Bangla - প্রেমের গল্প

হিমঘরে রাখা হৃদয়

Spread the love

সঞ্জয় মিত্র


এক

বরফে মোড়া সেই পাহাড়ি শহরে ফেরার সময় অর্ণবের বুকের ভেতর একটা চাপা কষ্ট দানা বেঁধে উঠছিল, যেন প্রতিটি চাকা ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে তার হৃদয়ের জঞ্জালগুলো ফিরে আসছিল একে একে। ট্রেন ছাড়ার অনেক আগেই সে জানত—এই ফিরে আসাটা কেবল চাকরির ডাকে নয়, একটা অসমাপ্ত গল্পের মুখোমুখি হওয়া, যার শেষ পাতাটা সে ছিঁড়ে ফেলতে পারেনি। চার বছর আগে মীরা যেদিন এক ভয়াবহ তুষারধসে হারিয়ে গেল, সেইদিন থেকেই শহরটার রঙ তার চোখে ধূসর হয়ে গেছিল। এবার সে ফিরল—পাহাড়, কুয়াশা, আর মৃতপ্রায় স্মৃতির শহরে, সেই কেবিনটায়, যেখানে প্রতিটি জানালা একেকটা অলিখিত কবিতা হয়ে ঝুলে আছে, যেখানে প্রতিটি কাঠের দেওয়ালে মীরার গন্ধ আটকে আছে, আর প্রতিটি রাতে শোনা যায় অনুনয়ের নিঃশব্দ প্রতিধ্বনি। হিমবিজ্ঞানী অর্ণব এবার সরকারি বরফ গবেষণা কেন্দ্রের নতুন প্রকল্পের দায়িত্বে এসেছে, কিন্তু সে জানে এটা শুধুই অজুহাত। সত্যি বলতে—সে ফিরেছে, কারণ প্রতিদিন রাতে তার ঘুমের মধ্যে মীরা ফিরে আসে। কখনও জলভেজা কেশে তাকিয়ে থাকে দরজার ফাঁক দিয়ে, কখনও বলে, “তুমি কি এখনও আমার জন্য বরফ রাখো?” অর্ণবের চোখে হিমঘর মানেই এক সময়ের জমে যাওয়া আবেগ, আর এই শীতে সেই আবেগ আবার গলে উঠছে ধীরে ধীরে।

কেবিনে ঢুকে প্রথমেই সে জানালা খুলে দেয় — হালকা হিমেল হাওয়া ঢুকে পড়ে ভেতরে, কাঁপিয়ে দেয় প্রতিটি ইন্দ্রিয়। চারদিকে নীরবতা — যেন পুরো শহরটা জমে আছে, একটা দমবন্ধকরা নিস্তব্ধতা নিয়ে। সে ধীরে ধীরে ঘরের কোনায় রাখা সেই পুরনো কাঠের ট্রাঙ্কটা বের করে, যার মধ্যে মীরার আঁকা ছবিগুলো, একটা পুরনো স্কার্ফ, আর সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস — একটি লাল মলাটের ডায়েরি। ডায়েরিটা ছিল মীরার নিজের হাতে লেখা—যেটা এক সময় অর্ণব নিষিদ্ধ বলেই জেনেছিল। কিন্তু এখন যখন সে পাতাগুলো উল্টায়, তখন শব্দগুলো তার শরীর জুড়ে হিমশীতল কাঁপুনি বইয়ে দেয়—”তোমার চোখের ভেতর যে নিঃশব্দে বরফ নামে, আমি সেই বরফে মরে যেতে চাই।” শেষ পাতায় এসে সে থমকে যায়—মীরার লেখা, আঁকাবাঁকা হাতে, শেষবার, যেন তাড়াহুড়োয় লেখা — “আমি ফিরে আসব। হিমঘরের ভেতরেই থাকব। আমি তোমার অপেক্ষায়…”। অর্ণবের গলা শুকিয়ে আসে। এই হিমঘর — সরকারি গবেষণা কেন্দ্রের পরিত্যক্ত অংশ — যেটা এখন আর কেউ ব্যবহার করে না, সেটার ভেতরেই কি সে আছে? না কি এই তার একাকীত্বের ফল?

সন্ধ্যা গড়ালে শহরে নেমে আসে ঘন কুয়াশা। কেবিনের বাইরের বাতি হালকা হলুদ আলো ছড়ায় বরফের ওপরে, আর সেই আলোয় অর্ণব দেখতে পায় জানালার কাঁচে জমে আছে এক জোড়া ছাপ—যেন কারো আঙুল ছুঁয়ে গেছে সেখানটা। সে ঘেমে ওঠে। দরজার বাইরে পা রাখতেই হালকা পায়ের ছাপ — ঠিক যেন কেউ হেঁটে গেছে, বরফে রেখেছে তার অস্তিত্ব, কিন্তু এগুলো এসে শেষ হয়েছে জানালার নিচে। কোথাও যাওয়ার আর কোনও চিহ্ন নেই। সে সেই জানালার কাচে হাত রাখে, ঠান্ডায় তার আঙুল কেঁপে ওঠে। হঠাৎ কাচের ওপাশে দেখা দেয় একটি ছায়া — মুহূর্তেই মিলিয়ে যায়। তার মনে পড়ে — মীরা একবার বলেছিল, “যদি আমি মরে যাই, জানালার কাচে আমি আবার আসব। স্রেফ একটিবার ছুঁয়ে দেখো, আমি থাকব।” সেই মুহূর্তে অর্ণব বুঝতে পারে — এই শহরে সে একা নয়, আর তার ভালোবাসা হয়তো গলে যায়নি, বরং গভীর কোনো হিমঘরে, জমাট বাঁধা এক হৃদয়ের মতো এখনো বেঁচে আছে — আর অপেক্ষা করছে, ফিরে আসার জন্য।

দুই

সকালের আলো বরফে ছড়িয়ে পড়ে এক ধরণের সাদা নিঃসঙ্গতা নিয়ে, যেন প্রকৃতিও এখানে নিঃশব্দে শোক পালন করছে। কেবিনের ঘড়িতে সকাল সাতটা বাজলেও অর্ণবের মনে হয় যেন রাত এখনো পুরোপুরি কাটেনি। গতরাতের জানালার সেই হাতের ছাপ, ছায়ার উপস্থিতি—সব কিছুই যেন এখন বাস্তবতার চাইতে বেশি বাস্তব। সে নিজের ওপর রাগ করে, নিজেকে বারবার যুক্তির কাঠগড়ায় দাঁড় করায়, কিন্তু মনের গভীরে এক গোপন বিশ্বাস উঁকি দেয়—হয়তো মীরা সত্যিই ফিরেছে। কিংবা ফিরছে না, কিন্তু তার স্মৃতিগুলো এতটাই জীবন্ত যে, তুষার গলিয়ে সে ফিরে আসছে কল্পনার রূপ ধরে। সেই ভাবনার ঘোরে, হঠাৎই মনে পড়ে সেই কাঠের তলপেটে রাখা মীরার পুরনো বাক্সটার কথা, যেটা সে শেষবার খুলেছিল চার বছর আগে—যেদিন শেষ চিঠিটা পেয়েছিল। সে ধীরে ধীরে কেবিনের ঘরের কোণায় গিয়ে পুরনো কাঠের মেঝে সরিয়ে ফেলে। নিচে, জমে থাকা বরফ আর ধুলোর স্তরের ভেতর একটা লোহার বাক্স—বহুদিনের বন্ধ, যার ওপর আঁকা মীরার নিজের হাতে আঁকা লাল পদ্মফুলটা আজও ফ্যাকাশে হয়ে ঝুলছে।

চাবির খোঁজে দরজার ওপাশের তাক তোলার সময় হঠাৎ সে টের পায়, একটা বই মেঝেতে পড়েছে—এটা সেই ডায়েরি নয় যেটা গতকাল রাতে পড়েছিল, বরং আরও পুরনো কিছু। পাতাগুলো মলিন, কিন্তু হাতের লেখা স্পষ্ট—মীরার ছেলেবেলার দিনলিপি। সেখানে লেখা রয়েছে শৈশবের পাহাড়, স্নোফ্লেক ছোঁয়ার প্রথম অনুভব, প্রথম প্রেমের স্বপ্ন, আর অর্ণবকে প্রথম চিঠি লেখার কাঁচা ইচ্ছের কথা। পাতাগুলোর ফাঁকে একটি পাতলা চিরকুট পড়ে যায় — যেখানে লেখা, “যেদিন আমি হারিয়ে যাব, এই বাক্সে খোঁজো আমাকে। আমার হৃদয়কে রাখছি এখানে, বরফের নিচে, গোপনে।” বাক্স খুলতেই অর্ণব দেখে একগুচ্ছ পেইন্টিং—সবগুলোতে শুধু একজন মানুষ আঁকা—অর্ণব নিজেই। কিন্তু প্রতিটি ছবিতে অর্ণবের চোখ বন্ধ, মুখের পাশে বসে আছে এক ছায়ামূর্তি। একটিমাত্র ছবি বাদে, যেখানে অর্ণব মীরার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে—পেছনে তুষারঝড়। ছবির নিচে লেখা: “শেষ গল্পটা বাকি রেখেছি। যদি তুমি একদিন খুঁজতে আসো, যেন আমিও সেই পাতায় ফিরতে পারি।” অর্ণব হঠাৎ অনুভব করে যেন ঘরের তাপমাত্রা কিছুটা কমে গেছে, ঘাড়ের পেছনে হিম একটা বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে তাকে, অথচ সব জানালা বন্ধ।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়। অর্ণব এবার সিদ্ধান্ত নেয়, হিমঘরের দরজা সে নিজেই খুলে দেখবে—আর কিছু না হোক, নিজের মনকে শান্ত করবে। সরকারি দপ্তরে সেই হিমঘর বহুদিন ব্যবহার হয় না, পুরনো ফাইলপত্র অনুযায়ী সেটি এখন গবেষণার বাইরে রাখা, কোনো রক্ষণাবেক্ষণ নেই। তার কাছে থাকা মাস্টার-কার্ড দিয়ে সে দরজা খুলে ভিতরে ঢোকে। ঘরের ভেতর অন্ধকার, বাতাস ভারি, আর জায়গাটা আশ্চর্যভাবে শীতল, যেন বাইরে থেকে আরও ঠান্ডা। দেয়ালের পাশে একটি বড় ফ্রিজিং ইউনিট — যার ওপরে জমানো বরফের স্তর, এবং তার নিচে শুয়ে আছে একটি নামহীন, মোটা কম্বলে মোড়া মানব-আকৃতির কিছু। অর্ণব এগিয়ে যায়, কিন্তু তার পা আটকে যায় এক পুরনো লাল স্কার্ফে—ঠিক যেরকম মীরা পরত। হঠাৎই ইউনিটের ওপরের বরফ গলে গলে পড়ে জল, এবং ভেতর থেকে খুব ক্ষীণভাবে ভেসে আসে এক কণ্ঠ—জানা গলা, কিন্তু অপার্থিব, “তুমি তো বলেছিলে, আমি হারালে খুঁজে পাবে। দেখো, আমি এখানেই আছি।” ভয়, বিস্ময়, ভালোবাসা আর এক অদ্ভুত আর্তি মিশে যায় অর্ণবের চোখে-মুখে। সে জানে না এটা হ্যালুসিনেশন, হিমঘরের কোনো প্রতিধ্বনি, না সত্যিই সে সেই হৃদয়কে খুঁজে পেয়েছে—যাকে সে চার বছর ধরে বরফে খুঁজছিল।

তিন

রাত গভীর হতেই চারদিকের নিস্তব্ধতা অর্ণবের কানে কাঁটা হয়ে বিঁধতে থাকে। কাঠের কেবিনের ভেতর সোজা হয়ে বসে থাকা এই মানুষটা যেন বোবা হয়ে গেছে। কাঁপা হাতে সে জ্বালিয়ে রাখে কাঠের উনুনটা, কিন্তু ভেতরের শীত ততক্ষণে তার চামড়ার নিচে ঢুকে গেছে। দিনের আলোয় সে যেসব চিহ্ন, যেসব শব্দ, আর হিমঘরের সেই পুরনো ইউনিটের পাশে মীরার স্কার্ফ পেয়েছিল, সবকিছু মিলে মনের মধ্যে এক ভয়ংকর ছায়া তৈরি করেছে। অর্ণব জানে, এইসব যুক্তির বাইরের জগতে সে পা রেখে ফেলেছে, কিন্তু ফেরার পথ আর নেই। বাইরের বরফ আস্তে আস্তে জানালায় গা বুজিয়ে জমে যাচ্ছে, বাতাসের দাপট কমেছে, কিন্তু অর্ণবের মনে একটা অদ্ভুত শোরগোল—যেন কানে কেউ ফিসফিস করে বলছে, “ঘুমোতে যেও না, আমি আসছি…”। সে ডায়েরিটা আবার হাতে নেয়। আজ সন্ধেয় নতুনভাবে আবিষ্কৃত বাক্স থেকে পাওয়া আরেকটি পাতায় লেখা ছিল—“আমার চোখে দেখা প্রথম তুষারপাতের স্মৃতি যেন বরফে মিশে গেছে। তুমি যদি কোনোদিন জানালার বাইরে তাকাও, আমি সেখানেই থাকব।” অর্ণব জানে, সে আর স্রেফ পৃষ্ঠার শব্দ পড়ছে না—সে মীরার আত্মা পড়ছে।

কেবিনের একপাশে বড় একটা জানালা, যেটা পাহাড়ের দিকে মুখ করে। সেই জানালায় হালকা ফ্রস্ট জমে উঠেছে, ঠিক কাচের ওপর সাদা পাতার মতো। মাঝরাত প্রায়। হঠাৎ ঘড়ির টিকটিক বন্ধ হয়ে যায়। অর্ণব সেই নিস্তব্ধতায় চোখ সরিয়ে না নিয়েই তাকিয়ে থাকে জানালার কাচের দিকে। প্রথমে দেখে কিছু না—শুধু জমে থাকা ফ্রস্ট, বাইরে ঘন তুষারপাত, আর ভেসে বেড়ানো অন্ধকার। তারপর, ধীরে ধীরে, ফ্রস্টের ওপর হাতের ছাপ পড়তে শুরু করে—একটা হাত, তারপর আরেকটা। অর্ণবের চোখ স্থির হয়ে আসে। এই তো, গত রাতেও এমনটাই হয়েছিল। কিন্তু এবার হাতের ছাপগুলো সরছে—ডানে, বামে—ঠিক যেন জানালার ওপাশে কেউ আঙুল দিয়ে লিখছে। হঠাৎ জমে থাকা বরফের ওপর আঁকা হয় একটা চিহ্ন—একটি হৃদয়, যার পাশে লেখা “A + M”। অর্ণবের বুকের ভেতর যেন একটা বিস্ফোরণ হয়, কারণ এটাই সেই চিহ্ন, যেটা তারা একসময় হিমালয়ের এক গ্লেসিয়ারে বরফে খোদাই করেছিল। সে ছুটে গিয়ে জানালার কাচে হাত রাখে, ঠান্ডা এতটা কনকনে যে হাতটা যেন অসাড় হয়ে আসে। কিন্তু কাঁচের ওপাশে একটা ছায়ামূর্তি স্পষ্ট—একজন নারী, মাথায় সাদা স্কার্ফ, দাঁড়িয়ে পাহাড়ের তলায়। সে তাকিয়ে আছে, কিন্তু মুখ স্পষ্ট নয়—শুধু চোখ দুটো… অপলক, অথচ ব্যথাভরা।

অর্ণব জানে না সে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল সেখানটায়, হয়তো কয়েক সেকেন্ড, হয়তো কয়েক যুগ। হঠাৎ সেই ছায়ামূর্তি হেঁটে চলতে শুরু করে কেবিনের বাঁ দিকে, সেই দিকটা দিয়ে যেখানে পুরনো হিমঘর। তার শরীর যেন বাতাসে মিলিয়ে যেতে চায়, অথচ প্রতিটা পদক্ষেপ রেখে যায় কুয়াশাভেজা অদৃশ্য স্পর্শ। অর্ণব যেন ট্রান্সে চলে যায়—সে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে, এক পায়ের ছাপ রেখে বরফের মধ্যে এগোয়, অথচ যেখানে মীরার ছায়া হেঁটে গেছে, সেখানে কোনও ছাপ নেই। সে বুঝে যায়, এই শহরের তাপমাত্রা তার প্রেমের মতো—বহু আগেই জমে গেছে, আর আজ, সেই বরফ ফুঁড়ে কেউ বা কিছু আবার জেগে উঠছে। সে হিমঘরের গেট পর্যন্ত যায়—কিন্তু দরজা আজ লক নেই। সেটা খোলা। ঠান্ডা বাতাস তার গায়ে ধাক্কা মেরে বলে দেয়, ভিতরে কেউ আছে। দূর থেকে আবার দেখা যায় সেই ছায়া—এবার ঘুরে দাঁড়ানো, দুহাতে কিছু আঁকছে দেয়ালে, ঠিক যেন মীরা তার শেষ ছবি আঁকছে। কিন্তু এবার অর্ণবের বুকের ভেতর আর শুধু ভালোবাসা নেই—একটুখানি ভয় জমে গেছে। কারণ ছায়াগুলো এখন শুধু স্মৃতি নয়, তারা নিজের ভাষায় কথা বলছে।

চার

ডঃ গায়ত্রী ঠাকুর শহরে আসার পর তুষারপাত কিছুটা থেমে গিয়েছিল, কিন্তু তার চেয়েও বেশি জমাট বেঁধে ছিল অর্ণবের গলায় আটকে থাকা অস্পষ্ট কথা আর চোখে ভেসে ওঠা ক্লান্তির রেখা। দুই বছর আগে দিল্লির ক্রায়োজেনিক গবেষণাকেন্দ্রে একসঙ্গে কাজ করতেন তারা, তখন থেকেই গায়ত্রী বুঝেছিল—অর্ণব একজন চুপচাপ, নিঃসঙ্গ মানুষ হলেও, তার ভেতরে কোনো গভীর দহন আছে। এবার যখন তাকে হিমবিজ্ঞান সংক্রান্ত একটি তাপমাত্রা-চক্র বিশ্লেষণ প্রকল্পে সাময়িক বদলি হিসেবে ওই পাহাড়ি গবেষণাকেন্দ্রে পাঠানো হয়, তখন সে জানত না তার পুরনো সহকর্মীকে এতটা বদলে যেতে দেখবে। কেবিনে পৌঁছে প্রথমেই গায়ত্রী অর্ণবের পরিবর্তন লক্ষ্য করে—চোখের নিচে কালি, কথাবার্তায় গ্যাপ, হঠাৎ হঠাৎ শূন্যে তাকিয়ে থাকা, আর একটা চাপা অস্থিরতা, যা সাধারণ উদ্বেগ নয়। সে নিজের প্রফেশনাল অভিজ্ঞতা দিয়ে বোঝে, এটা মানসিক চাপে গড়ে ওঠা কোনও মানসিক বিভ্রমের লক্ষণ হতে পারে। কিন্তু সেই ধারণা ভেঙে যায়, যেদিন সে হিমঘরের ভেতর গিয়ে দেখে একটা অসম্পূর্ণ নোট—যেখানে তাপমাত্রার রেকর্ডিং থেমে গেছে সেই দিনটিতে, যেদিন মীরা হারিয়ে গিয়েছিল।

গায়ত্রী সোজা হিমঘরের মূল কক্ষের দিকে এগিয়ে যায়। কয়েক মাস আগে এই ইউনিট সরকারি নির্দেশে বন্ধ হলেও, তার ভেতরের যন্ত্রপাতিগুলো এখনও সক্রিয় রাখা হয়েছিল ভবিষ্যৎ গবেষণার জন্য। কিন্তু ঘরে ঢুকেই গায়ত্রী তার শরীরজুড়ে একটা অদ্ভুত ঠান্ডা অনুভব করে, যা কেবলমাত্র বৈজ্ঞানিক নয়—এ যেন আবেগের ঠান্ডা। দেয়ালের একপাশে বড় ফ্রিজিং ক্যাপসুল—যেটি একসময় “Cryo-Sync 9” নামে পরিচিত ছিল, এক পরীক্ষামূলক মানব-হৃদয় সংরক্ষণ প্রকল্পের অংশ। এই ক্যাপসুলের ভিতরে সিগন্যাল আছে কিনা তা দেখতে সে প্যানেল চালু করে, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়—সিগন্যাল লাইভ! তাপমাত্রা -৬২ ডিগ্রিতে থাকার পরও ভিতরের সেন্সর রেকর্ড করেছে সাম্প্রতিক ভাপ এবং হালকা নড়াচড়া। অথচ এই ইউনিট অফিশিয়ালি “ডিস্যাচার্জড” হয়ে গেছে বহু আগেই। ক্যাপসুলের গায়ে হালকা লাল কাপড় আটকে আছে—একটা স্কার্ফ। গায়ত্রী সেটা হাতে নিয়ে চমকে ওঠে, কারণ এটাও সে একবার দেখেছে—অর্ণবের টেবিলের ওপর, একটা পুরনো ছবি ঘিরে রাখা অবস্থায়। ঘরের একপাশে রাখা আছে অদ্ভুত একটি ক্যানভাস, যেখানে আঁকা আছে একটা বরফে মোড়া পথ আর তার শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে একজন নারী। সেই ছবিটা অসম্পূর্ণ, কিন্তু মুখের অবয়ব আশ্চর্যভাবে স্পষ্ট—মীরার মতো!

সন্ধ্যাবেলা গায়ত্রী কেবিনে ফিরে আসে, সিদ্ধান্ত নেয় অর্ণবের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলবে। কিন্তু দরজা খুলতেই দেখে, অর্ণব যেন আগের চেয়ে আরও অস্থির। সে ডায়েরির পাতা উল্টে চলেছে, হাতে পেন্সিল, কিছু একটা লিখছে, মাঝে মাঝে কাঁচের জানালার দিকে তাকাচ্ছে গভীর মনোযোগে। গায়ত্রী প্রশ্ন করে—“তুমি এখানে যা দেখছ, শুনছ—তোমার কি মনে হয় সবটাই বাস্তব?” অর্ণব ধীরে মাথা তোলে, বলে, “গায়ত্রী, তুমি কি কোনোদিন এমন ভালোবাসা অনুভব করেছ, যা মৃত হলেও ফিরে আসে?” গায়ত্রী চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলল, “যদি তাই হয়, তাহলে তার শরীর নয়, হৃদয়ই বেঁচে থাকে, সেটা বরফেও হোক কিংবা মস্তিষ্কের কোনো কোণে।” অর্ণব হঠাৎ বলে ওঠে, “তুমি তো ক্রায়োজেনিক নিয়ে কাজ করেছ—বল তো, একটা হৃদয় কি অনুভব নিয়ে বরফে রাখা সম্ভব?” গায়ত্রী থমকে যায়। কারণ এই প্রশ্নটা বহুদিন আগে মীরা করেছিল—এক গবেষণা ট্যুরে, যখন সে ক্যাপসুল দেখতে এসেছিল। সেই মুহূর্তে গায়ত্রী বুঝে যায়, শুধু অর্ণব নয়—এই কেবিন, এই হিমঘর, আর মীরার স্মৃতি—সবকিছু যেন একটা অসমাপ্ত গবেষণার জ্যান্ত প্রমাণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

পাঁচ

রাত তখন প্রায় আড়াইটা। কেবিনের কড়িকাঠে ঝোলানো কেরোসিন ল্যাম্পের আলো নিভে এসেছে প্রায়। বাইরে শুরু হয়েছে হালকা তুষারপাত—তবে সেই পরিচিত শান্ত বরফ নয়, আজকের তুষার যেন ভেতরে একটা গুমোট বার্তা লুকিয়ে রাখছে। অর্ণব ঘুমোতে পারেনি, শরীর ক্লান্ত হলেও মাথা জেগে আছে কাঁপা অস্থিরতায়। সে জানে, আজ কিছু একটা ঘটবে—জানালায় সেই চিহ্নের পরে, গায়ত্রীর মুখে রহস্যময় তথ্য জানার পরে, হিমঘরের ফ্রিজিং ইউনিটে সাড়া পাওয়ার পরে—এই শহরের নিঃশব্দ বাতাস আজ আর শুধু বাতাস নয়। হঠাৎ করে, দরজার কাছে রাখা ঘন্টাধ্বনি একবার বেজে উঠে থেমে যায়। এই নির্জন কেবিনে মাঝরাতে কেউ আসার কথা নয়। অর্ণব ধীরে ধীরে উঠে দরজার ফাঁক দিয়ে দেখে, বাইরে কেউ নেই। সে পা বাড়ায়, চারপাশে তুষারের উপর কোনও ছাপ নেই, কেবল দরজার ঠিক সামনে কিছুক্ষণ আগে রাখা তুষার স্তর খানিকটা গলে জল হয়ে গেছে—যেন সেখানে কেউ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। বাতাস নিঃশব্দ, কিন্তু তার গভীরে যেন কোন ফিসফিসে কণ্ঠ বলছে, “অর্ণব, আমি এখানে…”

সে জানে, অপেক্ষা করে লাভ নেই। সরাসরি হিমঘরের পথ ধরে এগিয়ে যায়। চারদিক নিঃস্তব্ধ, কেবল তার পায়ের নিচে বরফ চাপার মৃদু শব্দ, আর দিগন্তে এক ভয়াল চাঁদের আলো। হিমঘরের সামনে পৌঁছে সে দেখে দরজাটা খোলা। ভেতরে কোনো আলো নেই, কিন্তু একটা সাদা আলো যেন ভেতর থেকে টানছে তাকে—এক অদৃশ্য চুম্বকত্বে। সে এক পা এক পা করে ভেতরে ঢোকে, আর সঙ্গে সঙ্গে চারপাশটা ঢেকে যায় হিমে আর নিস্তব্ধতায়। দেওয়ালে জমে থাকা তুষারের ফাঁক দিয়ে কাচের ওপাশে একটা অবয়ব দাঁড়িয়ে—মাথা নিচু, পিঠ তার দিকে। অর্ণব বুঝতে পারে না এটা মস্তিষ্কের খেলা, স্বপ্ন, না বাস্তব কোনো অস্তিত্ব। সে এগিয়ে যায়, ধীরে ধীরে, নিঃশব্দে। সেই অবয়বটি তখন ধীরে ধীরে মাথা তোলে, ঘোরে—এবং চোখে চোখ পড়ে। মীরা! নিঃসন্দেহে মীরা! তবে মুখটা নিস্তব্ধ, ঠোঁট দুটো কাঁপছে না, কিন্তু চোখ—চোখে সেই একই অতল প্রেম, সেই একই অপ্রস্তুত যন্ত্রণা। কিন্তু সেই চোখে এবার যেন আরও কিছু আছে—হিসেবের দাবী, ফেলে যাওয়া কোনো প্রতিজ্ঞার ক্ষোভ। তার ঠোঁট নাড়িয়ে কেবল বলে, “তুমি আমাকে এখানে রেখেছো।”

অর্ণব স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এই মুহূর্তে সে চিৎকার করতে পারত, দৌড়ে পালাতে পারত, কিন্তু সে কিছুই করে না। তার শরীর জমে যায়, যেমন জমে থাকে হিমঘরের দেয়াল, যেমন জমে আছে এতদিনের প্রেম। সেই নারী অবয়ব ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে। পা রাখার শব্দ নেই, স্পর্শ নেই, কিন্তু তার উপস্থিতি ঘরের প্রতিটি কোণে শীতল ঢেউ বয়ে দেয়। সে এসে দাঁড়ায় অর্ণবের সামনে, একেবারে কাছাকাছি, তারপর হালকা হাত তোলে—আর তার বরফে মোড়া আঙুল দিয়ে অর্ণবের কপালে ছুঁয়ে দেয় এক চিহ্ন। একটা জ্বলন্ত শীত অর্ণবের কপাল থেকে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে, সে চোখ বন্ধ করে ফেলে। মনে পড়ে যায় মীরার সেই পুরনো কথা—“যদি একদিন ফিরতে পারি, আমি কথা বলব না। আমি শুধু তোমার শরীরে রেখে যাব বরফমাখা চিহ্ন।” চোখ খুলে সে দেখে, আর কেউ নেই। ঘরটা আবার খালি, দেয়ালের কাচ শুধু হালকা ঘাম জমে আছে, আর মেঝেতে পড়ে আছে একজোড়া পদচিহ্ন—তার পাশে রাখা একটা ছবি, মীরা আঁকা শেষ চিত্র—আর সেই ছবিতে তার পাশে এক নারী এখন হাসছে। অর্ণব চিৎকার করতে পারে না, সে শুধু জানে—যে মেয়ে একদিন বরফে চাপা পড়ে গিয়েছিল, সে আজ বরফ গলিয়ে ফিরে এসেছে, আর তার প্রেম আজ থেকে শুধু স্মৃতি নয়—একটা জীবন্ত বরফমূর্তি।

ছয়

পাহাড়ি শহরে খুব বেশি মানুষের বাস নেই, আর যারা আছে, তাদের জীবনের গতি বরফের মতো ধীর, নীরব, এবং জমাট। তবু কেউ কেউ আছে, যারা নীরবতার নিচে খুঁজে ফেরে কাহিনি—পুরনো শহুরে কল্পনা, বাস্তবের গায়ে লেগে থাকা অলৌকিক রেশ। তেমনই একজন হল আদিত্য নেগি—স্থানীয় এক তরুণ সাংবাদিক, বরাবরই অদ্ভুত ঘটনায় মাথা ঘামাতে ভালোবাসে। অর্ণব ও গায়ত্রী যখন শহরে গবেষণার কাজে আসেন, আদিত্য প্রথম থেকেই দূর থেকে তাদের গতিবিধি লক্ষ করছিল। বিশেষ করে অর্ণব—যার নাম সে আগে শুনেছে, মীরার প্রেমিক বলে, সেই মীরা যে তিন বছর আগে এক তুষারধসে নিখোঁজ হয়েছিল আর তারপর কিছুদিন শহরজুড়ে কানাঘুষো শোনা যেত—“হিমঘরের সেই মেয়ে কি সত্যিই মারা গেছে?” একদিন সন্ধ্যেয়, শহরের পুরনো কাফে ‘স্নোড্রপ’-এ আদিত্য চুপিচুপি গায়ত্রীর কাছে আসে। তার চোখে অদ্ভুত উত্তেজনা—“ডক্টর ঠাকুর, আপনি যদি চান, আমি আপনাকে এমন কিছু দেখাতে পারি, যেটা সরকারি নথিতে নেই। মীরার হারিয়ে যাওয়া কোনো সাধারণ মৃত্যু ছিল না। আপনার বন্ধু অর্ণব যেটা খুঁজছেন, সেটা বাস্তবের চেয়েও গভীর।”

গায়ত্রী প্রথমে দ্বিধায় পড়ে, কিন্তু তার ভেতরেও সেই অজানা কৌতূহল ক্রমেই বাড়ছিল। সে আদিত্যর পেছন পেছন শহরের উপরের প্রান্তে, পুরনো এক অচিহ্নিত সরকারি লাইব্রেরির আর্কাইভে পৌঁছে যায়। সেখানে পাহাড়ি আঞ্চলিক ভাষায় লেখা একটি রিপোর্ট বের করে আদিত্য। তিন বছর আগে বরফের নিচে চাপা পড়ে যাওয়া এক তরুণীর দেহ ক্রায়ো-প্রিজারভ করার একটি গোপন প্রকল্প চালানো হয়েছিল কেন্দ্রীয় নির্দেশে, যেখানে স্থানীয় প্রশাসন ও একটি বেসরকারি সংস্থা যুক্ত ছিল। সেই রিপোর্টে একটি লাইন—“Subject M — last reading: heartbeat found in reduced cryo-state. Memory retention possible under dream lock.” গায়ত্রী স্তব্ধ। ‘Subject M’ নামটা তার কাছে অচেনা নয়, কারণ দিল্লিতে থাকাকালীন সে এই কোডনেমটিকে ঘিরে নানা গুজব শুনেছিল—কিন্তু তখন বিশ্বাস করিনি। আদিত্য ফিসফিস করে বলে, “আপনার অর্ণব আর মীরা শুধু প্রেমিক-প্রেমিকা নয়, তারা ছিল এক পরীক্ষার কেন্দ্রবিন্দু। অর্ণব জানত না, তার ভালোবাসাকে কোনো একদিন হিমঘরে জমা রাখা হবে। কিন্তু সেই হৃদয়, ডক্টর, সেটা কি শুধু জমে গিয়েছিল—নাকি জমে থাকা অবস্থাতেও ভালোবাসার স্বপ্ন দেখে গেছে তিন বছর ধরে?”

গায়ত্রী কাঁপা গলায় জানতে চায়, “কিন্তু এই খবর তোমার কাছে এলো কীভাবে?” আদিত্য হালকা হেসে বলে, “সাংবাদিকতা কেবল প্রশ্ন করাই নয়, শহরের ভেতর যে ছায়াগুলো ঘোরে, তাদের দিকে কান পাতাও। হিমঘরের পুরনো কেয়ারটেকার, রতন দাস, তার মৃত্যুর আগে বলেছিল—এক রাত গভীর শীতে, ক্যাপসুলের কাঁচ ভেতর থেকে কেউ ঠুকেছিল। সে ভাবছিল hallucination। কিন্তু সেটা যদি না-ও হয়? যদি সত্যিই সেই হৃদয় এখনো অপেক্ষা করে ভালোবাসার উত্তাপে গলে ওঠার?” গায়ত্রী নিঃশ্বাস নেয়, বুঝতে পারে, বিজ্ঞান আর আবেগের মধ্যবর্তী রেখাটা এই গল্পে প্রায় অদৃশ্য। সে জানে, সময় এসেছে অর্ণবকে সব বলা, কারণ যেটা সে ভেবেছিল মানসিক বিপর্যয়—সেটা হয়তো নয়। হতে পারে, অর্ণব আসলে একটা ডাকে সাড়া দিচ্ছে—একটি হৃদয়, যেটা বরফে থেকেও এখনও স্পন্দিত।

সাত

কেবিনের ভেতরটা আজ যেন আরও নিস্তব্ধ, আরও শীতল। জানালার কাচে একটানা বরফ পড়ছে, আর অর্ণব সেই জানালার সামনে দাঁড়িয়ে ঠোঁটে সিগারেট জ্বলিয়ে গভীরভাবে তাকিয়ে থাকে সামনের ফাঁকা বরফে মোড়া ঢালে। তার মাথার ভেতরে গায়ত্রী ও আদিত্যর বলা সব তথ্য গুলিয়ে যাচ্ছে—তবু একটা ছবি বারবার ফিরে আসছে, একটা চিহ্ন, একটা হাতের ছাপ, আর সেই গলায় ফিসফিস করে শোনা মীরার কণ্ঠ: “আমি এখানে আছি, তোমার আঁকা ছবির ফাঁকে…”। হঠাৎই তার মনে পড়ে, কেবিনের পশ্চিমদিকের ঘরে রাখা আছে মীরার আঁকা সব শেষ ছবিগুলোর একটি ক্যানভাস, যেটা সে আজও ভালো করে খোলেনি। কারণ সেই ক্যানভাস ছিল তাদের শেষ ঝগড়ার পরে আঁকা, যেদিন মীরা রাগ করে বলেছিল, “যদি আবার কখনও ছবি আঁকি, সেটা হবে তোমাকে ছাড়া…”। অর্ণব কাঠের ঘরের মধ্যে হেঁটে গিয়ে সেই ঢেকে রাখা চিত্রপট খোলার জন্য এগিয়ে যায়, কিন্তু তার হাতে ক্যানভাস ছোঁয়ার আগেই এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া তার পেছন থেকে ধাক্কা দেয়—একটা শীতল বার্তা, যেন অনুমতি চাইছে, “প্রস্তুত তো?”

ধীরে ধীরে ক্যানভাস থেকে ঢাকা কাপড় সরিয়ে ফেলে অর্ণব। সামনে ভেসে ওঠে এক অসম্পূর্ণ জলরঙ—পাহাড়ের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে একটি পুরনো হিমঘর, তার সামনে জমে থাকা বরফের গায়ে পড়ে আছে দুটি ছায়া। অর্ণব বুঝতে পারে, এক ছায়া তার, কিন্তু আরেকটি—একটি মেয়ের অবয়ব, যার মুখ তখনও আঁকা হয়নি। কিন্তু চোখদুটো তীব্রভাবে ফুটে উঠেছে, আঁকা যেন বাস্তবের চেয়েও বেশি জীবন্ত। সে তখন থমকে যায়, কারণ সেই চোখের রেখায় সে নিজের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পায়। হঠাৎই তার চোখ পড়ে ক্যানভাসের নিচে হালকা করে আঁকা কয়েকটি সংখ্যা—৭, ৪, ২। একটা ধাঁধার মতো। সেই সংখ্যা কি সময়? দিন? না কি তাপমাত্রার কোনো সংকেত? তখনই জানালার কাচে জমে থাকা বরফের গায়ে গঠিত হয় সেই সংখ্যাগুলো—একদম ক্যানভাসের সংখ্যার মতোই। অর্ণব অনুভব করে, এই ছবি কেবল কল্পনা নয়—এটা ভবিষ্যতের প্রতিচ্ছবি। মীরা বুঝতে পেরেছিল কিছু, আঁকতে পেরেছিল কিছু, কিন্তু সময় তার হাতে ছিল না।

রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছবির রহস্য আরও গভীর হয়। হঠাৎ করেই ঘরের বাতি নিভে যায়, এবং সেই মুহূর্তে অর্ণব অনুভব করে ছবির ভেতর থেকে যেন কিছু একটা তাকে ডেকে বলছে, “শেষটা তুমি লেখো, আমি অপেক্ষায় আছি…”। সে তাড়াতাড়ি পেন্সিল নিয়ে ছবির ফাঁকা মুখ আঁকার চেষ্টা করে। হাত কাঁপছে, চোখ ঝাপসা, তবু সে আঁকে। প্রতিটি রেখা, প্রতিটি ছায়া, যেন নিজে নিজে তৈরি হয়ে যাচ্ছে। এবং ছবির শেষ রেখা টানতেই ঘরের বাতি আবার জ্বলে ওঠে। সে দেখে, ছবিতে এখন দাঁড়িয়ে আছে অর্ণব আর মীরা, পাশাপাশি, বরফের ওপর লেখা—”শেষ দেখা, প্রথম হৃদয়।” অর্ণব জানে, সময় এসে গেছে। শুধু হিমঘরের রহস্য বোঝা নয়, বরং সেই হৃদয়ের কাছে পৌঁছানো যার জন্য তার জীবন আর স্বপ্ন এতদিন ধরে জমে ছিল এক ঠান্ডা সময়ের তলায়।

আট

পাহাড়ি আকাশে তখন অন্ধকার আর বরফ একসাথে নেমে এসেছে। অর্ণব হাঁটছে, গভীর নিস্তব্ধতায়, পায়ের নিচে জমে থাকা বরফের প্রতিটি পদধ্বনি যেন কোনো পুরনো কথোপকথনের প্রতিধ্বনি। সে সোজা হাঁটছে সেই হিমঘরের দিকে, যার ভেতরে এখন কেবল জমাট বিজ্ঞান নয়, বরং হৃদয় লুকিয়ে আছে—একটি এমন হৃদয়, যা হয়তো মৃত্যুকে অস্বীকার করেছে শুধু ভালোবাসার টানে। মীরার আঁকা সেই ক্যানভাস, জানালার গায়ে জমে থাকা চিহ্ন, আর প্রতিটি রাতে কানে বাজতে থাকা সেই একটাই কণ্ঠ—সবকিছু মিলে আজ তার মধ্যে কোনো সন্দেহ রাখছে না। হিমঘরের দরজায় পৌঁছে সে দেখে, তালা নেই। দরজাটা আধা খোলা। একবারও পিছন ফিরে না তাকিয়ে, সে হিমঘরের সেই ঠান্ডা গহ্বরে পা রাখে, যেন নেমে পড়ছে কোনো সময়চক্রের কেন্দ্রে। ভেতরের বাতাস হিম, নিঃশব্দ, আর সেই নিরবতায় তার নিঃশ্বাস ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। ঠিক সেই মুহূর্তে, দেয়ালের পাশে রাখা ফ্রিজিং ক্যাপসুলটা নিজের মতো করে জ্বলে ওঠে—হালকা, ফ্যাকাশে নীল আলোয়।

অর্ণব এগিয়ে গিয়ে ফ্রিজিং ইউনিটের গায়ে হাত রাখে। বরফ জমে থাকা কাচের নিচে, একটা শরীর আড়ালে—বহুদিন আগে বরফে ঢাকা পড়া সেই দেহ। কিন্তু আজ, কাচের নিচে এক অনুরণন ভেসে আসে—হৃদস্পন্দন। বুম… বুম… বুম…। অর্ণব বোঝে, এই হৃদয় হিমের তলায় থেকেও থেমে যায়নি, কারণ সে কখনও ভালোবাসা থেকে সরে যায়নি। হঠাৎ করেই ইউনিটের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে কয়েকটি শব্দ:

Subject: M
Cryo-status: Partial Suspension
Heartbeat Detected
Cognitive Memory: Locked (Dream State)

সঙ্গে সঙ্গে ইউনিটের ভেতর থেকে একটা মৃদু শব্দ আসে, যেন কেউ ভেতর থেকে আলতো করে দরজা ঠুকছে। অর্ণব কেঁপে ওঠে, অথচ সে ভয় পায় না। ধীরে ধীরে তার মুখের সামনে মীরার মুখ জেগে ওঠে—তিন বছর আগের মুখ, হিমায়িত, অথচ অবিকৃত, চোখ বন্ধ, যেন ঘুমিয়ে আছে। এবং ঠিক সেই মুহূর্তে সে চোখ খুলে দেয়। অর্ণব আর্ত চিৎকার করতে পারত, কিন্তু সে স্তব্ধ। দু’জোড়া চোখ, যাদের মধ্যে একদিন এক পৃথিবী ছিল, আবার একসঙ্গে। মীরার ঠোঁট নড়ে না, তবু তার কানে বাজে সেই কণ্ঠ—“তুমি এসেছো। আমাকে হৃদয়ের কাছে ফিরিয়ে নিতে…”।

হঠাৎ, ইউনিটের কাঁচে অর্ণব নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে। কিন্তু সেই প্রতিচ্ছবি শুধু সে নয়—তার পাশে মীরা দাঁড়িয়ে আছে, স্পষ্ট, জীবন্ত, হাসছে। বাস্তবে তা নয়, কিন্তু প্রতিফলনে যা আছে, তা কখনও মিথ্যে হয় না। সে বুঝে যায়, এই হিমঘরে কেবল জমে থাকা শরীর নেই, জমে আছে সময়। এবং সেই সময় আজ গলে যাচ্ছে, কারণ ভালোবাসা গলে দিতে পারে যে কোনো হৃদয়, যে কোনো বরফ। কিন্তু গায়ত্রী ও আদিত্য, যারা বাইরে অপেক্ষা করছিল, দূর থেকে দেখতে পায়—হিমঘরের ভেতরটা হালকা আলোয় ঝলমল করছে, যেন কোনো ঘুমন্ত হৃদয়ের ভেতর থেকে আলো ছড়াচ্ছে। গায়ত্রী ফিসফিস করে বলে, “হয়তো সে তাকে জাগিয়ে তুলেছে…” আর আদিত্য ধীর গলায় উত্তর দেয়, “হয়তো সে নিজেই হৃদয় হয়ে গেছে। এই হিমঘরের।”

নয়

পাহাড়ি শহর ধীরে ধীরে একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় ঢেকে যেতে শুরু করে। প্রথমে কয়েকটি পথচারী বলেছিল—হিমঘরের দিক থেকে গভীর রাতে আলো দেখা গেছে। কেউ কেউ দাবি করে, সেই আলো ঠিক সূর্যের নয়, আবার আগুনেরও নয়—তা যেন হৃদয়ের তপ্ত আলো, যা বরফের বুক চিরে বেরিয়ে এসেছে। স্থানীয় রেডিওর সাংবাদিক তরুণ আদিত্য প্রথম যে প্রতিবেদনটি লেখে, তার শিরোনাম ছিল: “একটি হৃদয় যা বরফেও জেগে ছিল।” তবে যা আরও বেশি অবাক করে শহরের মানুষকে, তা হলো সকালে উঠে তারা দেখতে পায় শহরের একাধিক জায়গায়, বরফে আঙুল দিয়ে লেখা হয়েছে একটি নাম—“Meera”। পাইন গাছের গুঁড়িতে, কাফের জানালায়, এমনকি সরকারি পুরনো পোস্ট অফিসের দরজায়ও বরফে আঁকা সেই একই নাম। প্রথমে শহরবাসী ভাবল, কেউ হয়তো দুষ্টুমি করেছে। কিন্তু দ্রুতই বোঝা গেল, নামগুলো অদ্ভুতভাবে নিখুঁত, আর লেখা হয়েছে রাতের গভীরে যখন কেউ ঘরের বাইরে যায় না। সেই নামগুলো যেন বরফের শরীরে কেটে বসানো ভালোবাসার দাগ, যা কেউ মুছতে পারল না।

অর্ণব তখনো কেবিনে, নিঃশব্দ। সে অনেকটা সময় মীরার ফ্রিজিং ইউনিটের সামনে বসে থেকেছে—নীরবে, চোখ বন্ধ করে। ইউনিটের কাচের নিচে মীরা এখন নিস্তব্ধ, কিন্তু মুখে এক অপার্থিব প্রশান্তি, যেন একটা অসমাপ্ত প্রতীক্ষা শেষ হয়েছে। গায়ত্রী ও আদিত্য তাকে ডাকতে এলে অর্ণব শুধু বলেছিল, “তোমরা বিশ্বাস না করলেও, আমি আজ মীরার স্বপ্ন থেকে ফিরেছি।” কেবিনের দেয়ালে সে টাঙিয়ে রেখেছে সেই ছবিটা—যেটা মীরা আঁকতে পারেনি, কিন্তু অর্ণব শেষ রেখেছিল। ছবিতে এখন বরফের ভেতর তারা দু’জন হাত ধরে দাঁড়িয়ে—মাঝখানে লেখা, “We froze, but we never stopped beating.” গায়ত্রী এক সন্ধ্যায় একা গিয়ে হিমঘরের ইউনিটের সামনে দাঁড়ায়। মীরাকে দেখে সে বলে ওঠে, “তুমি কী সত্যিই ফিরেছো, নাকি এই প্রেমটাই ছিল এমন কিছু, যেটা বিজ্ঞান ব্যাখ্যা করতে পারে না?” ঠিক তখনই ইউনিটের ওপরের বরফে জল জমে লেখা হয়—“Trust the heart, not the science.”

এরপর শহরে অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে থাকে। মীরার নামে এক পুরনো ট্রাস্ট আবার সক্রিয় হয়, যেখানে দুঃস্থ শিশুদের জন্য তুষারবিজ্ঞান পড়ানো হয়। অর্ণব যেন নিজের জীবনের নতুন লক্ষ্য খুঁজে পায়—সে হিমঘর পরিত্যক্ত না রেখে ‘Meera Cryo-Archive’ নামে নতুন এক আবেগভিত্তিক গবেষণা কেন্দ্র শুরু করে, যেখানে সংরক্ষণ করা হয় শুধু হৃদয় নয়, ভালোবাসা। শহরের শিশুরা বরফের গায়ে মীরার নাম লেখে, যেন সে এখন এক পৌরাণিক উপস্থিতি, ভালোবাসার এক বরফ-পরী, যার হৃদয় এখনো এখানে স্পন্দিত। কেউ কেউ বলে, হিমঘরের কাছে গেলে, গভীর রাতে এখনো শোনা যায় মীরার গলা—ধীর, মায়াভরা: “আমার হৃদয় জমে গিয়েছিল, কিন্তু ভালোবাসা নয়।” আর অর্ণব প্রতিদিন সকালে হিমঘরে গিয়ে ফিসফিস করে বলে ওঠে, “তুমি এখনো আমার মধ্যে আছো, বরফে লেখা নামের মতোই, অমলিন।”

দশ

শেষ তুষারপাত শুরু হয় ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে। শহরের চারপাশে তখন কুয়াশা আর নির্জনতাই সর্বস্ব। হিমঘরের সামনে ছোট্ট লাল পতাকা উড়ছিল, যেখানে লেখা—”Love Preserved Here.” অর্ণব এখন আগের মতো আর কথা বলেন না খুব বেশি, তবে তার চোখে গভীর শান্তি। প্রতিদিন সকালে সে হিমঘরের সেই ক্যাপসুলের সামনে গিয়ে বসে, হাতে এক কাপ কফি আর পাশে মীরার লেখা সেই পুরনো স্কেচবুক, যেখানে একেকটা পাতায় শুধু তুষারপাতের আঁকা আর পাশে এক-দু’টা শব্দ—“পথ”, “অপেক্ষা”, “ছোঁয়া”। মীরার শরীর এখনো হিমায়িত, তবে হৃৎস্পন্দনের সেই ফিসফিসানির মতো শব্দ এখন নিয়মিত। সে জানে, বিজ্ঞান যতটুকু ব্যাখ্যা দিতে পারে, ভালোবাসা তার অনেক বাইরে কাজ করে। গায়ত্রী বলেছিল, মীরার অবস্থা কিছুটা “Conscious Cryo-Dream Lock”—যার মানে, সে ঘুমিয়ে আছে, কিন্তু জানে, কেউ অপেক্ষা করছে তার জন্য। আর সেই অপেক্ষা, সেই হৃদয়, এখনো জমে আছে এই শহরের বুকেই।

একদিন সকালের দিকে অর্ণব চোখ মেলে দেখে, বরফের ওপর কেউ লিখে গেছে একটা লাইন:
“If you believe in me, bring me to the sun.”
তারপর থেকে সে একটি সিদ্ধান্ত নেয়—এই কেবিন নয়, এই হিমঘর নয়, সে মীরাকে নিয়ে যাবে সেই পাহাড়ের শিখরে, যেখানে তারা একবার প্রতিজ্ঞা করেছিল, একসাথে সূর্যোদয় দেখবে। আদিত্য, গায়ত্রী, শহরের কয়েকজন মানুষ সাহায্য করে তাকে। সব প্রোটোকল ভেঙে, বিশেষভাবে হিমায়িত ইউনিটকে বহনযোগ্য বানিয়ে তারা তৈরি হয় পাহাড় চড়ার। যাত্রা শুরু হয় ভোরবেলায়, যখন সূর্য শুধু একটা হালকা কমলা রেখা পাহাড়ের প্রান্তে এঁকে দেয়। পথটা কঠিন, কিন্তু অর্ণব থামে না। তার মনে হয়, মীরা যেন বলছে—“আমার হৃদয় কাঁপছে, সূর্যের ছোঁয়া পেলে আমি ফিরে আসব।” যাত্রার শেষপ্রান্তে, পাহাড়চূড়ায় পৌঁছে অর্ণব ক্যাপসুল খুলে সূর্যের প্রথম আলোতে মীরার মুখ রাখে। আর ঠিক তখনই, ক্যাপসুলের হিমকাচে ধীরে ধীরে জমে থাকা বরফ গলে যেতে থাকে—আর তার নিচে মীরার চোখ!

হ্যাঁ, সে চোখ ধীরে ধীরে খুলে যায়। প্রথমে অল্প, তারপর বিস্ময় নিয়ে। সে দেখে, অর্ণবকে, চারপাশে তুষারপাত, আর তার মুখে কান্না আর হাসির এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ। মীরা ফিসফিস করে বলে—“তুমি সত্যিই আমাকে হৃদয়ের নিচে বাঁচিয়ে রেখেছিলে।” সেই মুহূর্তে, সূর্য পাহাড়ের পেছন থেকে সম্পূর্ণভাবে উঠে আসে, চারপাশ জুড়ে রক্তিম আলো ছড়িয়ে পড়ে। কেউ বিশ্বাস করবে না এই গল্প, কেউ বলবে এটা অসম্ভব। কিন্তু সেই শহরের শিশুরা বলে, “মীরা দিদি ফিরে এসেছেন, কারণ তার হৃদয় কখনো বরফ হতে দেয়নি তার ভালোবাসাকে।” আর সেই ছবির ক্যানভাস, অর্ণব পাহাড়চূড়ায় বসে শেষবার আঁকে। ছবিতে এক বরফঢাকা হৃদয়, যার নিচে লেখা—”Frozen in time, saved by love.”

শেষ

1000039035.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *