Bangla - তন্ত্র

মরণবিলাসী

Spread the love

সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়


এক

শহর কখনও কাউকে নিজের করে নেয় না, আবার কখনও কাউকে ছেড়ে দেয় না—এই দুইয়ের মাঝখানে অনন্তভাবে আটকে ছিল সায়ন্তন চৌধুরীর জীবন। কলকাতার এই কর্পোরেট কাঁচের খাঁচায় তার দশ ঘন্টার অফিস, তিন ঘন্টার ট্রাফিক, আর বাকি সময় শুধু দমচাপা ক্লান্তি। ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে শহরের আলোগুলো যেন মৃত্যুর স্বপ্ন দেখায়, বেঁচে থাকার নয়। গত এক বছরে সায়ন্তনের মধ্যে অনেক কিছু ভেঙেছে—প্রেম, আশা, বিশ্বাস, নিজেকে ভালোবাসার ক্ষমতা। নয়নিকার চলে যাওয়া যেন তার আত্মাকে একবারে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। সেই অভিশপ্ত দিনগুলোর পরেই শুরু হয় প্যানিক অ্যাটাক, ঘুম না হওয়া, নিজেকেই অচেনা মনে হওয়া। অনেক মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে গিয়েছে, মেডিটেশন অ্যাপ ডাউনলোড করেছে, কিন্তু কিছুতেই ভেতরের সেই নির্জন কালো গহ্বরটা ভরেনি। এবার সে স্থির করেছিল—এই অদৃশ্য শূন্যতা থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র রাস্তা মৃত্যু। তবে তার মৃত্যুটা যেন একমাত্রিক না হয়, যেন কোনও উদ্দেশ্য থাকে। আত্মহত্যার আগের রাতে সে শেষবার ইন্টারনেটে সার্চ করছিল — “Peaceful way to die”, “What happens after death”, আর সেই সময় এক অদ্ভুত ব্লগে চোখ পড়ে — “ত্রিলোকানাথ—যিনি মৃত্যু দেখান মৃত্যুর আগেই।” প্রথমে হাসি পেলেও কৌতূহলটা থামেনি। ব্লগটা লিখেছিল এক ফটোগ্রাফার, যে পুরুলিয়ায় গিয়ে নাকি এমন এক তান্ত্রিকের দেখা পেয়েছিল যিনি ‘মৃত্যুর অভিজ্ঞতা’ করাতে পারেন। কিছুই বিশ্বাসযোগ্য ছিল না, তবুও সায়ন্তনের মনে হলো, যদি শেষ যাত্রা করতেই হয়, তবে একটু ঘুরে, বুঝে, দেখে নেওয়া যাক।

পরদিন ভোরবেলায় সে একটা ব্যাকপ্যাক গুছিয়ে, ফোনটা সাইলেন্ট করে হাওড়া স্টেশন থেকে পুরুলিয়ার লোকালে চড়ে বসল। ট্রেন ছাড়তেই শহরের কংক্রিটের খাঁচাগুলো পিছনে পড়তে লাগল, আর তার ভিতরের কষ্টগুলো যেন ধীরে ধীরে কোনো এক অচেনা গন্তব্যে ভেসে যাচ্ছিল। জানালার বাইরের দৃশ্য বদলাচ্ছিল—চালের খোলা ছাউনির গ্রাম, লাল মাটির পথ, সুঁচালো শালগাছের সারি। সায়ন্তনের মনেও যেন একটা ভিন্ন সময় প্রবাহিত হচ্ছিল, যেখানে ঘড়ি নেই, ক্যালেন্ডার নেই, কেবল একটা উদ্দেশ্য—মৃত্যুকে দেখা। পুরুলিয়া স্টেশনে নামার পর অটো, বাস, পায়ে হেঁটে সে পৌঁছায় এক নির্জন বস্তি এলাকার সীমানায়, যেখানে কেউ বললো “ওই জঙ্গলের ভেতরে গেলে একটা পুরোনো শ্মশান আছে, সেখানেই থাকে তান্ত্রিক ত্রিলোকানাথ।” সন্ধ্যা নামছিল। সায়ন্তনের চোখে ক্লান্তির ছাপ, কিন্তু ভেতরে এক অদ্ভুত তীব্রতা কাজ করছিল। সে হাঁটছিল সেই নির্জন শালবনের ভেতর দিয়ে, যেখান থেকে পাখির ডাক থেমে গেছে, বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠেছে। একটা জায়গায় এসে দাঁড়াতেই হঠাৎ ঝোড়ো হাওয়ার মতো অনুভূতি হলো, যেন কেউ বা কিছু তার পেছনে নিঃশব্দে হেঁটে চলেছে। সায়ন্তন পেছনে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেল না, কিন্তু তার ঘাড় বরাবর একটা শীতল ঠাণ্ডা বয়ে গেল।

শেষে যখন সে পৌঁছায় শ্মশানের পাথরের দরজার সামনে, তখন আকাশে শেষ আলোটুকুও মিলিয়ে গেছে। শ্মশান নয়, যেন মৃত্যু নিজেই দাঁড়িয়ে আছে সামনে। ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে ধূপ-ধুনোর ধোঁয়ার মধ্যে বসে থাকা এক মধ্যবয়স্ক পুরুষ—তার গায়ে গেরুয়া, কপালে ভস্ম, আর চোখে যেন একটা অপার্থিব স্থিরতা। তিনি কিছু না বলে সায়ন্তনের দিকে তাকিয়ে থাকেন। আশেপাশে আরও কয়েকজন—তান্ত্রিক শিষ্য, কিংবা প্রেতসাধক—নীরব। কেবল আগুনের কুণ্ড থেকে মাঝে মাঝে হঠাৎ শিখা উঠে আসে, আর হাওয়ায় ধূপের গন্ধ মিশে এক প্রকার ঘোর তৈরি করে। কিছুক্ষণের নিরবতার পর সেই গম্ভীর কণ্ঠস্বর বলে ওঠে, “তুমি এসেছো, কারণ তুমি মরতে চাও। কিন্তু তুমি কি জানো, মৃত্যুর আগে মৃত্যু মানে কী?” সায়ন্তনের গলা শুকিয়ে যায়। সে জানে না কী বলতে হবে। কেবল মাথা নত করে বলে, “আমি জানতেই চাই… মৃত্যুর পর কী আছে।” ত্রিলোকানাথের চোখে তখন যেন এক শীতল আগুন জ্বলছিল। তিনি বললেন, “তা হলে আজ থেকে শুরু হবে তোর যাত্রা। মনে রাখিস, চোখ দিয়ে যা দেখবি, তা সব সত্য নয়। কিন্তু যা অনুভব করবি, তা-ই তোর ভবিষ্যৎ।” দূরে কোনও একটা শেয়াল ডাকল। রাতের আকাশে তারা ওঠে এসেছে। সায়ন্তন জানে না ঠিক কী অপেক্ষা করছে তার জন্য। কিন্তু একটা কথা এখন তার স্পষ্ট—সে আর শহুরে সায়ন্তন নেই। সে এক মরণবিলাসী, যে মৃত্যুর সীমানায় দাঁড়িয়ে দেখতে চায়—জীবনের সত্য আসলে কতটা গভীর হতে পারে।

দুই

সায়ন্তনের মনে হচ্ছিল, সে যেন সময়ের এক অদ্ভুত ফাঁকে ঢুকে পড়েছে—যেখানে শহুরে পরিচয়, গতানুগতিক ব্যর্থতা বা প্রেমঘটিত হাহাকার কোনও কিছুই আর তার উপর প্রভাব ফেলছে না। পুরুলিয়ার সেই শ্মশানবেষ্টিত বনভূমিতে, রাতের নিস্তব্ধতার মাঝে ত্রিলোকানাথের আশ্রম যেন বাস্তব নয়—একটি বোধের ক্ষেত্র, যেখানে প্রবেশ করেই মানুষের যাবতীয় যুক্তি ভেঙে পড়ে। সেদিন রাতেই তাকে একটি ছোট্ট খড়ের কুঁড়েঘরে ঠাঁই দেওয়া হয়—সেখানে আলো নেই, কেবল মাটির প্রদীপ আর খড়ের বিছানা। ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করতেই তার বুক ধকধক করতে শুরু করল, যেন ভেতরে বসে থাকা অতল এক ভয় হঠাৎ প্রাণপণে উঠে আসছে। অথচ বাইরে সেই ভয়ানক নৈঃশব্দ্য, যেটা কোনও শহর নয়, মৃত্যুর নিজস্ব ভাষায় কথা বলে। ঘুম আসে না, কিন্তু স্বপ্ন নামে। চোখ খুলেই সে দেখে এক অদ্ভুত দৃশ্য—তার নিজের মৃতদেহ পুড়ে যাচ্ছে আগুনে, আশেপাশে শ্মশানবাসীরা মন্ত্র জপছে, আর দূরে এক নারী ছায়া—নয়নিকার মতো দেখতে—কেবল দাঁড়িয়ে আছে নীরব, চোখে জল নেই, মুখে কিছু নেই, শুধু সেই দৃষ্টিটা যেন গলা কেটে ফেলে। চমকে ঘুম ভেঙে যায়, ঘর্মাক্ত সায়ন্তন দেখে প্রদীপ নিভে গেছে। বাতাসে যেন কেউ ধীরে ধীরে হাঁটছে, পদচিহ্নের শব্দ নয়, বরং উপস্থিতির ভার—যেটা বোঝা যায়, অনুভব করা যায়, কিন্তু স্পষ্ট দেখা যায় না। ঘড়ি নেই, সময় বোঝার উপায় নেই, কিন্তু মনে হচ্ছিল গভীর রাত। এই প্রথম সে অনুভব করল, সে হয়তো জীবিত, কিন্তু তার আশেপাশে যা আছে তা শুধুই জীবনের ছায়া নয়, মৃত্যুর প্রতিচ্ছবিও।

পরদিন সকালে শ্বেতানন্দ এসে তার ঘরের সামনে বসে রইল। মুখে অদ্ভুত এক প্রশান্তি, যেন কত যুগ ধরে কিছু বলার প্রয়োজন পড়েনি। সে বলল না, সায়ন্তনও কিছু জিজ্ঞেস করল না। ধীরে ধীরে তারা হাঁটতে শুরু করল শ্মশানঘাটের দিকে—যেখানে আগুন এখনও জ্বলছে, যেন রাতভর কোনও আত্মা শেষ হয়নি। চারপাশে ছড়িয়ে থাকা কাঁসার থালা, শুষ্ক পাতা, কিছু হাড়ের টুকরো আর ভাঙা কাঠের স্তূপ—এইসবের মাঝেই হঠাৎ করে শ্বেতানন্দ বলে উঠল, “তুই জানিস, মানুষের সবচেয়ে গভীর ইচ্ছেটা কী?” সায়ন্তন প্রশ্নটা বুঝতে পারেনি। “মরণ?”—সে কাঁপা কণ্ঠে বলল। শ্বেতানন্দ মাথা নেড়ে বলল, “না, মৃত্যুর মতো কিছু একটা দেখে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা। মানে, মানুষ মরতে চায় না, মানুষ মরার স্বাদ নিতে চায়। তোকে সেই স্বাদ নিতে হবে, তবে ধাপে ধাপে। ত্রিলোকানাথ যা দেখাবে, তা অনুভব করতে পারলে তোর ভিতরে যা মরে আছে, তার অন্ত্যেষ্টি হবে।” এই কথাগুলো যেন ধ্বনির মতো সায়ন্তনের ভেতর ঘুরে ফিরে আঘাত করতে থাকল। তাকে বলা হলো—প্রথম ধাপ শুরু হবে আজ রাতেই, যেখানে তার ভেতরের প্রথম ভয় বেরিয়ে আসবে। এই ধাপে শরীরের নয়, মন ও সত্তার সীমা পরীক্ষা করা হবে। সায়ন্তনের মাথায় তখন একটাই ভাবনা—আমি কি সত্যিই প্রস্তুত?

রাতের প্রথম প্রহরে তাকে আনা হলো শ্মশানের এক নির্জন অংশে, যেখানে চারপাশে শুধু জ্যোৎস্নার আলো পড়ে আছে, আর মাঝখানে এক পুরনো পাথরের চত্বর, যার মাঝখানে রাখা এক শ্মশানদীপ—অন্ধকারে হালকা জ্বলন্ত, প্রায় নিভে আসা আলো। তাকে বলা হলো, সে এখানে বসে থাকবে একটানা তিন ঘণ্টা—না নড়বে, না চোখ বন্ধ করবে। যদি চোখ বন্ধ করে, তবে স্বপ্ন শুরু হবে। যদি নড়ে, তবে অভিজ্ঞতা ভেঙে যাবে। সে বসে পড়ল, হাওয়ার শব্দে শালগাছ কাঁপছে, দূরে কেউ যেন শিস দিচ্ছে, আবার যেন না-ও দিচ্ছে। ধীরে ধীরে তার চারপাশ ঘিরে নামল হিমশীতল ঘোর—প্রথমে মনে হলো কিছু নেই, তারপর যেন পেছন থেকে কেউ ধীরে ধীরে এসে দাঁড়ালো। সে তাকালো না, কিন্তু অনুভব করল—সেই উপস্থিতি। কেউ তার পিঠে নিঃশ্বাস ফেলছে। হঠাৎ কানে বাজল একটি শব্দ—নয়নিকার কণ্ঠ, “সায়ন্তন… আমি কোথায়?” সে চমকে উঠল, কিন্তু নড়ল না। চোখ বড় বড় হয়ে উঠছে, শ্বাস আটকে আসছে, কিন্তু সে ঠায় বসে। হঠাৎ সে অনুভব করল তার চারপাশটা কুয়াশায় ঢেকে গেছে, সামনে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সেই কুয়াশার ভেতর থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল একটা ছায়া, যার গায়ে তার নিজের অফিসের পোশাক, গলায় ফাঁসির দাগ, চোখে ফাঁকা দৃষ্টি। সে নিজের দিকেই তাকিয়ে বলে উঠল—“তুই মরবি, তো মর, কিন্তু জানিস তো, মরার পরেও দায় শেষ হয় না।” এরপর হঠাৎ সব আলো নিভে গেল। নিঃশব্দে এক ঝড় উঠল মনে—কিন্তু সায়ন্তনের শরীর তখন বরফের মতো, স্থির, নিস্পন্দ। হঠাৎ সব কিছু থেমে গেল। চোখের সামনে একটা আগুনের রেখা দেখা দিল—ত্রিলোকানাথের সেই শ্মশানদীপ। মনে হলো, এক অদ্ভুত স্তব্ধতার মধ্যে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। এবং সেই হারানোতে, সে প্রথমবার একটু মুক্তির স্বাদ পেল।

তিন

ভোরবেলায় কুয়াশা সরতেই সায়ন্তন বুঝতে পারল, সে কেবল রাত কাটায়নি, সে একদম অন্য একটা সত্তার স্তরে নেমে গিয়েছিল। চারপাশটা অনেকটাই চেনা, অথচ মনে হচ্ছিল জায়গাটা বদলে গেছে। শ্মশানটা যেন আগের চাইতে বেশি জীবন্ত, অথচ মৃতপ্রাণে পূর্ণ। শ্বেতানন্দ এসে বলল, “তুই পাশ করেছিস। কিন্তু এটা তো কেবল শুরু।” এরপর সে সায়ন্তনকে নিয়ে গেল আরও গভীরে, শ্মশানের এমন একটা প্রান্তে যেটা আগেও দেখেনি সে—একটানা পোড়া গন্ধ, ভাঙা শিবমূর্তি, আর এক বিশাল প্রাচীন পাথরের চত্বর, যার মাঝে একটা প্রজ্বলিত ‘শ্মশানদ্বীপ’ সারাক্ষণ জ্বলছে। শ্বেতানন্দ বলল, “এটা শুধুই আগুন নয়, এটা তোর চেতনার প্রহরী। তুই যতক্ষণ নিজেকে জানিস, ততক্ষণ এটা জ্বলবে। একবার ভুললে—এ নিভে যাবে।” সায়ন্তন বসে পড়ল দ্বীপের পাশে, ত্রিলোকানাথ দূরে এক চক্র আঁকছিলেন, আগুনের ধারে বসে ধূপ জ্বালাচ্ছিলেন। আচমকাই চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে এল। গাছের পাতা থেমে গেল, পাখির ডাক স্তব্ধ, এমনকি বাতাসও থেমে গেল। শুধু দ্বীপের শিখাটি দপদপ করে জ্বলছে, ঠিক যেন কারও নিঃশ্বাসের মতো।

সায়ন্তনের চোখ একসময় ঝাপসা হতে লাগল, শরীর ভারী হয়ে এল। সে জানত না ঘুমিয়ে পড়েছে কি না, কিন্তু হঠাৎ দেখল চারপাশটা একেবারে অন্ধকার হয়ে গেছে—না, অন্ধকার নয়, ধোঁয়ায় ভরে গেছে। সেই ধোঁয়ার ভিতর থেকে আসছে ফিসফিসানি—তার নিজের কণ্ঠে। “তুই ব্যর্থ, তুই অকর্মণ্য, তোকে কেউ ভালোবাসেনি”—এইসব বাক্য বারবার প্রতিধ্বনিত হতে লাগল, যেন কে যেন সেগুলো কানে ফিসফিস করে বলছে। সে উঠে দাঁড়াতে গেল, কিন্তু পা যেন মাটি কামড়ে ধরেছে। সেই মুহূর্তে ধোঁয়ার মাঝে ভেসে এল এক মুখ—তার মৃত বাবার, যিনি তার ছোটবেলায় মারা গিয়েছিলেন। মুখটা অদ্ভুত নির্লিপ্ত, চোখ স্থির, মুখে কোনও দুঃখ নেই, কেবল একটাই প্রশ্ন—“তুই মরতে চাস, নাকি মরার ভান করছিস?” এরপর চারপাশে আলো জ্বলে উঠল, এক অদ্ভুত আলো, যেখানে আগুন নেই, অথচ শরীর জ্বলছে। সায়ন্তন চিৎকার করে উঠে পড়ে, শ্বাস নিতে পারছিল না। আর ঠিক তখনই সামনে এসে দাঁড়াল ত্রিলোকানাথ। তিনি বললেন, “তোর ভয় এখন প্রকাশ পেয়েছে। এবার শুরু হবে আসল কাজ—প্রহরীর অভিষেক।” এই শব্দটা সায়ন্তনের মাথায় বিঁধে গেল। সে বুঝতে পারল না—এই প্রহরী কে? দ্বীপ? নাকি সে নিজেই?

পরদিন সন্ধ্যায় শুরু হলো তার দ্বিতীয় ‘অভিজ্ঞতা’—ত্রিলোকানাথ একটি কালো তামার পাত্রে জল এনে বললেন, “এটা শ্মশানের ‘চিত্রজল’—যেটা শুধু মৃত আত্মার প্রতিচ্ছবি ধরে রাখে। তুই এতে মুখ দেখবি।” সায়ন্তনের ঠোঁট শুকিয়ে এল, কিন্তু সে তাকাল। প্রথমে নিজেকেই দেখল, কিন্তু ধীরে ধীরে তার প্রতিবিম্ব বদলে যেতে থাকল—একবার নয়নিকার মুখ, তারপর তার অফিসের বস, তারপর এক অজানা নারী—সবাই একে একে বলছে, “তুই তো শুধু পালাতে চাস, মুখোমুখি হতে নয়।” একসময় প্রতিবিম্বে এক ছায়া-সত্তা উঠে এলো—হুবহু সায়ন্তনের মতো দেখতে, কিন্তু চোখদুটি সম্পূর্ণ শূন্য, ঠোঁটে হাসি নেই, এক হাতে একটি সাদা কাপড়, যা দিয়ে যেন গলা বাঁধা। ছায়াটি ধীরে ধীরে বলল, “আমি তুই—যদি তুই এখানে থেকেই যাস।” সায়ন্তন চোখ ফিরিয়ে নিল, দম বন্ধ হয়ে আসছিল। ত্রিলোকানাথ বললেন, “এই দ্বীপ জ্বলবে ততদিন, যতদিন তুই নিজেকে ভুলে যাস না। কিন্তু যদি নিজেকে মেনে নিস—সবকিছুকে—এই দ্বীপ তোকে পথ দেখাবে। মনে রাখিস, মৃত্যুর আগে সবারই একটা প্রহরী লাগে। সেটা তোর ভেতরেই। এবার থেকে, তুইই তোর দ্বীপের প্রহরী।” শ্মশানের সেই আগুন তখনও জ্বলছিল। কিন্তু তার আলোর মধ্যে, সায়ন্তন প্রথমবার নিজের ছায়া স্পষ্ট করে দেখতে পেল।

চার

রাত যত গভীর হচ্ছিল, সায়ন্তনের চারপাশে তত ঘন হয়ে আসছিল অতীতের ছায়া। শ্মশানদ্বীপের সেই আলো, যা সারাদিন তার প্রহরী হয়ে জ্বলেছিল, হঠাৎ যেন নিভে গেল। আশ্রমের খোলার ঘরে বসে থাকতে থাকতে তার চোখে যেন ঘোর লাগা শুরু হলো, এক ধরনের নিঃশব্দে কাঁপতে থাকা ঘোর, যা বাস্তবতাকে পর্দার মতো ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছিল। তারপর একসময় বুঝতে পারল, সে আর বাস্তবে নেই। কোথাও ঢুকে পড়েছে—সম্ভবত নিজেরই মনস্তলের গহিনে। জায়গাটা চেনা, অথচ অচেনা। চারপাশে মেঘলা আলো, একটা পুরনো ঘর, দেয়ালে নয়নিকার আঁকা স্কেচ—আর একটা জানালার ধারে সে নিজেকে দাঁড়িয়ে দেখল। তার চুল এলোমেলো, গায়ে হালকা সাদা শার্ট, চোখে কালি—সে জানে, এ তারই অতীতের রূপ। কিন্তু হঠাৎ ঘরের ভিতর থেকে কেউ পেছন থেকে এসে ধরা দিল—সেই চিরচেনা গলার স্বর, সেই ঘ্রাণ, সেই চোখ—নয়নিকা। সায়ন্তনের হৃদয় থমকে গেল, হাঁসফাঁস করা নিঃশ্বাসে সে শুধু দেখতে থাকল সেই মুখ, যা একদিন তার জীবন ছিল। নয়নিকার চোখে কোনও অভিযোগ নেই, শুধু নিরবতা। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে শুধালো, “তুমি এখনও আমাকে দোষ দাও?” সায়ন্তন উত্তর দিতে পারল না, শুধু মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকল। নয়নিকার কণ্ঠ নরম, কিন্তু ভিতরে আগুন, “আমি তো তোমাকে ছেড়ে যাইনি, তুমি নিজেকে একা করেছিলে।” সায়ন্তনের চোখে জল এলো, কিন্তু সে জানে, এ সত্য নয়। নয়নিকা তো চলে গিয়েছিল। বা হয়তো বাস্তব নয়, এই নয়নিকা তার সেই অপরাধবোধের ছায়া, যা তাকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে।

এই স্বপ্ন-বাস্তবতার ভিতর নয়নিকা হঠাৎ তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল, দু’হাত বাড়িয়ে বলল, “তুমি যদি মরো, আমি চিরদিন তোমার সঙ্গে আটকে থাকব এই ঘরটায়। তুমি জানো তো, ভালোবাসা কখনও মরে না।” সায়ন্তনের গলা শুকিয়ে গেল। এই নয়নিকা যেন কেবল তার প্রাক্তন প্রেমিকা নয়, তার ‘অপরিণত প্রেমের প্রতিচ্ছবি’। তাকে ত্রিলোকানাথ আগেই বলেছিল, “সব স্বপ্নে ছায়া থাকে, আর সেই ছায়া যদি চেনা হয়, তবে সে-ই তোমার আসল বন্ধন।” নয়নিকার উপস্থিতি যেন ধীরে ধীরে ঘরটাকে গ্রাস করতে লাগল। দেয়ালের সব ছবিগুলোতে নয়নিকার মুখ, জানালার বাইরে অন্ধকার আকাশে যেন তার চোখগুলো জ্বলছে। সায়ন্তন ভয় পাচ্ছে, কিন্তু দৃষ্টিটা সরাতে পারছে না। নয়নিকা বলল, “তুমি কি জানো, মৃত্যুর পরেও আমি তোমার কাছে থাকব? এটাই তুমি চেয়েছিলে তো—আমার সঙ্গে চিরন্তন একাত্মতা?” সায়ন্তন তখন বুঝতে পারল, এই স্বপ্ন-ছায়া তাকে আবদ্ধ করে রাখছে। সে যদি এখানেই ডুবে যায়, তবে আর ফেরা সম্ভব হবে না। হঠাৎ করে চারপাশ কাঁপতে শুরু করল, নয়নিকার চোখ লাল হয়ে উঠছে, গলা যেন বিকৃত, সে চিৎকার করে বলল, “তুমি পালাতে পারবে না! তুমি তো আমাকেই মরতে শিখিয়েছিলে!” সেই ভয়ানক মুহূর্তে সায়ন্তন গলা ছেড়ে চিৎকার করল, “আমি ক্ষমা চাই! আমি স্বীকার করি, আমিই পালিয়েছিলাম!” ঠিক সেই মুহূর্তে সমস্ত দৃশ্য গলে গিয়ে মিলিয়ে গেল।

তার ঘুম ভেঙে গেল, শরীর ভিজে, নিঃশ্বাস ভারী। আশ্রমের বাইরে সকাল হয়ে গেছে। পাখির ডাক, দূরে কোনও ধূপজ্বালার গন্ধ ভাসছে। দ্বীপ এখনও জ্বলছে—তবে আগুনের রং যেন বদলে গেছে, যেন তাতে এখন এক আশ্রয়ের আলো আছে। ত্রিলোকানাথ তখন সামনে এসে বললেন, “আজ তুই তোর ভালোবাসাকে মেনে নিয়েছিস, আর সেটাই তো প্রথম মুক্তি।” সায়ন্তনের চোখে জল, কিন্তু তার মধ্যে এক গভীর স্থিরতা। সে জানে, নয়নিকার সেই ছায়া ছিল তার মনের পাঁজরে গাঁথা অপরাধবোধ, যা প্রতিস্বপ্নে রূপ পেয়েছিল। আজ সে তাকে দেখেছে, মুখোমুখি হয়েছে, এবং সেটিকে বিদায় জানিয়েছে। মৃত্যুর যাত্রা মানে কেবল শরীর নয়, আত্মার গভীর স্তরের আবর্তেও প্রবেশ করা। আর এই অধ্যায় শেষে, সায়ন্তন প্রথমবার টের পেল—সে হয়তো মরতে আসেনি। সে ফিরে যেতে চায়, কিন্তু নতুন একজন হিসেবে।

পাঁচ

ত্রিলোকানাথ তাকে ডেকে নিল এক বিকেলের আবছা আলোয়, যেখানে শ্মশানের ধারে জ্বলে উঠেছিল চারটি ধূপকাঠি, চারটি ভিন্ন রংয়ের আগুন। “আজ তুই দেখতে পাবি নিজেরই চারটি রূপ,” বলল গুরু, “চারটি ভবিষ্যৎ—যার যেকোনোটি তুই বেছে নিতে পারিস, অথবা এড়িয়ে যেতে পারিস। তবে এই পথগুলো দেখার পর কেউ আর আগের মতো থাকে না।” সায়ন্তন মনে মনে প্রস্তুত ছিল, কিন্তু তার ভিতরে একটা কাঁপুনি চলছিল। একেকটি ধূপকাঠির ধোঁয়া চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল, আর সেই ধোঁয়ার ঘূর্ণিতে তার চারপাশ অন্ধকার হয়ে এল। প্রথম ধূপের ধোঁয়া গাঢ় নীল। সায়ন্তন দেখতে পেল, সে একটা অন্ধকার শহরের রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে—কোনও নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই, চেহারা শীর্ণ, চোখ ফাঁকা, কাঁধে একটা ভাঙা ব্যাগ। সে ভিখারি নয়, পাগলও নয়, সে একজন ‘বেঁচে থাকা মৃত’। তার মুখে কেউ কথা বলে না, তার স্মৃতিতে কেউ নেই—এ যেন এক আত্মাহীন অস্তিত্ব। দ্বিতীয় ধূপের ধোঁয়া ছিল রক্তলাল। সেখানে সে এক বড় কর্পোরেট অফিসের কেবিনে বসে আছে—মাথা ঝুঁকে পড়া, চোখে ক্লান্তি, মুখে অশান্তি। ফাইলের পাহাড়, ঘড়ির কাঁটার দৌড়—সব আছে, কিন্তু প্রেম নেই, স্বপ্ন নেই। রাতে সে বিছানায় শুয়ে চোখ মেলে থাকে, ভাবছে—“কেন এত বড় একটা জীবন শুধু দায়িত্বে গেল?” এই রূপটিও ‘জীবনের আড়ালে মৃত্যু’।

তৃতীয় ধূপের ধোঁয়া ছিল সাদা। সেখানে সে একটি ছোট পাহাড়ি গ্রামে, একজন গৃহশিক্ষক, মুখে শান্তি, চোখে আলো। সে ছোট ছোট বাচ্চাদের পড়ায়, গাছ লাগায়, সন্ধ্যায় নদীর পাড়ে বসে বই পড়ে। নয়নিকার কোনও অস্তিত্ব নেই এখানে, তবুও তার অনুপস্থিতি এক প্রকার পূর্ণতাই। এই জীবন তার এক সম্ভাব্য মুক্তির পথ, যদি সে ফিরে যেতে চায়। শেষ ধূপের ধোঁয়া ছিল ধূসর—সবচেয়ে অস্থির। সেখানে সায়ন্তন নিজেকে দেখে এক সন্ন্যাসী রূপে—গেরুয়া কাপড়ে, গলায় রুদ্রাক্ষ, কপালে ভস্ম। সে এক গুহায় বসে ধ্যান করছে, কিন্তু তার চোখে জ্বলছে এমন এক আগুন, যা দেখে বোঝা যায় সে এখনও ভুলে যায়নি কিছুই। এই রূপ—এক দগ্ধ আত্মার, যে সবকিছু ছেড়ে দিয়েছে, কিন্তু তবুও পিছু টানে। ধোঁয়া মিলিয়ে যেতে লাগল। চারপাশ আবার আলোর মুখ দেখল। সায়ন্তনের মুখে তখন অদ্ভুত প্রশান্তি, অথচ ভিতরে চলছিল প্রচণ্ড দ্বন্দ্ব। সে জানত, এই চতুষ্পথ থেকে কোনও একটিই হতে পারত তার ভবিষ্যৎ—হয়তো এখনও হতে পারে। ত্রিলোকানাথ শান্ত গলায় বললেন, “মৃত্যুর আগেই মানুষ অনেকবার মরে, বুঝলি? এই চার রূপ—তোরই চার মৃত্যু। এখন বল, কোনটা তুই দেখতে চাস?”

সায়ন্তন কিছু বলল না, কারণ সে জানত, এই প্রশ্নের উত্তর মুখে দেওয়া যায় না—দিতে হয় অভিজ্ঞতা দিয়ে। তার ভেতরে তখন এই চার ছায়া একসঙ্গে নড়াচড়া করছে, একেকটি নিজের মতো করে তাকে টানছে। কিন্তু হঠাৎ তার মনে হলো, নয়নিকার সেই প্রতিস্বপ্ন, দ্বীপের প্রহরী, তার নিজেরই গলার স্বর—সব মিলিয়ে একটা কথা বারবার ফিরে আসছে, “তুই যদি নিজেকে পুরোপুরি স্বীকার করতে পারিস, তবেই বাঁচতে পারবি।” সে শ্মশানের মাটিতে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ল। বাতাস ভারী হয়ে আসছিল, মাথা নীচু, চোখ বুঁজে সে বলল, “আমি সব রূপ গ্রহণ করি। আমি যা কিছু ছিলাম, হব, হতে পারতাম—সব আমার। আমি পালাব না আর।” ত্রিলোকানাথ মৃদু হাসলেন। আকাশে যেন ঝাপটা দিয়ে একটা হাওয়া বইল, চার ধূপ একসঙ্গে নিভে গেল। সায়ন্তনের চোখ খুলতেই দেখল, সামনে সেই শ্মশানদ্বীপ জ্বলছে আগের চেয়ে উজ্জ্বল। আজ সেই আলো তার চোখে অন্ধকার ফেলছে না, বরং তারই ভিতরে আলো ফেলছে। আজ সে চারটি মৃত্যু দেখেছে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে সে মরে গেছে। বরং, সে প্রথমবার নিজের জীবনের সম্ভাবনাগুলো সত্যভাবে দেখেছে—ভয় না পেয়ে।

ছয়

শ্মশানদ্বীপের চারপাশে সন্ধ্যার ধোঁয়া নেমে এলে সায়ন্তন একা বসেছিল মাটির ওপর। ঘাসে শিশির জমে উঠেছে, শালপাতা ঝরছে নিঃশব্দে। হঠাৎ সেই নিঃশব্দতা যেন খণ্ডিত করল এক হেঁটে আসা পায়ের শব্দ—মাটি চাপা দেওয়া, কিন্তু ভারী, টান টান, যেন সময় নিজে হাঁটছে। সায়ন্তন তাকিয়ে দেখল, দূরে ধূপকাঠির ধোঁয়ার মাঝখান দিয়ে এগিয়ে আসছে এক বয়স্কা নারী, যাকে সে আগে কখনো দেখেনি, অথচ তার উপস্থিতি এত গভীর, যেন বহু জন্মের চেনা। সাদা ধুতি, গা ঢাকা ভাঙা চাদর, কপালে মাটি মাখা, হাতে একটা পুরনো কঞ্চি। তার চুল পিঠে লম্বা, ঝাঁকড়া, যেন শুকনো লতা। তবুও তার চোখ… সেগুলো কোনো বুড়ির চোখ নয়, বরং আগুনের মতো—যেখানে স্মৃতি, মৃত্যু, আর সময় জ্বলছে। ত্রিলোকানাথ দূর থেকে বললেন, “এই হল শ্মশানবুড়ি। তিনিই রক্ষক, তিনিই সীমানার প্রহরী। ওনার অনুমতি না পেলে কেউ সত্যিকারের মৃত্যুর চৌকাঠ পার হতে পারে না।” শ্মশানবুড়ি সামনে এসে বসে পড়লেন আগুনের ধারে, একবার তাকালেন সায়ন্তনের দিকে, তারপর মাটি ছুঁয়ে চোখ বন্ধ করলেন। কয়েক মুহূর্ত কিছুই বললেন না। তারপর কাঁপা কণ্ঠে, কিন্তু তীব্র অভিজ্ঞতার ভারে ভারী গলায় বললেন, “তুই মরতে আসছিস। কিন্তু জানিস তো, মৃত্যুর পরে কী আছে?” সায়ন্তন গলা শুকিয়ে গেলেও আস্তে বলল, “আমি জানি না। জানতেই এসেছি।” শ্মশানবুড়ি এক অদ্ভুত হাসি হাসলেন, “জানতে এসেছিস… জেনে গেলে আর ফিরে যেতে পারবি না। তবুও চাই?” সায়ন্তন মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিল।

শ্মশানবুড়ি তখন তার সামনে এক সাদা ছাইয়ের রেখা টানলেন মাটির ওপর। বললেন, “এটা হল অগ্নিপথ—যার এক প্রান্তে জীবন, অন্য প্রান্তে শূন্যতা। তুই এই পথে হাঁটবি চোখ বুজে, যদি পথ হারাস, তবে হারাবি নিজেকেই।” সায়ন্তন কিছু না বলেই জুতো খুলে ছাইয়ের রেখায় পা রাখল। এক মুহূর্তেই যেন তার চারপাশ বদলে গেল—মাটির বদলে আগুনের আলপথ, বাতাস নেই, শব্দ নেই, কেবল পায়ের নিচে পোড়া ছাইয়ের দহন। সে হাঁটছিল, কিন্তু যেন কোথাও পৌঁছাতে পারছিল না। পথ অদৃশ্য, কিন্তু অনুভূতি জ্বলন্ত। হঠাৎ কোথা থেকে যেন ভেসে আসছে কণ্ঠস্বর—একবার নয়নিকার, একবার তার মায়ের, একবার তার নিজেরই আত্মপ্রবঞ্চনার স্বর, “তুই পালিয়ে যাচ্ছিস… তুই সাহসী নোস… তুই নিজের শেষটাও জানিস না।” একেকটা শব্দ তার ভেতর ছুরির মতো বিঁধে যাচ্ছিল। তার পা ভারী হচ্ছিল, চোখের সামনে অন্ধকার জমাট বাঁধছিল। তবুও সে চলতে লাগল, গুটি গুটি পায়ে, এক অনন্ত রেখা ধরে। এক সময় মনে হলো, সে পড়ে যাবে। তার সমস্ত শরীর দগ্ধ, মনের ভিতর কান্না জমে আছে, চোখ খুললে দেখবে না কিছুই। কিন্তু ঠিক তখনই তার বুকের ভেতর থেকে এক কণ্ঠস্বর জেগে উঠল—তার নিজেরই কণ্ঠ, কিন্তু অনেক শান্ত, অনেক গভীর—“তুই মরতে আসিসনি। তুই বাঁচতে চাস। শুধু সেটা স্বীকার করলি না।”

চোখ খুলতেই সায়ন্তন দেখল, সে শ্মশানের আগুনের পাশে বসে আছে। শ্মশানবুড়ি তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুই পার করেছিস অগ্নিপথ। কিন্তু তুই মরিসনি—তুই তো নিজেকে খুঁজে পেলি।” এরপর তিনি তার কাঁপা হাত বাড়িয়ে সায়ন্তনের কপালে ছোঁয়া দিলেন, আর বললেন, “মৃত্যুর আসল অর্থ জানিস কী? সেটা একটা সময়কাল—যেখানে মানুষ নিজের অন্তর্দৃষ্টি পায়। তুই এখন মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকবি, কারণ তুই জানিস—কে তুই।” সায়ন্তন চুপ করে বসে রইল, কিন্তু তার ভেতরে যেন বিস্ফোরণের মতো একটা শান্তি জেগে উঠছিল। বহুদিন পর তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল—কিন্তু সেটা আর দুঃখের ছিল না, সেটা মুক্তির, নিজের ভিতরে ফেরার আনন্দের। সে জানত, তার যাত্রা এখনও শেষ হয়নি। কিন্তু শ্মশানবুড়ি তাকে যা দিলেন—একটা সীমানার পার হওয়ার অভিজ্ঞতা—সেটা কোনো বইতে লেখা থাকে না। ওই রাতে, দ্বীপের আলো যেমন ছিল, সায়ন্তনের ভিতরেও তেমন আলো জ্বলছিল, যেটা আর নিভে যাওয়ার নয়।

সাত

সকালের আলো যখন ধীরে ধীরে আশ্রমের গায়ে পড়তে শুরু করল, তখন সায়ন্তন প্রথমবার দীর্ঘঘুম থেকে জেগে উঠল একেবারে স্থির মনে। তার শরীর যেন হালকা, মনে হচ্ছিল সে যেন রাতভর ভেসে ছিল কোনও অদৃশ্য স্রোতে, আর ভোরের আলো তাকে ফিরিয়ে আনল এক নতুন সত্তায়। শ্মশানবুড়ির ছোঁয়া যেন তার ভেতরে খুলে দিয়েছিল এক অদ্ভুত দরজা, যেটা এতদিন বন্ধ ছিল। সেই দরজার ওপারে সে দেখতে পেয়েছিল নিজের প্রকৃত চেহারা—সেই সত্তা, যে আদতে মরতে চায়নি, শুধু ভুলভাবে বাঁচতে বাঁচতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। শ্বেতানন্দ এসে ধীর গলায় বলল, “অনেকেই ভাবে আত্মহত্যা একটা শেষ রাস্তা। কিন্তু আসলে সেটা একটা দিশাহীনতার প্রকাশ—একটা ভুল অনুবাদ, যেখানে আত্মা বলতে চায়, ‘এভাবে নয়, অন্যভাবে বাঁচতে চাই।’” সায়ন্তনের মনে পড়ল, কতবার সে নিজেকে বলেছিল, “আমি ব্যর্থ। আমার কিছুই নেই। কেউ নেই।” অথচ এই আশ্রমে, এই তান্ত্রিকদের মাঝখানে, এই আগুনের আলোয় সে খুঁজে পেয়েছে নিজেকে—যেখানে প্রেম ছিল, ভুল ছিল, কিন্তু ছিল আলোও। শুধু সেই আলো দেখতে সে কখনও দাঁড়ায়নি।

ত্রিলোকানাথ সেদিন তাকে নিয়ে গেলেন আশ্রমের এক পুরনো কূপের ধারে। “এই কূপে আমরা নিজেদের মুখ দেখি না,” তিনি বললেন, “আমরা দেখি আমাদের জন্মতত্ত্ব—আমাদের ভয়, আমাদের অভিমান, আমাদের গোপন আকাঙ্ক্ষা।” কূপের জলে সায়ন্তন যখন তাকাল, প্রথমে সে দেখল তার ছোটবেলার ছবি—সে একা একটা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে, মা ব্যস্ত রান্নাঘরে, বাবা অফিসে নেই, হাতে একটা ছেঁড়া বই। সেই দৃষ্টি—একাকীত্বের প্রথম পাঠ। তারপর দৃশ্য বদলাতে লাগল—বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রিয় বন্ধু, যে হঠাৎ বন্ধ হওয়া যোগাযোগে দূরে সরে গিয়েছিল, তার ঠোঁটের কোণে সেই পরিচিত তাচ্ছিল্যের হাসি। এরপর এল তার অফিসের ঘর—সেখানে সে বসে আছে, একের পর এক কল সাড়া দিচ্ছে, অথচ কেউ তার দিকে একবারও তাকাচ্ছে না। সবশেষে এল নয়নিকা—কিন্তু প্রেমিকা হিসেবে নয়, এক আয়নার প্রতিচ্ছবি হিসেবে, যাকে সে ব্যবহার করেছিল নিজের শূন্যতা ভরার জন্য। এই দৃশ্যগুলো তাকে বিদ্ধ করল, অথচ সে সরে এল না। প্রথমবার সে নিজের জীবনকে পুরোপুরি দেখল—সত্যি ও স্বীকারোক্তির আয়নায়। ত্রিলোকানাথ তখন বললেন, “তুই মৃত্যুহীন, সায়ন্তন। কারণ তুই নিজেকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলি, অথচ শেষ পর্যন্ত নিজেকেই চিনতে পেরেছিস। এই চিনেই জীবন।”

ফেরার সময় ঘনিয়ে এলো। সায়ন্তন জানে, সে আর আগের মতো নেই। এই আশ্রম তাকে এমন এক ভিতর দেখিয়েছে, যা কোনো থেরাপি, কোনো ওষুধ, বা সম্পর্ক দেখাতে পারেনি। ত্রিলোকানাথ বললেন, “তুই চাইলে থাকতে পারিস। আমরা তোকে শিখাবো, কীভাবে মানুষের মানসিক মৃত্যু থামানো যায়। কিন্তু তোকে ফিরে যেতেই হবে, কারণ তোকে শুধু নিজেকে নয়, অন্যদেরও ফেরাতে হবে সেই শেষ রাস্তা থেকে।” সায়ন্তন মাথা নাড়ল, তার চোখে এখন আগুনের প্রতিবিম্ব, কিন্তু তার মুখে শান্তি। শ্মশানবুড়ি তখন দূর থেকে শুধু একবার তাকালেন, আর সায়ন্তনের মনে হলো, সেই দৃষ্টি বলছে, “তুই বেঁচে থাকিস, কারণ এখন তুই জানিস—মরার মানে কী নয়।” সে ফিরে চলল, কিন্তু আর সেই ছায়া হয়ে নয়, বরং নিজের আলোর কাছে। তাকে আর কেউ চিনে উঠতে পারবে কি না, জানে না। কিন্তু সে নিজেকে নতুন করে চিনেছে, আর সেই চেনা—এই যাত্রার আসল সার্থকতা।

আট

কলকাতায় ফেরার সময় ট্রেনের জানালার ধারে বসে থাকা সায়ন্তন দেখছিল—পেছনে পড়ে যাচ্ছে মাঠঘেরা নিস্তব্ধতা, গাছগাছালির ফাঁকে হারিয়ে যাচ্ছে শ্মশানবেষ্টিত সেই আশ্রম, সেই ঘন ছায়ায় ঢাকা বন, যেখানে সে মরতে গিয়েছিল কিন্তু ফিরে এল বেঁচে থাকার আলো নিয়ে। বুকের ভিতর এক অদ্ভুত নিঃশব্দ দীপ্তি—না আগুন, না আলো, তবে তাতে উষ্ণতা আছে, স্পষ্টতা আছে। শহরের চেনা কোলাহল, বাসের হর্ন, লোকের ভিড়, কারওর কিছু যায় আসে না—কিন্তু তার চোখে এই ভিড় একেবারে অন্যরকম লাগছিল। সে দেখছিল প্রতিটি মুখে ছাপ—কেউ ক্লান্ত, কেউ হাল ছেড়েছে, কেউ নিজেকে ঠকানো মুখোশ পরে আছে। একসময় যে মানুষটা নিজেও এই ভিড়ে ছিল এক ছায়ার মতো, আজ সে নিজেই আলোর বাহক। তার ব্যাগে কিছু নেই—নয়নিকার ছবি, আত্মহত্যার পত্র, পুরোনো খাম—সব ফেলে এসেছে। শুধু আছে একটা ছোট পিতলের পাত্র, যার ভিতর এক চিমটি শ্মশানছাই। সেটাই তার তাবিজ—তার বেঁচে থাকার স্মারক।

সায়ন্তন প্রথমে গিয়েছিল সেই হাসপাতালের ছাদে, যেখানে সে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সেই রাত, সেই শেষ ধাপ, মনে পড়ছিল তার। কিন্তু এবার সে দাঁড়িয়ে রইল বহুক্ষণ—নীরবে। চারতলার ওপরে সেই বাতাস, সেই আলো—সবকিছু চেনা, তবুও আজ অন্যরকম। এবার সে এক পা এগিয়ে গিয়ে পেছনে ঘুরে তাকাল। মনে হলো, কেউ একটা তার কাঁধে হাত রাখল। সে জানত, কেউ আসলে নেই। কিন্তু অনুভব তো বাস্তবের চেয়েও শক্তিশালী। এরপর সায়ন্তন শুরু করল তার প্রকৃত কাজ—নতুন করে। প্রথমে লিখল একটি খোলা চিঠি—”যারা ভাবো, আর কোনো উপায় নেই, তাদের জন্য।” সেই চিঠি পোস্ট করল অনলাইন ব্লগে, যেখানে সে লিখল তার অভিজ্ঞতার কথা, সেই আশ্রম, ত্রিলোকানাথ, শ্মশানদ্বীপ, শ্মশানবুড়ি, আর নিজের অন্তর্জগতের ভাঙাচোরা অভিজ্ঞতা। সে জানত না, কেউ পড়বে কিনা। কিন্তু কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তার লেখা ভাইরাল হলো। শত শত মন্তব্য, কেউ বলছে, “আপনার লেখা পড়ে আত্মহত্যার ইচ্ছেটা কমে গেছে”, কেউ আবার বলছে, “আমারও একবার দেখা উচিত ছিল শ্মশানের আলো।”

তারপর শুরু করল একটা ছোট মঞ্চ—“শেষ আলো” নামে। একখানা ঘর ভাড়া নিয়ে কিছু চেয়ার, একটু কাগজ-কলম, এক কেটলি চা, আর প্রতিদিন সন্ধ্যায় দরজা খোলা রাখে। কেউ আসলে বসে, কথা বলে, চায়ের কাপ হাতে। কেউ শুধু কাঁদে, কেউ কথা না বলে বসে থাকে। সেখানে সায়ন্তন কিছু শেখায় না, শুধু শোনে। কখনও সে বলে না সে ‘বেঁচে গেছে’; সে শুধু বলে—“আমি একদিন নিজেকেই শেষ করতে গিয়েছিলাম, কিন্তু শেষবেলায় নিজেকেই চিনে ফেলেছিলাম।” ধীরে ধীরে, সেই মঞ্চ শহরের এক কোণায় হয়ে উঠল এক আড়ালহীন স্বীকারোক্তির জায়গা। নয়নিকার কথা কেউ জিজ্ঞেস করে না, কিন্তু তার অভাব বোঝা যায়—সায়ন্তনের প্রতিটা কথা, প্রতিটা চুপ করে বসে থাকা মুহূর্তে তার ছায়া থাকে। সে নিজেও জানে, নয়নিকা আজও আছে—তবে অপরাধবোধে নয়, বরং স্মৃতির নিঃশব্দ স্বীকৃতিতে। একদিন সে তার ডেস্কের ডায়রিতে লিখল—“মৃত্যু আমার কাছে এসেছিল, আমি হাত বাড়িয়েছিলাম। কিন্তু তার আগেই আমি নিজেকে খুঁজে পেলাম। আর তারপর আমি বাঁচতে শিখলাম।”

শেষ

 

1000038711.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *