Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

চতুর্থ প্রজন্ম

Spread the love

চৈতালি লাহিড়ী


এক
প্রতিভার জীবনের প্রথম স্মৃতি যেন সেই গন্ধ—হলুদের, ধূপের, আর নতুন শাড়ির আলতো কলকার। বাল্যবিয়ে তার জন্য ছিল এক নীরব আনুষ্ঠানিকতা, চোখের কোনায় জল জমলেও মন বোঝেনি এর অর্থ। ছোট্ট গ্রামের মাটির বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ির লাল ইটের প্রাচীরের মধ্যে পা রাখার মুহূর্তে সে অনুভব করেছিল পৃথিবীটা কত বড়, আর সেই বড় পৃথিবীতে সে কতটুকু ক্ষুদ্র। প্রতিভার বয়স তখন মাত্র তেরো, বইয়ের পাতায় এখনও তার হাতের গন্ধ লেগে ছিল, অথচ জীবনের নতুন পাঠশালায় তাকে পা রাখতে হলো অনিচ্ছায়। স্বামী অরুণমাধব, দশ বছরের বড়, শুরুর দিকে মুখে কথাই বলতেন না; শ্বশুরবাড়ির রীতিনীতি, শাশুড়ির কড়া চোখ, আর গৃহস্থালির দায়িত্ব একসঙ্গে যেন বুকের উপর বসে ছিল। তবু ধীরে ধীরে প্রতিভা শিখতে লাগল রান্না, অতিথি আপ্যায়ন, আলমারি গোছানো, আর সবচেয়ে বড় শিক্ষা—নীরবে সব সহ্য করা। সেই সময়কার বাংলার গেরস্ত বাড়ির মেয়ে-মানুষের জীবনটাই ছিল যেন বেঁচে থাকাকে অলিখিত শিল্পের মতো ধরে রাখা; অল্প বয়সেই শিখতে হয় সব কিছু মেনে চলা, শিখতে হয় কাঁদলেও ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা আঁকতে। আর প্রতিভা শিখেছিল নিঃশব্দে নিজের যন্ত্রণা ঢেকে রাখতে, কারণ সে জানত এটাই রীতি, এটাই তার নিয়তি।
বছর দুই যেতে না যেতেই প্রতিভার কোল জুড়ে আসে প্রথম সন্তান, তারপর আরেকটি। সংসারের কাজের ফাঁকে সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রতিভা মনে মনে বলত—তোমাদের জন্যই এই সব কষ্টের মানে আছে। স্বামীকে নিয়ে তার কোনো রোম্যান্টিক স্বপ্ন ছিল না, বরং ছিল একরকম দূরত্ব মেশানো নির্ভরতা। স্বামী বাইরে কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন, আর ঘরে প্রতিভা অল্প বয়সে পরিণত হতে বাধ্য হয়েছিল। হঠাৎ এক বর্ষার রাতে অরুণমাধবের জ্বর থেকে সেরে না ওঠা আর একেবারে চলে যাওয়া প্রতিভাকে দাঁড় করিয়ে দেয় এক চরম সত্যের সামনে—এবার থেকে তার একা লড়তে হবে। শ্বশুরবাড়ির সবার চোখে সেই মুহূর্তে সে কেবল একজন বিধবা—যার জীবনের রঙ মুছে গেছে, যার চুলে আর ফুল গাঁথা চলবে না, শাড়ির রঙ হবে সাদা। প্রতিভার ভেতরে তখনও ঝড় চলছিল—ভয়, অভিমান, আর বেদনা মিলে এক অদ্ভুত নীরবতা। কিন্তু কোলের শিশু আর বড় মেয়েটির চোখে তাকিয়ে সে সিদ্ধান্ত নিল, কান্নার সময় নেই; এখন তাকে দাঁড়াতেই হবে। সমাজের চোখে বিধবা মানে অশুভ, অথচ সেই অশুভ পরিচয়ই সন্তানদের জন্য তার লড়াইয়ের অস্ত্র হয়ে উঠল। শ্বশুরবাড়ির দেওয়া ছোট্ট একটি ঘর আর কিছু গয়না বেচে প্রতিভা শুরু করল পাড়ার মেয়েদের সেলাই শেখানো; সমাজের নিয়মের বাইরে গিয়ে হলেও ছেলেমেয়েদের শিক্ষার খরচ জোগাতে হবে—এটাই ছিল তার প্রতিজ্ঞা।
দিনের পর দিন প্রতিভার জীবনের রঙ সাদা হলেও তার মনে লাল-নীল স্বপ্ন বেঁচে ছিল। এক সন্ধ্যায়, যখন বৃষ্টি পড়ছিল ছাদের টিনে, প্রতিভা আলমারি খুলে অরুণমাধবের দেওয়া একখানা লাল পাড়ের ধূসর শাড়ি বের করল। সেই শাড়িটা বিয়ের প্রথম বছরে স্বামী তাকে দিয়েছিলেন, যেটা পরে আর গায়ে তোলার অধিকার নেই বলেই শিখেছিল সে। কিন্তু সেই শাড়ির ভাঁজে লুকানো ছিল তার কৈশোরের শেষ স্মৃতি, প্রথম শিউলি ফোটা ভোরের গন্ধ, আর অরুণমাধবের নিঃশব্দ সান্নিধ্য। প্রতিভা শাড়িটা বুকে চেপে ধরল, চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল কিন্তু গলার স্বর বেরোল না। সেদিন সে বুঝেছিল, সমাজ তার রঙ কেড়ে নিতে পারে, শাড়ি পরার অধিকার কেড়ে নিতে পারে, কিন্তু তার ভেতরের শক্তি আর স্বপ্ন কেড়ে নিতে পারবে না। সেই শাড়িই হয়ে রইল তার জীবনের চিহ্ন, যা সে যত্ন করে রেখে দিল আলমারির তলায়—যেন একদিন তার মেয়ে বা নাতনি সেটা খুঁজে পেয়ে বুঝতে পারে, কেমন ছিল এক নারীর নীরব কিন্তু অনড় লড়াই; যেন তারা বুঝতে পারে জীবনের রঙ শুধু বাইরের নয়, অন্তরেরও। আর এভাবেই প্রতিভা নিজের না বলা গল্প বুনে রাখল ভবিষ্যতের জন্য, এক অদৃশ্য সুতোর মতো, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে যাবে শক্তির উত্তরাধিকার হয়ে।
দুই
অনুরাধা যখন প্রথমবার নিজের হাতে মা প্রতিভার সেই লাল পাড়ের ধূসর শাড়িটা ছুঁয়েছিল, তখন তার বয়স মোটে ষোলো। বিয়ের বয়স এসে গেছে, সমাজ বলছে এখনই মেয়ের গায়ে হলুদ দিয়ে বিদায় দিতে হবে। কিন্তু অনুরাধার চোখ ছিল বইয়ের পাতায়, আর স্বপ্ন ছিল শহরের কলেজের বড় বড় ঘর, উঁচু জানালা দিয়ে আসা রোদ আর বন্ধুদের খিলখিল হাসি। প্রতিভা নীরবে মেয়ের ইচ্ছের কথা শুনেছিল, কিছু বলেনি, শুধু মেয়ের চোখে দেখেছিল সেই আগুন যা সমাজের বাধা ডিঙোতে চায়। শেষমেশ প্রতিভাই শ্বশুরবাড়ির কঠিন মুখগুলোকে সামলে মেয়েকে কলেজে ভর্তি করিয়েছিল, যদিও সমাজের চাপে খুব বেশি দূর যেতে দেয়নি। অনুরাধা পড়াশোনা করল স্নাতক পর্যন্ত, তারপর বিয়ে হলো রমেশের সঙ্গে, যে একেবারে শহরতলির মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ী পরিবার থেকে উঠে আসা এক তরুণ। নতুন সংসারে এসে অনুরাধা প্রথমে একটু স্বস্তি পেয়েছিল; রমেশের মুখে কিছুটা নরম ভাষা ছিল, আর শ্বশুরবাড়ি খুব কঠোর না হলেও প্রত্যাশার ভার কম ছিল না। অনুরাধার শৈশবের ইচ্ছেগুলো ততদিনে কিছুটা নরম হয়ে এসেছে, কারণ এখন তার জীবন জুড়ে রমেশ আর নতুন বাড়ির অজস্র কাজ।
কিন্তু মনটা মাঝে মাঝে অদ্ভুত এক শূন্যতায় ভরে যেত। অনুরাধা একদিন বিকেলে নিজের পুরনো ডায়েরিটা খুলে লিখেছিল, “আমার ইচ্ছেগুলো এখন আর চিলের মতো ডানা মেলে না, তবু ওরা মরে যায়নি।” সংসারে থাকতে শিখেছে সে, শ্বশুর-শাশুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে মুখ বুজে থাকা, রমেশের ব্যবসায়িক চিন্তায় সঙ্গ দেওয়া, মেয়েকে বড় করার স্বপ্ন দেখা—সবই শিখেছে। রমেশ তাকে কখনও অফিসে আনতে বা হিসাব রাখতে ডাকত; অনুরাধা তাতে উৎসাহ পেত, মনে হতো নিজের শিক্ষার দাম কিছুটা হলেও দিতে পারছে। কিন্তু অনেক রাতেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে যখন চাঁদ দেখত, মনে হতো সেই কলেজের বড় বড় জানালা আর বন্ধুদের হাসির মধ্যে একটা ফাঁকা স্থান রয়ে গেছে, যা আর কোনোদিন পূরণ হবে না। তবু সেই ফাঁকা স্থানটাকে মেনে নিয়েই অনুরাধা নিজের নতুন জীবনের রঙ বুনতে থাকে। আরেকটি মেয়ে জন্ম নেয় তার গর্ভে—রোহিণী। মেয়ের চোখে তাকিয়ে দেখে ছোটবেলার নিজের ছায়া। রোহিণীর জন্য আরও ভালো জীবন চায়, চায় মেয়ে যেন স্বপ্নপূরণের পথে এগিয়ে যেতে পারে কোনো বাধা ছাড়াই।
অনুরাধা তখন প্রায় প্রতি রাতে একটুখানি সময় নিজের জন্য রাখত, যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। সেই সময়ে সে লিখত চিঠি—যা কাউকে পাঠাত না—শুধু নিজের মনের কাছে স্বীকারোক্তির মতো। লিখত, “মেয়েকে একদিন বলব, নিজের স্বপ্নের কাছে কখনও দোষ স্বীকার কোরো না।” এই চিঠিগুলো একসময় লুকিয়ে রাখত ট্রাঙ্কের নিচের দিকে, পুরনো জামা আর বইয়ের পাশে। সেই চিঠিগুলোয় অনুরাধা নিজের না-পাওয়ার ব্যথা, স্বপ্নের টুকরো আর রোহিণীর জন্য অগাধ ভালোবাসা বুনে রাখত—যেন একদিন রোহিণী বড় হয়ে যদি এই চিঠিগুলো খুঁজে পায়, বুঝতে পারে মায়ের মনের অজানা গল্প। সমাজের রক্তচক্ষু, শ্বশুরবাড়ির না বলা নিয়ম, স্বামীর ব্যস্ততা—সবকিছুর ভেতরেও অনুরাধা ভেবেছিল, জীবনের মানে শুধু সহ্য করা নয়, বরং স্বপ্নটুকু বাঁচিয়ে রাখা। সেই স্বপ্নই তাকে শিখিয়েছিল হাসতে, আবার কাঁদতেও; আর সেই হাসি-কান্নার রংই হয়তো একদিন রোহিণীর জীবনেও ছাপ ফেলবে—একটি অদৃশ্য সুতোর মতো, যা এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে বয়ে চলে।
তিন
রোহিণীর প্রথম স্মৃতি তার মায়ের মুখ—ম্লান আলোয় বসে ডায়েরির পাতা উল্টানো, চোখের কোণে ক্লান্তির রেখা; আর বারান্দায় দাঁড়িয়ে চুপচাপ চাঁদ দেখা। তখনও ছোট্ট রোহিণী বোঝেনি মায়ের ভেতর লুকোনো স্বপ্ন আর না-পাওয়ার কষ্ট, শুধু অনুভব করেছিল এক রকম অদৃশ্য জেদ, যা বইপড়া আর কেরিয়ারের গল্পে তাকে উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে থাকতে শেখায়। কলেজের দিনগুলোয় রোহিণী অন্য সবার চেয়ে একটু বেশি চুপচাপ, কিন্তু মনের মধ্যে আগুন ছিল স্পষ্ট—তাকে নিজের মতো করে বাঁচতেই হবে, নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস, ক্যাম্পাসের কোলাহল, আর প্রথম চাকরির ইন্টারভিউ—সবই একটার পর একটা লাফিয়ে আসছিল তার জীবনে। মা অনুরাধা তাকে বারবার বলতেন, “ভয় পাস না, যা চাস, সেটা নে,” আর সেই কথাগুলো রোহিণীর বুকের ভেতরে গেঁথে যেত। কিন্তু জীবনের গল্প কখনও সহজ হয় না; স্বপ্ন যত উঁচুতে ওড়ে, বাস্তবতার টান তত তীব্র হয়ে টানে নিচে। প্রথম চাকরি পাওয়ার পর রোহিণী খুব দ্রুতই বুঝেছিল—নারী হিসেবে তাকে শুধু কাজের যোগ্যতা নয়, বারবার প্রমাণ করতে হবে যে সে সত্যিই এই জায়গায় থাকার উপযুক্ত। প্রতিদিনের ছোট ছোট লড়াই, সহকর্মীদের হালকা ব্যঙ্গ, গোপন চোখের ইঙ্গিত—সবকিছুর মধ্যেও সে দাঁড়িয়েছিল নিজের মতো করে, হাসি চেপে, চোখে কঠোর দৃঢ়তা নিয়ে।
বছর কয়েক পর প্রেম, বিয়ে, আর নতুন জীবনের স্বপ্ন woven হল—মনে হলো এবার জীবনের সব লড়াইয়ে জিতেছে। স্বামী রাহুলের সঙ্গে প্রথম দিকে সবই স্বপ্নের মতো লাগছিল, কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই টের পেল, সংসার মানেই দুইজনের ইচ্ছের সমান ভারসাম্য নয়। অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত শরীরে রান্নাঘরে দাঁড়ানো, মেয়ের জন্য রাত জাগা, সকালে মিটিংয়ের প্রস্তুতি—সব মিলিয়ে নিজের জন্য সময়ই থাকত না। ধীরে ধীরে রাহুল আর তার মধ্যে দূরত্ব তৈরি হতে লাগল, ঝগড়া বাড়তে লাগল, আর একদিন সম্পর্ক শেষ হয়ে গেল কাগজের সইয়ে। চারপাশের মানুষের দৃষ্টি, “ডিভোর্সি” তকমা, একা মেয়েকে মানুষ করার দ্বায়িত্ব—সব মিলিয়ে রাতের পর রাত নিঃশব্দ কান্না ছিল তার একমাত্র সঙ্গী। তবু রোহিণী হাল ছাড়েনি। একদিন মা অনুরাধার সেই পুরনো চিঠিগুলো খুঁজে পেয়ে পড়েছিল; সেই চিঠিতে মায়ের লুকানো স্বপ্ন, ভালোবাসা আর অনুতাপের কথা। সেদিন রোহিণী যেন নতুন করে নিজেকে চিনল; মা শুধু মা নয়, একসময় স্বপ্ন দেখা এক মেয়ে ছিল।
রোহিণী ঠিক করল, নিজের জীবন শুধু ব্যথা আর ভাঙনের গল্প হবে না; হবে শক্তির, পুনর্গঠনের, আর নতুন করে গড়ে তোলার কাহিনি। অফিসের দায়িত্ব বাড়ল, নতুন প্রজেক্টের লিডার হলো, রাত জাগা কমল না, তবু সে হাসতে শিখল—কারণ এখন সে জানে, তার হাসি শুধু তার নয়, তার মেয়ে ঈশিতার জন্যও বাঁচিয়ে রাখতে হবে। অফিসের এক বন্ধু একদিন বলেছিল, “তুমি এত শক্ত কীভাবে হলে?” রোহিণী শুধু মৃদু হেসেছিল, মনে মনে ভেবেছিল—এই শক্তি এসেছে ঠাকুমা প্রতিভার নিঃশব্দ লড়াই থেকে, মায়ের অজানা চিঠি থেকে, আর নিজের বুকের গভীরে লুকানো সেই আগুন থেকে, যা কখনও নিভে যায়নি। রাতে যখন মেয়ে ঈশিতাকে গল্প শোনাত, কখনও সে খোলাখুলি বলত না নিজের জীবনের ব্যথার কথা, কিন্তু ঈশিতার চোখে সে দেখত সেই একই রকম আগুনের ঝলক। আর সেদিনই সে বুঝত, শক্তি আসলে উত্তরাধিকার—যা মা থেকে মেয়ে, নাতনির চোখে গিয়ে পৌঁছায় এক অদৃশ্য সুতোর মতো, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ছুঁয়ে থাকে। আর এই বোধই রোহিণীর জীবনের আলোকপথ, যা তাকে অন্ধকারে হারিয়ে যেতে দেয় না।
চার
ঈশিতার প্রথম বড় হওয়ার গল্প শুরু হয়েছিল এক সন্ধ্যায়, যখন সে মায়ের বইয়ের আলমারি ঘাঁটতে গিয়ে হঠাৎ একটা হলুদ হয়ে যাওয়া খামের মধ্যে পায় কিছু চিঠি আর পুরনো একখানা শাড়ির অংশ—লাল পাড়ের ধূসর কাপড়, যার গন্ধে ভিজে ছিল অচেনা স্মৃতির গন্ধ। তখন তার বয়স কেবল আঠারো, তবু সেই স্পর্শেই মনে হয়েছিল যেন শত বছরের পুরনো কোনো কাহিনির সঙ্গে হঠাৎ দেখা। মায়ের লেখা ডায়েরির পাতায় চোখ বুলিয়ে ঈশিতা পড়েছিল না-পাওয়ার কথা, স্বপ্নভঙ্গের ব্যথা আর সেই ব্যথার ভেতরেও মেয়েকে শক্ত রাখার অনুরোধ। আরেকটু পরে ট্রাঙ্কের তলায় পেয়ে গিয়েছিল দিদিমা অনুরাধার হাতে লেখা চিঠি, যেখানে লেখা ছিল “ভয় পাস না, যা চাস, সেটা নে।” আর তারও নিচে প্রায় রঙ ম্লান হয়ে আসা ঠাকুমা প্রতিভার শাড়ির ভাঁজ, যা কখনও পরা হয়নি কিন্তু কখনও ফেলে দেওয়া হয়নি। সেই মুহূর্তে ঈশিতা বুঝতে পেরেছিল, এই শাড়ি আর চিঠিগুলো শুধু কাপড় আর কাগজ নয়; এরা আসলে চার প্রজন্মের নারীর মধ্যে থাকা এক অদৃশ্য বন্ধন, যা রক্তের থেকেও গভীর, শব্দের থেকেও শক্ত। নিজের ছোট নোটবুকটা খুলে সে প্রথমবার লিখেছিল: “আমিও একদিন এই গল্পের অংশ হবো।” সেই নোটবুকের পাতাগুলো ধীরে ধীরে ভরে উঠল না বলা কথায়—প্রজন্মের গল্প, নিজের ভয়, রাগ, ভালোবাসা আর প্রশ্নে।
কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় বা ক্লাসের গুনগুন কথার ফাঁকে ঈশিতা ভাবত, কেন তার মনে হয় সে কেবল নিজের জন্য নয়, বরং আরও কারও জন্য বাঁচছে? রাত জাগা ঘুমহীন সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রল করতে করতে কখনও নিজের শরীর নিয়ে কটুক্তি, কখনও নিজের মত প্রকাশের জন্য ট্রল আর ঘৃণার মুখে পড়তে হয়েছিল। মনে হয়েছিল সমাজের চোখে নারী মানেই এখনো বিচারযোগ্য, এখনো শর্তসাপেক্ষ। কিন্তু ঈশিতা একা লড়াই বন্ধ করেনি; নিজের নোটবুকের পাতায় সে লিখেছিল, “ভুল করলে লজ্জা নয়, শিখে নিয়ে আবার দাঁড়াতে হয়।” সেই নোটবুকই হয়ে উঠেছিল তার সবচেয়ে আপন সঙ্গী—যেখানে সে নিজের ভাঙা স্বপ্নের কথা যেমন লিখত, তেমনি লিখত নতুন স্বপ্ন বোনার কথাও। মায়ের চোখে দেখা শক্তি আর দিদিমার চিঠিতে লেখা বিশ্বাসের গল্প তাকে শিখিয়েছিল ভেঙে পড়লে আবার উঠতে হয়। এমনও দিন গেছে, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনে বসে বন্ধুরা জোরে জোরে হাসছে, আর ঈশিতা চুপচাপ নোটবুকের পাতায় শুধু একটা লাইন লিখেছে: “আমি কখনও একা নই, আমার সঙ্গে আছে তিন প্রজন্মের না বলা গল্প।”
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই নোটবুকের পাতাগুলো শুধু ব্যক্তিগত ডায়েরি হয়ে থাকেনি; ঈশিতার জীবনের মানে হয়ে উঠেছিল। সে ভাবত, একদিন এই গল্পগুলো নিয়ে লিখবে একটা বই—যা হবে শুধু ঠাকুমা প্রতিভার শাড়ি, দিদিমা অনুরাধার চিঠি আর মায়ের ডায়েরির কথা নয়; হবে তাদের লড়াই, শক্তি আর ভালোবাসার ইতিহাস। রাতের আকাশের তারা গুনতে গুনতে ঈশিতা ভাবত, গল্পের আসল মানে হয়তো গল্প নয়, বরং সেই বন্ধন—যা মানুষকে একত্র রাখে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে যায়। আর সেই অদৃশ্য বন্ধনই একদিন তাকে বলবে, “লিখে ফেল, যেন আমরা ভুলে না যাই।” তাই ঈশিতা নিজের নোটবুকে শেষ লাইনটায় লিখল: “আমিও এই চতুর্থ প্রজন্মের এক উত্তরাধিকারী, আর আমার কলমই হবে সেই সুতোর মতো, যা গল্পগুলোকে বাঁচিয়ে রাখবে।”
পাঁচ
ঈশিতা যেদিন পুরনো কাঠের ট্রাঙ্কটা পুরোপুরি টেনে বার করল, সেদিন জানল না কী খুঁজছে, শুধু মনে হচ্ছিল ওখানে লুকানো আছে এমন কিছু যা তার নিজেরও অজানা, অথচ গভীরভাবে নিজেরই অংশ। ট্রাঙ্ক খুলতেই প্রথমে ধুলো উড়ল, আর সেই ধুলোয় যেন ভেসে উঠল কয়েক প্রজন্মের দীর্ঘশ্বাস আর স্বপ্নের ছায়া। ভেতরে রাখা ছিল ঠাকুমা প্রতিভার লাল পাড়ের ধূসর শাড়ি, যা কখনও আর পরা হয়নি; দিদিমা অনুরাধার নিজের হাতে লেখা অজস্র চিঠি, যা কাউকে পাঠানো হয়নি; আর মায়ের ডায়েরি, যেখানে ভাঙা সম্পর্ক, একলা মায়ের দুঃখ, আর না বলা কথার ভার লুকিয়ে ছিল। ঈশিতা প্রথমে শাড়িটা বুকে চেপে ধরল, চোখ বন্ধ করে একটা পুরনো দিনের গন্ধ টের পেল—যেন কোনো অদৃশ্য হাত তার পিঠে হাত রাখল, বলল, “ভয় পাস না, তুই একা নস।” শাড়ির ভাঁজে আঙুল চালিয়ে সে অনুভব করল সেই নীরব লড়াই, যে লড়াই ঠাকুমাকে শিখিয়েছিল কিভাবে সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের অশ্রু গোপন করতে হয়। মনে হলো প্রতিটি সুতোর ফাঁকে লুকিয়ে আছে এমন সব গল্প, যা উচ্চারিত হয়নি কখনো, কিন্তু রয়ে গেছে উত্তরাধিকারে।
তারপর ঈশিতা তুলল দিদিমা অনুরাধার চিঠি—হাতের লেখা খানিক কাঁপা, কালো কালি ফিকে হয়ে গেছে, তবু প্রতিটি শব্দ যেন আজও স্পষ্ট। চিঠিগুলোয় বারবার ফিরে আসা কথা—নিজের মেয়ের জন্য ভালো চাওয়া, নিজের না-পাওয়ার দুঃখ, আর সমাজের চোখ রাঙানির মধ্যে থেকেও স্বপ্ন দেখতে শেখানোর কথা। ঈশিতা পড়তে পড়তে টের পেল, এই চিঠিগুলো আসলে দিদিমার একান্ত বন্ধুর মতো ছিল, যেখানে তিনি নিজের কষ্ট আর ভয়ের কথা লুকিয়ে রাখতেন, কারণ কারও কাছে প্রকাশ করার মতো সময় বা সাহস ছিল না। সেই অজানা পাঠক আসলে ছিলেন ভবিষ্যতের কেউ, যাকে তিনি কখনও দেখেননি, তবু জানতেন, একদিন কেউ পড়বে আর বুঝবে। ঈশিতা হঠাৎ আবিষ্কার করল, সেই “ভবিষ্যতের কেউ” আর কেউ নয়—সেই নিজেই। চোখে জল এল, তবু সে মুছল না; কারণ এই জল কষ্টের নয়, বরং এক রকম আত্মীয়তার, যা জন্মের বহু আগেই বোনা হয়েছিল কাগজের অক্ষরে, শাড়ির ভাঁজে আর নিঃশব্দ বিশ্বাসে।
সবশেষে ঈশিতা তুলল মায়ের ডায়েরি—সবচেয়ে কাছের, তবু সবথেকে অজানা। পাতায় পাতায় লেখা ছিল জীবনের টুকরো গল্প: প্রথম প্রেম, প্রথম চাকরির উত্তেজনা, বিয়ের পর স্বপ্নভঙ্গ, আর একলা মা হয়ে ওঠার নীরব যুদ্ধ। মা কখনও এই গল্পগুলো ঈশিতাকে বলেনি, তবু লেখা ছিল যেন একদিন মেয়েই পড়ে বুঝবে। সেই ডায়েরির শেষ পাতায় মা লিখেছিল: “তুই একদিন বুঝবি, ভাঙা স্বপ্ন দিয়ে নতুন স্বপ্ন গড়া যায়।” ঈশিতা তখন মনে মনে বলেছিল, “হ্যাঁ মা, আমি বুঝতে শুরু করেছি।” ট্রাঙ্কের সবকিছু গুছিয়ে রেখে ঈশিতা জানালার পাশে বসে ছিল অনেকক্ষণ, মাথায় ঘুরছিল শাড়ির গন্ধ, চিঠির শব্দ, আর ডায়েরির অক্ষর—সব মিলিয়ে এক রকম স্মৃতির কৌটো, যা শুধু অতীত নয়, বরং বর্তমান আর ভবিষ্যতের সঙ্গী। আর সেদিনই ঈশিতা ঠিক করেছিল, এই কৌটোর গল্প একদিন সে নিজের ভাষায় লিখবেই, যেন নতুন প্রজন্ম জানে, কীভাবে শক্তি আর স্বপ্ন জন্মায় না বলা গল্পের ভিতরে লুকিয়ে থাকা অদৃশ্য সুতোর মধ্যে দিয়ে।
ছয়
ঈশিতা বুঝতে শুরু করেছিল জীবনের আসল গল্প কখনও শুধু নিজের নয়, বরং সেই গল্পে লুকিয়ে থাকে আরও অনেকের নিশ্বাস, না বলা কথা আর চোখের কোণ ভিজিয়ে ফেলা ব্যথা। এক রাতে জানালার ধারে বসে যখন সে ট্রাঙ্ক থেকে বের করা শাড়িটা কোলে নিয়ে বসেছিল, মনে হচ্ছিল ঠাকুমা প্রতিভা যেন পাশে বসে আছে, চোখে সেই নিঃশব্দ দৃঢ়তার ছাপ নিয়ে বলছে, “আমার সময়েও ভয় ছিল, তবু থামিনি।” ঠাকুমা যে লাল পাড়ের ধূসর শাড়িটা নিজের কাছে আগলে রেখেছিল, তা শুধু শাড়ি নয়—তা ছিল ঠাকুমার ভালোবাসা, স্বপ্ন আর সমাজের চোখে অবজ্ঞার বিরুদ্ধে ছোট্ট এক প্রতিরোধ। ঈশিতা সেই সুতোর ভেতর অনুভব করল একধরনের টান, যা সময়ের সীমারেখা অতিক্রম করে পৌঁছে গেছে তার নিজের বুকের ভেতর। শাড়িটা বুকে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করতেই যেন শুনতে পেল এক অচেনা গান, যেটা ঠাকুমা হয়তো নিজের মনে গুনগুন করে গাইত, সন্তানদের জন্য, নিজের জন্য, আর সেই অদৃশ্য সুতোর জন্য যা তাকে বাঁচিয়ে রাখত। ঠাকুমার নীরব লড়াই ছিল না বলা গল্পের মতো—যেখানে কথা কম, কিন্তু শক্তির স্পর্শ ছড়িয়ে আছে প্রতিটি ভাঁজে।
তারপর দিদিমা অনুরাধার চিঠির দিকে চোখ পড়তেই ঈশিতা যেন অনুভব করল সেই অজানা কথোপকথন, যা কখনও শোনেনি, তবু বারবার নিজের ভেতরে শুনতে পায়। চিঠির কাগজে স্পষ্ট লিপি, কখনও কিছু শব্দ মুছে গেছে জল পড়ে, তবু সেই অক্ষরের ফাঁকে লুকিয়ে আছে এক মেয়ের স্বপ্নভঙ্গের ব্যথা আর তবু মেয়ের জন্য নতুন স্বপ্ন দেখার সাহস। ঈশিতা কল্পনা করল, কেমন করে দিদিমা প্রতিদিন রাতের আঁধারে এই চিঠিগুলো লিখত, আর ভোরের আলো আসার আগেই লুকিয়ে রাখত ট্রাঙ্কের তলায়, যেন এই না বলা কথাগুলো থেকে যায় শুধু ভবিষ্যতের জন্য। সেই অদৃশ্য সুতোর টানই দিদিমাকে শক্তি দিয়েছিল, আর সেই সুতোর গায়েই গাঁথা ছিল মায়ের জীবনের গল্প। মা রোহিণীর ডায়েরির পাতায় ঈশিতা দেখেছিল নিজের মায়ের ভেতরের ভাঙন আর আবার জোড়া লাগানোর চেষ্টা। ডায়েরির প্রতিটি লাইনে ছিল কষ্ট, কিন্তু সেই কষ্টের মধ্যেও ছিল আলোর মতো জেদ—যা বলত, “তুই একদিন বুঝবি, সবটাই শেষ হয়ে যায় না।” ঈশিতা বুঝতে পারল, এই অদৃশ্য সুতোর টান আসলে কেবল গল্প নয়, এটা এক ধরনের শক্তি, যা ভেঙে পড়লেও আবার গড়ে তোলে।
শেষ রাতে ঈশিতা ট্রাঙ্কের সবকিছু গুছিয়ে আবার আলমারির তলায় রেখে দেয়নি, বরং নিজের টেবিলের কাছে রেখে দিল, যেন প্রতিদিন চোখে পড়ে, প্রতিদিন মনে পড়ে সেই অদৃশ্য টানের কথা। নোটবুকে সে লিখল, “আমার শিরায় বয়ে চলে সেই সুতোর গল্প, যা ঠাকুমা বুনেছিলেন নীরব কান্নায়, দিদিমা লিখেছিলেন না পাঠানো চিঠিতে, আর মা রেখেছিলেন অজানা স্বপ্নের ভাঁজে।” সে বুঝল, এই টান কখনও তাকে একা হতে দেবে না, কারণ এই টানেই লুকিয়ে আছে উত্তরাধিকার, এই টানেই লুকিয়ে আছে সেই ভালোবাসা যা সময়কে অতিক্রম করে। আর সেদিনই ঈশিতা ঠিক করল, একদিন এই গল্পগুলো লিখে ফেলবেই—শুধু নিজের জন্য নয়, বরং সেই সব মেয়েদের জন্যও যারা এখনও লড়ছে, যারা হয়তো একদিন এই শাড়ি, এই চিঠি আর এই ডায়েরির মতোই নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখবে নিজের না বলা কথা, কিন্তু হার মানবে না। কারণ অদৃশ্য সুতোর টানই শেখায়, হার মানা নয়—যত ভাঙা হোক, আবার জোড়া লাগানো যায়।
সাত
ঈশিতা সবসময় ভেবেছিল, বড় হয়ে ঠিক মায়ের মতো হবে না—মায়ের চোখে যে অব্যক্ত ক্লান্তি, নিজের স্বপ্নকে একপাশে সরিয়ে দেওয়ার অভ্যাস, সেইটা সে নিজের মধ্যে আনতে চায়নি। কিন্তু যত বড় হতে থাকল, তত বুঝতে পারল মায়ের জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্ত, প্রতিটি ত্যাগ আসলে তার জন্যই ছিল, মায়ের নিজের জন্য নয়। এক সন্ধ্যায়, মা আর মেয়ের মধ্যে প্রথমবার খোলাখুলি কথা হয়েছিল—মায়ের চোখে সেই চেনা ক্লান্তির ছায়া, তবু ঈশিতার প্রশ্নে এক নতুন ভোরের মতো নরম আলোর রেখা ফুটে উঠেছিল। ঈশিতা বলেছিল, “তুমি কেন নিজের স্বপ্নগুলো শেষ পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখলে না?” মা চুপ করে থেকে বলেছিল, “কারণ তোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য স্বপ্নের চেয়ে বড় কিছু তখন আর ছিল না।” সেই জবাব শুনে ঈশিতা প্রথমবার অনুভব করেছিল, মায়ের মতো হওয়া মানে নিজের স্বপ্ন ভুলে যাওয়া নয়, বরং নিজের স্বপ্নের ভেতরেও আরেকজনকে জায়গা করে নেওয়া। মা যেমন একসময় নিজের ভাঙা সম্পর্কের কষ্টের মধ্যে থেকেও মেয়েকে হাসিখুশি মানুষ করতে পেরেছিল, তেমনি ঈশিতা ঠিক করল, ওর নিজের পথ হবে আলাদা, তবু সেই পথের মাটিতে লেগে থাকবে মায়ের চোখের জলের গন্ধ।
কয়েক মাসের মধ্যে ঈশিতার বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষ, thesis এর চাপ, আর নতুন করে তৈরি হওয়া সম্পর্কের টানাপোড়েন সব মিলিয়ে জীবনটা জট পাকাতে লাগল। কখনও মনে হতো, যদি মা থাকত না পাশে, যদি তার সেই শান্ত গলা আর চোখের ভেতরকার আলো না দেখত, তবে হয়তো হার মানত। কিন্তু মা একদিন রাতে নীরবে এসে বলেছিল, “তুই আমার মতো হবি না, নিজের মতো হবি, তবু নিজের ভিতরে একটু একটু করে আমাকেও রাখবি।” সেই রাতে ঈশিতা বারান্দায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভেবেছিল, সত্যিই তো, মা থেকে শেখা মানে শুধু তাঁর ভুলগুলো এড়িয়ে চলা নয়, তাঁর জেদের, ধৈর্যের, আর ভালোবাসার উত্তরাধিকারও নিজের মধ্যে বয়ে নিয়ে চলা। নোটবুকে লিখেছিল, “মায়ের মতো হতে চাইনি, তবু মায়ের থেকে শেখা ছাড়া থাকতেও পারি না।” সেই লাইনগুলো লিখতে লিখতে চোখ ভিজে গিয়েছিল, কারণ সে টের পেয়েছিল, সম্পর্কের গভীরতায় কখনও স্পষ্ট সীমারেখা থাকে না; বরং থাকে অদৃশ্য টান, যা তর্ক, রাগ, অভিমান সব পেরিয়ে গিয়ে একসময় বোঝায় যে মায়ের হাতের স্পর্শ আর চোখের সেই চেনা দৃঢ়তা ছাড়া পৃথিবীটা অনেক বেশি অচেনা হয়ে যায়।
পরদিন সকালেই ঈশিতা মায়ের সঙ্গে ট্রাঙ্কের সব স্মৃতি গুছিয়ে বসেছিল—ঠাকুমার শাড়ি, দিদিমার চিঠি আর মায়ের ডায়েরি। মা সেই শাড়িটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর হেসে বলল, “জানি, একদিন তোর মেয়েও এটাই খুঁজবে।” তখন ঈশিতা অনুভব করেছিল, এই উত্তরাধিকার আসলে শুধু রক্তের নয়, গল্পেরও। মায়ের মতো নয়—মানে নিজের মতো স্বপ্ন দেখতে শেখা, কিন্তু মায়ের থেকে শেখা মানে সেই স্বপ্নে সম্পর্কের উষ্ণতাও জড়িয়ে রাখা। মা আর মেয়ের সেই চুপচাপ বসে থাকা মুহূর্তটুকুই যেন হয়ে উঠেছিল সবচেয়ে সত্য, সবচেয়ে শক্ত স্মৃতি। আর ঈশিতা জানত, একদিন যদি কখনও নিজের গল্প লিখে শেষ করে, সেই গল্পের মূল সুরটুকু হবে এইটুকুই—মায়ের মতো নয়, তবু মায়ের থেকে শেখা; কারণ মায়ের গল্প শেষ হয় না, বরং নীরবে আরেক প্রজন্মের গল্পের প্রথম লাইন হয়ে যায়।
আট
ঈশিতা একদিন বইয়ের তাক গোছাতে গিয়ে হঠাৎ থমকে গেল—হাতে ধরা ছিল নিজের সেই নোটবুক, যেখানে শুরুর পাতায় লেখা ছিল, “আমি একদিন এই গল্পের অংশ হবো।” নোটবুকের পাতাগুলো এখন প্রায় ভরে এসেছে; তাতে ঠাকুমা প্রতিভার নীরব লড়াই, দিদিমা অনুরাধার চিঠির ব্যথা আর মায়ের চোখের ভেতর লুকোনো স্বপ্নের কথা লেখা আছে। সেই লেখাগুলো শুধু স্মৃতি নয়, বরং এক ধরনের বোধ—যা বুঝিয়েছে, জীবনের গল্প কখনো একা লেখা যায় না, কারণ জীবনের রঙ, শব্দ আর নীরবতা সবই তৈরি হয় পূর্বসূরীদের গল্পের ছায়ায়। ট্রাঙ্কের সেই শাড়ি আর চিঠিগুলোকে ঈশিতা আর আলমারির গহিনে লুকিয়ে রাখেনি; বরং নিজের টেবিলের উপরেই রাখত, যেন প্রতিদিন চোখে পড়ে, মনে থাকে এই শিকড়ের কথা। কারণ ঈশিতা জানত, এই উত্তরাধিকার শুধু ধনসম্পত্তির নয়, এই উত্তরাধিকার আসলে স্বপ্নের, শক্তির আর ভাঙা স্বপ্ন থেকে নতুন স্বপ্ন গড়ার গল্পের। এক রাতে বারান্দায় বসে বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ শুনতে শুনতে ঈশিতা লিখেছিল, “আমার শিরায় বয়ে চলে সেই অদৃশ্য সুতোর গল্প, যা একদিন হয়তো আমার মেয়েও অনুভব করবে।” সেই লাইনগুলো লিখে ঈশিতার মনে হয়েছিল, যেন শতাব্দীর পুরনো এক অদৃশ্য হাত তার মাথায় হাত রাখছে, আর বলছে—“তুই একা নস, আমরা তোর সঙ্গেই আছি।”
এরপর আস্তে আস্তে ঈশিতা বুঝেছিল, ঠাকুমা প্রতিভা, দিদিমা অনুরাধা আর মা রোহিণী প্রত্যেকেই তাদের জীবনে সমাজের চোখ রাঙানি, কুসংস্কার আর হারানোর ভয় পেরিয়েও নতুন করে গড়তে শিখিয়েছে। ঠাকুমার লাল পাড়ের ধূসর শাড়ি ছিল নীরব প্রতিবাদ, দিদিমার না পাঠানো চিঠিগুলো ছিল নিজের কষ্ট স্বীকার করার সাহস, আর মায়ের ডায়েরি ছিল স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার পরেও নতুন করে স্বপ্ন দেখার অনুরোধ। ঈশিতা যখন নিজের জীবনের টানাপোড়েনে জড়িয়ে পড়ত, তখন এই উত্তরাধিকারই তাকে বারবার টেনে তুলত। চাকরির ইন্টারভিউর আগে আতঙ্কে বুক কাঁপত, নতুন সম্পর্ক গড়ার সময় মনে হতো আবার হারিয়ে যাবে না তো? কিন্তু তখনই মনে পড়ত মায়ের সেই লাইন—“তুই একদিন বুঝবি, সবটাই শেষ হয়ে যায় না।” এই উত্তরাধিকার তাকে শিখিয়েছিল ভাঙা স্বপ্নই শেষ কথা নয়, বরং নতুন স্বপ্ন গড়ার উপাদান। আর এই ভাবনাটাই একদিন তাকে নিজের প্রথম বই লিখতে সাহস দিয়েছিল—যেখানে সে লিখেছিল তাদের গল্প, যারা হয়তো ইতিহাসের পাতায় নেই, তবু প্রতিটি প্রজন্মকে আলো দেখায়।
শেষ পাতায় ঈশিতা লিখেছিল, “এই গল্প শুধু ঠাকুমা, দিদিমা আর মায়ের নয়; এই গল্প আমারও, আর একদিন আমার মেয়েরও হবে।” বইয়ের খাম বন্ধ করার সময় তার মনে হয়েছিল, এই উত্তরাধিকার এখন আর শুধু শাড়ি বা চিঠিতে সীমাবদ্ধ নয়; এখন তা রক্তের মতো, নিঃশ্বাসের মতো, প্রতিটি শব্দের মধ্যে বেঁচে থাকবে। সেই মুহূর্তে ঈশিতা জানত, গল্পের আসল শক্তি গল্পের মধ্যে নয়, গল্প বাঁচিয়ে রাখার ইচ্ছের মধ্যে থাকে। আর সেই ইচ্ছা, সেই অদৃশ্য সুতোর টানই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে চলে, কখনও থামে না, কখনও শেষ হয় না। সেদিন আকাশের দিকে তাকিয়ে ঈশিতা মৃদু হেসেছিল, কারণ সে জানত—হারানোর ভয় যতই বড় হোক, উত্তরাধিকার সবসময় বেঁচে থাকে, কারণ ভালোবাসা আর স্বপ্ন কখনও মরে না।

1000034538.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *