সুব্রত গাঙ্গুলি
প্রতীক দত্ত, কলকাতার এক নামকরা দৈনিকের অনুসন্ধানমূলক সাংবাদিক, চিরকাল যুক্তির পথ ধরেই হাঁটতে অভ্যস্ত ছিল। কিন্তু কিছু ঘটনা এমন থাকে, যেগুলো যুক্তিকে ছাপিয়ে যায়—এমনই এক ঘটনার পেছনে ছুটে সে এসে পৌঁছেছিল পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী এক গ্রামে, নাম উজানডাঙা। শহর থেকে অনেকটা পথ পেরিয়ে, রুক্ষ কাঁচা রাস্তা ও নিস্তব্ধ পলিমাটির ফাঁকে দাঁড়িয়ে থাকা গ্রামটির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল এক পরিত্যক্ত জমিদারবাড়ি—মহিমা চৌধুরী প্রাসাদ। এই বাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা কাহিনি তাকে টেনেছিল এখানে: প্রতি বছর চৈত্র সংক্রান্তির রাতে, বাড়ির মধ্যবর্তী ত্রিকোণ চত্বরে রাখা এক প্রাচীন ব্রোঞ্জের প্রদীপ নিজে থেকেই জ্বলে ওঠে—কেউ জ্বালায় না, কেউ দেখেনি জ্বালাতে, তবুও জ্বলে। খবরটি প্রথম সে পায় এক বৃদ্ধ পাঠকের চিঠি থেকে, যার ভাষা ছিল—“আপনার চোখ খুলে যাবে, যদি একবার প্রদীপটা নিজের চোখে দেখেন।” সেই রহস্যময় সংকেতকে গুরুত্ব দিয়েই সে পৌঁছায় এখানে, ক্যামেরা, নোটবুক, ও সন্দেহ নিয়ে।
গাঁয়ের লোকেদের মধ্যে প্রথম যে মানুষটির সঙ্গে দেখা হয়, তিনি হরিনাথ পাল, গ্রামের প্রাচীনতম বাসিন্দা। ঝুঁকে পড়া শরীর, দৃষ্টিশক্তি ঘোলা, কিন্তু মুখে রহস্যঘেরা হাসি। প্রতীককে দেখে প্রথমে অবাক হন, তারপর খুব ধীর গলায় বলেন—”আপনি তো এই বাড়ির পথ চেনেন… মনে হয় যেন আপনি আগে এসেছিলেন।” প্রতীক হেসে বিষয়টা উড়িয়ে দেয়, কিন্তু অস্বস্তি পিছু ছাড়ে না। পরিত্যক্ত বাড়ির গেট খুলে দেয় জানকী দেবী, এক আশি পেরোনো অথচ স্থিরদৃষ্টির বৃদ্ধা। একসময় এই বাড়ির উত্তরাধিকারিণী ছিলেন, এখন একাকী থাকেন একপাশের ঘরটিতে। “প্রদীপ দেখতে এসেছ?”—প্রশ্নটি ছুড়ে দিয়ে তিনি যেন প্রতীকের মানসিক অবস্থা যাচাই করলেন। প্রতীক শুধু মাথা নাড়ে। জানকী দেবী ইঙ্গিত দেন, বাড়িতে থাকতে চাইলে থাকতে পারে, তবে কিছু প্রশ্নের উত্তর সময়ের আগে খোঁজার প্রয়োজন নেই। প্রথম রাতেই প্রতীক বুঝে যায়, এই বাড়ির বাতাস, কাঠের মেঝের শব্দ, এমনকি রাতের স্তব্ধতা—সবকিছু যেন তাকে কিছু মনে করিয়ে দিতে চায়। মধ্যরাত নাগাদ ঘুম ভেঙে যায় তার, কেমন একটা গন্ধ ভেসে আসে—জলন্ত ঘৃতের, পোড়া চন্দনের। জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখে, আঙিনার মাঝখানে রাখা প্রদীপটা জ্বলছে। কিন্তু আশেপাশে কেউ নেই, কোনো চলাফেরার চিহ্ন নেই। ক্যামেরা হাতে নিয়ে দৌড়ে নেমে আসে, কিন্তু মাটিতে কোনো পায়ের ছাপ পায় না। আর প্রদীপের শিখা—সে এক অদ্ভুত রঙের, যেন কমলা আর নীলের মিশ্র আলো।
সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রতীক নিজের মোবাইলে আগের রাতের ভিডিও দেখে, কিন্তু ক্যামেরায় শুধু অন্ধকার। কিছুই ধরা পড়েনি। সে বাড়ির ঘর ঘুরে ঘুরে দেখে, পুরনো দরজার পাশে একটা ছোট্ট কৌটো খুঁজে পায়, যার মধ্যে আছে পুরনো চিঠি আর একটি ছেঁড়া ডায়েরির পৃষ্ঠা। পাতায় লেখা—“তৃতীয় রাত, চতুর্থ স্তবক। প্রদীপ যদি জ্বলে, তার মানে আচার অসম্পূর্ণ। আবার জন্ম হবে—সেই ঋণ শোধ না হওয়া পর্যন্ত।” প্রতীক হঠাৎ গা ছমছম করে ওঠে। কেমন করে একাধিক সূত্র একই কথার ইঙ্গিত দেয়? কে লিখেছে এই কথা? কে সেই ঋণী? নিজের লেখায় বহুবার সে ভণ্ড সাধুদের মুখোশ খুলেছে, কিন্তু এবার তার নিজের মনেই প্রশ্ন জাগে—তাহলে কি এমন কিছু সত্যিই আছে, যা যুক্তি ছুঁতে পারে না? সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে জানকী দেবী আবার আসে, হাতে এক কাপ চা আর মুখে প্রশ্ন—“আজ প্রদীপ নিভে গিয়েছে, তাই না?” প্রতীক তাকিয়ে থাকে তার চোখে, যেন প্রশ্ন করতে চায়—আপনি জানলেন কীভাবে? কিন্তু প্রশ্নটা আর মুখ থেকে বেরোয় না। বৃদ্ধা ধীরে ধীরে চলে যান, আর প্রতীক অনুভব করে, এই রহস্যের কেন্দ্রবিন্দুতে কেবল অতীত নয়—তার নিজের অস্তিত্বই জড়িয়ে আছে।
***
প্রতীক পরদিন সকালবেলা সোজা বাড়ির আঙ্গিনার পাথরের বেদির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। যেখানে গতরাতে প্রদীপ জ্বলতে দেখেছিল, সেখানে এখন শুধুই ছাই আর সামান্য ঘৃতের গন্ধ। মাটিতে আবার একবার ভালো করে খুঁজে দেখলেও কোনো মানুষের পায়ের ছাপ নেই, এমনকি বাতাসে আগুন জ্বলার কোনো গন্ধও আর নেই। সে বাড়ির প্রতিটি ঘর পরিদর্শন করে, ধুলো জমা খাট, বন্ধ জানালা, ছাদ থেকে ঝুলে থাকা মাকড়সার জাল—সব কিছু যেন অদ্ভুত এক নীরবতার সাক্ষ্য বহন করে। তবে বাড়ির দক্ষিণ-পূর্ব দিকের এক ঘরের সামনে এসে থেমে যায় সে। দরজার গায়ে আঁচড়ের দাগ, আর দরজার ওপর কাঠে খোদাই করা—”কর্তব্য শেষ না হলে আত্মা বিশ্রাম পায় না।” ভেতরে প্রবেশ করলে চোখে পড়ে ছড়ানো ছিটানো পুরনো মালা, ঘি রাখা ভাঙা মাটির পাত্র, কয়েকটি পোড়া ধূপকাঠি আর এক কোণে রাখা একটি বিশাল আয়না, যার কাঁচ ফেটে গেলেও মাঝখানে একটি দাগহীন টুকরো এখনো পরিষ্কার। প্রতীক আয়নার সামনে দাঁড়াতেই তার নিজের মুখ যেন বদলে যায়—না, সে নিজের মুখই দেখে, কিন্তু যেন মনে হয় চোখের পেছনে অন্য কেউ তাকিয়ে আছে। আতঙ্কে চোখ ফিরিয়ে নেয় সে, এবং পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে দেখতে পায় জানকী দেবী দাঁড়িয়ে আছেন। মুখে তার স্বাভাবিক সেই রহস্যময় চেহারা, কিন্তু চোখে খুব সামান্য একটা করুণার রেখা। তিনি বলেন, “এই ঘরটা ছিল পূর্বপুরুষের সাধনার ঘর। কিন্তু সাধনা শেষ হয়নি। কেউ একজন বারবার ফিরে আসে শেষ করতে।”
সেই রাতে প্রতীক আর ঘুমোতে পারে না। বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে ঘড়ির কাঁটা টিকটিক শব্দে কানের ভেতর গেঁথে যায়। হঠাৎ জানালার পাশে বাতাস কেঁপে ওঠে—একটা মৃদু শব্দ হয়, যেন কেউ ধীরে ধীরে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ছে। প্রতীক চোখ মেলে তাকায়, এবং দেখে দরজার ফাঁক দিয়ে আলো প্রবেশ করছে, ঠিক যেন প্রদীপের। সে উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই হিমেল হাওয়া এসে মুখে লাগে, আর সে দেখে, সেই প্রদীপটা আবার জ্বলছে—একই জায়গায়, একই ভাবে। কিন্তু এবার পাশে এক নারীমূর্তি দাঁড়িয়ে আছে, সাদা শাড়ি, খোলা চুল, মুখটা স্পষ্ট নয়, কিন্তু প্রতীক অনুভব করে, সে তার নাম জানে—রত্নমালা। চোখের পলকে সেই দৃশ্য মিলিয়ে যায়, এবং সে নিজেকে খাটে বসে থাকতে দেখে, শরীর ঘামে ভিজে, বুক ধড়ফড় করছে। কিন্তু জানালার পাশের বাতাসে আবার ভেসে আসে সেই একই গন্ধ—জলন্ত ঘৃত, পোড়া চন্দন। প্রতীক বুঝতে পারে, তার স্বপ্ন আর বাস্তবের রেখা মুছে যাচ্ছে। তখনই মনে পড়ে, হরিনাথ পাল বলেছিলেন—“আপনি তো আগে এসেছিলেন… মনে হয় আপনি এই জায়গারই।” কথাটা কি নিছক একটি খেয়ালী বয়স্ক মানুষের মন্তব্য, না কি সত্যিই সে এখানে আগে এসেছিল? তবে তা কবে? এই জন্মে নয়, তাহলে কোন জন্মে?
পরদিন সকালে জানকী দেবী চুপচাপ প্রতীককে বসিয়ে একটি ছোট কাঠের বাক্স এগিয়ে দেন। বাক্সের ভেতর একটা প্রাচীন ধাতব তাবিজ, আর সঙ্গে একটা ছেঁড়া কাগজে লেখা কিছু মন্ত্র—সংস্কৃত ভাষায়, কিন্তু পাশের লেখায় বাংলায় অর্থ লেখা—“যিনি পূর্বজন্মের ঋণে বাঁধা, তার জীবন হবে পুনরাবৃত্তি; প্রদীপ জ্বলে থাকলে ঋণ রয়ে যাবে।” প্রতীক এবার আর অস্বীকার করতে পারে না, এই বাড়ির সঙ্গে তার একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে—যা কেবল ইতিহাস নয়, আত্মার বয়ানের মতো মনে হয়। সে তাবিজটা হাতে নেয়, এবং তার শরীরের মধ্যে এক তীব্র কাঁপুনি অনুভব করে—একটি মুহূর্তে সে দেখতে পায় আগুনের কুণ্ড, লাল বসনে মোড়া এক যুবক, যজ্ঞের সামনে বসে মন্ত্র পড়ছে, পাশে সেই নারীমূর্তি—রত্নমালা। পরমুহূর্তে সে আবার বর্তমানকালে ফিরে আসে। জানকী দেবী শান্তভাবে বলেন, “তুমি এখনো পুরোটা দেখোনি। কিন্তু যেটুকু দেখেছ, তা মিথ্যে নয়। এ জন্মে তুমি ফিরে এসেছ কারণ শেষ কাজ বাকি। তবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তোমাকেই—তুমি প্রদীপকে নিভাবে, না কি তাকে জ্বলতে দেবে অনন্তকাল।” প্রতীক বুঝতে পারে, এটি আর শুধুমাত্র একটি প্রাচীন বাড়ি নয়—এটা যেন তার আত্মার পরীক্ষাকেন্দ্র, তার পুনর্জন্মের মুখোমুখি হওয়ার জায়গা।
***
প্রতীক নিজেকে যতই স্থির রাখার চেষ্টা করুক না কেন, তার ভিতরের টান যেন ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠছে। প্রতিটি রাত যেন একেকটি অতীতের জানালা খুলে দিচ্ছে—একেকটি দৃশ্য, একেকটি মুখ, এক অজানা জীবন। সে ঠিক করে হরিনাথ পালের সঙ্গে আবার দেখা করবে। বৃদ্ধ লোকটি তাকে নিয়ে যান গ্রামের এক প্রাচীন কালীমন্দিরের পাশে, যেখানে মন্দিরের পেছনে এক পরিত্যক্ত ঘরে রক্ষিত আছে কয়েকটি পুরাতন দলিলপত্র, যেগুলি জমিদার বাড়িরই ঐতিহাসিক নথি বলে জানা যায়। সেখানে প্রতীক পায় একটি পাতলা চামড়ার খামে ভাঁজ করা তাম্রপত্রের মতো কিছু, তাতে খোদাই করা নাম—“তাম্রলিপ্ত ভৈরবাচার্য, ১৬৮৩ বঙ্গাব্দ।” হরিনাথ জানান, তাম্রলিপ্ত ছিল এক তান্ত্রিক, যার সাধনার পরিধি এতটাই গভীর ছিল যে গ্রামের মানুষ তাকে ভগবানের দূত বলে মানত, আবার কেউ কেউ ভয় পেত তাকে অসুর মনে করে। সেই সময়ই নাকি জমিদার হরনাথ চৌধুরী তাম্রলিপ্তকে স্থায়ী আশ্রয় দেন, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন এই তান্ত্রিকই তার পরিবারে ‘অমরত্ব’ এনে দিতে পারে। কিন্তু একদিন আচমকা সেই তান্ত্রিক, যিনি মাসের নির্দিষ্ট এক রাত্রিতে একটি বিশেষ যজ্ঞে বসতেন, নিখোঁজ হয়ে যান—ঠিক যজ্ঞ শুরু হবার কিছুক্ষণ আগে। কেউ জানে না কী হয়েছিল, শুধু এটুকু শোনা যায়, সেই রাতেই প্রথম বার প্রদীপ নিজে থেকেই জ্বলে ওঠে। তারপর প্রতি বছর, ঠিক সেই একই রাতে, সেই একই জায়গায় প্রদীপ জ্বলে, যজ্ঞ শুরু হয় না, আর কোনো না কোনো অশান্তি ঘটে বাড়ির মধ্যে।
প্রতীক ফিরে এসে জানকী দেবীকে তাম্রপত্রটি দেখালে তিনি প্রথমবারের মতো কেঁপে ওঠেন। ধীরে ধীরে বলেন, “এই নামটা বহুদিন কেউ উচ্চারণও করেনি। তাম্রলিপ্ত এখানেই ছিল—এই বাড়ির গর্ভগৃহে বসেই সে যজ্ঞ করত। কিন্তু সেই যজ্ঞ ছিল অশুভ—সে মৃত্যুকে জয় করতে চাইত, আত্মাকে বন্দী রাখতে চাইত শরীর ছাড়াও। আর তুমিই সেই যজ্ঞের কেন্দ্রে ছিলে—রত্নমালার সঙ্গে।” প্রতীক বিস্ময়ে চেয়ে থাকে, কিন্তু প্রশ্ন করার আগেই তিনি বলতে থাকেন, “তুমি তখন ছিলে তার অন্যতম শিষ্য—জ্ঞানী, তবে দ্বিধাগ্রস্ত। রত্নমালার সঙ্গে তোমার ভালোবাসা ছিল যজ্ঞের পথে বাধা। তাম্রলিপ্ত তোমাকে বলেছিল তাকে ত্যাগ করতে, কিন্তু তুমি পারোনি। সেই রাত্রে যজ্ঞ অসম্পূর্ণ থেকে যায়—তাম্রলিপ্ত কোথায় মিলিয়ে যায়, কেউ জানে না। তবে কেউ কেউ ভাবে সে নিজেই নিজের আত্মা যজ্ঞকুণ্ডে বন্দী রেখে গেছে—যাতে ভবিষ্যতে কেউ এসে তাকে মুক্ত করতে পারে।” প্রতীক নিঃশব্দে শুনতে থাকে, মাথার মধ্যে যেন ঝড় বয়ে যায়। তাহলে সে কি সেই পূর্বজন্মের শিষ্য? এই জন্মে তার ফিরে আসা কি নিছক কাকতালীয়? না কি সবটাই পূর্বনির্ধারিত? জানকী দেবী মৃদুস্বরে বলেন, “তুমি যদি প্রদীপের শিখায় দৃষ্টি স্থির করো, তুমি দেখতে পাবে সেই রাত। তুমি যদি সাহস রাখো, নিজেকে চিনে নিতে পারবে।”
সেই রাতে প্রতীক আবার সেই একই স্বপ্ন দেখে, কিন্তু এবার তা আরও গভীর, আরও দীর্ঘ। সে দেখতে পায় বিশাল এক গৃহ, চারদিকে মাটির কুণ্ড ঘিরে রাখা প্রদীপ, রত্নমালা তার পাশে বসে আছে, চোখে জল। তাম্রলিপ্ত বসে আছেন মন্ত্রপাঠে, তার চোখে অশান্ত আগুনের দৃষ্টি। এবং হঠাৎ সেই দৃশ্যে প্রতীক বুঝতে পারে, সে নিজেই তখন অন্য কেউ ছিল—নাম ছিল আদিত্য। তার হাতে ছিল যজ্ঞের প্রধান উপকরণ, যার দ্বারা যজ্ঞ সম্পূর্ণ হত, কিন্তু সে তা বিসর্জন দেয় রত্নমালার প্রাণ বাঁচাতে। ফলত যজ্ঞ অসম্পূর্ণ থেকে যায়, এবং তাম্রলিপ্ত ক্ষিপ্ত হয়ে আত্মবিনাশী সাধনায় নিজেকে বন্দী করে রেখে যায়। স্বপ্নে প্রতীক দেখতে পায়—তাম্রলিপ্তের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, “যে প্রদীপ জ্বলছে, তা নিভিয়ে দিতে পারবে সেই, যে পূর্বজন্মে বাধা সৃষ্টি করেছিল। সে-ই মুক্তি দিতে পারবে।” হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় প্রতীকের। ঘরে অন্ধকার, কিন্তু জানালার বাইরে ঝিমঝিম আলো। সে উঠে গিয়ে আবার দেখে—প্রদীপ জ্বলছে, কিন্তু এবার শিখার ভেতর কী যেন নড়ছে—একটি ছায়া, এক জ্বলন্ত দৃষ্টি। প্রতীক অনুভব করে, এই যাত্রা তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা সে জানে না, তবে পিছিয়ে যাবার আর উপায় নেই। সে শপথ করে, এবারের যজ্ঞ শেষ হবে—কিন্তু কার মুক্তি হবে, আর কার অভিশাপ? তা হয়তো সময়ই বলবে।
***
প্রতীকের রাতের ঘুম এখন শুধুই প্রত্ন-স্মৃতির এক গভীর বৃত্ত। দিনের আলোয় বাস্তব যতই শক্ত হয়ে উঠুক, রাত হলেই সেই তান্ত্রিক সময় যেন ফিরে আসে। প্রতীকের জন্য সবচেয়ে অস্বস্তিকর বিষয় ছিল—স্বপ্ন নয়, বরং যে বিশদতায় সেই স্বপ্নগুলো আসছিল তা। রং, শব্দ, ঘ্রাণ, স্পর্শ—সবই ছিল বাস্তবের মতোই স্পষ্ট। প্রতীক দেখতে পায় রত্নমালার চোখ, যেখানে ভর ছিল অশ্রু ও আকুলতার। তার গলায় মালা পরিয়ে দিচ্ছে সে নিজে—আদিত্য রূপে। সেই মুহূর্তে এক নারীর মতো মুখে শান্তি দেখা যাচ্ছে না, বরং এক ভয়, যেন সে জানে—এই ভালবাসা শেষ পর্যন্ত কারও রক্ষা করবে না। রত্নমালা বলে, “আদি, ওঁর যজ্ঞ শেষ হলে আমি আর থাকব না। তুমি কি পারবে প্রদীপ নিভিয়ে দিতে?” প্রতীক ঘুমের মধ্যেই উত্তর দিতে চায়, কিন্তু শব্দ বেরোয় না। তার মধ্যে জন্ম নেয় দ্বন্দ্ব—সে কি সত্যিই তাম্রলিপ্তের যজ্ঞ ব্যর্থ করেছিল? আর যদি করে থাকে, তবে কি আজকের এই পুনর্জন্ম তার ঋণ শোধের জন্য? সকালে ঘুম থেকে উঠে সে নিজেকে আয়নায় দেখে—চোখের নিচে কালি, ঠোঁটে শুষ্কতা, কিন্তু চোখের গভীরে যেন অতীতের ছায়া ঘন হয়ে উঠেছে। জানকী দেবী কিছু না বললেও বুঝতে পারেন তার পরিবর্তন, শুধু বলেন—“সব আত্মার মুক্তি চায় না, কেউ কেউ অনন্তেও থাকতে চায়। কিন্তু যে বাঁধা, তাকে রেহাই দিতে হয়।”
প্রতীক ঠিক করে, এবার সে বাড়ির নিচের তলায় যাবেই। বাড়ির একটি ঘরের মেঝেতে একটি লোহার রিং পায়, যেটি ঘষে তোলার পর দেখা যায় এক সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে, সরু, স্যাঁতসেঁতে, অন্ধকার সিঁড়ি। সে হাতটর্চ জ্বালিয়ে নিচে নামে, এবং আবিষ্কার করে এক বিশাল গোলাকার গৃহ—পুরোটা গোলাকার দেয়ালে প্রাচীন তাম্রচিত্র খোদাই করা, যেগুলোতে নানা যজ্ঞ, প্রাণ বিসর্জন, তান্ত্রিক সাধনার চিত্র আঁকা। ঘরের একেবারে মাঝে একটা জ্বলন্ত কুণ্ড রয়েছে, যার উপর স্থাপিত একটি ধাতব ত্রিকোণ—মাঝখানে কাঁচের মতো একটা থালা, যার নিচে যেন ঘূর্ণায়মান ছায়া। প্রতীক কুণ্ডের সামনে দাঁড়িয়েই অনুভব করে—এই জায়গায় কোনো সময় সে বসেছিল, ঠিক এমনভাবেই। পাশে রাখা একটি রক্তরঞ্জিত পোড়া চিঠির টুকরোয় লেখা—”আদি, যদি ফিরে আসো, আমাকে মুক্ত করো। এই আলো আমার নয়। প্রদীপ নিভালেই হবে। — রত্নমালা।” প্রতীক সেই কুণ্ডের সামনে বসে, চোখ বন্ধ করে, মনে করতে চেষ্টা করে সেই রাত—মন্ত্রের শব্দ, আগুনের উত্তাপ, রত্নমালার ভয়, তাম্রলিপ্তের উচ্চারণ। তখন হঠাৎ তার হাতের মধ্যে তাবিজটা আবার গরম হয়ে ওঠে, এবং সে অনুভব করে, কোনো শক্তি যেন তার শরীরের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে—অতীত তার ভেতর দিয়ে বয়ে চলেছে।
রাত ঘনিয়ে এলে জানকী দেবী প্রতীকের সামনে বসে বলেন—“তুমি যদি চাও, আমি তোমাকে সাহায্য করব স্মৃতির দরজা সম্পূর্ণ খুলে দিতে। কিন্তু একবার খুললে আর ফিরে আসা যাবে না। তোমাকে দেখতে হবে, কেন প্রদীপ জ্বলে, কেন যজ্ঞ অসম্পূর্ণ ছিল।” প্রতীক সম্মতি জানায়। তখন জানকী এক প্রাচীন ধূপজ্বালিয়ে ধ্যানের ব্যবস্থা করেন। ধূপের গন্ধ, তামার ঘণ্টার শব্দ, এবং চোখ বন্ধ করতেই প্রতীক যেন দেহ ত্যাগ করে প্রবেশ করে সেই অতীতে—এক অদ্ভুত আলোয় ভরা গৃহ, শত শত প্রদীপের আলো, এক বেদীর সামনে বসে আছে তাম্রলিপ্ত, তার চারপাশে ঘূর্ণমান রক্তরঞ্জিত ধোঁয়া, আর দূরে দাঁড়িয়ে রত্নমালা। সে মুহূর্তে প্রতীক দেখে আদিত্যর হাত কাঁপছে, কারণ তার হাতে সেই চূড়ান্ত বস্তুটি—যা যজ্ঞ শেষ করবে। তাম্রলিপ্ত বলে—“তোমার ভালোবাসা তোমাকে দুর্বল করেছে, আদিত্য। তুমি জানো না, এই যজ্ঞ পূর্ণ হলে আমরা মৃত্যুকে জয় করব!” কিন্তু আদিত্য বলেছিল, “ভালোবাসা দুর্বলতা নয়। তোমার যজ্ঞ যদি তার প্রাণ চায়, তবে সে যজ্ঞ অভিশপ্ত।” ঠিক সেই সময় সে সেই উপকরণ ভেঙে ফেলে—যজ্ঞ ব্যাহত হয়, আগুন ছড়িয়ে পড়ে, আর তাম্রলিপ্তের কণ্ঠ ফেটে বলে—“তুমি ব্যর্থ করলে আমাকে। তবে আমি থাকব, প্রদীপ জ্বলবে, যতক্ষণ না তুমি ফিরে এসে তা নিভিয়ে দাও।” প্রতীক ধ্যান ভেঙে উঠে আসে, শরীর ঘামে ভিজে। জানকী দেবী বলে, “তুমি সব দেখেছো। এখন তুমিই সিদ্ধান্ত নেবে—এই জন্মে তুমি মুক্তি দেবে, না আবার সেই চক্রে বাঁধা পড়বে।” প্রতীক জানে, তার সামনে দুটি পথ—একটি অতীত বন্ধ করে দেওয়া, আর একটি তাম্রলিপ্তের যজ্ঞ পূর্ণ করা। কিন্তু সে জানে, প্রদীপ একদিন নিভতেই হবে।
***
পুরো এলাকা যেন হঠাৎ করে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, শুধু বাতাসে একটা কুঁচকে যাওয়া পাতার শব্দ আর দেওয়ালের কোনা থেকে কুয়াশার মতো আসা অজানা গন্ধ ছাড়া সব কিছু থেমে। প্রতীক তাকিয়ে ছিল গৃহস্থালির ধূলিধূসর গালিচার দিকে, যেখানে ঠিক সেদিন রাতে সে আবিষ্কার করেছিল অদ্ভুত প্রতিচ্ছবি—একটি সিঁদুর রাঙা পায়ের ছাপ, যা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিল। জমিদারবাড়ির এই ঘরটা আগেও দেখেছে সে, তবে স্মৃতিতে নয়, বরং স্বপ্নে। ঠিক যেমনটা ঘটেছিল তৃতীয় রাতের সেই দুর্বোধ্য ঘুমের মধ্যে। রাত্রি নামলে এখন আর ঘুম মানে বিশ্রাম নয়, বরং এক যাত্রা—পুনর্জন্মের, ভুলে যাওয়া দৃষ্টিকোণের। রানীমার প্রাচীন পাথরের মূর্তির সামনে বসে সে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে ছিল সেই প্রদীপটার দিকে, যেটা কেউ জ্বালায় না, অথচ জ্বলে—আর তার আগুন নিভে গেলে অজানা কান্নার শব্দ শোনা যায় চারপাশে। সেদিন হঠাৎই দরজার পাশের পাতলা দেয়ালে দেখা গেল একটা ছায়া—চেনা নয়, তবু চেনা। প্রতীক ভেবেছিল কেউ হয়তো তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু ঘুরে তাকাতেই দেখা গেল শূন্যতা, আর দরজার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়া একটা তীব্র শীতল হাওয়া। সেদিন প্রথম সে অনুভব করল, তার শরীর নয়, আত্মা—এই বাড়ির কোনও অতীত অংশে বাঁধা পড়ে আছে।
তন্নিষ্ঠ অনুসন্ধানে প্রতীক এবার পুরো দিন কাটালো পুঁথি আর নথিপত্র ঘেঁটে। পুরাতন ম্যানুস্ক্রিপ্ট থেকে জানা গেল, এই জমিদারবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন দেবাধর লাহিড়ী—এক অদ্ভুত চরিত্র, যিনি শুধু জমিদারি নয়, তন্ত্রচর্চার জন্যও বিখ্যাত ছিলেন। ইতিহাস বলছে, তাঁর মৃত্যু হয়েছিল তাঁরই তৈরি করা এক “অধর্মনাশী যজ্ঞের” মাঝখানে, যেখানে প্রদীপটা শেষবার জ্বালানো হয়েছিল তাঁর হাতে। যজ্ঞের তাপে ৭ জন মৃত্যুবরণ করলেও দেবাধরের দেহ কেউ খুঁজে পায়নি। পরবর্তী প্রজন্ম এই বাড়ি ছেড়ে চলে যায়, কিন্তু বাড়িতে কিছু নিয়ম রেখে যায়—প্রতি বছর এক নির্দিষ্ট রাতে প্রদীপ জ্বলবে, কোনও মানুষ তার সামনে যাবে না, না হলেই ‘পুনরায় আগমন’ ঘটবে। এই ‘আগমন’ বিষয়টা এতদিন প্রতীক কেবল গল্পে শুনেছিল, কিন্তু এবার যে জিনিসগুলো ঘটছে—সে নিজেও সন্দেহ করতে শুরু করেছে নিজের স্মৃতি নিয়ে। কুয়াশার আড়ালে, মনের গহীনে উঠে আসছে কিছু চিত্র—একজন কিশোরী কাঁধে ঝাঁপি নিয়ে যাচ্ছেন যজ্ঞস্থলের দিকে, তার কপালে চন্দনের তিলক, তার ঠোঁটের কোণে নামহীন অভিমান। প্রতীক জানে না কেন, কিন্তু সে মেয়েটিকে চেনে। তার নাম স্বরস্বতী, আর প্রতীকের স্বপ্নে সে বারবার বলে, “তুই ফিরলি অবশেষে।” এই বাক্যটা প্রতীকের মনোজগত উলটে দেয়—সে বুঝতে পারে, সত্যিকারের অনুসন্ধান সে করে না, বরং তার ভেতরের অতীত তাকে খুঁজে বের করেছে।
রাত্রি নেমেছে আবার, আর পাখিরা চুপ করে আছে বটগাছের ডালে। প্রদীপটা আবার জ্বলে উঠবে, এই বিশ্বাসের আলো আর ভয় দুই একসঙ্গে জ্বলছে প্রতীকের চোখে। কিন্তু এবার সে ভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়—প্রদীপ জ্বলার আগেই সে সেখানে উপস্থিত থাকবে। রানীমার মূর্তির সামনে বসে সে নিজেকে প্রস্তুত করে, ধূপকাঠির ধোঁয়া কুয়াশার মতো লেগে থাকে তার শরীরে। ঠিক তখনই এক অদৃশ্য করতালি যেন শোনা যায়, ধ্বনি আসে অচেনা ভাষায়—তন্ত্রসাধনার স্তোত্র। ঘরের দেওয়াল যেন শ্বাস নিচ্ছে, আর প্রতীক ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে এক অদৃশ্য সময়ে। চোখ বন্ধ করে সে যখন হঠাৎ খুলল, দেখে সে আর জমিদারবাড়িতে নেই—সে দাঁড়িয়ে আছে শত বছর আগের সেই যজ্ঞস্থলে, আর সামনে দাঁড়িয়ে দেবাধর নিজে। দেবাধরের চোখে প্রতিফলিত হয় সেই স্বরস্বতীর মুখ—এবং প্রতীক নিজের মুখে খুঁজে পায় সেই পুরুষকে, যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছিল ফিরে আসার, কিন্তু আর আসেনি। প্রদীপ তখনও জ্বলছে, দেবাধর বলছে—“যজ্ঞ এখনও শেষ হয়নি, প্রদীপ এখনো তোর হাতে নিভবে না। প্রথম তুই পালিয়েছিলি, এখন তোকে শেষ করতে হবে।” এই কথার ভারে প্রতীক থমকে যায়, কারণ সে অনুভব করে, তার বর্তমান জীবন আসলে একটা চক্রের অংশ, যার শেষ হওয়া বাকি। আর যেই মুহূর্তে সে আবার চোখ খুলে ফিরে আসে বর্তমানে, রানীমার মূর্তির পাশে জ্বলতে থাকা সেই প্রদীপটা কেঁপে ওঠে একবার—প্রতীকের নিজের হাতেই ধরা ছিল ধূপকাঠি।
***
প্রতীকের চোখদুটো যেন ঘোর লাগা ছবির মতো খুলল। সে আবিষ্কার করল, সে এখনও সিংহদুয়ারের কাছেই দাঁড়িয়ে, কিন্তু চারপাশে আলো-আঁধারি ছায়া আরও ঘন হয়ে এসেছে। তার কানে তখনও রিনরিন শব্দে ঘুরছে সেই মেয়েটির কণ্ঠস্বর—”যে পথ তুমি বেছে নিয়েছ, তার শেষ নেই।” প্রতীক যেন সেই কথার অর্থ বোঝার আগেই আবারও অনুভব করল এক অদৃশ্য শক্তি তাকে টানছে। ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখে, রাজবাড়ির পূর্ব দিকের এক বন্ধ অংশের দরজা খানিকটা খোলা। এ অংশে প্রবেশ নিষেধ ছিল। অথচ এই প্রথম, দরজাটি নিজে থেকেই যেন ডেকে নিয়ে চলেছে। ভিতরে পা রাখতেই প্রতীকের গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে—সারা ঘর জুড়ে ছড়ানো শতাব্দীপ্রাচীন মুদ্রা, মাটির পাত্র, ধূপকাঠি আর রক্ত লেগে থাকা ছিন্ন পত্র। বাতাস ভারী, যেন কোথাও কাছেই কেউ গভীর প্রাচীন মন্ত্রপাঠ করছে। প্রতীক হাঁটু গেড়ে একটি ছোট কালি-রঙা খাতা তুলে নেয়। খাতাটি পুরোনো হলেও ভিতরের অক্ষর আজও জ্বলজ্বল করছে—তান্ত্রিক বীজমন্ত্র, রক্তে লেখা শ্লোক, আর কোথাও কোথাও প্রতীকের বর্তমান জীবনের সঙ্গে মিলে যাওয়া নাম—প্রতীক, কৃষ্ণনগর, অশ্বত্থ গাছের নিচে… প্রতীক যেন হারিয়ে যায় সেই পাতায়।
খাতার প্রতিটি পৃষ্ঠায়, কেউ একজন তার পূর্বজন্মের তথ্য যেমন করে লিখে রেখেছে, ঠিক তেমনই ভবিষ্যৎও ছড়িয়ে রেখেছে—”আগুনে পূর্ণ হবে চক্র, ষষ্ঠ রাত্রে প্রাচীন প্রদীপে আবারও জ্বলবে আত্মার শিখা।” প্রতীক টের পায়, এটা শুধুই তার জার্নাল নয়, এ যেন কোনও কালের-চক্রে ঘুরতে থাকা আত্মার পুনর্জন্মের ডায়েরি। সে জানত না, কীভাবে এগোবে, কিন্তু খাতাটি তার হাতে মানে সে নির্বাচিত। হঠাৎ, ঘরের কোণে থাকা ধূপদানের আগুন যেন আরও তীব্র হয়ে ওঠে। তার থেকে উঠে আসা ধোঁয়ায় আকৃতি নেয় একটি মুখ—সেই তান্ত্রিক, যার ছবি সে আগেই দেখে এসেছিল রামপ্রসাদের পাণ্ডুলিপিতে। সেই মুখ যেন বলছে—”সপ্তচক্র সম্পূর্ণ না হলে এই শিখা নির্বাপিতই থাকবে। তোমাকে শেষ করতে হবে যে আমি শুরু করেছি।” প্রতীক বুঝতে পারে, এখন আর পিছন ফিরে যাওয়ার পথ নেই।
তার চোখ ফের পড়ে খাতার শেষ পাতায়—সেখানে লেখা, “পরবর্তী পদক্ষেপ: চক্রব্যূহে প্রবেশ। সন্ধ্যার পূর্বে, দক্ষিণের পোড়ো ঘর।” সে ছুটে যায় সেই ঘরের দিকে, যেখানে এক সময় জমিদারবাড়ির মেয়েদের তান্ত্রিক রীতিতে পাঠ দেওয়া হতো। ঘরের মাঝে থাকা বৃত্তাকার চিহ্নগুলি, এখন অদ্ভুতভাবে জ্বলছে। প্রতীক যখন চক্রব্যূহের কেন্দ্রস্থলে দাঁড়াল, হঠাৎ চারপাশ অন্ধকারে ছেয়ে গেল। চোখে মুখে ছায়ার ঢেউ খেলে যেতে লাগল। অন্ধকারের মাঝেই প্রতীক দেখতে পায় এক শিশু—তার মুখ অবিকল তারই ছোটবেলার মতো, কিন্তু কণ্ঠে প্রাচীন ভাষা—”যদি শেষ যজ্ঞ শুরু করেছ, তবে শেষ শিখাটিও জ্বালাতে হবে। নয়তো তুমি, আর এই আত্মারা, চিরতরে বন্দি থাকবে।” প্রতীক তবুও ভয় না পেয়ে সেই ছেলেটিকে বলে, “আমি ফিরতে চাই না। যদি এ-ই আমার পথ হয়, তবে আমি হেঁটে যাব তার শেষ সীমা পর্যন্ত।” শিশুটি মাথা নাড়িয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। আর প্রতীক বুঝে নেয়—এখন থেকে সময় নয়, শুধুই বিশ্বাস এবং আগুনই তার পথ।
***
জমিদারবাড়ির অন্দরমহলে রাত গভীর হলে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে আসে। প্রতীক জানালার ধারে বসে সারা দিনের নোটগুলো ঘাঁটছিল, কিন্তু তার মন বারবার সরে যাচ্ছিল সেই মন্দিরের প্রদীপ আর দিদিমার কণ্ঠস্বরের দিকে—“ওটা শেষ নয়, ওটা তো শুরু।” ভোরবেলা মন্দিরের সামনে আবার সেই অলৌকিক গন্ধ, এবং জ্বলা প্রদীপ। কে জ্বালায়? কেনই বা জ্বালায়? আর কেনই বা সে নিজেকে এত ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে ফেলেছে এই রহস্যে? তখনই তার ঘরের দরজায় ঠকঠক শব্দ। দরজা খুলে সে দেখে—ঠাকুরদা হরিপ্রসন্ন দত্তের পুরনো রক্ষিত বৈঠকখানার রক্ষক, বৃদ্ধ নারায়ণ দাঁড়িয়ে। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, “প্রতীক বাবু… আপনার জন্য কিছু রেখে গিয়েছিলেন হরিপ্রসন্ন বাবু… বলেছিলেন ঠিক এই বয়সে আপনি ফিরে আসবেন।” নারায়ণ তাকে নিয়ে গেলেন বৈঠকখানার ভিতরের ঘরে, যেখানে একটা ধুলোজমা কাঠের বাক্স খুলতেই প্রতীক পায় তার ঠাকুরদার হাতে লেখা কিছু পান্ডুলিপি—”অগ্নিযজ্ঞ ও কালতন্ত্র” নামে এক ভয়ংকর তান্ত্রিক নিদর্শনের উল্লেখ, এবং একটি মানচিত্র যা জমিদারবাড়ির ভেতর আরেকটি গোপন কক্ষের পথ দেখায়। চোখেমুখে বিস্ময় নিয়ে প্রতীক বুঝে ওঠে, এ শুধু তার পেশার অনুসন্ধান নয়, এ তার নিজের পূর্বজন্মের দায়বদ্ধতা।
পরদিন রাতেই প্রতীক মানচিত্র অনুযায়ী পৌঁছে যায় সেই গোপন কক্ষে। তার আগে সে দেখে যে নারায়ণ আরও কয়েকটি গোপন কথা শোনাতে চায়—বৃদ্ধ বললেন, “আপনি জানেন, ১৯০১ সালে এই বাড়ির এক রাজপুরোহিত ছিলেন কালাধর ভট্টাচার্য, যিনি ছিলেন এক সিদ্ধ তান্ত্রিক। তিনি তাঁর মৃত্যুর পূর্বে ঘোষণা করেছিলেন যে এক অর্ধেক-জন্মা আত্মা ফিরে আসবে—যার মাধ্যমে শেষ হবে অর্ধসমাপ্ত যজ্ঞ। সেই আত্মা নাকি আপনি…।” প্রতীক প্রথমে অবিশ্বাস করলেও তার ভিতরকার স্বপ্ন ও ভয়ানক পরিচিতি এই পুরনো ঘরগুলোর সাথে মিল খেয়ে যায়। কক্ষের ভেতরে সে দেখতে পায় এক বিশাল যজ্ঞমণ্ডপ, যা ধ্বংস হয়ে গেলেও স্পষ্টভাবে বোঝা যায় তার গুরুত্ব—পোড়া কাঠ, পাথরের ওপর আঁকা তান্ত্রিক চিহ্ন, একধারে পাথরের ভগ্ন মূর্তি, যার চোখ দুটি যেন তাকে চেয়ে আছে। প্রতীকের হঠাৎ মনে পড়ে—তার স্বপ্নে এই দৃশ্য ঠিক এইভাবেই এসেছিল। এবং তার ঠিক মাঝখানে ছিল প্রদীপটি। কক্ষের এক কোনায় সে পায় একটি রৌপ্যনির্মিত থালা, যাতে লেখা—“শেষ যজ্ঞ তখনই শেষ হবে, যখন পূর্বজন্মের আগুন জ্বলবে বর্তমান আত্মায়।”
প্রতীক ধীরে ধীরে অনুভব করে, তার ভিতরে যে অজানা টান অনুভব হচ্ছিল, তা এই যজ্ঞের, এই কালাধরের শেষ সাধনার। তার মনে পড়ে, স্বপ্নে সে নিজেকে দেখেছে অন্য বেশে, অন্য কণ্ঠে মন্ত্রোচ্চারণ করতে, পাশে ত্রিনয়নী এক মূর্তি, পাশে কালাধর… সেই স্বপ্নের দৃশ্য ধাপে ধাপে মিলে যাচ্ছে বাস্তবের সাথে। রাতে সে আবার ফিরে আসে মন্দিরে, যেখানে প্রদীপ এখনো জ্বলছে। সে এবার সাহস করে এক মন্ত্র জপে ফেলে—স্বভাবতই তার জানা ছিল না, কিন্তু সে যেন মুখস্তভাবে উচ্চারণ করতে থাকে। হঠাৎ প্রদীপের শিখা নাচতে থাকে, বাতাস ভারী হয়, আর এক মুহূর্তে মন্দিরজুড়ে কাঁপুনি ধরে যায়। প্রতীক বুঝতে পারে, এক কালচক্র আবার ঘুরে উঠেছে, এবং সে নিজেই এখন সেই যজ্ঞের অর্ধেক পুরোহিত, যার স্মৃতি লুকিয়ে আছে তার অতীতজন্মে। সেই রাতের পর, প্রদীপ আর নিভে না, এবং জমিদারবাড়ির নির্জন দেয়ালে এক নতুন ছায়া খেলে যায়—এক পূর্বজন্মের অসমাপ্ত যজ্ঞ যার জাগরণে এখনো অপেক্ষা করছে শেষ অধ্যায়ের জন্য।
***
কপাল ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ে প্রতীক, নীলাভা আর অন্বেষা। সময় তখন রাত বারোটা। উঠোনের ঠিক মাঝখানে, যেখানে শতবর্ষ ধরে সেই অদৃশ্য হাতে প্রদীপ জ্বলে ওঠে, সেখানেই বসানো আছে তাম্রের মণ্ডপ। বৃত্তাকার সেই যজ্ঞমণ্ডলে ছড়িয়ে আছে নানা মুদ্রা, শঙ্খ, পঞ্চমাকার উপকরণ। এক অদ্ভুত ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছে—ধূপ নয়, না-ই বা কোনো সুগন্ধি—এ যেন গন্ধেরও অতীত কিছু। প্রতীকের শরীর হঠাৎ অস্থির হয়ে উঠল। চোখের সামনে যেন আবছা হয়ে উঠছে আরেক সময়—এক ঋদ্ধ আশ্রম, আগুনের চারপাশে বসে থাকা সন্ন্যাসীরা, আর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন তিনিই—প্রতীক নন, তার পূর্বজন্ম—ঋষিবর অলোকানন্দ। নীলাভা তখনও তার হাত ধরে রেখেছে, যেন সে জানে এই মুহূর্তে প্রতীক আর সে নয়, অন্য কেউ হয়ে উঠেছে। হঠাৎই অন্বেষা কিছু একটা পড়ে ফেলল—এক পুরনো লিপি, সংস্কৃতে লেখা। তার পাঠে জানা গেল, এই প্রদীপ শুধু আলো নয়, এক আত্মার অনন্ত যাত্রার স্মারক। অলোকানন্দ যখন তন্ত্রসাধনার চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছেছিলেন, তখনই সে নিজের পরবর্তী জন্মের মাধ্যমে যজ্ঞ সম্পূর্ণ করার সংকল্প করেছিলেন।
ঠিক সেই মুহূর্তে মেঝের নিচে থেকে ভেসে এল আওয়াজ—না কোনো মানুষের, না জন্তুর—এ যেন মন্ত্রোচ্চারণ আর প্রলাপের সংমিশ্রণ। বাতাস ভারী হয়ে উঠল, আলো-আঁধারির খেলা শুরু হলো। অন্বেষা পা এগোতেই মেঝে ফেটে গেল, আর নিচ থেকে উঠতে লাগল ঘন ধোঁয়া। প্রতীক কাঁপা গলায় বলল, “এই তো…এই জায়গায় আমি মরেছিলাম। আগুনে, শেষ যজ্ঞে।” তার কণ্ঠস্বর যেন এক পুরনো ঋষির হয়ে উঠল। অন্বেষা চিৎকার করে উঠল, “তুমি প্রদীপ জ্বালাতে এসেছিলে, কিন্তু যজ্ঞ শেষ না করে ফিরে গিয়েছিলে! এবার পূর্ণ করো!” নীলাভার চোখে জল, কিন্তু তার হাত শক্ত, সে প্রতীকের হাত ছাড়ে না। প্রতীক ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় প্রদীপের দিকে, এক পুরনো মুদ্রা তুলে নেয়, ও শঙ্খ বাজিয়ে বলে, “এই আলো আমার আত্মার প্রজ্জ্বলন। আমি ফিরেছি, আর এইবার যজ্ঞ শেষ করব।” মুহূর্তেই মেঝে থেমে যায়, ধোঁয়া মিলিয়ে যায়, আর প্রদীপ আপনাআপনি জ্বলে ওঠে—এই প্রথম, সকলের চোখের সামনে।
আলোর ছায়ায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে এক মহাযোগীর অবয়ব—মাথায় জটা, চোখে অগ্নিময় দৃষ্টি—অলোকানন্দ! “প্রতীক, তুমি আমারই অবতার, আজ তুমি আমায় মুক্তি দিলে।” হালকা বাতাসে যেন মিশে গেল তার অস্তিত্ব। প্রদীপের আলো ধীরে ধীরে স্থির হয়ে গেল। অন্বেষা, নীলাভা আর প্রতীক দাঁড়িয়ে রইল সেই আলোয়, তিনজনে তিন ভিন্ন জীবন থেকে আসা, কিন্তু একটিই কাহিনির অন্তিম সূচনাপর্বে মিলিত। আর সেই রাত থেকে, প্রদীপ আর অদৃশ্যভাবে জ্বলে না, বরং প্রতি বছর, সেই বাড়ির তিনতলার বারান্দায় মানুষ একজোট হয়, আর প্রদীপ জ্বলে প্রতীকের হাতে। ইতিহাস আর রহস্য একে অপরের অলক্ষ্যে বাঁধা থাকে—প্রতীক জানে, তার যাত্রা শেষ নয়, এই আলো যতদিন জ্বলবে, ততদিন সে থাকবে এক চক্রের পাহারায়।
-সমাপ্ত-




