অতুল ব্যানার্জী
১
সকাল সকাল ঘুম ভাঙে সুবলের। তার ঘুমটা গাঢ় হলেও, সীমান্তে গর্জে ওঠা ট্রাকে চেপে আসা বিএসএফের পেট্রল-জিপের শব্দ যেন কানে লেগে থাকে স্বপ্নের মধ্যেই। তাদের ছোট কুঁড়েঘরটা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের একেবারে ধারঘেঁষে। কাঠের বারান্দা নেই, কুয়োর জল রোদে শুকিয়ে থাকে আধা বালতির মতো। মা জাহানারা বিবি তখনো হাঁড়িতে জল চড়িয়ে রাখেন, আর কাঁটাতারের ওপাশের ঝোপের দিকে কপালে ভাঁজ ফেলে তাকিয়ে থাকেন। তিনি জানেন, সেই দিকে নজর রাখতে হয়—সীমান্তে যেসব ঘটনা ঘটে, তা অনেক সময় পাছে এসে ঘরেও থাবা বসায়।
সুবল আজ আর স্কুলে যেতে চায় না। স্কুল মানে ধুলো জমা বেঞ্চ, অসহ্য গরম, আর মাস্টারের কাঠের স্কেলের ঠক ঠক। তার তুলনায় কাঁটাতারের পাশে বসে বাঁশি বাজানোই অনেক ভালো। বাঁশিটা তার বাবার—এক সময় গ্রামে গান গাইতেন, লোকনাট্যে অভিনয় করতেন। তারপর এক রাতে ওপারে যাওয়ার চেষ্টায় হারিয়ে যান। কেউ বলে, গুলিতে মরেছেন, কেউ বলে ধরা পড়ে গায়েব। তখন সুবলের বয়স মাত্র চার। তার পর থেকেই বাঁশি বাজিয়ে বাবাকে ডাকার মতোই সুর তোলে সে। মনে মনে ভাবে, ওপারে যদি তার সুর পৌঁছায়, বাবা একদিন ফিরবে।
বিকেলের দিকে, সীমান্ত ফাঁড়ির ওপাশে সদ্য বদলি হয়ে আসা বিএসএফ জওয়ান অরিন্দম পাল নিজের ক্যাম্পের প্রাচীরে বসে, সামনের দিকে তাকিয়ে থাকেন—চোখে গভীর এক ভাবনা। ৩৫ বছরের পুরুষ, উচ্চতা ছ’ফুট, কিন্তু মনটা যেন হাঁপিয়ে উঠেছে। কলকাতার বাড়ি থেকে ফোন আসে, স্ত্রী রোশনী কথা বলেন, কিন্তু কথার ভেতর কিছু একটা ফাঁকা থাকে।
তার পোস্টিং হয়েছে একেবারে গ্রাম্য সীমান্তে, যেখানে দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে দাঁড়িয়ে, পেট্রল দিয়ে আর নজর রেখে। কিন্তু সেই বিকেলেই প্রথম শোনেন এক অপূর্ব বাঁশির সুর—যেটা বেজে ওঠে ঠিক কাঁটাতারের ধারে। অরিন্দম চমকে ওঠেন, যেন বহুদিন পরে হৃদয়ের কোথাও এক টান লেগেছে। তিনি প্রথমে ভাবেন, হয়তো ওপার থেকে কেউ বাজাচ্ছে। কিন্তু পরে দেখেন, ভারতের দিকেই এক বালক, কাঁটাতারের এক কোণায় বসে, নিঃশব্দে, চোখ বন্ধ করে সুর তুলছে।
সেই মুহূর্তে অরিন্দমের চোখে ভেসে ওঠে তার ছোটবেলা—কলকাতার বেলেঘাটার ছাদে বসে বাঁশির সুর শেখার দিন, মায়ের মুখ, দাদুর বকুনি। এখন সে সৈনিক, নিয়ম আর দায়িত্বের বেড়াজালে বন্দি, কিন্তু এই এক সুরে ভেসে যায় সময়।
এরপর প্রতিদিন বিকেল হলেই অরিন্দম অপেক্ষা করেন—বাইরের পোস্টিং শেষ করে ফিরে এসে ঠিক পাঁচটা নাগাদ তার চোখ চলে যায় বাঁশির দিকে। সুবলও বুঝে যায়, ওপারে কেউ তাকে লক্ষ্য রাখছে। একদিন তাদের চোখে চোখ পড়ে—একটি হালকা হাসি ছুঁয়ে যায় দু’জনকে। তারা কথা বলে না, কোনো শব্দ নেই, শুধু এক বোবা আলোয় তৈরি হয় সম্পর্কের ভিত্তি।
সেই সন্ধ্যায় অরিন্দম নিজের ব্যাগে রাখা একটি চকোলেট বার বার দেখে—শেষমেশ, কর্তব্য ভুলে এক ফাঁকে সে সেটি কাঁটাতারের ধার দিয়ে রেখে আসে। পরদিন সুবল সেটা খুঁজে পায়। বিস্ময় আর আনন্দে তার চোখ ঝলসে ওঠে। সে বুঝে যায়, ওপারে কেউ আছে—এক বন্ধু, হয়তো এক সুরের ভক্ত, অথবা নিঃসঙ্গ কারও হৃদয়।
সীমান্তের আলো সন্ধ্যায় যখন লাল হয়ে আসে, কাঁটাতারের ওপার থেকে কেউ তখন একা দাঁড়িয়ে থাকে, আর এপারে বসে কেউ বাঁশি তোলে।
সীমান্ত, যেখানে দেশ ভাগ হয়—কিন্তু মন নয়।
২
অরিন্দম পালের জন্য দিনগুলো কাটে নিয়মানুবর্তিতার ছাঁচে—ভোরে উঠে শরীরচর্চা, পেট্রল ডিউটি, রিপোর্ট লেখা, আর সহকর্মীদের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত কথাবার্তা। তিনি বরাবরই দায়িত্বশীল, কোনো নিয়ম ভাঙেন না। কিন্তু এই পোস্টিংয়ে এসে যেন ভেতরের এক শূন্যতা আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। কলকাতার স্ত্রী রোশনী ফোনে বলে, “তুমি কেমন যেন বদলে গেছো, কম কথা বলো এখন।”
কিন্তু কী বলবে সে? সীমান্তের এই স্তব্ধ প্রান্তে দাঁড়িয়ে, যেখানে কেবল কাঁটাতার আর ধুলো জমা পথ, সেখানে কথা হারিয়ে যায়। কিন্তু প্রতিদিন বিকেলে, যখন বাঁশির সুর ভেসে আসে, তখন যেন তার চারপাশ রঙিন হয়ে ওঠে। সেই সুরে এক ধরণের আশ্বাস থাকে—যা বলে, তুমি একা নও। অরিন্দম বুঝতে পারেন, সেই বালক শুধু বাঁশি বাজাচ্ছে না—সে যেন প্রতিদিন অরিন্দমের নিঃসঙ্গ আত্মায় আলোর ছোঁয়া দিচ্ছে।
একদিন ডিউটির শেষে তিনি আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন ফাঁড়ির বাইরের প্রাচীরে। সূর্য তখন পশ্চিমের মাঠে হেলে পড়েছে, আর বাতাসে ধুলো উড়ে বেড়ায়। হঠাৎ সেই পরিচিত সুর ভেসে আসে। অরিন্দম নড়েচড়ে বসেন। তিনি একরকম না চেয়েই পা বাড়ান কাঁটাতারের কাছে। সেখানে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট দেখেন ছেলেটি—সুবল, লাল ফিতের ছেঁড়া প্যান্ট, ধুলোমাখা গায়ের জামা, আর চোখ দুটো অবাক মায়ায় পূর্ণ।
আজ তার বাঁশির সুর অন্যরকম—একটা নতুন সুরে শুরু করেছে, যেন কষ্ট আর সাহসের মিশ্রণ। অরিন্দমের বুকের ভেতর কেঁপে ওঠে, কিছুটা ব্যথা আর কিছুটা প্রশ্রয় মেশানো এক অনুভূতি। তিনি মাথা নিচু করে একটা ছোট্ট নোটবুক বের করেন—পিছনে তার ছোটবেলার ছড়া লেখা ছিল। তারপর, অন্যদের চোখ এড়িয়ে, সেটা ভাঁজ করে কাঁটাতারের ধার দিয়ে রেখে আসেন। সুবল তা দেখেও কিছু বলে না, শুধু একবার মৃদু হাসে।
পরদিন বিকেলে অরিন্দম অপেক্ষা করেন, কিন্তু সুর আসে না। তার মন অস্থির হয়ে ওঠে। ঠিক সন্ধ্যার দিকে আবার সেই পরিচিত সুর বাজে—কিন্তু এবার বাঁশির সঙ্গে ঝর্ণার শব্দ যেন মিশে যায়।
পরক্ষণেই দেখা যায় সুবল—আজ তার হাতে কিছু নেই, কিন্তু চোখে যেন কোনো বার্তা রয়েছে। পরদিন সকালে, ফাঁড়ির টেবিলের ওপর অরিন্দম খুঁজে পান এক ভাঁজ করা কাগজ। কে রেখে গেছে, কেউ জানে না। খুলে দেখেন—সুবলের হাতে আঁকা এক ছবি, যেখানে কাঁটাতার নেই, শুধু দুজন মানুষ পাশাপাশি বসে বাঁশি বাজাচ্ছে।
সেই মুহূর্তে অরিন্দম বুঝে যান, কাঁটাতারের ওপার থেকেও সম্পর্ক জন্মায়। শৃঙ্খলার ভিতরে থেকেও হৃদয়ের কিছু দিশা থাকে মুক্ত, উদার। সেই দিন থেকে তিনি প্রতিদিন একটা ছোট্ট কিছু রেখে যান ওর জন্য—কখনো একটা পেনসিল, কখনো একটা রঙ প্যাকেট।
এইভাবেই বাঁশির সুর ও সৈনিকের মন এক আশ্চর্য বন্ধনে বাঁধা পড়ে—যা চোখে দেখা যায় না, শুধু হৃদয়ে শোনা যায়।
৩
সুবলের সকালগুলো এখন আর আগের মতো আলসেমিতে কাটে না। সে ঠিক করে নেয়, স্কুলে না গেলেও প্রতিদিন বিকেলে ঠিক সময়মতো বাঁশি নিয়ে কাঁটাতারের ধারে যাবে। সুর এখন তার কাছে শুধু নিজের মনে কথা বলা নয়—এ যেন এক নিঃশব্দ যোগাযোগ, এক অচেনা বন্ধুর সঙ্গে। সেই বন্ধুটি যে চোখে চোখ রাখে, দূর থেকে মাথা নাড়ে, তার জন্য কিছু রেখে যায়—সেই সম্পর্কের উষ্ণতা সুবল আগে কখনও পায়নি। বাড়িতে সে এই ব্যাপারে কাউকে কিছু বলে না, এমনকি মাকেও না, কারণ সে জানে মা ভয় পাবে। বিএসএফ জওয়ানদের নিয়ে গ্রামে নানা গল্প আছে—কেউ বলে তারা কঠিন, কেউ বলে তারা নাকি ছেলেধরা পর্যন্ত! কিন্তু সুবলের চোখে সেই মানুষটা একদম আলাদা। তিনি কথা বলেন না ঠিকই, কিন্তু তাঁর চোখে যা আছে, তা সুবল খুব ভালো করে বোঝে—একটা দীর্ঘ একাকীত্ব, একটা নির্জনতা যা হয়তো তাঁর দায়িত্বে বাধা, কিন্তু হৃদয়ে মুক্ত। সেদিন সন্ধ্যায় সুবল একটি রঙিন কাগজে ছেঁড়া পেন্সিল দিয়ে একটি ছবি আঁকে—একটা মাঠ, একটা বাঁশি, আর দুটি মানুষ কাঁটাতার ছাড়াই পাশাপাশি বসে আছে। ছবিটা সে মুড়িয়ে রেখে আসে সেই জায়গাটায়, যেখানে প্রতিদিন কিছু না কিছু পড়ে থাকে। মনে মনে ভাবে, “ওপারের মানুষটা যদি ছবিটা দেখেন, বুঝতে পারবেন—আমি ওনার বন্ধু হতে চাই।”
অরিন্দম সেই দিন ক্যাম্পে ফিরে এসে আর মন বসাতে পারেন না। অন্যান্য জওয়ানরা ব্যাডমিন্টন খেলছে, কেউ চা খাচ্ছে, কেউ মোবাইলে সিনেমা দেখছে—কিন্তু তিনি নিঃশব্দে খোলা চাঁদের আলোয় বসে রয়েছেন, টেবিলের ওপর রাখা একটা ছোট কাগজের দিকে তাকিয়ে। ছবিটা তিনি কিছুক্ষণ আগেই পেয়েছেন—এত সরল, অথচ এত গভীর এক অনুভব! তার চোখে জল চলে আসে। তিনি নিজের ছোটবেলার কথা ভাবেন—সেই সময়কার বন্ধুরা, যাদের সঙ্গে ছাদে উঠে বাঁশি বাজাতেন, যাদের সঙ্গে স্টেশনের ধারে গল্প করতে করতে সময় কেটে যেত। এখন, এত বছর পর, এই দায়িত্বপূর্ণ, কঠিন জীবনের ভেতর কোথা থেকে এসে এক ছোট্ট ছেলে যেন তাঁকে সেই সময়ের গন্ধ এনে দিয়েছে। তিনি অনুভব করেন, এই সম্পর্কটা শুধু কাঁটাতারের দু’পাশের বন্ধুত্ব নয়—এ যেন এক গভীর আত্মীয়তা, যেখানে ভাষা নেই, নিয়ম নেই, আছে কেবল হৃদয়ের অনুভব।
পরের দিন, তিনি নিজের কাছে রাখা ছোট্ট একটা রঙ পেন্সিল সেট রাখেন কাঁটাতারের ধার দিয়ে, ছবির পাশে। তাঁর মনে হয়, এই ছোট্ট কিছুর মাধ্যমেই হয়তো একজন নিঃসঙ্গ জওয়ান আর একজন কল্পনাপ্রবণ শিশু—একসাথে জীবনের নতুন মানে খুঁজে পেতে পারে।
সেদিন বিকেলে সুবল নতুন করে সাজে—চুল আঁচড়ে নেয়, মায়ের পুরোনো ফতুয়া গায়ে দেয়, যেন কোনো উৎসব আছে। আজ সে ঠিক করেছে, শুধু সুর নয়, চোখে চোখ রেখে হাসবে। তার মধ্যে একটা আনন্দ কাজ করে—এমনকি সে স্কুল না গিয়ে যে অপরাধবোধ করত, তাও আজ নেই। বাঁশি হাতে কাঁটাতারের ধারে পৌঁছে দেখে, আজ ওপারে সেই জওয়ানটা একটু কাছাকাছি দাঁড়িয়ে। তাঁরা চোখে চোখ রাখে। এরপর যা ঘটে, তা এক অনাবিল অনুভূতি—সুবল বাঁশি বাজায়, আর জওয়ান মাথা নাড়িয়ে সুরে সুর মেলান যেন।
আকাশ তখন লালচে, ধানখেতের ফাঁকে ঝিঁঝিঁ ডাকছে, আর কাঁটাতারের ওপার-এপারে এক অপার্থিব বন্ধুত্বের মৃদু আলোকরেখা জ্বলে ওঠে।
সে দিন, ফাঁড়িতে ফিরে অরিন্দম মোবাইল খুলে স্ত্রীর মেসেজ দেখে—“আজ খুব ব্যস্ত, পরে কথা বলি।”
সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সেই ছবিটা আবার বের করেন। তারপর মোবাইলের ক্যামেরায় ছবিটা তুলে রেখে দেন।
তাঁর মনে হয়, এই ছেলেটাই হয়তো জীবনের এক সত্যি বন্ধু—যাকে নিয়ম, দায়িত্ব, সীমান্ত কিছুই আটকে রাখতে পারে না।
৪
সুবল এখন প্রায় প্রতিদিন নতুন কিছু নিয়ে যায় কাঁটাতারের ধারটায়—কখনো তার পুরোনো ছবির খাতা, কখনো বটপাতায় আঁকা একরকম ফুল, বা মায়ের বানানো শুকনো মুড়ির পুটুলি। কাঁটাতারের পাশের ছোট্ট গর্তটা যেন হয়ে উঠেছে এক অদ্ভুত ডাকঘর—যেখানে ভাষার কোনও ব্যবহার নেই, অথচ আবেগের আদান-প্রদান চলে নিয়মিত। সেদিন সে একটি ছোট কাগজে শুধু লিখে, “আমি বাঁশি বাজাই কারণ আপনি শুনছেন।” লেখা খুব অস্পষ্ট, বানান ভুলে ভরা, কিন্তু সেই লেখার মধ্যে ছিল একটা শিশুর নির্ভেজাল হৃদয়। কাগজটা সে মুড়িয়ে রেখে এল কাঠের পুরনো গুঁড়ির ফাঁকে। সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফেরার সময় তার মন ভরে উঠেছিল অদ্ভুত এক শান্তিতে। মা প্রশ্ন করলেন, “আজ এতো হাসছিস কেন?” সে বলল না কিছু, শুধু বলল, “আজ ভালো সুর উঠেছিল।” মা মুখে কিছু না বললেও একবার কাঁটাতারের দিকেই তাকিয়ে থাকলেন অনেকক্ষণ। তার চোখে ছিল ভয়, আর কিছুটা অবিশ্বাস—এই নীরব ছেলেটা যেন কোথায় যেন ভিন্ন কিছুতে জড়িয়ে যাচ্ছে।
অন্যদিকে, অরিন্দম আজ সারাদিন পোস্টে থেকেও মন বসাতে পারেননি। তার মাথায় ঘুরছে ছেলেটার লেখা কাগজটা—যেটা তিনি খুঁজে পেয়েছেন সকালে, ডিউটি শুরু করার আগে। “আমি বাঁশি বাজাই কারণ আপনি শুনছেন।”—এই একটি লাইন যেন সমস্ত ভাষা, নিয়ম, আর পোশাকি পরিচয়ের দেয়াল ভেঙে দিয়েছে। অরিন্দমের চোখে জল চলে এসেছিল প্রথমবার, অজান্তেই। এক যুদ্ধ ক্লান্ত সৈনিক, যে বহুদিন ধরে কেবল নিয়ম আর আদেশ মেনে চলেছে, আজ এক বালকের সুর আর একটি লাইন পড়ে ভেতরে ভিতরে বদলে যাচ্ছে। তিনি এবার সিদ্ধান্ত নেন—উত্তর দেবেন। খাতার পেছনের পাতায় লেখেন, “আমি শুনি কারণ তোমার সুরে শান্তি আছে। কখনও থামিও না।”
সেই কাগজ মুড়ে, তিনি রেখে আসেন আগের দিনের রঙ পেনসিল বক্সের খোলের ভেতর। এরপর বিকেলের দিকে দাঁড়িয়ে থাকেন পোস্টের চাতালে, অনেকটা সময়। সেদিন আর বাঁশি বাজে না।
সন্ধ্যায় ক্যাম্পে ফিরে সহকর্মীরা বলেন, “কিরে দাদা, আজকাল এত ভাবো কী নিয়ে?”
তিনি হেসে বলেন, “একটা ছোট ছেলের সঙ্গে কথা হচ্ছে, কিন্তু কথা না বলে।”
পরদিন সুবল খুঁজে পায় সেই কাগজটা। অরিন্দমের অক্ষরগুলো ঝরঝরে, পরিষ্কার, কিন্তু সেখানে লেখা ছিল যে কথাগুলো, তা যেন জীবনে প্রথমবার কাউকে বলতে শোনে সে—“তোমার সুরে শান্তি আছে।”
এই বাক্যটা পড়েই তার বুকটা কেমন যেন গরম হয়ে ওঠে। সে বুঝে যায়, মানুষটা শুধুই সৈনিক নন, তিনি একজন বন্ধু, শ্রোতা, আর হয়তো বাবার মতো কেউ, যিনি দূরে থাকেন কিন্তু হৃদয়ে থাকেন।
সেদিন বিকেলে সে আর বাঁশি না বাজিয়ে শুধু দাঁড়িয়ে থাকে। ওপারে তাকায়, দেখে অরিন্দমও দাঁড়িয়ে। চোখে চোখ রেখে দু’জন কেবল হাসে। আর কিছু বলে না কেউ, কারণ শব্দের দরকার হয় না।
পরে রাতে, ঘরের ভেতর হাঁটু গেড়ে বসে সে আবার একটা কাগজে আঁকে—একটা গাছ, তার শাখায় বসে এক ছেলে বাঁশি বাজাচ্ছে, আর তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন একজন লম্বা মানুষ, মাথায় ক্যাপ। নিচে লিখে, “আমার বাবার মতো।”
কাগজটা সকালে খুব সাবধানে মুড়িয়ে রাখে বাঁশির বাক্সের ভেতর, যেন সে তার মনের সমস্ত কথা সঁপে দিচ্ছে সেই মানুষটার হাতে—যিনি ওপারে দাঁড়িয়ে থেকেও, প্রতিদিন তার ভেতরের আলো জ্বালিয়ে রাখেন।
৫
সুবলের সেই ছোট্ট নিঃশব্দ বন্ধুত্বের গল্পটা এতদিন কেবল কাঁটাতারের দুই পাশে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু সীমান্ত এলাকার মানুষ চুপচাপ থাকলেও, নজর অনেকের থাকে। একদিন গ্রামের বটতলার চায়ের দোকানে কয়েকজন বয়স্ক মানুষকে বলতে শোনা গেল, “শুনেছো, ওই জাহানারার ছেলেটা নাকি বিএসএফ-এর এক জওয়ানের সঙ্গে কিসব আদান-প্রদান করছে! ওর বাবা তো পাচারে জড়িয়ে ছিল, ছেলে কি এখন…” কথাটা হাওয়ার মতো ছড়িয়ে পড়ে। কয়েকজন কৌতূহলী যুবক দূর থেকে নজর রাখতে শুরু করে, কে কখন কাঁটাতারের ধারে যায়। কেউ কেউ গুজব ছড়ায়, “ওই জওয়ানটা ওপারের কোনো বাচ্চাকে দিয়ে কীসব করাচ্ছে, রাতে চুপিচুপি চলে যায়।”
জাহানারা প্রথমে বুঝতেই পারেননি কী ঘটছে। পরে তাঁর এক আত্মীয়া এসে সাবধান করে দেন—“তোমার ছেলের দিকে নজর রাখো। সীমান্তে যাওয়া-আসা, ওসব ভালো নয়। আজকাল বিএসএফ সবাইকে সন্দেহ করে।”
জাহানারা অস্থির হয়ে ওঠেন। রাতে খেতে বসে ছেলেকে জিজ্ঞেস করেন, “তুই কাঁটাতারের পাশে কি করিস রোজ?” সুবল কিছুই বলতে পারে না। সে বোঝে, তার নিঃশব্দ বন্ধুত্বটাও এখন অন্যদের চোখে এক বিপদের রূপ নিচ্ছে।
অন্যদিকে ক্যাম্পেও নানান প্রশ্ন উঠে যায়। একজন জুনিয়র জওয়ান রিপোর্ট করে বসে যে অরিন্দম পাল একজন স্থানীয় বালকের সঙ্গে নিয়ম বহির্ভূত যোগাযোগ রাখছেন, যা সীমান্ত সুরক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে “সন্দেহজনক”। হেড কোয়ার্টার থেকে পর্যবেক্ষণ চালানোর আদেশ আসে।
অরিন্দম এইসব জানলেও কিছু বলেন না। তিনি বুঝে গেছেন, তাঁর প্রতিটি মুহূর্ত এখন হিসেবের ভেতর পড়ে গেছে। এক বিকেলে, যখন তিনি সুবলের দেওয়া একটি ছোট আঁকা কাগজ হাতে নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন, তখনই তার পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন জুনিয়র অফিসার, চোখে প্রশ্নভরা কৌতূহল।
“স্যার, ওটা কে দিয়েছে?”
অরিন্দম কিছু না বলে কাগজটা ভাঁজ করে রেখে দেন পকেটে। সহকর্মীরা বলতে শুরু করে, “দাদা, আপনি তো একটু বেশি ইমোশনাল হয়ে পড়ছেন। সীমান্ত জায়গা, এখানে ব্যক্তিগত অনুভূতির জায়গা নেই।”
তাঁর কানে কথাগুলো ধাক্কা মারে, কিন্তু হৃদয় সাড়া দেয় না।
তিনি ভাবেন, “তাহলে কী ভালোবাসা, বন্ধুত্ব বা স্নেহ, কেবল শহরের মানুষের জন্য? সীমান্তের ধুলোয় পা মাড়িয়ে বড় হওয়া ছেলেরা কি কারোর আপন হতে পারে না?”
সেই রাতে, গ্রামের এক গোপন কোণে কিছু লোক অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আলোচনা করে—“ওই ছেলেটাকে রাতেই উঠিয়ে নিয়ে জেরা করা দরকার।” কেউ কেউ আরও বলে, “ওর মা যদি বাধা দেয়, তাকেও ধরে দিতে হবে। সীমান্তে ওসব লুকোচুরি চলবে না।”
সুবলের মা যেন ছায়ার মতো টের পান, কিছু একটা অশুভ এগিয়ে আসছে। তিনি ছেলেকে বুকে জড়িয়ে বলেন, “আর তুই কাঁটাতারের ধারে যাবি না।” সুবল কিছুই বলে না, চোখের জল গড়িয়ে পড়ে। সে জানে, তার বন্ধুটাও এ কথা শুনলে খুব কষ্ট পাবে।
অন্যদিকে অরিন্দম ক্যাম্পে বসে তার রাত্রিকালীন রিপোর্ট শেষ করছেন, হঠাৎ বাহিনীর হেড ইনচার্জ এসে বলেন, “কাল HQ থেকে লোক আসছে আপনার সাথে কথা বলতে। আপনি যা করছেন, তাতে বাহিনীর ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।”
অরিন্দম চুপচাপ মাথা নত করেন।
কিন্তু ভিতরে ভিতরে তাঁর হৃদয়ে জেদ জন্ম নেয়—“কোন নিয়ম এতটা কঠিন হতে পারে যে, একটা শিশুর স্নেহ কিংবা বন্ধুত্বকেও অপরাধ বানিয়ে ফেলে?”
তাঁর চোখে শুধু একটা মুখ ঘুরে বেড়ায়—সুবল, যার চোখে প্রশ্ন থাকে না, থাকে শুধু বিশ্বাস।
৬
রাতটা ছিল অস্বাভাবিক নিস্তব্ধ, যেন হাওয়াও থমকে গেছে সীমান্তের দু’পাশে। রাত দশটার পরেই হঠাৎ করেই শুরু হয় উত্তেজনা—সীমান্ত পোস্টের ওয়াকিটকিতে সংকেত আসে যে ওপার থেকে কিছু দুষ্কৃতকারী গোপনে পারাপার করার চেষ্টা করছে। অরিন্দম তখন ক্যাম্পে ছিলেন, সঙ্গে সঙ্গে বন্দুক কাঁধে তুলে ছুটে যান পোস্টের দিকে। চারদিকে ফ্লাডলাইট জ্বলে ওঠে, জঙ্গলের দিকে গুলির আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হয়। কাঁটাতারের একপাশে ঝোপের ভেতর কাউকে দৌড়াতে দেখা যায়—অরিন্দম আর কয়েকজন জওয়ান পিছনে ধাওয়া করেন। ঠিক সেই সময় দূর থেকে ভেসে আসে এক চেনা সুর—সুবলের বাঁশি। কিন্তু সুরটা থেমে যায় হঠাৎই, আর গুলির আওয়াজে মিশে গিয়ে নিঃশেষ হয়ে যায়।
সব দৌড়ঝাঁপ, চিৎকার, হুকুমের মাঝে অরিন্দমের হৃদয় দুরুদুরু করতে থাকে। তার মনে হয়, এই জঙ্গলের ভেতর, এই নিশুতি রাতেই হারিয়ে গেল সেই ছোট্ট ছেলেটা, যে কোনো ভুল সময়ে কোনো ভুল জায়গায় চলে এসেছিল। কেউ কিছু বলেনি, কোনো মৃতদেহ মেলেনি, কিন্তু কোথাও যেন একটা ভেতরের আলো নিভে গেল।
সেই রাতেই ক্যাম্পে ফিরে অরিন্দম নিজের ডেস্কে বসে থাকেন, সামনে পড়ে থাকে সুবলের শেষ দেওয়া ছবি—তাদের দুজনকে দেখানো হয়েছিল একসঙ্গে একটি গাছের নিচে। ছবিটার দিকে তাকিয়ে তাঁর চোখ জলে ভরে ওঠে। এত বছর ধরে কত ঝুঁকিপূর্ণ পোস্টিং, কত হুমকি, কত শত্রু মুখোমুখি হয়েছেন—কিন্তু এতটা অসহায় কখনও অনুভব করেননি।
পরদিন ভোরবেলায় গোটা গ্রামে গুজব ছড়িয়ে পড়ে—“একটা বাচ্চা নাকি গুলিতে মারা গেছে।” কেউ বলে “ওই যে জাহানারার ছেলে, সে তো কাল সন্ধ্যার পর থেকে নিখোঁজ।” কেউ আবার বলে, “না না, ও চোরাচালান করছিল, ধরা পড়েছে।”
জাহানারা দরজার সামনে বসে থাকেন, চোখ ফেটে কান্না আসে না। রাতভর তিনি জেগেছিলেন, ছেলের ফেরার অপেক্ষায়। তার বুকের ভেতর সন্দেহ আর বিশ্বাসের মাঝে টানাপোড়েন চলে—সুবল কি সত্যিই কিছু করছিল, না কি ভুল সময়ে ভুল জায়গায় ছিল? কিন্তু তার মা-হৃদয় তবু বিশ্বাস করে, তার ছেলে এমন নয়।
গ্রামের কিছু ছেলে রাতের ঘটনার পর সীমান্তের দিকটা ঘুরে এসে বলে, “কোনো বাচ্চার চিহ্ন নেই, কিন্তু রক্ত লেগে আছে ঘাসে।”
এই অস্থিরতার মধ্যে কেউ কেউ বিএসএফের দিকে আঙুল তোলে, কেউ আবার বলে, “ও জওয়ানটা নিশ্চয় জানে কিছু।”
কিন্তু অরিন্দম চুপ করে থাকেন। তাঁর মুখে কোনো ব্যাখ্যা নেই, বুকের ভিতর জ্বলছে অনিশ্চয়তার এক অগ্নিকুণ্ড।
রাত গড়ায়, দিন কাটে, কিন্তু কোনো সুর আর শোনা যায় না কাঁটাতারের ধারে।
অরিন্দম প্রতিদিন বিকেলে সেই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে থাকেন, যেখানে তারা দেখা করত—হয়তো একটু শব্দ ভেসে আসবে, হয়তো কোনো পাতা দুলে উঠবে সেই পুরনো ইশারায়।
কিন্তু না—সীমান্ত যেন আরও নিঃস্তব্ধ, আরও শুষ্ক।
তিনি একদিন নিজে এগিয়ে যান গ্রামের দিকে, যদিও সেটি কর্তব্যের নিয়ম লঙ্ঘন।
বৃষ্টিভেজা পায়ে কাঁদা মাড়িয়ে গিয়ে হাজির হন সেই কুঁড়েঘরের সামনে, দরজার বাইরে জাহানারা বসে আছেন।
তাঁর দিকে একবার তাকান, তারপর আর কিছু না বলে ভেতরে চলে যান।
কিছুক্ষণ পর, ছোট্ট দরজা খুলে বেরিয়ে আসে এক নিঃশেষিত মুখ—সুবল।
সে বেঁচে আছে—তবে বদলে গেছে। মুখে শব্দ নেই, চোখে কেবল ভয়।
অরিন্দম তার দিকে তাকিয়ে থাকেন অনেকক্ষণ, তারপর বুকের ভেতর জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন—হয়তো এবার বাঁশির সুর আবার ফিরবে, তবে আগের মতো হবে না কখনোই।
৭
সেই দিনের পর থেকে পুরো ক্যাম্পে এক অদ্ভুত চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। হেড কোয়ার্টার থেকে আলাদা একটি তদন্ত টিম এসে পৌঁছায়। ক্যাম্পের প্রত্যেক জওয়ানের গতিবিধি খতিয়ে দেখা হয়, বিশেষ করে অরিন্দমের। তিনি কিছু বলেন না, মুখে সংযম, চোখে এক নিঃশব্দ প্রতিজ্ঞা। একদিন রাতে, ঘরে বসে রোশনীর মেসেজ পড়েন: “তুমি এত চুপ কেন, অরিন্দম? আমরা এখন অচেনা হয়ে যাচ্ছি।” উত্তর দিতে গিয়েও থেমে যান। কী লিখবেন? যে সম্পর্কটা তার হৃদয়ের গভীরে গড়ে উঠেছে, সেটা কি ফোনের স্ক্রিনে ব্যাখ্যা করা যায়? যে সম্পর্ক একজন ক্লান্ত সৈনিকের নিঃসঙ্গ হৃদয়ে এক শিশুর সরল বন্ধুত্ব দিয়ে আলোর রেখা টেনেছে, সেটা কি কোনো রিপোর্টে ধরা যায়?
সে রাতে, গোপনে, অরিন্দম ক্যাম্পের বাইরের ছোট গেট পেরিয়ে কাঁটাতারের পাশের পথ ধরে গ্রামমুখী হন। সমস্ত নিয়ম ভেঙে, সমস্ত বিধিনিষেধ অগ্রাহ্য করে তিনি পৌঁছে যান সুবলের কুঁড়েঘরের সামনে। দরজায় ধাক্কা দেন না, ডাকেন না। দাঁড়িয়ে থাকেন চুপচাপ।
কিছুক্ষণ পরে দরজা খুলে যায়—জাহানারা চোখে চোখ রাখেন তাঁর সঙ্গে, মুখে কোনো কথা নেই।
তারপর একটুআধটু নুয়ে গিয়ে বলেন, “আপনি এসেছেন?”
অরিন্দম মাথা নত করেন। তাঁর ঠোঁট কাঁপে, কিন্তু কোনও শব্দ বেরোয় না। জাহানারা ভেতরে ডাকেন। ছোট্ট উঠোনে মাটির ওপরে একটি টিনের বাক্সে বসে আছে সুবল, গায়ে পুরোনো জামা, চোখে কালি, মুখে নিস্তব্ধতা। সে উঠে দাঁড়ায় না, তাকায় না। শুধু চুপচাপ নিজের হাতের ভাঁজে মুখ গুঁজে রাখে। অরিন্দম সামনে এগিয়ে এসে হাঁটু মুড়ে বসেন ছেলেটির পাশে। বলেন, “আমি এসেছি… আবার শুনতে, যদি তুমি বাজাও।”
সুবল কিছু বলে না। কিন্তু ধীরে ধীরে সে একটি ভাঁজ করা কাগজ এগিয়ে দেয় তাঁর হাতে। খুলে দেখা যায়, একটি ছবি—একটা বিস্তৃত মাঠ, তার মাঝে একটি বাঁশির রেখা, আকাশে একটি পাখি। নিচে লেখা, “আমি বাঁচি, কারণ আপনি ছিলেন।”
জাহানারা অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর বলেন, “আমি ভয় পেয়েছিলাম, আপনাকে দোষারোপ করেছিলাম মনে মনে। কিন্তু আমি জানি, ও আপনাকে বিশ্বাস করে। ওর বাবার মতো করে…”
অরিন্দম চুপচাপ মাথা নিচু করেন। দীর্ঘ সময়ের পর যেন একটুকরো বৃষ্টিভেজা পৃথিবী ফিরে পেলেন তিনি—যেখানে কোনো যুদ্ধ নেই, কোনো প্রটোকল নেই, শুধু হৃদয়ের স্পর্শ আছে।
তাঁর ক্যাম্পে ফেরার সময় রাত প্রায় এগারোটা। কিন্তু এবার হাঁটার গতি তাঁর আলগা, চোখে একধরনের প্রশান্তি। পরদিন সকালে HQ থেকে আদেশ আসে—অরিন্দম পালকে আর একটি অগ্রবর্তী পোস্টে বদলি করা হচ্ছে। সহকর্মীরা কেউ খুশি, কেউ চুপ। অরিন্দম নিজের ব্যাগ গোছান, সমস্ত জিনিসের মাঝে ভাঁজ করে রাখেন সেই ছবিটা, যেটা সুবল দিয়েছিল।
বিকেলে ডিউটি হস্তান্তরের পর, তিনি আবার একবার কাঁটাতারের ধারে যান।
হাত পকেটে, চোখে শেষবারের মতো সেই জায়গাটিকে দেখে নেন, যেখানে প্রতিদিন এক শিশুর বাঁশির সুর তাঁকে নতুন জীবন দিয়েছিল।
ঠিক সেই সময়, দূর থেকে ভেসে আসে এক ক্ষীণ সুর।
তিনি তাকিয়ে দেখেন—ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে সুবল, বাঁশি হাতে, চোখে একটুকরো আলো।
কোনো শব্দ নেই, কেবল চোখে চোখ রাখা।
এক মুহূর্তের জন্য যেন কাঁটাতারটা অদৃশ্য হয়ে যায়, মাঠ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে আলো, শান্তি আর হৃদয়ের দিগন্ত।
৮
অরিন্দম পাল চলে যান সেই সীমান্ত ফাঁড়ি থেকে পরদিন ভোরেই। সরকারি জিপ এসে তাঁকে তুলে নেয় অন্য এক পোস্টের উদ্দেশে—আরও উত্তরে, আরও দুর্গম এক জায়গায়। সহকর্মীরা তাঁকে বিদায় জানালেও কেউ বিশেষ আবেগ প্রকাশ করে না। কিন্তু তাঁর মনে কোনো অভিমান নেই, বরং বুকের গভীরে এক অদ্ভুত উষ্ণতা রয়ে গেছে। যাবার সময় ব্যাগের ভেতরে ছোট্ট ছবিটা, কয়েকটি বাঁশির সুর নোট করে রাখা পুরনো ডায়েরি, আর ছোট্ট একটি গাছের পাতায় আঁকা সেই প্রথম চিঠিটি।
পথের ধুলো উড়তে উড়তে তিনি ফিরে তাকান সীমান্তের দিকে—সেই কাঁটাতারের ভেতর লুকানো এক আশ্চর্য বন্ধনের দিকে। কাঁটাতারের ওপারে আজ কেউ দাঁড়িয়ে নেই, কিন্তু তাঁর মনে হয়, বাতাসের ধুলোয় আজও একটুকরো বাঁশির সুর ভেসে আসে। সে সুর তাঁর বুকের মধ্যে গেঁথে গেছে—একটি শিশুর বন্ধুত্ব, যে কথাও বলে না, অভিযোগও করে না, কেবল ভালোবাসে নিঃশব্দে।
নতুন পোস্টে পৌঁছানোর পর তাঁর জীবন আবার রুটিনে বাঁধা পড়ে যায়। তবু, প্রতিদিন সকালে জুতো পরার আগে তিনি পাঁচ মিনিট চোখ বন্ধ করে সেই কাঁটাতারের পাশে কাটানো বিকেলগুলোর কথা ভাবেন।
আর ঠিক সেই সময়, চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক দৃশ্য—সুবল বসে আছে মাঠে, বাঁশি হাতে, আর তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসছে।
অন্যদিকে, সীমান্তের ওই গ্রামে জাহানারা এখন অনেকটা চুপচাপ। গ্রামের লোকেরা বুঝতে পারে, এই মা আর ছেলের জীবনে এক সময় এক গল্প ছিল যা আজ কেউ জোরে বলতে চায় না, কিন্তু জানে সবাই। সুবল এখন মাঝে মাঝে স্কুলে যায়, কিন্তু সে আর আগের মতো চঞ্চল নয়। সে নিঃশব্দে বড় হয়ে যাচ্ছে, বয়সের চেয়ে অনেক বেশি বোঝে জীবন। কাঁটাতারের ধারে এখন সে আর বসে না, মায়ের ভয় পায়, গ্রামের মানুষের কথা শোনে।
তবে তার বাঁশিটা সে ছাড়েনি। এখন সে একা ঘরের কোণায় বসে বাজায়—সেই একই সুর, যা একদিন একজন সৈনিককে জড়িয়ে ধরেছিল বন্ধুত্বে।
একদিন সন্ধ্যেবেলা সে তার মাকে জিজ্ঞেস করে, “মা, আমাদের এখানে চিঠি কিভাবে পাঠানো যায়?”
জাহানারা একটু থমকে যান, তারপর বলেন, “চিঠি? কাকে?”
সুবল চোখ নামিয়ে বলে, “একটা বন্ধুকে… উনি এখন দূরে।”
পরদিন সে কাঁটাতারের ধারে গিয়ে এক পাতা চিঠি রেখে আসে, অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক অচেনা জওয়ানের হাতে। চিঠিতে লেখা ছিল—“আপনি হয়তো এখন নতুন পোস্টে, নতুন নিয়মে। কিন্তু আমার বাঁশিটা এখনো বাজে, কারণ আপনি একদিন শুনেছিলেন।”
বছর দুই পরে, বর্ষার দিনে কলকাতার একটি লোকসংগীত উৎসবে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। মঞ্চে এক বিশিষ্ট অতিথি, যিনি সেনাবাহিনীর একজন প্রবীণ অফিসার, বক্তব্য রাখার সময় বলেন—“আমি আজ কথা বলব একজন বাঁশিওয়ালা ছেলের কথা, যে কোনো দেশের নাগরিক হতে পারে, কিন্তু সে আমার জীবনে সবচেয়ে বড় বন্ধু ছিল।”
হল নিস্তব্ধ হয়ে যায়।
তিনি বলেন, “সীমান্তে দায়িত্ব পালনের সময় একদিন, আমি খুঁজে পেয়েছিলাম এমন একজন, যার সঙ্গে কথা হয়নি, কিন্তু হৃদয়ের সবচেয়ে গভীর জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিল। তার দেওয়া একটি আঁকা ছবি, একটি চিঠি, আর তার সুর—আজও আমার ব্যাজের পাশে রাখা।”
এই বক্তব্য পরদিন খবরের কাগজে ছাপা হয়, সঙ্গে একটি স্ক্যান করা চিঠির ছবি—যেখানে শিশুসুলভ অক্ষরে লেখা, “আমি বাঁচি, কারণ আপনি ছিলেন।”
সেই ছবি একদিন গিয়ে পৌঁছায় পুরনো সেই সীমান্ত গ্রামে, সুবলের হাতে।
সে অনেকক্ষণ ধরে চুপ করে তাকিয়ে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে বাঁশি তোলে মুখে।
আর মাঠ জুড়ে আবারও এক নতুন সুর ভেসে ওঠে—যেখানে কাঁটাতার নেই, শুধু হৃদয়ের আলোর রেখা ছড়িয়ে থাকে দিগন্তে।
সমাপ্ত