তুষার অধিকারী
এক
আষাঢ় মাসের শেষভাগ। ঘন মেঘে ঢাকা আকাশের নিচে চিংড়িঘাটের ঘোলা জল থেমে থাকলেও বাতাস কাঁপিয়ে চলেছে। বোটের ইঞ্জিনের একটানা গর্জন ঠেলে, গহীন ম্যানগ্রোভের মধ্যে ঢুকে পড়ছে এক গবেষক দলের চার সদস্য—ড. অদিতি সেন, সম্রাট দে, জয়ন্ত ঘোষ ও স্থানীয় গাইড বীরাজ মুখার্জি। চারপাশে থমথমে নিরবতা। মাঝে মাঝে দূরে শোনা যায় ময়ূরের ডাক, আবার কোথাও চাঁদিয়ালের তীক্ষ্ণ শব্দ। গঙ্গার শাখা নদী ঘেঁষে বোটটা এগোচ্ছে, সঙ্গে করে যাওয়া খাবার, ক্যামেরা ট্র্যাপ, ড্রোন, ল্যাপটপ, আর একরাশ কৌতূহল। অদিতি চোখ মেলে দেখছেন—দু’পাশে যে বন, সেটাকে শুধুই গবেষণার বিষয় বলে মনে করা ভুল হবে। একটা অলিখিত অনুভব যেন সঙ্গী হয়ে এসেছে—এই বনের গভীরে কিছু আছে, যা তাদের এই অভিযানে টেনে এনেছে। সম্রাট ব্যস্ত তার লেন্স সেট করতে, কিন্তু বারবার চোখ পড়ে যাচ্ছে অদিতির মুখে—এই নারী যেন বনের সঙ্গেই কথা বলেন। জয়ন্ত তার নোটবুক খুলে রেখেছে; প্রতিটি গাছ, প্রতিটি ক্যানোপি, আর নদীর ধার বরাবর ছড়ানো পাখির পালকগুলোর বিবরণ টুকে নিচ্ছে। আর বীরাজ? সে চুপচাপ। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে বনের দিকে। মাঝেমাঝেই চোখ ছোট হয়ে আসে, যেন সে কিছু আঁচ করতে পারছে, যা বাকিরা টের পাচ্ছে না। তার হাতের তালু ঘেমে গেছে। “দিদি,” হঠাৎ সে বলে ওঠে, “আমরা কিন্তু কাল রাতের মধ্যে নদীর দক্ষিণ পাড়ে পৌঁছে গেলেই ভালো। ওই পাড়ে মুখো বনবিবির পুরনো থানে রাতে কেউ থাকে না।” বাকিরা হেসে উড়িয়ে দেয়—কুসংস্কার, লোকগল্প! কিন্তু বীরাজ হাল ছাড়ে না। তার গলা জোরে ওঠে না, কিন্তু শব্দগুলো ভারী হয়ে বাতাসে ঝুলে থাকে।
দুপুর গড়াতে গড়াতে দলটি পৌঁছয় ‘কুলতলা’ অঞ্চলের এক নির্জন খাঁড়িতে। এখানেই তাদের সাময়িক ক্যাম্প হবে—সুন্দরবনের গভীরে প্রবেশের আগে প্রস্তুতির ঘাঁটি। জায়গাটা যেমন নির্জন, তেমনি অভিশপ্ত বলেই পরিচিত স্থানীয়দের মধ্যে। কয়েক বছর আগে এক টুরিস্ট দল এখানে এসে একজনকে হারিয়ে ফিরে গিয়েছিল। ঘটনাটি নিয়ে তেমন কিছু প্রকাশ পায়নি, কেবল শোনা যায়—হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তি বলেছিল, “জঙ্গলের ভিতর কেউ তাকে ডেকেছিল।” সেই জায়গার আশেপাশে আজও কেউ সন্ধ্যার পর পা দেয় না। কিন্তু গবেষণা যেখানে, ভয় সেখানে বিলাসিতা নয়। ক্যাম্প গড়ার পর সম্রাট ও জয়ন্ত খুঁটিয়ে দেখে জায়গাটা। চারপাশে ম্যানগ্রোভের ঘন ঝোপ, ছায়ায় ঢাকা খাল, মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে কিছু অচেনা পাখি। ক্যামেরা ট্র্যাপ বসানোর জায়গা নির্ধারিত হয়। রাত নামার আগে খাওয়া-দাওয়া 済, আর একটা বৈঠকে সবাই তাদের পরবর্তী দিনের কাজ ভাগ করে নেয়। কিন্তু আলো নিভে যাবার কিছুক্ষণ পরই প্রথম অস্বাভাবিকতা টের পান অদিতি। ঘরের বাইরে, খালপাড়ে, যেন কেউ বা কিছু হাঁটছে—জলের কাদায় হালকা চাপড়ের শব্দ, যেন কোনো মানুষের নয়, আবার পশুরও নয়। অদিতি প্রথমে ভাবে, ভুল শুনছেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পর সম্রাট, যার ক্যামেরা সবসময় চালু থাকে, ঘুম থেকে উঠে বলে, “ক্যাম্পের চারপাশে কিছু একটা চলাফেরা করছে। মনে হচ্ছে কেউ পাহারা দিচ্ছে আমাদের।” জয়ন্ত দরজা খুলে বাইরে উঁকি দেয়—কিছু নেই। কিন্তু বাতাস যেন ভারী, ভেজা মাটি থেকে যেন উঠে আসছে অদ্ভুত এক গন্ধ—মরা পাতার নয়, বৃষ্টির নয়, বরং এমন কিছু যা শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। বীরাজ এইসবের কিছুতেই অবাক হয় না। শুধু ফিসফিস করে বলে, “সব সময় চোখ দিয়ে সব দেখা যায় না, বাবু। এই বনের চোখ আর নাক আলাদা।” বাকিরা তখনো হয়তো বুঝে উঠতে পারেনি—ক্যাম্পে আসার সঙ্গেই তারা নিজের অজান্তে প্রবেশ করেছে এক প্রাচীন খেলার মঞ্চে, যেখানে বাঘ নয়, ছায়ারা শিকার করে।
রাত গড়িয়ে যায় চাপা উদ্বেগে। অদিতি স্বপ্নে দেখতে পান—এক জঙ্গলের মেয়ে, যার মুখ অন্ধকারে ঢাকা, শুধু চোখ দুটো চকচক করছে। সে যেন কিছু বলছে, কিন্তু কোনো শব্দ নেই। হঠাৎই সেই চোখ দুটি এগিয়ে আসে, একদম তার মুখোমুখি। চমকে ঘুম ভাঙে অদিতির, ঘামছে পুরো শরীর। বাইরে তখন বৃষ্টি শুরু হয়েছে—হালকা, ঠাণ্ডা ফোঁটা পড়ছে পাতার ওপর। সম্রাট পাশে বসে আছেন, হাত দিয়ে কাঁধে রাখে, “সব ঠিক তো?” অদিতি মাথা নাড়েন, কিন্তু কিছু বলেন না। সকালে উঠে দেখা যায়, ক্যাম্পের একপাশে ক্যামেরা ট্র্যাপ খোলা। অথচ তারা সবাই জানে, সেটা অদিতি নিজে হাতে বসিয়েছিলেন। জয়ন্ত বিস্মিত, “কেউ রাতের অন্ধকারে এসেছিল?” বীরাজ বলে, “হয়তো কেউ নয়, কিছু। এখানে যারা থাকে, তারা বস্তু নয়, ছায়া। আর ছায়ারা আগেই জানে কে তাদের ডাকে সাড়া দেবে।” সম্রাট আর অদিতি একে অপরের দিকে তাকান। এমনকি যুক্তিবাদী জয়ন্তও এবার কিছুটা অস্বস্তি অনুভব করেন। তারপরই বীরাজ একটি পুরনো নৌকার কাঠের টুকরো তুলে দেখায়—ওটাতে আঁচড়ের দাগ। বড়, ধারালো, কিন্তু কোন জন্তুর এমন আঁচড় হতে পারে সেটা কেউ জানে না। আর অদিতির মাথার মধ্যে তখনও বাজছে সেই স্বপ্নের চোখদুটি। যেন কেউ তাকে ডেকেছে নাম ধরে। ‘অদিতি’—একটা ডাক, বনজ শব্দের ভিতর দিয়ে যেন ভেসে এসেছে। জঙ্গল যেন ইতিমধ্যেই তাদের চিনে ফেলেছে, এবং নির্বাচিত করেছে একজনকে, যার অতীত এই জঙ্গলের সঙ্গে বাঁধা।
দুই
সন্ধ্যা নামতেই পুরো ক্যাম্প জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এক অদ্ভুত নীরবতা—যেটা কেবলমাত্র গহীন জঙ্গলেই সম্ভব। বাতাসে কেমন একটা স্যাঁতসেঁতে ঘ্রাণ, ঘরের টিনের ছাদে মাঝে মাঝে বৃষ্টির টপ টপ শব্দ, আর দূরে কোথাও বাজছে শেয়ালের ডাক—জোড়ায় জোড়ায়। অদিতি ল্যাপটপ খুলে সারাদিনের তথ্যগুলো দেখতে বসেছেন, কিন্তু মনোযোগ স্থির হচ্ছে না। ডানদিকের জানালার পাশে বসে সম্রাট ক্যামেরার ফুটেজ ঘাঁটছে, হঠাৎ সে বলে ওঠে, “অদিতি, এসো তো। এটা দেখো।” পর্দায় দেখা যাচ্ছে: রাত দেড়টার দিকে ক্যাম্প থেকে কিছুটা দূরে, এক ঘন ম্যানগ্রোভের পাশে ধরা পড়েছে কিছু নড়াচড়া। প্রথমে মনে হচ্ছিল শিয়াল, কিন্তু সে বুঝতে পারে—আকৃতি বেশ বড়, মাথা নিচু করে হাঁটছে, যেন কোনো মানুষ। কিন্তু মানুষের মতোও না। গলার কাছটা যেন লম্বাটে, ছায়ার মধ্যে একবার মনে হলো যেন চার চোখ চকচক করছে। অদিতি এক ঝটকায় চেয়ার সরিয়ে এগিয়ে আসে। ফ্রেম ফ্রেম করে দেখে ভিডিওটা—ক্যামেরা তার রাতভিশনে ধরা ছবি কাঁপছে, কিন্তু এত স্পষ্টভাবে কোনো পরিচিত প্রাণীর গঠন মেলে না। জয়ন্ত, পাশের কেবিন থেকে এসে দেখে বলল, “এটা যদি বাঘ হত, তাহলে পায়ের ভঙ্গিটা অন্যরকম হতো। এটা… এইভাবে নিচু হয়ে চলে না।” বীরাজ তখন কিছুটা দূরে, খালপাড়ে বসে। কেউ তাকে ডাকলে সে ধীরে আসে। ভিডিওটা দেখে চোখ ছোট করে ফিসফিস করে বলে, “বলেছিলাম তো… এখানে কিছু আছে, যারা মানুষ নয়, আবার জানোয়ারও নয়। ওরা ছায়া। বনবিবির দূত। দেখছে, আমরা কী করছি।” বাকিদের ঠোঁট শুকিয়ে আসে। ক্যাম্পে আলো আছে, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি আছে, কিন্তু মনে হচ্ছে, এই অন্ধকারের মধ্যে তারা যেন খুব ছোট—খুব অসহায়।
রাত যত গভীর হতে থাকে, ঘরের ভেতরের আলো আরও ফিকে লাগে বাইরের অন্ধকারের তুলনায়। চারদিকে যেন জঙ্গল ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। ডিনার সেরে সবাই ঘরে ফিরে যায়, কিন্তু কেউ সত্যিই ঘুমোতে পারে না। অদিতি বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করলেও মাথার মধ্যে ঘুরছে সেই চোখজোড়া—সেই স্বপ্নের অচেনা নারী, যার শরীরটা ছায়ায় ঢাকা, শুধু দু’টো দীপ্তিময় চোখ জ্বলছে। বাইরে বাতাস হু হু করে বইছে, জানালার কাঁচে পড়ছে জল আর পাতা। হঠাৎ, রাত প্রায় তিনটের সময়, জয়ন্ত দরজা খুলে বাইরে পা রাখে। কেন যেন মনে হচ্ছিল কেউ তার নাম ধরে ডাকছে। “জয়ন্ত… জয়ন্ত…”—একটা মেয়েলি কণ্ঠ, কেমন যেন ঘুমপাড়ানি স্বর। সে টর্চ হাতে ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করে ক্যাম্পের পেছনের দিকে। তার পেছনে পেছনে ছায়া সরে যাচ্ছে, পাতা নড়ে উঠছে, কিন্তু কোথাও কোনো প্রাণীর আওয়াজ নেই। ঠিক তখনই সম্রাট ঘুম ভেঙে দেখে, জয়ন্ত নেই। দ্রুত সে বাইরে বেরিয়ে যায়। গলার স্বর চেপে ফিসফিসিয়ে বলে, “জয়ন্ত! কোথায় গেলে?” কিছুক্ষণ পর জয়ন্ত ফিরে আসে। মুখে বিস্ময়ের ছায়া, কাঁধে পাতা লেগে আছে। “আমি… একটা ছায়া দেখেছিলাম। মনে হল আমার মা ডাকছে। কিন্তু…”—সে থেমে যায়। তখনই বীরাজ চুপচাপ বলে ওঠে, “জঙ্গলের ছায়ারা কার চেহারা নেয়, জানো? যাকে তুমি সবচেয়ে বিশ্বাস করো, তার। যাতে ওরা তোমাকে টেনে নিতে পারে।” এই কথা শুনে সবাই স্তব্ধ। অদিতির হাতটা অনিচ্ছায় ঠাণ্ডা হয়ে আসে। এ কি নিছক হ্যালুসিনেশন? না কি সত্যিই জঙ্গল তাদের কাউকে লক্ষ্য করে ফেলেছে?
পরদিন ভোরে, সূর্য ওঠার অনেক আগে, পাখিরা ডাকতে শুরু করে। কিন্তু সেই ডাকেও ছিল অস্বাভাবিক রেশ। পাখির সুর যেন ভাঙা, যেন কণ্ঠে কষ্ট। ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে সম্রাট দেখল, গতরাতে লাগানো ক্যামেরাগুলোর মধ্যে একটি পড়ে আছে মাটিতে, ভাঙা। কেউ কি ইচ্ছে করে ওটা খুলে ফেলেছে? না কি বনের কোনো জন্তু? জয়ন্ত নিঃশব্দে বসে আছে। আগের রাতের ঘটনার কথা কারো মুখে কেউ বলছে না, কিন্তু প্রত্যেকের চোখেই লেগে আছে এক অজানা ভয়। তখনই বীরাজ এসে একটি পুরনো কঞ্চির টুকরো তুলে দেখায়, সেটাতে আঁকা আছে জ্যামিতিক কিছু চিহ্ন—যা স্থানীয় মানুষ ‘তন্ত্রমূলক সুরক্ষা চিহ্ন’ বলে চেনে। সে ফিসফিস করে বলে, “এই জঙ্গলেও লোকে বিশ্বাস করে, কিছু কিছু জায়গায় প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়… কিন্তু কিছু জায়গায় নয়। যেখানে ওরা থাকে, সেখানকার মাটি অন্যরকম।” জয়ন্ত, যার বৈজ্ঞানিক মন এতদিন এসব অবাস্তব বলে মনে করত, এবার বলে ওঠে, “আমরা কি তাহলে ভুল জায়গায় এসেছি?” অদিতি তার ল্যাপটপ বন্ধ করে জানালার দিকে তাকায়। সূর্য উঠেছে, কিন্তু আলো ঢুকছে না। যেন ঘন পাতার আড়ালে একটা অপার ছায়া নামিয়ে রেখেছে নিজেকে। গহীন বন যেন ধীরে ধীরে তাদের মন-প্রাণ-ভয় সব গ্রাস করে নিচ্ছে। এই প্রথম অদিতির মনে প্রশ্ন জাগে—তারা কি শুধুই গবেষণার কাজে এসেছেন? নাকি তারা ডাকা পড়েছেন? আর যদি কেউ ডেকেই থাকে… সে কে?
তিন
সকাল গড়িয়ে দুপুর। আকাশে মেঘের ভার। ক্যাম্পের আশপাশে বাতাস আজ অদ্ভুত নিস্তব্ধ—পাখিরা যেন কাকভোরের পর আর কোনো শব্দ করেনি। অদিতি টের পান, সময় যেন ধীরে ধীরে থেমে যাচ্ছে; ঘড়ির কাঁটাও যেন পেছনে হাঁটছে। আজ তাদের কাজ ছিল কাছাকাছি অঞ্চলে ড্রোন উড়িয়ে বনের ফ্লোরের ম্যাপিং করা—যাতে ট্র্যাপ বসানোর জায়গাগুলো চিহ্নিত করা যায়। সম্রাট, ড্রোন চালানোর দায়িত্বে, ক্যাম্প থেকে কিছুটা দূরে উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। অদিতি, জয়ন্ত এবং বীরাজ তাকে সাহায্য করছে। ড্রোন উঠতে না উঠতেই সম্রাট বলে, “আকাশ পরিষ্কার থাকলেও, নিচের গাছপালা এত ঘন, যেন সূর্যের আলোও মাটি ছুঁতে পারে না। ম্যাপিং হবে ঠিকঠাক?” জয়ন্ত জবাব দেয়, “ছবি তো নিতে পারবে, কিন্তু তলদেশে কী আছে তা বলা মুশকিল।” প্রায় বিশ মিনিট ড্রোন ঘুরে ঘুরে ছবি তোলে। ফিরে এসে, ল্যাপটপে ফুটেজ আপলোড করে তারা দেখতে শুরু করে। প্রথমে সব স্বাভাবিক—সবুজ, বাদামি, কাদামাটি। কিন্তু এরপর এক জায়গায় পৌঁছে ভিডিও থমকে যায়। চারজনের চোখ একসঙ্গে বড় হয়ে যায়। গাছপালার ফাঁকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে—একটা নারীমূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। পোশাক সাদা নয়, লাল নয়, বরং কাদায় মাখামাখি, তবুও যেন ছেঁড়া ঘোমটা মুখে চাপানো। মুখ দেখা যাচ্ছে না, শুধু কাঁধ থেকে শরীর পর্যন্ত দৃশ্যমান। পাশে একটা গাছ, আর তার গায়ে ঝোলানো কিছু… অনেকটা পুরনো কাপড়ের মতো।
সম্রাট চিৎকার করে ওঠে, “এই জায়গায় তো আমরা গতকাল গিয়েছিলাম! সেখানে কেউ ছিল না!” জয়ন্ত ঠোঁট কামড়ে ভিডিওকে জুম করে। ক্যামেরার লেন্স কিছুটা ঝাপসা, তবুও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে নারীমূর্তিটি নড়ছে না—একেবারে নিথর দাঁড়িয়ে। কিন্তু তার ছায়া—হ্যাঁ, তার ছায়া একবার একদিকে যাচ্ছে, আবার অন্যদিকে ফিরে আসছে, যেন সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নয়, বরং আলাদা সত্তা হিসেবে নিজস্ব গতিতে চলছে। অদিতির শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে আসে। “ছায়া যদি আলোর নিয়ম না মানে, তাহলে সে কি ছায়া থাকে?” জয়ন্ত ধীরে ধীরে বলে। বীরাজ চুপচাপ, তার ঠোঁট সাদা হয়ে গেছে। সে কেবল নিচু গলায় বলে, “এটা মুখো বনবিবি নয়। এটা ওই প্রাচীন আত্মা, যাকে ‘ডাকবিবি’ বলা হয়। ওর নাম উচ্চারণও অনেকে করে না। ডাকলেই ফিরে আসে।” বাকিরা চুপ করে থাকে, কিন্তু অদিতি এবার আর নিজেকে চেপে রাখতে পারে না। সে বলে, “কাল রাতে আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি। সেই একই রকম চেহারা। মুখ ঢাকা, চোখ নেই, কিন্তু একটা ভয়াবহ আকর্ষণ ছিল। ও কি… ডেকে আনছে আমাদের?” জয়ন্ত এবার উঠে দাঁড়ায়, “না, আমরা যদি এভাবে চলি, তাহলে কেবল তথ্য নয়, নিজেদের অস্তিত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। এই জায়গায় কিছু একটা আছে, যা বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না।” সম্রাট চুপচাপ ক্যামেরা বন্ধ করে। তার চোখে যেন একটা বিষণ্ণতা—একটাই ছবি, কিন্তু তাতে যতবার তাকাচ্ছে, ততবার যেন নতুন কিছু ধরা দিচ্ছে। ছবি কি কেবল ছবি? নাকি তার গভীরে লুকিয়ে আছে এমন কিছু, যা একবার দেখলেই মনে গেঁথে যায়?
সন্ধ্যার আগে সম্রাট একা গিয়ে ক্যাম্পের পেছনে সেই জায়গাটা খুঁজে বের করার সিদ্ধান্ত নেয়—যেখানে ভিডিওতে নারীমূর্তিটিকে দেখা গিয়েছিল। অদিতি বাধা দিতে চায়, কিন্তু সে বলে, “আমি শুধু যাচাই করে দেখতে চাই। ওখানে কিছু না থাকলে ভালো, থাকলে… বুঝতে পারব আমরা ঠিক কতটা গভীরে ঢুকে পড়েছি।” জয়ন্ত ও বীরাজ দূর থেকে নজর রাখতে রাজি হয়, তবে তারা বলে দেয়—সন্ধ্যার পর ফিরে না এলে খোঁজে যাবে না, কারণ সেই জায়গার চারপাশে রয়েছে নোনা কাদার নিচে গর্ত, যেগুলো লোকচক্ষুর আড়ালে বহু প্রাণ গ্রাস করেছে। সম্রাট হেঁটে যায়, টর্চ, ক্যামেরা আর ছোট রেকর্ডার নিয়ে। প্রায় আধঘণ্টা পর সে পৌঁছায় জায়গাটিতে। আশপাশে নিস্তব্ধতা। কিন্তু মাটি ভেজা, পাতা ছিন্নভিন্ন। হঠাৎ সে দেখে গাছের গায়ে একটা লাল কাপড়ের টুকরো ঝুলছে, ঠিক যেমনটা ফুটেজে দেখা গিয়েছিল। তার বুকের ভিতর ধকধক করে ওঠে। সে ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে দেখতে চায়, কিন্তু বাতাসে হঠাৎ ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করে। কোথাও কোনো শব্দ নেই, অথচ পেছনে মনে হয় কেউ হাঁটছে—কাদায় পায়ের আওয়াজ, থপ থপ থপ। সে ঘুরে তাকায়—কেউ নেই। ক্যামেরা অন করে ঘোরাতে থাকে, আর তখনই ক্যামেরার স্ক্রিনে দেখা যায়—তার পিছনে দাঁড়িয়ে সেই একই ছায়ামূর্তি। কিন্তু চোখ তুলে সামনে তাকালে কিছুই নেই! সে এক ঝটকায় পিছিয়ে আসে, দৌড়ে ক্যাম্পে ফিরে আসে। বীরাজ তাকে টেনে তোলে, “বলেছিলাম তো, ও ডাকে। এবার ও দেখেছে তোমাকে। এখন তুমি তার মনে রয়ে গেলে।” অদিতি, জয়ন্ত হতভম্ব হয়ে সম্রাটের ক্যামেরা ফুটেজ দেখতে থাকে। এবং তারা দেখতে পায়—শেষ অংশে ক্যামেরা হঠাৎ ঝাঁকুনি খায়, আর তার ঠিক আগে স্পষ্ট দেখা যায় দুটি জ্বলন্ত, অচিনচিনে চোখ—যা যেন চোখ নয়, আগুনের মতো কিছু। তারা আর বুঝতে পারে না—এই গবেষণা কি শুধুই প্রাণী পর্যবেক্ষণের, না কি তারা নিজের অজান্তে জড়িয়ে পড়েছে এক অন্য জগতের সঙ্গে?
চার
বৃষ্টিভেজা সকালে ক্যাম্প জুড়ে ছড়িয়ে ছিল এক অদ্ভুত চাপা চুপচাপ ভাব, যেন রাতের ছায়া এখনো পাতার ফাঁক দিয়ে নজর রাখছে চারদিকে। সম্রাট এখনো ঘোরের মধ্যে, তার চোখ লাল, ঘুমহীন। টেবিলে রাখা তার ক্যামেরা যেন এক সাক্ষ্যপ্রমাণ—যা কেউ মানতে চাইছে না, কিন্তু মুছেও ফেলতে পারছে না। জয়ন্ত এবার সিদ্ধান্ত নেয়—এই জায়গা সম্পর্কে যত বেশি সম্ভব তথ্য জোগাড় করতে হবে। সে ব্যাগ খুলে নিজের সংগ্রহ করা পুরনো ফিল্ড নোট, ম্যাপ, ও স্থানীয় জনজাতিদের ইতিহাস নিয়ে লেখা কিছু বই বের করে। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে তার চোখ আটকে যায় ১৯৭৮ সালের একটি গবেষণা মিশনের রিপোর্টে। ফাইলটা কুড়িয়ে পাওয়া গিয়েছিল বনদফতরের পুরনো রেকর্ড ঘরে, যেখানে লেখা ছিল—“প্রকল্প: সাউথ ম্যানগ্রোভ বায়োস্টাডি – গাইড নিখোঁজ, একজন গবেষক মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে, অপর দুই সদস্য নিঃশব্দে ফিরে যায়।” এই অংশটা পড়েই জয়ন্ত থমকে যায়। দলনেতার নাম ছিল ড. অরুণাভ পাল। সে ছিলেন কলকাতার প্রাণীবিজ্ঞানের প্রখ্যাত অধ্যাপক। পরবর্তী জীবনে জনসম্মুখে আর আসেননি। জয়ন্ত দ্রুত ইন্টারনেট ডেটা খুঁজে ড. পাল সম্পর্কে কিছু জানতে চায়, কিন্তু আশ্চর্যভাবে কোনো খোঁজ মেলে না—কোনো ছবি নেই, কোনো কাজের প্রকাশনা নেই, যেন তিনি ছিলেনই না।
অদিতি ধীরে এসে জয়ন্তের পাশে বসে। তার চোখে চিন্তার ছায়া। জয়ন্ত চুপচাপ ফাইলটা তাকে এগিয়ে দেয়। দুজনেই একসঙ্গে পড়ে: “দলটি সুন্দরবনের দক্ষিণ-পূর্বাংশে মুখো থানের ১২ কিলোমিটার ভিতরে গিয়ে ক্যাম্প করে। ৬ দিনের মাথায় গাইড নিখোঁজ। ৭ম দিন এক সদস্য অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে—নিজের শরীরে ছুরি চালায়, মুখে ফিসফিস করে বলে ‘সে আমাকে দেখছে’। ৮ম দিনে দল ক্যাম্প ত্যাগ করে।” অদিতি গলা নামিয়ে বলে, “আমরা যে জায়গাটায় আছি, সেটা সেই একই অঞ্চল। এর মানে আমরা কেবল ছায়াকে দেখছি না, আমরা এক অভিশপ্ত কাহিনির দ্বিতীয় অধ্যায় লিখছি।” জয়ন্ত বলে, “বুঝতে পারছ? এই জায়গার কথা হয়তো ইচ্ছে করে ঢাকা দেওয়া হয়েছিল। লোক যাতে না আসে। অথচ আমরা নিজেদের পায়ে হেঁটে সেই দরজায় এসেছি।” এই কথার মধ্যেই ক্যাম্পে ঢোকে বীরাজ। তার হাতে এক প্যাকেট, যা সে গ্রাম থেকে এনেছে। সে বলে, “এই জায়গার অনেক পুরনো নাম ছিল—ডাকখোলা। জায়গাটার নামই দেওয়া হয়েছিল কারণ রাতে নাকি এখানকার বাতাস মানুষের নামে ডাক দিত। আর এখানে একসময় জঙ্গলবাসীরা পূজা দিত ‘মুখো বনবিবির’ না, বরং ‘ডাকবিবি’র নামে—যাকে ভয় করা হতো, পূজা নয়। ওর কোনো মূর্তি নেই, শুধু এক সাদা কাপড় বাঁধা হয় গাছে।” বীরাজ একটা পুরনো গাছ দেখায়, যার গায়ে এখনো বাঁধা কাপড়ের ছেঁড়া টুকরো। অদিতির বুকের ভিতর শিউরে ওঠে—এটাই সেই গাছ, যেটা ড্রোনের ভিডিওতে ছিল।
দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাম্পের চারপাশে অস্বাভাবিক জিনিস শুরু হয়। ক্যামেরাগুলো যেগুলো নির্দিষ্ট করে বসানো হয়েছিল বাঘের গতিবিধি ধরার জন্য, তাদের বেশিরভাগই অকেজো হয়ে যায়। কিছু ভিডিওতে শুধু ফ্রেম ঝাঁকুনি, কিছুতে আগুনের মতো জ্যোতি—কিন্তু উৎস নেই। অদিতি একটা ক্লিপে দেখে, রাত তিনটার দিকে ক্যাম্পের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে এক নারীছায়া—সাদা আলখাল্লায়, তার গায়ের ছায়া মিশছে গাছের গুঁড়িতে, যেন সে মাটি ছুঁয়েও ছুঁচ্ছে না। তার পেছনে হালকা বাঁশির মতো শব্দ। জয়ন্ত বলে, “এটা কোনো প্রাণী নয়। আর যদি মানুষ হয়, তবে আমাদের এখানকার থাকা আরও বিপজ্জনক।” সম্রাট বলে, “ওটা মানুষ নয়, অন্তত যার চোখে আমি দেখেছি।” তার ঠোঁট শুকিয়ে আসে, সে জানে, যা সে দেখেছে, তার ভাষা নেই। সেই সন্ধ্যাবেলা বীরাজ আরও কিছু পুরনো কাহিনি শোনায়—জানায়, এই এলাকায় নাকি একটা গোষ্ঠী একসময় তন্ত্রসাধনার চর্চা করত। তারা বিশ্বাস করত, বনবিবি আসলে এক রূপান্তরিত শক্তি—তাকে ডাকলে সে আসে, কিন্তু যাকে সে পছন্দ করে না, তার আত্মা আর ফিরতে পারে না। সে বলে, “তোমরা শুধু দেখে যাচ্ছো, অথচ বোঝো না—তোমাদের একজনকে হয়তো ও পছন্দ করেছে। ডাক দিয়েছে। আর সেই ডাকে যার সাড়া পড়ে, সে আর নিজের মতো থাকে না।”
সন্ধ্যা গড়ায়। মাটির উপর কুয়াশার মত ধোঁয়া জমতে শুরু করে। ক্যাম্পে আলো জ্বলে থাকলেও যেন জঙ্গল ধীরে ধীরে আলোর উপরে ঢেকে পড়ছে, চাপা দুঃস্বপ্নের মতো। ঠিক তখনই, জয়ন্ত চিৎকার করে ওঠে, “এই দেখো! এই দেখো!” সে ল্যাপটপে একটা ক্লিপ চালাচ্ছে। পুরনো ১৯৭৮ সালের ফাইল থেকে পাওয়া একটি ভিডিও—কোনোভাবে রিকভারি করা গিয়েছিল। তাতে দেখা যায়—একজন গবেষক, তাঁর মুখ আংশিক দেখা যাচ্ছে, কাঁদছেন আর বলছেন, “ও বলেছে আমাকে এখানে থেকে যেতে হবে… আমি আর ফিরতে পারব না…” এবং শেষ মুহূর্তে ক্যামেরায় ধরা পড়ে সেই চেনা চোখজোড়া—একদম একই, যা আজ রাতে সম্রাট দেখেছিল। ক্যাম্পে চুপচাপ নামছে এক অবর্ণনীয় ভয়ের ছায়া। তারা জানে, আর কোনও বিজ্ঞান, কোনও যুক্তি, কোনও যন্ত্র তাঁদের সাহায্য করতে পারবে না—যদি না তাঁরা বুঝতে পারেন, কে সেই ডাক দিচ্ছে, আর কাকে বেছে নিয়েছে সে?
পাঁচ
সকালে জঙ্গলের বাতাস ছিল কেমন যেন গা-ছমছমে ভারী, আর মাটির গন্ধে লেগে ছিল যেন পচনশীল কোনো অতীতের ছায়া। চা খাওয়ার সময় বীরাজ হঠাৎ জানায়, “তিন কিলোমিটার দক্ষিণে একটা ছোট দ্বীপ আছে, স্থানীয় ভাষায় একে ‘অন্তর্জন’ বলে ডাকা হয়। ওখানে কেউ যায় না। অনেক পুরনো দিনের মানুষ বলে, ওই দ্বীপে একসময় এক বিধবা নারী থাকত, যার সঙ্গে বাঘও চোখ মেলাতে ভয় পেত। এখন জায়গাটা পরিত্যক্ত, কিন্তু গাছগুলো… গাছগুলো বেঁচে আছে অন্যরকমভাবে।” কথাটা শুনে বাকিরা থমকে যায়। অদিতি অবাক হয়ে বলে, “আমরা তো ম্যাপে এমন কোনও দ্বীপ দেখিনি।” জয়ন্ত তখনই নিজের ল্যাপটপ খুলে স্যাটেলাইট চিত্র ঘাঁটতে থাকে, কিন্তু অদ্ভুতভাবে সেই দ্বীপের কোনো অস্তিত্ব সেখানে নেই। সম্রাট বলে, “এই জায়গার অনেক কিছুই তো ম্যাপে থাকে না। হয়ত এই দ্বীপটা কেবল তাদের জন্য, যারা কিছু দেখতে প্রস্তুত।” শেষপর্যন্ত, সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, একটা ছোট নৌকা করে দুপুরের মধ্যে ওই দ্বীপে যাওয়া হবে। বীরাজ খুব একটা উৎসাহী নয়, কিন্তু বলে, “যাও, তবে সূর্য ডোবার আগেই ফিরে আসতে হবে।” ঠিক দুপুরে, চারজন মিলে রওনা হয় এক স্যাঁতসেঁতে খাঁড়ির পথ ধরে। মাঝপথে গাছের ফাঁক দিয়ে প্রথমবার চোখে পড়ে সেই দ্বীপ—নামহীন, কিন্তু অদ্ভুতভাবে মায়াময়। গাছগুলো সাধারণের মতো নয়; তাদের ডালপালা কেমন বাঁকা, যেন বাতাসেও কাঁপে না। বোট যখন তীরে লাগে, চারপাশে যেন একরকম শব্দহীনতা নেমে আসে—না পাখির ডাক, না হাওয়ার আওয়াজ—শুধু নিঃশব্দতা, যা কানে ভেসে নয়, ঢুকে যায় হাড়ের মধ্যে।
দ্বীপে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই জয়ন্তের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, “এখানে কিছু একটা আছে। যেন কেউ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল।” দ্বীপের মাটি অন্যরকম, ঘন কাদা আর লালচে খনিজে ভরা। গাছগুলো কাছ থেকে দেখে বোঝা যায়, এদের গায়ে পুরনো চিহ্ন—হাতের ছাপ, আঁচড়ের দাগ, আর কোথাও কোথাও লাল সুতো বাঁধা। মনে হয় যেন বহু আগে কেউ এখানে পুজো দিত। হঠাৎ সম্রাট একটা গাছের গোড়ায় দেখতে পায় ছেঁড়া একখানা কাপড়—ময়লা ধূসর রঙের, তাতে পুরনো রক্তের দাগ। অদিতি তার পাশে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট শুনতে পায়—জঙ্গলের ভিতর থেকে ভেসে আসছে এক নারীকণ্ঠ, যেন কারও নাম ধরে ডাকছে। “অ-দি-তি…” একেবারে ধীরে ধীরে, দীর্ঘ টান দিয়ে, যেন বাতাসকেই ধারালো করে দিচ্ছে সেই স্বর। সে চমকে ওঠে। পিছনে তাকায়—কেউ নেই। কিন্তু সেই ডাক তার মাথার মধ্যে বাজতে থাকে, আবার, আবার, আবার। জয়ন্ত তখন বলে, “এই দ্বীপেই হয়তো সেই পুরনো গবেষণা দলের শেষ চিহ্ন রয়েছে। আমরা হয়ত ইতিহাসের সেই চাপা অংশে এসে পড়েছি, যা কেবল গল্পে থেকে গেছে।” তারা দ্বীপের ভিতর দিকে এগিয়ে যায়, আর মাঝপথে তারা দেখতে পায় এক পুরনো কাঠের কুঁড়েঘর—ভেঙে পড়া, অর্ধেক ডুবে কাদায়, কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে কেউ একসময় এখানে থাকত। ঘরের ভেতরে একটা পুরনো বাক্স পাওয়া যায়, যেটার ভিতর থেকে মেলে কিছু ক্ষয়প্রাপ্ত কাগজ—লিখে আছে, “Day 5 – We heard her again. She is inside us now.” এই নোটের নিচে এক ছায়ামূর্তির আঁকাবাঁকা ছবি—দুই চোখ, কোনও মুখ নেই। অদিতির হাতে কাগজটা কাঁপছে। “She is inside us”—মানে কি?
দ্বীপে থাকা যত দীর্ঘ হয়, চারপাশের বাস্তবতা তত বিকৃত হতে শুরু করে। সময় থেমে যায়, ঘড়ির কাঁটা একই জায়গায় আটকে থাকে। বাতাস দিক পাল্টায় না, কেবল একরকম ভ্যাপসা ঘনত্ব নিয়ে চেপে বসে ফুসফুসের উপর। তখনই সম্রাট বলেন, “আমার ক্যামেরার ব্যাটারি শেষ হয়ে যাচ্ছে, অথচ আমি তো চার্জ করেছি।” জয়ন্ত বলে, “আমার ফোনেও নেট নেই। জিপিএস বন্ধ।” তখন বীরাজ, যে দ্বীপে পা না রেখেই বোটে বসে ছিল, চিৎকার করে ডাকে, “চলো! সূর্য নামছে!” চারজন দ্বীপ থেকে ফিরে আসতে চায়, কিন্তু তীরের পথ যেন আগের চেয়ে দীর্ঘ, অচেনা। কাদায় পা ডুবে যাচ্ছে। কিছুটা হাঁটার পরেই জয়ন্ত পেছনে ফিরে চিৎকার করে ওঠে, “এই… আমরা যে পথ দিয়ে এসেছিলাম, সেটা তো নেই!” তারা ঘুরপথে হাঁটতে শুরু করে, কিন্তু চারদিকের গাছ এখন আরও কাছে এসে গেছে, ডালপালা যেন তাদের ছুঁয়ে যেতে চাইছে। ঠিক তখনই, অদিতি আবার সেই ডাক শুনতে পায়। এবার স্পষ্টতর, “তুমি তো আমার… তুমি ফিরেছ… আমি তোমার ভিতরেই আছি…” ভয় আর বাস্তবতা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। কোনো রকমে তারা কাদার মধ্যে দিয়ে হেঁটে বোটে পৌঁছায়। বীরাজ তাদের মুখ দেখে কিছু বলে না, শুধু মৃদু কণ্ঠে বলে, “যারা ডাক শুনে যায়, তারা আর আগের মতো ফেরে না।” ক্যাম্পে ফিরে আসার পর অদিতি নিঃশব্দে ঘরে ঢোকে, দরজা বন্ধ করে দেয়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে নিজেকে দেখে—কিন্তু চোখের ভিতর কিছু অচেনা ঝিলিক। যেন অন্য কারও উপস্থিতি।
ছয়
সেই রাতটা ক্যাম্পে যেন পাথরের মতো নেমে আসে। কেউ কিছু বলে না, শুধু নিঃশব্দে সবাই নিজ নিজ ঘরে সরে যায়। অদিতি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার ভিতরে কেমন যেন এক ভিন্ন স্পন্দন, যা সে আগে কখনও অনুভব করেনি। গলার কাছে একটা ভার যেন জমে উঠছে, বুকের ভিতরটা টান টান। হঠাৎ করে তার মনে পড়ল, ছোটবেলায় একবার সে জ্বরে ঘোরে দেখেছিল—একটা অচেনা মহিলা তাকে জঙ্গলের দিকে ডাকছে, হাতে একফালি লাল কাপড়। আজ এত বছর পর, সেই ছবিটা আবার ফিরছে, আগের চেয়ে অনেক স্পষ্টভাবে। আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে দেখতে সে যেন ভুলে যাচ্ছে সে কে। তার ঠোঁট অল্প কাঁপে, এবং আয়নার ভিতরের মুখ যেন এক সেকেন্ড দেরিতে কাঁপে—কিছু একটা অস্বাভাবিক। দরজার ওপারে তখনও বাইরে ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা শব্দ, কিন্তু তার মাঝে মাঝে এক অদ্ভুত কণ্ঠ—মানুষের নয়, জানোয়ারের নয়, বরং একান্ত ‘জঙ্গলের’। অদিতি চোখ বন্ধ করে। তখনই তার কানে বাজে সেই পরিচিত স্বর: “তুইই তো আমার শরীর… তোর ভিতরেই আমি বাস করব এবার…” সে চমকে উঠে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে। হঠাৎ চোখে পড়ে, সম্রাট ক্যাম্পের পেছনের কর্নারে দাঁড়িয়ে আছে একা, একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে জঙ্গলের গভীরের দিকে।
অদিতি ধীরে গিয়ে পাশে দাঁড়ায়। সম্রাটের মুখে আতঙ্ক নয়, বরং একরকম বুঁদ হওয়া ভাব। সে বলে, “তুমি অনুভব করছো না অদিতি? আমরা এখানে শুধুই গবেষণা করতে আসিনি। এটা একটা ডাক ছিল। আমরা সেই ডাকে সাড়া দিয়েছি। আর এখন… তারা আমাদের ভিতর ঢুকছে।” অদিতি কাঁপা গলায় বলে, “তুমি কাদের কথা বলছো?” সম্রাট চোখ নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, “ছায়ারা। যাদের শরীর নেই, নাম নেই। যারা এই জঙ্গলের শরীর থেকে জন্ম নেয়। আমি এখনো প্রতিরোধ করছি, কিন্তু তুমি… তুমি তো অনেক দূর চলে গেছো অদিতি।” সেই মুহূর্তে পিছন থেকে বীরাজ আর জয়ন্ত এসে পড়ে। জয়ন্ত অবাক হয়ে বলে, “তোমরা এখানে দাঁড়িয়ে আছো? আমরা তো খুঁজেই পাচ্ছিলাম না!” বীরাজ চোখ সরু করে অদিতির দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন কিছু বুঝে ফেলেছে। তারপর ধীরে বলে, “তুমি কি আজ কোনো আয়নায় তাকিয়েছিলে?” অদিতি থতমত খেয়ে মাথা নাড়ে। বীরাজ গম্ভীরভাবে বলে, “এই বন আয়না ভালোবাসে না। আয়নায় আত্মা আলাদা হয়ে যায়। আর এই জঙ্গল, সে তো খালি শরীর চায়।” কথাটা শোনা মাত্রই জয়ন্ত বলে, “আমরা আর একদিনও এখানে থাকতে পারি না। আমি আজই এক্সট্রাকশন টিমকে বার্তা পাঠাবো।” কিন্তু সেই মুহূর্তেই তারা দেখে—ক্যাম্পের রেডিও ডিভাইস বিকল হয়ে গেছে। কোনো সংকেত যাচ্ছে না, আসছেও না। আশপাশে কেবল জঙ্গলের নিশব্দ ঢেউ।
রাত বাড়ে। ক্যাম্পে ফেরার সময় চারপাশে কুয়াশা জমেছে। কেউ কিছু বলে না। সকলে ভেতরে ভেতরে জানে, পরিস্থিতি আর তাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। সম্রাট নিজের ঘরে ফেরার পর আচমকা দরজা বন্ধ করে দেয়, আর কেউ তাকে বাইরে বেরোতে দেখে না। জয়ন্ত আতঙ্কে ঘরে বসে, নিজের হাতে বাঁধা রুপোর ব্রেসলেটটা চেপে ধরে—যা সে ছোটবেলায় দাদুর কাছ থেকে পেয়েছিল, বলা হয়েছিল “এটা তোর রক্ষাকবচ”। সে জানে না তাতে কতটা কাজ হবে, তবুও বিশ্বাস ছাড়া এখন আর কিছু অবশিষ্ট নেই। বীরাজ সেই রাতটা জেগে থাকে। চোখ বন্ধ করে বনের শব্দ শুনতে চায়—আর সে বোঝে, ছায়ারা এবার খেলা শুরু করেছে। তারা শরীর বেছে নিয়েছে, স্মৃতি বেছে নিয়েছে, আর এখন চূড়ান্ত সংযোগ ঘটবে। আর তখনই, রাত প্রায় তিনটের সময়, ক্যাম্পের ঠিক মাঝখানে অদিতিকে দেখা যায় দাঁড়িয়ে—সাদা রাতপোশাকে, চোখ দুটি কেমন ফাঁপা, ভেতরে কোনো আলো নেই। সে যেন হাঁটছে না, ভাসছে। তার মুখের কোনে অল্প হাসি, কিন্তু সে হাসি যেন মানুষের নয়। জয়ন্ত দরজা খুলেই এক ঝটকায় পিছিয়ে পড়ে। “অদিতি!”—সে ডাকে। কিন্তু সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই রূপ তাকে দেখে না, শুধু একটা কথা বলে—“আমরা তো এক হয়েই এসেছি, এখন আলাদা হবার কিছু নেই।” আর ঠিক তখনই ক্যাম্পের আলো নিভে যায়।
সাত
বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পুরো ক্যাম্প ঢেকে গেল নিঃশেষ এক অন্ধকারে। বাতাস থেমে গেল, যেন জঙ্গল নিজে নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। অদিতির ছায়ামূর্তি তখনও ক্যাম্পের মাঝখানে দাঁড়িয়ে। জয়ন্ত আর বীরাজ জ্বলন্ত টর্চ নিয়ে তার দিকে এগোতে চাইলেও শরীর যেন জমে যায়—এক পা এগোতে গিয়েও গা ঘিনঘিনে ঠান্ডা কাদায় আটকে পড়ে। তখনই একবার বজ্রের ঝলকে তারা দেখতে পেল—অদিতির মুখে স্পষ্ট হাসি, কিন্তু সেই হাসির পেছনে এক গভীর শূন্যতা, যেন তার শরীরে ঢুকে বসে আছে অন্য কিছু। ঠিক তখনই সে হঠাৎ পেছন ফিরে বনের দিকটায় তাকায়, এবং একবারে জোরে বলে ওঠে, “আমি তৈরি… এবার তুমি আসো!” কথা শেষ হতে না হতেই অদিতির শরীর কেঁপে ওঠে, যেন তার মেরুদণ্ড বেয়ে উঠে আসছে কোনো জ্যান্ত কিছু। জয়ন্ত তৎক্ষণাৎ দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরে ফেলে—তার শরীর কাঁপছে, জ্বর আসা শরীরের মতো গরম। সে শুধু ফিসফিসিয়ে বলে, “আমার ভিতরে কেউ কথা বলছে… আমি তাকেই বলছি চুপ করো, কিন্তু সে শোনে না। তোমরা পালাও… ও আসছে।” এতটুকু বলেই সে নিস্তেজ হয়ে পড়ে যায় বৃষ্টিভেজা মাটিতে।
তাদের কাছে সময় তখন এক থেমে যাওয়া নদী। বীরাজ আর জয়ন্ত মিলে অদিতিকে ঘরে নিয়ে আসে। ঘরের ভিতর মেঝেতে মাদুর পেতে তাকে শোয়ানো হয়, আর বাইরে থেকে দরজা আটকে দেওয়া হয়। সম্রাটের ঘর তখনো বন্ধ। তাকে একাধিকবার ডাকলেও সাড়া নেই। জয়ন্ত বাধ্য হয়ে দরজা ভাঙে—ভেতরে ঢুকে দেখে সম্রাট এক কোণে বসে, মাথা নিচু করে, তার পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পাতা, সুতো, আর অদ্ভুত কিছু প্রতীকচিহ্ন। দেয়ালে সে লিখে রেখেছে ক’টা লাইন:
“সবাই ভাবে জঙ্গলে গাছেদের আত্মা থাকে। কিন্তু তারা জানে না, আত্মারাও গাছে থাকে। ছায়ারা চুপ করে দেখছে। আমি আর চোখ তুলতে পারি না।”
সম্রাটের চোখজোড়া যেন রক্তবর্ণ, তবু শান্ত। সে বলল, “আমি ওকে ডেকেছিলাম না, কিন্তু ও এসেছে। অদিতি তো ওর দরজা মাত্র। তুমি জানো, কেউ কেউ আত্মার বাহক হয়—তারা নিজেরা জানে না, কিন্তু তাদের ভিতর দিয়ে খুলে যায় অন্য জগতের দরজা।” জয়ন্ত বুঝতে পারে, বিজ্ঞান আর বাস্তবতা থেকে তারা বহু দূরে এসে গেছে। সে সম্রাটের হাত ধরে বাইরে আনে। তখন বীরাজ বলে, “শোনো, আমি একটা পথ জানি—পুরনো এক জোড়া গাছের নিচে এক জায়গা আছে, যেখানে স্থানীয়রা বলে, ‘ছায়ার ছায়া পড়ে না’। আমরা ওখানে যেতে পারলে হয়তো ওকে বাঁচানো যাবে।” রাতে, এক ঝড়ো বাতাসে তারা বেরিয়ে পড়ে, অদিতিকে কাপড়ে মুড়ে কাঁধে তুলে। পথে গাছেরা শব্দ করে উঠছে, যেন কিছু জানাচ্ছে, কিছু আঁচ দিচ্ছে। তারা হাঁটছে এক বুক কাদা ডিঙিয়ে, বাঁশ ঝোপ ভেঙে, পোকা-মাকড় আর অচেনা ছায়ার মধ্যে দিয়ে।
ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর তারা এসে পৌঁছায় সেই দুই বিশাল পুরনো গাছের নিচে। সেখানে মাটির গায়ে স্পষ্ট দাগ, যেন বহু বছর আগে কেউ বারবার পায়ের ছাপ এঁকে রেখে গেছে এখানে। অদিতিকে সেখানে শুইয়ে রেখে বীরাজ হাতে বাঁধা সুতো খুলে নেয়, একফালি লাল কাপড় তার কপালে রাখে, আর গলায় কিছু অস্পষ্ট শব্দে মন্ত্র ফিসফিস করে। অদিতি নিঃসাড়, কিন্তু হঠাৎই তার মুখ কাঁপে, চোখ খুলে বলে ওঠে, “ও চায় না আমি ফিরি। ও চায় আমি ওর মতো হই। আমার শরীর তো ওর জন্য তৈরি ছিল।” সে চিৎকার করে ওঠে, তার শরীর ফেঁপে ওঠে এক মুহূর্তের জন্য, আর তখনই বৃষ্টির একঝলক নামে। বৃষ্টির ধারা যেন মন্ত্রের মতো ছড়িয়ে পড়ে, এবং কিছুক্ষণ পরে অদিতির নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হয়। জয়ন্ত, সম্রাট, বীরাজ—all collapse on the wet soil, যেন জীবন একটুখানি সময় ফেরত দিয়েছে।
আট
রাত পেরিয়ে ফর্সা সকাল হয়, কিন্তু জঙ্গলের রোদ যেন সোনালি নয়—ম্লান, মিশে থাকা এক রকম ধুলোয় ভরা আলো। অদিতি ধীরে ধীরে চোখ মেলে, আর বুঝতে পারে সে কোথাও একান্ত নীরবতায় ছিল। তার শরীর ভারী, কিন্তু মাথা ঝলমলে পরিষ্কার, যেন অনেক দিন পর ভেতরের এক শূন্যতা নিঃশেষ হয়ে গেছে। পাশে বসে থাকা জয়ন্ত কাঁপা গলায় বলে, “তুই ঠিক আছিস?” অদিতি চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর বলে, “ভিতরে কেউ ছিল। আমি জানতাম না। ও আমার স্বপ্নে এসেছিল ছোটবেলাতেই, কিন্তু আমি ভুলে গিয়েছিলাম। ও বলেছিল, আমি যদি জঙ্গলে যাই, ওর দরজাটা খুলে যাবে।” সম্রাট হঠাৎ বলে ওঠে, “দরজা তো খুলেই গেছে। কিন্তু এটা শুধু ওর নয়, আমাদেরও। আমরা সবাই এই জঙ্গলের অংশ। কেউ তা জানে, কেউ তা অস্বীকার করে।” বীরাজ তখন বলে, “আমরা এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে বেরোতে হবে। কিন্তু একবার শেষ কথা জেনে যেতে হবে—‘মুখো বনবিবি’ কে? এবং কেন এত ভয় এই চরিত্র নিয়ে?” সে নিজের ব্যাগ থেকে একটা পুরনো কাপড়মোড়া খাতা বের করে। খাতাটা সে পেয়েছিল গ্রাম থেকে, এক বয়স্ক মৎস্যজীবীর ঘরে। পাতায় পাতায় আঁকা কালি দিয়ে—এক নারীর মুখ, কখনো হাসি, কখনো গম্ভীর, কখনো ভয়ংকর।
বইটায় লেখা ছিল, “বনবিবি আসলে এক আত্মার নাম, সে রক্ষাকর্ত্রীও, আবার শাস্তিদাত্রীও। তবে মুখো বনবিবি আলাদা—তিনি মুখ ঢেকে থাকেন, কারণ তাঁর চোখে দেখলে মানুষের আত্মা কাঁপে। তাঁকে ডাকা হয় না, তিনি নিজেই ডাকেন। যে তাঁর ডাকে সাড়া দেয়, তার ভাগ্য নির্ধারিত হয়। কেউ ফেরে, কেউ ফেরে না। মুখো বনবিবি সর্বত্র নয়—তিনি থাকেন শুধু সেই জায়গাগুলোতে, যেখানে জঙ্গল নিজেই বেছে নেয় কে প্রবেশ করবে।” জয়ন্ত তখন বলে, “তাহলে সেই নারীমূর্তি, যাকে আমরা দেখেছি, যার ছায়া আলোর নিয়ম মানে না… সে-ই কি মুখো বনবিবি?” বীরাজ মাথা নাড়ে, “না। সে তাঁর ছায়া মাত্র। মুখো বনবিবি স্বয়ং কখনও প্রকাশ্যে আসেন না, কিন্তু যাদের ভিতরে তিনি প্রবেশ করেন, তারাই তাঁর বাহক হয়ে ওঠে। অদিতি এখন সেই সীমারেখা ছুঁয়ে ফিরেছে। আমরা যদি এখন চলে যাই, হয়তো রক্ষা পাওয়া যাবে। কিন্তু দরজাটা একবার খোলা হয়ে গেছে। ও আর বন্ধ হবে না।” সেই মুহূর্তে অদিতি চুপ করে বলে ওঠে, “আমি ওঁকে দেখেছি। একটিবার। আমার আয়নায় না, আমার চোখের ভিতরে। উনি দাঁড়িয়ে ছিলেন, মুখ ঢাকা, কিন্তু চারপাশে বাতাস ঘূর্ণি খাচ্ছিল, আর একটাই কথা বলছিলেন—‘তোমরা তো সত্যি জানতে এসেছো, তাহলে কেবল দেখে ফিরে যাবে কেন?’”
এই কথার পর ক্যাম্পে অদ্ভুত পরিবর্তন আসে। রাত্রিবেলা যেসব শব্দ শোনা যেত, সেগুলো কমে আসে। ক্যামেরাগুলো আবার কাজ করা শুরু করে, যদিও মাঝে মাঝে এক-আধটা ফ্রেমে অদ্ভুত সব আলোর রেখা দেখা যায়। সম্রাট বলে, “উনি আমাদের পরীক্ষা করছিলেন। আমরা ভিতরে যাইনি, কিন্তু ছুঁয়ে গিয়েছি সেই সীমানা, যেখান থেকে মানুষ ফিরে এলেও বদলে যায়।” জয়ন্ত একটি নতুন ফাইল খুলে তাতে শিরোনাম লেখে: “Project Mukho – The Unseen Guardian of the Mangroves.” সে জানে, এই কাহিনি হয়তো ছাপা হবে না, হয়তো প্রকাশিত হবে না কোনো জার্নালে, কিন্তু তার প্রয়োজন আছে—প্রমাণ রাখার জন্য, নিজের ভিতরের ভয়টাকে ঠোঁটের ভাষায় পরিণত করার জন্য। সেই সন্ধ্যায় তারা জঙ্গলের সীমানা ছাড়িয়ে গ্রামের দিকে পা বাড়ায়। পেছনে রেখে আসে সেই ক্যাম্প, সেই দ্বীপ, সেই ছায়াময় রাত। বীরাজ একবার থেমে পেছন ফিরে দেখে, মুখে মৃদু হাসি, “এই জঙ্গল কাউকে আসতে বলে না, কিন্তু যদি কেউ আসে… তাকে ফিরিয়ে দেয় না। আমরা বেরিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু কেউ কেউ থেকে গেছি। হয়তো ভবিষ্যতে, কেউ আবার এই পথে আসবে… তখন আবার দরজাটা খুলবে।” আর দূরে, গাছেদের ছায়ার ফাঁকে—এক মুহূর্তের জন্য দেখা যায় এক মুখ ঢাকা নারী দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর মুখে এক অচেনা প্রশ্রয়, আর চোখে… সময়হীনতা।
–
দু’বছর কেটে গেছে। কলকাতার ব্যস্ত শহর, যানজট, ধোঁয়া আর কনক্রিটের ফাঁকে আবার নতুন করে গড়ে উঠেছে জয়ন্ত, অদিতি আর সম্রাটের দৈনন্দিন জীবন। কিন্তু মনের ভিতরে এক নিরব এলাকা থেকে গুমরে ওঠে সুন্দরবনের সেই কয়েকটা রাত, সেই অন্ধকার ছায়া, সেই অচেনা ডাক। জয়ন্ত এখন একটি গবেষণা সংস্থায় কাজ করে, তার ডেস্কে একটা ছবি রাখা—দুই বিশাল গাছ, আর মাঝখানে ঘন কুয়াশা। পাশে ছোট করে লেখা, “The Door Was Real.” অদিতি এখন যোগ দিয়েছে একটি সংরক্ষণ প্রকল্পে, যেখানে সে স্থানীয় বনবাসীদের সঙ্গে কাজ করে পরিবেশ শিক্ষা নিয়ে। সে বাইরে থেকে স্বাভাবিক, হাসিমুখো। কিন্তু আয়নার সামনে দাঁড়ালে আজও সে অনুভব করে—চোখের ঠিক পিছনে কেউ আছে। যে সবসময় চুপ করে তাকিয়ে থাকে, কোনো দাবি নেই, কিন্তু উপস্থিতির ভারে কখনো নিঃশ্বাস আটকে আসে। সম্রাট আর ফিরে যায়নি ক্যামেরার পিছনে। সে এখন লেখে—ভয়ের সাহিত্য, লোককথার পুনর্পাঠ, শহরের পাঠকদের জঙ্গলের কথা বোঝাতে চায়। কিন্তু তার লেখার একেকটি পাতা যেন নিজেই ভয় পায় নিজের শব্দকে।
তাদের সেই যাত্রার কোনো সরকারি রেকর্ড নেই। সরকারি ভাষায় সুন্দরবনের সেই অঞ্চলটি “অগম্য ও মানববিরল” এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। জয়ন্ত বহুবার চেয়েছে সেই তথ্যগুলো প্রকাশ করতে—ড্রোন ফুটেজ, ক্যামেরা ক্লিপ, বনের ভিতরে পাওয়া সেই আঁকাগুলি, মুখো বনবিবির কাহিনি। কিন্তু প্রত্যেকবার কোথা থেকে যেন একটা অদৃশ্য প্রতিবন্ধকতা এসে দাঁড়িয়েছে। কোনো ফাইল আপলোড হতে চায় না, কোনো সার্ভার গ্রহণ করে না, আর অদিতি বারবার বলে, “সব কিছু বলাও ঠিক নয়। কিছু গল্প গল্প হয়েই বাঁচুক।” একদিন সন্ধ্যায় তারা তিনজন এক ক্যাফেতে দেখা করে, খুব স্বাভাবিকভাবে—চা, পুরোনো কথা, অফিসের গল্প। কিন্তু কথার মাঝখানে হঠাৎ সম্রাট চুপ করে যায়। সে ধীরে বলে, “তোমরা জানো? আমি কিছুদিন আগে স্বপ্নে দেখেছিলাম—সেই দ্বীপটা আবার ফিরেছে। এবার আমি একা গিয়ে পৌঁছলাম। গাছগুলো আরও কাছে চলে এসেছে। এবং এইবার… মুখো বনবিবি মুখোশ খুলেছিলেন।” কথাটা বলেই সে থেমে যায়, এবং তার চোখে যে ধরণের বিষণ্ণতা, তা কিছু বলার চেয়ে অনেক বেশি কিছুর ইঙ্গিত দেয়।
জয়ন্ত হেসে বলে, “তাহলে আবার যেতে হবে?” কিন্তু সেই হাসির নিচে এক চাপা ভয় লুকোনো থাকে। তারা জানে, সেই জায়গা, সেই জঙ্গল, সেই ডাক—সেটা একবারই আসে না। কিছু মানুষ জন্মায় যারা সেই ডাকে সাড়া দেয়। কেউ বুঝে, কেউ না বুঝেই পা বাড়ায়। জয়ন্তের ডেস্কে একটা অদ্ভুত পোস্টকার্ড পড়ে থাকে একদিন—কোনো প্রেরকের নাম নেই, শুধু একটাই লাইন লেখা:
“The door is open again. Will you walk through?”
সে চুপ করে বসে থাকে অনেকক্ষণ। জানে, সিদ্ধান্ত আবার তার—তবে এবার আর গবেষণার জন্য নয়, আত্মার খোঁজে।
সমাপ্ত




