অনিমেষ পাল
অধ্যায় ১:
চোখ খুলতেই জানালার বাইরের কুয়াশায় ঢাকা দৃশ্যটা ঝাপসা হয়ে গেল। কলকাতা থেকে আসার পর প্রথম সকাল, আর ঠিক তখনই ঋত্বিক বুঝে গেল—এই গ্রামের ভোর শহরের ভোর নয়। হেমন্তের কুয়াশা এখানে কেবল বাতাসে নয়, স্মৃতির ভেতরেও ঢুকে পড়ে। বাবা আর নেই। পঞ্চভূতে বিলীন হওয়ার পরেও যেন তার গলার কর্কশতা, ভাতের পাত থেকে ঝুলে পড়া মাছের কাঁটার মতোই, আজও জমে আছে দেয়ালে। গ্রামে ফিরে আসার আগে সে ভেবেছিল, হয়তো কিছুই চেনা লাগবে না। কিন্তু যখন মাটির উঠোনে পা রাখল, তখন মাটির নিচ থেকে শিকড়েরা যেন ফিসফিস করে ডেকে উঠল—“তুই ফিরে এসেছিস, ঋত্বিক!” পানের রঙে পুরনো হয়ে যাওয়া উঠোনের ধারে দাঁড়িয়ে সে হাত বুলালো মাটির চৌকাঠে। দরজার তালা খুলতে গিয়েও এক মুহূর্ত থেমে গেল, যেন কোনো অদৃশ্য হাত প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, “তুই কি সত্যিই ফিরেছিস, নাকি শুধু পালাতে চাস?” বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই সেই স্যাঁতসেঁতে গন্ধ—যেটা ছোটবেলায় তাকে অসুস্থ করে তুলত—এইবার কেমন যেন শূন্যতা মেশানো গন্ধ হয়ে ফিরে এল।
সন্ধ্যায় মোহন কাকার দোকানে যাওয়া হল। দোকানটা এখনও একই জায়গায়, ঠিক বটগাছটার নীচে। কাকা চশমা নামিয়ে চোখ ছোট করে দেখে বললেন, “ঋ…ঋত্বিক? আরে বাবা! একেবারে বাবার ছায়া হয়ে গেছিস রে।” কথাটা শুনে মনে হল, সময় যেন কারও দেহে লুকিয়ে বসে থাকে—একদিন ঠিক বেরিয়ে আসে। মোহন কাকার কথায় সে হাসল বটে, কিন্তু সেই হাসিতে ছিল একধরনের চাপা অস্বস্তি। গ্রামের মানুষের চোখের ভাষা বদলায় না, কেবল বদলে যায় তাদের চাহনি। দোকানের পাশে কিছু কিশোর ক্রিকেট খেলছিল। একটা বল গড়িয়ে এসে পড়ল ঋত্বিকের পায়ের কাছে। সে যেমন করে একদিন বল কুড়োত, এখন তেমনই ছেলেটা বল নিতে এসে বলল, “আপনি ওই পাকা বাড়ির ছেলে না?” এই প্রশ্নটা যেন একটাই: সে এখনও এই গ্রামের কেউ কি না, নাকি কেবল অতিথি। দোকান থেকে ফেরার পথে মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে সে দেখল সেই পুরোনো পুকুরটা, যার পাড়ে তারা একদিন পাড়ি জমিয়েছিল শালুকের খোঁজে। পানি কুয়াশায় ঢাকা, কিন্তু মনে হল—সেই জলের তলায় কেউ যেন তার নাম ধরে ডাকছে।
রাতে পুরোনো ঘরের মেঝেতে চিৎ হয়ে শুয়ে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। শহরের আলো যেখানে নক্ষত্রগুলো ঢেকে দেয়, সেখানে এই গ্রামের আকাশটা তাকে নতুন করে ভাবতে শেখাচ্ছিল। পেছনের বারান্দা থেকে বাবার পুরোনো চেয়ারটা দেখা যাচ্ছিল। চেয়ারটা খালি, কিন্তু ঋত্বিক জানত—স্মৃতি কখনো খালি থাকে না। ঘরে একটা পুরোনো অ্যালবাম পাওয়া গেল—তার ছেলেবেলার কিছু ছবি, পাশে দাঁড়িয়ে এক কিশোরী, চোখে বিস্ময় আর বিস্মৃতির খেলা। শ্রাবণী। সেই নামটা মনে পড়তেই বুকের ভিতর কেমন কেঁপে উঠল। এত বছর পরও সেই চোখের ভাষা ভুলে যায়নি সে। শ্রাবণীর চোখ ছিলো শালুকফোটা ভোরের মতো—নীরব, তবু কোমল আলোয় ভরা। ঘুমোতে পারল না সেদিন। মশারির ভেতরে বসে থাকা নিজের ছায়াকেও যেন অপরিচিত লাগছিল। মনে হচ্ছিল, কাল সকালেই তাকে আবার যেতে হবে সেই পুকুরপাড়ে। যদি সেই চোখটা আবার দেখা যায়—যেখানে একদিন ভালোবাসার প্রথম শালুক ফুটেছিল।
অধ্যায় ২:
পরদিন সকালে পুকুরপাড়ে হাঁটতে বেরোল ঋত্বিক। শিশির ভেজা ঘাসের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় তার মনে হচ্ছিল, এই রাস্তা সে বহুবার পেরিয়েছে—ছেলেবেলায়, হাত ধুয়ে এসে গাছের নিচে বসে হাওয়া খেত, শ্রাবণীর সঙ্গে ছিপ ফেলে মাছ ধরত। সেই স্মৃতি এখন যেন মাটির নিচে ঘুমিয়ে থাকা বীজ, যেগুলো হঠাৎ হঠাৎ মাথা তোলে। পুকুরপাড়ে এসে দাঁড়াতেই তার নজর গেল ঘাটের ধারে বসে থাকা একটি মেয়ের দিকে। সাদা তুলসীচূড়া শাড়ি, খোলা চুল, হাতে জলভর্তি লোটো। সে হাঁটু মুড়ে বসে কী যেন ভাবছিল। পেছন থেকে দেখেও ঋত্বিকের বুক কেঁপে উঠল—এ তো… এটা কি সত্যিই শ্রাবণী? না কি তার মনই পুরোনো মুখগুলোকে ঘুরিয়ে আনছে? সে আরেকটু এগিয়ে গেল। পায়ের শব্দে মেয়েটি ঘুরে তাকাল, আর সেই মুহূর্তেই চোখে চোখ পড়ে গেল—এক নিঃশব্দ বিস্ফোরণ যেন ঘটল।
দু’জনেই চুপচাপ তাকিয়ে রইল, যেন কথার চেয়ে বেশি কিছু বলার ছিল চোখে। সময় থেমে রইল কিছু মুহূর্ত, আর তার মধ্যেই ঋত্বিক দেখে ফেলল—শ্রাবণীর চোখ আজও আগের মতোই কথা বলে। কেবল সেই চোখে এখন আরও অনেক গল্প জমে আছে, যেগুলো তারা কখনো বলেনি। শ্রাবণী ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল, মুখে কোনো বিস্ময় নেই, আবার অভিমানও নেই। বরং এক ধরনের শান্ত গ্রহণযোগ্যতা ছিল তার চোখে—যেন এই ফেরাটা সে অনুমান করেছিল। “তুই… ফিরলি?” খুব সহজ প্রশ্ন, কিন্তু তার মধ্যে ছিল অবর্ণনীয় দীর্ঘ সময়ের চাপা প্রতিধ্বনি। ঋত্বিক হেসে বলল, “হ্যাঁ, ফিরে এসেছি। বাবার চলে যাওয়ার পর আর কোথায়ই বা যেতাম?” শ্রাবণী কিছু বলল না, কেবল ঘাড় নিচু করে একটু হেসে বলল, “তোর কথা মাঝে মাঝে শুনতাম মোহন কাকার মুখে। ভাবতাম, আর ফিরবি না।” এই কথাটা শুনে ঋত্বিকের গলার ভেতর কিছু আটকে গেল—সে জানে, কেন আর ফেরা হয়নি। কিন্তু সে বোঝে না, কেন মনে হচ্ছিল আজ শুধু উপস্থিতিই যথেষ্ট, ভাষার দরকার নেই।
ওরা পাশাপাশি হাঁটতে লাগল পুকুরপাড় ধরে। একটা সময়ের পর, তারা কথা না বলেও কথা বলছিল। বাতাসের শব্দ, গাছের পাতার দুলুনি, জলের ছলাৎ শব্দ—সব কিছু মিলে যেন এক অদ্ভুত সঙ্গীত তৈরি হচ্ছিল। “তুই এখন কী করিস?” শ্রাবণীর প্রশ্নে ঋত্বিক একটু হেসে বলল, “শহরে কপি-রাইটিং করি… বিজ্ঞাপনের ভাষা লিখি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এখানে এসে কিছু না লিখেই অনেক কিছু বুঝে ফেলছি।” শ্রাবণী হাসল, তার চোখে সেই পুরোনো মায়া। “তুই তো ছোট থেকেই কাগজ-কলমের বন্ধু ছিলি। তোর কবিতার খাতা এখনো আমার কাছে আছে।” কথাটা শুনে ঋত্বিক থমকে দাঁড়াল, “তুই সেই খাতা রেখেছিস?” শ্রাবণী মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ… তুই চলে যাওয়ার পরে ওটা পুকুরঘাটে পড়ে ছিল। আমি তুলে রেখেছিলাম, ভেবেছিলাম—হয়তো কোনো একদিন ফিরবি।” এইবার সত্যিই ঋত্বিকের চোখ ঝাপসা হয়ে এল। পুরোনো দিনে সে ভাবত, শ্রাবণী হয়তো কিছুই বোঝে না—তার কবিতা, তার ইঙ্গিত, তার না বলা ভালোবাসা। কিন্তু এখন মনে হচ্ছিল, সেই মেয়ে-ই একমাত্র বোঝে।
অধ্যায় ৩:
ঋত্বিক আবার ফিরে আসে সেই পুকুরটাতে, যেখানে এক সময় তারা শালুক খুঁজে বেড়াত। তখন তারা ছিল কেবল স্কুলের দুই বন্ধুর মতো, কিন্তু কোনো এক বর্ষার দুপুরে, শ্রাবণীর চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে বুঝেছিল—এই চোখের গভীরে এমন কিছু আছে, যা ভাষায় লেখা যায় না। সেই দিনটার কথা খুব স্পষ্ট মনে পড়ে তার: শ্রাবণী বলেছিল, “তুই জানিস, শালুকের ফুল কাদামাটির মধ্যেও ফোটে, কিন্তু তার চোখ সবসময় আকাশ খোঁজে।” তখন সে হেসে বলেছিল, “তোর চোখও যেন শালুকের মতো।” আজ সে হাসতে পারে না, বরং মনে হয়, সে অনেক দেরি করে ফেলেছে সেই ফুলের দিকে তাকাতে। পুকুরের জল এখনো সেই রকমই নিস্তরঙ্গ, তবে পাতার ফাঁকে ফাঁকে কিছু শালুক গাছ মাথা তুলেছে। তারা এখনও এখানে ফোটে, তবে শ্রাবণীর মতো কি তারা এখনও কাউকে ডাকে?
শ্রাবণীর সঙ্গে হঠাৎ দেখার পর থেকে ঋত্বিকের দিন কাটে অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে। পুরোনো বাড়ি, বাবার চেয়ার, উঠোনের নরম আলো—সবকিছু যেন এক নিরব ভাষায় কথা বলে। সে একদিন নিজের পুরোনো ঘর থেকে বের করে আনে সেই চিঠির খাতা, যেখানে ছোটবেলায় লিখেছিল ‘শ্রাবণী’ নামটা পঞ্চাশবার—সেই প্রতিটি অক্ষরের পেছনে লুকিয়ে ছিল শৈশবের এক অচঞ্চল প্রেম। সেই চিঠাগুলো কাউকে কখনো দেয়নি সে, দেয়নি বলেই হয়তো আজও কিছু অটুট থেকে গেছে। সেই স্মৃতিগুলোকে সে ভাঁজ খুলে আবার দেখতে চায়। শ্রাবণীকে একদিন পুকুরঘাটে বলে, “তুই এখনও ওখানে যাস? সেই বড়ো পদ্মপাতার পাশে, যেখানে আমরা বসতাম?” শ্রাবণী একটু হেসে বলে, “রোজই যাই। ওখানে এখন আর তুই নেই, তবে আমি তোর কল্পনাকে নিয়ে বসে থাকি।” এমনভাবে বলল যেন এই লাইনটা সে দীর্ঘদিন ধরে মুখস্থ রেখেছে, শুধু বলার সুযোগ খুঁজছিল।
একদিন বিকেলে তারা একসাথে বসে ছিল সেই পদ্মপাতার ধারে, হালকা মেঘলা আকাশে আলোর খেলা হচ্ছিল। হঠাৎ হাওয়া বইতে শুরু করল। শালুকপাতাগুলো নড়ছিল হালকা ঢেউয়ে, যেন কারা ফিসফিস করছে জলের নিচে। ঋত্বিক বলল, “তুই কোনোদিন জানতে চাসনি, আমি তোর দিকে ফিরে তাকিয়ে কী ভাবতাম?” শ্রাবণী চুপ করে বসে রইল। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, “ভেবেছিলাম, জানব না বলেই ভালো। না জানলে আশাও থাকে না।” এই কথাটা এতটা নির্মম আর বাস্তব যে, ঋত্বিক কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকে। তারপর বলল, “তবে আজ বলি—তুই ছিলি আমার প্রথম কবিতার অনুপ্রেরণা। তোর চোখেই আমি শিখেছিলাম, চুপ করেও ভালোবাসা প্রকাশ করা যায়।” সেই মুহূর্তে পুকুরের ওপার থেকে এক ঝাঁক শালিক উড়ে গেল, আর মনে হল, মেঘের নিচে সত্যিই কোনো এক নিঃশব্দ শালুক ফুটে উঠল।
অধ্যায় ৪:
ঋত্বিক এবং শ্রাবণীর প্রতিদিনের দেখা এখন প্রায় নিয়মে পরিণত হয়েছে, যদিও কেউই একে ‘দেখা’ বলে চিহ্নিত করে না। কখনও সকালবেলায় বাজারে, কখনও পুকুরপাড়ে হাঁটতে হাঁটতে, আবার কখনও চুপিচুপি স্কুল ছুটির পর শ্রাবণীর বাড়ির সামনের তালগাছের ছায়ায়। দু’জনেই জানে তারা একে অপরের আশেপাশে চুপচাপ সময় কাটাতে ভালোবাসে, অথচ সেই সময়গুলো যেন সবচেয়ে বেশি মুখর—চোখে, অভিব্যক্তিতে, নিঃশ্বাসে। মোহন কাকার দোকানে একদিন একসাথে বসে চা খাচ্ছিল তারা। মোহন কাকা হঠাৎ বলে উঠলেন, “ভালোবাসা তো মুখে বলার জিনিস নয় রে… চোখে যদি ফুটে ওঠে, তবেই সে সত্যি।” সেই কথা শুনে দু’জনের মুখেই এক অদ্ভুত চুপসি হাসি ফুটে উঠল। চোখাচোখি হল কিছুক্ষণের জন্য, যেন দুটো পৃথিবী সংলগ্ন হয়ে গেল এক বিন্দুতে।
ঋত্বিক নিজেকে প্রতিদিন একটু একটু করে খুঁজে পাচ্ছে এখানে। শহরের কর্পোরেট দুনিয়া, কাঁচের ঘেরা অফিসঘর, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ‘ক্রিয়েটিভ’ হয়ে ওঠার চাপ—সবই এখন অস্পষ্ট, দুরে ফেলে আসা কোনো যন্ত্রের আওয়াজের মতো। শ্রাবণীর সাথে কাটানো এই নীরব সময় তাকে শেখাচ্ছে—সব সম্পর্ক উচ্চারণ চায় না, কিছু সম্পর্ক কেবল অনুভবেই ধরা দেয়। একদিন তারা পুকুরঘাটে বসে। আকাশে নীলচে-সাদা মেঘ ভাসছে। শালুকের পাতা জলে ছায়া ফেলেছে। হঠাৎ শ্রাবণী বলে উঠল, “তুই কি জানিস, কবে প্রথম বুঝেছিলাম তোর চেয়ে আলাদা কেউ তেমন ছিল না আমার জীবনে?” ঋত্বিক তাকিয়ে থাকে তার মুখের দিকে। শ্রাবণী হালকা গলায় বলে, “যেদিন তুই কলকাতায় চলে গেলি, আমি প্রথমবার একা গেছিলাম সেই পুকুরের ধারে। আমি তোদের খেলাটা দেখতাম চুপিচুপি, কিন্তু সেদিন জায়গাটা খালি খালি লাগছিল। তুই ছিলি না বলে জায়গাটাই অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল।” এই স্বীকারোক্তি যেন অতীতের না বলা সব প্রশ্নের উত্তর হয়ে দাঁড়াল।
ঋত্বিক অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আমি কখনও ভাবিনি তুই… মানে, তুই বুঝতিস আমার অনুভবগুলো।” শ্রাবণী মৃদু হাসে। “অনুভব বোঝার জন্য তো শব্দ লাগে না, ঋত্বিক। আমি তোর না বলা কথাগুলো শুনতে শিখেছিলাম, কিন্তু তুই কি শুনেছিলি আমার?” প্রশ্নটা ভীষণ সোজা, অথচ জবাব জটিল। ঋত্বিক জানে, সে পারেনি। তখন তার বয়স কম ছিল, শহরের ডাক ছিল জোরালো, বাবা-মায়ের ইচ্ছের ভার ছিল বিশাল। ভালোবাসার কথা বললে তখন কী হতো? কেউ শুনত না—না তার বাবা, না সময়। কিন্তু এখন এই সময়, এই পুকুরপাড়, এই শালুকফোটা বিকেল তাকে দিচ্ছে সেই সুযোগ—যা বহু বছর আগে মিস হয়ে গিয়েছিল। হয়তো এখনও বলা হয়নি, কিন্তু তাদের মাঝে জমে থাকা নীরবতা আজ এক ধরনের পরিপূর্ণতা পেয়েছে। হয়তো এইটাই তাদের ভালোবাসার ভাষা।
অধ্যায় ৫:
সেই সন্ধ্যায় হঠাৎ করেই বৃষ্টি নেমেছিল। গ্রামের আকাশ এক নিমিষে কালো মেঘে ঢেকে গিয়েছিল, আর তার সাথে যেন মনখারাপের ঝিরঝিরে বৃষ্টি নামল ঋত্বিকের ভেতরেও। মোহন কাকার দোকানে গিয়ে সে অপেক্ষা করছিল—যদি শ্রাবণী আসে। গরম চায়ের কাপ থেকে ধোঁয়া উঠছে, কিন্তু সে চুমুক দিতে ভুলে যাচ্ছিল। ঠিক তখনই সামনে এসে দাঁড়াল শ্রাবণী—ছাতা ছাড়া ভেজা চুল, চোখে বৃষ্টির জল গড়িয়ে পড়ছে। মুখে সেই চেনা হাসি নেই, কিন্তু চোখে একটা আশ্চর্য স্থিরতা। “তুই ভিজলি?” — প্রশ্নটা ঋত্বিক নিজেও বুঝতে পারল না, কীসের জন্য করল। শ্রাবণী বলল, “ভিজতে ভালো লাগে… বৃষ্টি আমার মনের মতো।” মোহন কাকা ভেতরে চলে যাওয়ায় তারা দোকানের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকল একসাথে। চারপাশে কুয়াশা আর বৃষ্টির শব্দ ছাড়া আর কিছু নেই, তবুও সেই মুহূর্তে তাদের ভিতরের ভাষা যেন আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠল।
বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে হঠাৎ শ্রাবণী বলল, “জানিস ঋত্বিক, শালুকের ফুল বৃষ্টিতে কখনো মাথা নিচু করে না। বরং জলে ভিজে আরও খোলা হয়ে যায়।” কথাটা শুনে ঋত্বিকের মনে হল, শ্রাবণী নিজেকেই বলছে। সে একটু এগিয়ে গিয়ে তার হাতের কাছে দাঁড়াল, তারপর ধীরে বলল, “তোর চোখে আমি শালুক ফুটতে দেখেছি, কিন্তু সেই সময় আমি ভয় পেয়েছিলাম।” শ্রাবণী কিছু বলল না। তাদের মাঝে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো যেন একটা অদৃশ্য প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছিল, আবার সেতুও গড়ে দিচ্ছিল। কিছুক্ষণ পরে সে বলল, “ভয় তো আমি-ও পেয়েছিলাম। তুই চলে গেলে অনেক বছর নিজেকে দোষ দিয়েছিলাম, ভাবতাম হয়তো তুই জানতিস না… হয়তো জানলেও আমায় গুরুত্ব দিসনি।” ঋত্বিক মাথা নিচু করল। এতদিন পরে এসে এসব বলা সহজ নয়, কিন্তু সময় যেন তাদের দু’জনকেই ধীরে ধীরে সাহস দিচ্ছে।
বৃষ্টি কমতে কমতে দু’জন পুকুরপাড়ে হাঁটতে লাগল। শ্রাবণী হঠাৎ থেমে বলল, “তুই কি আবার চলে যাবি?” প্রশ্নটা যেন আকাশে ভেসে থাকা বজ্রপাতের মতোই নেমে এল ঋত্বিকের মাথায়। সে উত্তর দিতে পারল না সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু সে জানে, এবার চলে যাওয়া মানে শুধু একটা জায়গা ছেড়ে যাওয়া নয়—এবার চলে যাওয়া মানে হারিয়ে ফেলা, যা আর কখনো ফিরে আসবে না। সে বলল, “আমি জানি না… জানি শুধু এইবার যাই যদি, সব রেখে যেতে হবে।” শ্রাবণী মাথা নিচু করে মাটি দেখছিল। তারপর আস্তে করে বলল, “তুই যাস না। এখানে তোদের পুরোনো বাড়িটাও এখন একা, তোর মতোই। আমি রোজ শালুক ফুটতে দেখি, কিন্তু তুই থাকলে সেটা দেখার মতো হয়।” এই স্বীকারোক্তি এতটাই নরম, অথচ গভীর, যে ঋত্বিক বুঝে গেল—ভালোবাসা সবসময় উচ্চারণ চায় না, কোনো এক ভেজা সন্ধ্যায় শুধু থেকেও দেওয়া যায়।
অধ্যায় ৬:
ঋত্বিকের সঙ্গে শ্রাবণীর প্রতিদিন দেখা হওয়া এখন গ্রামের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। শালপাতার নিচে বসা বৃদ্ধদের দল, কাঁথা সেলাই করতে করতে কানে ফিসফিস করা গৃহিণীরা—সবাই যেন এক অদৃশ্য জাল বুনছে, যার কেন্দ্রে বসে আছে শ্রাবণী। একদিন বিকেলে, স্কুল ছুটির পর শ্রাবণী বাড়ি ফিরতেই তার মা দরজার সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার চোখে না ছিল রাগ, না ছিল ভালোবাসা—ছিল এক ধরনের নিরুপায় সমাজ-ভয় মেশানো চাপা হতাশা। “তুই রোজ ওর সঙ্গে দেখা করিস?” শ্রাবণী চমকে উঠে বলল, “কে বলল?” মা মাথা নিচু করে বললেন, “কেউ বলে না, কিন্তু এ গাঁয়ে বাতাসেও খবর ছড়ায়।” এরপর দুজনের মাঝে নীরবতা নেমে আসে, যা কেবল এক মা ও মেয়ের মাঝে সমাজের দাঁড় করানো কাঁটাতারের মতো। শ্রাবণী জানত, তার মা কেবল সমাজের কথা বলছেন না—তিনিও ভীত, মেয়ের স্বপ্ন আবার ছিঁড়ে পড়লে সেই কষ্ট তিনিই বহন করবেন।
ঋত্বিক যখন বিকেলে পুকুরপাড়ে এসে শ্রাবণীর অপেক্ষায় ছিল, সে তখনো জানত না আজকের দেখা তাদের নীরব অভ্যস্ততা ভেঙে দেবে। শ্রাবণী এসে দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু তার মুখে কোনো গল্প ছিল না, চোখে কোনো হাসিও নয়। “আজ আর হাঁটতে ভালো লাগছে না,” সে বলল। “কিছু হয়েছে?” — ঋত্বিক জিজ্ঞেস করতেই শ্রাবণী হালকা গলায় বলল, “হয়েছে তো… সমাজ আমার চোখে দেখে, না তোর। সবাই ভাবছে, তুই একদিন আবার চলে যাবি, আর আমি থাকব এই গাঁয়ের মুখরতা নিয়ে।” কথাগুলো তীক্ষ্ণ, কিন্তু হৃদয়সন্ধানী। ঋত্বিক কিছু বলতে যাচ্ছিল, শ্রাবণী থামিয়ে বলল, “তুই তো শহরের ছেলে। তোর চোখে গল্প আছে, কাগজে লেখার মতো জীবন। কিন্তু আমাদের জীবনে কাগজ নেই—আমাদের জীবন শুধু ঠোঁট কামড়ে চুপ করে থাকা।”
ঋত্বিক এই প্রথম বুঝতে পারল, সে কেবল নিজের স্মৃতি নয়, শ্রাবণীর বাস্তবকেও স্পর্শ করেছে। শহরের প্রেমে আবেগ থাকে, কিন্তু গ্রামের প্রেমে থাকে সাহসের প্রয়োজন। সমাজের চোখ এখানে খুব ধারালো। শ্রাবণী বলল, “আমি ভেবেছিলাম তুই ফিরলে… নতুন কিছু হবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমি আবার পুরোনো ভয়গুলোতে ফিরে যাচ্ছি।” সেই মুহূর্তে ঋত্বিকের চোখ ভিজে এল। সে বলল, “তুই কি তাহলে বলতে চাস, আমি ফিরে গেছি বলে ভুল করেছিস?” শ্রাবণী চুপ করে রইল। তার চোখে জল ছিল না, কিন্তু বিষাদ ছিল। কিছুক্ষণ পর সে বলল, “ভুল নয়… হয়তো এটাই জীবন। কিন্তু খবরের কাগজে তো এসব লেখা হয় না, সেখানে শুধু ছাপা হয় গল্প। আমি চাই তুই আমার জীবনের কাগজে সত্যি হ, গল্প না।” কথা শেষ করে সে চলে গেল, আর ঋত্বিক সেই পদ্মপাতার পাশে বসে রইল—নীরব, জলভরা চোখে।
অধ্যায় ৭:
সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে দরজা বন্ধ করে চুপচাপ বসে রইল ঋত্বিক। বাইরের কুয়াশা ঘরের ভিতরেও ঢুকে পড়ছিল যেন, দেয়ালের পলেস্তারা থেকে ঝরে পড়ছিল নীরবতা। মনের ভিতরে শ্রাবণীর কথা যেন বারবার ঘুরে ফিরে আসছিল—“তুই আমার জীবনের কাগজে সত্যি হ, গল্প না।” কথাটা কেমন জ্বালিয়ে দিচ্ছিল তাকে। অনেকক্ষণ বসে থাকার পর হঠাৎ কী মনে করে উঠে গেল সে, পুরোনো আলমারির চাবিটা খুঁজে বার করল। বহুদিন ধুলো জমে থাকা, কাঠের সেই ভারি আলমারির নিচের তাকে ছোট্ট একটা টিনের বাক্স রাখা ছিল—যেটা সে বহু বছর ছুঁয়েও দেখেনি। সেই বাক্স খুলতেই একটা পুরোনো খাম চোখে পড়ল। ওপরে কাঁপা হাতে লেখা, বাবার অক্ষর: “ঋত্বিক—যদি একদিন ফেরিস।” বুকের ভিতর কেঁপে উঠল তার।
চিঠিটা খুলতেই কাগজের গন্ধে একধরনের অভিমানের ধোঁয়া যেন বেরিয়ে এল। অক্ষরগুলো ছিল পুরোনো, মলিন, কিন্তু স্পষ্ট। বাবা লিখেছেন, “জানি তুই আমার মতো হতে চাসনি, তোর পথ আলাদা, মন আলাদা। তোর চোখে গল্প আছে, কবিতা আছে—আর সেই কবিতার নাম আমি বহু বছর আগে শুনেছি, সেই মেয়ের মুখে, যে তোকে চুপচাপ ভালোবাসত। হ্যাঁ, আমি জানতাম, শ্রাবণী তোর জীবনের একটা অধ্যায়, যেটা তুই লিখতে ভয় পেতিস। তোর চলে যাওয়ার পরও সে আমাদের বাড়ির দরজার কাছে বসে থাকত বিকেলগুলোয়, যেন তোর ছায়াকে জিজ্ঞেস করত, ‘আজ ফিরবি?’ আমি সেই ছায়া দেখতাম, দেখতাম তার চোখের ভেতর শালুক ফুটে আছে এখনও। কিন্তু তুই ছিলি না। তোর দোষ নয়, সময় দোষী ছিল। তবে একদিন যদি ফিরিস, ওর চোখে দেখে নিস, শালুক এখনও ফোটে কি না।”
চিঠিটা পড়ে ঋত্বিক স্তব্ধ হয়ে গেল। বাবার মতো কঠিন মানুষ যে এতটা গভীরভাবে বুঝতে পারতেন, তা কখনো ভাবেনি সে। বাবার চোখেও শ্রাবণী ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি ছিল। এত বছর ধরে সে শুধু নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবেছে—ভেবেছে যে, সময় চলে গেছে, সম্পর্কের গভীরতা হয়তো মুছে গেছে। কিন্তু এখন সে বুঝতে পারছে, যে ভালোবাসা চুপ করে অপেক্ষা করে, তার গভীরতা সময় মাপতে পারে না। রাতের নিস্তব্ধতা ছিঁড়ে সে উঠে দাঁড়াল, পুকুরপাড়ে যেতে মন চাইছিল। হঠাৎ যেন মনে হল—আজ রাতে যদি শ্রাবণী থাকে, তবে তার চোখে সে নতুন করে নিজেকে খুঁজে পাবে। হয়তো এবার সে গল্প হতে নয়, সত্যি হতে ফিরেছে। তার জীবনে আর চিঠি জমা থাকবে না, এবার সে নিজের কথাগুলো শ্রাবণীর সামনে উচ্চারণ করবেই।
অধ্যায় ৮:
ভোর হতে তখনো বেশ দেরি, আকাশের কোলে হালকা ধূসর আলো ফুটছে। ঋত্বিক হাঁটছিল চুপচাপ, যেন তার পায়ের নিচে শুধু রাস্তা নয়, সময়ও বিছিয়ে আছে। চিঠিটা তার বুক পকেটে, বাবার সেই মলিন কাগজ—যেটা কোনো কবিতা নয়, কিন্তু একটা জীবনের গোটা অনুভব। সে সোজা চলে গেল সেই পুকুরপাড়ে, যেখানে প্রতিদিনকার মতো শ্রাবণী এখনো আসবে কি না, জানে না। কিন্তু তার ভেতরে আজ কোনো সংশয় ছিল না, কোনো দ্বিধাও না। পুকুরের ঘাটে এসে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল—সেই পাতার ফাঁকে একগুচ্ছ শালুক ফুটে আছে। আর তার পাশে শ্রাবণী, সাদা শাড়িতে, মাথায় খোলা চুল, দু’হাতে মুঠো করে ধরে আছে কিছু পদ্মপাতা। দেখে মনে হচ্ছিল, এই দৃশ্য বহু বছর আগেই তার মনজুড়ে লেখা ছিল—শুধু দেখা হয়নি।
শ্রাবণী তাকিয়ে রইল, চমকাল না, কাঁপলও না—কেবল তার চোখে ফুটে উঠল সেই পুরোনো আলোর রেখা, যা একসময় অপ্রকাশিত থেকে গিয়েছিল। ঋত্বিক ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তারা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর সে পকেট থেকে চিঠিটা বার করল, বলল, “বাবা এটা রেখে গিয়েছিলেন, যদি আমি একদিন ফিরে আসি। বলেছিলেন, তোর চোখে যদি এখনও শালুক ফোটে, তবে সেটা আমার জন্য শেষ সুযোগ।” চিঠিটা সে হাতে ধরিয়ে দিল শ্রাবণীর কাছে। শ্রাবণী চুপচাপ পড়ে নিল চিঠিটা, তারপর জলভেজা চোখে তাকিয়ে বলল, “তোর বাবা জানতেন, আমি যাবার মানুষ নই… আমি রয়ে গিয়েছিলাম, শুধু তোকে অপেক্ষা করতেই।”
ঋত্বিক তার দু’হাত শ্রাবণীর হাতে রাখল। “আমি এবার সত্যি ফিরেছি, শ্রাবণী। শহরের ছায়া ছেড়ে, শব্দ ছেড়ে, কাগজের ভেতরের গল্প ফেলে এসেছি। এবার তোর চোখের শালুকটাই আমার একমাত্র কবিতা।” চারপাশে যেন হাওয়ার গতি থেমে গেল। সময় তাদের চারদিকে ধীর হয়ে এল। পুকুরের জলে শালুকপাতাগুলো শান্তভাবে দুলছিল, আর পেছনে সূর্যের প্রথম আলো সেই পাতার নিচে স্বর্ণালি ছায়া ফেলে দিচ্ছিল। শ্রাবণী ধীরে বলল, “এইবার তুই গেলে, আমি তোর অপেক্ষায় থাকব না। কারণ এইবার তুই থাকবি… আমার গল্পে নয়, জীবনে।” তাদের মাঝখানে শব্দ নয়, কোনো প্রতিজ্ঞাও নয়—কেবল চোখে চোখ রাখা এক চিরন্তন বিশ্বাস। এবং সেই মুহূর্তেই, কোনো ঘোষণা ছাড়াই, যেন দু’জনের মনজুড়ে ফুটে উঠল একটি নতুন শালুক—ভালোবাসার, অপ্রকাশ্যতার, আর একান্ত জীবনের।