সায়ন্তিকা দাশগুপ্ত
অধ্যায় ১: শেষ কৌশলের রাত
স্টার থিয়েটারের আলো নিভে যাওয়ার মুহূর্তেই সবার নিঃশ্বাস যেন আটকে গিয়েছিল। কলকাতার থিয়েটার-প্রেমীরা বহুদিন পর আবার এমন চমকপ্রদ কিছু প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছেন—রাজদীপ মুখার্জির “শেষ কৌশল”। থিয়েটারজুড়ে স্তব্ধতা। পর্দা ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে, ঘন কালো ধোঁয়ার মধ্যে থেকে উদিত হচ্ছে সোনালী আলো, তার মাঝে একা দাঁড়িয়ে আছেন রাজদীপ—তার মুখাবয়বে এক রহস্যময় আত্মবিশ্বাস, গলায় কোটের কলার তুলে। হাতজোড়া তুলে বললেন, “এই কৌশল দেখার পর যদি কেউ বলতে পারেন কীভাবে করলাম, আমি আমার ম্যাজিক ছাড়বো। আর যদি না পারেন, তবে আজ আপনারা দেখবেন… মৃত্যু থেকে ফেরা যায় কি না!” দর্শকদের ভেতরে কেমন যেন এক অজানা কাঁপুনি ছড়িয়ে পড়ল। সামনে রাখা ছিল লোহার তৈরি একটি কাচঘেরা কক্ষ, তার ভিতর একটি ইলেকট্রিক চেম্বার, যার নিচে গ্যাসের বার্নার। রাজদীপ নিজেই তার দেহে স্টিলের শেকল পরিয়ে, তালা লাগিয়ে নিজে ঢুকলেন সেই কাচের ঘরে। তার সহকারী হর্ষিল বাইরে থেকে চেম্বার লক করল, বিপ্লব রায় মঞ্চের সাইড থেকে সব কনফার্ম করে নিল—লাইটিং, ফায়ার, সময়, সব ঠিকঠাক চলছে কি না। দর্শকদের উচ্ছ্বাস আর উত্তেজনার মধ্যেই শুরু হল কাউন্টডাউন। ঘড়ি ধরে চলা ১২০ সেকেন্ড, যেখানে রাজদীপকে বেরিয়ে আসতে হবে—অথচ সেই ঘর ধীরে ধীরে গরম হতে শুরু করল, আগুনের শিখা দেখা গেল নিচের চেম্বারে। ধোঁয়ার মধ্যে রাজদীপের আবছা মুখ, তারপর নিঃশব্দ চিৎকার। হঠাৎ শোনা গেল একটা জোরালো শব্দ, একটা বিস্ফোরণ—স্টেজ কেঁপে উঠল। মুহূর্তেই থিয়েটারের লাইট নিভে গেল।
আলো ফেরার সময়, ধোঁয়ার মধ্যে থেকে যেটুকু দেখা গেল, তা শুধু ভয়াবহ। কাচের ঘরের ভিতর পড়ে আছে রাজদীপের অচেতন দেহ। শেকল খোলা, কিন্তু শরীর পুড়ে কালো। হর্ষিল ছুটে গেল, বিপ্লব চিৎকার করে ডাকল অ্যাম্বুলেন্স, দর্শকরা আতঙ্কে থিয়েটার ছেড়ে বেরিয়ে যেতে শুরু করল। পুলিশ এসে মঞ্চ ঘিরে রাখল, ততক্ষণে চিকিৎসক এসে জানিয়েছে—“রাজদীপ মুখার্জি মৃত। শরীরে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার চিহ্ন।” কেউ কিছু বুঝতে পারছিল না। আগুন জ্বলেছিল ঠিকই, কিন্তু সে আগুনের তাপে এত ক্ষত হয় না। আর যদি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন, তাহলে কিভাবে শেকল খুললেন? পুলিশের বক্তব্য: “অত্যন্ত দুঃখজনক দুর্ঘটনা। হয়ত তার কৌশলের সময় কিছু বৈদ্যুতিক ত্রুটি হয়েছিল।” কিন্তু থিয়েটারপ্রেমীদের অনেকেই জানতেন—রাজদীপের মতো পারফেকশনিস্ট এমন ভুল করেন না। তার শো আগে বহুবার একইভাবে হয়েছে, কখনো এইরকম কিছু হয়নি। সবাই স্তব্ধ, বিখ্যাত এক ম্যাজিশিয়ানের শেষ শো, যেন সত্যি হল “শেষ কৌশল”—একেবারেই শেষ।
তবে মঞ্চের শেষ সারিতে বসে থাকা একজন লোক তখনও উঠেননি। তিনি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ছিলেন, তার চোখ গভীর, সন্দেহে ভরা, ঠোঁটে ধরা একটা পুরনো কাঠের পাইপ। তার নাম নীরজ সেন। কেউ তাকে চেনে না, কিন্তু একসময় রাজদীপের ছাত্র ছিলেন। সম্পর্ক শেষ হয়েছিল এক প্রচণ্ড ঝগড়ার পর। আজকের শো তিনি টিকিট কেটে নয়, পাস নিয়ে দেখেছেন, ইরার এক বন্ধু তার জন্য রেখে গিয়েছিল। নীরজ জানতেন—রাজদীপ এমন “ঘটনাচক্রে” মরতে পারেন না। তার চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছিল থিয়েটারের নানা প্রান্ত—স্টেজের তলার দিকে এক কোণায় একটা লাল তার দেখা যাচ্ছে, যেটা সাধারণত ম্যাজিক কন্ট্রোলের সাথে যুক্ত হয় না। আর হর্ষিল যখন চেম্বার বন্ধ করছিল, তার কাঁপা কাঁপা হাত নজর এড়ায়নি। কিন্তু সবথেকে বেশি সন্দেহ তার হলো যখন পুলিশ কর্মকর্তারা বললেন, “মনে হচ্ছে দুর্ঘটনা”—এইভাবে একজন ম্যাজিক মাস্টার মারা যাবেন আর সবাই ধরে নেবে এটা দুর্ঘটনা? নীরজ ধীরে ধীরে চেয়ার থেকে উঠলেন, থিয়েটারের অন্ধকার ফাঁকা হলগুলোতে চুপচাপ হেঁটে চললেন ব্যাকস্টেজের দিকে। তার মন বলছিল, কিছু একটা খুব ভুল হয়েছে, আর সেই ভুল নয়—ইচ্ছাকৃত। এটা দুর্ঘটনা নয়, পরিকল্পিত খুন। এবং সেই খুনি ছিল মঞ্চেই, দর্শকদের সামনে, আলো-ধোঁয়া আর বিভ্রান্তির মধ্যে। ম্যাজিকের আড়ালে লুকিয়ে থাকা একটা রক্তাক্ত ছায়া। নীরজ জানতেন, তদন্ত এখনই শুরু করতে হবে—তাঁকে কেউ ডাকবে না, কিন্তু তিনিই পারবেন দেখতে সেই কৌশল যা সবাই মিস করেছে—“মৃত্যুর আসল ম্যাজিক।”
অধ্যায় ২: নীরজ সেন – অচেনা তদন্তকারী
স্টার থিয়েটারের পেছনের করিডোরটা কেমন অস্বস্তিকরভাবে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিল। দেয়ালের পেছনে নীলাভ আলো, দূর থেকে ভেসে আসা অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন, আর তার মাঝখানে ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছিল এক চুপচাপ মানুষ—নীরজ সেন। তার হাতে ধরা ছিল একটা পুরনো সিগারেটের কেস, কাঠের পাইপ ঠোঁটে, চোখ জোড়া থমথমে। কেউ তাকে কিছু জিজ্ঞেস করল না, থিয়েটারের লোকেরা ব্যস্ত, পুলিশ ব্যস্ত, কেউ জানেও না এই মানুষটা কে। কিন্তু নীরজ জানত, সে ঠিক কোথায় যাচ্ছে—স্টেজের নিচে, সেই “ট্র্যাপ ডোর” রুমে, যেখানে রাজদীপের শো-এর মেকানিজম নিয়ন্ত্রিত হয়। দরজা খোলা, ভিতরে হর্ষিল—রাজদীপের তরুণ সহকারী—সিটিয়ে বসে আছে, চোখ কোটরের মতো কালো, কাঁধ কাঁপছে। নীরজ দরজার কড়া না দিয়ে সরাসরি ঢুকে বলল, “তুমি তো মঞ্চের নিচে ছিলে, কী দেখলে?” হর্ষিল কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। তার চোখে ভয়, মুখে আতঙ্ক। নীরজ এক চুমুক নেয় পাইপে, ধোঁয়ার কুন্ডলী ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। “কে আসতে বারণ করেছে তোমায়?” — নীরজের গলায় কোমল চাপা উত্তেজনা। হর্ষিল ফিসফিস করে বলল, “আমি… আমি কিছু জানি না… আমি শুধু তালা লাগিয়েছিলাম…” নীরজ জানে, ও কিছু একটা লুকোচ্ছে। এই ভয়—এটা শুধু দুর্ঘটনার নয়, এটা কারও হুমকির ছায়া। তার চোখ ঘুরে যায় ঘরের এক কোণে—একটি মোটা তার, যেটা ট্র্যাপ দর লিফটের সাথে সংযুক্ত, কিন্তু এতে একটা অতিরিক্ত স্পার্ক সিস্টেম বসানো হয়েছে। “এইটা তো ছিল না!”—নীরজ মাটিতে বসে তারটা পরীক্ষা করে দেখে, তা নতুন। কে বসাল? কেন? একজন ম্যাজিশিয়ানের মৃত্যুর জন্য এটুকুই যথেষ্ট—একটা অতিরিক্ত কারেন্ট, একটি ভুল লাইন, আর একটি নির্ভুল পরিকল্পনা।
নীরজ স্টার থিয়েটার থেকে বেরিয়ে পড়ে গভীর রাতে, তার মন ঘুরপাক খাচ্ছে পুরনো স্মৃতির ধুলোয়। আজ থেকে আট বছর আগে, সে নিজেও রাজদীপের সেরা ছাত্র ছিল। একসময় রাজদীপ বলেছিলেন, “তুই একদিন আমায় ছাড়িয়ে যাবি।” কিন্তু তার কিছুদিন পরেই সম্পর্ক ভেঙে যায়। কারণ—একটা ট্রিক, যেটা নীরজ তৈরি করেছিল, রাজদীপ সেটাকে নিজের নামে শো-তে ব্যবহার করে। চরম অপমানিত হয়ে নীরজ শিষ্যত্ব ত্যাগ করে, এবং হারিয়ে যায় কালীঘাটের গলির ভিতর ছোট ম্যাজিক পার্টির জগতে। কিন্তু আজ, সেই পুরনো রাগ, আক্রোশ নয়—তার জেদের জায়গা একটাই: “এটা দুর্ঘটনা না, এটা খুন। আর খুনিকে আমি খুঁজব।” সে তার পুরনো ডায়েরি বের করে, যেখানে সে একসময় রাজদীপের কৌশল বিশ্লেষণ করত, স্কেচ করত থিয়েটারের ভেতরের গঠন। ডায়েরির এক পাতায় লেখা ছিল: “Death Escape—শুধু ফিজিক্যাল ট্র্যাপ না, এটা সাইকোলজিক্যাল বিভ্রান্তি।” সে জানে, কাউকে ফাঁসাতে হলে মঞ্চটাই যথেষ্ট। আর যে এমন ট্রিক জানে, সে হতে পারে থিয়েটারের টেকনিক্যাল স্টাফ—অথবা তার পরিবারের কেউ। সে পরদিন রাজদীপের বাড়িতে যায়, দেখা করে ইরার সঙ্গে। ইরা দুচোখে জল নিয়ে বলল, “আমি জানতাম না বাবা সত্যিই এটা করবেন… উনি গত এক সপ্তাহ ধরে কারও সঙ্গে কথা বলতেন না, শুধু বারবার বলতেন—‘শেষ বার, এটা শেষ শো… তারপর আমি থেমে যাব।’” নীরজ গভীর চোখে তাকিয়ে বলল, “আপনার বাবার কী এমন কথা ছিল, যা তিনি কারও সঙ্গে ভাগ করে নেননি?” ইরা এক মুহূর্ত চুপ করে রইল। তারপর বলল, “শেষ একদিন আগে বাবার সঙ্গে কাকু—সঞ্জীব কাকু—ভীষণ ঝগড়া হয়েছিল… আপনি চাইলে… আপনি আবার মঞ্চ দেখতে পারেন… আমি সাহায্য করব।” নীরজ জানে, ইরা কিছু বলছে না। কিন্তু তার চোখের ভাষায় একটা চাপা সঙ্কেত আছে—সে চায় সত্যি প্রকাশ পাক, কিন্তু কাউকে দোষারোপ করতে ভয় পাচ্ছে।
সন্ধ্যার আলোয় যখন থিয়েটারের বাইরে দাঁড়িয়ে নীরজ ধোঁয়ার কুন্ডলী ছাড়ছিল, তখন তার মনে চলছিল প্রশ্নের ঢেউ। রাজদীপ কি জানতেন, তিনি মারা যাবেন? তার “শেষ কৌশল” কি মৃত্যুর পূর্বাভাস ছিল? না, তিনি জানতেন না—তাহলে মৃত্যুর মুহূর্তে কেন চিৎকার করলেন না? কেন তার মুখে ছিল অবাক, আর ভয় মেশানো অভিব্যক্তি? একজন ম্যাজিশিয়ান যদি জানেই, সে মরবে—তবে সে আত্মবিশ্বাস হারায় না। আর রাজদীপ তো ভয় পেতেন না কিছুই। তবে সেই মুখের অভিব্যক্তি? সেটা বিশ্বাসঘাতকতা দেখার প্রতিক্রিয়া। কে তাকে বিশ্বাসঘাতকতা করল? মঞ্চে দাঁড়িয়ে কেউ, অথবা পরিবারের কেউ? অথবা… সেই ছাত্র… যে তাকে ভালোবাসত, কিন্তু পরে ঘৃণা করত? নীরজ জানে, তাকে আরও গভীরে যেতে হবে। কারণ মঞ্চের আলো, ধোঁয়া আর হাততালির পেছনে লুকিয়ে আছে একটা রক্তমাখা বিভ্রম—একটা খুন, যেটা ছিল সবার চোখের সামনে, কিন্তু কেউ দেখতে পায়নি। আর সে দেখবে। কারণ সে শুধু ম্যাজিক জানে না, সে জানে কীভাবে মানুষ বিভ্রান্ত হয়—আর সেই বিভ্রান্তির মধ্যেই সত্য লুকিয়ে থাকে।
অধ্যায় ৩: স্টেজের নিচে, মৃত্যুর ফাঁদ
স্টার থিয়েটার দিনের আলোয় সম্পূর্ণ আলাদা মনে হয়। ঝাঁ-চকচকে আলো নেই, ধোঁয়ার ঘনরাশিও নেই, নেই দর্শকের গুঞ্জন কিংবা হাততালির গর্জন। বদলে আছে নীরবতা, অদ্ভুত এক গা ছমছমে নিস্তব্ধতা—যেটা যেন মনে করিয়ে দেয়, এই মঞ্চেই মাত্র দুদিন আগে কেউ মারা গিয়েছিল, আর সেটা ছিল একটা শোয়ের মধ্যে, শত শত চোখের সামনে। সেই শোয়ের অদৃশ্য অংশ—মঞ্চের নিচে, যেখানে লাইটিং, শব্দ এবং যান্ত্রিক কৌশলের জগৎ—সেখানে ঢোকার অনুমতি পেয়ে নীরজ আজ সকাল সকাল পৌঁছে যায়। ইরার সাহায্যে থিয়েটার কর্তৃপক্ষ তাকে ঢুকতে দেয়, তবে শর্ত—পুলিশকে কিছু জানানো যাবে না। নীরজ জানে, সময় কম। সে ব্যাকস্টেজ পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামে, ঠাণ্ডা সিমেন্টের দেওয়ালে তার হাত স্পর্শ করে চলতে থাকে—এমন জায়গা, যেখান থেকে মৃত্যুর কৌশলটি নিয়ন্ত্রিত হয়। ট্র্যাপ ডোরের পেছনে রয়েছে একটি সরু কক্ষে, যেখানে থাকত ইলেকট্রিক সুইচ, স্পার্ক সিস্টেম, আর একটি প্রোগ্রামড রিমোট। সেই ঘরে ঢুকে সে দেখে, একটি দেয়ালের গায়ে লাগানো বোর্ডে লেখা রয়েছে: “High Voltage – Authorized Access Only.” এই ঘরটিকে দেখতে খুব সাধারণ মনে হলেও, এখানেই বসানো হয়েছিল এমন একটি ডিভাইস, যা নীরজকে চমকে দেয়—একটি অস্থায়ী ট্রান্সফর্মার, যা মাত্র একবারের জন্য প্রবল শক দিতে সক্ষম।
সে ধীরে ধীরে মেঝে ও দেওয়াল ঘেঁটে দেখতে শুরু করে। কিছুক্ষণ পর, পুরনো কাঠের তলার নিচে সে পায় কয়েকটা নতুন তার—যেগুলো ভিন্ন রঙের, এবং খুব তাড়াহুড়ো করে লুকোনো। এরা ঐ ডিভাইসের সঙ্গে যুক্ত। এতদিন রাজদীপ এই যন্ত্র কখনো ব্যবহার করেননি, কারণ তার পূর্বের শোয়ের ভিডিওতে এর কোনো অস্তিত্ব নেই। নীরজ বোঝে, কারও না কারও হাতে বদলানো হয়েছিল মঞ্চের সার্কিটিং সিস্টেম, সম্ভবত ঠিক আগের রাতেই। তার চোখ পড়ে এক কোণে রাখা একটি ছোট কালো বাক্সে—সেটি খুলতেই সে দেখে ভিতরে একটি ট্রিগার রিমোট এবং ব্যবহৃত ব্যাটারি। রিমোটটি রিমুভেবল, অর্থাৎ দূর থেকে বসে কেউ চাইলেই নির্দিষ্ট সময়ে ট্রান্সফর্মার অ্যাক্টিভ করে দিতে পারে। “যদি এটা পরিকল্পিত হয়, তবে খুনি ছিল মঞ্চে বসে। সে জানত কখন, কিভাবে রাজদীপ নিজের দেহটাকে অবস্থান করবে।” এমন সময়ে, হঠাৎ পেছনে শব্দ পেয়ে নীরজ চমকে ওঠে। দরজার ছায়ায় দেখা যায় হর্ষিল, মাথা নিচু, চোখ লাল। “আমাকে মাফ করে দিন, দাদা,” সে ফিসফিস করে বলে, “আমি ভয় পেয়েছিলাম… আমার কাছে একটা ফোন এসেছিল আগের দিন রাতে… কেউ বলেছিল ‘যদি চুপ না থাকিস, তোকেও পোড়াবো…’ আমি ভয় পেয়ে যাই… কিন্তু আমি কিছু করিনি… আমি কিছুই জানি না…” হর্ষিলের কান্না শুনে নীরজ বুঝে যায়, সে হয়তো পুরো পরিকল্পনায় ছিল না, তবে কিছু একটা নিশ্চিতভাবে জানে। “কার ফোন?”—নীরজ জিজ্ঞেস করে, কিন্তু ছেলেটা শুধু মাথা নাড়ে, নাম বলতে ভয় পায়। সম্ভবত, সেই ভয়-ই তাকে চুপ করিয়ে রেখেছে এই ক’দিন।
নীরজ ধীরে ধীরে ফিরে আসে ওপরে। তখন থিয়েটারের প্রধান হলে কেউ নেই। চারপাশে শুধু ফাঁকা চেয়ার, নিস্তব্ধ মঞ্চ, আর পিছনের গ্যালারিতে কয়েকটা ঢেকে রাখা আলো। সে মাঝখানে দাঁড়িয়ে, চোখ তুলে দেখে সেই কাচের ঘরটি যেখানে রাজদীপ মৃত্যুবরণ করেছিলেন—এখনো সেখানে শেকলের দাগ, পোড়া দাগ কিছুটা রয়ে গেছে। মঞ্চের উপর আলো এসে পড়েছে, আর নীরজের মনে হচ্ছে, যেন রাজদীপের ছায়া আজও দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে সেই দৃশ্য—আগুন, ধোঁয়া, চিৎকার। কিন্তু কোনো কৌশলেই আগুন ছাড়াই মৃত্যু ঘটতে পারে না, যদি না সেটি হয় ইলেকট্রিক্যাল শক। এখন প্রশ্ন—এই অতিরিক্ত সিস্টেম কে বসাল? থিয়েটার টেকনিশিয়ান বিপ্লব রায় তো কিছু বলেননি পুলিশকে। আর একজন সাধারণ সহকারী এই ধরনের কৌশল জানবেই বা কীভাবে? আবার এমনও হতে পারে, খুনি নিজেই প্রোগ্রামড যন্ত্র বসিয়ে বাইরে বসে শো দেখছিল। তখনই মনে পড়ে, সেই সাংবাদিক রঞ্জনা দত্তের কথা—যার ক্যামেরা সব কিছু রেকর্ড করছিল সেই রাতে। হঠাৎ, একটা দৃশ্য তার চোখে ভেসে ওঠে—স্টেজের নিচে ইন্সপেকশনের সময় সে যেই তারগুলো দেখেছে, তার একটিতে লেখা ছিল ‘RBX-2’. এটা একটা কোড, যা সাধারণত ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়াররা লেখে, এবং এই কোড সে আগেও কোথাও দেখেছে… ইরার প্রেমিক আদিত্যর ডিজাইনের নোটবুকে।
নীরজ বুঝতে পারে, এ কেবল থিয়েটারের মানুষজনের কাজ নয়—এতে বাইরের একজন ইনপুট দিয়েছে। হয়ত আদিত্য—যে একজন নতুন প্রজন্মের ইঞ্জিনিয়ার, স্মার্ট ট্রিগার সিস্টেম বানাতে পারে। আর সেই প্রযুক্তিই হয়ত খুনে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু সে কোথায়? কেন নিখোঁজ? আর সে যদি এতে জড়িত না-ই থাকে, তবে কেন রাজদীপ তাকে শেষ শো থেকে বের করে দিয়েছিলেন? অনেক প্রশ্ন জমে ওঠে নীরজের মাথায়, কিন্তু সে জানে, উত্তর খুঁজতে হবে ফাঁকের মধ্যে। মঞ্চের নিচে সে যা দেখেছে, তা প্রমাণ করে এটা নিছক দুর্ঘটনা নয়—এ এক পরিকল্পিত মারণচক্রান্ত, যার জন্য স্টেজকেই রূপান্তরিত করা হয়েছিল খুনের মঞ্চে। আর এই নাটকের খলনায়ক হয়ত এখনও মঞ্চের আলো-ছায়ার মধ্যেই লুকিয়ে আছে।
অধ্যায় ৪: ইরা ও অসমাপ্ত কথোপকথন
কলকাতার গোলপার্কের কাছে রাজদীপ মুখার্জিদের পুরনো বাড়িটা যেন সময়ের মিউজিয়াম—জং ধরা রেলিং, লোহার গেটের ওপরে লতাপাতা গজিয়ে উঠেছে, জানলার কাচে জমে আছে ধুলোর পরত, অথচ ভিতরে কোথাও যেন আজও বাজছে মঞ্চের রিহার্সালের গলা। এই বাড়িতেই বড় হয়েছেন রাজদীপ, এখানেই শিখেছেন প্রথম ম্যাজিক—তার বাবার হাত ধরে। আর এখন, সেই কিংবদন্তির মৃত্যুর পর, এখানেই পড়ে আছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পুরনো কাগজ, প্রপস, রিহার্সালের রেকর্ডিং, আর এক অসমাপ্ত জীবন। নীরজ যখন দরজায় কড়া নাড়ল, ইরা নিজেই দরজা খুলে দাঁড়াল। তার চোখে ঘুম নেই, ক্লান্তি আর অভিমান যেন মিশে এক হয়ে গেছে। সে কোনো কথা না বলে ভিতরে নিয়ে গেল, বসতে বলল রাজদীপের পুরনো লাইব্রেরি ঘরে—যেখানে একসময় নীরজ বহু সন্ধ্যা কাটিয়েছিল গুরু-শিষ্যের আলোচনায়। ইরার হাতে ছিল একটি ছোট কাপ—চায়ের ধোঁয়া বেরোচ্ছে, অথচ সে নিজে চা খাচ্ছে না, কেবল জানালার বাইরে তাকিয়ে বলল, “তুমি তদন্ত করছো, জানি। আমিও চাই সত্যিটা বেরিয়ে আসুক। কিন্তু… সত্যি জানলে তুমি ভেঙে পড়বে, প্রস্তুত তো?”
নীরজ প্রথমে কিছু বলেনি, শুধু তাকিয়ে ছিল ঘরের এক কোনায় রাখা সেই পুরনো স্ক্র্যাপবুকটার দিকে—যেটা একসময় রাজদীপ ব্যবহার করতেন নতুন কৌশল পরিকল্পনা করতে। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “তোমার বাবার চোখে ভয় দেখেছিল ইরায়… এমন ভয় আমি কোনো ম্যাজিশিয়ানের চোখে আগে দেখিনি। তিনি কাউকে চিনেছিলেন, যাকে বিশ্বাস করতেন, আর সেই বিশ্বাসই তাঁকে মেরে ফেলেছে।” ইরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “তিনি সবসময় বিশ্বাস করতেন, ম্যাজিক মানে শুধু বিভ্রম নয়—মানুষকে সত্যের বাইরে নিয়ে যাওয়ার রাস্তা। কিন্তু তিনি নিজেই জানতেন না, সত্যটা কতটা নির্মম হতে পারে।” নীরজ এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, “তোমার বাবার শেষ সপ্তাহ কেমন ছিল? কারও সঙ্গে ঝগড়া বা হুমকি?” ইরা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “একদিন বাবা আমাকে ডেকে বললেন, ‘ইরা, এই শো-এর পর আমি থেমে যাব। অনেক হয়েছে।’ আমি অবাক হয়েছিলাম—কারণ বাবা থামতে চায়নি কোনোদিন। আমি জানতে চেয়েছিলাম কেন, তখন উনি বললেন, ‘এবার অনেক বড় একটা ভুল直 করতে চলেছি… কেউ যদি এই ভুলটা ধরতে পারে, তাহলে তার হাতে থাকবে আমার শেষ ম্যাজিক।’ আমি বুঝিনি তখন, এখন বুঝতে পারছি… হয়ত তিনি জানতেন কেউ তাকে আঘাত করবে, কিন্তু তিনি সেটাকে নাটকের অংশ ভেবে নিজেই সেই মৃত্যুর মঞ্চ তৈরি করে দিয়েছিলেন।”
ঘরটা যেন হঠাৎ থমকে গেল। জানালার বাইরের সূর্য বেঁকে এসেছে ঘরের ভিতরে, আর আলো এসে পড়েছে সেই স্ক্র্যাপবুকটার উপর। নীরজ সেটি খুলে দেখতে থাকে। একেকটা পৃষ্ঠায় লেখা নানা কৌশলের নাম—“Mirror Illusion”, “Triple Lock Chain Escape”, “Fire Tunnel Trick”… হঠাৎ একটি পাতায় তার চোখ আটকে যায়—একটা লাল কালি দিয়ে বড় করে লেখা ‘RBX-2 ডিভাইস নিষিদ্ধ—জীবনের ঝুঁকি রয়েছে।’ পাশে ছোট করে লেখা ‘অদ্বিতীয় প্রোগ্রামার – এ কে সেন’। নীরজ চমকে ওঠে। “এ কে সেন?” ইরা মাথা নিচু করে বলে, “আদিত্য কৌশিক সেন। ও আমার… আমার ভালোবাসার মানুষ। আর বাবার চক্ষুশূল। বাবার শোয়ের জন্য আদিত্য একটা কাস্টম স্পার্ক সিস্টেম তৈরি করেছিল, কিন্তু পরে বাবাই সেটা ব্যবহার করতে রাজি হননি। বলেছিলেন, এটা ‘নাটক নয়, মৃত্যুর ফাঁদ’। তারপর একদিন ওদের মধ্যে ঝগড়া হয়, বাবা স্পষ্ট বলে দেন—আর কখনও ওকে থিয়েটারের আশেপাশেও দেখতে চাই না।” ইরা চোখে জল ধরে রাখার চেষ্টা করে বলল, “সেই রাতেই আদিত্য বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। তারপর আর যোগাযোগ হয়নি।”
নীরজ বুঝে যায়, ছায়ার মত একটি নাম সব কিছুতে ছড়িয়ে আছে—আদিত্য। সে প্রোগ্রাম বানাতে পারে, সে জানে রাজদীপের স্টেজের ফাঁকফোকর, আর সবচেয়ে বড় কথা—সে হারিয়েছে ভালোবাসা, সম্মান, ও বিশ্বাস। প্রশ্ন হচ্ছে, সে কি প্রতিশোধ নিতে ফিরেছিল? না, তাকে কেউ ব্যবহার করেছিল? ইরার মুখে বিষণ্ণতা, কিন্তু তাতে কিছু গোপনের ছায়া আছে—যা নীরজ বুঝতে পারে, সে ইচ্ছা করেই সব কিছু বলছে না। তার হাত চেপে ধরে ইরা বলে, “তুমি যদি আদিত্যকে খুঁজে বের করো… প্লিজ… জানিও আমি এখনও… তাকে বিশ্বাস করি। হয়ত সে কিছু করেইনি।” নীরজ উঠে দাঁড়িয়ে স্ক্র্যাপবুকটি হাতে নেয়, দরজার দিকে এগিয়ে যায়, তারপর থেমে বলে, “ম্যাজিক হল বিশ্বাস আর বিভ্রমের মাঝখানের জগৎ। কেউ যদি সত্যিই বিশ্বাসভঙ্গ করে, তবে সে শুধু খুনি নয়, সে একজন শিল্পী-ঘাতক। আমি জানব, কে সে।” আর জানালার বাইরে, কলকাতার সন্ধ্যে তখন নেমে আসছে, মঞ্চের আলো নিভে গেছে, কিন্তু ছায়া এখনও বাকি আছে।
অধ্যায় ৫: ছায়া অতীতের – গোপন প্রেম ও প্রতিযোগিতা
কলকাতার এক কোণে, দক্ষিণের এক নির্জন ক্যাফেতে বসে নীরজ পুরনো সংবাদপত্র আর একটি মোটা নোটবুকের পাতা উল্টাচ্ছিল। এই ক্যাফেটি একসময় রাজদীপ মুখার্জি নিয়মিত আসতেন—চা খেতে, লোকের সঙ্গে মিটিং করতে, নতুন শোয়ের ভাবনা সাজাতে। এমনকি এখানেই একদিন ইরা আর আদিত্য বসে ছিল, সবার চোখের আড়ালে, রাজদীপের অজান্তে। আজ সেখানে বসে নীরজ মনে করছিল সেই সময়ের কথা—যখন রাজদীপ শুধুমাত্র একজন ‘ম্যাজিশিয়ান’ ছিলেন না, বরং এক ‘রাজা’, যার অধীনে ছিল ম্যাজিকের পুরো সাম্রাজ্য। সেই রাজত্বে কেউ সহজে প্রবেশ করতে পারত না। নীরজ নিজেও প্রবেশ করেছিল এক অসাধারণ প্রতিভা নিয়ে, কিন্তু বেরিয়ে আসতে হয়েছিল অপমানিত হয়ে। এখন, একের পর এক ক্লু তাকে সেই পুরনো রাজত্বের ছায়া ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে—যেখানে প্রতিযোগিতা ছিল প্রেমের থেকেও বেশি জ্বালাময়, এবং বিশ্বাস ছিল সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।
নীরজের হাতে এখন যে নামটি ঘুরে ফিরে আসছে, সেটি হলো—ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। সত্তরের দশকের এক বিখ্যাত ম্যাজিশিয়ান, যিনি রাজদীপের সমসাময়িক ছিলেন, কিন্তু হঠাৎই ম্যাজিক জগত থেকে হারিয়ে যান। গুজব ছিল, রাজদীপই ভানুর একটা বিখ্যাত ট্রিক চুরি করে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন। সেই ট্রিকের নাম ছিল—”Mirror Collapse”—একটি আয়না ও ছায়া ব্যবহারের মারাত্মক মানসিক বিভ্রান্তি, যা ভানু ছাড়া কেউ করতেই পারত না। নীরজ পুরনো সংবাদপত্রে দেখে, সেই সময় ভানু মুখ খুলেছিলেন: “রাজদীপ আমার জীবন নিয়ে নিল, আমি এখন একটা মুখোশ ছাড়া ছায়া।” এরপরই তিনি নিখোঁজ হন। কেউ জানে না তিনি কোথায় আছেন, বেঁচে আছেন কি না। কিন্তু রাজদীপের শেষ শো-এর কিছু উপাদান, বিশেষ করে লাইট আর প্রতিফলনের ব্যবহার, চমকে দেয় নীরজকে—সেই পুরনো “Mirror Collapse” এর ছায়া যেন ফিরে এসেছে! তাহলে কি রাজদীপ তার শেষ শোতে আবার সেই নিষিদ্ধ কৌশল ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন? আর সেটা যদি ভানু জানতেন, তাহলে কি তিনি প্রতিশোধ নিতে পারেননি?
এই সময়েই নীরজ দেখা করে থিয়েটারের পুরনো এক কর্মচারী সুবল চক্রবর্তীর সঙ্গে—যিনি আজ অবসরপ্রাপ্ত, কিন্তু রাজদীপ আর ভানুর পুরনো সময়ের সাক্ষী। সুবল বলেন, “ভানুদা খুব ভালো মানুষ ছিলেন, কিন্তু রাজদীপ আসার পর ওর শো বন্ধ হয়ে গেল। রাজদীপ ওকে বলেছিল, ‘তুমি কাল, আমি আজ। আর আমি কাউকে নিজের কাল হতে দেব না।’ সেই দিনই ভানু চলে গেলেন—বলেছিলেন, ‘যেদিন তোমার আয়নার পেছনে ছায়া পড়বে, আমি ফিরব।’” নীরজের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যায়। আয়নার পেছনে ছায়া—ঠিক সেটাই ঘটেছে রাজদীপের শেষ শোতে। হঠাৎ, মনে পড়ে ইরার স্ক্র্যাপবুকের পাতার পাশে একটি অদ্ভুত চিহ্ন ছিল—একটা ভাঙা আয়নার ছবি, যার পাশে লেখা “RBX-2 + MC।” RBX-2 ডিভাইস ব্যবহার করা হয়েছে বিদ্যুতের জন্য, আর MC মানে কি “Mirror Collapse”? নাকি “মারাত্মক চক্রান্ত”?
তদন্তে নেমে নীরজ আবিষ্কার করে, আদিত্য কৌশিক সেন ছিল ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের শেষ ছাত্রদের একজন। সেটা কেউ জানত না, এমনকি ইরাও না। সে কখনো নিজেকে “ভানু-ঘরানার” বলে পরিচয় দেয়নি। তার প্রযুক্তি আর প্রোগ্রামিংয়ের পেছনে ছিল সেই পুরনো জাদুর প্রতিশোধস্পৃহা—যা আধুনিক হয়ে ফিরে এসেছে। তাহলে কি আদিত্য শুধু ইরার প্রেমিক নয়, ভানুর ছায়া হয়ে ফিরে এসেছিল রাজদীপের জীবনে? হয়ত রাজদীপ তা জানতেন, তাই শেষ মুহূর্তে তাকে থিয়েটার থেকে বের করে দেন। আবার, হয়ত তিনি জানতেন না—কে ছদ্মবেশে তার মৃত্যুর কৌশল রচনা করে দিচ্ছে।
তবে নীরজ জানে, শুধু প্রতিযোগিতা নয়, প্রেমও এই খেলায় বড় অস্ত্র। রাজদীপ সবসময়ই ইরাকে নিজের মতো গড়তে চেয়েছিলেন, কিন্তু তার স্বাধীন মতামত, প্রেম, পছন্দ—কোনটাই মেনে নিতে পারেননি। একজন পিতা হয়ে, একজন রাজা হয়ে তিনি ভুল করেছিলেন—ভেবেছিলেন, সবকিছু তার নিয়ন্ত্রণেই থাকবে। কিন্তু প্রেম এমন এক ম্যাজিক—যার ট্রিক নেই, শুধু বিস্ময় আছে। সেই বিস্ময়ই এখন খুনের ছায়া হয়ে ফিরে এসেছে। নীরজ জানে, এবার তার খুঁজে বের করতে হবে আদিত্যকে, অথবা সেই আয়নার পেছনে লুকিয়ে থাকা মুখোশধারীকে—যে হয়ত শুধু প্রতিশোধ নিতে নয়, একটি সত্য প্রতিষ্ঠা করতেও এসেছিল। তবে প্রশ্ন থাকছে—এটা কি একমাত্র প্রতিশোধের কাহিনি? না, এর ভিতরে আরও কেউ আছে, যে এই ছায়া-খেলায় অদৃশ্য থেকে দিকনির্দেশ দিচ্ছে?
অধ্যায় ৬: ক্যামেরার চোখ ও সাংবাদিক রঞ্জনা
কলকাতার রামধন মল্লিক লেন, সদর স্ট্রিটের ধারে একটা ছোট্ট তিনতলা বাড়ির চিলেকোঠায় থাকে সাংবাদিক রঞ্জনা দত্ত। সে বড় বড় চ্যানেলে কাজ করে না, নামী পত্রিকাতেও লেখে না। তার খবর প্রকাশ হয় ইউটিউব চ্যানেল, ছোট ম্যাগাজিন আর ব্লগে। কিন্তু একটাই জিনিস তাকে আলাদা করে দেয়—তার চোখ। থিয়েটার, শিল্প, ম্যাজিক—এইসব সংস্কৃতিময় জগতে রঞ্জনা যেভাবে দৃশ্য ক্যাপচার করে, তার মতো এত পর্যবেক্ষণক্ষম ক্যামেরা কলকাতায় দ্বিতীয়টি নেই। রাজদীপ মুখার্জির শেষ শো-এর দিনও সে ছিল সেই ক্যামেরা নিয়ে মঞ্চের সামনের সারিতে। যতক্ষণ শো চলছিল, ততক্ষণ তার চোখ ছিল লেন্সে আটকে—সে দৃশ্য দেখছিল একেবারে র’ (raw) ফর্মে। আর সেই কারণেই, যখন নীরজ সন্ধেবেলা তার বাড়িতে উপস্থিত হয়, রঞ্জনা তাকে দেখে অবাক হয় না। সে শুধু বলে, “তুমি এসেছ বুঝে নিয়েছিলাম… কারণ একমাত্র তুমিই রাজদীপ মুখার্জিকে চোখের পেছন দিয়ে চিনতে।”
রঞ্জনার ঘর ছোট, কিন্তু দেয়ালজুড়ে ক্যামেরার হ্যাং, লেন্স, ট্রাইপড, ম্যাগাজিন ক্লিপিংস আর পুরনো ভিডিও ফ্রেমের পিনবোর্ড। একটা পুরনো ডেল ল্যাপটপ খুলে সে একটা ফুটেজ চালায়—রাজদীপের শো-এর রেকর্ডিং। “তুমি যা খুঁজছো, তা এখানে আছে,” বলে সে ভিডিও স্ক্রাব করে নিয়ে আসে সেই মুহূর্তে—যখন রাজদীপ কাচের চেম্বারে ঢুকছেন, তালা লাগছে, কাউন্টডাউন শুরু হচ্ছে। কিন্তু এখানেই রঞ্জনা থামায়। “দেখো,” সে বলে, “এই সময়ে, একটা তীক্ষ্ণ লাল আলো মঞ্চের ডানপাশে ঠিক তিন নম্বর স্পটলাইটের পিছন থেকে ফ্ল্যাশ করে। সেটা মোটেও প্রপার লাইট রিফ্লেকশন নয়। এবং ঠিক সেই মুহূর্তেই কাচের ভিতরে রাজদীপ হঠাৎ চমকে ওঠেন—তার মুখে এক সেকেন্ডের জন্য ভয় আসে।” নীরজ চোখ আটকে যায় সেই চিত্রে। লাল আলো—RBX-2 ট্রিগার সিস্টেমের দূরবর্তী ফ্ল্যাশ? কিন্তু তা সম্ভব কিভাবে? কেউ কি থিয়েটারে বসেই সেটি অ্যাক্টিভ করেছে?
রঞ্জনা বলে, “শুধু এটা নয়। এই ভিডিওতে আমি আরও একজনকে পেয়েছি, যার উপস্থিতি কেউ খেয়াল করেনি—একজন বয়স্ক লোক, চোখে চশমা, মাথায় ধূসর চুল, ব্লেজার পরে, শেষ সারিতে বসে ছিলেন। তার মুখ ক্যামেরায় পুরো ধরা যায়নি, কিন্তু আমি যখন ফ্রেম-বাই-ফ্রেম ভিডিও এনালাইসিস করলাম, তখন লক্ষ্য করলাম তিনি একটা রিমোটের মতো কিছু বের করছেন কোটের পকেট থেকে।” নীরজের চোখ মুহূর্তে জ্বলে ওঠে। “আমায় ওই ফ্রেম দাও,” সে বলে। রঞ্জনা তাকে একটি পেনড্রাইভে সেই ক্লিপ কপি করে দেয়, কিন্তু বলে, “তুমি জানো না তুমি কাদের সঙ্গে লড়ছো। এ শুধু প্রতিশোধ না, এ হল এক শিল্প-চক্র, যেখানে ম্যাজিক আর ক্ষমতা মিশে গেছে। কারা যে সত্যি, আর কারা ছায়া—বোঝা মুশকিল।”
এই সময়েই রঞ্জনা চুপচাপ একটি খাম এগিয়ে দেয় নীরজের দিকে। “এইটা কেউ আমার দরজার নিচে রেখে গেছে গতকাল। ভিতরে একটা পুরনো ছবি—রাজদীপ, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় আর এক অদ্ভুত লোক, যার নাম লেখা নেই। ছবির পেছনে লেখা আছে—‘RBX ও Mirror Collapse একই শো-তে একসঙ্গে ব্যবহার করলে মৃত্যু অনিবার্য।’ কে দিয়েছে জানি না, কিন্তু আমার ভয় করছে।” নীরজ ছবিটা ভালো করে দেখে। তৃতীয় লোকটি ধূসর চুল, মোটা ফ্রেমের চশমা—হুবহু সেই শেষ সারির লোকের সঙ্গে মিলে যায়। তাহলে কি এই মানুষই পরিকল্পক? সে কি ভানুর পুরনো কেউ, নাকি সম্পূর্ণ ভিন্ন একজন—একজন যিনি চায় শিল্পীদের নিয়ন্ত্রণ করতে?
রঞ্জনার ক্যামেরার চোখ সত্যিই খুলে দেয় এক অন্ধকার পর্দা, যার ভিতরে লুকিয়ে আছে তথ্য, ছায়া, এবং শিহরণ। নীরজ জানে, এই ভিডিওই তার কাছে একমাত্র প্রমাণ—যে এই খুন ছিল পূর্বপরিকল্পিত, এবং একজন ব্যক্তি—একজন ‘ছায়ামানব’—সেটা বাস্তবায়ন করেছে দৃশ্যের ভিতরে থেকেই। আর সে জানে, এখনই সময় লোকটিকে খুঁজে বের করার, কারণ যতক্ষণ না তাকেও মঞ্চে টেনে আনা যায়, ততক্ষণ রাজদীপের মৃত্যু শুধু এক ‘দুর্ঘটনা’ হিসেবেই থেকে যাবে।
অধ্যায় ৭: খোয়াবনগর লেনে ছায়ামানব
কলকাতার ম্যাপেও খোয়াবনগর লেন খুঁজে পাওয়া যায় না সহজে। উত্তর কলকাতার শ্যামবাজার থেকে পাঁচ মিনিট রিকশা চড়ে গেলে একটা ছোট গলি পড়ে—বাঁদিকে ঝুপড়ি দোকান, ডানদিকে পুরনো বাড়িগুলোর সারি, আর মাঝখানে যেন সময় আটকে আছে। এখানেই, এক পরিত্যক্ত তিনতলা বাড়িতে থাকেন একজন প্রাক্তন লাইট ডিজাইনার, যিনি একসময় কাজ করতেন স্টার থিয়েটারে। নাম তার বিমল মিত্র, তবে অনেকে তাকে ‘ছায়ামানব’ নামেই চেনে—কারণ তার ডিজাইন করা আলো ছিল রহস্যে ভরা, চুপচাপ, দৃশ্যমান নয়, অথচ দর্শকের মনে ছায়ার মতো ছাপ ফেলে যেত।
নীরজ যখন সন্ধ্যায় সেই গলিতে পৌঁছায়, তখন এক পশলা বৃষ্টি থেমেছে appena। খোয়াবনগর লেনের বাতি জ্বলেনি এখনো। গলির ভেতর ছড়িয়ে আছে স্যাঁতসেঁতে কুয়াশা। তিনতলা একটা অন্ধকার বাড়ির দরজায় ধাতব নেমপ্লেট: “B. Mitra (Light Specialist – Retd.)”। দরজা ধাক্কা দিতেই খচ খচ শব্দে খুলে গেল। ভিতরে নীরজ দেখতে পেল এক সরু সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরে, আর তার গায়ে ঝুলছে পুরনো হ্যাঙ্গার, পোকামাকড়ের জাল, আর কিছু পুরনো ম্যাজিক পোস্টার। সে ধীরে ধীরে ওপরে ওঠে, আর পৌঁছয় তৃতীয় তলায়—সেখানে অন্ধকার ঘরের ভিতর এক পুরনো ল্যাম্পের আলো জ্বলছে, আর তার নিচে বসে আছেন বিমল মিত্র—ধূসর চুল, গাঢ় গলায় জিজ্ঞেস করেন, “তুই নীরজ?”
নীরজ একটু অবাক হয়, কিন্তু মাথা নাড়ে। বিমল একটা পাইপ ধরায়, তার মুখে অন্যমনস্ক হাসি। “তুই এসেছিস বুঝেছিলাম। রাজদীপের খুন, তাই না?” নীরজ চুপচাপ বসে পড়ে। বিমল বলতে শুরু করেন, “রাজদীপ বড় শিল্পী ছিল, কিন্তু সে ভয় পেত প্রতিযোগিতাকে। একসময় আমিই ওর জন্য আলো ডিজাইন করতাম, নতুন কৌশলের ছায়া বানাতাম। কিন্তু ভানুর ট্রিক চুরি করার পর সে আমাকেও সরিয়ে দেয়। বলেছিল, ‘আলো আমার নিয়ন্ত্রণে থাকবে, ছায়াও।’ সেইদিন থেকেই আমি আলোর বাইরে চলে গেলাম—ছায়া হয়ে রইলাম।” নীরজ জিজ্ঞেস করে, “RBX-2 আর Mirror Collapse একসাথে ব্যবহার করলে মৃত্যু কেন অনিবার্য?” বিমল গভীরভাবে বলে, “RBX মানে শুধু বিদ্যুৎ নয়, সেটা হাই-ফ্রিকোয়েন্সি সিগনাল। আর Mirror Collapse হলে সেই সিগনাল প্রতিফলিত হয় বহুগুণে। শরীর যদি সেই ফ্রিকোয়েন্সিতে থাকে—এক সেকেন্ডেই স্নায়ু পুড়ে যায়। রাজদীপ জানত এটা। তাও করল। অথবা, কেউ তার অজান্তেই সেটা ট্রিগার করল।”
নীরজ ধীরে ধীরে পকেট থেকে ছবিটা বের করে দেয়—যেটা রঞ্জনা দিয়েছিল। বিমল দেখেই চুপ হয়ে যান। ছবিতে থাকা তিন নম্বর লোকটা—হুবহু তাঁর মতোই। কিন্তু তিনি মাথা নাড়েন, “না, আমি ওই ছবিতে নেই। ওটা আমার যমজ ভাই, বিমলেশ মিত্র। ও ছিল প্রকৃত ইঞ্জিনিয়ার, ভানুর সঙ্গে কাজ করত। কিন্তু একটা ঝগড়ার পর সে গায়েব হয়ে যায়।” নীরজ বিস্ময়ে বলে, “তাহলে কি সে–ই ফিরে এসেছে?” বিমল মাথা নিচু করে বলে, “ভানুর মৃত্যুর খবর তুই জানিস?” নীরজ বলে, “মৃত?” বিমল চোখে তাকিয়ে বলে, “হ্যাঁ। ঠিক খুনের আগের রাতে, সে মারা যায়—হার্ট অ্যাটাকে। কিন্তু কেউ জানত না। আমি জানি কারণ ওর মৃত্যুসনদে আমার নাম ছিল সাক্ষী হিসেবে। আর মৃত্যুর দুদিন আগে ও বলেছিল, ‘আমি সব দিয়ে যাব—আর মৃত্যু দিয়ে শেষ করব।’”
এইসব শুনে নীরজ বোঝে, খেলার দাবা ছক আরও জটিল। ভানু মারা গেছেন। কিন্তু তার ছাত্র আদিত্য—যিনি ভানুর শেষ চিঠি পেয়েছিলেন—সেই চিঠিতে কি লেখা ছিল? বিমল বলেন, “আদিত্যকে আমি চিনতাম। ও একসময় এখানে আসত। ভানুর কাছে ও শিখেছিল প্রতিশোধ নয়—ন্যায় প্রতিষ্ঠার ট্রিক। কিন্তু কে জানে, সত্যিই সে সেই পথেই আছে, না তাকে কেউ ব্যবহার করছে।”
হঠাৎ নিচ থেকে কারা যেন দরজা ধাক্কাতে থাকে। বিমল তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে বলে, “তুই চলে যা আজ। মনে রাখিস, মঞ্চ যতই আলোয় ভরে থাকুক, খুন সবসময় ছায়াতেই হয়।” নীরজ সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ভাবে, তাহলে কি ছায়ার মধ্যেই সেই সত্য লুকিয়ে, যার আলো কেউ চায় না?
অধ্যায় ৮: মৃত্যু-পূর্ব চিঠি ও আদিত্যর সন্ধান
ভোররাতের কলকাতা যেন থেমে আছে কুয়াশার চাদরে। ছায়া আর আলোর ফাঁকে কিছু কিছু রাস্তা নিজের মতো করে জেগে ওঠে, যেমন শোভাবাজারের ধারে এক পুরনো রোডে ইন্টারনেট ক্যাফে ‘ডিজিটাল স্ক্রল’। ছোটো দোকান, ভেতরে পুরনো ডেস্কটপ কম্পিউটার, এবং মালিক—মুকুন্দ। বাইরে থেকে সাধারণ হলেও, এই দোকানেই আদিত্য সেন আসত প্রায়শই—ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইমেইল, চিঠি, আর গোপন ম্যাজিক ডকুমেন্ট এক্সেস করতে। সেই সূত্রেই আজ নীরজ এসেছে মুকুন্দের কাছে। মুকুন্দ মুখ চেনেন নীরজকে না, তবে “রাজদীপের খুন” বলতেই সে ভুরু কুঁচকে তাকায়, “একটা ছেলে আসত, সাইলেন্ট টাইপ, কোড লেখত সারাদিন। একবার বলেছিল—‘ম্যাজিক হচ্ছে ম্যাথের ট্র্যাজেডি।’ কিচ্ছু বুঝি নাই।” তারপর সে নীরজকে একটি কম্পিউটারে বসিয়ে দেয়, যেখানে আদিত্যর শেষ লগইনের কুকি এখনও অ্যাক্টিভ।
নীরজ তাড়াতাড়ি ব্রাউজারে History ঘেঁটে দেখতে পায় একটি এনক্রিপটেড মেইলবক্স: v.bhatta1931@protonmail.com — ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুরনো একটি অ্যাকাউন্ট, সম্ভবত মৃত্যুর আগে সে তা আদিত্যকে দিয়ে গিয়েছিল। মেইলবক্সে প্রবেশ করা যায় না, কিন্তু ড্রাফট ফোল্ডারে রয়েছে একটি মেইল—যেটি কখনো পাঠানো হয়নি। মেইলের সাবজেক্ট লাইনে লেখা:
“শেষ খেলা – রাজদীপকে ক্ষমা করো না”
বডিতে শুধুই একটি বাক্য:
“যে আলো আমাদের পোড়ায়, তার নিচেই জন্ম নেয় ছায়ার ন্যায়বিচার। তুমি জানো কী করতে হবে। – ভানু”
এই চিঠি নীরজকে ঝাঁকিয়ে দেয়। এটা একটা স্পষ্ট নির্দেশনা, একটা ছায়ার বিচারব্যবস্থা, যার প্রয়োগ হয়েছিল মঞ্চে। ভানু মারা যাওয়ার আগে এই পরিকল্পনার বীজ বপন করে গিয়েছিলেন, আর সেই বৃক্ষ হয়ত আদিত্যর হাতে ফলেছে। প্রশ্ন হল—আদিত্য এখন কোথায়?
এই সময়েই রঞ্জনা ফোন করে, “একটা ক্লু পেয়েছি নীরজ! আদিত্যর নাম একটা হসপিটালের লিস্টে আছে—তিনদিন আগে এক বন্ধ হাই-ভোল্টেজ শকের পর বেহুঁশ অবস্থায় একজন যুবককে ভর্তি করা হয়েছিল নাম-না-জানা রোগী হিসেবে। বয়স, গড়ন, মুখাবয়ব সব মিলিয়ে সম্ভবত তিনিই। হসপিটাল—কলকাতা মিশন নার্সিং হোম, তিলজলা।”
নীরজ সঙ্গে সঙ্গে রওনা দেয়।
হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে রাত তখন চারটা। ডিউটি নার্স প্রথমে কিছু বলতে চায় না, কিন্তু সাংবাদিক রঞ্জনার পরিচয়ে ও অনুরোধে, অবশেষে একজন পুরনো ওয়ার্ডবয়ের সহায়তায় সে পায় ওই কেবিনের সামনে দাঁড়াতে, যেখানে ভিতরে শুয়ে আছে একজন—মাথায় ব্যান্ডেজ, চোখ বন্ধ, পাশে ইসিজি মেশিনের যান্ত্রিক টিকটিক শব্দ।
নীরজ চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখে সেই চেনা মুখ—আদিত্য কৌশিক সেন। নিঃশ্বাস চলছে, কিন্তু সে গভীর কোমায়। হয়ত ট্রিগার ব্যবহারের পর বিপরীত কারেন্ট রিঅ্যাক্ট করে নিজের শরীরেই চলে আসে—যেটা ছিল “Mirror Collapse”-এর ভয়ঙ্কর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। আদিত্য হয়ত জানত এই ঝুঁকি, তবু নিয়েছিল।
নীরজ চুপচাপ তার পাশে বসে, হাতে ধরে সেই ছোট চিঠিটা, প্রিন্ট করে এনেছিল—ভানুর শেষ লেখা। আদিত্য শুনছে কি না কেউ জানে না, কিন্তু নীরজ ফিসফিস করে বলে,
“ভানু তোমাকে একটা দায়িত্ব দিয়েছিল। তুমি সেটা নিয়েছিলে, জানি। কিন্তু এটা খুন না ন্যায়? তুমি কি নিজেই শেষ ট্রিগার টেনেছিলে, নাকি কেউ তোমাকে দিয়ে করিয়েছে?”
আদিত্য চুপ। চোখের পাতাও কাঁপে না। কিন্তু হঠাৎ করেই সে নীরজের হাত শক্ত করে চেপে ধরে। এক মুহূর্ত, তারপর আবার নিস্তব্ধতা।
নীরজ উঠে দাঁড়ায়।
একটি নাম এখন তার মনে ভেসে উঠছে—সঞ্জীব মুখার্জি, রাজদীপের ভাই। যিনি রাজদীপের সম্পত্তিতে অংশীদার, থিয়েটারের লিজ ও লাইসেন্সে রয়েছেন, এবং যিনি সবসময়ই রাজদীপকে অপছন্দ করতেন। সেই লোকটাই হয়ত ছায়ার ভিতর দাঁড়িয়ে থেকে আদিত্যকে ঠেলে দিয়েছিল এক ভয়ঙ্কর ট্র্যাপে।
নীরজ এখন জানে, শেষ খেলা এখনও শেষ হয়নি। রাজদীপের মৃত্যুর পেছনে শুধু অতীতের প্রতিশোধ নয়, বর্তমানের লাভও লুকিয়ে আছে।
অধ্যায় ৯: সঞ্জীব মুখার্জি – দ্বৈরথের দ্বিতীয় যাদুকর
কলকাতার সাউথ সিটির কাছাকাছি এক অভিজাত অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স—‘সুর্যনিভাস’। এখানেই থাকেন সঞ্জীব মুখার্জি, রাজদীপের কনিষ্ঠ ভাই। বাইরে থেকে সুস্থির, মার্জিত, ব্যবসায়ীসুলভ আচরণের মানুষ, চুলে রূপালি রেখা, মুখে সবসময় এক রহস্যময় হাসি। কিন্তু বহুদিনের চেনা মানুষেরা বলেন, সঞ্জীব মুখার্জির হাসির আড়ালে একটা ঠান্ডা রাগ আছে, একটা দীর্ঘদিনের অভিমান, যেটা রাজদীপের নাম, খ্যাতি, আর কর্তৃত্বের ছায়ায় চাপা পড়ে গিয়েছিল বহু বছর। সেই রাগ কখনও স্পষ্ট হয়নি, কিন্তু রাজদীপের মৃত্যুর পর তার আচরণ ছিল সন্দেহজনকভাবে শান্ত। না, একটুও শোক বা দুঃখ ছিল না তার চোখে। যেন মৃত্যুর খবর সে আগেই জানত।
নীরজ যখন ‘সুর্যনিভাস’-এর রিসেপশনে গিয়ে সঞ্জীবের ফ্ল্যাটের নাম নেয়, তখন রিসেপশনিস্ট একবার চোখ তুলে দেখে জিজ্ঞেস করে, “আপনার কি অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে?”
নীরজ মাথা নাড়ে, “নাহ, তবে বলুন দীপব্রত ঘোষ এসেছেন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল লাইটিং কনসালটেন্ট।”
দশ মিনিট পর, সে ঢুকে পড়ে সঞ্জীবের ড্রয়িং রুমে—যেখানে কাঠের বুকশেলফ, কালো মার্বেল টেবিল, আর ঠিক মাঝখানে ঝকঝকে কাঁচের বাক্সে রাজদীপের পুরনো ম্যাজিক ওয়ার্ড্রোব রাখা। দেখে মনে হয় যেন রাজদীপের ছায়াকেও বন্দি করে রেখেছেন তিনি।
সঞ্জীব হাসিমুখে বসে বলেন, “তুমি সেই ছেলেটা? রাজদীপ যাকে একসময় ‘বিচিত্র প্রতিভা’ বলেছিল? কী চাও?”
নীরজ চুপচাপ বসে বলে, “সত্যি। আপনি জানেন এই মৃত্যুর পেছনে কী আছে, না থাকলে এত শান্তিতে থাকতেন না।”
সঞ্জীব একটু হেসে বলে, “সত্যি? বলো তো, কোনটা সত্যি? আমার ভাই জীবনে আমাকে কখনো স্টেজে উঠতে দিল না, আমার নিজের হাতের ম্যাজিকও ছিনিয়ে নিয়েছিল। Mirror Collapse আমি আবিষ্কার করেছিলাম, ভানু নয়। ওরা একসঙ্গে আমার সৃষ্টি চুরি করেছিল। ওরা দুজন মিলে আমাকে নির্বাসনে পাঠিয়েছিল। এটা কি সত্যি নয়?”
নীরজ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে।
“তুমি কি বলতে চাচ্ছেন আপনি… আপনি RBX সিস্টেমটা সেট করেছিলেন?”
সঞ্জীব মাথা নাড়ে, “আমি করিনি। আমি শুধু একজনকে বলেছিলাম, যে সত্যকে জানে, তাকে কিছুটা ‘সাহায্য’ করেছি। আদিত্য কৌশিক সেন। তার অভিমানকে আমি পথ দেখিয়েছি। ট্রিগার সে-ই টেনেছে, কিনা জানি না… আমি শুধু মঞ্চের পর্দা তুলেছিলাম। নাটক সে-ই খেলেছে।”
নীরজ এবার রেগে গিয়ে বলে, “আপনি জানতেন এতে মৃত্যু হবে, তাও কিছু বললেন না?”
সঞ্জীব ঠান্ডা গলায় বলেন, “মৃত্যু? ওটা তো অনেক আগেই হয়ে গিয়েছিল। রাজদীপ মরে গিয়েছিল সেদিন, যেদিন সে অন্যের সৃষ্টি নিজের নামে চালিয়েছিল। আমি শুধু মৃত্যুর দৃশ্যনাট্য লিখে দিয়েছি।”
নীরজ তখন পকেট থেকে বের করে সেই ভিডিও ক্লিপ—যেখানে সঞ্জীব দর্শকাসনে বসে রিমোট বের করছে।
“আপনি জানেন এই ক্লিপটা প্রমাণ হতে পারে?”
সঞ্জীব তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর মৃদু হেসে বলে, “স্মৃতি আর প্রযুক্তি—দুটোই মানুষের খেলনা। কিন্তু বলো তো, এই কাহিনির শেষ কোথায়?”
নীরজ উত্তর দেয়, “এই গল্পের শেষ হবে আদালতে।”
সঞ্জীব বলে, “তুমি আদালতে নেবে? তা হলে নাটক শেষ হবে একরকমে। আর যদি ওকে বাঁচিয়ে তোল—আদিত্য? তাহলে নাটক অন্যদিকে ঘুরবে। তুমি কি সত্যিই চাইছো সত্য বেরিয়ে আসুক? নাকি শুধু একটা পর্দা ফাটাতে?”
নীরজ উঠে দাঁড়ায়।
“আমি চাই মঞ্চে যেটা ঘটে, সেটা দর্শকের চোখে বিভ্রম না হয়ে বাস্তব হয়ে উঠুক। আপনি একটা খুনে সহায়তা করেছেন, সেটা যতই শিল্প বলে ঢাকুন, এটা খুনই।”
সঞ্জীব এবার উঠে এসে জানালার দিকে মুখ করে দাঁড়ায়। “তুমি যখন সত্যি সামনে আনবে, মনে রেখো—কেউ না কেউ ছায়া থেকে আবার আলোয় ফিরবেই। তখন সবাই জানবে, আলো একা খুন করে না—ছায়ারাও ছুরি চালাতে জানে।”
অধ্যায় ১০: শেষ কৌশল – থিয়েটারের প্রত্যাবর্তন
কলকাতার বুকে সন্ধ্যার রং যেন একটু গাঢ় হয়ে এসেছে আজ। থিয়েটার রোডের সেই পুরনো ‘রেড কার্পেট অডিটোরিয়াম’—যেখানে রাজদীপ মুখার্জির মৃত্যুর পর পর্দা একরকম স্থায়ীভাবে নেমে গিয়েছিল—আজ আবার আলোয় ঝলমল করছে। সাদা রঙের বিজ্ঞাপনী ব্যানারে লেখা:
“শেষ কৌশল – পুনরুজ্জীবনের সন্ধ্যায়”
নিচে ছোট করে লেখা:
“ডিরেকশন: নীরজ রায়”
নীরজ, ইরা, রঞ্জনা, এমনকি পুলিশ অফিসার অজয় দত্তও আজ এখানে আছেন। কারণ আজকের রাত শুধু একটা শো নয়, এটা এক খুনের সত্য উদঘাটনের পরিসমাপ্তি—এক চক্রের পর্দাফাঁস, এক শিল্পের পুনর্জন্ম। মঞ্চের ওপর সেই একই কাচের চেম্বার বসানো হয়েছে, সেই একই Triple-Lock সিক্যুরিটি, আর Audience-র সামনে সেই Countdown Board। তবে এবার নীরজ নিজে মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেন,
“আজকের শো-তে আমি ম্যাজিক দেখাব না। আমি দেখাব কীভাবে ম্যাজিককে খুনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। যিনি আজ এখানে নেই, রাজদীপ মুখার্জি, তাঁর মৃত্যুর রহস্য ফাঁস করব… আর সেই রহস্যের স্রষ্টাকে সবার সামনে নিয়ে আসব।”
অডিটোরিয়ামে মুহূর্তের নিস্তব্ধতা।
তারপরই মঞ্চে বড় স্ক্রিনে শুরু হয় এক ভিডিও—রঞ্জনার ক্যামেরায় ধারণকৃত সেদিনের রেকর্ডিং। ফ্রেম-বাই-ফ্রেম করে দেখানো হয় সেই লাল আলোয় ফ্ল্যাশ, সঞ্জীব মুখার্জির রিমোট তোলার মুহূর্ত, আর রাজদীপের চোখে ভয়ের প্রতিচ্ছবি। স্ক্রিনে আসে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুর আগের চিঠি, Mirror Collapse-এর নকশা, আর RBX-2 এর ফ্রিকোয়েন্সি ডায়াগ্রাম।
শেষমেশ দেখা যায় সেই হসপিটালের ফুটেজ—আদিত্য, কোমায় শুয়ে থাকা, তারপর ধীরে ধীরে চোখ খোলা। সে এখন সুস্থ। আর আজ, এই থিয়েটারে, মঞ্চের একপাশে সে দাঁড়িয়ে—একজন শিল্পী, যার হাত দিয়ে সত্যি হয়ত মৃত্যু এসেছিল, কিন্তু তা এক ‘ছায়ার নাট্যনির্দেশে’। সে মাথা নিচু করে দাঁড়ায়, বলে না কিছুই। কিন্তু তার চোখ বলে—সে বুঝেছে নিজের ভুল, এবং দায় নিচ্ছে।
মঞ্চে উঠে আসে অফিসার অজয়। সে ঘোষণা করে:
“সঞ্জীব মুখার্জিকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি হত্যাকাণ্ডে সহায়তা এবং ষড়যন্ত্রমূলক হত্যার অপরাধে। রাজ্য প্রযুক্তি ফরেনসিক বিভাগ নিশ্চিত করেছে যে RBX ট্রিগার তার রিমোট থেকেই সক্রিয় হয়েছিল। আদিত্য সেন নিজের স্বীকারোক্তি দিয়েছেন এবং আদালতের রায় অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে আইন অনুযায়ী।”
ইরা তখন উঠে আসে মঞ্চে।
তার কণ্ঠে ক্ষীণ কাঁপুনি, কিন্তু চোখে স্পষ্ট দৃঢ়তা।
“আমার বাবা ম্যাজিককে ভালোবেসেছিলেন, কিন্তু নিজের জীবনের গল্পটা কখনো লিখে যাননি। আজকের শো সেই অসমাপ্ত আত্মজীবনীর শেষ অধ্যায়।”
সে বলে,
“শেষ কৌশল আসলে ছিল এক পরীক্ষা—ভালোবাসা, বিশ্বাস আর ক্ষমার। কেউ কেউ হারিয়ে গেল, কেউ কেউ খুঁজে পেল নিজেদের। কিন্তু থিয়েটার এখনও বেঁচে আছে। কারণ ম্যাজিক কখনো মরে না—মরে শুধু মানুষ।”
শো শেষ হয় না কোনও চমক দিয়ে, বরং এক নিঃশব্দে।
নীরজ চুপচাপ পিছনের করিডোরে হেঁটে চলে যায়।
কাছেই এসে দাঁড়ায় রঞ্জনা।
সে বলে, “তুমি নাটকটা শেষ করলে না?”
নীরজ মৃদু হেসে বলে, “শেষটা তো কখনো শেষ হয় না। শুধু পরবর্তী দৃশ্য শুরু হয়।”
রঞ্জনা জিজ্ঞেস করে, “এখন তুমি কী করো?”
নীরজ সিগারেট ধরিয়ে জানালার বাইরে তাকায়, বলে,
“হয়ত একটা নতুন ম্যাজিক। কিংবা আরও একটা অসমাপ্ত মৃত্যুর গল্প… কলকাতায় তো ছায়া কম নেই।”
দূরে তখন আলো নিভে আসছে। কিন্তু একটি কণ্ঠ যেন মঞ্চের অন্ধকার থেকে বলে উঠছে—
“Ladies and gentlemen… the real illusion… is the truth you almost never saw.”
—
শেষ