Bangla - কল্পবিজ্ঞান

কার্বন হান্টারস

Spread the love

নন্দিনী পাল


বাতাসটা ভারি ছিল, যেন চোখের পাতায়ও ধুলো জমেছে। ২১৮০ সালের কলকাতা, এখন আর কলকাতা নেই—নাম পাল্টে হয়েছে “এয়ারজোন-৯”। শহরের আকাশে সবুজ নেই, কেবল ধূসর ও গাঢ় বাদামি রঙের এক বিষাক্ত স্তর যা দিনের আলোকেও ম্লান করে দেয়। মানুষ হাঁটে ফিল্টার মাস্কে মুখ ঢেকে, শিশুদের কৃত্রিম ফুসফুসে জন্ম দিতে হয়। আর সেই অদ্ভুত পৃথিবীর এক কোণে, কাঁচের ছাদের নিচে একটি ছোট্ট কেবিনে বসে আছে আরুণিকা সেন, চোখে ক্লান্তি, হাতে ট্যাবলেট, আর সামনে মায়ের বিছানা—ভেন্টিলেটরে নিঃশব্দে শুয়ে থাকা এক জীর্ণ শরীর। মায়ের চোখ বন্ধ, তবে মন খোলা—কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ যেন এ ঘরের একমাত্র জীবনের চিহ্ন। হাসপাতালের এই “অক্সি-ওয়ার্ড” প্রতি মিনিটে বিশুদ্ধ বাতাস চার্জ করে, আর সেই খরচ বহন করতে গিয়ে শেষ হয়ে গেছে আরুণিকার জমিয়ে রাখা প্রায় সবটুকু উপার্জন। কিন্তু তারপরও, সে হাল ছাড়েনি। কারণ তার কাজ শুধু বাঁচা নয়—সত্যকে খুঁজে বের করা। গত ছয় মাস ধরে সে খোঁজ করছিল এমন কিছু মানুষের, যারা বাতাস চুরি করে। হ্যাঁ, ঠিক শুনেছেন—চুরি! বিশুদ্ধ বাতাস এখন কারেন্সি, আর তার চারপাশে ছায়ার মতো ঘুরে বেড়ায় এক দল রহস্যময় চোর, যাদের নাম দেওয়া হয়েছে “কার্বন হান্টারস”।
সকাল নয়টা। বাইরের বাতাসের মান -৩৭২ AQI; সাধারণ মানুষের ফুসফুস সেটা টানলেই ফেটে যাবে। কিন্তু আজ আরুণিকার বেরোতেই হবে। নিজের ট্রান্সপারেন্ট মাস্ক গলিয়ে, নিঃশব্দ পরিবেশে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছল পোর্টাল-জেড নামের চৌকস চেকপয়েন্টে, যেখানে বায়োডোম থেকে বাইরের শহরে বেরোতে লাগে স্পেশাল অনুমতি। সে ছিল একজন সিনিয়র ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট, তাই তার অ্যাক্সেস ছিল শহরের ধূসর পরিধির ভেতরে প্রবেশের। বাইরের রাস্তায় নামলেই এক ভিন্ন জগত—ধ্বংসপ্রাপ্ত বাসাবাড়ি, কংক্রিটে মোড়া মৃত গাছের কঙ্কাল, আর বাতাসে কেমিক্যালের ঝাঁঝ। সে গিয়েছিল ডক-৭ এলাকায়, যেখানে রটে আছে বাতাস চোরদের গোপন চালান আসে রাতে। সেখানে দেখা হয় এক রহস্যময় কিশোরের সঙ্গে—হাড্ডিসার গড়ন, গায়ে ছেঁড়া জামা, হাতে একটা পুরনো অক্সিজেন ক্যানিস্টার। নাম বলেছিল জানিক মোরা। সে চুপচাপ তাকিয়ে ছিল আরুণিকার দিকে, যেন ওর চোখে কিছু চেনা—হয়তো আতঙ্ক, হয়তো বিশ্বাস। “তুমি কি হান্টারদের খুঁজছো?” ছেলেটি ফিসফিস করে বলে, আর তার কথায় আরুণিকার ভিতরের কৌতূহল আগুন হয়ে জ্বলে ওঠে। জানিক তাকে জানায়, প্রতিরাতে ৩টার সময় একদল মানুষ আসে পুরনো কোল্ডস্টোরের পাশ দিয়ে, তারা বাতাস বহন করে ছোট ছোট সিলিন্ডারে। তারা কোনো গ্যাং নয়, তারা বাঁচার জন্য চোর।
সেদিন রাতে আরুণিকা অপেক্ষা করে সেই পুরনো কোল্ডস্টোরের ছাদে। তার হাতে একটি হাই-রেজ ড্রোন ক্যামেরা, যার সাহায্যে সে রাতের দৃশ্য রেকর্ড করতে চায়। ঠিক ৩:০১ মিনিটে, মেঘে ঢাকা আকাশের নিচে এক ছায়াময় ট্রাক এসে থামে, তার পেছনের দরজা খুলে যায় নিঃশব্দে। সেখান থেকে বের হয় চার-পাঁচ জন মুখোশপরা ব্যক্তি, কাঁধে ক্যারিয়ার, যেগুলোতে জ্বলজ্বলে সবুজ আলো—অক্সিজেন! তাদের সঙ্গে আরও একটি মুখ—মহিলা, শরীর ঢেকে রাখা কোটে, কিন্তু চোখদুটি অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ। এই দৃশ্য রেকর্ড করতে গিয়ে আরুণিকার মনে হয়, সে শুধু সাংবাদিক নন, বরং এক যুদ্ধের পর্যবেক্ষক। বাতাস চুরির চেয়ে বড় কিছু যেন চলছে এই শহরে। হঠাৎ এক মুহূর্তে ড্রোনের আলো চোখে পড়ে এক হান্টারের। আর এরপর… গুলি! ড্রোন ধ্বংস, আর আরুণিকা প্রাণ নিয়ে পালায় অন্ধকার গলিপথে। তবে সেই মুহূর্তে সে বুঝতে পারে—সে শুধু একটি চোরচক্র নয়, এক বিপ্লবের কেন্দ্রে চলে এসেছে, যেখানে বাতাস বাঁচাতে চুরি করা হয়, আর বাতাস বাঁচাতে মানুষ খুনও করে। প্রশ্ন একটাই—এই পৃথিবীতে, নিঃশ্বাস নেওয়াটাই যদি অপরাধ হয়ে দাঁড়ায়, তবে সত্য বলতে কতদূর যাবেন আপনি?
সেই রাতে হাসপাতালের কাচঘেরা করিডোরে দাঁড়িয়ে আরুণিকা বারবার ভিডিও ফাইলটি চালাচ্ছিল তার হাতে থাকা ব্যাকআপ পেনড্রাইভে। যদিও ড্রোন ধ্বংস হয়েছিল, তবে তার আগেই একটা সংকুচিত সংকেত ভিডিও ক্লিপ পাঠিয়ে দিয়েছিল হেলমেট ক্যামেরার মাধ্যমে। সেই ১২ সেকেন্ডের ফুটেজে দেখা যাচ্ছিল মুখোশপরা এক ব্যক্তি অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে হাঁটছে, তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মহিলা, যার চোখ একবারের জন্য ক্যামেরার লেন্সে স্থির হয়েছিল। সেই চোখে ভয় ছিল না—বরং যেন এক চ্যালেঞ্জ ছিল, “তুমি জানো না, তুমি কোথায় ঢুকে পড়েছো।” আরুণিকার বুক ধড়ফড় করছিল, ঠিক যেন সেই চোখ তার দিকে তাকিয়ে এখনো বলছে—“তুমি শ্বাস নিতে চাও, তাই তো? কিন্তু আমরা শ্বাস নিই অন্যায় করে নয়, বরং সেটা ফিরিয়ে দিই লড়াইয়ের নামে।”
সকালটা শুরু হয়েছিল হাসপাতালের জরুরি ডাক দিয়ে। জানিক মোরা সেই রাতের পর আরুণিকার জন্য একটা বার্তা রেখে গিয়েছিল—একটা ছোট্ট কাগজে আঁকা ছিল একটা মানচিত্র, যার কেন্দ্রে লেখা ছিল “অক্সিজেন আসে এখানে, কিন্তু মনুষ্যত্ব যায় না”। সেই জায়গার নাম ইনফ্লো টানেল-১৯, শহরের নিষিদ্ধ এলাকার গভীরে, যেখানে একসময় সেন্ট্রাল পিউরিফায়ার প্ল্যান্ট ছিল। সেই প্ল্যান্ট এখন কেবল নামে আছে, আসলে তা এক মৃত কাঠামো, ভেতরে পড়ে থাকা ধ্বংসাবশেষ আর কেমিক্যাল বর্জ্যে। কিন্তু জানিকের দেওয়া মানচিত্র অনুযায়ী, এখানেই গড়ে উঠেছে কার্বন হান্টারদের এক গোপন আস্তানা। আরুণিকা সিদ্ধান্ত নেয়, সে একবারের জন্য সেই জায়গায় যাবে—অন্তত তার নিজের চোখে দেখে আসবে সত্যের এক ঝলক। জানিক, যাকে সে আগেই শিশুর চোখে দেখেছিল, এখন ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে এক সেতুবন্ধন—কারণ জানিক জানে ভিতরের রাস্তা, জানে কে কবে আসে, জানে কারা সত্যি বাঁচতে চায় আর কারা শুধু টাকায় নিঃশ্বাস বিক্রি করে।
রাতে তারা বের হয়, মুখে ফিল্টার মাস্ক, পায়ে শব্দহীন সোলের জুতো। ইনফ্লো টানেলের দিকে যেতে যেতে শহরের চেহারা পাল্টাতে থাকে। বিশাল ওয়াটার পাম্প, শূন্য বিশুদ্ধকরণ ট্যাংক, আর ফাঁকা হাইড্রো রিজার্ভ দেখে মনে হয়—কোনো কালে এই শহরে সত্যিই বাতাস শুদ্ধ করা হতো। সেই মৃত যন্ত্রের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তারা পৌঁছে যায় এক অন্ধকার কক্ষে, যেখান থেকে সূক্ষ্মভাবে বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ ভেসে আসে। সেখানে প্রথমবার আরুণিকা দেখে সেই কিশোরদের দল, যারা প্রতিদিন রাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বায়োলজিকাল অক্সিজেন সংগ্রহ করে। তাদের চোখে ভয় নেই, আছে একটা অদ্ভুত স্পর্ধা। একজন ছেলেকে দেখে সে চমকে ওঠে—তার মুখে স্পর্শকাতর সেল বসানো, মুখে ভ্রুক্ষেপহীন হাসি। কেউ আর শিশু নয় এখানে; সবাই কেবল বেঁচে থাকার ছাত্র। হঠাৎ করেই সেই মহিলাটি সামনে এসে দাঁড়ায়—আরুণিকার দেখা সেই রাতের মহিলা। নাম জানায় লুনা শিন। সে সাবেক সরকারী প্রযুক্তিবিদ, যার কোডের ভুলে একবার পাঁচ হাজার মানুষ মরে গিয়েছিল এক অক্সিজেন লিকের ঘটনায়। এখন সে নিজের যন্ত্র দিয়ে এই শিশুদের আর বাতাস-শূন্য মানুষদের জন্য প্রযুক্তি বানায়। আরুণিকা স্তব্ধ হয়ে যায়। তার সাংবাদিক চোখ সত্য খুঁজছিল, কিন্তু এখানে এসে সে যা দেখতে পায়, তা শুধু অপরাধ নয়—বরং এক বিকল্প সভ্যতা, যেখানে ন্যায়বিচার আর নিষ্ঠুর শাসনের মাঝখানে গড়ে উঠেছে বাতাসের এক অন্তর্ঘাতী বাজার।
লুনা তাকে এক প্রশ্ন করে—“তুমি কি সত্যি আমাদের মুখোশ খুলে বিশ্বকে দেখাবে? নাকি আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের কাহিনি বলবে, যেটা ইতিহাসে কেউ লেখে না?” আরুণিকার মনে প্রশ্ন দোল খায়—একজন চোর যদি অন্যদের বাঁচানোর জন্য চুরি করে, তবে সে কি শুধু চোরই থাকে? নাকি হয়ে ওঠে এক বিপ্লবী? জানিক সেই রাতে বলে—“আপু, আমরা বাতাস চুরি করি না, বাতাসকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করি।” আর তখনই আরুণিকা বুঝতে পারে, সে ঢুকে পড়েছে এমন এক লড়াইয়ে, যেখানে শত্রু আর নায়কের সংজ্ঞা মিলিয়ে যায় ধোঁয়ার ভেতর।
ইনফ্লো টানেল-১৯ থেকে ফিরে এসে আরুণিকার মাথায় যেন কেউ একগাদা ধোঁয়া ঢেলে দিয়েছে। মন আর চলছিল না আগের মত। হাসপাতালের কাচঘেরা ঘরে বসে সে দেখতে লাগল ফুটেজ—লুনা শিনের মুখ, জানিকের কণ্ঠস্বর, আর সেই শিশুগুলো যারা রোজ রাতের আঁধারে নিজেদের প্রাণকে বাজি রেখে কারও ফুসফুস বাঁচায়। কিন্তু এই তলহীন চোরাকারবারের শিকড় কোথায়? কার নির্দেশে চলে এই অপারেশন? কে সেই ছায়ার মানুষ, যার নাম সবাই ফিসফিস করে উচ্চারণ করে—রেইভ কিরান। সরকার তার নামে রেড নোটিস জারি করেছে, বাতাস চোরাকারবার, রাষ্ট্রদ্রোহ, প্রযুক্তি চুরি, এমনকি সন্ত্রাসবাদীর তকমাও দিয়েছে। কিন্তু হান্টারদের ভেতরে রেইভ এক নেতা, এক দেবতা। আর এখন সেই মানুষটিকে খুঁজে পাওয়া দরকার, কারণ সে-ই এই বাতাস যুদ্ধের আসল চাবিকাঠি।
আরুণিকার গোপন ফ্রিকোয়েন্সি ট্র্যাকারে আসে এক সংকেত—লুনার পাঠানো। “কাল রাত ২টা। পুরনো জার্ম কোয়ান্টা স্টেশন। একবার দেখো, সে হয়তো আসবে।” আরুণিকা দ্বিধায় পড়ে, কিন্তু জানিক বলে—”তুমি যদি রেইভ কিরানকে একবার চোখে দেখো, বুঝবে কারা খলনায়ক আর কারা শুধু অপরাধী হয়ে উঠেছে পরিস্থিতির জন্য।” রাতে পুরনো সেই স্টেশনে পৌঁছলে প্রথম যেটা চোখে পড়ে, তা এক বিরান ভবন—মরচে ধরা সিঁড়ি, নষ্ট ভেন্টিলেটর, বাতাসে ছেঁড়া ফাইবারের গন্ধ। আর ঠিক তখনই চারপাশে আলো নিভে যায়। পেছনে কড়া গলায় কেউ বলে—“তুমি সরকারি চর? নাকি সত্য খুঁজতে এসেছ?” পিছন ফিরে আরুণিকা দেখে এক দীর্ঘদেহী পুরুষ দাঁড়িয়ে—বয়স চল্লিশের আশপাশে, চোখ দুটি অদ্ভুতভাবে শান্ত, মুখে মুখোশ নেই। সেও যেন নিঃসাড়ে তাকিয়ে থাকে কিছু বুঝে নিতে। সে-ই রেইভ কিরান।
রেইভ তাকে কোথাও বসায় না, বরং সোজা নিয়ে যায় ভেতরের ল্যাব ঘরে—যেখানে বাতাস বিশুদ্ধ করার পুরনো যন্ত্র পড়ে আছে, যেগুলোর মধ্যে কিছু এখনো সে নিজে মেরামত করে চালু রেখেছে। রেইভ বলে, “তুমি জানো কি, পৃথিবীর শেষ বিশুদ্ধ অক্সিজেন রিজার্ভ এখন আর সরকার বা বিজ্ঞানীদের হাতে নেই। ওরা নিজে নষ্ট করেছে, কারণ স্বাভাবিক নিঃশ্বাস মানুষকে বিপজ্জনক করে তোলে। শ্বাসের স্বাধীনতা মানেই মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ভাবনার স্বাধীনতা। তাই তারা শ্বাসটাকেই বিক্রি করতে শিখেছে।” আরুণিকা অবাক হয়ে শুনতে থাকে, তার রেকর্ডার অফ—সে শুধু শোনে এক নরকের মহাকাব্য, যা বাইরে কেউ বিশ্বাসই করবে না। রেইভ তার অতীতের কথা বলে—সে একসময় ছিল শীর্ষ বায়োইঞ্জিনিয়ার, “গ্লোবাল এয়ার ফেডারেশন”–এর প্রধান বিজ্ঞানী। কিন্তু একসময় আবিষ্কার করে, তার বানানো অক্সিজেন ফিল্টারই সরকারের হাতে অস্ত্র হয়ে উঠেছে—নির্বাচিত মানুষদের ফুসফুসে বিশেষ ধরণে বাতাস দিয়ে তাদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। প্রতিবাদ করতেই তাকে ‘বিদ্রোহী’ ঘোষণা করে রাষ্ট্র।
রেইভ চুপ করে তাকায় আরুণিকার দিকে। বলে, “তুমি কি আমাদের গল্প বলবে? না কি আবারও কেউ হবে, যে সত্য দেখতে চেয়ে ফিরে যাবে নির্বাক থেকে?” আর তখনই আরুণিকা অনুভব করে, এই মানুষটি সন্ত্রাসবাদী নয়, সে এক বিপর্যস্ত ভবিষ্যতের নির্মাতা, যার হাত রক্তে লেপা হলেও চোখে শুধুই মুক্তির স্বপ্ন। এই অধ্যায়ে শেষ হয় সেই মুহূর্তে, যখন রেইভ তাকে একটা রেজোন্যান্স চিপ দিয়ে বলে—“এই ডিভাইস চালাও, শুনবে মানুষের কান্না। কিন্তু তখন যদি লিখো, সত্য পুরোটা লিখো—অর্ধেক সত্যও অনেক সময় মিথ্যের চেয়েও বেশি ভয়ংকর।”
রাত তখন প্রায় তিনটে। শহর ঘুমায় না, শুধু তার হৃদয় নিঃশ্বাস ফেলে ভারী হয় আরও। আর সেই রাতে, ধূলো, সীসা আর বিষাক্ত কার্বনের গন্ধ মিশে থাকা বাতাসের মাঝখান দিয়ে আরুণিকা সেন হেঁটে চলেছে এক গোপন বাজারের দিকে—যেখানে বিক্রি হয় জিনিসটা, যা একসময় মানুষের জন্মগত অধিকার ছিল—বাতাস। রেইভ কিরান তাকে দিয়েছিল এক রেজোন্যান্স চিপ, যার সংকেত ধরেই সে চলে এসেছে “সেভেন স্লট” নামের এক পরিত্যক্ত শিপইয়ার্ডে। বাইরের চেহারা মরচে ধরা ধাতু আর ধুলোয় ভরা, কিন্তু ভিতরে এক অদ্ভুত উন্মাদনা। পিচের মতো কালো মুখোশপরা লোকজন দাঁড়িয়ে আছে নিঃশব্দে, একে অপরের চোখে তাকায় না কেউ, কেবল ট্রান্সফার টার্মিনালে চোখ রাখে। চারপাশে ঝুলছে শীতল কাচের চেম্বার—তার ভেতরে সবুজাভ আলো, সিলিন্ডারে ভরা বিশুদ্ধ বাতাস। প্রতিটি চেম্বারে লেখা আছে তার বর্ণনা: “O₂—Purity 92%”, “Child Safe Air”, “Lung Balanced Oxygen, ₹2,00,000/cc”।
আরুণিকার মনে হচ্ছিল, সে কোনো ডিস্টোপিয়ান থিয়েটারের দর্শক, যেখানে শ্বাস নেওয়াটা এক বিলাসিতার নাটক। এক ছিন্নমূল পরিবার একটি সিলিন্ডারের দাম দর করে, কিছুক্ষণ পর তারা হেরে যায় আর কেউ তা কিনে নেয়। সেই বাবা স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলে—”তোর নয়, ছেলের মুখে লাগাবো।” স্ত্রীর চোখে জল, মুখে তীব্র দহন। বাতাস এখন আর চেতন বা নিঃশ্বাস নয়—এটা এখন মুদ্রা, যা কিনে নিতে হয় অন্য কারও প্রাণ থেকে। হঠাৎ করেই একটা দরজা খুলে যায়, সেখানে ঢোকে একদল সশস্ত্র রক্ষী, তাদের শরীরে সাইন-ইনফ্রারেড আর্মার, আর মুখে সরকারের প্রতীক। একদম পেছনে দাঁড়িয়ে এক পরিচিত মুখ—কম্যান্ডার জ়েড ড্রেভেন। সে সরকারের পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ রেজিমেন্টের সর্বময় কর্তা। তার চোখে ভ্রুক্ষেপ নেই, কেবল গলিত বরফের মতো শীতলতা। সে বলে—”আজকের নিলাম শুধু জরুরি ক্ষেত্রের জন্য—হাসপাতাল, কর্পোরেট হাউজ, বা স্ট্র্যাটেজিক ইনভেস্টমেন্ট ইউনিট। সাধারণ নাগরিকদের বাতাস কিনতে হলে আগে লাইসেন্স লাগবে।” মানুষের হাহাকার শুরু হয়, কিন্তু তা তীব্র হয় না, কারণ চিৎকার করলেই শ্বাস ছুটে যায়।
আর তখনই, ভিড়ের মাঝখান থেকে এগিয়ে আসে এক মুখোশপরা তরুণ। তার গলায় ছোট্ট একটা ফিল্টার ভিসার ঝুলছে। সে চিৎকার করে বলে—”এটা অন্যায়! এ বাতাস তো আমাদের সবার, এটা তো সৃষ্টির অংশ!” ড্রেভেন তাকে দেখে ঠাণ্ডা গলায় বলে—”তুমি কি একজন হান্টার?” ছেলেটি উত্তর দেয় না, শুধু হাত বাড়িয়ে দেয় বাতাসের সিলিন্ডারের দিকে। মুহূর্তের মধ্যে স্পার্কগান ছুটে আসে তার বুকে, ছেলেটি ধপ করে পড়ে যায় মাটিতে। শ্বাস ছুটে যায় আবার। কেউ কিছু বলে না। কেউ কিছু দেখে না। আর তখনই আরুণিকা বুঝে যায়, রেইভ কিরানের লড়াইটা শুধু শ্বাস নেওয়ার জন্য নয়, এটা একটা দমবন্ধ পৃথিবীতে একফোঁটা মুক্ত হাওয়ার জন্য যুদ্ধ।
সে নিজের ছোট ক্যামেরায় পুরো দৃশ্য ধারণ করে। কিছুক্ষণ পর একজন বৃদ্ধা তাকে ছুঁয়ে ফিসফিস করে বলে—”তুমি কি সাংবাদিক? প্লিজ, আমাদের কথা লিখো। ওরা শুধু বাতাস চুরি করছে না, আমাদের গলা চেপে ধরছে।” সেই মুহূর্তে একটা ছোট মেয়ে—খুব বেশি নয়, হয়তো ৭-৮ বছর বয়স—বাবার হাত ধরে কাঁদছে, তার হাতে একটা অক্সিজেন মাস্ক। আর তার বাবার হাতে কোনো টাকা নেই। সে চুপ করে মেয়ের মুখে মাস্ক লাগিয়ে দেয়, আর নিজের মুখ ঘুরিয়ে নেয় আকাশের দিকে, যেখানে আকাশ বলে কিছু নেই—শুধু ধোঁয়া আর কুয়াশা। আরুণিকার গলা শুকিয়ে যায়, চোখের পাতায় ঘাম জমে। সেই রাত, সেই বিক্রি, সেই শ্বাস-চুরি তার ভিতর গেঁথে যায়। সে বুঝে যায়—এই প্রতিবেদন আর শুধু ক্যারিয়ারের জন্য নয়, এটা তার নিজের শ্বাসের জন্য।
ভোরের আগেই জায়রা পৌঁছেছিল “রেজন্যান্স জিরো”-র সামনে—উত্তর মুম্বইয়ের পরিত্যক্ত একটি সাবওয়ে টার্মিনাল, যার ভিতরে নাকি একদা ট্রেন আসত আর যেত। এখন সেটা নিঃশব্দ কঙ্কাল, দেওয়ালে শ্যাওলার দাগ আর মাটিতে জলের ছোপ। কিন্তু এখানেই তাকে দেখা করতে হবে সেই ব্যক্তিটির সঙ্গে, যার নাম কেউ জানে না, শুধু ডাকে “লিভার”—কার্বন হান্টারদের সংগঠক এবং বেঁচে থাকার বিপরীতদিকের দালাল। জায়রা নিঃশব্দে হাঁটছিল, তার ব্রেথমাস্কে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে স্পন্দিত বাতাস টানছিল। কিছু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক ছায়ামূর্তি এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল, “তুমি কি বারো ঘন্টার আগেই এসেছো?” — কণ্ঠস্বরটা কেমন যেন ফিসফিসে, তবু গলায় এক অদ্ভুত কঠিন পরিহাস। জায়রা মাথা নাড়ল। “তুমি লিভার?” ছায়ামূর্তি উত্তর দিল না, বরং পেছনে হাঁটতে শুরু করল, আর জায়রাকে ইশারা করল অনুসরণ করতে।
ভেতরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই একটা ভারী দরজা বন্ধ হয়ে গেল তাদের পেছনে। চারপাশে ঝুলছিল পুরনো অক্সিজেন সিলিন্ডার, বাতিল বায়ু বিশোধক যন্ত্র, আর দেয়ালে আঁকা ছিল বড় বড় হান্টার চিহ্ন—ত্রিকোণ আবরণে মোড়া একটি গাছের প্রতীক। এইটা তাদের চিহ্ন, সেই অপরাধীদের যারা বিশুদ্ধ বাতাস চুরি করে কালোবাজারে বিক্রি করে। কিন্তু জায়রার মনে হচ্ছিল, এটা শুধু কালোবাজার নয়—এ যেন বেঁচে থাকার শেষ একটা নৈতিক যুদ্ধ। লিভার তাকে বসতে বলল একটা নড়বড়ে ধাতব চেয়ারে। তার সামনের টেবিলে ছড়ানো ছিল বেশ কিছু নোট, স্যাটেলাইট স্ক্যান, আর বিভিন্ন অঞ্চলের বাতাস বিশ্লেষণ রিপোর্ট। “তুমি জানতে চাও আমরা কি করি, কেন করি?” লিভার এবার জিজ্ঞেস করল। জায়রা সোজা হয়ে বসে বলল, “আমি জানতে চাই তোমরা কারা। আমি জানতে চাই আমার ভাই কেন হারিয়ে গেল। ও কি তোমাদের সঙ্গে ছিল?”—লিভারের মুখে তখন একটা নিষ্ঠুর ঠান্ডা হাসি। “তোমার ভাই… রিয়ান? হ্যাঁ, ও হান্টার ছিল। কিন্তু ও তোমার মতো সাংবাদিকদের বিশ্বাস করেছিল। আর এখন সে নেই।”
এই কথা শুনে জায়রার ভিতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। তার ভাই রিয়ান—যে বছরখানেক আগে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল, যার ছবি সে প্রতিদিন পকেটে রাখত—সে ছিল হান্টার? না, এটা হতে পারে না। সে তো বরাবর ছিল প্রতিবাদী, কিন্তু অপরাধী নয়। “তুমি বলছো আমার ভাই বাতাস চুরি করত?” জায়রার গলা কেঁপে উঠল। লিভার ঠান্ডা গলায় বলল, “তোমার ভাই বাঁচাতে চেয়েছিল শহরের বস্তির বাচ্চাগুলোকে—যাদের কোনো রেশন নেই, যাদের ভাগ্যে সরকারি বাতাস বরাদ্দ হয় না। আমাদের ব্যবস্থা তাদের বাঁচায়। সরকারের অ্যালগরিদমে তারা অদৃশ্য। তাদের জন্য আমরা বাতাস সংগ্রহ করি, বাঁচার অধিকার ফিরিয়ে দিই।” —জায়রার চোখ ছলছল করছিল। হঠাৎ একটা বিস্ফোরণের শব্দ হল বাইরে। লিভার উঠে দাঁড়াল। “তুমি বেশি সময় এখানে থাকতে পারবে না। কেউ আমাদের খোঁজ পেয়েছে।”—দূরে পুলিশ ড্রোনের আলো ঝলসে উঠতে লাগল। লিভার একটা ছোট ডিভাইস জায়রার হাতে দিল, “এটা নাও। তাতে তোমার ভাইয়ের শেষ মেসেজ আছে। কীসের জন্য সে মরেছে, জানার সময় হয়েছে তোমার।” জায়রা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। সেই মুহূর্তে সে বুঝল, সে যা খুঁজছিল তা কেবল একটা সংবাদ নয়—এ এক মহাযুদ্ধের ভিতরের সত্য, যেখানে শ্বাস নেওয়ার জন্যও দাম দিতে হয়, কখনও রক্তে, কখনও বিশ্বাসে।
২২১০ সালের গ্রিনজ়োনের ভেতর রাত্রির আকাশে তেমন তারা দেখা যায় না। শহরের কৃত্রিম আলো আর ভার্চুয়াল হ্যালোজেনে চাঁদটাও যেন কাচের মতো ঝাপসা হয়ে গেছে। অ্যালেয়া দাঁড়িয়ে ছিল বায়োডোমের কাচঘেরা প্রবেশপথের সামনে, তার ডান হাতে ক্লান্ত অথচ দৃঢ়ভাবে ধরা ডেটাক্যাবলটি। এই কেবলটিতেই ছিল তার সর্বশেষ অনুসন্ধান—এমন এক সত্য যা কেবল ‘দ্য ক্লিন এজেন্সি’র নয়, পুরো পৃথিবীর বাতাস নিয়ন্ত্রণকারী কর্পোরেট সিস্টেমকেই ধ্বংস করতে পারে। কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়। এই ডেটার চাবি একমাত্র এক ব্যক্তি জানে—দ্য কার্বন কিং। এবং কিং-এর কাছে পৌঁছনো মানেই মৃত্যু কিংবা তার থেকেও খারাপ কিছু।
এদিকে, অ্যালেয়ার সাবেক সহযোগী হান্টার কোরিয়ান—যে আগের অধ্যায়ে প্রতারক বলে প্রমাণিত হয়েছিল—সেই এখন আবার তাকে সাহায্য করতে আগ্রহী। কোরিয়ান তাকে বুঝিয়ে বলল যে বাতাস চোরাচালানের পেছনে যেসব রহস্য আছে, তা শুধু ‘কিং’ নয়, ‘ডেল্টা সেভেন’ নামের এক গোপন মিলিটারি-কর্পোরেট ইউনিয়নের দিকেও ইঙ্গিত করে। ডেল্টা সেভেন আসলে ক্লিন এজেন্সির শ্যাডো বিভাগ, যারা বৈজ্ঞানিকভাবে নির্মিত বিশুদ্ধ অক্সিজেন কেবল উচ্চমূল্যে ধনীদের কাছে বিক্রি করে, এবং নিম্নবর্গের মানুষদের কৃত্রিম বিষাক্ত ফিল্টার্ড এয়ার দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে। কোরিয়ান বলল, “তুই ভাবিস কার্বন হান্টাররা শুধু বাতাস চুরি করে? না রে, আমরা অনেকদিন ধরে ভেতর থেকে ভাঙার চেষ্টা করছি… শুধু নেতৃত্বটা ভুল জায়গায় ছিল।” অ্যালেয়ার মনে পড়ে গেল তার ছোটবেলার ভাই, যে বিষাক্ত বাতাসে ধুঁকে ধুঁকে মারা গিয়েছিল, আর সেই ক্ষতই তাকে সাংবাদিক হতে বাধ্য করেছিল।
অ্যালেয়া আর কোরিয়ান সিদ্ধান্ত নেয়, তারা যাবেন ‘ব্ল্যাক জোন-১৩’—সেটা এমন এক জায়গা যেখানে বাতাস চুরির মূল ঘাঁটি, এবং কিংের হাইডআউট। সেখানে পৌঁছতে হলে পেরোতে হবে যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চল, যেখানে মানুষের বদলে ক্লোন রোবট পাহারা দেয়, আর বাতাসে মিশে থাকে ন্যানোফিল্টার ট্র্যাপ। রওনা হওয়ার আগে অ্যালেয়া তার রেকর্ডারটা অন করে বলে, “এই যাত্রা হয় শেষ সত্যের দিকে, নয়তো আমাদের নিঃশেষ হবার পথ। কিন্তু যাই হোক, বাতাস কারো একার নয়—এই সত্যটা পৃথিবী জানবেই।” তাদের যাত্রা শুরু হয় ধোঁয়ার দেশে, যেখানে সূর্য ওঠে কৃত্রিম, আর প্রতিটি শ্বাসের পেছনে থাকে লড়াই।
মেঘলা আকাশের নিচে পুরনো হ্যানোভার ফ্যাক্টরির ধ্বংসাবশেষে বসে স্নেহা নিজের কণ্ঠ রেকর্ড করছিল—ডেটা জার্নাল এন্ট্রি ৬৮: “আজ আমি এমন কিছু দেখলাম যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। এরা বাতাস চুরি করে, কিন্তু শুধু ট্যাংকে ভরে বিক্রি করার জন্য না, কিছু হান্টার নাকি বিশুদ্ধ বাতাস নিজস্ব ‘মাইক্রোবায়ো-ডোম’ তৈরির জন্য ব্যবহার করছে—যেখানে ওদের পরিবার বেঁচে থাকে। প্রশ্নটা এখন এটা না যে ওরা অপরাধ করছে কিনা, প্রশ্নটা এটা যে আমরা সবাই কি বাঁচতে গিয়েই অপরাধী হয়ে যাচ্ছি?” সেই সময় দূর থেকে ঝোড়ো হাওয়ার শব্দের সঙ্গে ভেসে এলো এক অদ্ভুত যান্ত্রিক গর্জন। স্নেহা দৌড়ে ফ্যাক্টরির ভাঙা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল—দুইটি কালো ড্রোন তার অবস্থান স্ক্যান করে যাচ্ছে। ডেটা ডাউনলোড হয়ে গেছে বুঝে ও দ্রুত ডিভাইস অফ করে হুড তুলে আড়ালে সরে গেল।
এরই মাঝে অন্যদিকে, অর্ক আর লারসনের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে। অর্ক বুঝতে পারছে লারসন কোনোভাবে গোপনে ফেডারেশনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। তাদের গোপন আস্থানা ‘হ্যাভেনস কার্ভ’—যেটা এক বিশাল পাহাড়ের ভিতর তৈরি আন্ডারগ্রাউন্ড এয়ার কনটেইনমেন্ট সিস্টেম—তা এখন ঝুঁকির মুখে। অর্ক লারসনের ল্যাবে ঢুকে এক ভয়াবহ সত্য জানতে পারে—লারসন শুধু এয়ার হান্টার নয়, সে একই সঙ্গে একটি বায়ো-সিন্থেসিস টেস্ট চালাচ্ছিল যার মাধ্যমে ভুয়া বিশুদ্ধ বাতাস তৈরি করে ব্ল্যাক মার্কেটে বিক্রি করছিল। কিন্তু সেই বাতাসে ছিল কৃত্রিম কার্বন পার্টিকল যা দীর্ঘস্থায়ীভাবে শরীরের স্নায়ু ধ্বংস করে দিতে পারে। লারসনের উদ্দেশ্য ছিল একটাই—যত বেশিদিন মানুষ অসুস্থ থাকবে, ততদিন তার কৃত্রিম এয়ার ব্যবসা চলবে। অর্ক আর থাকতে পারে না, সে মুখোমুখি হয় লারসনের সঙ্গে—”তুমি একজন বিজ্ঞানী ছিলে, এখন তুমি একজন ভাঁড়!” কিন্তু লারসনের চোখে কোন অনুশোচনা নেই, বরং সে বলে, “আমি বাঁচতে শিখে গেছি, এখন পালা তোমার।”
স্নেহা ঘটনাচক্রে ‘হ্যাভেনস কার্ভ’-এ পৌঁছে যায় এবং অর্কের সঙ্গে আবার দেখা হয়। দু’জনের মধ্যে প্রথমবার বিশ্বাস তৈরি হয়—স্নেহা অর্ককে তার রেকর্ড করা ফুটেজগুলো দেখায়, লারসনের আসল চেহারার ভিডিও। অর্কও শোনায় তাদের টিমের কয়েকজন কীভাবে ‘বায়ো-ডোম’ এর মধ্যে শিশুদের বাঁচিয়ে রেখেছে। এই মুহূর্তে তারা বুঝতে পারে—শুধু ফেডারেশন নয়, হান্টারদের মধ্যেও বিশ্বাসঘাতকতা চলছে। তখনই তাদের নজরে আসে রেড ফ্ল্যাশিং সিগন্যাল—লারসন ফ্যাক্টরিতে পাগলের মতো কৃত্রিম বাতাস সিস্টেম চালু করেছে। পুরো এলাকা ধোঁয়ায় ঢেকে যাচ্ছে, যা শ্বাস নেওয়া তো দূর, চোখ খোলা রাখা যাচ্ছে না। অর্ক, স্নেহা আর আরেকজন সাইবার এক্সপার্ট ‘তাহা’ একত্রিত হয়ে প্ল্যান করে—লারসনের কৃত্রিম বাতাস কারখানাটাকে ধ্বংস করে দিতে হবে। তবে ধ্বংসের আগেই সেই সব ডেটা উদ্ধার করতে হবে যাতে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। যুদ্ধের আগে শুরু হয় এক দুর্দান্ত সাইবার হ্যাকিং অপারেশন—যেখানে ড্রোন, এআই সিকিউরিটি এবং মানুষের ত্রিমাত্রিক যুদ্ধ।
চাপা উত্তেজনার ভেতর, স্নেহা হঠাৎ একটা মাইক্রোড্রোন দেখে যার গায়ে লেখা—FENRIS UNIT। সে জানে এই ইউনিট কেবলমাত্র ফেডারেশন স্পেশাল অপস ইউনিট ব্যবহার করে। তাহলে কি লারসন একা নয়? পুরো ফেডারেশন কি এই কারচুপির সঙ্গে জড়িত? উত্তর এখনও অজানা। কিন্তু স্নেহা আর অর্ক বুঝে যায়, পরবর্তী অধ্যায়ে শুধুমাত্র লারসন নয়—তাদের লড়াই হবে একটা পুরো ব্যবস্থার বিরুদ্ধে।
আকাশ ঢাকা ধূসর মেঘে, নিচে যেন একটি কুয়াশার শহর, যেখানে বাতাস নিঃশ্বাস নয়—প্রতিশোধ হয়ে উঠেছে। অলিভিয়া, তার মুখে আধা-মাস্ক লাগিয়ে, হেঁটে চলেছে এক গোপন বায়ু-চেম্বারের দিকে, যেখানে অন্ধকারে কেবল পায়ের শব্দ আর দূরের যন্ত্রের ক্রমাগত হুইসেল। মিশনটা ছিল নিখুঁত, কায়রা আর গ্রুপের অন্য সদস্যদের নির্দেশ অনুযায়ী, তাকে চেম্বারে ঢুকে ‘অ্যাস্ট্রাল ফিল্টার’ নামক একটি পুরাতন প্রোটোটাইপ উদ্ধার করতে হবে। এটাই ছিল একমাত্র যন্ত্র যা বাতাসে মিথেন ও কার্বন ডাই-অক্সাইড আলাদা করতে পারত, যা একসময় নিষিদ্ধ করা হয়েছিল বড় তেল কর্পোরেশনের চাপের কারণে। এই ফিল্টার আবার চালু হলে কার্বন হান্টারদের শ্বাসরোধ করার ক্ষমতা হারাবে। অলিভিয়ার মনে পড়ে তার শৈশব, যখন সে মায়ের সঙ্গে ছাদের নিচে লুকিয়ে ফুসফুসে বাতাস নেওয়ার চেষ্টা করত, আর মা বলতেন, “একদিন হয়ত আমরা আবার খোলা হাওয়ায় হাঁটতে পারব।” সেই কথাই যেন আজ তাকে চালিত করছে।
অন্যদিকে, কার্বন হান্টারদের নেতা ড্রেভিন বুঝতে পারছিল, কেউ তার রাজত্বে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করছে। আগের রাতে তার ড্রোন প্যাট্রোল ক্যামেরা এক মহিলার ছবি তুলেছে, যার চেহারা ধোঁয়াশার মধ্যেও স্পষ্ট—অলিভিয়া। সে জানত এই নামটা। সংবাদমাধ্যমে অলিভিয়ার নাম বহুবার এসেছে, কিন্তু সে এতটা সাহস দেখাবে, তা ভাবেনি। ড্রেভিন তার একনিষ্ঠ অনুগামী রাইসাকে আদেশ দিল—“ওকে খুঁজে বের করো। ও আমাদের ভেতর থেকেই শ্বাস বন্ধ করার চেষ্টা করছে।” রাইসা, একদা সরকারি বায়ু-পুলিশ, এখন ড্রেভিনের ডানহাত, যাকে বলা হত “ছায়া-শিকারি”, কারণ তার উপস্থিতি বোঝার আগেই সে আঘাত করে যেত। অলিভিয়া তখন চেম্বারের ভেতরে প্রবেশ করেছে, তার হাতে স্ক্যানার যা বাতাসের গঠন বিশ্লেষণ করছে। প্রাচীন যন্ত্রগুলোতে ধুলো জমে আছে, কিন্তু তার চোখ ঝলসে উঠল একটি সুইচ দেখে, যার গায়ে লেখা “ACTIVATE ASTRAL FILTER – USE WITH CAUTION”।
যন্ত্রটা চালু করার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশে কাঁপন শুরু হল। কন্ট্রোল ইউনিটের মনিটরে ভেসে উঠল: “SYSTEM REACTIVATED AFTER 143 YEARS.” কিন্তু যেটা অলিভিয়া জানত না, তা হল এই যন্ত্র চালু হওয়া মানে শুধু বাতাস পরিষ্কার হওয়া নয়—এটা একটা সিগন্যালও পাঠায়, ঠিক যেমন আগেকার দিনের জরুরি সিস্টেমগুলো। এই সিগন্যাল এখন পৌঁছে যাচ্ছে ‘ওয়ার্থ সেন্ট্রাল’ নামের একটি নিষ্ক্রিয় প্রশাসনিক কেন্দ্রে, যেখানে বহু বছর ধরে কোনও মানুষ পা রাখেনি, কিন্তু যন্ত্র ঘুমিয়ে আছে। অলিভিয়ার আশপাশে বাতাস ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করেছে, তার মাস্ক খুলে সে প্রথমবারের মতো আসল অক্সিজেনের স্পর্শ পায়। সে কেঁপে ওঠে, চোখে জল চলে আসে—এটা অনুভূতির মতো, যা অনেকদিন হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই আনন্দ ক্ষণস্থায়ী হয়, যখন তার স্ক্যানার হঠাৎ করে বিপদ সংকেত দিতে শুরু করে। “Unknown bio-signal detected. Target approaching.” ছায়ার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে রাইসা—অস্ত্র তাক করে। তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে নিঃশব্দে, বাতাসে যেন নতুন উত্তেজনা—শুধু শ্বাস নয়, যুদ্ধের ঘ্রাণও আছে।
নিয়ন আলোয় ঝলমল ভেজা রাস্তাটির ধারে দাঁড়িয়ে নীলাহ তার স্নায়ুকে শক্ত করছিল। মুখে সুরক্ষা মাস্ক, হাতে একটি ক্লান্ত ফোটো-ড্রোন, আর হৃদয়ে একগুচ্ছ প্রশ্ন—সে তাকিয়ে ছিল ‘অ্যাক্সিস ফার্মা’-র গোপন গুদামের দিকে। এটাই সেই স্থান, যেখানে রেভা ও তার দল পাচার করা বাতাস জমা রাখত। কিন্তু তার ধারণা ছিল, এর বাইরেও কিছু আছে—আরও গভীরে, আরও ভয়াবহ কিছু। ঠিক তখনই মাটির নিচ থেকে কম্পন উঠল। যেন কোনো বিশাল যন্ত্র এক মুহূর্তে চালু হলো। পেছন থেকে রায়হানের কণ্ঠ ভেসে এল, “নীলাহ, এটা শুধু পাচার নয়… এটা একটা জীবন-চুরি… পুরো জেনারেশনকে ধ্বংস করার চক্রান্ত।”
ভিতরের লিফট-শাফ্ট দিয়ে নামতেই বিশাল এক গোলাকার কাচঘেরা কক্ষ চোখে পড়ল। তার মধ্যে আটকে রাখা আছে একাধিক প্রাণ—না, মানুষ নয়, জৈবিকভাবে তৈরি ‘বায়ো-চেম্বার হিউম্যানস’ যাদের শরীরে জেনেটিক কোড বসিয়ে তাদের ফুসফুসে বিশুদ্ধ বাতাস তৈরি করানো হচ্ছে। এরা কোনো নাগরিক নয়, কোনো অধিকারবিহীন জৈব দেহমাত্র। রেভা তার অসুস্থ বোনকে বাঁচাতে এই গবেষণাকে সমর্থন করেছিল, কিন্তু এভাবে? নীলাহ বিস্ময়ে জমে যায়। তার চোখের সামনে একটি শিশুকে টিউব থেকে টেনে বের করে বিশুদ্ধ বাতাস সংগ্রহ করছে এক টেকনিশিয়ান—এ দৃশ্য যেন সময় থামিয়ে দেয়। রায়হান ছবি তুলছে, ড্রোন ভিডিও নিচ্ছে, কিন্তু নীলাহর মনে হয় এই মুহূর্তের ভয়াবহতা কোনো ক্যামেরায় ধরা পড়ছে না।
তারা যখন গোপন সুরঙ্গ দিয়ে পালাতে চেষ্টা করছিল, তখনই বেজে ওঠে এলার্ম। পেছন থেকে ধাওয়া করে আসে রেভার অনুগত হান্টাররা। গোলাগুলি, গ্যাস, ধোঁয়া—সব মিলিয়ে এক বিভীষিকাময় লড়াই। রায়হান আহত হয়, নীলাহ তাকে টেনে নিয়ে যায় সুরঙ্গের আরেক দিকে। কিন্তু হঠাৎ সামনে আগুনের পর্দা। বায়োফুয়েল স্টোরেজে কেউ আগুন লাগিয়েছে—হয়তো রেভা নিজেই, প্রমাণ ধ্বংস করতে। আগুনের সেই লালচে আলোয়, ভস্ম হতে হতে দাঁড়িয়ে থাকে শত শত বায়ো-চেম্বার। নীলাহ পেছনে তাকায়—অভিযান শেষ হয়নি, বরং শুরু হলো অন্য এক সত্যের সন্ধান। সেই আগুনের পর্দা, যেন ভবিষ্যতের আড়ালে থাকা আরও গভীর এক রহস্যের মুখপাত্র।
১০
নির্জন জঙ্গল পেরিয়ে এক বিশাল কার্বন রিজার্ভারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিল মায়া, তার ডান হাতে ধরা ছিল একটি ম্যানুয়াল ডেটোনেটর, আর চোখে ছিল সেই দৃষ্টিভঙ্গি যা শুধুই তাদের চোখে দেখা যায় যারা মৃত্যু ও জীবনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সত্য বেছে নেয়। চারপাশে যেন পাখিরা, পশুরা সব থেমে গিয়েছে—এই দমবন্ধ পৃথিবীর মধ্যে শ্বাস নেবার লড়াই আজ শেষ হতে চলেছে। স্যাম ও কোরাকে হারানোর পর, মায়া আর কিছু হারানোর ভয় পায় না। সোলার স্ক্যানারে ধরা পড়েছে, শূন্যে ঝুলন্ত বায়ুর ট্যাংকারগুলো ইতিমধ্যেই রিজার্ভার থেকে বিশুদ্ধ বাতাস তুলে নিয়ে যাচ্ছে কর্পোরেট শহরের দিকে। আর কয়েক মিনিট পরেই সেই ট্রান্সফার স্থায়ী হয়ে যাবে, আর কেউই গরীব, সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এক বিন্দু বাতাসও পাবে না। মায়ার চোখে জল আসে না, আসে এক প্রবল তীব্রতা—যা তাকে ডেটোনেটর টিপে দিতে বাধ্য করে।
এক ভয়াবহ বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে চারদিক। রিজার্ভারের দেয়াল ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, প্রচুর বিশুদ্ধ বাতাস হু হু করে বেরিয়ে আসে। মায়া জানে, এটা তার নিজের মৃত্যুর স্বাক্ষরও হতে পারে। বিস্ফোরণের অভিঘাতে সে ছিটকে পড়ে, রক্তমাখা মুখে তাকিয়ে দেখে আকাশের দিকে উঠছে হালকা সাদা বাষ্প—শুদ্ধ বায়ু। চারদিকের সেন্সর অচল হয়ে গেছে, এবং কর্পোরেট হেলিকপ্টারগুলো পৌঁছানোর আগেই জায়গাটা ধোঁয়ায় ঢেকে যায়। দূরে, টানেল থেকে বেরিয়ে আসে কিছু লোক—যারা ছিল বাতাস-বঞ্চিত সীমান্তের মানুষ। তাদের চোখে বিস্ময়, মুখে সাড়া জাগানো চিৎকার—”আমরা বাঁচবো!” তারা ছুটে আসে রিজার্ভারের ধ্বংসস্তূপের দিকে, মায়ার দেহ তখনও নিস্তব্ধ, কিন্তু তার বুক উঠানামা করছে। সেদিন প্রকৃতির রণভেরী বাজিয়ে দিয়েছিল এক সাধারণ সাংবাদিক, যে সত্যের খোঁজে নেমে ছিল কিন্তু ফিরে এসেছিল এক বিপ্লবের স্থপতি হয়ে।
কয়েক সপ্তাহ পর, ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্কাই’ নামক নতুন এক মুক্ত মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের উদ্বোধনে মায়াকে দেখা যায়। তার কণ্ঠে বুলেটের দাগ, তার বাম চোখে অস্থায়ী আইপ্যাচ, কিন্তু তার হাসিতে ভয় নেই। স্যামের শেষ রেকর্ড করা বার্তাটি ছিল প্ল্যাটফর্মের প্রথম সম্প্রচার—“আমরা বাতাস চুরি করিনি, ফিরিয়ে দিয়েছি।” আজও, পৃথিবীর অনেক শহরে কার্বন হান্টাররা ধরা পড়ে, কিন্তু নতুন প্রজন্ম জানে—একজন মায়া ছিল, যে প্রশ্ন তুলেছিল, রুখে দাঁড়িয়েছিল, আর প্রমাণ করেছিল যে সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র শব্দ নয়, শ্বাস।

1000043148-1.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *