অর্পিতা দাশগুপ্ত
অধ্যায় ১: ইশারার প্রথম পাঠ
নবনীতা মুখার্জি যখন প্রথম “পূর্ব আনন্দনিকেতন বিশেষ বিদ্যালয়”-এর ধুলোমাখা ফটকে পা রাখেন, তখন আকাশে কুয়াশা জমেছিলো যেমন, তেমনি তাঁর মনের ভিতরেও ছিল অনিশ্চয়তার এক অদৃশ্য কুয়াশা। শহরের একপ্রান্তে ঝাঁপসা হয়ে থাকা এই স্কুলটিকে অধিকাংশ মানুষ ‘বাতিল জায়গা’ বলে এড়িয়ে যায়। গেটের ধারে একটা মরচে পড়া সাইনবোর্ড—যেখানে অর্ধেক লেখা খসে গেছে, তবু বোঝা যায়: এটি বাকপ্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য নির্মিত একটি বিদ্যালয়। স্কুল চত্বরের ভাঙা পাঁচিল, পুরোনো আমগাছের নিচে জমে থাকা শুকনো পাতা, আর একটি কাঠের বেঞ্চে বসে থাকা কেয়ারটেকার রফিক মিঞা—এই ছিল নবনীতার নতুন কর্মস্থল। সদ্য বিএড পাশ করা নবনীতা এই স্কুলে স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষিকার দায়িত্ব নিয়েছেন—কোনো বেতন নেই, কোনো সম্মানও নয়; শুধু একটা অদ্ভুত টান তাঁকে এখানে টেনেছে। নিজের ছোটবেলার এক খেলার সাথী—সোহিনী—যে জন্ম থেকেই বাকপ্রতিবন্ধী, তার সঙ্গে ইশারার ভাষায় কথা বলার চেষ্টা থেকেই নবনীতার এই পথচলা। তিনি বিশ্বাস করেন, প্রতিটি শব্দহীন শিশুর ভিতরেও আছে শব্দের মতোই উজ্জ্বল এক কণ্ঠ—শুধু তাকে বোঝার সাহস দরকার।
ক্লাসরুমে ঢুকতেই চারজন শিশু হকচকিয়ে তাকালো তাঁর দিকে। একজনের চোখ কোটরের ভিতর ঢুকে আছে, অন্যজন গালে গাল দিয়ে তাকিয়ে আছে জানালার দিকে, বাকিরা অন্যমনস্ক। কেউ শব্দ করে না, কেউ কথা বলার চেষ্টা করে না, শুধু তাদের চোখদুটো অনবরত হাঁটছে—প্রশ্ন নিয়ে, অবিশ্বাস নিয়ে। নবনীতা ধীরে ধীরে বোর্ডের কাছে গিয়ে একটা চক হাতে নিলেন এবং লিখলেন—”আমার নাম নবনীতা। তোমাদের বন্ধু হতে এসেছি।” তারপরে খুব ধীরে হাতের ইশারায় বোঝাতে শুরু করলেন নিজের নামের অক্ষরগুলো। বাচ্চারা একে একে তাকাল, হঠাৎ একটি মেয়ে—ছোট্ট শরীর, বাম চোখে একটি সাদা দাগ, মাথায় রক্তিম ক্লিপ—সামনে এগিয়ে এসে নবনীতার মতো করে ইশারাটা নকল করল। নবনীতা অবাক হয়ে তাকালেন তার দিকে, মেয়েটি একটু লাজুকভাবে হাসল। ঠিক সেই মুহূর্তে নবনীতার মনে হল—একটা বন্ধ দরজা যেন খানিকটা খুলে গেল। সেই দিনের ক্লাসে আর কেউ মুখ খোলেনি, কিন্তু এক অদৃশ্য সেতু তৈরি হয়ে গেছে, যে সেতু দিয়ে একদিন শব্দহীন হৃদয়েরা পৌঁছাবে নতুন অনুভবের কাছে।
বাড়ি ফেরার পথে নবনীতার মাথায় ঘুরতে থাকে হাজারো কথা। পাড়ার অনেকে তাঁকে দেখে টিটকিরি মারে—“ভালো কলেজে পড়েও এসব পাগলামি করছো?” কেউ বলে, “এই স্কুলের বাচ্চাদের কি মানুষ করা যায়?” কিন্তু তিনি জানেন, সমাজের চোখে এই বাচ্চারা হয়তো ‘অযোগ্য’, কিন্তু তিনি তাঁদের চোখে নিজের মতো দেখেন—সংবেদনশীল, প্রশ্নভরা, সাহসী। তাঁর বাবা, অবসরপ্রাপ্ত ডাক বিভাগের কর্মী বিশ্বজিৎ মুখার্জি, একদিন টেবিল চাপড়ে বলেছিলেন—“ভবিষ্যৎ নষ্ট করছিস, কেউ কদর দেবে না তোকে!” অথচ নবনীতা জানতেন, কদরের দরকার নেই, দরকার বোঝাপড়ার। সন্ধ্যায় নিজের ঘরে বসে সে চুপচাপ ইশারার ভাষার বইটা খুলে দেখে—‘বন্ধু’ শব্দটা কীভাবে ইশারায় বলা হয়। তারপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেই নিজেকে শেখায়, যেমন আজ শেখাতে চেয়েছিল চারজন চুপচাপ শিশুকে। বাইরে তখন হালকা বৃষ্টি শুরু হয়েছে, জানালার কাঁচে শব্দ পড়ছে ধীরে ধীরে। আর ঘরের ভিতরে জন্ম নিচ্ছে এক নতুন শিক্ষার প্রান্তর—যেখানে ভাষা নেই, তবু অনুভূতি আছে। নবনীতার মনে হয়, হয়তো সে সঠিক পথেই হাঁটছে—একটি এমন পথে, যেটা এখনও আঁকা হয়নি কোনো শব্দে, শুধু ইশারার প্রথম পাঠে।
অধ্যায় ২: অন্বেষার আঁকা কথা
পরের সপ্তাহে নবনীতা যখন ক্লাসে ঢুকলেন, তিনি লক্ষ্য করলেন সেই ছোট মেয়েটি—যার চোখে ছিল সাদা দাগ, মাথায় লাল ক্লিপ—দেয়ালের এক কোণে বসে কী যেন আঁকছে। মাটি থেকে উঠে আসা রোদের ফালি তার মুখের পাশে এক নিঃশব্দ দীপ্তি ছড়িয়ে দিয়েছে। নবনীতা কাছে গিয়ে নিচু হয়ে বসতেই দেখতে পেলেন—একটা কাগজে মেয়েটি এঁকেছে একটি গাছ, যার ডালে-ডালে চুপ করে বসে আছে রঙিন পাখি, আর নিচে বসে আছে একজন মেয়ের ছবি, যার চোখে চকচকে গোল ফ্রেমের চশমা। আঁকায় লেখা নেই, তবু সেখানে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে—এই ছবির মেয়েটি নবনীতা নিজে। নবনীতা ধীরে ধীরে তার দিকে তাকিয়ে একটি মৃদু ইশারা করলেন—“তোমার নাম কী?” মেয়ে মাথা নিচু করল, তারপর হাতে একটা শব্দ লিখে দেখাল—‘অন্বেষা’। সেই প্রথম নবনীতা জানলেন এই মেয়ের নাম, যার চোখ কথা বলে, কিন্তু মুখ নয়। নবনীতা অবাক হয়ে খেয়াল করলেন, অন্বেষার প্রতিটি আঁকায় এক আশ্চর্য অনুভব আছে—যেন সে শব্দের বদলে ক্যানভাস ব্যবহার করে তার ভাষা প্রকাশ করতে শিখেছে।
সেই দিন থেকেই অন্বেষা নবনীতার নীরব ছায়া হয়ে উঠল। অন্যরা যখন বর্ণমালা শেখে ইশারায়, তখন অন্বেষা নানা চিত্র এঁকে বোঝায় তার ভাবনা। একদিন সে একটি ছবি আঁকে—তাতে দেখা যায়, একজন শিক্ষক একটি কালো বোর্ডে কিছু লিখছেন, আর ছাত্রছাত্রীরা হাত তুলে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। ছবির কোণে একটি হাত ইশারায় বলছে—“ধন্যবাদ।” নবনীতা বুঝলেন, অন্বেষা কেবল শেখে না, সে অন্যদেরও শেখানোর ক্ষমতা রাখে। কিন্তু এই প্রতিভা কি শুধু চার দেয়ালের মধ্যে আটকে থাকবে? শহরের কোনো স্কুল কি নেবে অন্বেষাকে? এইসব প্রশ্ন তাকে চিন্তায় ফেলে দিল। অন্বেষার মা—শিউলি ঘোষ—একজন গার্মেন্টস কারখানার শ্রমিক, প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা কাজ করে বাড়ি ফেরেন, আর মেয়েকে একা ফেলে যান এই বিশেষ স্কুলে। নবনীতা যখন একদিন দেখা করতে গেলেন তাঁর সঙ্গে, শিউলি সোজাসুজি বললেন, “আপনারা যা পড়ান, তা দিয়ে কি ওর কোনো ভবিষ্যৎ হবে? কেউ কি ওকে চাকরি দেবে?” নবনীতা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, তারপর বললেন, “ভবিষ্যৎ হয়তো আজ নয়, কিন্তু ওর প্রতিভা একদিন নিজের জায়গা তৈরি করবে।”
পরদিন সকালে নবনীতা অন্বেষার আঁকা ছবি নিয়ে যান শহরের শিশু বিকাশ কেন্দ্রে। সেখানকার কর্মকর্তা প্রথমে ছবিগুলোর প্রতি উদাসীন ছিলেন, কিন্তু একটি ছবিতে যখন তিনি দেখেন—একটি হাত খোলা জানালার পাশে বসে আছে, আকাশে উড়ে যাচ্ছে একটি কাগজের উড়ন্ত পাখি, আর নিচে ছোট্ট হাতের লেখায় লেখা—“আমি মুক্ত”—তখন তাঁর চোখ থেমে যায়। তিনি বিস্মিত হয়ে বলেন, “এটা কে এঁকেছে?” নবনীতা তখন বললেন, “একজন বাকপ্রতিবন্ধী শিশু—যার ভাষা নেই, কিন্তু তার চোখে আছে পৃথিবী দেখার এক নতুন চশমা।” সেদিনই তাঁকে জানানো হয়—জাতীয় শিশু শিল্প প্রতিযোগিতার জন্য নির্বাচনের আবেদন খোলা আছে, এবং এমন চিত্রকর্মের জন্য বিশেষ বিভাগে আবেদন করা যাবে। নবনীতা উত্তেজিত হয়ে অন্বেষার নামে ফর্ম পূরণ করে ফেলেন। কিন্তু নতুন দ্বিধা এসে দাঁড়ায়—অন্বেষার মা কী বলবেন? সমাজ, প্রতিবেশী—তারা কি তা মেনে নেবে? অন্বেষার ছবি কি শুধু নিঃশব্দ ভালোবাসা হয়ে থেকে যাবে, নাকি তা একদিন হয়ে উঠবে মুখরিত স্বীকৃতি? নবনীতার বুকের ভিতর তখন কেবল একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খায়—”এই নীরবতা ভাঙবে কবে?”
অধ্যায় ৩: অবহেলার দেয়াল
সপ্তাহ ঘুরতেই এক অস্বস্তিকর সকাল হাজির হল। স্কুল চত্বরের বাইরে জড়ো হল কয়েকজন স্থানীয় মানুষ, তাদের মধ্যে ছিলেন পাড়ার স্বঘোষিত সমাজসেবী শ্রীমতী চ্যাটার্জি, যিনি নবনীতাকে বরাবরই তুচ্ছ মনে করতেন। তিনি সরাসরি বললেন, “এই স্কুলটা শুধু জায়গা নষ্ট করছে। এখানে কে আসে? তিন-চারটা প্রতিবন্ধী বাচ্চা নিয়ে নাটক চলছে।” সঙ্গে আরও কিছু অভিভাবক, যারা নিজের সন্তানের প্রতিবন্ধকতা অস্বীকার করে, বললেন—“এসব স্কুল বন্ধ হলে আমাদের সন্তানও ‘ভিন্ন’ তকমা পাবে না।” এমন তীব্র প্রতিবাদে নবনীতা প্রথমবার কাঁপে ওঠেন, কিন্তু মুখ নিচু করেন না। তিনি বোঝেন, অবহেলার এই দেওয়াল বহুদিন ধরে গড়ে উঠেছে—একটা অস্পষ্ট ভয় থেকে, একটা অশিক্ষিত সংকোচ থেকে। স্কুলের ভিতর বসে অন্বেষা, রিন্টু, শুভ, পায়েল—সবাই চুপচাপ তাকিয়ে থাকে দরজার দিকে, যেন তারাও বুঝতে পারছে, এই বিদ্যালয়ের অস্তিত্ব নিয়ে টানাটানি চলছে।
দুপুরে ব্লকের এক আধিকারিক এলেন তদন্ত করতে। তাঁকে দেখে শ্রীমতী চ্যাটার্জি জোরে জোরে বললেন, “সরকারি জমি দখল করে একটা ‘অকার্যকর’ প্রতিষ্ঠান চলছে, এখানে কোনো সঠিক সিলেবাস নেই, কোনো ট্রেন্ড শিক্ষক নেই।” নবনীতা শান্ত গলায় সব কথা শোনেন, তারপর একটা ছোট খাতা বের করেন, যেখানে তিনি সমস্ত পাঠ পরিকল্পনা হাতে লিখে রেখেছেন। তিনি বলেন, “এই স্কুলে আসা বাচ্চারা কথা বলতে পারে না, কিন্তু তাদের অনুভব আছে। আমি তাদের ভাষা দিয়েছি—ইশারার ভাষা, দৃশ্যের ভাষা, ভালোবাসার ভাষা।” তিনি অন্বেষার আঁকা একটা ছবি বের করেন—যেখানে একটি মেয়ে অন্ধকার ঘরে বসে, তার সামনে আলোর রেখায় লেখা আছে: “তোমরা তো শুনতে পাও, আমি দেখাতে চাই।” আধিকারিক কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন, তারপর ফাইল বন্ধ করে বলেন, “স্কুল আপাতত বন্ধ হচ্ছে না, বরং এর জন্য বিশেষ প্রতিবেদন তৈরি করতে হবে।” সেই মুহূর্তে শ্রীমতী চ্যাটার্জির মুখ থেমে যায়, আর নবনীতার পাশে এসে দাঁড়ান কেয়ারটেকার রফিক মিঞা, যিনি এক হাতে জামার পকেট থেকে গামছা বের করে চোখ মুছতে থাকেন।
পরদিন নবনীতা স্কুলে এসে দেখেন, কিছু অচেনা লোক স্কুলের সামনে মাটি খুঁড়ছে—জানতে পারেন, ওরা নতুন পানির সংযোগের কাজ করছে। পাশে দাঁড়িয়ে আছেন পাড়ার কয়েকজন তরুণ, যারা আগে কখনো স্কুলে আসেনি। তারা বলল, “দিদি, আপনার স্কুলটা আমাদের গর্ব—আমরা শুনেছি অন্বেষা দিল্লিতে যাচ্ছে?” নবনীতা অবাক হয়ে গেলেন, কারণ তিনি তো এখনও কাউকে বলেননি কিছু! পরে জানলেন, অর্ণব সাহা—যিনি গত সপ্তাহে স্কুলে এসেছিলেন রিপোর্ট করতে—তার পত্রিকায় একটা সম্পূর্ণ ফিচার ছাপা হয়েছে: “নিঃশব্দ পাঠশালা—যেখানে চোখই ভাষা।” সেই প্রতিবেদন ছড়িয়ে পড়েছে আশপাশের এলাকায়। অথচ, এই পুরো কাহিনির ভিতরেও নবনীতার মনের গভীরে রয়ে গেছে একটি ভাবনা—এত কিছুর পরেও কি সত্যিই সমাজ এই শিশুদের মর্যাদা দিতে শিখেছে? নাকি এটি সাময়িক বাহবা, যা অন্বেষার সাফল্যের উষ্ণতায় গলে যাচ্ছে? তিনি জানেন, অবহেলার দেওয়াল ভাঙতে শুধু সংবাদ নয়, চাই অনড় প্রতিজ্ঞা। আর সেই প্রতিজ্ঞাই তিনি করেছেন—নীরবতার কণ্ঠস্বর হয়ে উঠবেন, যতদিন না সমাজ নিজেই কথা শোনার ক্ষমতা অর্জন করে।
অধ্যায় ৪: সাংবাদিক ও শব্দহীনতা
নবনীতার স্কুলে প্রথম এসেছিলেন অর্ণব সাহা একজন কৌতূহলী সাংবাদিক হিসেবে—তাঁর সম্পাদক তাঁকে পাঠিয়েছিলেন ‘একটা মানবিক গল্প’ কভার করতে। শহরের প্রান্তে একটা বাকপ্রতিবন্ধী শিশুদের স্কুল—কাগজে পড়ে যে কাহিনির কোনো বাজার নেই, অর্ণব সেটাকেই গুরুত্ব না দিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন ক্যামেরা আর নোটবুক হাতে। কিন্তু স্কুলে পা রাখার পর তাঁর ভাবনাই বদলে গেল। প্রথমে অবাক হয়েছিলেন, যখন ক্লাসরুমে ঢুকে দেখেন চারটি শিশু একসাথে বোর্ডের দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে একটি ছন্দ শেখার চেষ্টা করছে—নবনীতা মুখে শব্দ না করেই তাঁদের বোঝাচ্ছেন শব্দ, বাক্য, ভাবনা। চারপাশে ছিল না কোনো কোলাহল, তবুও সেখানে চলছিল অসীম প্রাণচাঞ্চল্যের পাঠ। অর্ণব অনুভব করেন, এই নিঃশব্দতাই সবচেয়ে গর্জনময়। সেদিন ক্লাস শেষে তিনি নবনীতার সঙ্গে কথা বলেন—তাঁর উদ্দেশ্য জানতে চান, কোথা থেকে এত অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। নবনীতা হেসে শুধু বলেন, “এই শিশুরা শব্দহীন, কিন্তু তাদের মনের শব্দ শুনলে আপনি চুপ হয়ে যাবেন।”
অর্ণবের ভিতরে কী যেন ভাঙতে শুরু করে সেদিন থেকে। তাঁর নিজের ছোটবেলার এক স্মৃতি মনে পড়ে—তাঁর কাকা ছিলেন বধির, যাঁকে পরিবারে একঘরে করে রাখা হতো। কেউ কিছু বোঝাতে চাইত না, বরং চুপ থাকতে শেখাত। অর্ণব নিজের অক্ষমতাকে তখন বুঝতে পারেননি, কিন্তু এখন নবনীতার স্কুলে এসে যেন কানের ভেতরে সেই পুরনো অপরাধবোধ আবার শব্দ তুলল। তিনি ঠিক করলেন, এই স্কুলের গল্প কেবল কয়েকটি বাকপ্রতিবন্ধী শিশুর নয়, বরং এই সমাজের শ্রবণক্ষম কিন্তু ‘বুঝতে অক্ষম’ মানুষদেরও আয়না। কাগজে ফিরে গিয়ে তিনি একটি অসাধারণ ফিচার লেখেন—“নিঃশব্দ পাঠশালা: যেখানে চোখই ভাষা”—যেখানে তিনি বর্ণনা করেন কীভাবে অন্বেষার ছবি ভাষার মতো কথা বলে, কীভাবে নবনীতা শব্দ ছাড়া বাচ্চাদের শেখাতে শিখেছেন ভালোবাসার ভাষা। লেখার শেষে তিনি একটি প্রশ্ন রেখে দেন: “আমরা কি আসলেই শ্রবণক্ষম? নাকি শুধু শুনতে পারি, বুঝতে পারি না?”
প্রতিবেদন ছাপা হতেই সাড়া পড়ে যায় শহর জুড়ে। অনেকে ফোন করে জানতে চায়, “এই মেয়েটি অন্বেষা—ওকে কি দেখা যাবে?” অনেকে নবনীতাকে অনুরোধ করে ছবি পাঠাতে, কেউ কেউ অনুদান পাঠানোর ইচ্ছাও প্রকাশ করে। এমনকি এক শিল্প সংগঠন নবনীতার স্কুলে এসে অন্বেষার আঁকা চিত্রকর্ম প্রদর্শনের আগ্রহ জানায়। কিন্তু এই উন্মাদনার মধ্যেও নবনীতা শান্ত। তিনি জানেন, সংবাদ পত্রিকায় এলেই সব বদলে যায় না। বরং তিনি চায়, এই শিশুদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাক—সহানুভূতির জায়গা থেকে সমমর্যাদার জায়গায়। অন্যদিকে, অর্ণব বারবার ফিরে আসেন স্কুলে—প্রথমে আরও তথ্য জোগাড়ের জন্য, পরে এক অদ্ভুত আত্মিক টান থেকে। তিনি লক্ষ্য করেন, নবনীতার চোখে যে প্রতিজ্ঞা আছে, তা কোনো ক্যামেরা ধরতে পারে না। আর সেই মুহূর্তে, একটি বিকেলের ক্লাস শেষে, যখন অন্বেষা এসে তাঁর হাতে একটি ছোট কাগজ ধরিয়ে দেয়—যেখানে শুধু একটা ছোট পাখির ছবি আর নিচে আঁকা হাতের ইশারায় লেখা “বন্ধু”—তখন অর্ণব বুঝে যান, শব্দহীনতাই তাঁকে জীবনের সবচেয়ে অর্থপূর্ণ ভাষা শিখিয়ে দিচ্ছে।
অধ্যায় ৫: জাতীয় দৃষ্টিপথে অন্বেষা
নবনীতা যেদিন অন্বেষার জাতীয় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করলেন, সেদিন স্কুলের ক্লাসরুম যেন আরও আলোকিত লাগছিল। কাঁচের জানালা দিয়ে ঢুকে পড়া রোদ ঝিলমিল করছিল অন্বেষার হাতে আঁকা ছবির উপর, যেটা সে টেবিলে বিছিয়ে শেষ তুলির আঁচড় টানছিল। ছবিটিতে দেখা যাচ্ছিল—একটা বড় মঞ্চ, যেখানে একটি বাকপ্রতিবন্ধী শিশু দাঁড়িয়ে হাতের ইশারায় কিছু বোঝাচ্ছে আর সামনে বসা মানুষজন তাকে উঠে দাঁড়িয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছে। নবনীতা বুঝতে পারেন, অন্বেষা তার স্বপ্নটাকে ছবির মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছে। তিনি ওকে নিয়ে শহরের সাংস্কৃতিক ভবনে গেলেন, যেখানে প্রতিযোগিতার আগে বাছাই পর্ব চলছিল। চারপাশে নামকরা স্কুলের শিশু শিল্পী, সঙ্গে তাদের পরিপাটি পোশাক পরা অভিভাবক। আর তাদের পাশে অন্বেষা—একটা সাদামাটা ফ্রক পরা, চোখে ভরসাহীন কিন্তু ভিতরে টগবগে শক্তি। বিচারকদের সামনে অন্বেষা প্রথমে থমকে যায়, কিন্তু নবনীতার এক চোখের ইশারা পেয়ে সে তার ছবি তুলে ধরে এবং হাতের মুদ্রায় বোঝাতে থাকে প্রতিটি চিত্রের ভাব। বিচারকেরা একে একে বিস্মিত হয়ে পড়েন—এই মেয়েটি যেন শুধু ছবি আঁকেনি, সে এক ভাষাহীন অনুভূতির অভিধান রচনা করেছে।
বিচারকদের একজন হালকা গলায় বলেন, “এই মেয়েটি তো আমাদের শোনাতে চাইছে—কিন্তু কোনো শব্দ ব্যবহার না করেই। চমৎকার।” সেই মুহূর্তটা ছিল নবনীতার জীবনের অন্যতম গর্বের সময়। তিনি জানতেন অন্বেষা পারবে, কিন্তু এইভাবে পারবে—তা তিনি কল্পনাও করেননি। সপ্তাহখানেক পর, ডাক এল—অন্বেষা নির্বাচিত হয়েছে জাতীয় শিশু শিল্প পুরস্কারের জন্য, দিল্লির বিজ্ঞান ভবনে হবে পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান। সংবাদমাধ্যমে আবার ছাপা হল: “শব্দহীন চোখের ভাষা ছুঁয়ে গেল দেশকে”—সঙ্গে অন্বেষার ছবি, নবনীতার কথা। শহরের রাস্তায় পোস্টার পড়ল, স্থানীয় বিধায়ক ফোন করে জানালেন, “আমরা অন্বেষার পাশে আছি, আপনার স্কুলের উন্নয়নে সহযোগিতা করব।” এমনকি শ্রীমতী চ্যাটার্জিও মুখে একটু হাসি এনে বললেন, “মেয়েটা তো বুঝিয়ে দিল—ভাষা না থাকলেও জয় সম্ভব।” কিন্তু এরই মাঝে, এক অদ্ভুত দ্বিধা তৈরি হয় অন্বেষার মায়ের মনে। শিউলি ঘোষ চিন্তিত হয়ে নবনীতাকে বলেন, “দিল্লি! এত বড় জায়গায় আমার মেয়ে যাবে? না যদি কিছুর উত্তর না দিতে পারে, না যদি বোঝে মানুষ কী বলছে?” নবনীতা তাঁর হাত ধরে বলেন, “আপনার মেয়ে শুধু বুঝে না, অন্যদের বোঝাতে জানে। আপনি কি ওর ডানা কাটবেন, যখন ও উড়তে চাইছে?”
দিল্লি যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকরা এগিয়ে আসে, অন্বেষার ফ্রেমে বাঁধানো ছবি তৈরি হয়, স্কুল থেকে কয়েকটি প্রয়োজনীয় বই ও অ্যালবাম দেওয়া হয় তাকে উপহার হিসেবে। অন্বেষা বুঝতে পারে না, চারপাশে এত আলো কেন, এত লোক কেন তার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু সে বুঝতে পারে নবনীতা পাশে রয়েছেন, এবং তাঁর এক চোখের চাউনি মানেই—”তুমি পারবে।” স্কুলের বাকি বাচ্চারা অন্বেষাকে একে একে আঁকা ছোট কার্ড দেয়—কারও কার্ডে সূর্য, কারও কার্ডে নদী, কেউ আঁকে একটি হাত, যার ভিতরে লেখা—“অন্বেষা আমাদের আশা।” সেই দিন সন্ধ্যায়, এক নিঃশব্দ ঘরে, মোমবাতির আলোয় অন্বেষা একটি নতুন ছবি আঁকে—তাতে একটি বড় মঞ্চ, তার সামনে দাঁড়িয়ে সে নিজে, হাতে ধরা এক পতাকা, আর পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন একজন শিক্ষিকা—যার চোখে শুধু গর্ব, আর ভাষাহীন ভালোবাসা। সেই ছবিটিই ছিল অন্বেষার চুপচাপ বিদায়—তার মাটির স্কুল থেকে জাতীয় দৃষ্টিপথে ওঠার গল্পের মৌন প্রতীক।
অধ্যায় ৬: শেষ চিঠি, প্রথম ভাষা
দিল্লির অনুষ্ঠানস্থলে চারদিক আলোয় মোড়ানো, সভার ভিতর বিশিষ্টজনেরা, মঞ্চের উপরে রাষ্ট্রপতি, আর সামনের সারিতে বসে আছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা শিশু শিল্পীরা। তাদের মধ্যে অন্বেষা—একটি হালকা নীল পাঞ্জাবি ও সাদা পায়জামা পরে বসে আছে, পাশে নবনীতা। অন্বেষা চারপাশের এত শব্দ, আলো, ক্যামেরা দেখে কিছুটা গুটিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু নবনীতার ডানহাতটি ওর হাতে থাকতেই, যেন সে নিজের ভিতরে নতুন সাহস খুঁজে পেল। অনুষ্ঠান শুরু হয়, একে একে নাম ডাকা হচ্ছে, শিশুদের হাততালির মাঝে মঞ্চে ডাকা হচ্ছে তাদের কাজের স্বীকৃতিতে। হঠাৎ ঘোষিত হয়—“বিশেষ ভাষাহীন শিল্প বিভাগে, আসামের ‘নিঃশব্দ পাঠশালা’র ছাত্রী অন্বেষা ঘোষ।” মঞ্চে ওঠার আগে অন্বেষা নবনীতার চোখের দিকে তাকায়। কোনো শব্দ নেই, তবুও সেই চোখদুটি যেন বলে—“আমি পারব তো?” নবনীতা মৃদু মাথা নাড়েন—সেই ইশারাটি বহুবারের অভ্যাস, কিন্তু আজ তার অর্থ আরও গভীর।
অন্বেষা ধীরে ধীরে উঠে মঞ্চে যায়, হাতে তার আঁকা একটি ছবি—যেটি অনুষ্ঠান আয়োজকদের অনুরোধে সে উপস্থাপন করছে। ছবিটিতে দেখা যায়, একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি সরু সেতুর উপর, সামনে বিস্তৃত আকাশ, আর পেছনে রয়েছে স্কুল ভবনের রূপরেখা। ছবির এক কোণে ইশারার চিহ্নে লেখা রয়েছে—”আমি শব্দ ছাড়া বলেছি যা তোমরা শুনেছো।” রাষ্ট্রপতি নিজ হাতে পুরস্কার তুলে দেন, একটু ঝুঁকে অন্বেষার কানে কিছু বলেন। অন্বেষা বুঝতে পারে না, কিন্তু তার মুখে হালকা এক হাসি ফোটে, কারণ সে উপলব্ধি করে—সম্মান শব্দে নয়, চোখে প্রকাশ পায়। মঞ্চ থেকে নেমে সে নবনীতার কোলে এসে পড়ে, কেউ কিছু বলে না, কিন্তু চারপাশের জনতা দাঁড়িয়ে তালি দেয়। অনুষ্ঠানের শেষে একজন সাংবাদিক অন্বেষার কাছে জানতে চান—“তুমি কী ভাবো?” অন্বেষা তখন একটা কাগজ বের করে দেয়, তাতে একটি ছোট পাখি আর পাশে আঁকা দুটি চোখ—একটিতে অশ্রু, অন্যটিতে সূর্য। পাশে লেখা ছিল, “আমার চোখের ভাষা আপনাদের কণ্ঠের চেয়ে প্রখর।”
দিল্লি থেকে ফেরার ট্রেনে নবনীতা জানালার পাশে বসে, অন্বেষা তার কোল ঘেঁষে ঘুমোচ্ছে। ট্রেনের জানালায় শহর পালাচ্ছে, আলো আসছে, যাচ্ছে। নবনীতা তার ব্যাগ থেকে একটি চিঠির খাম বের করেন, যা দিল্লির মঞ্চে পুরস্কারের সঙ্গে তাঁকে হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল—রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে একটি ব্যক্তিগত স্বীকৃতি। খামে লেখা ছিল—“নবনীতা মুখার্জি, যিনি নিঃশব্দতাকে ভাষা দিয়েছেন।” তিনি ধীরে ধীরে চিঠিটি পড়েন, রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরিত কয়েকটি পংক্তি—“শিক্ষা তখনই পরিপূর্ণ হয়, যখন তা সীমাবদ্ধতার গণ্ডি পেরিয়ে হৃদয়ের ভাষা হয়ে দাঁড়ায়। আপনি সেই ভাষার দূত।” চোখে জল আসে নবনীতার, কাঁপা হাতে চিঠিটা ভাঁজ করেন, তারপর অন্বেষার আঁকা ছোট পাখির ছবিটা তার চিঠির ভিতর ঢুকিয়ে রাখেন। কারণ তাঁর কাছে এটাই আসল সম্মান—যা কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির থেকেও বেশি। সেই রাতে, ঘুমন্ত ট্রেনের গম্ভীর ছন্দে, নবনীতার মনে হয়—এই নিঃশব্দ যাত্রা হয়তো এক চিঠির মতো, যা কোনও শব্দ ছাড়াই পৌঁছে যায় ঠিকঠাক প্রাপকের কাছে। আজ, সেই চিঠির ভাঁজ খুলে গেছে, আর তাতে লেখা রয়েছে—ভাষা শুধু মুখে নয়, ভালোবাসার প্রতিটি ইশারায়।
অধ্যায় ৭: মুখ খুললো সমাজ
- অন্বেষা ও নবনীতা দিল্লি থেকে ফেরার পর দিনটি যেন এক উৎসবময় সকালে পরিণত হয়েছিল। পূর্ব আনন্দনিকেতনের সেই চিরচেনা চত্বর, যার দেয়ালে আগে ধুলো আর অবহেলা জমে থাকত, এখন ফুলের মালা আর রঙিন ফেস্টুনে মোড়া। পাড়ার মানুষ, যারা আগে বলত, “এই স্কুলে কিছু হয় না”, তারাই এখন বলছে, “আমাদের পাড়ার গর্ব অন্বেষা।” শিশুদের হাতে ছোট ছোট পতাকা, আর স্কুলের গেটে ঝুলছে নতুন রঙে লেখা ব্যানার—“স্বাগত অন্বেষা ও নবনীতা মিস।” সেই পুরনো পাঁচিল পেরিয়ে যখন নবনীতা স্কুলে ঢুকলেন, চারদিকের মুখগুলো তার দিকে তাকিয়ে একসাথে হাততালি দিল। কেউ কেউ এগিয়ে এসে জলখাবারের প্যাকেট দিল, কেউ নতুন বেঞ্চ দেওয়ার প্রস্তাব দিল। সবচেয়ে অবাক করা ঘটনা ঘটল, যখন শ্রীমতী চ্যাটার্জি—যিনি একসময় স্কুল বন্ধের জন্য থানায় পর্যন্ত গিয়েছিলেন—তিনি এগিয়ে এসে নবনীতার পায়ে হাত দিলেন। তিনি বললেন, “মাফ করবেন দিদি, আমরা বুঝিনি—আপনি কী সৃষ্টি করছেন।”
সেই মুহূর্তে নবনীতার মনে হল, দীর্ঘদিনের এক গ্লানি যেন চোখে জল হয়ে ঝরে পড়ছে। তিনি মাথা নিচু করে বললেন, “আমি কিছুই করিনি, শুধু দেখেছি ওদের মতো করে—ভালোবাসার চোখে।” সাংবাদিক অর্ণব সাহাও উপস্থিত ছিলেন সেদিন, ক্যামেরার লেন্সের আড়ালে তাঁর চোখ বারবার নবনীতার দিকে আটকে যাচ্ছিল। তিনি তার নতুন রিপোর্টে লেখেন—“সমাজ তখনই বদলায়, যখন একটি চোখ সাহস করে অন্ধ সমাজের দিকে তাকিয়ে বলে—‘দেখো আমাদের মতো করে।’” অন্বেষা এখন কেবল একটি মেয়ে নয়, একটি প্রতীক হয়ে উঠেছে—সমস্ত বাকপ্রতিবন্ধী শিশুদের নিরব লড়াইয়ের মুখ। শুধু তাই নয়, সরকারের তরফে ঘোষণা আসে—“নবনীতা নিঃশব্দ পাঠশালা”-কে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া হবে, এবং তার পরিকাঠামো উন্নয়নে বিশেষ অনুদান বরাদ্দ করা হবে।
এদিকে, নবনীতার বাড়িতে প্রথমবার তাঁর বাবা বিশ্বজিৎ মুখার্জি একটি খবরে উচ্ছ্বসিত হন। হাতে ধরে মেয়ের নাম লেখা সংবাদপত্রটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বারবার পড়েন। তারপর পাশের চায়ের দোকানে গিয়ে গর্ব করে বলেন, “আমার মেয়ে নবনীতা—শিক্ষিকা, জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত অন্বেষার শিক্ষক।” এই কথা শুনে দোকানদার বলে, “বাহ! চিনি তো! উনি আমাদের পাড়ার ‘সাইলেন্ট সুপারহিরো’।” সেই মুহূর্তে নবনীতা বুঝলেন—সবচেয়ে জোরালো শব্দ হলো সম্মানের, কিন্তু তা অর্জন হয় নিঃশব্দ লড়াইয়ের মাধ্যমে। সেই দিন স্কুল শেষে, রফিক মিঞা তাঁকে একটা ছোট থলে দিলেন—ভিতরে নতুন চক, রংপেন্সিল, আর নিজের হাতে আঁকা এক লাইন: “ভাষা না থাকলেও তুমি শিক্ষকতা করেছো হৃদয়ের পাঠ দিয়ে।” নবনীতা সেই বাক্যটি পড়লেন, চোখের কোণে জল জমে উঠল, আর মন বলে উঠল—এই সমাজ অবশেষে মুখ খুলেছে, কারণ কেউ একজন চুপ থেকেও কথা বলতে শিখিয়েছিলেন।
অধ্যায় ৮: নিঃশব্দ নয়, নীরব শক্তি
কয়েক মাস পর, পূর্ব আনন্দনিকেতনের সেই ভাঙাচোরা স্কুল ভবনের জায়গায় উঠে আসে নতুন রঙিন একটি দোতলা ভবন—চুনকাম করা দেয়ালে আঁকা আছে রঙিন পাখি, হাতের ইশারায় লেখা বাংলা বর্ণমালা, আর একপাশে বিশাল করে লেখা স্কুলের নতুন নাম—“নবনীতা নিঃশব্দ পাঠশালা”। এটি এখন কেবল একটি বিদ্যালয় নয়, এক সামাজিক বিপ্লবের প্রতীক। সরকার, এনজিও, স্থানীয় শিল্পী, সমাজকর্মী—সকলের সহযোগিতায় এটি হয়ে উঠেছে দেশের অন্যতম সেরা বাকপ্রতিবন্ধী শিশু শিক্ষাকেন্দ্র। শিক্ষকসংখ্যা বেড়েছে, প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে ইশারাভাষায়, প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে বসানো হয়েছে অডিওভিজুয়াল স্ক্রিন, আর শিক্ষার্থীদের চিত্রকলা, কবিতা ও অভিনয়ের জন্য আলাদা বিভাগ চালু হয়েছে। এই বদলের কেন্দ্রে রয়েছেন নবনীতা—যিনি সবকিছুর মাঝেও আগের মতোই সকালবেলা হাতে খাতা, চোখে চশমা পরে ক্লাসে ঢুকে পড়েন এবং ছাত্রছাত্রীদের দিকে তাকিয়ে ইশারায় বলেন, “আজ আমরা হৃদয় দিয়ে শিখব।”
অন্বেষা এখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী, কিন্তু তার প্রতিভা অনেকদূর এগিয়েছে—সে একটি বই লিখেছে, যার নাম “চোখের ভাষা”—যেখানে তার আঁকা ছবি আর ইশারাভাষায় লেখা অনুভূতির কোলাজ। বইটি দেশের নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়েছে, বিশেষ শিশুদের অভিব্যক্তির প্রশিক্ষণ উপকরণ হিসেবে। নবনীতা সেই বইয়ের ভূমিকা লিখেছেন, যার শেষ লাইন—“আমি কোনো দিন শব্দ শেখাইনি, আমি শুধু শিখিয়েছি ভাষা; যা চোখ, স্পর্শ, আর নির্ভরতায় তৈরি হয়।” স্কুলে প্রতি বছর একটি উৎসব হয় এখন—“নীরব উৎসব”, যেখানে গান হয় না, বক্তৃতা হয় না—শুধু চিত্র, অভিনয়, মূকাভিনয়, এবং অনুভূতির প্রদর্শনী। সেখানে অংশ নেয় দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা বাকপ্রতিবন্ধী শিশুরা, এবং তারা দেখে—তাদের দুঃখ আর অবহেলার গল্প কীভাবে জয় এবং গর্বে পরিণত হতে পারে।
অর্ণব সাহা এখন একটি ছোট চিত্রনির্মাণ প্রতিষ্ঠান খুলেছেন, এবং তাঁর প্রথম তথ্যচিত্র “নিঃশব্দের প্রতিধ্বনি”—যা নবনীতা ও তাঁর পাঠশালার উপর ভিত্তি করে নির্মিত, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছে। সেই ডকুমেন্টারির শেষ দৃশ্যে দেখা যায়—একটি কাঁচের জানালার ধারে দাঁড়িয়ে নবনীতা, পিছনের ক্লাসরুমে অন্বেষা শিশুদের শেখাচ্ছে, আর ক্যামেরার ভয়েসওভার বলে—“এই স্কুলে কেউ কথা বলে না, তবু এখানে প্রতিদিন জন্ম নেয় এক নতুন ভাষা—ভালোবাসার ভাষা।” নবনীতা বুঝতে পারেন, তাঁর জীবন কেবল শিক্ষকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না—তাঁর সংগ্রাম, তাঁর নীরবতা, তাঁর ছাত্রছাত্রীদের চোখ—সব মিলেই তৈরি হয়েছে এক বিশাল শক্তির স্তম্ভ, যার নাম নীরবতা। আর সে নীরবতা কখনও নিঃশব্দ নয়—তা সবচেয়ে সাহসী কণ্ঠস্বর, যা সমাজকে বদলে দেয় শব্দ ছাড়াই। এই গল্প হয়তো কোনো সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় আর নেই, কিন্তু হাজার হাজার শিশু ও অভিভাবকের হৃদয়ে লেখা হয়ে রয়েছে চিরস্থায়ী এক নাম—নবনীতা মুখার্জি।
***




