পৃথিবী তার চেনা আলোয় জেগে ছিল সেই ভোরে। কলকাতার আকাশটা কেমন গাঢ় ছায়ায় মোড়া, আর বাসের হর্ণ, চায়ের দোকানের কাশা কাশা আওয়াজ—সবকিছু যেন অরুনিমার শরীরে গেঁথে ছিল সেদিন। ওর চোখে তখন ব্যাগভরা কাগজ, অ্যাস্ট্রো-বায়োলজির রিপোর্ট, এক জোড়া ঘুমহীন চোখ, আর একটা রুমাল—যেটা ঈরা বানিয়ে দিয়েছিল ফেলে যাওয়ার আগের রাতে। অরুনিমা জানত, এই যাত্রা তার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি—চাঁদের বুকে ভারতীয় বিজ্ঞানী হিসেবে অবতরণ করা শুধু তার নয়, গোটা দেশের গর্ব। তবুও একটা ভার যেন বুকের বাঁ পাশে দলা পাকিয়ে ছিল, ঠিক যেমন বোঝা জমে মেঘলা আকাশে। ট্যাক্সি যখন বাড়ি থেকে বেরোলো, ঈরা তখন তার গাল চেপে ধরে বলেছিল, “তুমি কি আকাশে থেকেও গল্প বলতে পারবে?” অরুনিমা সেদিন শুধু মাথা নেড়েছিল, কথা বলতে পারেনি। তার স্বামী অনির্বাণ চুপ করে পাশে বসেছিল, জানালার বাইরে তাকিয়ে। অতীতের সব লড়াই, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা, নিজেকে বারবার প্রমাণ করার দায়—সবকিছুর শেষে আজ সে বেরিয়ে পড়ছে, অথচ মনে হচ্ছে কিছু যেন রেখে যাচ্ছে, হয়তো চুপ করে থাকা একটা পৃথিবী, যেখানে সে শুধুই এক গৃহিণী, যে রান্না করে, স্কুলে বাচ্চাকে ছাড়ে, রাতে গল্প শোনায়। বিজ্ঞানী পরিচয়টা যেন আজ খুব শুষ্ক, অথচ পৃথিবীর মাটিতে দাঁড়িয়ে থেকে তৈরি হয়েছিল এই অভিযানের ভিত্তি। এয়ারপোর্টের কাঁচের দেয়ালের ওপারে দাঁড়িয়ে ঈরা হাত নাড়ছিল—তার ছোট আঙুলে বাঁধা ছিল এক লাল সুতো, যেটা তারা দুজন মিলে বলেছিল, “এই সুতোর এক প্রান্তে মা, এক প্রান্তে আমি।”
তারা যখন মহাকাশযানে উঠল, তখন অরুনিমা ভাবেনি চোখে জল আসবে। কিন্তু মানুষের মস্তিষ্ক যত শক্তই হোক, মনটা ঠিক পুরোনো অভ্যাসে বাঁধা। পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রথম মুহূর্তে সে দেখতে পেয়েছিল শহরের আলোগুলো ছোটো হয়ে যাচ্ছে, আর ঈরার মুখ যেন একটা কাল্পনিক আয়নায় ফুটে উঠছে বারবার। কন্ট্রোল রুমের নির্দেশ, মনিটরের জ্বলা আলো, সহ-অভিযাত্রীদের ধাতব হাসি—সব মিলিয়ে সময়টা ছিল মেকি প্রাপ্তির মতো। সে বুঝতে পারছিল, একজন নারীর সাফল্যের মূল্য অনেক বেশি, কারণ তাকে সবসময় কাউকে রেখে, কিছু ভেঙে সামনে এগোতে হয়। তার মনে পড়ে যাচ্ছিল অনির্বাণের শেষ কথাগুলো: “তোমার স্বপ্ন সত্যি হওয়া মানে আমাদের স্বপ্নটা একটু কম পূর্ণ হওয়া।” অরুনিমা জানে, সে একা এগিয়ে গেছে বলে পেছনে ফেলে এসেছে একটা চুপচাপ সংসার—যেখানে বইয়ের তাকে আর পেঁয়াজ কাটার ছুরিতে দুটো আলাদা জীবন চলত পাশাপাশি। সে জানে না, ঈরা রাতে ঘুমাবে কিনা, না কি জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থাকবে ‘মায়ের চাঁদ’ দেখে। তার চোখের সামনে তখন লাল-নীল বোতাম, চাঁদের পৃষ্ঠের মানচিত্র, আর ঘন শ্বাস নেওয়া সহযাত্রীদের মুখ। তবুও কোথা থেকে একটা স্মৃতি ঘুরে ঘুরে ফিরে আসে—ঈরার গায়ে মেঘের মতো ছাপা একটা টপ, রান্নাঘরের জানালা দিয়ে আসা বাতাসের সুবাস, আর একটা শব্দ—‘মা।’ অরুনিমা একসময় নিজেকেই প্রশ্ন করে, “আমি কি পালিয়ে যাচ্ছি, না কি নিজেকে খুঁজে নিতে চলেছি?” পৃথিবী তখন অনেক দূরে, তবুও তার গায়ের রক্তে যেন পৃথিবীর মাটি মিশে আছে।
অভিযান সফল, যাত্রা শুরু। অরুনিমা যখন চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছায়, তখন তার হৃদয়ের ভার যেন একটু হালকা হয়। এখানে, এই ধূসর জগতে, কোনও রান্নার গন্ধ নেই, নেই ছেলেমেয়ের হোমওয়ার্কের চাপ, নেই শ্বশুরবাড়ির স্নেহমাখা তর্জন। তবুও, যেন কোথায় কী খালি খালি। সে জানে, এই অভিযান শুধু এক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নয়—এটা তার অস্তিত্বের পরীক্ষা। সে ভাবছিল, সমাজ একজন নারীকে গৃহিণী বলেই চেনে, যখন সে কোনও দৃশ্যমান ঘরের দেখাশোনা করে, সংসারের থালা গুছিয়ে রাখে। কিন্তু যদি কোনও নারী পৃথিবীর বাইরে থেকেও তার পরিবারের জন্য চিন্তা করে, ভালোবাসে, দূর থেকে নজর রাখে—তবে কি সে আর গৃহিণী থাকে না? অরুনিমা অনুভব করে, ‘গৃহ’ শব্দটা আসলে অনেক বড়। তার যে মায়া, যে স্বপ্ন, যে টান—তা কোনো মেঝে, দেওয়াল বা রান্নাঘর দিয়ে বেঁধে রাখা যায় না। চাঁদের বুকে দাঁড়িয়ে সে প্রথমবার ভাবে, “আমি গৃহ ছেড়ে এসেছি ঠিকই, কিন্তু হয়তো আমি এখনই প্রথমবার নিজের মধ্যে একটা গৃহ গড়তে শুরু করেছি।” আর তখনই তার মনে পড়ে যায় ঈরার কথা—“তুমি ফিরলে আমি তোমার জন্য তারা দিয়ে একটা নতুন ঘর আঁকবো।” এই কথাগুলো সে বুকের খুব গভীরে লুকিয়ে রাখে, ঠিক যেমন কেউ ঘরের পুরোনো চাবিটা রেখে দেয় তার স্মৃতির ড্রয়ারে।
–
ধূসরতা কখনও এত বিশাল হতে পারে, সেটা অরুনিমা কল্পনাও করেনি। যখন ল্যান্ডার নেমে এলো চাঁদের মাটি ছুঁয়ে, তখন জানালার ওপারে যে পৃথিবীটা ছিল, সেটা একটুখানি নীল বিন্দুতে বদলে গেছে। প্রথম পা ফেলার মুহূর্তটা কোনও বিজয়ীর চিৎকারে নয়, বরং এক ধরনের নিস্তব্ধ ধাক্কায় ভরে উঠল। মহাশূন্যের এই রাজ্য যেন নিঃশব্দ শ্মশান—প্রত্যেকটা ধুলোর দানায় ইতিহাস জমে আছে, কিন্তু কেউ কথা বলে না। চাঁদের ঘর, গবেষণাকেন্দ্র, ভাসমান বিছানা, অক্সিজেনের টিউব—সবই যেন এক যান্ত্রিক বিশুদ্ধতার প্রতীক। প্রথম রাতে যখন সে স্যুট খুলে বিছানায় এল, তখন তার শরীর কেঁপে উঠেছিল—এমন নয় যে ঠান্ডা লেগেছিল, বরং এক অদ্ভুত শূন্যতা ঢুকে পড়েছিল গলার গভীরে। পৃথিবীতে যখন ঘুম আসত না, তখন সে চুপিচুপি রান্নাঘরে যেত, ঈরার জন্য গরম দুধ গড়গড় করিয়ে দিত, জানালা দিয়ে দেখে নিত রাস্তার আলো। এখন এসব কিছু নেই। অরুনিমা জানে, সে একজন বিজ্ঞানী, সে জানে বেঁচে থাকতে গেলে আবেগকে বাদ দিয়ে চলতে হয়, তবু চাঁদের পাথরের নিচে পায়ের ছাপ ফেলার সময় মনে হচ্ছিল—এই পদচিহ্ন কি সত্যিই আমার? এই মাটি, এই বাড়ি, এই সময়—কোনোটাই কি আমার গৃহ হতে পারে?
পরের দিনগুলো কাটতে শুরু করে এক ঘড়ির কাঁটার মতো জীবনে। সূর্যোদয় নেই, রাতও নেই, শুধু সময়ের কৃত্রিম হিসেব। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে নমুনা সংগ্রহ, সিগনাল পাঠানো, বৈজ্ঞানিক রেকর্ড রাখা—এ যেন মানুষের তৈরি এক অবিরাম ছাঁচ, যাতে মনের খিদে ঢোকানো যায় না। সহ-অভিযাত্রীদের কেউ কেউ ঠোঁটে হাসি মেখে কথা বলে, কেউ আবার নীরব। এলেনা বসু—অভিযানের নেত্রী—সবচেয়ে বিচ্ছিন্ন, নিখুঁত মেশিনের মতো কাজ করেন। একদিন সকালের দিকে অরুনিমা কফি খেতে খেতে বলেছিল, “আপনার কখনও মনে হয় না, বাইরে তাকালে পৃথিবীটা একটা হারিয়ে যাওয়া পরিবার মনে হয়?” এলেনা সরাসরি জবাব না দিয়ে বলেছিলেন, “আমরা এখানে এসেছি জানার জন্য, অনুভবের জন্য নয়। তুমি যদি বেশি ভাবো, টিকে থাকতে পারবে না।” কথাটা তীব্র ঠেকেছিল, কিন্তু অরুনিমা জানত, ওর নিজের ভিতরেই অন্য এক কণ্ঠ আছে—যে অনুভব করে, ভাবে, স্বপ্ন দেখে। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে সে চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করে ঈরার গলার আওয়াজ—“আজ আমার স্কুলে একটা নতুন কবিতা পড়লাম, নাম ‘তারা-মায়ের ঘর’। জানো মা, ওরা বলেছে মা মানে যে সবসময় পাশে থাকে… তুমিও পাশে থাকবে তো?” তার মনে হয়, এই প্রশ্ন চাঁদের নিঃশব্দ দেয়ালে গুঞ্জন তোলে—কোন মা সবসময় পাশে থাকতে পারে? কোন গৃহিণী সবসময় ঘরে থাকে?
এরপর আসে এক মুহূর্ত, যেটা অরুনিমার জীবনের সব অভিজ্ঞতার থেকেও বেশি কাঁপিয়ে দেয়। এক রাতে চাঁদের বুকে একা দাঁড়িয়ে ছিল সে। আকাশ ছিল নিঃসাড়, নিঃশব্দ, স্থির। হঠাৎ মনে হল, চারদিকে এত নির্জনতা, এত শূন্যতা—এ যেন এক কালো গহ্বর যেখানে কেউ নেই, কিচ্ছু নেই। তার মনে হতে থাকে, সে হয়তো ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে, তার অস্তিত্ব ঘোলাটে হয়ে উঠছে, সে একজন বিজ্ঞানী বা মা নয়—সে শুধু একটা দাগ, একটা ছায়া, একটা মৌন প্রতিধ্বনি। সেই মুহূর্তে, অবচেতনে, সে নিজের হাতটা বুকের কাছে নিয়ে বলে ওঠে—“আমি আছি। আমি এখানে আছি। আমি নিজেই আমার গৃহ।” সেই শব্দ যেন প্রতিধ্বনিত হয় নিজস্ব অন্তরালে। সেদিন সে অনুভব করল, পৃথিবীর চার দেওয়ালের বাইরে থেকেও মানুষ নিজের ভিতরে এক বসবাসের জায়গা তৈরি করতে পারে—যেটা ঘরের থেকেও গভীর, যেটা শুধু ভালোবাসা বা দায়িত্ব নয়—আত্মার সহচরতা। সেই রাতে অরুনিমা চুপচাপ তার ডায়েরিতে লেখে:
“আজ বুঝলাম, গৃহিণী মানে শুধু ঘরের দায়িত্ব নয়, গৃহিণী সে-ই, যে নিজের আত্মার ঘর বানায়—যে ছাদহীন, প্রাচীরহীন, কিন্তু যেখান থেকে ফিরে আসে আলো। আমি এখন সেই ঘরে আছি।”
–
দুই সপ্তাহ হয়ে গেছে চাঁদের বুকে পা রেখেছে অরুনিমা। সময় এখন যেন একটা গলিত তরল—ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে ঠিকই, কিন্তু অনুভবের দিনরাত্রি গলছে নিজের ছন্দে। সে যেমন করে ক্যালসিয়াম স্যাম্পল জমাচ্ছে, তেমন করেই জমছে তার ভিতরের শূন্যতার স্তর। সবই নিয়মমাফিক চলছে, কিন্তু মনে হচ্ছে কিছু একটা অনুপস্থিত—কোনো টান, কোনো হাওয়া, কোনো পৃথিবী। এমনই এক ক্লান্ত সন্ধ্যায়, যখন শরীরটা ভারী আর মনটা ঠান্ডা প্লাস্টিকের মতো, ঠিক তখনই এল সেই চিঠি। একটা ছোট্ট ভিডিও বার্তা, পৃথিবী থেকে প্রায় আড়াই লাখ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে আসা এক নির্ভুল তথ্যের রূপ—তবু তার গায়ে ছিল মাটির গন্ধ, মেয়ের হাতের উষ্ণতা, স্বামীর চিন্তিত ভ্রু। স্ক্রিন অন করতেই দেখা গেল ঈরার মুখ—হাসি হাসি, চুল এলোমেলো, চোখ দুটো চকচক করছে। “হাই মা! আমি আজ স্কুলে বলেছি তুমি এখন মহাকাশের রান্নাঘরে আছো। সবাই হেসেছে, কিন্তু আমার ভালো লেগেছে। আমি তোমার জন্য একটা ঘর এঁকেছি, জানো? ভিতরে চাঁদ, বাইরেটা নীল। এটা তোমার ঘর মা, দূরের ঘর।” অরুনিমা কিছু বলতে পারছিল না, স্ক্রিনে শুধু নিজের চোখের জল দেখতে পাচ্ছিল। ঈরা তখন বলছিল, “তুমি ফিরলে আমি তোমায় নিজের বানানো তারা দিয়ে ঘর সাজিয়ে দেবো, ঠিক আছে?”
তারপর এল অনির্বাণের বার্তা। ভরাট গলা, কিন্তু কোথাও একটা দমচাপা আবেগ। “অরু, আমি জানি তুমি আমাদের মিস করছো। আমরাও তোমাকে করি। ঈরা তোমার পিলো ধরে ঘুমোয়—সে বলে ওটা নাকি মায়ের গন্ধ রাখে। আজ আমি স্কুলে ক্লাস নেওয়ার সময় হঠাৎ এক ছাত্রী প্রশ্ন করল, ‘আপনার স্ত্রী কি সত্যিই চাঁদে?’ আমি হেসে বললাম, ‘হ্যাঁ, আর সেখান থেকেই সে আমাদের জন্য আলোর বার্তা পাঠাবে।’ জানো, তোমাকে ভুলতে পারি না, শুধু অভ্যেস করে ফেলেছি তোমার অনুপস্থিতিকে। জানি তুমি সেখানে গিয়েছো শুধু নিজের জন্য না—আমাদের জন্যও। আমি তোমায় বোঝাতে পারিনি আগেই, কিন্তু আজ জানি—তুমি যা করছো, সেটা ভালোবাসার এক নতুন ব্যাখ্যা।” অরুনিমা ফোন বন্ধ করে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল চাঁদের মাটির দিকে। কাচের বাইরে ছিল এক বিশাল শূন্যতা, কিন্তু তার মনে হচ্ছিল যেন সেই শূন্যতাই আজ ভালোবাসায় পূর্ণ। চিঠির পৃথিবী এখন শুধু তার স্মৃতিতে নয়—তার স্পন্দনে, নিঃশ্বাসে, চোখের পলকে।
সেই রাতে সে আর ডায়েরি লিখল না, বরং চুপচাপ বসে থাকল জানালার পাশে। পৃথিবীকে আজ আর দূরের গ্রহ মনে হচ্ছিল না, বরং একটা চলমান ঘর—যেখান থেকে আলো এসে তার বুক ছুঁয়ে যায়। সে বুঝল, দূরত্ব ভালোবাসার মানচিত্রে পথ আটকাতে পারে না। একজন গৃহিণী হয়তো ঘরের মেঝেতে হাঁটে, রান্নাঘরের কড়াই নেড়ে দেয়, কিন্তু সে যদি দূর মহাকাশেও থাকে, তবুও তার অনুভবগুলো ঠিক পৌঁছে যায় প্রিয়জনের কাছে। সেই রাতে প্রথমবার অরুনিমার মনে হল, “আমিও ঈরার কাছে পৌঁছতে পারি, প্রতিদিন।” সে মনের মধ্যে একটা ছোট ঘর বানাল—তাতে তারা ঝুলল, একটা জানালা বানাল যেখানে পৃথিবী দেখা যায়, আর পাশে রাখল একটা ছোট্ট বালিশ, ঈরার জন্য। সে জানে না কবে ফিরবে, জানে না ফিরলে এই সম্পর্কগুলো কেমন থাকবে, তবু আজ তার মনে হয়—তার চিঠিও পৌঁছাবে ওদের কাছে। সে লিখে:
“প্রিয় ঈরা,
তোমার আঁকা ঘর আমি চোখে রেখেছি। আমি এখন যেখানে থাকি, সেখানে ঘরের বাইরে অনেক তারা, আর ভিতরে তোমার কথা। আমি সবসময় তোমার পাশে আছি—চাঁদের জানালার ধারে।
ভালোবাসা,
মা।”
–
চাঁদের চতুর্থ সপ্তাহে রাত যেন আরও দীর্ঘ হয়ে উঠল, অন্ধকার যেন আর নিছক অন্ধকার থাকল না—তা এক অতল আহ্বান, এক অন্তর্জাগতিক একাকিত্ব। অরুনিমা কাজ শেষ করে ডেটা আপলোড করতে গিয়ে লক্ষ্য করল, তার হাত কাঁপছে। কোনো যন্ত্রের গোলমাল নয়, এটা নিজের শরীরের প্রতিক্রিয়া। অভ্যন্তরীণ। তার মাথায় তখন একটা প্রশ্ন ঘুরছিল—“আমি এখন কোথায় আছি?” না, চাঁদের কোন অংশে বা কোন গ্রিডে তা সে জানে—তবে মানসিকভাবে, অনুভবের জায়গায় সে কোথায়? তার ভিতরটা যেন সরে যাচ্ছে ক্রমাগত, ঠিক যেমন বাতাসবিহীন এই জগতে সবকিছু ভাসে, কিন্তু কোনও কেন্দ্রে বাঁধা থাকে না। রাতে, সহ-অভিযাত্রীদের নিঃশব্দ ঘুমের মাঝে, অরুনিমা উঠে জানালার ধারে দাঁড়াল। পৃথিবী তখনও সেই ক্ষীণ নীল বিন্দু, অথচ আজ তা যেন তার চেনা নয়। পৃথিবীকে দেখলেই এখন একধরনের অপরিচিতি বোধ হয়—যেন কোনো সময় সে সেই গ্রহে ছিল, কিন্তু আজ আর সেখানে তার কোনও ঘর নেই। রান্নাঘরের তাক, মশলার কৌটো, ঈরার খেলনা—সব মনে পড়ে, কিন্তু মনে হয় সেগুলো শুধু স্মৃতি নয়, হারিয়ে যাওয়া কিছু, যেগুলোতে এখন সে শুধু দর্শক।
দিন যত এগোয়, অরুনিমার এই অনুভব তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। সে বুঝতে পারে, শুধু চিঠি পেলেই বা কী হয়—যখন মন থেকে সম্পর্কের উষ্ণতা জেগে না ওঠে? চিঠির পৃথিবী যেন হঠাৎ ফিকে হয়ে গেছে। কাজের সময়গুলোতে সে ঠিকঠাক আছে, কিন্তু ফাঁকা মুহূর্তগুলো—যেখানে কথা থাকার কথা ছিল, স্পর্শ থাকার কথা ছিল, সেখানে শুধু নীরবতা জমে। একদিন ল্যাবে বসে থাকতে থাকতে সে ফিসফিস করে বলে, “আমি কি এখন আর কারও কিছু নই?” সহকর্মীরা সেটা শোনে না, কিন্তু নিজের কানে তার উচ্চারণ তীব্রভাবে ধাক্কা দেয়। অরুনিমা ভাবে, একজন নারী যখন ঘর ছাড়ে, সমাজ তাকে সাহসী বলে—কিন্তু তার ভিতরের ভাঙন, তার নিঃশব্দ আত্মত্যাগ—সেগুলো কেউ দেখে না। চাঁদে তার কোনো দরজা নেই, দেয়াল নেই, বালিশ নেই—এমনকী এমন কেউ নেই, যার সামনে সে চুপ করে বসে থাকতে পারে। পৃথিবীতে অন্তত এক কাপ চায়ের পাশে কেউ ছিল যে বুঝত তার বিষণ্ণতা। এখন সে শুধুই ভেসে আছে এক বহির্বিশ্বের ভেতর, ঠিক যেমন অনিকেত, গৃহহীন কেউ। “আমি কি গৃহহীন হয়ে যাচ্ছি?”—এই প্রশ্নটা তাকে গ্রাস করতে থাকে। শুধু শারীরিক নয়, মানসিকও। সে এক ভাসমান সত্তা, যার কোনো ঠিকানা নেই—শুধু মাটি ছোঁয়া ছায়া আছে, নিজের অস্তিত্বের হালকা রেখা।
সে রাত ছিল ভয়ংকর। অরুনিমা ঠিকমতো ঘুমোতে পারেনি। বারবার একটা স্বপ্ন দেখতে লাগল—সে এক বিশাল ঘরে একা দাঁড়িয়ে, চারদিক কুয়াশায় ঢাকা, আর দূরে ঈরার গলা শোনা যাচ্ছে—“মা, তুমি কোথায়?” সে ছুটে যেতে চাইছে, কিন্তু কোনো দরজা নেই, কোনো পথ নেই। ঘুম ভেঙে গেলে, তার মুখে ঘাম, চোখে জল। সে নিজের হাতে জল ছিটিয়ে নেয়, তারপর ডায়েরি খুলে লিখতে শুরু করে—“আজ আমি বুঝলাম, গৃহ কেবল বসবাসের স্থান নয়। এটা এক নিরাপত্তা, এক নিজের অস্তিত্বের স্বীকৃতি। আমি হয়তো পৃথিবী থেকে চলে এসেছি, কিন্তু আমি নিজেকেও ফেলে এসেছি। আমি এখন শুধু গৃহত্যাগী নই, আমি গৃহহীন।” লেখার সময় তার হাত কাঁপছিল না, বরং এক অদ্ভুত স্থিরতা তাকে ঘিরে ছিল। সে জানত, এই স্বীকারোক্তিই তাকে রক্ষা করবে। সে জানত, এই অনুভবই ভবিষ্যতের আলো। গৃহহীনতা মানেই একধরনের শূন্যতা, কিন্তু সেই শূন্যতাকে বুঝে নিতে পারলে, তাতেই তৈরি হয় আত্মার আস্তানা। অরুনিমা চাঁদের কাঁচঘেরা জানালায় তাকিয়ে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে বলল, “আমি এখনও হারাইনি। আমি খুঁজে নিচ্ছি সেই ঘর, যেটা আমার ভিতরেই আছে।”
–
সেই রাতে চাঁদের আকাশে অদ্ভুত কিছু ছিল। অরুনিমা জানত, বৈজ্ঞানিক ভাষায় এর নাম “Ion Storm Distortion”—যেখানে সৌরঝড়ের কারণে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ঢেউ ব্যাহত হয়। কিন্তু ভাষার নাম যতই থাকুক, বাস্তবে তার রূপ ভয়ংকর। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হল পৃথিবীর সঙ্গে। কন্ট্রোল রুমের স্ক্রিনগুলো ঝাপসা হয়ে গেল, ডেটা পাঠানো বন্ধ, ভিডিও লিঙ্ক ব্ল্যাক। কেবল আলো জ্বলছিল ল্যাবের করিডরে—দপদপ, দপদপ করে। সহ-অভিযাত্রীদের মুখে চাপা উদ্বেগ, কেউ কেউ নিজের কাজে ব্যস্ত থাকতে চাইল, কিন্তু অরুনিমা বসে রইল একা, জানালার ধারে। পৃথিবীকে খুঁজে পেল না। যে নীল বিন্দুটি এতদিন ধরে চোখে রেখেছিল, আজ তা অদৃশ্য। মনে হচ্ছিল—বাড়ি নেই, ঘর নেই, কেউই নেই। পুরো ব্রহ্মাণ্ড যেন এক অন্ধ পর্দা টেনে দিয়েছে। অরুনিমার মনে হচ্ছিল কেউ যেন তার গলা চেপে ধরেছে, কেউ নয়—সম্ভবত ভয়। ভয় যে সে সত্যিই বিচ্ছিন্ন, সত্যিই গৃহহীন। এই প্রথম বার বুঝল, চোখের সামনে পৃথিবী না থাকলে, মনও ধীরে ধীরে তার অস্তিত্ব ভুলে যেতে চায়। চোখে জল এল না, কাঁদতেও পারল না, শুধু একটা ভাবনা গেঁথে রইল মাথায়—“যদি এখনই পৃথিবী আর ফিরেও না আসে, আমি তবে কে? আমি কার?”
সময় এগোচ্ছিল খুব ধীরে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেরিয়ে গেল, এখনও কোনো সিগনাল নেই। সহ-অভিযাত্রীদের মধ্যে কেউ কেউ প্রোটোকল ফলো করছিল—ব্যাকআপ প্ল্যান, স্টোরড অক্সিজেন চেক, ম্যানুয়াল সংযোগ পরীক্ষা। এলেনা বসু স্থির, শান্ত, যেন কিছুই হয়নি। তিনি শুধু বললেন, “আমাদের অভ্যন্তরীণ পাথরে স্থিতি বজায় রাখতে হবে।” কিন্তু অরুনিমার মনে হচ্ছিল সে যেন কোনও অন্ধকার সুরঙ্গের ভিতর আটকে আছে। ঈরার মুখ বারবার মনে পড়ছিল—যে বলত, “তুমি কি আজ আবার তারা দেখবে?” হ্যাঁ, সে আজ আবার তারা দেখছে, কিন্তু আজ তারা কাঁদছে না—আজ তারা শূন্য। তার মনে পড়ল ঈরার জন্মদিনে সে লুকিয়ে কেক বানিয়েছিল, সেই সন্ধ্যায় অনির্বাণ তার চুলে হাত বুলিয়ে বলেছিল—“তুমি ঘরের আলো।” আজ সে আলো কোথায়? তার চারপাশে শুধু কাঁচ, ধাতব যন্ত্রপাতি, স্ক্রিনের নীরবতা, আর হৃদয়ের একটা চাপা গুঞ্জন—“তুমি কি শেষ হয়ে যাচ্ছ?” এই প্রশ্নটা আসলে মৃত্যুর নয়, অস্তিত্বের। যখন চারপাশের সব পরিচয়, সম্পর্ক, ভাষা হারিয়ে যায়, তখন মানুষ কেবল একটা কিছু খুঁজে বেড়ায়—যা তাকে বাঁচিয়ে রাখে। অরুনিমার সেই মুহূর্তে মনে হল—একমাত্র ভেতরের আলোই তাকে রক্ষা করতে পারে। পৃথিবীর আলো চলে গেছে, কিন্তু তার ভিতরের আলো কি এখনও জ্বলছে?
রাত গভীর হল। চারপাশে নিঃশব্দের ভার যেন আরও ঘন হয়ে এল। অরুনিমা একসময় উঠে দাঁড়াল, ধীরে ধীরে তার ঘরের দেয়ালে রাখা আয়নার দিকে তাকাল। আয়নায় নিজের মুখ স্পষ্ট নয়—কোনো অচেনা নারী, চোখে ক্লান্তি, ঠোঁটে প্রশ্ন, কপালে নিঃশব্দ বিস্ময়। সে ফিসফিস করে বলল, “তুমি কে?” আয়না উত্তর দিল না, দেয়ও না। তখন অরুনিমা চোখ বন্ধ করে হাত রাখল নিজের বুকের উপর, শুনল নিজের শ্বাস—তাড়াতাড়ি নয়, ধীরে, কিন্তু জীবিত। সে অনুভব করল, পৃথিবী যত দূরে থাকুক না কেন, তার ভিতরে একটা পৃথিবী রয়ে গেছে। একটা ঘর, যেখানে ঈরার হাসি আছে, অনির্বাণের চোখে জল আছে, নিজের রান্না করা দুধের গন্ধ আছে। সেই ঘর সে বানিয়েছে অনেকদিন ধরে—স্মৃতি দিয়ে, ব্যথা দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে। সে আস্তে করে ডায়েরির পৃষ্ঠা খুলে লিখল:
“আজ পৃথিবী অন্ধকারে, কিন্তু আমার ভিতরে একটা আলো জ্বলছে। আমি গৃহহীন নই—আমি নিজের ভিতরেই গৃহ বানিয়ে নিয়েছি। আমি জানি না কবে পৃথিবী আবার কথা বলবে, কিন্তু আমি জানি, আমি এখনো আছি। আমি এখনো মা, আমি এখনো প্রেমিকা, আমি এখনো আমি।”
লিখে সে জানালার দিকে তাকাল। হঠাৎ চোখে পড়ল একটা ঝলক—এক ক্ষীণ রেখা—নীল, আলতো। পৃথিবী ফিরছে। অরুনিমা নিঃশ্বাস ছাড়ল, কিন্তু জানত, সেই আলো আসার আগেই সে নিজেকে ফিরে পেয়েছে। সে নিজেই এখন নিজের গৃহ। আর তার আলো নিভে যাবে না, যতদিন সে ভালোবাসতে জানে।
–
ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ঝড় কেটে যাওয়ার পর চাঁদের গবেষণাকেন্দ্রে যেন আবার ছন্দ ফিরে এল। পৃথিবীর সাথে সংযোগ স্থাপিত হল, ডেটা আপলোড আবার শুরু, স্ক্রিনে ফিরে এল পরিচিত কণ্ঠ আর মুখ। কিন্তু সেই রাতে, যখন সবাই কাজে ব্যস্ত, ঘুম বা বিশ্রামে ডুবে, তখন অরুনিমা একা ছিল খাবার টেবিলের এক কোণে, ঠাণ্ডা কফির কাপ নিয়ে বসে। তার চোখে তখন ক্লান্তি নয়, বরং একধরনের প্রশান্তি—যা আসে ভয়ের শেষ প্রান্ত থেকে ফিরে এলে। হঠাৎ পিছন থেকে এলেনা বসু এসে চুপচাপ বসে পড়লেন তার পাশে। এলেনা কখনো এভাবে কারো সঙ্গে বসেন না। তিনি অভ্যস্ত এক কঠোর শৃঙ্খলায়, নিজের ভিতরেই যেন এক কাচের ঘরে থাকেন—কারও নাগাল পায় না। কিন্তু আজ, সেই আগুনরঙা ধাতব মহিলা চুপচাপ কফির কাপ হাতে নিয়ে বললেন, “তুমি জানো, আমি এই নিয়ে তৃতীয়বার চাঁদে এসেছি। কিন্তু কোনওবারই এতটা ভেতরে কাঁপিনি, যতটা এবার।” অরুনিমা চমকে উঠল না, শুধু তাকিয়ে রইল তাঁর মুখের দিকে। এলেনা আবার বললেন, “এখানে আসার পর সবকিছু বদলে যায়। মানুষের ভেতরের আলো-আঁধারি, যা পৃথিবীতে চাপা থাকে, এখানে এসে যেন কাঁচের মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে।” তার গলায় ক্লান্তি ছিল, এবং এক অদ্ভুত মানবিক কম্পন—যেটা অরুনিমা আগে শুনেনি।
সেই প্রথম, এলেনা নিজের কথা বলতে শুরু করলেন। বললেন, “আমার যখন আট বছর বয়স, তখন আমি মা-কে হারাই। তারপর থেকে আমার পরিবার বলতে বিজ্ঞান। পুরুষতান্ত্রিক মহাশক্তির মধ্যে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রমাণ করতে গিয়ে আমি ভেবেছিলাম—আমি কেবল একজন যন্ত্র, যার আবেগ নেই, মন নেই। আমি যে নারী, সেটা ভুলে যেতে চেয়েছিলাম। মনে করতাম, অনুভব করলে দুর্বল হয়ে পড়ব।” একটু থেমে তিনি অরুনিমার চোখে চোখ রেখে বললেন, “কিন্তু তুমি এখানে এসে… যেন আমাকে ভুল প্রমাণ করলে।” অরুনিমা কিছু বলছিল না, তবু তার দৃষ্টি একদম স্থির ছিল। এলেনা বললেন, “তুমি কাঁদো, তুমি চিঠি লেখো, তুমি মেয়ে আর স্বামীকে মনে করো—তবু তুমি সবচেয়ে স্থিতিশীল। সবচেয়ে সংবেদনশীল হয়ে তুমি সবচেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠো। আমি এটা জানতাম না, যে ‘নারী’ পরিচয়টা আসলে এক দুর্বলতা নয়—এটা এক গভীর শক্তির আধার।” তখন অরুনিমা আস্তে করে বলল, “আমি নারী বলেই তো বিজ্ঞানী হতে পেরেছি। কারণ সৃষ্টি আমার ভিতরে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেয়। আমি কেবল একটি ব্যাকটেরিয়ার গঠন জানি না—আমি জানি অনুভূতির ভেতর দিয়ে বেঁচে থাকা কাকে বলে। আমি জানি, কীভাবে একটা ছোট মেয়েকে না দেখে, তবুও তাকে প্রতিদিন ভালোবাসতে হয়।” এই কথাগুলো বাতাসে ভাসে না, চাঁদের ভারহীন মাধ্যাকর্ষণে সোজা গেঁথে যায় এলেনার মনে। তিনি প্রথমবার নিজের মুখে একরকম নরম হাসি আনলেন, বললেন, “তুমি হয়তো প্রথম ব্যক্তি, যার কাছে আমি নিজেকে স্বীকার করলাম।”
ঘরের চারদিকে তখন নিঃশব্দ, ঘড়ির টিকটিকিও থেমে গেছে যেন। অরুনিমা অনুভব করল, দুই নারীর দুটো জীবনধারা যেন ধীরে ধীরে মিলে যাচ্ছে এক জায়গায়। একজন ছিল যুক্তির গড়নে, আর একজন অনুভূতির ভিতর—তবু আজ দুজনেই এক আশ্রয়ে পৌঁছেছে—নিজের ভিতরের সত্যকে আলাদা করে চেনা। এলেনা বললেন, “তুমি জানো, আমরা মহাকাশে আসি পৃথিবী থেকে দূরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আসলে নিজের গভীরে পৌঁছাতে এসেছি।” এই কথায় অরুনিমার মুখে আলো জ্বলে উঠল। সে জানে, সে একা ছিল না—তার মতো আরও একজন ছিল, যিনি শুধু নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলেন। সেই রাতে তারা একসাথে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে রইল। পৃথিবী অনেক দূরে, কিন্তু তারা দুজন যেন নিজেকে কাছ থেকে দেখতে পেল। সেই দিন থেকে এলেনার মুখ একটু নরম হয়ে গেল, কণ্ঠস্বরও আর যান্ত্রিক নয়। অরুনিমা বুঝল, গৃহ শুধুমাত্র দেওয়াল ঘেরা কাঠামো নয়, গৃহ হতে পারে দুটি হৃদয়ের মধ্যেকার স্বীকৃতি। এবং সেই স্বীকৃতি যখন হয়—তখন এমনকি চাঁদের উপরেও এক বসত গড়ে ওঠে, নিঃশব্দে, আলোছায়ায়, এবং পরস্পরের নির্ভরতায়।
–
চাঁদের বুকে সময় যেন গলিত সোনার মতো—ধীরে, নীরবে গড়িয়ে পড়ে, কিন্তু যার প্রতিটি মুহূর্ত মর্মে দাগ কাটে। অরুনিমা একদিন সকালে, কৃত্রিম দিনালোকের মাঝে দাঁড়িয়ে দেখছিল একটি ক্ষুদ্র শিলা। তার পৃষ্ঠে ছিল সূক্ষ্ম ফাটল, ঠিক যেন বহু বছর ধরে রোদ-ঝড়-মহাজাগতিক কণার আঘাতে গড়া এক অজানা জীবনের ছাপ। সে তার গ্লাভস-পরা আঙুলে স্পর্শ করল পাথরটিকে—কেমন অচেনা, অথচ ভীষণ আপন মনে হল। এ যেন পৃথিবীর বাইরে একটি নতুন ইতিহাস। তার মনে হচ্ছিল, এই গবেষণাগারে যে সে কণাগুলি জমাচ্ছে, তা কেবল বিজ্ঞান নয়, তার আত্মার অনুবর্তী সংস্করণ—যার প্রতিটি টুকরো গঠিত হয়েছে নিজের ত্যাগ, অনুভব আর দূরত্বের যন্ত্রণায়। আর আজ, এতদিন পর অরুনিমা বুঝল—সে ফিরে যেতে চাইছে ঠিকই, কিন্তু শুধু পৃথিবীতে নয়, নিজের গড়ে তোলা ঘরে। একটা ঘর, যা কেবল একটি বাড়ির ঠিকানা নয়—বরং এমন এক আশ্রয়, যেখানে তার স্বপ্ন, ব্যথা, ভালোবাসা আর সৃষ্টির আনন্দ মিশে আছে। সে জানত না সেই ঘর ঈরার আঁকা নীল-সাদা কাগজের খাঁচা হবে, নাকি নিজের আত্মার ভেতরে তৈরি এক নীরব কক্ষ—কিন্তু সে বুঝে ফেলেছিল, তার ঘর আসলে সে নিজেই।
এলেনা তাকে একদিন দুপুরে বললেন, “মিশনের শেষ পর্যায়ে আমরা সবাই একটা রিপোর্ট লিখি—নিজেদের বিশ্লেষণ, যন্ত্রপাতির কার্যকারিতা, আবিষ্কারের তালিকা। কিন্তু আমি চাই, তুমি তোমার অংশে কেবল তথ্য নয়, তোমার অনুভবও লেখো।” অরুনিমা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আপনার মনে হয়, ওরা সেটা বুঝবে?” এলেনা হেসে বললেন, “তারা না বুঝলেও, তোমার ঘর তো সেটা বুঝবে।” এই কথাটা গভীরভাবে গেঁথে গেল তার মনে। সেই রাতে অরুনিমা নিজের ল্যাপটপে বসে লিখল:
“এই চাঁদের বুকে দাঁড়িয়ে আমি প্রথমবার বুঝেছি, আমি কী খুঁজছিলাম। আমি গবেষক হিসেবে এলেও, আসলে খুঁজছিলাম আমার নিজস্ব ঘর—একটি ঘর, যা বাড়ি নয়, কিন্তু আশ্রয়। এই যাত্রা আমাকে শিখিয়েছে—নিজেকে ভালোবাসতে হয়, যেমনভাবে একজন মা তার মেয়েকে, একজন সঙ্গিনী তার প্রিয় মানুষকে ভালোবাসে। আমি আর কাউকে প্রমাণ দিতে আসিনি। আমি এসেছি নিজের ভিতরে আলো জ্বালাতে। আর আজ সেই আলো জ্বলছে। আমি নিজের ঘর খুঁজে পেয়েছি, নিজের অস্তিত্বকে জড়িয়ে ধরে।” এই লেখার প্রতিটি শব্দ যেন চাঁদের বুকে একেকটা পদচিহ্ন হয়ে পড়ছিল—অতল শূন্যতার ভিতরে একজন নারীর আত্মঘোষণা।
মিশনের শেষ দিন। বিদায়ের প্রস্তুতি চলছে। প্রত্যেকেই ব্যাগ গোছাচ্ছে, নমুনা বক্সে তালা দিচ্ছে, প্রযুক্তির শেষবারের মতো চেক চলছে। অরুনিমা একবার জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। পৃথিবী আজ অনেক উজ্জ্বল, অনেক কাছের মনে হয়। কিন্তু এবার সেই নীল গ্রহ তার কাছে কেবল এক ফেরা নয়—এক নতুন জন্ম। সে জানে, সে ফিরবে এক নতুন মানুষ হয়ে, এক গৃহিণী হয়ে—যে শুধুই রান্না বা সন্তানপালন করে না, বরং নিজের ঘর বয়ে নিয়ে চলে হৃদয়ের গভীরে। ঈরার আঁকা সেই ঘর, অনির্বাণের না বলা কথার ভাষা, আর চাঁদের বুকে কাটানো প্রতিটি নিঃশব্দ রাত—এসব নিয়েই সে ফিরবে। সে মনে মনে বলে, “আমি ফিরছি, কিন্তু পালিয়ে নয়। আমি ফিরছি নিজের সত্য নিয়ে, নিজের ঘর নিয়ে।” তারপর ধীরে ধীরে ল্যান্ডারের দিকে হাঁটতে থাকে সে, যেন তার পায়ের নিচের চাঁদ-ধূলোর প্রতিটি দানা সাক্ষী—এক নারীর নিজের গৃহে ফিরে আসার গল্পের।
–
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢোকার সময় যখন ল্যান্ডারের বাইরের আবরণে আগুন জ্বলে উঠছিল, তখন অরুনিমার মনে হচ্ছিল, এই আগুন যেন এক ধরণের অগ্নিপরীক্ষা। সেই আগুন শুধু যন্ত্রকে পুড়িয়ে ছাঁকছিল না, যেন তাকে, তার অস্তিত্বকে নতুন করে নির্মাণ করছিল। তাপপ্রবাহের শব্দের মাঝেও সে শুনতে পাচ্ছিল ঈরার সেই পুরোনো কথাটা—“তুমি ফিরলে আমি তোমায় নিজের বানানো তারা দিয়ে ঘর সাজিয়ে দেবো।” শব্দের ভেতরেই সে অনুভব করছিল ঘরের গন্ধ, পরিচিত বারান্দা, জানালার পর্দা, বালিশের কোমলতা। আর সেই সবকিছুর গভীরে ছিল এক আলোর রেখা, যার নাম ভালোবাসা। অবতরণ সফল হলে যখন হ্যাচ খোলা হল, তখন ধূলি, সূর্যালোক আর মানুষের কণ্ঠস্বর মিলেমিশে অরুনিমার চোখ ঝলসে দিল। সেই আলো ছিল সত্যিকারের—উষ্ণ, পরিচিত, মাটির গন্ধমাখা। সে প্রথমবার দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিল—অক্সিজেনের নয়, বরং নিজের পৃথিবীতে ফেরার শ্বাস। ফিরে আসার অনুভূতিটা ঠিক কান্না নয়, উল্লাসও নয়—একটা গভীর প্রশান্তি, যা শব্দে বলা যায় না, শুধু বুক দিয়ে টের পাওয়া যায়।
বিমানবন্দর থেকে বেরোতেই মানুষের ভিড়, ক্যামেরা, সংবাদমাধ্যমের ঝলকানি। কিন্তু অরুনিমার চোখ খুঁজছিল অন্য কিছু। ভিড়ের ভেতর ঈরার মুখটা যখন ফুটে উঠল, সময় থেমে গেল যেন। সে ছোটাছুটি করে মা’র দিকে ছুটে এল, দু’হাত বাড়িয়ে চিৎকার করে বলল, “তুমি এসেছো! আমার ঘরের তারা ফিরেছে!” অরুনিমা হাঁটু গেড়ে বসল, মেয়েকে বুকে টেনে নিল—তিন বছর নয়, যেন তিন জন্ম পরে এই ছোঁয়া। ঈরার ছোট্ট হাতে আঁকা ছিল একটি কাগজের ঘর—নীল ছাদ, হলুদ জানালা, আর উপরে পাঁচটি লাল তারা। অনির্বাণ পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল, চোখে জল। সে কিছু বলল না, শুধু ধরা গলায় বলল, “চলো, তোমার ঘর তোমার অপেক্ষায় আছে।” গাড়িতে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে অরুনিমা দেখছিল—সবকিছুই যেমন ছিল, তেমনি আছে, কিন্তু তার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে। এই শহরের রাস্তা, বাড়ির দেয়াল, রিকশার ঘন্টি, মুদির দোকানের ঝাঁপ—সবকিছুর মধ্যেই সে দেখতে পাচ্ছিল এক একেকটা ঘরের স্পন্দন। পৃথিবী এখন তার কাছে শুধু বসবাস নয়, এক গভীর বন্ধন।
রাতের বেলা অরুনিমা নিজের ঘরে ঢুকে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। বিছানার পাশের টেবিলে এখনো তার পুরোনো ডায়েরি, ঈরার বানানো কাগজের পাখি, আর অনির্বাণের রেখে যাওয়া চায়ের কাপ। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ—এবার আর নীল বিন্দু নয়, আকাশে সেই পুরোনো চাঁদ। কিন্তু সেই চাঁদের দিকে তাকিয়ে সে আজ আর বিচ্ছিন্নতা অনুভব করল না। সে জানে, সেখানে কিছু রেখে এসেছে সে—নিজের শূন্যতা, নিজের খালি হয়ে যাওয়ার দিনগুলো। আর ফিরে পেয়েছে এক নতুন নিজস্বতা। ঈরা এসে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল, “মা, ঘরে কেমন লাগছে?” অরুনিমা নিচু গলায় বলল, “তুই তো আছিস, আমি তো ঘরেই আছি।” সে চোখ বন্ধ করে অনুভব করল—এই ঘর কেবল চার দেওয়ালের নয়, এটি এক আত্মিক আশ্রয়—যেখানে মানুষ ভালোবাসা দিয়ে, ব্যথা দিয়ে, দূরত্ব পেরিয়ে, আলোর রেখা টেনে ঘর বানায়। সে এখন জানে, সে কেবল একজন বিজ্ঞানী নয়, কেবল একজন মা নয়, সে একজন গৃহিণী—যে তার নিজের গৃহ নিজেই বানিয়েছে, তারার আলোর ভিতর দিয়ে।
——-