তন্বী মিত্র
১
কলকাতার এক পুরনো দোতলা বাড়ির ছাদে বসে ঈশিতা প্রতিদিন রাত নামার অপেক্ষায় থাকে। ঘড়ির কাঁটা নয়, তার সময়টা চলে আকাশের আলো বদলের সঙ্গে। সন্ধ্যা নামার একটু পরেই যখন শহরের কোলাহল মিইয়ে আসে, আর হালকা ঠান্ডা হাওয়া এসে কানে ফিসফিসিয়ে বলে—”এবার ওঠো,” তখন সে তার কাঠের চেয়ারে বসে ছাদে এসে হাজির হয়। তার মুখে কোনো অভিব্যক্তি থাকে না, কিন্তু চোখে এক অদ্ভুত ঝিলিক খেলে যায়, যেটা শুধুই তারার আলোয় খুঁজে পাওয়া যায়। ঈশিতা জানে, সে একটা বিশেষ তারার জন্যই প্রতিদিন অপেক্ষা করে—একটা তারার যেটা প্রতিরাতে ঠিক একই জায়গায় জ্বলে, একই রকমভাবে, একইভাবে একা। তার ছাদের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ থেকে এক কোণ দেখা যায়, যেখান দিয়ে সেই তারাটি প্রতিদিন ধীরে ধীরে উঠে আসে, আর সেই আলোতেই সে প্রতিদিন নিজের ভিতরের কথা বলে যায়, এমনকি না বলেও।
ঈশিতার জীবনের গল্পটা হয়তো খুব সহজ, আবার হয়তো জটিল। বাবা-মা হারিয়েছে শৈশবে, মাসির কোলে বড় হয়েছে, আর বড় হতে হতে নিজের মনে এক কল্পনার জগৎ বানিয়ে নিয়েছে। ছোটবেলায় সে প্রথম তারাটা দেখে যেদিন মশারির ফাঁক গলিয়ে মাথা উঁচু করে আকাশে তাকিয়েছিল, সেদিন থেকেই তার বিশ্বাস জন্মায়—এই আলোর মধ্যে কিছু আছে, কিছু এমন যা শুধুই তার জন্য। স্কুলে বন্ধুরা যখন প্রেমপত্র লিখত, ঈশিতা তারার উদ্দেশ্যে লিখে রাখত ছোট ছোট কবিতা। কলেজে এসে অন্য মেয়েরা যখন ‘ডেটিং অ্যাপ’ ঘাঁটত, ঈশিতা তখনও তার ডায়েরির মধ্যে একটা পাতায় একটা করে তারার নাম লিখে রাখত—‘আলোকবিন্দু’, ‘শ্বেতশিখা’, ‘অদৃশ্য বন্ধু’। তার প্রথম প্রেমিক ছিল সেই তারা, যার নাম ছিল না, শুধু জায়গা ছিল। সে চেয়েছিল কেউ একদিন এসে বলবে—“তুমি যে তারাটার কথা বলো, আমি সেটাকেই দেখি প্রতিদিন।” আর তাই আজ এত বছর পরও, জীবনে কেউ আসুক বা না আসুক, সে প্রতিরাতে উঠে পড়ে সেই একটিমাত্র তারার দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। এমনকি সে রাতে কোনো লেখা লেখে না, কিছু পড়ে না, কিছু শোনেও না—শুধু তাকিয়ে থাকে, কারণ তার বিশ্বাস সেই তারার ওপাশেও কেউ আছে, তাকিয়েই আছে তার মতো করেই।
ঈশিতা জানে, বাস্তব পৃথিবী এতটা রোমান্টিক নয়। এখানে সম্পর্ক মানে সময়, মানে বাধ্যবাধকতা, মানে অনলাইন নোটিফিকেশন। কিন্তু তার ভালোবাসা যেন কাঁচের মতো—ভাঙা যায়, স্পর্শ করা যায় না। তার সেই তারাটির জন্য প্রেম মানে অপেক্ষা, আর অপেক্ষা মানেই ধৈর্য। মাসি যখন রান্নাঘর থেকে বলে—“ঈশু, আবার ছাদে গেছিস বুঝি?” সে হেসে উত্তর দেয় না, শুধু বলে, “আজ তারা বেশি উজ্জ্বল, মাসি।” আসলে সে প্রতিদিন ভেবে চলে, যদি সত্যিই কোনোদিন কেউ আসে—যে বলবে, “আমি সেই তারাটির কথা জানি,” তাহলে সে চমকে যাবে না, কাঁদবে না, হয়তো শুধু একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলবে, আর বলবে, “আমি জানতাম।” কারণ প্রতিদিন এই ছাদে বসে, এই শহরের ভিড়ে, কোলাহলের মাঝে, চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা যে কেউ পারে না—এটা ঈশিতা জানে। এই অভ্যাস শুধু তাদের, যারা বিশ্বাস করে, ভালোবাসা কখনও স্পর্শের নয়, শুধু অনুভূতির; যারা জানে, অনেক দূরের আলোর মাঝেও নিজের গল্প লুকিয়ে থাকে, যদি কেউ খুঁজে পায়। আর তাই ঈশিতা প্রতিদিন সেই তারাটির নিচে বসে থাকে, আর ভাবে—“ওটা আমার জন্য অপেক্ষা করছে।” ঠিক যেমনভাবে সে অপেক্ষা করে… কাউকে না জেনে, না দেখে, শুধু অনুভব করে। সেই অনুভবই তার প্রেম, তার কবিতা, আর তার প্রতীক্ষা।
২
পুণের শহরতলির এক চুপচাপ পাহাড়ি বাড়ির ছাদে আহান রায় নিজের টেলিস্কোপ ঠিক করে। রাতের ঠান্ডা বাতাসে তার নীল সোয়েটার একটু ফুলে ওঠে, আর চোখের নিচে পড়ে হালকা ছায়া—যেমনটা পড়ে বহু রাত না ঘুমানোর পরেও, মন যখন ক্লান্ত হয় না। আহান একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী, দিনের কাজ রাতে শেষ হয়, কিন্তু নিজের কাজের বাইরেও একটা অভ্যাস সে কখনও ছাড়ে না—একটা নির্দিষ্ট তারার দিকে তাকিয়ে থাকা। সে জানে না কেন, ঠিক কোন টান তাকে ওই তারার দিকে টেনে নিয়ে যায়, কিন্তু গত সাত বছর ধরে সে ওই একই আলোর বিন্দুটিকে দেখে আসছে। সেই তারাটির কোনো নাম আহানের কাছে নেই, তবে সে নিজের মনে একে ডাকে “ছায়ার চোখ” নামে—কারণ প্রতিবার তার দিকে তাকালেই তার মনে হয় কেউ তাকিয়ে আছে, অনেক দূর থেকে। সে ভাবে, হয়তো পৃথিবীর অন্য প্রান্তে আরেকজন মানুষ—একজন মেয়ে, এই একই তারাটির নিচে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে ঠিক এই ভাবেই।
আহান সাধারণত বাস্তববাদী। বিজ্ঞান শেখায় তথ্য আর সূত্র, গাণিতিক পরিমাপ আর দূরত্বের হিসেব। কিন্তু এই এক তারা তার বিজ্ঞানকে অস্বীকার করে চলে, তার যুক্তিকে নরম করে দেয়, আর ভাবনার ভিতর কবিতার মতো করে ঢুকে পড়ে। সে জানে না ঠিক কখন এই অভ্যাসটা তার মধ্যে জন্ম নিয়েছে—হয়তো সেই রাত থেকে, যেদিন তার ছোটবেলার বাড়ির ছাদে উঠে প্রথম টেলিস্কোপে দেখে এই আলোর বিন্দুটিকে। মা তখন বলেছিলেন, “তুই যদি চুপচাপ ওই তারাটার দিকে তাকিয়ে থাকিস, হয়তো কেউ তোকে চিনে নেবে।” মা মারা গেছেন অনেক বছর—ক্যান্সারে, নিঃশব্দে, যেন জীবন থেকেও একদিন চুপ করে হেঁটে বেরিয়ে গেলেন। সেই শোক থেকেই হয়তো জন্ম নিয়েছিল আহানের রাতজাগা স্বভাব, আর ওই তারাটিকে নিজের একাকীত্বের সঙ্গী করা। কখনও কখনও সে ভাবে, হয়তো তার মায়ের আত্মা ওই তারায় রয়ে গেছে। আবার কখনও মনে হয়, একজন অচেনা মেয়ে তাকে দেখছে—কিন্তু সেটা বাস্তব নয়, বরং এক প্রকার টান যা না ছুঁয়ে অনুভব করা যায়।
রাত যখন গভীর হয়, তখন আহান তার ডায়েরির খোলা পাতায় লিখে রাখে ছোট ছোট বাক্য—“আজ তারাটি কাঁদছিল।”, “আজ মনে হলো, আমিও কাউকে খুঁজছি।” এই লেখা কেউ পড়ে না, এমনকি সে নিজেও দ্বিতীয়বার পড়ে না। কিন্তু লেখে, কারণ সেই তারা তার ভেতরের কথা শোনে বলে সে ভাবে। দিনের আলোতে আহান একজন সফল তরুণ বিজ্ঞানী—সম্মেলনে বক্তৃতা দেয়, গবেষণাপত্র লিখে, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের অফার পায়। কিন্তু রাত হলেই সে একটা ছেলেমানুষে পরিণত হয়—যে শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবে, কেউ তাকে একইভাবে দেখছে কিনা। সে ভাবনার গভীরে চলে যায় এতটাই, যে কখনও কখনও আকাশের অন্ধকারকে ছুঁয়ে সে বিশ্বাস করে—জীবনে কোনো একদিন একজন আসবে, যে বলবে—“তুমি যে তারাটির কথা বলো, আমি সেটাকেই দেখি প্রতিদিন।” আহান সেই অপেক্ষায় আছে, স্পর্শ নয়—শুধু একটা চোখের দেখা, অথবা শব্দহীন স্বীকৃতির। কিন্তু যত দিন যায়, সে বুঝে—এটা হয়তো কোনোদিন হবে না। তবুও সে প্রতিরাতেই ফিরে আসে ছাদে, সেই নিরব আলোর দিকে তাকিয়ে বলে, “আমি আছি”—আর সে জানে, হয়তো কোথাও একটা মেয়ে আছে, যে শুনছে এই না বলা কথাগুলো।
৩
ঈশিতা নিজের ডায়েরির পাতায় আজ রাতের তারাটার নাম রাখল—”অপেক্ষা”। প্রতিদিনই তার নাম বদলায়, কিন্তু অর্থ বদলায় না। এই নামগুলো সে কাউকে কখনও দেখায় না, এমনকি সৌমিককেও না, যে কিনা তার সব গল্পের প্রথম পাঠক, একদম শৈশব থেকে। সৌমিক জানে ঈশিতা একা থাকতে ভালোবাসে, ছাদের কোণে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে কী যেন খোঁজে। সে একবার ঈশিতাকে বলেছিল—”তুই কি কাউকে খুঁজিস নাকি ওখানে?” ঈশিতা হেসে বলেছিল, “খুঁজছি না… শুধু জানি, কেউ আছে।” এই কথাটার মানে সৌমিক বোঝে না, বোঝার চেষ্টাও করে না, শুধু পাশে দাঁড়িয়ে থাকে নিঃশব্দে। ঈশিতার এই নিঃশব্দ প্রেমের গল্পটা কেউ জানে না, জানার প্রয়োজনও পড়ে না। কারণ এটা বাস্তবের নয়, কোনো দৃশ্যমান মানুষের সঙ্গে নয়—এটা একটা তারার সঙ্গে, একটা অনুভবের সঙ্গে, যেটা ছুঁয়ে দেখা যায় না, শুধু প্রতিদিন মন দিয়ে অনুভব করতে হয়। সে ভাবে, প্রেম যদি ছোঁয়া না যায়, তবুও সেটা কি বাস্তব হতে পারে না? সে ভাবে, যদি কোনোদিন কেউ তার চোখে চোখ রেখে বলে—“আমি সেই তারাটিকেই দেখি,” তাহলে কি এই গল্পটা হঠাৎ শেষ হয়ে যাবে?
ঠিক সেই রাতেই, আহান পুণের পাহাড়ি ছাদে বসে ডায়েরির পাতায় লিখছে—”আজ তারার নাম দিলাম—’প্রতিধ্বনি’। হয়তো কেউ আছে, যে আজ আমায় ভেবেছে, জানে না আমায়, তবুও অনুভব করে।” সে ভাবে, এইভাবে যদি লেখা হয় দু’জনে, পৃথক শহরে বসে, একটিই তারাকে উদ্দেশ করে—তবে সেটা কি কাকতালীয়? নাকি কোনো গভীর টান, যেটা সময়কে অতিক্রম করে চলে আসে অনুভবের রেখায়? আহান কখনও কাউকে বলেনি তার এই অভ্যাসের কথা। বিজ্ঞানীদের এমন আবেগপ্রবণতা একধরনের ‘দুর্বলতা’ মনে করা হয় একাডেমিক মহলে। তবুও সে লুকিয়ে লেখে, লুকিয়ে চেয়ে থাকে, কারণ তার মনে হয়, কোনো এক অপূরণীয় মিলের টান রয়েছে ওই একবিন্দু আলোতে। তার জীবনে অনেক সম্মান, বহু মানুষের প্রশংসা, তবুও এই একাকীত্বের জায়গায় সে কাউকে বসাতে পারেনি। সে চায় না কেউ তাকে স্পর্শ করুক; সে চায় কেউ হঠাৎ বলে উঠুক—“এই তারা, আমিও দেখি।” এইটুকুই তার প্রেম। না চাওয়া, না বলা, শুধু অনুভবের মতো করে ভাগ করে নেওয়া কোনো এক অদৃশ্য আলো।
এইভাবে দুইজন মানুষ, দুইটা ভিন্ন শহর, ভিন্ন পেশা আর ভিন্ন জীবনের বাঁকে দাঁড়িয়ে, প্রতিদিন একটিমাত্র তারার দিকে তাকিয়ে সময় পার করে দেয়। তারা জানে না একে অপরের নাম, মুখ, অস্তিত্ব। কিন্তু তারা দু’জনেই একই অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করছে আলাদা ডায়েরির পাতায়, একই সময়, একই নৈঃশব্দ্যে। কেউ কাউকে ছোঁয় না, কোনো মেসেজ নেই, ফোন কল নেই, কনফারেন্স বা পার্টিতে দেখা হয় না—তবুও এই সম্পর্কটা ধীরে ধীরে এক গভীর, অদৃশ্য প্রেমের দিকে গড়ায়। এটা এমন এক প্রেম, যেটা কেবল অনুভবে জন্মায়, স্পর্শ ছাড়াই বাঁচে। দু’জনের হৃদয়ে তারা হয়ে জ্বলে থাকে শুধু সেই আলো—যার নাম কেউ জানে না, কিন্তু যার আলোয় দু’জন মানুষ, দুটি শহর, দুটি নিঃসঙ্গ হৃদয় প্রতিরাতে একসঙ্গে বসে থাকে, না জানার মধ্যে সবচেয়ে গভীর মিল খুঁজে পায়। তাদের এই সম্পর্ক বাস্তব নয়, তবুও মিথ্যা নয়। এটা ‘ছুঁয়ে না যাওয়া প্রেম’—যেটা শেষ হবে না, কারণ এটা কখনও শুরুই হয়নি।
৪
ঈশিতা আজ রাতে লেখার মন নিয়ে বসেনি। সে ডায়েরির পাতা খুলে রেখে বসে থাকে ছাদের রেলিংয়ের পাশে, যেন পাতাগুলোর ওপর রাতের বাতাস হেঁটে যাবে। হঠাৎ করেই তার চোখ পড়ে মোবাইল স্ক্রিনে—একটি অনলাইন ফোরামের বিজ্ঞাপন ভেসে উঠছে: “Star Whisper — এক নক্ষত্রপ্রেমীর আত্মা খুঁজে পাবে তার মিল।” ঈশিতা কৌতূহলী হয়ে পড়ে। নিজের পরিচয় না দিয়েই সে সেই ফোরামে প্রবেশ করে। নিঃসঙ্গ মানুষেরা এখানে তারার ছবি পোস্ট করে, তাদের অনুভব লেখে, কেউ কেউ কবিতাও শেয়ার করে। ঈশিতা প্রথম কয়েকটি পোস্ট পড়ে হেসে ফেলে, ভেবেছিল এটা হয়তো ছেলেমানুষি, কিন্তু এরপর একটি ব্যবহারকারীর লেখা নজর কাড়ে—নাম ‘Skybound’। সে লিখেছে, “একটা তারা আছে, যেটা আমি দেখি প্রতিদিন, কিন্তু তার আলো আমার চেয়েও দূরের কাউকে খোঁজে। আমি জানি, কেউ আছে, যে তাকিয়ে থাকে একদৃষ্টে, যেমন আমিও।” ঈশিতা মুহূর্তেই থেমে যায়। তার বুকের ভিতরে কিছু যেন ধাক্কা খায়—এই লাইনগুলো সে নিজেই লিখতে পারত, অথবা হয়তো লিখেওছে অন্য কোনো রাতে, অন্য কোনো পাতায়।
ঈশিতা নিজের প্রোফাইল খুলে একটা ছদ্মনাম রাখে—‘InkandLight’। সে কোনো শব্দ না বলে শুধু লাইক দিয়ে যায় Skybound-এর পোস্টে। রাত গভীর হলে সে ভাবে, উত্তর দেবে কি? নিজের কোনো একটি পুরনো লেখা তার মানিয়ে দেবে কিনা? শেষমেশ সে এক পঙক্তি লিখে দেয়: “যে তারা দু’জনকে এক সঙ্গে টানে, সে কি একা থাকতে পারে?” তার মনে হলো, হয়তো প্রতিউত্তর আসবে না, অথবা আসলেও সেটা নিছক এক সৌজন্য মন্তব্য হবে। কিন্তু পরদিনই সে দেখে Skybound উত্তর দিয়েছে—“তারা একা নয়, তারারা শুধু নিঃশব্দে আলোর ভাষায় কথা বলে।” ঈশিতা হতবাক হয়, কারণ এতটা সংবেদনশীলতা সে অনলাইন কথোপকথনে আশা করেনি। এরপর তাদের মাঝে ছায়াসম এক আলাপ শুরু হয়। কেউ কারও নাম জানে না, মুখ জানে না, কিন্তু কথাগুলো একের ভেতরের আরেককে চিনে ফেলে। Skybound কখনো একটা তারা নিয়ে গল্প লেখে, কখনো একটা প্রশ্ন ফেলে—“তোমার কাছে রাত মানে কী?” আর InkandLight লিখে—“রাত মানে এমন এক সময়, যেটা শুধু অনুভবের জন্য বানানো।” এমন করে করে ঈশিতা বুঝতে পারে, কেউ একজন আছে, যে তার হৃদয়ের ভাষা বোঝে—না দেখে, না জেনেও।
অন্যদিকে, আহান Skybound নাম নিয়ে এই ফোরামে খুব কম মানুষকে গুরুত্ব দেয়। তার ধারণা ছিল, তার মতো ভাবুক আর কেউ নেই, অথবা থাকলেও তারা মুখোশ পরে। কিন্তু InkandLight-এর প্রতিটি লাইনে তার চেনা সুর বাজে। তার মনে হয়, এই মেয়েটি তাকে দেখে, ছুঁয়ে না গিয়েই। সে প্রথমবারের মতো কারো কাছে নিজের ভিতরের কথা বলার সাহস পায়। তারা একদিন তাদের ‘প্রিয় তারা’-এর দিক নির্দেশনা শেয়ার করে, আর দুজনেই চমকে যায়—কারণ তা একই! আহান ভাবে, এমনটা কীভাবে সম্ভব? পৃথিবীর দুই প্রান্তে থাকা দুইজন মানুষ প্রতিদিন একই তারাকে দেখে—না জেনেই! তবুও সে কোনো প্রত্যক্ষ প্রশ্ন করে না, কোনো ভিডিও কলের অনুরোধ জানায় না। কারণ সে জানে, এই অদৃশ্য বোধটাই তাদের একমাত্র সেতু। যদি সেটা স্পর্শ দিয়ে নষ্ট হয়, তাহলে হয়তো আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। তাই সে লিখে—“তুমি কি জানো, কিছু আলোর উৎস আমাদের ঠিক ঠিক টেনে আনে, কারণ আমরা জন্ম থেকেই হয়তো একে অপরকে খুঁজছিলাম।” ঈশিতা পড়ে, আর হেসে ফেলে নিঃশব্দে। এরপর সে তার ছাদে উঠে, সেই পুরোনো চেয়ারে বসে, আর প্রথমবারের মতো ভাবে—“হয়তো আমার গল্পটা শুধুই কল্পনা নয়। হয়তো সে আসবে না—কারণ সে আগে থেকেই এসেছে, শুধু আমি তাকে দেখিনি।”
৫
ঈশিতা আজকাল রাতের তারাটির চেয়ে Skybound-এর লাইনগুলোর জন্য বেশি অপেক্ষা করে। প্রতিদিন দুপুরের পরেই সে লগ-ইন করে দেখে, কোনো নতুন বার্তা আছে কিনা, কোনো কবিতা বা গল্প যেটা আবার হৃদয়ে কাঁপন জাগাবে। দুজনের আলাপ যেন এক অলিখিত চুক্তিতে পৌঁছেছে—নাম নয়, মুখ নয়, শুধু অনুভবের অদৃশ্য সেতু। তারা কখনো বলেনি তারা কে, কোথা থেকে কথা বলছে, কিন্তু প্রতি উত্তরে তারা এমন কিছু শেয়ার করে যেটা কেবল গভীর আত্মিক যোগাযোগ থেকেই জন্মায়। ঈশিতা এবার নিজের পুরনো লেখা থেকে কয়েকটি পঙক্তি তুলে দেয় Skybound-এর জন্য—লিখে, “আমি একদিন একটা কবিতায় লিখেছিলাম—‘আলো যত দূরে যায়, আমি তত কাছাকাছি হই। তুমিও কি এমন কিছু ভেবেছো?’” Skybound উত্তর দেয়, “আমি আমার ডায়েরিতে গত বছর লিখেছিলাম ঠিক একই কথা, শুধু শব্দগুলো বদলেছে।” এই মিল ঈশিতাকে শিহরিত করে। মনে হয় যেন অদৃশ্যভাবে কেউ তার চিন্তাগুলো আগেই জানে, তার আগে এগিয়ে থাকে, তার আগেই উত্তর দিয়ে দেয় অনুভবের সেই প্রশ্নগুলোর, যেগুলো সে কখনো জোরে বলেনি।
আহান সেই রাতে চুপচাপ বসে থাকে তার ডেস্কের পাশে। তার সামনের দেয়ালে একটি নীলছাপ নক্ষত্রচিত্র টাঙানো, যেখানে প্রতিটি তারা নিজস্ব নাম পেয়েছে—তবে একটিকে সে নাম দেয়নি কখনো, কারণ তার মনে হয়েছে সেটি কোনোদিন কারও হবে না, সেটা শুধুই অনুভবের জন্য রাখা। আজ প্রথমবার সে সেই তারা নিয়ে InkandLight-এর কাছে কিছু লেখে—“এই তারাটির কোনো নাম নেই, কারণ আমি চেয়েছিলাম কেউ একজন এসে তাকে নাম দিক।” ঈশিতা উত্তর দেয়, “আমি ওটার নাম দিয়েছিলাম ‘অপেক্ষা’, জানো?” সেই মুহূর্তে আহান চুপ করে যায়। তার হৃদয় কেঁপে ওঠে। এতদিন যে নাম সে মুখে আনতে পারেনি, সেই একই নাম, সেই একই তারা—অন্য একজন তাকে বলল। এই কি তবে এক অসম্ভব মিল? নাকি এটি সেই সংযোগ, যেটা তারা এতদিন ধরে অনুভব করছিল, কিন্তু নাম দিতে পারছিল না? সে ভাবে, এ কি ভালোবাসা? না কি দূর থেকে দূরের সঙ্গে মিশে যাওয়ার এক অলৌকিক উপলব্ধি? সেই রাতে আহান কোনো কথা লেখে না, শুধু ডায়েরির পাতায় আঁকেন সেই তারাটিকে, আর তার নিচে লেখেন একটা লাইন—“তুমি আমার নাম রেখেছো, অথচ আমি তোমাকে এখনো চিনি না।”
ঈশিতা রাতের ছাদে বসে আজ প্রথমবার তার চোখে অশ্রু অনুভব করে। এটা দুঃখের নয়, তৃপ্তির—কারণ এতদিন সে যেটা বিশ্বাস করত শুধু নিজের মনে, সেটাকে কেউ হয়তো সত্যিই ছুঁয়ে ফেলেছে। Skybound আর InkandLight এখন আর দুইজন অচেনা মানুষ নয়—তারা একে অপরের কল্পনার পরিপূরক। ঈশিতা ভাবে, তারা কি কোনোদিন দেখা করবে? নাম জানবে? কথা বলবে কণ্ঠস্বর শুনে? কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হয়, যদি সেই দেখা বাস্তব হয়েই যায়, তাহলে এই স্বপ্নের ভাষা, এই শব্দহীন সুর কি আর থাকবে? এই অদ্ভুত মিলের গন্ধটাই তো এতদিনের অপেক্ষার আসল সৌন্দর্য। সে চায় না এই সম্পর্কটি বাস্তবের চাপে ভেঙে যাক। তাই সে কোনো প্রশ্ন তোলে না, কোনো আহ্বান জানায় না। শুধু সেই তারা দেখে, আর ভাবে—“আমরা কী এতটাই ভাগ্যবান যে, একই তারায় চোখ রেখে, একে অপরের অনুভব চিনতে পেরেছি?” আর দূর কোথাও, অন্য আকাশের নিচে, আহানও একইভাবে ছাদে বসে, চোখ তুলে বলে—“হ্যাঁ, আমি জানি তুমি কে নও, কিন্তু আমি জানি তুমি আছো।”
৬
ঈশিতা এক রাতে Skybound-এর বার্তার উত্তর দিতে গিয়ে হঠাৎ নিজের পুরনো হাতে লেখা কবিতার একটি স্ক্যান পাঠিয়ে দেয়। কবিতাটার নাম ছিল “আলোকের নামতা”—যেখানে সে লিখেছিল, “আলো তুমি ছুঁয়ে যাও না, তবুও কাঁপিয়ে দাও। তুমি আসো না, তবুও প্রতিদিন ফিরে আসো।” সেটা সে লিখেছিল বছর তিনেক আগে, এক গভীর শীতের রাতে, যেদিন ছাদে বসে তার প্রথম প্রেমভঙ্গের শূন্যতা অনুভব করেছিল। কবিতাটি যতটা না কারও উদ্দেশে লেখা, তার চেয়েও বেশি নিজের মনকে সান্ত্বনার। কিন্তু Skybound-এর কাছে পাঠানোর পরই ঈশিতার মনে হয়, ‘আমি কি অনেক বেশি খুলে ফেলছি নিজেকে?’ তবে সেই সংশয়ের মধ্যেই আসে উত্তর—একটি ছবি, একটি স্ক্যান করা পাতার অংশ, যেখানে আহান লিখেছিল—“আলো না থাকলে ছায়া থাকে না, তাই আমি সবসময় অন্ধকারের মধ্যেও অপেক্ষা করি তোমার জন্য।” তার নিচে হস্তাক্ষরে লেখা একটি লাইনের সঙ্গে ঈশিতার শরীর থমকে যায়—“আমি জানি না তুমি কে, কিন্তু তুমি কোথাও আছো, আমি তোমাকে দেখিনি, অথচ চিনে গেছি।” এই বাক্যটিও ঈশিতা তার ডায়েরির এক পাতায় লিখেছিল, বছরখানেক আগে। সে তখন বুঝতে পারে—এটা আর কাকতাল নয়, এটা যেন দীর্ঘ অপেক্ষার এক গভীর চিঠি, যা দুইজন মানুষ অন知らায় লিখে গেছে, একে অপরের খোঁজ না রেখেও।
আহান সেই রাতে ডায়েরি বন্ধ করতে পারেনি। InkandLight-এর পাঠানো কবিতার লাইনগুলো তার চেনা—ততটাই চেনা, যতটা নিজের কোনো পুরোনো স্মৃতি। এমনকি তার মনে পড়ে যায়, একবার সে তার মাকে ঠিক এই অর্থে কিছু বলেছিল ছোটবেলায়—“আলো মানে কেউ আসে, কিন্তু কখনও সামনে দাঁড়ায় না।” তখন তার মা বলেছিলেন, “যাকে তুই খুঁজিস, সে তো তোর মতোই খুঁজছে।” এতদিন পর সেই অনুভবই যেন ফিরে আসে InkandLight-এর শব্দে। আহান ভাবতে থাকে—এই মানুষটি কে? এত মিল কীভাবে হয়? সে কি কোনোভাবে আমার জীবনের পুরোনো পথের কেউ? কেউ, যাকে আমি চিনিনি, তবুও যার সঙ্গে আমার অনুভবের সূত্র জড়িয়ে আছে বহু আগ থেকে? এই ভাবনায় ডুবে গিয়ে আহান InkandLight-কে একটা সরাসরি প্রশ্ন করে না, কোনো পরিচয়ের অনুরোধ জানায় না, শুধু লিখে—“আমরা যদি কোনোদিন না-ই দেখি একে অপরকে, তবুও কি আমাদের চিঠি শেষ হবে?” ঈশিতা পড়ে চুপ করে যায়, কারণ উত্তরটা সে জানে—না, এই চিঠি শেষ হবার নয়। এই সম্পর্ক একরকম ছায়া—যা নিজের স্পর্শে নয়, নিজের আলোতে বেঁচে থাকে। হয়তো এটাই আসল প্রেম, যেটা জানে না কবে শুরু হয়েছে, আর জানে না শেষ বলেও কিছু আছে কিনা।
ঈশিতা সেই রাতে প্রথমবার Skybound-এর জন্য কিছু লেখে না। সে শুধু ছাদে উঠে দাঁড়িয়ে একমনে সেই তারাটির দিকে তাকিয়ে থাকে। আকাশ মেঘলা নয়, তবুও আলোটা যেন আজ একটু কেঁপে ওঠে। সে ভাবে, কোনোদিন যদি তার এই না-দেখা মানুষটি তাকে ডাকেও, সে কি সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে? যদি আহান তাকে বলে—“আমরা দেখা করি”, তাহলে সে কি প্রস্তুত? ঈশিতা বুঝে যায়, তারা যত কাছাকাছি আসবে, এই অনুভবের দ্যুতি তত ম্লান হয়ে যেতে পারে। কারণ এ এক ধরনের পূর্ণতা যা অসম্পূর্ণ বলেই এত সৌন্দর্যময়। সে ভাবে, কেউ একজন তাকে দূর থেকে দেখছে, জানে না তার মুখ, কিন্তু জানে তার মনের ভাষা—এটাই তো প্রেমের সর্বোচ্চ রূপ হতে পারে। আর সেই ভাবনায় সে লিখে পাঠায় Skybound-এর কাছে মাত্র একটি লাইন—“তুমি চিঠি হয়ে এসো, খামে নয়।” আহান বার্তাটি পড়ে তার ডায়েরির শেষ পাতায় লেখে—“হ্যাঁ, কারণ খামে ঠিকানা থাকে, চিঠিতে থাকে হৃদয়।”
৭
ঈশিতার কাছে মনে হচ্ছিল, প্রতিদিন একটিমাত্র তারার দিকে তাকিয়ে যে সম্পর্ক জন্মেছিল, তা এবার নিজের ছায়া ছাপিয়ে রূপ নিচ্ছে বাস্তব কোনো আকাঙ্ক্ষায়। Skybound-এর সঙ্গে তার কথোপকথন ধীরে ধীরে এমন এক গভীরতায় পৌঁছেছে, যেখানে অনুভব আর অলীক ভাবনা একই সাথে মিলেমিশে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই একদিন Skybound লিখে—“একটা বইমেলা হচ্ছে কলকাতায়। আমি আসছি তিন দিনের জন্য। যদি তোমার ইচ্ছে হয়, আমরা দেখা করতে পারি, একেবারে নির্জনে, কোনো দাবি ছাড়াই, শুধু সেই তারাটার সাক্ষী রেখে।” ঈশিতা মোবাইল স্ক্রিনের দিকে চেয়ে থাকে। বুকের ভিতরটা কেঁপে ওঠে। এতদিন যার সঙ্গে সে অনুভবের আড়ালে কথা বলেছে, তাকে সামনাসামনি দেখার সম্ভাবনা একদিকে উত্তেজনাময়, আরেকদিকে ভয়ঙ্কর। যদি এই দেখা সবকিছু নষ্ট করে দেয়? যদি Skybound কোনোভাবেই তার কল্পনার মানুষ না হয়? অথবা যদি সে নিজেই Skybound-এর কল্পনায় মানায় না? তবুও সে রাজি হয়। উত্তর দেয়—“চলো দেখা করি, তবে সেই তারার নিচে। যেখানে কেউ না থাকে, শুধু আমরা আর আকাশ।”
বইমেলার দিন আসে। বিকেলে কলকাতার গঙ্গার পাড়ে এক নির্জন ঘাটে তারা ঠিক করে দেখা করবে—কোনো চিহ্ন, কোনো আগাম ছবি ছাড়া। শুধু থাকবে একটা পরিচায়ক: ঈশিতা একখানা নীল স্কার্ফ পরবে, আর Skybound হাতে রাখবে একটা হলুদ কাঠের খাম, যাতে লেখা থাকবে তাদের প্রিয় কবিতার লাইন—“তুমি চিঠি হয়ে এসো, খামে নয়।” ঈশিতা সকাল থেকেই অস্থির। সাজে না সাজে, জানে না কেমন করে হাসবে, কী বলবে। কিন্তু সন্ধ্যা নেমে আসে। সে পৌঁছে যায় ঠিক সময়ে। গঙ্গার পাড়ে বসে, সেই নির্ধারিত ঘাটের ধাপে বসে সে অপেক্ষা করে। তার হাত কাঁপে, মুখ শুকিয়ে আসে। কিন্তু আধঘণ্টা, একঘণ্টা—কেউ আসে না। না কোনো হলুদ খাম, না কোনো চোখে চেনা দৃষ্টি। সে আরও কিছুক্ষণ বসে থাকে, রাত নামতে থাকে, আকাশে দেখা দেয় সেই চেনা তারা। ঈশিতা আকাশের দিকে তাকায়, আর ধীরে ধীরে নীল স্কার্ফটা খুলে তার পাশের রেলিংয়ে রেখে দেয়। কোনো অভিযোগ নেই তার মুখে। শুধু চোখে জমে ওঠে এক দানা জল, যেটা পড়ে না, শুধুই ভাসে।
ঈশিতা ফিরে আসে বাড়িতে, ছাদে উঠে বসে সেই পুরনো চেয়ারে। সে এবার Skybound-এর ইনবক্সে কোনো রাগ, কোনো প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় না। শুধু লেখে—“আজ তারা অনেক শান্ত ছিল।” কিছুক্ষণের মধ্যেই উত্তর আসে। Skybound লেখে—“আমি এলাম না। কারণ আমি ভয় পেয়ে গেছি। যদি দেখা হয়ে যায়, তাহলে তুমি চলে যাও নি’ই, এমনটা বিশ্বাস করার অবকাশ আর থাকবে না। আমি জানি, আমি তোমার পাশে বসলে, তারা হয়তো নিভে যাবে।” ঈশিতা চুপ করে থাকে। কোনো উত্তর দেয় না। সে জানে, Skybound এসেছে তার হৃদয়ে। তাদের ভালোবাসা শুরু হয়েছিল দেখায় নয়, না-দেখায়। এবং সেই না-দেখাই তাদের আসল পরিচয়। তাই সে আবার ডায়েরি খুলে লেখে—“আজ দেখা হলো না। কিন্তু ভালোবাসা তো দেখার জন্য নয়। ভালোবাসা, যখন না দেখেও টের পাওয়া যায়, তখনই সে সত্যি হয়।”
৮
ঈশিতা এবার আর Skybound-এর ইনবক্সে যায় না। তারা এখন আর লিখে না, প্রশ্ন করে না, শুধু মাঝে মাঝে মাঝরাতে দু’জনেই লগ ইন করে, একে অপরের প্রোফাইল দেখে, আবার চুপচাপ সাইন আউট করে দেয়। তারা জানে, কিছু কিছু সম্পর্ক প্রশ্ন না করলেই টিকে থাকে, কিছু ভালোবাসা দূরত্বেই সবচেয়ে জীবন্ত থাকে। তবুও ঈশিতার মনে মাঝে মাঝে ভেসে ওঠে—Skybound যদি একবার এসেই যেত সেইদিন, যদি সে তাকে একঝলক দেখেও নিত! কিন্তু তারপর সে নিজেই ভাবে, যদি সেই দেখা সবকিছু নষ্ট করে দিত? যদি কল্পনার ছায়া হঠাৎ বাস্তব রূপে এসে ভয় ধরিয়ে দিত হৃদয়ে? তাই সে নিজেকে বোঝায়—এভাবে না দেখা থেকেই তো তারা একে অপরের সবচেয়ে কাছাকাছি। এক সন্ধ্যায়, মাসির পুরনো অ্যালবাম ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ সে দেখে এক ছবি—পুণেতে একবার কলেজ ট্যুরে গিয়েছিল দ্বিতীয় বর্ষে, একটি বিজ্ঞান গবেষণাগারের সামনে দাঁড়িয়ে তোলা দলগত ছবি। ছবির ডানদিকে এক ছেলেকে দেখে ঈশিতা থমকে যায়—চোখে চশমা, হাতে টেলিস্কোপের কেস, আর চোখে সেই অদ্ভুত স্থিরতা। তার বুকের ভিতর হঠাৎ যেন থেমে যায় কিছু এক মুহূর্তের জন্য।
ঈশিতা দ্রুত ছবি স্ক্যান করে Skybound-এর মেসেজে পাঠায়। লেখে না কোনো শব্দ, শুধু ইমেজ। কয়েক মিনিট পর উত্তর আসে—“তুমি তখন খুব কাঁচা ছিলে, অথচ চোখে ছিল ঠিক এই তারা-দেখা চাহনি।” ঈশিতা এখন নিশ্চিত। Skybound শুধু তার অনুভব নয়, তার অতীতও ছুঁয়ে এসেছে একবার, যদিও তারা কেউ কাউকে তখন চেনে না। আহান লিখে—“আমি সেইদিন বুঝিনি যে ওই ভিড়ের মধ্যে, একজন আছে, যে আমার মতো করে আকাশ দেখে। তোমার পেছনের চুলের ভাঁজে একটা নীল স্কার্ফ ছিল, মনে আছে?” ঈশিতা ছবি জুম করে দেখে—আশ্চর্য! সত্যিই তার গলায় অর্ধেক বাঁধা ছিল সেই স্কার্ফ, যেটা সে আজও রেখে দিয়েছে সেই ঘাটের রেলিংয়ে। যেন সেই ছায়া অনেক আগেই তাদের ঘিরে ছিল, শুধু তারা তখন জানত না। এখন ঈশিতা জানে—এই ভালোবাসা কোনো অ্যাক্সিডেন্ট নয়, এটা সময়ের গায়ে লেখা এক অলিখিত কবিতা, যা কেবল তারারা পড়ে ফেলতে পারে।
তারা আর দেখা চায় না, ঠিকানা জানে না, ফোন নম্বর নেয় না। শুধু তারা দু’জন, রাতের আকাশ আর সেই একটি তারা—যার নাম এখন তারা দু’জনেই জানে: “একটা তারার নাম”। আহান নিজের গবেষণাপত্রের শেষ প্যারাগ্রাফে লিখে—“তারা শুধু নক্ষত্র নয়, তারা আমাদের চুপ করে বলা অনুভবের প্রতিচ্ছবি।” আর ঈশিতা নিজের পরবর্তী কবিতার বইয়ের উৎসর্গ পাতায় লেখে—“তাকে, যাকে কোনোদিন ছুঁয়ে দেখিনি, তবুও প্রতিদিন তার চোখের আলোয় নিজের হৃদয় চিনেছি।” দু’জনেই এখন জানে, তারা দেখা না হওয়াতেই বেঁচে থাকে—এটাই তাদের সবচেয়ে নির্জন, সবচেয়ে নিখাদ ভালোবাসা। আর প্রতিটি রাত, প্রতিটি তারা, এখন তাদের সেই না-দেখা প্রেমের প্রতিদিনের স্মারক হয়ে রয়ে যায়।
-শেষ-