অর্ঘ্য দত্ত
অধ্যায় ১: অজানা উত্তরাধিকার
তীর্থর জীবনের সেই দিনটি যেন অন্য সব দিনের মতোই শুরু হয়েছিল, অথচ শেষ হয়েছিল এমন এক ঘটনার মধ্যে যা তার ভাবনার সীমার অনেক বাইরে। সকালে কলেজের ক্লাস শেষ করে বিকেলে বাড়ি ফিরতেই কাকা এসে বলল, দাদুর পুরনো ঘরের জিনিসপত্র কিছু বাছাই করতে হবে, আর সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তীর্থকে, কারণ দাদু নাকি প্রায়ই বলতেন কিছু জিনিস কেবল তার প্রিয় নাতির হাতেই থাকা উচিত। দাদুর সেই ঘরটায় ঢুকতেই তীর্থর মনে হল যেন পুরনো কালের গন্ধে ভিজে আছে প্রতিটি দেয়াল, প্রতিটি আসবাব। টালির চালের নীচ দিয়ে হালকা আলো এসে পড়ছে ধুলো জমা ট্রাঙ্ক আর বুকশেলফের ওপরে। পুরনো ফাইল, দামী পেপারওয়েট আর কাঁচের আলমারির ভেতর বইপত্র সরিয়ে অবশেষে এক কোণে চোখে পড়ল একটা কাঠের বাক্স, উপরে খোদাই করা হাতির দাঁতের কাজ, আর তার গায়ে অল্প মলিন সোনালি রঙের একটি চিহ্ন—যা দেখতে অনেকটা চতুরঙ্গ বা দাবার ঘুঁটির মতো। বাক্সটি হাতে নিয়ে তীর্থ বোঝার চেষ্টা করল এর ওজন বেশ ভারী, আর সেটা খোলার সময় তার মনে হচ্ছিল যেন এই বাক্সের ভেতর শুধু কাঠ আর দাঁত নয়, লুকিয়ে আছে দাদুর জীবনের কোনো না কোনো গল্প। ঢাকনাটা তুলেই তীর্থর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল—ভেতরে সাজানো আছে এক অদ্ভুত সুন্দর হাতির দাঁতের চতুরঙ্গ সেট, প্রতিটি ঘুঁটি যেন শিল্পীর নিখুঁত হাতে গড়া, আর তাদের নীচে হালকা নকশা করা। তীর্থ যখন সেই ঘুঁটিগুলো এক এক করে তুলছিল, দেখতে পেল তাদের তলার দিকে খোদাই করা কিছু অক্ষর আর চিহ্ন, যেগুলো আগে কোনো দিন দেখেনি। কেন জানি না, তার মনে হল এগুলো নিছক শৌখিন নকশা নয়, এর ভেতরে লুকিয়ে থাকতে পারে কিছু গোপন বার্তা।
সন্ধ্যা নামার আগেই তীর্থ চতুরঙ্গ সেট নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে আসে, আর নিজের ডেস্ক ল্যাম্পের আলোয় বসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে প্রতিটি ঘুঁটি। রাজা, রানী, উট, ঘোড়া—সবগুলোর নীচে ছোট ছোট অক্ষর, অঙ্ক আর কখনো এক অদ্ভুত আকারের চিহ্ন খোদাই করা। তীর্থর মাথায় ঘুরতে থাকে, হয়তো দাদু তার জন্য রেখে গিয়েছেন কোনো ধাঁধা বা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া কোনো রহস্য, যা খোলার চাবি এই চতুরঙ্গের চালের মধ্যে লুকিয়ে আছে। ঠিক সেই সময়ে তীর্থর চোখ যায় বাক্সের ঢাকনার ভেতর দিকের এক কোণে, যেখানে লেখা আছে ইংরেজিতে ছোট্ট একটা লাইন—“Look beyond the move to see the truth.” এই লাইনটি যেন তীর্থর মধ্যে এক নতুন উত্তেজনার জন্ম দেয়, আর সে ভাবতে থাকে এই বাক্যটি কীভাবে চতুরঙ্গের সাথে সম্পর্কিত হতে পারে। হয়তো এই বাক্স বা ঘুঁটিগুলোর ভেতরেই লুকিয়ে আছে এমন কিছু, যা সরাসরি চোখে পড়ে না। তীর্থর কৌতূহল ক্রমশ বেড়ে যায়, আর সেই রাতেই সে সিদ্ধান্ত নেয়, যতদূর সম্ভব রহস্যের ছায়া সরে যেতেই হবে, জানতে হবে দাদুর রেখে যাওয়া এই অদ্ভুত উত্তরাধিকার আসলে কী লুকিয়ে রেখেছে।
রাত তখন বেশ গাঢ় হয়েছে, জানলার বাইরে হালকা কুয়াশা জমতে শুরু করেছে। তীর্থ যখন আবার একবার চতুরঙ্গ সেটের দিকে তাকায়, মনে হয় যেন ঘরের অন্ধকারের মধ্যেই কোথাও থেকে তাকে দেখছে কোনো অদৃশ্য চোখ। এক অজানা ভয়ে বুক ধড়ফড় করতে থাকে, তবু কৌতূহল তাকে থামায় না। ঠিক তখনই, হঠাৎ তীর্থর মন পড়ে দাদুর সেই পুরনো নোটবইয়ের কথা, যেটা সে একবার দেখেছিল আলমারির এক কোণায়। দাদু প্রায়ই লিখতেন ইতিহাস, গল্প আর পারিবারিক কাহিনির নানা টুকরো টুকরো কথা। হয়তো সেই নোটবইতেই আছে কোনো সূত্র, যা চতুরঙ্গের গোপন রহস্যের কাছে নিয়ে যেতে পারে। ঠিক সেই রাতে, লণ্ঠন হাতে নিয়ে তীর্থ আবার নেমে যায় দাদুর ঘরে, সেই ধুলো জমা বুকশেলফের কাছে। বাতাসে যেন ভেসে আসে দাদুর কণ্ঠের প্রতিধ্বনি—“সব কিছুই দেখার মতো নয়, কিছু জিনিস অনুভব করতে হয়।” বুকের গভীরে এক অদ্ভুত স্রোত বয়ে যায়, আর তীর্থ টের পায়—এই রহস্য কেবল এক পুরনো খেলনা নয়, হয়তো এটা তার পরিবারের ইতিহাসেরই এক অজানা অধ্যায়, যেটি প্রকাশ পেতে চাইছে তীর্থর হাতেই।
অধ্যায় ২: রাতের আগন্তুক
রাত তখন আরও গভীর হয়েছে, ঘড়ির কাঁটা একটায় এসে ঠেকেছে, আর তীর্থ এখনো দাদুর ঘরেই বসে আছে নোটবইয়ের পাতা উল্টে উল্টে, যেন হারিয়ে যাওয়া কোনো ছেঁড়া গল্পের টুকরো খুঁজে বেড়াচ্ছে। নোটবইয়ের হলুদ হয়ে যাওয়া পাতায় দাদু লিখেছেন পারিবারিক ইতিহাস, ব্রিটিশ আমলের নানা ঘটনা, এমনকি কিছু রহস্যময় কবিতার মতো লাইন, যা প্রথম দেখায় কোনো অর্থ বলে মনে হয় না। তীর্থ বারবার সেই লাইনগুলোর মধ্যে খুঁজে পেতে চায় কোনো চাবিকাঠি, কোনো নির্দেশনা যা চতুরঙ্গের গোপন বার্তার সাথে মিলিয়ে দেখা যায়। ঠিক সেই সময়ে, হঠাৎ করেই দোতলার বারান্দার কাঁচের দরজায় টুক করে শব্দ হয়, যেন কেউ ধাক্কা দিল নরম হাতে। তীর্থ চমকে ওঠে, বুকের মধ্যে কাঁপন শুরু হয়, তবু সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে পর্দা সরিয়ে দেখে বাইরে ছায়াময় এক অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে, চোখে ধাতব ঝিলিক। ছেলেবেলার সব ভয়ের গল্প মনে পড়ে যায়, তবু এক আশ্চর্য সাহসে দরজার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে, “কে?” কোনো উত্তর আসে না, শুধু সেই অবয়ব একটু নড়ে ওঠে, আর তীর্থ দেখতে পায় আগন্তুকের হাতের আঙুল চতুরঙ্গ সেটের বাক্সের দিকে ইশারা করছে, যা তীর্থর হাতেই ধরা।
তীর্থর মনে হল, এটা কোনো সাধারণ চোর নয়, কোনো মূল্যবান জিনিস খুঁজছে না, বরং এই বিশেষ চতুরঙ্গ সেটটাই চায়। আগন্তুকের চোখে চোখ পড়তেই তীর্থর গায়ে কাঁটা দেয়, যেন সেই চোখে লুকিয়ে আছে বহু বছরের পুরনো এক অদৃশ্য ক্ষুধা, যা পূরণ হবে শুধু এই বাক্সের ভেতরের রহস্য উন্মোচনেই। ভয়ে তীর্থ দরজা বন্ধ করে তালা লাগিয়ে ফেলে, আর পাশের ঘর থেকে মোটা লাঠি নিয়ে এসে খোলা জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে, যদি ওই আগন্তুক ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করে। কয়েক মুহূর্ত পরেই ধাতব জুতার হালকা শব্দ মিলিয়ে যায় সিঁড়ির ধাপ বেয়ে, আর ঘরে নেমে আসে ভয়ার্ত নীরবতা। তীর্থর মাথায় তখন একটাই প্রশ্ন ঘুরছে—কে এই লোক? সে কিভাবে জানল তীর্থ এই চতুরঙ্গ সেট পেয়েছে? তীর্থ জানে না, কিন্তু অন্তর থেকে টের পায়, এই রহস্যের গভীরে গিয়ে না পৌঁছানো পর্যন্ত শান্তি পাবে না।
তীর্থর বুকের ভেতর তখনো ঢিমেধারা কাঁপন, কিন্তু কৌতূহল তার চেয়ে বড় হয়ে ওঠে। সে আবার বসে নোটবইয়ের দিকে, আর সেই অজানা আগন্তুকের চোখে দেখা ক্ষুধার অর্থ বোঝার চেষ্টা করে। নোটবইয়ের এক জায়গায় চোখ আটকে যায়—দাদু লিখেছেন, “যদি কখনো কেউ আসছে বলে মনে হয়, তার মানে সত্যিই কেউ আসছে। এবং তার খোঁজ থাকে চতুরঙ্গের খেলায় লুকানো উত্তরেই।” এই লাইন যেন এক ঝটকায় সব স্পষ্ট করে দেয়। আগন্তুক তীর্থকে নয়, চাই এই রহস্য, যা হয়তো বহুদিন আগে থেকে লুকিয়ে আছে তীর্থর পরিবারের অতীতে। সে ভাবে, কাল সকাল হতেই রূপালীর সঙ্গে দেখা করতে হবে, কারণ রূপালী ইতিহাস আর প্রত্নতত্ত্বে পারদর্শী, আর সে-ই হয়তো এই নকশা, অক্ষর আর চিহ্নের মানে বুঝতে সাহায্য করতে পারবে। রাতে আর ঘুম হয় না, শুধু ভোরের আলো আসা পর্যন্ত তীর্থ চেয়ারে বসেই কোলের উপর চতুরঙ্গ সেট রেখে অপেক্ষা করে, চোখে ভয়ের ছায়া আর মনে এক অজানা উত্তরাধিকার খুঁজে পাওয়ার তীব্র তাগিদ নিয়ে।
অধ্যায় ৩: রহস্যের সূত্র
সকাল হতে না হতেই তীর্থ সাইকেল নিয়ে রওনা হয় রূপালীর বাড়ির দিকে, বুকের ভেতর এক অদ্ভুত চাপা উত্তেজনা আর রাতের ঘটনার ভয় মিলেমিশে আছে। কলেজের বন্ধু হলেও রূপালী বরাবরই ছিল রহস্য আর ইতিহাসের প্রতি দুর্বল, পুরনো বই আর মানচিত্র নিয়ে কাটিয়ে দিতে পারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তীর্থ যখন পৌঁছে যায়, রূপালী এক হাতে চুল বেঁধে আরেক হাতে নোটবইয়ের পাতায় চোখ রেখে বসে ছিল, যেন ঠিক এই মুহূর্তেরই জন্য অপেক্ষা করছিল। তীর্থ চতুরঙ্গ সেটের বাক্স খুলে ঘুঁটিগুলো দেখায় আর বলে রাতের ঘটনার কথা, আগন্তুকের ছায়া আর দাদুর নোটবইয়ের সেই রহস্যময় লাইনের কথা। রূপালী প্রথমে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর ঘুঁটিগুলোর তলার দিকের অক্ষর আর চিহ্নগুলোর দিকে মনোযোগ দিয়ে দেখতে থাকে, একের পর এক ঘুঁটি ঘুরিয়ে মিলিয়ে দেখে কোনোটার চিহ্ন আর কোনোটার অঙ্ক কীভাবে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে।
রূপালী ধীরে ধীরে বলে, “দেখ, এই অক্ষর আর চিহ্নগুলো কেবল সাজানো নয়, এরা একটা ক্রম নির্দেশ করে। আর এই নোটে যে ‘Look beyond the move’ লেখা আছে, তার মানে হতে পারে চালের বাইরে, অর্থাৎ হয়তো ঘুঁটিগুলোকে চালানোর মতো না, বরং অন্যভাবে সাজানোর মতো কোনো রহস্য আছে।” তীর্থর চোখ চকচক করে ওঠে, কারণ সে নিজেও ভেবেছিল এমন কিছু। রূপালী চতুরঙ্গ বোর্ডের ওপর ঘুঁটিগুলো একবার অন্যরকমভাবে বসিয়ে দেখে, রাজা আর রানীকে আলাদা করে পাশে রেখে, আর অদ্ভুতভাবে মিলিয়ে যায় অঙ্ক আর অক্ষরগুলোর মানে। একটু পরে রূপালী বলে, “এগুলো আসলে একটি তারিখ আর একটি নাম নির্দেশ করছে, আর সেই নাম এক বিপ্লবীর, যার নাম তুমি ইতিহাসের বইতেও পাবে—মাধব চক্রবর্তী।” তীর্থ অবাক হয়ে যায়, কারণ মাধব চক্রবর্তীর নাম দাদুর নোটবইতেও পড়েছিল, কিন্তু কখনো গুরুত্ব দিয়ে ভাবেনি।
রূপালী বলে, “তোমার দাদু শুধু উত্তরাধিকার দিয়ে যাননি, তিনি আমাদের একটা রাস্তা দেখিয়েছেন, যা এই নাম আর তারিখ দিয়ে খুলবে।” তীর্থর মনে হয় তার শিরায় শিরায় রক্ত যেন গরম হয়ে যাচ্ছে উত্তেজনায়। রূপালী বলে, এই নামের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে কলকাতার কোনো পুরনো লাইব্রেরি বা আর্কাইভ, যেখানে হয়তো লুকানো আছে সেই বিপ্লবীর রেখে যাওয়া নথি বা মানচিত্র, যা চতুরঙ্গের ঘুঁটিতে লুকানো অঙ্ক আর চিহ্নের সাহায্যে পাওয়া যাবে। সেই মুহূর্তে তীর্থর চোখে এক নতুন আলো জ্বলে ওঠে, কারণ প্রথমবারের মতো সে মনে করে এই রহস্য কেবল তার পারিবারিক কৌতূহল নয়, বরং ইতিহাসের এক বড় সত্যকে উন্মোচন করার চাবিকাঠি। তারা ঠিক করে, আজ রাতেই যাবে উত্তর কলকাতার সেই পুরনো গ্রন্থাগারে, যেখানে লুকিয়ে থাকতে পারে মাধব চক্রবর্তীর অজানা অধ্যায়, আর তার সাথে তীর্থর পরিবারের ইতিহাসের এক অদৃশ্য সেতুবন্ধ।
অধ্যায় ৪: উত্তর কলকাতার অন্ধকার গলি
সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই তীর্থ আর রূপালী পৌঁছে যায় উত্তর কলকাতার সেই ধুলোমাখা প্রাচীন গ্রন্থাগারে, যার নাম কাগজে কলমে আছে, কিন্তু বাস্তবে প্রায় কেউই আসে না। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় যেন শতাব্দী প্রাচীন এই বাড়িটি এখনো ব্রিটিশ আমলের কোনো স্মৃতি আঁকড়ে ধরে আছে—উঁচু খিলান, ভাঙা দেওয়াল আর পোকায় কাটা কাঠের দরজায় মরচে ধরা তালা। ভেতরে ঢুকতেই বাতাসে ভেসে আসে স্যাঁতসেঁতে গন্ধ আর ধুলোয় ঢেকে থাকা পুরনো কাগজের গন্ধ, যা একদিকে ভয়ের, আবার অন্যদিকে রহস্যের প্রতিশ্রুতি দেয়। হাতে মোমবাতি আর টর্চ নিয়ে তারা ধীরে ধীরে এগোয়, পায়ের নিচে কাঠের মেঝে কড়মড় শব্দ করে, আর দেয়ালে ঝুলে থাকা মাকড়সার জাল যেন নিঃশব্দে আগলে রাখে বহু পুরনো গোপন কথা। রূপালী নোটবই আর চতুরঙ্গের ঘুঁটির চিহ্ন দেখে আন্দাজ করে কোন তাকে, কোন শেলফে যেতে হবে, আর তীর্থ সেই অনুযায়ী খুঁজতে থাকে, হাত বোলায় অন্ধকারে ঢাকা মলিন মলাটে।
একসময় রূপালী ফিসফিস করে ডাকে, “তীর্থ, এদিকে আসো,” আর তীর্থ কাছে যেতেই দেখে, মলাটছেঁড়া এক বইয়ের পাতার ভাঁজে লুকিয়ে আছে হলুদ হয়ে যাওয়া এক পৃষ্ঠা, যেখানে অদ্ভুত কায়দায় লেখা আছে কিছু লাইন আর তার নিচে মাধব চক্রবর্তীর স্বাক্ষর। সেই কাগজটিতে স্পষ্ট লেখা, “যদি আমার উত্তরাধিকারী এই লাইন পড়েন, তবে জেনে নিও, সত্য লুকিয়ে আছে অন্ধকারের গর্ভে, আর পথের নির্দেশ লুকোনো আছে দাবার চালের ভেতরেই।” তীর্থর বুকের মধ্যে তীব্র কাঁপন শুরু হয়, কারণ এই লাইনগুলো যেন দাদুর সেই নোটবইয়ের লাইনগুলোর সাথেই মিলে যায়। রূপালী বলে, “দেখেছ, এই লাইব্রেরির নথি শুধু ইতিহাস নয়, কোনো গোপন জায়গার মানচিত্রও নির্দেশ করছে,” আর তীর্থ টের পায় এই রহস্যের শিকড় অনেক গভীর, যা শুধু তাদের পরিবার নয়, কলকাতার ইতিহাসের সাথেও জড়িত।
ঠিক সেই সময়ে, হঠাৎ টর্চের আলোয় পড়ে যায় এক ছায়া, যা বইয়ের তাকের আড়াল থেকে তাদের দেখছিল এতক্ষণ ধরে। সেই ছায়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকে, তারপর হঠাৎ মিলিয়ে যায় অন্ধকারের মধ্যে। তীর্থ আর রূপালী দুজনেই ভয়ে জমে যায়, টের পায় তাদের ছাড়া এখানে আর কেউ আছে, যে জানে বা খুঁজছে এই একই রহস্য। বুকের মধ্যে ঢেউ খেলানো আতঙ্ক নিয়েই তারা বইয়ের তাক থেকে বের করে আনে একটা মোটা নথি, যাতে অর্ধেক ছেঁড়া মানচিত্র আঁকা আর কিছু কোডের মতো চিহ্ন রয়েছে। তীর্থ বুঝতে পারে, এই নথিই হতে পারে সেই সেতু, যা চতুরঙ্গের রহস্যকে মাধব চক্রবর্তীর লুকিয়ে রাখা সত্যের সাথে যুক্ত করবে। আর সেই সত্য জানার জন্য তাদের যেতে হবে আরেক ধাপ গভীরে—উত্তর কলকাতার সেই পরিত্যক্ত জমিদার বাড়িতে, যেটির কথা নথির শেষ লাইনে ইঙ্গিত করা আছে, আর যেখানে হয়তো লুকিয়ে আছে ইতিহাসের এক বিস্মৃত অধ্যায়, যা প্রকাশ পেলেই বদলে যাবে সবকিছু।
অধ্যায় ৫: জমিদার বাড়ির নীচতলা
পরের দিন সন্ধ্যায় তীর্থ আর রূপালী পৌঁছে যায় সেই পরিত্যক্ত জমিদার বাড়িতে, যার নাম লোকমুখে এখনো শোনা যায় “মৃতদেউল বাড়ি” নামে—কারণ অনেকেই বলে এখানে রাতের বেলা ছায়া চলে, দরজা আপনাআপনি খোলে বন্ধ হয়, আর শোনা যায় ফিসফিস করা গলা। রাস্তার মাথা থেকে এই বাড়িটা দেখতে ভগ্নদশার এক মহল, ছাদ ভেঙে পড়েছে কিছু অংশে, বারান্দার লোহার গ্রিল মরচে ধরা আর জংলা লতায় ঢেকে গেছে, তবু এই নীরব ধ্বংসস্তূপের মধ্যে লুকিয়ে আছে এক অজানা টান। মোমবাতি আর টর্চের আলোয় দু’জন ধীরে ধীরে ভেতরে ঢোকে, চারদিকের নিস্তব্ধতায় শুধু শোনা যায় তাদের নিজের নিঃশ্বাস আর পায়ের নীচের ভাঙা ইটের খচমচ শব্দ। একসময় তীর্থর চোখ পড়ে বড় হলঘরের এক কোণে ভাঙা খাটের নীচে অদ্ভুত নকশা আঁকা এক কাঠের দরজা, যা এতদিন ধুলো আর আগাছায় ঢাকা ছিল। রূপালী আগ বাড়িয়ে বলে, “এই নকশাটা দেখেছ? চতুরঙ্গের বাক্সের গায়ের সেই চিহ্নের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে।” তীর্থর বুকের ভিতর কেঁপে ওঠে, আর এক ঝটকায় তারা বুঝে যায় এটাই সেই গোপন দরজা, যার সন্ধান দাদুর নোট আর মাধব চক্রবর্তীর মানচিত্রে ছিল।
তারা মিলে দরজাটা টেনে তোলে, আর সিঁড়ির মতো নিচে নেমে যায় এক অন্ধকার নীচতলায়, যেখানে বাতাস ভারী, স্যাঁতসেঁতে আর যেন ইতিহাসের গন্ধে ভরা। অন্ধকারে টর্চের আলোয় দেখা যায় দেয়ালে ধূসর রঙের লিখন আর ছায়ায় ঢাকা প্রতীক, যার কিছু বোঝা যায়, কিছু রহস্যই থেকে যায়। সিঁড়ির শেষে পায় এক ছোট্ট ঘর, যেখানে রাখা আছে একটি লোহার বাক্স, আর বাক্সের ঢাকনার গায়েও খোদাই করা সেই একই চিহ্ন—চতুরঙ্গের চালের মতো সাজানো রেখা আর অক্ষর। তীর্থ চতুরঙ্গ সেট থেকে এক এক করে ঘুঁটি বের করে, আর রূপালীর নির্দেশে সেই চিহ্নগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে রাখে, ঠিক যেমন নথিতে নির্দেশ দেওয়া ছিল। মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধতার মধ্যে শোনা যায় দূরে কোনো ইঁদুরের ছোটাছুটি, আর তারপরই এক চাপা খটাস শব্দ করে খুলে যায় লোহার বাক্সের ঢাকনা। তীর্থ আর রূপালী দু’জনেই একসাথে ঢুকে দেখে, ভেতরে পুরনো কাগজ, সিল করা পত্র আর মলিন কাপড়ে মোড়া এক খণ্ড নথি।
তীর্থ হাত বাড়িয়ে সেই নথিটা তোলে, আর টর্চের আলোয় পড়ে স্পষ্ট হয় মাধব চক্রবর্তীর নাম, আর তার নিজের হাতে লেখা চিঠি, যেখানে বলা আছে ব্রিটিশ শাসনামলে গোপন রাখা কিছু বিপ্লবী নথির কথা, যেগুলো স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস বদলে দিতে পারত, কিন্তু সুরক্ষার জন্যই তা লুকিয়ে রাখা হয়েছিল উত্তরাধিকারীর হাতে তুলে দেওয়ার আশায়। তীর্থর মনে হয়, এই মুহূর্তে তার নিজের বুকের মধ্যে শুধু রক্ত নয়, ইতিহাসের দায় আর উত্তরাধিকার বইছে। রূপালী বলে, “তোমার দাদু এই নথিটা আমাদের কাছে পৌছে দেওয়ার জন্যই চতুরঙ্গের সেই খেলা শুরু করেছিলেন।” কিন্তু সেই মুহূর্তেই তারা টের পায়, অন্ধকার নীচতলায় তাদের ছাড়া আর কেউ একজন আছে, যার নিঃশ্বাসের শব্দ ভেঙে দেয় সেই পবিত্র নিস্তব্ধতা—আর যিনি এই রহস্যের শেষ চাবিকাঠি হাতছাড়া করতে চায় না কোনোভাবেই।
অধ্যায় ৬: শ্রীমন্তের ছায়া
তীর্থ আর রূপালী ধোঁয়াটে আলোয় ঘোরের মধ্যে দাঁড়িয়ে, হাতে ধরা সেই অমূল্য নথি, যখনই হঠাৎ পেছনে এক অজানা পদচাপের শব্দে কেঁপে ওঠে চারপাশ। ঘুরে দাঁড়াতেই তারা দেখে এক লম্বা ছায়াময় অবয়ব, চোখে জ্বলে ওঠা ধাতব দৃষ্টি আর হাতে ধরা টর্চ, যেটির আলো সরাসরি তাদের চোখে পড়ে। সেই মানুষটি ধীরে ধীরে সামনে আসে, আর টর্চের আলোয় দেখা যায় তার মুখ—তীক্ষ্ণ চেহারা, পাতলা গোঁফ আর ঠোঁটের কোণে রহস্যময় এক অর্ধহাসি। সে পরিচয় দেয়, “আমি শ্রীমন্ত,” আর ঠাণ্ডা গলায় বলে, “যে খোঁজ করছিলাম অনেকদিন ধরে এই নথির।” শ্রীমন্ত বোঝায়, সে কেবল সংগ্রাহক নয়, তার উদ্দেশ্য এই নথি হাতিয়ে নিয়ে দেশের বাইরে বিক্রি করা, যাতে সে কোটি কোটি টাকা পায়। তীর্থর বুকের মধ্যে রক্ত গরম হয়ে যায়, কিন্তু শ্রীমন্তের চোখে যে আত্মবিশ্বাস আর ছায়ার মতো ছায়াছায়া শীতলতা, তা দেখে বোঝা যায়—সে সহজে থামবে না। শ্রীমন্ত বলে, “তোমাদের দাদু আমার বাবাকে এই নথির গল্প শুনিয়েছিল, আর আমার বাবা মারা গিয়েছিল এই নথির পেছনে ছুটতে গিয়ে। এখন আমার পালা।”
তীর্থ আর রূপালী ভয়ে জমে যায়, কিন্তু তীর্থ ধীরে ধীরে নথিটা পকেটে রাখে, আর শ্রীমন্তের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, “তোমার কাছে এই কাগজ কেবল টাকার মূল্য আছে, কিন্তু আমার কাছে আছে দাদুর শেষ ইচ্ছা আর ইতিহাসের প্রতি দায়িত্ব।” শ্রীমন্ত ঠোঁটের কোণে হাসে, যেন এসব আবেগ তার কাছে কেবলই বোকামি, আর বলে, “তোমরা ভাবছ এই নথি রক্ষা করবে ইতিহাস? ইতিহাস টিকে থাকে না, টিকে থাকে শুধু টাকা আর ক্ষমতা।” তার কথা শেষ না হতেই, শ্রীমন্ত তীর্থর দিকে এগিয়ে আসে, আর এক লাফে নথি ছিনিয়ে নেয় তীর্থর পকেট থেকে। সেই মুহূর্তে রূপালী ঝুঁকে শ্রীমন্তের হাতে ধরা নথির এক প্রান্ত টেনে ধরে, আর তীর্থ শ্রীমন্তের হাত চেপে ধরে রাখে। অন্ধকার নীচতলায় এই টানাটানিতে টর্চের আলো দুলে ওঠে, দেয়ালের ছায়া নাচে, আর ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে যায় নিঃশ্বাসের শব্দ আর কাগজ ছিঁড়ে যাওয়ার আওয়াজে।
এক সময় শ্রীমন্ত জোরে ধাক্কা দিয়ে তীর্থকে মেঝেতে ফেলে, আর রূপালীও কাঁপতে কাঁপতে ছাড়ে তার হাত। কিন্তু ঠিক সেই সময়ে তীর্থর চোখে পড়ে লোহার বাক্সের মধ্যে আরেকটি ছোট বাক্স, যা খুলতেই বেরিয়ে আসে নথির আরেকটি কপি আর মাধব চক্রবর্তীর হাতে লেখা একটি গোপন চিঠি। তীর্থ চিৎকার করে বলে, “তুমি যা পেয়েছ সেটা পুরো নয়, আসল সত্য লুকিয়ে আছে এখানে।” শ্রীমন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে তীর্থর দিকে ছুটে আসে, কিন্তু রূপালী তার পথ রোধ করে দাঁড়ায়। সেই কয়েক সেকেন্ডের ভেতরেই তীর্থ হাতের নথিটা আঁকড়ে ধরে সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে ওঠে ওপরে, আর পেছন থেকে শোনা যায় শ্রীমন্তের ধাতব গলার ধমক, “তোমরা পালাতে পারবে না!” সেই মুহূর্তে তীর্থ বুঝতে পারে, এই লড়াই কেবল নথির নয়, এটি সত্য আর মিথ্যার মধ্যে এক অদৃশ্য যুদ্ধ, আর তাকে শেষ পর্যন্ত এই সত্যকেই বাঁচিয়ে রাখতে হবে, দাদুর স্বপ্ন আর নিজের বিবেকের কাছে।
অধ্যায় ৭: আলোর রহস্য
তীর্থ আর রূপালী বুক ধড়ফড়িয়ে উপরের ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসে অন্ধকার হলঘরে, শ্রীমন্তের ধাপের শব্দ ঠিক পেছনেই শুনতে পায়, আর মনে হয় এই লুকোচুরি আর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই শেষ হবে। হলঘরের কোণে তীর্থর চোখে পড়ে মাটিতে পড়ে থাকা পুরনো হারিকেন, যার কাঁচে ধুলো জমে আছে, আর পাশে শুকনো তেল আর দেশলাই। তীর্থ এক মুহূর্তের জন্য ভাবতেও পারে না, শুধু অনুভূতিতে ভর করে হারিকেনটায় তেল ঢেলে দেশলাই জ্বালায়, আর তাতে ধিকিধিকি আলো ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। সেই আলোয় চতুরঙ্গের ঘুঁটিগুলোর গায়ে আঁকা খোদাই, দাদুর নোটবইয়ের অদৃশ্য অক্ষর আর মাধব চক্রবর্তীর চিঠির ছেঁড়া লাইনগুলো এক অদ্ভুতভাবে একে অপরের সঙ্গে মিলিয়ে যায়, যেন অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা সত্য হঠাৎই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রূপালী ফিসফিস করে বলে, “দেখেছ, এই আলোর তাপে কালি উঠে এসেছে—দাদুর নোটবইতে লুকানো অক্ষর, যা শুধু গরম আলোয় দেখা যায়।” তীর্থর বুকের মধ্যে কাঁপন চলে, কারণ সেই অক্ষরগুলো মিলে যায় এক গুপ্ত বাক্স খোলার কোডের সাথে, যেটা তারা শ্রীমন্তের চোখ এড়িয়ে লোহার বাক্স থেকে তুলে এনেছিল।
তীর্থ ধীরে ধীরে সেই কোড চাবির মতো ঘুরিয়ে ছোট্ট বাক্সের তালা খোলে, আর খোলার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে আসে এক টুকরো ভাঁজ করা নথি, যেটা আগে তাদের চোখেই পড়েনি। সেই নথিতে লেখা আছে গোপন স্থানের মানচিত্র, যেখানে লুকিয়ে আছে ব্রিটিশ শাসনকালীন নীলনকশা আর বিপ্লবীদের পরিকল্পনা—যা প্রকাশ পেলে ইতিহাসের বড় অংশ নতুন করে লেখা হবে। তীর্থ আর রূপালী বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে, কারণ এই নথি এতদিন ধরে শুধু পরিবারের নয়, দেশের ইতিহাসও রক্ষা করছিল। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই, হারিকেনের আলোয় দেখা যায় শ্রীমন্তর ছায়া, যেটা লম্বা হয়ে দেওয়ালে নাচতে নাচতে তাদের কাছে চলে আসে। শ্রীমন্ত ঠাণ্ডা গলায় বলে, “তোমরা যা করছো, সেটা দিয়ে ইতিহাস বাঁচবে না, বরং অনর্থ ঘটাবে।” তার হাতে চকচক করে ওঠে লোহার রড, আর চোখে থাকে ক্ষুধার আগুন, যেন পৃথিবীর সব সত্যের চেয়ে টাকার মূল্যই বড়।
তীর্থর চোখে তখন রক্তের মতো গরম এক সাহস, আর রূপালীও চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে তার পাশে। তারা জানে শ্রীমন্তর হাত থেকে এই নথি রক্ষা করতে গেলে শেষ পর্যন্ত হয় লড়াই করতে হবে, নয়তো চিরতরে হারাতে হবে সেই উত্তরাধিকার, যা দাদু তার হাতে তুলে দিয়ে গিয়েছিলেন। শ্রীমন্ত যখন এক ধাক্কায় তীর্থর দিকে এগিয়ে আসে, সেই মুহূর্তে রূপালী হারিকেনটা উঁচু করে ধরে, আর তার আলোয় অন্ধকার হলঘরে ছায়া-আলোর লড়াই শুরু হয়। সেই লড়াইয়ে শুধু তিনজন মানুষ নয়, দাঁড়িয়ে থাকে সত্য আর মিথ্যা, আত্মত্যাগ আর লোভের মধ্যে এক নিঃশব্দ যুদ্ধ, যা ঠিক করবে ইতিহাস কোন পথে হাঁটবে।
অধ্যায় ৮: বিপ্লবীর গোপন নথি
শ্রীমন্তর চোখে তখন একরাশ ক্ষুধার আগুন, আর হাতের লোহার রড উঁচু হয়ে উঠেছে তীর্থর মাথার উপর, ঠিক সেই মুহূর্তে রূপালী নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে হারিকেনটাকে শ্রীমন্তর দিকে ছুঁড়ে মারে। হারিকেন মেঝেতে পড়ে ভেঙে যায়, আর আগুনের হলকা ছিটকে পড়ে শ্রীমন্তর পায়ের কাছে, কিছুক্ষণের জন্য সে হকচকিয়ে যায়। সেই ফাঁকে তীর্থ এক ঝটকায় পেছন দিকে সরে এসে শ্রীমন্তর হাত থেকে রড কেড়ে নেয়, আর হাতের নথিটা শক্ত করে বুকের কাছে চেপে ধরে। শ্রীমন্তের চোখে তখন অন্ধ ক্রোধ, সে তীর্থর দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে, আর দু’জনের মধ্যে শুরু হয় ধস্তাধস্তি, যেখানে রাতের অন্ধকার, আগুনের আলো আর ভাঙা হলঘরের ছায়ারা মিলে এক অদ্ভুত দৃশ্য তৈরি করে। তীর্থ শ্রীমন্তকে ঠেলতে ঠেলতে ধাক্কা দিয়ে দূরে ফেলে, আর রূপালী চিৎকার করে বলে, “তীর্থ, দৌড়াও!” কিন্তু তীর্থ জানে, এই নথি সে ফেলে পালালে আর কোনোদিন ইতিহাসের সত্য প্রকাশ পাবে না।
ঠিক তখনই, আগুনের আলোয় তীর্থর চোখে পড়ে নথির ভেতরে লুকিয়ে থাকা আরেকটি পাতায় মাধব চক্রবর্তীর নিজের হাতে লেখা চিঠি, যেখানে লেখা আছে, “যদি কখনো এই নথি কেউ পাওয়ার চেষ্টা করে, জেনে নিও সত্য সহজে বিক্রি হয় না, তার জন্য লড়াই করতে হয়।” এই লাইন তীর্থর রক্ত গরম করে দেয়, আর সে শ্রীমন্তর চোখে চোখ রেখে দাঁড়ায়, যেন বলতে চায়—তুমি শুধু টাকা দেখছ, আমি দেখছি উত্তরাধিকার আর আত্মত্যাগের ইতিহাস। শ্রীমন্ত আবার তীর্থর দিকে তেড়ে আসে, কিন্তু এইবার রূপালী পেছন থেকে তার কাঁধ চেপে ধরে টেনে ফেলে, আর সেই ফাঁকে তীর্থ লোহার রড দিয়ে শ্রীমন্তর হাত থেকে নথির ছেঁড়া অংশ কেড়ে নেয়। আগুন তখন আরও ছড়িয়ে পড়ছে, চারপাশে ধোঁয়া, গরম আর পুড়ে যাওয়া কাঠের গন্ধ। তীর্থ আর রূপালী ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে একসাথে দরজার দিকে ছুটে যায়, পিছনে ফেলে যায় শ্রীমন্তকে, যে আগুন আর লোভের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে অন্ধকারের প্রতিমূর্তির মতো।
বেরিয়ে আসতেই তারা দেখে রাতের আকাশে ভোরের আলো ফুটছে, আর ধোঁয়া মিশে যাচ্ছে সেই ফিকে আলোয়। তীর্থর বুকের মধ্যে শক্ত করে ধরা সেই নথি, আর মনে হয় দাদুর হাত যেন কাঁধে হাত রাখছে, বলছে—“তুই পেরেছিস, তীর্থ।” রূপালী ক্লান্ত নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “এখন আমাদের করতে হবে আসল কাজটা—এই নথি ঠিক জায়গায় পৌঁছানো।” তীর্থ তাকিয়ে থাকে দূরের আলোর দিকে, আর ভাবে এই নথি শুধু কাগজ নয়, এর মধ্যে লুকিয়ে আছে এক বিপ্লবীর রক্ত, বিশ্বাস আর ইতিহাসকে রক্ষা করার শেষ চেষ্টা। সেই মুহূর্তে তীর্থ বুঝতে পারে, সত্যকে বাঁচিয়ে রাখাই সবচেয়ে বড় জয়, আর তার এই লড়াই এখনই শেষ নয়—বরং সত্যকে সঠিক হাতে তুলে দেওয়ার পথই তার জীবনের আসল যুদ্ধের শুরু।
অধ্যায় ৯: সত্যের পথ
ভোরের ঠান্ডা বাতাসে যখন তীর্থ আর রূপালী হাঁপাতে হাঁপাতে রাস্তার ধুলোয় বসে পড়ে, তাদের কাঁধে তখনো আগের রাতের ধুলো, মুখে ক্লান্তি আর চোখে লুকানো জেদ। তীর্থর হাতের মধ্যে শক্ত করে ধরা সেই অমূল্য নথি, যেন শুধু কাগজ নয়, দাদুর শেষ চাওয়া আর ইতিহাসের প্রতি এক অদৃশ্য দায়িত্ব। রূপালী ধীরে ধীরে বলে, “তীর্থ, আমরা এখন কোথায় যাব? পুলিশের কাছে? কোনো সাংবাদিকের কাছে?” তীর্থ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, “না, পুলিশের হাতে দিলে হয়তো নথিটা হারিয়ে যাবে, সাংবাদিকের কাছে দিলে খবর হবে কিন্তু সত্যের মর্ম টিকবে না। আমাদের যেতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ঘোষালের কাছে, উনিই জানেন কিভাবে এই নথি সঠিক হাতে তুলে দিতে হয়, যেন এটা শুধু খবর হয়ে না থাকে, বরং ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃতি পায়।” রূপালী মাথা নাড়ে, আর দু’জনেই ওঠে ধুলো ঝেড়ে, পকেটের ভেতর লুকিয়ে রাখা সেই ছেঁড়া কাগজের টুকরোগুলো ঠিকঠাক করে।
রাস্তা তখনো ফাঁকা, কেবল ভোরের প্রথম রোদ গায়ে এসে লাগে, আর তীর্থর মনে হয় সেই আলো যেন দাদুর আশীর্বাদ, মাধব চক্রবর্তীর লড়াইয়ের প্রতীক। অটো ধরে তারা পৌঁছায় অধ্যাপক ঘোষালের বাড়িতে, দরজায় টোকা দিতেই খোলা চুল, চোখে ভারী চশমা পরা বৃদ্ধ মানুষটি দরজা খোলে। তীর্থ এক নিঃশ্বাসে সব ঘটনা বলে—চতুরঙ্গ সেট, দাদুর নোটবই, লুকোনো নথি আর শ্রীমন্তের ধাওয়া। অধ্যাপক ঘোষাল প্রথমে গভীরভাবে শোনেন, তারপর নথিটা হাতে নিয়ে আস্তে করে বলেন, “তোমরা বুঝেছ কত বড় কাজ করেছ? শুধু এক টুকরো কাগজ নয়, এ এক বিপ্লবীর আত্মত্যাগের দলিল, যা নতুন প্রজন্মকে দেখাবে স্বাধীনতার ইতিহাস কেবল বইয়ের পাতা নয়, মানুষের রক্ত আর সাহসের গল্প।” তার কণ্ঠে গর্ব আর কৃতজ্ঞতার মিশ্রণ তীর্থর বুক কাঁপিয়ে দেয়, আর মনে হয় এই নথি পৌঁছেছে ঠিক সেই হাতে, যিনি বোঝেন এর মর্যাদা।
অধ্যাপক ঘোষাল প্রতিশ্রুতি দেন, এই নথি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কাইভে সংরক্ষিত হবে, আর গবেষণার মাধ্যমে ইতিহাসের সত্য প্রকাশ পাবে। তীর্থর চোখে জল চলে আসে, কারণ দাদুর রেখে যাওয়া চতুরঙ্গের রহস্য অবশেষে ইতিহাসের পথে আলোকিত হলো। রূপালী তীর্থর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে, “দেখেছ, সত্যকে কেউ থামাতে পারে না, শুধু সাহস আর আস্থা লাগে।” তীর্থ নীরবে আকাশের দিকে তাকায়, মনে মনে বলে, “দাদু, তোমার গল্প আমি শেষ পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পেরেছি,” আর বুঝতে পারে এই লড়াই শুধু এক রাতের নয়, সত্য আর বিশ্বাসকে বাঁচিয়ে রাখার চিরন্তন যুদ্ধ।
অধ্যায় ১০: উত্তরাধিকার
তীর্থ আর রূপালী যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কাইভ থেকে বেরিয়ে আসে, তখন সকাল ভালো করে রোদে ভরে গেছে, চারপাশের গাছের পাতায় আলো ঝলমল করছে আর হাওয়ায় একটা হালকা গন্ধ—যেন মুক্তির, বাঁচার, সত্যের। তীর্থর মনে হয় বুকের ভেতর এতদিনের চাপা টেনশন, ভয় আর দায়িত্বের ভার এক মুহূর্তের জন্য হালকা হয়ে গেছে, কিন্তু সাথেসাথেই টের পায়, এই যাত্রার মধ্যে দিয়ে সে আর আগের মতো নেই। রূপালীও তার পাশ দিয়ে হেঁটে আসতে আসতে বলে, “জানো তীর্থ, শুধু নথিটাই রক্ষা করনি তুমি, আসলে তুমি নিজের ভিতরের এক অংশকেও খুঁজে পেয়েছ।” তীর্থ কিছু না বলে মুচকি হাসে, কারণ জানে রূপালী ঠিকই বলেছে—এই লড়াইয়ে শুধু ইতিহাস নয়, নিজের সাহস আর বিশ্বাসও নতুন করে চিনেছে সে।
বাড়ি ফিরে তীর্থ প্রথমেই দাদুর নোটবই আর সেই চতুরঙ্গ সেটটাকে নিয়ে বসে। প্রতিটি ঘুঁটির গায়ে হাত বোলায়, মনে পড়ে রাতের পর রাত ধরে কাটানো সময়, ধাঁধা মেলানোর চেষ্টা, আর সেই অজানা আগন্তুক শ্রীমন্তর চোখের ছায়া। নোটবইয়ের শেষ পাতায় চোখ পড়তেই দেখে দাদু লিখেছিলেন, “তীর্থ, যখন তুই এই রহস্যের শেষ প্রান্তে পৌঁছবি, তখন বুঝতে পারবি উত্তরাধিকার মানে শুধু সম্পদ নয়, বরং সত্যকে রক্ষা করার দায়িত্ব। সেটাই আসল উত্তরাধিকার, যা কখনো হারায় না।” এই লাইন পড়ে তীর্থর চোখ ভিজে আসে, আর সে মনে মনে বলে, “দাদু, আমি পেরেছি—তোমার রেখে যাওয়া সত্যকে ঠিক হাতেই তুলে দিতে পেরেছি।” সেই মুহূর্তে তীর্থ টের পায়, চতুরঙ্গের খেলা আসলে তার জীবনের খেলা হয়ে গিয়েছিল, আর সে এই খেলায় জিতেছে, কারণ লোভ নয়, সত্যকেই বেছে নিয়েছিল।
দিন কয়েক পর রূপালী তীর্থকে নিয়ে আবার সেই ভাঙা জমিদার বাড়িতে যায়, যেখানে আগুন আর ছায়ার সেই রাত কেটেছিল। তারা দাঁড়িয়ে থাকে ভাঙা দরজার সামনে, আর তীর্থ মন থেকে বলে, “এই বাড়ির দেয়ালে লুকিয়ে থাকা গল্পগুলো আর চাপা থাকবে না।” রূপালীও বলে, “তোমার দাদু শুধু রহস্য রাখেননি, তিনি উত্তরাধিকার দিয়ে গেছেন—যা আমাদের মতো মানুষকে সত্যের পথে টেনে আনে।” বাড়ি ফেরার সময় তীর্থ আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবে, সত্যকে রক্ষা করা যেমন কঠিন, তেমনি সুন্দরও, আর সে নিজেই এখন সেই গল্পের অংশ, যা একদিন আরেকজনের কাছে পৌঁছাবে, যেমন দাদু একদিন তার কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। আর সেই সত্যই থেকে যাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, অদৃশ্য চতুরঙ্গের চালের মতো, যা ইতিহাসের ছায়ায় পথ দেখাবে নতুন কাউকে, নতুন কোনো তীর্থকে।




