Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

জাদুকরী লালরঙ

Spread the love

বর্ণালী রাহা


শহরের উত্তর দিকের পুরনো অলিগলির মধ্যে এমন একটা গলি আছে, যার নাম কেউ ঠিক ঠাহর করতে পারে না। লোকমুখে বলে “লালগলি”, কেউ আবার “ঠাকুরদালান গলি” বলে ডাকেন— কিন্তু অফিসিয়াল মানচিত্রে তার কোনও অস্তিত্ব নেই। এই গলির একদম শেষে, পুরোনো পাথরের সিঁড়ি ঘেঁষে, এক আধভাঙা দোকান। বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় না কী বিক্রি হয় সেখানে। দোকানের নামফলক নেই, কাচের জানালাও নেই—শুধু লাল কাপড় দিয়ে ঢাকা একটা কাচবিহীন গেট। কিন্তু সন্ধ্যে নামতেই ভেতর থেকে একরকম আলো ঝলসে ওঠে, যেন কেউ ভিতরে রক্তমাখা প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়েছে। দোকানটির নাম কেউ কখনো জিজ্ঞেস করে না—যারা আসে, তারা ঠিক পথ খুঁজে নেয়। আর যারা একবার এসেছে, তারা আবার ফিরে আসে। সেই দোকানে প্রতিদিনই সন্ধ্যেবেলা এক বৃদ্ধা বসেন—শাদা চুল, গাঢ় লাল পাড়ের শাড়ি, নাকের পাশে একটা কালী তিল আর চোখে এমন এক দৃষ্টি, যা কোনও প্রজন্মে দেখা যায় না। লোকজন তাঁকে ডাকে “ঠাকুমা”—তাঁর নিজের নাম কেউ জানে না, জানার প্রয়োজনও পড়ে না। তিনি বলেন কম, শুধু হাত নেড়ে ইশারা করেন কোন শাড়ি কার জন্য।

ঠাকুমার দোকানে কখনোই পুরুষ আসেন না—এ যেন নারীদের গোপন ঘর, এক অদৃশ্য আশ্রয়। এখানে আসে স্কুল শিক্ষিকা, অফিস কর্মী, বধূ, কলেজ পড়ুয়া এমনকি রাস্তার ধারে থাকা এক বাচ্চা মেয়েও। এই সব নারীর জীবনে কিছু না কিছু একটা চাপা থাকে—অপমান, অসম্মান, হতাশা, প্রতিবাদ, কিংবা কোনও না বলা গল্প। ঠাকুমার চোখে সে সব কথা লেখা থাকে, তিনি কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করেন না, কিন্তু ঠিক জেনে যান কার জন্য কোন শাড়ি। প্রতিটি শাড়ি লাল, কিন্তু লালের রঙে ভিন্নতা—রক্তলাল, ইটালাল, কমলা টান, তামাটে আভা, ম্যাড়ম্যাড়ে জামদানি কিংবা চকচকে কাতান। শহরের কেউ কেউ বলে, এ দোকানের শাড়ি একবার যে পরে, তার জীবনে কিছু না কিছু বদল আসে—কেউ ভয় হারিয়ে ফেলে, কেউ প্রতিবাদ করে, কেউ আবার দুঃস্বপ্ন ভুলে নতুন জীবন শুরু করে। শাড়িগুলোর মধ্যে যেন এক অদ্ভুত উষ্ণতা থাকে, শরীর ছুঁয়ে দিলে রক্ত টগবগ করে ওঠে, মনে হয় এইতো এখনই কিছু বলে ফেলব যা এতদিন বলতে পারিনি। কিন্তু আশ্চর্য হলো, ঠাকুমা কখনো টাকা চান না। তিনি বলেন, “যার প্রয়োজন, সে দিতে জানে।” কেউ টাকা রেখে যায়, কেউ চুপচাপ চলে যায়।

সেদিন সন্ধ্যে ছিল অন্যরকম। শ্রেয়া দত্ত নামের এক যুবতী হেঁটে চলেছে কলকাতার শহরতলির অফিস থেকে ফিরবার পথে। দিনভর বসের ঝাড়, সহকর্মীদের কটুক্তি, এবং নিজের ব্যর্থতাকে বুকের মধ্যে চেপে হাঁটছিল সে। তার চোখে ছিল আত্মবিশ্বাসহীনতা, ঠোঁটে দমে যাওয়ার চিহ্ন। হঠাৎ, সে যেন কোনও অদৃশ্য টানে ঢুকে পড়ে সেই ‘লাল গলি’তে। কখন কীভাবে গলির বাঁকে এসে পৌঁছল, বুঝতেই পারেনি। এক অদ্ভুত নীরবতা চারদিকে, শুধু দূরে কোনো বাড়ির ভেতর থেকে আসছে কাঁসরঘণ্টার আওয়াজ। আর সেই অলিতে এক কাচবিহীন দরজা—সামনে দাঁড়িয়ে ঠাকুমা, কাতান শাড়ির একগুচ্ছ তুলে ধরছেন বাতাসে। শ্রেয়ার ভেতরে কিছু যেন কেঁপে ওঠে, সে কিছু না বুঝেই ঢুকে পড়ে দোকানে। ঠাকুমা তার দিকে তাকিয়ে হেসে একটি গাঢ় রক্তলাল বেনারসি তার দিকে বাড়িয়ে দেন। মুখে বলেন না কিছুই, শুধু চোখে একরকম আশীর্বাদের আভা। শ্রেয়া হাত বাড়িয়ে নেয় শাড়িটি—তার ডানহাত স্পর্শ করতেই মনে হয় একটা কাঁপুনি উঠল শরীরে। দোকানের বাতাস হঠাৎ ভারী হয়ে এল, মনে হলো যেন দেয়ালের লাল কাপড়গুলো নিঃশ্বাস নিচ্ছে। শ্রেয়া ব্যাগ থেকে টাকা বার করতে গেলে ঠাকুমা বলেন, “না, আজ নয়—তুমি পরে এসো, যখন সময় হবে।”

সে রাতেই শ্রেয়া শাড়িটি পরে বসে থাকে আয়নার সামনে। আয়নায় সে যেন নিজেকে চিনতে পারে না—চোখে একরকম দীপ্তি, মুখে দৃঢ়তা, কাঁধ সোজা। সে ভাবে, এতদিন সে চুপ থেকেছে কেন? কেন নিজের প্রতি এত অবিচার করেছে? পরদিন অফিসে গিয়ে শ্রেয়া প্রথমবারের মতো বসের মুখের সামনে দাঁড়িয়ে বলে, “আমি চুপ থাকবো না। আপনি যা করেছেন তা অন্যায়।” সেদিন তার কণ্ঠে কাঁপনি ছিল না, চোখে ভয় ছিল না, আর সহকর্মীরা যেন হঠাৎ চুপ করে যায়। কেউ কেউ পরে বলে, শ্রেয়ার পেছনে নাকি একটা লাল ছায়া দেখা গিয়েছিল, কেউ আবার বলে তার চোখ থেকে যেন আগুন বের হচ্ছিল। কিন্তু শ্রেয়া এসব কিছু বিশ্বাস করে না—সে শুধু জানে, এক লাল শাড়ি তাকে এমন কিছু বলেছিল, যা সে এতদিন নিজের কাছেও বলতে পারেনি। সেই রাতে ফেরার পথে সে ফিরে যায় সেই গলিতে, কিন্তু গলির দরজা বন্ধ—ঠাকুমা নেই, আলো নিভে গেছে। কিন্তু বাতাসে একটা হালকা গন্ধ রয়ে গেছে—জবা ফুলের গন্ধ, রক্তের গন্ধ, সাহসের গন্ধ। গল্প সবে শুরু হয়েছে।

বছর চল্লিশ পেরোনো আফসানা বেগম সকালে স্কুলে যান, দুপুরে বাড়ি ফেরেন, বিকেলে রান্নাঘরে সময় কাটান আর রাতে নিঃশব্দে বিছানায় গা এলিয়ে দেন—এ যেন কোনও এক যন্ত্রচালিত জীবনের ছাঁচে কেটে চলা এক নারী। বাইরের চোখে সে সম্মানিত একজন শিক্ষিকা, ছাত্রছাত্রীদের প্রিয় “আফসানা ম্যাম”, পাড়ায় সকলে তার ভদ্রতা, সংযম, রুচিশীলতা নিয়ে প্রশংসা করে। কিন্তু বাড়ির দরজার ভিতরে সে শুধুমাত্র একজন স্ত্রী—একটা জড়দেহ, যে স্বামীর খিটখিটে মেজাজ, সন্দেহপ্রবণতা ও মানসিক অত্যাচারের সামনে দিনের পর দিন মাথা নত করে এসেছে। তার স্বামী রশিদ সাহেব, যিনি এককালে সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, এখন ক্রমাগত বিষাক্ত হয়ে উঠেছেন—মদ্যপ, রুঢ়, আর ভয়ঙ্কর নিঃসঙ্গ এক মানুষ। আফসানার প্রতিটি সন্ধ্যে কাটে তার কথার তিরস্কারে, অকারণ সন্দেহে, কিংবা ঠাণ্ডা চাহনিতে। দিনের পর দিন তার অন্তরে জমেছে একরাশ ক্ষোভ, কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলেনি সে—বলা শেখেনি, কিংবা বলা মানেই সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া, সমাজের কটূচোখ, সন্তানের ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা।

সেদিন সন্ধেবেলা বাড়ি ফেরার পথে, রাস্তার মোড়ে হঠাৎ তার চোখে পড়ে সেই ‘লাল দোকান’। জানে না কেন আগে চোখে পড়েনি, কিংবা কখন দোকানটি সেখানে এসেছে—দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধাকে দেখে যেন হৃদয় ধড়াস করে ওঠে। বৃদ্ধার পরনে লাল বেনারসি, চুল সাদা, চোখে এক আশ্চর্য কৌতূহলহীন শান্তি। আফসানা ভিতরে ঢোকে, কিছু না বলতেই ঠাকুমা তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ, তারপর এক ভাঁজ করা রক্তজবা রঙের জামদানি তুলে দেন তার দিকে। শাড়ির রঙ এমন গাঢ়, যেন কোনও পুরনো দগ্ধ স্মৃতির ছাপ—হাতের ছোঁয়ায় মনে হলো ভেতরে আগুন লুকিয়ে আছে। ঠাকুমা ধীরে ধীরে বলেন, “যা জমে আছে, তাকে ঝরতেই হয়। তুমি প্রস্তুত, আফসানা বেগম?” আফসানা চমকে ওঠে—এই নাম তো কেউ বলেনি! তার মনে পড়ে যায় ছেলেবেলার এক স্বপ্ন, যেখানে সে একদিন এমন সাহসী হবে যে নিজের অপমান গিলে রাখবে না। হাতে শাড়ি নিয়েই সে বাড়ি ফেরে, মনটা অকারণ ভার হয়ে থাকে—কিন্তু এবার যেন ভয় নয়, বরং প্রস্তুতির চাপ।

রাতের খাবার টেবিলে রশিদ সাহেব প্রতিদিনের মতোই রাগারাগি করেন—ছোটখাটো কিছু নিয়ে, হয়তো নুন কম হয়েছে, কিংবা ভাত কিছুটা নরম। কিন্তু আজ আফসানা আর চুপ করে থাকেন না। শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, “তুমি দিনের পর দিন আমাকে দমিয়ে রেখেছো। আমি মানুষ, গোলাম নই। এবার আমি আমার মতো বাঁচবো।” কথাটা বলতেই রশিদ সাহেব স্তব্ধ হয়ে যান—চোখে অচেনা এক বিস্ময়। মুহূর্তে তার ঠোঁট থেমে যায়, মুখ শুকিয়ে যায়, যেন এতদিনের অভ্যস্ত শিকারের বদলে এবার সে শিকার। আফসানার কণ্ঠে ছিল না কাঁপুনি, চোখে ছিল না জল। শাড়ির আঁচল বুকের উপর দিয়ে ঝুলছিল, যেন রক্তের ঢেউ বয়ে চলেছে ভিতরে ভিতরে। পরদিন সকালে সে থানায় যায়, ঘরোয়া সহিংসতার অভিযোগ দায়ের করে, এবং নিজের স্কুলের মেয়েদের জন্য গড়ে তোলে একটি ‘নিরাপদ কনফিডেন্সিয়াল হেল্পলাইন’।

সন্ধেবেলায় সে আবার যায় সেই গলিতে, কিন্তু এবার দোকানের সামনে বসে থাকা ঠাকুমা নেই। দরজা খোলা, ভিতরে কয়েকটি লাল শাড়ি ঝুলে আছে নীরবে, যেন কোনও মন্দিরে পবিত্র চাদর রাখা থাকে। বাতাসে হালকা রক্তজবা ফুলের গন্ধ, আর দেয়ালে আঁকা এক মেয়ের মুখ—যার চোখে চোখ রাখলে আফসানা নিজের চেহারাটাই দেখতে পায়। সে বুঝতে পারে, শাড়িটা ছিল একটা দরজা—নিজের অন্তরকে চিনে নেওয়ার প্রবেশপথ। শহরের কোনায় এই দোকানটা কোনও সাধারণ কাপড়ের দোকান নয়—এ যেন এক সন্ন্যাসিনী শিবির, নারীর অন্তর্নিহিত আগুন জাগানোর এক প্রাচীন সাধনা। সেদিন সে যখন বেরিয়ে আসে, তার পেছনে ছায়া পড়ে না—শুধু সামনের দিকে তার নিজের দীর্ঘ প্রতিচ্ছবি ছড়িয়ে থাকে, লাল আলোয় ধরা পড়ে তার নতুন পরিচয়।

রুক্মিণী পাল, বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের বাংলা বিভাগের ছাত্রী। সে কবিতা লেখে ছোটবেলা থেকেই, ডায়েরির পাতায়, রাত জেগে, লুকিয়ে—যেন নিজের ভিতরের আগুনটাকে ভাষা দিতে পারে শুধু ছন্দে। বাড়ির রক্ষণশীল পরিবেশ, কড়া মা-বাবা, সমাজের চোখ—সবই তাকে শিখিয়ে দিয়েছে কীভাবে চুপ থাকতে হয়, কীভাবে মেয়ে হয়ে “শালীন” থাকা যায়। কিন্তু তার কলম কখনো চুপ থাকেনি। তার লেখায় উঠে এসেছে শরীর, প্রেম, আঘাত, মুক্তি—সবই এক মিশ্র মাদকতায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যমঞ্চে কখনো সে পড়েনি এসব লেখা, কারণ তার ভয় ছিল—এই সমাজ, এই শিক্ষক, এমনকি তার বন্ধুদের একাংশও তার লেখার শরীরী ভাষা বুঝতে পারবে না, বরং অপমান করবে, বিদ্রুপ করবে। তবু রুক্মিণীর ভিতরে গুমরে ওঠে কথা, জমা হতে থাকে না বলা কবিতা।

সেই সপ্তাহে বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজন হয় ‘নারী ও শব্দ’ শীর্ষক এক কবিতা পাঠের সন্ধ্যা। প্রথাগত কবিদের পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয় মঞ্চে কবিতা পাঠের জন্য। রুক্মিণী অনেক দিন ধরেই ভাবছিল, সে যাবে না—আবার নিজেকে বোঝাচ্ছিল, “না, এবার সময় এসেছে।” কিন্তু সাহস জোগাতে পারছিল না কিছুতেই। সেদিন বিকেলে ক্লাস শেষে হঠাৎ করে হাঁটতে হাঁটতে সে চলে যায় এক অপরিচিত গলির মধ্যে, যেন কে যেন তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। গলির শেষে দেখা মেলে সেই রহস্যময় লাল দোকানের—রক্তরঙ আলোয় ভেসে থাকা এক অস্পষ্ট স্বপ্নের মতো। ভিতরে বসে আছেন সেই বৃদ্ধা ঠাকুমা, এবার যেন আরও বেশি পরিচিত লাগছে তাঁর মুখ। রুক্মিণী চোখের ইশারায় একটি পাতলা লাল জমদানি দেখায়, ঠাকুমা হেসে বলেন, “এই শাড়ির প্রতিটি সূতোতে লেখা আছে একেকটি না-বলা কবিতা। তুমি শুধু পড়ে নাও।” শাড়ির আঁচল ছুঁতেই যেন ভিতরটা কেঁপে ওঠে রুক্মিণীর—এত হালকা, কিন্তু এত ভারী!

সেদিন সন্ধেয় রুক্মিণী মঞ্চে ওঠে, পরনে সেই লাল শাড়ি। আলো পড়ে তার গায়ে, আর তার চোখে স্পষ্ট দেখা যায় একরকম দীপ্তি—না, সেটা রঙের নয়, সেটা সাহসের। সে কাঁপা কাঁপা গলায় শুরু করে, “আমার শরীর মানে আমার শব্দ / আমার বুক মানে একখণ্ড জমি / যেখানে চাষ হয় বাঁচার।” প্রথমেই কিছুটা স্তব্ধতা, তারপর ধীরে ধীরে দর্শকদের মধ্য থেকে উঠতে থাকে ফিসফাস, বিস্ময়, চমক। রুক্মিণীর কণ্ঠ গাঢ় হয়ে ওঠে, তার গলার আওয়াজ যেন শুধু মাইক্রোফোনে নয়, মনের গভীর থেকে আসছে। কবিতা শেষ হলে কয়েক মুহূর্ত নীরবতা—তারপর হঠাৎ করে দর্শকদের মধ্যে থেকে করতালির ঝড়। এমন করে কেউ কখনো মঞ্চে এমন স্পষ্ট শরীরী রাজনীতি নিয়ে কবিতা পড়েনি। অনেকেই দাঁড়িয়ে পড়ে সম্মানে, কয়েকজন চোখ মুছে ফেলে, কেউ কেউ রেকর্ড করে সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করে দেয়।

রুক্মিণী মঞ্চ থেকে নেমে বুঝতে পারে, সে আর আগের সেই ভয়পাওয়া কবি নয়। তার মধ্যে কোনও কিছু বদলে গেছে—সে শুধু শব্দের মধ্যে নেই, সে এখন শব্দ হয়ে উঠেছে। পরে শুনে, তার সেই কবিতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছে, সাহসী কণ্ঠের নিদর্শন হিসেবে। কিন্তু তার পরদিন সকালে সে যখন আবার সেই গলিতে ফিরে যায় ঠাকুমার দোকানে, তখন দেখে দোকান বন্ধ—মাঝ দরজায় লাল কাপড়ে লেখা একটা পঙ্‌ক্তি দুলছে বাতাসে: “যারা বলে, তারা আর চুপ থাকে না।” রুক্মিণী হাসে—এই শহর বদলাচ্ছে, লালরঙের মতো—ধীরে, সাহসে, আর অভ্যন্তরীণ আগুনে। তার ডায়েরির পাতাগুলো আর লুকিয়ে নেই, বরং খোলা বাতাসে উড়ছে। আর সেই বাতাসে লেগে আছে এক চেনা গন্ধ—কবিতার, রক্তের, এবং মুক্তির।

ঠাকুমাকে সবাই জানে, কিন্তু কেউ চেনে না। ঠাকুমা আছেন, বসেন, হাসেন, শাড়ি দেন, কিন্তু তার গল্প কেউ জানে না। কেউ কখনো জিজ্ঞেস করেনি, তিনি কোথা থেকে এলেন, কীভাবে এলেন বা কত বছর ধরে এই দোকানে বসেন। যাঁরা তাকে দেখেছেন, তাঁদের কাছে ঠাকুমা যেন সময়ের বাইরের কেউ—একটা ছায়া, এক গন্ধ, এক আগুনের অস্তিত্ব। তাঁর শাড়ির দোকান যেমন নিঃশব্দে গজিয়ে উঠেছিল শহরের এক কোণে, তেমনই নিঃশব্দে ক্রমশ আশ্রয় হয়ে উঠেছে নারীদের জন্য। কিন্তু এই অধ্যায়ে, পাঠক প্রথমবার ঠাকুমার অতীতের দরজা খুলে দেখতে পাবে সেই আভাস, যেখান থেকে উঠে আসে তাঁর লালরঙের সাধনার উৎস, আর সেই রহস্যময় “আয়নার” গল্প।

১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময়, অবিভক্ত বাংলার এক গ্রামে জন্মেছিলেন ললিতা—এক অদ্ভুত মেয়ের নাম, যার চোখে জন্ম থেকেই একধরনের আগুন ছিল। সে মাটির পুতুলে শাড়ি পরিয়ে রাখত, আর শাড়ির পাড়ে লিখে রাখত অদ্ভুত মন্ত্র। গ্রামে তাকে ডাকা হতো “পাগলী”, আবার কেউ কেউ বলত, “শক্তির বেটি”—কারণ, তার ছোঁয়ায় কুকুর থেমে যেত, কাঁসার থালা কম্পিত হতো, আর রক্তপাত বন্ধ হয়ে যেত লাল আলতা দিয়ে টেনে দেওয়া গোলচিহ্নে। দেশভাগের সময় সে হারিয়ে ফেলে পরিবারকে—কেউ মরে, কেউ চলে যায় সীমান্তের ওপারে। তখন থেকেই সে হেঁটে হেঁটে আসে এই শহরে—মাথায় ছিল শুধু একটা কাপড়ের পুটুলি আর একপাটি আয়না।

সেই আয়না ছিল সাধারণ নয়। আয়নার রূপ ধরা দেয় এক সন্ধ্যায়, যখন সে এক পরিত্যক্ত মন্দিরে আশ্রয় নেয়। আয়নার দিকে তাকিয়ে সে দেখতে পায় নিজের নয়, অন্য নারীদের মুখ—কারও মুখে ভয়, কারও মুখে রক্ত, কারও চোখে অভিশাপ। সে বুঝে যায়, এই আয়না শুধু প্রতিবিম্ব দেখায় না, দেখায় ভবিষ্যৎ; কখনো দেখায় প্রয়োজন, কখনো লুকোনো শক্তি। এরপর থেকে সে আর আয়নাকে ব্যবহার করত না সাজতে—আয়নাই হয়ে ওঠে তার সহচর। সেই আয়নার উপর চোখ রেখে সে বুঝে যেত, কার জীবনে কী অভাব, কে কবে শাড়ির ছোঁয়ায় নতুন হবে।

বছর পেরিয়ে যায়। ললিতা হয়ে ওঠে ঠাকুমা। কণ্ঠে শ্লথতা আসে, চুল সাদা হয়, কিন্তু চোখের আগুন নিভে না। সে জানে, শাড়ির ভিতর লুকিয়ে থাকে এক শক্তি—যা কেবল সঠিক নারীকে ছুঁয়ে দিলে জেগে ওঠে। সেই জন্যই প্রতিটি শাড়ি ঠাকুমা নিজে বুনতেন না, কিন্তু প্রতিটি শাড়ির পরতে পরতে সে ছড়িয়ে দিতো কিছু গোপন শব্দ, কিছু অদৃশ্য শঙ্খরেখা, যেন এক শাক্ত মন্ত্র। তার দোকানে রাখা ছিল সেই পুরনো আয়নাটি—দোকানের এক কোণে লাল কাপড়ে ঢাকা। কখনো কেউ তাকালে দেখতে পেত না নিজেকে—তাদের দেখাতো অন্য কিছু। শ্রেয়া দেখেছিল ভয়হীন মুখ, আফসানা দেখেছিল আগুনে মোড়া হাত, রুক্মিণী দেখেছিল নিজের ছায়াকে মঞ্চে কবিতা পাঠ করতে। আয়নাটি দেখায় যে রূপটি নারীর ভেতরে আছে, কিন্তু বাইরে আসেনি।

এখন ঠাকুমা জানেন, তাঁর সময় ফুরিয়ে আসছে। এই শহরের নতুন প্রজন্ম জেগে উঠছে। তার প্রয়োজন ক্রমশ কমবে। কিন্তু তার কাজ শেষ হয়নি। আয়নাটি এবার নিজের জায়গা ছেড়ে বেরোতে চাইছে—ঠিক যেমন এক সময় ললিতা বেরিয়ে এসেছিল গ্রামের ভস্মভূত ঘর থেকে। এবার শহরের আরও অনেক নারীর দরজা খুলতে হবে, আর সেই খোলার চাবিকাঠি থাকবে এই আয়নার দেখানো শাড়ির মধ্যেই। এক রাতের অন্ধকারে ঠাকুমা একটি নতুন শাড়ি বোনেন—সবচেয়ে গাঢ় লাল, যেখানে সূতোয় সূতোয় আঁকা এক অপরূপ মুখ, একটি আয়নার মতো হাসি, আর মাঝখানে লেখা একটি পঙক্তি—“আমি আছি, যতদিন লাল বেঁচে আছে।” এটাই হবে তাঁর শেষ রচনা। দোকানে যেদিন কেউ আসবে না, সেদিন এই শাড়ি নিজেই কাউকে খুঁজে নেবে, যাকে দিয়ে শুরু হবে এক নতুন অধ্যায়।

এই অধ্যায়ের শেষে আমরা বুঝে যাই, ঠাকুমা আসলে একজন নারী নয়—একটি ধারক। এক প্রাচীন শক্তি, এক আধুনিক যাত্রার প্রথম মশালধারী। আয়না ছিল তার উপকরণ, আর লালরঙ ছিল তার ভাষা। এই ভাষা এখন ছড়িয়ে পড়ছে শহরের কোণে কোণে, নিঃশব্দে, সাহসে, আগুনে। গল্পের ভিতরে যেন সময় থেমে নেই—বরং প্রতিটি নারী চরিত্র এই সময়ের মধ্য দিয়ে হাঁটছে, ঠাকুমার শাড়ির আঁচল ধরে।

শরৎকালের সন্ধ্যাটা যেন সেই দিন একটু বেশিই নরম আর রক্তিম ছিল। বটতলার ওপারে বসে থাকা অশ্বথ গাছের ছায়া শহরের রাস্তার উপর লাল রঙের একটি কল্পনার চাদর বিছিয়ে রেখেছিল। বাতাসে শিউলি ফুলের গন্ধ, আর দূর থেকে ভেসে আসছিল কাশফুলের নরম দুলুনির মতো ধুনুচি নাচের ঢাকের শব্দ। ঠিক তখনই শান্তিনগরের পুরনো বাসাবাড়ির একতলায় বসে নিরুপমা দেবী জানালার ধারে বসে ছিলেন, হাতে গীতা, মুখে ক্লান্তির ছায়া। পাঁচ বছর ধরে তিনি একা, স্বামীর মৃত্যুর পর ছেলেটাও বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। দিনের পর দিন সেলাই করে, পুরনো স্মৃতি নিয়ে কাটিয়ে দেন তিনি। কিন্তু সেইদিন, সেই বিশেষ সন্ধ্যায় তাঁর চোখ পড়ে পাশের বাড়ির নতুন প্রতিবেশিনী জয়ন্তীকে, যে সদ্য একটি লাল শাড়ি পরে নেমেছে রাস্তায়, চোখেমুখে যেন অদ্ভুত আলো।

জয়ন্তী সেই সকালে গিয়েছিল সেই বিখ্যাত লালরঙ শাড়ির দোকানে — যেটা শহরের ব্যস্ততা থেকে একটু দূরে, গলির ভেতরে, যেন চোখ এড়িয়ে যাওয়া এক অতিপ্রাকৃত স্থানে। বৃদ্ধা দোকানদারী মহিলার মুখে ছিল চন্দনের দাগ আর একজোড়া চোখ যা মাটির গভীর থেকে উঠিয়ে আনা শালগাছের স্মৃতি বহন করতো। জয়ন্তীর হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন একটি শাড়ি — বেনারসি কাপড়ে লাল-সোনালি জরির কাজ, যেন আগুনের ফোঁটা। “এই শাড়িটা সাহসী নারীদের জন্য,” তিনি বলেছিলেন, “যারা কথা বলতে জানে, প্রতিবাদ করতে জানে।” জয়ন্তীর বিয়ে হয়েছে এক উচ্চপদস্থ, কিন্তু অত্যন্ত রুক্ষ স্বভাবের অফিসার রাজীবের সঙ্গে। বছরের পর বছর তার অত্যাচারে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল সে। আজ লাল শাড়িটি পরে সে যখন পথে বেরোল, তার চোখের ভাষা আর মুখের রেখায় যেন আগুন ফুটে উঠলো। বিকেলের পরেই সে স্বামীকে মুখোমুখি হয়ে প্রথমবার জোর গলায় কথা বলল—”আমি মানুষ, তোমার সম্পত্তি নই।”

এই ঘটনা শুনে নিরুপমার মনে অদ্ভুত আলোড়ন শুরু হল। তিনি রাতের দিকে ধীর পায়ে সেই দোকানের দিকে গেলেন। ঠিক যেমনটা শোনা গেছে, দোকানটা যেন সময়ের বাইরের এক বিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছে। প্রবেশ করতেই টের পেলেন, সেখানে কেবল লালরঙেরই রাজত্ব। একটার পর একটা শাড়ি যেন মুখ খুলে বলছে — কারো বিগত অতীতের গল্প, কারো পরাধীনতা, আবার কারো বিদ্রোহের ডায়েরি। বৃদ্ধা দোকানদারী আবারও সেখানে ছিলেন — আজ যেন তাঁর মুখে মৃদু হাসি। নিরুপমাকে বললেন, “তোমার জন্যও একটি আছে।” তিনি এগিয়ে দিলেন এক নিটোল লাল তসর শাড়ি, যার পাড়ে গাছের পাতার মতো জ্যামিতিক নকশা। “এটা পরলে তুমি জানতে পারবে, কত কথা তোমার ভিতরে আটকে আছে।” নিরুপমা বাড়ি ফিরে শাড়িটা পরে আয়নার সামনে দাঁড়ালেন — দীর্ঘ বছর পর যেন নিজেকে ফিরে পেলেন।

রাতে নিরুপমা প্রথমবারের মতো নিজের ডায়েরি খুলে লিখতে শুরু করলেন — তাঁর স্বামীর সঙ্গে অসম্পূর্ণ কথোপকথন, একা থাকার অভিমান, সমাজের কাছে বারবার নতমস্তক হওয়া, এবং শেষত তাঁর নিজের অস্তিত্বের দাবি। পরদিন সকালে, প্রতিবেশী আর আত্মীয়রা অবাক হয়ে দেখল, নিরুপমা রাস্তায় হেঁটে চলেছেন — এক দমে সোজা থানার দিকে। তিনি নিজের জায়গা থেকে এক বৃদ্ধা প্রতিবেশীর সম্পত্তি আত্মসাৎ করার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানালেন, যা নিয়ে অনেকেই মুখ বন্ধ করে থেকেছিলেন। মানুষ তাঁকে দেখে বলে উঠল — “এ কি সেই নিরুপমা, যিনি নিজের ছায়াকেও ভয় পেতেন?” কিন্তু লাল শাড়ির নিরুপমা ছিলেন আজ অন্য রকম — দৃঢ়, শান্ত, অথচ অগ্নিসংগঠিত। সেই সন্ধ্যায়, তিনি জানালার ধারে বসে থাকলেন না — বরং খোলা ছাদে উঠলেন, বাতাসে হাত ছুঁড়ে বললেন, “আকাশটা এখন আমারও।”

বৃষ্টির ছাঁট পড়েছে জানালার কাঁচে। দক্ষিণ কলকাতার এক শান্ত গলির ভেতর সায়ন্তিকা বসে আছে নিজের ছোট্ট দোতলা বাড়ির ছাদে, হাতে এক কাপ গরম চা। মাথার ঘোরে ঘুরছে সেই শাড়ির দোকানের কথা—সেই লাল রঙের শাড়ি, যার রঙ যেন গলিয়ে দিয়েছে তার ভিতরের সমস্ত শীতলতা। বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে সায়ন্তিকার জীবন বদলেছে নিঃশব্দে। যে মেয়েটি অফিসে মাথা নিচু করে কাজ করত, নিজের স্বপ্নগুলোকে চুপিচুপি পেঁচিয়ে রাখত পাটের ব্যাগে, সে আজ সহকর্মীদের সামনে নিজের মত প্রকাশ করে, নির্দ্বিধায় বলিউডের চটুল গান গায় ট্রাফিক সিগন্যালে আটকে পড়লে, আর সন্ধ্যায় শহরের ভিড়ে হাঁটতে হাঁটতে নতুন গল্পের চিন্তা করে। সেই শাড়িটা আজ যেন তাকে রঙের চশমা পরিয়েছে—সবকিছুই এখন অন্যরকম লাগে। তার ছোটবেলার ইচ্ছে ছিল একজন চিত্রনাট্যকার হওয়ার, কিন্তু বাবা-মার ইচ্ছেতে পড়াশোনার শেষে সে হয়ে গিয়েছিল এক কর্পোরেট দাসী। কিন্তু আজকাল তার প্রতিটি সন্ধ্যা কাটে লেখা নিয়ে, পুরনো খাতা আর কালি কলমে ভর করে।

যেই রাতে সায়ন্তিকা সেই লাল শাড়ি পরে ফিরেছিল, তার জীবনের বুনোট যেন খুলতে শুরু করেছিল একটা অদৃশ্য হাওয়ায়। মা প্রথমে চিন্তিত হয়েছিল—“এই শাড়ি কোথা থেকে পেলি? এত পুরনো দেখাচ্ছে, আবার অদ্ভুত লাল। কে দিল তোকে?” সায়ন্তিকা শুধু হেসেছিল। কোনো উত্তর ছিল না তার কাছে—আর দরকারও হয়নি। সেই রাতেই তার ঘরে ঢুকে পড়েছিল এক অচেনা আত্মবিশ্বাস, যেন ঘুম ভেঙে গেলেই কিছু একটা তৈরি হবে, জন্ম নেবে এক নতুন জীবন। ঠিক তাইই হলো। অফিসে বসদের সামনে যে ক্লায়েন্ট প্রেজেন্টেশন দিতে সে সবসময় পেছনে থাকত, এবার সে-ই স্বেচ্ছায় করল উপস্থাপনা—সেই প্রেজেন্টেশনে এমন একটা গল্প বলেছিল সে, যা শুনে চুপ করে গিয়েছিল ঘর। তার গল্পে ছিল ভালোবাসা, বিদ্রোহ আর ভাঙনের রঙ—লাল রঙ। তার শব্দগুলো যেন শাড়ির মতই দাগ রেখে যাচ্ছিল শ্রোতাদের মনে।

এমনই এক দিনে সায়ন্তিকা অফিস থেকে ফেরার পথে দেখল, রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে আরেকজন মেয়ে—বয়সে তরুণী, চোখে এক ধরনের হতাশা। পোশাক ছিল পরিপাটি, কিন্তু চোখে ছিল ক্লান্তি। সায়ন্তিকা একবার তাকিয়ে চলে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ যেন কিছু একটা টেনে নিল তাকে ফিরে যেতে। সে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি ঠিক আছো?” মেয়েটি একটু হকচকিয়ে বলল, “আমার ফোনটা হারিয়ে গেছে, বাড়ি ফিরতে পারছি না।” সায়ন্তিকা তাকে নিজের ফোন থেকে কথা বলার সুযোগ দিল, তারপর বাড়ি পৌঁছে দিতে অফার করল। পথে কথার ফাঁকে জানা গেল মেয়েটির নাম মেহুল, সে ইন্টার্নশিপ করতে এসেছে মুম্বই থেকে। সেই রাতে সায়ন্তিকার মনে হলো—এই রঙ, এই সাহস, এই নতুন পরিবর্তন শুধু তার একার নয়, এটা ছড়িয়ে দেওয়া উচিত। পরের দিন, সে সিদ্ধান্ত নিল—যেসব নারী জীবনের প্রতিকূলতার মাঝে লড়ছে, তাদের জন্য কিছু করবে। একটা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম শুরু করল সে—“লালরঙের গল্প” নামে, যেখানে মহিলারা নিজেদের জীবনের বদলের গল্প শেয়ার করবে, নির্ভয়ে, নির্লজ্জে।

এই নতুন উদ্যোগে সায়ন্তিকার বন্ধুরাও এগিয়ে এলো—স্নেহা, একজন সাংবাদিক; রুমানা, একজন ফটোগ্রাফার; আর কৃতি, যিনি সমাজসেবী হিসেবে কাজ করেন শহরের পিছিয়ে পড়া নারীদের নিয়ে। তারা একত্রে শুরু করল “লালরঙ উৎসব”—প্রতিমাসে একদিন, শহরের কোনো খোলা জায়গায় মহিলারা একত্রে মিলিত হয়ে তাদের জীবনের গল্প বলবে, শাড়ি দান করবে, গান গাইবে, আর লাল রঙে রাঙাবে নিজেদের অস্তিত্ব। সেই শাড়ির দোকান, যেখানে এই গল্পের শুরু—সেটিও তাদের এক প্রাচীন তীর্থস্থানের মতো হয়ে উঠল। বৃদ্ধা মহিলা আজও সেখানে বসেন, নিঃশব্দে, চোখে এক প্রজ্ঞার দীপ্তি। কিন্তু আজকাল তিনি শাড়ি বিক্রি করেন না, শুধু উপহার দেন—ঠিক যাদের প্রয়োজন, শুধু তাদেরই হাতে তুলে দেন সেই জাদুকরী লালরঙ। আর তার পর থেকেই, শহরের আকাশে যেন অন্যরকম আলো জ্বলে ওঠে, সন্ধ্যার বাতাসে ভেসে আসে সাহস আর সংহতির গান।

প্রিয়াঙ্কা ঘুম ভেঙে উঠে বসতেই টের পেল—ঘরে আলো নেই, শুধু বাইরের রাস্তার লালচে আভা জানালার ফাঁক গলে তার মুখে এসে পড়েছে। গায়ে এখনও সেই লাল শাড়িটা। কাল রাতেও সে এটা খুলতে পারেনি—এক অজানা আকর্ষণ তাকে ধরে রেখেছিল। আয়নার সামনে দাঁড়াতেই সে নিজেকে যেন নতুন করে চিনল। চোখে স্পষ্ট কিছু একটা জ্বলে উঠছে, ঠোঁট শক্ত, মুখে জেদ—যেটা আগে কখনও ছিল না। আজ তার মনে হচ্ছে, অনেক কিছুর জবাব আছে তার কাছে। বহুদিন ধরে বাড়িতে শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার, নিজের ইচ্ছেকে দমিয়ে রাখা, আত্মমর্যাদা বিসর্জন—সব কিছু যেন আজ হঠাৎ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল এই শাড়িটা। প্রিয়াঙ্কা আজ ঠিক করল—আর নয়। সে মুখোমুখি দাঁড়াবে, উচ্চারণ করবে নিজের দাবিগুলো, প্রতিবাদ করবে সেই চিরাচরিত “চুপ করে থাকো” আদেশের বিরুদ্ধে।

প্রিয়াঙ্কার শ্বশুরমশাই, যতীন রায়, একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি অফিসার। মুখে রাশভারী, আচরণে শৃঙ্খলাপূর্ণ—তবে কড়াকড়ির আড়ালে লুকিয়ে থাকে এক ধরণের দমননীতি। ছেলে সৌরভ কিছু বলে না, নিঃস্পৃহ। শাশুড়ি সরস্বতী দেবীও নীরব সাক্ষী, কোনোদিন প্রিয়াঙ্কার পাশে দাঁড়াননি। রান্নাঘরে কাজ করতে করতে মাঝে মাঝেই অপমান—”তোকে তো কিছুই আসে না”, “আমাদের সম্মান শেষ করে দিয়েছে”, “বাড়ির মেয়ে হলে বুঝতিস!”—এইসব কথা হজম করেছে প্রিয়াঙ্কা বছরের পর বছর। কিন্তু আজ সে দাঁড়ালো। সকালবেলা যতীন রায় যখন খবরের কাগজে চোখ রেখেছিলেন, প্রিয়াঙ্কা তখন গিয়েই সোজাসুজি বলল, “আজ থেকে আমি নিজের মতো বাঁচব। আপনি কিছু বলার আগে একবার নিজেকে প্রশ্ন করুন—আপনার আদর্শ, আপনার শৃঙ্খলা, আমাদের কতটা ক্ষতি করেছে। আর আমার দোষ কোথায়, সেটা বলার আগে নিজের ছেলেকে জিজ্ঞাসা করুন, সে কবে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে।”

ঘরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। যতীন রায়ের মুখ রক্তবর্ণ, সরস্বতী দেবী চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন, আর সৌরভ কিছু না বলেই উঠে ঘর ছেড়ে চলে গেল। কিন্তু প্রিয়াঙ্কা পিছিয়ে আসেনি। শাড়ির আঁচল শক্ত করে গেঁথে নিয়ে সে একের পর এক কথা বলতেই থাকল—নিজের স্বপ্ন, নিজের অধিকার, নিজের সম্মান, আর সেই সব মুহূর্তের কথা, যখন তার দম আটকে এসেছিল কিন্তু সে চুপ থেকেছে। আজ সে আর চুপ থাকবে না। কথাগুলো যেন আগুনের মতো ঝরে পড়ছে তার মুখ থেকে—প্রতি বাক্যে সাহস, প্রতিবাদ আর আত্মবিশ্বাস। আর সেই লাল শাড়িটা, যেন আগুনের শিখার মতো তার শরীর ঘিরে জ্বলছিল—দেখিয়ে দিচ্ছিল, মেয়েরা শুধু মানিয়ে নেওয়ার পাত্র নয়, তারা নিজের জন্য লড়তেও পারে।

বিকেলে সে আবার সেই দোকানে গিয়েছিল। রহস্যময় বৃদ্ধা তখনো সেখানে। প্রিয়াঙ্কা ধীরে গিয়ে বলল, “আপনার শাড়িটা আমাকে বদলে দিয়েছে। কিন্তু আমি জানতে চাই, আপনি কে?” বৃদ্ধা হেসে বললেন, “আমি তো কেউ না। আমি শুধু তোমাদের সাহসটা মনে করিয়ে দিই, যেটা তোমাদের মধ্যেই ছিল, হারিয়ে গিয়েছিল সময়ের ধুলোয়। লাল হলো আগুন, লাল হলো প্রতিবাদ—শাড়িটা শুধু এক চিহ্ন, আসল রঙ তো জেগে ওঠে তোমাদের ভিতরেই।” প্রিয়াঙ্কা মাথা নেড়ে হেঁটে বেরিয়ে গেল, বুঝে গেল—তার যাত্রা এখন শুরু।

লালরঙের শাড়ির রহস্য শহরের অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়েছে। কেউ বলছে এটা জাদু, কেউ বলছে অভিশাপ, আবার কেউ বলছে, এক মায়ের চোখের সারা জীবনের কান্না থেকে তৈরি সেই শাড়ির রঙ। মীরা, নূপুর, শ্যামলী, ইরা—এদের প্রত্যেকের জীবনেই শাড়ির মাধ্যমে এসেছে এক বিপ্লব। কিন্তু এর পেছনের সত্যটা জানার জন্য এবার পা বাড়ালো চৈতালি। অন্যদের মতো সে শাড়ি কেনেনি। সে শুধু দূর থেকে দেখেছে, সেই বৃদ্ধা নারীকে, যে যেন সময়ের বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে, ঠিক যেন তার চারপাশের সব কিছু থেমে গেছে, শুধু তিনি লাল শাড়ি তুলে দেন, আবার বসে পড়েন কাঠের চেয়ারে।

চৈতালি ছিল এক ইতিহাসবিদ—অথচ সে তার নিজের শহরের এই গোপন ইতিহাস জানত না। তাকে টানছিল সেই বৃদ্ধা মহিলার চোখ। চৈতালি জানতে পারে, আশির দশকে এই শহরে ‘প্রতিবাদের বয়স’ নামে এক আন্দোলন হয়েছিল, যেখানে নারীরা নিজেদের জীবনের বিরুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে ছিল। সেখানেই প্রথম দেখা গিয়েছিল এই লাল শাড়িকে, যেটা পরা এক নারীর আত্মহননের ঘটনাকে ঘিরে নানান গুজব ছড়ায়। কিন্তু সেই নারী মরেননি—তিনি অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন। সেই থেকে শহরে মাঝে মাঝে এই শাড়ির পুনরাবির্ভাব ঘটে, শুধু বিশেষ সময়ে, বিশেষ কিছু নারীর জীবনে।

চৈতালি এক রাতে সাহস করে যায় সেই দোকানে। বৃদ্ধা তখন মেঝেতে বসে একটা পুরোনো ছবির অ্যালবাম দেখছিলেন। চৈতালি তাকে প্রশ্ন করে, “এই লাল শাড়ি কোথা থেকে আসে?” বৃদ্ধা তাকিয়ে বলেন, “তুমি প্রশ্ন করলে, তার মানে তুমি প্রস্তুত। শাড়িটা কোনো কাপড় নয়, এ এক চেতনা—এক বিদ্রোহের প্রতীক। কিন্তু এটা সবার জন্য নয়। যারা নিজের ভিতরে আগুন বহন করতে পারে, শুধু তারাই এ শাড়ি নিতে পারে।” চৈতালি বুঝতে পারে, এই দোকান এক দোকান নয়—এ এক প্রবেশদ্বার। তার পরের কথাগুলো যেন বাতাসে মিলিয়ে যায়, আর বৃদ্ধা উঠে গিয়ে চৈতালির সামনে তুলে ধরেন একটি লাল শাড়ি—নতুন, অথচ যেন বহু পুরনো। চৈতালি শাড়িটা হাতে নিলে তার দৃষ্টিতে ভেসে ওঠে অতীতের প্রতিবাদী নারীরা, সাহসিকতার গল্প, আর নিজস্ব অপূর্ণ জীবনের প্রতিচ্ছবি।

শাড়িটি পরে চৈতালি বাড়ি ফিরে আসে। ঘুমাতে গিয়ে তার মনে হয় সে যেন কোন স্বপ্নে ঢুকছে না—বরং অতীত তার স্বপ্নে এসে ঢুকে পড়ছে। সে দেখতে পায় শহরের সেইসব রক্তাক্ত আন্দোলন, নারীদের ক্ষোভে ফেটে পড়া, পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক কাঠামোর গুঁড়িয়ে যাওয়া। সকালে উঠে সে ঠিক করে, এবার সময় এসেছে এই কাহিনি লিখে যাওয়ার—এই নারীদের ইতিহাসকে কাগজে আনার, যাতে আগামী দিনের মেয়েরা শুধু সাহস নয়, সত্যিকারের শক্তি খুঁজে পায়। শাড়ির দোকান আর কোথাও থাকে না। তার জায়গায় শুধু একটা খালি ঘর, জানালার পাশে কিছু লাল সুতো উড়ছে বাতাসে। চৈতালি জানে, শাড়ি এখন তার মধ্যে, আর সে-ই নতুন প্রজন্মের জাদুকরী। এইভাবেই লালরঙ জেগে থাকে—প্রতিটি সাহসী নারীর স্পন্দনে।

——

1000043463.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *