অদ্রীশ চক্রবর্তী
১
শৌভিক দত্তের চোখের সামনে পুরনো ছাপাখানার প্রেস মেশিন ক্রমাগত ক্লিক করতে থাকল। ঢাকা গলির ভেতরে, এক কোণে ছাপাখানাটি ঘরছাড়া ও বড্ড পুরোনো হয়ে পড়েছে। দিন-রাত কর্মচারীরা যন্ত্র চালায়, কিন্তু আজ সকালে কিছু অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। পেছনের ডেস্কে বসে ছিল শৌভিক, হাতে ছিল তাঁর দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত কিছু অর্ডার, তবে একটার মধ্যে কিছু অদ্ভুত ব্যাপার ছিল।
“এই অর্ডারটা কোথা থেকে এল?” শৌভিক মনে মনে প্রশ্ন করছিল। এই অর্ডারের ঠিকানা ছিল রহস্যময় এবং পুরোপুরি অচেনা—”অনন্তপুর, গোধূলি প্রান্তে”। তাছাড়া, যে-ই অর্ডারটি দিয়েছিল, তার নাম লেখা ছিল “প্রেরক অজ্ঞাত”। এই ধরনের অর্ডার তো কখনো আসে না!
তবে অদ্ভুত এক জিনিস ছিল—অর্ডারটি একেবারে হাতে লেখা, পুরনো কাগজে। কাগজের কোণে সোনালি তন্তু দিয়ে কিছু লেখা ছিল, যা সাধারণ চোখে পড়ত না। শৌভিক চোখ কুঁচকে পড়ল। এমন একটি অর্ডার আসার মানে কি?
এখানেই শেষ নয়, অর্ডারের মধ্যে লেখা ছিল এক ভয়ঙ্কর বাক্য:
“আপনাকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে প্রেতযজ্ঞে—১২ অশ্বিন, মধ্যরাত্রি, স্থান: অনন্তপুর শ্মশান।”
শৌভিক বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। এই ধরনের অর্ডার আগে কখনো পায়নি। তার মনের মধ্যে কয়েকটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। তবে, কি হলো যে একটি ছাপাখানায় এমন একটা অর্ডার এসে পৌঁছাল? এমনকি প্রেতযজ্ঞের কথা তো কোনো আধুনিক মানুষ মনে রাখে না। এই ছিল শৌভিকের মনে একটানা চিন্তা—তার চিরকালীন যুক্তিবাদী মন কাজ শুরু করল।
মিহির, ছাপাখানার টাইপসেটার, সেদিনও তার পাশেই বসে ছিল। কাগজটি হাতে নিয়ে মিহিরের চেহারা একদম বদলে গেল। তার চোখে ভয়—এক অদ্ভুত ভীতি স্পষ্ট হয়ে উঠল। “এই অর্ডারটা কেন এসেছে? তুমি জানো না, বাবু, এই ধরনের অর্ডার সুরক্ষিত করা উচিত না,” মিহির কাঁপা কাঁপা গলায় বলল।
“কী বলছো, মিহির? তুমিই তো বলেছিলে—তন্ত্রের ব্যাপারে কোনও বিশ্বাস নেই। এখন কেন এমন মনে হচ্ছে?” শৌভিক উত্তর দিল। মিহির তার দৃষ্টি ঘুরিয়ে ফেলে, কিছু বলল না। শুধু ছাপাখানার পেছনের তাকের দিকে তাকিয়ে ছিল। কয়েক মিনিট পর, মিহির অবশেষে বলল, “বাবু, আমি কিন্তু এই ধরনের অর্ডারের ইতিহাস জানি। তোমার দাদুর প্রিন্টিং হাউসে অনেক বছর আগে এমন কিছু অর্ডার এসেছিল। তবে, সেগুলো কোনও ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে আসেনি। ভূপেন পাল, ওই কর্মচারী, যাকে তোমার দাদা খুব ভালো করে জানতেন—সে নিখোঁজ হয়েছিল এমন এক অর্ডার আসার পর।”
শৌভিক কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠল। তার মাথায় কিভাবে যেন এই অদ্ভুত অর্ডারের সঙ্গে ভূপেন পালের কথা উঠে আসে। তার বাবা-ঠাকুরদার পুরনো নথিপত্র খুঁজলে সে দেখতে পাবে, অনেক আগে এমন একটি ঘটনার কথা লেখা ছিল। তবে, সে কখনও এসব বিশ্বাস করতো না। কিন্তু, এখন যেন কিছু একটা ঘটতে চলেছে, আর তার মাথায় এক ভয়ঙ্কর চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল।
অর্ডারটি হাতে নিয়ে শৌভিক আবার একবার পড়তে শুরু করল। “১২ অশ্বিন, মধ্যরাত্রি, অনন্তপুর শ্মশান।” কোথায় এই জায়গা? শৌভিক জানে, সে যদি ভুল না হয়, এটি শহরের এক কোণায়—যেখানে অনেক পুরোনো শ্মশান ছিল। সেই শ্মশান সম্পর্কে কিছু পুরনো লোকের কথা শুনেছিল, যাদের কাছে মৃত্যুর পরে আত্মারা ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু, এতটা গভীরে যেতে হবে, এ তো সে কখনও ভাবেনি।
“আমি যেতে পারি, তবে কিছুদিন পরে। এখন কিছু জরুরি কাজ আছে।” শৌভিক শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিল। যদিও, তার মধ্যে এক অদৃশ্য তাগিদ ছিল—এই অর্ডারের পিছনে কি কিছু গূঢ় রহস্য লুকানো রয়েছে? সে বুঝতে পারছিল না, কিন্তু কিছু একটা ছিল, যা তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
অবশেষে, তিনি ছাপাখানার খাতা বন্ধ করে কফি মেশিনের দিকে এগিয়ে গেলেন। ঘরবাড়ির বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। এই অর্ডারের বিপদ কি তাকে পেছনে ফেলে দিবে? না কি, তাকে এক ভয়াবহ যাত্রার দিকে টেনে নিয়ে যাবে, যেখানে সত্য কেবল এক অন্ধকার পথেরই মাঝে?
এমন অনিশ্চয়তার মধ্যে, শৌভিক দত্ত আজও জানত না, তার জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হতে চলেছে।
২
ছাপাখানার দরজা বন্ধ করে বাড়ি ফিরলেও, শৌভিকের মন যেন আটকে ছিল সেই অদ্ভুত অর্ডারটিতেই। ঘরের মধ্যে আলো জ্বলছিল, কিন্তু জানালার বাইরে শহরের কুয়াশা-মিশ্রিত আকাশ অদ্ভুতভাবে ঝিমিয়ে ছিল। বারান্দায় বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে, সে আবারও বারবার পড়ে চলছিল সেই শব্দগুলো— “প্রেতযজ্ঞে আমন্ত্রণ”। যেন প্রতিটি অক্ষর তাকে কিছু বলতে চাইছে, কিছু জানাতে চাইছে। হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল মিহিরের বলা নাম—ভূপেন পাল।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই, ছাপাখানার পুরোনো খাতা ঘাঁটতে শুরু করল শৌভিক। এই খাতাগুলো তার ঠাকুরদার সময় থেকে সংরক্ষিত আছে। ধুলো জমা কভার, হলদে পাতাগুলোর ভেতর এক জায়গায় সে খুঁজে পেল ১৯৫৭ সালের একটি এন্ট্রি—”বিশেষ অর্ডার: রক্তরঞ্জিত আমন্ত্রণপত্র, ছাপার পর কর্মচারী নিখোঁজ—ভূপেন পাল”। শৌভিক কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। হঠাৎ যেন তার মনে হলো ঘরের বাতাসটা ভারী হয়ে উঠেছে, শব্দহীন, নিঃশব্দ। পেছনে ফিরে তাকাতেই সে দেখতে পেল—ঘরের দরজা নিজের থেকে সামান্য একটু খুলে আছে, যদিও সে নিশ্চিত করেই তা বন্ধ করেছিল।
চোখ সরিয়ে আবার খাতায় মন দিল সে। নিচে ছোট হস্তাক্ষরে লেখা—“অর্ডারের ভাষা: সংস্কৃত মিশ্র, অজ্ঞাত উৎস। প্রেরক: T.S.”। শৌভিকের বুকের ভেতর দিয়ে যেন কাঁপন বয়ে গেল। T.S.—ত্রিপুরা সাধ্বী? অক্ষর দুটি একটাই মিলছে, কিন্তু এমন একটা নাম সে এর আগে কখনও শুনেনি। হঠাৎ তার মনে পড়ল, ছাপাখানার পিছনে একটি পুরোনো কাঠের আলমারি আছে—যেটা প্রায় ২৫ বছর কেউ খোলেনি। সেই আলমারির মধ্যে হয়তো আরও কিছু লুকিয়ে থাকতে পারে।
দুপুরে ছাপাখানায় গিয়ে সে আলমারির তালা খুলল। কাঠের ঘ্রাণ আর পুরনো কাগজের গন্ধে ভরে গেল ঘরটা। একে একে কাগজগুলো নামাতে নামাতে, সে খুঁজে পেল একটি প্যাকেট—পুরনো ফাইল কভারে বাঁধা, যার উপরে লেখা “ভূপেন পাল – নিখোঁজ ফাইল, ১৯৫৭”। ভেতরে ছিল কিছু অসমাপ্ত ছাপা কাগজ—একটি আমন্ত্রণপত্রের খসড়া। ঠিক সেই ভাষা, ঠিক সেই রচনায় লেখা:
“প্রেত-ভোগ, মধ্যরাত্রি, আত্মার ত্যাগে সিদ্ধি।”
তারপর ছিল একটি ছোট চিরকুট:
“আমি যা ছাপাচ্ছি, তা শুধু অক্ষর নয়—এ যেন আত্মার বিক্রয়পত্র। আমি ভয় পাচ্ছি। কেউ যেন ছায়ার মধ্যে তাকিয়ে আছে।”
শৌভিক এখন পুরোপুরি সাড়া দিয়ে গেছে এই রহস্যে। অথচ, তার মন বলে দিচ্ছে—এই সবকিছু এক নির্দিষ্ট পথের দিকে তাকে ঠেলে দিচ্ছে। ভূপেন পাল নিখোঁজ হয়েছিল। তার ছাপা বন্ধ হয়নি। আর সেই ছাপা?… হ্যাঁ, সে হঠাৎ অনুভব করল, ছাপাখানার প্রেস মেশিন মাঝে মাঝেই মধ্যরাতে নিজে থেকে শব্দ করছে। গত মাসে দু’বার এমন ঘটনা ঘটেছে। কর্মচারীরা মজা করে বলেছিল—“ভূপেনদার আত্মা ফিরেছে বুঝি!”
শৌভিক এগিয়ে গেল প্রিন্টিং মেশিনের দিকে। ভূপেনের সময়কার প্রেস, এখনও ব্যবহার হয়। ধাতব হাতল স্পর্শ করতেই কেমন যেন ঠান্ডা ঠান্ডা একটা অনুভূতি হলো। যেন কেউ সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে, স্রেফ দৃষ্টি অদৃশ্য। সে একবার মেশিন চালিয়ে দেখতে চাইল। হাতল নামানোর সঙ্গে সঙ্গে একটানা শব্দ তুলে কাগজ ঢুকল প্রেসে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে কাগজে ছাপা হল সেই একই লাইন, যা সে খাতায় পেয়েছিল:
“প্রেত-ভোগ, আত্মার ত্যাগ, অনন্তপুর।”
কিন্তু—সে তো টাইপ দেয়নি! কোথা থেকে এল এই ছাঁদ? এই অক্ষরগুলো কি আগে থেকেই ছাঁচে ছিল? তার কাঁধের উপর দিয়ে ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেল। সে দ্রুত মেশিন বন্ধ করল। মিহির দৌড়ে এল, চোখে ভয়—“আপনি প্রেস চালালেন? এই সময়? আমি কিন্তু সাবধান করেছিলাম, বাবু! ওই মেশিনে ওরা এখনও বসে থাকে… ভূপেন পাল নিজে নিজের শেষ অক্ষর ছেপে গিয়েছিল।”
কথাগুলো যেন মাথায় বাজতে থাকল শৌভিকের। বাস্তব আর অবাস্তবের মাঝখানে দাঁড়িয়ে, সে বুঝতে পারছিল—এই রহস্য কেবল একটি অর্ডারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি সময়চক্র, যেটি বহু বছর ধরে চলেছে—আর এবার তার পালা। পেছনের জানালার বাইরে ঝড়ের আওয়াজ উঠছিল, আর শৌভিকের চোখে প্রতিফলিত হচ্ছিল সেই অদ্ভুত প্রেত-আমন্ত্রণপত্রের অক্ষর, যেটা রাতের অন্ধকারে আরও বেশি জ্বলজ্বলে হয়ে উঠছে।
৩
উত্তর কলকাতার সন্ধ্যা তখন গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে। শৌভিক দাঁড়িয়ে আছে চিৎপুরের এক পুরনো লাইব্রেরির সামনে, নাম “প্রাচ্যপাঠ কুঠির”। লাইব্রেরিটির ভিতরে এখনও কেরোসিন বাতির আলো জ্বলে—বইপত্র ছাড়া এইখানে আর কিছুই যেন টিকে নেই। এইখানেই বাস করেন এক বৃদ্ধ, অশোকেশ ঘোষাল, যিনি একসময় কলকাতার অলৌকিক ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতেন। শৌভিক ভেতরে ঢুকতেই বৃদ্ধ মাথা তুলে তাকালেন, গলার আওয়াজ একদম নরম—“ছাপাখানার ছেলে, না? তোমার দাদুকে চিনতাম।”
শৌভিক চুপচাপ সামনে রাখা স্টুলে বসল, তারপর ধীরে ধীরে বলল, “একটা জায়গা খুঁজছি, কাকু। নাম—অনন্তপুর।”
অশোকেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, “তুমি ভুল জায়গা খুঁজছো না, ছেলেটা। অনন্তপুর এখন রাস্তার নামেও নেই, মানচিত্রেও না। সেটি একসময় ছিল শহরের সীমানার শেষ প্রান্তে, যেখানে যাতায়াত বন্ধ ছিল সন্ধ্যার পর। ওখানে এক শ্মশান ছিল, যেখানে সাধকরা তান্ত্রিক যজ্ঞ করত, কেবল প্রেত শক্তি আহ্বানের জন্য। আমি একবার গিয়েছিলাম ১৯৭১ সালে। তারপর আর সাহস হয়নি।”
শৌভিকের কণ্ঠে কাঁপা পড়ল। “আপনি আমাকে পথ দেখাতে পারবেন?”
বৃদ্ধ একটু হাসলেন। “পথ নয়, সাবধানতা শিখিয়ে দিতে পারি।”
পরদিন রাতে, ট্রাম ধরে শৌভিক রওনা দিল। সে জানে না ঠিক কোন দিকে যাচ্ছে, শুধু অশোকেশ কাকুর বলে দেওয়া দুটো ক্লু মনে রাখল—“মেছোঘাটের পর, যেখানে গ্যাসের গন্ধ ভেসে আসে, একটা লোহার গেট পাবে—সেই গেটেই অনন্তপুর।” ট্রাম থামল। শহর যেন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে, বাতি নিভে আসছে। সে একা এগিয়ে গেল। তার ব্যাগে রাখা আছে সেই নিমন্ত্রণপত্রের কপি—নিজের হাতে ছাপানো না হলেও, প্রেস থেকেই বেরিয়েছে। গেটটা পেল এক অদ্ভুত চুপচাপ স্থানে—তিনটে লোহার খুঁটি একজায়গায় বেঁধে রাখা, যেন কারও প্রবেশ আটকাতে নয়, বরং একটা পুরোনো চিহ্ন বাঁচিয়ে রাখা।
শৌভিক গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকল। এক ধরণের পচা কাঠের গন্ধ ভেসে এলো, আর সঙ্গে ভেজা মাটি। চারদিকে গাছপালা, তবে তার ভেতরে একটা পথ ছিল, যা কুয়াশার মধ্যে টেনে নিয়ে চলেছে। সেই পথেই হাঁটতে হাঁটতে সে পৌঁছাল একটি খোলা জায়গায়—এক ধ্বংসস্তূপের মতন, কোথাও কোথাও ছাই জমে আছে, পাথরে খোদাই করা কিছু অদ্ভুত চিহ্ন। সেইখানেই, যেন ঘড়ির কাঁটা থেমে গেল। বাতাস দাঁড়িয়ে পড়ল, আর সামনের মাটির উপরে বসে থাকা একটি নারীমূর্তিকে সে দেখতে পেল।
শাড়ি পরা, কপালে তিলক, এক চোখে ভয়, এক চোখে রহস্য—ত্রিপুরা সাধ্বী।
সে ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকাল, বলল, “তুমি এসেছো… সময়ের আগেই। কেউ তাড়না দিচ্ছে তোমাকে?”
শৌভিক কিছু বলার আগেই সে আবার বলল, “তোমার প্রেস… ভূপেনের মতোই প্রেত-অক্ষরে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এবার আমন্ত্রণ পৌঁছেছে তোমার জন্য। ত্যাগ না করলে ফেরাও হবে না।”
শৌভিক গলা শুকিয়ে গেল। “আপনি কি… T.S.? আপনি সেই… যিনি অর্ডার দিয়েছিলেন?”
ত্রিপুরা হেসে উঠল। তার হাসিতে ছিল না কোনো আনন্দ, বরং ছিল এক তীক্ষ্ণ সংকেত—“আমি পথ দেখাই, নির্দেশ দিই না। তুমি যদি সত্য জানতে চাও, তবে প্রেতযজ্ঞে আসতে হবে—১২ অশ্বিন, মধ্যরাত্রি। আজ যা দেখলে, তা শুধু ভূমিকা।”
তারপর, হঠাৎ কুয়াশা গাঢ় হল, চারপাশ যেন ঢেকে গেল একটা অদৃশ্য পর্দায়। চোখ খুলতেই শৌভিক আবার গেটের বাইরে, যেখানে ট্রাম লাইনের পাশে বাতি ঝিমাচ্ছে। তার শরীর ঘামে ভিজে, হাত কাঁপছে, আর ব্যাগে রাখা নিমন্ত্রণপত্রটা—তাতে রক্তের ছিটে!
কিন্তু কোথা থেকে এল রক্ত? সে তো একা গিয়েছিল!
৪
রাত গভীর। শৌভিক নিজের বিছানায় শুয়ে আছেন, কিন্তু ঘুম আসে না। ঘড়ির কাঁটা টিক টিক শব্দে বুকের ভেতর কাঁপন ধরাচ্ছে। বারবার মনে পড়ছে ত্রিপুরা সাধ্বীর চাহনি—সে চোখ দিয়ে যেন মন পড়ে ফেলতে পারে। মাথায় ঘুরছে সেই বাক্য: “ত্যাগ না করলে ফেরাও হবে না”। বাইরে হালকা বৃষ্টি পড়ছে, জানালার কাঁচে ফোঁটা গড়িয়ে পড়ে অদ্ভুত ছন্দে। তার শরীর ক্লান্ত, কিন্তু মনটা উত্তেজনায় টনটন করছে। ব্যাগ খুলে সে আবার বের করল সেই নিমন্ত্রণপত্রের কপি। কিন্তু এবার অবাক হয়ে দেখে—পত্রের অক্ষরগুলো বদলে গেছে। সেখানে আর কোনো ‘তারিখ’ নেই, শুধু লেখা:
“পথ শুরু হয়েছে। বন্ধ হবে আত্মত্যাগে।”
আবার কীভাবে সম্ভব? এটা তো ছাপানো ছিল! চোখ কি ভুল দেখছে?
পরদিন ছাপাখানায় পৌঁছেই শৌভিক বুঝল কিছু ঠিক নেই। মিহির দরজা বন্ধ করে কাঁপা গলায় বলল, “বাবু, গত রাতে কেউ যেন ছাপাখানায় ঢুকেছিল। কাগজ এলোমেলো, ছাঁদগুলো নড়ে গেছে। আমি একটা শব্দও শুনিনি, অথচ ঘুম ভেঙে দেখি প্রেস মেশিন ঘুরছে।”
শৌভিক বুঝতে পারল, সে আর একা নেই। কিছু একটা অদৃশ্য সত্তা তার চারপাশে রয়েছে। সে সিদ্ধান্ত নেয়, সমস্ত যুক্তি ফেলে এবার সত্যের গভীরে ঢুকতে হবে। সন্ধ্যেবেলা সে আবার যায় প্রাচ্যপাঠ কুঠিরে, অশোকেশ ঘোষালের কাছে। বৃদ্ধ এবার তাকে এক পুরনো পুঁথি দেখান—”প্রেততন্ত্র রহস্য” নামে লেখা এক গোপন তান্ত্রিক নথি। পাতায় পাতায় প্রাচীন মন্ত্র, চিহ্ন, এবং একটি পরিচিত শব্দ—“অনন্তপুর যজ্ঞমণ্ডল”।
অশোকেশ কাঁপা হাতে একটি অংশ পড়ে শোনান:
“প্রেতযজ্ঞে আহ্বান করা আত্মা মুক্তি পায় যখন তার মৃত্যুর কারণকে কেউ বহন করে। যিনি নিমন্ত্রণ পান, তিনি যদি রক্ত দিয়ে প্রতিশ্রুতি না দেন, তবে প্রেত তাকে ধরে রাখে সময়ের বাইরে।”
এইবার শৌভিক ঠাণ্ডা মাথায় বুঝল—তাকে শুধু নিমন্ত্রণ দেওয়া হয়নি, তাকে বেছে নেওয়া হয়েছে। তার ছাপাখানা, তার পরিবার, এমনকি হয়তো তার পূর্বপুরুষও জড়িয়ে আছে এই প্রাচীন তন্ত্রচক্রে।
ত্রিপুরা সাধ্বীর কথা মনে পড়ে: “আমরা পথ দেখাই, নির্দেশ দিই না।”
তবে কেন তাকেই?
রাত সাড়ে এগারোটা। শৌভিক সোজা চলে গেল অনন্তপুরে। এইবার সে ভয় পায় না, সে চায় উত্তর। গেটের ভেতরে ঢুকতেই কুয়াশা গাঢ় হয়ে এল, বাতাসে ভেসে এলো ধূপ-ধুনোর গন্ধ। খোলা মাঠে আগুনের ধোঁয়া উঠছে। সেইখানেই দাঁড়িয়ে ছিলেন ত্রিপুরা সাধ্বী, আগুনের পেছনে আরও কয়েকটি ছায়ামূর্তি—সবাই লাল পরনে, চোখ ঢাকা, হাতে রুদ্রাক্ষর মালা।
“তুমি এসেছো সময়ের আগেই,” ত্রিপুরা বললেন, এবার তার গলায় আশ্চর্য রকম কোমলতা। “ভালো, কারণ আত্মা প্রস্তুত।”
শৌভিক দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ।
ত্রিপুরা এগিয়ে এসে তার কপালে কিছু আঁকলেন, এক ধরনের বৃত্ত—মাটি, ধূপ আর রক্ত মিশিয়ে।
“আজ তুমি জানবে, কেন ভূপেন পাল ফিরতে পারেনি। তার কাজ অসমাপ্ত ছিল। যে নিমন্ত্রণ তুমি পেয়েছো, তা তোমাকে চুক্তিতে বেঁধেছে। তোমার মুদ্রণযন্ত্র শুধুই কালি ছাপে না, আত্মার ভাষা ছাপে।”
সে আরেক ধাক্কা খায়। তবে কি…?
তার প্রেস, সে নিজে, তার কাজ—সবই ছিল নিযুক্ত একটি পূর্বনির্ধারিত যজ্ঞের জন্য?
ত্রিপুরা মাটিতে বসে, বলল, “তুমি ত্যাগ করবে, তবে তা হবে নিজের আত্মার এক অংশ। সেই অংশ ছাপা হবে, ছড়িয়ে যাবে, এবং আরেক আত্মা মুক্তি পাবে। যদি তা করতে না পারো, তুমি নিজেই হবে বন্দি আত্মা—যেমন ভূপেন।”
একটা ছোট তামার পাত্রে সে কিছু দেয়—ধূপ, কালি, ও রক্ত। বলল, “যে সিদ্ধান্ত তুমি নেবে, তা চিরস্থায়ী। সময়ের বাইরে যে থাকে, সে আর ঘরে ফেরে না।”
শৌভিকের সামনে তখন দুই রাস্তা—ফিরে গিয়ে সবকিছু অস্বীকার করে বাঁচা, নাকি নিজের আত্মার এক টুকরো দিয়ে কারও আত্মা মুক্ত করা।
আগুনে আলো তখন ছায়া নাচাচ্ছে। এবং শৌভিক জানে—এই রাত্রির পর সে আর কখনও আগের মতো থাকবে না।
৫
রাতের শেষ প্রহরে ছাপাখানায় একা দাঁড়িয়ে ছিল শৌভিক। জানত, আজ কিছু ঘটবেই। আগের রাতের পর থেকেই শরীর যেন হালকা অথচ ভারি—দুটি বিপরীত অনুভব। সে ফিরে এসেই বন্ধ ছাপাখানার দরজা খুলেছিল চাবি ছাড়াই, নিজেই অবাক হয়েছিল। যেন কোন অদৃশ্য হাত আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল তার জন্য। ঘরের ভেতরে ঢুকতেই কাঁচের জানালায় ছায়ার মতো কিছু নড়ল, বাতাস স্তব্ধ, আর মেশিনটা—যেটা গতকাল বন্ধ রেখে গিয়েছিল—আবার নিজে থেকে নড়ে উঠল।
প্রেস মেশিনের সামনে গিয়ে সে থমকে দাঁড়াল। রোলারগুলো ঘুরছে, কালি চুঁইয়ে পড়ছে, অথচ কেউ চলছে না, কেউ চালায়নি। ধাতব হাতল গা ছমছমে ঠান্ডা। হঠাৎ পেছন থেকে আসা এক শব্দে সে কেঁপে উঠল—চেয়ারের ঘর্ষণ, যেন কেউ উঠে দাঁড়াল। “ভূপেন?”—এই শব্দটিই তার গলা থেকে নিজে থেকেই বেরিয়ে এল। কোন উত্তর নেই। তবে সে জানে, কেউ বা কিছু এখানে রয়েছে।
সে হালকা হাত লাগিয়ে প্রেস চালু করল, মেশিন গর্জন করে উঠল। আর ঠিক তখনই কাগজে ছাপা হতে লাগল অদ্ভুত অক্ষর—সংস্কৃত ও বাংলা মিশ্রিত বাক্য:
“যে ত্যাগী, সে মুক্ত। যে ভয় পায়, সে বন্দি। অক্ষরে বাঁচে আত্মা। রক্তেই ছাপ হয় চুক্তির।”
শৌভিক হতবাক হয়ে দেখল, সে যে টাইপসেট দেয়নি, সেসব শব্দ নিজে থেকেই ছাপা হচ্ছে। একের পর এক পৃষ্ঠা বেরোচ্ছে—সব একরকম লেখা, অদ্ভুত হরফে, মাঝে মাঝে কোথাও রক্তের মতো দাগ, শুকিয়ে আসছে কাগজে।
কিন্তু—কালি তো লাল ছিল না!
প্রেস বন্ধ করতে গিয়ে সে হাত দিল, আর সেই মুহূর্তে এক ধাতব তাপে ঝলসে উঠল আঙুল। ব্যথায় কুঁকড়ে গেল সে, কিন্তু বুঝল—এটা কেবল যন্ত্র নয়, একটা জীবন্ত চুক্তি।
সেদিন রাতটা ঘুমহীন কেটে গেল। পরদিন সকালে মিহির এল, তার মুখ ফ্যাকাশে। “বাবু, আমি আর পারবো না… কাল রাতেও আমি প্রেসে কারও পায়ের শব্দ শুনেছি… হালকা মাটির ঘ্রাণ… যেন ভূপেনদা…”
শৌভিক তাকে থামিয়ে দিল। “তুমি চাইলে যেতে পারো। এটা এখন আমার পথ।”
মিহির কিছু না বলে পেছন ঘুরে চলে গেল, কিন্তু যাওয়ার আগে একবার চোখে ভয় মিশ্রিত করুণ দৃষ্টি ছুঁয়ে গেল।
দুপুরে শৌভিক সব ফেলে এক পুরনো দালানে চলে গেল—যেখানে তার দাদুর এক আত্মীয় একসময় থাকতেন। সেখানে সে পেল পুরনো কাঠের বাক্স—ভিতরে দাদুর হাতে লেখা কিছু পৃষ্ঠা:
“১৯৫৭ সালের প্রেত-অর্ডার বন্ধ করিনি। আমি ছাপিয়েছিলাম। ভূপেন গিয়েছিল অনন্তপুরে, ফেরেনি। প্রেস তখন থেকেই তন্ত্র ছাপে। এখন প্রতি প্রজন্মে কেউ না কেউ বেছে নেওয়া হয়। আমি এড়াতে পেরেছিলাম। এবার সে সুযোগ তোমার নেই।”
এই চিঠি পড়ে শৌভিক যেন বোঝে—অভিশাপ শুধু প্রেসে নয়, তার রক্তেও আছে। আর এখন, সেই অভিশাপের রঙ কালি নয়, রক্তে লেখা হচ্ছে। এবং সেই রক্ত কার, তা সে জানে না। শুধু জানে, প্রতি পৃষ্ঠায় যেসব ছাপা হচ্ছে, তা আর মুছা যাবে না।
এমনকি মেশিনের যন্ত্রপাতিতে সে দেখতে পেল ছোট ছোট খোদাই—তামার পাতায় তন্ত্রমন্ত্র, যেগুলো কেউ বসিয়েছিল অনেক আগে। এই মেশিন অভিশপ্ত নয়—জাগ্রত।
শেষ রাতে, যখন সে সব আলো নিভিয়ে একা বসেছিল প্রেসের সামনে, হঠাৎ দেখা গেল—একটি ছায়া তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। সে ঘুরে তাকাতে সাহস পেল না।
কিন্তু প্রেস আবার চালু হল, নিজে থেকে, শব্দ করল—ধীরে, ভারি, অথচ স্থির।
এবং সেই কাগজে এবার একটি নতুন শব্দ ছাপা হল:
“শৌভিক দত্ত।”
তার নাম, স্পষ্ট অক্ষরে।
আর নিচে লেখা:
“আমন্ত্রণ গৃহীত। আত্মত্যাগ প্রস্তুত।”
৬
প্রেসের মেশিন থেমে গেলেও শব্দ যেন শৌভিকের মনের মধ্যে বাজতে থাকল। সেই রাত থেকে আর কিছুই আগের মতো স্বাভাবিক থাকেনি। চোখে বারবার ভেসে উঠছিল নিজের নামটা, যেটা মেশিন ছেপেছিল—স্বয়ংক্রিয়ভাবে, নিজের থেকে। অথচ সে কোন কম্পোজ দেয়নি, কোন ছাঁদ বানায়নি। তার মানে, কেউ বা কিছু, তাকে নির্বাচন করেছে। সে জানে, এখন আর ফেরার পথ নেই। একমাত্র উপায়—এই অভিশপ্ত চক্রের মূল উৎস খুঁজে বের করা। তার খোঁজ শুরু হয় কলকাতার এক অন্ধকার অধ্যায়ের দিকে—যেখানে ‘প্রেততন্ত্র’ কেবল বই নয়, এক জীবন্ত চুক্তি।
সে আবার গেল প্রাচ্যপাঠ কুঠিরে, অশোকেশ ঘোষালের কাছে। এবার বৃদ্ধ তাকে নিয়ে গেল লাইব্রেরির ভেতরের গোপন একটি ঘরে, যেখানে ধুলোমাখা শেলফে সাজানো ছিল হারিয়ে যাওয়া পুঁথি। একটা কালো রঙের কাঁচে মোড়া বই টেনে বের করলেন—”প্রেততন্ত্র শাস্ত্র: আত্মবন্দির মুক্তিপথ”। পাতা উলটে অশোকেশ বললেন, “এই বইটায় লেখা আছে, কীভাবে আত্মা, যাকে চুক্তির মাধ্যমে বন্দি করা হয়, তা মুক্ত হতে পারে। তবে এর মূল্য দিতে হয় রক্ত দিয়ে—তুমি যদি সত্যি চাও, বুঝে শুনে এগিও।”
শৌভিক হাত দিয়ে পাতায় হাত বোলাতেই অক্ষরগুলো যেন নড়ে উঠল। চমকে উঠল সে। এক পৃষ্ঠায় লেখা—
“যে আত্মা চুক্তিবদ্ধ, তার মুক্তি হয় আত্মত্যাগে, অথবা প্রেতের কাজ সম্পূর্ণ হলে। তবে, যদি বংশধরেরা সত্য উপলব্ধি করে চুক্তি ভঙ্গের পথ খোঁজে, তবে আত্মাবন্দি স্থান ত্যাগ করে।”
সে আরও পড়ে জানতে পারল, ‘তন্ত্রবন্দি’ হল সেই আত্মা, যাকে চুক্তির ছাপে আবদ্ধ করা হয়। আর সেই ছাপ যদি ছাপাখানার মতো এক “বহ্নিসূচী যন্ত্রে” তৈরি হয়, তবে তা একটি আত্মার প্রেতরূপ ধরে রাখে, যতক্ষণ না তার শেষ কাজ সম্পন্ন হয়।
শৌভিক বুঝতে পারল—ভূপেন পাল এখনও বন্দি। এবং সেই কাজ এখনও অসমাপ্ত।
রাতে ফিরে এসে শৌভিক ছাপাখানার পেছনের সেই পুরনো কোঠায় ঢুকল—যেটা বহু বছর ধরে তালাবদ্ধ ছিল। তার ঠাকুরদার বানানো গোপন কুঠুরি, যেখানে রাখা ছিল কিছু নিষিদ্ধ লেখা। সে একটা কাঠের বাক্স খুঁজে পেল, যার গায়ে লেখা—“অশুভ পাণ্ডুলিপি: T.S. নির্দেশিত”। ভেতরে ছিল তিনটি কাগজের পাতা, যার একটিতে আঁকা ছিল এক গোলাকার মণ্ডল—সাতটি রেখা, যার প্রতিটি প্রান্তে লেখা ছয়টি নাম, আর একটিতে “ভূপেন পাল”।
অপর পৃষ্ঠায় লেখা ছিল—“শেষ আত্মত্যাগের পূর্বে মুদ্রণ বন্ধ করা চলবে না। যারা ত্যাগ করেনি, তারা ছায়ার খাদে আটকে থাকে।”
সেই কাগজের শেষ লাইনে লেখা ছিল—“পরবর্তী: শৌভিক দত্ত।”
তার হৃদয় জেঁকে ধরল আতঙ্কে। তবে কি বহু বছর আগে থেকেই তার নাম এই তালিকায় ছিল? তবে কি সমস্ত কিছু পূর্বনির্ধারিত?
প্রেস চালু থাকল সারা রাত। শৌভিক এবার নিজের হাত দিয়ে ছাঁদ তৈরি করল—ভূপেনের নাম, তার অন্তর্ধান, তার শেষ কথাগুলো। সে ভাবল, যদি এইসব সত্য ছাপিয়ে সে চুক্তির একপাশে পৌঁছাতে পারে, তবে হয়তো মুক্তির সূত্র পাবে। এক পর্যায়ে সে দেখতে পেল—এক পৃষ্ঠায় লেখা হল,
“ভূপেন পাল আত্মত্যাগ করেনি, সে রক্ষা করতে চেয়েছিল পরবর্তীকে। তাই সে বন্দি।”
এইবার সব স্পষ্ট। ভূপেন তার কাজ শেষ করেনি—সে প্রেসে না ছেপে পালাতে চেয়েছিল, এবং সেই কারণেই তার আত্মা ছায়ায় বন্দি হয়ে আছে।
শৌভিক জানে, এবার তাকে চুক্তির শেষ কাজ করতে হবে—ছাপতে হবে এক পূর্ণ ‘প্রেতনিমন্ত্রণ’, যেটি প্রেতের আত্মা-মুক্তির মাধ্যম। তবে সেই ছাপা শেষ হলেই, আত্মা বের হবে—হয় মুক্তির জন্য, নয় প্রতিশোধের জন্য।
৭
১২ অশ্বিন। চাঁদ ঢাকা, বাতাস ভারী, আকাশে যেন অনিশ্চয়তার ছায়া। শৌভিক জানে—এটাই সেই রাত, যার কথা প্রতিটি নিমন্ত্রণপত্রে লেখা ছিল। তার প্রেস মেশিন দিনভর নিজে থেকে চলেছে, ছাপিয়েছে একের পর এক পৃষ্ঠা, যেগুলোতে এক ভয়ানক চক্রের গল্প লেখা, যার শেষ বিন্দু সে নিজেই। ব্যাগে কিছু পৃষ্ঠা, ধূপকাঠি, পুঁথি আর নিজের রক্ত মেশানো কালির শিশি নিয়ে সে রওনা দিল অনন্তপুরের দিকে। চারপাশের কুয়াশা আজ আরও ঘন। সে রাস্তা চিনে গেছে, কিন্তু আজ রাস্তা যেন তাকে চিনে ফেলেছে।
গেট পেরোনোর পর মনে হচ্ছিল কেউ পেছনে পেছনে হাঁটছে, অথচ ফিরে তাকালেই নিঃস্তব্ধতা। রাতের নিস্তব্ধতা এতটা ভারী, যেন শব্দ করলেই আকাশ ফেটে যাবে। অনন্তপুরের শ্মশানভূমি জেগে উঠেছে—সাতটি প্রদীপ জ্বলছে গোল বৃত্তে, যার কেন্দ্রে বসে আছেন ত্রিপুরা সাধ্বী। তার চারপাশে ছায়ার মতো আরও ছয়টি সন্ন্যাসী, যারা মুখ ঢাকা, নিঃশব্দ। আগুনের মাঝে রাখা একটি তাম্রপাত্রে টগবগ করে ফুটছে কালো কিছু, আর ধূপের গন্ধে মাথা যেন ঘোরে শৌভিকের।
ত্রিপুরা বললেন, “তুমি সময়মতো এসেছো, শৌভিক দত্ত। এবার তুমি শেষ কাজ সম্পূর্ণ করবে।”
তাঁর হাতে দেওয়া হল একটি তালপাতার পৃষ্ঠা—যেখানে লাল অক্ষরে লেখা “প্রেতনির্বাহ মন্ত্র”, আর নিচে নির্দেশনা—“শেষ মুদ্রণ চলাকালীন, আত্মত্যাগকারী নিজ রক্ত দিয়ে সাক্ষর করবে।” শৌভিক প্রেসের পাতা খুলে রাখল, সেই পাতায় ছাঁদ দিল নিজের তৈরি করা বাক্যে—“ভূপেন পাল, মুক্ত হোন। আমি সাক্ষর দিলাম। সত্য প্রকাশ হল।”
ধীরে ধীরে সে রক্তমেশানো কালি ছড়িয়ে ছাঁদ বসালো। প্রেস ঘুরতে শুরু করল, এক ছন্দে, এক অদ্ভুত তালে—প্রায় যেন মন্ত্রোচ্চারণ। চারপাশের তান্ত্রিকরাও একসাথে উচ্চারণ করতে লাগল সেই মন্ত্র, বাতাস ভারী হয়ে উঠল। আগুনের রং পাল্টে গিয়ে হালকা বেগুনি, তারপর ধূসর।
ঠিক সেই মুহূর্তে আগুনের মধ্য থেকে এক ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এল—ঝাঁকড়া চুল, পোড়া জামা-কাপড়, চোখে গভীর ক্লান্তি—ভূপেন পাল। সে তাকাল শৌভিকের দিকে, কাঁপা গলায় বলল, “তুই… শেষ করলি… আমি বাঁচলাম।”
শৌভিক সামনে এগিয়ে গিয়ে বলল, “আমি চাইনি তুমি বন্দি থাকো। আমি চাই কেউ মুক্তি পাক এই অভিশপ্ত চক্র থেকে।”
ভূপেন মৃদু হেসে আগুনের দিকে তাকাল, ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে লাগল ধোঁয়ার সঙ্গে। আর তখনই, শ্মশানের বাতাসে উঠে এল হঠাৎ এক ঝাপটা, এক কর্কশ শব্দ, যেন চুক্তি ছিঁড়ে যাওয়ার আওয়াজ।
ত্রিপুরা বললেন, “এবার আত্মা মুক্ত। কিন্তু তুমি?”
শৌভিক নিচে তাকাল—তার নিজের হাতে সেই পাতার নিচে রক্ত ছড়িয়ে অদ্ভুত লিপি ফুটে উঠেছে—“পরবর্তী অভিভাবক: শৌভিক দত্ত।”
৮
ভোরের আলো পড়ে অনন্তপুরের ধ্বংসাবশেষে। শৌভিক একা দাঁড়িয়ে, আগুন নিভে গেছে, ত্রিপুরা সাধ্বী এবং তার সঙ্গীরা অদৃশ্য, যেন তারা কোনওদিন আসেনি। মাঠে পড়ে আছে ছাপা কাগজের শেষ পৃষ্ঠা—রক্ত আর কালি মিশ্রিত সেই চুক্তি, যাতে লেখা: “পরবর্তী অভিভাবক: শৌভিক দত্ত”। বাতাসে এক অদ্ভুত ভারী নিরবতা, যেন প্রকৃতিও কিছু বোঝার চেষ্টা করছে। শৌভিক কাগজটা হাতে তুলে নেয়, দেখে তার নাম আরেকবার ঝকঝক করছে, যেন তাজা ছাপা হয়েছে মাত্র। সে বুঝতে পারে—এখন সে শুধু এক ছাপাখানার মালিক নয়, সে এক মুদ্রিত চুক্তির রক্ষক।
ফিরে আসার সময় শহরটাকে যেন নতুন লাগে। ট্রাম চলছে, রিকশা চলছে, কিন্তু যেন সব কিছু দূরত্বে। নিজের ঘরে ঢুকেই সে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। নিজের চোখে দেখে চেনা মুখ, কিন্তু তার চোখের গভীরে এসেছে অন্য এক ছায়া—অতীতের। প্রেসে গিয়ে সে দেখে মিহির ঠিকই ফিরে এসেছে, ভয়ে কাঁপছে, কিন্তু মুখে দৃঢ়তা। সে বলল, “আমি কোথাও যাব না, বাবু। এই প্রেস এখন বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আপনি একা নন।”
শৌভিক মৃদু হেসে বলে, “বাঁচাতে নয়, বুঝতে হবে—এর কাজ কী।” তারপর সে প্রেসের নীচের খোপ খুলে, যেখানে তার দাদু একবার বলেছিলেন কিছুই রাখা যাবে না। সেখানে সে খুঁজে পেল একটা ছোট কাঁচের বাক্স—ভেতরে পুরনো ছাপা পাণ্ডুলিপি। হস্তলিপিতে লেখা, “মুদ্রিত চুক্তির শেষ ব্যাখ্যা”।
সেই পাণ্ডুলিপিতে লেখা,
“যিনি চুক্তির শেষ পৃষ্ঠায় নাম লেখান, তিনি ভবিষ্যতের আত্মাদের পথ দেখান। প্রেতযজ্ঞ চলবে না আর, তবে স্মৃতি থাকবে। প্রেস তাকে অস্বীকার করতে পারবে না, সে নিজের ছায়া হতে বেরোতে পারবে না। তবে সে চাইলে, ভবিষ্যতের জন্য লিখে যেতে পারবে ‘অন্য’ নিমন্ত্রণ।”
শৌভিক বুঝল, তার সামনে দু’টি রাস্তা—এক, প্রেসকে রেখে দেওয়া যেমন চলছে, অন্ধকার পথে আত্মা বাঁধা; অথবা দুই, প্রেসকে রক্ষা করে, তা দিয়ে নতুন কিছু লেখা—যা ভয় নয়, মুক্তি দেয়।
সে চুপচাপ পাণ্ডুলিপি গুটিয়ে রাখে, তারপর প্রেসে গিয়ে নতুন এক ছাঁদ তৈরি করে। ছাঁদে লেখা:
“এই প্রেস অভিশপ্ত নয়, স্মরণচিহ্ন। আত্মারা এখানেই কথা বলে। তবে এইবার তারা ভয় দেখাবে না, মুক্তি দেবে।”
সেদিন বিকেলে, প্রেসের দরজা খুলে সে ঘোষণা করল—এবার থেকে এটি “মুক্তমুদ্রা প্রেস”, যেখানে শুধু লেখা হবে হারিয়ে যাওয়া কাহিনি, মুক্তির ইতিহাস, এবং আত্মাদের স্বর। আর কেউ প্রেতযজ্ঞে নিমন্ত্রণ পাবে না—এইবার তাদের ডাকা হবে আলোতে।
কিন্তু, ঠিক শেষ রাতে, যখন সে প্রেস বন্ধ করে ঘুমাতে যাবে, দেখে কাগজে ছাপা হচ্ছে নতুন এক বাক্য—
“তুমি আমাদের রক্ষা করলে। আমরাও তোমার পাশে থাকব… তবে মনে রেখো, চুক্তির শেষ পৃষ্ঠারও এক শেষ আছে।”
—




