অনুপমা চ্যাটার্জী
এক
নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ, ঠান্ডা কলকাতা নিজের ছায়া ধীরে ধীরে ছড়িয়ে দিচ্ছে শহরের কোণায় কোণায়। সন্ধের আলো মিশে যাচ্ছে গলির অন্ধকারে। দেবাঞ্জন ঘোষাল, সবে মাত্র শেষ করল তার ফটোগ্রাফি অ্যাসাইনমেন্ট — এক পুরনো হাভেলির ধ্বংসপ্রাপ্ত দরজার ক্লোজআপ, ছেঁড়া পর্দার ফ্রেমে বন্দী বিকেলবেলার সূর্য। তার ক্যামেরা ব্যাগ কাঁধে ঝুলে আছে, পায়ে এক ক্লান্ত অথচ সন্তুষ্ট হাঁটা। হ্যারিসন রোড ধরে উত্তরদিকে হেঁটে চলেছে, উদ্দেশ্য কোনো চায়ের দোকান খুঁজে গরম পানীয়ে ঠান্ডা হাড়কে কিছুটা আরাম দেওয়া। কিন্তু গলির এক মোড়ে পৌঁছেই সে থেমে যায়। এক অচেনা রকমের নীরবতা তাকে টেনে ধরে, যেন সময় হঠাৎ থেমে গেছে। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা একজন নারী—কালো লেহেঙ্গায় মোড়া, মাথার চুল খোঁপা করে বাঁধা, কপালে লাল টিপ। কিন্তু সবচেয়ে অস্বাভাবিক ছিল তার পায়ের নুপুরের শব্দ। সে শব্দ ছিল স্পষ্ট, অথচ আশেপাশে কোনও বাতাস নেই, কোনও নড়াচড়া নেই। তার চোখে তাকাতেই দেবাঞ্জনের বুক কেঁপে ওঠে—সেই চোখ যেন এক বিস্মৃত যন্ত্রণার সাক্ষ্য বহন করছে। এক মুহূর্তের জন্য দু’জনের চোখাচোখি, তারপর সেই নারী ধীরে ধীরে বাঁ দিকের এক অন্ধকার গলিতে অদৃশ্য হয়ে যায়।
রাতে দেবাঞ্জন ফিরে আসে তার গোলপার্কের ফ্ল্যাটে। সে সারা পথ কিছু বলল না, এমনকি বাইকটাও যেন চুপচাপ চলল, কোনো শব্দ ছাড়াই। সেই চোখের দৃষ্টি যেন তার ভেতরে ঢুকে গিয়েছে, মনের দেয়ালে আঁচড় কেটে দিয়েছে। সে নিজেকেই প্রশ্ন করতে থাকে—কে সে নারী? কেন তার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হলো, হৃদপিণ্ড যেন আটকে গেছে মাঝপথে, নিঃশ্বাস থেমে যাচ্ছে ধীরে ধীরে? সেই রাতেই শরীরটা খারাপ লাগতে শুরু করে। প্রথমে মাথা ঘোরা, তারপর ঠান্ডা ঘামে ভেজা গাল। ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন আসে—এক বিস্তৃত অন্ধকার প্রাসাদ, যেখানকার বারান্দা দিয়ে হেঁটে আসছে সেই নারী, পায়ের শব্দ যেন মন্ত্রের মত ঘুরে ফিরে আসে—ছন ছন ছন… ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখে ঘর অন্ধকার, অথচ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কার যেন ছায়া। কিন্তু চোখ মেলে তাকাতেই সেটা মিলিয়ে যায়। জ্বর এসে যায় দুপুরের মধ্যেই—১০৩ ডিগ্রি। দেবাঞ্জনের মুখ শুকিয়ে আসে, দেহ নিস্তেজ। ডাক্তার বলে ভাইরাল ইনফেকশন, বিশ্রাম নিতে বলে, কিন্তু তার দৃষ্টি দেখে ঠাকুমা বুঝে যায়—এটা শুধুই শরীরের অসুখ নয়। দেবাঞ্জনের মুখে হালকা হাসি—”আমি কি তবে প্রেমে পড়ে গেলাম, ঠাকুমা?” ঠাকুমা চমকে ওঠেন। “কালো লেহেঙ্গা, বললি? আর নুপুরের শব্দ?” তারপর মুখ গম্ভীর করে বলেন, “এই শহরে কিছু ছায়া আছে রে দেবু, যারা মানুষ নয়, শুধু অপেক্ষায় থাকে কাউকে দেখে ধরা দেবার, আর তারপর তাকে টেনে নিয়ে যাবার…”
পরের দিন সন্ধ্যায়, কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেই দেবাঞ্জন আবার ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। তার মনে অদ্ভুত এক আকর্ষণ, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সেই একই গলির দিকে। রাত আটটা নাগাদ সে ফের পৌঁছে যায় সেই মোড়টায়। বাতাস থেমে আছে, মানুষজন কম, কিন্তু ঠিক সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে সে, যেখান থেকে নারীটি তাকে দেখেছিল আগের রাতে। হঠাৎ তার পেছনে বাতাস কাঁপে, আর ছন ছন শব্দে আবার ফিরে আসে সেই পায়ের মন্ত্র। ধীরে ধীরে সে ফিরে তাকায়, আর দেখে—সে আবার এসেছে। এবার কিছুটা কাছাকাছি, চোখে সেই একই দৃষ্টি, কিন্তু ঠোঁটে এক রহস্যময় হাসি। “তুমি আবার এসেছো?” — কণ্ঠটা ঠাণ্ডা, কিন্তু ভেতরে আগুনের মত দোলা দেয়। দেবাঞ্জন কিছু বলার আগেই সে হেঁটে চলে যায় আবার সেই অন্ধকার গলির ভেতর দিয়ে। আর দেবাঞ্জন দাঁড়িয়ে থাকে ঠিক আগের জায়গাতেই—হৃদপিণ্ড যেন খাঁচা ভেঙে বেড়িয়ে আসতে চাইছে, কিন্তু পা যেন ঠেকে গেছে মাটির সঙ্গে। তারপর অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে সে হাঁটতে শুরু করে, কিন্তু বুঝতে পারে, তার শরীর যেন আগের থেকে আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে। সেই রাতে আর ঘুম আসেনি। সে শুধু ভাবতে থাকে—কে এই নারী? কী তার পরিচয়? আর কেনই বা তার চোখের দিকে তাকালেই মনে হয়, যেন অতীতের কোনও অপরাধ আমার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে, যার শাস্তি আমি না চাইলেও পেতে চলেছি?
দুই
রাত তখন সাড়ে দশটা। গোলপার্কের একতলা ফ্ল্যাটের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে নিম্নচাপের ছোঁয়ায়। ঘরের প্রতিটি কোণ যেন নিজের মধ্যে গুটিয়ে আছে, নিঃশব্দে। দেবাঞ্জন সেই সন্ধ্যার পর থেকে একদৃষ্টে জানালার বাইরে তাকিয়ে রয়েছে। চোখে ঘুম নেই, মুখে বলিরেখার মতো জমে থাকা ধন্দ। ঠাকুমা গায়ত্রী দেবী তাকে ডেকে চা খেতে বললেও সে মাথা নাড়েনি। অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর সে হঠাৎ বলে ওঠে—”কাল রাতে যাকে দেখেছিলাম, তাকেই আজ আবার দেখলাম ঠাকুমা। একদম সেই একই জায়গায়। কালো লেহেঙ্গা, পায়ে নুপুর। কিন্তু এবার সে কথা বলল… বলল, আমি আবার ফিরে এসেছি।” ঠাকুমা ধীরে ধীরে চায়ের কাপ রেখে উঠে দাঁড়ালেন। তার মুখের রেখা শক্ত হয়ে গেছে। “এই শহর ভুলে যায় না, দেবু… কিছু মুখ থেকে যায় রক্তে মিশে। তোর দাদু একটা গল্প বলত একসময়… শুনবি?” দেবাঞ্জন কিছু বলে না, মাথা নিচু করে বসে থাকে। ঠাকুমা ধীরে ধীরে নিজের ঘর থেকে একটি পুরনো কাঠের বাক্স বের করে আনলেন—তাতে ছিল এক চুড়ি, একটা বিবর্ণ ছবি, আর একটা চিঠি। “এই মেয়েটা, যার ছবি দেখছিস, তার নাম ছিল নন্দিনী। তখনকার জমিদার কন্যা। খুবই সুন্দরী, কিন্তু নিজের পছন্দের এক নিম্নবর্ণের যুবকের সঙ্গে প্রেমে পড়ে যায়। পরিবার মেনে নেয়নি, আর ছেলেটাকে একদিন রাতে খুন করে গাছে ঝুলিয়ে দেয়। নন্দিনী মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। তার শেষ রাতের কথা কেউ ভুলতে পারে না—সে কালো লেহেঙ্গা পরে পায়ে নুপুর পড়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছিল, তারপর আর ফেরেনি। পরে তার দেহ পাওয়া যায় বাগানের জলের ট্যাংকে। চুল খোলা, মুখ বিকৃত, আর শরীরে আগুনের পোড়া দাগ। কিন্তু সেই রাতের পর থেকেই মানুষ বলে—নন্দিনী ফেরে, সন্ধ্যার অন্ধকারে, যাদের প্রেমের নামে প্রতারণা করে, তাদের শাস্তি দিতে।”
দেবাঞ্জনের শরীর কাঁপে। মাথার ভেতর যেন ঝড় উঠছে। ছবির মেয়েটার চোখের দিকে তাকাতেই বুকের ভিতরে কেমন ঠকঠক করে ওঠে। এ তো সেই একই দৃষ্টি! একই শূন্যতা! সে বিশ্বাস করতে পারে না, একটা গল্প, ঠাকুমার পুরনো কাহিনি, আর তার নিজের অভিজ্ঞতা—সব কিছু কেমন মিলেমিশে যাচ্ছে! সে উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের এদিক-ওদিক হাঁটতে শুরু করে, হাতের মধ্যে অনিচ্ছাসত্ত্বেও সেই ছবিটা আঁকড়ে ধরে। “কিন্তু ঠাকুমা,” সে ধীরে বলে, “ও তো আমার সঙ্গে খারাপ কিছু করেনি, বরং… যেন আমাকে ডাকছিল। ওর চোখে তো ছিল শুধু দুঃখ। আমি যেন… যেন তার দিকে না তাকিয়ে থাকতে পারিনি।” ঠাকুমা এবার সরাসরি দেবাঞ্জনের দিকে তাকান। “ওর দুঃখই ওর অস্ত্র, দেবু। এইসব আত্মা মানুষকে প্রতারিত করে না, মোহিত করে। আর তোর মত অনুভবী মন তো সেই ফাঁদে সহজেই পড়ে যায়। কিন্তু তুই বুঝতে পারছিস না, ওর দিকে তাকানো মানেই ধ্বংস ডেকে আনা।” দেবাঞ্জন চুপ করে থাকে, কিন্তু ভিতরে ভিতরে সে অনুভব করে, নন্দিনীর অস্তিত্ব কেবল আতঙ্ক নয়—তাকে যেন কোনো কারণে নিজেই খুঁজছে। সে অনুভব করে, তার আর এই মেয়েটির মাঝে কোনও পূর্বজন্মের বন্ধন লুকিয়ে আছে কি না।
পরদিন বিকেলে সে একা চলে যায় কলেজ স্ট্রিটের ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে। পুরনো জমিদারবাড়ি ও উত্তর কলকাতার স্থানীয় লোককাহিনি নিয়ে কিছু রেকর্ড খুঁজতে খুঁজতে সে পায় একটা নিউজ ক্লিপিংস—১৯৭২ সালের, যেখানে লেখা: “জমিদার কন্যার রহস্যমৃত্যু, সমাজ স্তম্ভিত।” সেই প্রতিবেদনে নাম ছিল: নন্দিনী চৌধুরী। কনকচূড়ায় অবস্থিত সেই জমিদারবাড়ির ছবি ছাপা হয়েছিল সাথে, যার বারান্দায় এখনো পড়ে আছে ধ্বস্ত বেদি, ছেঁড়া পর্দা। দেবাঞ্জনের বুকটা ধক করে ওঠে—এই ছবি তার স্বপ্নে এসেছিল! সেখানে লেখা ছিল নন্দিনী প্রেম করতেন তাদের পরিবারের বাগানের মালী বিপিনের সঙ্গে। জমিদারের পুত্ররা তার “অপবিত্রতা” ঢাকতে তাকে পুড়িয়ে মারে বলে সন্দেহ, কিন্তু কোনও প্রমাণ মেলেনি। দেবাঞ্জন সিদ্ধান্ত নেয়—তাকে কনকচূড়া যেতেই হবে, সেই জমিদারবাড়ি দেখতে হবে, বুঝতে হবে এই অভিশপ্ত প্রেমের গল্পের ভিতর সত্য কতটা, কল্পনা কতটা। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে সে দেখে, তার জানালার কাচে ঘাম জমেছে—অথচ ঘরেই কেউ ছিল না। আর বিছানার পায়ের কাছে পড়ে আছে একটি কাঁচের নুপুর… অর্ধেক ভাঙা। সে যখন তা হাতে তুলে নেয়, ঠান্ডায় যেন হাত জমে যায়। এই শহরের রাত যেন তাকে আর ধরে রাখতে পারছে না।
তিন
কনকচূড়ার জমিদারবাড়ি—প্রবেশপথে ধ্বস্ত শ্বেতপাথরের সিংহদ্বার, যেখানে মুছে যাওয়া নামফলকে এখনো কিছু খোদাই চিহ্ন থেকে গেছে, যেমন—‘চৌধুরী বাড়ি, ১৮৯৪’। দেবাঞ্জন ঘোষাল তার পুরনো নিকন ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল মূল গেটের সামনে। কুয়াশায় মোড়ানো সকাল, এবং সেই পরিত্যক্ত বাড়ির নিস্তব্ধতা যেন বাতাসের শব্দকেও গিলে নিচ্ছে। সে ধীরে ধীরে ভেতরে ঢোকে, দেওয়ালের ভাঙা পলেস্তারা আর ঝুলন্ত লতাগুল্মের ফাঁক দিয়ে আলো ঢুকছে, যেন সেই ঘরগুলোর দুঃখ এখনো রয়ে গেছে। হঠাৎই এক ঠান্ডা শিরশিরে হাওয়া তার ঘাড়ের পেছন দিয়ে বয়ে যায়। আর সেই মুহূর্তে—সে আবার শুনতে পায় সেই পরিচিত শব্দ—ছন… ছন… ছন…। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই হৃদস্পন্দন যেন স্থির হয়ে যায়। তার সামনেই দাঁড়িয়ে নন্দিনী—অবিকল সেই আগের রূপে—কালো লেহেঙ্গা, লাল টিপ, পায়ে নুপুর। এবার কিন্তু সে স্পষ্ট বলে ওঠে, “তুমি এসেছো?” দেবাঞ্জন হতভম্ব হয়ে কিছু বলতে পারে না। নন্দিনী ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে, তার চোখে এক অপার্থিব দীপ্তি, কিন্তু মুখে এক বিষণ্ণতা, যেন কেউ চিরকাল অপেক্ষা করেছে এই দেখা হওয়ার জন্য।
“তুমি আমায় চেনো?” — গলায় কাঁপন নিয়ে জিজ্ঞেস করে দেবাঞ্জন। নন্দিনী হালকা হেসে বলে, “তুমি সব জানবে সময় হলে। শুধু এটুকু জানো, আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।” তার গলার স্বর যেন ঘন মেঘলা আকাশে বজ্রপাতের আগমনী সুর, গা শিরশির করে ওঠে। কিন্তু ভয়ের বদলে দেবাঞ্জনের হৃদয়ে জন্ম নেয় এক অবর্ণনীয় টান, যেন সে এই মেয়েটিকে বহু জন্ম ধরে চেনে। নন্দিনী তার দিকে এগিয়ে এসে ধীরে ধীরে বলল, “আমায় কেউ ভালোবাসেনি, দেবাঞ্জন। সবাই শুধু ভয় পেত। কিন্তু তুমি আমাকে ভয় পাও না।” দেবাঞ্জনের মুখে কোনো উত্তর আসে না, শুধু সে নীচু গলায় বলল, “তুমি কি… সত্যি?” — নন্দিনী উত্তর দিল না। হঠাৎই আশেপাশের বাতাস ঘন হয়ে এল, চারপাশের রঙ যেন সাদা-কালোয় রূপ নিল। কিছুক্ষণ সব থেমে থাকল। তারপর নন্দিনী একটানা তাকিয়ে রইল দেবাঞ্জনের চোখে, আর তারপর পিছন ফিরে চলে গেল ছাদের দিকের সিঁড়ির দিকে, ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল কুয়াশায়। দেবাঞ্জন দৌড়ে উঠতে চাইলে পা হড়কে পড়ে যায়, আর চোখের সামনে অন্ধকার।
জ্ঞান ফেরে বিকেলে, স্থানীয় এক কেয়ারটেকার তাকে দেখে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। হালকা আঘাত, মস্তিষ্কে ধাক্কা। কিন্তু দেবাঞ্জনের মনে তখনও প্রতিধ্বনি বাজছে নন্দিনীর সেই প্রশ্ন—“তুমি এসেছো?” সে বুঝতে পারছে না, সে কি এক আত্মার প্রেমে পড়ছে, নাকি নিজেরই মানসিক বিভ্রমে হারিয়ে যাচ্ছে? হাসপাতালের জানালার পাশে বসে সে নিজের ডায়েরিতে লেখে—”যদি সে বিভ্রম হয়, তবে আমি স্বেচ্ছায় হারাতে চাই। আর যদি সে বাস্তব হয়, তবে আমি তার মৃত্যুর সঙ্গেও হাঁটতে রাজি।” সে ফিরতে চায় না, সে পালাতে চায় না। আর সেই রাতেই, যখন সে হাসপাতালের বিছানায় চোখ বন্ধ করে ছিল, হঠাৎ শুনতে পায় জানালার বাইরে সেই চেনা ছন ছন শব্দ। চোখ খুলে জানালার দিকে তাকাতেই দেখে এক পায়ের ছায়া, যেন কেউ একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। সে বিছানা থেকে উঠে আসে, জানালা খোলে, কিন্তু বাইরে কেউ নেই। শুধু বাতাসে ভেসে আসে এক গন্ধ—বেলফুল আর কিছু জ্বলন্ত চুলের গন্ধের সংমিশ্রণ। দেবাঞ্জনের ঠোঁটে হাসি খেলে যায়। সে জানে—নন্দিনী গেছে না, বরং কাছে এসেছে… অনেক কাছাকাছি।
চার
কলকাতায় ফিরে এসে দেবাঞ্জন যখন নিজের ঘরের দরজাটা খুলল, ঠিক তখনই তার ফোনটা কাঁপতে শুরু করল। স্ক্রিনে নাম জ্বলজ্বল করছে — ঈশান রায়। তার কলেজের পুরনো বন্ধু, বর্তমানে সংবাদপত্রের এক অনুসন্ধানী সাংবাদিক। “তোকে তো খুঁজে পাচ্ছি না কয়েকদিন! কোথায় ছিলি?” — ফোনের ওপাশ থেকে ঈশানের কণ্ঠে চাপা বিরক্তি। দেবাঞ্জন প্রথমে কিছু বলতে চায়নি, কিন্তু ঈশান জোরাজুরি করলে সব খুলে বলে — কালো লেহেঙ্গা পরা এক নারী, তার চোখ, তার উপস্থিতি, তার কথা, আর সেই জমিদারবাড়িতে দ্বিতীয়বার দেখা হওয়ার অভিজ্ঞতা। সব শুনে ঈশান প্রথমে হাসে। “তুই তো সত্যিই হ্যালুসিনেশনে চলে গেছিস! দেবু, তুই কী বলছিস জানিস? এক মৃত মেয়ের প্রেমে পড়েছিস, যার প্রেতাত্মা কলকাতায় ঘুরে বেড়াচ্ছে?” দেবাঞ্জন নীরব থাকে। তারপর ধীরে বলল, “হ্যাঁ ঈশান, আমি জানি এটা পাগলামি শোনায়। কিন্তু আমি চোখে দেখেছি, স্পর্শ করেছি, তার গন্ধ পেয়েছি। আমি জানি আমি যা দেখছি, তা সত্যি।” ঈশান কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, “তুই সিরিয়াসলি একটাও ছবি তুলিসনি?” দেবাঞ্জন ক্যামেরার ব্যাগ থেকে মেমোরি কার্ড বের করে দেয়ালে প্রোজেক্ট করে দেখায়, কিন্তু অবাক করা বিষয় — সেই দিনের সব ছবি আছে, শুধু নন্দিনীর কোনও চিহ্ন নেই! ক্যামেরার চোখে যে নারী কখনো ছিলই না! ঈশানের চোখ গোল হয়ে যায়, কিন্তু সে বলার চেষ্টা করে — “এটা কোনো ট্রিক, হয়তো লেন্সের রিফ্লেকশন… অথবা তুই হয়তো শারীরিকভাবে এত ক্লান্ত ছিলি, যে তোর ব্রেনই তোকে সব বানিয়ে দেখাচ্ছে।”
কিন্তু দেবাঞ্জন চুপচাপ নিজের টেবিলের ড্রয়ার থেকে বের করে এক জিনিস ঈশানকে দেয় — সেই কাঁচের ভাঙা নুপুর। ঈশান সেটি হাতে নিতেই তার আঙুল কেঁপে ওঠে — ঠান্ডা, অস্বাভাবিকভাবে ঠান্ডা ধাতুর মতো। দেবাঞ্জন বলে, “এটা আমি ওর দেখা পাওয়ার পরে পেয়েছিলাম। ঘরের মেঝেতে। তুই যদি বিশ্বাস না করিস, তাহলে এটাও এক কাকতালীয় ঘটনা ধরে নে।” ঈশান মৃদু গলায় বলল, “দেখ, আমি তোকে পাগল ভাবছি না। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যুক্তিকে। তুই তো আগে এমন ছিলি না, এখন দেখছি কেমন যেন এক ‘ট্রান্স’-এর মধ্যে থাকিস। এমন কিছু তুই দেখছিস, যা আমরা বাকি সবাই দেখতে পাচ্ছি না — এটা কি প্রেম, না তোর কোনো অবচেতন অপরাধবোধ?” দেবাঞ্জন ঈশানের দিকে তাকায়। “আমি জানি, ওর মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। আমি যেন প্রতিদিন তার দুঃখ টের পাই, যেন সে আমায় খুঁজে বেড়াচ্ছে প্রতিশোধ নয়, মুক্তির জন্য। আর আমি ওকে ভালোবেসে ফেলেছি।” ঈশান চুপচাপ উঠে দাঁড়ায়। “তুই যা বলিস বল, আমি এটা ছেড়ে দিতে পারি না। আমি এই ‘নন্দিনী’ নামটা খুঁজে দেখব। যদি সত্যি কিছু হয়ে থাকে, তাহলে সেটা ইতিহাসে কোথাও থাকবেই। আর যদি না থাকে, তবে আমি তোকে প্রমাণ করে দেব — তুই শুধু একা একা স্বপ্ন দেখছিস।” সে বাইরে বেরিয়ে যায়, কিন্তু তার মুখে ছিল অস্বস্তি। যেন মনে মনে স্বীকার করেও নিতে পারছে না, যে এই অদ্ভুত অভিজ্ঞতাগুলো নিছক বিভ্রম।
ঈশান ফিরে যায় নিজের অফিসে এবং গভীর অনুসন্ধান শুরু করে। পুরনো সংবাদপত্র, কলকাতা হেরিটেজ ফাইল, জমিদার বাড়ির ইতিহাস — সব ঘাঁটতে ঘাঁটতে এক রাতে সে খুঁজে পায় এক জীর্ণ বইয়ের ভিতরে থাকা একটি অসমাপ্ত প্রতিবেদনের কপি, যেখানে লেখা: “নন্দিনী চৌধুরী, জমিদারবাড়ির কন্যা, প্রেমের অপরাধে নিখোঁজ। কিছুজন বলেন সে আত্মহত্যা করেছে, কেউ বলেন তাকে খুন করা হয়েছে। আর কিছু লোক বিশ্বাস করেন—সে ফেরে। বিশেষ করে নভেম্বরের মাসে।” ঈশান ফোন তুলে দেবাঞ্জনকে কল করে। “দেবু, একটা কথা বলি? আমি জানি না এটা কাকতালীয়, না অভিশাপ, কিন্তু ঘটনাগুলো একে অপরের সঙ্গে অদ্ভুতভাবে মিলছে। আমি একটা প্যারানর্মাল স্টাডি গ্রুপের লোকেদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। তুই চাইলে ওদের সঙ্গে কথা বলতে পারিস।” দেবাঞ্জন মৃদু হেসে বলে, “ওরা কি প্রেম বোঝে, ঈশান?” ফোনের ওপাশে ঈশান চুপ করে থাকে। হয়তো সে এখন বুঝতে পারছে, কিছু অনুভূতি যুক্তির ঊর্ধ্বে — আর কিছু সম্পর্ক, মৃত্যুর পরেও শেষ হয় না।
পাঁচ
কনকচূড়া গ্রামটা যেন সময়ের বাইরে আটকে থাকা একটা ছায়া, যেখানে আধুনিকতা পৌঁছায়নি, আর পৌরাণিক বিশ্বাস এখনো মানুষের মন নিয়ন্ত্রণ করে। একশো বছরের পুরনো সেই জমিদারবাড়ি থেকে সামান্য দূরে ছোটো একটা মাটির ঘরে থাকে একজন বৃদ্ধ — নরেন চাচা। গ্রামের সবাই বলে, তিনিই শেষ ব্যক্তি, যিনি নন্দিনী চৌধুরীর জীবিত অবস্থা নিজের চোখে দেখেছিলেন। দেবাঞ্জন সকালে পৌঁছে গেলে নরেন চাচা প্রথমে তাকে ভিতরে ডাকেন না। দরজার ফাঁক দিয়ে কড়া চোখে দেখেন। “তুমি কি তার কাছে গেছ?” — প্রথম প্রশ্নেই বুকটা কেঁপে ওঠে দেবাঞ্জনের। সে মাথা নাড়ায়। নরেন চাচা দরজা খুলে দেন। ঘরের ভেতরে পুরনো কাঠের চৌকি, দেয়ালে হলুদ হয়ে যাওয়া কালজয়ী ফ্রেম, আর কোণে ধুপকাঠির গন্ধ। বৃদ্ধ ধীরে বসে বলেন, “ও ফিরেছে, তাই তো?” দেবাঞ্জন চুপচাপ বসে থাকে, আর নরেন চাচা যেন নিজের গলার স্বরকেই অনুসরণ করে হারিয়ে যেতে থাকেন সেই অতীতে।
“নন্দিনী ছিল আলোর মতন মেয়ে, বাবার অঙ্গুলিতে ঘুরত না, নিজের মত করে চলত,” — শুরু করেন নরেন চাচা। “জমিদার মহাশয়ের একমাত্র মেয়ে। মুখে যেন চাঁদের আলো। কিন্তু অভিশাপ ছিল জন্ম থেকেই—মা মরেছিল প্রসবে, আর দাদারা ছিল রাজনীতি আর ক্ষমতার পেছনে। ওর জীবনে একটু কোমলতা ছিল কেবল বাগানের ছেলেটা—বিপিন। ওরা দুজন লুকিয়ে দেখা করত, আমি জানতাম, কিন্তু বলিনি কাউকে।” নরেন চাচার গলা ভারি হয়ে আসে। “একদিন ভুল করে নন্দিনী তার হাতে একটা ব্রেসলেট দিয়ে দেয়, সেটা ওর দাদা দেখে ফেলে। তারপর যা হল, তা স্বপ্নেও ভাবিনি। একরাতে বিপিন নিখোঁজ হয়ে গেল। পরে তার দেহ পাওয়া যায় পুকুরঘাটে, চোখ আর জিভ তুলে নেওয়া। নন্দিনী পাগল হয়ে গেল—না খেয়ে, না ঘুমিয়ে কাঁদত বারান্দায় দাঁড়িয়ে। কেউ তার কাছে যেত না। এক রাত, পৌষের কুয়াশা আর অন্ধকারে ও বাড়ি ছাড়ে — পরে ওর পোড়া দেহ মেলে গাছতলায়, একটা কালীমূর্তির সামনে। মুখ পুরো পুড়ে গিয়েছিল, কিন্তু হাতে তখনো ছিল সেই নুপুর, যে নুপুর আমি নিজে দিয়েছিলাম তাঁকে।”
দেবাঞ্জনের গা শিউরে ওঠে। নরেন চাচার মুখে ভয়ের কোনো চিহ্ন নেই, কেবল একটা ক্লান্তি। “ওর মৃত্যু হয়নি, বাবু। ও নিজেই ফিরে এসেছে। প্রতি বছর এই সময়েই—নভেম্বরের শেষ রাতে। ও ভালোবাসতে জানত, কিন্তু যাদের ভালোবাসত, তারাই ওকে খুন করল। এখন ও বেছে নেয় সেই পুরুষদের, যাদের চোখে মায়া আছে, কিন্তু যাদের হৃদয়ে ভয় নেই। সে তোমাকে পছন্দ করেছে, বাবু।” নরেন চাচা উঠে এসে একটা ছোটো বাক্স এনে দেয় — ভেতরে পুরনো একখানা চিঠি, কিছু পুড়ে যাওয়া কাগজ, আর সেই প্রাচীন দিনের ছবি—যেখানে দেখা যাচ্ছে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে এক কিশোরী মেয়ে, চোখে তাকালে বুকের মধ্যে চাপ পড়ে। “তুমি যদি সত্যিই ওকে ভালোবাসো, তাহলে ওর আত্মাকে মুক্ত করো। তোমার ভালোবাসায় যদি সত্য থাকে, তাহলে ও নিজেই হারিয়ে যাবে। না হলে… তুমি হবে তার পরবর্তী অভিশাপ।” নরেন চাচা হঠাৎ চুপ করে যান। বাইরের বাতাসে ছন ছন করে বাজে পায়ের শব্দ, যেন এক নারীর উপস্থিতি অদূরেই। দেবাঞ্জনের চোখে জল চলে আসে—ভয়ের জন্য নয়, বরং তীব্র মমতায়। সে জানে, সে এবার আর পিছু হটবে না। সে নন্দিনীকে শেষবারের মতো দেখতে চায়—ভালোবাসার জন্য, অথবা নিজের মৃত্যুর জন্য।
ছয়
কনকচূড়ার আকাশে তখন চাঁদের আলো নেই, কুয়াশার ঘোমটা যেন মাটিকে ঢেকে রেখেছে এক মৃত শিয়রে চাদরের মতো। জমিদারবাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেবাঞ্জনের মুখে কোনও ভয় নেই, শুধুই অপেক্ষা—একটি দৃষ্টির জন্য, একটি উপস্থিতির জন্য, যে আজ আর তাকে অন্ধকার থেকে পালাতে দেবে না। তার মনে পড়ছিল নরেন চাচার কথা—”তুমি যদি সত্যি ভালোবাসো, তাহলে ও নিজেই মুক্তি পাবে।” তার কাঁধে ক্যামেরা নেই, ডায়েরি নেই, কিছু নেই—শুধু একখানা ফুল, সাদা চামেলি, আর একখানা পুরনো ছবি, যেখানে নন্দিনী আছে তার বাগানের পাশে দাঁড়িয়ে, চোখে সেই চিরচেনা বিষণ্ণতা। হঠাৎ, হাওয়ার এক নিঃশব্দ দোলা তাকে সচকিত করে তোলে। পেছনে ফিরে সে দেখে—সে এসেছেই। ধীরে ধীরে, নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে, যেন বাতাস তাকে ছুঁতে ভয় পাচ্ছে। আজকের রাতে সে যেন আগের থেকে আলোকিত, অথচ চোখে সেই একই দুঃখ, মুখে ধোঁয়াটে হাসি। “তুমি ফিরেছো?”—নন্দিনী ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করে। দেবাঞ্জন এগিয়ে গিয়ে তার হাতে সেই চামেলির ফুলটি রাখে। “তোমার জন্য,” সে বলে।
নন্দিনী ধীরে সেই ফুলটা নিয়ে চোখে লাগায়, তারপর বলে, “তুমি জানো তো আমি কে?” দেবাঞ্জন মাথা হেঁট করে বলে, “আমি জানি তুমি কে ছিলে। কিন্তু আমি যা জানি, তার থেকেও বেশি আমি অনুভব করি—তুমি কে, এখন।” সে ধীরে নন্দিনীর মুখের দিকে তাকায়—সেই মুখ, যেখানে আছে ভয়, প্রেম, অভিশাপ আর মুক্তির সব কিছুর মিশ্রণ। “আমি তোমায় ভালোবাসি, নন্দিনী। এমন ভালোবাসা যা শরীরের নয়, আত্মার।” নন্দিনী হেসে ফেলে। “তুমি জানো না, ভালোবাসার কী মূল্য দিতে হয়। আমি যাদের ভালোবেসেছি, তারা সবাই মরে গেছে। আমি চাইনি, কিন্তু তারা হারিয়ে গেছে। তুমি আমার জন্য তৈরি নও।” দেবাঞ্জন চুপ করে থাকে। “তুমি যদি আমার হতে চাও,” নন্দিনী ধীরে ধীরে বলে, “তবে তোমাকে মৃত্যুকে ছুঁতে হবে।” তারপর সে এগিয়ে এসে তার ঠোঁটে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ায়—কোনও উষ্ণতা নেই, কোনও কাঁপুনি নেই, শুধু এক গা ছমছমে শূন্যতা, যেন সেই চুম্বন মৃত্যুরই আরেক রূপ।
চোখের সামনে চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। দেবাঞ্জন টের পায় না সে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে, না-কি সে অন্য কোনও স্তরে চলে গেছে। কিন্তু তার শরীর হালকা, মনে হচ্ছে এক গহীন নদীর ধারে দাঁড়িয়ে আছে—পেছনে লাল শাড়ি, সামনে কুয়াশা। আর সামনে দাঁড়িয়ে আছে নন্দিনী, সম্পূর্ণ অন্য এক রূপে—মুখে কোনও বিষণ্ণতা নেই, চোখে শান্তি, যেন অভিশাপের শিকল ভেঙে গেছে। “তুমি আমাকে সত্যিকারের ভালোবেসেছো,” সে বলে। “তোমার ভালোবাসা আমাকে বাঁচাতে পারেনি, কিন্তু মুক্তি দিয়েছে।” চারপাশে আলো ছড়িয়ে পড়ে, আর হঠাৎ নন্দিনী মিলিয়ে যায় বাতাসে—থেকে যায় শুধু ছন ছন করে পায়ের শব্দ, আর একটা চামেলির ফুল, যা উড়ে এসে দেবাঞ্জনের বুকে পড়ে। ঠিক তখনই তার নিঃশ্বাস ফিরে আসে। সে জেগে ওঠে ভোরের আলোয়—জমিদারবাড়ির বারান্দায়, একা। তার শরীরে ঠান্ডা, কিন্তু মন গভীরভাবে শান্ত। আর পাশেই পড়ে আছে সেই ছবি—নন্দিনীর, যেখানে তার মুখে প্রথমবার দেখা যাচ্ছে হাসি। দেবাঞ্জন জানে, সে নন্দিনীকে হারায়নি। সে তাকে মুক্ত করেছে, আত্মার বন্ধন থেকে। এখন সে আর ‘অভিশপ্ত’ নয়—সে এক স্মৃতি, এক প্রেম, এক মুক্ত আত্মা।
সাত
নভেম্বরের শেষ রাত্রির পরে দেবাঞ্জনের জীবন যেন ঘড়ির কাঁটার মতো পালটে যায়। যে মানুষটা ক্যামেরায় মানুষ আর শহরকে খুঁজে বেড়াত, সে এখন দিনের পর দিন তাকিয়ে থাকে ফাঁকা আকাশের দিকে, যেন সেখানেই এক মুখ দেখা যায়—নন্দিনীর মুখ। ওর চলে যাওয়া কোনও শেষ নয়, বরং এক নীরব উপস্থিতি, যা ছায়ার মতো লেগে থাকে, হাওয়া হয়ে গায়ে বসে থাকে। ঈশান যখন তাকে দেখতে এল, দেবাঞ্জনের চোখে অদ্ভুত এক প্রশান্তি দেখে সে থমকে যায়। “তুই কি এখনো বিশ্বাস করিস, সে ছিল সত্যি?” — ঈশান জিজ্ঞাসা করে। দেবাঞ্জন ধীরে মাথা নাড়ে। “সে ছিল সত্যি, ঈশান। যেমন আমি আছি, তেমনি। তবে সে ছিল সময়ের বাইরে। সে মুক্ত হয়েছে, এখন আর আসে না। কিন্তু আমি তাকে অনুভব করি। প্রতিদিন।” ঈশান নরম গলায় বলে, “তুই জানিস, তোর শরীরটা কিন্তু ভেতরে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ডাক্তার বলেছে কিছু দুঃসাহসিক নিউরো-ইমিউন রিঅ্যাকশন হয়েছে, তোর শরীর ধীরে ধীরে সাড়া দেওয়া বন্ধ করে দিচ্ছে।” দেবাঞ্জনের মুখে এক টুকরো হাসি। “ভালোবাসা হয়তো এমনই, ঈশান। যার পরিণতি দেহে হয় না, হয় আত্মায়।”
এই সংবাদ ঈশানকে স্তব্ধ করে দেয়। সে বুঝতে পারে, যুক্তি দিয়ে সবকিছু ব্যাখ্যা করা যায় না। দেবাঞ্জনের শিরায় যে প্রেম বইছে, তা কোনও নারীর প্রতি নয়—তা এক আত্মার সঙ্গে আত্মার বন্ধন, এক মৃত্যু-ছোঁয়া ভালোবাসা, যা তার শরীরকে ভাঙলেও মনের ভিতর কিছু একটা গড়ে দিয়েছে। দেবাঞ্জন এখন আর হাসপাতালে যেতে চায় না, ওষুধ খেতে চায় না। সে শুধু অপেক্ষা করে এক নিশুত রাতের জন্য—যখন বাতাস কাঁপবে, নুপুর বাজবে, আর নন্দিনীর ছায়া তাকে নিতে আসবে। প্রতিরাত সে সেই চামেলির ফুলগুলো বিছানার পাশে রাখে, সেই ছবি দেয়ালের গায়ে ঠেকিয়ে দেয়, আর জানালার পর্দা খোলা রাখে—যদি সে আবার ফিরে আসে। এক রাতে, বিদ্যুৎহীন হাওয়ায়, যখন চারপাশ স্তব্ধ, হঠাৎ সে অনুভব করে এক পরিচিত গন্ধ—বেলফুলের। চোখ খোলার আগে থেকেই সে বুঝে যায়—সে এসেছে। এবার শব্দ নেই, আলো নেই, শুধু এক শীতল হাত তার কপালে রাখে, আর ফিসফিস করে বলে—“তুমি প্রস্তুত তো?”
সকালবেলা ঈশান ফোন করে, বারবার। কোনও উত্তর নেই। সে দেবাঞ্জনের ঘরে ছুটে আসে। দরজা খোলা, ঘরের বাতাস ঠান্ডা, কিন্তু অদ্ভুত শান্ত। বিছানার পাশে একটা খোলা খাতা—লেখা আছে:
“তোমরা বলেছিলে, সে মৃত্যু,
আমি বলি, সে মুক্তি।
তোমরা বলেছিলে, সে অভিশাপ,
আমি বলি, সে প্রেম।
আমি চললাম, তার সঙ্গে।
যেখানে দেহ ফুরোয়,
সেখানে ভালোবাসা শুরু হয়।”
বিছানায় দেবাঞ্জন শুয়ে আছেন—চোখ বন্ধ, মুখে শান্তির ছায়া, বুকের উপর রাখা চামেলি ফুল। ডাক্তাররা বলেন, ঘুমের মধ্যে হার্ট ফেল করেছে। কিন্তু ঈশান জানে, ওর শরীর থেমে গেছে, কিন্তু ওর আত্মা? সে তো নন্দিনীর সঙ্গে চলেই গেছে—যেখানে অভিশাপ আর প্রেম এক হয়ে যায়, আর মৃত্যুও মাথা নত করে।
আট
দেবাঞ্জনের মৃত্যুর পর এক মাস কেটে গেছে। কনকচূড়ার জমিদারবাড়ি এখনো দাঁড়িয়ে আছে এক বোবা সাক্ষীর মতো, ঠিক যেমন ছিল আগেও—কিন্তু ঈশানের চোখে এখন সবকিছু অন্যরকম। বন্ধু হারানোর শোক একদিকে, আর অন্যদিকে অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা—যা তার যুক্তিবাদী বিশ্বাসকে নাড়িয়ে দিয়েছে গভীরভাবে। দেবাঞ্জনের মৃত্যুর পরে সে এক অন্ধকার রাতেই গিয়েছিল সেই বাড়িতে। সেদিন ছিল সেই একই দিন—নভেম্বরের শেষ রাত। বাতাসে আবার সেই পরিচিত বেলফুলের গন্ধ, আর পায়ের আওয়াজ—ছন ছন ছন… ঈশান সাহস করে বারান্দা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে যায়। আর ঠিক সেখানেই, বারান্দার ঝুলে পড়া পর্দার ছায়ার নিচে দাঁড়িয়ে এক নারী—কালো লেহেঙ্গা, খোলা চুল, পায়ে নুপুর, কিন্তু চোখে জল। সে ধীরে ধীরে ঈশানের দিকে এগিয়ে এসে বলে, “তুমি তার বন্ধু, তাই তো? ও ভালোবাসতে শিখেছিল, মৃত্যুকে ছুঁয়ে। আমি এখন মুক্ত, কিন্তু ও… আমার ভেতরেই থেকে গেছে। সে এখন আর মানুষ নয়, সে এখন আমার আলো।” ঈশান কিছু বলতে চায়, কিন্তু গলা শুকিয়ে আসে। নন্দিনীর মুখ যেন মাটির নয়, যেন ছায়ার আলোর গড়া কিছু, যার গভীরে দেবাঞ্জনের চেহারা ধীরে ধীরে মিলিয়ে এসে স্থির হয়।
ঈশান জোর করে বলে ওঠে, “তুমি কি… ওকে টেনে নিয়ে গেলে?”
নন্দিনী মাথা নাড়ায়। “আমি কাউকে নিয়ে যাই না। সে নিজেই এল। ভালোবাসা দিয়ে মুক্ত করেছিল আমাকে, আর নিজেকে বেঁধে ফেলেছিল আমার হৃদয়ের সঙ্গে। এখন সে আমার প্রতিধ্বনি। সে নেই, কিন্তু আমি আছি ওর ভেতরে। আর এই বাড়ি—এটাই এখন আমাদের ঠাঁই।” ঈশান ধীরে ধীরে পিছু হটে। কিন্তু যাবার আগে সে বলে, “তোমরা কি আবার ফিরে আসবে?”
নন্দিনী বলে, “প্রেম যদি সত্যি হয়, তবে আত্মা ফিরে আসে না। সে ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে, গন্ধে, আলোয়। আমাদের আর ফিরে আসার প্রয়োজন নেই। আমরা আছি, যাদের হৃদয়ে বিশ্বাস আছে।”
সেই মুহূর্তে হাওয়ায় আবার ছড়িয়ে পড়ে বেলফুলের গন্ধ, জানালার কাঁচে জমে ওঠে শিশিরের নকশা, যেন কারও লেখা শেষ হয়ে যাওয়া কবিতা। ঈশান বুঝতে পারে—এই গল্পে কোনও ভূত নেই, কোনও অভিশাপ নেই—এ এক প্রেমের এমন দ্যুতি, যা মৃত্যুর সীমাও অতিক্রম করে যেতে পারে।
পরের বছর এক সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ঈশানের লেখা—”কালো লেহেঙ্গা: এক অমর প্রেমের উপাখ্যান”। কেউ তা পড়েও বাস্তব মনে করে না, কেউ ভাবে গালগল্প। কিন্তু কনকচূড়ার জমিদারবাড়ি এখনো দাঁড়িয়ে আছে, আর বছরে একবার, নভেম্বরের শেষ রাতে, সেই বাড়ির আশপাশে কেউ কেউ কানে পান এক অদ্ভুত শব্দ—নুপুরের ছনছন, আর বাতাসে মিশে থাকা এক অপরূপ গন্ধ… চামেলির। যারা হৃদয় দিয়ে ভালোবাসে, তাদের জন্য এই গল্প কখনো শেষ হয় না।
শেষ