সমাপ্তি বর্মন
সকালটা ছিল মেঘলা, অথচ বৃষ্টির কোনো আভাস নেই। রুক্মিণীর মাথার ওপর দিয়ে পাখির ছায়া উড়ে গেল—একটা নীল কুড়ুলি, সেইরকম রঙিন পালকের পাখি যেটা কেবল কুশলনগরের আকাশেই দেখা যেত তাদের ছোটবেলায়। বিশ বছর পর এই জায়গাটায় ফিরে আসার সাহস সে নিজের কাছেই একটা বিস্ময় মনে হচ্ছিল। পাশে বসে থাকা ভাই অর্ণব হঠাৎ বলে উঠল, “এই রাস্তার বাঁকে একটা নারকেল গাছ ছিল, মনে আছে?”
রুক্মিণী হেসে মাথা নাড়ল। “আর মনে নেই? ওই গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে আমি তোকে গুমরার জুস খাওয়াই বলেছিলাম, আর তো তোর গায়ে গড়িয়ে পড়েছিল!”
দুজনেই হেসে উঠল। সেই হাসির মধ্যে ছিল পুরনো দিনের গন্ধ, ছিল শৈশবের ডাকে সাড়া দেওয়ার এক অন্তরঙ্গতা।
গাড়ি এসে থামল সেই ছোট্ট কাঠের ব্রিজটার সামনে, যার নিচ দিয়ে কাবেরী নদীর একটা শাখা বয়ে চলে গেছে অনেক বছর ধরে। ব্রিজটা আগের মতোই আছে—হয়তো একটু নড়বড়ে, কিছু জায়গায় শেওলা জমেছে কাঠের ফাঁকে, কিন্তু এখনও দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করেই। পাশে একটা কুঁড়েঘর, তার সামনের বারান্দায় বসে থাকা বৃদ্ধ লোকটা চোখে চশমা লাগিয়ে বলল, “ফিরে এসেছো, না?”
রুক্মিণী একটু চমকে উঠল। “চেনেন আমাকে?”
লোকটা হাসল। “তোমার মুখে তোমার দিদার ছায়া। চেনা না কি হয়?”
তারা ব্রিজের দিকে এগিয়ে গেল। কাঠে পা রাখার সময় একটা কড়কড়ে আওয়াজ উঠল, অর্ণব সাবধানে বলল, “আরে সাবধানে চল, ভেঙে পড়িস না যেন।”
রুক্মিণী মাথা নাড়ল। “এই ব্রিজটাই তো আমাদের ছোটবেলার প্রতিদিনের রাস্তা ছিল। এখানেই দাদু আমাকে প্রথম বলেছিল, ‘একদিন তোমার মতো কেউ এই ব্রিজের নিচে কিছু পাবে, যেটা খুব দরকার ছিল জানবার জন্য।’ আমি ভাবতাম, এটা শুধু গল্প, হয়তো আজ সত্যি কিছু আছে।”
দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। নদীর জলে সূর্যের আলো পড়ছে টুকটাক করে। হঠাৎ অর্ণব নিচু হয়ে ব্রিজের কাঠের নিচের একটা ঢাকনা টেনে বলল, “এই জায়গাটায় কাঠ একটু আলাদা। লাগানো মনে হচ্ছে। খোলার চেষ্টা করি?”
রুক্মিণী ঘাড় কাত করে দেখল। “কর, কিন্তু সাবধানে।”
অর্ণব ধীরে ধীরে কাঠটা খুলে ফেলল। ভেতরে একটুখানি গর্ত, তার মধ্যে একটা প্লাস্টিক মোড়া ছোট ডায়রি। কেমন ধুলো গন্ধ বেরোল।
ডায়রিটা তারা ব্রিজের পাশে বসে খুলল। প্রথম পাতায় লেখা:
“৩১ মে, ১৯৬৫ — আজ প্রথমবার তাকে দেখলাম। সে এক ব্রাহ্মণ বাড়ির মেয়ে, আর আমি নিছক একজন কাঠুরে পরিবারে বেড়ে ওঠা কিশোর। কিন্তু তার চোখে আমি কিছু একটা খুঁজে পেলাম—যেটা সারা জীবন খুঁজেছি।”
রুক্মিণীর গলা শুকিয়ে এল। “এটা তো দাদুর লেখা হাত! দেখ, নিচে নাম লেখা আছে—‘হরিদ্বীপ চক্রবর্তী’।”
অর্ণব ফিসফিস করে বলল, “তুমি তো বলেছিলে, দাদু নাকি জীবনে কোনো প্রেম করেননি, দিদাকে ছাড়া?”
রুক্মিণী ডায়রির পাতায় আঙুল বুলিয়ে বলল, “হয়তো আমরা কিছুই জানতাম না। হয়তো এই কুশলনগরেই দাদুর একটা পুরনো প্রেম লুকিয়ে ছিল।”
ডায়রির পরের পাতায় লেখা:
“তার নাম শুনলাম—শোভনা। স্কুলে পড়ে তখনও, কিন্তু আমি তাকিয়ে থাকি নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে, যদি কখনও আবার তাকে দেখি।”
অর্ণব ডায়রির পাতা উল্টাতে উল্টাতে থমকে গেল। “রুকু, দেখো এটা—একটা ছোট স্কেচ।”
সত্যিই, পাতার এক কোণে আঁকা এক নারীমূর্তি—মাথায় বিনুনী, হাতে একতারা। নিচে লেখা: “শোভনা, আমার গানের মেয়ে।”
রুক্মিণীর মনটা কেমন করে উঠল। “দাদু তো গান গাইতেন না, তাই না?”
অর্ণব মাথা নাড়ল। “না, কিন্তু হয়তো সে গাইত। হয়তো সেই গানেই দাদু প্রেমে পড়েছিলেন।”
একটা পুরনো জীবন, একটা অজানা অধ্যায় ডায়রির পাতায় ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে। রুক্মিণী যেন নিজের শ্বাসটাও শুনতে পাচ্ছিল স্পষ্টভাবে।
“এই প্রেম যদি অসমাপ্ত থাকে, তাহলে আমরা কি সেটা শেষ করতে পারি?”
অর্ণব তাকাল বোনের দিকে। “কীভাবে?”
“ডায়রিটা পড়তে হবে শেষ পর্যন্ত। তারপর বুঝতে হবে, এই শোভনা কে ছিল, কোথায় থাকত, কীভাবে হারিয়ে গেল। আমরা যদি জানি, তবে দাদুর গল্পটা বলা হবে একদিন।”
বিকেল হয়ে গেছে। কুশলনগরের রাস্তায় আলো ঝিমঝিম করছে। গ্রামের একমাত্র চায়ের দোকানে বসে দুটো কফি অর্ডার দিল তারা। দোকানদার বলল, “বহুদিন পর কেউ আপনাদের মতো শহরের ছেলে-মেয়ে আসছে ডায়রি পড়তে। আগেও কেউ এসেছিল।”
রুক্মিণী কপাল কুঁচকে বলল, “কেউ এসেছিল মানে?”
দোকানদার বলল, “তিন মাস আগে, একজন বৃদ্ধ মহিলা এসেছিলেন। ওই ব্রিজের সামনে ঘণ্টাখানেক দাঁড়িয়ে ছিলেন। নাম বলেছিলেন না, কিন্তু চোখে ছিল অদ্ভুত এক ভেজা আলোর রেখা।”
অর্ণব চমকে উঠল, “মহিলা? দাদুর বয়সী কেউ?”
“হ্যাঁ, একদম সেই বয়সের। তারপর গুম হয়ে গেলেন। কেউ আর কিছু জানে না।”
রুক্মিণী ও অর্ণব পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল। মাথার ভেতর একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল—এই মহিলা কি সেই শোভনা? দাদুর ডায়েরির শোভনা?
রুক্মিণী কফির কাপটা হাতে নিয়ে একটানা তাকিয়ে ছিল রাস্তার ধারে সেই কাঠের ব্রিজটার দিকে। অর্ণব তার পাশে বসে চুপ করে ছিল, যেন ডায়েরির পাতাগুলো থেকে উঠে আসা প্রতিটি শব্দ মাথায় বসে গেছে। দোকানদার তখন আরেক কাস্টমারের দিকে মন দিয়েছিল, কিন্তু ওদের কথাটা বোধহয় ওর কানে গিয়েছিল ঠিকই, কারণ ফিসফিস করে বলল, “এই জায়গাটায় অনেক গল্প চাপা পড়ে থাকে, জানেন তো। শোভনা নাম শুনেছি অনেক ছোটবেলায়… কিন্তু কেউ তাকে দেখেনি। শুধু বলত, নদীর পাড়ে এক মেয়ে গান গাইত একতারা হাতে, যাকে সবাই ভুলে গেল।”
রুক্মিণী একটু উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞেস করল, “আপনি শোভনার বাড়ি কোথায় ছিল সেটা জানেন?”
দোকানদার মাথা নাড়ল। “পুরোনো হালেগেট বস্তির পাশে একটা বাড়ি ছিল, বাঁশঝাড়ের আড়ালে। এখন কিছু নেই, সব জায়গায় কনস্ট্রাকশন শুরু হয়েছে।”
অর্ণব উঠে দাঁড়াল। “চলো না, আজই গিয়ে দেখি জায়গাটা।”
রুক্মিণী বলল, “না, এখন সন্ধে হয়ে যাচ্ছে। কাল সকালে যাব। আজ রাতটা ডায়েরিটা পুরো পড়ে নিই।”
ওরা আবার সেই গেস্টহাউসে ফিরে এল যেখানে থাকছে—ছোট্ট পাহাড়ের গায়ে কাঠের ছাউনি দেওয়া বাড়ি, বারান্দা থেকে নিচে কাবেরীর ঝিরঝিরে ধারা দেখা যায়। রুক্মিণী বিছানায় বসে ডায়েরির পাতা ওল্টাতে লাগল।
“১৫ জুন, ১৯৬৫— আজ শোভনার গলা শুনলাম কাছ থেকে। সে গান গাইছিল, ‘আসেনা মোর ঘরে, পাখির পাল’। আমি পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলাম, কোনো শব্দ না করে। গান শেষ হলে সে বলল, ‘আসতে পারো, লুকোচ না।’ আমি থমকে গেলাম। সে জানত আমি আছি।”
অর্ণব নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “মানে দেখা হয়েছিল ওদের। শুধু দূর থেকে নয়।”
রুক্মিণী বলল, “এবং সেটা বারবার।”
ডায়েরির পরের পাতায় লেখা:
“সে বলল, তার গলা নাকি তার দিদা বলত নদীর ঢেউয়ের মতো। আমি বললাম, আমার দিদা বলতেন, আমার হাতের কাঠের কাজ নদীর স্রোতের মতো চলে। সে হেসে বলল, ‘তাহলে আমরা দুজনে নদীর সন্তান।’ আমি তখনই জানতাম, আমি এই মেয়েকে ভালোবেসে ফেলেছি।”
রুক্মিণীর চোখ ভিজে উঠল। এই দাদু তো সে চেনে না—এমন কবি, এমন কোমল হৃদয়!
অর্ণব হঠাৎ বলল, “একটা কথা খেয়াল করেছিস? দাদু কোথাও নিজের নামের পরে পদবি লেখেনি। শুধু হরিদ্বীপ।”
রুক্মিণী চমকে বলল, “হ্যাঁ, ঠিকই তো! আর ডায়েরির পিছনে কোনো তারিখ নেই, কবে শেষ হয়েছে—তা-ও নেই।”
তারা ডায়েরির শেষ পাতার দিকে এগোল। সেখানে লেখা:
“আমরা পালাতে চেয়েছিলাম। আমি তাকে নিয়ে দূরে চলে যাব, যেখানেই হোক। কিন্তু তার পরিবার, তার জাত, আর আমার নীচু জন্ম—সব কিছু বাধা হয়ে দাঁড়াল। শোভনা বলল, আমি যেন তাকে ভুলে যাই। কিন্তু আমি পারি না। তাই এই ডায়রি রেখে গেলাম, যদি কোনোদিন কেউ এটা খুঁজে পায়—তাকে বলবে, আমি ভালোবেসেছিলাম, সত্যিই ভালোবেসেছিলাম।”
আর কোনো লেখা নেই। কেবল একটা পাতার নিচে ছোট করে আঁকা একটি ফুল—কৃষ্ণচূড়া।
অর্ণব বলল, “এই প্রেম তো শেষ হয়নি। শুধু সময় থেমে গেছে।”
রুক্মিণী বলল, “এবং এখন আমাদের সময় শুরু।”
সেই রাতে ওরা আর ঘুমোতে পারল না। জানালার বাইরে ঝিঁঝিঁর ডাক, নদীর শব্দ, আর শীতল হাওয়ার মধ্যে ওদের মনে হচ্ছিল, দাদুর প্রেম যেন সেই বাতাসে মিশে ওদের ছুঁয়ে যাচ্ছে। রুক্মিণী বারবার শোভনার মুখ কল্পনা করছিল—একতারা হাতে, নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে গান গাইছে, তার চোখে জল আর প্রেমের অপেক্ষা।
পরদিন ভোরবেলা, তারা বেরিয়ে পড়ল। দোকানদার যেই জায়গার কথা বলেছিল, সেই হালেগেট বস্তি এখন আধা শহরের মতো—ছোট ছোট ফ্ল্যাট, দোকানপাট, কংক্রিটের গলি। বাঁশঝাড় কোথাও নেই। কিন্তু এক বৃদ্ধা দরজার ধারে বসে ছিলেন, তাকে অর্ণব জিজ্ঞেস করল, “এই এলাকায় কি আগে কোনো শোভনা দিদিমা থাকতেন?”
বৃদ্ধা চমকে তাকাল। “তোমরা কে?”
রুক্মিণী ডায়েরিটা বার করে দেখাল। “এটা আমার দাদুর লেখা। তিনি শোভনাকে ভালোবাসতেন। আমরা খুঁজছি তাকে।”
বৃদ্ধা ধীরে ধীরে বললেন, “শোভনা আমার ছোটবেলার বন্ধু ছিল। ওর গলা ছিল সোনার মতো। কিন্তু তারপরে একদিন হঠাৎ হারিয়ে গেল। কেউ জানে না সে কোথায় গেল, কেউ খুঁজেও পেল না।”
রুক্মিণী কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “আপনি কি মনে করেন, সে হয়তো আজও বেঁচে আছেন?”
বৃদ্ধা মাথা নাড়লেন। “কেউ যদি তিন মাস আগে এই এলাকায় এসে কাঁদে, গান গায়, তারপর হারিয়ে যায়—তাহলে সেই ‘সে’ কে হতে পারে, বলো তো?”
অর্ণব আর রুক্মিণী পরস্পরের দিকে তাকাল। যেন ডায়েরির শেষ লাইনের উত্তর এবার তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
বৃদ্ধার কথা রুক্মিণী আর অর্ণবের মাথায় ঝড়ের মতো বাজছিল। “তিন মাস আগে… গান গায়… তারপর হারিয়ে যায়।” শব্দগুলো যেন সারা গ্রাম থেকে বয়ে আসছিল, ভেসে আসছিল সেই পুরনো ব্রিজের নিচে। রুক্মিণী মনে মনে ভাবছিল, কীভাবে এক নতুন কৌতূহল তাদের জীবনে ঢুকে পড়ল, এক অসমাপ্ত গল্প, একটা দীর্ঘদিনের লুকোনো প্রেম।
“তাহলে, সে কোথায় চলে গেল?” অর্ণব জিজ্ঞেস করল।
বৃদ্ধা চোখ বুজে কিছু সময় চুপ থেকে বললেন, “ও কখনও কিশোরী ছিল না। নদী তো তাকে চেনে। সে গায়, নদী তার কথা জানে। আমি মনে করি, সে যদি ফেরে, তো এঁর থেকে বেশি কিছু কেউ জানবে না। নদী জানে, তাই…”
বৃদ্ধা কথা শেষ না করেই চুপ হয়ে গেলেন। রুক্মিণী আর অর্ণব একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তাদের মনে হাজারটা প্রশ্ন, হাজারটা কথা। গলির কোণায় যেখানে বাঁশঝাড় ছিল, সেখানে ছোট একটি বাড়ি একসময়ে ছিল কিনা, তার কোনে কিছু কি রহস্য ছিল? তারা তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে রওনা হলো। সেই ভোরের কনকনে ঠাণ্ডায়, কুশলনগরের ছায়ায় তারা যেন খুঁজে চলেছে কিছু, যা কখনও তাদের পরিবারের কাছে ছিল না।
বাড়ির পথ ধরে তারা চলে গেল। এখনও কিছু লোক কাজ করছিল রাস্তার পাশে, সাইটে যেভাবে কংক্রিট লেগেছে, তাতে আর কোনো উঁচু বাঁশঝাড় থাকবার কথা নয়। কিন্তু রুক্মিণী কল্পনা করছিল, এই ঘোরাঘুরির মাঝে সেই গায়িকা হয়তো কোথাও হারিয়ে গেছে, গানের সঙ্গে হয়তো ছিল তার আরেকটি আসল চেহারা।
অর্ণব বলল, “তুমি ঠিকই বলেছিলে—দাদুর জীবনে যেন একটা অসমাপ্ত প্রেমের গল্প ছিল। কিন্তু শোভনা যদি সত্যিই ফিরে আসে… এই ডায়রিটা খুঁজে পাওয়ার পর, তার জীবনটা কি সবকিছু বদলে যাবে?”
“এটা কিন্তু গোপন থেকে গোপনেই ছিল,” রুক্মিণী বলল। “কেউ কিছু জানত না। আর ডায়রির লেখা সবকিছুই তো আমাদের জীবনের গতি বুঝতে পারবে না। তবে কীভাবে এত বছর পর আমাদের সামনে এসে পড়ল? না জানি কী কিছু ছিল, যা সে নিজেও ধারণ করতে পারেনি। হতে পারে, এই ডায়রি আমাদের জন্য ছিল, আমাদের কাছে এক নতুন দিগন্ত খুলে দেওয়ার জন্য।”
তারা সেই বাড়ির পাশে এসে দাঁড়াল। দরজাটা আধখোলা ছিল। রুক্মিণী ধীরে ধীরে দরজাটি খুলে ভিতরে প্রবেশ করল। বাড়িটি এত পুরনো, একসময় একটা সময়ের সাক্ষী ছিল, এখন আর কেউ সেখানে থাকে না। পোকামাকড় এবং কাঠের গন্ধ ভেতরে ভর করেছে।
বাড়ির এক কোণে কাঠের আলমারি ছিল, যা কয়েক বছর আগে পর্যন্ত টিকে ছিল। অর্ণব আলমারি খুলে কিছু খুঁজতে লাগল। “রুকু, দেখো এটা!” অর্ণব একটা পুরনো কাগজ বের করল। কাগজে লেখা ছিল, “এটাই শোভনার শেষ চিঠি। সে এই শর্তে চলে গেল, যে একদিন ফিরবে।”
রুক্মিণী চমকে গিয়েছিল। তার সামনে একটা অজানা গাঁথা খুলে গিয়েছিল। “শেষ চিঠি? কি লিখেছিল সে?”
অর্ণব বলল, “তবে তো কিছু রহস্য রয়ে গিয়েছে। যদি সে কখনও ফিরে আসে, তবে হয়তো আমাদের সামনে দারুণ একটা গল্প অপেক্ষা করছে।”
তারা আরও কিছু কাগজ খুঁজতে লাগল। আর কিছু সময় পরেই তারা একটা পুরনো ছবি পেল, যা ছিল শোভনার এবং তার দাদুর। ছবির পিছনে লেখা ছিল, “শেষ দেখা। এটা ছিল একটা বিদায়।”
রুক্মিণী ছবিটি হাতে নিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। ছবির মধ্যে একটা নির্ভেজাল প্রেমের অনুভূতি ছিল। ছেলেটি ছিল হালকা হাসি নিয়ে, আর মেয়েটি ছিল সেই হাসির সাথেই জীবনের প্রথম ভালোবাসায় ডুবে।
অর্ণব বলল, “এই গল্পটা কোথায় গিয়েছিল, রুকু?”
“এটাই তো এখন প্রশ্ন।” রুক্মিণী ধীরে ধীরে বলল। “এটা ছিল তাদের শুরু, কিন্তু কোথায় শেষ হলো?”
অর্ণব চোখ তুলে বলল, “মাঝে কোথাও কিছু লুকিয়ে থাকলেও, সেটা আমাদের খুঁজে বের করতেই হবে। মনে রাখো, দাদুর অসমাপ্ত প্রেম আর শোভনার গল্প শেষ হবে আমাদের হাতে।”
ওরা আবার সেই কাঠের ব্রিজের দিকে হাঁটতে থাকল। সেদিন সন্ধ্যায় নদীর তীর ধরে, বৃষ্টির আগে আকাশের ওপর অন্ধকার নেমে এসেছিল। রুক্মিণী আর অর্ণব জানত, তাদের এই যাত্রা এখানেই থামবে না, শোভনার গল্প তাদের অব্যাহত রাখবে।
রুক্মিণী তার ভাইকে বলল, “কিছু দিন বাদে ফিরে এসে আবার ব্রিজের নিচে কিছু পাবে। আমি নিশ্চিত।”
অর্ণব মাথা নেড়ে বলল, “হয়তো, কিন্তু তখন হয়তো আমরা না থাকব।”
রুক্মিণী ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে বলল, “এই প্রেমের ছায়া আর কখনো মুছবে না।”
পরদিন সকাল সকাল, কুশলনগরের আকাশে মেঘের কালো রং একে একে সরতে লাগল। নদীর পাড়ে সোনালি রোদ পড়েছে। বাতাসে আর্দ্রতা এখনো কিছুটা রয়ে গেছে, কিন্তু কল্পনার মতো বিশাল কিছু একটা যেন শ্বাস নিতে শুরু করেছে। রুক্মিণী আর অর্ণব গতকাল সন্ধ্যায় যেখান থেকে ফিরে এসেছিল, আজ সেখানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। চায়ের কাপ হাতে রুক্মিণী বলল, “আমরা যদি শোভনাকে খুঁজে না পাই, তাহলে দাদুর প্রেমের গল্প কিভাবে শেষ হবে?”
অর্ণব খানিকটা চুপ থেকে বলল, “আমরা তো অনেক কিছুই জানি না। এই ডায়েরির পাতায় বেশ কিছু অসমাপ্ত জায়গা আছে। কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্যটা শুধু এইটাই—তাকে খুঁজে বের করা।”
ডায়েরির কথাগুলো ওদের মাথায় ঘুরছিল। অতীতের প্রেমের গল্প, এক অসম্পূর্ণ সম্পর্ক, এক ঐতিহাসিক ভুল বোঝাবুঝি—সেসব তাদের মনের মধ্যে ধীরে ধীরে জেগে উঠছিল। ডায়েরির পাতা খুলে শোভনা আর দাদুর সম্পর্কের এক অস্পষ্ট চিত্র সামনে আসছিল, যেটা কেবল বিশ্বাস আর নীরব অভ্যস্ততা থেকেই তৈরি হয়েছিল।
তারা একসঙ্গে আবার সেই বাঁশঝাড়ের পেছনে গেল। গতকাল যা কিছু খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল, তাতে মনে হচ্ছিল, শোভনার জীবন কেবল একটা রূপকথার মতো ছিল, যেখানে প্রেমের কোলাহল ছিল, কিন্তু বাস্তবের কঠিন সত্যের মধ্যে তারা হারিয়ে গিয়েছিল। গতকাল তাদের মনে প্রশ্ন ছিল, শোভনা কোথায় গিয়েছিল, কেন গিয়েছিল, এবং কিভাবে হারিয়ে গেল। কিন্তু তাদের আরো একটি প্রশ্ন ছিল—কেন এই সম্পর্ক, এই প্রেম এত গোপন, এত অদৃশ্য ছিল?
অর্ণব বলল, “আমরা তো জানি না। কিন্তু আমরা যদি আসল উত্তর খুঁজে না পাই, তাহলে এই জায়গা, এই গ্রাম, এই ব্রিজ—সবকিছুই নষ্ট হয়ে যাবে। দাদুর সব কিছু অদৃশ্য হয়ে যাবে।”
রুক্মিণী মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক বলেছিস। দাদু তো কখনো শোভনার নাম উচ্চারণ করত না। আমরা কি জানি, তার বাকি জীবনটা কিভাবে কাটল?”
তারা সেই এলাকার এক পুরনো দালানের পাশ দিয়ে হাঁটতে থাকল। বাতাসে একটু তাজা গন্ধ ছিল, হয়তো বৃষ্টি আসার সম্ভাবনা ছিল। অর্ণব কিছুটা গম্ভীর হয়ে বলল, “রুকু, মনে পড়ে তো তুমি বলেছিলে, আমাদের দাদু না কি বাউল ছিল?”
“হ্যাঁ, আমি শুনেছিলাম। দাদু আর দিদা প্রথমে এখানে থাকতে এসেছিল। সেখানেই দাদু গান গাইত। কিন্তু শোভনার সঙ্গে তার গল্প কখনো শোনানো হয়নি।”
“তাহলে, শোভনা কি সেই বাউল গানের মেয়ে ছিল?” অর্ণব প্রশ্ন করল।
“এটা তো সত্যি হতে পারে,” রুক্মিণী একটু থামল, “কিন্তু আমাদের সঠিক উত্তর জানতে হবে। এই গ্রাম, এই ব্রিজ—সব কিছু সঠিক অবস্থানে রাখার দায়িত্ব আমাদেরই।”
পথের ধারে তারা এক ছোট দোকানে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিল, যখন হঠাৎ তাদের চোখ পড়ল একটি পুরনো লোকের দিকে, যিনি দোকানের ভেতর থেকে বাইরে বের হচ্ছিলেন। তার চোখ ছিল খানিকটা চিন্তিত, কিন্তু রুক্মিণী যেন তাকে কোথাও দেখে মনে পড়তে লাগল। লোকটি তার দিকে এগিয়ে এসে বলল, “তুমি তো রুক্মিণী, না?”
রুক্মিণী অবাক হয়ে বলল, “হ্যাঁ, আপনি কে?”
লোকটি মুখে এক হালকা হাসি দিয়ে বলল, “আমি ছিলাম সেই সময়টা। শোভনার সঙ্গে, আর তোমার দাদুর সঙ্গেও কিছু সময় ছিল। আমি একজন পুরনো বন্ধু।”
“তাহলে আপনি কি জানেন শোভনার সম্পর্কে?” রুক্মিণী তৎক্ষণাৎ জানতে চাইলো।
লোকটি মাথা নেড়ে বলল, “সব কিছু জানি না। তবে যা জানি, সেটা বলব। তবে তুমি তো শোভনার কথা জানলে, তার জন্য তুমি কী করতে চাও?”
রুক্মিণী আর অর্ণব একে অপরকে অবাক চোখে দেখল। লোকটি বলে যাচ্ছিল, “শোভনা ছিল এক গানের মেয়ে, একদম নিঃসঙ্গ। কখনো সে পালিয়ে গিয়েছিল, কখনো হারিয়ে গিয়েছিল। তবে তার জীবন ছিল অন্যরকম। একেবারে অদৃশ্য এক গন্তব্যে। তার সাথে এক অজানা সম্পর্ক ছিল, আর সেটার মাঝেই সে হারিয়ে গিয়েছিল। সে ছিল দাদুর প্রিয়। আমি জানি না, তবে তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকতে… এটা ছিল কষ্টের।”
“কিন্তু সে কোথায় গিয়েছিল?” অর্ণব উত্তেজিত হয়ে বলল।
লোকটি নিঃশ্বাস ফেলল, “জানো, শোভনা ছিল এক অদৃশ্য সত্তা, অনেক মানুষ ভেবেছিল তার জীবনটা শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু কেউ জানতো না, সে কেবল এক গানের মেয়ে ছিল।”
রুক্মিণী সজাগ হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কীভাবে সে গেল, কোথায় গেল?”
লোকটি ঝুঁকে গিয়ে বলল, “সে যে গানের পথে চলেছিল, তাকে কোনোভাবেই থামানো সম্ভব হয়নি। সে অদৃশ্য, জীবন্ত হয়ে, যেন এক ঝলক, একটা সুরেই হারিয়ে গিয়েছিল। আর সেই সুরটাই বেঁচে আছে আজও, কুশলনগরের এই বাতাসে।”
রুক্মিণী আর অর্ণব একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল। তাদের মনের মধ্যে, শোভনার গল্প এক অজানা পথে পৌঁছে যাচ্ছিল।
“এটা আমাদের দাদুর অসমাপ্ত গল্পের একটি নতুন দিক। কিন্তু কি ঘটেছিল, কেন সে হারিয়ে গেল, আজও অজানা।” রুক্মিণী বলল।
অর্ণব বলল, “তবে একটা কথা মনে রেখো, রুকু। শোভনার প্রেমের অজানা প্রান্তই হবে আমাদের শেষ অধ্যায়।”
তারা একে অপরকে দেখে, শোভনার অবাস্তব গল্পের গোপন ছায়ায় আটকে থাকল, জানল না, আসল সত্যের দিকে এগোতে তাদের কতটা সময় বাকি ছিল।
শোভনার রহস্য আরও গভীর হতে লাগল। রুক্মিণী আর অর্ণব জানত, তারা শোভনার অতীতের অজানা প্রান্তে পৌঁছাতে অনেক কিছুই জানতে হবে। তবে গত কয়েক দিনের অনুসন্ধান তাদের সামনে এক নতুন দ্বার খুলে দিয়েছে, যেখানে একে একে প্রশ্নগুলো উঠছিল, কিন্তু উত্তরগুলো আরও বেশি লুকিয়ে থাকছিল। আজকের দিনটা তাদের কাছে ছিল একটা নতুন শুরু—তাদের অন্তর্দৃষ্টি যেন আরও প্রসারিত হচ্ছিল, তারা যেন শোভনার মধ্যে নিজের কিছু খুঁজে পাচ্ছিল।
তারা বাড়ি ফিরে আসার পথে দোকানদারদের সঙ্গে আরও কিছু কথা বলল। কিন্তু সবাই বলছিল একই কথা—শোভনা একদিন হারিয়ে গিয়েছিল। কেউ জানত না সে কোথায় গিয়েছিল। সবার মধ্যে একটা অজানা ভয় ছিল, যেন শোভনা কেবল অদৃশ্য নয়, সে একটা অপ্রত্যাশিত অধ্যায়ের প্রতীক। সময়ের সঙ্গে তার অস্তিত্ব মুছে গেছে, তবে তার ছায়া এবং গান যেন আজও আছেই। এমনকি গ্রামের গাছপালা, নদী আর বাতাসও তাকে মনে রাখে।
রুক্মিণী আর অর্ণব সেদিন রাতেই ঠিক করল, তাদের আরও খোঁজ করতে হবে। তারা জানত, শোভনার আর দাদুর সম্পর্ক কখনো শেষ হয়নি, কিন্তু কেন এই সম্পর্কটি গোপন ছিল, কেন কখনো প্রকাশ পায়নি, তা এখনো অজানা। পরের দিন তারা আবার একবার সেই পুরনো ব্রিজের কাছে ফিরে যাবে—যেখানে এই গল্প শুরু হয়েছিল, যেখানে সেই অদৃশ্য প্রেমের প্রথম সুর বাজেছিল।
কুশলনগরের ব্রিজের তীরে এসে দাঁড়িয়ে রুক্মিণী এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল। তার চোখের সামনে যেন উন্মুক্ত হয়ে গেছিল শোভনার অস্তিত্ব—একটি নির্জন, অব্যক্ত প্রেম, যে প্রেমে কোনো শেষ ছিল না। সে বলল, “অর্ণব, এখানে কী ছিল আমাদের দাদুর জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান গোপনীয়তা? আমরা জানি না। কিন্তু এখানকার বাতাসে যে কোনো সময় শোভনার গান ফিরে আসবে।”
অর্ণব কিছুটা অবাক হয়ে রুক্মিণীর দিকে তাকাল। “তুমি কি বুঝতে পারছ, রুকু, এই সমস্ত কিছু জানতে গিয়ে আমরা নিজেকেই হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছি? আমার মনে হয়, আমাদের আরও গভীরে যাওয়ার সময় এসেছে। হয়তো এখনই কিছু খুঁজে পাব, যা আমরা আগে কখনো ভাবিনি।”
কথাগুলো শুনে রুক্মিণী আর একবার সজাগ হয়ে ওঠে। শোভনার প্রেমের ছায়া তাদের সঙ্গেই থাকছে, যেন তারা কেবল সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ঠিক কী ছিল শোভনার গানের মধ্যে, সে গান কীভাবে তাদের জীবনে ঢুকেছিল, সেটাই তাদের জন্য এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। তবে রুক্মিণী জানত, তারা যখন শোভনার জীবন খুঁজে পাবে, তখনই দাদুর প্রেমের শেষ অধ্যায় খোলাসা হবে।
তারা সেই দিন সন্ধ্যায় এক জায়গায় বসে ডায়েরির পাতা পড়তে লাগল। ডায়েরির শেষ কিছু পাতায় লেখা ছিল:
“শোভনা, তুমি চলে গেলে, কিন্তু আমার মনে তোমার ছায়া রয়ে গেল। আমি জানি, তুমি কখনো আমাকে ভুলবে না। কিন্তু আমি ভুলতে পারি না। আমি জানি, তুমি কোথাও আছো, তোমার গান এখনও বাতাসে ভাসছে, আমি শুধু অপেক্ষা করি তোমার ফিরে আসার জন্য।”
রুক্মিণী মনে মনে ভাবছিল, এই প্রেম কি সত্যিই অসম্পূর্ণ ছিল, না কি এটি একটা গভীর বিশ্বাসে পরিণত হয়েছিল? সেই ডায়েরির কথাগুলো যেন তাদের জীবনের এক নতুন দিক দেখাচ্ছিল। যদিও তাদের সামনে কিছু অস্পষ্টতা ছিল, কিন্তু রুক্মিণী জানত, এই অসমাপ্ত গল্প তাদেরকে এক অজানা পথে নিয়ে যাবে।
পরদিন, রুক্মিণী আর অর্ণব কুশলনগরের অন্য এক প্রান্তে গেল। সেখানকার এক পুরনো মহিলা ছিল, যিনি আগে এখানে বাস করতেন এবং শোভনার সাথে কিছু সময় কাটিয়েছিলেন। মহিলা তাদেরকে বললেন, “শোভনা ছিল এক অদ্ভুত মেয়ে, কোনো সময় সে অন্যদের মতো নয়। তবে তার গান শুনে মনে হত, সে জানত না সে কোথায় যাচ্ছে, কিন্তু তার গান যেন কিছু একটা জানিয়ে যাচ্ছিল।”
মহিলার কথা শুনে, রুক্মিণী জিজ্ঞেস করল, “তাহলে, শোভনা কোথায় গিয়েছিল?”
মহিলা মাথা নেড়ে বললেন, “সে একদিন নদীর পাড়ে গান গাইতে গিয়েছিল, তারপর আর ফিরেনি। অনেক খোঁজা হয়েছিল। কিন্তু সে যে গায়, সে যে কখনো হারিয়ে যাবে, সেটা কেউ ভাবেনি।”
এখন রুক্মিণী আর অর্ণব সত্যিই ভেবে পাচ্ছিল না কী করতে হবে। তারা পুরো কুশলনগর চষে ফেলেছে, কিন্তু কোথাও শোভনার কোন সঠিক চিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু এমন সময়, যখন তারা আরেকটি পুরনো বাড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়াল, তারা দেখতে পেল দরজার পাশে একটি নতুন নামফলক ঝুলছে। নামটা ছিল “শোভনার গান।”
রুক্মিণী আর অর্ণব একে অপরকে তাকিয়ে দেখে, গম্ভীরভাবে ঢুকল সেই বাড়ির ভেতরে। বাড়ির মধ্যে একটি পুরনো কাঠের পিয়ানো ছিল, পাশে একতারা রাখা ছিল। পিয়ানোর কাছে বসে, অর্ণব একটা বই খুলে বলল, “এই বইটা দাদু আর শোভনার গল্পের একটা অংশ হতে পারে। হয়তো এখানে কিছু পাওয়া যাবে।”
রুক্মিণী বইয়ের পাতাগুলো উল্টাতে লাগল, এবং হঠাৎ করে একটি লুকানো চিঠি বেরিয়ে এল। চিঠিতে লেখা ছিল:
“শোভনা, তুমি কখনো আমার ভালোবাসার কথা বুঝতে পারবে না। তবে জানো, তুমি একদিন ফিরে আসবে, এবং তখন আমরা একসাথে গান গাইব।”
এটা দাদুর লেখা ছিল।
চিঠি হাতে নিয়ে রুক্মিণী আর অর্ণব একে অপরকে অবাক হয়ে দেখছিল। যে চিঠি তারা পেয়েছিল, তা ছিল দাদুর শেষ শব্দ। রুক্মিণী চিঠিটি পুরোটা পড়তে শুরু করল।
“শোভনা, তুমি জানো না, কীভাবে তোমার গান আমার অন্তর স্পর্শ করেছিল। আমি জানতাম না তুমি যে হারিয়ে যাবে, আমি জানতাম না তোমার খোঁজ আমার জন্য অমীমাংসিত হয়ে থাকবে। কিন্তু আজ আমি জানি, তুমি একদিন ফিরবে, ফিরে এসে সেই গান গাইবে। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব, তুমি ফিরে এলেই বুঝতে পারবে যে প্রেম কখনো থামেনি।”
এটি ছিল একটা বিরাট উন্মোচন। দাদু আর শোভনার সম্পর্কের গোপন কথাগুলো যেন একেবারে খোলাসা হয়ে যাচ্ছিল। রুক্মিণী কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তার মাথার মধ্যে অসংখ্য প্রশ্ন ছিল। কেন দাদু এই সম্পর্ক গোপন রেখেছিলেন? কী এমন কারণে তাদের দুজনের মধ্যে এতো বড় বাধা এসেছিল যে, তাদের প্রেম কোনোদিন পূর্ণতা পায়নি?
অর্ণব বলল, “তবে, শোভনার গান তো এখনও বাতাসে ভাসছে। তুমি নিজেও তো বলেছিলে, তুমি গানের মধ্যে তার উপস্থিতি অনুভব করতে পারো।”
রুক্মিণী হেসে বলল, “হ্যাঁ, প্রতিদিন সকালে, আমি যখন এই ব্রিজের কাছ দিয়ে যাই, আমি শুনতে পাই শোভনার গানের সুর। এটা সত্যি কি না, জানি না। কিন্তু মনে হয়, তার গানের মধ্যে কিছু রহস্য ছিল।”
“আমরা কি জানি, এই গানের সঙ্গে কোনো আধ্যাত্মিকতা ছিল?” অর্ণব বলল। “এটা হয়তো কোন এক অদৃশ্য শক্তির মতো ছিল। হয়তো দাদুর জীবনের সঙ্গে শোভনার সম্পর্কের রহস্য এই আধ্যাত্মিক সুরের মধ্যে লুকিয়ে ছিল।”
রুক্মিণী তার ভাইয়ের কথায় একমত হয়ে মাথা নেড়ে বলল, “হয়তো। কিন্তু আমরা কখনো জানব কি, শোভনা কোথায় গেছে?”
অর্ণব একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমাদের আর কোনো পথ বাকি নেই। আমাদের শোভনার গান শোনার জন্য, আর তার প্রেমের গল্পের শেষ দেখতে, একমাত্র পথ হলো এই গ্রাম আর এই ব্রিজের কাছ থেকে সত্যিটা খুঁজে বের করা।”
তারা আরও কিছু সময় ঐ বাড়ির মধ্যে কাটাল, এবং ঠিক করল, তারা কুশলনগরের বিভিন্ন প্রান্তে আরও কিছু খোঁজ করবে। একদিন এক পুরনো কাঠের দোকানে গিয়ে তারা কিছু নতুন তথ্য পেল। দোকানদার বললেন, “আমার বাবা শোভনার সঙ্গে ভালো বন্ধু ছিল। তাকে একদিন গাইতে শুনেছিলাম। সে কি ছিল জানি না, কিন্তু তার গান শুনলে মনে হয়, সে নিজেই এক গান হয়ে গেছে।”
রুক্মিণী ও অর্ণব আরও একবার বিস্মিত হয়ে তাকাল। তাদের ধারণা ছিল, শোভনা শুধু একটি মানুষ ছিল, কিন্তু আসলে সে যেন এক সুর, এক রূপকথা, যার গাঁথা চলে গেছে কুশলনগরের আকাশে, বাতাসে। তার প্রেম ছিল অসম্পূর্ণ, তবে সে কখনো ভুলেনি। সেই প্রেম, সেই গান, সেই ছায়া—আজও কুশলনগরে বয়ে চলেছে।
সন্ধ্যার দিকে, রুক্মিণী আর অর্ণব কুশলনগরের ব্রিজের কাছে এসে দাঁড়াল। ঘাসের ওপর এক ঝাঁক পাখি উড়ে চলে যাচ্ছিল। নদীর জল ঝিকমিক করছে, যেন কিছু একটা সুরে বাজছে। রুক্মিণী আকাশে তাকিয়ে বলল, “এটা সত্যি মনে হচ্ছে না, অর্ণব। আমি মনে করি, শোভনা আর দাদুর প্রেমের গল্প কখনো শেষ হবে না। শোভনার গান সবসময় কুশলনগরের আকাশে ভাসবে, যতদিন না কেউ এই সুর বুঝবে।”
অর্ণব তার বোনের কথা ভাবছিল। তবে সে জানত, আজ থেকে এই ব্রিজের তীরে দাঁড়িয়ে, তারা কেবল শোভনার গল্প খুঁজে পাবে না, বরং দাদুর অসম্পূর্ণ প্রেমও তাদের জীবনে একটি নতুন দিক খুলে দেবে। “তুমি ঠিক বলেছ, রুকু। শোভনা হয়তো ফিরে আসবে না, কিন্তু তার গান শোনার মধ্য দিয়ে আমরা তার কাছাকাছি পৌঁছতে পারব। তার প্রেম কখনো মুছে যাবে না।”
এদিন সন্ধ্যায়, কুশলনগরের তীরের কাছাকাছি একতারা বাজানোর আওয়াজ শুনে রুক্মিণী বলল, “শোনো, ওটা কি শোভনার গান?”
অর্ণব মাথা নেড়ে বলল, “এটা একটা গল্প, রুকু। হয়তো সেই গল্প শেষ হয়নি, কিন্তু আমাদের সামনে এখন আরো একটি নতুন অধ্যায় রয়েছে।”
পথে হাঁটতে হাঁটতে রুক্মিণী আর অর্ণব বুঝতে পারছিল, তারা যা খুঁজে বের করেছে তা কেবল শোভনার গানই নয়, বরং দাদু ও শোভনার প্রেমের চিরকালীন প্রকৃতির সন্ধান। একদিন তারা হয়তো এই গল্প পুরোপুরি জানতে পারবে। কিন্তু ততদিন পর্যন্ত, কুশলনগরের কাঠের ব্রিজের কাছে এসে, তারা বাকি সব গল্প, সব প্রেমের মতই শুনতে থাকল—শোভনার গান, যার সুর আজও বাতাসে ভাসছে।
রুক্মিণী আর অর্ণব জানত, তাদের অনুসন্ধান এখানেই শেষ হবে না। কুশলনগরের এই ব্রিজ, এই নদী—এগুলো ছিল তাদের দাদুর জীবনের সেই অধ্যায়, যা আজ পর্যন্ত সবার কাছে অজানা ছিল। শোভনার গান আর প্রেমের গল্প এখন তাদের হাতে। কিন্তু এই গল্পের শেষটা কোথায়? তাদের কাছে সবসময় মনে হয়েছে, কিছু একটা অধরা, কিছু একটা অসম্পূর্ণ থেকে গেছে।
পরের দিন সকালে, তারা সিদ্ধান্ত নিল, তারা শোভনার গানের সন্ধান করবে, কিন্তু শুধু তাতে আটকে থাকবে না। তারা জানে, এই গান আর প্রেমের গল্প কেবল কুশলনগরের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। শোভনা ছিল এক শিল্পী, যে কেবল গানের মাধ্যমে তার হৃদয়ের গভীরতা প্রকাশ করেছিল। সেই গান, সেই শিল্প, সেই প্রেম—এটা হয়তো কোথাও চলে গেছে, আরও দূরে।
অর্ণব বলল, “আমরা যদি শোভনার কাছে পৌঁছাতে চাই, তবে আমাদের শুধু গানটা শুনে থাকতে হবে না। তার জীবনের সেই মুহূর্তগুলোও খুঁজে বের করতে হবে, যেগুলো তার জীবনকে এক নতুন দিশা দিয়েছে।”
রুক্মিণী মাথা নেড়ে বলল, “তবে আমাদের সত্যি জানতেই হবে, শোভনা কোথায় গেল। তার গান, তার জীবন, সে কেবল কুশলনগরের সীমায় ছিল না। আমরা যদি তার প্রেমের গল্প জানি, তবে আমরা তার সুরগুলো বুঝতে পারব।”
তারপর তারা সেই পুরনো লোকটির কথা মনে করল। তাকে যখন তারা জিজ্ঞেস করেছিল শোভনার সম্পর্কে, তখন সে বলেছিল, “গানটা ছিল অন্যরকম। শোভনা ছিল যেন এক অদৃশ্য সুর, যা কখনো শেষ হতে পারে না।” সে আরও বলেছিল, “দাদু ও শোভনার সম্পর্ক কখনো সম্পূর্ণ হয়নি। শোভনা যে চলে গিয়েছিল, তার কারণ কিছু গোপন ছিল। এটা ছিল জীবনের এক বড় বাঁক, যেটি সবার জন্য অজানা।”
তারা সেই লোকটির কথা মনে করছিল, তবে সেও তো একটা ধাঁধার মতো ছিল, কিছু না বলেই চলে গিয়েছিল। কিন্তু কেন, কেন সে এভাবে অজানা রেখে গেল? শোভনার সেই গান, সেই সুর, তার প্রেম—সবই যেন তাদের কাছে একটা সেলাই করা গল্পের মতো ছিল, যেখানে কিছু একটার অভাব ছিল।
“আমরা যদি সত্যিই শোভনার গল্প খুঁজে বের করতে চাই, তাহলে আমাদের কুশলনগরের অজানা জায়গাগুলো দেখতে হবে,” অর্ণব বলল। “আমরা হয়তো তার অক্ষত গল্পটা জানবো না, কিন্তু তার পিছনের কিছু মুহূর্ত খুঁজে পেলে আমাদের ধারণা স্পষ্ট হতে পারে।”
রুক্মিণী বলল, “আমরা একে একে পুরনো কাঠের দোকান, বাড়ি, গাছের তলা, সব জায়গা দেখব। একদিন শোভনা হয়তো এখানে ফিরে আসবে। কিন্তু তার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। আর খুঁজতে হবে তাকে।”
তারা একদিন বিকেলে, যখন সূর্য নিঃশব্দে নিচে নামে, তখন আবার পুরনো ব্রিজের কাছে ফিরে গেল। নদীর জল আজও আগের মতোই ঝিকমিক করছিল। সেই জল, সেই বাতাস—সব কিছু যেন শোভনার গানকে আরও জীবন্ত করে তুলছিল। রুক্মিণী আর অর্ণব একসঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিল। তারা জানত, তারা যে গল্প খুঁজছে, তার শেষ এখনো দূরে।
“তুমি কি মনে কর, শোভনা কখনো আমাদের কাছে ফিরে আসবে?” রুক্মিণী হঠাৎ প্রশ্ন করল।
অর্ণব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “না, আমি মনে করি না। সে আমাদের কাছে ফিরে আসবে না, কিন্তু তার সুর, তার গান আমাদের সঙ্গেই থাকবে। সে যে কোনও একদিন ফেরে না, তার কারণ ছিল—যেটা আমরা জানি না।”
“তবে আমরা জানতেও পারব না। আমরা জানতেও চাই না। তবে তার গান শুনে বুঝতে পারব। এর মধ্যেই তার সব কিছু প্রকাশিত।” রুক্মিণী বলল, “এটা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়, কিন্তু এই অসম্পূর্ণ গল্পই শোভনার জীবনের শেষ অধ্যায় হয়ে দাঁড়াবে।”
এইসব কথা বলার পর, রুক্মিণী আর অর্ণব আবার ব্রিজের পাশের নদীতে একপাল পাখির উড়ন্ত দৃশ্য দেখল। পাখিরা আকাশে একে একে গমন করছিল। ঠিক তখনই রুক্মিণী একটা খোলা পাতা দেখতে পেল, সাদা কাগজের ওপর কিছু লেখা ছিল। সেই লেখা শোভনার শেষ চিঠির অংশ ছিল, “আমি তোমাকে ভালোবেসেছিলাম, কিন্তু তোমার জীবন আর আমার জীবনের পথ কখনো এক হবে না। তবে আমি জানি, আমার গান তোমার হৃদয়ে থাকবে। এই গান, এই সুর—কখনো শেষ হবে না।”
রুক্মিণী আর অর্ণব চমকে উঠল। এই ছিল সেই চূড়ান্ত প্রকাশ, যা তারা খুঁজছিল। শোভনার গান, তার প্রেম, তার ইতিহাস—এই সবকিছু ছিল অদৃশ্য, ছিল এক সুরের মধ্যে মিশে। তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে ছিল শোভনার প্রেমের এক নতুন দিক, যা এতদিন তারা অজানা রেখেছিল। শোভনার সেই চিঠি, সেই গান—সবই তাদের কাছে এক নিঃশেষে প্রাপ্তির মতো ছিল।
অর্ণব হেসে বলল, “তুমি জানো, রুকু, শোভনার গল্পের শেষ অংশটা হয়তো আমরা কখনোই জানতে পারব না। কিন্তু তার গান, তার প্রেম, তার সুর—এসব আমাদের সঙ্গেই থাকবে। এটা আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা।”
রুক্মিণী মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, তার গান কেবল কুশলনগরের ব্রিজের কাছে নয়, আমাদের হৃদয়ে চিরকাল থাকবে।”
তাদের সামনে শোভনার সুর আর প্রেম, এই অদৃশ্য সম্পর্ক, ছিল একটি চিরকালীন ছায়া। কুশলনগরের কাঠের ব্রিজের নিচে, শোভনার গান আজও ভাসে, প্রতিদিন ভেসে চলে যাচ্ছে।
রুক্মিণী আর অর্ণব জানত, তারা আর কখনো শোভনার গল্পের পুরোটা জানতে পারবে না। কিন্তু কুশলনগরের এই ব্রিজ, এই নদী, এই বাতাস—এসব এখন তাদের জীবনের অংশ হয়ে গেছে। এই অদৃশ্য প্রেমের গল্প, এই গান, যা শোভনার হৃদয়ে ছিল, তারা যেন সেগুলোর অংশ হয়ে উঠেছিল। আর এই গান, এই গল্প, তাদের সামনে কখনো কখনো জীবনের মতো সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
তারা সকালে আবার ব্রিজের কাছে গেল, নদীর তীরে হাঁটতে লাগল। সেই ভোরের আলো, সেই ঠান্ডা হাওয়া, সেই গাঢ় গন্ধ—সব কিছু যেন শোভনার অব্যক্ত প্রেমের মতো চিরকাল বয়ে চলেছে। অর্ণব নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে বলল, “তুমি কি মনে কর, শোভনার সেই গান, তার প্রেম—এটা শুধু কুশলনগরের তীরে ছিল?”
রুক্মিণী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “না, এই গান, এই প্রেম—এটা একদিকে গোপন, আর অন্যদিকে প্রকাশিত। তার সুর বাতাসের মতো, শুধু এখানে না, পৃথিবীর কোনো কোণায়, কোনো মানুষের হৃদয়ে ভাসতে থাকবে।”
তারা নদীর পাড়ে আরও কিছু সময় হাঁটল, গানের সুর মনে রেখেই। তারপর রুক্মিণী বলল, “এখানে, এই জায়গায়, কোনো কিছু অক্ষত রয়ে গেছে। শোভনার গান এখানে প্রহেলিকার মতো বাস করছে। তার জীবনের যে অংশটা অসম্পূর্ণ ছিল, তার সুর যেন তা পূর্ণ করেছে।”
অর্ণব মাথা নেড়ে বলল, “আমরা হয়তো কখনো তার গান, তার প্রেম, তার জীবন জানব না, কিন্তু এটাই আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা। শোভনার মতো একজন মানুষকে বুঝতে গেলে তার গান শুনতে হবে, তার আত্মার গভীরে প্রবেশ করতে হবে।”
তারা ফিরে আসতে লাগল, কিন্তু তাদের মনে একটা ভাবনা ছিল—যতটুকু খুঁজে পেয়েছিল তারা, ততটুকু সত্যি বা না, তারা জানত না। কিন্তু একটা বিষয় তাদের মনে ছিল, শোভনা, তার প্রেম, তার গান, সব কিছু যেন এক অসমাপ্ত গল্প হয়ে রয়ে গেছে। তারা যখনই এই ব্রিজের কাছে আসবে, তার গান, তার প্রেম, তার অদৃশ্য সুর তাদের মনে ফিরে আসবে।
ঘণ্টা খানেক পর, তারা একটি ছোট্ট চায়ের দোকানে বসে কফি পান করছিল। দোকানদার বলল, “এই ব্রিজের কাছেই ছিল শোভনা। আমি তো তাকে জানি না, কিন্তু তার গান সবসময় শুনেছি। মনে হয়, তিনি কোথাও নেই, কিন্তু তার গান বাতাসে ভাসে।”
রুক্মিণী একটু চিন্তা করে বলল, “তাহলে, দোকানদারও জানত, শোভনা ছিল এখানে। কিন্তু সে কেন হারিয়ে গেল?”
দোকানদার ধীরে ধীরে বলল, “সে ছিল এক গানের মেয়ে। তার জীবন এক রূপকথার মতো। কখনো সে হারিয়ে গিয়েছিল, কখনো আবার ফিরে আসত। কিন্তু তার ফিরে আসা কখনো সম্পূর্ণ হয়নি। সে শুধু গান গাইত, আর সেই গানের মধ্যে কিছু ছিল যা তার জীবনকে পুরোপুরি পূর্ণ করেছিল।”
এতক্ষণ শুনে, রুক্মিণী আর অর্ণব একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল। কিছু একটা উপলব্ধি হচ্ছিল তাদের—শোভনা ছিল এক আশ্চর্য সত্তা, যার অস্তিত্ব কেবল গান এবং প্রেমের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। তার কাছে, তার গানই ছিল তার জীবন। আর তার এই গান, একদিন কুশলনগরের তীরে শোভনা হারিয়ে গেলেও, তার সুর আজও বাতাসে ভেসে যায়।
“শোভনা হয়তো কখনো ফিরবে না,” অর্ণব বলল, “কিন্তু তার গান, তার প্রেম—এই জায়গায়, এই বাতাসে, সে থাকবে চিরকাল।”
রুক্মিণী আকাশে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ, তার গান আর প্রেম কখনো থামবে না। সব জায়গায়, সব মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে যাবে।”
বিকেলে, যখন তারা কুশলনগর ছেড়ে শহরের দিকে ফিরে যাচ্ছিল, তাদের মনে শোভনার গান ছিল। এক অদৃশ্য সুর, এক প্রাচীন প্রেমের গল্প—যেটা তারা কখনোই শেষ করতে পারবে না, তবে সেটির অস্তিত্ব চিরকাল তাদের সঙ্গে থাকবে। কুশলনগরের ব্রিজ, শোভনার গান, দাদু আর শোভনার প্রেম—সব কিছুই এখন তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছিল। আর যখনই তারা ব্রিজের কাছে আসবে, শোভনার গল্প, তার প্রেমের সুর তাদের সঙ্গে ফিরে আসবে।
তাদের জীবনের এই অসম্পূর্ণ প্রেমের গল্প, শোভনার গানের সুর, কুশলনগরের প্রতিটি কোণে বয়ে চলেছিল, সেই মুহূর্তে আর কোনো কিছুই প্রাপ্তি ছিল না। তারা জানত, শোভনার প্রেম আর গান এক অদৃশ্য পথে চলে গেছে, কিন্তু তাদের হৃদয়ে, কুশলনগরের তীরে, সেই সুর আজও বয়ে চলছিল।
শোভনার গল্প আর তার অসম্পূর্ণ প্রেমের গান কুশলনগরের তীরে, তার ভেজা বাতাসে, এক অদৃশ্য সুরের মতো লুকিয়ে ছিল। রুক্মিণী আর অর্ণব জানত, এই গল্প কখনো পুরোপুরি শেষ হবে না। যতটুকু তারা জানে, ততটুকুই তারা শিখেছে, তবে শোভনার জীবন এবং তার প্রেম ছিল এমন এক যাত্রা, যা তাদের জীবনের অংশ হয়ে উঠেছিল। কিছু মুহূর্ত, কিছু গান—যেগুলো ধীরে ধীরে তাদের ভিতরে গেঁথে গেছে।
তারা একদিন ব্রিজের কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল। নদীর জল শান্ত, সূর্যের আলো সেই শান্ত পানিতে প্রবাহিত হচ্ছিল। একটি পুরনো পাখি গাছে বসে আকাশের দিকে উড়াল দিয়েছিল। রুক্মিণী তার চোখ বন্ধ করে, সেই পাখির উড়ে যাওয়া দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ, তার মনে হল—শোভনার গান আর প্রেমের সুর এখনো বাতাসে ভাসছে। তার সব কিছু যেন এই ব্রিজের গায়ে লেখা একটা অজানা ইতিহাস। একতারা বাজানোর সুর, শোভনার গানের প্রতিধ্বনি—এগুলো আজও তাদের হৃদয়ে বাজছে।
অর্ণব, একটু দূরে দাঁড়িয়ে, নদীর তীরে হাঁটছিল। তার মনে এক সুর ভাসছিল, যেন শোভনার গান, তার হৃদয়ের গভীরে, আর একটা নতুন ইতিহাস তৈরি করছে। সে ফিরে এসে বলল, “কিছু তো জানি না, রুকু, কিন্তু এটা মনে হচ্ছে—শোভনার গল্পটা অনেক গভীরে চলে গেছে, অনেক দূরের কোনো দেশে। কুশলনগরের এই জায়গা, এই নদী, সব কিছু—এটা তার অস্তিত্ব, তার গানের একেকটি ধারা।”
রুক্মিণী দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, “তুমি ঠিক বলেছ, অর্ণব। কিন্তু এখানে, এই ব্রিজের কাছে, শোভনার গান থামেনি। তার প্রেম থামেনি। সে এখানে আছে, তার গান শুনে, তার প্রেম অনুভব করে আমরা আজও এখানে দাঁড়িয়ে আছি। এই পৃথিবীতে, তার প্রেমের সুরটাই যেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সে কখনোই আমাদের কাছে আসবে না, আমরা কখনো তার সঙ্গে মিলিত হব না।”
অর্ণব চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বলল, “হয়তো শোভনা সত্যিই আমাদের কাছে ফিরে আসবে না। কিন্তু এই তীরে, এই নদীতে, তার গল্প, তার গান—তাহলে কেবল চিরকালই থাকুক। সে একটা কাল্পনিক গল্প, কিন্তু সেই গল্পের শক্তি আমাদের জীবনের অংশ হয়ে গেছে।”
রুক্মিণী তার ভাইয়ের কথায় সায় দিল, কিন্তু সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল, শোভনার প্রেমের গল্প কিছু অজানা পথে চলে যাচ্ছে। এই ব্রিজের কাছে, কুশলনগরের পেছনে, যে জায়গায় তারা দাঁড়িয়ে ছিল—সবকিছু যেন তার চোখে এক অন্যভাবে ধরা পড়ছিল। শোভনার প্রেম, তার গান, তার ইতিহাস—সব কিছু যেন একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু তারপরও, কতটা জানার ছিল? কতটা আসলেই তাদের সামনে ছিল?
তারা একসঙ্গে হাঁটতে শুরু করল, কিন্তু মনে হচ্ছিল, তারা যেন শোভনার গল্পের কোনও শেষ পর্বে পৌঁছাতে পারবে না। একসময়, নদী পাড়ি দেওয়ার জন্য তারা একটি পুরনো নৌকা দেখে। অর্ণব বলল, “এই নৌকাটা যদি শোভনার জন্য তৈরি হত, তাহলে তার সুর কখনো থামত না।”
রুক্মিণী নৌকাটার দিকে তাকিয়ে, এক দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। “হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস। শোভনার জন্য এই নদী, এই সুর—সব কিছু ছিল জীবনের আসল অভ্যন্তরীণ সত্তা।”
তারা নৌকায় চড়ে নদীর অন্য পাড়ে গেল। এখানে, আরেকটি পুরনো বাড়ি ছিল, যেখানে শোভনার সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু পুরনো নথিপত্র ও অঙ্কিত ছবি ছিল। তারা বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করল এবং সেখানে দেখতে পেল শোভনার চিত্র। ছবিটি ছিল এক নারীর মুখ, তার চোখে যেন কিছু গভীরতা ছিল—একটি মিষ্টি হাসি, যা তার একমাত্র প্রেম, দাদুর প্রতি ছিল।
ছবির পাশে লেখা ছিল, “শোভনা, তুমি ফিরে আসবে, আমি জানি। তোমার গান পৃথিবী জুড়ে বাজবে। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব, যতদিন না তুমি ফিরেছ।”
“এই চিঠিটা তো দাদুর লেখা,” রুক্মিণী এক ঝলক দেখে বলল। “তাহলে, দাদু শোভনাকে কি সত্যিই ভালোবেসেছিল?”
অর্ণব নীরবে মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, কিন্তু শোভনার জীবনের মধ্যে একটা অদৃশ্য অভ্যন্তরীণ বাধা ছিল। তাদের প্রেম অসম্পূর্ণ ছিল, আর এই অসম্পূর্ণ প্রেমের কারণ, হয়তো দাদু নিজেই জানতেন না।”
তারা বাড়ির ভিতর আরো কিছু সময় কাটালো। সেখানে আরও কিছু পুরনো স্মৃতি এবং কাগজপত্র পেল, কিন্তু কিছুতেই পুরোপুরি সত্যি উদ্ঘাটন করল না। সব কিছু যেন রহস্যময় আর অসম্পূর্ণ রয়ে গেছিল। যদিও শোভনার জীবন ও প্রেমের গল্প আজও তাদের কাছে খোলসা হয়নি, তবুও তাদের মনে ছিল একটা শান্তি। তারা জানত, তার প্রেম এবং গান কখনো থামবে না—এটি এক চিরস্থায়ী সুর, যা কুশলনগরের আকাশে এবং নদীতে ভাসবে।
তাদের মনে একটি চিরকালীন বোধ ছিল—শোভনার গান, তার প্রেম, কুশলনগরের ব্রিজ, সব কিছু তাদের জীবনের অংশ হয়ে উঠেছিল। এবং এই প্রেমের সুর যখনই তারা শোনে, তখন তাদের মনে মনে শোভনার উপস্থিতি বেঁচে থাকে।
অর্ণব বলল, “আমরা হয়তো শোভনার সঙ্গে কখনো সাক্ষাৎ করব না, কিন্তু তার গান, তার প্রেম, সব কিছু আমাদের জীবনের অঙ্গ হয়ে গেছে।”
রুক্মিণী মৃদু হেসে বলল, “হ্যাঁ, তার প্রেম অমর। যতদিন এই ব্রিজ, এই নদী, এই বাতাস থাকবে, ততদিন তার গান শোনা যাবে।”
তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল, মনে মনে জানত যে, শোভনার প্রেমের গল্প এই পৃথিবী থেকে কখনো হারাবে না।
রুক্মিণী আর অর্ণব কুশলনগরের ব্রিজের দিকে পা বাড়িয়ে হাঁটছিল। তাদের মনে ছিল এক অদ্ভুত শান্তি, কিন্তু সেই শান্তি কখনো পূর্ণ ছিল না। শোভনার প্রেমের গল্প আজও অসম্পূর্ণ ছিল, কিন্তু তারা জানত, যতদিন কুশলনগর থাকবে, ততদিন তার গান, তার প্রেমের সুর বয়ে চলবে এই আকাশে, বাতাসে, নদীর পাড়ে।
ব্রিজের কাছে এসে দাঁড়িয়ে, রুক্মিণী একবার শেষবারের মতো আকাশের দিকে তাকাল। সূর্য ফিকে হয়ে আসছিল, আর নদী যেন সোনালী আভায় ভেসে উঠছিল। রুক্মিণী তার মনে মনের গভীরে শোভনার গানের সুর শুনতে পাচ্ছিল। সেই সুর যা ছিল এক অসীম প্রেমের প্রতিনিধিত্ব। “শোভনা, তুমি কখনো আসবে না, কিন্তু তোমার সুর আমার হৃদয়ে থাকবে চিরকাল।” সে এক দমে বলল।
অর্ণব খানিকটা চুপচাপ রইল। এরপর ধীরে ধীরে বলল, “তুমি ঠিক বলেছ, রুকু। কিন্তু এই গল্পের শেষটা আজও অজানা। শোভনার প্রেম—এটা আমাদের জীবনে কখনো শেষ হবে না। যেমন সে ফিরে আসেনি, তেমনই তার গল্পও শেষ হয়নি।”
তারা কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। ব্রিজের নিচে নদী এখন শান্ত। বাতাসে শোভনার গান ভেসে আসছিল, যেন সে এখানেই ছিল, কোথাও না কোথাও, তাদের অজান্তে, তাদের মনে। কোনো এক অনন্ত সময়ের মতো, শোভনার গল্প যেন নীরবে বহমান হয়ে চলছিল।
“তাহলে, আমরা কি কখনো জানব না শোভনার গল্পের সবটা?” রুক্মিণী প্রশ্ন করল।
অর্ণব গভীরভাবে ভাবল, তারপর উত্তর দিল, “হয়তো। কিন্তু শোভনার প্রেম, তার গান—এসব আমাদের সঙ্গেই থাকবে। আমরা তার মধ্যে কিছু পেয়েছি, যা শেষ হবার নয়।”
তাদের মনে কিছু একটা উদিত হচ্ছিল। এই গল্পের শুরু, পথচলা, প্রেমের সুর—এগুলো ছিল কেবল এক পৃথিবীর কোণায় শেষ হয়ে যাওয়া গল্প, কিন্তু তার পেছনে যে আধ্যাত্মিকতা, প্রেমের সুর ছিল, তা আর কখনো হারাবে না। কুশলনগরের এই ব্রিজ, নদী, বাতাস—সব কিছু যেন শোভনার প্রেমের প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
রুক্মিণী আবার আকাশে তাকিয়ে বলল, “শোভনার গল্পটা কেবল আমাদের জীবনে একটা অধ্যায়, কিন্তু তার গান—তার সুর—এগুলো এখন আমাদের সঙ্গেই থাকবেই। সে হারিয়ে গেলেও, আমরা জানি, তার সুর কখনো থামবে না।”
অর্ণব এই কথাগুলো শুনে, নিজের মনে কিছু ভাবতে থাকল। তারপর বলল, “আমরা শোভনার গল্প জানলাম ঠিকই, কিন্তু জানি না, তার জীবন, তার প্রেম—এগুলোর মধ্যে কি কোনো বিরোধ ছিল? কেন তার প্রেম অসম্পূর্ণ ছিল? কেন সে ফিরে আসেনি?”
রুক্মিণী চুপ করে কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, “হয়তো তার জীবনের লক্ষ্য ছিল অদৃশ্য। কোনো একটা অজানা জায়গায় সে গিয়ে পৌঁছেছিল, যেখানে তার গানটা আর থামবে না। তার প্রেম হয়তো এক অপরূপ খোঁজ ছিল, যা সে নিজে পেয়ে গিয়েছিল, কিন্তু আমাদের জানা হয়নি।”
অর্ণব মাথা নেড়ে বলল, “তুমি ঠিক বলেছ, রুকু। এই প্রেম ছিল অদৃশ্য, আর তাই কখনো শেষ হতে পারে না।”
সে সময়, নদীর একপাশ থেকে আসছিল কিছু ছোট পাখির দল। তারা সোজা আকাশের দিকে উড়ে যাচ্ছিল। রুক্মিণী তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই পাখির মতো, শোভনার প্রেমও কোনো এক অজানা জায়গায় উড়ে যাচ্ছে, আমাদের হৃদয়ে গেয়ে যাচ্ছে।”
অর্ণব একটু তাচ্ছিল্যভাবে হেসে বলল, “অদ্ভুত, তাই না? হয়তো শোভনা ফিরবে না, কিন্তু তার প্রেম, তার গান—এটা আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় উত্তর।”
“হয়তো সে ফিরে আসবে না,” রুক্মিণী বলল, “কিন্তু জানো, তার গান, তার সুর, তা তো একদিন কোথাও ফিরে আসবে।”
রুক্মিণী আর অর্ণব, কুশলনগরের এই তীরে, শোভনার প্রেমের সুরের মধ্যে নিমগ্ন হয়ে গেছিল। তারা জানত, শোভনার গান কেবল একটি অল্প সময়ের জন্য ছিল না, তা একটি চিরস্থায়ী সুর হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল, কুশলনগরের প্রতিটি কোণে। তাদের হৃদয়ে, তাদের অস্তিত্বে, শোভনার প্রেমের সুর ছিল এক চিরন্তন প্রেরণা।
তাদের মনে হল, জীবনে কখনো কোনো প্রেম অসম্পূর্ণ থাকে না। যেটা আসল, সেটা চিরকালীন। শোভনার গান, তার প্রেম—এগুলো কুশলনগরের বাতাসে ভেসে থাকবে, প্রতিদিন, প্রতিটি মুহূর্তে।
এদিকে, ব্রিজের তীরে দাঁড়িয়ে, নদীর শান্ত জল ও সোনালী সূর্যের আলোয়, রুক্মিণী আর অর্ণব বুঝতে পারল, তারা যা খুঁজছিল, তা তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় অধ্যায় হয়ে উঠেছিল। শোভনার প্রেমের গল্প, তার গান—এটা ছিল এক চিরন্তন কাব্য, যা কখনো থামবে না।
কুশলনগরের ব্রিজ, শোভনার সুর, তার প্রেমের প্রতিধ্বনি—এসব সব সময় তাদের সঙ্গেই থাকবে। এটা ছিল তাদের জীবনের এক চিরকালীন অংশ। তারা জানত, শোভনার প্রেমের শেষ চূড়ান্ত পর্যায় একদিন এসে পৌঁছাবে, তবে এখনো কিছু না জানা সত্য ছিল। যেটা তারা জানত, তা ছিল—শোভনার প্রেম ও গান কোনোদিন শেষ হবে না।
শেষ