Bangla - ভ্রমণ

তিন দিন টোকিওতে

Spread the love

বর্ণালী চট্টোপাধ্যায়


টোকিওর নারিতা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাঁচের দেওয়ালের ওপারে ছড়ানো রোদটা কেমন কৃত্রিম বলে মনে হচ্ছিল ঋতাভরীর। নয় ঘন্টার বিমানে ক্লান্ত শরীর, চোখের নিচে কালচে ছাপ, আর মাথার ভেতরে যেন শব্দহীন কোনো তীব্র গুঞ্জন— ঠিক যেমনটা হয় ঘুমহীন দীর্ঘ যাত্রার শেষে। প্লেন যখন নামছিল, তখন উপর থেকে দেখা শহরটা তাকে মায়াবী লেগেছিল— ছিপছিপে বাড়িগুলো, পরিপাটি রাস্তা, যেন কারও মন খারাপ করার অবকাশ নেই। কিন্তু মাটিতে নামার পরেই সে বুঝেছিল, দুনিয়াটাই বদলে গেছে। চারদিকে অচেনা হরকানা, কাতাকানা, কাংজি— সব মিলিয়ে মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো। যে কায়দায় এক অফিসার তার পাসপোর্ট চেক করছিল, সেখানে স্নিগ্ধতা ছিল ঠিকই, কিন্তু মানুষের মতো নয়, যেন প্রোগ্রামড সৌজন্য। ইমিগ্রেশন লাইনের সামনে দাঁড়িয়ে ঋতাভরী ভাবছিল, ‘এটা কি স্বপ্ন? আমি কি সত্যিই কলকাতা ছেড়ে অন্য এক গ্রহে এসে পড়েছি?’ কলকাতার সেই পরিচিত গন্ধ— বাসের ধোঁয়া, গলির রাঁধুনির ঝাল মশলা, ভিজে মাটির ঘ্রাণ— এগুলো যেন অদ্ভুতভাবে দূর থেকে কানে কানে বলে যাচ্ছিল, “তুই এখানে নেই।” সে জানত, শুধু তিন দিনের জন্যই এসেছে, আন্তর্জাতিক ছাত্র সম্মেলনে যোগ দিতে, কিন্তু মনের মধ্যে একটা হালকা দমবন্ধ ভাব ততক্ষণে জমে উঠছিল। তার ছোটখাটো স্যুটকেস নিয়ে যখন সে এয়ারপোর্ট থেকে নারিতা এক্সপ্রেস ধরতে যাচ্ছিল, তখন পথ চিনে নেওয়াটা যেন একটা পরীক্ষার মতো লাগছিল। সব বোর্ডিং সাইন বোঝা যাচ্ছে না, লোকজন হাসছে না, কেউ তাকাচ্ছে না, প্রত্যেকে ব্যস্ত, নিখুঁত, নিঃশব্দ। ট্রেনে উঠে সে জানালার ধারে বসে দেখছিল, কী নিখুঁতভাবে শহর এগিয়ে চলেছে— গাছগুলো গুচ্ছ গুচ্ছ করে সাজানো, গাড়ির লাইন বাঁক নিচ্ছে যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা রেখার মতো, আর কেউ একে অপরের মুখের দিকে তাকায় না। এ কেমন শহর? তার তো কেউ নেই এখানে।

হোটেলটা আগেই বুক করা ছিল— শিনজুকু অঞ্চলে, এক ছোট, আধুনিক ডিজাইনের ব্যবসায়ী হোটেল, যেখানে রিসেপশনিস্ট হাসে না, শুধু নমস্তে বলে মাথা ঝোঁকায়। ঘরটা ছোট, বিছানা দেওয়ালে ঠেকানো, জানালার পাশে ছোট ফোল্ডিং ডেস্ক, আর এককাপ কফির মতো নিঃসঙ্গতা। ঘরে ঢুকেই ঋতাভরী নিজের ব্যাগ থেকে একটা ছোট মাটির গন্ধওয়ালা বেলপত্র এনেছিল— ঠাকুরের কাছ থেকে নিয়ে এসেছিল মা— সেটা বিছানার পাশে রাখল। ফোনে চার্জ দিয়ে মা-কে ভিডিও কল করতে গিয়েও থেমে গেল— কী বলবে? যে সে ভয় পাচ্ছে? যে তার খুব একা লাগছে? মা হয়তো বলবে, “তিন দিনের তো ব্যাপার, এইটুকুতেই মন খারাপ?” অথচ একাকিত্বটা ছিল ভীষণ রকম সত্যি। ফেসবুকে ছবি আপলোড করলে হয়তো সবাই বলবে, “ওয়াও, জাপান!” কিন্তু সেই ক্যামেরার বাইরের ভয়, দমচাপা অনুভূতি কে বুঝবে? ডায়েরি খুলে ঋতাভরী লিখল— “আজ আমার মধ্যে একটা জাদুবাস্তবতা কাজ করছে। আমি যেন নিজের ছায়ার সঙ্গে কথা বলছি। টোকিও এত নিঃশব্দ কেন?” রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার চারপাশ আরও বেশি অচেনা হয়ে উঠছিল। জানালার বাইরে আলো-ভরা শহরটায় গাঢ় ছায়া পড়ে যাচ্ছিল আর তার বুকের মধ্যে কেমন একটা চাপা কষ্ট হচ্ছিল— বাংলা গান চালিয়ে সে মৃদু আওড়ে উঠল, “আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো বিদেশিনী।” এই গানের কোনো বিদেশিনী নয়, সে নিজেই এখন বিদেশিনী— নিজের জায়গা থেকে ছিটকে আসা এক যাত্রী। ঘুম আসছিল না। নিজের শরীরটাকে যেন বেমানান লাগছিল বিছানার মধ্যে— এই বিছানা তার নয়, এই শহর তার নয়, এই ভাষা তার নয়। অথচ এখানেই তাকে আগামী তিন দিন কাটাতে হবে। চোখ বুজে সে কলকাতার গন্ধ খুঁজে ফিরছিল— কলেজ স্ট্রিটের গলি, গরম ঘুগনি, প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডে ছুটে চলা ট্রাম। এ শহরে ট্রাম নেই, কেবল নিঃশব্দে চলা ম্যাট্রো আর গুছিয়ে বসা মানুষ।

ভোররাতে ঘুম ভাঙে হালকা আলোয়। সে বোঝে, আজ নতুন দিন। প্রথম দিন। কনফারেন্সের রেজিস্ট্রেশন, একটা ওয়ার্কশপ, তারপর এক্সকর্শন— এগুলোই তালিকায় আছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে দেখে, নিজের চোখে এক অচেনা ক্লান্তি। আলতো করে কাজল টানে, হালকা লিপস্টিক— কিন্তু মনটা সাজানো যায় না। সে মনে মনে বলে, “আমি পারব।” ব্যাগ গুছিয়ে, নাম ব্যাজ ঝুলিয়ে, সে হোটেল থেকে বেরোয়। বাইরে রোদের ঝলকানি, শিনজুকুর ব্যস্ত রাস্তা, সাইকেলে ছুটে চলা স্কুলছাত্র, আর মাথা নত করে অফিসে ছুটে চলা মানুষ— যেন কারও মুখে গল্প নেই। সে হাঁটে, ম্যাপে দেখে দেখে কনফারেন্স ভেন্যুর দিকে এগোয়। হঠাৎই এক বৃদ্ধ জাপানি ভদ্রলোক তার পাশে এসে দাঁড়ান, কিছু বলার চেষ্টা করেন, কিন্তু ঋতাভরী কিছুই বুঝতে পারে না। দুজনেই কিছুটা হাসে— এই প্রথম দিনের প্রথম মানবিক মুহূর্ত, ভাষাহীন বন্ধুত্ব। হয়তো এই শহরেও কিছু গল্প আছে। হয়তো, শুধু বুঝে নিতে হবে।

টোকিওর সকালটা যেন নিখুঁতভাবে আঁকা কোনো ছবি— পরিষ্কার আকাশ, রাস্তায় ছুটে চলা নিঃশব্দ গাড়ি, ট্রাফিক সিগন্যালে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ, আর সবকিছুর মধ্যে এক অদৃশ্য ছন্দ। ঋতাভরী ধীরে ধীরে বুঝতে পারছিল, শহরটার সৌন্দর্য যত না চোখে, তার চেয়ে অনেক বেশি আচরণে। শিনজুকুর রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সে চোখে পড়ে এই নিখুঁত নিষ্ঠুরতা— কেউ কারো সঙ্গে চোখাচোখি করে না, কেউ কারো পাশে গা লাগায় না, কারো মুখে বিরক্তি নেই, আবার খুব বেশি হাসিও নেই। যেন সবাই নিজের নিজস্ব পৃথিবীর ভেতর চলেছে, এক নিঃশব্দ যুদ্ধ। কনফারেন্সের ভেন্যু—টোকিও ইউনিভার্সিটি অফ ফরেইন স্টাডিজ— পৌঁছে সে দেখে নানা দেশের ছাত্রছাত্রী, কেউ ইতালিয়ান, কেউ থাই, কেউ কোরিয়ান, কেউ আফ্রিকান। সবাই নিজেদের মতো করে মিশছে, কথা বলছে, অথচ ঋতাভরীর মনে হচ্ছিল, সে যেন বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ওয়ার্কশপের রেজিস্ট্রেশন ডেস্কে গিয়ে নাম বলতেই হালকা একটা গোলমাল— উচ্চারণটা যেন ঠিক মিলছে না। “Ritabhari?” জাপানি স্বরে উচ্চারিত নামটা কেমন অদ্ভুত শোনায়। সে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে দেয়। ব্যাজটা হাতে পেয়ে একটা অচেনা স্বস্তি হয়— এই নামটা অন্তত তার নিজস্ব। চারদিকে কেউ ইংরেজিতে কথা বললেও, বাকিদের মধ্যে জাপানি কথোপকথনের এক বিরামহীন স্রোত— যেন সে একা এক ভাষার দ্বীপে আটকে গেছে। খাবার পর্বে প্রথমবার, সে মেশিন থেকে কিনে আনা টিকিট হাতে এক ছোট্ট রেস্তোরাঁয় ঢোকে। দেয়ালে ঝুলছে সুশি, টেম্পুরা, রামেনের ছবি, আর তার নিচে হরকানায় লেখা নাম। কাউন্টারে দাঁড়িয়ে সে বোঝার চেষ্টা করছিল কোনটা কী— হঠাৎই পেছন থেকে এক মেয়ে এগিয়ে এসে বলে, “Need help?” ঋতাভরী চমকে ফিরে তাকায়। হাসিমুখের এক জাপানি তরুণী— চোখে গোল ফ্রেমের চশমা, হাতে ক্যামেরা ঝোলানো— ইংরেজিতে কথা বলছে! যেন এক ফোঁটা জল শুকনো গলায় পড়ল।

তার নাম নোরি ফুজিমোতো। জন্ম জাপানে, কিন্তু ইংরেজি শেখা হয়েছে থাইল্যান্ডে ছোটবেলায় বাবা-মায়ের চাকরিসূত্রে থেকে। এখন টোকিওতেই ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফি করে, কনফারেন্সে এসেছে নিজের একটি ভিজ্যুয়াল জার্নাল উপস্থাপন করতে। নোরির সঙ্গে কথা বলতে বলতে ঋতাভরী বুঝে যায়, ভাষা শুধু অক্ষরের বিন্যাস নয়— এটা সাহসেরও বিষয়। নোরির উৎসাহে তারা রামেন অর্ডার করে, বসে আলাপ শুরু করে। ঋতাভরী শোনায় কলকাতার কথা, বর্ষার দুপুর, কলেজ স্ট্রিট, ফুচকা, বাঘাযতীন ব্রিজ— আর নোরি শোনায় ওসাকা, ফুকুয়োকা, পাহাড়ে হাঁটা আর চেরি ব্লসমের গল্প। হঠাৎ করেই ঋতাভরী টের পায়, অচেনা ভাষার ভিতরেও এক ধরণের ‘ভাষাহীন’ বোঝাপড়া জন্মাতে পারে। কেউ একজন তার পাশে আছে, চোখে চোখ রেখে কথা বলছে, শুনছে, বুঝছে। এই বোঝাপড়া জাপানি বা বাংলা নয়—এটা মানুষ-মানুষের মধ্যে এক অতীন্দ্রিয় সেতু। সেই বিকেলটা যেন হালকা রোদে মোড়া ছিল, আর শহরের ব্যস্ততা ধীরে ধীরে পেছনে পড়ে যাচ্ছিল। নোরি তার ক্যামেরা দেখায়—ছবি তোলে পথের লোকজনের, ট্রাফিক আলো, ছাতা মাথায় হেঁটে যাওয়া বৃদ্ধা। সে বলে, “I like stories without words.” ঋতাভরী মনে মনে ভাবে, “আমি তো সবসময় শব্দ খুঁজি— কবিতায়, গল্পে, ডায়েরির পাতায়।” কিন্তু এই শহর তাকে শেখাচ্ছে, সব কথা ভাষায় ধরাও যায় না।

বিকেলে হোটেলে ফিরে এসে ঋতাভরী আয়নার সামনে দাঁড়ায়। তার মনে হয়, আজকের সে সকালকার মেয়েটির চেয়ে একটু সাহসী, একটু কম দিশেহারা। শিনজুকুর এক রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আজ সে পথ জিজ্ঞেস করেছিল একজনকে— প্রথমে ইংরেজিতে, উত্তর না পেয়ে অগত্যা মুখভঙ্গিতে। লোকটি হেসে বুঝিয়ে দিয়েছিল— কোনো অপমান নেই, কেবল বোঝার চেষ্টা। ছোট ছোট জয়গুলো এত ক্ষুদ্র, কিন্তু মনটাকে শান্ত করে দেয়। ফোনে মা-কে ভিডিও কল করে বলে, “আজ রামেন খেয়েছি, গরম গরম ছিল, নুডলস লম্বা লম্বা, আর পাশে কী যেন ছিল, বুঝিনি, তবে খারাপ লাগেনি।” মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কাঁচা মাছ খাসনি তো?” দুজনেই হেসে ওঠে। সেই হাসির মধ্যে একটু আপন, একটু বাড়ির গন্ধ ছিল। কথা শেষ করে সে বিছানায় বসে আবার ডায়েরি খোলে— আজ লিখে, “নোরি এক ভাষাহীন দরজা খুলে দিল। হয়তো ভাষা না জানলেও সম্পর্ক গড়ে ওঠে, শুধু চাই চোখে চোখ রাখা সাহস।” শহরটা এখনো অচেনা, তবু মনে হচ্ছে, একটা জানালা খোলা হয়েছে। যেখান দিয়ে আলো ঢোকে, আর সেই আলোয় নিজের মুখটা একটু পরিষ্কার করে দেখা যায়।

টোকিও বে-এর ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা রেনবো ব্রিজ যেন শহরের শরীরে আঁকা এক সাদা রেখা, যার বুক দিয়ে ছুটে চলে সময়। বিকেলের আলোর ঝিকিমিকি তার গায়ে রং বদলায়, কখনও হালকা হলুদ, কখনও কমলা, কখনও নীলচে সাদায় মাখামাখি এক বিভ্রম। সেই ব্রিজের ধারে দাঁড়িয়ে ঋতাভরী প্রথমবার টোকিওকে ‘দূর থেকে’ দেখল। সে আর নোরি ফুজিমোতো দুজনেই হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছেছিল এখানকার ওপেন ওয়াকওয়েতে, মাথার ওপর দিয়ে ছুটে চলেছে গাড়ি, পায়ের নিচে জল, আর সামনে বিশাল শহরের সিলুয়েট। এতদিন ধরে যে শহরকে শুধু অ্যানিমে আর ইউটিউব ভিডিওয় দেখেছে, আজ সে শহর তার চোখের সামনে জীবন্ত— তবুও কেমন যেন স্বপ্নের মতো। নোরি হেসে বলল, “You know, most people see Tokyo from inside. But sometimes you have to step out to see it clearly.” ঋতাভরী জানত না কী জবাব দেবে, কিন্তু এই বাক্যটা যেন তার ভেতরে গিয়ে জমে রইল। সে ব্যাগ থেকে একটা পেন আর খাতা বের করে লিখে রাখল, যেন শব্দগুলো হারিয়ে না যায়। “টোকিওর ভিড়ের মাঝেও একটা নিঃসঙ্গতা আছে। আবার সেই নিঃসঙ্গতার ভেতরেও গল্প জমে।”

ব্রিজের ধারে বসে তারা অনেকক্ষণ কথা বলেছিল। হাওয়া বইছিল ধীরে ধীরে, আর দূরে দেখা যাচ্ছিল ইয়াকাতাবুনে ভাসমান রেস্তোরাঁ— লাল লন্ঠন ঝুলছে, তার আলো জলে পড়ে কাঁপছে। নোরি বলল, “আমার মনে হয় তুমি বেশি ভাবো।” ঋতাভরী একটু হেসে বলল, “হ্যাঁ, আমি নিজেকে বোঝার জন্য ভেতরে ভেতরে অনেক বেশি হাঁটাহাঁটি করি।” নোরি তার ক্যামেরার ফ্রেমে ঋতাভরীর এক অচানাচোখ তুলে ধরল— “এই চোখে কিছু গল্প লুকোনো আছে।” দুজনের কথায় কখন যেন সন্ধ্যা নেমে এসেছিল, আকাশ গাঢ় হতে শুরু করেছিল। আলো-আঁধারির খেলায় শহরটা যেন আরেকটা রূপ নিল— একদিকে টাওয়ারের গা ছুঁয়ে যাওয়া আকাশ, আরেকদিকে মেট্রো লাইনের শব্দে থরথর করা শহর। ঋতাভরী জিজ্ঞেস করল, “তুমি কখনও অন্য দেশে যাওয়ার কথা ভাবো না?” নোরি একটুও না ভেবে বলল, “Tokyo is my maze. If I leave it, I might forget who I am.” এই কথাটা শুনে ঋতাভরীর বুকের ভেতর কিছুটা ব্যথা হল। সে তো উল্টোটা করছে— নিজের পরিচয়ের খোঁজে টোকিওর মতো গোলকধাঁধায় ঢুকেছে। অথচ এখানকার মানুষ তাদের নিজস্ব গোলকেই আত্মপরিচয়ের অংশ মনে করে। এই বিপরীত মানসিকতা তাকে চিন্তায় ফেলল।

ফেরার পথে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে শিনাগাওয়া স্টেশনের কাছে এক ছোট কফি শপে ঢুকল। কাঁচের জানালার পাশে বসে থাকল কিছুক্ষণ, গরম গ্রিন টি হাতে। ঋতাভরী মনে মনে ভাবল— কলকাতায় এখন রাত নেমে গেছে। তার মা হয়তো খবর দেখছে, তার বাবা ঘুমিয়ে পড়েছেন, আর বন্ধুরা ইনস্টাগ্রাম স্ক্রল করছে। এখানে সে একা, তবুও এই একাকিত্বে আজ আর কাঁটা ফোটে না, বরং নিজেকে নতুনভাবে চিনতে ইচ্ছা করে। নোরি তাকে হালকা গলায় বলে, “You know, you’re changing.” ঋতাভরী জিজ্ঞেস করল, “How?” নোরি বলল, “You are learning to listen, without words.” কথাটা কানে গিয়ে হৃদয়ে নামল। সত্যিই তো, এই শহর কথা বলে না চিৎকার করে, এখানে কেউ গল্প বলে না গলা উঁচু করে— তবুও প্রতিটি আলো, প্রতিটি ট্রেনের ছুট, প্রতিটি ভদ্র নমস্কার একটা করে গল্প। সে আজ শহরটাকে অন্য চোখে দেখছে। আর হয়তো সেই চোখ দিয়েই সে নিজেকেও দেখছে নতুন করে। কফির কাপ ফাঁকা, কিন্তু মনে যেন ভরে উঠেছে কোনো পুরনো জলসার গানের মতো— অপরিচিত, তবুও অদ্ভুতভাবে আপন।

টোকিওর সকাল যতই সুন্দর হোক, ক্ষুধার যন্ত্রণা আর বাঙালি জিভের অভ্যস্ত স্বাদকে উপেক্ষা করা কঠিন। ঋতাভরীর জন্য আজকের দিনটা শুরু হয় এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব দিয়ে— সে কি বিদেশে এসেও নিজের চেনা স্বাদ খুঁজে বেড়াবে, না কি নিজেকে শহরের স্বাদে ছেড়ে দেবে? হোটেলের সকালের খাবার ছিল সাজানো-গোছানো: ভিনেগার দেওয়া স্যালাড, তাজা ফল, অল্প করে সিদ্ধ মাছ, আর একধরনের পাতলা চালের ভাত। সে ভাবল, “এ তো হাসপাতালের ডায়েট!” কিন্তু মজার কথা হলো, এখানকার কেউই বিরক্ত নয়। পাশের টেবিলে বসা এক বৃদ্ধা কাঁচা মাছের সঙ্গে সয়াসস মিশিয়ে দারুণ উপভোগ করছে। ঋতাভরী প্রথমে কাঁটা চামচ খুঁজছিল, তারপর মনে পড়ল— এখানে চপস্টিক দিয়েই খেতে হয়। হালকা সংকোচ নিয়ে সে চপস্টিক হাতে তুলে খাবার ধরতে গেল, কিন্তু মাছটা ফসকে গিয়ে প্লেটে পড়ল। নিজের অক্ষমতায় লজ্জায় সে চারপাশে তাকাল, কেউ দেখছে কি না—কিন্তু কেউ না দেখে বরং, যেন ইচ্ছা করেই না দেখার অভিনয় করছে। এই শহরের মানুষ কাউকে অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলতে চায় না, তাই তারা এমন নিখুঁতভাবে ‘দেখে না’ যে তা-ও একধরনের সামাজিক সৌজন্য। তবে এক তরুণী ওয়েটার এগিয়ে এসে নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, “Would you like a spoon?”—ঋতাভরী হেসে মাথা নাড়ল। সে নিজেই শিখবে। কেবল খাবার নয়, এই একেকটা ছোট ছোট জিনিসই যেন টোকিও তাকে শেখাচ্ছে— ধৈর্য, আত্মসম্মান আর নম্রতা।

সেদিন বিকেলে কনফারেন্সের মাঝে ছিল ‘কালচারাল এক্সচেঞ্জ সেশন’। প্রতিটি দেশের প্রতিনিধিরা তাদের নিজস্ব খাবার, পোশাক, ও সাংস্কৃতিক উপস্থাপনা নিয়ে এসেছিল। ঋতাভরী সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল ছোট ছোট প্যাকেট— নলেন গুঁড়, ছোট সন্দেশ, আর মা-র বানানো শুকনো নারকেলের নাড়ু। সে জানত, এই খাবারগুলো টোকিওর কারও জিভে পরিচিত নয়, তবুও তার ভিতর থেকে এক ধরনের গর্ব জন্ম নিচ্ছিল— “আমার স্বাদ, আমার মাটি থেকে উঠে আসা।” সে যখন সন্দেশ এগিয়ে দিল এক কোরিয়ান ছাত্রীকে, মেয়েটি প্রথমে কৌতূহলী হয়ে দেখল, তারপর খেয়ে বলল, “This is soft… and sweet like rain.” সেই তুলনা শুনে ঋতাভরীর মুখে আলগা হাসি ফুটে উঠল। তার মনে হলো, খাবার শুধু স্বাদ নয়— এটা স্মৃতি, আত্মপরিচয়, ভালোবাসার ভাষা। এমন সময় সে নোরিকে বলল, “তুই জানিস, আমার মা যখন রাঁধে, তখন শুধু খাবার বানায় না— একটা আবেগ ঢেলে দেয়।” নোরি হেসে বলল, “My mother too. Maybe mothers are the same everywhere.” দুজনে তখন হাতে হাতে ঘুরে বেড়াল অন্য দেশের স্টলে— কেউ স্প্যানিশ তাপা এনেছে, কেউ তুর্কি বাকলাভা, কেউ কনসোমে সুপ। নোরি যখন এক জাপানি গ্রিন টি মুচি তুলে দিল ঋতাভরীর দিকে, সে দ্বিধা সত্ত্বেও মুখে রাখল— আর আশ্চর্য হয়ে দেখল, তার জিভে এক ধরণের অচেনা কিন্তু আরামদায়ক স্বাদ ছড়িয়ে পড়ছে। তখনই সে বুঝল, খাবারের মধ্যে দিয়ে সে এই শহরের শরীর ও হৃদয়কে ছুঁতে পারছে।

রাতের দিকে হোটেলে ফিরে এসে ঋতাভরী নিজের ডায়েরি খুলে লিখল— “আজ আমি চামচ ছেড়ে চপস্টিক হাতে নিয়েছি। শুধু খাবারের জন্য নয়, সাহসের জন্য।” সে অনুভব করল, এই শহরে প্রতিদিন তার চেনা অভ্যাসগুলো ভেঙে যাচ্ছে, আর তার মধ্যে জন্ম নিচ্ছে নতুন কিছু। আজ সকালে সে কাঁচা মাছ ধরতে পারেনি ঠিক মতো, কিন্তু বিকেলে সে একজোড়া চপস্টিক দিয়ে পুরো খাবার শেষ করেছে— সেটাও ছিল একধরনের জয়ের অনুভব। সে জানে, এই ছোট ছোট পরিবর্তনগুলোই তার মধ্যে এক বড় রূপান্তরের সূচনা করছে। সে ফোনে মা-কে মেসেজ দিল, “আজ তোর নারকেলের নাড়ু এক কোরিয়ান মেয়েকে খাওয়ালাম। ও বলল, ‘রেন-এর মতো মিষ্টি’। মজা না?” মা রিপ্লাই দিলেন, “জানতাম, তুই পারবি। খাবারের ভাষা সবাই বোঝে।” সেই একটা উত্তর যেন ঋতাভরীর ভিতরের দ্বিধাকে মুছে দিয়ে বলে দিল, “তুই নিজেকে সঙ্গে নিয়ে এখানে এসেছিস, তোর ভিতরেও তো একটা দেশ আছে।” জানালার বাইরে টোকিওর আলো তখন ম্লান হয়ে গিয়েছে, কিন্তু ঋতাভরীর চোখে সেই আলো স্পষ্ট— কারণ সে জানে, এখন থেকে প্রতিটা পদক্ষেপে সে আরও একটু নিজেকে খুঁজে পাবে।

টোকিওর হোটেল রুমটা রাতে যেন আরও ছোট হয়ে আসে। সকালে যে জানালার বাইরে আলোয় ভেসে থাকা শহর দেখা যেত, রাতে সেটা নিভে গিয়ে নিঃশব্দ এক চৌকাঠ হয়ে দাঁড়ায়। ঋতাভরী বিছানায় বসে ছিল, হাতে মোবাইল, স্ক্রলে স্ক্রলে একের পর এক চেনা মুখ— কেউ কফিশপে, কেউ কলেজে, কেউ বাড়ির বারান্দায় বসে হাসছে। আর সে একা, এই ঘরের ভেতর, চারদিকে শৃঙ্খলার এমন এক পৃথিবী যেখানে কারও হাসি নেই, কান্নাও নেই, শুধু নিখুঁত নিস্তব্ধতা। সে জানত, এখানে আসবে, এসব অনুভব হবে, কিন্তু বাস্তবে যখন সবকিছু সত্যি হয়ে ধরা দেয়, তখন তার অভিঘাত গভীরতর হয়। সে হঠাৎ করে টের পায়— নিঃসঙ্গতা সবসময় চুপচাপ থাকে না, কখনও সেটা গায়ে গায়ে ঘোরে, নিঃশ্বাসে জমা হয়, শব্দহীন চিৎকারে পরিণত হয়। সে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে, চেনা গলির আওয়াজ শুনতে চায়— ভ্যানওয়ালার হাঁক, স্কুলফেরত বাচ্চাদের চিৎকার, বারান্দা থেকে ডাক পড়া— কিন্তু কিছুই শুনতে পায় না। এই শহর এমন নিঃশব্দ কেন? এখানে কানে ঢোকে শুধু বাতাসের শব্দ, ট্রেনের দূরবর্তী গর্জন, আর নিজের বুকের ধুকপুকানি।

হঠাৎ ফোনটা বেজে ওঠে—মায়ের ভিডিও কল। ঋতাভরী ধরতে গিয়েও থেমে যায়। সে জানে, মা বুঝে ফেলবেন তার মুখের গলদ। মুখে হাসি টানতে চেষ্টা করেও পারছে না। কল রিসিভ না করে সে টেক্সট করে— “একটু পরে কথা বলি।” তারপর সে ফোনটা নিচে রেখে দেয়, যেন নিজের কাছ থেকেই পালাতে চায়। হোটেল রুমের টেবিলে রাখা ডায়েরি সে খুলে নেয়, কিন্তু কী লিখবে বুঝতে পারে না। তার মাথার ভেতর কিছু শব্দ ঘুরছে— “আমি কি এখানে এলাম নিজেকে খুঁজতে, না নিজেকে হারিয়ে ফেলতে?” ঘরের ভেতর হালকা হলুদ আলো, তার পাশে মাটির সেই বেলপাতা, মা-র দেওয়া, ঠাকুরের ঘরের গন্ধমাখা— একমাত্র নিজের শহরের ছোঁয়া বয়ে আনা কিছু। সে বেলপাতাটা হাতে নেয়, চেপে ধরে, যেন মাটির গন্ধে নিজের আত্মাকে খুঁজে পাবে। তারপর চোখ বন্ধ করে আবার শুয়ে পড়ে, আর ধীরে ধীরে যেন নিঃসঙ্গতার গায়ে গা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে, তবে গভীর নয়— আধা ঘুম, আধা স্বপ্ন।

ভোরের দিকে সে ঘুম ভেঙে চুপচাপ জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। শহরটা তখনও আলোয় ভরা নয়, কিন্তু নিঃশব্দে ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। রাস্তার নিচে চলা মেট্রোর ছায়া, দূরে ছুটে চলা একটি ট্রেন, আর আকাশে ফুটে ওঠা প্রথম আলো— সব মিলিয়ে এক রকম শান্তির ছায়া পড়ে তার চোখে। ঋতাভরী বুঝতে পারে, এই নিঃসঙ্গতা হয়তো তার শত্রু নয়— বরং একটা আয়না, যেখানে সে নিজেকে নতুন করে দেখছে। হয়তো এতদিন সে নিজের কথা কখনও শোনেনি, বাইরে আর ভেতরের এই ব্যবধান নিয়ে ভাবেনি। এখন, এই বিদেশে, এই একাকিত্বের মধ্যে, সে নিজেকে সামনে রেখে বসেছে। সে ভাবতে থাকে—এই নিঃসঙ্গতাও কি একটা ভাষা? যেটা শব্দ ছাড়া হৃদয়ে ঢোকে? সে ফোনটা আবার হাতে নেয়, মাকে মেসেজ করে: “ভালো আছি, একটু চুপচাপ ছিলাম, ভাবিস না।” উত্তর আসে এক লাইন— “চুপচাপ থাকা খারাপ না, মাঝে মাঝে দরকার।” সেই লাইনে এক মায়ের ভাষা, এক পৃথিবীর আশ্বাস— আর সেই আশ্বাসেই ঋতাভরী ধীরে ধীরে নিজের মনটাকে আলগোছে মুঠোয় ধরে, জানে—এই নিঃসঙ্গতার শব্দটাও এখন থেকে তার নিজের।

টোকিওতে তৃতীয় দিনের সকালটা অন্য রকম ছিল। আকাশে মেঘ ছিল হালকা, যেন শহরটাও আজ কিছুটা ধীর পায়ে হাঁটতে চাইছে। ঋতাভরী ঘুম থেকে উঠে একরকম চুপচাপ চায়ে চুমুক দিচ্ছিল, হঠাৎই মনে পড়ল—আজ তার দেখা হবে অরিন্দম দার সঙ্গে। কলেজের এক সিনিয়রের মাধ্যমে পরিচয় হয়েছিল এই মানুষটির সঙ্গে, যিনি প্রায় দশ বছর ধরে জাপানে আছেন, প্রথমে স্কলারশিপ নিয়ে পিএইচডি করতে এসে, পরে স্থায়ীভাবে চাকরি নিয়ে রয়ে গেছেন। অরিন্দম দা তাকে মেসেজে লিখেছিলেন, “তুই একা এখানে, কাউকে চিনিস না—তাই ভাবলাম দেখা হলে ভালো লাগবে। তোকে কাসাই পার্ক আর ফুকাগাওয়া ফুড মার্কেট দেখাব।” এই আমন্ত্রণে প্রথমে একটু দ্বিধা হয়েছিল—একজন অচেনা বাঙালি, এতদিন টোকিওতে থেকে কতটা বদলে গেছেন কে জানে! কিন্তু শেষমেশ সাহস করে রাজি হয়েছিল ঋতাভরী—হয়তো নিজের ভাষা, নিজের উচ্চারণে কথা বলার একটা সুযোগ মিলবে, যার খুব অভাব সে এই শহরে অনুভব করছিল।

কাসাই পার্কের ঢোকার মুখেই দেখা হল অরিন্দম দার সঙ্গে। মানুষটা যেন ‘ক্লাসিক প্রবাসী’— হালকা গলায় বাঙালি টান, কিন্তু ব্যবহারে নিখুঁত জাপানি শৃঙ্খলা। ধবধবে জামা, চোখে পাতলা ফ্রেম, আর মুখে একরকম ক্লান্তি, যা বিদেশে অনেক বছর থাকলে গায়ে লাগে। “তোকে দেখে ভালো লাগল, ঋতাভরী,” বলে হাত বাড়িয়ে দিলেন। “তুই অনেক সাহস করে এসেছিস, আমি জানি প্রথম কয়েকদিন কেমন লাগে।” তারা দুজনে ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল পার্কের মধ্যে দিয়ে, আশপাশে ছেলেমেয়েরা সাইকেল চালাচ্ছে, বাচ্চারা খেলছে, আর গাছে গাছে চেরি ব্লসমের শেষ কটা ফুল রয়ে গেছে। অরিন্দম দা বললেন, “টোকিওর এই দিকটা একটু শান্ত। আমি যখন নতুন এসেছিলাম, তখন প্রতিদিন এখানেই বসে থাকতাম। নিজের মাটির কথা ভাবতাম, ফোন করতাম বাড়িতে… পরে সেটা কমে গেল। সময়, কাজ, রুটিন—সব মিলে নিজেকে পাল্টে ফেললাম।” ঋতাভরী কিছুটা অবাক হয়ে শুনছিল। মানুষটা ঠিক কী বলছেন? এটা কি অভিযোগ, না স্বীকারোক্তি? তিনি হঠাৎ বললেন, “তুই বুঝবি একদিন—কখন যেন নিজের ভাষাটা কেবল ফোনের মধ্যে আটকে যায়, নিজের রান্নার স্বাদটা আর জিভে চড়ে না। একটা সময় আসে, যখন প্রশ্ন করিস—আসলে তুই কে?”

তারা পরে গিয়েছিল ফুকাগাওয়া মার্কেট এলাকায়, যেখানে টোকিওর স্থানীয়দের ভিড়ে একটু গাঢ় গন্ধে মাখানো রাস্তাগুলো বাঙালির হাটের মতো মনে হয়। মাছ, মিসো, টকজিরে ডুবানো সবজির গন্ধ, আর ঠেলা গাড়ি ঘিরে ভিড়। সেখানে দাঁড়িয়ে অরিন্দম দা বললেন, “দেখ, এই জায়গাটায় আমি এখনও কলকাতার একটা ফ্লেভার পাই।” তারা একসঙ্গে বসে খেল টেম্পুরা আর উডন নুডলস, সঙ্গে সয়াসস আর সবুজ চা। অরিন্দম দা বললেন, “তোর প্রজন্ম ভিন্ন, তুই হয়তো নিজের শিকড় নিয়ে বেশি ভাবিস। আমরা এত ভাবিনি। এখানে আসার পর অনেকেই রুট খুঁজতে খুঁজতে শিকড় ভুলে যায়।” কথাটা শুনে ঋতাভরীর গায়ে একটা ঠান্ডা বাতাস বইল। সে ভাবছিল—ঠিক তাই তো হচ্ছে না কি? এই শহর তাকে যতটুকু শিখিয়েছে, ঠিক ততটাই টেনে নিয়েছে তার নিজের ‘ঋতাভরী’ হয়ে ওঠা চেতনা থেকে। সে বলল, “কিন্তু ভুলে গেলে তো নিজের ভিতরেই একটা শূন্যতা থেকে যায়?” অরিন্দম দা হেসে মাথা নাড়লেন, “থাকে। তবে সেই শূন্যতা নিয়েই বেঁচে থাকা শিখে নিতে হয়। এক সময় তো শূন্যতাও স্বাভাবিক হয়ে যায়।”

ফিরতি পথে ট্রেনের জানালার পাশে বসে ঋতাভরী ভাবছিল—এই অরিন্দম দার মতো কত মানুষ ছড়িয়ে আছে টোকিওর গলিতে, যারা নিজের শিকড় হারিয়ে ফেলেছে? যারা কেবল ‘ঠিক সময়ে ট্রেন ধরতে পারে’, কিন্তু নিজের ভেতরের যাত্রায় পথ খুঁজে পায় না? তার মনে হল, সে এখানে তিন দিনের জন্য এসেছে, কিন্তু এই তিন দিনেই যদি নিজেকে না ধরে রাখতে পারে, তাহলে অরিন্দম দার দশ বছর হয়তো তার ভবিষ্যৎ হয়ে দাঁড়াবে। সে চুপচাপ নিজের দিকে ফিরে তাকাল। এই শহর তাকে তাড়িয়ে দেয়নি, বরং আপন করে নিতে চায়—তবে শর্ত দিয়ে। সেই শর্ত হলো আত্মপরিচয়ের বিনিময়ে প্রযুক্তি, অভিজাততা আর সুশৃঙ্খল নিঃসঙ্গতা। সে জানালার বাইরে তাকাল—রাস্তার ধার দিয়ে ছুটছে মানুষের সারি, নিখুঁতভাবে সাজানো, হাসির চিহ্ন নেই, তবু কোথাও এক ধরনের ছায়া আছে—যেখানে প্রশ্ন জমে থাকে। সেই ছায়ায় সে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেল। নিজেকে বলল, “আমিও পথ হাঁটছি, তবে ভুলে যাব না কে ছিলাম।”

টোকিওর তৃতীয় দিনের বিকেলে হঠাৎ করে রোদটা নরম হয়ে এল। ঋতাভরী বুঝল, এই আলো শুধু সূর্যরশ্মি নয়, একটা মুড, একটা আত্মীয়তা, যা শহরটা মাঝে মাঝে দেখায় কিন্তু সম্পূর্ণ দেয় না। নোরির সঙ্গে আজ সে গেছে উদেও পার্কে—সেখানে এখনো কিছু চেরি গাছের ডালে রঙিন ফুল বেঁচে আছে, পাতার ফাঁকে ফাঁকে গোলাপি ছায়া ফেলছে মাটিতে। হালকা হাওয়া বইছে, সেই হাওয়ায় পাঁপড়ি উড়ছে একদিক থেকে অন্যদিকে। যেন কে এক অদৃশ্য শিল্পী পেইন্ট ব্রাশ দিয়ে শহরটাকে একটু কোমল করে দিচ্ছে। ঋতাভরী সেই ফুলের ছায়ায় দাঁড়িয়ে মনে মনে বলল, “এই শহরটাও কবিতা হতে পারে, যদি কেউ চোখ মেলে পড়ে।” নোরি পাশে বসে ছিল ঘাসের ওপর। বলল, “Cherry blossom lasts for a very short time. That’s why we love it so much. Beautiful things don’t stay long.” ঋতাভরী চুপ করে রইল। সেই কথাগুলো যেন তার নিজের জীবনের কথা—এই তিন দিনের ভেতরেই সে যেন আবিষ্কার করে ফেলেছে সৌন্দর্য, ক্ষণস্থায়ীত্ব, হারিয়ে যাওয়ার ভয়।

তারা পাশাপাশি বসে ছিল। কোনো কথা হচ্ছিল না। চারপাশে বহু মানুষ, কেউ পিকনিক করছে, কেউ ছবি তুলছে, কেউ কেউ গাছের ডালে চেয়ে নির্ভার হাসছে। কিন্তু তবুও, এই ভিড়ের মধ্যে একটা নৈঃশব্দ্য কাজ করছিল। নোরি একটা পাঁপড়ি তুলে ঋতাভরীর হাতে দিল। বলল, “Keep it. It’s yours.” ঋতাভরী পাঁপড়িটা হাতে নিয়ে দেখছিল—পাতলা, প্রায় স্বচ্ছ, তবু তার মধ্যে একটা গাঢ় রং আছে। তার মনে পড়ল, কলকাতায় ও বসন্তকালে রাস্তায় কৃষ্ণচূড়ার পাঁপড়ি পড়ে, স্কুল ফেরার পথে সে জুতো দিয়ে টিপে দিত, শব্দ করত না, কিন্তু রং লেগে থাকত পায়ের নিচে। আজ টোকিওতে এই ফুল, এই পাঁপড়ি—একেবারে অন্য, কিন্তু অনুভবটা যেন একই। সে বলল, “তুই জানিস, আমাদের দেশে চেরি ব্লসম নেই। কিন্তু বসন্ত আছে। আর বসন্তেরও আছে একরকম অস্থিরতা।” নোরি তাকিয়ে বলল, “Maybe we are all a little restless during spring.” এই এক কথায় যেন দুই সংস্কৃতি, দুই মেয়ের অভিজ্ঞতা মিলেমিশে গেল। এমনই তো হয়—যখন ভাষা, দেশ, ধর্ম পেরিয়ে কেউ কারও চোখে চেয়ে কিছু বোঝে, তখন একটা সেতু তৈরি হয়, নামহীন, অথচ অটুট।

বিকেলটা কাটল চুপচাপ। নোরি ক্যামেরায় ছবি তুলল, ঋতাভরী কবিতা লিখল। এমনকি তারা একসঙ্গে কয়েকটা ছবি তুলল—হাসিমুখে, গাছের নিচে দাঁড়িয়ে। ঋতাভরী বুঝল, আজ তার মন কেমন শান্ত। হয়তো এই শান্তি অনেকটা আসছে এই শহরের নিঃশব্দ স্বীকারোক্তি থেকে, এবং নোরির মতো কারও উপস্থিতি থেকে, যে তাকে না বলেই বুঝে নিচ্ছে। ফেরার সময় সে পাঁপড়িটা ব্যাগের ডায়েরির পাতায় রেখে দিল, একটু মুচড়ে গেলেও রংটা রয়ে গেল। হোটেলে ফিরে সে লিখল—“এই তিন দিনে আমি অনেক কিছু শিখেছি। ভাষা ছাড়া কীভাবে কথা বলতে হয়, অচেনার ভিতর কীভাবে নিজেকে খুঁজে নিতে হয়, এবং কীভাবে এক পাঁপড়ি বুকের মধ্যে জমে থাকা কষ্টকে নরম করে দিতে পারে।” সে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে তাকাল শহরের দিকে—আজ সে যেন ভয় পায় না, আজ টোকিওকে দেখে সে তার চোখের মধ্যেই, আতঙ্ক নয়, আত্মবিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পায়।

বিদায়ের সকালটা সবসময় একটা অদ্ভুত শূন্যতা নিয়ে আসে। ঋতাভরীর ঘুম ভাঙল অ্যালার্মে নয়, ঘড়ির কাঁটার ধীর শব্দে। জানালার বাইরে তখনও অন্ধকারের শেষচিহ্নগুলো রয়ে গেছে, কিন্তু আকাশে ধীরে ধীরে নীলের ছোঁয়া নামছে। সে ধীরে ধীরে উঠে পড়ে, স্যুটকেসের চেইন খুলে দেখে—সবকিছু গুছানো, তবুও কোথায় যেন কিছু বাকি থেকে গেছে। তিন দিন আগে যে ঘরে সে এসে ঢুকেছিল অচেনা মুখে, সেই ঘর এখন তার নীরব সাক্ষী। বিছানার পাশের ছোট টেবিলের ওপর পড়ে আছে একটি পাঁপড়ি—চেরি গাছের, গতকালের, হালকা শুকিয়ে গেছে, কিন্তু রংটা এখনো টিকে আছে। ঋতাভরী সেটাকে ডায়েরির পাতায় আঠা দিয়ে আটকে দেয়—ঠিক তার কবিতার পাশে, যেখানে লেখা ছিল: “আমিও একদিন ঝরে যাব, কিন্তু আমার রং থাকবে।” তারপর সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখে—এই তিনদিনে কিছু একটা বদলেছে। চোখের নিচে একটু ঘুমের অভাব, কিন্তু তার চেয়েও বড় যে পরিবর্তন—ভয়টা আর নেই। সেই ভয়, যা নিয়ে সে একা একা প্লেনে উঠেছিল, যে ভয়টা প্রথম চপস্টিক ধরার সময় হাতে কেঁপেছিল, আজ সেটা চলে গেছে। শহরটা তাকে ঠিকভাবে বিদায় জানাবে কিনা, সে জানে না। কিন্তু সে বিদায় দিচ্ছে ভালোবাসা দিয়ে।

বের হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে দরজার নিচ দিয়ে এক খাম গড়িয়ে এল। সে কুড়িয়ে নিল—লেখা: “To Ritabhari – from Nori.” ঋতাভরী অবাক হয়ে খুলল খামটা। ভিতরে ছিল এক ছোট্ট পলারয়েড ছবি—চেরি গাছের নিচে দুজনে পাশাপাশি বসে আছে, পেছনে গোলাপি আলো ঝরে পড়ছে, আর নোরির হাতে ধরা সেই পাঁপড়িটা। ছবির পেছনে লেখা ছিল শুধু এক লাইন: “Some places bloom inside you. Tokyo will bloom in you.” চোখে জল এসে গেল ঋতাভরীর—এটা কোনও দুঃখের নয়, বরং এমন এক অনুভবের যা ভাষায় ধরা যায় না। সে জানত, এই শহরের অনেককিছু সে আবার পাবে না—এই নিরবতা, এই ঘর, এই আলো, এই একাকিত্বের ভেতরে জেগে ওঠা সাহস—কিন্তু এই অনুভব সে বয়ে নিয়ে যাবে। নিচে নেমে রিসেপশনে গিয়ে সে হালকা মাথা নোয়াল, “Thank you.” ছোটখাট মহিলা স্টাফটি বিনয়ের সঙ্গে বললেন, “Arigato gozaimasu. Please come again.” সেই বাক্যটা ঋতাভরীর কানে যেন সুর হয়ে বাজল। “Please come again”—এটা শুধু সৌজন্য নয়, যেন শহর নিজেই বলছে, “তুই চাইলে আবার ফিরে আয়।”

এয়ারপোর্টের দিকে ছুটে চলা ট্রেনে বসে সে জানালার দিকে তাকিয়ে ছিল। টোকিও শহরটা একে একে পিছিয়ে যাচ্ছিল, গাঢ় হয়ে আসছিল দৃশ্য, তার সঙ্গে জমা হচ্ছিল স্মৃতি। এই শহর তাকে শেখাল, ভেতরের যে ভয়গুলোকে সে এতদিন ঢেকে রেখেছিল, সেগুলোকে আলোতে আনতে হয়—তবে একা নয়, কারও পাশে দাঁড়িয়ে। সে ভাবল, “নোরি, অরিন্দম দা, এমনকি অচেনা ওয়েটার মেয়েটিও—সবাই আমার এই গল্পের চরিত্র। আমি নিজে নিজের গল্পের লেখক, কিন্তু তাদের ছায়া না থাকলে আমার প্যারাগ্রাফ অসম্পূর্ণ থেকে যেত।” প্লেন ছাড়ার আগে সে শেষবারের মতো ফোনে একটি টেক্সট পাঠাল—নোরিকে: “আমি ফিরছি, কিন্তু আমার কিছুটা অংশ এখানে ফেলে যাচ্ছি।” টেক্সটের নিচে সে একটা চেরি পাঁপড়ির ইমোজি জুড়ে দিল। জানে, কোনো ভাষা দরকার নেই। সেই মুহূর্তে টোকিওর আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হল, যেন শহরটা তাকে চোখে চোখ রেখে বলছে—”তুই তো এখানেই রয়ে গেলি, ঋতাভরী।”

কলকাতা বিমানবন্দরের বাতাসটা ঘরে ফেরা জাহাজের মতো ভারী—পরিচিত, কিন্তু ময়লা ধরা। প্লেন থেকে নামতেই ঋতাভরীর প্রথম যে জিনিসটা মনে পড়ল তা হল—“টোকিওতে সবকিছু গন্ধহীন ছিল, অথচ এখানকার বাতাসেই একটা ধুলো, ঘাম আর বাসির চা-পাতার গন্ধ আছে।” এমন নয় যে সে এটা আগে বুঝত না, কিন্তু এই তিনদিনের নীরব, শৃঙ্খল, পলিশ করা শহর থেকে এসে কলকাতার এই কাঁচা বাস্তব তার গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বাইরে মা দাঁড়িয়ে ছিলেন, চোখে চিরচেনা আতঙ্কমাখা স্নেহ, “তোর কিছু হয়েছে না তো?” ঋতাভরী হেসে জবাব দিল, “একটুও না মা। বরং অনেক কিছু হয়েছে—ভিতরে।” গাড়িতে উঠেই মা-র বানানো নারকেল নাড়ুর প্যাকেট সে খুলল, একটা মুখে দিয়ে চোখ বন্ধ করল। সেই চেনা স্বাদের মধ্যে সে টের পেল—এই কলকাতায় ফেরার মুহূর্তে তার মনের ভিতরে একটা শহর গড়ে উঠছে—টোকিওর মতোই বাস্তব, কিন্তু স্মৃতির দোলচালে গড়া। ছেলেবেলার বাড়ি, পুরনো বারান্দা, পাড়ার মোড়ের চা—সবকিছুর মধ্যে আজ সে টোকিওর একটা ছায়া দেখতে পাচ্ছে। ঠিক যেমন টোকিওর এক বিকেলে সে দেখেছিল কলকাতার এক টিপে দেওয়া চুল বাঁধা মেয়ের মুখ।

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই প্রথমে সে বুঝে উঠতে পারল না—কোন শহরে সে আছে। জানালার বাইরে হর্নের আওয়াজ, ফুচকা ওয়ালার হাঁক, একটা হালকা নোংরা আলো এসে পড়েছে তার বালিশে। “টোকিওতে সকালগুলো নিঃশব্দে আসত,” সে ভাবল। কিন্তু এরপরেই বুঝল, এই শব্দগুলোকেও তো সে একসময় ভালোবাসত। এখন হয়তো শুধু তফাৎটা চোখে পড়ছে। মা এসে বললেন, “এত সকালে উঠে পড়েছিস?” ঋতাভরী জবাব দিল, “টোকিওর ঘড়ি এখনো মাথায় চলছে।” সে চুপচাপ নিজের ঘরের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রইল। ওখানে এখনও একটা পুরনো সানাই-এর পোস্টার, খাটের পাশে ছোট টেবিলে রেখে দেওয়া সেই পুরনো কবিতা খাতা। সে ডায়েরি খুলে টোকিওর পাতাগুলো পড়তে লাগল—সেখানে শুধু শহরের গল্প নয়, তার নিজের রূপান্তরের দাগও লেগে আছে। তার মনে হল, এই কলকাতা আর আগের মতো থাকবে না—কারণ সে নিজেই আর আগের মতো নেই। তার চোখ এখন দুই শহরের ছবি একসঙ্গে দেখে, তার জিভ দুই সংস্কৃতির স্বাদ বয়ে বেড়ায়। হয়তো এটাই সত্যিকারের ভ্রমণ—যেখানে গন্তব্য নয়, ফিরে আসাটাই বদলে দেয় সবকিছু।

ঋতাভরী কলেজে ফেরার পর সবাই তাকে ঘিরে ধরল—“কী দেখলি?”, “সুশি খাসলি?”, “জাপানি মেয়েরা কি সত্যি তত শান্ত?”—প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে সে বুঝল, কিছু উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ সে যা দেখেছে, তা শুধু চোখে দেখা নয়—তাকে অনুভব করতে হয়। সে শুধু বলল, “টোকিও খুব নিঃশব্দ, আর সেই নীরবতাতেই আমি আমার গলা খুঁজে পেয়েছি।” বন্ধুরা হেসে বলল, “তুই তো দার্শনিক হয়ে এলি!” সে হাসল, কিন্তু ভেতরে জানত—এটা দার্শনিকতা নয়, এটা স্রেফ সত্যি। চেরি পাঁপড়ি এখনো তার ডায়েরির পাতায় শুকনো হয়ে আছে, তবু সেই গোলাপি রঙে একটা শহরের প্রতিচ্ছবি জমে রয়েছে। নোরির দেওয়া সেই ছবিটা, অরিন্দম দার কথাগুলো, হোটেলের সেই জানালার পাশে বসে থাকা সময়—সব মিলিয়ে আজ সে জানে, “আমি যদি নিজেকে ফিরে না আনতে পারতাম, তবে কোনো শহরই আমার হয়ে উঠত না।” টোকিও তাকে বদলে দিয়েছে, আর কলকাতা সেই বদলটাকে নিজের করে নিতে শুরু করেছে।

ঋতাভরী টেবিলের সামনে বসে ছিল, সামনে খুলে রাখা ছিল সাদা খাতা আর হাতে ছিল কলম। আজকের তার কাজ ছিল—নিজের টোকিওর অভিজ্ঞতা নিয়ে একটা প্রবন্ধ লেখা। কিন্তু লেখা শুরু করা মানে ছিল স্মৃতির এক ঝর্ণাধারায় ডুব দেয়া—যা সহজ ছিল না। সে বুঝেছিল, টোকিও শুধু একটা শহর নয়, এটা একটা অনুভূতি, একটা চ্যালেঞ্জ। সে লিখতে শুরু করল, “টোকিও হলো এক অবিরাম গতি, যেখানে মানুষ ছুটছে, কিন্তু শব্দ হচ্ছে কম। এখানে নিঃশব্দই কথা বলে, আর সেই নিঃশব্দের ভেতরেও আছে এক অদ্ভুত মানুষের স্পর্শ।” লেখায় সে বর্ণনা করল কিভাবে শহরের আলো ও ছায়ার খেলা তার মনকে জাগ্রত করেছে, কিভাবে অরিন্দম দার কথাগুলো তার আত্মাকে খুঁড়ে বের করেছিল, আর কিভাবে নোরির সঙ্গে কাটানো সময়গুলো তাকে অন্যভাবে ভাবতে শিখিয়েছে। এই শহর তাকে নিজের মধ্যে লুকানো ভয় আর চাওয়া দুটোকে দেখতে শিখিয়েছে। সে লিখল, “যেখানে ভাষা বাধা, সেখানে আত্মা ভাষার বাইরে কথা বলে।”

লেখা এগিয়ে চলল ঋতাভরীর জীবনের সেই ছোট ছোট মুহূর্তগুলোর দিকে—প্রথম চপস্টিক ধরার অস্বস্তি, রেনবো ব্রিজের ধারে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করা, চেরি ব্লসমের নিচে বসে নোরির সঙ্গে নিরব কথা বলা। সে জানত, এই সব অনুভূতি কেবল তার নয়, বরং বিদেশে গিয়ে নিজেকে খুঁজে পাওয়া সবার গল্পেরই অংশ। লেখায় সে স্পষ্ট করল, টোকিও তাকে ভয় দেখায়নি, বরং নিজের ভেতরের অজানা জায়গাগুলোকে সামনে এনেছে, যা আগে সে কখনো দেখেনি। সে লিখল, “আমি জানতাম, বিদেশ মানে শুধু জায়গা পরিবর্তন নয়—এটা নিজের সঙ্গে দ্বন্দ্ব, নিজেকে নতুন করে চিনতে চাওয়া।” লেখাটি যখন শেষ করল, তখন একটা অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করল। মনে হল, এই শব্দগুলো এখন তার নিজস্ব সেতু, যা তাকে কলকাতা আর টোকিওর মাঝে যোগসূত্র তৈরি করতে সাহায্য করবে।

শেষে সে প্রবন্ধের শেষ লাইন লিখল, “টোকিও আমার জন্য এক শিল্পকর্ম—অবিচ্ছিন্ন আলো আর ছায়ার খেলা, নিঃশব্দে কথা বলা মানুষের শহর, যেখানে আমি হারিয়েছি নিজেকে আর খুঁজে পেয়েছি নতুন করে। এই শহরটা শুধু জায়গা নয়, আমার আত্মার এক অংশ।” কলম রেখে ঋতাভরী জানালার বাইরে তাকাল। সন্ধ্যার আকাশে শহরের আলো ফুটছিল, দূর থেকে ট্রেনের হুডুডু শব্দ আসছিল। সে জানত, তার এই টোকিও আর যেখান থেকে এসেছে তা আর আলাদা নয়—কিন্তু আজ থেকে দুই শহরের সেই সীমারেখাটা তার নিজের সীমানা হয়ে গেছে। এই ভ্রমণ ছিল শুধু দেহের নয়, বরং আত্মার—যেখানে হারিয়ে যাওয়া, খুঁজে পাওয়া, আর স্বীকারোক্তি মিলেমিশে একাকার। এবং এই ভ্রমণ সে আজ শেষ করল, কলম রেখে, নতুন শুরুতে।

1000038726.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *