অমিতাভ বসু
পর্ব ১: জলের ওপারে শব্দ
১৮৯৭ সালের জানুয়ারি মাস। আন্দামানের বাতাসে তখনও রৌদ্রের ছায়া। দূর থেকে দেখা যায় সেলুলার জেলের লোহা-দেওয়া গঠন, যেটা যেন কোনো বিশাল মাছের কঙ্কালের মতো পড়ে আছে দ্বীপের বুক চিরে। লম্বা বারান্দা, ভয়ানক নির্জনতা, আর তিনতলার ফাঁসির মঞ্চ—সব মিলিয়ে এটি ছিল ব্রিটিশ শাসনের এক ঠান্ডা নরক।
এই সেলুলার জেলেই এসে পৌঁছেছিল এক কবি—নাম হেমচন্দ্র সেন। কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজে সাহিত্য পড়াতেন, বিপ্লবী ভাবনার জন্যে যুবকদের মধ্যে ছিলেন খুবই জনপ্রিয়। তবে তাঁর বিপ্লবের অস্ত্র ছিল আগুন নয়—কবিতা। তাঁর লেখা ‘রক্তঝরা বসন্ত’ কবিতা ব্রিটিশদের চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়ায়, কারণ তিনি তাতে এক বদ্ধঘরের ছাদ ভেদ করে বেরিয়ে আসতে চাওয়া যুবকের বর্ণনা দিয়েছিলেন—যার মধ্যে দেশবন্দিদের রূপ খুঁজে পেয়েছিল জনতা। হেমচন্দ্র গ্রেপ্তার হন, দেশদ্রোহিতার অভিযোগে বিচারে নির্বাসন হয় কালাপানিতে।
তিনি এসেছিলেন মলিন ধুতি, খালি গা, গালে কাঁচা দাড়ি আর চোখে এক আশ্চর্য শান্তি নিয়ে। অথচ সেই শান্তি ছিল গভীর ক্ষোভের ওপর চাপা পড়া। জেলকর্মী নৃপতি দাস, যিনি সদ্য নিয়োগ পেয়েছেন সেলুলার জেলে, প্রথম দিনেই লক্ষ করেছিলেন, অন্য বন্দিদের মতো এই মানুষটি চিৎকার করেন না, কাঁদেন না, এমনকি অভিশাপও দেন না। তিনি নির্জনে বসে থাকেন আর অনবরত কিছুকে মনে মনে আওড়ান।
দুই সপ্তাহ পর হেমচন্দ্র বন্দি নম্বর পঁচানব্বই হন। তাঁর কুঠুরিটা ছিল দক্ষিণ ব্লকের দ্বিতীয় তলায়, জানালাহীন। তবু সেই অন্ধকার ঘরে, তিনি যেন অন্য আলো জ্বালিয়ে রেখেছিলেন। প্রতিদিন শ্রম শেষে তিনি ফিরে এসে কাঠের দেওয়ালে পাথরের টুকরো দিয়ে কিছু লেখেন, যা রাতে এসে পড়ে যেত জেল পরিষ্কার করতে আসা নৃপতির চোখে। নৃপতি পড়তে জানতেন না ভালোভাবে, কিন্তু কিছু শব্দ তাঁর বুক কাঁপিয়ে দিত—‘নীরবতার শঙ্খ’, ‘বাঁধা প্রজাপতির পাখা’, ‘জলের মতো স্বাধীনতা’।
নৃপতি আস্তে আস্তে বুঝতে শিখল—এই লেখাগুলি কবিতা, আর তার ভিতরে আছে এক বিপ্লব। সে একদিন সাহস করে বলল, “বাবু, আপনি কী লিখেন?” হেমচন্দ্র তাকিয়ে বললেন, “আমি সময়ের রক্তে লেখা রাখি। হয়তো একদিন কেউ পড়বে।”
তারপর নৃপতি দিনে দিনে সাহসী হয়ে উঠল। সে প্রতিদিন রাতে দেওয়ালে লেখা কবিতাগুলি কাগজে তুলে রাখে। কাগজ না থাকলে পুরনো বস্তার টুকরোয়। কালি না পেলে কাঠকয়লা, মাটি, এমনকি রক্ত দিয়েও লিখে রাখে সে। এই কাজ তার নিজের কাছেই একধরনের পাপ বলে মনে হত, আবার মনে হত এই লোকটা যতটা মুখে চুপ, ততটাই শব্দে বিপ্লবী। সে জানত না একশো বছর পর এই কবিতাগুলিই হবে ইতিহাসের নীরব দলিল।
হেমচন্দ্রের দিন কাটত মাটি কোপাতে কোপাতে, নারকেল গাছ কেটে, পাথর ভাঙতে ভাঙতে। কিন্তু সন্ধের পর, কুঠুরির দেয়ালে শুরু হত তাঁর আসল কাজ—কবিতা লেখা। তিনি লিখতেন না স্বাধীনতার আহ্বান নিয়ে, বরং লিখতেন একজন মানুষের ভিতরে যে ছটফটানি, তা নিয়ে। তাঁর ভাষা ছিল নদীর মতো—শান্ত, অথচ গভীরভাবে প্রবাহমান।
একদিন হেমচন্দ্র অসুস্থ হয়ে পড়েন। জ্বর, খিদে না পাওয়া, আর দুর্বলতা। চিকিৎসা বলতে ছিল একখানা কম্বল, আর নুনজল। নৃপতি রাতে এসে চুপি চুপি একমুঠো ভাত দিয়ে গেল। হেমচন্দ্র সেই রাতে কোন কবিতা লেখেননি। নৃপতি ভাবল, বুঝি শেষ হল তাঁর লেখা। পরদিন সকালে সে দেখতে পেল, দেওয়ালে লেখা একটা বাক্য—”যদি আমায় না পাও, তবে শব্দে খুঁজে নিও।”
এই কথাটা যেন সরাসরি নৃপতির হৃদয়ে ঢুকে গেল। সে সেই রাতেই ঠিক করল, যতদিন বাঁচবে, এই কবিতাগুলি সে লুকিয়ে রেখে যাবে। জেলের বাইরে কেউ জানে না এই লেখা আছে, এমনকি বন্দিরাও না। সে তৈরি করল এক গোপন বাক্স, সেখানে গুঁজে রাখল সেইসব কাগজের টুকরো। মাঝে মাঝে কবিতাগুলির ভাষা বোঝার জন্য সে পুরনো বন্দিদের কাছে বাংলা শিখত।
এরই মধ্যে হেমচন্দ্র আরও অসুস্থ হয়ে পড়লেন। একরাতে তিনি জ্ঞান হারান। তাঁর শেষ কবিতা ছিল:
“আমি আলো খুঁজি অন্ধকারের গর্ভে,
জলের নিচে জ্বলন্ত এক রাত্রির মতো।
স্বাধীনতা কোনো রং নয়—
এ এক রক্তমাখা নির্জনতা।”
তারপর আর কিছু লেখেননি। তিন দিন পর হেমচন্দ্র মারা যান। মৃত্যুর পর তাঁর দেহ সাগরের ধারে কবর দেওয়া হয়। কেউ জানত না, তিনি কে ছিলেন, কী লিখতেন। শুধু নৃপতি জানত।
বছর কুড়ি পর, ভারত স্বাধীন হল। সেলুলার জেল একদিন জাদুঘরে পরিণত হল। কিন্তু সেই বাক্সটি রয়ে গেল মাটির নিচে, জেলের পুরনো গোডাউনের এক কোণে, ঘাসে ঢাকা।
অনেক অনেক বছর পর, ২০১৫ সালে, ইতিহাসের এক তরুণ গবেষক ঐশিকী চক্রবর্তী আন্দামানে গবেষণায় এসে এক অদ্ভুত কাগজের স্তূপ খুঁজে পান। ধুলো মোছার পরে দেখা গেল, সেখানে লেখা আছে—
‘কালাপানির কাব্য’ — হেমচন্দ্র সেন।
পর্ব ২: বাক্সের ভেতর কাঁপে কাব্য
২০১৫ সালের একটি ভেজা দুপুর। আন্দামানের হাড়গিলা বাতাসে অদ্ভুত গন্ধ ছিল—নোনা জল আর স্মৃতির সংমিশ্রণ। ঐশিকী চক্রবর্তী তখন পোর্ট ব্লেয়ারে সদ্য গিয়েছেন গবেষণা করতে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে তিনি একটি বিশেষ প্রকল্পে এসেছেন—ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে লেখালেখির ভূমিকা: জেলজীবনের দলিল।
ঐশিকী ছোটবেলা থেকেই আন্দামান ও কালাপানি নিয়ে মুগ্ধ। “সেলুলার জেল” মানেই তার চোখে ছিল যেন কালো-সাদা ছবি, ভাঙা দরজা, রক্তমাখা ইতিহাস। কিন্তু গবেষণার কাজ কেবল আবেগ দিয়ে চলে না—তাকে খুঁটিয়ে খুঁজতে হয় ছোট কাগজ, চিঠি, দলিল, অনুদ্ঘাটিত নথি। সেলুলার জেলের সংরক্ষিত আর্কাইভে কাজ করতে করতে হঠাৎই চোখে পড়ে এক ধুলোধূসরিত কাঠের বাক্স। সেটা রাখা ছিল পুরনো গোডাউনের এক কোণে, যেখানে সাধারণত কর্মচারীরাও যায় না।
বাক্সটা ছোট, তালা ঝুলছে না, কিন্তু খোলার পরেই যেন সময় আটকে গেল। ভিতরে সযত্নে রাখা বহু পুরনো কাগজ—কিছু নষ্ট হয়ে যাওয়া, কিছু আধা-পোড়া। তাতে লেখা অদ্ভুত শব্দ—নীরবতা, আগুন, জেলখানা, প্রেম, প্রতিবাদ। সব লেখা হাতের লেখা, প্রাচীন বাংলা, কোথাও কোথাও রক্তের মতো কালি ছোপ ছোপ। প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা—
“কালাপানির কাব্য”
— বন্দি নং ৯৫
হেমচন্দ্র সেন
ঐশিকীর হৃদয় কেঁপে উঠল। হেমচন্দ্র সেন—এই নাম তিনি শুনেছিলেন একবার কলেজের একটি ভাষণপ্রতিযোগিতায়, খুব অস্পষ্টভাবে। কোনো উল্লেখযোগ্য ইতিহাসের বইতে তাঁর নাম নেই। কিন্তু বাক্সের ভিতর লেখা কবিতাগুলি এমনভাবে শব্দে জ্বলছিল যে মনে হচ্ছিল এগুলো কেউ আজও লিখে যেতে পারত।
তিনি শুরু করলেন প্রতিটি কবিতা পড়ে পড়ে লিখে নেওয়া, স্ক্যান করে রাখার কাজ। কিন্তু সমস্যা হল, কিছু কবিতা ছিল অসম্পূর্ণ, কিছুটা ঘোলা, কিছু পুরনো বস্তার টুকরোয় লেখা। ঐশিকী বুঝলেন, এগুলো কেবল কবিতা নয়—এই একেকটি পঙ্ক্তির ভিতর একেকটা যুগ চাপা পড়ে আছে। যেমন একটি কবিতায় লেখা ছিল:
“আমার শরীর এক বন্দি সমুদ্র,
তবু আমার স্বপ্ন সাঁতার কাটে জোয়ারে।“
ঐশিকীর কৌতূহল তখন ইতিহাসের বাইরে চলে গেল। তিনি যেন পড়ছিলেন একজন বন্দি কবির ডায়েরি—যিনি জানতেন না কবে মরে যাবেন, তবু জানতেন তাঁর কবিতা বেঁচে থাকবে। তিনি সেদিন রাতেই ফোন করলেন কলকাতার বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক অরিন্দম মুখার্জিকে।
“স্যার, আমি হয়তো একটা অবিশ্বাস্য জিনিস পেয়েছি। আপনি শুনেছেন হেমচন্দ্র সেন নামক কারো কথা?”
অরিন্দমবাবু একটু চুপ করে বললেন, “বাঁকুড়া জেলার এক শিক্ষক, যিনি দেশদ্রোহিতার দায়ে কালাপানিতে পাঠানো হয়েছিলেন। তাঁর লেখা কিছু কবিতা নিয়ে একটা লোককথা শুনেছিলাম। কেউ বলেছিল, সেগুলো আর নেই—সব পুড়ে গেছে বা চুরি হয়েছে।”
ঐশিকী উত্তেজিত হয়ে বললেন, “আমি তার কবিতা পেয়েছি, স্যার। অনেকগুলো। মনে হচ্ছে, কোনো এক জেল কর্মচারী এগুলো লুকিয়ে রেখেছিল। আপনি কি এখানে এসে আমাকে সাহায্য করতে পারবেন?”
কয়েক দিনের মধ্যেই অধ্যাপক অরিন্দম পোর্ট ব্লেয়ার পৌঁছান। তিনি কবিতাগুলোর গভীরতা দেখে বিমুগ্ধ হয়ে পড়েন। কিছু কবিতা ঐশিকী পড়ে শোনালে তিনি স্তব্ধ হয়ে যান। একটি কবিতার পংক্তি ছিল—
“তুমি যদি জেলখানার দেয়াল হতে,
আমি হতাম চাঁদের আলো—
যে দেয়ালের গায়ে পড়ে থাকে
শুধু নিঃশব্দে।“
এই কবিতা ছিল এমন এক ভালোবাসার কথা, যা কারাগারের মধ্যে থেকেও মুক্তির স্বপ্ন দেখে। অরিন্দম বললেন, “এ এক নতুন কাব্যধারা—কারাবাসের রোমান্টিসিজম। এটা বাংলার কবিতায় ছিল না। এগুলো শুধু সাহিত্য নয়, ইতিহাসের মৌখিক সাক্ষ্য।”
ঐশিকী তখন সিদ্ধান্ত নেন—এই কবিতাগুলি একটি গবেষণাগ্রন্থে রূপান্তর করবেন, যার নামই হবে “কালাপানির কাব্য”। তিনি অনুমতি চেয়ে পোর্ট ব্লেয়ারের আর্কাইভ থেকে সেই কাগজগুলি ডিজিটাল রূপে সংরক্ষণের অনুমতি নেন।
কিন্তু একটি বিষয় তখনও অজানা ছিল—এই কবিতাগুলি কার সংরক্ষিত করা? কে রেখেছিল এমন ঝুঁকি নিয়ে? একদিন পুরনো রেজিস্টারে চোখ পড়ে একটি নামে—নৃপতি দাস, সেলুলার জেলের কনস্টেবল, ১৮৯৬–১৯২০ সাল পর্যন্ত কর্মরত। ঐশিকী বুঝতে পারেন, এই মানুষটি হয়তো কবির নিঃশব্দ উত্তরাধিকার। তখন তাঁর সামনে দাঁড়ায় আরও বড় প্রশ্ন—নৃপতি নিজে কেন এই কবিতাগুলি সংরক্ষণ করলেন? তিনি কি বুঝতেন এর গভীরতা, না কি নিছক মানবিকতা থেকেই তিনি এ কাজ করেছিলেন?
ঐশিকী ঠিক করেন—এই ইতিহাস কেবল লেখা নয়, বোঝাও জরুরি। তিনি যাবেন নৃপতির গ্রামের খোঁজে। তিনি খুঁজে পান সরকারি নথিতে—বসিরহাটের নিকটে খাসবাটি গ্রামে নৃপতির স্থায়ী ঠিকানা। পরবর্তী গন্তব্য স্থির হয়—পশ্চিমবঙ্গ।
আর আন্দামানের দ্বীপ তখন রাতের অন্ধকারে ঘুমোচ্ছিল। কিন্তু ঐশিকীর চোখে চোখে জ্বলছিল কবিতার আঁচ। সেলুলার জেলের মৃত দেয়ালের গায়ে যেন ছায়া পড়ছিল এক কবির, আর এক কর্মচারীর, যাঁরা ইতিহাসের দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে গড়ে তুলেছিলেন এক অনন্য কাব্য-বন্ধন।
পর্ব ৩: খাসবাটির ছায়ায়
খাসবাটি—বসিরহাটের সীমান্ত ঘেঁষা এক ছোট গ্রাম। বর্ষার শেষে কাঁচা রাস্তার কাদায় ভেসে যাওয়া একটা নামমাত্র পথ, দুপাশে শাল-গাছ আর বেতের ঝোপ। ঐশিকী চক্রবর্তী যখন সেখানে পৌঁছান, তখন বিকেলের আকাশে জল-জমা রোদ। গ্রামের মানুষ খুব বেশি জানে না ইতিহাস, জানে ধান-পাট, চাষাবাদ আর নদীর চর বদলের গল্প।
গ্রামে ঢোকার মুখেই একটি প্রাচীন কুঁড়েঘর দেখা গেল। মাটির দেওয়াল, খড়ের ছাউনি। পাশেই একটি আধা-ভাঙা পোড়ামাটির পিলার, যাতে লেখা ‘নৃপতি দাস স্মৃতি মঞ্চ’। ঐশিকীর গাইড হালকা হেসে বললেন, “এই মঞ্চ নাকি এক সময় নৃপতি দাসের নাতি বানিয়েছিলেন, কিন্তু কেউ ব্যবহার করে না। সবাই বলে ও তো ছিল শুধু এক পিওন—কিসের স্মৃতি?”
ঐশিকী এগিয়ে যান। ঘরের পাশে একটি বৃদ্ধ বসে ছিলেন কাঠের পিঁড়িতে, হাতে বাঁশি। তাঁর গায়ে ছেঁড়া লুঙ্গি, পাকা দাড়িতে খসখসে বাতাস। ঐশিকী নম্রভাবে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি নৃপতি দাসের পরিবারের কেউ?”
বৃদ্ধ মাথা তুললেন। চোখ দুটো ঝাপসা হলেও গভীর। “আমি ওনার পৌত্র। নাম রণজিৎ দাস। কিন্তু দাদুর কথা তেমন কেউ এখন মনে রাখে না। শুনেছি উনি নাকি আন্দামানে কাজ করতেন, জেলখানায়। তারপর আর কোনো খবর পাইনি।”
ঐশিকীর বুক কেঁপে উঠল। তিনি বললেন, “আপনার দাদু ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যাওয়া এক অমূল্য মানুষ। আমি তাঁকে খুঁজতে এসেছি। ওঁর সংরক্ষিত কিছু কবিতা আমি পেয়েছি—যেগুলো কালাপানি থেকে লুকিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন।”
রণজিত হঠাৎ চুপ করে গেলেন। তারপর ধীরে ধীরে উঠে ঘরের ভিতরে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এলেন একটি ছোট কাঠের বাক্স হাতে নিয়ে। তার ভিতরে ছিল কিছু মলিন কাগজ, একটা পুরনো কলম, আর একটি ছোট্ট ছবি—ধূসর মুখ, ধুতির কোচড়ে প্যাড বাঁধা, মুখে মৃদু হাসি।
“এই ছবি একবার আমাদের বাড়ির একজন পন্ডিত তুলেছিলেন,” বললেন রণজিৎ, “দাদু কবিতা পড়তেন না, কিন্তু একটা কথা সবসময় বলতেন—‘জেলে এক কবির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, তিনি বেঁচে থাকবেন শব্দের ভিতরে।’ তখন বুঝিনি, আপনি বলার পর মনে পড়ছে।”
ঐশিকী বাক্সটা হাতে নিয়ে চোখ বুজলেন। যেন সময় থেমে দাঁড়িয়েছে। এই পরিবার, এই ঘর, এই গাঁয়ের মাটির মধ্যেই লুকিয়ে ছিল ইতিহাসের গোপনতম কবিতা।
তিনি রণজিৎবাবুকে অনুরোধ করলেন, বাক্সটির ছবি ও তথ্য গবেষণার কাজে ব্যবহার করতে। রণজিৎ সম্মতি দিলেন, বললেন, “আপনি যদি সত্যিই এই গল্প বলার মানুষ হন, তবে আপনি-ই দাদুর উত্তরসূরি।”
ঐশিকী ফিরে এলেন কলকাতায়, মনের ভিতর এক ঝড় নিয়ে। হেমচন্দ্র সেন এখন কেবল কবি নন—তিনি ইতিহাসের এক অন্ধকার পর্বের কণ্ঠস্বর। তাঁর কবিতা কেবল স্বাধীনতার নয়, কারাগারের মধ্যেও কবিতা লিখে যাওয়া মানুষের সাহসের দলিল।
তিনি কাজ শুরু করলেন গবেষণাপত্র তৈরির। সেই সঙ্গে বাংলা একাডেমি ও কয়েকটি প্রকাশনীর সঙ্গে কথা বললেন সংকলন প্রকাশের জন্য। কিন্তু এই সময়েই শুরু হল সমস্যা।
একটি ব্রিটিশ গবেষকদলের পক্ষ থেকে অভিযোগ এল—এই কবিতাগুলি জাল, “বসন্ত শত্রুতা” বা “নীরবতার শঙ্খ” নামে কোনো কবিতা আগে কখনো প্রকাশিত হয়নি, সুতরাং এগুলিকে ঐতিহাসিক দাবি করা যায় না। কিছু সংবাদপত্রে লেখা হল, “একটি আবেগনির্ভর আবিষ্কার—তথ্যহীন কাব্যদলিল।”
ঐশিকী তখন চুপ করলেন না। তিনি প্রকাশ করলেন একটি কবিতা, যা তিনি সম্পূর্ণ হস্তলিপি ও রক্তমাখা কালি সহ একটি ভিডিওতে তুলে ধরলেন। তার প্রথম দুটি পংক্তি ছিল—
“আমি রক্তে লিখি ইতিহাসের নাম,
যা মুছে ফেলে সময়ের শাসন।“
সেই ভিডিও ভাইরাল হয়ে যায়। বহু লেখক, কবি, শিক্ষক ঐশিকীর পাশে দাঁড়ান। বাংলা সাহিত্যজগৎ নাড়া খেয়ে যায়—“এই কি সেই হারানো কণ্ঠস্বর, যার খোঁজ আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম?”
কিন্তু ঐশিকীর মনে তখনও একটি প্রশ্ন জ্বলে—হেমচন্দ্র সেনের মৃত্যুর সময় শেষ কবিতাটি তিনি লিখেছিলেন “যদি আমায় না পাও, তবে শব্দে খুঁজে নিও।”
তবে কি আর কোথাও লুকিয়ে আছে আরও কবিতা? আরও কোনো চিহ্ন?
পর্ব ৪: শব্দের কবরস্থান
আলোর নিচে সবচেয়ে বড় ছায়া পড়ে—ঐশিকী এই কথাটা হেমচন্দ্র সেনের কবিতায় পড়ে ছিল একটা পাতলা কাগজে। কিন্তু বাস্তবে সে যেন তা উপলব্ধি করছিল আজকাল বারবার। যখন কবিতাগুলো তাকে বিখ্যাত করতে শুরু করল, তখনই তাকে আক্রমণ করতে লাগল একদল মানুষ যারা বিশ্বাস করত না, কবিতা যে জেলের দেওয়ালে জন্মায়, তা হতে পারে না। তাদের যুক্তি ছিল, বিপ্লব মানে বন্দুক, গোপন বার্তা, গুপ্তচর। কবিতা তো বিলাসিতা। তখন ঐশিকী বুঝেছিল—এই সমাজে শব্দই আসলে সবচেয়ে বিপজ্জনক অস্ত্র।
কিন্তু তাঁর গবেষণার কাছে এসব সমালোচনা ক্ষুদ্র মনে হচ্ছিল। তিনি এখন প্রতিটি কবিতাকে সংরক্ষণের পাশাপাশি তার ব্যাকরণ, উপমা, রূপক ও কাব্যগত গঠন বিশ্লেষণ করছিলেন। হেমচন্দ্র সেন কেবল দেশপ্রেমিক নন—তিনি ছিলেন একজন কাব্যদর্শনের নির্মাতা। তাঁর কবিতাগুলিতে বারবার ফিরে আসছিল কিছু বিশেষ প্রতীক—দেয়াল, জেলখানা, জ্যোৎস্না, জল। তিনি জলকে স্বাধীনতার প্রতীক করতেন, আর দেয়ালকে আত্মার কারাগার।
এইসব কাব্যিক ভাবনার মাঝে ঐশিকীর মনে একটা প্রশ্ন তীব্র হয়ে উঠছিল—কেন তিনি শেষ কবিতায় লিখলেন, “যদি আমায় না পাও, তবে শব্দে খুঁজে নিও”? এর মানে কি শুধু কাব্যিক ইঙ্গিত, না কি তাঁর রেখে যাওয়া কাব্যভাণ্ডার এখনও অসম্পূর্ণ?
একদিন গভীর রাতে, যখন সে হেমচন্দ্রের একটি কবিতার হস্তলিপি পরীক্ষা করছিল, একটি লাইন তার চোখে ধরা পড়ল—
“যেখানে জলের ভিতরে অক্ষর তলিয়ে যায়,
সেখানে লুকিয়ে আছে আমার শেষ নাম।“
এই পংক্তি যেন বার্তা বহন করছিল। ঐশিকীর মনে পড়ল, অরিন্দম স্যার বলেছিলেন একবার—সেলুলার জেলের দক্ষিণ ব্লকে ছিল একটি পুরনো কুয়া, যেখানে বন্দিরা জল আনত। সেটা অনেক পরে বন্ধ হয়ে যায়, কারণ তার তলদেশে একবার একটি বন্দির দেহ পাওয়া যায়। কুয়াটি আজও আছে, কিন্তু আবর্জনা আর ঘাসে ঢেকে গিয়েছে।
পরদিন ভোরেই ঐশিকী পোর্ট ব্লেয়ারে ফিরে এলেন। জেলের পুরনো মানচিত্র ঘেঁটে খুঁজে বের করলেন সেই কুয়ার অবস্থান। তিনি এবং স্থানীয় এক সাফাইকর্মী সহ কুয়াটির আশেপাশে মাটি খুঁড়তে শুরু করলেন। অনেকক্ষণ খোঁড়ার পর বের হল একটি পাথরের বাক্স, যার গায়ে লেখা ছিল—
“অক্ষরের কবরস্থানে যারা প্রবেশ করে,
তাদের হৃদয়কে প্রস্তুত রাখো।
— হেমচন্দ্র সেন”
ঐশিকীর হাত তখন কাঁপছিল। তিনি বাক্সটা সাবধানে খুললেন। ভিতরে পাওয়া গেল একটি পুঁথি—ছোট ছোট কাগজ একত্রে গাঁথা, বাঁধা ছিল নারকেল দড়ির মাধ্যমে। কাগজগুলি ছিল আর্দ্র, কিছু ছেঁড়া, কিছু গলে যাওয়া, তবু বেশির ভাগ লেখা এখনো স্পষ্ট। এই ছিল শেষ কাব্য—হেমচন্দ্র সেনের জীবনের শেষ লেখা।
প্রথম পাতায় লেখা—
“কালাপানির অন্তর্গত কবিতা”
— ‘জলের শব’
এই কাব্যটি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। আগের কবিতাগুলোতে যেমন জেলখানার বাস্তবতা আর আত্মার ছটফটানি ছিল, এই কবিতাগুলিতে ছিল মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একজন মানুষের একান্ত নিঃসঙ্গ চিৎকার। যেন তিনি জানতেন তাঁর মৃত্যু আসছে, আর শব্দই একমাত্র জায়গা যেখানে তিনি নিজেকে অমর করতে পারবেন।
একটি কবিতা ছিল এমন:
“আমার দেহ যাবে না কোথাও,
সে মিশে যাবে এ দ্বীপের পাথরে।
কিন্তু আমার নিঃশ্বাস থাকবে
তোমার পড়া প্রতিটি শব্দের ভিতরে।“
ঐশিকী জানতেন, এ আবিষ্কার আর শুধু গবেষণার বিষয় নয়—এ ইতিহাসের এক নয়া অধ্যায়। তিনি বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করলেন ভারতের ন্যাশনাল আর্কাইভস, ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ হিস্টোরিকাল রিসার্চ এবং বাংলা একাডেমির সঙ্গে। একটি বিশেষ প্রেস কনফারেন্সে তিনি প্রথমবার সর্বসমক্ষে ঘোষণা করলেন—
“আজ আমরা যে স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলি, তা কেবল বোমা আর রক্ত নয়—এ শব্দের যুদ্ধও। হেমচন্দ্র সেন সেই যুদ্ধে একাকী লড়েছিলেন, এক ফোঁটা কালিতে হাজার ফোঁটা রক্ত ঢেলে।”
সংবাদপত্র, টেলিভিশন, অনলাইন পোর্টাল—সব জায়গায় হৈচৈ পড়ে গেল। কেউ বলল—“ঐশিকী চক্রবর্তী আমাদের জাতির কাব্যিক নায়ককে ফিরিয়ে এনেছেন।” কেউ আবার সন্দেহ প্রকাশ করল—“এতদিন পরে এসব বের হওয়া কি নিছক কাকতালীয়?”
তবে মানুষের মন শব্দে মোহিত হয়, সন্দেহে নয়। কলকাতার কলেজ স্ট্রিট থেকে শুরু করে আন্দামানের গ্রীষ্মে ঝলসানো বইয়ের দোকান পর্যন্ত, ছড়িয়ে পড়ল হেমচন্দ্র সেনের নাম।
তাঁর কবিতাগুলি নতুন করে ছাপা হল—“কালাপানির কাব্য” নামে। বইয়ের ভূমিকায় ঐশিকী লিখলেন—
“যাঁরা ইতিহাস লেখেন, তাঁরা প্রায়শই ভুলে যান নিঃশব্দ কবিদের কথা। হেমচন্দ্র সেন ছিলেন এমনই এক কবি—যাঁর শব্দ ছিল তাঁর প্রতিবাদ, যাঁর কবিতা ছিল তাঁর অস্তিত্ব।”
পাঠকরা বই পড়ে বলল—এই কবিতা শুধু অতীত নয়, আজকের দিনেও প্রযোজ্য। একজন তরুণ লেখক লিখলেন, “আমি এই কবিতাগুলি পড়ে প্রথমবার বুঝলাম, কীভাবে একটি জাতি কাঁদে, রাগে, আবার ভালোবাসে—একই সঙ্গে।”
এদিকে ঐশিকীর জীবনেও পরিবর্তন এল। তিনি ডাক পেলেন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে—এই কাব্য নিয়ে আলোচনা করার জন্য। তাঁর গবেষণাকে কেন্দ্র করে একটি তথ্যচিত্রও নির্মিত হতে চলল—“শব্দের নির্বাসন” নামে।
তবে ঐশিকী জানতেন, এই সব সাফল্যের নিচে লুকিয়ে আছে একজন নির্জন কবির আত্মা। তিনি জানতেন—হেমচন্দ্র সেন চাইতেন না কেবল বাহবা, তিনি চাইতেন তাঁর কবিতা পড়ে কেউ সত্যি কিছু অনুভব করুক।
আর তাই ঐশিকী একদিন একা গিয়ে দাঁড়ালেন সেলুলার জেলের সেই কুঠুরির সামনে—দক্ষিণ ব্লকের দ্বিতীয় তলা, যার ভিতর বন্দি নং ৯৫ বাস করতেন। তিনি কুঠুরির দরজায় হাত রেখে চোখ বুজলেন।
“আপনাকে আমি খুঁজে পেয়েছি শব্দে।
আর এখন আপনার নিঃশ্বাসও বাতাসে ভেসে আছে।”
পর্ব ৫: নির্বাসিতের আত্মজীবনী
জীবনের পরতে পরতে হেমচন্দ্র সেনের কবিতা ছড়িয়ে পড়েছিল—একেকটি শব্দ যেন একেকটি শিকল, যা তাঁকে বেঁধে রেখেছিল অথচ মুক্তিও দিয়েছিল। ঐশিকী যখন সেলুলার জেলের সেই নির্জন কুঠুরির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তখন তাঁর মনে হল, সময় যেন একসাথে থেমে গেছে আর বয়ে যাচ্ছে। দেয়ালের ফাটল, মেঝের ধুলো, আর বাতাসে জমে থাকা ঘামে-কাদা-আঘাতের গন্ধ—সব মিলিয়ে হঠাৎ যেন একটা নতুন গল্প শোনা যাচ্ছিল। এক নিষিদ্ধ আত্মজীবনী, যাকে কেউ লিখতে দেয়নি, তবু সে নিজেই শব্দের ভিতর বেঁচে ছিল।
ঐশিকী জেলের ইনচার্জের সঙ্গে কথা বলে বিশেষ অনুমতি নিলেন—এক রাতের জন্য ওই কুঠুরির ভিতর থাকার। গবেষণার স্বার্থে। তাঁর ইচ্ছা ছিল, যেখান থেকে কবিতাগুলি জন্মেছিল, সেখানে বসে কিছুক্ষণ নীরবে থাকা। যেন সেই সময়ের সাথে একটা সংলাপ গড়ে ওঠে।
রাতের আন্দামান নিঃস্তব্ধ। বাহিরের বাতাসে কেবল শোনা যাচ্ছিল ঝিঁঝিঁ পোকার সুর, আর মাঝেমধ্যে সাগরের হালকা গর্জন। ঐশিকী মোমবাতি জ্বালিয়ে কুঠুরির ভিতর বসলেন। দেওয়ালের দিকে তাকালেন—যেখানে একদিন হেমচন্দ্র লিখতেন চুনকাম দেওয়ালে পাথর দিয়ে। আজ সেই লেখাগুলি মুছে গেছে, তবু যেন ছায়ার মতো তারা থেকে গেছে। হঠাৎ মোমবাতির আলোয় দেওয়ালের একটা বিশেষ অংশে চোখ আটকে গেল। পুরনো আঁচড় কাটা দাগের ভেতর কিছু অক্ষরের মতো গড়ন।
তিনি ব্যাগ থেকে ছোট ব্রাশ আর হালকা ক্লিনার বের করে মৃদু করে ঘষে নিলেন সেই অংশ। স্পষ্ট হল একটা লাইন—
“আমি নিজেকে লিখি রোজ, যেন মরে গিয়েও বাঁচি।”
ঐশিকীর গা শিউরে উঠল। তিনি বুঝলেন, এই কুঠুরি কেবল বন্দিশালা নয়, এটি ছিল এক কবির ডায়েরি। তিনি সেখানেই বসে লিখতে শুরু করলেন নিজের নোটবুকের প্রথম পৃষ্ঠা—
“হেমচন্দ্র সেন, বন্দি নং ৯৫, সেলুলার জেল, আন্দামান।
আপনি ছিলেন ইতিহাসের এক পরিত্যক্ত নায়ক।
আজ আমি, ঐশিকী চক্রবর্তী, আপনার নির্বাসিত আত্মজীবনীর সাক্ষী।“
সেই রাতটা তাঁর জীবনের এক মোড় ঘোরানো মুহূর্ত হয়ে থাকবে। তিনি অনুভব করলেন, শব্দ কেবল সাহিত্য নয়—এ এক নৈতিক দায়িত্ব। যার কাছে পৌঁছানোর মানে সময়কে পুনরায় সৃষ্টি করা।
কলকাতায় ফিরে এসে ঐশিকী সিদ্ধান্ত নিলেন, “কালাপানির কাব্য” কেবল বই হিসেবে প্রকাশিত হবে না—এ হবে একটি জাতীয় আর্কাইভ প্রকল্প। তিনি যোগাযোগ করলেন সাহিত্য একাডেমি, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং ইন্ডিয়ান পেন সেন্টারের সঙ্গে। সব জায়গাতেই উত্তেজনা—একজন ভগ্নপ্রায় কবির এমন সম্পূর্ণ, অথচ অপ্রকাশিত রচনা পাওয়া এক বিস্ময়।
এই সময়েই কলকাতার নামী প্রকাশনী ‘শব্দলোক’ আগ্রহ প্রকাশ করে। প্রকাশক বললেন, “এই কবিতা শুধু ছাপা হবে না, আমরা চাই এর একটা জীবন হোক—শ্রুতিনাটক, চিত্রনাট্য, নাট্যরূপ, স্কুল পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্তি।”
ঐশিকী নিজে এই প্রজেক্টের কিউরেটর হলেন। শুরু হল ‘কালাপানির কাব্য উৎসব’—একটি তিন দিনের অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা, যেখানে পাঠ, আলোচনাচক্র, প্রদর্শনী, নাটক এবং হেমচন্দ্র সেনকে নিয়ে তথ্যচিত্র প্রদর্শিত হবে। স্থান ঠিক হল, রামমোহন হল, কলকাতা।
এই উৎসব শুরু হওয়ার ঠিক একদিন আগে, ঐশিকী একটা অদ্ভুত চিঠি পান। খামটা খুব পুরনো, হাতে লেখা। প্রেরক—রত্না দাস, ৭৮ বছর বয়সী, বসিরহাট, খাসবাটি।
চিঠিতে লেখা—
“আমি নৃপতি দাসের কনিষ্ঠ পুত্রবধূ। আপনি যখন এসেছিলেন তখন বাড়িতে ছিলাম না। আমার শাশুড়ি মৃত্যুর আগে একটা বাক্স আমাকে দিয়ে বলেছিলেন—‘এগুলো যেদিন কেউ খুঁজে পাবে, তার হাতে দিও। যিনি কেবল পড়েন না, বোঝেনও।’ ঐশিকী, আপনি কি সেই মানুষ? যদি হন, তবে আসুন। বাক্সে যে জিনিস আছে, তা হয়তো এখনও আপনাকে অবাক করবে।”
ঐশিকীর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। এতদিন ধরে যা তিনি খুঁজে ফিরেছেন, তা হয়তো এখানেই লুকিয়ে। তিনি উৎসব শেষ হতেই বসিরহাটের ট্রেন ধরলেন। মনে হচ্ছিল, যেন একটা শেষ পর্ব তাঁর ডাকছে। কারণ যা কিছু হারায়, তা যদি ফিরে আসে, তবে সেটা শুধু আবিষ্কার নয়—এ এক পূর্ণতা।
পর্ব ৬: বাক্সের ভিতর বাঁচা
বসিরহাট স্টেশনে ট্রেন যখন পৌঁছল, তখন বিকেলের আলো হেলে পড়েছে মাঠের ওপরে। ঐশিকীর চোখে এই গ্রাম যেন আগের থেকেও অচেনা লাগছিল—যেন সময় তার ছায়া পাল্টে ফেলেছে। সেই পুরনো রাস্তা, ধুলিধূসরিত কুয়ো, ঝুলে থাকা টিনের চাল—সব কিছুতেই আজ একটা প্রত্যাবর্তনের গন্ধ। তিনি ভাবছিলেন, একটা বাক্স—এতটা বছর পেরিয়ে—কী এমন ধারণ করে থাকতে পারে যা তাঁর এতদিনের গবেষণার চূড়ান্ত বাঁক হতে চলেছে?
রত্না দাস তাঁদের উঠোনে বসে ছিলেন। শাড়ির আঁচলে মুখ ঢাকা, হাতে একটা কাঠের ছোট বাক্স। ঐশিকী পা ছুঁতেই তিনি একপলক চেয়ে থেকে বললেন, “তুমি এসে পড়েছ… আমি জানতাম, তুমি ফিরবে।”
বাক্সটা ছিল জং ধরা তালায় আটকানো। খোলার আগে রত্না বললেন, “তোমার জন্যই রেখে গেছিলাম। কেউ বোঝেনি এর দাম, আমি শুধু শাশুড়ির মুখের কথায় ভরসা করে রেখেছিলাম। এখন বুঝছি, এর ভিতর সত্যিই কোনো প্রাণ আছে।”
তালা খোলার শব্দটা যেন অনেকটা শিকল খুলে যাওয়ার মতো লাগল। ভিতরে ছিল একটি পাতলা কাপড়ে মোড়া তামার রোল, যার ভিতর গুটানো কয়েকটি কাগজ। এই কাগজ ছিল হেমচন্দ্র সেনের হাতের লেখা, কিন্তু এইবার সম্পূর্ণ আলাদা গন্ধ। যেন তিনি নিজেকে নিয়ে লিখেছেন, নিজের জীবনের প্রতিটি পাল্টে যাওয়া মুহূর্ত।
প্রথম কাগজটির উপরে লেখা—
“আমি, একজন নির্বাসিত কবি”
— হেমচন্দ্র সেন
এই ছিল তাঁর আত্মজীবনীর এক খণ্ড। তাতে লেখা:
“আমি কলকাতায় শিক্ষকতা করতাম, কিন্তু কবিতা আমার অভিশাপ হয়ে উঠেছিল। কবিতা মানে তখন আগুন ছড়ানো, মানুষের ভিতরে ঝড় তোলা। আমি চাইনি বন্দুক ধরতে, চাইনি রক্তে স্নান করতে—কিন্তু চেয়েছিলাম মানুষ জেগে উঠুক। সেই জন্যেই আমার লেখা ‘রক্তঝরা বসন্ত’ বইটি বাজেয়াপ্ত হয়, আর আমাকে পাঠানো হয় কালাপানিতে।”
“আমি জানতাম, সেলুলার জেল থেকে জীবন্ত বেরোব না। তবু আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আমার প্রতিটি নিঃশ্বাস, প্রতিটি মাটির গন্ধ আমি পরিণত করব শব্দে। যেন কেউ একদিন পড়ে ফেলে বুঝতে পারে, কীভাবে নিঃশব্দের মধ্যেও একটি জাতি কথা বলে।”
এই লেখা ছিল এতটাই ব্যক্তিগত, এতটাই উন্মুক্ত, যে ঐশিকীর চোখে জল এসে গেল। তিনি অনুভব করলেন, ইতিহাস কখনও কেবল ঘটনা নয়—তা অনুভূতির দলিল। হেমচন্দ্র নিজে জানতেন, তাঁর দেহ শেষ হবে কিন্তু তাঁর কবিতা বেঁচে থাকবে।
পরবর্তী কাগজে ছিল একটি চিঠি—লিখে গেছেন হেমচন্দ্র, সম্ভবত মৃত্যুর কিছুদিন আগে। প্রাপক—নৃপতি দাস। তাতে লেখা:
“নৃপতি, তুমি আমাকে প্রতিদিন কিছু সময় দিয়েছো, যখন সবাই মুখ ফিরিয়েছে। তুমি চুপ করে আমার লেখা পড়েছ, আর আমি বুঝেছি—আমার কবিতা কেবল কাগজে নয়, একজন মানুষের হৃদয়েও জায়গা করে নিতে পারে। যদি কোনোদিন কেউ এই কবিতা খুঁজে পায়, তবে তাকে বলো—আমি লিখেছিলাম বাঁচার জন্য, মরার জন্য নয়।”
চিঠির নিচে তাঁর নামের পাশে আঁকা ছিল একটি ছোট্ট রক্তচিহ্নের মতো কালি ছোপ—হয়তো নিজের আঙুলের ছাপ, হয়তো কবিতার শেষ পাদটীকা।
ঐশিকী বুঝতে পারলেন, এটা কেবল গবেষণা নয়, এটা উত্তরাধিকারের গ্রহণ। তিনি রত্নার কাছে বাক্সটি নিয়ে ধন্যবাদ জানালেন। রত্না শুধু বললেন, “তোমার মত কারও হাতেই এগুলো থাকার কথা ছিল।”
কলকাতায় ফিরে ঐশিকী এই নতুন দলিলগুলির প্রতিটি অনুবাদ ও সংরক্ষণ শুরু করলেন। এইবার তিনি তাঁর বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করলেন—নতুন নাম “কালাপানির কাব্য: নির্বাসিত কবির আত্মজীবনী”।
এবার শুধুই কবিতা নয়, পাঠকের সামনে এল সেই কবির হৃদয়, তাঁর কষ্ট, তাঁর ভালোবাসা, তাঁর স্বপ্ন। বইয়ের একটি বিশেষ অংশে ঐশিকী লিখলেন:
“একটা দেশ কেবল রণতুর্য আর বিপ্লবীর রক্তে তৈরি হয় না—তাতে দরকার হয় শব্দের, যে শব্দ ইতিহাসের গভীরে বয়ে নিয়ে যায় শ্বাস।”
বইটি শুধু গবেষকদের নয়, সাধারণ পাঠকদের মাঝেও আলোড়ন তোলে। হেমচন্দ্র সেন হয়ে ওঠেন এক প্রতীক—নীরব অথচ প্রবল প্রতিবাদের। তার কবিতা বাংলার বিভিন্ন কলেজের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়, নাট্যদলগুলি তাঁর কবিতার উপর নাটক তৈরি করে, এমনকি একটি ওয়েব সিরিজও নির্মিত হয়—“শব্দের নির্বাসন” নামে।
তবে ঐশিকী জানতেন, গল্প এখানেই শেষ নয়। তাঁর কাছে বাকি ছিল একটি প্রশ্ন—যে কবি লিখলেন ‘আমি নিজেকে লিখি রোজ’, তিনি কি কখনও একটিবারের জন্য নিজেকে ক্ষমা করেছিলেন?
পর্ব ৭: ক্ষমার কবিতা
ঐশিকীর ঘরের দেয়ালে তখন একটি ফ্রেমে বাঁধানো সেই বাক্যটি ঝুলছিল—
“আমি নিজেকে লিখি রোজ, যেন মরে গিয়েও বাঁচি।“
তার নিচে রাখার জায়গায় ছিল হেমচন্দ্র সেনের হাতে লেখা পাতাগুলি, যেন শব্দ দিয়ে তৈরি একরকম পুরাণ। রাতে যখন সে একা থাকত, সে বিশ্বাস করত—এই শব্দগুলোর ভিতরেই কবি হেমচন্দ্র এখনও শ্বাস নেন।
একদিন বিকেলে, সে বইমেলার একটি সেমিনারে বক্তব্য রাখতে গিয়েছিল—বিষয় ছিল: “লেখা যখন প্রতিবাদ।” প্রশ্নোত্তর পর্বে এক তরুণ গবেষক জিজ্ঞেস করল, “হেমচন্দ্র সেন তো জানতেন, তাঁর লেখা কখনও ছাপা হবে না, কেউ পড়বে না। তাহলে তিনি কেন লিখতেন?”
ঐশিকী কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল,
“কারণ লিখে যাওয়াটা ছিল তাঁর ক্ষমা চাওয়া। তাঁর নিজের কাছেই। নিজের জড়তা, ভয়, আত্মদ্বন্দ্ব—সবকিছুকে তিনি ক্ষমা করে দিয়েছিলেন লেখার মধ্য দিয়ে। তাঁর কবিতা ক্ষমার কবিতা, অস্তিত্বের স্বীকারোক্তি। তাই তিনি লিখতেন, যেন ভুল করে বেঁচে যাওয়াটাও একটা ইতিহাস হয়ে ওঠে।”
এই কথাগুলো ছড়িয়ে পড়ল মানুষের মধ্যে। পরদিন সংবাদপত্রের শিরোনাম হল—“কালাপানির কবিতা আসলে আত্মার মুক্তির প্রার্থনা”।
এর পরেই ঐশিকী এক অদ্ভুত চিঠি পান। লেখাটি হেমচন্দ্র সেনের হাতে লেখা নয়, তবে ভাষায় তারই ছায়া। প্রেরক—একজন বয়স্ক মহিলা, নাম মোহিনা সেন। কলকাতার বেহালায় থাকেন। তিনি লিখেছেন—
“আপনি যেসব কবিতা প্রকাশ করেছেন, তার মধ্যে দু-একটি কবিতা আমি বহু বছর আগে শুনেছিলাম আমার ঠাকুমার মুখে। তিনি বলতেন, তাঁর বাবার ছোট ভাই কবি ছিলেন—নাম হেমচন্দ্র। পরিবারের কেউ তাঁকে নিয়ে কিছু বলত না। তাঁকে নাকি ‘দেশদ্রোহী’ বলে ত্যাগ করা হয়েছিল। আমি তখন বুঝতাম না, এখন বুঝছি—আপনি হয়তো আমার আত্মীয়ের কথা বলছেন।”
ঐশিকীর আবার একবার মনে হল, ইতিহাস কেবল নথি নয়—এ হল মানুষের শিরায় জমে থাকা লজ্জা, গোপনতা, আর না বলা কথা। তিনি মোহিনা সেনের সঙ্গে দেখা করলেন। তাঁর কাছে কিছু পারিবারিক চিঠি ছিল, যেখানে হেমচন্দ্রের কথা একবার উল্লেখ করা হয়েছিল—“হেম কবিতার পেছনে পাগল হয়েছে, শুনলাম জেলে গেছে, পরিবারের মান-ইজ্জত সব ধুলোয়।”
ঐশিকীর মাথায় তখন একটা নতুন পরিকল্পনা তৈরি হচ্ছিল। শুধু কবিতা ছাপা নয়—এই সমস্ত পারিবারিক, সামাজিক পরিসরে হেমচন্দ্র সেনের অনুপস্থিতি, তিরস্কার, নির্বাসন—সব মিলিয়ে একটা পূর্ণাঙ্গ চিত্র তৈরি করা দরকার।
তিনি ঘোষণা করলেন একটি নতুন প্রকল্প—
“পুনর্পাঠ: হেমচন্দ্র সেন”—যেখানে থাকবে কেবল তাঁর লেখা নয়, থাকবে তাঁর অনুপস্থিতির ইতিহাসও। ঐশিকী বললেন,
“আমরা কেবল যাঁরা ছিলেন তাঁদের স্মরণ করি, যাঁদের ভুলে গেছি তাঁদের ইতিহাসে স্থান দিই না। হেমচন্দ্র সেন ছিলেন তেমনই এক মানুষ—যাঁকে সমাজ বর্জন করেছে, অথচ তিনি সমাজের জন্যই লিখেছেন।”
এই প্রজেক্টে যুক্ত হলেন বহু নতুন গবেষক, শিল্পী, ইতিহাসবিদ। তৈরি হল একটি ট্র্যাভেলিং এক্সিবিশন—**“কালাপানির ছায়ায়”—**যা কলকাতা, দিল্লি, ঢাকা, লন্ডন ও আন্দামানে প্রদর্শিত হবে। প্রদর্শনীতে থাকবে হেমচন্দ্র সেনের কবিতা, কুঠুরি থেকে উদ্ধার হওয়া অক্ষর, নৃপতির সংরক্ষিত দলিল, এবং ঐশিকীর গবেষণার ভিজ্যুয়াল উপস্থাপনা।
এই সময় ঐশিকীর জীবনে একটা ব্যক্তিগত ঘটনাও ঘটে। তার বাবা, একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি অফিসার, যিনি এতদিন হেমচন্দ্র প্রসঙ্গে বিশেষ কিছু বলেননি, একদিন কফির কাপ হাতে এসে বললেন,
“তুই অনেক সাহসিক কাজ করেছিস। একজন নির্বাসিত কবিকে ইতিহাসে ফিরিয়ে আনেছিস। আমি ভেবেছিলাম, কবিতা মানুষ বাঁচাতে পারে না। আজ বুঝছি, তা পারে—কম করে হলেও বাঁচা শেখাতে।”
ঐশিকী সেদিন রাতে এক নতুন কবিতা লেখে, যার নাম রাখে—
“ক্ষমার কবিতা”।
তাতে সে লেখে—
“তুমি যখন ভুল করেছ,
আমি তা কবিতায় লিখেছি।
তুমি যখন হারিয়ে গেছ,
আমি শব্দে খুঁজে পেয়েছি।
তুমি যখন নির্বাসিত,
আমি তোমায় করে নিয়েছি নিজের ভিতর।“
পর্ব ৮: সেলুলারের আকাশপথে
আন্দামানের সেলুলার জেল আজ আর জেলখানা নয়—এখন সেটা এক নির্ভরযোগ্য জাদুঘর, যেখানে হাঁটলে পুরনো শিকল আর নিঃশ্বাসের আওয়াজ কানে আসে না, শুধু ক্যামেরার ক্লিক আর গাইডের রেকর্ডেড ভয়েস শোনা যায়। কিন্তু ঐশিকীর চোখে এই জায়গাটা ছিল না শুধুমাত্র অতীত, এটা ছিল জীবন্ত একটি কবিতার শরীর, যার প্রতিটি কোণে, প্রতিটি পাথরে, প্রতিটি ফাটলে লুকিয়ে আছে কোনও না কোনও উচ্চারণ।
ঐশিকী যখন আন্দামানে আবার পৌঁছালেন, তখন ‘কালাপানির কাব্য’ আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত একটি সংকলন। কিন্তু এবার তাঁর আসা ছিল এক অন্য উদ্দেশ্যে—একটি স্থায়ী প্রদর্শনীর সূচনা। ভারতের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও ইতিহাস গবেষণা কেন্দ্রের যৌথ উদ্যোগে, সেলুলার জেলের দক্ষিণ ব্লকে হেমচন্দ্র সেনের নামে একটি বিশেষ কক্ষ তৈরি হয়েছে—‘নির্বাসিত কবির ঘর’। এই ঘর হবে তার চিহ্ন, যে মানুষকে কণ্ঠ রোধ করা হয়েছিল, কিন্তু যিনি শব্দ দিয়ে নিজেকে চিরকালীন করে তুলেছিলেন।
প্রদর্শনীর উদ্বোধনে ঐশিকীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল প্রধান বক্তা হিসেবে। কক্ষে ঢুকে তাঁর চোখে জল এসে যায়—তিন নম্বর কুঠুরি, যার দেওয়ালে প্রতিলিপি করা হয়েছে হেমচন্দ্রের সেই বিখ্যাত কবিতা—
“যদি আমায় না পাও, তবে শব্দে খুঁজে নিও।“
আর পাশেই রাখা হয়েছে কাঠের সেই বাক্স, যার ভিতর ছিল চুপচাপ ইতিহাস।
অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন নানা প্রান্তের কবি, লেখক, গবেষক, এমনকি আন্দামানের স্কুল থেকে আসা ছাত্রছাত্রীরাও। ঐশিকী মাইক হাতে নিয়ে দাঁড়ালেন, চারদিক নীরব।
তিনি বললেন,
“হেমচন্দ্র সেন নিজে কখনও মঞ্চে দাঁড়িয়ে কবিতা পড়েননি। তিনি যে কবিতা লিখতেন, তা দেওয়ালে, কাঠে, বস্তায়, নিজের রক্তে। তিনি জানতেন, শব্দই শেষ অবলম্বন। আজ এই প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে আমরা শুধু তাঁকে নয়, সেই সকল নির্ভীক মানুষদের স্মরণ করছি, যাঁরা কলম তুলে নিয়েছিলেন কালের বিরুদ্ধে।”
তাঁর বক্তব্য শেষে এক কিশোর ছাত্রী, নাম প্রমীলা দত্ত, উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি একটা কবিতা লিখেছি, হেমচন্দ্র সেনের কথা ভাবতে ভাবতে। পড়তে পারি?”
ঐশিকী মুচকি হেসে বললেন, “এই তো আসল উত্তরাধিকার। অবশ্যই পড়ো।”
প্রমীলা পড়ল—
“তুমি চুপ করে থেকেছিলে,
তবু তোমার শব্দগুলো বেঁচে গেছে।
তুমি নির্বাসিত,
তবু আমরা তোমায় ঘরে ফিরিয়ে এনেছি।“
ঘরজুড়ে নীরবতা। তারপর হালকা হাততালি, কিন্তু তাতে গর্ব আর কৃতজ্ঞতার ধ্বনি মিশে ছিল।
ঐশিকীর মনে হল, তিনি এবার সত্যিই হেমচন্দ্রকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছেন। তাঁর কবিতা কেবল বইয়ে নয়, মানুষের মুখে, শিশুর কলমে, তরুণের চোখে বাসা বাঁধছে। এটাই তাঁর প্রকৃত মুক্তি।
প্রদর্শনীর শেষ অংশে হেমচন্দ্র সেনের একটি দীর্ঘ কবিতা ছিল, যার নাম “আকাশের ওপারে কালাপানি”। ঐশিকী সেই কবিতাটি গলায় গলা মিলিয়ে পড়ে শোনালেন—
“আমি যাবো না কোথাও,
এই শিকলেই বাঁধা আমার আত্মা।
তবু আমার শব্দ পাড়ি দেবে সাগর,
তারা উড়বে স্বাধীন পাখির মতো—
আকাশের ওপারে, কালাপানির বুক চিরে।“
পর্ব ৯: মৃত্যুর পরবর্তী পাঠ
সেলুলার জেলের বাতাসে সেই সন্ধ্যায় একধরনের নিস্তব্ধ উৎসব ছিল। প্রদর্শনী শেষ হলেও ঘর ছেড়ে কেউ যাচ্ছিল না। যেন প্রতিটি দর্শক শব্দের ওজনে কিছুক্ষণ নীরব থেকে, নিজের ভেতরের গোপন কুঠুরিকে আবিষ্কার করতে চাইছিল। ঐশিকী, এক কোণে দাঁড়িয়ে, দেখছিলেন—একদা যেটা ছিল নিঃশব্দ মৃত্যুর কারখানা, আজ সেটা পরিণত হয়েছে পাঠশালায়। হেমচন্দ্র সেনের মৃত্যুর পর প্রথমবার, যেন তাঁর কবিতা জীবনের পাঠ দিচ্ছে।
সেই রাতে ঐশিকী থাকার জন্য বেছে নেন সেলুলার জেলের পাশে একটি সরকারি গেস্ট হাউস। সেখানে একটানা বসে সে হেমচন্দ্রের শেষ পাণ্ডুলিপি পুনরায় পড়ে ফেলেন—‘কালাপানির অন্তর্গত কবিতা’—যার সবচেয়ে শেষ কবিতাটির নাম ছিল “শেষ জলে নাম লেখা”।
পঙ্ক্তিগুলো এমন:
“আমার নাম মুছে যাবে রেজিস্টারে,
কিন্তু ঢেউয়ের গায়ে আমি রেখে যাব
একটি অস্পষ্ট অক্ষর।
যদি কেউ পড়ে ফেলে,
তবে বুঝে নিও—
আমি ক্ষমা করে গেছি সবাইকে,
নিজেকেও।“
এই কবিতাটি পড়ে ঐশিকী কেঁদে ফেলেন। কারণ এই কবিতার শেষ লাইনে সেই ব্যক্তিকে দেখতে পান যাঁকে এত বছর ধরে খুঁজছিলেন—না, শুধু একজন কবি নয়, একজন মানুষ, যিনি দুঃখ দিয়ে নয়, ক্ষমা দিয়েই নিজেকে পূর্ণ করেছিলেন। যিনি রক্তের দাগকে রূপ দিয়েছিলেন জলরঙে, আর শব্দের আঁচড়ে নির্মাণ করেছিলেন এক বিকল্প ইতিহাস।
পরদিন ভোরে, প্রদর্শনীর পরেরদিন, তিনি হেমচন্দ্র সেনের কবিতা থেকে তৈরি নতুন সংকলনের নাম ঘোষণা করেন—“শেষ জলে নাম লেখা“। এতে থাকবে শুধু কবিতা নয়, ঐশিকীর নিজের নোট, আবিষ্কারের সময়কার ভাবনা, নৃপতি দাসের সংগ্রহ করা চিঠি ও কাগজপত্র, মোহিনা সেনের পারিবারিক চিঠির অনুলিপি, এমনকি প্রমীলা দত্তের কবিতাটিও।
বইয়ের ভূমিকায় ঐশিকী লেখেন—
“এই বই কারও সাহস জোগাবে না হয়তো, কিন্তু কাউকে সাহসী করে তুলবে—নিজের ভাষা খুঁজে নেওয়ার, নিজের আত্মাকে ক্ষমা করার।”
কলকাতায় ফিরে, এক সন্ধ্যায় ঐশিকী যান নন্দন চত্বরে—সেখানে চলছে ‘কালাপানির কাব্য’ অবলম্বনে নির্মিত ডকুফিকশনের প্রিমিয়ার। পরিচালক, তরুণ ও নিরীক্ষামূলক ভাবনার অধিকারী অনিমেষ বসু, হেমচন্দ্র সেনের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য বেছে নিয়েছেন এক নতুন মুখ—একজন নাট্যশিক্ষার্থী, যিনি নিজেই কবিতা লেখেন।
চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য মন ছুঁয়ে যায়—একাকী হেমচন্দ্র কুঠুরির অন্ধকারে বসে, দেয়ালে কবিতা লিখছেন, আর গলায় গলা মিলিয়ে চলেছে তাঁর নিজের গলার আওয়াজ:
“আমি নিজেকে লিখি রোজ, যেন মরে গিয়েও বাঁচি।“
দর্শক চুপচাপ, কেউ কেউ কাঁদছেন। কেউ আবার ভাবছেন—এতদিন পরে কেন এই কবির কথা সামনে এলো?
ঐশিকী তখন জানতেন, অনেক উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন নেই। শুধু একটা শব্দ যথেষ্ট—“এখন।“
এই সময়েই কেন্দ্রীয় শিক্ষা বোর্ড একটি ঘোষণা করে—হেমচন্দ্র সেনের কবিতা ও আত্মজীবনী সংক্ষিপ্ত রূপে উচ্চ মাধ্যমিক পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হবে। সেই ঘোষণায় লেখা থাকে:
“বাংলার এক নির্বাসিত কবি, যাঁর কণ্ঠস্বর দেয়াল ভেদ করে উঠে এসেছে। তরুণদের জানাতে হবে—কীভাবে একটি শব্দ হতে পারে অস্ত্র, আর কীভাবে মৌনতা হতে পারে মহাকাব্য।”
ঐশিকী রাতে ফোন করেন মোহিনা সেনকে। তিনি বলেন,
“আপনার পূর্বপুরুষ ইতিহাসের পাতায় ফিরেছেন। এবার আপনি জানেন, আপনার ঠাকুমা যা বলতেন, তা গল্প ছিল না—তা ছিল কাব্য। সেই কাব্য এখন জাতির স্মৃতি।”
ফোনের ওপারে কেবল একটা ফিসফিস শব্দ: “ধন্যবাদ…”
সেই রাতের আকাশে, আন্দামান থেকে কলকাতা, জল থেকে শব্দ, দেয়াল থেকে হৃদয়—সব কিছুর মাঝখানে যেন ভেসে উঠছিল একটা লাইন—
“আমি কেবল কবি নই,
আমি সেই অক্ষর—
যে হারিয়ে গেলেও
উচ্চারণ হয়ে ফিরে আসে।“
পর্ব ১০: কবিতার দেশে ফিরে আসা
কলকাতা, ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ। হাওয়ায় শীতের ধুলো, ধুপকাঠির গন্ধ, আর কফির কাপ থেকে উঠে আসা নিঃশ্বাস। ঐশিকী চক্রবর্তী নিজের নতুন বই “শেষ জলে নাম লেখা” প্রকাশের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বাংলা একাডেমির অডিটোরিয়ামে আয়োজন হচ্ছে বিশেষ সাহিত্য সন্ধ্যার—একবারে অনাড়ম্বর অথচ গম্ভীর অনুষ্ঠানের, যেখানে প্রধান অতিথি নন কেউই, সবার কেন্দ্রে আছেন এক অনুপস্থিত কবি—হেমচন্দ্র সেন।
মঞ্চে বড় স্ক্রিনে ভেসে উঠছে সেই বাক্যগুলো, যেগুলো কোনও প্রেসে ছাপা হয়নি হেমচন্দ্রের জীবদ্দশায়। স্লাইডে আসে তাঁর হাতে লেখা কবিতার পাতাগুলি, নৃপতির সংরক্ষিত দলিল, তাঁর অর্ধেক কুঁচকে যাওয়া কলম, আর সেই ছেঁড়া কাগজ—যার গায়ে লেখা ছিল—
“যদি আমায় না পাও, তবে শব্দে খুঁজে নিও।“
এদিন বক্তৃতা করেন ঐশিকী, শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে—
“আমরা যখন কবিতাকে ইতিহাস থেকে আলাদা করে ফেলি, তখন কবিরা নির্বাসিত হন। কিন্তু হেমচন্দ্র সেন ফিরে এসেছেন। কারণ তাঁর কবিতা ছিল আত্মার দলিল, ভয়ের গহ্বর থেকে উঠে আসা এক আশ্চর্য আলো।”
তিনি প্রথমবার প্রকাশ্যে পড়ে শোনান সেই কবির ‘শেষ কবিতা’, যেটি সম্প্রতি খুঁজে পাওয়া গিয়েছে মোহিনা সেনের পারিবারিক ডায়েরিতে। কবিতার নাম “ফিরে আসা”।
“আমি চলে গেছিলাম, নিঃশব্দের দিকে।
কারাগারের দেয়ালে শব্দের মতো লেগেছিলাম।
এখন যদি কেউ পড়ে, কারও চোখে জল আসে,
তবে জেনে নিও—
আমি সত্যিই ফিরে এসেছি।
কোনও জেলখানার দরজা আমাকে চিরকাল আটকে রাখতে পারেনি।
আমি কবিতা হয়ে ঘুরে বেড়াই—
তোমার বুকের ভিতর।“
এই কবিতা পড়া শেষ হলে অডিটোরিয়ামে একটা নিঃশব্দ বিস্ফোরণ ঘটে। কেউ হাততালি দেয় না, কেউ চিৎকার করে না, কেবল একধরনের মৌন শ্রদ্ধা ঝরে পড়ে সবার চোখে-মুখে। ঐশিকী বুঝে যান—এই হল ইতিহাসের বিজয়, যেখানে শব্দ বন্দুককে হারায়।
অনুষ্ঠান শেষে, এক তরুণ ছেলেমেয়ে এসে ঐশিকীর হাতে একটি ছোট খাম দেয়। খুলে দেখা যায়, একটি কবিতা, নাম “কালাপানির কাব্য ২.০”, লিখেছেন তারা একসাথে—
“একটা কবি ছিল, তাকে কেউ চিনত না,
সে নিজের নাম কাঁটাতেও পারত না।
তবু তার কবিতা ইতিহাস লিখল—
কারণ সে বিশ্বাস করেছিল,
শব্দ একদিন পথ দেখায়।“
ঐশিকী হেসে বললেন, “এইটাই হেমচন্দ্র সেনের প্রকৃত মুক্তি। আমি শুধু একজন পথ খুঁজে দিয়েছি, বাকিটা তোমরাই এগিয়ে নেবে।”
সেদিন রাতে, ঐশিকী নিজের ডেস্কে বসে শেষ নোটটি লেখেন হেমচন্দ্র সেনকে উদ্দেশ্য করে—
“আপনার কবিতা আমাকে ভাঙতেও শিখিয়েছে, গড়তেও।
আপনি একদিন চুপ করে মরে গিয়েছিলেন,
আজ আমি কাঁধে নিয়ে চলেছি আপনার শব্দের কাঁধছোঁয়া জীবন।
আপনাকে আর কখনও হারাতে দেব না।
কারণ, আপনি বেঁচে আছেন আমাদের ভিতর—
ছায়া হয়ে নয়, আলো হয়ে।”
বাইরে তখন কলকাতার রাত। দূরে বাজছে একটা ভাঙা হারমোনিয়াম। আর ঐশিকী জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ভাবছেন,
কালাপানি?
তা তো শুধু একটা কারাগার নয়।
তা এক অভ্যন্তরীণ সাগর,
যেখানে কিছু মানুষ ডুবে যায়, আর কেউ কেউ
তাদের শব্দে করে অনন্ত যাত্রা।
— সমাপ্ত —