Bangla - ভূতের গল্প

নবান্নর আগের রাত

Spread the love

অর্ঘ্য দত্ত


আগমন

বিকেলের আলো তখনো জমে আছে গাছের পাতায়, যখন শুভম দাস ট্রেন থেকে নামল। ছোট্ট একটা স্টেশন—নাম ‘মাহেশচর’। আশেপাশে ঝিম ধরা সবুজ মাঠ, দূরে একটা নদীর রেখা দেখা যায়, আর ঝাঁক বেঁধে উড়ছে সাদা বক।

শুভম শহরের ছেলে, কলকাতার এক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক। পিএইচডির বিষয় লোকজ কৃষিপদ্ধতি তার সামাজিক প্রভাব, আর সেই সূত্রেই আজ এই প্রত্যন্ত জায়গায় তার পদার্পণ। এতটা ভিতরে ঢুকতে হবে, তা আগে আন্দাজ করেনি। স্থানীয় এক শিক্ষকের মাধ্যমে পরিচিত হয়েছে গ্রামের নাম—গোপীনাথপুর, আর সেই গ্রামের পাশেই একটি রহস্যময় ধানখেত, যেখানে প্রতি বছর নবান্নর আগের রাতে কেউ পা রাখে না।

স্টেশন থেকে বেরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেই একটা ভ্যানে চেপে বসে শুভম। ড্রাইভার, বছর পঁঞ্চাশের এক লোক, জিজ্ঞেস করল, “আপনি ওই শহরের মাস্টারমশাইর অতিথি?”

শুভম মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, হরেন্দ্র স্যারের বাড়ি যাব। গোপীনাথপুর।”

লোকটা একটু চুপ করে থেকে হেসে বলল, “নবান্নর আগের রাতের গল্প শুনেছেন বুঝি?”

শুভম অবাক, “তা শুনেছি… কিন্তু আপনি কি বিশ্বাস করেন এসব?”

লোকটা একটু ঘাড় কাত করে বলল, “বিশ্বাস না করলেও, ওই খেতে কেউ পা দেয় না। বাপ-ঠাকুর্দারাও দেয়নি।”

ভ্যানে চড়ে যেতে যেতে শুভম দেখে—পথের ধারে ঝোপে বেত, কাঁশফুল আর মাঝেমধ্যে পড়ে থাকা ধানগাছের গুঁড়ি। একটা অদ্ভুত নীরবতা যেন গাঁয়ের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।

গোপীনাথপুর গ্রামটা খুবই ছিমছাম। বাড়িগুলো মাটির, তবু কোথাও একটা শৃঙ্খলা আছে। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হরেন্দ্র স্যার খুপরি খুপরি করে বেরিয়ে এলেন বরণ করতে। “এসো, এসো শুভম। ভীষণ আনন্দ হল যে তুমি এলেই। আমি তোমার থাকার সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। একটাই অনুরোধ—তুমি যেহেতু গবেষণা করতে এসেছ, গ্রামের মানুষদের ভয় না দেখিয়ো। ওরা অনেক কিছুতেই অন্ধবিশ্বাস করে।”

শুভম একটু হেসে বলল, “স্যার, আমি যুক্তির লোক। ভয় দেখাতে আসিনি, বরং বুঝতে এসেছি—এই বিশ্বাসগুলো টিকে আছে কেন। আর সত্যিই যদি কোনো অলৌকিক কিছু থেকে থাকে, তার বাস্তবতা যাচাই করাই তো আমার কাজ।”

রাতের খাবার শেষে, ছাদে বসে দুইজনের আড্ডায় উঠে এল সেই ধানখেতের গল্প।

হরেন্দ্র স্যার বললেন, “যে খেতের কথা শুনছ, তার নাম বিন্নি খেত—গাঁয়ের সবচেয়ে উর্বর জমি। কিন্তু গত পঁচিশ বছর ধরে ওখানে কেউ নবান্নর আগের রাতে যায় না। কারণ, শোনা যায়, এক বিধবা মহিলা—কমলা—প্রতি বছর ঐ রাতে আসে ওর নিজের ধান কাটতে। বহু বছর আগে তার স্বামী ও একমাত্র ছেলে নদীতে ডুবে মারা যায়। তার পর কমলাও ক্যানালের জলে ঝাঁপ দিয়েছিল। কিন্তু দেহ আর মেলেনি।”

শুভম বলল, “অদ্ভুত কাকতাল। দেহ না পাওয়া গেলে মানুষের মনে কল্পনা তো জন্মাবেই।”

স্যার মাথা নেড়ে বললেন, “তা ঠিক। কিন্তু আশ্চর্য বিষয় কী জানো? যেদিন কেউ ভুল করে ঐ খেতে কাজ করেছে, পরদিন তার গায়ে একরকম পোড়া দাগ আর জ্বর ধরা পড়ে। একবার এক বহিরাগত মজুর কাজ করেছিল, সেই রাতে নাকি সে নিজের ঘরেই পুড়ে মারা যায়। পুলিশ এসেছিল, কিন্তু কিছুই প্রমাণ হয়নি।”

শুভমের চোখে একটা চমক জেগে উঠল। সে ঠিক করে ফেলল—এই বিন্নি খেত-এর রহস্যের কিনারা সে করবেই।

পরদিন সকালেই শুভম বেরিয়ে পড়ল। হাতে খাতা-কলম, মোবাইল, আর ডিএসএলআর। সে আগে গেল পাশের বাজারে, গ্রামের প্রবীণদের সঙ্গে কথা বলবে বলে।

চায়ের দোকানে বসে এক বৃদ্ধ বললেন, “ছেলেটা গবেষণা করতে এসেছে শুনি? ওই জমির কথা জেনে তো বটেই এসেছে!”

শুভম বলল, “হ্যাঁ দাদু, আমি যুক্তির দৃষ্টিতে ব্যাপারটা দেখতে চাই। আপনি ওখানে গিয়েছেন কখনো?”

বৃদ্ধ বললেন, “আমার বয়স এখন আশি। আমি দেখেছি, কমলা বউকে জ্যোৎস্নায় মাঠের ধারে বসে কাঁদতে। তখনও সে মরেনি। পরে শুনলাম, মরেও নাকি ফেরে। আমি চোখে দেখিনি, কিন্তু আমার ভাইয়ের ছেলে গেছিল একবার, সে আজও খোঁড়া। ভয় দেখাও না, কিন্তু সাবধান থেকো।”

বিকেলে শুভম নিজে গিয়ে বিন্নি খেত দেখতে চাইল। মাঠটা ধানগাছ ভর্তি, কিছুটা ঢালু হয়ে গিয়ে নদীর পাড়ে মিশেছে। একটা অদ্ভুত নির্জনতা সেখানে—পাখি নেই, কিচিরমিচির নেই, বাতাস নেই। যেন সময় থেমে আছে।

শুভম কাঁধে ক্যামেরা ঝুলিয়ে কয়েকটা ছবি তুলল। হঠাৎ, ঝোপের ভেতর থেকে যেন একটা মৃদু কণ্ঠ ভেসে এল—
“এই ধান আমার… আমার ধান…”

শুভম থমকে গেল। পেছনে ফিরে তাকাল—কেউ নেই।
কিন্তু তার ক্যামেরার ডিসপ্লেতে তখনো জ্বলজ্বল করছে এক ছায়া—
একটি সাদা শাড়ি পরা মহিলা, যার মুখ ঢাকা… আর সে দাঁড়িয়ে আছে ধানের মধ্যে।

ছায়ার ভিতর আলো

শুভম ক্যামেরার স্ক্রিনের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল। ঠোঁট শুকিয়ে আসছে, গলা দিয়ে একটা শব্দও বেরোতে চাইছিল না। স্ক্রিনে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে—সাদা শাড়ি পরা এক মহিলা, মুখ ঢাকা, পা খানিকটা মাটি থেকে উঁচু, যেন বাতাসে ভেসে আছে।

সে তাকালো সামনে—কিছুই নেই। খেত খালি। বাতাস স্থির। অথচ ক্যামেরায় সেই ছবি স্পষ্ট।

সে ফট করে স্ক্রিনটা অফ করে আবার অন করল। ছবিটা এখনো আছে। স্ক্রিন জুম করে চোখের দিকে যেতে চাইলে বুঝতে পারল—চোখ দুটো যেন আছে আবার নেই। এক অদ্ভুত ফাঁকা ঘোরের মতো, যেন তাকিয়ে থেকেও কিছুই দেখছে না।

শুভমের শরীরের লোম খাড়া হয়ে উঠল। এত বছর বিজ্ঞান, যুক্তি আর বিশ্লেষণের সঙ্গে কাটিয়ে দেওয়া এক মানুষের পক্ষে এই ছবি হজম করা সহজ নয়। সে মনে মনে বলল, “এটা কোনো আলোর প্রতিফলন… কিংবা আমার ক্যামেরার লেন্সে কোনো গন্ডগোল।”

তবে সত্যি বলতে, সে নিজেও জানত—এটা কোনো প্রযুক্তিগত ত্রুটি নয়। কিছু একটা ঘটছে, যা সে নিজে বিশ্বাস করতে চায় না।

ফিরে এসে সে সোজা হরেন্দ্র স্যারের কাছে গিয়ে বলল, “স্যার, আমি বিন্নি খেতে গিয়ে একটা ছবি তুলেছি। আপনি একটু দেখবেন?”

স্যার চশমা পরে হাতে নিলেন ক্যামেরাটা। ছবি দেখে তাঁর মুখ থমকে গেল। তিনি এক মুহূর্ত স্তব্ধ থেকে বললেন, “এই মহিলা… এ তো কমলা! মানে… অনেকটা তাঁর মতোই।”

শুভম বলল, “আপনি কীভাবে বলছেন ওটাই কমলা?”

স্যার ধীরে ধীরে বললেন, “আমি কমলাকে দেখিনি কখনো। কিন্তু আমার বাবা বলতেন, উনি সাদা শাড়ি পরতেন, মুখ সবসময় ঘোমটা ঢাকা। মাথায় একটা পেতলের খোপা বাঁধতেন। এই ছবি তার হুবহু বর্ণনা দেয়।”

শুভম একটু চিন্তিত গলায় বলল, “স্যার, এটা কি কোনো সাজানো নাটক হতে পারে? কেউ যদি ইচ্ছাকৃত এই ছবি তোলার মুহূর্তে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে… হয়তো গ্রামবাসীদের ভয় দেখিয়ে রাখার জন্য?”

স্যার বললেন, “তা হতে পারে, কিন্তু এই ধরনের নিঃশব্দ উপস্থিতি, এমনভাবে ক্যামেরায় ধরা পড়া… এতদিনেও কেউ প্রমাণ দিতে পারেনি।”

সন্ধ্যা নামে। গ্রামে ঘরের আলোগুলো জ্বলে উঠছে। একটা কুকুর দূরে ঘেউ ঘেউ করে উঠছে, আর নদীর ওপারে কোথাও একটা বাঁশির আওয়াজ কানে আসছে। শুভম ঠিক করে—এই রাতটা সে নিজেই কাটাবে বিন্নি খেতের ধারে। যদি সত্যিই কিছু ঘটে, তাহলে সেটা প্রমাণ করাই তার দায়িত্ব।

রাত ১০টা নাগাদ সে একটা ত্রিপল, মশার ধূপকাঠি, টর্চ আর ক্যামেরা নিয়ে বেরোয়। হরেন্দ্র স্যার বহুবার বাধা দেন—“তুমি জানো না তুমি কী পেতে চলেছ!”—কিন্তু শুভম নাছোড়বান্দা।

বিন্নি খেতের ধারে একটা উঁচু বাঁধানো জায়গায় বসে সে অপেক্ষা করতে থাকে। চারপাশে পোকাদের শব্দ, মাঝেমাঝে নদীর ঢেউয়ের মৃদু ছলাৎ ছলাৎ। রাত ১২টার দিকে হঠাৎ বাতাস যেন ভারী হয়ে ওঠে। মাথার ওপরে পূর্ণিমার চাঁদ ঠিকরে পড়ছে ধানের উপর, কিন্তু আলো যেন ভেতরে ঢুকছে না। ধানের ভিতর কোথাও একটা ছায়া নড়ছে।

টর্চ জ্বালিয়ে সামনে তাকাতেই শুভম দেখে—একটা ধানগাছ নিজের জায়গা থেকে যেন একটু নড়ে উঠল। ধানগাছ? না কি কেউ ধানের আড়ালে দাঁড়িয়ে?

সে ধীরে ধীরে ক্যামেরা তোলে, লেন্স জুম করে ফোকাস করতে গিয়ে হঠাৎ দেখে—একটা মুখ ভেসে উঠছে। সেই একই মহিলা, এবার আরও কাছে। ঘোমটা সরিয়ে এক ঝলকে মুখটা দেখা গেল। ত্বক নেই, কেবল হাড়, আর কালো চোখের গহ্বর থেকে বেরোচ্ছে ধোঁয়ার রেখা।

শুভম চিৎকার করে ওঠে, পেছনে পড়ে যায়। চোখ বন্ধ করে টর্চ অফ করে দেয়।

কিছুক্ষণ কেটে যায় নিস্তব্ধতায়। সে আবার চোখ মেলে দেখে—কেউ নেই। চারদিক নিস্তব্ধ। ধানগাছগুলো নীরব। যেন কিছুই ঘটেনি।

সে কাঁপা হাতে মোবাইল টিপে সময় দেখে—১টা ১৭। হাতে ঘড়ির কাঁটা যেন থেমে গেছে তখন।

ভোরের আলো ফুটতেই সে ফিরে আসে হরেন্দ্র স্যারের বাড়িতে। মুখ শুকনো, চোখে রক্তরেখা।

স্যার কিছু না জিজ্ঞেস করে শুধু এক গ্লাস জল এগিয়ে দেন।

শুভম ফিসফিস করে বলল, “স্যার… আমি ভাবতাম ভূত বলে কিছু নেই। কিন্তু কাল রাতে… আমি… আমি তার চোখে চোখ রেখেছি।”

স্যার বললেন, “তবে কি বুঝলে, গবেষক?”

শুভম মাথা নিচু করে বলল, “এই গ্রামে কিছু আছে, যা শুধু বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে ধরা পড়ে না। মানুষের বিশ্বাস, যন্ত্রের চেয়েও গভীর। এখন আমি শুধু জানি—এই রহস্যের গভীরে নামা ছাড়া আমার গত্যন্তর নেই।”

হারিয়ে যাওয়া দিনের ছায়া

শুভম সারারাত ঘুমোয়নি। চোখ লাল, মুখ থমথমে। পরপর তিনবার মুখ ধুয়েও যেন ধুলো সরে না—শুধু বাইরে নয়, তার মনের ভিতরও ধুলো জমেছে। সে বুঝতে পারছে, গতরাতের ঘটনা কেবল ক্যামেরায় ধরা পড়া এক দৃশ্য নয়—এ এক বোধের ঘূর্ণি, যেটা তাকে গ্রাস করতে চাইছে।

হরেন্দ্র স্যার চুপচাপ বসে থাকেন উঠোনে। পাশের নারকেল গাছটা দুলছে হালকা বাতাসে, আর সাদা ধুতি পরে স্যার যেন গ্রামেরই এক ইতিহাস হয়ে উঠেছেন। শুভম গিয়ে বলল, “স্যার, আমি আর খালি যুক্তির ভিতর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। আমি এখন বিশ্বাস করতে চাই। কিন্তু জানতেও চাই—কমলার অতীতটা কী? কেন সে এখনো আসে এই খেতে?”

স্যার চোখ বন্ধ করে বললেন, “এই কথাগুলো যার জানার কথা, সে আজও বেঁচে আছে। গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ—তাঁর নাম রুস্তম কাকা। বয়স প্রায় ৯০ ছুঁইছুঁই। একসময় জমিদারবাড়ির দালানে কাজ করতেন, পরে কৃষক হয়ে যান। এখন কথা বলেন কম, কিন্তু শোনেন অনেক কিছু। চাইলে ওঁর কাছে নিয়ে যেতে পারি।”

শুভম সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়ে। তারা রওনা দেয় গ্রামের শেষপ্রান্তে, যেখানে দাওয়াল দেওয়া এক ভাঙাচোরা মাটির ঘর, তার উঠোনে শুকোচ্ছে কিছু তুঁতপাতা আর চাটাইয়ে রাখা সোলার চার্জার।

রুস্তম কাকা ধুঁ ধুঁ করে বসে ছিলেন, চোখে ঝাপসা চশমা, গালে কাটা দাড়ি আর হাতে লাঠি।

স্যার সালাম দিয়ে বললেন, “কাকা, এই যে ছেলেটা এসেছে কলকাতা থেকে। বিন্নি খেত আর কমলা বিধবার বিষয়ে জানতে চায়।”

রুস্তম কাকার চোখে আলো জ্বলে উঠল। “কমলা? ওরে বাবা… এখনও কেউ ওর কথা ভাবে?”

শুভম কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “আমি শুধু জানতে চাই—ও কি সত্যিই বেঁচে নেই? আর ওর মৃত্যুর পেছনে কি কোনো সত্য লুকিয়ে আছে?”

কাকা থেমে থেমে বলতে শুরু করলেন—

“তখন আমি চৌদ্দ-পনেরো বছরের। জমিদারবাড়ির একজনের কাজ করতাম—জল দেওয়া, গেট খোলা-বন্ধ করা এসব। একদিন দেখলাম, নতুন এক বউ আসছে—গরিব ঘরের মেয়ে, রূপে রাজরানী। নাম ছিল কমলা। স্বামী ছিল গ্রামের এক কিশোর কৃষক—নির্বাক, শান্ত। ওদের ভালোবাসা ছিল, জানিস? সেইরকম কইনো ভালোবাসা, গন্ধ ছড়াত আশপাশে।”

কাকা হালকা কেশে আবার বলতে থাকলেন—

“কিন্তু জমিদারপুত্র চুপচাপ ছিল না। কমলাকে পছন্দ করে ফেলে। একদিন একটা নবান্নের রাতে, ধান উঠছিল, তখন সবার নজর সরিয়ে কমলাকে ডাক পাঠায়। বলে, কিছু পরামর্শ দিতে হবে জমির ব্যাপারে। কেউ দেখে না, কিন্তু আমি জল নিতে গেছিলাম পেছনের ঘর, সেখানে যা শুনি তাতে আমার ছোট বুকে শাঁ করে কিছু কেটে যায়।”

শুভম চুপ করে শুনছে।

“কমলার চিৎকার। ‘আমারে হাত দিও না, ঠাকুর আছেন।’ তারপর একটা থাপ্পড়ের শব্দ। আমি ভয়ে পালিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু বুঝেছিলাম, জমিদারপুত্র যা চেয়েছে, জোর করেই নিয়েছে। পরদিন গ্রামে গুজব ছড়ায়, কমলার স্বামী নাকি নদীতে ডুবে মরেছে। দুদিন বাদে কমলাও নিখোঁজ।”

স্যার বললেন, “কেউ কি কিছু করেনি?”

রুস্তম কাকা বললেন, “জমিদারের বিরুদ্ধে কে কথা বলবে, বাবা? আর কেউ ভাবল—কমলা লজ্জায় নিজেই মরেছে। কিন্তু আমি জানতাম—ও পাগল হয়নি, ও অন্যায় সহ্য করেনি। বরং আমি বিশ্বাস করি—ওর আত্মা ওর নিজের জমি পাহারা দেয়, যেন কেউ আর কোনোদিন কারো অধিকার কাড়তে না পারে।”

শুভম চোখ বন্ধ করে বসে রইল। তার মনে হতে থাকল—এই আত্মা এক অভিশাপ নয়, বরং এক দাবির প্রতীক। কমলা নিজে ভেঙে পড়েনি, সে রেগে উঠেছে, আর তার রাগই আজও মাঠ পাহারা দেয়।

বাইরে তখন হালকা বৃষ্টি পড়ছে। সাদা ধানের ফুলে ভেজা মাঠের উপর বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ শুনতে শুনতে শুভম একটা সিদ্ধান্ত নেয়—
সে শুধু রহস্য উন্মোচন করবে না। সে প্রমাণ করবে—কমলা কোনো ভূত নয়, সে এক প্রতিবাদ, এক প্রতিশোধ, যা ইতিহাস চেপে রাখতে পারেনি।

দালানের অন্ধকারে

শুভমের মনে একটাই কথা ঘুরপাক খাচ্ছে—কমলা আর তার মৃত্যুর গল্পটা শুধু ভূতের নয়, এটা এক রক্তমাখা অন্যায়ের ইতিহাস। এতদিন ধরে গ্রামের মানুষের মনে ভয় ছিল যে কেউ সেই জমিতে পা রাখলে অপবিত্র হবে। কিন্তু শুভম বুঝেছে, আসলে অপবিত্র ছিল সেই রাত, সেই মানুষগুলো, যারা এক মেয়ে আর তার আত্মমর্যাদাকে লুটেছিল।

হরেন্দ্র স্যারের সঙ্গে বসে সে বলল, “স্যার, আপনাদের জমিদারবাড়িটা কি এখনো আছে?”

স্যার বললেন, “আছে ঠিকই। তবে এখন ভগ্নপ্রায়। কেউ ওদিকে যায় না। শোনা যায়, পেছনের ঘরটা—যেখান থেকে কমলার কান্না শোনা গিয়েছিল—সেটা এখনো বন্ধ। তালা ভাঙেনি। কিন্তু মাঝে মাঝে রাতের দিকে ভেতর থেকে কাঁসার থালার শব্দ আসে, খিলখিল করে কেউ হাসে…”

শুভম উঠে দাঁড়াল। “স্যার, আমায় ওখানে নিয়ে চলুন। আমি সব দেখতে চাই।”

স্যার মাথা নাড়লেন, কিন্তু জানতেন—এই ছেলেকে আটকানো যাবে না।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল। দুইজন হেঁটে চলেছে গ্রামের শেষপ্রান্তে, যেখানে একটা উঁচু টিলা ঘেরা জমিদারবাড়ি, এখন আগাছায় ঢেকে আছে। বুনো জুঁই আর শুঁটকি পাতার গন্ধ বাতাসে, আর খোলা জানালার ফাঁক দিয়ে উড়ে যাচ্ছে বাদুড়।

ঘরের গেটটা আধা ভাঙা। ভিতরে ঢুকতেই শুভম দেখে, জমিদার আমলের পোড়াবাড়ির এক সময়ের গৌরব এখনও কিছুটা অবশিষ্ট—মার্বেলের সিঁড়ি, কারুকার্যখচিত বেলকনি, আর ছাদের দিকে অদ্ভুত এক চিত্র—এক সাদা শাড়ি পরা নারীমূর্তি, যার মুখ নেই।

“এটা কি আগে থেকেই ছিল?” শুভম জিজ্ঞেস করল।

স্যার বললেন, “আমার শোনা মতে, জমিদার মৃত্যুর আগে এই ছবিটা আঁকিয়ে ছিলেন। কেউ বলে, এটা কমলার প্রতিচ্ছবি। কেউ বলে, ওর তাড়নার ছায়া।”

তারা এগোতে এগোতে পৌঁছাল সেই ‘পেছনের ঘর’-এর সামনে। ঘরটায় তালা ঝোলানো, দরজার কড়ায় জং ধরা।

শুভম হাত রাখতেই তালা খুলে গেল সহজেই। যেন এতদিন পর কেউ নিজের ইচ্ছেতে তাকে ডেকে এনেছে।

ঘরের ভিতরটা অন্ধকার, আবছা আলোয় দেখা যায়—একটা ভাঙা আয়না, ধুলো ধরা চৌকি আর মাটির কাঁসার থালা।

শুভম মোবাইল টর্চ জ্বালিয়ে দেয়। ঘরের এক কোণে মাটির দেয়ালে আঁচড়ের দাগ—অনেকগুলো। যেন কেউ নখ দিয়ে দাগ করেছে বাইরে বেরোনোর চেষ্টা করতে করতে।

একটা শীতলতা গায়ে এসে লাগে। দরজা বন্ধ, অথচ বাতাস বইছে ভেতরে।

হঠাৎ আয়নার দিকে তাকিয়ে শুভম চমকে ওঠে। তার পেছনে একটা ছায়া। সে ঘুরে দেখে—কেউ নেই।

আয়নায় আবার তাকায়। এবার সেই ছায়া স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সেই একই সাদা শাড়ি, মুখ ঘোমটা ঢাকা।

কিন্তু এবার ছায়াটা এক পা করে এগিয়ে আসছে আয়নার মধ্য দিয়ে… বাস্তবে নয়, কিন্তু আয়নার গায়ে।

শুভম ধীরে ধীরে ক্যামেরা তোলে। হঠাৎ, আয়নার উপরে একটা শব্দ হয়—টুংটুং টুং!

কাঁসার থালা উলটে পড়ে যায় মাটিতে। টর্চ নিভে যায়।

অন্ধকার। নিঃশব্দ। কেবল শুভমের বুক ধুকপুক শব্দ করছে।

তারপর, অন্ধকারে এক গলা—
“আমার গলা কেউ শুনেছিল? কেউ সাক্ষী ছিল আমার তলিয়ে যাওয়া রাতের?”

শুভম ঘামতে ঘামতে জিজ্ঞেস করে, “তুমি… তুমি কি কমলা?”

নীরবতা। তারপর এক দীর্ঘশ্বাস। “তুই পা রেখেছিস… এবার সত্যি জানবি।”

এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস শুভমের গা ঘেঁষে চলে যায়। দরজাটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় নিজের থেকেই।

ভেতরে শুধু সেই আয়নাতে দেখা যাচ্ছে—কমলার মুখ। এবার আর মুখ ঢাকা নেই। মুখ পুড়ে যাওয়া, এক চোখে রক্তরেখা, কিন্তু তবু যেন তার ভিতরে এক আর্তি—এক অনুরোধ।

হঠাৎ এক জিনিস চোখে পড়ে শুভমের—আয়নার পাশে রাখা একটা কাঠের বাক্স। ধুলো ঝেড়ে খুলতেই সে দেখে—এক পুরোনো ডায়েরি। তার উপর লেখা—

কমলার দিনপঞ্জি১৯৭৪

দিনপঞ্জির দাগ

ঘরের অন্ধকারে কাঁপা হাতে শুভম সেই ডায়েরিটা খুলল। পাতাগুলো হলদেটে হয়ে গেছে, জায়গায় জায়গায় পোকায় কাটা, কিন্তু কালি আজও ঝাপসা হয়নি। প্রথম পাতায় লেখা:

এই কাগজগুলোই আমার সাক্ষী। যদি আমি না ফিরি, যেন কেউ একদিন পড়ে সত্যি জানে।
কমলা

শুভম চেয়ারে বসে পড়ে, আয়নার পাশে। বাইরের হাওয়া থেমে গেছে। ঘরের নিঃশ্বাস শুধু পাতার শব্দে ভাঙে।

প্রথম পাতায় লেখা,
কার্তিক, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ
আজ আমার বিয়ে। আমি বুঝতে পারছি না এই আনন্দ আমার কিনা। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে শান্তি পাই। শ্যামল, চুপচাপ ছেলে। আমাকে ভালোবাসবে বলেই বিশ্বাস করি।”

পাতা উলটে শুভম দেখে—বিয়ের পরের দিনগুলোর বর্ণনা। নতুন সংসার, গ্রামের হাটে যাওয়া, নদীর ধারে কাপড় ধোওয়ার গল্প।

কিন্তু একসময় লেখার ধরন বদলে যায়।

২৮ অগ্রহায়ণ
আজ জমিদারপুত্র প্রথমবার ডাকল। বলল, আমি নাকি ভালো গান গাই। আমি ভয় পেয়েছি, কিন্তু কিছু বলিনি।”

পৌষ
আজ রাতে আবার ডাকল। স্বামী বলল, ওখানে যেও না। কিন্তু আমি ভাবলাম, যেহেতু জমিদার ডাকছে, না গেলে বাড়ির মানহানি। ভুল করেছি?”

এরপর এক পাতায় শুধু এক লাইন—

আমার ঘোমটা সরিয়েছিল, আমি চেঁচাইনিভয়ে।

শুভমের গলা শুকিয়ে আসে। যেন শব্দগুলো একেকটা ছুরি হয়ে ঢুকছে শরীরে।

পৌষ
আমি আজ নদীর ধারে গেছিলাম। শ্যামলের মুখ দেখা যায়নি। গুজব উঠেছে সে ডুবে গেছে। কিন্তু আমি জানি, ও মরেনি। কেউ ওকে সরিয়ে দিয়েছে। আমি জানি কেন। জমিদার বলেছিল—ও যদি বাধা দেয়, ওকে সরানো হবে। এখন বুঝি।”

পৌষ
আজ আমি শেষবার লিখছি। হয়তো আর ফিরে আসব না। আমি যাব সেই বিন্নি খেতে, আমার নিজের হাতে ধান কাটতে। ওটা আমার সংসারের শেষ চিহ্ন। আমি কাঁদতে চাই না, আমি চাই কেউ আমার জায়গায় দাঁড়াক একদিন।”

এই লেখার পাশে দাগ—জলের? না কি চোখের?

শুভম ডায়েরি বন্ধ করে। তার মনে হতে থাকে, কমলা সত্যিই আত্মহত্যা করেনি। সে প্রতিবাদ করেছিল। সেই প্রতিবাদের প্রতিধ্বনি আজও বাতাসে ভেসে বেড়ায়।

এবার সে বুঝতে পারে—এই বিন্নি খেতে রাতের যেসব রহস্যময় ঘটনা ঘটে, তার মূল হোতা কমলা নয়, বরং সেই মানুষগুলো যারা অন্যায়ের ইতিহাসকে চাপা দিয়ে রেখেছে।

ঘরের বাইরে এসে সে দেখে, হরেন্দ্র স্যার এখনও অপেক্ষায়। স্যার জিজ্ঞেস করেন, “তুমি কিছু পেলে?”

শুভম ডায়েরিটা বাড়িয়ে দিয়ে বলেন, “আমি শুধু পেলাম এক নারীর শেষ আর্তি। এটা কেবল এক ভূতের গল্প নয় স্যার, এটা একটা গোপন মামলা—একটা অপরাধ, যা এই গ্রামের ভিতর চাপা পড়ে গেছে। আমি এবার চাই—এই ডায়েরির সত্যিটা গ্রামের সবাই জানুক।”

স্যার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “শুভম, তুই যদি এই সত্যি প্রকাশ করিস, গ্রামের লোক কীভাবে নেবে? যারা এত বছর ধরে ভয় করে এসেছে, তারা কি স্বীকার করবে ওর মৃত্যুর পেছনে মানুষ ছিল?”

শুভম বলল, “ভয়কে জিইয়ে রাখলে কমলারা বারবার মরে যাবে, স্যার। আমি এই ভয় ভাঙতে এসেছি।”

তারা দুজনে হাঁটতে থাকল গ্রামমুখো। বিকেলের শেষ আলো ঝাঁপিয়ে পড়ছে ধানের উপর। আর কোথাও যেন বাতাসে ভেসে এল একটা কণ্ঠ—
আমার কথা কেউ শুনেছে?”

সাক্ষীর মুখোমুখি

পরদিন সকাল। গোপীনাথপুর গ্রাম যেন অদ্ভুতভাবে শান্ত। ধানখেত থেকে ফিরে এসেছে কাকদের ডাক, কাঁথার ধারে বসে মহিলারা চাল বাছছে, কিন্তু বাতাসে আজ একটা অস্বস্তি ঘুরছে—যেন কিছু একটা ভাঙতে চলেছে, কিছু একটা ফুঁসে উঠবে।

শুভম আর হরেন্দ্র স্যার পঞ্চায়েত ঘরে ঢোকার আগেই সেখানে ভিড় জমে গেছে। খবর ছড়িয়েছে—একজন শহরের গবেষক কমলা নামের সেই আত্মার সত্যি ইতিহাস সামনে আনবে। অনেকে আগ্রহে এসেছে, অনেকে সন্দেহে, আবার অনেকে এসেছে কেবল ভয় দূর করার আশায়।

ঘরের মাঝখানে একটা টেবিল, তার উপর রাখা ডায়েরি।
শুভম দাঁড়িয়ে বলে, “এই ডায়েরি কোনো গুজব নয়, এটা ইতিহাস। কমলা নামের এক নারী, যার কাহিনি আমরা ভূতের গল্প বলে চালিয়ে দিয়েছি, সে আসলে এক নিষ্ঠুর ব্যবস্থার বলি।”

সে ডায়েরির পৃষ্ঠা খুলে পড়ে শোনায় কমলার সেই পাতা—

আমি ঘোমটা সরাইনিভয়ে। আমার স্বামীকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি যাই, আমার নিজের ধান কাটতে।

কথাগুলো পড়া শেষ হতে না হতেই পিছন থেকে একটা গলা বলে ওঠে—
আমি দেখেছিলাম…”

ঘর নিস্তব্ধ। সবাই তাকায় গলা যার, সে একজন চুপচাপ বৃদ্ধ—বয়স আশির কোটায়। নাম ধনঞ্জয় পোদ্দার, আগে ছিলেন জমিদারবাড়ির কেয়ারটেকার।

তিনি ধীরে ধীরে উঠে বলেন, “আমি এতদিন চুপ ছিলাম। ভয় ছিল, অপবাদ ছিল। কিন্তু আজ আর থাকতে পারছি না। আমি সেদিন দেখেছিলাম, জমিদারপুত্র রঘুপতি বাবুর ঘরে যখন কমলাকে জোর করে ঢোকানো হয়েছিল, তখন শ্যামল, ওর স্বামী, ওখানে ঢুকে যায়। দু’জনের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। তারপর একটা ধাতব কিছু দিয়ে মাথায় আঘাত করা হয়।”

কেউ ফিসফিস করে—“মানে শ্যামলকে খুন করা হয়েছিল?”

ধনঞ্জয় কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, “শ্যামল তখনই পড়ে যায়। কমলা ছুটে গেছিল নদীর দিকে। আমি আর যেতে পারিনি। পরদিন শুনি, শ্যামলের দেহ নাকি নদীতে পাওয়া গেছে। কিন্তু আসলে ওকে রাতে বাড়ির পাশের বাঁশঝাড়ে পুঁতে ফেলা হয়েছিল।”

এক নারী ফুঁপিয়ে ওঠে—“তাহলে এতদিন আমরা ভুল জানতাম?”

ধনঞ্জয় বললেন, “ভুল না, ভুল জানানো হয়েছিল। জমিদারপুত্র তারপর বিদেশ চলে যায়। জমিদারির পতন হয়। কিন্তু কমলার আত্মা থেকে যায়—কারণ তার বিচার হয়নি।”

শুভম এগিয়ে এসে বলল, “তাহলে এই গ্রামে যেসব অলৌকিক ঘটনা ঘটে, সেগুলো কমলার ভয় নয়—তার প্রতিরোধ। সে চায় কেউ তার হয়ে দাঁড়াক। সে চায় সত্যি বেরিয়ে আসুক।”

ভিড়ের মাঝে কেউ কেউ মাথা নাড়তে থাকে। কেউ বলে, “ওই জমিতে তো সত্যিই কেউ যায় না, এত বছর ধরে… তবে ওর অভিশাপ নয়, ওর ইতিহাস ছিল।”

এক বালক বলে ওঠে, “আমি যাব ঐ খেতে। এবার আমরাই ওর ধান তুলব, ভয় করে না।”

শুভম তখন ডায়েরিটা তুলে বলল, “এই ডায়েরি কেবল এক নারীর নয়—এটা এক গোটা সমাজের ন্যায়বিচারের দাবি।”

বাইরে তখন ধানের উপর হাওয়ার সোঁ সোঁ শব্দ। দূরে নদী। আর মনে হয়, কোথাও যেন সেই সাদা শাড়ির ছায়া দাঁড়িয়ে—তবে এবার তার চোখে ভয়ের ছায়া নেই, বরং এক শান্তি।

শেষ কাটা ধান

নবান্নর আগের রাত।

বিন্নি খেত যেন নতুন করে নিশ্বাস নিচ্ছে। এত বছর পর, সেই নিষিদ্ধ জমিতে এবার আবার ধান কাটবে গ্রামের মানুষ। পঞ্চায়েত সিদ্ধান্ত নিয়েছে—ভূত নয়, ভয় নয়, এবার সত্যের সম্মানে জমি শস্যে ভরে উঠবে।

শুভম দাঁড়িয়ে আছে ধানের কিনারায়, কাঁধে ঝোলানো ক্যামেরা। তার পাশে দাঁড়িয়ে হরেন্দ্র স্যার, আর গ্রামের তরুণরা হাতে কাচি আর খুন্তি নিয়ে প্রস্তুত। চারদিকে যেন বাতাসে কাঁপে এক সুর—শান্ত, অথচ গা ছমছমে।

“চলো,” বলল এক যুবক, “আজ কমলার ধান আমরা তুলব।”

শুভম একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখে। খেতে পা রাখার আগে সে মাটিতে এক মুঠো ধুলো নিয়ে বলল, “যদি কোথাও থেকে থাকো, কমলা, আমরা তোমার পক্ষে। আমরা কোনো অপরাধ চাপা দিতে আসিনি।”

প্রথম কোপ পড়ে ধানের শীষে। কেউ চিৎকার করে ওঠেনি। কেউ অজ্ঞানও হয়নি। বরং বাতাস হালকা, আকাশে চাঁদ উঠছে ধীরে ধীরে।

তবে শুভমের মনটা অস্থির। সে একটা অদ্ভুত অনুভূতি পাচ্ছে—পেছন থেকে কেউ তাকিয়ে আছে।

হঠাৎ সে ক্যামেরা অন করে খেতের ভেতরে ফোকাস করে। একদম কোণে, জলের কাছে, ধানের ভিতর দিয়ে একটা সাদা আবছা ছায়া হেঁটে যাচ্ছে। কারও চোখে পড়ছে না, কেবল শুভমের স্ক্রিনে সে স্পষ্ট।

সে একা এগিয়ে যায় ছায়ার দিকে। বাকি সবাই ব্যস্ত ধান কাটা আর মন্ত্র পড়ায়।

ছায়াটা ধানের মাঝে দাঁড়িয়ে। এবার পরিষ্কার—সাদা শাড়ি, পেছনে বাঁধা চুল, আর মুখটা ঘোরানো।

“কমলা?” শুভম ধীরে ধীরে বলে।

ছায়াটা ধীরে মুখ ফেরায়। মুখটা আজ আর পুড়ে যাওয়া নয়, চোখে আতঙ্ক নেই। বরং মুখে এক আশ্চর্য শান্তি। ঠোঁটে এক হালকা হাসি।

সে বলে না কিছু, শুধু আঙুল তুলে দেখায় জমির একদিক। শুভম এগিয়ে গিয়ে সেখানে খুঁড়ে দেখে—মাটির নিচে একটি পুরোনো কাঠের বাক্স। খুলতেই বেরোয় একটা নীলরঙা শাল আর একটি চিঠি।

চিঠিতে লেখা—

যদি কেউ একদিন আমার হয়ে ধান কাটে, আমি মুক্ত হবো। আমি কারো অভিশাপ হতে চাইনি। আমি শুধু আমার ঘর চাইতাম ফেরত। এবার আমি যাইগানের সুরে, বাতাসে মিশে।

শুভম চোখ তুলে দেখে—ছায়াটা আর নেই।

সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। চারদিকে ধান কাটা চলছে, ধানের গন্ধ ভেসে আসছে, আর হাওয়ায় মিশে আছে এক মৃদু গুনগুন সুর—

ধান কাটো রে ভাই, ধান কাটো রে
মোর কান্নার খেত আজ হাসে রে…”

তারা জানে না কে গাইছে, কোথা থেকে আসছে এই সুর। কিন্তু গ্রামের বয়স্ক এক মহিলা বললেন, “এই সুর তো কমলার… ছোটবেলায় ও গাইত।”

সবাই থমকে দাঁড়িয়ে, মাথা নিচু করে শ্রদ্ধা জানায় সেই কণ্ঠস্বরকে, যে আর ভূত নয়, ইতিহাসের ভিতর এক চিরকালীন সত্য।

 

আলোর ভিতর দিয়ে

বিন্নি খেতের ধান সব কাটা শেষ। খেত এখন খালি, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তা শূন্য নয়—বরং ভরে আছে হাসি, স্বস্তি আর এক অব্যক্ত মুক্তির উল্লাসে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা ধান কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছে মাড়াইয়ের দিকে। কেউ আর ভয় করছে না। কেউ আর গোধূলির ছায়া দেখে চোখ ফেরায় না।

শুভম পেছনে দাঁড়িয়ে থেকে সব দেখছে। তার হাতে কমলার সেই চিঠি, বুকের ভেতর জমে আছে এক অন্যরকম শিহরণ—এটা ছিল এক নারীর প্রেত নয়, প্রতিবাদের প্রতীক।

হরেন্দ্র স্যার পাশে এসে দাঁড়ান। তাঁর চোখে জল, গলায় কাঁপন। “শুভম, তোকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এতদিন আমরা ভূত ভয় করে বসে ছিলাম। বুঝিনি, আমরা ভুল মানুষের পায়ে প্রণাম করেছি, আর সত্যিটাকে ছায়া বানিয়ে রেখেছিলাম।”

শুভম বলে, “আমি তো শুধু পথ দেখালাম, আলো তোমরা নিজে জ্বালালে।”

গ্রামে উৎসবের প্রস্তুতি চলছে। প্রথমবার সেই জমির ধান দিয়ে নবান্নর পায়েস রান্না হবে। মহিলারা ঘরের বারান্দায় চাল কুটছে, পুরুষেরা উঠোনে আলপনা আঁকছে। হঠাৎ সব কিছুতে একটা প্রাণ এসেছে—যা বহু বছর ছিল না।

পঞ্চায়েত ঘরের সামনে শুভম দাঁড়িয়ে বলল, “এই ডায়েরিটা শুধু আমার গবেষণার অংশ নয়, এটা এই গ্রামের সম্পদ। এটা এখানে থেকেই যাবে। আমি চাই, তোমরা এটা সংরক্ষণ করো—যেন ভবিষ্যতে কেউ ভুলে না যায়, কমলার কথা।”

এক তরুণী বলে উঠল, “আমরা ওর নামে পাঠাগার খুলব। গ্রামের মেয়েরা এখন থেকে লিখবে, পড়বে, জানবে। কমলার লেখা থেকেই আমরা শুরু করব।”

শুভমের চোখে জল আসে। এই তো চাইছিল সে—যেন অতীতের অন্ধকারে শুধু আতঙ্ক নয়, আলোর পথও ফুটে ওঠে।

পরদিন ভোরে শুভম ফিরছে। হরেন্দ্র স্যার তাঁকে স্টেশনে নামিয়ে দিতে এসেছেন। ট্রেন এখনও আসেনি। ধারের নদীটা কুয়াশায় ঢেকে গেছে।

স্টেশনের বেঞ্চে বসে শুভম একটা শেষবারের মতো চিঠি বের করল। সেই চিঠির এক কোণে লেখা—

আমি আর কেউ নই, আমি একজন চাষির বউ। আমি যে ধান কেটেছিলাম, তা ছিল আমার স্বপ্ন। আর যদি কোনোদিন কেউ জিজ্ঞেস করে, কেন আমি রাত্রে ফিরে আসিবলবে, আমি শুধু চাই কেউ আমার হয়ে কাটুক সেই ধান। কারণ আমার স্বপ্ন আমি বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম।

ট্রেনের হুইসেল বাজল। শুভম উঠে দাঁড়াল। ট্রেনে ওঠার মুহূর্তে হাওয়ার ভিতর দিয়ে ভেসে এল এক পরিচিত কণ্ঠ—

ভয় নয়, আমার কথা মনে রেখো।

শুভম জানালা দিয়ে তাকাল। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে এক সাদা শাড়ি পরা মেয়ে। এইবার আর তার মুখ ঢাকা নয়। মুখে এক পরিপূর্ণ প্রশান্তি। সে আর ফিরে আসবে না। কারণ তার কথা কেউ আজ মনে রাখবে, ভয় নয়—সম্মানের সঙ্গে।

ট্রেন ছুটে চলে শহরের দিকে। আর পিছনে পড়ে থাকে এক গ্রাম, এক সত্যি, আর এক নারীর নাম—কমলা, যে ভূত হয়ে নয়, ইতিহাস হয়ে বেঁচে থাকবে।

সমাপ্ত

WhatsApp-Image-2025-07-14-at-12.47.46-PM-1.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *