্ন, যারা হয়তো হাজার বছর আগে পৃথিবী থেকে পালিয়ে এসে এখানে লুকিয়ে ছিল। প্রশ্ন ছিল এখন একটাই — তারা কি আমাদের মতোই মানুষ ছিল? না কি মানুষ তাদেরই উত্তরসূরি? আর যদি তাই হয়, তাহলে আমরা কি নিজের অতীতকে ভুলে গেছি, না কি কেউ আমাদের ভুলিয়ে দিয়েছে?
অধ্যায় ৪: অতীতের ছায়া
তিস্তা রায় সংকেতের সাম্প্রতিকতম তরঙ্গ বিশ্লেষণ করতে গিয়েই বুঝলেন— এই বার্তায় শুধু তথ্য নেই, আছে অনুভব। সে স্পষ্টভাবে বলতে পারছিল না কেন, কিন্তু সংকেতটির ভিতরে যেন এক প্রকার “চাপা কষ্ট” অনুভব হচ্ছিল— যেন কেউ অসহায়ভাবে কাউকে কিছু জানাতে চাইছে, অথচ ভাষাহীন। ড. অনিরুদ্ধ তখন তার পাশে বসে থাকা মনিটরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, “তিস্তা, তুমি এই ধরণের তরঙ্গ আগেও কোথাও দেখেছো?” সে মাথা নাড়ে। “কখনো না। কিন্তু এতে একটা বিশ্লেষণযোগ্য ছন্দ আছে, যত বিশ্লেষণ করি, ততই মনে হচ্ছে এ এক অভ্যন্তরীণ চেতনার দোলা।” অনিরুদ্ধ তখন বলেন, “তাহলে এটা হয়তো সত্যিই একটি চেতনা— একটি স্মৃতি—যেটা সময় পেরিয়ে এখনও টিকে আছে।” এরই মাঝে রাফি তার মেরামতকৃত রোভারকে আবার সেই ভূগর্ভস্থ চেম্বারে পাঠান। এবার রোভার আরও গভীরে গিয়ে আরও একটি ঘর আবিষ্কার করে, যেটি দেখলে যেন মনে হয় এক ধরণের “আর্কাইভ চেম্বার”— দেয়াল জুড়ে সূক্ষ্ম প্রতীক, পাথরের উপর চিত্ররূপের আদলে কিছু খোদাই, যার মাঝে বারবার ঘুরে ফিরে আসে এক অদ্ভুত দৃশ্য: বিশাল ঢেউয়ের মাঝে বিলীন হয়ে যাচ্ছে এক মহাদেশ, আর আকাশপথে ছোট ছোট যান উড়ছে, চাঁদের দিকে রওনা হয়ে।
তিস্তা ও অনিরুদ্ধ মিলিয়ে এই চিত্রের প্রতিটা দিক বিশ্লেষণ করেন। তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছান— এটি কোনো কল্পনা নয়, বরং একটি হারানো সভ্যতার চাক্ষুষ ইতিহাস। সেই সভ্যতা, যারা পৃথিবীর ওপর এক দুর্যোগের সময়, চাঁদে আস্তানা গড়েছিল। এই ছবি দেখে তিস্তার চোখ স্থির হয়ে আসে, “এরা কি আমাদের মতো দেখতে?” অনিরুদ্ধ বলেন, “তাদের মাথার গঠন, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মানুষের মতোই, কিন্তু চোখের জায়গায় পাথর বসানো কেন?” তিস্তা ধীরে বলেন, “হয়তো তারা কোনোভাবে দেখত না, তারা অনুভব করত।” এই বিশ্লেষণ করতে করতেই রোভার আরও একটি সংকেত ধারণ করে, যেটি ছিল এক দীর্ঘ তরঙ্গধারার সঙ্গীতের মতো— মন ছুঁয়ে যাওয়া এক ধীর ও গাঢ় সুর, যার মধ্যে বেদনার গন্ধ। সেই সুর শুনে তিস্তা ঘাড় নিচু করে চুপ করে থাকেন, আর অনিরুদ্ধ কাচের পেছনে তাকিয়ে বলেন, “এদের অস্তিত্ব হয়তো শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু ওরা চাইছে আমরা তা মনে রাখি। আমরা যেন ওদের বিস্মৃত না হই।”
তবে এই আবিষ্কারের খবর দীর্ঘক্ষণ চেপে রাখা গেল না। ভারতের স্পেস ইন্টেলিজেন্স শাখা এই সংকেতের রেকর্ড পেয়ে যায় এবং কর্নেল সামীর ওপর চাপ সৃষ্টি করে এই গবেষণা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিতে। সামীর দ্বিধায় পড়ে যান— একদিকে দায়িত্ব, আরেকদিকে এক এমন সত্য যা মানুষ জানে না। তিনি অনিরুদ্ধকে ডেকে বলেন, “আপনারা বুঝতে পারছেন তো, আমরা একটা সীমার মধ্যে কাজ করছি। যদি এই তথ্য ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে বৈশ্বিক রাজনৈতিক ভারসাম্য বদলে যেতে পারে।” অনিরুদ্ধ উত্তর দেন, “সত্য কখনো সীমার মধ্যে থাকতে পারে না, কর্নেল।” তার গলায় ছিল কোনো প্রতিবাদ নয়, ছিল এক ধরনের অভিমান। ঠিক তখনই ঘটে যায় এক অনভিপ্রেত ঘটনা— ভূগর্ভস্থ সেই গম্বুজে রাখা সত্তার চারপাশে হঠাৎ এক ঝলক আলো ছড়িয়ে পড়ে, এবং সংকেতের গতি দ্বিগুণ হয়ে যায়। রোভার বিকল হয়ে যায়, আর গবেষণা কেন্দ্রে বিপদ সংকেত বেজে ওঠে। মুহূর্তের মধ্যেই সব আলো নিভে যায়, যেন কেউ বা কিছু জেগে উঠছে বহু বছরের ঘুম ভেঙে। রাফি চিৎকার করে ওঠে, “ওটা বেঁচে আছে! ও জেগে উঠছে!” তিস্তা তখন নিঃশব্দে বলে, “না, সে শুধু জাগছে না… সে আমাদের স্মরণ করাচ্ছে—তাকে, তাদের, আমাদের অতীতকে।” চাঁদের ওই একটুকরো গহ্বরে সেই মুহূর্তে কেবল আলো আর কম্পনের সুর বাজছিল না, বাজছিল এক সভ্যতার ফিরে আসার চাবিকাঠি—ভবিষ্যতের ইতিহাস রচনা করতে চলেছে এক বিস্মৃত অতীত।
অধ্যায় ৫: স্মৃতির ফাঁদ
চাঁদের নীলাভ আলোয় ছেয়ে থাকা সেই নির্জন গবেষণা কেন্দ্রের অভ্যন্তরটা কেমন যেন দম বন্ধ করা অনুভব হচ্ছিল। রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে বিজ্ঞানীরা সংকেত বিশ্লেষণ করলেও সঠিক কিছু স্পষ্ট হচ্ছিল না। অথচ প্রতিটি মুহূর্তে নতুন এক অদ্ভুত ব্যাখ্যা উঠে আসছিল। ড. আয়ুশা একরাশ কাগজ ছড়িয়ে বসে পড়েছিলেন কন্ট্রোল রুমে। হালকা মাথাব্যথা নিয়ে তিনি জানালার দিকে তাকালেন—দূরে পাহাড়ের গায়ে এখনও সেই রহস্যময় আলোটা টিমটিম করছে, যেখান থেকে সংকেত পাঠানো হচ্ছে বলে ধারণা। হঠাৎই লুনা রোভার চালিয়ে রণদীপ ফিরে এল, তার হেলমেট খুলে একরাশ ঘাম মুছতে মুছতে বলল, “আমি নিশ্চিত, সেখানটা এক প্রাচীন শিলাখণ্ডের ভিতরে ঘেরা। কিন্তু ওই পাথরের গায়ে মানুষের মত খোদাই! কে বা কারা করেছে সেটা—আমরা জানি না।” তার গলায় যেন ভয় ও কৌতূহলের মিশেল। সায়ন্তনের ল্যাবে থাকা ‘মেমরি এক্সট্রাক্টর’ যন্ত্রের কথা মনে পড়ল রণদীপের। এই যন্ত্র ব্যবহার করে প্রাচীন সত্তার স্মৃতিকে জীবন্তভাবে দেখা সম্ভব, যদি তার কোষজাত ডেটা ঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা যায়। আয়ুশা এবং রণদীপ মিলে সেই ধারণাকেই সামনে রেখে পরিকল্পনা শুরু করল।
পরের দিন সকালে, সায়ন্তন ও অ্যালেক্স সেই পাথরের গুহার ভিতর থেকে সংগৃহীত নমুনাগুলি পরীক্ষাগারে এনে রাখে। নমুনাগুলোর গায়ে ছিল মাইক্রোস্কোপিক লিথিয়াম-ক্যালসিয়াম গঠন, কিন্তু তার চেয়েও অদ্ভুত ছিল একধরনের জীবন্ত কোষের অস্তিত্ব, যেটা হাজার হাজার বছর ধরে জ্যোতির্বিজ্ঞানের সমস্ত ধারনাকে উপেক্ষা করে টিকে ছিল! সায়ন্তন সেগুলির উপর অত্যন্ত সতর্কভাবে মেমরি এক্সট্রাক্টর স্থাপন করল। যন্ত্রটি চালু হতেই প্রথমে অদ্ভুত শব্দ হতে লাগল। তারপর চারদিক অন্ধকার হয়ে গিয়ে হঠাৎ এক উজ্জ্বল আলোর ঝলক—একটা ভিজুয়াল ফুটেজের মত মনে হল। সবাই বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইল বিশাল স্ক্রিনের দিকে। দৃশ্যপটে ধীরে ধীরে উদিত হল এক প্রাচীন সভ্যতার চিত্র—চাঁদের উপর বিশাল শহর, গম্বুজাকৃতি ঘরবাড়ি, বায়ুশূন্যতা কাটিয়ে চলার উপযোগী যানবাহন। আর তার মাঝে মাঝে হেঁটে বেড়ানো এক রহস্যময় প্রজাতি—যাদের গঠন কিছুটা মানুষের মত হলেও চোখদুটি বড়, মাথা চ্যাপ্টা, ও হাতের আঙুলগুলো ছিল পাঁচটার বদলে ছয়টি। দৃশ্যপট ঘনিয়ে এল—চাঁদ তখন ধ্বংসের মুখে, বিশাল এক সৌরঝড় আসন্ন। সেই প্রজাতির কিছু সদস্য একটি গভীর গুহায় ঢুকে নিজেকে ঘুমের মতো ঘোরে পাঠাচ্ছে, যেন তারা ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষা করছে।
এই স্মৃতির ঝলক সকলের মনে গভীর প্রভাব ফেলল। সায়ন্তন মাথা চুলকে বলল, “তাহলে আমাদের সামনে থাকা জীব—সে কোনো এলিয়েন নয়। এটা সেই প্রজাতির শেষ প্রতিনিধি, যাদের একটা সময়ে চাঁদ ছিল নিজের বাসভূমি।” আয়ুশা ধীরে ধীরে বলল, “আর আমরা যদি ভুল করি? যদি এই স্মৃতির টুকরোগুলো কেবল বিভ্রম হয়?” অ্যালেক্স মাথা নেড়ে উত্তর দিল, “আমরা যা দেখছি, তা কেবল অতীত নয়, হয়ত এটাই ভবিষ্যতের ইঙ্গিত।” হঠাৎই গবেষণা কেন্দ্রের ভেতরে তীব্র শব্দ হল—দুই নম্বর ল্যাব থেকে ধোঁয়া উঠছে। সবাই দৌড়ে গিয়ে দেখে, সেই শিলাখণ্ডের ভেতরে বন্দি জীবটি নেই। তার জায়গায় শুধুই পাথরের গুঁড়ো আর একটুকরো স্ফটিক পড়ে আছে, যার মধ্যে ঝলসে উঠছে সেই একই চোখের মত দৃষ্টি। রণদীপ কাঁপা গলায় বলল, “ও বেঁচে গেছে… বা তাকে কেউ জাগিয়ে তুলেছে।” রহস্য এবার আর শুধু অতীতে নেই—তা এখন বর্তমানের হৃদয়ে ঢুকে পড়েছে। এক অজানা যুদ্ধের ইঙ্গিত যেন স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছে চাঁদের মৃতপ্রায় ভূখণ্ডে।
অধ্যায় ৬: সাদা ধূলোর নিচে
লুনার স্টেশন “অ্যারেমিস” আবারও স্তব্ধ হয়ে পড়েছে। সংকেত বিচ্ছিন্ন, কম্পিউটার সিস্টেম পুনরায় রিবুট করার চেষ্টা বিফল হয়েছে। এলেনা আর মিতুল কেন্দ্রের জেনারেটর রুমে প্রবেশ করে দেখতে পেলো, পুরো ইউনিট জুড়ে যেন কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে ছিঁড়ে ফেলেছে কিছু তার। কিন্তু সেটাই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অংশ নয় — দেওয়ালের গায়ে কেউ খোদাই করে রেখেছে চেনা-অচেনা গাণিতিক প্রতীক, যেগুলো একদম সেই প্রাচীন ভিনগ্রহের সংকেতের অনুরূপ। এলেনার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল, “এগুলো… এগুলো তো আমরা আগেই দেখেছি! কিন্তু কে করলো?” ঠিক তখনই ব্যাকআপ সিস্টেমে সামান্য আলো জ্বলে ওঠে, তাদের চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ওঠে ঘরের এক কোণে বসে থাকা এক আকৃতি — সেই পাথরের মতো মানবাকৃতি, যার অস্তিত্বই প্রমাণ করে সে এক প্রাচীন সভ্যতার প্রতিনিধি। তবে এবার সেটা কেবল বসে নেই, তার চোখ খুলে গেছে।
দল ছিটকে পড়ে। মিতুল দ্রুত ক্যাপ্টেন আলির সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে, কিন্তু তার হেলমেটে তখন এক অদ্ভুত ফিসফিসানি প্রবেশ করে — যেন বহু কণ্ঠ একসাথে ফিসফিস করছে কোনও নামহীন ভাষায়। ততক্ষণে এলেনা আতঙ্কে কিছুটা পিছিয়ে গেছে, আর “ঐ” আকৃতি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়েছে। সেটার চেহারায় ভয় নেই, বরং বিস্ময় আর দুঃখের ছায়া। সেটি হঠাৎই নিজের কণ্ঠে কথা বলে ওঠে, যান্ত্রিক কিন্তু কেমন যেন মানবিক অনুভূতি মেশানো ভাষায় — “তোমরা আবার এসেছো… পৃথিবী আবার উঠে দাঁড়াবে?” এই কথাগুলো শুনেই জ্যোতির্ময় বিস্ময়ে বলে ওঠে, “তাহলে আমাদের অনুমানই ঠিক… তুমি সেই সভ্যতার প্রতিনিধি, যারা চাঁদে এসে আত্মগোপন করেছিল।” আকৃতিটি ধীরে ধীরে ঘরের দেওয়ালে ভেসে ওঠা প্রতীকগুলোর দিকে ইশারা করে, তারপর জানায় যে তারা ছিল “আর্কাইভার” — এক প্রাচীন নক্ষত্র সভ্যতার ধ্বংসপ্রাপ্ত উত্তরাধিকারী, যারা নিজেদের জ্ঞানকে ভবিষ্যতের কোনও সভ্যতার কাছে পৌঁছে দিতে চাঁদের নিচে নীরবভাবে অপেক্ষা করছিল।
ক্যাপ্টেন আলি ও রাভি অবশেষে জেনারেটর কক্ষে পৌঁছলে দেখে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে গেছে। সেই ‘অভ্যাগত’ স্বচক্ষে দেখে তারা স্তম্ভিত, কারণ এই দর্শন একযোগে ভয়াবহ এবং বিস্ময়কর — যেন ইতিহাস ও ভবিষ্যতের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে তারা। আকৃতিটি জানায়, “সময় শেষ হয়ে আসছে। চাঁদের অভ্যন্তরে যেটা ঘুমিয়ে আছে, তা জেগে উঠবে — এবং সেটা ধ্বংস ডেকে আনবে।” সবাই থমকে যায়। কীসের ইঙ্গিত দিচ্ছে সে? চাঁদের নিচে আর কী লুকানো রয়েছে? ঠিক তখনই ভূকম্পন শুরু হয়। সেন্টার শেকিং। ক্যাপ্টেন চিৎকার করে ওঠে, “সবাই সতর্ক! আমাদের আরও গভীরে যেতে হবে… সত্যটা এখনও পুরোটা প্রকাশ পায়নি।” আতঙ্ক, কৌতূহল, আর দায়বদ্ধতা — এই তিনটি অনুভূতির ছায়ায় পাঁচজন মানুষ নামতে শুরু করে চাঁদের বুকে আরেক ধাপে, যেখানে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর নিয়তি লুকিয়ে রয়েছে।
অধ্যায় ৭: অজানা প্রতিরোধ
মহাকাশযান অরোরা-৭ এর অভ্যন্তরে এখন শুধুই উদ্বেগ আর রহস্যের ছায়া। ডাক্তার অন্বেষা রায় ও লেফটেন্যান্ট কুশল দত্ত মিলে ওই অদ্ভুত সত্তার স্নায়বিক গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছিলেন। সত্তাটি নিজেই নড়ে না, কিন্তু ওর চারপাশের শক্তিকণা যেন সময়ে সময়ে তরঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ছিল। অন্বেষা বুঝতে পারছিলেন—এটা কোনো সজীব বার্তা নয়, বরং একটা প্রতিরক্ষামূলক প্রতিক্রিয়া। তারা কিছু একটার খুব কাছাকাছি চলে এসেছে, হয়তো খুব বেশিই কাছাকাছি। হঠাৎ করেই বেসের একটি সাইড চেম্বার থেকে প্রচণ্ড শব্দ উঠে আসে, যেন ভেতরে কিছু একটা ধ্বংস হয়েছে। কুশল দৌঁড়ে সেখানে পৌঁছান, দেখে যান—ল্যাবের একাংশ অচল হয়ে পড়েছে। কম্পিউটার স্ক্রিনে আগুনের মতো রঙের মধ্যে আবছাভাবে ভেসে উঠছে কিছু প্রতীক, যেগুলোকে কোনো ভাষা হিসাবে শনাক্ত করা যাচ্ছে না, কিন্তু সত্তার মস্তিষ্ক তরঙ্গের সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে। এটা স্পষ্ট—ওরা সত্তাটিকে শুধু জাগিয়ে তোলে নি, বরং ওর পূর্বস্মৃতি বা প্রাচীন সংকেত সিস্টেমকেও সক্রিয় করে ফেলেছে।
ডঃ সাহিল বন্দ্যোপাধ্যায় এই সংকেত বিশ্লেষণের দায়িত্ব নিচ্ছেন, আর তার পাশে বসে রয়েছেন ক্যাপ্টেন মিরা সেন। সাহিল ধীরে ধীরে বুঝতে পারছেন, এ সংকেত যেন কোনো নির্দিষ্ট প্যাটার্নে আবৃত। অনেকটা একটা পুরোনো শব্দধ্বনির মতো, যেটা বারবার নির্দিষ্ট ছন্দে ফিরে আসছে। মিরা বললেন, “এটা কি সম্ভব যে ও নিজেই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে?” সাহিল মাথা নাড়লেন, “হয়তো বা। তবে সেটা বন্ধুত্বপূর্ণ কিনা, সেটাই বড় প্রশ্ন।” ঠিক তখনই তাঁদের সামনে সত্তার গ্লাস চেম্বারে হালকা চিড় দেখা যায়, আর সেই চিড় থেকে ধীরে ধীরে এক ধরণের নীল আলো বের হতে থাকে—যেটা কেবলমাত্র ইনফ্রারেড স্ক্যানারেই ধরা পড়ে। মিরা সতর্ক হন, পুরো ঘরকে সিল করে দেওয়া হয়, কিন্তু সেই আলো যেন চেম্বারের ভেতরে শুধু সত্তার মধ্যেই একধরণের বিক্রিয়া তৈরি করে চলেছে। ওর দেহের চারপাশে তরঙ্গ উঠে যাচ্ছে, মস্তিষ্কের মধ্যেকার স্নায়ুবন্ধনী দ্রুত সক্রিয় হচ্ছে। সাহিল রুদ্ধস্বরে বলেন, “এটা যদি পূর্ণ রূপে জেগে ওঠে, আমরা আর কিছুই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবো না।”
এদিকে লুনার বেসের বাইরে, গবেষক অর্ণব বসু আর প্রযুক্তিবিদ লিনা সেন তাঁদের নতুন-আবিষ্কৃত ভূগর্ভস্থ টানেলের আরেকটি অংশে প্রবেশ করেছিলেন। ওখানে এক প্রাচীন সভ্যতার আরও চিহ্ন মেলে—ধাতব গঠন, পাথরে খোদাই করা রাশি রাশি চিহ্ন, কিছু হিউম্যানয়েড অবয়বের মূর্তি, আর একটি কেন্দ্রীয় কক্ষে এক অদ্ভুত ধাতুর থালার মতো বস্তু, যার মধ্য থেকে দপদপ করে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। অর্ণব বললেন, “আমার মনে হচ্ছে এই বস্তুই ওদের শক্তির উৎস ছিল, কিংবা হয়তো এটা কোনো ধরনের সক্রিয় ডিভাইস।” হঠাৎ সেই আলো আরও তীব্র হতে থাকে, আর চারপাশ কেঁপে ওঠে—টানেলের ছাদ থেকে ধুলো আর পাথর খসে পড়ে। লিনা চিৎকার করে ওঠে, “এটা কি ওর সঙ্গে সংযুক্ত?” হ্যাঁ, এবার সবাই বুঝে যায়, ওই ভূগর্ভস্থ স্থাপনা, সত্তা, আর সংকেত—সবই একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত। চাঁদের বুকে একবার ঘুমিয়ে পড়া এক সভ্যতা আবার ধীরে ধীরে জেগে উঠছে, আর মানবজাতি এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে যাচ্ছে।
অধ্যায় ৮: অতীতের আওয়াজ
চাঁদের বুকে গড়ে ওঠা গবেষণা কেন্দ্র ‘অ্যালবিডো-১’ এই মুহূর্তে এক অজানা ইতিহাসের দরজায় দাঁড়িয়ে। সূর্যহীন অন্ধকার গুহার ভেতর আবিষ্কৃত সেই অদ্ভুত প্রাণীর পাশেই এখন দাঁড়িয়ে আছে ডঃ রেহান, ক্যাপ্টেন ইভা, লিউন এবং হায়মা। প্রাণীটির অর্ধ-মানবীয় চেহারা, অর্ধ-ধাতব আবরণ এবং তার শরীর থেকে নির্গত হওয়া অতি দুর্বল শব্দে বোঝা যাচ্ছে—এটি শুধু জীবিত নয়, বরং কথা বলতেও সক্ষম। হায়মা তার অনুবাদ সিস্টেমের মাধ্যমে শব্দগুলো ক্যাপচার করছে। এবং এক এক করে সেই সংকেতের মাধ্যমে উঠে আসছে এমন এক ইতিহাস, যা বিজ্ঞানীদের কল্পনারও বাইরে। প্রথমে যে ভাষাটি অস্পষ্ট ও অচেনা মনে হয়েছিল, সেটির ধরণে ক্রমে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে প্রাচীন সুমেরীয় ও দ্রাবিড় ব্যাকরণের মিল। শব্দগুলি একত্র হলে বোঝা যায়, “আমরা পৃথিবীর পুরোনো জাতি… ধ্বংসের আগে আশ্রয় নিয়েছিলাম এখানে… ফিরে যাব কি পারি?” — বার্তা এতটাই কাঁপিয়ে দেওয়া যে ক্যাপ্টেন ইভা নিজের হেলমেট খুলে ফেলার মতো অবস্থা তৈরি করে। লিউন স্পর্শ করতেই প্রাণীটির চোখ খানিক খোলে—তার চোখে ছিল শুধুই দীর্ঘশ্বাস আর গভীর শূন্যতা।
সেই মুহূর্তে রেহান একটি ভয়ঙ্কর সত্য আবিষ্কার করে। প্রাণীটি যে কন্টেইনমেন্ট চেম্বারে রাখা ছিল, তার পাশের দেয়ালে খোদাই করা ছিল কিছু প্রতীক ও চিত্র। সেগুলোতে দেখা যাচ্ছে — মহাসমুদ্রের ঢেউ, তুফান, ধ্বংসপ্রাপ্ত শহর এবং তারপরে মহাকাশযানে চড়ে কিছু মানুষ চাঁদের দিকে রওনা দিচ্ছে। মনে হচ্ছিল, পৃথিবীর এক সভ্যতা তাদের ভবিষ্যৎ জানত। তারা জানত পৃথিবী একদিন ধ্বংস হবে, এবং তার আগেই তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ রক্ষার্থে চাঁদে ঘাঁটি গড়বে। কিন্তু কী কারণে তারা পৃথিবীতে ফিরে আসেনি? আর কেনই বা তাদের সম্পর্কে কোনো ইতিহাস পৃথিবীর বুকে নেই? রেহান বুঝে যায়, সম্ভবত সভ্যতাটি অত্যন্ত অগ্রসর ছিল—তারা ইতিহাস মুছে দিয়েছিল, নিজেদের অস্তিত্বকে চিরতরে গোপন রাখতে। আর সেই প্রাণীটি—সে হয়তো ছিল সেই সভ্যতার শেষ দূত, যে কোনো কারণে বন্দি হয়ে পড়ে চাঁদের বুকে, ভবিষ্যতের কারো কাছে একটি বার্তা পৌঁছে দেওয়ার অপেক্ষায়।
গভীর শ্বাসে ভারি হয়ে ওঠে কন্ট্রোলরুমের বাতাস। কিন্তু ঠিক তখনই হায়মার ডিভাইসে আরেকটি সংকেত ধরা পড়ে—এটি আগের চেয়েও শক্তিশালী। শুধু শব্দ নয়, এবার সেই প্রাণীর দেহ থেকে নির্গত হচ্ছে একধরনের তরঙ্গ—যা সরাসরি প্রভাব ফেলছে তাদের চারপাশের যন্ত্রপাতিতে। আলো ঝাপসা হয়ে আসছে, কম্পিউটার স্ক্রিন ব্ল্যাংক হয়ে যাচ্ছে, এবং ক্যাপ্টেন ইভার হেলমেটে বিকৃতি ঘটছে। তার মানে এই প্রাণী শুধু কথা বলতে পারে না—তার মধ্যে রয়েছে একধরনের শক্তি, যা প্রযুক্তিকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। হায়মা জানায়, “এটা মেটা-ওয়েভ… খুব পুরোনো ধরণের শক্তি, যেটা শুধুই জৈবিক নয়, বরং কোয়ান্টাম স্তরে কাজ করে। যদি ঠিকঠাক বিশ্লেষণ করা যায়, তবে এ থেকে এমন প্রযুক্তির সূত্র পাওয়া যাবে, যা আমাদের সভ্যতাকেও বদলে দিতে পারে।” কিন্তু রেহান চিন্তিত—“আমরা কি প্রস্তুত এমন এক শক্তিকে জাগিয়ে তোলার জন্য? আমাদের সভ্যতাও তো একদিন… তাদের মতোই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।” চারদিকে তখন নিঃস্তব্ধতা। প্রাণীটি তার চোখ বন্ধ করে আবার ঘুমিয়ে পড়ে, যেন ভবিষ্যতের ওজন আর একবার নিজের কাঁধে নিয়ে নেয়।
অধ্যায় ৯: মহাকালের নিঃশব্দ দরজা
নীরবতা যেন চাঁদের এই প্রান্তে আরো ঘনীভূত হয়ে উঠেছে। ‘অরোরা বেস’ এখন পরিণত এক অজানা মঞ্চে, যেখানে সময়, বিজ্ঞান ও অতীতের ছায়া এক অদ্ভুতভাবে মিশে গেছে। ক্যাপ্টেন রায়, আরুষি, মিকো ও শিউলি — চারজনই এখন সেই বিশাল ভূগর্ভস্থ কক্ষের এক কোণে দাঁড়িয়ে, যার মধ্যে বন্দি ছিল সেই রহস্যময় প্রাণী — ‘প্রাচীন দূত’। কিন্তু আজ, তার কোষের দরজাটা ভেঙে পড়ে আছে। জীবটি নেই। কেবল ধূসরাভ ছায়ার রেখা মাটিতে যেন কিছু জানান দিচ্ছে — হয় পালিয়েছে, নয়তো এক অন্য বাস্তবতায় প্রবেশ করেছে। এদিকে শিউলি তার হোলোগ্রাফিক স্ক্যানারে দেখতে পাচ্ছে চাঁদের ভেতরের ভূগোল যেন বদলে যাচ্ছে। সেখানে একটি নতুন চ্যানেল তৈরি হয়েছে, যা গভীরতর এক ফাটল হয়ে মহাকালের মতোই বিস্তৃত। হঠাৎই বেজে ওঠে এক ঘন বেসুরো শব্দ — যেন চাঁদের নিচে কিছু খুলছে। ক্যাপ্টেন রায় বুঝে যান — এটা কোনো দরজা, কোনো প্রাকৃতিক ফাটল নয়, বরং এক প্রযুক্তিগত নির্মাণ, যা কোনো সভ্যতা অনেক কাল আগে তৈরি করেছিল।
তারা সবাই দ্রুত সেই শব্দের উৎসের দিকে এগিয়ে যায়। আরুষি তার ডেটা প্যাডে যাচাই করে জানায় — এই দরজার পেছনে রয়েছে এক “স্টেসিস ফিল্ড”, একধরনের স্থির-সময়ের কক্ষ, যা কেবলমাত্র মহাজাগতিক কোডেই খোলা সম্ভব। রায় বুঝে যান, তাদের জ্ঞান বা তথ্য দিয়ে এটি খোলা অসম্ভব — কিন্তু হয়ত সেই ‘প্রাচীন দূত’-ই এই কোড জানে। এবং সে হয়তো ঠিক এই দরজা খুঁজতেই বেরিয়েছে। হঠাৎই তাদের পেছনে বাজ পড়ে, শিউলি চমকে উঠে ঘুরে তাকায় — জীবটি ঠিক তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে। এবার তার চোখে ভয় নেই, বরং নিরুত্তাপ, সময়চক্রে ঘূর্ণায়মান এক আত্মার মত। সে ইঙ্গিত করে সেই দরজার দিকে। ক্যাপ্টেন রায় এক পলক দেখে বুঝে যান — এটাই মূল মুহূর্ত, এটা কেবল একটা বৈজ্ঞানিক অভিযান নয়, বরং ইতিহাসের গভীরে প্রবেশ করার চাবিকাঠি। তারা জীবটির পেছনে হাঁটতে হাঁটতে প্রবেশ করে সেই চ্যানেলের ভিতর। একসময় তারা পৌঁছায় সেই দরজার মুখে — যেটা কোনো ধাতু দিয়ে গঠিত নয়, বরং একরকম তরল-আলোয় তৈরি, যা স্পর্শ করলেই আঙুলের গায়ে হালকা স্রোতের মত প্রতিক্রিয়া হয়। জীবটি হঠাৎই দু’হাত তুলে একটা স্পন্দনের মত শব্দ তোলে — সেই দরজাটি ধীরে ধীরে খুলতে থাকে।
দরজার ওপারে তারা দেখে এক অপার্থিব দৃশ্য — এক বিশাল গম্বুজাকৃতি চেম্বার, যার প্রতিটি দেয়ালে সূক্ষ্ম নক্সায় অঙ্কিত এক সভ্যতার ইতিহাস। উঁচুতে এক জটিল যন্ত্র চলমান, তার মধ্যে এক স্ফটিকের কোর — যা বিকিরণ করছে এক শীতল, নীল আলো। জীবটি তাদের বোঝায় যে, এই যন্ত্রটাই ছিল তাদের “চেতনার গ্রন্থাগার”, যেখানে তারা পৃথিবীর প্রাচীন স্মৃতি, ভাষা, ও ইতিহাস সঞ্চয় করে রেখেছিল। আর সেই গ্রন্থাগারের শক্তি আজ ধীরে ধীরে শেষ হয়ে আসছে। আরুষি আবিষ্কার করে, সেই স্ফটিক আসলে সময়ের মধ্য দিয়ে বার্তা পাঠাতে পারে — ঠিক সেই সংকেতের মত যেটা তারা প্রথমে পেয়েছিল। শিউলি আবিষ্কার করে, এই স্ফটিক দিয়ে পৃথিবীতে এক সাবসিস্টেম পাঠানো হয়েছিল — যা হয়ত পৃথিবীর সভ্যতায় কখনও প্রভাব ফেলেছে, হয়তো তাদের ইতিহাসের অনেক বাঁকে। ক্যাপ্টেন রায় অনুভব করেন, এই কক্ষ, এই যন্ত্র, এই বার্তা — সবকিছুই শুধু বৈজ্ঞানিক নয়, বরং অস্তিত্বগত এক প্রশ্নের উত্তর। ‘আমরা কোথা থেকে এসেছি?’ ‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’ আর সেই উত্তরের দরজায় এখন তারা দাঁড়িয়ে।
অধ্যায় ১০: মহাশূন্যের প্রহেলিকা
নীরব চাঁদের ভূমিতে আবার একবার নেমে এলো ভোরের আলো। যদিও সূর্যের আলো এখানে পৌঁছাতে সময় লাগে এবং সেটা খুব ম্লান, তবু বেইজ ক্যাম্পের চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো এক অনন্য উজ্জ্বলতা, যেন এক যুগান্তকারী সন্ধিক্ষণ। কন্ট্রোল রুমে দাঁড়িয়ে থাকা তৃষা, ইরফান, ড. সেন ও অধিনায়ক রাভি কেউ একে একে তাকিয়ে থাকল সেই বিশাল হেলিকাল মাটির গহ্বরটির দিকে, যেটি নীচে কোনো এক বিস্ময় জগতের দরজা খুলে দিয়েছিল। প্রাচীন সেই গুহা যেখানে ধরা পড়েছে এক সভ্যতার চিহ্ন — নামহীন, ইতিহাসবর্জিত, অথচ উচ্চতর। তাদের পাঠানো সংকেত, তৃষার কানে শোনা অপার্থিব শব্দ, আর সেই হিউম্যানয়েড সত্তার ধ্বংসপ্রাপ্ত কক্ষ—সব মিলিয়ে এক ধাঁধার শেষ অধ্যায়ও যেন আবার একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা।
তৃষা এবং ড. সেন আবার সেই সংকেত বিশ্লেষণে বসেন। ডেটা থেকে তারা আবিষ্কার করলেন, শেষ সংকেতে একটি নির্দিষ্ট বিন্যাসে শব্দ ধ্বনিত হয়েছিল। ভাষাতত্ত্বের বিশেষ অ্যালগোরিদম দিয়ে তারা বের করলেন: সেটা ছিল একটা বিদায় বাণী। “আমরা পৃথিবীর সন্তান, কিন্তু ফিরে যেতে পারিনি। এখন চাঁদের কোলে নিদ্রিত।” এই শব্দগুলো যে শুধু তৃষার কানেই প্রতিধ্বনিত হয়েছিল, তা নয়—এটি আসলে ছিল সর্বজনীন, এক মানসিক অনুরণন। এমন ভাষা যা হৃদয় দিয়ে শোনা যায়, কানে নয়। ড. সেন বললেন, “তৃষা, এদের অস্তিত্ব যদি ধ্বংস হয়ে গিয়ে থাকে, তবে তারা আমাদের মস্তিষ্কে এমন সংকেত দিয়ে গেছে, যেটা কোনো যন্ত্রে ধরা পড়ে না। এটা নিছক বৈজ্ঞানিক নয়, এক ধরনের কসমিক ট্রান্সমিশন।”
বেইজ ক্যাম্পে ফেরার আগে অধিনায়ক রাভি ঘোষণা দেন: গুহার প্রবেশপথ সম্পূর্ণভাবে সিল করে দেওয়া হবে, কারণ এই প্রযুক্তি পৃথিবীকে এখনই প্রস্তুত নয়। তাঁরা চাঁদের পৃষ্ঠে একটি স্মারক ফলক স্থাপন করেন—একটি ধাতব চাকতির মতো, যার মধ্যে সংকেতটি হাইপারসোনিক কম্পনের মাধ্যমে খোদাই করা। তাতে লেখা থাকে: “এখানে এক সভ্যতা ঘুমিয়ে আছে, যারা একদিন ফিরতে চেয়েছিল।” যখন নভোযান উৎক্ষেপণের জন্য প্রস্তুত হয়, সবাই একসাথে পেছনে ফিরে চাঁদের সেই স্থির, রহস্যময় মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তৃষা জানে, সে কিছু রেখে যাচ্ছে যা তার আত্মার অংশ হয়ে গেছে—এক অনাবিষ্কৃত মানবিক বোধ, এক কল্পনাকে ছুঁয়ে যাওয়ার অনুভব। পৃথিবীর দিকে ফিরে যাওয়ার মুহূর্তে তার মনে হয়, এই অভিযান কেবল বিজ্ঞানের নয়, এই ছিল আত্মার এক অনুসন্ধান। চন্দ্ররহস্য আর কোনো বিজ্ঞানপত্রে থাকবে না—এটা এখন মহাশূন্যের প্রহেলিকা, এক নিঃশব্দ সাক্ষী এক হারিয়ে যাওয়া আলোকযুগের।
সমাপ্ত