সঞ্জয় দে
পর্ব ১: বাড়ির রহস্য
অভিজিৎ ছিল ইতিহাসের ছাত্র। তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল পুরনো বাড়িগুলোর ইতিহাস খোঁজা, বিশেষত সেগুলোর যেগুলো সময়ের সাথে হারিয়ে গেছে অথবা কেউ তাদের কাহিনী জানে না। একদিন, তার বন্ধু প্রীতম তাকে একটি পুরনো বাড়ির কথা জানায়, যে বাড়ি সম্পর্কে নানা গুজব ছড়িয়ে আছে। লোকজন বলে, এখানে অদ্ভুত হাসির শব্দ শোনা যায় এবং অনেক মানুষ এখানে হারিয়ে গেছে। সেই রাতের পর থেকেই বাড়িটির নাম তার মনের মধ্যে দানা বাঁধতে শুরু করেছিল।
অভিজিৎ ভেবেছিল, এই বাড়ির রহস্য উন্মোচন করতে পারলে তার গবেষণায় নতুন একটি দিক যোগ হবে। তাই এক সকালে, তার গবেষণার জন্যই সেদিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বাড়িটি শহরের একেবারে প্রান্তে, এক নির্জন জায়গায় অবস্থিত ছিল। বাড়ির গেট ছিল সবুজ রঙের, সেখান থেকে প্রবেশ করলেই মেঠোপথ ধরে এক পুরনো, বাদ পড়া বাড়ি দেখা যায়। পুরনো পাথরের দেয়াল, নষ্ট হয়ে যাওয়া জানালা, আর খালি উঠোন—সবকিছুই যেন এখানে এত বছর ধরে কোনো জীবিত মানুষের ছোঁয়া পায়নি।
প্রথমবারের মতো ওই বাড়ির দরজাটা খুলে অভিজিৎ একা প্রবেশ করল। তিনি জানতেন না যে এই বাড়ির ইতিহাস তার জীবনকে এক অদ্ভুত দিকে নিয়ে যাবে।
বাড়ির ভেতর এক অন্ধকার পরিবেশ। সিলিং-এর পালকের মধ্যে জমে থাকা ধুলো মেঝের ওপর ছড়িয়ে আছে। ঘরগুলির এক একটি দরজা খুলে গেলে ভেতরে এক পোকামাকড়ের নিঃশব্দ চলাচল এবং পুরনো কাঠের গন্ধ এসে মনকে অস্থির করে তোলে। অভিজিৎ ঠিক কোথা থেকে শুরু করবে ভেবেই পাচ্ছিল না। এক সময়, তিনি একটি বড় কক্ষে ঢুকলেন, যেখানে এক সাইডে একটি পুরনো বইয়ের তাক ছিল।
তিনি বইগুলি একে একে ঘেঁটে দেখতে লাগলেন। বইয়ের পাতা খুললে ধূসর এক ধোঁয়া বেরিয়ে আসছিল। একটা বই তার চোখে পড়ল, এটি ছিল এক সময়ের এক ইতিহাস সংকলন। কিন্তু তার কভারের ওপর লেখা ছিল কিছু অদ্ভুত শব্দ: “ভূতের হাসি”।
অভিজিৎ কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে বইটি খুলল। সেখানে ইতিহাসের বেশ কিছু তথ্য ছিল, কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত ছিল ওই হাসির শব্দের উল্লেখ। বাড়ির মালিকদের সম্পর্কে কিছু বিশেষ তথ্য পাওয়া গেল, যাদের আত্মার কথা বলা হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন। আর যে শব্দটি অভিজিৎ খুঁজছিল—ভূতের হাসি—তাও সেখানে লেখা ছিল। এই শব্দগুলো, বইটি বলছিল, একটি পুরনো অভিশপ্ত ঘটনার অংশ, যা বাড়ির মধ্যে এক অদৃশ্য শক্তির জন্ম দিয়েছিল।
বইটি পড়তে পড়তে অভিজিৎ বুঝতে পারে, এই বাড়িটি যে শুধুমাত্র পুরনো নয়, বরং একটি ভয়ঙ্কর অতীতের সাক্ষী। সেই মুহূর্তে তার মনটাও এক অদ্ভুত আতঙ্কে ভরে ওঠে। তিনি বুঝতে পারেন, যে রহস্যটি সে খুঁজতে এসেছে, তা এতটা সহজ নয়, বরং একটি গভীর ও অন্ধকারের পথ অনুসন্ধান করতে হবে।
পর্ব ২: প্রথম রাতের আতঙ্ক
অভিজিৎ সেই রাতে বাড়ির ভিতরে একা থাকাকালীন গভীরভাবে চিন্তা করতে থাকে। সে জানত, এমন রহস্য সমাধান করা সহজ হবে না, কিন্তু তার মানসিকতা ছিল দৃঢ়। তার লক্ষ্য ছিল ইতিহাসের আড়াল থেকে সত্য বের করে আনা। কিন্তু বাড়ির প্রতিটি কোণ, প্রতিটি পুরনো কাঠামো, যেন তাকে আরও একতরফা শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে এনে ফেলছিল। বাড়ির মেঝে, দেয়াল, জানালার কাচ—সবকিছু ছিল যেন একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাসের মতো, যা পৃথিবীর সবকিছু থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন।
পাঠকৃত বইয়ের পাতা জুড়ে পুরনো ইতিহাস ছিল, যেখানে এক পুরনো শত্রুতা ও অভিশাপের কথা বলা ছিল। তবে অভিজিৎ তেমন কিছু মনোযোগ না দিয়ে একে একে সে সব ঘর ঘুরে দেখছিল। হঠাৎ, একক সময়ের মতো গভীর রাত হতে শুরু করেছিল, আর সেখানে এক গভীর অন্ধকার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। বারান্দার বাইরে থেকে একটি ছোট ঝড়ও উঠেছিল, বাতাস যেন বাড়ির জানালা থেকে আঘাত করে ঘরের ভিতর ঢুকছিল।
সেই রাতের আকাশ ছিল অন্ধকার, চাঁদের আলোও যেন মেঘের আড়ালে লুকিয়ে গিয়েছিল। ঘরের ভিতর গভীর নীরবতা, আর তার মধ্যে থাকা হাসির শব্দ—এগুলো সব এক অজানা শক্তির চিহ্ন হতে পারে, এ ভাবনা অভিজিৎকে তাড়া করছিল। কিছুক্ষণ পরই, তার কানে আসতে থাকে সেই হাসির শব্দ। প্রথমে সে ভাবল যে এটি হয়তো তার কল্পনা, কিন্তু শব্দটি ক্রমেই পরিষ্কার হতে থাকে। অভিজিৎ বুঝতে পারে, এটি স্বাভাবিক কিছু নয়, বরং কিছু অশরীরী শক্তি তাকে অনুসরণ করছে।
হাসির শব্দ আসতে থাকে অনেকটা ঘরের এক কোণ থেকে। অভিজিৎ প্রথমে দিশেহারা হয়ে ওঠে। নিজের হাতে আলো ধরতে থাকে। সে ভাবতে থাকে, “এটা কি শুধুই আমার মন? না, কিছু একটা তো হচ্ছে!” কিন্তু হাসির আওয়াজ থামছিল না, বরং আরও স্পষ্ট ও জোরাল হতে থাকে। এক সময়, সারা ঘর যেন সেই হাসির আওয়াজে ভরে ওঠে।
আলোটা এক জায়গায় স্থির রেখে অভিজিৎ আস্তে আস্তে সেই শব্দের উৎস খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে থাকে। কক্ষের এক কোণ থেকে হাসির শব্দ আসছিল, কিন্তু যখন সে সেখানে পৌঁছায়, কিছুই দেখতে পায় না। তার সমস্ত শরীরটা যেন চরম শীতল হয়ে যায়। সে আরও একবার শব্দটি শোনে, এবারের শব্দটি যেন আরো ভয়ঙ্কর। এই হাসির মধ্যে কোনও আনন্দ নেই, বরং একটি অতিপ্রাকৃত খিলখিল হাসি, যা মনকে ভয়ঙ্কর আতঙ্কে ঠেলে দেয়।
আলোটা তার হাতে হালকা ঝলক দিয়ে আবার ফ্ল্যাশ করে উঠে, কিন্তু সেই হাসির উৎস এখনও অদৃশ্য ছিল। সে দ্রুত কক্ষের দরজার দিকে দৌড়াল, কিন্তু সেসময় দরজাটি খুলছিল না। ভিতর থেকে শক্ত কোনো প্রতিরোধ যেন তাকে আটকে রেখেছিল। অভিজিৎ হতবাক হয়ে বুঝতে পারে, সে এক চরম বিপদের মধ্যে পড়ে গেছে।
কিছু সময় পর, ঘরের এক কোণ থেকে ঠাণ্ডা একটা শীতল হাওয়া বয়ে আসে। হাওয়ার ভেতর কোনো এক অদ্ভুত গন্ধ ছিল। অভিজিৎ অনুভব করল, সেই হাসির সঙ্গে কোনও সম্পর্ক থাকতে পারে এমন কিছু অশরীরী শক্তির উপস্থিতি বাড়ছে। ঘরের মেঝের ওপর কাঠের সুর-ঢালানো শব্দ শুনতে পেল সে। কোনো অদৃশ্য হাতে কিছু যেন ঘষছে, হয়তো তাতে আরও একটি রহস্য শিকার করার জন্য।
আবহাওয়া আরও খারাপ হতে থাকে, আর সে নিজেকে একেবারে অচেনা পরিবেশে আটকে থাকতে অনুভব করে। ঘরের দরজা এখনও বন্ধ ছিল। বাতাসের ঝাপটার পরপর, হালকা রোদ উঠে এবং কিছু দূরে টেলিভিশন পর্দায় আস্তে আস্তে দুলতে থাকে। তার মনে হয়, এটা ঠিকভাবে বিশ্বাসযোগ্য কিছু নয়। যেন সেই বাড়ির কিছু ভিন্নরকম বাস্তবতার দ্বারা শাসিত হয়েছে।
তবে, যখন সে দেখতে পেল, নিজের সামনে দুলতে থাকা টেলিভিশন স্ক্রিনের মধ্যে একটা শূন্য স্থান উদ্ভূত হয়েছে, তখন সে বুঝতে পারল—এটা কোথাও না কোথাও তার জন্য কিছু গুরুতর পরিস্থিতি তৈরি করেছে। যেখানে হালকা দেখা গিয়েছে, সেখানে কিছু না কিছু গুপ্ত রহস্যের আনাচে কানাচে সংজ্ঞায়িত শক্তি ধ্বনিত হয়ে উঠেছে।
অভিজিৎ নিজেকে সবসময় নিশ্চিত করেছে, যে হাসি সে শুনছে, তা হয়তো তাকে ভয় দেখানোর জন্যই। কিন্ত কোনো অজ্ঞাত শক্তি যখন তাকে চেপে ধরেছিল, তখন সে বুঝতে পারে, এই বাড়ির ভিতর এক অন্য পৃথিবী রয়েছে, এক অদ্ভুত শক্তির দখলে। হাসির শব্দ, যতই সে পালাতে চেষ্টাই করুক, ঠিক ততই সে আরও কাছে এসে পৌঁছায়।
পরবর্তী পদক্ষেপে, অভিজিৎ স্থির হতে চেষ্টা করে। সে মনে মনে ঠিক করে ফেলে যে, যতদিন না সে এই রহস্যের সমাধান না করবে, ততদিন সে এখান থেকে বেরিয়ে যাবে না। তার পথ এখন এক গভীর অন্ধকারে ভরা, যা তাকে বহুদিন পর এক নতুন সত্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
পর্ব ৩: অশরীরী উপস্থিতি
অভিজিৎ, সেই রাতের পর, বুঝতে পারছিল না কী ঘটছে। ঘরের মেঝে, দেয়াল, জানালা—সব কিছু এক অদ্ভুত শূন্যতায় পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। হাসির আওয়াজ, যা তাকে তার মাথার মধ্যে দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করছিল, এখনও তার কানে ঘুরছিল। সে নিজের চোখের সামনে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখেছিল, কিন্তু তার বিশ্বাস হচ্ছিল না—যে হাসির আওয়াজটা শোনাচ্ছিল, সেটা কোনো মানুষ বা কোনো সাধারণ জীবিত প্রাণীর আওয়াজ ছিল না। এটি ছিল এক অদৃশ্য শক্তির উপস্থিতি।
আলোর স্নিগ্ধ ঝলক দিয়ে, তার সামনে এক মুহূর্তে ঘটে যেতে থাকে কিছু অজানা ঘটনা। ঘরের এক কোণে কিছু অদ্ভুত ছায়া পেলে তার মনের ভিতর চাপ সৃষ্টি হতে থাকে। এর মধ্যেই, আচমকা তার চোখে পড়ে এক চমকপ্রদ দৃশ্য—ঘরের মাঝখানে অন্ধকারের মধ্যে একটি পুরনো কাঠের চেয়ার, যা নিজে থেকেই দুলছিল। তবে, তা কোনো বাতাসের কারণে নয়, যেন কেউ বসেছিল সেই চেয়ারে। চেয়ারটির অদ্ভুতভাবে দুলতে থাকা এক এক দমে অভিজিৎ উপলব্ধি করতে পারে—এটা কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। কিছু অশরীরী শক্তি তাকে অনুসরণ করছে।
অভিজিৎ ভয় পেয়ে সেদিকে এগিয়ে গেল, কিন্তু হঠাৎ চেয়ারের দুলানো বন্ধ হয়ে গেল। সব কিছু মুহূর্তে শান্ত হয়ে গেল। অভিজিৎ শ্বাস ফেলতে থাকল, তার হৃদপিণ্ড যেন গতি হারিয়ে ফেলেছে। সে আবার ভয়ে পিছিয়ে গিয়ে সেদিকে একদৃষ্টে তাকাল, কিন্তু কিছুই ঘটল না। ঘরের মধ্যে কোথাও কিছু ছিল, কিন্তু তার সামনে কোনো অশরীরী উপস্থিতি ছিল না। যেন এটি সব তার কল্পনা ছিল।
তবে, ঠিক সেই সময় তার কানে এল সুরের এক হালকা গুঞ্জন, এক অদ্ভুত আওয়াজ—ভূতের হাসি। এই হাসি যেন এক আগের মতো অদৃশ্য আক্রমণের মতো সোজা তার কানে পৌঁছায়, তবে এবার হাসির মধ্যেই কিছু ভিন্ন মাত্রা ছিল—এক ধরনের প্রাচীন শক্তি, যা দীর্ঘদিন ধরে এক জায়গায় আটকে ছিল। অভিজিৎ মনে করল, তার সুরুচি এবং সাধনার পথে কিছু এমন লুকানো দিক বেরিয়ে এসেছে, যা এখন তাকে পরাভূত করতে চাইছে।
সে চেষ্টা করল রুমের সীমানা আঁকতে, তার সমস্ত মনে হতে থাকে যে তাকে এখন দ্রুত কিছু করতে হবে। তাকে তার নির্ধারিত পথ খুঁজে বের করতে হবে, যদি সে এই বাড়ির রহস্যের মুখোমুখি হতে চায়। কিন্তু, হঠাৎ চোখে পড়ল এক ছোট্ট চিহ্ন—একটি সাদা গা dark ় হাতের ছাপ। এটি ছিল কোথাও থেকে আসা কিছু এক ভয়ঙ্কর চিহ্ন, যা অভিজিতের চোখে পড়েছিল।
সে দৌড়ে গিয়ে ড্রয়ার খুলে রক্তের মতো একটি কাগজে লুকানো কিছু তথ্য দেখতে পেল। সেখানেও লেখা ছিল একই নাম, যে নামটা সে আগে পড়েছিল সেই বইয়ের মধ্যে—এটি ছিল ‘বাঁধনপুরী’, এক পুরনো শক্তি। সেসব লেখা তাকে আরও ভয়ের মধ্যে ঠেলে দেয়, আর তার মানসিকতার স্তর বাড়ে। এ যেন একটা তাবিজের মতো, যে তাবিজের ভেতর এক অদৃশ্য শক্তি আটকে ছিল, যা এক সময় এক চরম বিপদ থেকে তাকে উদ্ধার করতে পারে। তবে এই তাবিজ তাকে যখনই অনুসরণ করবে, সে একই বিপদে পড়বে।
ঠিক তখনই, ঘরের এক কোণে পুরনো ঘরবাড়ির অন্ধকার থেকে একটি অশরীরী চিত্র বেরিয়ে এল। এটি ছিল এক মহিলার ছায়া, যিনি এক সময় এখানে বসবাস করতেন। তার চোখে ছিল এক বিশেষ ঝলক, যেন কোনো এক চিরন্তন শোকের প্রতিফলন। সে ঠিকঠাক ভাবে অভিজিতের দিকে তাকাল, কিন্তু কোনো শব্দ বের হলো না তার মুখ থেকে। তখন বুঝতে পারল, যে মানুষটি তাকে অনুসরণ করছে, সে শুধু কোনো এক পুরনো স্মৃতি, যা কোনও সময়ের মধ্যে হারিয়ে গেছে।
অভিজিৎ তৎক্ষণাৎ দৌড়ে এসে ঘরের দরজা খুলল, কিন্তু আগের মতো দরজা আবার বন্ধ হয়ে গেল। এবারে, হাসির আওয়াজ আর থামছিল না। তার পাশে ওই মহিলার চিত্রটি আরও কাছাকাছি চলে আসে, এবং একে একে ঘরটি আরও বেশি অন্ধকার হয়ে যায়। সেই হাসি, যা প্রথমে কেবল ভয় পেয়েছিল, এখন তার মনের মধ্যে এক আতঙ্কের শৈল্পিক রূপ নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। সেটা তার কাছে সত্যিই ভয়ের চেয়ে বেশি কিছু।
অভিজিৎ একেবারে স্নায়ুবিকভাবে ভেঙে পড়ল। তার চারপাশে এখন একটাই প্রহেলিকা ছিল—এটা কি আসলেই কোনো বাস্তব ঘটনা, না কি কিছু এক ধরনের বিভ্রমের আওয়াজ? তার মনে হচ্ছিল, এই শূন্যতায়, এই অন্ধকারে কিছু সত্যিই অবাস্তব ঘটছে। সে জানত, তাকে সঠিক উত্তর খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু সেই উত্তর যদি তাকে আরো এক শয়তানি দিকের দিকে ঠেলে দেয়, তাহলে কি সে তা সহ্য করতে পারবে?
সে জানত, তাকে আরো গভীরে যেতে হবে। কিন্তু সেই গভীরতা, সে জানত, তার জন্য অপেক্ষা করছিল এক ভয়ঙ্কর পরিণতি।
পর্ব ৪: হাসি
অভিজিৎ যখন ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল, তখন তার চারপাশে শুধু অন্ধকার ছিল। ঘরের আলো জ্বলানোর চেষ্টা করে সে কোনো ফল পায়নি। এখন শুধুই একটানা হাসির আওয়াজ, সেই হাসি যা তাকে বিভ্রান্ত করে চলেছে। হাসির শব্দ কখনো দূরে, কখনো কাছে এসে পৌঁছাচ্ছে, এবং এর সঙ্গে একটি অদ্ভুত শীতলতা অনুভব করতে শুরু করে অভিজিৎ। হঠাৎ তাকে মনে হতে থাকে, যেন কোনো অশরীরী শক্তি তার কাছে আসছে, তাকে পেছনে ফেলে রেখে চলে যাচ্ছে।
সে সরে গিয়ে একটি জানালার কাছে চলে আসে। কক্ষের ভিতরের বাতাস ক্রমেই শীতল হতে থাকে, এক নিঃশব্দ আতঙ্কের সঙ্গে। একসময়, জানালার কাচের ওপর মুছে যাওয়া আলোর রেখা দেখা যায়, তবে সেই আলো ছিল একেবারেই হালকা। অভিজিৎ জানালার বাইরে তাকাল, তবে বাইরে কিছুই দেখা গেল না—শুধু তীব্র অন্ধকার আর বরফের মতো ঠাণ্ডা বাতাস।
তবে, অন্ধকারের মধ্যে, চোখের সামনে শূন্যতায় কিছু যেন দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। ঘরের এক কোণ থেকে ধীরে ধীরে একটি কালো চিত্র মুছে উঠে আসে, আর সেখান থেকে শুরু হয় সেই হাসির আওয়াজ। এটি যেন কিছু প্রাচীন সময়ের ভয়ংকর স্মৃতি, যেগুলো দীর্ঘদিন ধরে এখানে আটকে ছিল। অভিজিৎ অনুভব করল, এটা কোনো সাধারণ ভয় নয়, এটা ছিল এক অশরীরী শক্তি, যা তাকে খুব গভীরভাবে শিকার করতে চাইছে। ঘরের মধ্যে সৃষ্ট অন্ধকার আরও ঘনীভূত হতে থাকে, যেন তার অস্তিত্ব ধীরে ধীরে চুষে নেওয়ার চেষ্টা করছে।
এখন, তার সমস্ত শরীরের রক্ত যেন জমে গেছে। এক মুহূর্তের জন্য তার মনে হল, সে মাটির মধ্যে পড়ে যাবে। হাত-পা ভারী হয়ে আসছে, সে গা dark ় হাসির আওয়াজের শিকার হয়ে গেছে। এই হাসি, সেই অজানা হাসি, যেন তার হৃদয় থেকে বের হয়ে এসেছে—একটি অদ্ভুত মিশ্রণ, দুঃখ, হতাশা, এবং এক অনন্ত সময়ের প্রতি ঘৃণা।
হঠাৎ, অভিজিৎ এক কটাক্ষে সেদিকে তাকায়, যেখানে সেই হাসির শব্দ শুরু হয়েছিল। সেখানে কিছু কালো আবছা সৃষ্টি দেখতে পায়। সেটা যেন কোনো মানুষের ছায়া নয়, কিন্তু আবার তার মধ্যে কিছু অস্বাভাবিকতা ছিল। যতই সে তার দিকে এগিয়ে যায়, ততই সেগুলো যেন আরও গা dark ় হয়ে ওঠে। এক সময়, একটি বিশাল অন্ধকার ছায়া সামনে আসে, যা এক অস্বাভাবিকভাবে দুলতে থাকা সিলিং ফ্যানের নিচে অবস্থান করছিল। সিলিং ফ্যানটি নিজের এক আক্রোশী সুরে দুলছিল, আর সেটি যেন সমস্ত ঘরের বাতাস চুষে নিচ্ছিল।
অভিজিৎ খেয়াল করে, ছায়াটির গা dark ় সিলুয়েট যে কোনও সময়ে তাকে ঘিরে ফেলবে। সে ছায়ার দিকে এগিয়ে যায় এবং হঠাৎ দেখলো, সেই ছায়ার মধ্যে একটি মুখের ছাপ ছিল, তবে সেটি ছিল একদম অপূর্ব এবং ভীতিকর। সেটি যেন কোনও পুরনো দানবের মুখ, যার চোখগুলোর মধ্যে এক গভীর শূন্যতা ছিল। সে আরও একবার ঘরে ফেরা চেষ্টা করে, কিন্তু দরজা আবারও বন্ধ হয়ে যায়।
সে অনুভব করে, তার জীবন একটি চক্রে আটকে গেছে, এবং সে এই ভয়ের ভেতর আটকা পড়ে গিয়েছে। এই ঘটনার এক পেছনে, পুরনো রহস্য এবং শক্তি রয়েছে, যা সে বুঝতে পারছে না। সে জানতো, এই বাড়ির যে রহস্যগুলো সে আবিষ্কার করতে এসেছে, সেগুলোকে আরও গভীরভাবে খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু যতই সে এগিয়ে যাচ্ছিল, ততই কিছু অদৃশ্য শক্তি তাকে পিছু টানছিল, যেন সে একটি বড় ভুল করতে যাচ্ছে।
হাসির আওয়াজ তখন আরও শোনা যেতে থাকে, কিন্তু এবার হাসির মধ্যে কোনো সুখ ছিল না, বরং যেন এক অন্ধকার প্রচণ্ডতা ছিল। পুরো ঘরটির মধ্যে তখন অসহনীয় ঠাণ্ডা অনুভূত হতে থাকে, যেন বাড়িটি নিজেই জীবন্ত হয়ে উঠেছে এবং তার শরীরের মধ্যে ঢুকে পড়ছে।
অভিজিৎ চেষ্টা করছিল কিছু একটা করা, কিন্তু তার শরীরের সমস্ত শক্তি যেন শূন্য হয়ে গেছে। সে জানত, তার সামনে দুটি পথ রয়েছে—একটি হল পালানো এবং অন্যটি হল এই অশরীরী শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে লড়াই করা। তবে সে জানত, এ ধরনের শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে তাকে অতীতের গোপন রহস্য এবং শক্তি সম্বন্ধে জানাতে হবে। তাকে বাড়িটির অতীত সম্পর্কিত আরও তথ্য খুঁজে বের করতে হবে।
তবে সে জানত, যখন কোনও স্থান ও সময় অন্ধকারের মধ্যে ঢেকে যায়, তখন সেই মুহূর্তে সব সত্য, সব রহস্য এক জায়গায় এসে জমা হয়। এবং সেই সত্য বের করতে গিয়েই তাকে অবশ্যই এই অদৃশ্য শক্তির মুখোমুখি হতে হবে।
এবং ঠিক তখন, হঠাৎ তাকে মনে পড়ে যায় একটি ছোট, পুরনো পত্রিকা যা বইয়ের ভেতর ছিল—“ভূতের হাসি।” সেটা একটি সনাক্তকরণ চিহ্ন ছিল, যা তাকে আগামী রাতের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলছিল।
সে মনস্থির করেছিল, এবার আর তাকে পিছু হটতে হবে না। তাকে শুধু ওই হাসির উৎস খুঁজে বের করতে হবে, এবং সেই সূত্রটিকে ব্যবহার করে এই রহস্যের শেষ সমাধান করতে হবে।
পর্ব ৫: অতীতের শয়তান
অভিজিৎ কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে ছিল। তার চারপাশে যে হাসির শব্দগুলি ঘুরছিল, সেগুলি যেন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এবার সে একদম নতুন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে—সে আর পালাবে না। এই বাড়ির রহস্য খুঁজে বের করতেই হবে। রাতের অন্ধকার, সেই হাসির গা dark ় শব্দ, সব কিছুই যেন এক রহস্যময় যাত্রার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এই রহস্যের পিছনে কিছু গভীর দুঃখ ও অতীতের শোক লুকিয়ে ছিল—যা সে এখনও পুরোপুরি জানত না।
অভিজিৎ ঠিক করে ফেলল, তাকে ওই পুরনো বইটির দিকে আরও মনোযোগ দিতে হবে। ওই বইটির পাতা ঘাঁটতে ঘাঁটতে সে কিছু ভিন্ন ধরনের তথ্য পেয়েছিল, যা তার মনে আতঙ্কের জন্ম দিয়েছিল। এক পরিসরে, বইটিতে লেখা ছিল যে, বহু বছর আগে এই বাড়ির এক বাসিন্দা ছিল, যিনি কোনো এক অদ্ভুত চুক্তির কারণে আত্মহত্যা করেছিলেন। তার আত্মা, সেই ভয়ঙ্কর আত্মা, এই বাড়ির মধ্যে আটকা পড়ে ছিল, আর তার হাসি ছিল সেই ভয়ঙ্কর শক্তির প্রতীক।
বইটির পাতায় লেখা ছিল, “এ বাড়ি শয়তানী শক্তির অধীনে রয়েছে, আর তার হাসি এক অন্ধকারের অনুরণন। সেই হাসি শোনা যাদের, তাদের কখনও মুক্তি নেই।” অভিজিৎ তৎক্ষণাৎ এই কথাগুলি তার মনে বসিয়ে দেয়, কিন্তু সে জানত না কীভাবে এই অশরীরী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করবে। তার সামনে ছিল এক অসম্ভব চ্যালেঞ্জ, যেখানে ইতিহাস এবং বাস্তবতা একাকার হয়ে গিয়েছিল।
সে বুঝতে পারছিল, কিছু খুঁজে বের করার জন্য তাকে সেই বাড়ির পুরনো ইতিহাসের দিকে আরও গভীরভাবে নজর দিতে হবে। রাতের অন্ধকারে, সে একে একে বাড়ির সমস্ত কোণ খুঁজতে শুরু করল। বইয়ের মধ্যে পাওয়া গোপন পৃষ্ঠাগুলির সূত্র ধরেই সে বাড়ির ভেতরের অতীত অনুসন্ধান করছিল।
একসময়, একটি পুরনো দেয়ালের পেছনে একটি গোপন দরজা খুঁজে পায়। দরজাটি এতটাই পুরনো এবং ক্ষয়প্রাপ্ত ছিল, যে তার খোলার সময় ভাঙনের আওয়াজও আসে। অভিজিৎ দরজাটি খুলে ভিতরে প্রবেশ করল। এখানে, পুরো পরিবেশ ছিল একরকম অদ্ভুত—তিন দিকে ছড়ানো ছিল মোমবাতির শিখা, আর এক কোণে একটি বিশাল প্রাচীন চিত্রকলা ঝুলছিল। চিত্রকলা ছিল সেই হাসির প্রতীক, যা প্রথম দিন থেকেই অভিজিতের কানে এসেছিল। সেই হাসি যেন একটি শক্তিশালী, বিভ্রান্তিকর শক্তির প্রতীক।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে অভিজিৎ বুঝতে পারল, সে এখানে এক পুরনো রীতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সবকিছু, এই সমস্ত কিছুই যেন এক রহস্যময় শক্তির উপস্থিতি। সেই চিত্রকলার মধ্যে, এক ভয়ার্ত মুখ ছিল, কিন্তু তার চোখের পাতা বন্ধ ছিল, যেন সে কিছু দেখতে পারছে না। তখনই সে মনে করল, সে যদি সে সব চোখ খুলে দেয়, তবে কী হবে? সে কি জানতে পারবে সেই রহস্যের ভিতর লুকিয়ে থাকা সত্য?
অভিজিৎ এক মুহূর্তে সাহস করে, চিত্রকলা থেকে একটি মোমবাতি নিয়ে ছোঁয়ায় চিত্রের চোখের কাছে। সেই মুহূর্তে, অদ্ভুত এক ঝলক অনুভব হলো, যেন চিত্রের চোখগুলো জীবিত হয়ে উঠেছে। চোখ দুটি খোলার সাথে সাথে ঘরের অন্ধকার আরো ঘনীভূত হতে থাকে, যেন কিছু ভয়ের ছায়া ঘিরে ধরেছে তাকে। হাসির আওয়াজ আরও তীব্র হতে থাকে, যেন ঘরের দেয়ালগুলো টপকাতে শুরু করেছে।
অভিজিৎ ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু তাকে অদ্ভুতভাবে আশপাশের সব কিছু ঘুরে দেখা হচ্ছিল। তিনি বুঝতে পারেন, সেই ভয়ঙ্কর হাসি আসলে একটি পুরনো শয়তানি শক্তির অংশ। এই শক্তি এতদিন ধরে এক স্নায়ু চাপে কাজ করছে, আর এখন সেটা বাইরে বেরিয়ে আসতে চায়। কিন্তু এই চিত্রকলায় ছিল সেই শক্তির এক অদৃশ্য চিহ্ন, যা সেই হাসির পিছনে লুকিয়ে ছিল।
হাসির শব্দ, যা আগে তার কানে এসেছিল, এখন যেন সত্যি সত্যি তার ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। তার মস্তিষ্কের মধ্যে সেই হাসির প্রতিধ্বনি প্রবাহিত হতে থাকে, যেন সেগুলো কোনও এক অন্য পৃথিবী থেকে উঠে আসছে। তার সমস্ত শরীর কাঁপছিল, সে জানত, সে আর এক পা এগোতে পারবে না। এই বাড়ির ভিতর এক অজানা গা dark ় শক্তি, এক ভয়ঙ্কর শয়তানি তাকে আকর্ষণ করে চলেছে। তাকে এই অশরীরী শক্তির মধ্যে আটকা পড়ে থাকতে হবে।
তবে এক মুহূর্তে, সে এক ভিন্ন ধরনের শক্তি অনুভব করল। একটি মৃদু আলোর ঝলক দিয়ে, সেই ভয়ের হাসি থেমে গেল। সেই সময়ে, অভিজিৎ তার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রশ্নের মুখোমুখি হয়—এটা কি তার কল্পনা? না, আসলেই কি সে একটা অশরীরী শক্তির মধ্যে বন্দী হয়ে পড়েছে? সে জানে, তাকে এই রহস্যে প্রবেশ করতে হবে, সে তার অনুসন্ধান শেষ করবে, কিন্তু সেই অনুসন্ধান তার জন্য কতটা নিরাপদ, তা জানত না।
পর্ব ৬: প্রথম চিত্র
অভিজিৎ আরও একবার চিত্রকলার দিকে তাকাল, যা এখন যেন এক জীবন্ত সত্ত্বা হয়ে উঠেছে। তার চোখে সব কিছু ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল, যেন চারপাশের পৃথিবীটা হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে গেছে। সেই চিত্রে থাকা পুরনো মানুষটির হাসি যেন এক ভয়ানক প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এক অস্পষ্ট কণ্ঠ ভেসে এল—”এটাই তোমার পথ।”
বুকের মধ্যে গলগল করে ওঠা শ্বাসের আওয়াজ কানে আসছিল, কিন্তু একথা বোঝা যাচ্ছিল না—তাকে কি সত্যিই কিছু করা উচিত? এই অশরীরী শক্তি, এই ভয়ঙ্কর হাসি, যা তাকে বার বার তাড়া করে, সে কীভাবে এ থেকে মুক্তি পাবে? তার ভাবনাগুলো একে একে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল, যেন ভয়ের ছায়ায় হারিয়ে যাচ্ছে।
চিত্রের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে, তাকে একটা অতিপ্রাকৃত অনুভূতি হতে শুরু করেছিল। এ বাড়ির প্রতিটি কোণ যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে। তার মনে হচ্ছিল, সেই শয়তানি শক্তি, যা এতদিন ধরে ঘরবাড়ির অন্ধকারে লুকিয়ে ছিল, এখন তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এই বাড়ির গা dark ় হাসি, যেন তাকে ধীরে ধীরে নিজের মধ্যে শুষে নিতে চাইছে।
হঠাৎ, তার চোখে পড়ল এক পুরনো কাঠের বাক্স, যা বইয়ের তাকের নিচে চাপা পড়েছিল। বাক্সটি খুলতে গিয়ে অভিজিৎ অবাক হয়ে গেল। সেখানে একটি পুরনো মানচিত্র ছিল। মানচিত্রটি এতটাই মলিন এবং ক্ষয়ে গেছে যে, একে দেখতে গেলে খুব কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু অভিজিৎ বুঝতে পারল, এটি বাড়ির গোপন স্থানগুলোর একটি অতি পুরনো মানচিত্র। এর মধ্যে খোলামেলা পাথরের গর্তের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছিল, যেখানে পুরনো শয়তানি শক্তি আটকা পড়ে ছিল।
অভিজিৎ দ্রুত মানচিত্রের দিকে তাকাল। মানচিত্রে লেখা ছিল, “যেখানে হাসি সবসময় চলে, সেখানে গোপন পথ রয়েছে।” এটি যেন তার উপর নতুন এক চাপ তৈরি করেছিল। মানচিত্রটি ছিল এমন এক স্থানের, যেখানে গা dark ় হাসি কখনো থেমে না, আর তার অন্তর্নিহিত রহস্যের দিকে তাকে প্রবাহিত করে নিয়ে যায়। মানচিত্রের ঠিক মধ্যে একটি ছোট বিন্দু ছিল, যেখানে সবচেয়ে বেশি অন্ধকার ছিল।
অভিজিৎ জানত, এ মুহূর্তে তার সামনে আর কোনো পিছু হটার সুযোগ নেই। সে পুরোপুরি এই রহস্যের মধ্যে আটকা পড়ে গেছে। সে সিদ্ধান্ত নিল, তাকে মানচিত্র অনুসরণ করতে হবে। হয়তো সে যে জায়গায় যেতে যাচ্ছে, সেখানে শেষ পর্যন্ত তার সঠিক উত্তর মিলবে। কিন্তু সে জানত না, সেই উত্তর তাকে কেমন পরিস্থিতিতে ফেলে দিবে।
সে সিলিং ফ্যানের নিচে দাঁড়িয়ে মানচিত্রটি হাতে নিয়ে বাড়ির গভীরে প্রবেশ করতে শুরু করল। ঘরের সমস্ত জানালা একে একে খুলে যাচ্ছে, যেন সে কোনো অদৃশ্য শক্তির প্রভাবের নিচে। বাইরে ঝরঝর করে বৃষ্টি পড়ছিল, এবং সেখানেও সেই হাসির শব্দ একে একে তীব্র হয়ে উঠছিল। মানচিত্রের পথে চলতে চলতে অভিজিৎ বুঝতে পারছিল, হাসির আওয়াজ আরও কাছে চলে আসছে।
তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি ছোট পথ ছিল। ধীরে ধীরে সে সেই পথে এগিয়ে গেল। তার মনে হচ্ছিল, এটি কোনও সাধারণ পথ নয়, বরং একটি অন্ধকার রাস্তা, যা তাকে এক শয়তানি শক্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই হাসির আওয়াজের মধ্যে যেন কিছু চমকপ্রদ রহস্য লুকিয়ে ছিল, যা এখন তাকে অনুসরণ করে চলেছে। সে নিশ্চিত ছিল না, তাকে সেই জায়গায় যেতে হবে, তবে মানচিত্রে দেখানো পথ অনুসরণ করতেই হবে।
জীবনের প্রতি তার একরকম তীব্র প্রশ্ন ছিল, “তবে, এ পথটি আমাকে কীভাবে শেষ করবে? আমি কি সেই রহস্যের মুখোমুখি হবো?” মনে মনে ভেবেছিল সে, কিন্তু হাসির আওয়াজ তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, যেন সে এখন এক ভীষণ দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে পড়েছে।
মানচিত্র অনুসরণ করতে করতে, এক সময় তার চোখে পড়ল একটি পুরনো দরজা, যা খুবই ক্ষয়ে গেছে। দরজাটি ছিল মোটামুটি অচল, তবে শক্ত হাতে তা খুলে দিল। ভিতরে ঢুকতে গিয়ে, তার চোখে পড়ল এক পুরনো কক্ষে, যেখানে এক নিঃশব্দ মৃত্যু ও শক্তি বাস করছিল। এখানে, সেই হাসির শব্দ আরও জোরালো হয়ে উঠেছিল। ধীরে ধীরে অভিজিৎ অনুভব করতে থাকে, সে যেন কোনো এক সময়ের মধ্যে ঢুকে পড়েছে, যেখানে পুরনো শক্তির প্রতীক আবার জীবন্ত হয়ে উঠছে।
কক্ষের ভিতরে তখন একটি ছোট তাবিজ দেখা যায়, যেখানে একটি প্রাচীন চিহ্ন আঁকা ছিল। তাবিজটি সোজা তাকে ডেকে নিচ্ছিল, যেন কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক থেকে তার জীবনের রূপান্তর হবে। অভিজিৎ তাবিজটি হাতে নিয়ে বুঝতে পারল, এটি সেই শয়তানি শক্তির চিহ্ন, যা এতদিন ধরে বাড়ির অন্ধকারে লুকিয়ে ছিল।
এই মুহূর্তে, অভিজিৎ শ্বাস রুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। সে জানত, তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে—এটি কি তার জন্য একটি মুক্তির পথ, নাকি একটি নতুন অন্ধকারের দিকে চলার সংকেত? তবে সে জানত, সে যদি এই তাবিজের রহস্য সমাধান করতে না পারে, তবে এই বাড়ির হাসি কখনও থামবে না।
পর্ব ৭: রাতের পর রাতের হাসি
অভিজিৎ তাবিজটি হাতে নিয়ে কক্ষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল। সেই তাবিজের আকৃতি ও চিহ্ন তার মধ্যে এক অদ্ভুত অনুভূতি সৃষ্টি করছিল। মনে হচ্ছিল, এটি তার জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তের মুহূর্ত—এটা হয় তাকে মুক্তি দেবে, নয়তো তাকে আরও গভীর অন্ধকারে ঠেলে দেবে। অভিজিৎ জানত, এই বাড়ির ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা প্রতিটি দিক, প্রতিটি টুকরো তথ্য তাকে এক সীমানায় নিয়ে যাবে, যেখানে সত্য ও মিথ্যার বিভাজন অস্পষ্ট হয়ে পড়বে।
সে তাবিজটি হাত থেকে নামিয়ে ধীরে ধীরে একটি পুরনো কাঠের টেবিলের ওপর রাখল। টেবিলের চারপাশে অদ্ভুতভাবে এক ধরনের শূন্যতা অনুভব হচ্ছিল। বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল, যেন কোনো এক অদৃশ্য শক্তি তাকে ঘিরে ফেলেছে। অভিজিৎ জানত, এই তাবিজ একটি চাবি, যা এই বাড়ির গোপন রহস্য খুলে দেবে। কিন্তু সেই রহস্যটি কি তাকে বাঁচাতে সাহায্য করবে, নাকি আরও গভীর অন্ধকারে ঢুকিয়ে ফেলবে?
আলো নিভিয়ে দিয়ে, অভিজিৎ আবার সেই হাসির শব্দ শুনল। শুরুতে যেটি কেবল দূরের কোনও মেঘের গুঞ্জন ছিল, এখন সেটি এতটা জোরালো ও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে যে, তার মনে হতে লাগল, হাসি যেন তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সে নিজের মনকে শক্ত করে বলে উঠল, “এটা শুধু আমার মন, কিছু নয়। আমি এই হাসির ভেতর সত্য খুঁজে বের করব।”
এমন সময়, তার চোখের সামনে ছোট ছোট হালকা রেখা সৃষ্টি হতে থাকে। সেই রেখাগুলো তাবিজের চারপাশে ঘুরতে থাকে। যেন তাবিজটি এক মন্ত্রমুগ্ধতার মতো কাজ করছে, এবং ধীরে ধীরে পুরো কক্ষটি আলোয় ভরে যাচ্ছে। কিন্তু সেই আলো ছিল অস্বাভাবিক—সে আলো ছিল এক অদ্ভুত গা dark ়, যা যেন সবকিছুকে তলিয়ে নিচ্ছিল।
হাসির আওয়াজ আরও তীব্র হয়ে ওঠে, যেন চারপাশের দেয়ালগুলো ভারী হয়ে উঠছে। অভিজিৎ তার পুরো শরীরের ভেতর এক অদৃশ্য শক্তির স্পর্শ অনুভব করতে থাকে। সে অনুভব করতে পারে, সেই হাসি শুধুমাত্র একটি শব্দ নয়, বরং এক ধরনের আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতীক, যা সেই বাড়ির অতীতের কোনো এক অন্ধকার অধ্যায়ের দিকে তাকে নিয়ে যাচ্ছে। তাকে যেন প্রাচীন কিছু উপকারিতা অনুসরণ করতে বলা হচ্ছে—এবং সেই উপকারিতাটি তাকে এক বিশাল বিপদের মুখোমুখি করবে।
এতক্ষণ ধরে যে হাসির শব্দ সে শুনছিল, তা এখন তার কানের মধ্যে এক দুঃস্বপ্নের মতো মিশে যাচ্ছে। সেটি আর কোনও সাধারণ হাসি ছিল না, বরং যেন এক ঘোরের মধ্যে আবদ্ধ এক আত্মার আত্মকথা। অভিজিৎ এক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে যায়, ভাবতে থাকে, এই সব কিছু কি আসলেই ঘটছে? বা, এটা কি শুধুই তার মনের ভুল?
অভিজিৎ আবার তাবিজটির দিকে তাকাল। ঠিক তখনই, একটি ঝলক দিয়ে, তাবিজের উপর লেখা প্রাচীন চিহ্ন গুলি তার চোখে ধরা পড়ে। সেখানে একটি অদ্ভুত ভাষায় লেখা ছিল: “যারা এই পথ অনুসরণ করবে, তারা অতীতের বোঝা বহন করবে, এবং ভবিষ্যতের প্রতি কোনো আশার দৃষ্টি থাকবে না।”
অভিজিৎ তাবিজটি আবার হাতে নিয়ে পরীক্ষা করল। মনে হল, তাবিজটির মধ্যে এক অদ্ভুত শক্তি ছিল, যা তাকে অনুভব করাচ্ছিল, সে যেন অতীতের একটি গল্পের অংশ হয়ে গেছে। সেই গল্প, যা আজকের বাস্তবতার থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছিল। এভাবে, তার সামনে এক বিশাল শূন্যতা দাঁড়িয়ে ছিল, যেখানে সে প্রতিটি সিদ্ধান্তের সাথে জীবনের গভীরতা ও অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল।
এক মুহূর্তের জন্য, অভিজিৎ ভেবেছিল যে সে আর এই বাড়ি থেকে বের হতে পারবে না। সে ভেবেছিল, এই হাসির আওয়াজ যতটা ভয়ঙ্কর ছিল, ততটা তার জীবনও অন্ধকারে ডুবে যেতে চলেছে। কিন্তু হঠাৎ, তার মনে হল, যদি সে নিজেই সেই হাসির উৎস খুঁজে বের করতে পারে, তাহলে কি সে সব কিছু বুঝে উঠতে পারবে?
তিনটি শব্দ, “অতীত, শূন্যতা, আর হাসি,” যেন অভিজিৎকে আরও গভীর করে ঠেলে দিচ্ছিল। সে জানত, সে যা কিছু করতে যাচ্ছিল, তার পেছনে এক বড় রহস্য লুকিয়ে রয়েছে—এবং সে সেই রহস্যের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল।
এসময় তার মনে হলো, যে একটুকু তথ্য সে পেয়েছিল, সেটা তাকে এখন একটি অপরিহার্য প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এই বাড়ির হাসি, এই অদৃশ্য শক্তি—সব কিছু একটি একক রহস্যের অংশ, যা তাকে কোনোভাবেই অতিক্রম করতে হবে। কিন্তু সেই রহস্য কি তার জন্য সত্যিই এতটা ভয়ানক? বা, সে কি শেষ পর্যন্ত নিজেকে মুক্ত করতে পারবে?
অভিজিৎ এক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার কাছে সব কিছু পরিষ্কার হয়ে আসছিল। তাবিজটি, হাসি, ঘরের অন্ধকার—সব কিছু এখন তার সামনে ছিল। তার জীবন এখন সেই অন্ধকার শক্তির সাথে যুক্ত হয়ে গেছে, যা সে আর পালাতে পারবে না।
সে সিদ্ধান্ত নিল, তার এই রুদ্ধশ্বাস যাত্রার শেষ করে, তাকে সে রহস্যের সামনে দাঁড়াতে হবে। তার সামনে ছিল এক বিরাট চ্যালেঞ্জ, যা শুধু তার জীবন নয়, পুরো অতীতের রহস্যের সমাধান ঘটাবে।
পর্ব ৮: অদৃশ্য অস্তিত্ব
অভিজিৎ তাবিজটি হাতে নিয়ে দীর্ঘক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে ছিল। তার মনকে একটা অদ্ভুত অনুভূতি জড়িয়ে ধরেছিল—এটা কি সত্যিই তার সামনে ঘটে যাচ্ছে? সে নিজেকে প্রশ্ন করতে থাকল। যতটা গভীরভাবে সে এই বাড়ির রহস্যে প্রবেশ করেছে, ততই সেই রহস্য আরো বেশি অন্ধকারে ঢুকে যাচ্ছিল। হাসির আওয়াজ আরও তীব্র এবং বিভ্রান্তিকর হয়ে উঠেছিল, যেন তার চারপাশের পৃথিবী আর বাস্তবতা নেই। তার মস্তিষ্কের কোণে কোণে একটা ভয়ানক অনুভূতি জেগে উঠেছিল—এ বাড়ির শক্তি, এই হাসি, সেগুলো কিছুই সাধারণ নয়। এগুলো বাস্তবতার বাইরের কোনো অশরীরী অস্তিত্ব।
সে জানত, তার সামনে একাধিক প্রশ্ন রয়েছে, কিন্তু তার সঠিক উত্তরগুলো কোথায়? সে কি এই অশরীরী শক্তির সামনে দাঁড়ানোর সাহস পাবে? অথবা তাকে সত্যিই এই বাড়ির অতীতের সাথে এক হয়ে যেতে হবে?
ঘরের মধ্যে অন্ধকার আরও ঘনীভূত হতে থাকে, এবং অভিজিৎ মনে মনে প্রস্তুত হতে থাকে। তার সামনে যে বাধাগুলো ছিল, সে জানত, সেগুলো সে কাটিয়ে উঠতে পারবে না যদি সে নিজে সত্যের দিকে না এগিয়ে যায়। তাবিজটি তার হাতে যেন আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল, একটি অদৃশ্য শক্তি যা তাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
সে জানত, তাকে এই বাড়ির অতীতের চিত্র এবং ইতিহাস বুঝতে হবে। ঘরের প্রতিটি কোণ তাকে একটা ভিন্ন বার্তা দিয়ে যাচ্ছে—অথবা তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে যে এই বাড়ির অতীতের কোনও কক্ষ কোথাও গোপন ছিল, যেখানে সে পৌঁছাতে পারেনি। কিন্তু সেই স্থানটি কোথায়? কোথায় ছিল সেই গোপনতা, যা এতদিন পর্যন্ত অদৃশ্য ছিল? হাসির শব্দ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছিল, যেন ঘরের প্রতিটি ভাঙা অংশে তার উপস্থিতি অনুভূত হচ্ছিল।
অভিজিৎ হঠাৎ মনে পড়ে গেল একটি পুরনো কাহিনী, যা বাড়ির ইতিহাসের একটি অন্ধকার অধ্যায় ছিল। তিনি পড়েছিলেন, সেই বাড়ির আগের মালিকেরা একবার একটি প্রাচীন শয়তানি পন্থা অনুসরণ করেছিলেন—যেখানে হাসি ছিল শক্তির চিহ্ন। বাড়ির প্রতিটি প্রাচীন অংশে, প্রতিটি ধ্বংসস্তূপে, সেই হাসির প্রতিধ্বনি অবশিষ্ট ছিল। এমনকি, স্থানীয়রা বলত, সেই হাসি কোনও সাধারণ মানুষের ছিল না, বরং সেটি ছিল এক অদৃশ্য শক্তির হাসি, যেটি শতাব্দীজুড়ে এই বাড়ির ভিতরে এক চিরস্থায়ী বসবাসে ছিল।
আলোর নিভে যাওয়া সেই ঘরে, অভিজিৎ নিজের ভিতর এক অতিপ্রাকৃত শক্তি অনুভব করতে শুরু করে। হাসির আওয়াজ যেন তার নিজের মধ্যে প্রবাহিত হয়ে তাকে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি জানত, তাকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। হাসি, যেটি এত দিন ধরে তাকে ঘিরে রেখেছিল, তা কি সত্যিই তাকে নিজের অধীনে নিয়ে যাবে, না সে নিজে সেই শক্তিকে পরাস্ত করতে পারবে?
এমন সময়, হঠাৎ গা dark ় এক শীতল হাওয়া সারা ঘরে প্রবাহিত হতে থাকে। অভিজিৎ নিজের শরীরের চারপাশে এক অদ্ভুত শূন্যতা অনুভব করল। সেদিকেই তার চোখ পড়ে। ঘরের এক কোণে, মেঝে থেকে উঠে আসা একটি অন্ধকার ছায়া দেখতে পেল। ছায়াটি ধীরে ধীরে তাকে দিকে এগিয়ে আসছিল। একটি চাপা হাসি যেন আবার তার কানে আসছিল। এবার তা আর কোনো দুর্বল আওয়াজ ছিল না, বরং একটি গভীর, ভয়ঙ্কর রক্তক্ষয়ী হাসি, যা তাকে ভয় ও শূন্যতার দিকে ঠেলে দিচ্ছিল।
অভিজিৎ জানত, এই অশরীরী শক্তির সামনে দাঁড়িয়ে তার নিজেকে শক্তিশালী করতে হবে। সে তাবিজটি হাতে নিয়ে ছায়ার দিকে এগিয়ে গেল। সে বুঝতে পারছিল না, এই ছায়া কি মানবিক ছিল, না এক অতিপ্রাকৃত শক্তি যা তাকে সজাগ করে তুলছিল। কিন্তু সে জানত, এই মুহূর্তে একটাই পথ—এবার তাকে ওই ছায়াটিকে, ওই অশরীরী শক্তির অবশেষ, মোকাবিলা করতে হবে।
ছায়াটি আরও কাছে চলে আসছিল, আর সেই হাসি আরও কটু হয়ে উঠছিল। অভিজিৎ নিজের হাত শক্ত করে ধরে রেখেছিল। সে বুঝতে পারছিল না, সেই হাসি তাকে কীভাবে প্রভাবিত করছে, কিন্তু অনুভব করছিল—এটা শেষের শুরু। তার সামনে এক ধরনের দ্বন্দ্ব ছিল—একটা শক্তি, যা তাকে নিজের জীবন, নিজের অস্তিত্বের পরীক্ষা নিতে বাধ্য করছে।
তখনই, শূন্যতার মধ্যে একটি আওয়াজ ভেসে আসে—”তুমি কি সত্যিকারের শক্তির মুখোমুখি হতে পারবে?” সে শব্দ অভিজিতের চারপাশে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। তার চোখে তখন কিছু অদ্ভুত দৃশ্য ভেসে উঠছিল—যেন সে অতীতের কোনো সময়ে পৌঁছে গেছে, এবং সেই সময়ে হাসি, এক অশরীরী শক্তির প্রতীক হিসেবে, তাকে নিয়ে যাচ্ছিল। তার সামনে কিছু এক রহস্যময় বিপদের ছবি ভেসে উঠছিল, যা তাকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলছিল।
অভিজিৎ সেই হাসির শব্দের দিকে তাকিয়ে থাকল। তবে এবার, সে বুঝতে পারছিল যে, তার সামনে থাকা এই শক্তি, যে এই বাড়ির রহস্যের ভিত্তি ছিল, সেই শক্তির প্রতিরোধের জন্য তাকে নিজের আত্মাকে শক্তিশালী করতে হবে। সে জানত, এই ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে তাকে বের হয়ে আসতে হবে—একটা নতুন সত্যের সন্ধানে।
শুরু হয়ে গেল তার যাত্রা, যেখানে তাকে নিজের শিরোপার জন্য সাহস এবং শক্তি বের করতে হবে। কিন্তু সে জানত, এই রহস্যের পরবর্তী ধাপ আরও ভয়ঙ্কর হতে চলেছে।
পর্ব ৯: শেষ রাত
অভিজিৎ তার চারপাশে গভীর অন্ধকার দেখতে পাচ্ছিল। সেই অদ্ভুত হাসি, যা এতদিন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, এখন যেন ঘরটির প্রতিটি কোণ থেকে ঘুরে ফিরে আসছিল। তবে, আজ সে অন্য কিছু অনুভব করছিল। এটি আর কেবল একটি আতঙ্কের অনুভূতি ছিল না, বরং তার ভিতরে কোনো অদৃশ্য শক্তি বিরাজ করছিল। সে জানত, এখন তাকে এই অশরীরী শক্তির সঙ্গে এক অজানা যুদ্ধে জড়াতে হবে—এটি আর কোনো ভয়ের গল্প ছিল না, এটি ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
সেই হাসি, যা প্রথমদিকে তার মনে শঙ্কা সৃষ্টি করেছিল, এখন যেন এক শক্তিশালী শোরগোলের মতো সারা ঘরকে ভরিয়ে তুলছিল। সেই হাসির মধ্যেই যেন একটি কলহ, একটি চিরস্থায়ী যন্ত্রণা লুকিয়ে ছিল। এক দিকে, সে যেন একটি আধ্যাত্মিক যুদ্ধের মাঝে চলে গিয়েছে, অন্য দিকে তার সমস্ত মস্তিষ্ক ও মন, এই অশরীরী শক্তির মুখোমুখি হতে চাচ্ছিল। কিন্তু তার মনে একটাই প্রশ্ন ছিল—এই যুদ্ধ শেষ হবে কিভাবে? এই রহস্যের সমাধান খুঁজে পাবার পর সে কি সত্যিই মুক্তি পাবে?
তাবিজটি তার হাতে শক্ত হয়ে উঠছিল। সে জানত, তার সামনে এক বড় বিপদ অপেক্ষা করছে, কিন্তু এ মুহূর্তে, তাকে সমস্ত ভয়কে পরাস্ত করে একত্রিত করতে হবে। তাকে আরও গভীরভাবে একে একে সমস্ত অতীতের ইতিহাস খুঁজে বের করতে হবে, যা তাকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছে।
হাসির আওয়াজ আরও তীব্র হতে থাকে। ঘরটি যেন ধীরে ধীরে এক চক্রাকারে ঘুরতে থাকে, আর সেই হাসি অবিরাম প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। সে অনুভব করতে থাকে, হাসি যেন তার অন্তরঙ্গ অনুভূতিতে ঢুকে পড়ছে—তার সমস্ত শ্বাস, তার সমস্ত চিন্তা, সেই হাসির সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। এক মুহূর্তে, তার মনে হয়েছিল যে সে এক চিরস্থায়ী আন্ধকারের মধ্যে আটকা পড়েছে।
কিন্তু অভিজিৎ জানত, এই চিরস্থায়ী ঘোরের মধ্যে সে শুধুমাত্র একটি পথ খুঁজে বের করতে পারে—যত গভীর অন্ধকার হোক, তাকে নিজেকে সেখান থেকে বের করে আনতে হবে। সে জানত, তাকে এই রহস্যের মোকাবিলা করতে হবে। এবং সেই রহস্য সমাধান করতে তাকে অতীতের কিছু ইতিহাস এবং শক্তি খুঁজে বের করতে হবে, যা এই হাসির উৎসে লুকিয়ে ছিল।
সে তাবিজটি হাতে ধরে পুরো বাড়ির ভেতরে আরো একবার ঘুরে বেড়াতে শুরু করল। তার চোখে সেই কালো ছায়ার চিত্রটি স্পষ্ট হয়ে উঠছিল, যা তাকে বারবার তাড়া করছিল। অভিজিৎ জানত, সেই ছায়ার মাঝে একটি ভয়ঙ্কর শক্তি লুকানো ছিল, যা তাকে পুরোপুরি ঘিরে ফেলেছিল। সেই ছায়াটি যেন তাকে বলে দিচ্ছিল, “তুমি এই ঘরের মধ্যে নিজের সত্য খুঁজতে এসেছ, তবে, তুমি কি সেই সত্য সহ্য করতে পারবে?”
প্রতিটি ঘর, প্রতিটি কক্ষ যেন তাকে চ্যালেঞ্জ করছিল। ঘরের দেয়ালে হালকা রূদিত ছাপ ছিল, আর তাবিজের মধ্যে শকুনের মতো সুর দিয়ে ওঠা এক অদৃশ্য মন্ত্রগাথার আওয়াজ কানে আসছিল। প্রতিটি কোণে, প্রতিটি জায়গায় তার ওপর অশরীরী শক্তির প্রভাব বাড়ছিল। এক সময়, অভিজিৎ ঠিক করে ফেলল, তাকে এই রহস্যের সমাধান করতে হবে, না হয় সে এখান থেকে বের হতে পারবে না।
অভিজিৎ এক কোণ থেকে আরেক কোণে হাঁটতে হাঁটতে আবার সেই পুরনো বইটি দেখতে পেল, যেখানে ওই হাসির সম্পর্কে কিছু অদ্ভুত তথ্য লেখা ছিল। বইটির পৃষ্ঠাগুলো তোলার সময়, অভিজিৎ নতুন একটি চিহ্ন আবিষ্কার করল। সেখানে লেখা ছিল, “যে হাসি শেষ হতে জানে না, সে হাসি শুধুমাত্র একটি বন্ধুর পথের নির্দেশিকা, যাকে পেছনে রেখে আসা সম্ভব নয়।“
এই নতুন তথ্যটি অভিজিতের মনকে আরও আরও গভীরভাবে আবদ্ধ করে ফেলল। বইটির পৃষ্ঠার মধ্যে আরো কিছু কথা লেখা ছিল—“হাসির উৎসই তোমার শেষ আশ্রয়, সেখানে তুমি মুক্তি পাবে না, কিন্তু সেটা তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় বাস্তবতা।”
অভিজিৎ কাগজটির দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে, এখানে যে রহস্য লুকিয়ে আছে, তা শুধু বাড়ির ইতিহাসই নয়, বরং তার নিজের অস্তিত্বেরই অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই হাসির উৎস, সেই অদৃশ্য শক্তি, যা এতদিন তাকে ঘিরে রেখেছিল, তা আসলে তার অজানা অতীতের অংশ।
এই মুহূর্তে, অভিজিৎ শেষ পর্যন্ত এক কঠিন সিদ্ধান্তে পৌঁছল। সে জানত, তার জীবন এক অনন্ত গোলকধাঁধার মধ্যে আটকে আছে। তার সামনে আর কোনো পথ ছিল না, except একটাই। সে সেই হাসির উৎস, সেই অদৃশ্য শক্তির মুখোমুখি গিয়ে পুরোপুরি সৎ ও সাহসী ভাবে রুখে দাঁড়াবে।
অভিজিৎ তাবিজটি শক্ত করে ধরল, এবং চোখ বন্ধ করে সেই অন্ধকার ঘরে প্রবেশ করতে শুরু করল। কক্ষের মধ্য থেকে হাসির আওয়াজের চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছানোর আগেই, সে বুঝতে পারল—এটা শুধু একটি যুদ্ধ নয়, এটি তার জীবনের অন্তিম সমাধান হতে চলেছে।
অভিজিৎ জানত, যে কোনো অশরীরী শক্তির মুখোমুখি দাঁড়ানোর জন্য তাকে নিজের ভিতরে অদৃশ্য এক শক্তির খোঁজ করতে হবে। তার মনের গভীরে তাকে নিজের অস্তিত্বকে একভাবে পুনরাবৃত্তি করতে হবে। তবেই সে হাসির উৎসের একমাত্র নিদান খুঁজে পাবে।
পর্ব ১০: রহস্যের সমাধান
অভিজিৎ তার অন্তর্নিহিত শক্তির প্রতি বিশ্বাস রেখে ঘরের গভীরে প্রবেশ করতে থাকে। ঘরের চারপাশে অন্ধকার ছিল, এবং সেই অদৃশ্য হাসির শব্দ ক্রমেই জোরালো হতে থাকছিল। তার চারপাশের বাতাসও যেন ভারী হয়ে উঠেছিল, যেন ঘরটি এক জীবন্ত সত্ত্বা হয়ে উঠেছে এবং তার প্রতি প্রতিশোধ নিতে চায়। কিন্তু অভিজিৎ জানত, সে যদি এই অশরীরী শক্তির মুখোমুখি না হয়, তবে তার জীবনের কোনো মানে থাকবে না। সে যদি সত্যের সন্ধান না পায়, তবে তার সারা জীবনই ব্যর্থ হবে।
সে একে একে কক্ষের মধ্যে এগিয়ে চলে। তার সামনে এক অদ্ভুত, পর্দাবিহীন জানালা ছিল, যা বাইরে দিকে খুলে যাচ্ছিল। কিন্তু জানালা দিয়ে কোনো আলো আসছিল না—শুধু অন্ধকার, যেন সবকিছু সেখানে আটকে গেছে। ঘরের ভেতরের বাতাস ছিল মৃত, গা dark ় এবং ঠাণ্ডা। সেই অদ্ভুত হাসির শব্দটি, যা এতদিন তাকে আতঙ্কিত করেছে, এখন যেন তার সঙ্গী হয়ে উঠেছিল। তার মনে হচ্ছিল, এই হাসি তার সঙ্গে কথা বলছে, তাকে চ্যালেঞ্জ করছে, তাকে আসল সত্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
এক মুহূর্তে, ঘরের কোণ থেকে একটি অন্ধকার ছায়া বেরিয়ে আসতে থাকে। সেই ছায়াটি ধীরে ধীরে অভিজিৎ-এর দিকে এগিয়ে আসে, যেন তাকে কিছু বলতে চাচ্ছে। কিন্তু, সেই ছায়ার মধ্যে কোনো মুখ ছিল না—একটি অদৃশ্য সত্ত্বা, যা শুধু তার উপস্থিতি দিয়ে অনুভূত হচ্ছিল। অভিজিৎ জানত, সে যদি এই ছায়ার সামনে দাঁড়াতে না পারে, তবে সে কখনোই এই বাড়ির রহস্য সমাধান করতে পারবে না।
তাবিজটি তার হাতে শক্ত হয়ে উঠছিল, এবং সেই শক্তির মধ্যে একটি অদ্ভুত ধরনের শীতলতা অনুভব হচ্ছিল। অভিজিৎ একটি দীর্ঘ শ্বাস নিল এবং ছায়াটির দিকে এগিয়ে গেল। একদম কাছে চলে এসে, সে জানতে পারল, সেই ছায়ার মধ্যে এক পুরনো রহস্য লুকিয়ে ছিল—এটা ছিল এক অব্যক্ত আত্মার চিহ্ন, যা এই বাড়ির অতীতের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল।
হাসির শব্দ আরও তীব্র হতে থাকে। এটি যেন কোনো দানবীয় হাসি, যা শোনা যায়, কিন্তু দেখার উপায় নেই। তবে, অভিজিৎ এবার অদৃশ্য শক্তির সামনে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারে, এই হাসি শুধু ভয় ধরানোর জন্য নয়, বরং তাকে এক ধরনের অন্তর্নিহিত শক্তি অনুভব করাচ্ছে। তাকে সেই অতীতের সত্যের মুখোমুখি করতে চাচ্ছে।
অভিজিৎ জানত, তাকে এই অশরীরী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। সেই হাসি তাকে একটি ভয়ের জগতে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু সে নিজেকে ধরে রেখে ধীরে ধীরে সেই হাসির উৎসের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। এবার, সে বুঝতে পারে, এই বাড়ির রহস্য তার একান্ত শত্রু নয়, বরং একটি পুরনো, শক্তিশালী অস্তিত্ব, যা অতীতে হারিয়ে গেছে এবং এখনও এই বাড়ির ভিতর আটকা পড়েছে।
অভিজিৎ তাবিজটি হাতে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে থাকে। একসময়, সে একটি ঘরের দিকে এগিয়ে গেল, যেখানে এক অদ্ভুত আলো ঝলকাতে শুরু করে। সেই আলো যেন তাকে এক অদৃশ্য পথে নিয়ে যাচ্ছিল। কক্ষের মধ্যে একটি পুরনো ছবি ছিল—একটি পুরুষের ছবি, যার চোখ দুটি অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ছিল। সেই ছবির মধ্যে যে হাসি ছিল, তা যেন তার নিজেরই ছিল। অভিজিৎ দাঁড়িয়ে রইল, এবং এক মুহূর্তে সে বুঝতে পারে, সেই হাসি আর কোনো সাধারণ হাসি নয়, বরং একটি আত্মার প্রতিধ্বনি, যা দীর্ঘদিন ধরে এই বাড়িতে বসবাস করছে।
তার সামনে একটি দরজা ছিল, যা পুরনো এবং ক্ষয়ে গিয়েছিল। দরজাটি খুলে সে দেখতে পেল, একটি বড় কক্ষে প্রবাহিত হওয়া এক শক্তিশালী আলো ছিল। সেই আলো তার চোখের সামনে এক রহস্যময় পথ খুলে দিয়েছিল। তার সামনে ছিল এক বৃহত্তর সত্য—এটি ছিল সেই রহস্যের সমাধান। অতীতের অন্ধকারের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সেই ভয়ঙ্কর হাসির উৎস ছিল তার সামনে।
অভিজিৎ জানত, তাকে এই পথ অনুসরণ করতে হবে। এ পথে আরও অনেক বিপদ হতে পারে, কিন্তু সে জানত, এই বাড়ির রহস্যের উত্তর বের করা ছাড়া তার আর কোনো উপায় নেই। তার সামনে ছিল এক নতুন অধ্যায়, যেখানে সে অশরীরী শক্তির বিরুদ্ধে শেষ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হতে চলেছিল।
সে তাবিজটি হাতে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজা খুলে, তার সামনে এক বিশাল কক্ষের চিত্র খোলামেলা হয়ে উঠল। কক্ষের মাঝখানে একটি মূর্তি ছিল, একটি পুরনো রূপালী মূর্তি, যা গা dark ় চামড়ায় ঢাকা ছিল। মূর্তির চোখ দুটি ছিল বন্ধ, এবং সেই মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে, সে অনুভব করেছিল—এই মূর্তি ছিল সেই শক্তির অবশিষ্টাংশ, যা দীর্ঘদিন ধরে এই বাড়িতে আটকা পড়েছিল।
তার সামনে সেই হাসির শকুনের মতো হাসি শুনতে পেল। এবার অভিজিৎ বুঝতে পারে—এটা কেবল একটি হাসি নয়, বরং এক অদৃশ্য শক্তির ডাক। তাকে অবশ্যই সেই শক্তির মোকাবিলা করতে হবে, যদি সে এই রহস্যের শেষ সমাধান পেতে চায়। সে জানত, এই শেষ লড়াই তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন যুদ্ধ হতে চলেছে।
তিনটি শব্দ, “সত্য, শক্তি, হাসি,” তার মনে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল। এবার তার সামনে সেই অন্ধকার শক্তির মুখোমুখি হওয়ার সময় এসেছে। সে তাবিজটি হাতে নিয়ে প্রস্তুত হয়ে উঠল, এবং চূড়ান্ত লড়াই শুরু হল।
পর্ব ১১: শেষ অবধি হাসি
অভিজিৎ তার হাতে তাবিজটি শক্ত করে ধরেছিল, এবং সামনে পা বাড়াতে থাকল। কক্ষের ভিতরে আলো ছিল, কিন্তু সেই আলো ছিল অস্বাভাবিক—হালকা নয়, বরং একটি ভীতিকর, গা dark ় সুরঙ্গে ঢুকে যাওয়ার মতো। এর মধ্যে সেই হাসির শব্দ আবার তার কানে বাজল। এই হাসি, যা এত দিন ধরে তাকে অনুসরণ করেছিল, এখন যেন ঘরটির কোণায় কোণায় ঘুরছিল, এবং তার থেকে এক ভয়ানক মর্মান্তিক অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ছিল।
তবে, অভিজিৎ জানত, তাকে ভয়ে পিছু হটতে হবে না। তার সামনে এক অজানা শক্তির মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। এই হাসি, যা এতদিন তার মনের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি করেছিল, তা কেবল এক প্রলয়—যেটি এখন তাকে নিজের শক্তি আর সাহস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করাচ্ছিল। সে জানত, এই রহস্যের সমাধান শুধুমাত্র এক শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে আসবে—যে নিজেকে অতিক্রম করতে পারবে, যে অতীতের ভয়কে জয় করতে পারবে।
সে আবার তাবিজটি হাতে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলল। একসময়, কক্ষের এক কোণে থাকা বিশাল মূর্তিটি তার চোখে পড়ল। মূর্তিটির মুখে কোনো অভিব্যক্তি ছিল না, তবে তার চোখ দুটি বন্ধ ছিল। সেই মূর্তির গা dark ় সুরগন্ধ, যা পুরো ঘরটিকে পূর্ণ করে রেখেছিল, সেটি যেন এক জীবন্ত শূন্যতা। তার কাছে মনে হচ্ছিল, মূর্তির চোখ দুটো খুললেই তার সামনে অন্ধকারের এক নতুন দিক খুলে যাবে। এই মূর্তিটি যে কেবল একটি শূন্য রূপ নয়, বরং এক অশরীরী শক্তির প্রতীক, সেটা বুঝতে তার সময় লাগেনি।
অভিজিৎ এবার নিজেকে পুরোপুরি স্থির করল। তাবিজটির শক্তি তাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, যেন সেটি তার হাতে নিজের অস্তিত্বের শেষ চিহ্ন তুলে দিয়েছে। সে আর পিছু হটবে না, কারণ জানত, এই বাড়ির সত্ত্বা তাকে কখনও শান্তি দেবে না যতক্ষণ না সে এই রহস্য সমাধান করে। সে মূর্তির দিকে এগিয়ে গেল, এবং এক নিঃশ্বাসে প্রাচীন মন্ত্রটির উচ্চারণ করতে শুরু করল, যেটি সে বইয়ের পৃষ্ঠায় পড়েছিল। তার মুখ থেকে মন্ত্রটি বের হয়ে আসতেই, ঘরের মধ্যে তীব্র এক শীতলতা অনুভূত হতে শুরু করল। সেই শীতলতার মধ্যে হাসির আওয়াজ কিছুটা থেমে গেল, কিন্তু এখনও এটি পুরোপুরি বন্ধ হয়নি।
এক মুহূর্তের জন্য, ঘরের বাতাস থেমে গিয়েছিল। অনুভূতি হচ্ছিল, যেন পুরো সময় স্থির হয়ে গেছে। কিন্তু পরের মুহূর্তেই, মূর্তিটি আস্তে আস্তে চোখের পাতা খুলে ফেলল, এবং তার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল এক অদৃশ্য শক্তি। সেই শক্তি এতটাই প্রবল ছিল যে অভিজিৎ একে অনুভব করেছিল—একদিকে ঘরটি পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে গেল, অন্যদিকে মূর্তিটি জীবন্ত হয়ে উঠল। সেই হাসি, যা এতদিন তাকে ঘিরে রেখেছিল, এখন এক ভয়ানক রূপ ধারণ করে তার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল।
অভিজিৎ নিজের ভয়ের উপর জয় পেয়ে মূর্তির দিকে আরও এগিয়ে গেল। সে জানত, এই হাসির উৎস থেকে, সে যেভাবে নিজেকে শক্তিশালী করতে পারবে, সেটাই তার জীবনের শেষ চ্যালেঞ্জ। মূর্তিটি তাকে চেয়ে ছিল, কিন্তু তার মুখে কোনো সঙ্গত কারণ ছিল না—যতটুকু সময় সে দাঁড়িয়ে ছিল, ততটুকু সময় তার মনে হচ্ছিল, মূর্তিটি সে শুধু একটি শূন্য শক্তির প্রতীক, আর তাকে মোকাবিলা করতে হবে।
তবে, তার মাথায় এক মুহূর্তের জন্য একটা ভিন্ন চিন্তা উঁকি দিল। “তুমি কী আসলেই সেই শক্তি থেকে মুক্তি পেতে পারবে?” এটা ছিল তার নিজস্ব ভয়, কিন্তু এই মুহূর্তে, সে উপলব্ধি করল, তার অন্তর্নিহিত শক্তির কোনও দিক অবশিষ্ট ছিল না। সে সাহসী হয়ে উঠে সেই মূর্তির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে, অভিজিৎ সেই হাসির ভয়াবহ উপস্থিতি অনুভব করছিল। কিন্তু এবার, সে জানত, তার সামনে এক নতুন যাত্রার সূচনা হয়েছে—এটা তার জীবনের সেই মুহূর্ত, যেখানে সে শেষ পর্যন্ত সঠিক পথে পৌঁছাবে। তাবিজটি তার হাতে শক্ত হয়ে উঠল এবং সঠিক সময় আসল। তার আওয়াজ, “এখন এই বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় এসেছে,” সারা ঘরে প্রতিধ্বনিত হলো।
এক চোখে, সেই হাসির শব্দ আরও তীব্র হয়ে ওঠে। কিন্তু অভিজিৎ তা উপেক্ষা করল, এবং তাবিজটি তুলে সঠিক পথ অনুসরণ করতে লাগল। সে জানত, সে যদি এই বাড়ি থেকে বের হতে চায়, তাহলে তাকে অতীতের সমস্ত ভয় এবং এক অদৃশ্য শক্তির মধ্যে দিয়ে যেতে হবে।
হাসির আওয়াজে আর কোনো ভয় ছিল না। অভিজিৎ তার শক্তি ও সাহস দিয়ে ওই বাড়ির রহস্যের সমাধান করেছে। আর তার ভিতর, সে এক নতুন পথ পেয়ে গেছে—এখন সে তার জীবনে আসল শান্তি খুঁজে পাবে। সেই হাসির আওয়াজ যেন একটি পুরনো অধ্যায়ের শেষ হয়ে গিয়েছিল। সেই অশরীরী শক্তি, যেটি এতদিন ধরে তাকে শিকার করছিল, এখন নিজেই হারিয়ে গেছে।
অভিজিৎ বাড়ির দরজাটি খুলে দিল, এবং বাইরে অন্ধকার রাত ছিল। তবে, এবার তার মনে কোনো ভয় ছিল না। হাসির সেই শব্দ আর কানে আসছিল না—এটা ছিল এক নতুন সকাল, যেখানে সে নিজের জীবনের নতুন পথ শুরু করেছিল।




