Bangla - ভূতের গল্প

চৌধুরীবাড়ির শেষ অতিথি

Spread the love

তিথি বসু


পর্ব : সেই ভগ্নপ্রায় দরজার শব্দ

নদীয়ার কুয়াশা ঢাকা বিকেলে ট্রেন থেকে নামতেই শুভমর মনে হলো সময়টা যেন হঠাৎ করে থমকে গেছে। বাইরের হাওয়া ঠান্ডা, কিন্তু বাতাসের মধ্যে কিছু একটা গুমোট। সে ব্যাগপত্র গুছিয়ে রিকশাওয়ালার দিকে এগোল। “চৌধুরীবাড়ি যাবেন?” জিজ্ঞেস করতেই রিকশাওয়ালার মুখটা কেমন থমথমে হয়ে গেল।

“চৌধুরীবাড়ি? ওই যে শ্মশানের পাশে যেটা?”
শুভম মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ, ওটাই। আমি গবেষণার জন্য এসেছি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনুমতি আছে।”

রিকশাওয়ালা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বলল, “আমি ওইদিক যাই না বাবু। ওখানে এখন কেউ থাকেও না।”

শেষমেশ অনেক বোঝানোর পরে একজন রাজি হলো। অন্ধকার নেমে আসছিল, আর চৌধুরীবাড়ির পথটা খড়ি গাছ আর ধানের ক্ষেতের মাঝ দিয়ে, যেন সময়ের কোনো গলিপথে ঢুকে যাচ্ছে শুভম।

চৌধুরীবাড়ি—একসময় নদীয়ার বিখ্যাত জমিদারদের বাসভবন। এখন তা শুধু একটা পুরনো স্মৃতিচিহ্ন। তিনতলা বাড়ির দরজাটা আধখোলা। শুভম রিকশা থেকে নেমে সামনের উঠোনে পা রাখতেই একটা শব্দ কানে এলো—মরা কাঠের দরজার ঠুকঠুক আওয়াজ, যেন কেউ হাওয়ায় ঠেলছে। কিম্বা…

“কে আছেন?”
কোনো উত্তর নেই। শুধুই হাওয়া, আর দূরের শেয়ালের ডাক।

শুভম জানত, ভয়কে প্রশ্রয় দিলে চলবে না। সে আলো জ্বালাল। ব্যাগ খুলে বাইরে থেকে আনা একটা সোলার ল্যাম্প বার করল। ঘরটা ধুলোয় ভর্তি, তবু ভেতরের কাঠের আসবাব, পুরনো আয়না, দেয়ালের কিছু তেলচিত্র—সব এখনও ঠিকঠাক আছে। চৌধুরীদের প্রাচীন ঐশ্বর্যের কিছু চিহ্ন এখনও অদ্ভুতভাবে রয়ে গেছে।

ঘরের কোণে একটা কাঠের আলমারি, বেশ পুরনো, কিন্তু তালা নেই। শুভমের কৌতূহল চাড়া দিল। আলমারির ভেতরে কিছু পুরনো বই, আর একদম নিচে একটা পাতলা নীল কাপড়ে মোড়া কিছু একটা। কাপড় খুলতেই বেরোলো একটি ফ্রেমে বাঁধানো পোর্ট্রেট—একজন তরুণী, হয়তো উনিশ-বিশ বছরের। চোখের দৃষ্টিতে একটা অদ্ভুত টান, যেন সে শুভমকে দেখতে পাচ্ছে। নিচে ছোট হরফে লেখা—”বিমলাবালা চৌধুরাণী, ১৯০৭”।

শুভম চমকে উঠল। এতো সেই বিমলাবালা, যার নাম তার গবেষণার নোটে ছিল। বহু বিতর্কিত মৃত্যু, কেউ বলে আত্মহত্যা, কেউ বলে অপঘাত, আবার কেউ বলে সে কখনো মরেনি—মাটির তলায় লুকিয়ে ছিল কিছু না বলা ইতিহাস।

বাইরের হাওয়া হঠাৎ থেমে গেছে। যেন সময় দাঁড়িয়ে পড়েছে। ঘরের দেওয়ালে টাঙানো ঘড়ির কাঁটা ৮টা বেজে ১৭ মিনিটে আটকে আছে। কিন্তু শুভমের হাতঘড়িতে তখন ঠিক ৯টা বেজে ২২। সে ভাবল, পুরনো ঘড়ি তো, থেমেই থাকবে। কিন্তু ঘড়ির কাঁটা এমনভাবে যেন “ঠিক তখনই” কিছু ঘটেছিল।

রাতটা সে নিচের ঘরেই কাটাবে ঠিক করেছিল। নিজে রান্না করা খাবার, এক বোতল জল, আর একটা কম্বল নিয়ে চৌকি পেতে বসে গেল। বাইরে শেয়ালের ডাক এখনও চলছে। হঠাৎ জানলার পাশ দিয়ে একটা ছায়া সরে গেল।

শুভম উঠে জানলার কাছে গেল, কিছুই নেই। একদৃষ্টে অন্ধকার তাকিয়ে আছে। শুধু নিচের উঠোনে হঠাৎ তার চোখে পড়ল একটা সাদা ওড়নার প্রান্ত—হালকা বাতাসে দুলছে।

সে জানে, বাড়িতে সে ছাড়া আর কেউ থাকার কথা নয়। এই এলাকায় কেউ থাকে না, আশেপাশে বসতবাড়িও নেই। তাহলে ওই সাদা কাপড়টা? কার?

তখনই পেছন থেকে ভেসে এলো একটা শব্দ—একটা মিহি, প্রায় কানে কানে ফিসফিস করা আওয়াজ—
“তুমি আবার এসেছো?”

শুভম ঘুরে তাকাল, কেউ নেই। কেবল আয়নায় বিমলাবালার প্রতিবিম্ব… না, সেটা তার ভুল ছিল হয়তো। সে আয়নাটা ধরতে যেতেই, আয়নার কাঁচে জলছাপ হয়ে জমে উঠল কিছু অক্ষর—অস্পষ্ট, কিন্তু ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে উঠছে—
চুপ করে থাকো। তারা দেখে ফেলবে।

শুভম যেন জমে গেল। এই আয়নাটা কি বাষ্পে এমনভাবে লেখা তৈরি করছে? নাকি কেউ… সত্যিই লিখেছে?

তার মাথা ঘুরে উঠল। সে চৌকিতে ফিরে এল, কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল। তার মনে হচ্ছিল ঘরের দেয়ালের ফাটল থেকে যেন কেউ তাকিয়ে আছে। রাত গভীর হলে ঘুম আসার কথা, কিন্তু তার চোখের পাতা যেন অচেনা চিন্তায় আটকে গেল।

তখনই বাড়ির ওপরে, দ্বিতীয় তলার বারান্দায়, এক চাপা ধাতব শব্দ—চাবির ঘষাঘষি, তালা খোলার আওয়াজ, আর তারপরেই… দরজার খোলা বন্ধ হওয়ার ঠুকঠুক শব্দ, একেবারে সেই সন্ধ্যার দরজার মতো।

কিন্তু শুভম তো জানে, ওই ঘরের চাবি কারও কাছে নেই।

সে উঠে দাঁড়ায়। ল্যাম্প হাতে নিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ায়। মেঝেতে একরাশ ছায়া যেন তার পায়ের কাছে গড়িয়ে পড়ে। সে সিঁড়ি বেয়ে ওঠে, প্রতিটি ধাপে কড়কড় শব্দ। দ্বিতীয় তলার করিডোর অন্ধকার। ঘরের দরজাটা আধখোলা। শুভম ধাক্কা দিয়ে খোলে, আর দেখে…

একটা খাট। তার ওপরে একটা পেতলের আয়না। আয়নার সামনে বসে আছে একটি মেয়ে। লাল পাড়ের সাদা শাড়ি, মাথায় বিনুনী। সে চুল আঁচড়াচ্ছে। কিন্তু আয়নায় তার মুখ নেই।

শুভম চিৎকার করে উঠতে যাবে—ঠিক তখনই মেয়েটি ধীরে ধীরে পিছন ফিরতে থাকে।

তার মুখে কোনোরকম অভিব্যক্তি নেই, কিন্তু চোখে এমন এক চাহনি—যা কারও নয়। চোখদুটো যেন কুয়াশায় ঢাকা, অথচ স্পষ্ট। মেয়েটি ফিসফিস করে বলে,
“তোমার লেখা আমি পড়েছি। কিন্তু তুমিও কি আমার গল্প জানো?”

আলো নিভে যায়।

পর্ব : আয়নার ভিতর দিয়ে

শুভমের গলা শুকিয়ে গেছে। সামনে বসে থাকা মেয়েটি এখনও তাকিয়ে আছে তার দিকে—চোখে অদ্ভুত শীতলতা, কিন্তু ভয় নয়। যেন অনেক কিছু বলার আছে, কিন্তু সময় নেই। হঠাৎ বাইরের বৃষ্টির শব্দে মুহূর্তে ভেঙে যায় সেই নিস্তব্ধতা। সে blink করে, আর চোখ ফেরাতেই দেখে, ঘরটা খালি। আয়নার সামনে শুধু একটা পুরনো চিরুনির হাড়ি পড়ে আছে, আর জানলার পর্দা ধীরে ধীরে দুলছে।

“ভুল দেখেছি?” নিজের মনেই ফিসফিস করে শুভম। কিন্তু তার হাত ঘেমে উঠেছে, বুকের ভেতরে ধুকপুক শব্দ এখন এতটাই জোরে বাজছে যে মনে হচ্ছে কেউ বাইরেও শুনে ফেলবে।

সে নিচে নেমে আসে। ঘরের দরজাটা লক করে দেয়। জানে, ভৌতিক গল্পে যা বলা হয়—এমন কিছু দেখলে নিজের অবস্থান শক্ত করতে হয়, আলো জ্বালাতে হয়, ঘরের চাবি নিজে রাখে, আর দরজা বন্ধ করে রাখতে হয়। কিন্তু এই সব তো গল্পে হয়… বাস্তবে কি?

সে চৌকিতে বসে পোর্ট্রেটটা আবার খোলে। বিমলাবালার মুখটা যেন একটু অন্যরকম লাগছে। সেই চোখের দৃষ্টি, যেটা আগে শুধু ছবি বলে মনে হচ্ছিল, এখন অনেক বেশি জীবন্ত। মনে হচ্ছে, সে কিছু চাইছে—একটা গল্প বলতে চাইছে, অথবা… সতর্ক করছে।

শুভম আবার নিজের থিসিসের খাতা খোলে। তাঁর বিষয়: ‘ব্রিটিশ ভারতীয় নারীদের শিক্ষা ও জমিদার বংশের নারীর আত্মপরিচয়: বিমলাবালার জীবন ও মৃত্যু’। গল্প আছে, বিমলাবালা ছিলেন বিদ্যোৎসাহী। ব্রাহ্ম মতাদর্শে বিশ্বাসী, কিন্তু তাঁর পরিবার ছিল রক্ষণশীল। তাঁর শিক্ষক নীলরতন বাবু ওনার জন্য একটি গৃহপাঠশালার ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই তাঁর মৃত্যু হয়—বাড়ির শয়নকক্ষে। কেউ বলে আত্মহত্যা, কেউ বলে—বিমলা নাকি কিছু দেখে ফেলেছিলেন, যা তাঁর দেখা উচিত ছিল না।

থিসিসে এগুলো পুরনো রেফারেন্স থেকে পাওয়া। কিন্তু বাস্তবে চৌধুরীবাড়িতে এসে সে যা দেখছে, তা যেন এসব গল্পের বাইরেও কিছু।

রাত গভীর হতে থাকে। বাইরে বৃষ্টি থেমে গেছে, কিন্তু জানলার কাঁচে অদ্ভুত ভাবে জমে উঠছে জল। শুভম এগিয়ে গিয়ে দেখে—জল নয়, যেন কোনো চুপচাপ হাত দিয়ে সেই কাঁচে লেখা হচ্ছে।

আমার ঘরটা খুঁজে পাবে?”

তিনটি শব্দ—হালকা, কুয়াশা দিয়ে আঁকা। কিন্তু স্পষ্ট।

“তুমি কে?” শুভম জিজ্ঞেস করে।

জানলা থেকে কোনো উত্তর আসে না। শুধু কাঁচটা কেঁপে ওঠে হালকা শব্দে। তারপর নিচে পড়ে যায় একটা পুরনো চাবি—মেঝেতে ধাতব আওয়াজে।

শুভম কাঁপা হাতে চাবিটা তুলে নেয়। চাবির সঙ্গে বাঁধা একটা কাগজ, ইংরেজিতে লেখা—“Bimalabala’s Trunk – Back Room Closet”

সে জানে, এই বাড়ির পেছনের ঘরটা আজও কেউ খোলেনি। তালা লাগানো। বহু পুরনো কাঠের সিঁড়ি বেয়ে সে আবার পেছনের দিকে যায়। দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। ভেতর থেকে হালকা একটা গন্ধ ভেসে আসছে—পুরনো লাল শাড়ি আর সজনে ফুলের মতো একটা হালকা, ধরা যায় না এমন গন্ধ।

চাবি ঘুরিয়ে দরজা খোলার সময় যেন শব্দটা একটু বেশিই জোরে বাজে। শুভম ধাক্কা দিয়ে দরজাটা খুলতেই কেমন একটা ঠান্ডা ধাক্কা লাগে গায়ে। ঘরটা পুরোপুরি অন্ধকার, শুধু ল্যাম্পের আলোয় যা দেখা যায়। একপাশে কাঠের একটা ট্রাঙ্ক, পাথরের মেঝেতে বসে। দেয়ালে মাকড়সার জাল, বাতাসে ওড়ে পোকাদের ডানা।

শুভম ধীরে ধীরে ট্রাঙ্কটা খুলে দেখে—ভেতরে কাপড়, বই, কিছু রৌপ্য গয়না, আর একগুচ্ছ চিঠি। হলুদ হয়ে যাওয়া, ধুলোমলিন, কিন্তু অক্ষর এখনও স্পষ্ট। একেকটা চিঠি নীলরতনের লেখা—‘প্রিয় বিমলা’, ‘তোমার চোখে আজ যেন রোদ উঠেছে’, ‘তুমি যে আলো বাঁচিয়ে রাখো আমার ভেতরে’—এইসব প্রেমে ভেজা শব্দ।

শুভম চমকে ওঠে। সে জানত, নীলরতন ছিলেন ওনার শিক্ষক। কিন্তু এরা তো প্রেমে পড়েছিলেন! এই কথা ইতিহাসের কোথাও নেই। কোনো গবেষণাপত্রে উঠে আসেনি।

হঠাৎ পেছন থেকে একটা ছায়া এসে দাঁড়ায়।

“তুমি ওদের কথা জানো না,” কণ্ঠস্বরটা আবার সেই একই—মেয়েলি, নরম, অথচ শিরায় ঠাণ্ডা জল বইয়ে দেয়।

শুভম ঘুরে দাঁড়ায়। এবার স্পষ্ট দেখা যায় তাকে—বিমলাবালা।

সে ঠিক একফুট দূরে দাঁড়িয়ে। এবার তার মুখ স্পষ্ট, চোখে জল। সে ধীরে ধীরে বলে,
“ওরা চায় না তুমি জানো, ওরা এখনও এখানে আছে।”

“কারা?” শুভম জিজ্ঞেস করে।

বিমলা ফিসফিস করে বলে, “তিনজন লোক, যারা আমাকে পুড়িয়েছিল, অথচ শহর জুড়ে ঘোষণা করেছিল আমি আত্মহত্যা করেছি। আমি লিখে গিয়েছিলাম সব, কিন্তু আমার কণ্ঠ বন্ধ করে দেওয়া হয়।”

“তাহলে তোমার আত্মা এখন…?” শুভম জিজ্ঞেস করতেই বাতাসের মধ্যে একটা ঠাণ্ডা কাঁপুনি উঠে আসে।

“তুমি যদি সত্যি জানতে চাও, তাহলে শেষ ঘরের আয়নাটা ভেঙো। ওটা শুধু মুখ দেখায় না—স্মৃতি ধরে রাখে।”

শুভম আর কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই, সে মিলিয়ে যায়। যেন হাওয়ার সঙ্গে মিশে যায়।

শুভম ট্রাঙ্কের চিঠিগুলো জিনিসপত্র গুছিয়ে ব্যাগে রাখে। এরপর সে সোজা গিয়ে দাঁড়ায় নিচের ঘরে সেই বিশাল আয়নার সামনে—যেখানে প্রথম বার বিমলাবালাকে দেখতে পেয়েছিল।

সে আয়নার উপর হাত রাখে। আয়নার কাঁচটা হঠাৎ ঠাণ্ডা হয়ে যায়। এক মুহূর্তে তার মনে হলো সে নিজের মুখ দেখছে না—দেখছে অন্য কারও, যিনি কাঁদছেন। পেছনে দাঁড়িয়ে আছে তিনটি অস্পষ্ট ছায়া—তারা সবাই পুরুষ, চোখে রাগ, মুখে হিংস্রতা।

হঠাৎ করেই আয়নার কাচে ফাটল ধরে। প্রথমে হালকা, তারপর বেড়ে যেতে থাকে। শুভম এক ধাক্কায় আয়নাটাকে মাটিতে ফেলে দেয়। কাঁচ ভেঙে যায়। ঝনঝন শব্দ হয়, আর সেই সঙ্গে এক চিৎকার—কোনো নারীর ভয়ঙ্কর, বেদনাময় আর্তনাদ—ঘরজুড়ে গুমরে ওঠে।

আলো নিভে যায়।

পর্ব : পাণ্ডুলিপির রক্তদাগ

ঘরজুড়ে আয়নার ভাঙা টুকরোগুলো ছড়িয়ে আছে। প্রত্যেকটি টুকরোয় প্রতিফলিত হচ্ছে একাধিক মুখ—শুভম একেকটা কাঁচের টুকরোতে একেকরকম ছায়ামূর্তি দেখতে পেল। কেউ হেসে উঠছে, কেউ কাঁদছে, কারও চোখ যেন শুধু তাকে গিলতে চাইছে। সে দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নেয়, বুকটা ধুকধুক করছে।
ভাঙা আয়নার নিচে একটা পাতলা কাঠের স্ল্যাব আলগা হয়ে আছে, যেটা আগে খেয়াল করেনি। শুভম এগিয়ে গিয়ে সেটা টেনে তোলে। নিচে একটা গহ্বরের মধ্যে পুরু কাগজে মোড়া একটা পাণ্ডুলিপি। ধুলোর গন্ধে ভরে ওঠে ঘর। পাণ্ডুলিপির বাঁধন নষ্ট হয়ে গেলেও তার ভেতরের কালি এখনও তাজা।

প্রথম পাতায় লেখা—আমার কণ্ঠ রুদ্ধ করে তারা ভাবল, সত্য গুম হয়ে যাবে। কিন্তু শব্দের চেয়ে বড় আত্মা কিছু নেই।
নিচে স্বাক্ষর—বিমলাবালা চৌধুরাণী

শুভমের হাত কেঁপে উঠল। সে জানত না, বিমলাবালা কোনোদিন নিজে লেখালিখি করতেন। এতদিন তাঁর পরিচয় কেবল একজন বিদ্যোৎসাহী নারীর, এক জমিদার কন্যার। কিন্তু এখানে রয়েছে এক সম্পূর্ণ অজানা অস্তিত্ব—এক প্রতিবাদী, অনুভবী, সাহসী আত্মা।

পাণ্ডুলিপির দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় বিমলা লিখেছেন—
যেদিন আমি প্রথম তাঁর প্রেমপত্র পাই, সেদিন থেকেই বুঝেছিলাম, আমার গল্প আর শুধুই আমার থাকবে না। ওরা আমাদের চিঠিগুলো ছিঁড়ে ফেলেছিল। কিন্তু আমি কপি করে রেখে দিয়েছিলাম, ওই পুরনো ট্রাঙ্কে। তারা জানত না, মেয়েরা শুধু ভালোবাসে না, লিখেও রাখে।

শুভমের মনে পড়ল, সে যে প্রেমপত্রগুলো পেয়েছিল, সেগুলো হয়তো মূল নয়—কপি। আর সেই প্রেম একদিন হয়ে উঠেছিল গোপন, বিদ্রোহী, বিপজ্জনক।

বাইরের আকাশ তখন গাঢ় হয়ে এসেছে। বাতাসে ভেসে আসছে শালপাতার ঘষাঘষি শব্দ। সে সিদ্ধান্ত নেয়, এই পাণ্ডুলিপি আগামীকাল সকালেই ডিজিটাল স্ক্যান করে ফেলবে। এত অমূল্য প্রমাণ ইতিহাসে খুব কমই পাওয়া যায়।

কিন্তু পাণ্ডুলিপির শেষে এসে সে থমকে যায়। কয়েকটি পৃষ্ঠা রক্তমাখা। রক্ত শুকিয়ে গাঢ় বাদামি হয়ে গেছে, কিন্তু শব্দগুলো স্পষ্ট।
ওরা তিনজনকাকাশ্বশুর, রমাকান্ত সেন, আর তৃতীয় জনযে ছিল সবচেয়ে নিকটজন, যার বিশ্বাস করেছিলাম। তাঁর নাম আমি এখানে লিখতে পারি না। কিন্তু যিনি আমার শিক্ষকও ছিলেন, তিনিই আমার মৃত্যুর দিন আমাকে ঘরে তালাবদ্ধ করে চলে যান। আমি ওদের গলায় মায়ের স্বর্ণহার দেখেছিলাম। ওরা চেয়েছিল আমি চুপ থাকি। না হলে মাকে পুড়িয়ে দেবে।

শুভমের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।
“তৃতীয় জন… নীলরতন?”

তার মাথায় যেন বাজ পড়ে। সে তো ভেবেছিল, নীলরতন ছিলেন বিমলার প্রেমিক, সহায়, রক্ষাকর্তা। তাহলে? এই পাণ্ডুলিপির কথাগুলো কি সত্য? নাকি বিমলা শেষ সময়ে বিভ্রান্ত ছিলেন? কিংবা, এটা কারও পরিকল্পিত জালিয়াতি?

ঠিক তখনই, ঘরের কোণে একটা আওয়াজ—টুপ করে যেন কিছু পড়ল। সে চোখ ফেরাল। পাণ্ডুলিপির নিচে একটা সোনালি রঙের পেনডেন্ট গড়িয়ে বেরিয়ে এসেছে। ছোট, কিন্তু ভারী। খুলে দেখে—ভেতরে দুই মুখের ছোট ছবি—বিমলা ও নীলরতন, পাশাপাশি।

শুভমের গলায় কাঁটা ফুটে ওঠে। “তবে কি ও তাঁকে ভালোবাসতেনই? এত বিশ্বাস করতেন যে প্রতারণায় ভেঙে পড়েছিলেন?”

বাইরে তখন হঠাৎ কুকুরের হুঁক হুঁক ডাকে বাতাস কেঁপে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির মেঝে যেন কাঁপে, দূরের একটা দরজা অকারণে নিজে থেকেই খোলে।

শুভম এগিয়ে গিয়ে দেখে—ওটা রান্নাঘরের দরজা। ভিতর থেকে ধোঁয়ার গন্ধ আসছে, যেন কিছু পোড়ানো হচ্ছে। সে দ্রুত ঢুকে দেখে—একটা পুরনো মাটির চুল্লিতে এখনো আগুন জ্বলছে, অথচ সে তো কখনো আলো দেয়নি। সেখানে রাখা একটা পিতলের হাঁড়িতে কী যেন সেদ্ধ হচ্ছে।

সে ঢাকনা তোলে—হাঁড়ির ভেতর কালি রঙা এক তরল, আর তার ওপর ভেসে আছে একফালি লাল পাড়ের কাপড়। সেই লাল পাড়ের সাদা শাড়ি! বিমলাবালার পোষাক? না কি…

তার পেছনে তখন আবার সেই কণ্ঠস্বর—
ওরা শবদেহটা সেদ্ধ করেছিল, যেন শনাক্ত করা না যায়। মাকে বাঁচাতে আমি চুপ ছিলাম। এখনো চুপ থাকব?”

শুভম ঘুরে দাঁড়ায়, কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না। শুধু চুল্লির আগুনের লেলিহান শিখা এক মুহূর্তে বেড়ে উঠে ছাদের কাছাকাছি পৌঁছে যায়, যেন আকাশ পর্যন্ত পৌঁছতে চায়।

সে পেছনে ফিরে বেরিয়ে আসে রান্নাঘর থেকে। আর পারছে না। ঘাম, গন্ধ, আতঙ্ক—সব মিলে মাথা ঘুরছে।

সে নিচের ঘরে ফিরে এসে বসে পড়ে। পাণ্ডুলিপি, চিঠি, সেই পেনডেন্ট—সব একসাথে ব্যাগে ঢোকায়। সে জানে, যতক্ষণ এসব তার কাছে আছে, ততক্ষণ সে চৌধুরীবাড়ি ছেড়ে যেতে পারবে না।

সে সিদ্ধান্ত নেয়, কাল ভোরবেলা উঠে সে সোজা যাবে কলকাতার বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রমাণগুলো জমা দেবে। সত্যিকারের ইতিহাস ফিরিয়ে আনবে।

কিন্তু তখনই এক টান। কার যেন একটা ঠাণ্ডা হাত তার ব্যাগের চামড়ায় ছুঁয়ে গেল। আর সেই সঙ্গে এক চিৎকার—
তুই ইতিহাসে নাম লেখাতে এসেছিস? কিন্তু আমি তো শেষ নামটা জানি নাআমাকে তো ভুলেই গিয়েছিল সবাই।

শুভম পেছনে তাকায়। একটা আয়নার খন্ডে—ভাঙা কাচের ছোট টুকরোয়—এক নতুন মুখ ফুটে উঠেছে। ততক্ষণে সে বুঝে গেছে, এই বাড়িতে শুধু বিমলা নয়, আরও কেউ আছে। কেউ, যে ছিল চতুর্থ… যার মুখ ইতিহাস কখনো দেখেনি।

পর্ব : চতুর্থ ছায়া

ভাঙা কাচের টুকরোটার প্রতিচ্ছবিতে যে মুখটা ফুটে উঠেছিল, সেটি পরিচিত ছিল না। চুলগুলো এলোমেলো, চোখ দুটি ফোলা—কিন্তু কেমন যেন আত্মার অতল থেকে উঠিয়ে আনা দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে শুভমের দিকে। মুখটা যেন দগ্ধ, অথচ চোখে ছিল শীতল ঘৃণা। কাচের রঙে, ঘরের হাল্কা আলোয় ছায়াটি ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল।

শুভম অনুভব করল, কেবল বিমলা নয়, আরও কেউ এই বাড়ির ইতিহাসে লুকিয়ে রয়েছে—আর সেই কেউ একজন বঞ্চিত, ত্যাগী, হয়তো প্রতিহিংসায় জ্বলতে থাকা আত্মা, যাকে কেউ কোনোদিন ডকুমেন্ট করেনি।

সে রাতে আর ঘুম এল না। সকালবেলায় পাখির ডাকেও সে চমকে উঠল। ঘড়ির কাঁটা আটকে ছিল রাত ৩টা ১৪ মিনিটে—বিগত চারঘণ্টা যেন কেবল ঘন হয়ে জমে আছে তার শরীরের ওপর।

সে বাইরে বেরিয়ে এল। সকালটা ছিল অস্পষ্ট রোদে ভেজা, পলিসজ্জিত। বাড়ির সামনের উঠোনে এসে দাঁড়াতেই পেছনে হঠাৎ একটি শব্দ—কাঠের মেঝেতে মৃদু চাপা পায়ের ছাপের মতো আওয়াজ। কেউ হেঁটে গেলো তার পেছনে, কিন্তু দেখা গেল না।

সে নিজেকে বোঝাতে লাগল—বাড়ি পুরনো, কাঠগুলো দেবে যাচ্ছে, বাতাসে জানলা কেঁপে ওঠে, এসব কিছুই অস্বাভাবিক নয়।
কিন্তু মনের ভেতর তার একটা ধোঁয়াটে স্তর জমে আছে—যেখানে প্রতিটি ঘটনার মধ্যে স্পষ্ট করে কোনো অদৃশ্য সূত্র জুড়ে দিচ্ছে সব কিছু।

সে বেরিয়ে গ্রাম পর্যন্ত যায়। এক বৃদ্ধ পানবিক্রেতার কাছ থেকে জল নেয়। কথার ফাঁকে সে জিজ্ঞেস করে—
“চৌধুরীবাড়িতে আগে কি চারজন থাকতেন শেষদিকে?”

বৃদ্ধ থমকে যায়। তারপর মিহি হেসে বলে, “চারজন? বাবু, সবাই জানে বিমলাবালা আর তাঁর কাকা ছিলেন শেষদিকের বাসিন্দা। তারপর বাড়ি বন্ধ। কেউই আর এল না।”

“নীলরতন সেন?”

বৃদ্ধ মাথা নাড়ে। “তিনি তো বাইরে থাকতেন। বছরশেষে দু-একদিন আসতেন।”

“আর তৃতীয় জন?”

বৃদ্ধের চোখে বিস্ময়—“তৃতীয় জন মানে?”

“একজন পুরুষ, অচেনা চেহারা, কিন্তু যাঁকে কেউ ইতিহাসে রাখেনি—যিনি হয়তো সব জানতেন। বিমলার লেখা পাণ্ডুলিপি বলছে এমন একজন ছিলেন।”

বৃদ্ধ চুপ করে যায়। তারপর ফিসফিস করে বলে—
“একবার ভেবেছিলাম আমি ভুল দেখেছি… কিন্তু ছোটবেলায় বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একজন লোককে দেখেছিলাম ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতে। কারও মুখ দেখা যাচ্ছিল না। হাতের ভঙ্গি ছিল এমন যেন ছুঁড়ে ফেলার চেষ্টা করছে কিছু… পরে শুনেছিলাম, সেই রাতে এক দাসীর গলায় দড়ি লেগেছিল। কে টেনেছিল, কেউ জানত না।”

শুভম গলায় গরম চা ঢাললেও ঠান্ডা ভাব কাটল না। এক অজানা আতঙ্ক তার শরীর ঘিরে ধরছে। সে ফিরল বাড়িতে, যেন চৌধুরীবাড়ির পাঁজরে ঢুকেই আবার সেই অন্ধকারের তলায় নেমে পড়ল।

তৃতীয় তলার ঘরগুলো সে আগেও ঘুরে দেখেনি। আজ সে উঠে যায়। ওপরের করিডোরে বাতাস ভারী, মেঝেতে ধুলো জমেছে এতটাই যে পদচিহ্ন পড়ে থাকে। ঘরের দরজাগুলো বন্ধ, কিন্তু একটি দরজা খোলা—যার পাশেই ঝুলছে ধুলোমাখা একটা পুরনো বেলনঘড়ি।

ঘরের ভেতরে শুধু একটা তক্তপোশ, আর দেয়ালে একটা সাদা কাপড়ের পেছনে কিছু লুকানো। শুভম কাপড় সরাতেই বেরিয়ে আসে একটি পোট্রেট—অদ্ভুতভাবে বিমলার মুখের সঙ্গে মিলে যায়, কিন্তু মুখখানা একটু বাঁকা, চোখের দৃষ্টি বেপরোয়া। নিচে লেখা: রাখি১৮৯৯

শুভম হতবাক। ‘রাখি’? এই নাম ইতিহাসে কোথাও নেই। পাণ্ডুলিপিতে, চিঠিতে, কারও স্মৃতিতে নয়। তাহলে এই মেয়ে কে?

ঘরের এক কোণে ধুলো মুছে সে দেখে একটা কাঠের বাক্স। খুলতেই তার চোখে পড়ে কিছু চিরকুট, লেখাগুলো এলোমেলো, যেন কারও রাগে বা যন্ত্রণায় লেখা—

  • “তুই যা পারিস কর, বিমলা, কিন্তু আমি জানি ও কাকে ভালোবাসে।”
  • “তোর মুখে শিক্ষার বুলি, কিন্তু মনের ভিতরে আগুন জ্বলে। আমি দেখেছি।”
  • “ওর চোখে আমি ছিলাম ছায়া। কিন্তু আমি ছায়া নই। আমি আগুন।”

শুভম বুঝতে পারে—‘রাখি’ ছিলেন এই বাড়ির এক অবহেলিত নারী, হয়তো দাসী, বা আত্মীয়, বা অন্য কেউ—যিনি বিমলাকে ঈর্ষা করতেন। হয়তো সেই ঈর্ষাই একদিন রূপ নেয় ঘৃণায়, প্রতিহিংসায়।

ঘরের বাতাস হঠাৎ ভারী হয়ে ওঠে। জানলার কাঁচে জমে ওঠে জলছাপ। আবার সেই অদৃশ্য হাত লিখতে শুরু করে—
তুই শুধু ওর কথা জানিস? আমার কথা লিখবি না?”

শুভম চমকে পিছিয়ে আসে। দেয়ালে কুয়াশার মতো জমে ওঠে এক নারীমূর্তি—যার চোখে পাথরের মতো কঠিন অভিমান।

সে ফিসফিস করে—
“আমার নাম কেউ জানে না। আমি মরেছি এই ঘরে, গলায় দড়ি দিয়ে। আমি তো জানতাম ওরা তিনজন ছিল না… ছিল চারজন। ওর শিক্ষক শুধু প্রেমিক ছিল না, বিচারকও ছিল। আমার দোষ শুধু ছিল—আমি ভালোবাসতাম। আর আমি দাসী।”

এক মুহূর্তে দেয়ালের ছায়া ছিঁড়ে এক চিৎকার ছড়িয়ে পড়ে ঘরজুড়ে। বাতাসে যেন কয়েকশো নারীর কান্না, একসাথে। কাচ ভেঙে পড়ে, মেঝে কেঁপে ওঠে।

শুভম বুকে পাণ্ডুলিপি চেপে বসে পড়ে, ভয়ে নয়—দায়বদ্ধতায়।

এই বাড়ির ইতিহাস শুধু জমিদার কন্যার নয়, প্রেমিক-শিক্ষকের নয়—এই বাড়ির ইতিহাস এক অশ্রুত নারীরও, যার কথা কেউ লেখেনি। যে ছিল ‘অতিথি’ নয়—একটা সময়ের চিৎকার।

পর্ব : নামহীনদের স্মৃতি

চৌধুরীবাড়ির তৃতীয় তলার সেই ঘরটা এখন যেন শুধুই একটা ফাঁকা কক্ষে সীমাবদ্ধ নয়—এ যেন স্মৃতি আর অভিমানের চাপে ভারাক্রান্ত এক আখ্যানকক্ষ, যেখানে বাতাসও নিঃশব্দ কান্না লুকিয়ে রাখে। রাখি নামটা এখন শুভমের মনে গেঁথে গেছে। এতকাল বিমলাবালাকে নিয়েই ইতিহাস খুঁড়েছে সে, কিন্তু এই মেয়েটি? যাকে কেউ কখনও লিখে রাখেনি, কোনো পাণ্ডুলিপি যার নাম রাখেনি—সেই কি সত্যিই ছিল না?

সে নিচে নেমে আসে। বাইরের আকাশ ধূসর, কুয়াশায় মোড়া। উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে শুভম লক্ষ করে—পুরনো পুকুরঘাটটা অদ্ভুতভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন জলও কিছু বলতে চাইছে।

সে এগিয়ে যায় পুকুরঘাটের দিকে। সিঁড়িগুলো ভাঙাচোরা, কিন্তু মাঝখানে জলে ভেসে আছে এক পুরনো কাঁসার গয়না, আধা-ডোবা। কেউ কি ফেলেছে? না কি সে অনেক আগেই হারিয়ে গেছে?

“এই গয়নাটা কার ছিল?” শুভম ফিসফিস করে।

হাওয়ার দোলায় একটা পাতাঝরা গাছের ডাল দুলে ওঠে।

সে আবার বাড়ির ভেতর যায়। ট্রাঙ্কের চিঠিগুলো, বিমলার লেখা, আর রাখির সেই দুর্বোধ্য লেখাগুলো সব মিলিয়ে একটি চার-মুখো প্যারালাল গল্প তৈরি হচ্ছে—যার মধ্যে প্রেম আছে, বিশ্বাসভঙ্গ আছে, এবং… মৃত্যু।

শুভম এবার পাণ্ডুলিপির শেষ পৃষ্ঠাগুলো খুঁটিয়ে পড়ে। বিমলা লিখেছেন—
আমি জানি, ওরা আমায় ঠকিয়েছে। কিন্তু যার উপর আমি ভরসা করেছিলাম, সে আমাকে ফেলে গিয়েছে। তবু, আমি কাউকে দোষ দিতে পারি না। এই বাড়িতে শুধু আমি একা নই, রাখিও বন্দী। সে আমায় ঘৃণা করত। কিন্তু সে ভালোবেসেছিল। আমাদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব ছিল, তা আর শুধু নারী দ্বন্দ্ব নয়তা হয়ে গেছে অস্তিত্বের লড়াই।

শুভম প্রথমবার বুঝতে পারে—এই বাড়ির ভেতরে ‘ভূত’ মানে শুধু অতীতের মৃত্যু নয়, মানে একান্তভাবে এমন কিছু যাদের কোনো নাম কেউ রাখেনি। যারা ছিলেন, কিন্তু ছিলেন না কারও ইতিহাসে।

তার ফোনে চার্জ নেই। সে রেকর্ড করতে পারছে না, ছবিও তুলতে পারছে না। অথচ এই মুহূর্তগুলোই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সে ব্যাগে রাখা কাগজে পেন দিয়ে লিখতে শুরু করে:
চৌধুরীবাড়ির রাখি: এক অদৃশ্য চরিত্রের উপস্থিতি এবং তার প্রতিফলন বিমলাবালার ইতিহাসে

ঠিক তখনই পেছনে একটা ঠাণ্ডা শ্বাসের শব্দ।
“তুই আমাকে লেখার চেষ্টা করছিস?”

শুভম ঘুরে দাঁড়ায়। সেখানে কেউ নেই, কিন্তু বাতাস ভারী, অদ্ভুতভাবে ঠাণ্ডা।

সে বলে, “হ্যাঁ। আমি তো চাই সবাই জানুক তুমি কে ছিলে।”

তৎক্ষণাৎ একটা জানলা কাঁপে, আর ঘরের এক কোণ থেকে ছিটকে পড়ে একটা ছোট কাঠের বাক্স। শুভম সেটা খুলে দেখে, ভেতরে একরাশ পুরনো পুঁথিপত্র, যেখানে এক নারীর হাতের লেখা—তবে বিমলার নয়।

লেখা:
আমার নাম রাখি। আমি জন্মেছিলাম এই বাড়ির বাইরের ঘরে। আমার মা ছিলেন দাসী, আর আমি ছিলামঅর্ধেকমানুষনা প্রজা, না গৃহিণী। কিন্তু আমি ভালোবেসেছিলাম। আমার চোখে বিমলা ছিল আভিজাত্যের প্রতিমা। কিন্তু আমার হৃদয়ে ছিল ভয়সে সব কেড়ে নেবে। আমি নিজের ভালোবাসার জন্য যুদ্ধ করেছিলাম। হয়তো ভুলভাবে।

শুভমের গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। এই বাক্সটা যদি আজ না পড়ত, কেউ জানতই না রাখি সত্যিই ছিল।

এতক্ষণে সে বুঝতে পারে, তিনজন পুরুষের বিচার নয়—এই বাড়িতে চারজন নারীর আত্মা লুকিয়ে আছে: বিমলাবালা, তাঁর মা, রাখি, আর অচেনা এক নীরব দাসী—যিনি রাখির মা ছিলেন। এবং প্রতিটি মৃত্যুর পেছনে আছে অসমাপ্ত ইতিহাস, গোপন রাখা যন্ত্রণার স্তূপ।

শুভম সিদ্ধান্ত নেয়—সে এই বাড়ি ছাড়বে না যতক্ষণ না সমস্ত সত্যি সামনে আনা যায়।

সন্ধ্যা নামে। বাড়ির ছাদ থেকে দেখা যায় দূরের পাখিদের নীড়ে ফেরা। শুভম জানে, আজ রাতে কিছু ঘটবেই।

সে আবার ফিরে আসে সেই আয়না ভাঙা ঘরে। এবার সে টেবিলের ওপরে কাঁচের টুকরোগুলো গুছিয়ে একটি বৃত্ত তৈরি করে। মাঝখানে রাখে সেই গয়না, সেই চিঠি, আর রাখির নাম লেখা সেই নোট।

সে চোখ বন্ধ করে বলে—
“তোমরা যদি সত্যিই এখানে থাকো, যদি কেউ আমার শব্দগুলো শোনো, তবে এবার কথা বলো। এবার তোমাদের গল্প আমায় দাও। আমি লিখে রাখব।”

এক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা।

তারপর ঘরের দরজাগুলো একসাথে কাঁপতে শুরু করে। বাতাসে উড়তে থাকে কাগজের পাতাগুলো, জানলার পর্দা নিজে থেকেই উড়ে গিয়ে দেয়ালে আটকে যায়। বাতাসের চাপায় পেনডেন্টটা গড়িয়ে পড়ে এক কাঁচের টুকরোর ওপর, আর সাথে সাথে তার মুখে যেন ধরা পড়ে এক প্রতিচ্ছবি—রাখির।

সে বলছে—
“তুই সত্যি লিখবি?”

“হ্যাঁ,” শুভম বলে।

“তাহলে প্রথম বাক্যটা এই রাখ—
যাদের কেউ মনে রাখে না, তাদেরও গল্প থাকে।

পর্ব : যাদের কেউ মনে রাখে না

রাখির সেই উচ্চারণ — “যাদের কেউ মনে রাখে না, তাদেরও গল্প থাকে”—শুভমের কানে যেন ঘণ্টার মতো বেজে ওঠে। এমন একটি বাক্য যা ইতিহাসের আড়ালে থাকা প্রতিটি নারীর আর্তনাদ। সে জানে, এখন তার কাজ শুধু একজন গবেষকের নয়—সে হয়ে উঠেছে এক সাক্ষ্যদাতা, যাকে এই চৌধুরীবাড়ির অন্ধকার নিজ হাতে ইতিহাস লিখিয়ে নিতে চাইছে।

রাত তখন নিঃশব্দ। ঘরের বাতি নিভে গেছে আবার। কেবল সোলার ল্যাম্পের হলদে আলোয় দেয়ালে ছায়ারা নড়াচড়া করছে। ছায়াগুলো কি বাতাসের খেলা, নাকি কিছু আরও গভীর?

শুভম আবার পাণ্ডুলিপির দিকে ফিরে যায়। রাখির লেখা পাতাগুলো একত্র করে সে খেয়াল করে, তাতে শুধু আক্ষেপ আর ভালোবাসা নয়, কিছু সংকেতও আছে—চৌধুরীবাড়ির ভেতরে আরেকটি ঘরের অস্তিত্বের, যেটা বাইরের কোনো মানচিত্রে চিহ্নিত নয়।

একটি জায়গায় লেখা আছে—
বাড়ির পেছনের গোলঘরটায় আমি ওর নাম লিখে রেখেছিলাম। বিমলা সব কিছু জানার আগে সেটা মুছে ফেলেছিল। আমি ওকে অভিশাপ দিয়েছিলামযদি আমার ভালোবাসা কোনোদিন সম্মান না পায়, তবে বাড়ির কেউই শান্তি পাবে না।

গোলঘর?

শুভম তো সে ঘরটায় কখনো যায়নি। বাড়ির পশ্চিম দিকের ঝোপঝাড়ের পেছনে ধ্বংসস্তূপের মতো কিছু একটা দেখেছিল ঠিকই, কিন্তু ওটা ঘর, সেটা বুঝতে পারেনি।

ল্যাম্প হাতে নিয়ে সে বাড়ির পেছনে যায়। ঘাস গলা অব্দি লেগে আছে, পায়ের নিচে কাঁটা, মাটির গন্ধে ভিজে গিয়েছে প্যান্ট। ধীরে ধীরে ঘন ঝোপ ঠেলে সে একটা গোলাকার পোড়ো ইটের ঘরের মুখে এসে দাঁড়ায়।

দরজা নেই। তার বদলে একটা ঢালু ইটের পথ নিচের দিকে নেমে গেছে। ভিতরে যেন অন্ধকারের মুখ। দেয়ালে জং ধরা লোহার হুক, আর পাশে একটা ছোট জানালা, যার কাঁচ ভাঙা।

ভেতরে ঢুকতেই একটা গুমোট গন্ধ তার নাকে আসে—পচা কাঠ, বদ্ধ বাতাস, আর যেন… পুরনো কাগজের গন্ধ।

মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিছু পোড়ানো পাতার ছাই, মাঝখানে একটা আয়তকার পাথরের ফলক। শুভম হাত বুলিয়ে দেখে—ফলকে নাম খোদাই করা:

রাখি | মৃত: অজানা | লাশ অদৃশ্য | স্মৃতি: এই ঘর

একটা দম বন্ধ হয়ে আসে শুভমের। এটা কি কোনো অনানুষ্ঠানিক কবর? কারা বানিয়েছে এটা? এমনকি যে পরিবার রাখির অস্তিত্বকেই অস্বীকার করেছে, তারাই কেন এখানে ফলক বসাবে?

ঠিক তখনই ঘরের দেয়ালে এক টোকা-টোকা শব্দ হয়। দেয়ালের একটা অংশে কাদা জমে আছে, আর তার ওপর আঙুল দিয়ে আঁকা কয়েকটা দাগ। শুভম ধীরে ধীরে বুঝতে পারে—ওগুলো শব্দ নয়, কিছু আঁকা হয়েছে।

একটি রূপরেখা—একজন নারী দাঁড়িয়ে, তাঁর মুখ ঝুঁকে আছে, আর সামনে দাঁড়িয়ে তিনজন পুরুষ। হাতে শিকল, মুখে অন্ধকার।

এই ঘরেই কী সেই রাতের ঘটনা ঘটেছিল?

বাইরের হাওয়া যেন এক নিমেষে ভারী হয়ে ওঠে। গোলঘরের ভেতর আলো নিভে যায়।

একটি কণ্ঠস্বর আবার ভেসে আসে—

“আমি মরিনি, শুভম। আমি শুধু আর মুখ দেখাতে পারিনি। আমাকে ভুলে যেতে বলেছিল তারা। কিন্তু আমি শুধু ভালবেসেছিলাম। আমার পাপ ছিল কি?”

শুভম এবার ভয় পায় না। সে স্থির গলায় বলে—“না। ভালোবাসা পাপ নয়। কিন্তু সত্য গোপন করা পাপ। আমি তোমার গল্প লিখব। তোমাকে আর অদৃশ্য রাখব না।”

ঘরের মাঝখানে হঠাৎ যেন বাতাস ঘুরতে শুরু করে, ছাই উড়তে থাকে চক্রাকারে। সেই ঘূর্ণির মাঝে শুভম দেখে—রাখির মুখ, বিমলার মুখ, আর… এক তৃতীয় ছায়া, যার মুখ নেই, কিন্তু শরীরের ভঙ্গিমা বলে—সে ছিল নিয়ন্ত্রক, বিচারক, বিশ্বাসঘাতক।

নীলরতন?

শুভম দৌড়ে বাড়ির ভেতরে ফিরে আসে। সে খুঁজে পায় পুরনো এক নথিপত্রের থলি—যেখানে জমিদার পরিবারের আইনজীবীর সঙ্গে কিছু চিঠি বিনিময় আছে। সে পাতাগুলো পড়তে থাকে, আর চোখে পড়ে একটি চিঠি, যেখানে লেখা—

রাখিকে দূরে পাঠানো হয়েছে। ওর উপস্থিতি চৌধুরীবাড়ির মর্যাদা লঙ্ঘন করছে। বিমলাবালার সাথে ওর দ্বন্দ্ব বাড়ছে। শিক্ষকের সম্মান রক্ষা করতে আমাদের এমনটা করতেই হলো।

নিচে সই—নীলরতন সেন।

শুভম থমকে যায়। তাহলে সত্যিই… যাঁকে এতকাল প্রেমিক বলে ভাবা হচ্ছিল, তিনিই কি আসলে এই সবকিছুর পেছনের মুখ?

চৌধুরীবাড়ির নীরব বাতাস যেন এবার উত্তরে জবাব দেয়—একটা দীর্ঘ শ্বাস, যেন কোনো দীর্ঘ ক্লান্ত আত্মা মাটি থেকে উঠে এসে বলছে—“তোর কলমে যদি রক্ত থাকে, তবে আমাকে লিখে রাখ।”

শুভম পাণ্ডুলিপির এক নতুন খাতা খুলে বসে, তার প্রথম লাইনে লেখে—

চৌধুরীবাড়ির শেষ অতিথি এক আত্মা নয়একাধিক নারীর নিঃশব্দ প্রতিবাদ। যারা বেঁচে ছিল, মরে গেছে, আবার বেঁচে উঠছে, যতদিন না কেউ সত্যি কথা লেখে।

পর্ব : দাহনমঞ্চের চাবি

চৌধুরীবাড়ির দরজার ওপর দিয়ে যে রোদের রেখা ঢুকেছে, তা যেন আর সাধারণ ভোরের আলো নয়—তা যেন মৃতদের চোখ ফুঁড়ে বেরোনো শেষ সত্যের দীপ্তি। শুভম মাটিতে বসে আছে, সামনে খোলা খাতা, পাশে রক্তবর্ণ পেন্ডেন্ট, আর হাতে আঁকা সেই পোট্রেট যা এতদিন গোপনে ছিল কোনো অন্ধ কোণে।

রাতভর না ঘুমিয়ে সে একটানা লিখেছে। বিমলা, রাখি, আর তাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা সেই তৃতীয় মুখ—নীলরতনের নাম এখন আর গৌরবের নয়, এক অন্ধকার অভিজ্ঞান। সে এখন জানে, কেউই নির্দোষ ছিল না। সবাই কিছু লুকিয়েছে, সবাই কিছু হারিয়েছে।

কিন্তু এখনও সব লেখা হয়নি।

গোলঘর থেকে ফিরে আসার সময় সে খেয়াল করেছিল, পুকুরঘাটের পাশে একটি ভাঙা চৌকাঠের নিচে কিছুর ঝিলিক দেখা যাচ্ছিল। সকালে সে সেখানে ফিরে গিয়ে খুঁজে পায় একটি লোহার ছোট তালাবন্ধ বাক্স। অনেক চেষ্টা করে সেটা খোলার উপায় পায় না। কিন্তু তার মনে পড়ে—বিমলাবালার প্রথম যে ছবিটি সে পেয়েছিল, তার পেছনে বাঁধানো কাঠের গায়ে ছিল এক হালকা গর্ত। সে আবার সেই ছবিটার দিকে ফিরে যায়।

ছবির কাঠ ফালি করে খুলতেই, ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে একটা ছোট ধাতব চাবি—জংধরা, কিন্তু টিকিয়ে রাখা। চাবিটা যখন তালায় প্রবেশ করে, তখন একটা হালকা ক্লিক শব্দ হয়—যেন একটা দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান।

বাক্সের ভিতরে কিছু পাণ্ডুলিপির টুকরো, পুড়ে যাওয়া ছবি, আর একটি লাল কাপড়ে মোড়ানো কাঠের টুকরো। কাপড় খুলতেই বেরিয়ে আসে একটি ছাপা চিহ্ন—ত্রিশূলের মতো, কিন্তু এর মাথায় তিনটি চোখ আঁকা। নিচে লেখা—

দাহনমঞ্চ। যেখানে সব মিথ্যে পুড়েছিল, আর সত্যকে ছাই করে রাখা হয়েছিল।

শুভম থমকে যায়। দাহনমঞ্চ? সে তো জানত, চৌধুরীদের পারিবারিক চিতাস্থল ছিল দক্ষিণ পাশে শ্মশানঘাটে, গঙ্গার ধারে। কিন্তু এই শব্দটা বলছে কিছু আরও গভীর। সে আবার খোঁজ করতে থাকে।

পুরনো নথিপত্রে একটা মানচিত্রে চৌধুরীবাড়ির পুরো এলাকা আঁকা ছিল—এক কোণায় অদ্ভুতভাবে আঁকা একটি ঘূর্ণি চিহ্ন। নিচে লেখা—“অন্তঃস্থল, কেবল যারা দৃষ্টি রাখে হৃদয়ে।”

এটা কি ধাঁধা? না কি কোনো চোরাগোপ্তা ঘরের সংকেত?

সে মানচিত্রের ফটো তুলে নেয়, আর বেলা গড়ালে হাঁটতে শুরু করে দক্ষিণ দিকে, শ্মশান পেরিয়ে। আধা কিলোমিটার মতো চলার পর একটি পরিত্যক্ত ঝোপের ভিতর সে দেখতে পায় একটা পাথরের চৌবাচ্চা—মাটির সমান্তরাল, যার চারপাশে আগাছা, আর মাঝখানে একটি পোড়ানো চুল্লির মতো গহ্বর। পাশে একখণ্ড কালো পাথরে ক্ষয় হয়ে লেখা—জীবনান্তে, যাকে সবাই ভুলে যায়।

তার গায়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যায়।

সে ঘেঁষে বসে। গহ্বরের পাশে কিছু পুরনো কাঠ, পোড়া রঙ, আর কিছু ছাইয়ের স্তূপ। তার হাতে থাকা কাঠের ত্রিশূল প্রতীক চেপে ধরে। গহ্বরের মুখে সেটি ধরতেই হঠাৎ ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে এক মৃদু আলোর রেখা—যেন তলায় কিছু আছে।

শুভম ঝুঁকে দেখে—গহ্বরের ভিতরে একটা ধাতব পেটিকায় ভরে আছে কিছু কাগজ। সে নামিয়ে আনে সেগুলো। খুলেই বুঝতে পারে—এগুলো চৌধুরীবাড়ির “অস্বীকৃত” কাগজপত্র। তাতে রয়েছে—

  • বিমলার মৃত্যুর সরকারি নথি, যেখানে উল্লেখ নেই রাখির কোনো নাম।
  • নীলরতনের চিঠি, যেখানে তিনি লিখছেন—রাখিকে মুছে ফেললেই সম্মান রক্ষা হবে।
  • জমিদার কাকার স্বীকারোক্তি—বিমলার চোখে আমরা ধরা পড়েছিলাম। কিন্তু কিছু বলবে না ভেবেছিলাম।

এই সবকিছু পড়ে শুভম স্তব্ধ হয়ে যায়। সে বুঝতে পারে, এই বাড়ির সবচেয়ে বড় অভিশাপ হলো—অস্বীকার। যাকে চাওয়া হয়নি, তাকে লেখা হয়নি। যাকে লেখা হয়নি, সে প্রতিশোধ চায়।

হঠাৎ ঘূর্ণি হাওয়ার মতো কিছু একটা তার চারপাশে জড়ায়। কুয়াশার মতো, অথচ ঘামে ভেজা। গলার কাছ দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে যায়, যেন কেউ ফিসফিস করে বলছে—

তুই কি জানিস, শেষ অতিথি কে?”

শুভম জিজ্ঞেস করে, “কে?”
আওয়াজ আসে—
তুই।

এক মুহূর্তে চারপাশ থেকে ছায়া উঠে আসে—বিমলার, রাখির, রাখির মায়ের, আর একটি শিশুর—হয়তো যার নাম কোনোদিন কেউ জানেনি। প্রত্যেকেই মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে, পেছনে আগুনের রেখা।

শুভম হাঁটু গেড়ে বসে বলে, “তোমরা যা বলতে চাও, আমি শুনব। আমি লিখব। কিন্তু আমায় সত্যটা দাও—এই বাড়ির শেষ সত্য।”

বিমলার ছায়া ফিরে তাকায়, বলে—
তুই যা লিখছিস, তা শুধু আমার নয়। তা ওরওরাখিরও। কিন্তু তুই জানিস না, আমি মরিনি আত্মহত্যা করে। আমি মরেছিলাম, যখন আমি ওকে বিশ্বাস করেছিলাম।

রাখির ছায়া ফিসফিস করে বলে,
আমিও মরিনি শুধুই ভালোবাসায়। আমি মরেছিলাম যখন আমাকে অস্বীকার করা হয়েছিল।

বাতাস ভারী হয়ে যায়। সেই দাহনমঞ্চ এখন যেন একটা জীবন্ত স্মৃতিফলক।

শুভম জানে, তার কাজ শেষ হয়নি। তার কলম চালু আছে। কিন্তু এই বাড়ির ইতিহাস লিখে শেষ করা যাবে না যতক্ষণ না কেউ স্বীকার করে—তাদের মৃত্যু কোনো দুর্ঘটনা ছিল না, ছিল পরিকল্পিত চুপ করিয়ে দেওয়া।

পর্ব : আত্মাদের আলেখ্য

শুভম বসে আছে দাহনমঞ্চের পাশে, তার সামনে ছড়িয়ে রয়েছে সেই নথিপত্র—যা কোনো ইতিহাসের পাতায় ছিল না, কিন্তু এই বাড়ির প্রতিটি দরজার কড়ায় কড়ায় লুকিয়ে ছিল। পাণ্ডুলিপিগুলোর গায়ে ছাই লেগে আছে, কিছু লেখায় আগুনের কালচে ছাপ। তার মনে হয়, এই মুহূর্তে সে নিজে কেবল একজন গবেষক নয়, সে যেন হয়ে উঠেছে সেই মাধ্যম, যার শরীর দিয়ে এক শতাব্দীর পাপ, প্রেম, অভিশাপ আর অস্বীকার লেখা হয়ে উঠছে।

তখনই আকাশে এক বজ্রধ্বনি—গম্ভীর, ভারী, যেন কোনো ঘুমন্ত ঈশ্বর জেগে উঠছে।

পেছনে দাঁড়িয়ে আছে চারটি ছায়া। বিমলা, রাখি, রাখির মা, এবং সেই শিশুটি—কোনো নামহীন আত্মা। তারা সবাই দেখছে শুভমের দিকে, কিন্তু মুখে কোনো কথা নেই। কেবল চোখে জমে আছে বহু জন্মের অভিমান, বহু অস্বীকৃতির দাহ।

শুভম ধীরে ধীরে বলে—
“আমি লিখছি। কিন্তু তবুও বুঝে উঠতে পারছি না—কে ছিল মূল ঘাতক? শুধু নীলরতন? কাকা? রাখি? নাকি সময় নিজেই?”

বিমলা বলে, “সময় ঘাতক নয়, সময় সাক্ষী। ঘাতক তারা, যারা সত্য জানত, কিন্তু চুপ করে থাকত। যারা ভালোবাসা দিয়ে প্রতারণা করত। যারা মুখে বলত শিক্ষার কথা, অথচ মেয়েদের কণ্ঠ চেপে রাখত।”

রাখি বলে, “আমিও দোষী, আমি ঈর্ষাকাতর হয়েছিলাম। আমি চাইনি ওর মৃত্যু। কিন্তু আমি চাইতাম কেউ একদিন বলুক—আমিও ছিলাম।”

শুভম মাথা নিচু করে বলে, “আজ বলছি। আজ লিখছি। তোমাদের প্রতিটি নাম থাকবে, প্রতিটি কান্না, প্রতিটি লেখা। আমি এই বাড়িকে একটি জীবন্ত পাঠশালা করে তুলব—যেখানে ভুল ইতিহাস নয়, সত্য বাঁচবে।”

ছোট শিশুটি, যাকে কেউ কোনোদিন ডেকেওনি, বলে ফেলে—
“তুমি পারবে?”

তখনই, দাহনমঞ্চের তলায় থেকে উঠতে থাকে এক তীব্র আলো, যেন মাটির নিচে লুকিয়ে আছে একটা শক্তি, যা বহু বছর পর আজ মুক্তি চাইছে।

আলোয় সমস্ত ছায়ারা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে ওঠে—তাদের মুখে প্রশান্তি, কিন্তু চোখে জল।

আচমকা শুভমের হাতে থাকা পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠা বাতাসে উড়তে শুরু করে। তারা চারদিকে ঘুরে বাড়ির মাথার উপর দিয়ে উড়তে উড়তে ফিরে আসে চৌধুরীবাড়ির ভেতর। প্রতিটি ঘরের জানলা খুলে যায়, দরজাগুলো দুলে ওঠে, আর প্রতিটি ঘরে বইতে থাকে বাতাস—স্মৃতির বাতাস।

শুভম পেছনে তাকায়—চৌধুরীবাড়ির ছাদে আজ প্রথমবার, এক শতাব্দী পর, ওড়ছে একটি লাল পাড়ের সাদা শাড়ি। সে জানে, এই ওড়নার ওড়ানো কোনো বাতাস নয়—এ এক সম্মতির চিহ্ন।

সে ফিরে আসে বাড়ির ভিতরে। সব কাগজ গুছিয়ে নিয়ে সে স্থির সিদ্ধান্ত নেয়, আগামীকাল সকালেই এগুলো নিয়ে যাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার থিসিস হবে শুধু বিমলার উপর নয়—চৌধুরীবাড়ির নারীরা: এক আত্মাহীন ইতিহাসের খণ্ডচিত্র।

রাত গভীর হয়।

সেই আয়নার ঘরে আবার সে ফিরে যায়। আয়নাটা ভাঙা, কিন্তু তার ফ্রেম এখনও টাঙানো। শুভম সেই ফ্রেমের মাঝে নিজের লেখা প্রথম পাতাটা গুঁজে দেয়।

এক হালকা আওয়াজ—কাঠের ফ্রেমের পেছন থেকে যেন একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হলো। ঘরের বাতাস থেমে যায়।

এক মুহূর্ত, দুটি মৃদু হাত পিছন থেকে তার কাঁধে স্পর্শ করে—কোনো আতঙ্ক নেই, কেবল তাপ। সে জানে, এ বিমলার।

“তুমি শেষ অতিথি,” বিমলা বলে, “তোমার কাজ শেষ নয়। তুমি শুধু আমাদের গল্প নয়, ভবিষ্যতের গল্পও লিখবে। যেন আর কোনো রাখিকে, কোনো বিমলাকে অস্বীকার না করা হয়।”

“তুমি কোথায় যাবে এখন?” শুভম জিজ্ঞেস করে।

“আমরা সবাই ফিরছি নিজের নিজের নামে। নাম ছাড়া আত্মা থাকে না, শুভম। তুমি নাম দিয়ে দিলে। এবার আমাদের যাওয়ার সময়।”

ঘর জুড়ে ধীরে ধীরে বাতাস থমকে আসে। দেওয়ালের ফাটল মেরামত না হলেও, তার গায়ে যেন রোদ পড়ে একটা উজ্জ্বল রেখা তৈরি হয়।

শুভম চোখ বন্ধ করে মাথা নিচু করে।

যখন সে চোখ তোলে, তখন আর কেউ নেই।

সকালে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের চতুর্থ তলায়, অধ্যাপক দীপ্তিমা ব্যানার্জি শুভমের পাণ্ডুলিপি হাতে নিয়ে চুপ করে বসে ছিলেন অনেকক্ষণ। তারপর বলেছিলেন—
“তুমি শুধু গবেষণা করোনি, তুমি সত্য উদ্ধার করেছ। এই কাজ এখন শুধু তোমার নয়, আমাদেরও।”

তিন মাস পর, চৌধুরীবাড়ির শেষ অতিথি নামে একটি গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়—বেস্টসেলার হয় না, পুরস্কারও পায় না। কিন্তু যারা পড়ে, তারা কাঁদে।

শুভম এরপর আর চৌধুরীবাড়িতে ফিরে যায়নি। কিন্তু একবার, বহুদিন পর, কোনো এক গ্রাম্য মেলায়, সে এক মেয়েকে দেখে—লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পরে, চোখে গভীর দৃষ্টি, হাতে একটি খাতা।

সে মেলামেশার ভিড়ে হারিয়ে যায়।
শুভম বুঝেছিল, কেউ লেখা হয়ে গেলে, সে আর মরে না।

শেষ

WhatsApp-Image-2025-07-10-at-11.07.06-AM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *