শুভ্রনীল দে
১
নতুন শহরের এক কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা পুরোনো দোতলা বাড়িটা প্রথম থেকেই ইরার ভালো লাগেনি। বাইরে থেকে একরকম, ভেতরে ঢুকলেই মনে হয়, সময় যেন এখানে আটকে গেছে— দেওয়ালের ছোপ ধরা রঙ, কাঠের সিঁড়ির আর্তনাদ, আর অলিন্দে সারাদিনই একটা চাপা ছায়া। ইরার মা স্মিতা এক বড়ো কোম্পানিতে কাজ করে, রাতে দেরি হয় প্রায়শই, ফলে স্কুল থেকে ফিরে ইরাকে বেশিরভাগ সময় একাই কাটাতে হয়। প্রথম কয়েকদিন তেমন কিছু মনে হয়নি— নতুন স্কুল, নতুন পাড়া, নিজের ছোট একটা ঘর— সবকিছু মিলিয়ে একরকম উত্তেজনা ছিল। কিন্তু ঠিক সপ্তম দিন রাতে শুরু হয় প্রথম অস্বস্তি। রাতে ঘুম ভেঙে যায়, পাশে টেবিল ঘড়ির কাঁটায় সময়— ২টা ১৫। জানালার বাইরে অন্ধকারে ঝিমিয়ে পড়া পাড়া নিস্তব্ধ, কিন্তু বাড়ির ভেতর থেকেই ভেসে আসে শব্দ— ধীরে ধীরে অলিন্দে কেউ পায়চারি করছে। কাঠের মেঝেতে চাপা চাপা শব্দ— যেন কারও পুরোনো স্যান্ডেলের গা-সওয়া হাঁটা। ইরা থমকে শোনে, বুক ধকধক করে ওঠে, কেউ নেই আশেপাশে। দরজা খোলার সাহস হয় না তার, শুধু শুয়ে শুয়ে শুনতে থাকে, শব্দটা থেমে যায় এক মিনিটের মাথায়। ভেবেছিল স্বপ্ন, কিন্তু পরদিনও ঠিক একই সময়ে, একই শব্দ— এমনকি আতরের এক অদ্ভুত গন্ধও ভেসে আসে হাওয়ার সঙ্গে, যেটা সে আগেও কোথাও পেয়েছিল, কিন্তু মনে করতে পারে না ঠিক কোথায়।
দিন কাটতে থাকে, আর ইরার ভয় বাড়ে। দিনের বেলায় সে যত স্বাভাবিক থাকে, রাতে যেন তাকে চেপে ধরে কেউ— অলিন্দ যেন ডাকতে থাকে তাকে, সময় মিলিয়ে ঠিক ২টা ১৫-তেই ঘুম ভেঙে যায় প্রতিদিন। সে কয়েকবার মোবাইলের রেকর্ডার চালিয়ে রাখে, কিন্তু সকালে শুনে দেখে, কিছুই রেকর্ড হয়নি— নিঃশব্দ। সে মা স্মিতার সঙ্গে কথায় কথায় একদিন বলেও ফেলে, “মা, আমাদের বাড়ির অলিন্দে কেউ ঘোরে রাতে?” স্মিতা থমকে যায় মুহূর্তের জন্য, তারপর হেসে উড়িয়ে দেয়, “এই পুরোনো বাড়িগুলোর কাঠের গঠনই এমন, নড়লেই শব্দ করে।” কিন্তু ইরার মনে হয়, মা কিছু লুকোচ্ছে। সে দেখে, রাত ২টার সময় তার ঘড়ির কাঁটা প্রায়শই বন্ধ হয়ে যায় ঠিক ২টা ১৫-তে, আবার চলতে শুরু করে এক মিনিট পর। সে অলিন্দের দিকের জানালাটা খুলে একদিন দাঁড়িয়ে পড়ে, বাইরে কেবল অন্ধকার— কিন্তু জানালার কাচে ধরা পড়ে তার প্রতিচ্ছবি। ভয়ের কথা, সেই প্রতিচ্ছবির মুখাবয়ব তার নিজের নয়— যেন একই চেহারার, কিন্তু বড়ো বয়সী কারো মুখ। সে দ্রুত ঘরের আলো জ্বেলে দেয়, জানালাটা বন্ধ করে দেয় সজোরে। এরপর রাত কাটে আতঙ্কে, কান পাতলেই মনে হয়, কেউ ফিসফিস করছে ঠিক দরজার বাইরে। আতরের সেই গন্ধ— পুরোনো, কিছুটা ঝাঁঝালো, কিছুটা মিষ্টি— যেন দুঃসহ স্মৃতির মতন ফিরে ফিরে আসে, ইরার মনে হয়, সে আগে কোথাও এই গন্ধের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল।
তিন দিন পর, শনিবার, মা বাসায় ছিল দুপুরে। ইরা তাকে আবার সরাসরি প্রশ্ন করে— “মা, আমি আমার ছোটবেলার কিছু মনে করতে পারি না ঠিকঠাক। দাদুর বাড়িতে কবে গেছিলাম শেষবার?” স্মিতা থেমে যায়, তারপর বলে, “তোমার তিন বছর বয়সে একবার অনেকদিন ছিলে ওখানে, আমার অফিস ট্রেনিং ছিল।” কিন্তু ইরার মন তাতে সন্তুষ্ট হয় না। তার মাথায় গেঁথে থাকে অলিন্দের সেই পায়ের শব্দ, আতরের গন্ধ, আর জানালার কাচে দেখা সেই অপরিচিত অথচ চেনা মুখ। সে খোঁজ নেয় বাড়ির স্টোররুমে রাখা পুরোনো বাক্সঘাটের, একটা ছোট লাল জামা খুঁজে পায়— যেটার গায়ে আজও লেগে আছে সেই আতরের গন্ধ। আর তার পেছনে ছোট্ট হাতে লেখা একটা নাম— “ইরা, ২০১৪”। তার বয়স তখন তিন, কিন্তু সেই জামার গন্ধ আর অলিন্দের আওয়াজ যেন একসাথে বাঁধা। ইরার মনে হতে থাকে, তার স্মৃতি শুধু ভুল নয়— বরং কিছু লুকোনো, চাপা পড়ে থাকা ঘটনার নিঃশব্দ ইঙ্গিত। সেই রাতে আবার সে শোয়, কিন্তু এবার ঠিক ২:১৫-তে উঠে অলিন্দে যায়। বাতি নিভে গেলে, অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থেকে শোনে সেই পায়চারি, আর জানালায় দেখা যায়— একটা ছায়া। তার নিজের মত, আবার একেবারেই না। হঠাৎ হাওয়ার একটা ঝাপটা আসে— আতরের গন্ধে ভরে যায় চারদিক, আর ইরা বুঝতে পারে— সে যা দেখছে, তা অতীত নয়… ভবিষ্যৎ।
২
পরের দিন থেকেই ইরার মনে হতে লাগল, সে যেন ঘোরের মধ্যে আছে। স্কুলে শিক্ষক যখন অংকের সূত্র বোঝাচ্ছিলেন, ইরা তাকিয়ে ছিল জানালার বাইরে, সেখানে নীল আকাশে কোনো ছায়া চলাফেরা করছিল কিনা বোঝার চেষ্টা করছিল। স্কুল শেষে বাড়ি ফেরার পরও তার মনের ভেতর অলিন্দের সেই আওয়াজ গুঞ্জন করছিল। কিন্তু সেদিন একটা নতুন ব্যাপার ঘটল— দুপুরে মা বাসায় থাকায় ইরা নিজের ঘরে বসে হোমওয়ার্ক করছিল। হঠাৎ করেই বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল সেই গন্ধ— পুরোনো আতরের, যা সে এর আগে কেবল রাতে অনুভব করত। ঘরের দরজা খোলা, বাইরে থেকে কোনো হাওয়া আসছে না, আর মা রান্নাঘরে। সে চেয়ার থেকে উঠে এসে খুঁজে খুঁজে বারান্দা, অলিন্দ, বাথরুম— কোথাও কিছু নেই। কিন্তু গন্ধটা স্পষ্ট, একরকম পুরনো গোলাপ ও চন্দনের মিশ্র ঘ্রাণ— যেমন পুরোনো ডায়েরির ভাঁজে থাকা ফুল শুকিয়ে গেলে গন্ধ ছড়ায়। ইরা ফিরে আসে তার ঘরে, কিন্তু ঠিক তখনই দরজার কোণায়, দেয়ালের ছায়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা এক অস্পষ্ট অবয়ব দেখতে পায়। উচ্চতায় তার মায়ের চেয়ে লম্বা, গায়ে ঢিলেঢালা এক ধরণের শাড়ি, মাথার দিকটা ঝুঁকে আছে সামনের দিকে। ইরা চোখ বড় বড় করে তাকায়, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই ছায়াটা মিলিয়ে যায়।
সেদিন রাতে ইরা আর ঘুমোতে পারল না ঠিকঠাক। মা খেয়াল করেছিল ইরার অস্থিরতা, জিজ্ঞেসও করেছিল, “কিছু হয়েছে?” কিন্তু ইরা শুধু বলেছিল, “আজ একটা গন্ধ ছিল ঘরে। আগের মত। অনেক পুরোনো লাগছিল।” মা কিছু না বলে মাথায় হাত রেখে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু রাত ২:১৫ বাজতেই, আবার সেই শব্দ— ধাপে ধাপে এগিয়ে আসা পায়ের শব্দ। ইরা এবার উঠে দাঁড়াল। ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এলেও সাহস করল দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াতে। শব্দটা থেমে গেল হঠাৎই। সে ধীরে ধীরে দরজার ছিটকিনি খুলে অলিন্দের দিকে তাকাল। শূন্য। কিন্তু আতরের গন্ধ এবার এতটাই তীব্র, মনে হল কেউ একটানা তার ঘাড়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। জানালার দিকে তাকাতেই সে আবার দেখে নিজের প্রতিচ্ছবি— তবে এবার যেন চোখে একরকম অতল গভীর দৃষ্টি, একেবারেই অচেনা। সে জানে, ওটা সে নয়। কিংবা হয়তো সে— এমন এক ‘সে’, যাকে এখনো সে চেনে না। ইরা জানে না, কেন, কিন্তু তার গলার নিচে ঠাণ্ডা ঘাম জমতে থাকে, পা যেন হিম হয়ে আসে। গন্ধটা একসময় মিলিয়ে যায় ধীরে ধীরে, কিন্তু ঘড়ির কাঁটা ২:১৬-তে পৌঁছানোর আগেই ইরা জানালাটা বন্ধ করে শুয়ে পড়ে আবার। বুকের ভেতর এক অজানা আশঙ্কা পাক খেতে থাকে।
পরদিন সকালে, মা যখন কাজে বেরিয়ে যায়, ইরা চলে যায় মিশু কাকুর কাছে। পাশের বাড়ির এই মধ্যবয়সী মানুষটি তার একমাত্র নির্ভরযোগ্য আশ্রয়— মা তাকে বড় একটা কিছু বলেন না, কিন্তু মিশু কাকু সব কথা মন দিয়ে শোনেন। ইরা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, “কাকু, আমাদের অলিন্দে রাত ২:১৫-তে কেউ হাঁটে। আমি শব্দ পাই। আর একধরনের আতরের গন্ধ আসে।” মিশু কাকু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর খুব ধীরে বলেন, “তোমার মা কি বলেছে কিছু?” ইরা মাথা নেড়ে জানায়, “না। উনি বলেন, পুরোনো কাঠের বাড়ি, শব্দ হয়। কিন্তু কাকু, আমি জানি… এটা শুধু শব্দ না। কিছু একটা আছে।” মিশু কাকু উঠে গিয়ে নিজের একটা পুরোনো চাবির গুচ্ছ এনে দেয়, আর বলেন, “এই বাড়ির দোতলায় একটা বন্ধ ঘর ছিল, যেটা একসময় আমি দেখেছিলাম। সেখানে একটা মহিলা থাকতেন অনেক বছর আগে। তার চলাফেরা ছিল একটু অদ্ভুত। তিনি সারারাত পায়চারি করতেন আর গায়ে থাকত একধরনের বিশেষ আতর— গোলাপ ও চন্দনের মিশ্রণ। তারপর হঠাৎ একদিন নিখোঁজ হয়ে যান। কেউ আর খোঁজ পায়নি।” ইরার গলা শুকিয়ে আসে। সে বুঝতে পারে, এই আতরের গন্ধ, এই সময়টা, এই পায়ের শব্দ— সব কিছুই হয়তো একটা সত্যের ইঙ্গিত, যা বহু বছর আগের, কিন্তু এখনও বেঁচে আছে অলিন্দের প্রতিটা ধাপে। এখন তার বুঝতে হবে— সেই আত্মা যদি ফিরে আসে বারবার, তবে সে কী চায়? আর তার নিজের ভবিষ্যত— সেই পেছনের ছায়ার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে কিনা।
৩
ইরা সেই রাতে আর ঘুমাতে পারেনি। ঘুমাতে গেলেই যেন মনে হত কেউ তার পাশে নিঃশব্দে বসে আছে। আতরের সেই চেনা অথচ অজানা গন্ধ যেন বালিশের নিচে, চাদরের ভাঁজে লুকিয়ে আছে। ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়লেও, সকাল হতেই সে উঠে পড়ে। আজ রোববার— মা ঘরে, কাজে যাবে না। ইরা সিদ্ধান্ত নেয়, সে এবার নিজেই খুঁজবে নিজের স্মৃতির ভেতরে। ছোটবেলার কিছুই তার মনে পড়ে না স্পষ্টভাবে— তিন বছরের আগের জীবন যেন এক কুয়াশার মধ্যে ঢাকা। অথচ মানুষ তো অন্তত কিছু ছবি মনে রাখতে পারে— সে পারে না। না কোনো বাড়ি, না কোনো খেলনা, না কোনো বিশেষ মুখ। মায়ের বলা মতে, সে তিন বছর বয়সে কয়েকমাসের জন্য নানাবাড়িতে ছিল, কিন্তু ইরা সেই সময়ের কিছুই মনে করতে পারে না। এটা কি স্বাভাবিক? নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে তার মনের স্মৃতির দরজা কেউ বন্ধ করে দিয়েছে? ইরা উঠে পড়ে স্টোররুমে। ধুলোমাখা পুরোনো বাক্স, কাপড়ের ভাঁজ, পুরনো খাতাপত্র— সব এলোমেলো। কিন্তু এক কোণায় সে দেখতে পায় একটা ছোট রঙচঙে বাক্স, যার ওপর আঁকা এক শিশুর নাম— “ইরা ২০১৪”। হাতের লেখা নরম, গোলগাল। বাক্সটা খুলতেই সে পায় একটুকরো লাল জামা, একজোড়া ছোট জুতো, একটা ছেঁড়া পুতুল যার গায়ে এখনও সেই আতরের গন্ধ।
কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যজনক জিনিসটা ছিল একটি ছোট ডায়েরি। তাতে ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু লাইন লেখা— কার লেখা ঠিক বোঝা যায় না, কিছুটা তাড়াহুড়ো করে লেখা, কিছুটা অদ্ভুত শব্দে ভরা। একটি পাতায় লেখা ছিল, “ইরা আজ আবার জানালায় তাকিয়ে ছিল… সে কি মনে করতে পেরেছে?” আরেক পৃষ্ঠায়— “ঘড়ি বন্ধ হয়ে যায় যখন ছায়া নামে অলিন্দে, তখন কিছু হারিয়ে যায়। আবার ফিরে আসার আগে, ঘুম ভাঙে।” ইরার বুক ধকধক করে ওঠে। এ ডায়েরি কাদের লেখা? কেন এখানে এইভাবে লুকিয়ে রাখা হয়েছে? সে ডায়েরির এক কোণে ঠোঁটের চিহ্নের মত লিপস্টিকের ছোঁয়া দেখতে পায়, তার পাশেই আতরের হালকা দাগ। সমস্ত অনুভূতি একসঙ্গে তাকে গ্রাস করে— ভয়, কৌতূহল, হঠাৎ মনে পড়া ঝাপসা ছবি— যেন এক নারীর কণ্ঠ বলছে, “ইরা, জানালার দিকে তাকিও না…” কিন্তু সেই কণ্ঠ মায়ের নয়। এই কণ্ঠ, এই আতর, এই ছায়া— কেউ যেন ধীরে ধীরে ইরার ভেতরে ফিরে আসছে, তার জায়গা করে নিচ্ছে।
দুপুরে ইরা ডায়েরিটা নিয়ে যায় মিশু কাকুর কাছে। তিনিও চমকে ওঠেন লেখা দেখে। “এই হাতের লেখা অনেকটা তোমার মাসির মত,” বলেন তিনি নিচু গলায়। ইরা থমকে যায়— “আমার মাসি? কিন্তু মা তো বলে উনার সাথে তেমন যোগাযোগ নেই।” মিশু কাকু মাথা নিচু করে বলেন, “তোমার মা ও মাসি ছিলেন জমজ। কিন্তু হঠাৎ করে একদিন… তোমার মাসি নিখোঁজ হয়ে যায়। তখন তোমার বয়স মাত্র তিন। বাড়ির কেউ কিছু বলেনি তোমাকে, মা তোমাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন নানাবাড়িতে।” ইরা বুঝে যায়, তার ছেলেবেলার স্মৃতি একা হারিয়ে যায়নি— তাকে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই হারিয়ে যাওয়া অংশটাই আজ ফিরে আসছে অলিন্দের ধাপে ধাপে পায়ের শব্দে, আতরের গন্ধে, জানালায় তারই অপরিচিত প্রতিচ্ছবিতে। সে এখন জানে, অলিন্দে যে ঘোরে, সে শুধু অতীত নয়— সে স্মৃতির বাইরে থাকা এক অপরিণত ভবিষ্যৎ, হয়তো একটা সতর্কবার্তা। আর সেই বার্তা সে নিজে না বুঝলে— সময় আটকে যাবে ঠিক রাত ২:১৫-তেই।
৪
মিশু কাকুর মুখ যেন থমথমে হয়ে উঠল ইরার প্রশ্নে। বাইরের আলো ছায়ার মতো পড়ছিল তার মুখে— যেন কোনও পুরোনো ভয় আবার জেগে উঠেছে। “তুমি বলছ… আতরের গন্ধ? ঠিক রাত ২:১৫-তে আওয়াজ হয়?” মিশু কাকু একটু চুপ করে থেকে মাথা নাড়লেন। “হ্যাঁ, আমি জানতাম এ কথা একদিন না একদিন উঠবেই। অনেক বছর আগে… এই বাড়ির এক কোণে, ঠিক যেই ঘরটা এখন তালা দেওয়া, সেখানে থাকতেন এক মহিলা। তার নাম ছিল ঊর্মিলা। অনেকটা তোমার মায়ের মতন দেখতে, একই মুখ, কিন্তু মনটা ছিল… একটু আলাদা। কেউ কেউ বলত, সে রাতে ঘুমাত না— সারা রাত পায়চারি করত অলিন্দে। কেউ বলত, তার চোখে এমন কিছু ছিল, যেটা সাধারণ চোখে ধরা পড়ত না। আর তার গায়ে সবসময় থাকত একধরনের আতরের গন্ধ— গোলাপ আর চন্দনের এক বিরল মিশ্রণ। এমন গন্ধ অন্য কোথাও পাওয়া যেত না।” ইরার বুক কাঁপতে লাগল। মিশু কাকু বললেন, “আমি তখন এখানে ভাড়াটে ছিলাম, ওনার ঘর ছিল পশ্চিম দিকের বারান্দার পাশে। মাঝরাতের পরে জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতেন, কারও সঙ্গে কথা বলতেন— যদিও সামনে কেউ থাকত না।”
“একদিন হঠাৎ করে… উনি হারিয়ে গেলেন,” মিশু কাকুর কণ্ঠ যেন ধীরে ধীরে ফিসফিসে হয়ে এল। “সকালে উঠে দেখি, দরজা খোলা, ঘরে কেউ নেই। কিন্তু মেঝেতে ছড়িয়ে ছিল সেই আতরের ভাঙা কাচের শিশি। পুলিশ এসেছিল, কিন্তু কিছুই খুঁজে পায়নি। তোমার মা তখন খুব খারাপ অবস্থায় ছিল মানসিকভাবে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে শুধু বলত— ‘ঊর্মি তো আছে… সে তো গেছে কোথাও না!’ তারপর হঠাৎ একদিন তোমাকে পাঠিয়ে দিল নানাবাড়ি, আর কয়েকমাস নিজে নিখোঁজ হয়ে গেলেন। ফিরে এলে অন্য মানুষ— শান্ত, চুপচাপ, আর এই বিষয়টা যেন কোথাও নেই। আমি তখনই বুঝে গেছিলাম, কিছু একটা ঘটেছিল সেই রাতে, যেটা কেউ স্বীকার করতে চাইছে না।” ইরার গলা শুকিয়ে গেল, সে ফিসফিস করে বলে, “আপনি কি কখনও শুনেছেন… ওনার আওয়াজ?” মিশু কাকু বললেন, “শুনেছি। এখনও মাঝেমাঝি, রাত ঠিক ২:১৫-তে অলিন্দে পা ফেলার সেই পরিচিত টিপটিপ আওয়াজ। প্রথমে ভাবতাম কল্পনা, কিন্তু পরে বুঝলাম, কিছু কিছু আওয়াজ মন ভুলে যায় না— যেমন গন্ধ। আতরের সেই গন্ধ মাঝে মাঝে এখনো ভেসে আসে আমার জানালার ফাঁক দিয়ে। আমি জানি, কেউ ফিরে আসতে চায়।”
ইরার মনে হচ্ছিল, সে যেন এক ছায়াময় দুনিয়ায় ঢুকে পড়ছে— যেখানে সময়, স্মৃতি আর বাস্তব সব গুলিয়ে যাচ্ছে। বাড়ি ফিরে সে সোজা চলে গেল সেই তালাবদ্ধ ঘরের দিকে— যেটা মিশু কাকু বলেছিলেন ঊর্মিলার ছিল। দরজার নিচে মাথা ঠেকিয়ে সে শুনল— নিস্তব্ধতা। কিন্তু ঘরের গন্ধে এখনও আতরের এক পরত যেন লেগে ছিল। সে মাকে কিছু বলতে পারল না, শুধু চোখে চোখ পড়তেই অনুভব করল, মা সব জানে। কিন্তু মুখে কিছু বলবেন না। রাতে ঘুমোতে গেলে আবার আতরের গন্ধ, আবার সেই পায়ের আওয়াজ। এবার ইরা জানে, ওই ছায়া, ওই গন্ধ… কেবল অতীত নয়। সেটি তার নিজের ভেতরে লুকিয়ে থাকা এক অচেনা ভবিষ্যৎ, যার ছায়া ধীরে ধীরে পেছনের অলিন্দ দিয়ে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। সে একা নয়— কেউ বা কিছু তাকে নিজের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে চাইছে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা— আর সময় তো থেমে যায় ঠিক ২:১৫-তেই।
৫
ইরা জানত, সময় গড়ায় সামনে— কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে তার জীবন যেন সময়কে ঘিরেই আটকে পড়েছে। প্রতিদিনের ঠিক একই মুহূর্ত— রাত ২:১৫— যেন তার ভেতরেই একটা প্যাঁচ তৈরি করে চলেছে, একই শব্দ, একই আতরের গন্ধ, আর একই ভয়। কিন্তু এবার একটা নতুন ঘটনা ঘটল, যা তাকে হতবাক করে দিল। একদিন সকালে উঠে ইরা দেখে, তার টেবিল ঘড়ি বন্ধ হয়ে গেছে— ঠিক ২:১৫-তে। প্রথমে ভেবেছিল ব্যাটারি ফুরিয়েছে, কিন্তু পরখ করে দেখে, ঘড়ির ব্যাটারি ঠিকই আছে, শুধু কাঁটা দুটো আর চলছে না। সে ঘড়িটা খুলে রেখে দেয় ড্রয়ারে। কিন্তু পরদিন রাতে ঘুম থেকে উঠে দেখে, ঘড়িটা ড্রয়ারের বাইরে পড়ে আছে— আর কাঁটাগুলো আবার ২:১৫-তেই থেমে আছে। এবার সে নিজের মোবাইলে অ্যালার্ম দেয় ঠিক ২:১০-এ, ভাবল, শব্দ হবার আগেই সে চোখ মেলে দেখবে কী হয়। কিন্তু মোবাইলের স্ক্রিন হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়, বাটন টিপেও আলো আসে না। বাতাসে আতরের গন্ধ ছড়াতে শুরু করে তখনই, আর অলিন্দ থেকে শোনা যায় সেই চেনা পায়ের আওয়াজ। যেন কারও অস্তিত্ব সময়কে নিজের মতো চালিয়ে নিচ্ছে— যেন সময়, ঘড়ির কাঁটা, সব কিছু কারও নির্দেশে আটকে যাচ্ছে।
ইরা এবার ভয় পায় না, বরং সিদ্ধান্ত নেয়— যদি কিছু থেকে পালানো না যায়, তবে তার মুখোমুখি হতে হবে। সে অলিন্দের দিকে পা বাড়ায়, হাতে ছোট একটা টর্চ। আলো ফেলতেই মেঝেতে দেখা যায় কয়েকটি অস্পষ্ট পায়ের ছাপ— ছোট ছোট পায়ের ছাপ, যা বারান্দা থেকে এসে থেমে গেছে জানালার সামনে। কিন্তু জানালার কাচে এবার আর প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে না— বরং সেখানে এক অন্য রকম ছায়া, যেটা একসময় তার মতো দেখতে হলেও এখন আর নয়। ছায়ার চোখগুলো যেন তাকে দেখতে পাচ্ছে। ইরা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সময় যেন চারপাশে স্তব্ধ হয়ে গেছে। বাতাস থেমে গেছে, শব্দ নেই, শুধু ঘরের ভেতর সেই আতরের গন্ধ। হঠাৎ ছায়াটা কাচের ওপারে হাত তোলে— তার আঙুলে একটা লাল সুতো বাঁধা। ইরার মনে পড়ে যায়, ছোটবেলায় সে একবার আঙুলে লাল সুতো পরে ঘুরে বেড়াত— কেউ বলেছিল, “এই সুতো বাঁধলে হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি ফিরে আসে।” কিন্তু সেই কথাটা বলেছিল কে? তার মা? নাকি… ঊর্মিলা মাসি? স্মৃতিগুলো যেন হঠাৎ খোঁড়াখুঁড়ির মতো উঠে আসতে থাকে। সে মনে করতে পারে, তিন বছর বয়সে এক মহিলা তাকে কোলে করে জানালার সামনে দাঁড় করিয়ে বলেছিল, “এই জানালা দিয়ে একদিন তুই নিজেকেই দেখবি।”
এই মুহূর্তে ইরার মনে হয়, হয়তো সেই কথাই আজ সত্যি হতে চলেছে। সময় যেহেতু ধরা পড়ে গেছে, এবার সেই সময়ের ভেতর ঢুকে পড়া ছাড়া তার উপায় নেই। সে ঘরে ফিরে নিজের খাতার এক কোনায় লিখে রাখে— “আমি যখন হারিয়ে যাব, তখন খুঁজে নিও সময়ের কাঁটার ফাঁকে। আমি এখানে ছিলাম।” এরপর সে ঠিক করে, পরদিন রাতে ২:১৫-তে আবার জানালার সামনে দাঁড়াবে, তবে এবার সে কেবল দর্শক হয়ে থাকবে না। সে দেখতে চায়, ছায়াটা কী করে, কথা বলে কি না, কিংবা তার মতো দেখতে সেই ভবিষ্যতের ‘ইরা’ আদৌ কি তারই আত্মা হয়ে গেছে। সময় একটা ফাঁদ— ইরা জানে, সে এখন তাতে আটকে গেছে, কিন্তু সে হারাতে চায় না নিজেকে। যদি সত্যিই কিছু আসছে ভবিষ্যত থেকে, তাহলে সেই ‘কিছু’ তাকে ডাকছে। আর যারা ডাকে… তারা ফিরে আসে।
৬
ইরা পরের রাতে আবার ২:১৫-এ উঠে এসে দাঁড়িয়ে ছিল জানালার সামনে। বদ্ধ অন্ধকারে, বাতাসে আতরের সেই মিষ্টি কিন্তু ভারী গন্ধে চারপাশ যেন ভারী হয়ে উঠেছিল। তার সারা শরীরে এক অদ্ভুত শীতলতা ছড়িয়ে পড়ছিল, যেন কিছু মুহূর্তের জন্য সে সময়ের সীমানা ছাড়িয়ে গেছে। এবার সে জানত, অলিন্দে যে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে, সেই ছায়া তারই ভবিষ্যত— এবং সেই ভবিষ্যত কেবলই তার প্রতিচ্ছবি নয়, বরং তা যেন এক সংকেত, এক প্রলয়। ইরা মনে মনে একে একে সেই শব্দগুলো পুনরাবৃত্তি করছিল— “আমি ফিরে আসব… আমি ফিরে আসব…” কিন্তু এর মানে কী? কে ফিরে আসবে? সে, নাকি… সে যে আর নেই?
ঠিক তখনই, জানালার কাচে একটা গা dark ় ছায়া দেখতে পেল। প্রথমে খুব হালকা, তারপর ধীরে ধীরে তা স্পষ্ট হতে থাকে। ইরা নিজের অজান্তেই কাছে চলে গেল, হাত টেনে জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে একপাল রাতের অন্ধকারে ঢুকে গেল। জানালার কাচে বাকা রেখায় দাঁড়িয়ে ছিল এক নারীর অবয়ব— তার মাথার ওপর সুরক্ষিত এক কাচের বটলার, যেটার ভিতরে সুরভিত আতরের গন্ধ মাখানো ছিল। সারা শরীরের প্রতিটি তন্তু দিয়ে সে অনুভব করল, এই চেহারা তাকে কোথাও একবার দেখে থাকতে পারে। অদ্ভুত, কেন সে এমন অনুভব করছে? মনে হয় যেন তাকে কখনো দূর থেকে কেউ দেখেছিল, আবার সে কাউকে জানে, জানে না এমন অনুভূতি— হঠাৎ জানালার কাচে কোনও রকমে একটি লেখা উঁকি দেয়, আবার দ্রুত মুছে যায়।
“আমি ফিরে আসব…”
অতীত আর ভবিষ্যতের সীমানা একে একে ভেঙে পড়ে ইরার মনে। তার চোখের সামনে পুরো অন্ধকার ঘরটা যেন এক টুকরো স্মৃতির মতো টুকরো টুকরো হয়ে এল। সে বুঝতে পারে, সে অনেক কিছু ভুলে গেছে— না, ভুলেনি। কিছু স্মৃতি তাকে ইচ্ছাকৃতভাবে মুছে দেওয়া হয়েছে, যেন সে কখনো জানতে না পারে। তার চিন্তা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, শরীরে শীতল এক শিহরণ বয়ে যায়। সে জানালার দিকে একটানা তাকিয়ে থাকে, কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হয়— এক অজানা আকর্ষণে সে যেন নিজের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পায়। তবে সে শুধু অতীতের চিহ্ন নয়, সেই আঙ্গুলের ছাপও ছিল কাচের গায়ে— আর সেই ছাপটাই এবার তার মনকে অন্ধকারে ঝলমলে করে তোলে।
মা তখন ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে দেখে ইরা চমকে ওঠে। তার মা, সেই শান্ত, ঘন অন্ধকারের মতো, চুপচাপ জানালার দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু কী যেন গভীর দৃষ্টিতে মাকে দেখে ইরা অনুভব করে, মা কিছু জানে— বা সে সব জানে। এতদিন মা তাকে কিছু বলেননি, সে জানত— কিছু তাজা স্মৃতির ঝলক মা হয়তো বেমালুম মুছে ফেলেছেন, কিন্তু আজ, আজ ইরা দেখল, মা যেন আসলে সব জানে। “মা,” বলল ইরা খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে, “এই ঘরে… একটা লেখা ছিল। ‘আমি ফিরে আসব।’ আপনি কিছু জানেন?” মা একটুও না বলে জানালার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তারপর তিনি এক ঢোক লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে খুব আস্তে বলে, “তুমি জানো, ইরা… আমরা অনেক কিছুই জানি না। সবকিছু স্মৃতির ভিতর রাখা হয় না। কখনো কিছু জানলেই মনে হয়… সেই স্মৃতি এক সময় চলে যায়। তেমনি, কিছু কিছু স্মৃতি একসময় অতীতে হারিয়ে যায়… যেন না থাকলেই ভালো।”
তাদের কথাবার্তা থেমে যায়। ইরা তার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে— চোখের কোণে মুছে যাওয়া স্মৃতির আঁচড় দেখতে পায়। কিন্তু এখন সে বুঝতে পারছে, তার শৈশবের যে অতীত ছিল, সেটি শুধু হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি নয়— বরং গোপন চক্রান্তের অংশ, যেটা মাকে মুখ খুলতে দেয়নি। ইরার মনে পড়ল, মায়ের মুখে কোনও এক সময়, ছোটবেলায়, এক অদ্ভুত ভয়ার্ততা ছিল। আজকাল মায়ের চোখে সেই অন্ধকার ভয়ার্ততা পুরোপুরি স্বচ্ছ হয়ে উঠেছিল।
ইরা ডায়েরি খুলে আরেকবার খুঁজতে শুরু করে, কোথায় সেই অদৃশ্য লেখা— “আমি ফিরে আসব।” তার চোখে কাঁপুনি ধরল, যখন সে দেখল, আবার ডায়েরির এক পাতায় তেমনই লেখা ছিল। তবে এবার লেখা সোজাসুজি তার দিকে, এক গা dark ় সিলুয়েটের মতো। “আমি ফিরে আসব— কিন্তু এইবার তুমি জানবে না, কেন। কেন তুমি এখন অলিন্দের আওয়াজ শুনবে। কারণ সময় সত্যিই থেমে যায়, এবং তা শুধু আমাদের জন্য নয়।”
ইরা চমকে ওঠে, তবুও সে বুঝে যায়— যা সে অনুভব করছে, সেটি শুধু অতীত নয়, তারই এক ভয়ঙ্কর ভবিষ্যৎ। তার সামনে এখন শুধু একটি পথ— সেই পথ যা তাকে সময়ের আর এক অচেনা দিকের দিকে নিয়ে যাবে।
৭
রাত এবার যেন অদ্ভুত শান্ত। এমন শান্ত, যেন প্রকৃতি নিজেই নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে— কোনও বড়ো ঘটনার পূর্বাভাসে। ইরা জানত, এই রাতটা আর পাঁচটা রাতের মতো নয়। আজ আর শুধু আতরের গন্ধ বা অলিন্দের শব্দে সে ভয় পায় না— বরং আজ সে জানে, তাকে এক সত্যের মুখোমুখি হতে হবে। একটানা সাত রাত ধরে ঠিক ২:১৫-তে ঘড়ির কাঁটা থেমেছে, আতরের গন্ধে ভরেছে ঘর, আর অলিন্দে ছায়ারা হেঁটেছে চুপচাপ। আজ, সেই অষ্টম রাতে, ইরা মায়ের চোখে কিছু অস্বাভাবিক দেখল— একটা ভয়, যেটা দীর্ঘদিন চেপে রাখা। মা আর চোখের দিকে তাকাতে পারছেন না, শুধু বলে গেলেন, “আজ জানালাটা বন্ধ রেখো, ইরা। কিছু দেখবে না। কিছু শুনবে না।” ইরার ঠোঁটে সামান্য হাসি ফুটল— এই প্রথম সে বুঝতে পারল, মা এতদিন তাকেই রক্ষা করছিল। কিন্তু আর রক্ষা করার সময় নেই। আজ সে জানবে— কে ছিল ঊর্মিলা, কেন সে হারিয়ে গেল, এবং সেই ছায়া তারই প্রতিচ্ছবি হলে— কেন সে ফিরে আসছে।
রাত ২:১৪ বাজতেই ইরা উঠে দাঁড়াল, ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে অলিন্দে এল। বাতাস নিঃশব্দ, জানালার কাচ জ্যোৎস্নায় রূপালি। হঠাৎ একটা মৃদু ঝাপটা— আতরের গন্ধ আছড়ে পড়ল চারপাশে। সে এবার জানালায় চোখ রাখে না, কারণ সে জানে, ছায়ারা জানালায় নিজেকে দেখায় না, তারা পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে। সে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ায়— আর ঠিক তখনই দেখে, অলিন্দের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে একজন। অবয়বটা অস্পষ্ট, কিন্তু চুল, মুখের গঠন— অনেকটাই তার মতো। কিন্তু চোখ দুটি কুয়াশার মতো। ছায়া বলল না কিছু, শুধু এগিয়ে এল এক পা, তারপর আরেক পা। ইরার মনে হচ্ছিল তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, অথচ সে নড়ছে না। হঠাৎ সে বুঝতে পারে, ছায়াটার কণ্ঠ তার নিজের কণ্ঠস্বরেই বলে উঠল, “তুই ভুলে গেছিস, ইরা। আমায় ভুলে গেছিস। তুই আমিই… অথবা আমি তুই।” ইরা ঘাড় নাড়ল ধীরে। “তুই কে?” ছায়া এবার সরাসরি সামনে দাঁড়ায়। আলো ফেলে, আর দেখা যায়, ছায়াটা তার মতোই— শুধু মুখে একটা পুরোনো ক্ষত। আর তার আঙুলে বাঁধা সেই লাল সুতো, যেটা ছোটবেলায় হারিয়ে গিয়েছিল। ছায়া বলল, “তুই যখন জানালার দিকে তাকাতে ভয় পেতিস, আমি তখন সেখানেই ছিলাম। তোর ভুলে যাওয়া আমিই এখন ফিরেছি— কারণ তুই পালিয়ে গেছিলি। স্মৃতির গর্তে। মা তোর ভুলে যেতে বলেছিল, আর তুই ভুলে গেছিস— আমায়।”
সেই মুহূর্তে সব জট যেন খুলে যেতে থাকে। ইরা বুঝতে পারে, ছোটবেলায় যে ঘটনার রাতে ঊর্মিলা নিখোঁজ হয়েছিলেন, সেটি কেবল একটা অদৃশ্য হারিয়ে যাওয়া নয়— বরং নিজের অস্তিত্ব বাঁচানোর একটা অসমাপ্ত প্রচেষ্টা। ইরা, তিন বছর বয়সে, হয়তো এক ভয়াবহ কিছু প্রত্যক্ষ করেছিল— হয়তো তার মাসির ছায়া, বা তার অচেনা রূপ, হয়তো নিজের মধ্যকার অন্য সত্তা। সেই ভয় এমন প্রবল ছিল যে স্মৃতি নিজেই নিজেকে মুছে দেয়। আর মা— সে সমস্তটা জানার পরেও চুপ করে থাকে, কারণ এই সত্য তার জন্যও সহ্য করা অসম্ভব। ছায়া এগিয়ে এসে ইরার কানে ফিসফিস করে বলে, “তুই আমাকে স্বীকার করলেই আমি হারিয়ে যাব… নয়তো তোর ভেতরেই বেঁচে থাকব চিরকাল।” ইরার চোখ ছলছল করছিল। সে মুখে কোনো শব্দ আনতে পারছিল না। কিন্তু কিছু একটা করতে হবে। নিজেকে বাঁচাতে হলে ছায়াটিকে গ্রহণ করতেই হবে— বা অস্বীকার করতে হবে সত্যকে। সে জানালার কাচে আবার একবার তাকায়— এবার কাচে প্রতিচ্ছবি দুটো, এক তার, এক ছায়ার। কিন্তু তারা আলাদা নয়। এবার দুটো মিলছে— সময়ের ফাঁদ ভাঙতে যাচ্ছে।
এবং ইরা আস্তে করে বলে, “আমি মনে রেখেছি। আমি ভয় পাই না আর। তুই আমিই… আমি তোকেই খুঁজছিলাম।”
৮
“তুই আমিই… আমি তোকেই খুঁজছিলাম।” ইরার এই স্বীকারোক্তির সঙ্গে সঙ্গে চারপাশ যেন হঠাৎ নরম আলোয় ভরে ওঠে। ছায়াটি আর কিছু বলে না, কেবল মাথা ঝুঁকিয়ে চোখ মেলে তাকায়। তার ঠোঁটের কোণে এক আশ্চর্য বিষণ্ণতা, যেন বহু বছর ধরে সে শুধু এই কথাটির অপেক্ষাতেই ছিল। ধীরে ধীরে ছায়াটি পেছনে সরে যায়, মিশে যায় জানালার কাচে— আর আতরের ঘ্রাণ, যা এতদিন ইরার মনে ভয় জাগাতো, এবার যেন এক শান্তি এনে দেয়। সময় থেমে থাকেনি আজ রাতে। ঘড়ির কাঁটা ২:16 পেরিয়ে যায়। ইরা জানে, কিছু একটা ভেঙে গেছে— না, বরং খুলে গেছে। দরজা, জানালা, স্মৃতির বন্ধ বাক্স— সব একে একে খুলে যাচ্ছে। তখনই সে অলিন্দের কোণে, পুরোনো কাঠের তলার নিচে দেখতে পায় কিছু উঁচু হয়ে আছে। ইরা নিচু হয়ে খোঁচা দিয়ে তুলে আনে একটি সাদা খাম। খুব সাধারণ কাগজ, কিন্তু খামের উপরে লেখা, “ইরা – যদি কখনও মনে পড়ে…”
হাত কাঁপতে থাকে তার। খামটা খুলতেই ভেতর থেকে বের হয় একটি চিঠি, রুক্ষ কাগজে লেখা বহু পুরোনো অক্ষরে। লেখাটি শুরু হয়েছে এইভাবে:
“ইরা,
যখন তুমি এই চিঠি পড়ছো, তখন হয়তো তুমি অনেক কিছু মনে করতে শুরু করেছো। আমি ঊর্মিলা। তোমার মাসি। আমি ছিলাম এই বাড়ির ছায়া হয়ে— কারণ কিছু সত্যি কখনও প্রকাশ পায় না আলোয়। আমি জানতাম, তুমি দেখেছিলে সেদিন রাতে। আমি নিজের ভেতরে হেরে গিয়েছিলাম, নিজের মধ্যকার ছায়া আমাকে গিলে ফেলছিল। তোমার চোখের সামনে আমি… আরেক রূপে এসেছিলাম, যেটা আমি নিজেও সহ্য করতে পারিনি। তাই আমি চলে যাই— বাইরে নয়, সময়ের পেছনে। আমি তোমার ভেতরেই লুকিয়ে থাকি। আতরের গন্ধে, অলিন্দের শব্দে, জানালার কাচে আমি বারবার ফিরে আসি। কারণ, আমি জানতাম, একদিন তুমি সাহস পাবে। তুমি আমায় ডেকে নেবে— এবং আমিও ফিরে আসার পথ খুঁজে পাবো। আমি তোমায় ভয় পাইনি, ইরা। তুই আমার আলো ছিলি। আমি শুধু চাই, তুই ভুলে যাস না— সত্যি যদি ভয়াবহ হয়, তবুও তা জানার অধিকার তোর আছে।”
ইরা চিঠির প্রতিটি শব্দে যেন তার মনের গভীরে গিয়ে পৌঁছায়। এই প্রথম তার অতীত, যেটা এতকাল ছায়ায় ঢাকা ছিল, এখন এক একটি স্তরে পরিষ্কার হতে থাকে। সে বুঝতে পারে, ঊর্মিলার হারিয়ে যাওয়া মানে মৃত্যু নয়— বরং সময়ের এক জটিল খাঁচায় আটকে যাওয়া, যেখান থেকে তাকে মুক্ত করতে হতো ইরাকেই। চিঠির শেষ লাইনে লেখা—
“তুই যদি আমায় গ্রহণ করিস, আমি আর আসবো না। যদি ভুলে যাস, আবার ফিরবো। অলিন্দে নয়— তোর মনেই।
ভালোবাসা রইলো,
ঊর্মি মাসি”
চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে ইরার গালে। কিন্তু এবার সেই অশ্রু আর ভয়ের নয়— বরং এক বোঝাপড়ার, এক গভীর সম্পর্কের, যে সম্পর্ক সময়কে পেরিয়ে আত্মায় বাস করে। সে জানে, আজ থেকে প্রতিটি রাত ২:১৫ শুধু একটা সময় নয়, বরং স্মৃতির দরজা। দরজা, যেটা সে চিরদিন খোলা রাখতে চায় না— বরং সম্মানের সঙ্গে বন্ধ করে রাখতে চায়, যাতে আর কোনও ছায়া তার দিকে ফিরে না তাকায়।
৯
পরদিন সকালে ইরা হাতের সেই পুরোনো চিঠিটা নিয়ে সোজা চলে গেল রান্নাঘরে, যেখানে মা নিঃশব্দে চা বানাচ্ছিলেন। জানালার ফাঁকে আলো ঢুকছে, ধোঁয়ায় যেন সময় ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। ইরা চুপচাপ চিঠিটা মায়ের সামনে রেখে বলল, “তুমি কখনও বলোনি… কিন্তু তুমি জানো সব কিছু। এই চিঠিটা তুমি লুকিয়ে রেখেছিলে না?” মা থমকে গেলেন। হাতের কাপ থামিয়ে চিঠিটার দিকে তাকালেন, কিন্তু না ছুঁলেন, না বললেন কিছু। ইরার গলা কাঁপছিল, “মা… তুমি চাও না আমি জানি কেন?” তখন মা ধীরে ধীরে বসে পড়লেন চেয়ারটায়। চোখে সরাসরি না তাকিয়ে শুধু বললেন, “কারণ সব সত্য মানায় না, ইরা। কেউ কেউ বেঁচে থাকে ভুলে থাকার জন্য। আমি চাইনি তুমি সেই ছায়াকে চিনে ফেলো। আমি ভয় পেয়েছিলাম।” তার কণ্ঠে এমন এক কষ্টের ভার ছিল, যা কোনও শব্দে ব্যাখ্যা করা যায় না। “ঊর্মি আমার বোন ছিল ঠিকই,” মা বললেন, “কিন্তু সে আমার অর্ধেকও ছিল— তার ভেতরটা আলাদা। ছোটবেলা থেকেই কিছু ছিল ওর মধ্যে, যেন দুটো সত্তা লড়ছে। একসময়… সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠল।”
ইরা এগিয়ে গিয়ে বলল, “তুমি তাকে ভয় পেতে শুরু করেছিলে?” মা চুপ। তারপর খুব ধীরে মাথা নেড়ে বললেন, “না। আমি নিজেকে ভয় পেতাম। কারণ… আমি বুঝতে শুরু করেছিলাম, আমি আর ও আলাদা হচ্ছি। আমি স্বাভাবিক হতে চাইলাম, সংসার করতে, মা হতে। কিন্তু ঊর্মি পারল না। সে নিজেকে অন্যভাবে দেখতে শুরু করল। আয়নায় সে বলত, ‘আমি আসলে কেউ নই, কিন্তু আমি যদি আরেকজন হতাম…?’ এক রাতে তুমি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলে, তখন ঊর্মি তোমাকে কোলে নিয়ে বলেছিল— ‘তুই আমিই… আমি তুই।’ আমি শুনে চমকে উঠেছিলাম। ওর দিকে তাকাতে পারিনি। তারপর…” মা থেমে গেলেন। “সেই রাতেই ও হারিয়ে গেল।” কথাটা বলে মা চোখ বন্ধ করে ফেললেন।
ইরার মাথার ভেতর ছায়ারা ঘুরে বেড়াতে লাগল— সেই আতরের গন্ধ, সেই জানালার প্রতিচ্ছবি, সেই অন্ধকার অলিন্দ। সে বুঝল, ঊর্মিলার হারিয়ে যাওয়া কেবল এক ঘটনার পরিণতি ছিল না, বরং তার নিজের ভিতরের লড়াইয়ের এক রূপ। আর সেই লড়াইয়ের কিছুটা ঢেউ এসে পড়েছিল ইরার মধ্যেও— কারণ সে তো জন্মসূত্রে তাদেরই উত্তরসূরি। ইরা চুপ করে বসে থাকল। তারপর হঠাৎ একটা ঝলক মাথায় আসে— মায়ের ঘরের পুরোনো কাঠের তাকের পেছনে একটা ছোট বাক্স, যেটা সে আগে কখনও খোলেনি। মা একবার বলেছিল, ওখানে শুধুই পুরোনো কাপড় রাখা থাকে। কিন্তু ইরার মনে সন্দেহ জাগে। বিকেলে মা যখন ঘরের বাইরে, ইরা আলতো করে গিয়ে তাকটা নামায়। কাঠের পেছনে ছোট একটা সিন্দুক— তালা বন্ধ, কিন্তু পাশেই এক ভাঙা চাবি পড়ে আছে। অনেক কষ্টে খুলে দেখল— তার ভেতরে আছে আরেকটি চিঠি। তবে এ চিঠিতে লেখা:
“আমিও ওর মতো হয়ে যাচ্ছি। যদি আমি একদিন হারিয়ে যাই, যদি কেউ আর চিনতে না পারে আমায়, তাহলে জানবে— আমার মুখে চুপ থাকার চাবি ছিল। সেই চাবি, আমি রেখে গেলাম ইরার চোখে। যদি সে একদিন জানতে চায়— সে নিজেই খুলে নেবে।”
চোখ ঝাঁপসা হয়ে আসে ইরার। এখন সে জানে, সব নীরবতা কেবল ভুলে যাওয়ার জন্য নয়— কিছু নীরবতা আসলে অপেক্ষা করে একদিন খুলে পড়ার। এখন সে আর ভয় পায় না। এখন শুধু শেষ মুখোমুখির সময়।
১০
রাত নেমেছে নিঃশব্দে, যেন চারপাশের অন্ধকারও জানে আজ কিছু চিরতরে বদলে যাবে। ইরা অলিন্দে দাঁড়িয়ে, হাতে সেই দুটি চিঠি— একটি ঊর্মিলা মাসির, আরেকটি মায়ের হাতে লেখা নীরবতার কথা। আজ আর আতরের গন্ধ তাকে কাঁপিয়ে তোলে না। আজ আর ২:১৫-কে সে ভয় পায় না— কারণ সে জানে, রাত যত গভীর হয়, নিজের ছায়া তত স্পষ্ট দেখা যায়। জানালার কাচে এইবার সে দেখতে পায় সেই ছায়াকে, এক নারীর অবয়ব, যাকে সে একাধারে চিনে, আবার চেনে না। ছায়াটি ধীরে ধীরে হাত তোলে— এবার তার চোখে আগের সেই শীতলতা নেই, বরং গভীর ক্লান্তি। ইরা জানে, ছায়াটি আর কেবল ভয় নয়— এটা তারই অর্ধেক, যার সঙ্গে তাকে বোঝাপড়া করতেই হবে। সে চুপচাপ এগিয়ে গিয়ে জানালার ঠিক সামনে দাঁড়ায়, এবং সেই চেনা কণ্ঠে বলে ওঠে, “তুই আর ফিরে আসতে চাইছিলি না, তাই না?” ছায়া একটু মাথা ঝাঁকায়। ইরা এবার দুটো চিঠি জানালার তলায় রেখে বলে, “তুই আমার, আমি তোর। কিন্তু তুই এখানে আটকে থাকবি না আর। আমি জানি সবটা। আমি তোকে ভুলিনি। তুই মুক্ত।”
সেই মুহূর্তে একটা হালকা বাতাস আসে জানালার ফাঁক দিয়ে। আতরের ঘ্রাণ নেই, কেবল এক নির্মলতার ছোঁয়া। ছায়াটি আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেতে থাকে— আর জানালার কাচে শুধু ইরার নিজের প্রতিচ্ছবি ফিরে আসে। একলা, দৃঢ়, নিঃশব্দ। ঘড়ির কাঁটা এবার ২:16 অতিক্রম করে ২:17-এ পৌঁছায়। ইরা বুঝতে পারে, সময় এবার সত্যিই বয়ে চলেছে। অলিন্দ নিঃশব্দ, বাতাসে কোনও ভারী ঘ্রাণ নেই, কোনও শব্দ নেই। সে জানে, এই প্রথমবারের মতো সেই রাতের আওয়াজ আর আসবে না। সে ধীরে ধীরে জানালার পর্দা টেনে দেয়। অলিন্দের দেয়ালে ঝুলতে থাকা ঘড়ির টিকটিক শব্দ যেন দূর হতে হতে মিলিয়ে যায়। আর ইরা, এবার প্রথমবারের মতো দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বিছানায় ফিরে যায়— ঘুমের দিকে নয়, মুক্তির দিকে।
পরদিন সকালে সূর্যের আলো ঘরে ঢোকে অন্যরকম উজ্জ্বলতায়। মা চুপচাপ ইরার পাশে এসে বসেন। কিছু বলেন না, শুধু একবার চোখে চোখ রাখেন— আর ইরা শুধু মাথা নাড়ে, যেন বলছে, “সব ঠিক আছে, এখন।” মায়ের চোখে এবার জল নয়, বরং এক স্বস্তি। অনেক বছর ধরে লুকিয়ে থাকা ভয়, স্মৃতি, আর চুপচাপ রাখা চাবি সব আজ মুক্ত।
ইরা জানে, অলিন্দে এখন আর কেউ হাঁটে না। জানালার কাচে শুধু নিজেকে দেখা যায়।
আর সময়? সে তো চলছেই, টিক টিক করে— যেমন হওয়া উচিত।
***