Bangla - রহস্য গল্প

তালের বীজে লেখা নাম

Spread the love

অদিতি সরকার


পর্ব ১: আগুনের গান

সাঁইথিয়া স্টেশনের বাইরে একটা মেঘলা দুপুর। ট্রেন থেকে নামার পর ধুলো-ওড়া রেললাইন পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ঐশানী বসু বুঝল, শহরের থেকে এই জায়গাটা সম্পূর্ণ আলাদা। কাঁসার থালার মতো নরম আলো পড়ে আছে গাছেদের পাতায়, আর দূরে ধুলোয় ভেসে আসছে একটানা ঢোলের আওয়াজ। কোথাও কেউ বাউল গাইছে।

ঐশানী একজন লোকসংস্কৃতি গবেষক, কলিকাতার এক নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফোকলোর ও পারফর্মিং আর্টস নিয়ে গবেষণা করে। কিন্তু এইবার তার আগ্রহ ছিল খুব নির্দিষ্ট এক চরিত্রকে ঘিরে—হেমাঙ্গিনী মা। ছয় দশক আগে, এই অঞ্চলেই এক নারী বাউলের খ্যাতি ছড়িয়েছিল। বলা হতো, তার গান নাকি মানুষের ভিতরের পাপ বার করে আনে, আর গান শুনে অনেকেই বদলে গেছে। কেউ কেউ নাকি নিখোঁজও হয়ে গেছে।

গ্রন্থাগারে পচে যাওয়া পুরনো কাগজে কিছু অস্পষ্ট রেফারেন্স ছিল, কিন্তু নামটা বারবার ফিরে আসছিল—‘তালের বীজ’। হেমাঙ্গিনী নাকি একবার বলেছিলেন, “আমি তালের বীজে নাম লিখি, বাতাসে ছাড়ি। যার নামে গান বাজে, তারই ভিতর আলো ফোটে।”

এই কথার মানে তখন ঐশানীর কাছে দুর্বোধ্য ছিল, কিন্তু আজ যখন সে সাঁইথিয়ার দিকে হাঁটছে, মন যেন বলছে—উত্তর কাছে।

স্থানীয় একজন ফকিরের নাম পেয়েছিল—ধরণী ফকির। বয়স নব্বই ছাড়িয়েছে। এখন আর গান গায় না, আখড়ার এক কোণায় একা থাকেন। কেউ কেউ বলে, তিনি হেমাঙ্গিনীর একমাত্র সাক্ষী। কেউ বলে, তিনিই হেমাঙ্গিনীকে লুকিয়ে রেখেছেন।

একটা রিকশা জোগাড় করে ঐশানী ‘মাধবপুর’ গ্রামের দিকে রওনা হল। বাতাসে কাঁঠালের গন্ধ, মাঝে মাঝে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে থামে। ঘোড়ার গাড়ির মতো ছন্দে কাঁপে রিকশা। রাস্তায় লোকজন কম, কিন্তু যখন দুটো ছোট বাচ্চা পাশ দিয়ে ছুটে গেল, তাদের গলার আওয়াজ কানে এল—
“তালের বীজে নাম আছে, যাই না যাই, সে আসে!”

ঐশানী চমকে উঠল।
রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করল, “এই ছেলেগুলো কী বলছিল?”
রিকশাওয়ালা হেসে বলল, “ওরা গাছতলার ভূতের গল্প বলে। ওই হেমাঙ্গিনী মা’রে নিয়া বলে, উনি এখনও গানে ঘুরেন, রাতে।”

আখড়াটা পৌঁছাতে সন্ধে নামল। ধরণের আখড়ায় ঢুকতেই একটা পুরনো পুকুর, জলে ছায়া নড়ে। ঘাসে বসে একটা লোক ঢোল পিটাচ্ছে, কিন্তু গান নেই, শুধু তাল। আড়ালে একটা বাঁশঝাড়, আর তার পেছনে ছোট কুটির। দরজায় মাটির চিত্র—মানুষ, পাখি আর মাঝখানে এক তালগাছ।

ঐশানী নাম ডেকে বলল, “ফকির সাহেব?”
ভেতর থেকে ধীর গলায় উত্তর এল, “আপনি সেই কলেজের মেয়ে?”

ঐশানী মাথা নেড়ে এগিয়ে এল। ভেতরে আলো কম, একটা কুপির বাতি আর ছেঁড়া চারাইয়ের মাদুরে বসে আছেন ধরণী ফকির। মুখে অসংখ্য রেখা, কিন্তু চোখে একরাশ আলো।

“হেমাঙ্গিনী মার কথা জানতে এসেছেন?”
ঐশানী কাঁপা গলায় বলল, “হ্যাঁ। উনি কি সত্যিই গান দিয়ে মানুষ পাল্টাতেন?”
ধরণী হেসে বললেন, “উনি তো নিজেই গান ছিলেন। ওঁর গলা শুনলে হাওয়া দাঁড়িয়ে যেত।”
“তালের বীজে লেখা নাম… সেটা কী?”
ধরণী মাথা নিচু করে বললেন, “তা আমি জানি। কারণ আমিও একবার আমার নাম দেখেছিলাম সেই বীজে।”

ঐশানী স্তব্ধ হয়ে গেল।
ধরণী ধীরে ধীরে পেছনের ঝুল আলগা করে এক কৌটো বার করলেন। কৌটোর মধ্যে তিনটে শুকনো তালের বীজ, যার গায়ে সূক্ষ্ম খোদাই করা—যেন কারও হাতের লেখা।

ঐশানী তাকিয়ে বলল, “এ তো কবরে লেখা নামের মতো।”
“না,” ধরণী বললেন, “এটা জীবনের নাম। যার ভিতর পাপ ঘুমোয়, হেমাঙ্গিনী তার নাম লিখতেন, তারপর গান গাইতেন। অনেকেই পালিয়ে যেত, কেউ আর ফিরত না।”

“আপনি?”
“আমি থাকি, কারণ আমার পাপ আমি স্বীকার করেছি। কিন্তু এখন সেই বীজ হারিয়ে যাচ্ছে। কেউ চুরি করছে। আর যারা চুরি করছে, তারা মরছে। গান না শুনেই।”

ঐশানীর মাথায় ঘূর্ণি উঠল।
রাতে থাকার ব্যবস্থা হল পাশের ঘরে। জানালার পাশে পুকুর, আর বাইরে বাঁশবনে যেন কেউ ঢুকে গেল।

ঐশানী শুয়ে পড়ল। চোখ বুঝলেই শুনতে পেল—একটা ধীর গলা, নারীস্বর।
“তুই নাম দেখেছিস… তোকে আমি ডাকব…”

সে চমকে উঠল। জানালার কাঁচে এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ল।

আর দূরে বাঁশবনের গা ঘেঁষে কে যেন গেয়ে উঠল—
“আলো তোরা দেখিস না, আমি যে অন্ধকার…”

পর্ব ২: বাঁশবনের গায়িকা

সকাল হতেই ঐশানী ঘুম ভেঙে দেখল, জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ধরণী ফকির এক দৃষ্টিতে পুকুরের দিকে তাকিয়ে আছেন। বাতাস ঠান্ডা, বৃষ্টির জল জমে আছে ঘাসে। ভোরের আলোয় আখড়ার চারপাশে যেন এক অনুচ্চ শব্দ ভেসে বেড়াচ্ছে—কোনো সুর, আবার যেন নিঃশব্দ আত্মার হাঁটাচলা।

ঐশানী ধরণীর পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
“গতকাল রাতে আমি একটা গলার শব্দ শুনলাম। কেউ গান গাইছিল।”
ধরণী ধীরে বললেন, “সে গলা হেমাঙ্গিনীর। শুনেছেন তো?”

ঐশানীর শরীর কেঁপে উঠল।
“কিন্তু উনি তো বহু আগেই… অন্তর্ধান হয়েছেন। না কি… মারা গেছেন?”
ধরণী চোখ বন্ধ করে বললেন, “ওঁরা মরে না। গানের মানুষেরা, বিশেষত যাঁরা নিজেকে বিসর্জন দেয় সুরে, তাঁরা কোথাও রয়ে যান। বাতাসে, পাতায়, শব্দে। হেমাঙ্গিনী এখনও আছেন। গানের মধ্যে।”

ঐশানী গভীরভাবে তাকিয়ে বলল, “তাহলে আপনারা কেন বলেন উনি অন্তর্ধান হয়েছেন?”
“কারণ ওঁকে আর কেউ চোখে দেখেনি। শুধু গান শুনেছে।”

ঐশানী সিদ্ধান্ত নিল, সে ওই বাঁশবনের ভেতর যাবে। যেখান থেকে রাতে সুর ভেসে এসেছিল।

বাঁশবনটায় ঢুকতেই গা ছমছমে একটা ঠান্ডা লাগল। পাতা নড়ছে না, অথচ যেন কেউ ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে। কয়েক ধাপ এগোতেই সে দেখতে পেল, এক জায়গায় মাটি অস্বাভাবিক রকম উঁচু। খুঁটিয়ে দেখে বুঝল, কারও পায়ের ছাপ। এবং আশ্চর্যজনকভাবে, ছাপগুলো একটানা ঘুরে ঘুরে একটি গোল আকার তৈরি করেছে।

মাটি খুঁড়ে দেখতে গিয়েই তার চোখ আটকে গেল—একটা তালের বীজ।
কিন্তু এটা অন্যরকম। বীজটার গায়ে খোদাই করা এক নাম: রবিকান্ত সরকার।

ঐশানী বুকটা চেপে ধরল।
এই নামটা তার পরিচিত। গত সপ্তাহে লোকসংস্কৃতি গবেষণার এক ফোরামে একজন লোক বলেছিল—একজন গবেষক এই এলাকায় এসে নিখোঁজ হয়েছেন। নাম রবিকান্ত সরকার।

সে পকেটে করে বীজটা তুলে নিল।

আখড়ায় ফিরে এসে ধরণীকে দেখাল বীজটা।
ধরণী এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “এটা নতুন লেখা। হেমাঙ্গিনীর হাতের লেখা হলেও, আমি নিশ্চিত এইটা গত ক’দিনের মধ্যে তৈরি হয়েছে।”
“মানে হেমাঙ্গিনী মা বেঁচে আছেন?”
“সেটা জানি না। তবে কেউ ওঁর নিয়ম মেনে আবার এই কাজ করছে।”

ঐশানী চিন্তায় পড়ে গেল।
“রবিকান্ত সরকার এখানে এসেছিল?”
“হ্যাঁ। তিনদিন ছিল। হঠাৎ একদিন বাঁশবনে ঢুকে আর ফেরেনি। কেউ খুঁজতেও যায়নি। আমি কাউকে কিছু বলিনি, কারণ ভয় ছিল।”

ঐশানী থমথমে গলায় বলল, “ভয় ছিল কীসের?”
“যদি পাপের তালিকায় আমার নামও লেখা থাকে।”

এই সময় পাশের ঘরে এক বৃদ্ধা ঢুকলেন। ধরণী তাঁর দিকে ইশারা করে বললেন, “এ হলেন রাধামণি মাসি। আগে হেমাঙ্গিনীর সঙ্গে থাকতেন। আজকাল কথা বলেন না, শুধু গান শোনেন।”

ঐশানী বিনীতভাবে এগিয়ে গেল।
রাধামণি হঠাৎ বলে উঠলেন, “তুই হেমাঙ্গিনীর কথা জানিস?”
“হ্যাঁ মাসি, আমি খুঁজতে এসেছি ওঁর গল্প।”

রাধামণি মৃদু হাসলেন।
“ও গান গেয়ে নাম লেখাত। যার গলায় কাঁটা, যার চোখে লালসা, যার মনে ভয়—সেই নাম উঠত বীজে। আর গান শেষ হলে, তারা পালাত। কেউ পাহাড়ে, কেউ নদীতে। তবে একজন ছিল যে পালায়নি।”

“কে?”
“ধরণী,” — মাসি তাকিয়ে ছিলেন ফকিরের দিকে, — “ও গান শুনে কেঁদেছিল, পা ছুঁয়েছিল হেমাঙ্গিনীর। তখনই বীজ ফেটে গিয়েছিল।”

ঐশানী বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল।

সন্ধ্যায় হঠাৎ ঝড় উঠল। আকাশ কালো, বিদ্যুৎ ঝলকায় মাটিও কেঁপে উঠছিল। ঐশানী চুপচাপ নিজের নোটবুক লিখছিল, হঠাৎ জানালায় কড়া নাড়ার শব্দ।

সে দরজা খুলে তাকিয়ে দেখল—কেউ নেই।

তবে নিচে পড়ে আছে একটা পুঁটলির মতো কিছু। খুলে দেখল—আরেকটা তালের বীজ। এবার লেখা নাম: ঐশানী বসু।

সে বসে পড়ল, হাত কাঁপছে। পেছন থেকে ধরণী বললেন, “ওই বীজ গান চাইছে। যদি গান না হয়, যদি তুমি সত্য মেনে না নাও—তবে তুমি হারিয়ে যাবে।”

“কিন্তু আমি তো কিছু করিনি!”
“ভুল করাই পাপ নয়। স্বীকার না করাই পাপ।”

ঐশানী কিছু বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই আকাশে বিদ্যুৎ চমকাল, আর দূর থেকে ভেসে এল সেই গলা—
“তুই কে? তুই কী ভাবিস নিজেকে?”

ঐশানী এক লাফে জানালার কাছে গেল। বাঁশবনের ভেতর থেকে যেন এক নারীশরীর ছায়ার মতো চলেছে, হাতে একখানা একতারা।

আর সেই একতারায় তালের মতো বেজে চলেছে কারও নাম—

“ঐ…শা…নী…”

পর্ব ৩: নামফলক ও নালিশ

ঐশানী জানালার পাশে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তার হাতে ধরা সেই তালের বীজের গায়ে নিজের নাম দেখে যেন শরীর জমে গিয়েছিল। এতদিন ধরে সে কত পুরাতন কাহিনি অনুসন্ধান করেছে, কত আখড়ায় ঘুরেছে, কিন্তু কোথাও কোনো বাস্তবিক প্রতিক্রিয়া তাকে এতটা নাড়িয়ে দেয়নি। কিন্তু এখন—এখানে—এই নির্জন আখড়ায়, একটা বীজ তার নাম ধরে ডাকছে, আর বাঁশবন থেকে ভেসে আসছে সেই গলা, সেই একতারা, সেই সুর।

“তুই কে?”—এই প্রশ্নটা তার ভিতরেও বাজছিল বারবার।

“তুই কে?”—এই প্রশ্নটা শুধুই সেই বাঁশবনের গায়িকার নয়, এটা যেন তার নিজের ভিতরের প্রশ্নও। কে সে? কেন এই অনুসন্ধান? সে কি শুধুই গবেষক? নাকি আরও কিছু?

ধরণী ফকির ধীরে এসে পাশে দাঁড়ালেন।
“তুমি ভয় পেয়েছ?”
ঐশানী কিছু বলল না। কেবল জিজ্ঞেস করল, “আপনার বীজে যেদিন নাম উঠেছিল, তখন আপনি কী করলেন?”
ধরণী শান্ত গলায় বললেন, “আমি হেমাঙ্গিনীর সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। বলেছিলাম—হ্যাঁ, আমার লোভ ছিল, আমার অহংকার ছিল, আমি আপনার গলায় আমার জয় খুঁজতে চেয়েছিলাম। আমি স্বীকার করেছিলাম।”
“তারপর?”
“উনি গান গাইলেন, আর বীজটা ফেটে গিয়েছিল। আমার নাম মুছে গিয়েছিল।”

ঐশানী সেই তালের বীজটা আবার হাতে নিয়ে তাকিয়ে দেখল। ছোট ছোট আঁকাবাঁকা অক্ষরে লেখা: ঐশানী বসু।

সে চোখ বন্ধ করল। কী পাপ লুকিয়ে আছে তার ভিতর? কী দোষ?

একটা স্মৃতি যেন ঝলকে উঠল।

দুই বছর আগে।
অন্য এক বাউল গবেষক—সাম্যদীপ ঘোষ। ঐশানীর সহকর্মী। প্রায় একই বিষয় নিয়ে কাজ করছিল। একদিন কনফারেন্সে ঐশানী সাম্যর লেখা কিছু তথ্য নিজের পেপারে ব্যবহার করেছিল—কোনো রেফারেন্স ছাড়াই। সাম্যদীপ রাগে-দুঃখে গবেষণা ছেড়ে দিয়েছিল। ঐশানী তখন বিষয়টাকে চাপা দিয়ে দিয়েছিল, কারণ তার স্কলারশিপ ও গবেষণা সেই কাগজের সাফল্যের ওপর নির্ভর করছিল।

সে কি একরকম চুরি ছিল?

সে কি একরকম পাপ?

ঐশানী চুপ করে রইল। তারপর ধরণীর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি স্বীকার করি।”

ধরণী বললেন, “তাহলে অপেক্ষা করো। আজ রাতে যদি তুমি গান শোনো, গান যদি তোমার ভিতর ডাকে, তবেই বীজ ফাটবে। না হলে তুমি… হারিয়ে যাবে।”

ঐশানী গলা শুকনো মনে করল। সে আরেকবার বীজটাকে চুমু খেল।

রাত্রি গভীর। বিদ্যুৎ নেই। কুপির আলোয় বসে ঐশানী তার নোটবুকে লেখে:

“হেমাঙ্গিনী হয়তো একজন মানুষ ছিলেন, হয়তো একজন সাধিকা। কিন্তু তার গানের ভিতর যে শক্তি আছে, তা বাস্তবের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এটা এক আত্মার পরিভ্রমণ। অথবা এক অতিপ্রাকৃত বিচারব্যবস্থা। তালের বীজ, যার গায়ে লেখা হয় মানুষের নাম—তা যেন সেই শেষ ডাক। একটা আয়না। যার ভিতর নিজের পাপের মুখোমুখি হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।”

ঠিক তখনই বাইরে বাঁশবনের দিক থেকে একতারা বাজল। গলা এল—এবার খুব স্পষ্ট। নারীকণ্ঠ, গভীর, করুণ, অথচ ভয়াবহ রকম সত্যভরা।

“তুই নাম দেখেছিস, তুই পাপ চিনেছিস, তুই কি মানবি?”

ঐশানী ধীরে দরজা খুলল। এক ধাক্কায় ঠান্ডা হাওয়া ঢুকল। বাঁশবনের দিকে এগিয়ে গেল সে। চারপাশে নিঃস্তব্ধতা, শুধু পায়ের শব্দ আর পাতার নিঃশব্দ নড়াচড়া।

হঠাৎ সে থমকে দাঁড়াল।

তার সামনে—একটা শূন্য চৌকোনা জমি। মাঝখানে একটা মাটির ঢিপি। সেই ঢিপির সামনে গোঁজা আছে একটা কাঠের ফলক। আর তার ওপর লেখা: সাম্যদীপ ঘোষ।

ঐশানীর গলা শুকিয়ে এল। “এটা কী?”

একটা গলা তার পেছনে বলে উঠল, “নামফলক। যার বীজ ভাঙে না, তার নাম এখানে ওঠে। তার আত্মা আর যায় না। বাঁশের মাঝে ঘুরে বেড়ায়, গান গায়, প্রতিশোধ চায়।”

ঐশানী ঘুরে তাকাল। অন্ধকারের মাঝে এক নারীমূর্তি দাঁড়িয়ে। সাদা লাল পাড় শাড়ি, হাতের একতারা ঘাড়ে ঝোলানো, চোখে তীব্র দৃষ্টি।

“তুমি… হেমাঙ্গিনী মা?”

মূর্তি মাথা নাড়ল। “আমি সেই গান, যেটা কেউ শুনতে চায় না। আমি সেই বিচার, যেটা হৃদয়ের ভেতরে হয়।”

ঐশানী হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল।

“আমি দোষী। আমি আমার বন্ধুর কৃতিত্ব কেড়ে নিয়েছিলাম। আমি ভয় পেয়েছিলাম আমার ব্যর্থতাকে। আমি স্বীকার করি। আমাকে ক্ষমা করো।”

হেমাঙ্গিনীর মতো সেই ছায়ামূর্তি ধীরে একতারা বাজাল। সেই তালের সুর।

আর ঠিক তখনই ঐশানীর হাতে ধরা বীজটা ফাটল। ভেতর থেকে একটা সাদা আলো বেরিয়ে আকাশের দিকে উঠল, আর অন্ধকার কেঁপে উঠল। চারপাশে বাতাস থেমে গেল। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস—এক মুক্তি।

ঐশানী ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল—সেই নামফলকে সাম্যদীপের নামটা এক মুহূর্তের জন্য ঝাপসা হয়ে গেল, তারপর মিলিয়ে গেল। শুধু একটা শব্দ রইল—মুক্ত।

আর হেমাঙ্গিনী?

তিনি নেই।

শুধু পাতায় পাতায় ভেসে বেড়াচ্ছে এক গানের পংক্তি—
“পাপ ফোটে যেমন বীজে, তেমনি গান ফোটায় আলো…”

পর্ব ৪: আঁধারের নিচে আলো

ঐশানী বসু ঘরে ফিরল এক নিঃশ্বাসে। হাতের তাল ফেটে গিয়েছে, কিন্তু রক্ত নয়, কেবল উষ্ণ এক আলো যেন ছড়িয়ে পড়েছে তার আঙুল বেয়ে। মাথা ঘুরছিল। অনুভূতিরা এত জোরে ঘুরপাক খাচ্ছিল যে ঠিকমতো কিছু ভাবতে পারছিল না সে।

সে ধরণী ফকিরের ঘরের দরজায় ধাক্কা দিল।
ভিতর থেকে দরজা খুলে গেল, আর ধরণী শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “হেমাঙ্গিনী গান গাইলেন?”
ঐশানী কাঁপা গলায় বলল, “আমার বীজ ফেটে গেছে। আমি স্বীকার করেছিলাম। আমি… আমি সাম্যদীপকে অবিচার করেছিলাম।”
ধরণী মাথা নাড়লেন। “গান তো আসলে ক্ষমার পথ। হেমাঙ্গিনী কাউকে শাস্তি দেন না, তিনি শুধু সেই দরজাটা দেখান, যেটা পেরিয়ে গেলে মুক্তি পাওয়া যায়।”

ঐশানী কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে বসে পড়ল।
“আপনি বলেছিলেন, অনেকেই গান শুনে পালিয়ে গেছেন। কেউ কেউ নিখোঁজ হয়েছেন। তাহলে কি তাদের বীজ ভাঙেনি?”
“হয়তো স্বীকার করতে পারেনি, অথবা পারেনি গানটাকে বুঝতে। তারা হারিয়ে গেছে সেই সুরের গোলকধাঁধায়।”

এই মুহূর্তে রাধামণি মাসি ঘরে ঢুকলেন। হাতে একটি পুরোনো খাতা, মলাট ছেঁড়া, পাতায় পাতায় মেহগনি রঙের দাগ।

“এইটা হেমাঙ্গিনীর ডায়েরি,” মাসি বললেন, “সব গানের কথা এখানে ছিল, কিন্তু তার চেয়েও বেশি ছিল নাম—যারা গান শুনে পালিয়েছিল, তাদের নাম, এবং যারা থেকে গিয়েছিল, তাদের নামও।”

ঐশানী ধীরে ধীরে সেই ডায়েরির পাতা ওল্টাতে লাগল। প্রতিটি পাতার ওপরে লেখা কোনো একটি গান। নিচে কয়েকটি নাম—কোনোটা কাঁচা হাতের লেখায়, কোনোটা ঘোলাটে কালি দিয়ে মুছে দেওয়া।

“এই নামগুলো এখন কোথায়?”
রাধামণি বললেন, “কেউ কেউ তো মারাই গেছে। কেউ নদীতে ডুবে, কেউ অরণ্যে হারিয়ে। কিন্তু কয়েকজন এখনো বেঁচে আছে। কেউ কেউ পাগল, কেউ জিনে ধরেছে বলে মানুষের সঙ্গে কথা বলে না। কেউ গান লেখে কিন্তু কাউকে শোনায় না।”

ঐশানী উঠে দাঁড়াল। “আমি তাদের সঙ্গে দেখা করতে চাই।”

ধরণী ফকির জানালেন, “তোমাকে যেতে হবে বিষ্ণুপুরের কাছে একটা গ্রামে—চণ্ডীতলা। সেখানে আছে নরেন পাল। সে একসময় হেমাঙ্গিনীর এক শিষ্য ছিল। গান জানত, কিন্তু পরে সে গান ছেড়ে জড়াল লোকতন্ত্রের গানে, পয়সার গান, মঞ্চের গান। সে স্বীকার করেনি, আর এখন সে পাগল। গানের একটা পংক্তি সে দিনরাত লিখে দেয়ালের গায়ে—‘আলো আঁধারে নাম লেখে না’।”

পরদিন সকালে ঐশানী রওনা দিল। ধরণী একটা চিঠি লিখে দিলেন—“নরেন পাল আমার চেনা। সে যদি চিঠিটা দেখে, হয়তো তোমার কথা শুনবে।”

চণ্ডীতলা গ্রামে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গেল। রোদ একটু ঢলে পড়েছে, কিন্তু হাওয়ায় একরকম ভ্যাপসা গন্ধ। স্থানীয় একজন মন্দিরের পাশে ইশারা করে বলল, “ওখানে থাকে ওই পাগল লোকটা। দেয়ালের গায়ে শুধু লিখেই যায়, গান গায় না।”

ঐশানী ছোট্ট টিনের ঘরের সামনে দাঁড়াল। দরজা খোলা, ভেতরে একটা ছেঁড়া বিছানা, মাটিতে পড়ে আছে কয়টা কলম, আর দেয়ালজোড়া একটাই বাক্য:
আলো আঁধারে নাম লেখে না
আলো আঁধারে নাম লেখে না
আলো আঁধারে…

সে চিঠিটা বার করে সামনে এগিয়ে দিল।

একজন শীর্ণ, হাড্ডিসার লোক ঘর থেকে বেরোল। চোখের ভেতর অনন্ত ভয়, আর গলায় সরু গলা—“তুই কে?”
ঐশানী বলল, “আমি হেমাঙ্গিনীর আখড়া থেকে এসেছি। আমি ঐশানী বসু। আপনার জন্য চিঠি এনেছি।”

নরেন পত্রটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। তারপর হঠাৎ চিৎকার করে উঠল—“না! আমি শুনতে চাই না! আমি আর গান গাইব না! আমাকে দোষ দিও না! আমি স্বীকার করি না!”

ঐশানী শান্তভাবে বলল, “আপনি ভয়ের জন্য গান ছেড়েছিলেন?”
নরেন থমকে গেল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “আমি… আমি টাকা চেয়েছিলাম। আমার গলায় ছিল হেমাঙ্গিনীর গান, কিন্তু আমি তা বিক্রি করেছিলাম কলকাতার এক প্রযোজককে। গান তো গেল, কিন্তু তালের বীজ এল…”

“আপনিও পেয়েছিলেন বীজ?”
“হ্যাঁ। আমার নাম লেখা ছিল। আমি গান শুনিনি। আমি পালিয়ে এসেছিলাম। তারপর থেকেই এই বাক্যটা মাথায় বাজে।”

ঐশানী সামনের মাটিতে বসে পড়ল। “আপনি যদি আবার শোনেন? যদি স্বীকার করেন?”
নরেন তার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, “গান তো শুনি না, কেবল সুরটা বাজে মাথায়—‘আলো আঁধারে নাম লেখে না।’ আমি এখনো জানি না, আমি আলো না আঁধার…”

ঐশানী হঠাৎ ব্যাগ থেকে নিজের রেকর্ডারটা বার করল। হেমাঙ্গিনীর একটা পুরোনো রেকর্ডিং চালাল। ধরণী ফকিরের দেওয়া একটি মাত্র ক্লিপ ছিল—হেমাঙ্গিনীর গলা।

“আমি দেখেছি তালের পাতায়, এক নাম কাঁদে চুপে…
তুই কি শুনিস সেই কান্না, না তুই শুধু নিজেকে শোনাস?”

নরেন থেমে গেল। চোখ ছলছল করছে। সে চুপ করে বসে পড়ে মাথা নিচু করল। তারপর বলল, “আমি স্বীকার করি। আমি পাপ করেছিলাম। আমি গান বিক্রি করেছিলাম। আমি… আমি হেমাঙ্গিনীকে ভুলে গিয়েছিলাম।”

ঐশানী অপেক্ষা করছিল। কিছুক্ষণ পর নরেন নিজেই উঠল, একটা ডালের পেছন থেকে বার করল ছোট একটা বীজ।
“এটা সেই তালের বীজ। এতদিন ধরে রেখেছিলাম। খুলতে পারিনি।”

সে বীজটা হাতে দিল ঐশানীকে।

ঐশানী দেখল, বীজের গায়ে লেখাগুলো ঘোলাটে হয়ে গেছে, নাম স্পষ্ট নয়, কালি ছড়িয়ে গেছে।

নরেন বলল, “আমি জানি না এটা ভেঙে যাবে কি না। কিন্তু আমি আজ প্রথমবার হেমাঙ্গিনীর গান শুনলাম, ভয় না পেয়ে।”

ঐশানী বলল, “ভয় নয়, গান বুঝলে আলো আসে।”

নরেন চোখ বন্ধ করল। এক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা। তারপর অনেক অনেকদিন পর সে গুনগুনিয়ে গাইল—

“তুই আমার নাম জানিস না, আমি যে তোর ভিতর…”

ঐশানী দেখল, দেয়ালের লেখাগুলো একে একে মুছে যাচ্ছে, যেন বাতাসে উড়ে যাচ্ছে।

পর্ব ৫: বৃষ্টির গন্ধে লেখা গল্প

বৃষ্টির হালকা গন্ধে ভিজে উঠছিল চণ্ডীতলার রাস্তা। নরেন পালের কুঁড়ে ঘরের বাইরে বসে ঐশানী চুপ করে শুনছিল পাতা ছুঁয়ে ঝরে পড়া জলের শব্দ, আর ভেতরে ভেতরে অনুভব করছিল—একটা পুরোনো দরজা খুলছে তার মনেই। যে দরজা তার নিজের অপরাধবোধ, চেপে রাখা গ্লানি আর আত্ম-অন্ধকার দিয়ে বন্ধ হয়ে ছিল এতদিন।

নরেন পাল আবার গুনগুন করতে শুরু করেছিল।
হেমাঙ্গিনীর সেই গানেরই এক টুকরো…
“তুই গলার গন্ধ ভুলে গেছিস, মুখ দেখেছিস আয়নায়, আয়না তো তোর ছিল না…”

ঐশানী বুঝতে পারছিল, যে মানুষকে সমাজ ‘পাগল’ বলে চিহ্নিত করেছে, সে আসলে এক ভিন্ন ঘরানার মুক্ত মানুষ—সে হয়তো ভেঙে পড়েছে, কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি। বরং আজ সে আবার নিজের গলা খুঁজে পেয়েছে।

নরেন তাকিয়ে বলল, “তুই শুনলি গানটা?”
“হ্যাঁ। মনে হলো নিজের গলায়ই বাজছে।”
“তাহলে তুই বুঝেছিস হেমাঙ্গিনীর ক্ষমা কেমন। ও কাউকে অভিশাপ দেয় না, শুধু আয়না ধরিয়ে দেয়। নিজের মুখ যদি নিজে চিনে নিতে পারিস, তবে বেঁচে যাবি।”

ঐশানী পকেট থেকে সেই বীজটা বের করল যেটা নরেন দিয়েছিল। কালি ঝাপসা, কিন্তু আলোয় চোখ ঘোরালে দেখা যায়—একটি নাম আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে।
“তুমি তো বেঁচে গেছ।”
নরেন হেসে বলল, “না রে মেয়ে, আমি এখনো মরিনি। শুধু এবার গানটা সত্যি করে গাইছি।”

ঐশানী রওনা দিল আবার সাঁইথিয়ার আখড়ায় ফিরতে। একরাশ প্রশ্ন আর এক টুকরো সুর নিয়ে।

আবার ফিরে এসে সে দেখল আখড়ায় আজ অনেক লোক। সামনে ছোট্ট মেলার মতো কিছু একটা বসেছে। ধরণী ফকির ব্যস্ত, রাধামণি মাসি বসে রকমারি চিত্র এঁকেছেন পাটকাঠিতে। একজন তরুণী বাউল গাইছেন—যাঁকে ঐশানী আগে দেখেনি।

সে ধরণীর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আজ কী উপলক্ষে এত লোক?”
ধরণী হেসে বললেন, “আজ আখড়ার প্রতিষ্ঠা দিবস। একসময় হেমাঙ্গিনী এই দিনেই প্রথম গান গেয়েছিলেন এই আঙিনায়। সেই থেকেই নিয়ম হয়ে গেছে।”

ঐশানী একটু থেমে বলল, “আপনি বলেন, উনি আর জীবিত নন। কিন্তু আমি তো দেখেছি তাঁকে। আমি তাঁর গান শুনেছি। আমিও বদলে গেছি।”
ধরণী বললেন, “তোমার দেখা আর চোখে দেখা এক নয়। তুমি তাঁর ভিতর দেখেছো। ওটাই সবচেয়ে সত্যি।”

ঐশানী নিচে বসে গান শুনতে লাগল। তরুণী বাউল গাইছেন—

“আমি কাকে বলি আপন, যারে দেখি সে তো পর…
পথের কাঁটা বলে আমায়, আমিই তো পথের ঘর…”

গান শুনে ঐশানীর মনে হল, হেমাঙ্গিনীর কণ্ঠ যেন ফিরে এসেছে। গলার কম্পন, শব্দের ঝাঁজ—সবকিছু তেমনই।

সে গায়িকার কাছে গিয়ে জানতে চাইল, “তোমার নাম কী?”
মেয়েটি মুচকি হেসে বলল, “আমার নাম জাগরণী। আমি রাধামণি মাসির শিষ্যা। গানের মধ্যে হাঁটি, জেগে থাকি।”

ঐশানী বলল, “তুমি কি কখনো হেমাঙ্গিনী মার গান শুনেছ?”
“না, কিন্তু মাসি বলেন, যেদিন ঠিকঠাক গাইতে পারব, সেদিন তাঁর গলা শুনব বাতাসে।”

ঐশানী মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল মেয়েটির দিকে। সেই মুখের মধ্যে যেন কোনো কাল্পনিক আগুনের ছায়া। সে বুঝল, হেমাঙ্গিনীর উত্তরাধিকার চলে গেছে জাগরণীর কণ্ঠে। হয়তো একদিন ও-ই গাইবে সেই গান, যা বদলে দেবে আরেকজনকে।

রাতে খাওয়ার পর ধরণী ফকির হঠাৎ বললেন, “তুমি জানো, হেমাঙ্গিনী তার জীবনের শেষ গান লিখেছিলেন একটা ছেঁড়া কাগজে, যেটা আজো খুঁজে পাওয়া যায়নি?”
“না। কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল?”
“কে জানে। কেউ বলে, সে গান লেখার পরই উনি অন্তর্ধান হন। সেই গানটা যেই গাইবে, সে-ই হয়তো হেমাঙ্গিনীর আসল উত্তরসূরি।”

ঐশানীর ভিতরে একটা কৌতূহল দানা বাঁধল। “কোনো সূত্র নেই?”
“শুধু এটুকু শোনা যায়, সেই গান শুরু হয়েছিল এই পংক্তিতে—
‘তুই তালের বীজে আলো লিখিস, আমি আঁধারে নাম রাখি…’”

ঐশানী চুপ করে ভাবল—এই গান হয়তো কোথাও আছে, হয়তো কারো গলার মধ্যেই আটকে আছে।

পরদিন সকালে ঐশানী আখড়া ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সে ঠিক করেছে এই গবেষণাকে থিসিসে নয়, বইয়ে পরিণত করবে। একটা গল্প হিসেবে, যেটা শুধু তথ্য নয়, অভিজ্ঞতার গল্প।

রওনা হওয়ার আগে ধরণী ফকির তাকে এক খাম দিয়ে বললেন, “তুমি রেখে দাও। এটা হেমাঙ্গিনীর গানের একটা কপি। আমি লিখে রেখেছিলাম, ভুলতে না পারার জন্য।”

ঐশানী খাম খুলে দেখল, ভিতরে চার লাইনের এক পংক্তি—

“তুই তালের বীজে আলো লিখিস,
আমি আঁধারে নাম রাখি।
তুই ভয় পাস, আমি গান গাই,
তুই ভুলিস, আমি থাকি…”

ঐশানী চোখ বন্ধ করল। মনে হল, এই চার লাইনের মধ্যেই যেন সব লেখা আছে—ভয়, পাপ, মুক্তি আর গান।

সে বিদায় নিল।

রাতের ট্রেনে ফিরে যাওয়ার সময় ঐশানী জানালার পাশে বসে ছিল। বাইরে অন্ধকারে গাছেরা দুলছে। হঠাৎ কোথা থেকে যেন ভেসে এল সেই সুর—
“তুই ভুলিস, আমি থাকি…”

সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। ট্রেনের শেষ কামরায়, জানালার গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একজন নারী। লালপাড় শাড়ি, একতারা কাঁধে। চাঁদের আলোয় তার মুখ স্পষ্ট নয়, কিন্তু ঐশানী জানে—সে হেমাঙ্গিনী।

আর সে হাসছে। কোনো কথায় নয়—সুরে।

ঐশানী তার ব্যাগ থেকে সেই বীজটা বের করল। এবার সেটার গায়ে আর কোনো নাম নেই। শুধু একটা ছোট দাগ—যা যেন বলে,

“তুই পারলি।”

পর্ব ৬: হারিয়ে যাওয়া গানের খোঁজে

কলকাতার জনারণ্যে ফিরে এসে ঐশানী বসু যেন কিছুতেই নিজেকে খুঁজে পাচ্ছিল না। ট্রেনের কামরায় হেমাঙ্গিনীর মুখ দেখার পর থেকে তার মাথার ভিতরে যেন একটা অনন্ত সুর বাজছিল, দিনের বেলায় তা চাপা পড়ে যেত বাইরের শব্দে, কিন্তু রাতের বেলা… নিঃশব্দ ঘুমঘোরে সেই সুর হঠাৎ চেপে বসত তার বুকের ওপর।

যেন কারও মৃদু গলা বলছে—
“তুই তো দেখেছিস, এখন লিখিস, লিখিস গান… নয়তো হারাবি আবার…”

সে ফিরে এসেই তার বিশ্ববিদ্যালয়ের গাইডের সঙ্গে দেখা করল। তার নাম ছিল ডঃ বিজয় মল্লিক—লোকসংস্কৃতির একজন কঠিন অথচ নিষ্ঠাবান পণ্ডিত। ঐশানী ডায়েরি, রেকর্ডিং, এবং সেই তালের বীজের ছবি সব দেখাল তাঁকে।

ডঃ মল্লিক অনেকক্ষণ চুপ করে ছিলেন। তারপর বললেন, “তুমি আসলে যা পেয়েছো, তা গবেষণার বিষয় নয়, আত্মার বিষয়। কিন্তু তুমি এটা লিখে যেতে পারো যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মও বুঝতে পারে—গানের ভিতরেও বিচার আছে।”

“আমি চাই একটা বই লিখতে,” ঐশানী বলল। “হেমাঙ্গিনীকে নিয়ে। শুধু তাঁর গান নয়, যাঁরা তাঁর গানে পাল্টে গেছেন তাঁদের নিয়েও।”
“তোমার গল্পে তো সে গান আছে, যেটা কেউ খুঁজে পায়নি—‘তুই তালের বীজে আলো লিখিস’…”
“হ্যাঁ, সেই পংক্তিগুলো ধরণী ফকির আমাকে দিলেন।”
“তুমি জানো কি, এই পংক্তি কোনও ছাপানো গানে নেই? কেউ কোনোদিন এ গান গায়নি—লোকচর্চায় এমন কিছু শোনা যায়, কিন্তু লিখিত প্রমাণ নেই।”

ঐশানী চুপ করে থাকল। তার হাত ব্যাগের ভিতর চলে গেল—তালের বীজটা সে এখন সর্বদা সঙ্গে রাখে।

“আপনি কি বিশ্বাস করেন, হেমাঙ্গিনী মা এখনও কোথাও আছেন?”
ডঃ মল্লিক মৃদু হাসলেন। “আমরা যাঁদের নিয়ে গবেষণা করি, তাঁরা কোনোদিন পূর্ণরূপে মরে না। কারণ তাঁরা আমাদের ভিতর বেঁচে থাকেন, আর তুমি তো তাঁদের গলা শুনেছো। তাই তো বলছো, তিনি আছেন। সেই অস্তিত্বটাই সত্য।”

ঐশানী মাথা নুইয়ে বলল, “তাহলে আমি এখন কোথায় খুঁজব সেই শেষ গানটা?”

ডঃ মল্লিক বললেন, “তুমি কি জানো শান্তিনিকেতনের গীতভবনে একবার হেমাঙ্গিনী পারফর্ম করেছিলেন? সম্ভবত ১৯৬৭ সালের মার্চে। তখন সে গানের কিছু চিত্রায়ণ হয়েছিল হাতে ধরে রাখা ৮ মিমি ফিল্মে। সেই ভিডিও আজ অবধি প্রকাশ হয়নি। গীতভবনের পুরোনো সংরক্ষণাগারে গেলে হয়তো কিছু পাবে।”

ঐশানীর চোখ জ্বলে উঠল। “আমি যাব।”

দু’দিন পর সে শান্তিনিকেতনের পথে। গীতভবনের আর্কাইভ অফিসার ছিলেন সরলা দে, বয়স ষাটের ওপর, কিন্তু মুখে চিরসবুজ হাসি।

“হেমাঙ্গিনী? ও তো আমার মায়ের বন্ধু ছিল,” সরলা বললেন। “মায়ের মুখে শুনেছি, হেমাঙ্গিনী নাকি গান গাইতেন চোখ বন্ধ করে, যেন নিজের শরীরেই ছিলেন না। সে সন্ধ্যার শেষ গান কেউ ভুলতে পারেনি।”

ঐশানী সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, “সেই গানের রেকর্ডিং কি আছে?”
সরলা মাথা নেড়ে বললেন, “আছে, কিন্তু অবস্থা ভালো না। পুরোনো ফিল্ম। আমরা ডিজিটাইজ করার আগেই হারিয়ে ফেলার ভয় হয়। তবে চাইলে দেখতে পারো, একটা কক্ষ আছে—‘পুরোনো চিত্রাগার’। এক্ষুনি নিয়ে চল।”

ঐশানী দুলতে দুলতে হাঁটছিল। ভিতরে যেন একটা আশ্চর্য আলো জ্বলে উঠেছে। যদি সেই গানে সে হেমাঙ্গিনীর মুখ আর কণ্ঠ শুনতে পায়, তাহলে হয়তো অনেক রহস্য পরিষ্কার হয়ে যাবে।

চিত্রাগারে ঢুকে সরলা একটা ধুলো পড়া কাঠের কেস খুললেন। তার ভিতর থেকে একটা রিল বার করে বললেন, “এইটাই সম্ভবত ১৯৬৭ সালের পারফর্ম্যান্স। কিন্তু পুরোটা ধরা ছিল না, শেষ গানটা আধাআধি… তারপর ফিল্ম শেষ হয়ে গেছিল।”

ঐশানী মাথা নুইয়ে বলল, “আমাকে দেখান। আমি শুধু দেখতে চাই, শুনতে চাই—অল্প হলেও।”

প্রজেক্টরে সেই পুরোনো দৃশ্য ফুটে উঠল। সাদাকালো, হেঁয়ালি আলোর মতো এক নারী, হাতে একতারা। চোখ বন্ধ, মুখ সামান্য নিচু। পাশে এক বৃদ্ধ বাজাচ্ছেন ঢোল, আর তার সামনে বসে বহুজন।

আর তারপর কণ্ঠ…

“তুই তালের বীজে আলো লিখিস,
আমি আঁধারে নাম রাখি।
তুই ভয় পাস, আমি গান গাই,
তুই ভুলিস, আমি থাকি…”

ঐশানী চোখ বন্ধ করে ফেলল। এই গলাটাই সে শুনেছিল বাঁশবনে, এই গলাটাই তার বীজ ফাটিয়েছিল।
কিন্তু ভিডিওটা এখানেই থেমে গেল। ফিল্ম ঝাপসা, আলোর ছায়া নাচে পর্দায়।

তবু ঐশানী জানে—এটাই সেই গান। হেমাঙ্গিনীর শেষ গান।

বেরিয়ে এসে সে গাছতলায় বসে কাঁপা হাতে নিজের নোটবুকে লিখে ফেলল পংক্তিগুলো। এরপর পাশে বসে থাকা সরলা দে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি গান লেখো?”
“না। আমি গান শুনি।”
“তবে আজ থেকে তোমার গানও শুরু হল। কারণ তুমি সেই সাক্ষী, যে হারিয়ে যাওয়া সুরকে ফিরিয়ে এনেছো।”

ঐশানী হেসে বলল, “গান তো শরীরের মধ্যে জন্মায়। আমি তো শুধু কাগজে রাখছি।”
“না, গান কাগজে নয়—মনে জন্মায়। তুমি আজ থেকে হেমাঙ্গিনীর গান বহন করছো। নিজের ভিতরে।”

ঐশানী মাথা নিচু করে বলল, “তাহলে এবার আমাকে একটা কাজ করতে হবে।”

রাত্রে হোস্টেলে ফিরে এসে সে ল্যাপটপ খুলল, একটা নতুন ফোল্ডার তৈরি করল:
“তালের বীজে লেখা নাম – A Field Chronicle of Baul Mysticism”
প্রথম পৃষ্ঠায় সে লিখল—

“এই বই কোনো গবেষণা নয়। এই বই একটি মেয়ের যাত্রাপথ, যে ভুল করেছিল, স্বীকার করেছিল, আর এক সুরের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। এখানে গান আছে, পাপ আছে, মুক্তি আছে। আর আছে এক নামহীন নারীর কণ্ঠ—যিনি হয়তো এখনও বাঁশবনের পাতায় গান গেয়ে যান…”

পর্ব ৭: তালের বীজের উত্তরাধিকার

ঐশানী বসু জানত না তার লেখা শুরু হওয়ার পর কীভাবে একদিন, একেকটা বাক্য হেমাঙ্গিনীর গলার মতো আত্মায় এসে বাজে। তার ডায়েরির প্রতিটি পৃষ্ঠায় জড়িয়ে যাচ্ছে এক একটি গল্প—যেন সে লেখেনি, লেখা হয়ে উঠেছে। যেন কোনো অদৃশ্য হাত, বাতাসের মতো হালকা, তার কলম চালিয়ে দিয়েছে।

বইয়ের নামটা স্থির করেছে—তালের বীজে লেখা নাম।

এই বই শুধু হেমাঙ্গিনী বা ঐশানীর কথা নয়, এই বই হলো সেইসব মানুষের, যারা গান শুনে নিজের পাপের মুখোমুখি হয়েছে, যারা ভয় পেয়েছে, কিন্তু পালায়নি। এই বই সেই গল্প বলবে—যেখানে সুর একটা আয়না, যেখানে শব্দ একটা দগ্ধ আলো।

দিনে সে গ্রন্থাগারে বসে গবেষণা করে, রাতে বাঁশি বাজানো চুপচাপ গান শোনে ইউটিউব খুঁজে—পুরনো বাউল রেকর্ডিং, লোকাল ক্লিপিংস, হেমাঙ্গিনীর ছায়াস্বর।

কিন্তু তার মনে প্রশ্ন জাগে—এইসব তথ্য সে পেয়েছে, এই অভিজ্ঞতা সে অনুভব করেছে, কিন্তু তারপর?

তার উত্তরাধিকার কী?

গানটা কি এখানে থেমে যাবে?

নাকি চলবে অন্য কারও গলায়?

সেই প্রশ্নের উত্তরটা যেন আবার তাকে ফিরিয়ে নিল সাঁইথিয়ায়। তিন সপ্তাহ পর, বইয়ের খসড়া শেষ করেই সে রওনা দিল আবার সেই আখড়ার দিকে।

এইবার সঙ্গে নিয়ে গেল একটি বাউল একতারা, মেদিনীপুর থেকে সংগ্রহ করা একটুকরো কাঁসার ঘণ্টি, আর একটি খাম—যার ভিতরে ছিল সেই তালের বীজ। এখন সেটি নিষ্ক্রিয়, নাম নেই, আলো নেই, কিন্তু ঐশানী জানে, এই বীজের ভিতরে একবার একটা পাপ-পরিণতির গল্প লেখা ছিল। এখন এই বীজ শুধু স্মৃতি নয়, এক উত্তরাধিকার।

আখড়ায় পৌঁছেই সে রাধামণি মাসির খোঁজ করল।
মাসি উঠোনে বসে পাটকাঠি আঁকছেন।
ঐশানী বলল, “আমি ফিরেছি। আমার গল্প শেষ হয়নি।”
মাসি এক ঝলক চোখ তুলে তাকিয়ে হেসে বললেন, “শেষ হয়? গান কি কোনোদিন শেষ হয় রে?”

ঐশানী বলল, “আমি একটা বই লিখেছি হেমাঙ্গিনী মা-কে নিয়ে। আপনার অনুমতি নিয়ে আমি সেটাকে ছাপাতে চাই।”
মাসি মাথা নাড়লেন। “তুই শুধু বই লেখিস না। তুই গানটাও শিখ। কারণ গান বইয়ের মতো শব্দে নয়, মনে বেঁধে থাকে।”

ঐশানী বলল, “আমার ভয় করে। আমার গলায় গান নেই।”
মাসি বললেন, “তোর ভিতরে গান আছে। সেই গান তুই লিখেছিস তো এতদিন! এখন শুধু গলা দিয়ে বের করে আন।”

এইসময় উঠোনে ঢুকল সেই মেয়ে—জাগরণী। একতারা হাতে। তার চোখে একটা নতুন দীপ্তি।

ঐশানী বলল, “তুই গান গাচ্ছিস এখন?”
জাগরণী মাথা নেড়ে বলল, “মাসি বলেন, আমি এখন শব্দে না, নিঃশ্বাসে গান গাই।”
ঐশানী মুগ্ধ হয়ে তাকাল।

জাগরণী পাটের নিচে থেকে একটি ছোট খাম বার করল। বলল, “একটা বীজ পেয়েছি গতরাতে, পুকুরের ধারে। গায়ে কিছু লেখা নেই, কিন্তু গন্ধ আছে—হেমাঙ্গিনীর গলার গন্ধ।”

ঐশানীর হাত কাঁপল। সে বলল, “আমি একটা বীজ এনেছি, যেখানে আমার নাম লেখা ছিল, আর ফেটে গেছে। যদি এইটা সেই ফেটে যাওয়া বীজ হয়…”

দুজনের বীজ পাশাপাশি রাখল। এক মুহূর্তের জন্য দুটো আলাদা দেখতে লাগল, তারপর বাতাসে যেন ঝাঁপসা কাঁপুনি উঠল। পাতা নড়ল না, অথচ শব্দ হল। এক অদৃশ্য ঘণ্টার ধ্বনি।

মাসি বললেন, “এখন সময় হয়েছে নতুন গান লেখার। তুই আর ঐশানী একসাথে বসে গান লিখবি। হেমাঙ্গিনীর গান শেষ হয়েছে না, এখন তার নতুন রূপ হবে তোদের কলমে।”

ঐশানী প্রথমে ভয় পেল। সে তো গবেষক, সুরকার নয়। কিন্তু তারপর সে বুঝল—এই ভয়টাই তো প্রথম গানের দ্বার।

সে জাগরণীর পাশে বসে বলল, “আমরা একসাথে লেখব। এক গলায় গাইব। পুরোনো সুরের ভেতর নতুন কথা বসাব।”

মাসি বললেন, “তালপাতা আন। রং আন। পাটকাঠিতে লিখবি তোদের গান।”

তালপাতার ওপর প্রথম পংক্তিটা ঐশানী লিখল—
“তুই পাপে নাম খোঁজিস, আমি গানে আলো রাখি…”

জাগরণী লেখে—
“তুই ভাঙা বীজে মায়া খুঁজিস, আমি বাঁশে গান বাঁধি…”

এইভাবে গান তৈরি হয়—শব্দে, শ্বাসে, আর এক আত্মীয়তায়।

ঐশানী প্রথমবার গলা খুলে গাইল। ভয়, পাপ, অভিমান পেরিয়ে এক নির্মল সুরে।

আর তখনই আকাশ ভেঙে হালকা বৃষ্টি এল। পুকুরের ঘোলা জলে ছড়িয়ে গেল সাদা ফেনা। আর দূরে, বাঁশঝাড়ের ফাঁক দিয়ে এক নারী ছায়া হেঁটে গেল ধীরে ধীরে।

হাতের একতারা কাঁধে ঝোলানো। গলায় সেই পুরোনো গানের প্রতিধ্বনি—
“তুই ভুলিস, আমি থাকি…”

ঐশানী বুঝল—হেমাঙ্গিনী মা আজ তাঁর বীজ হস্তান্তর করলেন।

পর্ব ৮: বীজ, বৃষ্টি, এবং বিদায়বেলা

বৃষ্টি থেমে গেল অনেকক্ষণ আগে, কিন্তু পাতার ফাঁকে জমে থাকা জলের ফোঁটাগুলো এখনও একেক করে মাটি ছুঁয়ে পড়ে, যেন কোনো অলক্ষ্য কান্না। ঐশানী বসে ছিল পুকুরঘাটে, জলের প্রতিচ্ছবিতে নিজের মুখ খুঁজছিল। গত কয়েক মাসে কত বদলে গেছে তার জীবন। এখন সে আর শুধুই গবেষক নয়, এখন সে নিজের মুখ চিনতে পেরেছে এক অদ্ভুত সুরের আয়নায়।

তার পাশে বসে আছে জাগরণী। পায়ের কাছে রাখা তাদের একতারা, আর মাঝখানে একটা তালপাতায় লেখা নতুন গান—হেমাঙ্গিনী মার স্মৃতিতে লেখা, আর বর্তমানের ছায়ায় ভেজা।

জাগরণী বলল, “তুই চলে যাবি তো এবার?”
ঐশানী বলল, “হ্যাঁ। আমার বইয়ের পাণ্ডুলিপি জমা দিতে হবে। তারপর তো প্রকাশনার কাজ। কিন্তু মনে হচ্ছে কিছু ফেলে যাচ্ছি।”
“সব কিছু তো কেউই নিয়ে যেতে পারে না।”
“কিন্তু আমি যদি ভুলে যাই?”
“তুই ভুলতে পারবি না। কারণ গান তোকে চিহ্নিত করেছে। তুই সেইজন, যার বীজ ফেটেছিল। সেইরকম মানুষ শুধু স্মৃতি নিয়ে যায় না, স্মৃতি গড়ে তোলে।”

ঐশানী নিঃশ্বাস ফেলল। তার হাতের তালুতে বীজটা নেই, কিন্তু এক অদ্ভুত ভার যেন এখনও সে অনুভব করে।

“জাগরণী, তুই গান শেখাবি তো?”
“হ্যাঁ। এবার আমি শেখাব। গান তো যে জানে সে-ই শেখায় না, যে বোঝে সে-ই শেখায়। মাসি বলেছিল।”

ঐশানী উঠে দাঁড়াল। “আমি এবার চলি। কিন্তু আমি আবার ফিরে আসব। বারবার।”
“তোর জন্য আখড়ার দরজা খোলা থাকবে,”—জাগরণী হেসে বলল।

এই সময় রাধামণি মাসি এসে দাঁড়ালেন। তাঁর হাতে ছিল ছোট্ট কাঠের বাক্স।
“তুই যদি সত্যি গান নিয়ে চলতে চাস, তবে এটা রাখ।”
ঐশানী বাক্সটা খুলে দেখল—ভিতরে একটি তালের বীজ, কিন্তু এবারের বীজটা ছিল চকচকে, মসৃণ, আর তার গায়ে কালি দিয়ে লেখা ছিল একটা অদ্ভুত প্রতীক—মধ্যে এক বিন্দু, চারপাশে চারটি রেখা, যেন চারদিক ছড়িয়ে দেওয়া গান।

“এটা কী?”
মাসি বললেন, “হেমাঙ্গিনী রেখে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, যেদিন কেউ সত্যি বুঝবে গান কাকে বলে, সেদিন ওকে দিয়ে দিও।”

ঐশানী বুঝল, এটা তার পুরস্কার নয়, তার দায়িত্ব।

কলকাতা ফিরে এসে সে ডঃ মল্লিককে পাণ্ডুলিপি জমা দিল। তিনি চুপ করে পড়লেন কিছু পাতা। তারপর বললেন, “তোমার বই শুধু গবেষণা নয়, এটা একটা যাত্রার দলিল।”
ঐশানী বলল, “আমি এখন বুঝি, গান শুধু সুর নয়। এটা আত্মার ভাষা।”
“এবং তুমি সেই ভাষা শিখেছ। এখন তুমি সেটার বাহক।”

প্রকাশনা সংস্থা বইয়ের খসড়া পড়ে মুগ্ধ। বইয়ের নাম নিয়েও কোনো দ্বিধা নেই—তালের বীজে লেখা নাম।

প্রথম সংস্করণে ঐশানী জুড়ে দিল সেই পংক্তি যা তালপাতায় প্রথমবার লিখেছিল—
“তুই পাপে নাম খোঁজিস, আমি গানে আলো রাখি…”

বই ছাপা হলো ঠিক পূর্ণিমার আগে।
লঞ্চের দিন আয়োজিত হলো রবীন্দ্র সরোবরের এক চত্বরে—যেখানে বৃক্ষ আর হাওয়া একে অপরকে চেনে।

ঐশানী মঞ্চে উঠে বলল, “এই বই কোনো কল্পকাহিনি নয়। এটা আমার দেখা কিছু ঘটনা, শোনা কিছু গান, আর অনুভব করা এক আলোর গল্প। এটা সেইসব মানুষের কাহিনি, যারা গান শুনে পাল্টে গেছে। যারা ভয় পেয়েছে, কিন্তু পালায়নি।”

তারপর সে হাত বাড়িয়ে ডেকে নিল একজনকে—জাগরণী। প্রথমবার শহরে এসে, লাল পাড় শাড়িতে সে যেন ঠিক হেমাঙ্গিনীরই প্রতিধ্বনি।

জাগরণী গাইল সেই গান—
“তুই গলায় ভয় রাখিস, আমি মুখে গান রাখি…
তুই ভুলে যাস বারবার, আমি আবার লিখি…”

লোকজন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনল।

ঐশানী জানত, এই গান কেবল সুরের অভিজ্ঞতা নয়—এটা জীবনের সাক্ষ্য।

লঞ্চের শেষে, এক প্রৌঢ় লোক ঐশানীর কাছে এসে বললেন, “আমি সাম্যদীপ ঘোষ। একসময় তোমার সহগবেষক ছিলাম।”

ঐশানী থমকে গেল।

“তুমি যখন আমার তথ্য ব্যবহার করেছিলে রেফারেন্স ছাড়া, আমি রাগ করেছিলাম, ক্ষোভ নিয়ে গবেষণা ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন তোমার বই পড়ে বুঝলাম, তুমি শুধু ভুল করোনি, সেটা মেনেছ। গান শুনেছ। পালাওনি।”

ঐশানীর চোখ ছলছল করছিল। “আমি ক্ষমাপ্রার্থী।”
সাম্যদীপ মাথা নেড়ে বললেন, “আমিও তাই। আবার গবেষণায় ফিরেছি। তোমার লেখা আমাকে আলো দেখিয়েছে।”

ঐশানী জানত, এখন সে সত্যি মুক্ত।

রাতে বাড়ি ফিরে, জানালার ধারে বসে ঐশানী বীজটা হাতে নিল—যেটা মাসি দিয়েছিলেন।

তার গায়ে আলো পড়ে জ্বলজ্বল করছে সেই প্রতীক। হঠাৎ করেই মনে হল, সেই প্রতীকের চার দিক যেন ছড়িয়ে পড়ছে পাতার ছায়ায়।
আর দূরে কোথাও যেন ভেসে আসছে এক গলা—
“তুই গান শুনলি, এবার তুই গান হ।”

ঐশানী চোখ বন্ধ করল। আর এবার, এক দীর্ঘ নীরবতার ভেতর, তার ভিতরের গলা নিজে থেকেই গেয়ে উঠল—
“তুই ভুলিস, আমি থাকি…”

পর্ব ৯: সুরের ভিতরে শুদ্ধি

কলকাতার হালকা ঠান্ডা ভোরে, জানালার ফাঁক গলে আসা আলোয় ঐশানী বসু আজ যেন একটু অন্য রকম মানুষ। বই প্রকাশ হয়ে গেছে। পাঠক প্রতিক্রিয়া আসতে শুরু করেছে। কেউ লেখে—“গান দিয়ে পাপের বিচার, এ এক নতুন ধারণা।” কেউ বলে—“হেমাঙ্গিনী কি সত্যিই ছিলেন?” আর কেউ কেউ শুধু লেখে—“এই বই আমাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে।”

ঐশানী জানে, প্রশ্নগুলো ঠিক। কারণ তার লেখাও ছিল একটা প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা।

কিন্তু এই বইয়ের পর সে বুঝতে পেরেছে, এখন তার আরও বড় দায়িত্ব—গানকে শুধু বিষয় নয়, উপায় করে তোলা। গান দিয়ে মানুষের ভুল দেখা, নিজের ভুল স্বীকার করা, আর শেষত এক জায়গায় পৌঁছানো—যেখানে ভিতরের গলাটা বলবে, “তুই পারলি।”

সে আবার ধরণী ফকিরকে চিঠি লেখে।
লিখে, “আমি চাই আখড়ায় ফিরে গিয়ে কিছুদিন থাকি। গান শিখি, বোঝি, ছড়িয়ে দিই। আপনি অনুমতি দেবেন?”

এক সপ্তাহ পর একটিমাত্র উত্তর আসে—
“তোর জন্য আখড়া সবসময়ই খোলা।”

ঐশানী আবার সাঁইথিয়ার সেই রাস্তায়। রিকশাওয়ালা চিনে ফেলেছে এবার, হাসে আর বলে, “গানের দিদিমণি ফিরলেন!”

পৌঁছাতেই আখড়ার পরিবেশ পাল্টে গেছে। উঠোনে নতুন কয়েকজন এসেছে—কেউ স্কুল ফেলে পালিয়ে আসা কিশোর, কেউ বিধবা মেয়ে, কেউ শহর ছেড়ে আসা চাকরিজীবী। ধরণী ফকির তাদের বসিয়েছেন, তাল শেখাচ্ছেন, রাধামণি মাসি ছবি আঁকছেন, জাগরণী একতারা হাতে নতুনদের গান শেখাচ্ছেন।

ঐশানী দেখে, আখড়া একটা স্কুলে রূপ নিচ্ছে—সুরের স্কুল, কিন্তু তা পাঠ্যসূচিভিত্তিক নয়, আত্মাভিত্তিক।

ঐশানী বলে, “আমি থাকতে চাই। শিখতে চাই। এবং শেখাতে চাই।”
ধরণী মাথা নাড়েন, “তুই এখন গায়, কিন্তু গলা দিয়ে নয়—চোখ দিয়ে, হাত দিয়ে, কথা দিয়ে।”
ঐশানী হাসে। “আমি এবার সত্যি গলা দিয়ে গাইতে চাই।”

সেই রাতেই শুরু হয় আখড়ার নতুন গানচক্র। উঠোনে ধূপ জ্বলে, চারদিকে মাদুর পাতা। মাঝখানে বসে ধরণী, রাধামণি, জাগরণী, আর নতুনরা। ঐশানী হাতের একতারা ছুঁয়ে প্রথমবার নিজে গান গায়—হেমাঙ্গিনীর সেই গান—

“তুই পাপে নাম খোঁজিস,
আমি গানে আলো রাখি…”

গলা কাঁপছিল, কিন্তু মনের ভিতরে ছিল না একটুও ভয়।

গান শেষ হলে হঠাৎ উঠোনের এক কোণে থাকা নতুন ছেলে—নাম ভাস্কর—চোখ মুছতে মুছতে বলল, “আমার ভিতরটা যেন খুলে গেল। আমি মাকে না বলে এখানে চলে এসেছি। আমার মনে হয়েছিল, আমি কাউকে মুখ দেখাতে পারি না। কিন্তু এই গানটা শুনে মনে হচ্ছে, আমি ভুল করেছিলাম ঠিক, কিন্তু তা শেষ নয়।”

ঐশানী বুঝল—এই তো আসল কাজ। গান দিয়ে কেউ নিজের ভুল বুঝতে পারল, স্বীকার করল, আর মুক্ত হল।

সেই রাতে ঐশানী লিখে রাখে ডায়েরিতে—
“গান হলো একধরনের শুদ্ধি। যে গলায় সত্য থাকে, সে গান শ্রুতি নয়, প্রার্থনা হয়।”

পরদিন সকালে রাধামণি মাসি হঠাৎ তাঁকে ডেকে বলেন, “তুই কি জানিস, হেমাঙ্গিনী মা একবার বলেছিলেন, তাঁর গান একদিন চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে? গ্রামের পর গ্রামে, শহরের চত্বরে, মানুষের কানে না, হৃদয়ে বাজবে।”
ঐশানী হেসে বলে, “তাই তো হচ্ছে। আপনি-আমি সবাই তো তাঁর সেই গানের ধারক।”
মাসি বলেন, “তাহলে এখন সময় এসেছে তোর নতুন কাজ শুরু করার।”

“নতুন কাজ?”
“তুই এবার নিজেই একটা আখড়া তৈরি করবি। শহরে। ওখানে গিয়ে গান শেখাবি, মানুষ আনবি, যাদের ভিতরে ভয় আছে, ভুল আছে। ওদের তুই গানে নাম লেখাতে শেখাবি।”

ঐশানী কেঁপে ওঠে। “আমি পারব?”
মাসি হেসে বলেন, “তোর বীজ তো ফেটেছে। এখন তুই বীজ বুনবি।”

তিন মাস পরে, বালিগঞ্জ অঞ্চলে এক পুরনো বাড়িতে ঐশানী শুরু করে ‘আলোবীজ’ নামে এক গানের আখড়া। ছোট্ট ঘর, দুটো একতারা, একজোড়া ঢোল, কিছু মাদুর। আর অনেক অনেক গল্প।

প্রথমে আসে চারজন—একজন কলেজে ব্যর্থ হয়ে মানসিক অবসাদে ভোগা মেয়ে, একজন পাড়ার চায়ের দোকানি, একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংককর্মী, আর একজন থিয়েটার অভিনেত্রী যার গলা এক দুর্ঘটনায় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

ঐশানী প্রথমে তাদের শোনায় হেমাঙ্গিনীর গল্প, তারপর গায় গান।
একেকজন নিজের গল্প বলে। কেউ বলে, “আমি লুকিয়ে প্রেম করেছিলাম আর শেষে সেই মেয়েটা আত্মহত্যা করে।”
কেউ বলে, “আমি বাবার টাকা চুরি করেছিলাম।”
কেউ বলে, “আমি বিশ্বাসঘাতকতা করেছি বন্ধুর সঙ্গে।”

ঐশানী সবাইকে একটি করে শুকনো তালের বীজ দেয়—নাম ছাড়া।
বলে, “তোমরা গান শুনো, আর নিজের ভিতরের পাপের মুখোমুখি হও। তারপর যে লিখতে চাও, সেই নাম লিখে ফেলো।”

এভাবে শুরু হয় ‘আলোবীজ’-এর যাত্রা।

একদিন রাতে, আখড়ার মেঝেতে বসে ঐশানী চুপ করে নিজের গলায় গুনগুন করছিল। হঠাৎ পেছনে কাঁধে এক হাত। ঘুরে দেখে—হেমাঙ্গিনী মা।

না, বাস্তব না। স্বপ্নের মতো। ছায়ার মতো। কিন্তু উপস্থিতি স্পষ্ট।

হেমাঙ্গিনী বলেন, “তুই তো এখন নাম লেখাচ্ছিস। আমি তোকে দিয়েছিলাম শেষ বীজটা। এখন তুই তা বুনিস মানুষের ভিতরে।”

ঐশানী চোখে জল নিয়ে বলল, “আপনার গান আমি মনে রাখব।”
হেমাঙ্গিনী হেসে বললেন, “না রে মেয়ে, এখন তুই গান। তোর গলায় আমি বেঁচে থাকি।”

এক মুহূর্তে তিনি মিলিয়ে গেলেন। জানালার কাঁচে টুপটাপ করে বৃষ্টি পড়ল।

ঐশানী জানত, সেই শব্দও এখন গান।

পর্ব ১০: তুই গান, আমি নাম

কলকাতার বালিগঞ্জের এক পুরনো বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে ঐশানী বসু আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। একটা হালকা মেঘ ভেসে যাচ্ছে, তার নিচে সন্ধ্যার রঙ ছড়িয়ে পড়ছে শহরের জানালায় জানালায়। নিচে তার গড়া আখড়া ‘আলোবীজ’-এ আজ প্রথম খোলা আসরের আয়োজন। তার গলার গানে আজ আর ভয় নেই, কাঁপুনি নেই। এখন তার গলায় আছে হেমাঙ্গিনীর ছায়া, নিজের স্বর, আর এক আশ্চর্য আত্মবিশ্বাস—যেটা তৈরি হয়েছে পাপের স্বীকারোক্তি, ক্ষমার কান্না আর একতারা ধরা শুদ্ধির দীর্ঘ যাত্রায়।

তিন বছর পেরিয়ে গেছে তার প্রথম আখড়ায় যাওয়া থেকে। আজ সে শুধু গান শেখায় না, সে ‘গানের আয়না’ তৈরি করে। যারা আসে, তারা নিজের ভিতরের ভুল, দুঃখ, অসম্পূর্ণতা—সবকিছু নিয়ে আসে। তারপর ঐশানীর কাছে শেখে—কীভাবে সুরে নিজেকে শুদ্ধ করতে হয়।

আজকের খোলা আসরে অনেকেই আসছে। কেউ কবি, কেউ অফিস-ক্লার্ক, কেউ অভিনেতা, কেউ অবসরপ্রাপ্ত। কিন্তু সবার চোখেই এক রকম উন্মুখতা—নিজেকে একটু একটু করে খুলে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা।

ঐশানী ধীরে ধীরে নিচে নামল।

জাগরণী এসেছিল সাঁইথিয়া থেকে। সে এখন আখড়ার সহগুরু। হাতে তার সেই পুরনো একতারা, গলায় হালকা মালা আর চোখে এক নির্ভার গভীরতা।

আসরের শুরুতে ঐশানী বলল, “আজকের দিনটি আমার কাছে একটি পর্বের শেষ, আর এক নতুন গানের শুরু। এই ‘আলোবীজ’ এখন আর শুধু আমার নয়—এটা আমাদের সকলের। এখানে কেউ বিচার করে না, কেউ শাস্তি দেয় না। এখানে শুধু গান হয়। সেই গান, যা কাউকে পাল্টে দেয়।”

তারপর সে বলল, “আজ আমি একটা গান গাইব, যা একসময় গাওয়া হয়নি। একটা অসমাপ্ত গান, যার শেষ লাইন আমি আজ লিখে ফেলেছি।”

সে হাতে তুলে নেয় তালপাতার পুরনো টুকরোটা—যেটায় লেখা ছিল:

“তুই তালের বীজে আলো লিখিস,
আমি আঁধারে নাম রাখি।
তুই ভয় পাস, আমি গান গাই,
তুই ভুলিস…”

ঐশানী হাসে। তারপর বলে, “এই লাইনটা ছিল অসম্পূর্ণ। আর আমি লিখেছি—
‘তুই ভুলিস, আমি থাকি।’
এই আমি হলো হেমাঙ্গিনী। এই আমি হলো তুমি। এই আমি হলো সেই গান, যা কোথাও হারায় না।”

আসরের ভেতর নিঃশব্দ ভালোবাসা ছড়িয়ে পড়ে।

তারপর গান শুরু হয়।

ঐশানী গায় সেই পুরনো গান—
“তুই পাপে নাম খোঁজিস,
আমি গানে আলো রাখি।
তুই ভাঙা বীজে মায়া খুঁজিস,
আমি বাঁশে গান বাঁধি।
তুই ভয় পাস, আমি গান গাই,
তুই ভুলিস, আমি থাকি।”

আসরের পর, এক এক করে মানুষজন উঠে আসে তার কাছে।
একজন বলেন, “আমি বউকে মেরে ফেলেছিলাম—অবহেলায়, চুপ করে থেকে। আজ গান শুনে বুঝলাম, আমি সেজন্য নিজেকেই শাস্তি দিয়ে চলেছি।”
আরেকজন বলেন, “আমি মেয়েকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলাম। এখন সে নেই। আমি গলার ভিতর থেকে একটাই প্রশ্ন পাই—আমি কি ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য?”
ঐশানী সবার হাতে একটা করে তালের বীজ দেয়, বলে, “লিখে ফেলো নাম। শুধু নাম নয়, দোষ। এরপর গান শোনো। গান বিচার করবে না, মুক্তি দেবে।”

রাতে, আখড়া ফাঁকা হলে, ঐশানী মেঝেতে বসে পড়ে। পাশে বসে জাগরণী।

ঐশানী বলে, “তুই জানিস, হেমাঙ্গিনী একদিন বলেছিলেন—‘তুই গান হ, আমি নাম হবো’। তখন বুঝিনি কথাটা। এখন বুঝি, গান হচ্ছে চলমান আত্মা, আর নাম হচ্ছে মানুষের ভেতরের সত্য।”
জাগরণী হাসে, “তোর গলায় এখন সেই সত্য বাজে।”

ঐশানী হঠাৎ একটা খাম বাড়ায়।
“এইটা তোকে দিতে বলেছে ধরণী ফকির। গত মাসে চিঠি পাঠিয়েছেন।”
জাগরণী খাম খুলে পড়ে—

> “জাগরণী, হেমাঙ্গিনী মা একবার বলেছিলেন—যদি কেউ গলায় কান্না আর মুক্তি একসাথে গাইতে পারে, তবে সেই গলাতেই নাম লেখা যায়। তুই সেই কণ্ঠ। এখন থেকে তুই তালের বীজ রাখিস, গান শোনাস, নাম লেখাস।
– ধরণী ফকির”

 

জাগরণীর চোখে জল আসে।
ঐশানী বলে, “তুই এবার এই আখড়ার গার্ডিয়ান।”
জাগরণী কাঁপা গলায় বলে, “আর তুই?”
“আমি যাব। নতুন জায়গায়। নতুন আখড়া গড়ব। যেখানে গান এখনো পৌঁছায়নি, সেখানে পৌঁছে দেবো। যেখানে পাপ আছে, কিন্তু গান নেই—সেখানে গান নিয়ে যাবো।”

দুই বছর পর…

ভারতের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে গেছে ‘আলোবীজ’-এর শাখা। সাঁওতাল গ্রাম থেকে শিলিগুড়ি, অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে দার্জিলিং—যেখানে ভয়, লজ্জা আর অপরাধ লুকিয়ে আছে, সেখানে ঐশানীর তৈরি গান পৌঁছে গেছে।

অফিস নেই, বোর্ড নেই, ব্যানার নেই। শুধু উঠোন, কুপির আলো, একতারা, আর হাতে তুলে দেওয়া একটা বীজ—নামহীন।

মানুষ গান শুনে কাঁদে, ভাবে, লিখে ফেলে নিজের নাম। তারপর সেই নাম বীজের গায়ে লেখা হয় না আর—কারণ গান শোনার পর সেই নাম আর অপরাধের তালিকায় থাকে না।

ঐশানী আর গলা দিয়ে গান গায় না। সে শুধু বসে, দেখে, শোনে—আর সুরের ভিতরে আরেকজন হয়ে যায়।

তালের বীজগুলো এখন আর ভেঙে পড়ে না, তারা অঙ্কুর গজায়।

শেষ দৃশ্যে, এক পাহাড়ি গ্রামে—ঐশানী বসে আছে এক পাথরের ওপর। পাশের নদীর জল শান্ত। তার পাশে এক কিশোরী বসে—চোখে ভয়, হাতে এক ফাঁকা বীজ।

ঐশানী বলে, “তুই কিছু ভুল করেছিস?”
কিশোরী মাথা নাড়ায়।
“তুই স্বীকার করিস?”
সে কাঁদতে কাঁদতে বলে, “হ্যাঁ।”

ঐশানী তার দিকে তাকিয়ে বলে,
“তাহলে গান শুন।
গান শুনলে তুই নাম হবি না,
তুই গান হবি।”

আকাশে তখন একটানা মেঘ ভেসে যাচ্ছে।

আর কোথাও বাঁশির শব্দ বাজছে।

শেষ

1000025212.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *