Bangla - ভূতের গল্প

প্রেতবাড়ির প্রদীপ

Spread the love

অদ্রিজ দাশগুপ্ত


বিকেলের রোদ যেন পাকা শালপাতার মতো গায়ের ওপর নেমে এসে বসে ছিল। আজনা গ্রামের রেলস্টেশনটি ছিল খুব ছোট, একটা মাত্র প্ল্যাটফর্ম, তাও অর্ধেকটা ঘাসে ঢাকা। কলকাতা থেকে লোকাল ধরে এসে নামল নয়ন দত্ত—একটা পুরনো রঙচটা ব্যাগ কাঁধে, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, আর ঠোঁটের কোণে একরকম দ্বিধা। ট্রেনটা চলে গেল ধোঁয়ার লেজ রেখে, আর নয়ন একবার ঘড়ি দেখল—বিকেল চারটে দশ। রিকশা নেই, টোটো নেই, সামনে মাঠের ধার দিয়ে কাঁচা রাস্তাটা নেমে গেছে গ্রামের দিকে। সে একটু থেমে ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে কপালে ঘাম মুছে নিল। এই গ্রামের নাম আজনা—সে অনেক দিন আগে একবার এসেছিল, খুব ছোটবেলায়। তখন তার মা সঙ্গে ছিলেন, হাত ধরে হেঁটেছিল এই রাস্তায়, আর এখন… এখন সে একা ফিরছে, ঠিক যেন কোনো অদৃশ্য টান তাকে টেনে এনেছে। গ্রামটা আগের মতোই আছে, বরং যেন আরও চুপচাপ হয়ে গেছে। কিছুটা হাঁটার পর প্রথম যে মানুষের দেখা মিলল, তিনি একজন বৃদ্ধ—কুঁকড়ে যাওয়া শরীর, ধুতি-জামা পরে বসে ছিলেন এক গামছা বিছানো চায়ের দোকানে। নয়ন সেখানে একটু থামল। চায়ের অর্ডার দিয়ে বলল, “বড় বাড়িটা কোনদিকে?” বৃদ্ধ চেয়ে রইলেন, যেন চিনতে পারলেন কি না। একটু থেমে বললেন, “ওই তো, রাস্তার শেষে… প্রেতবাড়ির দিকেই যাচ্ছো বুঝি?” কথাটা শুনে নয়নের ভ্রু কুঁচকে উঠল—“প্রেতবাড়ি?” বৃদ্ধ হেসে উঠলেন—“আহা, শহরের লোক! না বুঝবি… ওই বড় বাড়ির বারান্দায় রাতবিরেতে একটা প্রদীপ জ্বলে। কেউ কাছে গেলে নিভে যায়, কাশি শোনা যায়। সবাই বলে বুড়ির আত্মা ঘোরে ওখানে… ছেলের অপেক্ষায়!” নয়ন আর কোনো কথা না বলে চা খেয়ে উঠে হাঁটতে শুরু করল, তার কানে যেন বাজছিল—“প্রদীপ, কাশি, প্রেতবাড়ি…”

পথটা আঁকাবাঁকা। দুপাশে সর্ষে খেতের মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে আছে তালগাছ, আর দূরে কিছু মাটির ঘর। অনেকগুলো বক উড়ে গেল জলাশয়ের ধারে। কিন্তু নয়নের মনটা যেন ভারী হয়ে উঠছিল। ছোটবেলায় সে এখানে এসেছিল, কিন্তু সেই সফরটা ছিল যন্ত্রণার—তার মা বীণাপাণি দেবী তখন এই বাড়িতে একা থাকতেন। তার বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে তিনি কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিলেন। নয়ন—তখন অরুণ নামে পরিচিত—মাকে ছেড়ে শহরে পালিয়েছিল বাবার কাছে। তারপর অনেক বছর যোগাযোগ রাখেনি। কিন্তু ক’মাস আগে একটি চিঠি পেয়েছিল এক অজানা গ্রামের নাম-লিখা খামে—কেউ একজন জানিয়েছিল, “আপনার মা মারা গেছেন। প্রদীপটা এখনও জ্বলছে।” সেই থেকেই নয়নের মনে অদ্ভুত অনুভূতি—তাঁকে আর একবার দেখতে না পারার অপরাধবোধ, মায়ের শেষ দিনের পাশে না থাকা, সবকিছু মিলিয়ে একটা দুঃস্বপ্নে বাঁচছিল সে। আর তাই, একদিন ঠিক করে ফেলল—ফিরবে। গ্রামের লোকেরা তাকে চিনতে পারবে না, তবু সে ফিরবে। সে আজ এখানে এসেছেই তার অতীতের মুখোমুখি হতে। বাড়িটা দূর থেকে দেখা গেল—একটা দোতলা কাঠের পুরনো জমিদারবাড়ি, সামনে লোহার গেট, আর গেটের পাশে বাঁশঝাড়ের আড়ালে এক কুয়াশার আস্তরণ। তার পা থেমে গেল মুহূর্তে—বারান্দায় সত্যিই একটা প্রদীপ জ্বলছে। সূর্য এখনো ডোবেনি, তবু সেই আলোটা অস্বাভাবিক। নয়নের গা বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ল। সে জানে, এই বাড়ির প্রতিটি দেয়াল তার শৈশবের কান্না, আর এখন সেই স্মৃতির ফাঁকে কোনো এক আত্মা অপেক্ষা করছে।

নয়ন ধীরে ধীরে গেটের দিকে এগিয়ে গেল, তার পায়ের আওয়াজ মাটির ওপরে শুষে নিচ্ছে পরিবেশ। গেটটা ধাক্কা দিতেই এক বিকট শব্দ করে খুলে গেল। ভিতরে ঢুকেই সে টের পেল বাতাসটা একেবারে আলাদা—ঠাণ্ডা, কিন্তু ভারী। চারপাশে কোনো পাখির ডাক নেই, কোথাও কোনো কুকুরের চিৎকারও না। যেন এই জায়গাটা গ্রাম থেকে আলাদা, সময় থেকে ছিন্ন। সে এক পা এক পা করে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেল। তার চোখ ঠিক সেই প্রদীপে—সেই টিমটিমে আলো যেন তাকে ডেকে নিচ্ছে, অথবা তাড়িয়ে দিচ্ছে—বোঝা যাচ্ছে না। সে যখন মাত্র পাঁচ-ছয় ফুট দূরে, ঠিক তখন ফুঁস করে নিভে গেল আলোটা। ঠিক সেই মুহূর্তে, ভেতর থেকে শোনা গেল একটা অসহ্য কাশি—বুড়ো মানুষের বুক ফাটা কাশি, যেন তার শ্বাস থেমে যেতে চাইছে। নয়ন এক ঝটকায় পিছিয়ে গেল, হাঁটু কাঁপছে তার। কিন্তু সে আর পালাল না। বরং নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমি এসেছি… ফিরে এসেছি…” বাতাস যেন একটু নড়ে উঠল, গাছের পাতায় মৃদু শব্দ। আলো নিভে গেলেও অন্ধকার হয় না একেবারে, কারণ নয়নের ভেতরের আলো আজ তার ভয়কে ছাপিয়ে উঠছে। সে জানে, এই বাড়িতে কিছু আছে—কোনো অপেক্ষা, কোনো প্রশ্ন, যা উত্তর চায়। এই বাড়ি, এই প্রেত, এই প্রদীপ—সব মিলিয়ে এক গল্পের শুরু আজ, যার নাম প্রেতবাড়ির প্রদীপ।

চায়ের দোকানটা সকালবেলায় আরও জমজমাট থাকে। মাটির কাপের ধোঁয়া ওঠা চায়ের সঙ্গে গ্রামের লোকেরা গল্প করে, খবরের কাগজ পড়ে, আর মাঝে মাঝে ছুঁড়ে দেয় চাপা ভয়-ভীতির কাহিনি। নয়ন ওই দোকানে আবার আসে—অ diesmal সে চুপ করে বসে না, বরং কথা বলে মদন ঘোষালের সঙ্গে। মদনবাবু এখানে একরকম জ্যেষ্ঠ পুরুষ; লোকেরা তাকে শ্রদ্ধা করে, একটু ভয়ও পায়। তার চোখে-মুখে সময়ের রেখা, কিন্তু গলায় এখনো কাঁপে কৌতূহলের উত্তাপ। “তুমি যে ও বাড়িতে গিয়েছিলে, শুনলাম,”—তিনি বললেন। নয়ন চুপচাপ মাথা নেড়ে জানায় হ্যাঁ। “প্রদীপ নিভে গেল, তাই তো? কাশি শুনলে নিশ্চয়?”—একটা হালকা হাসি ফুটে ওঠে বৃদ্ধের মুখে, কিন্তু চোখের গভীরে ভয় লুকানো। “এই বাড়িটা একসময় কেমন ছিল, জানো?” তিনি শুরু করেন গল্প, কেউ বাধা দেয় না। চায়ের দোকানে তখন কেবল কাপে ঠোকা-ধাতব শব্দ, আর মদন ঘোষালের কণ্ঠস্বর। “বাড়িটার আসল নাম ছিল শ্যামল নিকেতন। জমিদার রজনীকান্তবাবুর স্ত্রীর নামে হয়েছিল, বীণাপাণি দেবী। এক সময় ভরা সংসার, লোকজন, আতিথ্য চলত ওখানে। কিন্তু যুদ্ধ, রাজনীতি, আর অভিজাততার পতন—সব কিছু মিলিয়ে একদিন সব ফুরিয়ে যায়।”

মদন ঘোষাল কফ কাশলেন হালকা করে, তারপর আবার বললেন, “বীণাপাণি দেবী ছিলেন খুব কঠোর মহিলা। কিন্তু ছেলেকে ভালোবাসতেন অপার। ছেলেটার নাম ছিল অরুণ। খুব মেধাবী ছিল, লেখাপড়া করতে শহরে যেত। একসময়, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছেলে যেন বদলে গেল—মায়ের শাসনে হাঁফিয়ে উঠত, মায়ের কথায় বিরক্ত হতো। আমরা অনেকেই জানতাম—বীণাপাণি দেবী তার ছেলেকে আঁকড়ে রেখেছিলেন, বড্ড বেশি ভালোবাসতেন। কিন্তু সে ভালোবাসাই ছেলেটার গলায় দড়ি হয়ে উঠেছিল। একদিন হঠাৎ করেই অরুণ চলে গেল—কেউ জানল না কোথায়, কিভাবে। ওর মা সেই দিন থেকে যেন অন্য মানুষ হয়ে গেলেন। প্রথম ক’দিন শুধু দরজার সামনে বসে থাকতেন, হাতে একটা কালি-কলমের চিঠি। ‘ও নিশ্চয় চিঠি পাঠাবে,’ বলতেন। চিঠি আর এল না, ছেলে আর ফিরল না।” চারপাশ নিস্তব্ধ। নয়ন কফির চুমুক দিতে গিয়েও হাত থামিয়ে দেয়। তার বুকের ভেতর যেন ঢেউ ওঠে—গল্পটা সে জানে, কারণ সে-ই সেই অরুণ। তার নিজের স্মৃতি চোখে ভেসে ওঠে—মায়ের কণ্ঠস্বর, “বাবা’র মতো হইও না অরু, তুমি অন্তত আমাকে ছেড়ে যেও না।” কিন্তু সেদিন বাবার হাত ধরে শহরের ট্রেনে উঠেই সে পিছনে তাকায়নি। এত বছর পর সে বুঝছে, কী হারিয়েছিল।

“তারপর?” নয়ন প্রশ্ন করল, যদিও সে উত্তর জানে। “তারপর?”—মদনবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তারপর একদিন দেখা গেল, বাড়ির বারান্দায় একটা প্রদীপ জ্বলছে—রাতে, অন্ধকারে। কেউ জানে না কে জ্বালায়। লোকে বলে, বুড়ি নাকি মরে গিয়েও ছেলেকে খুঁজছে। কেউ বাড়ির কাছে গেলেই আলো নিভে যায়, আর কাশির শব্দ আসে। প্রথমদিকে আমরা ভেবেছিলাম চোর-ডাকাত, কিন্তু পরে সাহস করে এক পাণ্ডে গিয়েছিল। সে ফিরে এসে জ্বর বাঁধিয়ে শয্যাশায়ী হয় তিন মাস। বলে, বুড়ি তাকে বলেছে—‘অরু ফিরবে, ঠিক ফিরবে।’” চারপাশের লোকেরা গা ছমছম করে চুপ করে আছে। কেউ একজন ফিসফিস করে বলে, “এটা অভিশাপ নয়, এটা ব্যথা।” নয়ন উঠে দাঁড়ায়। তার মুখে কোনো কথা নেই, কিন্তু ভিতরের ধাক্কাটা পরিষ্কার—সেই ব্যথা যার নাম ‘ফেলে আসা মা’। মদন ঘোষাল চোখে তাকিয়ে বলেন, “তুমি কে রে? কেমন করে জানলে এত কথা?” নয়ন হাসে, বড় কষ্টের হাসি—“আমিও খুঁজছি আমার উত্তর… আর কেউ খুঁজছে আমাকে।” মদনবাবু কিছু বলতে চাইলেও, নয়ন চলে যায়, হাঁটে সেই পুরনো পথে, যেখানে তার কৈশোর পিছুটান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

গল্পটা এবার আর ইতিহাসের পাতায় আটকে নেই—এটা নয়নের শরীরের ভেতরে বাজতে থাকা শোকগাথা। সে জানে, এই গ্রামের প্রতিটি গাছ, প্রতিটি বাতাস আজ তাকে প্রশ্ন করবে—তুই কোথায় ছিলি এতদিন? বীণাপাণি দেবী শুধু এক প্রেত নয়, সে এক স্মৃতি, এক তৃষ্ণা—মাতৃত্বের, অপেক্ষার, আর ক্ষমার। নয়নের পা তাকে আবার টেনে নিয়ে যায় সেই লোহার গেটের দিকে। গেটটা আজ সরে যায় শব্দ ছাড়াই, যেন সেই বাড়িও চেনে তাকে। “অরু ফিরবে”—এই শব্দটা তার কানে বাজে আবার। সে জানে, এই প্রদীপ নিভবে আরও বারবার, যতক্ষণ না সে মুখোমুখি হয় সেই আত্মার, যাকে সে ফেলে এসেছিল একদিন অবহেলায়। সে জানে, রাত গভীর হবে, বাতাসে কাশি শোনা যাবে, আর একদিন সেই টিমটিমে আলো তার জন্যই জ্বলে থাকবে।

রাতের আজনা গ্রাম যেন অন্য এক গ্রহের অংশ—নিস্তব্ধ, অনড়, আর অন্ধকারে আচ্ছন্ন। ফিকে চাঁদের আলোতে শুধু ছায়া দেখা যায়, তার কোনো আকার বোঝা যায় না। নয়ন সেদিন রাতের খাবার খেয়েই বেরিয়ে পড়ে। হাতে একটা ছোট টর্চ, পকেটে মোবাইল, আর মনের ভিতর অসম্ভব একটা টান—যা তাকে ফের টেনে নিয়ে যায় সেই পুরনো জমিদার বাড়ির দিকে। দিনের আলোয় যা কিছু ধ্বস্ত-ধূলিধূসরিত বলে মনে হয়, রাতের অন্ধকারে তা যেন এক জীবন্ত প্রহেলিকা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বাড়িটার দিকেই হাঁটতে হাঁটতে নয়নের মনে পড়ে, তার ছোটবেলায় মা বলতেন, “রাত মানে হল আত্মার সময়। এই সময়টাতে মন দুর্বল হয়, আর আত্মারা জেগে ওঠে।” সেই কথা তখন একটা কুসংস্কার বলে মনে হলেও আজ তার প্রতিটি পা ভারী হয়ে আসছে, যেন সত্যি সত্যি কোনো এক অলক্ষ্য অস্তিত্ব তাকে নিরীক্ষণ করছে। বাতাস নিস্তরঙ্গ, কুকুরের ডাক নেই, পাখির শব্দ নেই—শুধু সে আর তার ছায়া।

গেটটা এবার সে নিজেই ঠেলে খোলে। মজার বিষয়, আগেরবারের মতো এবার কোনো শব্দ হয় না। যেন সেই বাড়িটা আজ প্রস্তুত তার জন্য, অপেক্ষা করছিল তার ফিরে আসার। বাড়ির সামনে এসে সে থেমে যায়। বারান্দায় সেই প্রদীপ আবার জ্বলছে—টিমটিমে, কমলা আভা, আর তার চারপাশে অদ্ভুত নিঃস্তব্ধতা। নয়ন বারান্দার দিকে কয়েক পা এগোতেই শরীরের ভেতর দিয়ে যেন ঠাণ্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল। বাতাস এখানে অনেক ঠাণ্ডা, আর তার গা বেয়ে ঘাম নেমে আসে। সে টর্চ জ্বালিয়ে আলো ফেলতে গিয়েও থেমে যায়—প্রদীপের আলোয় সব স্পষ্ট, অথচ কিছুই বোঝা যায় না। এমন একটা আলো, যা শুধু আলো নয়—তা যেন এক দীর্ঘশ্বাস, এক স্মৃতি, এক অভিযোগ। নয়ন এবার মুখ থেকে নিঃশ্বাস ছাড়ে, আর ধীরে ধীরে বারান্দার দিকে এগোয়। ঠিক তখনই—একটা নিঃশব্দে, ঝপ করে নিভে যায় প্রদীপটি। তার ঠিক পরেই ভেসে আসে সেই শব্দ—একটা থেমে থেমে, বুকফাটা কাশি, যেন ফুসফুস ছিঁড়ে বার হয়ে যাবে এখনই।

নয়ন থেমে যায়, ঠোঁট কেঁপে ওঠে, কিন্তু এবার সে পালায় না। সে জানে, এই কাশি সে শুনেছে বহুবার—ঘুমের মধ্যে, স্মৃতির গহ্বরে, মায়ের শেষ কথা হয়ে। তার সামনে এখন শুধু অন্ধকার, আর সেই শব্দ, যেটা ভয় নয়—অপেক্ষা। “মা…”—তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে শব্দটা, জানেও না সে নিজেই বলেছে কিনা। অন্ধকার ভেদ করে কিছু এগিয়ে আসে না, কেউ স্পর্শ করে না, কিন্তু সে অনুভব করে একটা উপস্থিতি। হঠাৎ করেই সে যেন জানালার ভাঙা কাঁচে এক ছায়ামূর্তি দেখে—ক্যামোফ্ল্যাশড রূপ, যেটা ধরা যায় না, বোঝা যায়। তার গা ঠাণ্ডা হয়ে আসে, পায়ের নিচে মাটি কাঁপে না, কিন্তু শরীর ভারী লাগে। সে বলে ওঠে, “আমি ফিরেছি… আমি দেরি করে ফেলেছি… কিন্তু এখন আমি আছি।” তখন চারপাশ থেকে যেন বাতাস একটু নড়ে ওঠে, শুকনো পাতার শব্দ হয়, আর সেই নিভে যাওয়া প্রদীপের পাশে হঠাৎ একটা হালকা কমলা আভা জ্বলে ওঠে—অনেক কম আলো, কিন্তু পরিষ্কার। নয়ন দাঁড়িয়ে থাকে, স্তব্ধ। এতদিন পর, সে বুঝতে পারে, মায়ের আত্মা হয়তো শুধু অপেক্ষা করছিল না, সে চিনত ছেলেকে—প্রদীপ নিভিয়ে জানাত যে, সে ভুলে যায়নি। আর আজ সেই নিভে যাওয়া আলো আবার জ্বলেছে, কেননা ছেলেটি ফিরে এসেছে। এই আলোয় ভয় নেই—আছে অশ্রু, আছে ক্ষমা, আছে অমোঘ ভালোবাসার ছায়া।

পরদিন সকালবেলায় নয়নের ঘুম ভাঙে চমকে। যেন কারো ডাক বা স্পর্শ তার নিদ্রা ছিঁড়ে ফেলেছে। উঠেই জানালার দিকে তাকিয়ে সে দেখে, রোদের আলো তার ঘরের মাটির মেঝেতে ছায়া ফেলে রেখেছে। গত রাতের অভিজ্ঞতা—প্রদীপ, কাশি, সেই অদৃশ্য উপস্থিতি—সবকিছু স্বপ্ন বলেই মনে হতো যদি না সে নিজের কাঁধে এখনও ঠাণ্ডা স্পর্শের অনুভূতি টের পেত। ঘরের কোণে রাখা ব্যাগ খুলে সে একটা খাতা বের করল—নিজের নোটবুক। লিখে রাখল: “২য় রাত, প্রদীপ নিভলো, কাশি শোনা গেল, আলো আবার জ্বলে উঠল। আমি ওনার সামনে নিজেকে পরিচয় দিলাম না, কিন্তু মনে হল তিনি চিনে ফেলেছেন আমাকে।” লেখার সময় তার হাত একটু কাঁপছিল। বাইরে তখন গ্রামের সাধারণ সকাল—বাচ্চাদের হাসির শব্দ, দূরে বাঁশিতে মেঠো সুর। কিন্তু নয়নের ভেতরকার সকাল অন্যরকম—অস্থির, ভারী, অজানা প্রশ্নে ভরা। আজ তাকে কারও সঙ্গে দেখা করতে হবে—কোনও একজন যিনি তাকে ভিন্ন দৃষ্টিতে এই গ্রামের রহস্য দেখতে শেখাবেন।

গ্রামের প্রাথমিক স্কুলটা খুব ছোট—দুটো ঘর, একটা খেলার মাঠ আর এক পাশে পুরনো বটগাছ। নয়ন হাঁটতে হাঁটতে সেখানে পৌঁছায়, এবং গেটের ধারে একটা দৃশ্য দেখে থেমে যায়। একটি ছাত্রী কেঁদে ফেলেছে, আর তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন একজন নারী—সাদা সালোয়ার, চোখে পাতলা ফ্রেমের চশমা, হাতে খাতা ও চক, কণ্ঠে একধরনের কোমল অথচ দৃঢ় শব্দ—“কাঁদবি না, মন দিয়ে শোন, ভয় পেলে শেখা যায় না।” নয়ন ঠিক তখনই প্রথমবার দেখে লাবণীকে—গ্রামের স্কুলশিক্ষিকা। পরে জেনেছিল সে, লাবণী নিজেই শহরের মেয়ে, কিন্তু এখানে পোস্টিং পেয়ে থেকে গেছেন—কারণ এই শান্ত গ্রাম, তার নিঃসঙ্গতাকে গ্রহণ করেছে। নয়ন কিছুটা দ্বিধায় এগিয়ে গিয়ে বলল, “আপনি কি লাবণীদি?” — মহিলা একটু চমকে তাকালেন, তারপর হেসে বললেন, “আমি কি চিনি আপনাকে?” নয়ন পরিচয় দিল—“নয়ন দত্ত, ইতিহাস গবেষণা করি। গ্রাম, লোকবিশ্বাস, পুরনো কাহিনি নিয়ে কাজ করি। প্রেতবাড়ি নিয়ে কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে এসেছি।” লাবণী প্রথমে একটু অবাক হলেও, তার কথায় আতঙ্ক বা অস্বস্তি দেখালেন না। বরং বললেন, “ও বাড়ির কথা শুনলে গ্রামের মানুষ ভয় পায়। কিন্তু ভয় পেলেই সব সত্যি হয়ে যায় না। আপনি কী খুঁজছেন?”

দুপুরবেলা স্কুল ছুটি হলে লাবণী ও নয়ন একসঙ্গে হাঁটলেন সেই বড়ো বাড়ির দিকে। লাবণী বললেন, “আমি নিজেও এই বাড়ির গল্প শুনে এসেছি। বীণাপাণি দেবীর নাম জানি। কিন্তু একবারও কেউ বলেনি, তার ছেলে ফিরবে। সবাই বলে, ওনার আত্মা অভিশপ্ত, ছেলের অভিশাপে মরে গেছেন।” নয়ন প্রশ্ন করে, “আপনি বিশ্বাস করেন না এসব?” লাবণী একটু থেমে বললেন, “আমি প্রেত-অপ্রেতে বিশ্বাস করি না ঠিকই, কিন্তু ‘অপেক্ষা’ নামে একটা জিনিস আছে, যা মরে না। যাকে ফেলে যাওয়া হয়, তার অভিমান গভীর হয়। আপনি কি জানেন, আপনি যা খুঁজছেন, সেটা কি শুধুই ইতিহাস?” নয়ন চুপ করে যায়। সে জানে, সে ইতিহাস নয়, নিজের ইতিহাস খুঁজতে এসেছে। সে জানে, তার নাম নয়ন হলেও, প্রেতবাড়ির কাহিনিতে সে-ই সেই ‘অরুণ’। লাবণী তখন বলে ওঠেন, “আপনার চোখে একটা ক্লান্তি আছে। আপনি শুধু গবেষক নন, আপনি যেন কিছু ফিরিয়ে আনতে এসেছেন।” নয়ন প্রথমবার লাবণীর দিকে তাকিয়ে অনুভব করে, কেউ একজন তার ভেতরের সত্যিটা ছুঁয়ে ফেলেছে। এই গ্রামে, যেখানে সময় থেমে আছে, সেখানে কেউ একজন তাকে বুঝে ফেলেছে—তা অবিশ্বাস্য, কিন্তু সত্যি।

রাত গভীর হলে নয়নের ঘুম আসে না। শরীর বিছানায়, কিন্তু মন যেন সেই বারান্দার কাছেই ঘোরে—যেখানে প্রতিরাতে টিমটিমে একটা আলো জ্বলে, নিভে যায়, আবার জ্বলে ওঠে। আজ রাতেও সে চেষ্টা করছিল নিজের চিন্তাগুলোকে লিখে রাখতে, কিন্তু কলম আর শব্দ একে অন্যের থেকে পালাচ্ছিল। লাবণীর সঙ্গে দুপুরের কথোপকথন তার ভেতর এক অদ্ভুত অস্থিরতা এনে দিয়েছে—কেউ তাকে বুঝে ফেলেছে, মুখে না বললেও চোখে চোখে পড়ে গেছে তার অপরাধবোধ, তার গোপন পরিচয়। সে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে বিছানায় শোয়, কিন্তু ঘুম আসে না তবুও। চারপাশ নীরব, রাতের ভেতর হঠাৎ একটা পেঁচার ডাকে তার মন কেঁপে ওঠে। ঠিক সেই সময়েই, কোনো এক অজানা মুহূর্তে, ঘুম এসে যায়। কিন্তু সেই ঘুম শান্ত নয়—সেই ঘুম তাকে নিয়ে যায় এমন এক স্বপ্নের ভিতরে, যেটা স্বপ্ন নয়, যেন স্মৃতির ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা বাস্তব।

সে দেখে—ঘরের কোণায় একটা পাটকাঠির খাটে বসে আছেন এক বৃদ্ধা। শাড়ির আঁচল গায়ে জড়িয়ে, মাথায় পাকা চুল এলোমেলোভাবে পড়ে আছে। গলা শুকিয়ে আসছে যেন, কিন্তু মুখে কোনো ভীতির রেখা নেই। তিনি কাশছেন—ধীরে, গভীরভাবে, যেন ভিতর থেকে ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে শব্দটা। চারপাশে অদ্ভুত এক আলো—না চাঁদের, না প্রদীপের। নয়ন দাঁড়িয়ে, কিন্তু পা যেন নড়ছে না, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। হঠাৎ সেই বৃদ্ধা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকান তার দিকে। নয়নের চোখে স্পষ্ট দেখা যায় সেই মুখ—সেই চেনা মুখ, যেটা কোনো ছবিতে বহু বছর আগে দেখেছিল। বীণাপাণি দেবী। তার মা। মুখে কোনো রাগ নেই, দৃষ্টি তীব্র নয়—বরং যেন একধরনের অভিমান আর প্রশ্ন। তিনি ধীরে ধীরে বলেন, “তুই ফিরেছিস?”—শব্দটা নয়নের কানে নয়, হৃদয়ে ধাক্কা মারে। সে কিছু বলতে চায়, কিন্তু মুখ থেকে কোনো শব্দ বেরোয় না। তার গলা আটকে যায়, চোখ জলে ভরে ওঠে। বৃদ্ধা আবার বলেন, “তুই তো কথা দিয়েছিলি, যাবি না। কিন্তু তুই গেছিস, আমায় ছেড়ে গেছিস… আমি এখানে অপেক্ষা করেছি—প্রতিদিন, প্রতি রাত, প্রতিক্ষণ।” তার মুখের প্রতিটি রেখা যেন এই অপেক্ষার ইতিহাস বয়ে নিয়ে চলেছে।

ঠিক তখনই ঘরের এক কোণ থেকে হঠাৎ আলো নিভে যায়। একটা হালকা ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে, আর সেই ধোঁয়ার মধ্যে বীণাপাণি দেবী ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকেন। নয়ন ছুটে যেতে চায়, চিৎকার করে বলতে চায়—“মা, আমি ফিরেছি! আমি এখানে!” কিন্তু তার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয় না, হাত সামনে বাড়িয়ে দেয়, কিন্তু পৌঁছতে পারে না। তার মুখ থেকে শুধু ফিসফিস শব্দ—“মা… মা…”। ঠিক সেই সময়েই ঘুম ভেঙে যায়। ঘামেভেজা গা, বুক ধুকপুক করছে, আর কানে যেন এখনও সেই কাশির আওয়াজ বাজছে। সে উঠে বসে দেখে, জানালা খোলা—বাতাস ঢুকছে নিঃশব্দে। কিন্তু তার বুকের ভেতর চলছে তাণ্ডব। সে জানে এটা স্বপ্ন ছিল না। এটা ছিল ডাক—একটা আত্মার, এক মৃতার, তার মায়ের। যে আজও প্রতীক্ষায় আছে। নয়ন বুঝে যায়—এখন আর পেছনে ফেরার সময় নেই। সামনে এগোতে হবে, মুখোমুখি হতে হবে সেই মায়ার, সেই অপরাধবোধের, যে তার জীবনের সবচেয়ে গভীর ঋণ হয়ে রয়ে গেছে।

পরদিন সকালবেলা, নয়ন একেবারেই চুপচাপ। চা-দোকানে যায় না, কারো সঙ্গে দেখা করে না। সে হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় সেই বাড়ির ভেতর, দরজার কাছে। গেট খুলে ঢোকার সময় কোনো শব্দ হয় না, কেবল যেন বাতাসটা একটু গা ছমছমে হয়ে ওঠে। আজ সে কোনো ভয় অনুভব করছে না, বরং এক ধরণের আকর্ষণ, যেন ভেতরে কিছু পড়ে আছে যার সঙ্গে তার একান্ত সংযোগ। ভাঙা সিঁড়ি পেরিয়ে সে ঢুকে পড়ে ভিতরের হলঘরে। দেয়ালে জাল বোনা, ছাদ থেকে ঝুলে থাকা পুরনো ঝাড়বাতির পায়ায় জমেছে ধুলোর স্তর। একটা পুরনো কাঠের সিন্দুক চোখে পড়ে, ধুলো চাপা পড়ে আছে, কিন্তু হাতের স্পর্শে বোঝা যায় ভিতরে কিছু আছে। নয়ন ধীরে ধীরে হাত লাগায়, আর খুলে ফেলে সেই সিন্দুক—একটা কাগজের গন্ধ ছড়ায়, পচা নথির গন্ধ, কিন্তু তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা থাকে স্মৃতি।

সিন্দুকের ভিতরে সে পায় একটা ছোট বাক্স—লোহা দিয়ে বাঁধানো, ওপরে নাম লেখা মলিন হাতে—“অরুণ”। তার বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। সেই নাম, যেটা সে ফেলে রেখেছিল পেছনে, যেটা সে বদলে হয়ে উঠেছিল ‘নয়ন’। বাক্স খুলতেই পায় কয়েকটা চিঠি—তার নিজের হাতে লেখা, শৈশবে লেখা। একটায় সে লিখেছিল, “মা, আমি ভালো আছি। স্কুলে প্রথম হয়েছি।” অন্যটায়, “মা, বাবা বলেছে এখানে থেকে যেতে হবে। তুমি কাঁদো না।” সে জানত না মা সেই চিঠিগুলো জমিয়ে রেখেছিল। কিন্তু অবাক কাণ্ড—একটি চিঠি, যার খাম ছেঁড়া, সেটা কখনও পাঠানো হয়নি। সেটা ছিল বীণাপাণির লেখা। কম্পিত অক্ষরে লেখা, অশ্রুসিক্ত কাগজ, ঠিক যেন হৃদয়ের শেষ সুর:
“অরু, যদি কখনো ফিরতে ইচ্ছে হয়, এই বাড়ি তোমার জন্যই থাকবে। আমি প্রতিরাতে একখানি প্রদীপ জ্বালাব, যতদিন না তুমি আবার ডাক দাও, মা বলে। যতদিন না তুমি আমাকে মাফ করো। যদি আমি না থাকি, তাও সে আলো জ্বলে থাকবে, আমার হয়ে।”

নয়নের চোখে জল এসে যায়। তার হাত কাঁপে, বুকের ভেতর দিয়ে যেন কারা বুলিয়ে দেয় একটা বিষণ্ণতার সুর। এই চিঠি কোনো কাহিনির অংশ নয়, কোনো অলৌকিক ভয়েরও নয়—এ এক মা’য়ের কণ্ঠ, তার ভাঙা হৃদয়ের আর্তি। নয়ন জানে এখন, প্রদীপ নিভে যায় শুধু ভয় দেখানোর জন্য নয়—প্রতিবার কেউ কাছে এলে, তার মা পরীক্ষা করতেন, এ কি তার ছেলে? সে বুঝতে পারে—এখন আর এই অপেক্ষা বাড়ানোর সময় নয়। সে চিঠিগুলো নিয়ে গিয়ে বুকে চেপে ধরে, তার চোখের কোণে দাঁড়িয়ে থাকা জল ধীরে ধীরে নামতে থাকে—যেন অন্তর্গত পাপের মুক্তি। ঠিক তখন, পিছনের বারান্দার কোণে থাকা দরজা একটু সরে যায় হালকা হাওয়ায়। যেন কেউ বলে—”দেখেছিস, আমি রেখেছিলাম তোকে মনে।”

নয়ন ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে সেই বাড়ি থেকে, কিন্তু আজ সে পালিয়ে যায় না। চিঠিগুলো নিয়ে সে যায় লাবণীর কাছে, তাকে দেখায় সবকিছু—প্রথমবার নিজের পরিচয় প্রকাশ করে, স্বীকার করে, “আমি-ই সেই অরুণ। আমি পালিয়ে গেছিলাম। এখন ফিরেছি, কিন্তু দেরি হয়ে গেছে।” লাবণী চুপ করে থাকে, অনেকক্ষণ পর বলে, “তোমার মা এখনও আছেন, আলো হয়ে, অপেক্ষা হয়ে। যেই দিন তুমি তার সামনে দাঁড়িয়ে সত্যি বলবে, তিনি শান্ত হবেন।” নয়ন বুঝতে পারে, পরবর্তী পদক্ষেপ কী। সে আর এই প্রেতবাড়িকে ভয় পায় না—এই বাড়ি তারই বাড়ি, এই আত্মা তারই রক্তের আত্মা। এখন সময় এসেছে, একবার মুখোমুখি হওয়ার—মায়ের, আত্মার, নিজের অপরাধের, আর সেই প্রদীপের, যেটা এখনও টিমটিম করে জ্বলছে।

রাতটা ছিল অমাবস্যার। আকাশে একফোঁটা আলো নেই, যেন সমস্ত নক্ষত্ররাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। গ্রামজুড়ে নিরবতা নেমে এসেছে হিমের মতো, নিঃশ্বাস ফেললেও শব্দ হয়। নয়ন আজ প্রস্তুত। নিজের পরিচয় স্বীকার করার পর তার শরীরে যেন নতুন রক্ত বইছে। সে জানে, আজকের রাতই নির্ধারণ করবে সবকিছু—মায়ের আত্মা এবার শান্ত হবে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর আজই মিলবে। লাবণীর পরামর্শে সে একটা তুলসী মালা সঙ্গে নেয়, আর নিজেই মায়ের প্রিয় সেই মেঘরঙা শাড়িটা, যা বাক্সে পাওয়া গেছিল, একটি কাপড়ে মুড়ে রাখে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—সে সঙ্গে নেয় সেই শেষ চিঠিখানি, যেখানে লেখা ছিল, “আমি প্রতিরাতে প্রদীপ জ্বালাব, যতদিন না তুমি আমাকে মা বলে ডাকো।” নয়নের মন বলছিল, আজ সেই ডাকের উত্তর দিতে হবে।

রাত প্রায় বারোটা। নয়ন আবার ঢোকে সেই বাড়িতে, কিন্তু এবার আর তার মনে কোনো দ্বিধা নেই। হাতে প্রদীপ রাখে সে—আজ সে নিজে প্রদীপ জ্বালাতে চায়। বারান্দার মেঝে ঝেড়ে সে সেই চিঠি রেখে দেয়, তার ওপরে প্রদীপটা বসিয়ে দেয়। বাতাস ঠাণ্ডা, শীতল। সে ধীরে ধীরে কাঠিলাঠি ঘষে আগুন বের করে জ্বালায় প্রদীপ, আর ঠিক তখনই, পেছনে কার যেন নিঃশব্দ পায়ের আওয়াজ। সে জানে—কেউ আসছে না, কেউ আছে আগে থেকেই। সে চোখ বন্ধ করে বলে, “মা, আমি ফিরেছি। আমি দেরি করেছি, ভুল করেছি, কিন্তু তুমি তো চিঠিতে লিখেছিলে, তুমি আলো জ্বালাবে… আমি সেই আলোর সামনে এসে দাঁড়িয়েছি।” ঠিক তখনই প্রদীপের আলো অস্বাভাবিকভাবে কেঁপে ওঠে, আর বাতাসে এক অদ্ভুত মন্ত্রমুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে। ছায়া গাঢ় হয়, বাড়ির করিডোরে ফিসফিস শব্দ, যেন কারা খুব আস্তে ডাকছে—“অরু… অরু…”

হঠাৎ করেই নয়নের চোখের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েন বীণাপাণি দেবী। কোনো কুয়াশা নয়, কোনো আধা-দৃশ্যমান ছায়া নয়—একেবারে স্পষ্ট, মাটি ছোঁয়া চুল, চোখে জল, গলায় ম্লান সোনার হার, আর ঠোঁটে এক অসমাপ্ত হাসি। নয়ন হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে, তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে সেই শব্দ—“মা!” এক নিমিষে বাতাস স্তব্ধ হয়ে যায়, ঝিঁঝিঁপোকা চুপ, চারপাশ থেমে থাকে। বীণাপাণির মুখে এবার সত্যিকারের হাসি ফুটে ওঠে—শান্ত, অভিমানবিহীন। তিনি হাত বাড়িয়ে ধীরে ধীরে নয়নের মাথায় রাখেন হাত—ঠাণ্ডা, কিন্তু আশীর্বাদময়। কিছু না বলেই ধীরে ধীরে তিনি মিলিয়ে যান বাতাসে, কিন্তু প্রদীপের আলো আর নিভে না—জ্বলে থাকে উজ্জ্বলভাবে। সেই আলোয় নয়ন দেখে, তার চোখে জল আর অন্ধকার নেই। এই বাড়িটা আর প্রেতবাড়ি নয়—এটা আজ আবার এক ছেলের কাছে ‘বাড়ি’ হয়ে উঠেছে।

পরদিন সকালে নয়ন ঘুম ভাঙতেই অনুভব করল—আজ অন্যরকম একটা হাওয়া বইছে। জানালার বাইরের গাছগুলো যেন শান্ত, নির্ভার। কুয়াশার পরত পাতলা হয়ে এসেছে, আর পাখিরা অনেক দিন পর যেন সত্যিকার স্বরে ডেকে উঠেছে। সে উঠে দাঁড়ায়, একবার আয়নায় চোখ পড়ে—চোখের নীচে কালো দাগ কমে এসেছে, শরীরটা আর আগের মতো ভারী লাগছে না। কাল রাতের সেই মুখোমুখি হওয়া, মায়ের ছোঁয়া, প্রদীপের আলো—সব কিছু যেন তাকে ভেতর থেকে শুদ্ধ করে দিয়েছে। এখন তার কোনো ভয় নেই, কোনো অজানা টান নেই। সে জানে, অপেক্ষার পরিসমাপ্তি ঘটেছে, এবং এবার সময় হয়েছে এক নতুন সূচনা। নয়ন বেরিয়ে পড়ে আবার সেই প্রাচীন বাড়ির দিকে—শেষবারের মতো। তার হাতে থাকে সেই বাক্স, যেখানে মা’র চিঠিগুলো, শাড়িটা, আর তার ছোটবেলার একটা ছবি রাখা। সে জানে, এগুলো আর তাকে বয়ে বেড়াতে হবে না—এইগুলো মাটির হবে, কিন্তু স্মৃতির ভিতরে থেকে যাবে চিরকাল।

সে বাড়ির উঠোনে পৌঁছাতেই দেখে, আজ বাতাস হালকা। দেয়ালে জালের পরিমাণ কম, যেন রাতের কোনো অদৃশ্য স্পর্শ চারপাশ ঝেড়ে দিয়ে গেছে। সে প্রদীপটা আবার বারান্দায় রাখে, কিন্তু এবার জ্বালায় না। এবার সে চায় মায়ের আত্মা যেন চিরতরে বিশ্রাম নেন, আলো নয়—শান্তি যেন তার শয্যা হয়। উঠোনের মাঝখানে একটা ছোট গর্ত খুঁড়ে সে বাক্সটা রাখে, চারপাশে মাটি চাপা দেয়। তারপর আগুন ধরায় কিছু শুকনো খড় দিয়ে। আগুন বাড়তে থাকে, গন্ধ ছড়ায় পোড়া কাপড়, পুরনো কাগজ, এবং এক দীর্ঘপ্রতীক্ষিত পরিসমাপ্তির। আগুনের শিখায় ওঠে ছোটবেলার কান্না, শহরের নিষ্ঠুরতা, মায়ের অপেক্ষা, মায়ের অভিমান, আবার সেই অভিমান থেকে জন্ম নেওয়া ভালোবাসা—সব কিছু একসঙ্গে ধ্বংস হয়, এবং পুনর্জন্ম নেয়। নয়ন আগুনের দিকে তাকিয়ে থাকে, চোখে জল নেই, মুখে শুধু এক শান্তির ছায়া। লাবণী তখন এসে পাশে দাঁড়ায়, চুপচাপ। সে কিছু বলে না, শুধু নয়নের কাঁধে এক হাত রাখে। আর নয়ন মাথা নিচু করে বলে, “শেষটা শেষ নয়, লাবণীদি। মা এখন আলো নন, তিনি আমার ভিতরে।”

দুপুর গড়িয়ে যায়। বাড়িটা এবার নিস্তব্ধতার মধ্যে এক গভীর প্রশান্তিতে ভরে ওঠে। আর কেউ বলে না ‘প্রেতবাড়ি’, কেউ রাতে আর কাশি শোনে না। গ্রামের লোকেরা প্রথমে আশ্চর্য হয়, পরে ধীরে ধীরে তারা এই বাড়িকে ‘শ্যামল নিকেতন’ নামে স্মরণ করতে শুরু করে আবার। কেউ কেউ বলে, প্রদীপটা নাকি আবার জ্বলে ওঠে মাঝে মাঝে, কিন্তু এবার আলো নিভে যায় না। সে আলো কারও ভয় নয়—সে এক আশীর্বাদ। নয়ন গ্রাম ছাড়ার সময় বাড়ির দিকে ফিরে তাকায় একবার—সেই প্রাচীন, ধুলিমলিন বারান্দা, যেখানে প্রদীপ ছিল, এখন সেই বারান্দায় একটা ছোট্ট তুলসী গাছ রাখা। সে জানে, মা আর নেই ঠিকই, কিন্তু তার অভিমানী আত্মা এবার পরিত্রাণ পেয়েছে। আগুনে সব ভস্ম হয়েছে—চিঠি, কাপড়, দুঃখ, বেদনা। কিন্তু স্মৃতিতে যা রয়েছে—তাই অমর। নয়ন চলে যায়, কিন্তু রেখে যায় এক নতুন ইতিহাস, যেখানে প্রেত নয়, এক মায়ের ভালোবাসা ও প্রতীক্ষার গল্প বেঁচে থাকে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।

পরদিন সকালে নয়ন ঘুম ভাঙতেই অনুভব করল—আজ অন্যরকম একটা হাওয়া বইছে। জানালার বাইরের গাছগুলো যেন শান্ত, নির্ভার। কুয়াশার পরত পাতলা হয়ে এসেছে, আর পাখিরা অনেক দিন পর যেন সত্যিকার স্বরে ডেকে উঠেছে। সে উঠে দাঁড়ায়, একবার আয়নায় চোখ পড়ে—চোখের নীচে কালো দাগ কমে এসেছে, শরীরটা আর আগের মতো ভারী লাগছে না। কাল রাতের সেই মুখোমুখি হওয়া, মায়ের ছোঁয়া, প্রদীপের আলো—সব কিছু যেন তাকে ভেতর থেকে শুদ্ধ করে দিয়েছে। এখন তার কোনো ভয় নেই, কোনো অজানা টান নেই। সে জানে, অপেক্ষার পরিসমাপ্তি ঘটেছে, এবং এবার সময় হয়েছে এক নতুন সূচনা। নয়ন বেরিয়ে পড়ে আবার সেই প্রাচীন বাড়ির দিকে—শেষবারের মতো। তার হাতে থাকে সেই বাক্স, যেখানে মা’র চিঠিগুলো, শাড়িটা, আর তার ছোটবেলার একটা ছবি রাখা। সে জানে, এগুলো আর তাকে বয়ে বেড়াতে হবে না—এইগুলো মাটির হবে, কিন্তু স্মৃতির ভিতরে থেকে যাবে চিরকাল।

সে বাড়ির উঠোনে পৌঁছাতেই দেখে, আজ বাতাস হালকা। দেয়ালে জালের পরিমাণ কম, যেন রাতের কোনো অদৃশ্য স্পর্শ চারপাশ ঝেড়ে দিয়ে গেছে। সে প্রদীপটা আবার বারান্দায় রাখে, কিন্তু এবার জ্বালায় না। এবার সে চায় মায়ের আত্মা যেন চিরতরে বিশ্রাম নেন, আলো নয়—শান্তি যেন তার শয্যা হয়। উঠোনের মাঝখানে একটা ছোট গর্ত খুঁড়ে সে বাক্সটা রাখে, চারপাশে মাটি চাপা দেয়। তারপর আগুন ধরায় কিছু শুকনো খড় দিয়ে। আগুন বাড়তে থাকে, গন্ধ ছড়ায় পোড়া কাপড়, পুরনো কাগজ, এবং এক দীর্ঘপ্রতীক্ষিত পরিসমাপ্তির। আগুনের শিখায় ওঠে ছোটবেলার কান্না, শহরের নিষ্ঠুরতা, মায়ের অপেক্ষা, মায়ের অভিমান, আবার সেই অভিমান থেকে জন্ম নেওয়া ভালোবাসা—সব কিছু একসঙ্গে ধ্বংস হয়, এবং পুনর্জন্ম নেয়। নয়ন আগুনের দিকে তাকিয়ে থাকে, চোখে জল নেই, মুখে শুধু এক শান্তির ছায়া। লাবণী তখন এসে পাশে দাঁড়ায়, চুপচাপ। সে কিছু বলে না, শুধু নয়নের কাঁধে এক হাত রাখে। আর নয়ন মাথা নিচু করে বলে, “শেষটা শেষ নয়, লাবণীদি। মা এখন আলো নন, তিনি আমার ভিতরে।”

দুপুর গড়িয়ে যায়। বাড়িটা এবার নিস্তব্ধতার মধ্যে এক গভীর প্রশান্তিতে ভরে ওঠে। আর কেউ বলে না ‘প্রেতবাড়ি’, কেউ রাতে আর কাশি শোনে না। গ্রামের লোকেরা প্রথমে আশ্চর্য হয়, পরে ধীরে ধীরে তারা এই বাড়িকে ‘শ্যামল নিকেতন’ নামে স্মরণ করতে শুরু করে আবার। কেউ কেউ বলে, প্রদীপটা নাকি আবার জ্বলে ওঠে মাঝে মাঝে, কিন্তু এবার আলো নিভে যায় না। সে আলো কারও ভয় নয়—সে এক আশীর্বাদ। নয়ন গ্রাম ছাড়ার সময় বাড়ির দিকে ফিরে তাকায় একবার—সেই প্রাচীন, ধুলিমলিন বারান্দা, যেখানে প্রদীপ ছিল, এখন সেই বারান্দায় একটা ছোট্ট তুলসী গাছ রাখা। সে জানে, মা আর নেই ঠিকই, কিন্তু তার অভিমানী আত্মা এবার পরিত্রাণ পেয়েছে। আগুনে সব ভস্ম হয়েছে—চিঠি, কাপড়, দুঃখ, বেদনা। কিন্তু স্মৃতিতে যা রয়েছে—তাই অমর। নয়ন চলে যায়, কিন্তু রেখে যায় এক নতুন ইতিহাস, যেখানে প্রেত নয়, এক মায়ের ভালোবাসা ও প্রতীক্ষার গল্প বেঁচে থাকে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।

গ্রাম ছাড়ার আগে নয়ন আর একবার সেই বাড়িটার চারপাশ ঘুরে দেখে। এবার তার দৃষ্টিতে কোনো ভয় নেই, বরং গভীর শ্রদ্ধা ও মমতা। এককালের “প্রেতবাড়ি” এখন তার চোখে এক স্মৃতি-বহনকারী স্থান, যেখানে আছড়ে পড়েছিল এক মায়ের হাহাকার, আর আজ সেখানে ঘুমিয়ে রয়েছে চিরশান্ত আত্মা। নয়ন নিজেই সেই তুলসী গাছের পাশে একটা ছোট্ট সাদা পাথরের ফলক বসিয়েছে—যেখানে মাটি, জল আর বিশ্বাস একত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে এক অনন্ত শ্রদ্ধা হিসেবে। ফলকে লেখা শুধু কয়েকটি শব্দ: “বীণাপাণি, এক মা, এক আলো।” গ্রামের লোকেরা একে দেখে একটু চমকে যায়, কিন্তু কিছুকাল পর সেটা তারা আপন করে নেয়। কেউ কেউ প্রতিদিন তুলসীতে জল ঢালে, কেউ বা সন্ধেবেলা প্রদীপ জ্বালায়। কেউ প্রশ্ন করে না—“ভূত আছে কিনা”, বরং ধীরে ধীরে বলে ওঠে, “ভালোবাসা এলে আত্মারাও শান্তি পায়।” নয়ন দেখেন, যেই ভয়ের গল্পে মানুষ বাড়ির পাশ দিয়েও হাঁটতে সাহস পেত না, সেই বাড়ির বারান্দায় এখন ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা খেলা করে।

এদিকে নয়ন লাবণীর সঙ্গে অনেকটা সময় কাটায়। তারা বিকেলবেলা মাঠের পাশে হাঁটে, শোনে গাছের পাতার শব্দ, দেখে নদীর জলে সূর্য ডোবা। দুজনের কথায় এখন আর ‘প্রেত’ নেই, আছে শুধু মানুষ, অভিমান, আর ক্ষমার গল্প। লাবণী বলে, “আমরা অনেকেই অতীতকে ভয় পাই। অথচ ওটাই তো আমাদের তৈরি করে।” নয়ন সম্মত হয়। সে এখন জানে, ইতিহাস শুধু তথ্য নয়, ইতিহাস মানে সম্পর্ক, আত্মা, স্মৃতি—যা বারবার ফিরে আসে ঠিক প্রদীপের আলোর মতো। লাবণী বলে, “তুমি ফিরেছো বলে হয়তো প্রেত নেই আর। কিন্তু তুমি না ফিরলে বীণাপাণি দেবী আজও নিভে যাওয়া প্রদীপের পাশে বসে থাকতেন।” নয়ন তার দিকে তাকিয়ে শুধু একটুখানি হাসে—একটা হালকা, মুক্তির হাসি। তারপর বলে, “তুমি থাকলে আরও আগেই ফিরতাম।” সেই মুহূর্তে নদীর হাওয়া বইতে থাকে উড়ন্ত ঘাসের মাথায়, আর দুজন মানুষের মধ্যে এক আশ্চর্য নীরবতা জন্ম নেয়—ভয়ের পর প্রেমের, হাহাকারের পর শান্তির।

চলার দিন এসে যায়। নয়ন ট্রেন ধরার জন্য তৈরি হয়, কিন্তু এবার তার হাতে কোনো ব্যাগ নেই, কাঁধে কোনো বোঝা নেই। সে এসেছে নিজের বোঝা ঝেড়ে ফেলতে, আর ফিরে যাচ্ছে নতুন মন নিয়ে। স্টেশনে পৌঁছানোর আগেই সে একবার মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে পড়েন। মাটি ছুঁয়ে সে একটা শেষ প্রার্থনা করে—“মা, আমি ফিরব। এবার আর চিরতরে নয়, আমি আবার আসব, আলো নিয়ে, গল্প নিয়ে।” তার চোখ বন্ধ থাকে কিছুক্ষণ। তারপর সে হাঁটে প্ল্যাটফর্মের দিকে, ট্রেনের হুইসেল শোনা যায় দূরে। কেউ তাকে ডাকে না, কিন্তু যেন হাওয়ার মধ্যে কারো একটুকরো নিঃশ্বাস মিশে থাকে—“ফিরিস বাবা, আলো নিভিস না।” নয়নের চোখের কোণে এক ফোঁটা জল ঝরে, কিন্তু সে সেটাকে অশ্রু বলে না, বলে—এটা জল নয়, এ মাটি আর ভালোবাসার মিলন।

ছয় মাস কেটে গেছে। শহরের ব্যস্ত রাস্তায় নয়ন এখন একজন রিসার্চার থেকে লেখক হয়ে উঠেছে—“প্রেতবাড়ির প্রদীপ” নামের বইটি ছাপা হয়েছে, পাঠকের ভালোবাসা পেয়েছে। কিন্তু সাফল্যের আলোয় তার চোখ ঝলসে যায়নি, বরং সেই আলো তাকে বারবার মনে করিয়ে দেয়, একটা প্রদীপ এখনো জ্বলছে তার ভেতরে—যেটা নিভে গেলে আবার হারিয়ে যাবে সেই সব অসমাপ্ত সম্পর্কের ছায়া। লাবণীর সঙ্গে সে চিঠি চালাচালি করে—মোবাইল থাকলেও তারা ইচ্ছে করেই হাতে লেখা চিঠি আদানপ্রদান করে, যেন পুরনো সময়টা ধরে রাখা যায়। একদিন, এক শান্ত বিকেলে, একটি চিঠি আসে লাবণীর কাছ থেকে—“তোমার বাড়ির বারান্দায় প্রদীপটা নাকি মাঝেমধ্যে নিজে থেকে জ্বলে ওঠে। কেউ জ্বালায় না, বাতাস নেই, কিন্তু আলো জ্বলে। অনেকে দেখে ভয় পায় না, বরং এখন বলে, ‘ও মা ফিরেছেন বুঝি।’” নয়ন সেই চিঠি পড়ে হঠাৎ স্থির হয়ে যায়। মনে পড়ে যায় সেই কাশির শব্দ, সেই ঠান্ডা হাত, সেই মা’র অভিমান। সে জানে, কিছু সম্পর্ক মুছে যায় না—তারা সময়ের সীমানা ছাড়িয়ে আলো হয়ে থেকে যায়।

এক সপ্তাহ পর নয়ন ফের ফিরে আসে গ্রামে। ট্রেন থেকে নামার পর চারপাশে বদল ধরা পড়ে তার চোখে—তবে সেটা চোখের নয়, মনে। মানুষ বদলায়নি, রাস্তা বদলায়নি, কিন্তু পরিবেশে একটা আত্মীয়তা তৈরি হয়েছে। আগে যেখানে সে একজন বহিরাগত ছিল, আজ সেখানে সে এক ছেলে, এক সন্তান, যে ফিরে এসেছে শুধু নিজের জন্য নয়—সব হারানোদের তরফে। সে সোজা চলে যায় সেই বাড়িতে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দেখে, বারান্দার সেই জায়গায় একটা নতুন প্রদীপ রাখা হয়েছে—ধারালো, কাচের ঢাকনা দেওয়া, কিন্তু তার মধ্যেও জ্বলছে সেই পুরনো, পরিচিত, কমলা আভা। কেউ এসে বলে না, ‘ভূতের বাড়ি’, বরং কয়েকজন বৃদ্ধ বলে, “ওখানে তো বীণাপাণি থাকেন। আলো নিভে না আর।” নয়ন মাথা নিচু করে সেই প্রদীপের সামনে বসে পড়ে। এবার তার হাতে কোনো চিঠি নেই, কোনো ক্ষমার আর্তি নেই—শুধু দু’চোখ বন্ধ করে একটা মৃদু প্রার্থনা:
“আলোটা জ্বালিয়ে রেখো মা… যদি কোনোদিন আবার দেরি হয়ে যায়।”
প্রদীপের শিখা তখন হালকা কেঁপে ওঠে, যেন সম্মতি জানায়।

বিকেলে লাবণীর সঙ্গে নয়ন হাঁটে সেই তুলসী তলার ধারে। চারপাশে কাঁচা ঘর, ছেলেমেয়েদের খেলা, আর মাঠ জুড়ে সূর্যের সোনালি আলো। লাবণী হেসে বলে, “তুমি জানো? তুমি যখন এখানে ছিলে, তখন গ্রামের লোকেরা নিজেদের ইতিহাস ফিরে পেয়েছিল। এখন তুমিই তাদের গল্পের চরিত্র।” নয়ন হেসে ফেলে, বলে, “তাহলে আমি একদিন লোককাহিনির লোক হয়ে যাব?” লাবণী একটু থেমে বলে, “তুমি তো আছই—প্রেতবাড়ির প্রদীপ হয়ে।” নয়ন তাকিয়ে থাকে তার চোখে। দুজনেই জানে—এটাই শেষ অধ্যায় নয়। আলো নিভে না, শুধু স্থানান্তরিত হয়। সেই আলো আজ প্রেত নয়, ইতিহাস নয়—ভালোবাসা।
বাড়ির বারান্দায় তখনও প্রদীপ জ্বলছে—নয়নের অনুপস্থিতিতেও। কারণ, কেউ একজন হয়তো এখনও জানে, তার ছেলেটি আবার ফিরবে… ঠিক প্রদীপের আলোর মতো, নিভে গিয়েও জ্বলে উঠবে।

***

1000040338.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *