দেবব্রত জানা
অধ্যায় ১: শস্যখেতের ছায়ায়
পুব দিক থেকে সূর্যের আলো যখন ধানক্ষেতের কাঁচা সবুজ পাতার উপর পড়ত, রঘুবর হালদারের মনেও আলো ঝরে পড়ত। প্রতিদিনের মতো আজও সে ভোর ছ’টার মধ্যে মাঠে পৌঁছে গিয়েছিল। কুয়াশা তখনো জমির উপর পাতলা চাদরের মতো বিছানো, আর নলকূপের জলে হাত-মুখ ধুয়ে রঘুবর দাঁড়িয়ে পড়ে নিজের জমির দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ—যেন মাটি কথা বলছে তার সঙ্গে। এই জমি তার দাদার দাদা কিনেছিলেন, এরপর প্রজন্ম ধরে চাষ চলছে, আর এখন তিনিই সেই উত্তরাধিকার। ধান, পাট, সর্ষে, আর মাঝেমাঝে একটু আখ—এই নিয়েই তাদের সংসার চলে। জমির প্রতিটি চওড়া ডোল, প্রতিটি মাটির ফাটল, এমনকি কোথায় কাক বাসা বাঁধে—সব তার চেনা। রঘুবর ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে পানের গাছের গোড়ায় জল দিল, পাশেই খোঁড়া মাটির মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা শুকনো পাতা ঝাড়ল, আর মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবল, “এই বছর যদি বর্ষা ঠিকমতো আসে, তাহলে এক বিঘায় দেড়শো মন উঠবেই।” তার চোখে ক্লান্তি নেই, আছে দীর্ঘ অভ্যাস আর মাটির প্রতি মায়া।
বাড়িতে ফিরে গেলে কমলা অপেক্ষায় থাকে। মাটির বারান্দায় বসে সে মুখ গুঁজে চাল বাছে, কখনও বাঁশের ঝুড়ি থেকে কুঁচো শাক বেছে আলু দিয়ে রান্না করে। সারা বাড়িতে একটা নিরবতা থাকে, মাঝে মাঝে মোরগের ডাক, দূরের চাষিদের হাঁকডাক, আর বাচ্চাদের ছুটোছুটি ছাড়া তেমন কিছু শোনা যায় না। কিন্তু আজ একটু অন্যরকম। আজ সুব্রত বাড়ি ফিরছে—তাদের একমাত্র ছেলে, শহরের কলেজে পড়ে শেষ বর্ষে। কমলা সকাল থেকে রান্না করছে, চিতল মাছের কালিয়া, লাউ দিয়ে চিংড়ি, আর চালধোয়া ভাতে পুঁইশাক। তার মনে যতটা আনন্দ, ঠিক ততটাই উদ্বেগ—সুব্রত এখন বড় হয়েছে, তার নিজের মত আছে, নিজের ভবিষ্যৎ ভাবছে। রঘুবর যদিও মুখে কিছু বলে না, তার চোখের গভীর নিরবতায় একটা প্রশ্ন ঝুলে থাকে, “সে কি আমার মতোই চাষ করবে? নাকি জমি ছেড়ে শহরের চাকরির খোঁজে হারিয়ে যাবে?” আর এই প্রশ্নটার উত্তর এখনও তারা কেউই জানে না। বিকেল নাগাদ সোনালী রঙের আলোর মধ্যে দিয়ে একটা সাইকেল আসে ধুলো উড়িয়ে—সুব্রত! তার পরনে হালকা প্যান্ট-শার্ট, চোখে সানগ্লাস, আর কাঁধে ব্যাগ। রঘুবর দূর থেকে দেখে, তার বুকের মধ্যে একটা হালকা গর্ব আর অজানা শূন্যতা একসঙ্গে বাজতে থাকে।
রাতে খাওয়ার টেবিলে সবাই একসঙ্গে বসে। পুরনো কাঠের টেবিল, যার এক কোণায় ছাল উঠছে, তবুও যেন একটুকরো ইতিহাস হয়ে আছে ঘরে। সুব্রত গল্প করে তার কলেজের, শহরের ট্র্যাফিকের, মোবাইল অ্যাপ আর স্টার্টআপ কোম্পানির। সে বলে, “আত্রেয়ী নামে একটা মেয়ে আছে, খুব স্মার্ট, আমাকে একবার একটা সেমিনারে নিয়ে গেছিল।” কমলা হেসে বলে, “ওই মেয়েকে একদিন বাড়িতে আনিস তো, দেখব।” রঘুবর চুপ করে শোনে, মাঝে মাঝে এক-আধটা প্রশ্ন করে—“শহরে মাটির গন্ধ পাওয়া যায় নাকি?” সুব্রত একটু হাসে, বলে, “না বাবা, মাটি আছে, কিন্তু গন্ধটা কেমন যেন ফ্ল্যাট হয়ে গেছে।” সেই রাতে, খাওয়া শেষ হওয়ার পরে, রঘুবর একা বারান্দায় বসে বিড়ি ধরায়। চাঁদ তখন আধখানা, আর দূরের বাঁশঝাড়ে হাওয়া বইছে। তার মনে হয়, সুব্রত যেন এক পায়ে মাটির উপর, আর আরেক পায়ে বাতাসে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ধরে রাখা যাচ্ছে না, কিন্তু ছাড়াও যাচ্ছে না। এই দ্বন্দ্বের শুরু এখানেই, যেখানে শস্যের নরম ছায়ায় দাঁড়িয়ে এক বাবা ভাবে—স্বপ্ন কি শুধু শহরের, না কি গ্রামেও স্বপ্ন বাঁচে?
অধ্যায় ২: জানলার ওপাশে
সুব্রত যখন কলকাতায় প্রথম এসে পৌঁছায়, তখন বুকে গর্ব আর চোখে বিস্ময়—এই দুটোর মিশ্রণ। হাওড়া স্টেশনের ভিড়, বাসস্ট্যান্ডে অটোওয়ালাদের হাঁকডাক, আর মাথার উপর দিয়ে কেটেই চলেছে উড়ালপুল—সবকিছু যেন জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের দরজা খুলে দিচ্ছে। প্রথম কয়েকদিন সে যাদবপুরের এক সহপাঠীর মেসে ওঠে। ঘরটা ছোট, এক পাশে বিছানা, আরেক পাশে পড়ার টেবিল। জানলার বাইরে তাকালে দেখা যায় পাশের অ্যাপার্টমেন্টের উঁচু দেয়াল, তার মাথায় জলাধার আর সারি সারি এয়ারকন্ডিশনের বহিরাংশ। গ্রামের খোলা মাঠের অভ্যস্ত চোখে এগুলো যেন দমবন্ধ করা দেয়াল। কিন্তু সুব্রত নিজেকে বোঝায়—স্বপ্ন পূরণ সহজ নয়, এটুকু সহ্য করতে হবে। কলেজে তার পারফরম্যান্স ভালো, আর সেই সুবাদেই আত্রেয়ীর সঙ্গে তার আলাপ। আত্রেয়ী সেন—চকচকে শহরের প্রতিনিধি, কিন্তু তাতে কোনো অহংকার নেই। তার কণ্ঠে স্বচ্ছতা, চোখে আত্মবিশ্বাস, আর কথায় এমন একটা সরল যুক্তি, যা সুব্রতের মতো ছেলেদের আকর্ষণ করে। প্রথম দিকে তারা শুধু সেমিনারে একসঙ্গে কাজ করত, পরে দুপুরের ক্যান্টিনে একসঙ্গে বসা, তারপরে মেসেঞ্জারে রাতের গল্প—সব মিলিয়ে সম্পর্ক এক নতুন জায়গায় গড়াতে থাকে।
এক বিকেলে কলেজ শেষে তারা দক্ষিণ কলকাতার এক ছোট ক্যাফেতে বসেছিল। টেবিলের উপর কফির কাপ, আর দেওয়ালে সাজানো ছবি—মেট্রো রেলের, রবীন্দ্রসদনের, আর বইমেলার পোস্টার। আত্রেয়ী বলল, “তোমার গ্রামের কথা শুনে বেশ লাগে। আমি কখনও গ্রামে যাইনি, কিন্তু মনে হয় যেতে পারলে মনটা একটু শান্ত হতো।” সুব্রত তাকিয়ে থাকে তার চোখে, তারপর হেসে বলে, “গ্রামে শান্তি আছে ঠিকই, কিন্তু সুযোগ নেই। আমি তো এই শহরে এসেছি নিজেকে তৈরি করতে, বাবাকে সাহায্য করতে।” আত্রেয়ী চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর বলে, “তবে তুমি কি নিজের শিকড় পুরোপুরি কাটতে পারবে?” কথাটা যেন সুব্রতের বুকের ভেতর কোথাও গিয়ে বিঁধে। সে জানে, তার বাবা তাকে নিয়ে গর্ব করে, মা প্রতিদিন অপেক্ষা করে চিঠির, আর সেই বিনোদিনী মাসি যে প্রায়ই বলে, “জল যেখানে জন্মায়, সেখানেই তার সবচেয়ে গভীর রং হয়।” কিন্তু শহরের জীবন তাকে নতুন কিছু শেখাচ্ছে—এখানে সময় মানে টাকা, সম্পর্ক মানে প্রয়োজন, আর স্বপ্ন মানে প্রতিযোগিতা। অনেক রাত অবধি তার ঘুম আসে না। জানলার ওপাশে তাকিয়ে থাকে সে—মোটরগাড়ির শব্দ, দূরের অ্যাপার্টমেন্টের আলো-আঁধারি, আর মানুষের ছুটে চলা—সব দেখে মনে হয়, সে যেন একটা দৌড়ে নেমে গেছে, যার শেষ কোথায় সে জানে না।
একদিন একটা কোম্পানিতে ইন্টার্নশিপের সুযোগ পেল সে। চাকরিটা বড় না হলেও কাজ শিখতে পারবে বলে রাজি হয়ে গেল। সকাল ন’টায় অফিস ঢোকা, সন্ধ্যা ছ’টায় ফেরা—এই রুটিনের মধ্যে প্রথম কিছুদিন সে আনন্দ খুঁজে পায়, নিজেকে গড়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তৃতীয় সপ্তাহ থেকে বুঝতে পারে, তার সামনে কেউ নেই, পিছনেও কেউ নেই—শুধু কম্পিউটার স্ক্রিন, একরাশ কাজ, আর ঠান্ডা মুখের সহকর্মীরা। দুপুরে ক্যান্টিনে বসে খাওয়ার সময় কেউ কারও চোখে তাকায় না। “এটাই শহরের নিয়ম,” আত্রেয়ী একদিন বলে, “এখানে সবাই নিজের মতো, খুব বেশি আশা রাখলে কষ্ট পাবে।” কথাটা সত্যি, কিন্তু সে সহজে মেনে নিতে পারে না। গ্রামে সন্ধ্যায় যখন আলো নিভে যেত, তখন তারা বারান্দায় বসে থাকত—চা খেতে খেতে গল্প হতো, পাড়ার মানুষ হেঁটে হেঁটে দেখা করত। এখানে সন্ধ্যার মানে গ্লাস-তোলা পার্টি, অথবা ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়া। আর এর মধ্যেই একদিন, আত্রেয়ী তাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি কখনও ভেবেছো তোমার গ্রাম নিয়ে কিছু করার কথা?” সুব্রত চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। সে জানে, তার ভেতরে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। একদিকে আধুনিক জীবনের তাড়না, আরেকদিকে শিকড়ের টান। জানলার ওপাশে তাকিয়ে থাকা এই মানুষটা জানে—সে কোথায় আছে, কিন্তু ঠিক কোথায় যেতে চায়, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
অধ্যায় ৩: ছোটো পাটির চিঠি
কলকাতায় আসার প্রায় এক মাসের মাথায়, এক সকালে সুব্রতের ঘরের দরজায় একজন কুরিয়ারম্যান এসে হাজির। হাতে একটা খাম। প্যাকেটটা খুলতেই সে দেখে ভিতরে একটা হাতে লেখা চিঠি—ঝাঁঝরা পাড়ার বিনোদিনী মাসির হাতের লেখা, তার দাদুর বোন, যাকে সে “ছোটো পাটি” বলেই ডাকত শৈশব থেকে। চিঠি খুলতেই একরাশ স্মৃতি ঝাঁপিয়ে পড়ে। কাঁচা কাগজে হালকা কালি দিয়ে লেখা সেই চিঠিতে গন্ধ ছিল শুকনো নিমপাতার, আর অক্ষরের ফাঁকে যেন শীতের সকালের পাটখেতের শিশির লেগে আছে। বিনোদিনী মাসি লিখেছেন—“রাতের বাতাসে এখনও বাঁশঝাড়ের মাথায় ঝিম ধরে বসে থাকে বুড়ি পেঁচা। তোর মা প্রতিদিন সকালে তালপাতার ঝাড়ু দিয়ে উঠোন সাফ করে, তারপর নলকূপে জল তোলে। তুই যেদিন চলে গেলি, তোর বাবার চোখে কিছু ছিল না, কিন্তু সেদিন ভাতের থালায় ওর হাত থেমে গেছিল। রঘুবর এখন মাঠে যায়, কাজ করে, ফিরে এসে চুপ করে বিড়ি টানে। তুই বলেছিস শহরে থেকে বড়ো হবি, আমি জানি তুই পারবি—কিন্তু তোর শিকড় ভুলিস না।” তারপর চিঠির শেষ দিকে মাসি লিখেছেন, “মাটির গন্ধ একবার নাকে গেলে তা ভুলে থাকা যায় না রে। শহর তোকে আলাদা করে ফেলবে, কিন্তু মনে রাখিস—গাছ যত উঁচু হোক, তার শেকড় তো মাটিতেই।”
চিঠিটা পড়ে সুব্রত চুপ করে বসে থাকে। বাইরের জানলা দিয়ে তখন ঝলমলে রোদ, কিন্তু তার ভেতরে যেন কুয়াশা জমছে। শিকড়… এই শব্দটা তার মনের মধ্যে ঘুরতে থাকে বারবার। সে ভাবে—শেষ কবে সে সন্ধ্যায় পুকুরপাড়ে বসে সূর্যাস্ত দেখেছে? শেষ কবে সে কাঁচা রাস্তা দিয়ে হেঁটেছে, ধুলো লাগা পায়ে? এখন তার পা ঘামে ট্রাফিকের ধুলোয়, চোখে জ্বালা জ্বলন্ত স্ক্রিনে চেয়ে থাকার কারণে, আর মাথা ধরে থাকে মেট্রোর শব্দে। অফিসে যেতে যেতে চারপাশে তাকিয়ে সে দেখে অসংখ্য মুখ, কিন্তু একটাও মুখ চেনে না। কেউ কারও দিকে হাসে না, কেউ কারও কাছে বসে গল্প করে না। অথচ তার গ্রামে, যেদিন কৃষকরা চাষের পরে একত্র হয়ে খেজুরগাছের নিচে বসত, সেখানে প্রতিদিনই একজন অন্যজনের সুখ-দুঃখের অংশীদার হতো। চিঠির ভিতরে বিনোদিনী মাসি একটা শুকনো বেলপাতা গুঁজে দিয়েছিলেন—একটা প্রাচীন অভ্যেস, যেন মাটির সঙ্গে আশীর্বাদের যোগসূত্র। বেলপাতাটা হাতে নিয়ে সে হঠাৎ করে বুঝতে পারে, সে শুধু শহরে এসে জীবন খুঁজতে আসেনি, সে পালিয়ে এসেছে একটা পরিচয় থেকে—যেটা তৈরি হয়েছিল মাঠে, মাটিতে, আর সেই অদৃশ্য বন্ধনে।
সেই রাতে আত্রেয়ীর সঙ্গে দেখা করার সময় সে চিঠিটা নিয়ে যায়। রেস্তোরাঁর এক কোণে বসে, সে আত্রেয়ীকে চিঠিটা পড়ে শোনায়। আত্রেয়ী প্রথমে চুপ করে থাকে, তারপর ধীরে ধীরে বলে, “তোমার মাসির ভাষাটা যেন কবিতা।” সুব্রত মৃদু হাসে, বলে, “উনি সারাজীবন পড়াশোনা করেননি, কিন্তু মানুষের চোখ দেখে মনের কথা বলে দিতে পারেন।” আত্রেয়ী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, “তাহলে তুমি কী ভাবছো? গ্রামে ফিরে যাবে?” প্রশ্নটা সহজ, কিন্তু তার উত্তর কঠিন। সুব্রত জানে, সে এখন ফিরে যেতে পারে না—এখনও তার কাজ শেখা বাকি, নিজের পায়ে দাঁড়ানো হয়নি। কিন্তু সে বুঝতে পারে, একদিন ফিরতে হবে, ফিরতে চাইবে। সে বলে, “আমি যদি গ্রামে ফিরেও যাই, শুধু চাষ করব না, কিছু গড়ব—যেটা মাটিকে প্রযুক্তির সঙ্গে মেলাবে।” আত্রেয়ী মাথা নাড়ে, বলে, “আমিও যেতে চাই, দেখবো সেই জায়গাটা, যেখান থেকে তুমি উঠে এসেছো।” তারা দু’জন চুপ করে বসে থাকে কিছুক্ষণ। জানলার বাইরে রাত নেমে এসেছে, গাছের ডালে বাতাস লেগে হালকা শব্দ হচ্ছে। সেই মুহূর্তে সুব্রতের মনে হয়, শহরের মাঝেও একটা গ্রাম বাস করে—স্মৃতির গ্রাম, চিঠির গ্রাম, আর মাটির গন্ধে ভেজা এক নিঃশব্দ পরিচয়, যা তাকে প্রতিদিন মনে করিয়ে দেয়, সে কে।
অধ্যায় ৪: শহরের নাম মায়া
সুব্রত আজকাল গভীরভাবে অনুভব করে, শহর তাকে মায়ায় আবৃত করে রেখেছে। প্রথম দিকে সে মনে করেছিল, শহর মানে স্বাধীনতা, মানে সুযোগ, মানে এক নতুন পৃথিবী। কিন্তু এখন বুঝতে পারে, শহরের নাম ‘মায়া’—এখানে যা দেখানো হয়, তা সব কিছু নয়। চারপাশের বিল্ডিংগুলো, ট্রাফিকের হর্ণ, মেট্রোর বাতি—সবই যেন একটা বড়ো খেলা, যেখানে মানুষ নিজেদের মধ্যে একে অপরকে ছাপিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা চালাচ্ছে। সে নিজে যেন এক অদ্ভুত যন্ত্রের অংশ হয়ে গেছে। সকালে অফিস, দুপুরে লাঞ্চ, তারপর আবার অফিস—এই চক্রে সে এমনভাবে আটকে গেছে যে নিজেকে খুঁজে পাওয়া দায়। আত্রেয়ী তাকে বলে, “শহরে কি তোমার নিজের সত্ত্বা হারিয়ে গেছে?” কিন্তু সে জানে না কীভাবে তার উত্তর দেবে। নিজের মনের মধ্যে এক গহীন শূন্যতা গেথে গেছে, যেন সে কোন্ পথে চলতে চলতে এই শহরের মাঝে একা হয়ে গেছে।
আত্রেয়ী নিজেও এই শহরের মায়ায় আটকা পড়েছে। তার জীবনে শহরের জীবনে আধুনিকতা আর প্রযুক্তির এক তীব্র প্রবাহ প্রবাহিত হয়, কিন্তু সেই আধুনিকতা তাকে কখনও কখনও বিপন্ন মনে হয়। সে জানে, শহরের গতি এত দ্রুত যে, এখানকার মানুষগুলো সময়ের চাপকে এত বেশি অনুভব করে যে, জীবনের ছোট ছোট সুন্দর মুহূর্তগুলো তারা হারিয়ে ফেলছে। আত্রেয়ী জানত, সে বড় হতে চেয়েছিল, শহরকে উপভোগ করতে চেয়েছিল, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এই শহর তার সত্যিকার মানে হারিয়ে ফেলেছে। একদিন বিকেলে, যখন সূর্য ডুবতে শুরু করেছিল, তারা দু’জন ক্যান্টিনে বসে ছিল। আত্রেয়ী বলেছিল, “তুমি জানো, শহরে এক দিন চুপ করে বসে থাকলে মনে হয়, কিছুই নেই, কিছুই সার্থক নয়।” সুব্রত মাথা নিচু করে জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল। তার চোখে যেন এক অজানা চাপ, এক বিষাদ। সে শুধু আকাশে ওঠা প্রথম তারাটার দিকে তাকিয়ে ছিল, যেন নিজেকে খুঁজে পাওয়ার জন্য কিছু একটা চাচ্ছিল। আত্রেয়ী তার হাত ধরেছিল, “তুমি যদি ফিরে যাও, তবে তোমার মাটি ঠিকই তোমাকে স্বাগত জানাবে। কিন্তু যদি একদিন শহরেই বসে থাকতে চাও, তবে মনে রেখো—এই মায়ার ভেতর হারিয়ে যেও না।”
সুব্রত বুঝতে পারছিল, আত্রেয়ী ঠিক বলছে। শহরের মধ্যে এক অদ্ভুত বিভ্রম আছে। একটা সময়, যখন সে ছোট ছিল, গ্রামের মাঠে গেলে একদম মুক্ত মনে সব কিছু দেখত। ধানক্ষেতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সূর্যের আলো গায়ে পড়লে মনে হতো, পৃথিবীটাই তার হয়ে গেছে। সে মনে করত, যদি এই মাঠটাকে সবার কাছে তুলে ধরতে পারে, তাহলে সবাই বুঝবে এই সাদামাটা জীবনটাই আসল। কিন্তু শহরে এসে, আড্ডা দিতে দিতে, অফিসের কাজ করতে করতে, সেই অনুভূতি হারিয়ে যেতে থাকে। এখন মনে হয়, শহরের প্রাণবন্ততা অনেকটা সার্বিক হানাহানি। এখানে সবকিছু তাড়াহুড়ো আর প্রতিযোগিতার মধ্যে চলে, এবং মাঝে মাঝে মানুষ নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পায় না। সুব্রত মাঝে মাঝে ভাবত, যদি সে গ্রামে ফিরে যায়, সেখানে আবার সেই নিরবতা আর শুদ্ধতা খুঁজে পাবে কি না। কিন্তু সে জানে, ফিরে গিয়ে সব কিছু আবার শুরু করা কঠিন হবে। গ্রামে ফিরে গেলে পুরনো অভ্যেস, পুরনো বন্ধন, পুরনো কষ্টগুলো আবার ফিরে আসবে।
একদিন সন্ধ্যায়, সুব্রত মেট্রো থেকে নামার পর আত্রেয়ী তাকে বলেছিল, “তুমি জানো, এই শহর প্রতিদিন এক নতুন রূপে আসে, কিন্তু তার ভিতরটা আসলে অন্ধকার।” তৎক্ষণাৎ সে আত্রেয়ীর কথাগুলো ভাবতে থাকে। শহর তো আসলে একটা বড়ো নাটক, যেখানে সবাই অভিনয় করছে, সবাই কোনো না কোনো চরিত্রে বিভূষিত হচ্ছে। কিন্তু সেই অভিনয়ে কোথাও যেন এক অদ্ভুত শূন্যতা রয়েই যায়। আত্রেয়ী জানত, শহরের প্রলোভনে অনেক কিছু হারিয়ে যায়, কিন্তু মাটির গন্ধ হারানোর পর যে শূন্যতা তৈরি হয়, তা কখনও পূর্ণ হয় না। আর সুব্রত জানত, তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে—শহর তার ভবিষ্যৎ হবে, না কি গ্রাম, যেখানে সে জন্মেছিল? জীবনের পথ যেখানে তার শিকড় নিয়ে বেঁচে থাকার সুরক্ষা ছিল, সেখানে ফিরে গিয়ে কি সে সত্যিই তার আত্মপরিচয় খুঁজে পাবে?
অধ্যায় ৫: কাঁচা রাস্তা ও কংক্রিট
গ্রামের কাঁচা রাস্তাগুলো যেন স্নেহের মতো আঁকড়ে ধরে রেখেছিল স্মৃতিকে—যেভাবে কোনো মা তার সন্তানের ছোটোবেলার পায়ের ছাপ আগলে রাখে। এদিকে শহরের কংক্রিটের রাস্তা, সুউচ্চ ফ্লাইওভার, চকচকে মোবাইল স্ক্রিন আর ঠান্ডা অ্যাক্সেল-চেয়ার—সবকিছুতেই যেন ছুঁইছুঁই এক সুবিধে, কিন্তু শেকড়হীনতা। একদিন সুব্রত অফিস থেকে ফিরছিল। তার চোখে ক্লান্তি, কানে হেডফোনে বাজছিল রবিশঙ্করের সেতার। হঠাৎ সে ভাবল—শেষ কবে সে মাটির গন্ধ পেয়েছে? শেষ কবে পায়ে ধুলো লেগে সন্ধ্যাবেলায় গরু ফেরার আওয়াজ শুনেছে? মেট্রোর ফ্ল্যাট শব্দের নিচে সেই স্মৃতি যেন মুছে যেতে চাইছে। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই মায়ের ফোন। কমলার কণ্ঠে যেন শত যোজন দূরের এক চিরচেনা ছোঁয়া ছিল—“বাবা, তোর বাবা বলল, আমন ধানের ফলন ভালো হয়েছে এবার, কিন্তু খেত কেটে তুলে আনতে একটু লোক দরকার। ও বলল, যদি তুই থাকতি, ভালো হতো।” ফোনের ও-পাশে সুব্রতের গলা শুকিয়ে যায়। সে কিছু বলতে পারে না, শুধু বলে, “মা, আমি একদিন আসব, একদিন না একদিন ফিরব।”
পরের দিন সে অফিসে গিয়েও মন বসাতে পারে না। সহকর্মীরা হিসেব কষছে, প্রেজেন্টেশন করছে, কেউ কেউ কফির মগ হাতে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে। কিন্তু সুব্রতের চোখে একটিই দৃশ্য ভেসে উঠছে—তার বাবা রঘুবর হালদার, ধানের গাদা নিয়ে মাঠের ধার দিয়ে হেঁটে আসছেন, ঘামে ভেজা গা, কিন্তু চোখে একটা শান্তি, যা এই কাচে মোড়া শহরের কোনো মানুষের চোখে নেই। সে জানে, বাবা কিছু বলে না, অভিযোগ করে না, কিন্তু তার চুপ করাটা আসলে সবচেয়ে বড়ো চিৎকার। বিকেলে সে আত্রেয়ীর সঙ্গে দেখা করে। দক্ষিণ কলকাতার এক বইমেলায় তারা হাঁটতে হাঁটতে গল্প করে। আত্রেয়ী বলে, “তোমার বাবা অনেক শক্ত লোক, তাই না?” সুব্রত মাথা হেঁট করে বলে, “হ্যাঁ, কিন্তু সেই শক্ত লোকটাই ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছে, আমি সেটা টের পাই।” আত্রেয়ী তখন তার হাত ধরে বলে, “তুমি যদি ফিরতে চাও, তবে আমি সঙ্গে যাব।” সুব্রত অবাক হয়ে তাকায়। আত্রেয়ীর চোখে কোনো ভয় নেই, বরং যেন এক চুপচাপ প্রতিজ্ঞা। সে হেসে বলে, “তুমি তো শহরের মেয়ে, কাদা-মাটি কীভাবে সামলাবে?” আত্রেয়ী মৃদু হেসে বলে, “মানুষকে যদি ভালোবাসা যায়, তাহলে তার মাটিকেও ভালোবাসা যায়।”
এক সপ্তাহ পরে সুব্রত গ্রামে ফিরে যায়। ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে—সবুজ ধানক্ষেতের মাঝে চুল্লির ধোঁয়া উঠছে, পাখিরা ধানখেতে বসে, আর মাটির রাস্তা যেন তার ফিরে আসার অপেক্ষায়। গাঁয়ের ছেলেরা ছুটে আসে তাকে দেখতে, ছোটোবেলার সঙ্গীরা হেসে বলে, “তুইও বুঝি আবার গরু চরাবি?” রঘুবর কিছু না বলে শুধু সুব্রতের মাথায় হাত রাখেন। সেই রাতে, বারান্দায় বসে, রঘুবর বিড়ি টানেন, আর ছেলের পাশে বসে বলেন, “তুই যা শিখেছিস শহরে, তা এখন এখানেই লাগা। আমি তোকে কখনও আটকে রাখিনি, শুধু চাইছিলাম—তুই ভুলে যাস না, কার গর্ভে জন্মেছিলি।” সুব্রত চুপ করে বসে থাকে। তার পায়ের নিচে মাটি, মাথার উপর তারার আকাশ, আর বুকের ভিতর এক ধরনের পরিপূর্ণতা, যা কোনো শহরের ছোঁয়ায় আসে না। শহরের কংক্রিটে তার শরীর হয়তো জায়গা পেয়েছিল, কিন্তু আত্মা তো এখানে—এই কাঁচা রাস্তার প্রতিটি ফাটলে, এই ধানের গন্ধে, এই পাখির ডাকে। আর তখনই সে বুঝে যায়—সে শুধু ফিরে আসেনি, সে আসলে নতুন করে জন্ম নিচ্ছে, মাটির কোলে।
অধ্যায় ৬: আত্রেয়ীর প্রশ্ন
গাঁয়ের সকালের হাওয়া শহরের তুলনায় অনেক হালকা, অনেক বেশি জীবন্ত—এখানে বাতাস শুধু বয়ে যায় না, কথা বলে। সে সকালে উঠেই পুকুরঘাটে মুখ ধুয়ে পাটখেতের ধার ধরে হাঁটছিল, সেই পুরনো পথ যেখানে একসময় খালি পায়ে দৌড়েছিল শৈশবে। পাড়ার লোকজনরা তাকে দেখে অবাক হয় না, বরং আশ্বস্ত হয়—সুব্রত ফিরেছে, যেন হারানো কোনো নদী তার গতিপথ খুঁজে পেয়েছে। আত্রেয়ী দুইদিন পরেই ট্রেনে চড়ে গ্রামে পৌঁছায়। তার মুখে ক্লান্তি থাকলেও চোখে ছিল একরাশ কৌতূহল। স্টেশন থেকে মাঠের পথ ধরে সাইকেল রিকশায় যেতে যেতে সে বলে, “তোমার গ্রামটা তো ছবির মতো।” সুব্রত মৃদু হেসে বলে, “হ্যাঁ, কিন্তু ছবির পেছনেও একটা বাস্তবতা থাকে।” সেই সন্ধ্যায় আত্রেয়ী বারান্দায় বসে খেতে খেতে বলে, “তুমি যদি এখানে থেকে যাও, তাহলে কি তোমার শহরের স্বপ্নগুলো ফেলে দেবে?” প্রশ্নটা হঠাৎ আসে, কিন্তু সুব্রত জানে—এই প্রশ্নই আসলে তাকে প্রতিদিন তাড়া করছে।
রাতে খাওয়ার পরে আত্রেয়ী তাকে ডাকে বাড়ির পাশের তালগাছতলায়। চারপাশে শুধু পাখির ডাক, মাঝে মাঝে রাতচরা পাখি ডাকে। তারা দু’জন নিঃশব্দে কিছুক্ষণ বসে থাকে। তারপর আত্রেয়ী বলে, “তুমি জানো, আমি শহরে বড় হয়েছি, আধুনিকতার মধ্যে বড় হয়েছি, কিন্তু তাও মাঝে মাঝে মনে হতো, কিছু একটা মিস করছি। তোমার গ্রামের গন্ধ, এই শুদ্ধতা, এই নিরবতা—এগুলোই কি মানুষকে মানুষ করে তোলে?” সুব্রত মাথা নিচু করে থাকে। আত্রেয়ী আবার বলে, “কিন্তু তুমি? তুমি তো শহরে নিজের জায়গা করে নিচ্ছিলে। আজ যদি আমি না আসতাম, তবে তুমি কি ফিরতে?” এই প্রশ্নে সুব্রত একটু থমকে যায়। তার চোখে একরাশ দ্বিধা—সে কি আসলে শহরের? না কি গ্রামের? সে কি তার নিজের শিকড় বুঝেছে? তারপর ধীরে ধীরে বলে, “আমি শহরে গিয়েছিলাম নিজেকে গড়তে, কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখেছি, নিজের ভিতরটা কেমন ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। আমি জানি, আধুনিকতা দরকার, কিন্তু তাতে যদি আত্মপরিচয় মুছে যায়, তবে সেটা আর উন্নতি নয়, সেটা হারিয়ে যাওয়া।” আত্রেয়ী চুপ করে শোনে। তারপর বলে, “তাহলে তুমি আসলে কার?” —এই প্রশ্নে এবার আর কোনও উত্তর থাকে না।
তাদের কথা শেষ হয় না। আকাশের তারা বাড়ে, হাওয়া বইতে থাকে, আর পায়ের নিচে শুয়ে থাকে রাতজাগা পোকাদের কলরব। সেই রাতে ঘরে ফিরে সুব্রত ঘুমাতে পারে না। সে জানে, তাকে দুটো পথের মধ্যে একটা বেছে নিতে হবে না—বরং তাকে একটা নতুন পথ বানাতে হবে, যেখানে শহরের জ্ঞান আর গ্রামের হৃদয় একসঙ্গে বাঁচতে পারে। আত্রেয়ীর প্রশ্ন তাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে, কারণ সেটা কেবল সম্পর্কের প্রশ্ন নয়—এটা তার অস্তিত্বের প্রশ্ন। পরদিন সকালে সে রঘুবরের কাছে গিয়ে বলে, “বাবা, আমি চাষ করব, কিন্তু আগের মতো নয়। আমি একটা কৃষি-সহায়ক কেন্দ্র গড়ব, যেখানে গ্রামের লোকজন আধুনিক পদ্ধতিতে ফসল ফলাবে, বাজারে বিক্রি করবে। আমাদের মাটি যদি এত উর্বর হয়, তাহলে আমাদের জীবন কেন শুকিয়ে যাবে?” রঘুবর মুখ তুলে তাকায়, তার মুখে প্রথমবার একটা আলোকছটা—ছেলে সত্যিই ফিরে এসেছে, শুধু শরীরে নয়, মনেও। আর আত্রেয়ী? সে হাঁটে মাঠের আল ধরে, পায়ের নিচে কাদা লেগে যায়, তবুও হাসে। কারণ তারও মনে হয়—এই মাটির গন্ধে, এই শেকড়ের টানে, সত্যিকারের ভবিষ্যৎ লেখা হতে পারে।
অধ্যায় ৭: মাটির ডাক
সুব্রতের পরিকল্পনা একসময় শুধু চিন্তার ভিতরে সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু গ্রামের ধুলোমাখা সকাল, নলকূপের জল, আর পুকুরপাড়ে বসে থাকা ধীবরের গল্প শুনতে শুনতে সেই চিন্তা মূর্ত হতে শুরু করল। সে ঠিক করল, শুধু ধান কাটার সময় এসে বাবাকে সাহায্য করলেই চলবে না—গ্রামকে ফিরিয়ে দিতে হবে তার হারিয়ে যাওয়া সম্মান। একদিন, পাড়ার মাঠে সব চাষিদের ডেকে পাঠাল সে। রঘুবর শুরুতে একটু দ্বিধায় ছিলেন, কিন্তু ছেলের মুখে আত্মবিশ্বাস দেখে আর কিছু বলেননি। মাঠে প্রায় কুড়িজন চাষি এসে জমা হয়—কেউ চওড়া গামছা মাথায় বেঁধে এসেছে, কেউ খালি গা, কাঁধে কুদালি। সুব্রত বোঝাতে শুরু করে—কীভাবে মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে বীজের মান বোঝা যায়, কীভাবে ফসল বিক্রির সময় শহরের বাজারদর জেনে নেওয়া যায়, কীভাবে আধুনিক পদ্ধতিতে জল সংরক্ষণ করলে ফলন বাড়ে। প্রথমে তারা অবিশ্বাসে তাকায়, কেউ বলে, “এই মোবাইল দিয়ে কি ধান হয় নাকি?” কিন্তু ধীরে ধীরে, সুব্রতের উদাহরণ আর বাস্তব যুক্তিতে সবাই একে একে মাথা নাড়তে শুরু করে। আত্রেয়ীও পাশে দাঁড়িয়ে, মহিলাদের নিয়ে আলোচনা করে—ঘরের বউদের কীভাবে হোম-মেড প্যাকেজিং দিয়ে আয় করা যায়, কীভাবে মেয়েরা নিজেরাই চাষ শেখার ক্লাস নিতে পারে। সেই মাটির উপর, যেটায় শুধু শস্য গজাত, এবার মানুষ গজাতে শুরু করল—সচেতন মানুষ, জেগে ওঠা মানুষ।
এরপর শুরু হয় প্রকল্পের কাজ। একটা ছোট ঘর তৈরি হয়, খড়ের ছাউনি দেওয়া, ভিতরে পুরোনো চেয়ার-টেবিল, আর এক কোণায় রাখা থাকে পুরনো ডেস্কটপ কম্পিউটার। এটা সুব্রতের “গ্রামীণ কৃষি-সহায়ক কেন্দ্র।” প্রথমে কেউ আসে না, পরে একজন আসে, তারপর দু’জন, এরপর ধীরে ধীরে মানুষজন আসতে শুরু করে। পাড়ার গোপালদা একদিন এসে বলে, “আমার আখের খেতটা কেমন আছে দেখবি তো একবার?” আরেকদিন বাসুদেব মাস্টারমশাই এসে বলে, “সুব্রত, এবার তোরা যদি সফল হোস, তাহলে বাকি গ্রামের ছেলেরা তোদের মতোই গ্রামে থাকবে।” শহর তখন অনেক দূরের এক গল্প হয়ে দাঁড়ায়, যেন কোনো পুরোনো দিনের স্মৃতির মতো। অথচ এখানে, এই মাঠে, এই মাটিতে, প্রতিদিন নতুন কিছু গড়ে উঠছে। আত্রেয়ী সকালের দিকে ছেলেমেয়েদের নিয়ে স্বনির্ভর পাঠশালার আয়োজন করে, যেখানে প্রযুক্তি শেখার পাশাপাশি তারা গ্রামের লোককাহিনি, ধাঁধাঁ, আর রূপকথাও শেখে। কারণ তারা জানে—শিকড়ের শিক্ষা আর আধুনিক জ্ঞান, এই দুই মিলে যে জীবন তৈরি হয়, সেটা সবচাইতে টেকসই। বিনোদিনী মাসি যেদিন প্রথমবার এসে সেই ঘরটা দেখে, তার চোখ ছলছল করে ওঠে—সে শুধু বলে, “আমার ভাইপো এখন মাটির সঙ্গে কথা বলে।”
এক সন্ধ্যায়, যখন পুকুরপাড়ে বক বসে আছে, আর তালগাছের মাথায় ঝিরঝিরে হাওয়া বইছে, তখন সুব্রত একা বসে আছে মাঠে। তার চোখে একধরনের তৃপ্তি—যেমন হয় চাষির, যখন দেখে ধানের শীষ নুয়ে পড়েছে ভারে। আত্রেয়ী এসে তার পাশে বসে। বলে, “তুমি জানো, এই মাটি আমাকে ডাক দেয় এখন। আমি শহরে ফিরতে চাই না আর।” সুব্রত চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর বলে, “এই ডাক আমি অনেকদিন আগে পেয়েছিলাম, কিন্তু তখন বুঝিনি। এখন বুঝি, এই ডাক কখনও মিথ্যে হয় না।” তারা দু’জন মাঠের মাঝখানে হেঁটে যায়, যেখানে একদিন সুব্রতের দাদু চাষ করতেন, আর এখন যেখানে নতুন স্বপ্নের বীজ রোপিত হচ্ছে। সেই রাতের আকাশে তারা ভরে থাকে, আর মাটির গায়ে জমে থাকে ঘাসের শিশির। জীবনের এক অনন্ত চক্র যেন সম্পূর্ণ হয় সেই রাতে—যেখানে ছেলেটি ফিরে আসে, মেয়েটি শেকড় খোঁজে, আর মাটি আবার মানুষকে আশ্রয় দেয়।
অধ্যায় ৮: শেষ বৃষ্টির পরে
বর্ষার শেষ বৃষ্টি নেমেছিল এক বিকেলে—নিমগাছের পাতা ভিজে গিয়েছিল একটানা, আর মাঠজুড়ে ছিল জলজমা। গাঁয়ের মাটির গন্ধ বাতাসে মিলিয়ে গিয়ে একধরনের আর্দ্র মায়া তৈরি করছিল। সেই মাটিতে পা ফেলে যখন সুব্রত মাঠের দিকে হেঁটে যাচ্ছিল, তার মনে হচ্ছিল—এই পথটাই যেন তার জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ পথ, যেখানে শৈশব, যন্ত্রণার ভাঁজ, পড়াশোনার ক্লান্তি আর স্বপ্নের লুকিয়ে থাকা ছায়া—সব মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। আত্রেয়ী পেছনে আসছিল ধীরে ধীরে, তার শাড়ির আঁচলে তখন কাদার ছোপ, চুল বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েছে, কিন্তু তার মুখে ছিল এমন এক প্রশান্তি, যা শহরে কোনওদিন সে খুঁজে পায়নি। চারদিকে পাখির ডাক, গরুর ঘন্টি, আর দূরের বাঁশঝাড়ের ফাঁকে জল জমে থাকা পথ যেন জানিয়ে দিচ্ছিল—মাটির বুকেই লিখে রাখা থাকে মানুষের সত্তা।
সেইদিন রাতে, গ্রামের স্কুলঘরে আয়োজন হয়েছিল “গ্রামীণ উদ্ভাবনী উৎসব”—সুব্রত ও আত্রেয়ীর হাত ধরে শুরু হওয়া একটি প্রয়াস। আশেপাশের দশটা গ্রামের ছেলেমেয়েরা এসেছিল, তারা কেউ হাতে বানানো সেচ যন্ত্র দেখাচ্ছিল, কেউ সোলার প্যানেল চালানো হ্যান্ড-পাম্প, আবার কেউ মোবাইল অ্যাপ থেকে চাষের ডেটা দেখাচ্ছিল। বাসুদেব মাস্টারমশাই চোখে চশমা নামিয়ে বলেছিলেন, “এই উৎসব শুধু প্রদর্শনী নয়, এটা প্রমাণ—আমরাও পারি। শুধু শহর নয়, গ্রামও এখন ভাবছে, বানাচ্ছে, গড়ছে।” রঘুবর মৃদু হেসেছিলেন—এই হাসিতে ছিল গর্ব, বিস্ময়, আর এক চিলতে জল। কমলা পাটির ঘোমটার ফাঁক দিয়ে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, “তুই ফিরেছিস, মানেই আমরা আবার বাঁচতে শিখেছি।” আর তখনই, মঞ্চের আলোয় দাঁড়িয়ে সুব্রত বলেছিল, “শহর আমাকে শিখিয়েছে, কিন্তু গ্রাম আমাকে গড়েছে। আমি দুটোকে আলাদা করব না। কারণ যেখান থেকে আমি এসেছি, সেটাই আমার গন্তব্য।” সেই মুহূর্তে চারপাশের মানুষ চুপ করে শোনে, আর কেউ কেউ চোখ মুছে।
তারপর রাত নামে। উৎসব শেষে সবাই বাড়ি ফিরে যায়, আলো নিভে যায় স্কুলঘরে, কিন্তু মাটিতে পড়ে থাকে মানুষের পায়ের ছাপ—যারা একটা স্বপ্ন দেখে ফেলেছে। সুব্রত আর আত্রেয়ী, দু’জন হাঁটতে হাঁটতে পুকুরপাড়ে গিয়ে বসে। আকাশে তখন পূর্ণিমা, জলে তার প্রতিফলন। হাওয়া ঠাণ্ডা, পাড়ার কুকুর ঘুমিয়ে পড়েছে। আত্রেয়ী বলে, “তুমি জানো? শেষ বৃষ্টির পরেই জমিতে ভালো ফসল হয়। আমি বিশ্বাস করি—এই ‘শেষ বৃষ্টি’ আমাদের জীবনের শেষ নয়, বরং একটা নতুন শুরুর আভাস।” সুব্রত তার দিকে তাকিয়ে শুধু বলে, “আমাদের জীবনটা হোক মাটির মতো—নরম, কিন্তু ধারণক্ষম। যেখানে ফেলে দিলে স্বপ্ন গজায়।” আত্রেয়ী তখন হাতটা রাখে সুব্রতের মাটিতে রাখা হাতের উপর। তারা চুপ করে বসে থাকে, কিছু বলে না—কারণ সেই মুহূর্তে, শব্দের দরকার হয় না। বৃষ্টি চলে গেছে, মাটি ভিজে আছে, আর আকাশের তারা জানিয়ে দেয়—তাদের পথ ঠিক, আর সেই পথেই তারা হেঁটে যাবে—শেকড়ের দিকে, ভবিষ্যতের দিকে।
শেষ