Bangla - ভূতের গল্প - রহস্য গল্প

কুয়াশার ঘড়ি

Spread the love

এক

দার্জিলিঙের পথে ঋদ্বয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাড়ি উঠছিল ক্রমাগত সর্পিল খাড়া রাস্তায়, আর আকাশে তখন নেমে এসেছে এক চিলতে কুয়াশা, যেন পাহাড় নিজেই ধোঁয়ার কুয়াশায় শরীর ঢেকে ফেলেছে। হিমেল হাওয়া জানালার কাচে ধুলো জমিয়ে দিচ্ছিল, আর দূর থেকে পাইন গাছের ছায়া যেন কোন গোপন সংকেত দিচ্ছিল তাকে। লেখার কাজে বেরোনো ঋদ্বয়ের পরিকল্পনা ছিল দার্জিলিঙের মূল শহরের একটু বাইরে, নির্জন এক হোমস্টেতে দু’সপ্তাহ থাকা, প্রকৃতির কাছে নিজেকে সমর্পণ করে যান্ত্রিক জীবনের ধুলো ঝেড়ে ফেলা। কিন্তু পথ বদলে গেল সেই দুপুরেই, যখন হঠাৎ তার গাড়ি পাহাড়ি এক রাস্তার ধারে বিকল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে—আর মোবাইলে সিগনালও উধাও। সামনের দিকে তাকিয়ে সে দেখতে পেল একটা পুরনো কাঠের তৈরি হোটেল, যার নাম একধরনের কুয়াশার ভেতর প্রায় অদৃশ্য হয়ে আছে—তবে যতটা বোঝা গেল, তাতে লেখা আছে: “Hotel Mistview Inn – Estd. 1934”। দরজার সামনে একটা ছোট ঘণ্টা ঝোলানো, আর ভিতরে অন্ধকার আলোয় লম্বা করিডোর, যেন একটা ঘুমন্ত সময়ের ভেতর সে হেঁটে যাচ্ছে।

হোটেল ম্যানেজার বিমল দে-এর চোখে ছিল এক ধরণের নিষ্পৃহতা—চোখে চোখ রেখে কথা বলে না, কেবল মাথা নাড়ে। সে বলল, “ঘর আছে, এক রাতের জন্য? উপরে ২০৩ নম্বর ঘর। ডিনার সাতটায়।” ঋদ্বয় ঘরটায় ঢুকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় গা এলিয়ে দিল, কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই চোখ চলে গেল ঘরের প্রাচীন দেওয়ালঘড়ির দিকে—কাঁটা দাঁড়িয়ে আছে ৬টা ৪৪-এ। অনেকক্ষণ ধরে সেটাই দেখছে সে, কোনো পরিবর্তন নেই। বাথরুম থেকে ফিরে এসে আবার দেখে, সময় একই জায়গায়। হালকা ভয় কাজ করছিল, কিন্তু নিজেকে বলে, “পুরনো ঘড়ি, কাজ করছে না—ব্যস।” ডিনার শেষে করিডোরে হেঁটে যাবার সময় সে লক্ষ্য করল, এক দীর্ঘ আয়নায় নিজেকে দেখা যাচ্ছে একটু বিকৃতভাবে, যেন তার প্রতিফলন ঠিক সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে না। সিঁড়ি ঘরে ওঠার মুখে হঠাৎ কার যেন নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ শুনে পিছন ফিরে তাকাল সে, কিন্তু কেউ নেই। রাতে বিছানায় শুয়ে অনেকক্ষণ ঘুম আসছিল না, আর বাইরে ক্রমশ ঘন হয়ে উঠছিল কুয়াশা। তারপর হঠাৎ দরজার বাইরে টিকটিক শব্দ, যেন কেউ ঘড়ির কাঁটা হাতে ঘুরিয়ে চলেছে। সে দরজার কাছে গিয়ে কানে লাগিয়ে শুনল, কিন্তু কিছুই স্পষ্ট নয়—শুধু একটা অস্বস্তিকর চাপা শব্দ, যেটা ক্রমেই বেড়ে উঠছিল।

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই সে জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখে—আবহাওয়া এক, একই কুয়াশা, একই গন্ধ। নিচে নেমে দেখে বিমল দে তাকে ঠিক আগের দিনের মতোই নম্র ভঙ্গিতে বলছে, “আপনার নাম বলুন, আমি বুকিং রেজিস্টারে লিখে নিই।” ঋদ্বয় একটু থমকে গিয়ে বলে, “গতকাল তো দিলাম… মনে নেই?” ম্যানেজার চমকে তাকিয়ে বলে, “গতকাল আপনি এখানে ছিলেন?” রিসেপশনের পাশে বসে থাকা মহিলা সাফ বলে দিলেন, তাঁরা এই প্রথম মুখ দেখছেন তাঁর। রুমের চাবি ফের ২০৩ নম্বর। ঋদ্বয়ের মাথা ঝিমঝিম করে উঠল—বিছানায় ফিরে এসে সে মোবাইল চেক করল—তারিখ এক, সময় সকাল ৯টা ১২। সবকিছু যেন হুবহু আগের দিনের কপি। সে ভাবতে চেষ্টা করল—সে কি ঘুমিয়ে বিভ্রমে ছিল? স্বপ্নে ছিল? কিন্তু ঘড়ির কাঁটা, সেই ৬:৪৪, আবার ঘরের দেওয়ালে আটকে আছে। ধীরে ধীরে সে উপলব্ধি করতে শুরু করল, সে একটা সময়ের চক্রে আটকে গেছে—একই দিন, বারবার, এবং হয়তো এই হোটেলটাই এর কেন্দ্র। কুয়াশা জানলার কাচ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে, যেন কোনো গোপন ফিসফাস সে শুনতে চাইছে। আর তখনই, করিডোরের শেষ মাথায় সে দেখতে পেল—এক ছায়ামূর্তি নীরবে দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক সন্ধ্যার মতো আলো-আঁধারিতে, এক হাতে যেন ঘড়ির কাঁটা ধরা, আর চোখে… গভীর লাল আলোর দৃষ্টি।

দুই

ঋদ্বয়ের মাথা কেমন ভার হয়ে ছিল সকাল থেকেই। সময় যেন চলছিল কিন্তু কোথাও থেমে গিয়েও ছিল। বিছানা থেকে উঠে সে জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকালো—একই কুয়াশা, একই পাহাড়ি নিঃস্তব্ধতা, একইভাবে পাইন গাছের ডাল থেকে জল টুপটাপ ঝরছে। ফোনে তাকিয়ে দেখল তারিখ আগের দিনের, সময় সকাল ৯টা ১২। তার বুক কেঁপে উঠল, কিন্তু নিজেকে ধরে রাখল সে—বলল, “হতে পারে ফোন রিস্টার্ট হয়নি, বা ঘুমিয়ে আমি কিছু মিস করেছি।” কিন্তু নিচে নেমে হোটেলের রিসেপশনে গিয়ে বিমল দে-র মুখোমুখি হতেই তার মাথা ঘুরে উঠল—সেই একই হাসি, একই সংলাপ: “আপনার নাম বলুন, আমি বুকিং রেজিস্টারে লিখে নিই।” কণ্ঠস্বরও যেন টেপে রেকর্ড করা। এইবার সে কড়া গলায় বলল, “কাল আমি এখানে ছিলাম, আপনিই চাবি দিয়েছিলেন।” ম্যানেজারের মুখে কোনো ভাবান্তর ঘটল না, কেবল ঠোঁটের কোণে এক যান্ত্রিক হাসি, যেন এই পরিস্থিতি সে বহুবার দেখে এসেছে। ঋদ্বয় হঠাৎ অনুভব করল—সেই দেওয়ালঘড়িটা, যার কাঁটা দাঁড়িয়ে আছে ৬টা ৪৪-এ, আবার তাকিয়ে আছে তার দিকে। যেন সময়টা শুধু আটকে নেই, বরং তাকে পর্যবেক্ষণ করছে।

হোটেলের ডাইনিং হলে বসে যখন সে চা খাচ্ছিল, তখন আশপাশে থাকা অতিথিদের মধ্যে এক কিশোর হঠাৎ বলে উঠল, “বাবা, আমি ওই ঘড়ির শব্দ শুনতে পাচ্ছি না কেন?” তার বাবা হেসে বলল, “ভেতরের স্প্রিং খারাপ হয়ে গেছে, কাজ করে না।” কিন্তু ঋদ্বয়ের কানে তখনও বাজছে সেই চাপা টিকটিক শব্দ, যা বাইরে কুয়াশার পেছনে হারিয়ে যায় না। ঠিক তখনই তার চোখে পড়ে এক তরুণী—কাল রাতের করিডোরে যে ছায়ামূর্তির অবয়ব সে দেখেছিল, সেই ছায়ার মতই চুল, একই চোখ। কিন্তু এই মেয়েটি বাস্তব, ছায়া নয়। সে টেবিলে বসে একটি নোটবুকের ওপর কিছু লিখছে, আর বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। ঋদ্বয় তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে, “মাফ করবেন, আপনার নাম মালবিকা?” মেয়েটি চমকে উঠে বলে, “আপনি কিভাবে জানলেন?” সে হাসে না, তার চোখে ছিল অস্থিরতা। তখনই ঋদ্বয় তার সমস্ত সন্দেহ একসাথে উগরে দেয়—“আপনি কি একই দিন বারবার দেখছেন? প্রতিদিন কেউ না কেউ কি হারিয়ে যাচ্ছে এই হোটেল থেকে?” মালবিকা থমকে যায়। তার ঠোঁট কেঁপে ওঠে, সে ধীরে বলে, “তুমি কি সত্যিই জানো ব্যাপারটা? আমি ভেবেছিলাম শুধু আমি একা এই দুঃস্বপ্নে আটকে আছি।” তারা দুজন মুখোমুখি হয়ে বোঝে—এই লুপে তারা দুজনই বন্দি, আর আজই ছিল তৃতীয় দিন, যখন কেউ একজন নিখোঁজ হবে—অথবা, তাদের এক জন।

দুপুর গড়াতে না গড়াতেই হোটেল থেকে রেজিস্ট্রেশনের এক পর্যটক—এক ফটোগ্রাফার ছেলেকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তার ঘরে গিয়ে ঋদ্বয় দেখে, বিছানা গুছানো, ব্যাগের চেইন খোলা, কিন্তু ক্যামেরা নেই, লোক নেই। কেউ মনে করে, হয়তো সে পাহাড়ে বেরিয়েছে। কিন্তু মালবিকা জানে—এটাই নিখোঁজ হবার শুরু। আগের দিন, সে নিজেও এমন একজনকে দেখেছিল—হোটেলের রুমে থেকে নিখোঁজ, তারপর পরদিন ঠিক যেন কিছুই হয়নি, সেই লোক আবার হাজির। ঋদ্বয় ও মালবিকা ঠিক করে তারা আজ সন্ধ্যা ৬:৪৪-এর আগেই বেরিয়ে যাবে এই হোটেল থেকে। কিন্তু ঠিক ৬টার পরেই যেন সময়ের গতি পাল্টে যায়—বাইরে কুয়াশা ক্রমশ ঘন হয়ে আসে, আর হোটেলের করিডোর যেন লম্বা হতে থাকে অদ্ভুতভাবে। তারা সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে দেখে, নিচে নামার শেষ নেই। প্রত্যেকটি দরজা যেন একই নম্বর—২০৩। এক পর্যায়ে হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়, আর ঘরের ঘড়িতে সেই বন্ধ কাঁটা আবার জ্বলে ওঠে—৬:৪৪। তারা করিডোরের মাথায় দেখতে পায় সেই ছায়ামূর্তি—লম্বা, অস্পষ্ট, চোখ লালচে আলোয় জ্বলছে। সে যেন কারো নাম ধরে ডাকছে—“ঋদ্বয়…” খুব নিচু গলায়। ঋদ্বয়ের শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত নেমে যায়। পেছনে তাকিয়ে দেখে, মালবিকা অদৃশ্য—ঠিক যেমন গতকাল হয়েছিল অন্য কারো সঙ্গে। ঠিক তখনই তার মাথায় আবার ঘোরে, সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসে। পরদিন সে চোখ মেলে দেখে, ঠিক আগের মতো—সকাল ৯টা ১২, জানলার বাইরে সেই একই কুয়াশা, আর ঘড়ির কাঁটা অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে—৬টা ৪৪-এ।

তিন

ঋদ্বয়ের চোখ খুলতেই জানলার বাইরে সেই একই দৃশ্য—ধূসর কুয়াশা, জলেভেজা গাছ, আর পাহাড়ি বাতাসের নিঃশব্দতা। এবার আর অবাক হয়নি সে। মোবাইল হাতে নিয়ে সরাসরি তারিখ আর সময় দেখে—একই: সকাল ৯:১২। সে যেন অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে এই সময়চক্রে। একভাবে উঠে দাঁড়িয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে দেখে—কান চোখ মুখে ক্লান্তি জমে আছে, চোখের কোলে কালি, যেন বহু বছর ধরে সে ঘুমায়নি। ঘড়ির দিকে তাকায়—দেয়ালঘড়ির কাঁটা যেমনটা ছিল, তেমনই রয়েছে—৬টা ৪৪ মিনিট। অথচ এখন সকাল। ঘড়িটা যেন ভেঙে যাওয়া সময়ের প্রতীক নয়, বরং একটা ছায়া, যা এই হোটেল জুড়ে ছড়িয়ে আছে। সে নিজের চুলে হাত বুলিয়ে ধীরে নিচে নামে, যেখানে দিনটা আবার শুরু হয়েছে—বিমল দে একই সংলাপ বলছে, রিসেপশনিস্ট আবার রেজিস্টারে নাম চায়, আর সকালের প্রাতরাশে সেই একই রুটির গন্ধ ভাসছে বাতাসে। কিন্তু এবার সে আর প্যাসিভ ভুক্তভোগী নয়—সে খেয়াল করছে, গুনে রাখছে। তার মনে পড়ে গেল গতকালকের সেই ফটোগ্রাফার ছেলেটির কথা—রূদ্ধা পাল। সে তো কাল সন্ধ্যার পর থেকে নেই। তার ঘরে ছুটে গিয়ে দরজা ধাক্কা দেয় ঋদ্বয়, কিন্তু চমকে ওঠে—রূদ্ধা ভেতরে বসে আছে, ক্যামেরায় কিছু ছবি ঘাঁটছে। যেন কিছুই ঘটেনি।

“তুমি তো…!” ঋদ্বয় কথাটা শেষ করতে পারে না। রূদ্ধা হাসে, “আমরা কি আগে কোথাও দেখা করেছি?” তার ভঙ্গিতে কোনো চিন্তার ছাপ নেই, বরং যেন এক নতুন সকাল তার জন্য শুরু হয়েছে। ঋদ্বয়ের ঠোঁট শুকিয়ে আসে। রূদ্ধা কাল সন্ধ্যায় নিখোঁজ হয়েছিল, আর আজ আবার আগের দিনের মতো ফিরে এসেছে। একটা ভাবনা মাথায় খেলে যায়—যদি এই টাইম-লুপ সত্যিই কাজ করে, তবে প্রতিদিনের শেষে কাউকে ‘মুছে’ ফেলা হয়, কিন্তু সেই মুছিয়ে যাওয়া মানুষ পরদিন আবার ফিরে আসে আগের অবস্থায়, যেন একটি নিখুঁত পুনরাবৃত্তির অংশ। কিন্তু কি ভিত্তিতে কাউকে বেছে নেয় সময়? কে সিদ্ধান্ত নেয় কাকে হারিয়ে দিতে হবে? ঋদ্বয় খেয়াল করল, রূদ্ধার মোবাইল নেই, তার ক্যামেরার স্ক্রিনে হঠাৎ ফ্ল্যাশ করে একটি অদ্ভুত ছবি—এক ছায়ামূর্তির, যার মাথায় ঘড়ির কাঁটা গেঁথে বসে আছে, চোখ দুটো লালচে আলোয় জ্বলছে, আর পেছনে সেই ঘড়ির দেওয়াল। রূদ্ধা ছবিটা দেখিয়ে বলল, “কাল রাতের তোলা, ঠিক মনে নেই কোথা থেকে পেলাম। আজ সকালে এটা দেখি। অদ্ভুত, তাই না?” ঋদ্বয়ের গলা শুকিয়ে আসে, সে আর কিছু বলে না। তার মনে হতে থাকে—এই হোটেলের দেয়াল, ঘড়ি, করিডোর—সব কিছুই যেন একটা জীবন্ত ল্যাবিরিন্থ, যার প্রতিটি কোণে সময় জমে জমে একটা ভয়াবহ আকৃতির জন্ম দিয়েছে।

ঋদ্বয় মালবিকার সঙ্গে দেখা করতে যায় ডাইনিং হলে। মালবিকা এদিকে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। সে নোটবুকে একটা তালিকা করেছে—কে কোন দিনে এসেছে, কারা নিখোঁজ হয়েছে, এবং প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬:৪৪-এর সময় কারা করিডোরে ছিল। “রাতের ঠিক ৬:৪৪-এ সময় থেমে যায় না,” সে বলল, “সময়ের দরজা খুলে যায়, এবং যার মুখ প্রথম সেই ছায়ার চোখে পড়ে, সে হারিয়ে যায়। সেই ছায়ামূর্তিকে আমি বলি ‘ঘড়ির রক্ষক’। সে সময়ের পাহারাদার।” মালবিকা বলল, তার ধারণা অনুযায়ী, ৭ জনের উপস্থিতি লুপে পরিপূর্ণতা দেয়, এবং এই সংখ্যাই প্রয়োজন হয় একটি চক্রে। আর তাই প্রতিদিন কেউ না কেউ “নেওয়া” হয়, যাতে ভারসাম্য থাকে। আজ সেই সপ্তম মানুষটি হল ঋদ্বয়। সে যদি আজ রাতে সেই ছায়ার চোখে পড়ে, হয়তো আর ফিরতে পারবে না। ঋদ্বয়ের বুক ধকধক করে ওঠে, কিন্তু সে জানে এবার পালাবার সময় নয়—সে ঠিক করে, আজ সে ঘড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে, সময় থামার আগেই। সে মালবিকাকে বলে, “আজ আমি সময়কে দেখব, যেন সময় আর আমাকে না দেখে।” সেই রাতে ঘড়ির কাঁটা ৬:৪৪-এর দিকে এগোতে থাকে, করিডোরে বাতি নিভে আসে একে একে, কুয়াশা জানলার কাচ ঘেঁষে নামে নিচু গলায়, আর হোটেলের আয়না… সেই আয়নায় তারা দেখে—এক লালচে আলো আর ছায়া ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে, মুখে নেই কোনো চেহারা, হাতে ধরা ঘড়ির কাঁটা, যেটা এক সময় হয়তো কোনো পাপের চিহ্ন ছিল। আর সেই ছায়া ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে ঋদ্বয়ের দিকে।

চার

মালবিকা লাহিড়ী জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন ঠিক যেভাবে গত তিনদিন ধরে দাঁড়িয়ে আছেন—কাঁধে একটা মোটা চাদর, হাতে তার ছোট ডায়েরি, আর চোখে বিস্তৃত এক চিন্তার সমুদ্র। ডায়েরির পাতাগুলো রোদ না পেয়ে যেন নিজেই ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, তার লেখাগুলো দিনের পর দিন নতুন করে লেখা হচ্ছে, কিন্তু পৃষ্ঠাগুলোতে আগের রাতের আতঙ্ক এখনও জমে থাকে। মালবিকা আজ প্রায় এক সপ্তাহ ধরে এই টাইম-লুপে আটকে আছেন, কিন্তু প্রথম চার-পাঁচ দিন সে বুঝেই উঠতে পারেনি যে তার সঙ্গে কী হচ্ছে। দার্জিলিঙে সে এসেছিল মা-বাবার সঙ্গে, কিন্তু যেদিন তারা হোটেলে ঢোকে, সেদিন রাতেই সব কিছু বদলে যায়। প্রথম দিন সকালটা ছিল শান্ত, ঘোরাঘুরিও হয়, তবে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামতেই তার মা হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যান। বাবা ভেবেছিলেন তিনি ভুল করে বেরিয়ে গেছেন, পুলিশ ডাকার চেষ্টা হয়, কিন্তু সেই রাতে হোটেলের টেলিফোনও কাজ করছিল না। পরদিন সকালে মালবিকা দেখেন সবকিছু আগের অবস্থানে ফিরে এসেছে—তার মা-বাবা একইরকম হাসিমুখে, আগের দিনের মতো জামাকাপড় পরে, ঘর গুছানো, সব কিছু যেন নতুন করে শুরু। কিন্তু কেবল মালবিকার মনেই রয়ে গেছে আগের দিনের স্মৃতি। আর সেই দিন থেকেই সে বুঝতে পারে, সময় এখানে এক অদৃশ্য জালে বাঁধা।

চতুর্থ দিন থেকে মালবিকা খেয়াল করে, প্রতি সন্ধ্যা ৬টা পঁচিশ নাগাদ হোটেলের আলো একটু একটু করে নিভে আসে, আর ৬:৪৪-এর সময় হঠাৎ জানলার বাইরে কুয়াশা এমনভাবে ঘন হয়ে যায়, যেন বাইরের দৃশ্য একদম অদৃশ্য হয়ে পড়ে। ওই সময় কেউ দরজার সামনে থাকলে, সে এক অদ্ভুত চাপা কণ্ঠস্বর শুনতে পায়—একটা দমবন্ধ করা দীর্ঘ নিঃশ্বাস, আর মাঝে মাঝে কারো গলা—যা মানুষের হলেও নয়, প্রেতেরও না। তার ডায়েরির একটি পাতায় সে লিখেছিল:
“সময় থেমে যায়, শুধু তার ছায়া হেঁটে চলে… আর যাকে সে ছুঁয়ে যায়, সে আর সকাল দেখে না।”
প্রথমদিকে বাবা-মাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল মালবিকা, কিন্তু পরদিন ঘুম থেকে উঠে দেখত তারা আবার ‘নতুন সকাল’ শুরু করেছে, কিছু মনে নেই। এই অসহ্য চক্র তাকে ভিতরে ভিতরে অস্থির করে তুলেছিল, কিন্তু সে ঠিক করে, লড়বে। সে প্রতিদিন হিসেব রাখে—কে আসছে, কে যাচ্ছে, কে হারিয়ে যাচ্ছে। আর এই পর্যবেক্ষণের মাঝেই সে বুঝতে পারে, প্রতিদিন রাতে কেউ না কেউ করিডোরের আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব হারিয়ে ফেলে—ঠিক সেই মুহূর্তেই ছায়ামূর্তির চোখ পড়ে যায় তার ওপর।

ঋদ্বয়ের সঙ্গে দেখা হবার দিন মালবিকা প্রথমবার কারো মুখে নিজের ভয়কে প্রকাশিত শুনতে পায়। সে বুঝতে পারে, এই চক্রে সে একা নয়—আর এই উপলব্ধিটা তার ভেতরের একটা শক্তিকে জাগিয়ে তোলে। সে তাকে ডেকে নেয় নিজের ঘরে, ডায়েরি খুলে একে একে সবকিছু দেখায়—তারিখ, সময়, কে কখন নিখোঁজ হয়েছে, কোন ঘরে ছিল, কারা করিডোরে ছিল। তার বিশ্বাস, এই ছায়ামূর্তি—এই ঘড়ির রক্ষক—কেবল তাদের নেয় না, বরং একটা ভারসাম্য রক্ষা করে। হয়তো বহু বছর আগে এখানে সময় নিয়ে কিছু হয়েছিল—কোনো প্রাচীন অভিশাপ, অথবা আত্মহত্যা, বা অস্বাভাবিক মৃত্যু, যার ফলেই সময়ের রেলপথ ভেঙে গেছে। মালবিকা বলে, “ঋদ্বয়, তুমি আজ এখানে এসেছ, ঠিক এই সংখ্যাটা পূর্ণ করতে। আজ তুমি সপ্তম।” সে তাকে দেখে বলে, “কিন্তু তুমি ফিরেছ আগের দিন থেকেও, যেটা কেউ করে না। হয়তো তুমিই পারবে এই চক্র ভাঙতে।” ঋদ্বয়ের চোখে তখন এক অদ্ভুত আলো, আর সে বলে, “তাহলে আজ রাত আমরা একসাথে কাটাব, আয়নার সামনে, ঠিক যখন ৬টা ৪৪ বাজবে। যদি ভয় আসে, একসাথে ভয় পেতে হবে। যদি ছায়া আসে, একসাথে ছুঁতে হবে সেই অন্ধকার। হয়তো আজ সময়কে থামানো যাবে।” মালবিকা জানালার বাইরে তাকায়—কুয়াশা ধীরে ধীরে নামছে, আর বাতাসে ভেসে আসছে করিডোরে ঘড়ির সেই চিরন্তন শব্দ—টিক… টিক… টিক…।

পাঁচ

রূদ্ধা পাল চোখ খুলে দেখে তার বিছানার পাশেই পড়ে আছে তার ক্যামেরা—একটা পুরনো নিকন DSLR, যেটা সে পাহাড়ে ওঠার সময় সর্বক্ষণ হাতে রাখে। অথচ তার মনে পড়ছে না ঠিক কীভাবে আগের দিন রাতটা শেষ হয়েছিল। সে বিছানায় বসে পড়ে আর চারপাশটা একবার দেখে নেয়—সবকিছু ঠিক আছে, কিন্তু কেমন যেন নিষ্প্রাণ, ফাঁপা লাগে পরিবেশটা। দেয়ালে ঘড়ির কাঁটা থেমে রয়েছে ৬টা ৪৪-এ, ঠিক যেমনটা সে গতকালও দেখেছিল। সে দরজা খুলে বাইরে পা রাখে, আর সঙ্গে সঙ্গে এক চাপা ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগে। করিডোর একেবারে নীরব, হোটেলের কর্মচারীরা নিঃশব্দে হেঁটে বেড়াচ্ছে, তাদের মুখে একটা অনুপস্থিত ভাব, যেন তারা কোনো অনন্ত অভ্যাসে অভ্যস্ত। রূদ্ধা একবার ক্যামেরা অন করে ছবি ঘাঁটতে থাকে—তার মনে আছে, কাল সন্ধ্যাবেলায় সে বাইরে বেরিয়ে কিছু পাহাড়ি শট তুলছিল। কিন্তু স্ক্রিনে ফুটে উঠতে থাকে এমন কিছু ছবি, যেগুলো সে মনে করতে পারে না তুলেছে। ছবি একটার পর একটা এগোতে থাকে—একটা ছায়া পাহাড়ের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে, চোখ দুটো থেকে আলো বেরোচ্ছে; আরেক ছবিতে দেখা যাচ্ছে হোটেলের সেই দীর্ঘ করিডোর, কিন্তু দরজাগুলোর নম্বর সব একই—২০৩।

সবচেয়ে অদ্ভুত ছবিটা ছিল একটা আয়নার—তাতে দেখা যাচ্ছে রূদ্ধা নিজে দাঁড়িয়ে আছে, অথচ আয়নাতে তার প্রতিবিম্ব নেই। তার পেছনে একটা অস্পষ্ট অবয়ব ঘাড়ের ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে, হাতে এক টিকটিক শব্দ করা ঘড়ির কাঁটা, আর সে যেন ক্যামেরার দিকেই তাকিয়ে হাসছে—চোখ দুটো লালচে আলোয় জ্বলজ্বল করছে। রূদ্ধা ক্যামেরা নামিয়ে ফেলে দেয়াল ধরে দাঁড়ায়। তখনই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হয়—ঋদ্বয়। সে ভেতরে ঢুকে বলে, “তুমি জানো, কাল রাতে তুমি নিখোঁজ ছিলে। আমি তোমাকে খুঁজেছি, তুমি কোথাও ছিলে না।” রূদ্ধা যেন হেসে ওঠে, “তোমরা সবাই কেন বলছ এটা? আমি তো কোনোদিন নিখোঁজ হইনি।” ঋদ্বয় এবার ক্যামেরার স্ক্রিনের দিকে তাকায়—ছবিগুলো দেখে সে রীতিমতো স্তব্ধ। সে মালবিকাকে ডেকে আনে। মালবিকা ছবি দেখে বলে, “ও বুঝতেই পারছে না, যে প্রতিদিন সে ‘মুছে’ যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে। রূদ্ধা টাইম লুপের ভেতর একটা পরিণত চিহ্ন হয়ে গেছে। হয়তো সে-ই প্রথম ‘নেওয়া’ হয়েছিল।” তারা চেষ্টা করে রূদ্ধাকে বোঝাতে, কিন্তু রূদ্ধার মস্তিষ্কে যেন একটা দেয়াল—সে বিশ্বাসই করতে পারে না যে সময় একই জায়গায় ঘুরছে।

ঋদ্বয় তার নোটবুকে লিখে নেয়, “রূদ্ধা = ধোঁয়াশা + প্রমাণ”। ক্যামেরার ছবিগুলোই যেন এখন সময়ের ছাপ, যা প্রতিদিন মুছে ফেলা হয়, কিন্তু কোনো যন্ত্রের ভেতরে যদি সেটা থেকে যায়? যদি সময় ‘ডিলিট’ করতে না পারে ডিজিটাল প্রমাণ? মালবিকা বলে, “আমাদের এখন দরকার সেই আয়নাটা খুঁজে বের করা, যেটা এই ছায়া প্রতিবার ব্যবহার করে।” রূদ্ধা তাদের থামিয়ে বলে, “আমি একটা কথা মনে করতে পারছি… এক সন্ধ্যায় আমি করিডোরের শেষে একটা দরজার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম, সেখান থেকে ঘড়ির কাঁটার মতো শব্দ আসছিল, আর দেয়ালে লাগানো একটা আয়নায় হঠাৎ আমি নিজেকে দেখতে পাইনি।” তারা বুঝে যায়—হোটেলের যে ঘরটা এখন অব্যবহৃত বলে রাখা আছে, ৩১৭ নম্বর, সেটাই সম্ভবত ছায়ার আসল আস্তানা। তারা সিদ্ধান্ত নেয় আজ রাতেই সেখানে যাবে, ক্যামেরা নিয়ে। রূদ্ধা ক্যামেরার ব্যাটারি চার্জ দিতে বসে, আর আয়নার দিকে একবার তাকায়—তখনই আয়নার কাচে এক ঝলক তার প্রতিবিম্ব হেঁটে চলে যায়… অথচ সে নিজে দাঁড়িয়ে রয়েছে স্থিরভাবে।

ছয়

দার্জিলিঙের কুয়াশা ভেদ করে একদিন সকালে ঋদ্বয় ও মালবিকা বেরিয়ে পড়ে হোটেলের বাইরের লোকজনের খোঁজে—যাঁরা হয়তো ‘Mistview Inn’ সম্পর্কে কিছু জানেন। হোটেল মালিক বিমল দে-কে প্রশ্ন করা অর্থহীন; সে প্রতিবার একইরকম খাপছাড়া হাসি দেয় আর বিষয় ঘুরিয়ে দেয়। তবে হোটেলের পাশেই একটা ছোট চায়ের দোকান আছে, যেটা সকালে খোলে, দুপুরের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়। সেই দোকানে চা বানাচ্ছিল এক বৃদ্ধ—খুব শান্ত স্বভাবের, কুচকুচে সাদা গোঁফ, ভুরু আর মুখে জমাট কুঁচকে যাওয়া চামড়া। তার নাম পূর্ণচন্দ্র রাই, বয়স আশির কাছাকাছি। তিনি এখানে ৫০ বছর ধরে আছেন। প্রথমে তিনি ওদের কথায় কান না দিলেও যখন ঋদ্বয় ঘড়ির সময় আটকে থাকা, নিখোঁজ পর্যটক আর রুম ২০৩-র প্রসঙ্গ তোলে—তখনই বৃদ্ধ চুপ করে যায়। তারপর ধীরে চা ঢালতে ঢালতে বলে, “তোমরা Mistview-এর ভেতরের সময়টা দেখতে পাচ্ছো… বুঝতে পারছো? মানে এখনো পুরোপুরি গ্রাস করে নেয়নি।”

ঋদ্বয় আর মালবিকা স্তব্ধ হয়ে তার কথা শুনতে থাকে। বৃদ্ধ বলেন, “১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে, Mistview হোটেলে এক ভয়ানক ঘটনা ঘটে। সেই সময় হোটেলটা বেশ জমজমাট, ব্রিটিশ আমলের স্ট্রাকচার, কাঠ আর লোহার মিশেলে তৈরি—ভূমিকম্পেও টলেনি। তবে সেই এক রাতে সব কিছু বদলে যায়। হোটেল ঘরের একটাতে ছিল এক ট্যুরিস্ট পরিবার—স্বামী, স্ত্রী আর তাদের আট বছরের ছেলে। রাতে ৬টা ৪৪ নাগাদ ছেলেটি করিডোরে খেলা করতে করতে উধাও হয়ে যায়। পুলিশ আসে, খোঁজাখুঁজি হয়, কিন্তু কারো কোনো হদিশ মেলে না। মায়ের মানসিক অবস্থা খারাপ হয়ে যায়, তিনি বারবার বলেন ছেলেকে আয়নার ভেতর কেউ টেনে নিয়েছে। বাবা একসময় পাগল হয়ে গিয়ে হোটেলের দেয়ালের ঘড়ির কাঁটা নিজের চোখে গেঁথে দেয়… তারপর হোটেল বন্ধ হয়ে যায় এক বছর।” মালবিকা তখন হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, “ঘড়ির কাঁটা? মানে বাস্তব ঘড়ির কাঁটা দিয়ে চোখে?” বৃদ্ধ মাথা নাড়েন, “হ্যাঁ… আর সেই থেকে প্রতি বছর ওই সময় এখানে কোনো না কোনোভাবে মানুষ নিখোঁজ হতে শুরু করে। পরে হোটেল মালিক পাল্টে যায়, কিন্তু অভিশাপটা থেকে যায়। আমি নিজে এখানে কাজ করতাম, ১৯৮৫ পর্যন্ত। তারপর চলে আসি… কিন্তু ওই সময়টার কুয়াশা এখনও বদলায় না।”

ঋদ্বয় ও মালবিকা এখন বুঝতে পারে, টাইম-লুপটা কেবল আধুনিক প্রযুক্তি বা মনের বিভ্রম নয়—এটা একটি অভিশপ্ত সময়ের বলয়, যেটা সৃষ্টি হয়েছিল এক শিশুর নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। আয়না, ঘড়ি, ছায়ামূর্তি—সবই হয়তো সেই সময়ের ‘ছায়া’ মাত্র। মালবিকা বলে, “আপনি কি জানেন সেই ছেলেটির নাম?” বৃদ্ধ থেমে যায়, কিছুক্ষণ ঠোঁট কামড়ে বলে, “হ্যাঁ… নাম ছিল নীলাভ। ওর মা বলত, ওর জন্ম হয়েছিল ৬টা ৪৪ মিনিটে সন্ধ্যায়।” এই তথ্য শুনে ঋদ্বয়ের মাথায় ঝড় ওঠে। যদি সেই সময়টায় জন্মই কাউকে সময়ের কেন্দ্র বানিয়ে দেয়, তাহলে নীলাভ তার মৃত্যুর মুহূর্তে সেই সময়কে নিজের মতো করে থামিয়ে রাখতে চেয়েছিল? হয়তো আয়নার ভেতর থেকে সে বা তার ছায়া এখনও নতুন ‘সঙ্গী’ খোঁজে। সেই সন্ধ্যা ৬:৪৪ মানেই এক চক্রের দ্বার খুলে যায়। ঋদ্বয় চায়ের কাপ নামিয়ে বৃদ্ধকে বলে, “আপনি বলেছিলেন—সবকিছু এখনো পুরোপুরি গ্রাস করেনি আমাদের। তাহলে সময় এখনও আমাদের নিতে পারেনি?” পূর্ণচন্দ্র রাই তখন একবার পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে বলে, “সময় সব নেয় না বাবু… কেবল যাদের ভয় সবচেয়ে গভীরে, তাদের ঘড়ির কাঁটা থামিয়ে রাখে। যারা নিজে থেকে ছায়ার চোখে তাকায়, তারাই ফিরে যেতে পারে না।”

সাত

রাত নেমে এসেছে Mistview Inn–এ, কিন্তু এই রাত যেন আর পাঁচটা রাতের মতো নয়—আজ সময় নিজের শ্বাস থামিয়ে অপেক্ষা করছে। করিডোরের আলো টিমটিম করছে, জানলার কাচ জুড়ে জমেছে ঘন কুয়াশা, যেন হোটেলের বাইরের পৃথিবী মুছে গেছে। ঋদ্বয়, মালবিকা আর রূদ্ধা তিনজন প্রস্তুত—হাতে ক্যামেরা, সঙ্গে একটি ছোট্ট LED টর্চ আর মালবিকার সেই রহস্যময় ডায়েরি। তাদের লক্ষ্য একটাই—ঘর ৩১৭, সেই পরিত্যক্ত কক্ষ, যেটা সময়ের কেন্দ্র হতে পারে। হোটেলের শেষ মাথায় সেই ঘর, যার দরজার ওপর একটিমাত্র মরচে ধরা নামফলক, লেখা প্রায় ঘষে মুছে গেছে। রূদ্ধা বলে, “দরজাটা অনেকদিন খোলা হয়নি। আলো নেই।” ঋদ্বয় ধীরে ধাক্কা দেয়, আর ঘড়ির ঠিক ৬:৩৯ বাজে।

ঘরটায় ঢুকতেই চারপাশ জুড়ে গন্ধ—পুরনো কাঠের, আর্দ্রতা আর ধুলোর গন্ধ। মেঝে কাঁপছে হালকা করে, যেন হোটেল নিজেই নিঃশ্বাস নিচ্ছে। দেওয়ালে পুরনো, অর্ধভাঙা আয়না ঝুলছে, আর সেই আয়না দেখতে একেবারে অস্বাভাবিক—তাতে প্রতিবিম্ব ফুটে ওঠে না পরিষ্কারভাবে, বরং চেহারা বিকৃত হয়ে যায়। রূদ্ধা ক্যামেরা অন করে আয়নার ছবি তোলে, আর তখনই ক্যামেরার স্ক্রিনে দেখা যায়—আয়নার পেছনে একজন দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু বাস্তবে পেছনে কেউ নেই। মালবিকা ডায়েরি খুলে পড়ে, “সময় যখন আয়নায় আটকে যায়, ছায়া তখন শরীর খোঁজে।” হঠাৎ আয়নায় টকটকে লাল চোখ জ্বলে ওঠে, আর বাতাস হিম হয়ে যায়। ঘরটা কেঁপে ওঠে হঠাৎ, জানলার কাচে ঠকঠক শব্দ, আর ঘড়ি… ঘড়ির কাঁটা নিজের জায়গা থেকে ঘুরতে শুরু করে—৬:৪১… ৬:৪২…

তারা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, তখন হঠাৎ করে আয়নায় এক পুরনো দৃশ্য ফুটে ওঠে—এক বাচ্চা ছেলে খেলছে করিডোরে, হঠাৎ করেই তার চোখ মুখে ভয়, সে দৌড়াতে শুরু করেছে আর পেছনে… একটা ছায়া ধাওয়া করছে। ছেলেটা বারবার পেছনে তাকিয়ে বলছে, “মা… মা…” আর তারপর হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে—আয়নার মধ্যেই ঢুকে পড়ছে। মালবিকা ফিসফিস করে বলে, “এটাই নীলাভ… এই সেই দিন।” ঠিক সেই মুহূর্তে ঘড়ির কাঁটা ৬:৪৪ পেরোয়, আর আয়না বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে। হঠাৎ ঘরের বাতি নিভে যায়। ছায়ামূর্তি ঠিক তাদের পেছনে—উচ্চতা ছাদের প্রায় কাছাকাছি, চোখ থেকে আলো ছিটকে বেরোচ্ছে, হাত থেকে ঝুলছে ভাঙা ঘড়ির কাঁটা। সে এগিয়ে আসে নিঃশব্দে। রূদ্ধা ঘাবড়ে গিয়ে ছবি তোলে, কিন্তু ক্যামেরা কাজ করে না—ব্যাটারি একেবারে শেষ। মালবিকা ঘরের এক কোণে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে, ডায়েরি খুলে পড়ে যায়, “ছায়ার চোখে তাকিও না… নয়তো সময় তোমাকে খেয়ে ফেলবে।”

ঋদ্বয় সাহস করে মুখোমুখি দাঁড়ায় ছায়ার। তার মনে পড়ে পূর্ণচন্দ্র রাই বলেছিলেন—“যে ভয় পায় না, সেই ফিরে যায়।” সে চোখ বন্ধ করে বলে, “তুই আমাকে নিতে পারিস না। আমি তোকে ভয় পাই না। সময়কে আমি দেখেছি, ছুঁয়েছি।” তখন ছায়ামূর্তির পায়ের নিচে আয়না ফেটে যায়, ভেতর থেকে এক তীব্র ঝড় উঠে আসে। হোটেল কেঁপে ওঠে। ছায়া আরেকবার বিকট কণ্ঠে বলে, “সময়… চলবে…” তারপর অদৃশ্য হয়ে যায়। আয়নার ভেতর আলো জ্বলে ওঠে, আর আয়নার কাচে দেখা যায়—এক দরজা, যেটা তারা আগে দেখেনি। দরজা খুললেই হয়তো তারা বেরোতে পারবে এই চক্র থেকে। কিন্তু তার আগে… কাউকে থেকে যেতে হবে ভিতরে। সময়কে পাহারা দিতে।

আট

ঘরের মেঝেতে চিড় ধরা আয়না এখন এক রহস্যময় দরজা—তার কাঁচের ভেতরে গাঢ় রুপোলি আলো ঘূর্ণি খাচ্ছে, যেন এক অজানা সময়ের প্রবাহ। ঝড় থেমে গেছে, কিন্তু ঘরটা নিঃশব্দ হয়ে আছে এক অস্বাভাবিক ভারে। ছায়ামূর্তি অদৃশ্য, কিন্তু তার উপস্থিতি যেন এখনও বাতাসে জমে আছে। তিনজন—ঋদ্বয়, মালবিকা আর রূদ্ধা—দাঁড়িয়ে থাকে দরজাটার দিকে চেয়ে। আয়নার গায়ে ভেসে ওঠে এক অদ্ভুত বাক্য, যেটা রক্তের মতো লাল:
“Time needs a watcher. Only two may pass.”
মালবিকা ধীরে বলে, “আমাদের মধ্যে একজনকে থেকে যেতে হবে… সময়ের পাহারাদার হয়ে।” সে ডায়েরির পাতায় চোখ রাখে—একটা পুরনো লাইন সে আগেও পড়েছিল:
“যেখানে সময় থামে, সেখানে একটা মন জেগে থাকতে হয়।”
ঋদ্বয়ের মুখ থমথমে, সে জানে এই দরজার ওপারে হয়তো মুক্তি আছে, হয়তো স্বাভাবিক সময়ের ফিরে যাওয়া, কিন্তু কেউ একজন যদি এই ঘরের মাঝে, এই ধ্বংসস্তূপ সময়ের কেন্দ্রে না থাকে—এই চক্র কখনোই থামবে না।

রূদ্ধা হঠাৎ বলে ওঠে, “আমি থাকব।” তার গলা শান্ত, চোখে এক অভ্যস্ত বিষণ্নতা। “আমি আগেও অনেকবার মুছে গেছি, ফিরে এসেছি, হয়তো এই সময়ের সঙ্গে আমার কিছু চুক্তি আগে থেকেই হয়েছে, যা আমি নিজেই জানি না। আমি তো এক অর্থে মৃত—তোমরাই এখনো জ্যান্ত।” মালবিকা এগিয়ে এসে তার কাঁধে হাত রাখে, “তুমি ভেবেছ এটা সহজ? এখানে থেকে যাওয়া মানে চেতনায় অচল থাকা, প্রতিটি রাত সেই ছায়ার মুখোমুখি হওয়া, প্রত্যেক ৬টা ৪৪-এ এক অসমাপ্ত মৃত্যুর সাক্ষী হওয়া।”
রূদ্ধা মাথা নিচু করে বলে, “তবু এটাকেই আমি বুঝতে পারি। আমি ছবি তুলে রেখেছি অনেকের হারিয়ে যাওয়ার। আজ হয়তো আমি শেষবার তুলি… নিজেকে।”

ঋদ্বয় এগিয়ে আসে, “না, রূদ্ধা, এটা দায়িত্ব নয়—এটা আমাদের সিদ্ধান্ত হতে হবে। আমরা কেউই নায়ক না, কেউই ঋষি নই। সবাই ভয় পাই। কিন্তু এই চক্র যদি ভাঙতেই হয়, তবে তোমার থাকাটাই যুক্তিযুক্ত। কারণ তুমি এই লুপে প্রথম ছিলে, তোমার অস্তিত্ব হয়তো এর মূলে বাঁধা।”
রূদ্ধা হালকা হাসে, “অত কথার দরকার নেই। আমি থাকব। শুধু… আমার ক্যামেরাটা নিয়ে যেও।” সে ক্যামেরাটা ঋদ্বয়ের হাতে তুলে দেয়।

তারা আয়নার সামনে দাঁড়ায়। মালবিকা ফিসফিস করে বলে, “তুমি আমাদের মনে থাকবে, রূদ্ধা।”
রূদ্ধা চুপচাপ দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। তার পিছনে আয়নার কাঁচে আবার ছায়ামূর্তির আবছা উপস্থিতি ঘনিয়ে আসে। আলো হঠাৎ ম্লান হয়ে আসে, ঘড়ির কাঁটা আবার ধীরে ৬টা ৪৪-এ থেমে যায়।

ঋদ্বয় আর মালবিকা আয়নার ভিতর পা রাখে—হালকা আলোতে শরীর গলে যায়, যেন সময় এক নতুন পাতায় তাদের লিখে নিচ্ছে। তারা অদৃশ্য হয়ে যায়।
আর ঘর ৩১৭–এ রূদ্ধা একা দাঁড়িয়ে থাকে, পেছনে ছায়া ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে, তার কাঁধে হাত রাখে, আর দেয়ালের ওপর ঘড়ির কাঁটা নিজে নিজে ঘুরে উঠে দাঁড়ায়—৬:৪৫।

প্রথমবারের মতো ঘড়ির কাঁটা চলে…

নয়

আলোটা চোখে সরাসরি এসে পড়ল। ঋদ্বয় চোখ মেলে প্রথম যে জিনিসটা দেখে, তা হল একটা সাদা জানালার পর্দা—ভিজে কুয়াশা নেই, ঘড়ির কাঁটা থেমে নেই, বরং এক ঝকঝকে সকাল। গলার স্বর শুনে সে চমকে ওঠে—“গুড মর্নিং স্যার, আপনার চা।” এক হোটেল কর্মচারী ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে। পাশে মালবিকা ধীরে ধীরে উঠে বসে, চোখ কুঁচকে বলে, “আমরা… কোথায়?” রিসেপশন থেকে ভেসে আসে অন্য অতিথিদের কোলাহল, হাসি, পত্রিকা উল্টোনোর শব্দ। মনে হচ্ছে যেন Mistview Inn ফিরে গেছে স্বাভাবিকতায়। ঘড়ির কাঁটাটা টিকটিক করছে ঠিকভাবে—সকাল ৯:১৬।

দু’জন একে অপরের দিকে তাকায়—কেউ কিছু বলে না, শুধু চোখের ভিতর ধরা পড়ে গাঢ় এক বেঁচে থাকার শ্বাস। তারা নিচে নেমে আসে, কেউ আর অদ্ভুতভাবে তাদের দিকে তাকায় না, কেউ আগের দিনের কথা মনে রাখে না। বিমল দে বসে খবরের কাগজ পড়ছে, আর কফিতে চুমুক দিচ্ছে, দেখে মনে হয় সে কখনোই কোনো রহস্যের মধ্যে ছিল না। মালবিকা বলে, “আমরা কি সত্যিই ফিরে এসেছি?” ঋদ্বয় টেবিলের ওপরে রাখা ক্যামেরাটা খুঁজে পায়—রূদ্ধার নিকন। সে ব্যাগ খুলে স্ক্রিন অন করে ছবি দেখতে থাকে। সব আগের মতোই আছে—ছবির মধ্যে নীলাভ, আয়না, ছায়া… আর সবশেষ ছবিটা… রূদ্ধা। কিন্তু সেখানে সে একা নেই—পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক বালক, নীল সোয়েটার পরা, যার চোখে গভীর শান্তি, মুখে এক চিলতে হাসি। ছবিটার নিচে টাইমস্ট্যাম্প—৬:৪৪:০০।

মালবিকা ছবি দেখে চোখে জল আনে। “রূদ্ধা এখনও আছে… কোথাও সময়ের প্রহরায়।” তারা হোটেল ছাড়ে। দার্জিলিংয়ের পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে নামতে নামতে তারা খেয়াল করে, এই শহর আগের মতোই আছে, কিন্তু তাদের ভেতরে কিছু একেবারে পাল্টে গেছে। তারা যেন এক আলাদা মাত্রায় নেমে এসেছে। ঋদ্বয় হাত ধরে মালবিকার, “আমরা ফিরে এসেছি ঠিকই, কিন্তু আমাদের একটা অংশ চিরকাল থেকে গেল সেখানে।” মালবিকা ধীরে বলে, “সেই ঘরে… সেই আয়নায়।”

নীচের শহরে পৌঁছে তারা একটা স্থানীয় বইয়ের দোকানে ঢোকে। মালবিকা একটা পুরনো বই দেখে চমকে ওঠে—“Darjeeling’s Cursed Spaces” নামে বইটি। তাতে একটি অধ্যায়:
“The Inn Where Time Stood Still”
ছবি: Mistview Inn। তার নিচে লেখা:
“Rumors speak of a room numbered 317, where time halts every evening at 6:44 PM. Witnesses vanish, yet sometimes… return.”

ঋদ্বয় বই বন্ধ করে দোকানদারকে জিজ্ঞেস করে, “এই হোটেলটা কি এখনো চালু?” দোকানদার অবাক হয়ে বলে, “কোন Mistview Inn? সেটা তো তোরা বলছিস কোথাকার নাম? এখানে তো এমন কোনো হোটেলই নেই।”
তারা দুজন একে অপরের দিকে তাকায়।

ঘড়ির কাঁটা তখন দুপুর ১২টা পেরিয়ে গেছে।

কিন্তু…
ঋদ্বয়ের কানে তখনো যেন শুনতে পায় একটা দূরের ঘড়ি…
টিক… টিক… টিক…

দশ

ঘর ৩১৭-তে নীরবতা থমকে আছে। বাইরে ঝড় থেমে গেলেও, এই ঘরের জানালায় কুয়াশা আরও ঘন হয়ে জমে উঠেছে, যেন জানলার ওপাশে আর কোনো জগৎ নেই। রূদ্ধা বসে আছে সেই আয়নার সামনে, হাতে তার ক্যামেরা—কিন্তু সে জানে এখন এই ক্যামেরা আর কোনো ‘চিত্র’ ধারণ করে না, বরং সে নিজেই ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে এক চলমান ছবি, সময়ের অদৃশ্য ফ্রেমে বাঁধা।

প্রথম কয়েকঘণ্টা সে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কেবল নিজেকে খুঁজেছে—নিজের শ্বাসে, নিজের ছায়ায়, নিজের চেতনায়। কিন্তু ধীরে ধীরে সে খেয়াল করে তার ছায়া আর আগের মতো নেই। আয়নার কাচে আজ আর তার প্রতিফলন পড়ে না। সে ঘুমোতে পারে না, ক্লান্তি আসে না, ক্ষুধা-পিপাসা নিঃশেষ। ঘড়ির কাঁটা প্রতি সন্ধ্যায় যখন ৬:৪৪-এ পৌঁছায়, তখন তার চারপাশে বাতাস থেমে যায়, আয়নার কাচে নীলাভের মুখ ভেসে ওঠে—হাসি মুখে, ছোট্ট গলায় বলে, “তুমি আমার সঙ্গে থাকো?” আর তখন সে বুঝতে পারে—এই সময়ের কেন্দ্রবিন্দুতে রূদ্ধা একমাত্র মানবিক অস্তিত্ব, যাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে অনন্ত সময়।

একদিন সে আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের মুখে কিছু অদ্ভুত পরিবর্তন দেখে—চোখে আলো, ঠোঁটের কোণে এক ছায়া, ঘাড়ে ভারী হয়ে ওঠা কাঁধের কাছে একটা ভাঙা ঘড়ির কাঁটার আঁচড়। আর তখন সে স্মরণ করে—প্রথমবার Mistview Inn-এ এসেছিল প্রায় সাত বছর আগে, কিন্তু তার চেতনায় সেই স্মৃতি এক অদ্ভুতভাবে ফাঁকা। সে হয়তো আগেও এই ঘরে আটকে পড়েছিল, আবার মুক্ত হয়ে গিয়েছিল ভুলে গিয়ে, কিন্তু এবার সে নিজেকে মনে রাখছে। এবার সে জানে, আর ফিরবে না।

রাতে আবার দরজা খুলে যায়… কুয়াশার ভেতর দিয়ে কেউ হেঁটে আসে। ছায়া নয়—এক কিশোরী, হয়তো প্রথমবার Mistview-এ। তার চোখে ভয়, কাঁধে ব্যাগ, চুল ভেজা। সে দরজায় দাঁড়িয়ে বলে, “এই ঘর কি খালি?”
রূদ্ধা এবার উঠে দাঁড়ায়, ধীরে বলে, “না, এখন আর নয়।”
আয়নার গায়ে আবার ভেসে ওঠে লাল অক্ষরে লেখা:
“Time needs a watcher.”

আর তারপর থেকে…
ঘর ৩১৭ আর কখনো খালি থাকে না।
প্রতিটি সন্ধ্যা ৬:৪৪-এ, Mistview Inn–এ বাতাস থেমে যায়।
একটি ছায়ামূর্তি করিডোর ধরে হেঁটে চলে…
যার চোখে লাল আলো, আর হাতে ক্যামেরা—
যেটা আর ছবি তোলে না, শুধু সময় জমা রাখে।

সমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *