Bangla - রহস্য গল্প

নাগমণির সন্ধানে

Spread the love

নির্মাল্য বসু


এক

হেমন্তের সকালে কলকাতার আকাশ ছিল ধোঁয়াটে, যেন স্মৃতি জমা ধুলোয় ধরা পড়ে আছে। ড. অনিরুদ্ধ বসু তার বাগুইআটির ফ্ল্যাটের বারান্দায় বসে সিগারেট ধরালেন, সামনে একটা পুরনো কাঠের টেবিলে ছড়ানো ইতিহাসের বইপত্র আর হিন্দু-মিথলজির লিপিবদ্ধ নথি। গত কয়েক বছর ধরে তিনি সক্রিয় গবেষণা থেকে দূরে ছিলেন, কিন্তু পুরনো অভ্যাসটা এখনও যায়নি—প্রতিদিন ভোরবেলা ধোঁয়ায় মিশে যাওয়া শহরটাকে দেখতে দেখতে কল্পনায় ফিরে যেতেন হারিয়ে যাওয়া সভ্যতার দিকে। এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল। কেয়ারটেকার কমল একটা বাদামি খাম এগিয়ে দিল—অদ্ভুত ধরনের মোটা কাগজে মোড়া, প্রেরকের নাম নেই, শুধু লেখা: “ড. অনিরুদ্ধ বসু, পুরাতত্ত্ব গবেষক, কলকাতা।” খাম খুলে অনিরুদ্ধ প্রথমে দেখলেন একটা ছেঁড়া নকশা—হাতে আঁকা একটা ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরের চিত্র, মন্দিরের চারপাশে গাছপালা, আর নিচে কিছু প্রত্নপ্রতীক, যেগুলোর মানে প্রথম দর্শনেই বোঝা গেল না। তার সঙ্গেই একটা সাদাকালো ছবি—আলোকছায়ার খেলা, ছবির মাঝখানে ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে থাকা এক মন্দির, আর মন্দিরের মাথায় বসে আছে একটা সাপের প্রতিকৃতি। ছবির নিচে ছোট করে হাতে লেখা: “পূর্ণিমার রাতে অর্পণ হয় জীবন, জাগে মণির শ্বাস।” চিঠির পেছনে লেখা একটাই ঠিকানা: ছাতনীডি, পুরুলিয়া জেলা।

চিঠিটা অনিরুদ্ধর মনের ভেতরে কাঁপন তুলল। ‘নাগমণি’ শব্দটা তিনি শেষ শুনেছিলেন প্রায় তিরিশ বছর আগে, তাঁর ঠাকুরদার মুখে, যিনি ছিলেন নিজেও এক সময়ের প্রত্নতাত্ত্বিক। ছেলেবেলায় তিনি শুনতেন, পুরুলিয়ার কোনো এক জঙ্গলঘেরা এলাকায় একটি প্রাচীন মন্দির আছে, যার নীচে লুকিয়ে আছে “নাগমণি” নামের এক অলৌকিক পাথর। কথিত আছে, সেই মণির অভিশাপেই প্রতি পূর্ণিমায় একজন করে মানুষ নিখোঁজ হয়। অনিরুদ্ধ তখনকার মতো এসবকে লোককথা ভেবেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন, এত বছর পর সেই কথা আবার ফিরে এলো এই অদ্ভুত চিঠির মাধ্যমে। তার মধ্যে যেভাবে প্রাচীন চিহ্ন আঁকা হয়েছে, তাতে নিশ্চিত হওয়া যায়—এই চিঠি কেউ ইচ্ছে করে তৈরি করেনি; বরং এটা সেইসব নিঃসঙ্গ গবেষকের হাতে এসেছে, যারা জানে কীভাবে হারানো কাহিনি চিত্রে বাঁধতে হয়। রোহিনী সেন, তাঁর প্রাক্তন ছাত্রী, এখন একটি নিজস্ব গবেষণারত সংস্থায় কাজ করে, ও প্রত্নলিপি বিশ্লেষণে পারদর্শী। পরদিন সকালেই তিনি রোহিনীকে ফোন করে ডেকে পাঠালেন। রোহিনী ছবিটা দেখেই চমকে উঠল—কারণ এই প্রতীকগুলো সে আগে কোথাও দেখেছে, সম্ভবত এক হরপ্পা সভ্যতার প্রান্তবর্তী গুহাচিত্রে। নকশায় থাকা সাপাকৃতি এবং তার মুখে জিহ্বা-দেখানো প্রতিমা পূর্বভারতের লোকবিশ্বাসের সাথে মিল রাখে। “স্যার, এটা যদি সত্যি হয়, তাহলে আমাদের এখনই বেরোতে হবে,” বলল রোহিনী, চোখে উত্তেজনার ঝিলিক।

অনিরুদ্ধ আর দেরি করলেন না। তারা দু’জনে পুরুলিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করলেন—রাতের ট্রেন ধরে, হাওড়া থেকে ঝালদাগামী লোকাল পর্যন্ত। ঝালদা থেকে জিপে প্রায় দু’ঘণ্টার পথ—চক্রপথে পাহাড়ি রাস্তা পেরিয়ে ছাতনীডি নামের গ্রামে পৌঁছানো গেল। সে গ্রাম যেন সময়ের বাইরে বসে আছে—একেকটা বাড়ি মাটির তৈরি, জানালায় কাঠের শিক, আর মুখচোরা মানুষ, যারা বাইরের লোক দেখলেই চোখ ফিরিয়ে নেয়। তাদের মাঝে ছড়িয়ে আছে নিঃশব্দ ভয়, যা ভাষায় প্রকাশ হয় না, কিন্তু চোখে লেখা থাকে। গ্রামের প্রবীণতম মহিলা, অঞ্জলি দেবী, একজন কর্কশ অথচ প্রজ্ঞাবান বৃদ্ধা, মুখে বললেন—“আপনারা মণির খোঁজে এসেছেন তো? আমি জানতাম, আবার কেউ আসবে।” তাঁর চোখে ছিল এমন এক অভিজ্ঞতার ছায়া, যা বহু পূর্ণিমার রাত্রি দেখেছে। গ্রামের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা মন্দিরের ভগ্নপ্রায় ধ্বংসাবশেষের দিকে তাকিয়ে অনিরুদ্ধর মনে হল—এই গল্পটা নিছক লোককথা নয়, এখানে এমন কিছু লুকিয়ে আছে, যার প্রভাব সময়কেও অতিক্রম করে। আর সেই সন্ধানের প্রথম ধাপ এই চিঠি—যা তাদের নিয়ে এসেছে সেই জায়গায়, যেখানে পূর্ণিমার আলো ছুঁলেই শুরু হয় অদৃশ্য কারও পদচিহ্নের গল্প।

দুই

ছাতনীডি গ্রামের মাটির গন্ধে একরকম আর্দ্রতা আছে, যেন অদৃশ্য কোনো কিছু প্রতিনিয়ত সেখানে নিঃশ্বাস ফেলে। পুরুলিয়ার পাহাড়ি রাস্তায় দীর্ঘ সফরের পর, ড. অনিরুদ্ধ বসু আর রোহিনী সেন দাঁড়িয়ে ছিলেন গ্রামের প্রবেশপথের একচিলতে ধুলোভরা মাঠে, যেখানে বাতাসে শুকনো পাতার মৃদু ঝিরঝির শব্দ ছড়াচ্ছিল। গ্রামের মানুষজন তাদের আগমনে কৌতূহলী হলেও মুখে কোনও কথা বলেনি। পেছনে একটা খরস্রোতা শুকনো ঝর্নার চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল, যেটা শীতকালে পুরো শুকিয়ে যায়। ঘন বাঁশঝাড়ের আড়ালে অদ্ভুত এক নিঃশব্দতা—যেন পাহারা দিচ্ছে কিছু। তাঁরা যেইমাত্র হাঁটতে শুরু করলেন, একজন বার্ধক্যজর্জরিত মহিলা—অঞ্জলি দেবী, কাঠের লাঠিতে ভর দিয়ে এগিয়ে এলেন। তাঁর গাল পাকা, চোখ কুয়াশার মতো ধোঁয়াটে, আর কণ্ঠস্বর শুকনো পাতার মতো খসখসে। তিনি সরাসরি অনিরুদ্ধর দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনারা মণির খোঁজে এসেছেন তো? জানতাম, কেউ না কেউ আবার ফিরে আসবেই।” রোহিনী চমকে উঠলেও অনিরুদ্ধ শান্তভাবে প্রশ্ন করলেন—“আপনি জানেন মণি কোথায়?” বৃদ্ধা হাসলেন, “জানার চেয়েও ভয় পাই বেশি। এই মন্দিরে একদিন আমার ভাইও ঢুকেছিল পূর্ণিমার রাতে… আর ফিরে আসেনি।”

পুরুলিয়ার লোককাহিনি বলে, এই গ্রামের পাশের প্রাচীন মন্দিরে প্রতি বছর একটি পূর্ণিমায় একজন করে মানুষ নিখোঁজ হয়। কেউ বলেন সাপের টানে হারিয়ে যায়, কেউ বলেন মন্দির ‘নিয়ে নেয়’। আধপাকা মুখে এই কাহিনি অনেকেই বললেও প্রমাণ নেই কারোর। রোহিনী তার নোটবুক খুলে অঞ্জলি দেবীর বয়ান লিখে নিতে শুরু করল। “আমার বয়স তখন বারো। পূর্ণিমা রাত। হঠাৎ চারদিক থমকে গেল, যেন সব গাছ নিঃশ্বাস বন্ধ করে দিল। আমি জানালায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, দেখি আমার ভাই গোপাল ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল। মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই, চোখ স্থির। আমরা পরদিন খুঁজতে গিয়ে মন্দিরের পেছনে তার চটি আর রক্তমাখা গামছা পেয়েছিলাম। কিন্তু মানুষটা গায়েব। সাপের কামড়ের দাগ ছিল না, রক্ত জমাট বাঁধেনি। কেউ কিছু বোঝেনি।” রোহিনী বুঝল, ঘটনা অলৌকিক না হলেও অস্বাভাবিক বটে। মন্দিরের ধ্বংসস্তূপটা জঙ্গলের ঠিক ধারে—ছড়িয়ে আছে লতা, পাথরের ফাটলে ভাঙা নকশা, আর কয়েকটা রহস্যময় প্রতীক। সন্ধ্যের আলোয় সেটা যেন এক মৃত স্মৃতির মতো দাঁড়িয়ে আছে—যেখানে সাপও বাসা বাঁধে না, পাখিও বসে না। তারা যখন মন্দিরের চারপাশ ঘুরে দেখছিল, তখন একজন চাষি এগিয়ে এসে বলল—“ওদিকে যাবেন না বাবু, শীতের রাতে ওখানে নাকি কান্নার শব্দ শোনা যায়। সব প্রাণী সরে যায়।”

রাত্রে তাঁরা গগন মাহাতোর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। গগন একজন মধ্যবয়সী বনবাসী, যিনি গ্রামের প্রান্তে একটি ছনের ঘরে একা থাকেন। সে ছিল অদ্ভুতরকম শান্ত, মুখে যতটা কম কথা, চোখে ততটাই গল্প জমা। অনিরুদ্ধ তাকে মন্দিরের ছবি দেখালেন, গগন অল্প হেসে বলল, “এগুলো তো ছেলেবেলায় আঁকা শিখেছিলাম। দাদুর হাতে একটা পুঁথি ছিল, তাতে এই চিহ্নগুলোই ছিল।” সে তাদের নিয়ে গেল নিজের ঘরের পেছনে, একটা কাঠের বাক্স খুলে বের করল সেই পুরনো পুঁথির ছেঁড়া পাতা—যার ভাষা সম্পূর্ণ অচেনা, তবু নকশা মিলছে অনিরুদ্ধদের চিঠির সঙ্গে। সেখানে ‘নাগদ্বার’, ‘সপ্তনাগ’ এবং ‘জীব-অর্পণ’ শব্দের প্রতীকী চিত্র রয়েছে। রোহিনী তাৎক্ষণিক ব্যাখ্যা করল—“এটা সম্ভবত কোনো উপাসনার সংকেত, যেখানে কিছু বিশেষ দিনে একধরনের চক্র শুরু হয়। এই পাথর হয়ত কোনো প্রাচীন যন্ত্রের অংশ—নাগদের পূজার উপকরণ।” গগন হঠাৎ বলল—“নাগমণি শুধু পাথর না বাবু, ওটা নাকি শ্বাস নেয়। আমার দাদু বলতেন, রাত যত গভীর হয়, মণি তত জেগে ওঠে।” এই কল্পনাকে প্রথমে গাঁজাখুরি বলেই মনে হয়েছিল অনিরুদ্ধর, কিন্তু প্রতীকগুলো এবং নিখোঁজ মানুষদের খবরে একটা গভীর অস্বস্তি মাথা তুলছিল। সেদিন রাতেই রোহিনী একটি নতুন সংকেত আবিষ্কার করল—পুঁথিতে আঁকা সাতটি মুখবিশিষ্ট সাপের প্রতিকৃতি, যার মধ্যে একটি মুখ ছিল মানুষের। “এটা কি তাহলে প্রতীকী রূপ, না কি কোনো রূপান্তরের ইঙ্গিত?” অনিরুদ্ধ বললেন ধীরে, সিগারেটের ধোঁয়া ছড়িয়ে দিতে দিতে—“হয়তো এই রহস্যের কেন্দ্রবিন্দু সময় না, বিশ্বাস। আর বিশ্বাস যদি শরীর নেয়, সে শরীর হতে পারে সাপেরও।”

তিন

পরদিন সকালে কুয়াশা কিছুটা সরতেই গগন মাহাতোর ঘরে আবার উপস্থিত হলেন ড. অনিরুদ্ধ ও রোহিনী। গগনের ঘরটা একেবারেই গুহার মতো—ভিতরে কাঠের তাকজোড়া দেয়ালে ঠাসা ধুলো ধরা পুঁথি, কাগজ, আর জীর্ণ তালপত্রে লেখা অস্পষ্ট সংকেত। তার আলো একমাত্র আসে একটি ছোট খোলা জানালা দিয়ে, যার পাশে জ্বলে থাকা কুপি বাতি যেন নিজেই এক নিঃশব্দ প্রহরী। অনিরুদ্ধ আগেই বুঝেছিলেন, এই গগন শুধু একজন স্থানীয় মানুষ নয়—সে এই গ্রামের ইতিহাসের এক জীবন্ত দলিল, শুধু নিজে তা স্বীকার করে না। গগন ধীরে ধীরে এক পুরনো কাঠের বাক্স বের করল। ভিতরে ছিল পাঁচটি ছেঁড়া পাতা, পাতাগুলোর লেখা প্রায় মুছে গেলেও কিছু কিছু প্রতীক দৃশ্যমান—বিশেষ করে ফণিমণির মতো দেখতে সাপের মাথা, গোলচক্রের মাঝে একটি চোখ, এবং তার চারপাশে অদ্ভুত হস্তলিপি। প্রতিটি পাতার পাশে ছিল ক্ষুদ্র নকশা—যার কিছু কিছু দেখতে অদ্ভুতভাবে আধুনিক যন্ত্রপাতির মতো, অথচ তাদের মধ্যে লুকিয়ে আছে বহু পুরাতন প্রত্নধর্ম। রোহিনী হাত বাড়িয়ে একটি পাতা তুলতেই লক্ষ্য করল, তার নিচে লুকানো আছে একটা সোনালি পুঁথির অংশ। স্পর্শ করতেই গগনের গলা ভারী হয়ে উঠল—“এটা আমাদের রক্তের উত্তরাধিকার। আমাদের বংশের পুরুষরা রক্ষা করত এই পুঁথি, আর যে-ই এর সত্যতা জানে, তার জীবন আর নিজের থাকে না। আপনি যদি সত্যিই জানেন কি খুঁজছেন, তাহলে ফিরে যেতে পারেন না, বাবু।”

ড. অনিরুদ্ধ পুঁথির প্রতিটি দিক খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। প্রতিটি পাতায় ব্যবহৃত কালি এবং লিখনের শৈলী দেখে অনুমান করা গেল, এগুলোর বয়স কমপক্ষে দুই থেকে তিন শতাব্দী। কিন্তু আশ্চর্য বিষয় ছিল—এই হস্তলিপিগুলোর মধ্যে ব্যবহৃত ভাষা সম্পূর্ণ কোনও একক লিপির উপর নির্ভর করছে না। এক এক পৃষ্ঠায় সংস্কৃত, পালি, এমনকি হরপ্পার প্রতীকেও কিছু চিহ্ন জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এটা একটি সরল কাহিনি নয়, বরং বহু সভ্যতা ও বিশ্বাসের মধ্যে এক গোপন সেতুবন্ধনের প্রচেষ্টা। গগনের মুখে উঠে এল তার পূর্বপুরুষের গল্প—যে ছিল এক সময় এই অঞ্চলের এক মহাপুরোহিতের সহচর, আর যার দায়িত্ব ছিল ‘নাগদ্বার’ রক্ষা করা। সেই ‘দ্বার’ নাকি খোলে শুধু পূর্ণিমার রাতে, যখন আকাশে নির্দিষ্ট ছায়াপথ প্রতিফলিত হয়। তখনই ‘নাগমণি’ নিজেকে প্রকাশ করে। কিন্তু যারাই সেই আলোকে স্পর্শ করতে চেয়েছে, তারা কেউ আর ফিরে আসেনি। রোহিনী এই গল্প শুনে পুঁথির মাঝে থাকা প্রতীকগুলিকে ক্রমানুসারে সাজাতে শুরু করল। আশ্চর্যভাবে, এই প্রতীকগুলোর বিন্যাসে মেলে একটি চক্রাকার মানচিত্র—যার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে বর্তমান মন্দিরের অবস্থান, আর চক্রের বাইরে রয়েছে সাতটি বিন্দু, যা সম্ভবত “সপ্তনাগ”-এর প্রতিনিধিত্ব করে। “এই সাতটি বিন্দুই হয়তো সাতজন রক্ষক, অথবা সাতটি বলিদানের স্থান,” বলল রোহিনী, চোখে বিস্ময়ের ঝিলিক।

এই আবিষ্কার অনিরুদ্ধকে কাঁপিয়ে দিল। গতকাল পর্যন্ত যে মন্দিরটিকে তিনি নিছক একটি স্থান হিসেবে দেখছিলেন, এখন সেটা এক বিশাল জ্যোতির্বিদ্যার-নির্ভর শক্তিকেন্দ্র বলে মনে হতে লাগল। আর এই পুঁথি তার মূলদ্বার। গগন জানাল, প্রতি পূর্ণিমার আগের দিন এক অদ্ভুত সন্ন্যাসী মন্দিরের পাশ দিয়ে হাঁটে—কালো ধুতি পরা, চোখে ছাইমাখা। গ্রামের লোকেরা তাকে দেখে না বললেই চলে, শুধু যারা ভিতরে ডুবে গেছে এই ‘মণি’র সন্ধানে, তারাই তাকে দেখতে পায়। “সেই মানুষটা কি সত্যিই জীবিত, নাকি সে-ও এই অভিশপ্ত প্রক্রিয়ারই অংশ?” প্রশ্নটা উচ্চারণ করতেই হাওয়ার ঝাপটা কেঁপে উঠল ঘরের কুপি বাতি, আর গগনের চোখে ছায়া নেমে এল। তিনি বললেন—“ও আমাদের দাদুর দাদার সময়েও ছিল। আমি যখন ছোট, তখনো ছিল। হয়তো আপনারা তাকে দেখবেন।” রাতে ফেরার পথে অনিরুদ্ধ আর রোহিনী গ্রামের পথ ধরে হাঁটছিলেন। চারপাশে পেঁজা কুয়াশা, ল্যাম্পপোস্টের আলো প্রায় নিভে গেছে। দূর থেকে মন্দিরের শিখর দেখা যাচ্ছে, তার গায়ে যেন একটা অন্ধ আলো জ্বলে উঠছে। রোহিনী ফিসফিস করে বলল, “স্যার, আপনি বিশ্বাস করেন তো—এই গল্পটা শুধু ইতিহাস নয়?” অনিরুদ্ধ একটু থেমে, সিগারেট ধরিয়ে বললেন—“আমি বিশ্বাস করি, প্রতিটা গল্পই বাস্তব, যতক্ষণ না আমরা তাকে অস্বীকার করি। আর এই মণি… সে নিজেই আমাদের বিশ্বাসকে পরীক্ষা নিচ্ছে।”

চার

ছাতনীডি গ্রামের উত্তরে একটা পুরনো শ্মশানঘাট আছে, যা মানুষ ব্যবহার করে না বহু বছর ধরে। জায়গাটাকে সবাই “নাগঘাট” বলে—সেখানে রাত নামলে কুকুর ঘেউ ঘেউ করে, আর বাতাসের গন্ধে থাকে একধরনের কাঁচা পচা রক্তের মতন গন্ধ, যেটা অনুভবে ধরা যায় কিন্তু ভাষায় ব্যাখ্যা করা যায় না। গগন মাহাতো জানিয়েছিল, শ্মশানঘাটের এক কোণে একটি পুরনো পাথর খচিত ‘নাগচক্র’ রয়েছে, যেটা কেবল পূর্ণিমার রাতে কুয়াশার মধ্যে পরিষ্কার দেখা যায়। এই তথ্য পেয়ে ড. অনিরুদ্ধ ও রোহিনী ঠিক করলেন, তারা রাতে শ্মশান ঘুরে আসবেন। বিপ্লব সিংহ, গ্রামের স্থানীয় থানার অফিসার, এই পরিকল্পনা শুনে একটু অস্বস্তি প্রকাশ করলেও বাধা দিলেন না—বরং বললেন, “যা খুশি করেন স্যার, কিন্তু সাবধানে যান, এই জায়গায় একবার লোক গিয়েছিল, তার কেবল টর্চ পাওয়া গিয়েছিল।” রাত প্রায় ১১টা, দু’জনে টর্চ নিয়ে পৌঁছালেন নাগঘাটে। চারদিকে ঝোপঝাড়ে ঢাকা, অজস্র শুকনো পাতা মাটিতে ছড়িয়ে, আর অন্ধকার যেন গায়ে সেঁটে থাকে। বাতাসে হালকা ধোঁয়া, আর দূরের কোনো শ্মশানবাড়ির চুল্লি থেকে ছড়িয়ে পড়া আগুনের গন্ধ যেন মিলেমিশে তৈরি করছিল এক অজানা আতঙ্ক। টর্চের আলোয় তাঁরা দেখতে পেলেন ভাঙা মাটির স্তূপে চাপা একটি পাথর, যার গায়ে খোদাই করা ফণার মতো সাতটি মুখ—ঠিক যেমনটা গগনের পুঁথিতে ছিল।

হঠাৎ করেই রোহিনী থমকে দাঁড়াল। “স্যার, শুনছেন?” সে ফিসফিস করে বলল। অনিরুদ্ধ কান পেতে শুনলেন—কান্নার মতো কোনো শব্দ, গলা ভাঙা, যেন জলপথে ভেসে আসছে। শব্দটা প্রথমে দূর থেকে আসছিল, তারপর যেন একটানা তাঁদের চারপাশে ঘুরতে লাগল। ঠিক সেই সময় টর্চের আলো ঝাপসা হয়ে এল। বাতাস এক ঝটকায় গা শিউরে দিল। তারপর হঠাৎ—একটা ছায়া, প্রায় মানবাকৃতি, কালো ধুতি পরা, শ্মশানের এক কোণ থেকে ধীরপায়ে হেঁটে গেল। রোহিনী ভয় পেয়ে অনিরুদ্ধর পাশে এসে দাঁড়াল। “ওই তো… ওই ছায়াটা, গগনের বলা সেই লোকটা?” অনিরুদ্ধ কোনোমতে ফিসফিস করে বললেন, “হয়তো। অথবা কেউ আমাদের এই খেলায় জড়িয়ে ফেলছে।” দু’জনে তাকে অনুসরণ করল, ছায়াটা সরু পথ দিয়ে শ্মশানের পাশের বাঁশবনে ঢুকে গেল, কিন্তু যখন তাঁরা পৌঁছালেন, তখন আর কিছুই নেই—শুধু একটা মরা পাতা কুঁচকে যাওয়ার শব্দ। রোহিনী একটা গাছের গুঁড়িতে হাত রাখতেই বুঝল সেটা ঠান্ডা, কিন্তু ভেজা—ঠিক যেন কারও নিঃশ্বাস তাতে জমে আছে। হঠাৎ পায়ের নিচে কিছুর শব্দ, টর্চ ফেলে দিলেন অনিরুদ্ধ। মাটিতে ছিল এক জোড়া চটি, আর রক্তমাখা গামছা—যা অঞ্জলি দেবীর ভাই গোপালের ছিল বলে মনে হলো। এত বছর পর সেই চিহ্ন কি আবার জেগে উঠল? না কি কেউ ইচ্ছে করে রেখেছে?

রাত বাড়ছিল, আর পরিবেশ আরও ভারী হয়ে উঠছিল। দূরে শিয়ালের ডাক, সঙ্গে কোথা থেকে যেন হাওয়ায় ঘূর্ণি উঠে শোঁ শোঁ শব্দ তুলছে। অনিরুদ্ধ হঠাৎ লক্ষ্য করলেন, গামছার পাশে মাটিতে আঁকা আছে একটি বৃত্ত, তার ভেতরে একটি চোখের চিহ্ন। রোহিনী বলল, “এটা সেই চক্রের কেন্দ্রবিন্দু, যা আমরা পুঁথিতে দেখেছিলাম।” পাথরের দিকে তাকিয়ে তারা বুঝতে পারল, শ্মশানের এই জায়গাটাই হতে পারে সেই ‘বলিদানের’ স্থান, যেখান থেকে কিছু শুরু হয়—হয়তো পূর্ণিমার রাতে কেউ এখানে আসে, কাউকে ধরে নিয়ে যায়, বা কেউ নিজেই চলে যায়… অজানা এক টানে। অনিরুদ্ধ সিগারেট ধরালেন—হাত কাঁপছিল, তবুও মুখ শক্ত রাখলেন। “এই জায়গা কোনো শ্মশানের থেকেও গভীর কিছু,” তিনি বললেন। “এখানে ইতিহাস মৃত নয়, বরং ঘুমিয়ে আছে, আর আমরা হয়তো সেই ঘুম ভাঙিয়ে ফেলেছি।” ফিরে আসার সময় তাঁরা কারো পায়ের ছাপ খেয়াল করলেন—তা যেন পেছনের দিকে চলে গেছে, যেন কেউ তাদেরই অনুসরণ করছিল। অথচ ছায়া ছাড়া কেউ ছিল না। শ্মশান পেরিয়ে যখন তাঁরা গ্রামে ফিরলেন, রাত তখন প্রায় তিনটে। কিন্তু গ্রামের বাতাস যেন বদলে গেছে—একটা চাপা শ্বাসের মতো কিছু পেছনে রয়ে গেল, যেন তাদের স্পর্শ করে আবার মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।

পাঁচ

পূর্ণিমার দিন ছাতনীডি গ্রামে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজ করে—যেন গোটা প্রকৃতি নিঃশব্দ প্রতীক্ষায় বসে থাকে কোনো এক অনিবার্য ঘটনার। সকাল থেকেই আকাশ ঝকঝকে হলেও বাতাসে একটা চাপা উৎকণ্ঠা ছিল, যেমনটা মৃত্যুর আগের মুহূর্তে অনুভূত হয়। ড. অনিরুদ্ধ, রোহিনী ও গগন মাহাতো একসাথে গ্রামের বাইরে সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরে গিয়েছিলেন দুপুর নাগাদ, জায়গাটা খালি হলেও চারদিকে পায়ের ছাপ দেখা যাচ্ছিল—তাজা ছাপ, যেন কেউ একাধিকবার ঘুরে গেছে সেই এলাকায়। মন্দিরের ভাঙা স্তম্ভের গায়ে এবার রোহিনী খুঁজে পেল নতুন কয়েকটি প্রতীক—যা আগের নকশার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। সে আঁকতে আঁকতে বলল, “স্যার, এই চিহ্নগুলোর মানে হতে পারে ‘উৎসর্গ’, ‘নাগপথ’ এবং ‘উত্তরণ’। এগুলো যদি সত্যি হয়, তাহলে এই মন্দিরের নিচে একটা প্রবেশপথ আছে।” অনিরুদ্ধ আশ্চর্য হয়ে বললেন, “একটা মন্দির, একাধিক নিখোঁজ, এক গোপন পুঁথি আর এরকম প্রতীক—সব মিলে যাচ্ছে। এমনকি এই প্রবেশপথ যদি সত্যি থেকেও থাকে, তাহলে সেটা সক্রিয় থাকে কেবল বিশেষ সময়ে। হয়তো আজই।” এরই মধ্যে তাঁরা জানতে পারলেন, গ্রামে থাকা এক তরুণ সাংবাদিক সুদীপ হাজরা—যে গোপনে মন্দিরের রহস্য অনুসরণ করছিল, হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গেছে।

সুদীপ গত কয়েকদিন ধরেই গোপনে অনুসন্ধান করছিল। সে নাকি কিছু নতুন তথ্য পেয়েছিল, এমনটাই বলেছিলেন অঞ্জলি দেবী। তবে আজ সকাল থেকে তার ফোন বন্ধ, সে কোথাও নেই। থানার অফিসার বিপ্লব সিংহ জানান, “ওর ফোনে শেষ বার লোকেশন রেকর্ড হয়েছিল মন্দির সংলগ্ন বাঁশঝাড়ের পাশে।” আরেকটা অদ্ভুত বিষয় হল—সুদীপের ড্রোন ক্যামেরার ফুটেজ পাওয়া গেছে, যেটা সে কয়েকদিন আগে চালিয়েছিল। অনিরুদ্ধ ও রোহিনী ফুটেজটা দেখে রীতিমতো স্তম্ভিত। ক্যামেরা প্রথমে উপরের দিক থেকে মন্দির চত্বর দেখাচ্ছে, তারপর হঠাৎই ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল নেমে গিয়ে দেখায়—একটা ছায়ামূর্তি, কালো ধুতি পরে, মাথায় ছাই মাখানো, মন্দিরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সে একবার ঘুরে পিছনে তাকায়, চোখদুটো সরাসরি ক্যামেরায় তাকায়, আর তখনই ক্যামেরা ভেসে ওঠে—ধাঁধা ধরা প্যাচে। “স্যার, এটা কি সেই লোকটা? যে শ্মশানে হেঁটে যাচ্ছিল?” রোহিনী জিজ্ঞেস করল। অনিরুদ্ধ ধীরে বললেন, “এটা সে-ই। একই চেহারা, একই পায়চারি। এই মানুষটা যেন সময়ের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।” সন্ধে নামতেই গ্রামে আবার ছড়িয়ে পড়ে গুজব—কেউ একজন মন্দিরের কাছ থেকে আর্তচিৎকার শুনেছে, কেউ বলেছে তারা দেখেছে মাটির নিচে আলো জ্বলে উঠেছে।

রাত দশটার দিকে, পূর্ণিমার আলোতে গোটা মন্দির চত্বর যেন সাদা কুয়াশায় মুড়ে যায়। ঠিক সেই সময়, গগন মাহাতো জানাল যে তার দাদুর নথিতে লেখা ছিল—“পূর্ণিমার রাতে যখন সাত তারকার ছায়া মাটিতে পড়ে, তখনই ‘নাগদ্বার’ উন্মুক্ত হয়।” রোহিনী তখন জ্যোতির্বিদ্যার কিছু সূত্র বের করে বলল, “আজকের পূর্ণিমা একটি বিরল জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক সংযোগে হচ্ছে—যেখানে ওরিয়ন বেল্টের তিনটি তারা মিলে ঠিক মন্দিরের উপরিভাগে ছায়া ফেলবে।” তারা বুঝতে পারলেন—এটাই সেই রাত, যেটা হয়তো বহু বছর পর আবার এসেছে। অনিরুদ্ধ সিদ্ধান্ত নিলেন, তাঁরা এবার প্রবেশ করবেন মন্দিরের ভিতরের দিকে—যেখানে, হয়তো, সেই ‘নাগমণি’র সন্ধান লুকিয়ে আছে। ঠিক তখনই গগন থামিয়ে বলল—“একবার ঢুকলে, কেউ ফিরে আসে না। আপনাদের আত্মা দৃঢ় তো?” অনিরুদ্ধ বললেন—“ভয় নিয়ে ইতিহাস লেখা যায় না।” তাঁরা টর্চ, ক্যামেরা, আর পুঁথির পাতাগুলো নিয়ে এগিয়ে গেলেন মন্দিরের গা ঘেঁষে। হঠাৎ মাটির নিচ থেকে কেমন একটা শব্দ উঠল—মৃদু গর্জনের মতো, যেন পাথরের কোনো স্তর ধসে পড়ছে। মন্দিরের পেছনে এক গুহার মতো ছোট ছিদ্র, তার মধ্যে বয়ে আসছে শীতল বাতাস—সেই বাতাসে ছিল ধূপ, সাপ, আর মৃত্যুর গন্ধ। “এটাই হয়তো সেই দ্বার,” রোহিনী বলল কাঁপা গলায়। তার চোখে ভয় ছিল, কিন্তু তীব্র কৌতূহলও। আর পেছনে, পূর্ণিমার আলোয়, মন্দিরের ছায়ায় তারা আবার দেখল—সেই কালো ধুতি পরা সন্ন্যাসী, দাঁড়িয়ে আছে স্থিরভাবে, চোখে তীব্র দৃষ্টি। আর সেই মুহূর্তে, হাওয়ার গর্জনে যেন শোনা গেল—“মণি কখনো মানুষের হয় না… শুধু তার কণ্ঠস্বর শোনা যায়।”

ছয়

পূর্ণিমার আলোয় ছাতনীডি গ্রামের সেই প্রাচীন মন্দির যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ড. অনিরুদ্ধ, রোহিনী ও গগন মাহাতো মন্দিরের পেছনে ছোট একটি অন্ধকারমুখী গুহামুখ দেখতে পেলেন, যা সাধারণ চোখে ধরা পড়ে না, কিন্তু পুঁথির মানচিত্র অনুযায়ী সেখানেই লুকানো রয়েছে প্রবেশপথ। ছোট খাটো হলেও মুখে জমে থাকা শ্যাওলা ও গায়ে খোদাই করা প্রতীকগুলো স্পষ্ট বলে দিচ্ছিল—এটা প্রকৃতপক্ষে কোনো প্রাকৃতিক গুহা নয়, বরং ইচ্ছাকৃতভাবে নির্মিত। ভিতরে প্রবেশ করতেই তাদের টর্চের আলো ধরা পড়ল একটি সরু সিঁড়িতে, যা মাটির গভীরে চলে গেছে। সেই সিঁড়ি ভেজা, পাথরের—প্রতিটি ধাপ যেন বহু শতাব্দীর ধুলোর ভারে থেমে আছে। চারদিকে নিস্তব্ধতা এতটাই গভীর যে, নিজেদের নিঃশ্বাসও যেন অপরাধের মতো শোনায়। নিচে নামার সময় বাতাস ক্রমে ঠান্ডা হতে লাগল—কেবল ঠান্ডা নয়, তাতে একটা অদ্ভুত ধাতব গন্ধ, যার মধ্যে সাপের গা ছোঁয়ার শীতলতা মিশে আছে। ২০-২৫ ধাপ নামার পর তাঁরা দাঁড়ালেন একটি খোলামেলা কুঠুরিতে, যেখানে চারদিকে অর্ধচন্দ্রাকার প্রাচীন স্তম্ভ, প্রতিটির মাথায় খোদাই করা রয়েছে ফণা তোলা সাপ। মাঝখানে একটি গোল মেঝে, যেখানে কুঠারের মতো ধাতব প্রতীক বসানো, আর তার চারপাশে ছড়িয়ে আছে জ্বালানো ধূপদানের ভস্ম।

রোহিনী হাঁটু গেঁড়ে মেঝের প্রতীকগুলো পরীক্ষা করতে লাগল। “এই প্রতীকগুলো বৌদ্ধ ও নাগসাধকদের মধ্যেকার মিশ্র সংস্কৃতির ইঙ্গিত দেয়,” সে বলল। “মধ্যযুগে এমন কিছু সাধক ছিল যারা সর্পশক্তিকে জ্ঞান ও আত্মোত্থানের প্রতীক হিসেবে মানত। সম্ভবত এই মেঝেটিই সেই ‘বলিদান চক্র’, আর তার নিচেই লুকিয়ে আছে ‘নাগমণি’।” অনিরুদ্ধ চারপাশের দেওয়াল পরীক্ষা করতে গিয়ে আবিষ্কার করলেন—প্রতিটি দেয়ালে খোদাই করা গল্পের দৃশ্য। একটিতে দেখানো হয়েছে, একজন মানুষ এক ফণিমণিকে অর্পণ করছে কিছুর জন্য; অন্যটিতে, একজন পুরোহিত এক শিশুকে সাপের সামনে রেখে তার কপালে হাত রাখছে। সম্ভবত এগুলোই সেই রহস্যময় ‘জীব-অর্পণ’ প্রথার চিত্ররূপ। হঠাৎ গগন চিৎকার করে উঠল—তার পা মাটির নিচে দেবে গেছে, আর সেই জায়গা থেকে উঠে এল ধোঁয়া ও গন্ধ, যেন কিছু দীর্ঘদিন আটকে ছিল ভিতরে। তারা মাটি সরিয়ে পেল এক আয়তাকার পাথরের ফলক, যেটা তুলতেই দেখা গেল—নিচে রয়েছে একটি ছোট ঘর, তার মাঝখানে একটি মঞ্চ, আর সেই মঞ্চের ওপর—একটা উজ্জ্বল সবুজাভ পাথর, যেটা কোনো বাহ্যিক আলো ছাড়া নিজেই আলো ছড়াচ্ছে। “এটাই… এটাই ‘নাগমণি’,” রোহিনী স্তম্ভিত কণ্ঠে বলল।

কিন্তু তারা যতই এগোতে যায়, কুঠুরি কাঁপতে থাকে—মৃদুভাবে নয়, যেন মাটির নিচে কিছু একটা শ্বাস নিচ্ছে। পেছনে গুহামুখ থেকে হাওয়ার প্রবাহ ঠান্ডা হয়ে যায়, আর সেই হাওয়ায় আবার ভেসে আসে সেই গলার শব্দ—“মণি কখনো মানুষের হয় না…।” হঠাৎ আলো নিভে যায়, কেবল মণির নরম সবুজ আলো টিমটিম করে জ্বলতে থাকে। সেই আলোয় তাঁরা দেখতে পান, মঞ্চের চারপাশে ফণা তোলা কয়েকটি সাপ, নিঃশব্দে কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে আছে—চোখদুটো আলোয় ঝিকমিক করছে। গগন থরথর করে কাঁপছিল, কিন্তু অনিরুদ্ধ ধীরপায়ে এগিয়ে গেলেন, মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে। তিনি চোখ বন্ধ করে পুঁথির মন্ত্র উচ্চারণ করতে শুরু করলেন—একটি জ্যোতিষচক্রভিত্তিক মন্ত্র, যেটা গগনের পুঁথির শেষ পাতায় লেখা ছিল। ধীরে ধীরে সাপগুলো সরে গেল, যেন তারা সেই শব্দে শান্ত হয়েছে। অনিরুদ্ধ হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করলেন ‘নাগমণি’—অবর্ণনীয় অনুভূতি হল, যেন তার চেতনা ছড়িয়ে পড়ছে, একটি কাচের দেয়ালের ভেতর দিয়ে পৃথিবীর অতীত ও ভবিষ্যৎ উঁকি দিচ্ছে। তার মনে হতে লাগল, সে একসঙ্গে হাজার বছর আগের বলিদান দেখছে, আর ভবিষ্যতের সেই সময়ও, যেখানে কেউ আবার এই দ্বার খুলবে। পাথরের গভীর থেকে যেন একটা কণ্ঠ ভেসে এলো—“তুমি শুধু দর্শক, অধিকারী নও। ফিরে যাও, নয়তো থেকে যাও—চিরকাল।”

সাত

নাগমণি স্পর্শ করার মুহূর্তে ড. অনিরুদ্ধ যেন আর নিজের মধ্যে ছিলেন না। চোখ বন্ধ করতেই তাঁর চারপাশে বাস্তব জগতের দেয়াল ভেঙে পড়তে লাগল। সেই অন্ধকার কুঠুরির মাটি, স্তম্ভ, সাপের ফণা—সবকিছু মিলিয়ে যেন একটা শক্তিশালী চেতনার প্রবাহ তাঁর মনে ঢুকে গেল। একটা সাদা আলোয় ডুবে তিনি দেখতে পেলেন—একটি পুরনো সভ্যতা, ধবংসপ্রাপ্ত নয়, বরং প্রাণচঞ্চল, এক পুরোহিতের নির্দেশে মানুষরা মাটির নিচের এই উপাসনাকেন্দ্রে সমবেত হয়েছে। তাদের সামনে মঞ্চে রাখা আছে সেই জ্বলজ্বলে সবুজ পাথর—‘নাগমণি’। কিন্তু কেউ পাথর ছুঁচ্ছে না। পুরোহিত এক হাতে এক শিশুকে ধরে আছে, আর অন্য হাতে একটি ধাতব যন্ত্র—যার প্রতিকৃতি অনিরুদ্ধ আগেই পাথরের খোদাইয়ে দেখেছেন। শিশুটির কপালে ছোঁয়া দিতেই, সে হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যায়, আর মণির আলো দ্বিগুণ হয়ে ওঠে। লোকেরা করজোড়ে প্রণাম করে। সেই মুহূর্তে তিনি বুঝতে পারলেন—এই ‘নাগমণি’ কেবল কোনও পাথর নয়, এটি একধরনের ‘সচেতন শক্তি’। এটি নিজেই স্মৃতি ধরে রাখে, সময়ের পরম্পরায় নিজের ইচ্ছায় কিছু মানুষকে ডেকে নেয়, আর কিছু স্মৃতি ফিরিয়ে দেয়। হঠাৎ দৃশ্য বদলে গেল—এবার তিনি দেখলেন এক সন্ন্যাসী, কালো ধুতি পরা, কপালে ভস্মের রেখা, মঞ্চে বসে মণির সামনে ধ্যানস্থ। সে যেন কারও জন্য অপেক্ষা করছে। তার পাশে পড়ে আছে কয়েকটি রক্তমাখা বস্তু—চটি, গামছা, একটা ভাঙা লণ্ঠন। সেই একই চিহ্ন, যেগুলো তাঁরা শ্মশানে পেয়েছিলেন।

অনিরুদ্ধর মনে হল, তিনি এখন শুধু সময় নয়, চরিত্রও হয়ে উঠছেন—কখনও সেই পুরোহিতের দৃষ্টিতে দেখছেন, কখনও সন্ন্যাসীর মনে প্রবেশ করছেন। আর তখনই তিনি বুঝতে পারলেন, এ কেবল ইতিহাস নয়, এ এক পুনরাবৃত্তি। মণি নিজে সময়কে ঘুরিয়ে আনে, বারবার, যতক্ষণ না তার ‘উপযুক্ত অধিকারী’ তার কাছে পৌঁছায়। এবং এই অধিকারী নির্বাচিত হয় না—সে ধরা পড়ে যায়। “আপনি তো নিজেই চলে এসেছেন,” কানে ভেসে এল সেই সন্ন্যাসীর কণ্ঠস্বর। চোখ মেলে অনিরুদ্ধ দেখলেন—তিনি এখন আবার মঞ্চে দাঁড়িয়ে, কিন্তু তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই একই মানুষ, যাকে তিনি শ্মশানে দেখেছিলেন, আবার ফুটেজেও। তাঁর চোখদুটো যেন কাচের মতো, ভিতরে কিছুই নেই, অথচ সবকিছু দেখতে পাচ্ছে। “তুমি যদি ফিরে যেতে চাও, এখনই যাও। কিন্তু যদি থেকে যাও, তুমি মণির অংশ হয়ে যাবে,” সেই কণ্ঠ বলল। হঠাৎই আলো নিভে গেল। চারপাশে আবার কুয়াশা, ঠান্ডা হাওয়া। আর অনিরুদ্ধ বুঝতে পারলেন, তিনি এখনও স্পর্শ করে আছেন সেই পাথরটিকে—কিন্তু সময় পেরিয়ে গেছে অনেকটা। পেছনে রোহিনীর ভয়মিশ্রিত গলা শোনা গেল, “স্যার! আপনি ঠিক আছেন তো?” অনিরুদ্ধ ধীরে বললেন—“আমি অতীত দেখে এলাম। আর মনে হচ্ছে, আমাদের ভবিষ্যৎ ওখানেই লেখা আছে।”

তারা দ্রুত ফিরে এল সেই গুহা থেকে। সাপগুলো আর পথ আটকে ছিল না, যেন তাদের কাজ শেষ। উপরের পৃথিবীতে ফিরে আসতে আসতে তারা বুঝতে পারল, প্রায় তিন ঘণ্টা কেটে গেছে—কিন্তু তাদের মনে হয়েছিল, এটা মাত্র কয়েক মিনিট। গগনের মুখ শুকিয়ে গেছে, সে বলল, “আপনারা বেরোতে পেরেছেন, এটাই সবচেয়ে অস্বাভাবিক। কেউ ফিরে আসে না।” অনিরুদ্ধ তখন পুঁথির শেষ পাতাটার দিকে তাকালেন—সেখানে একটা খালি বৃত্ত আঁকা, যার চারপাশে লেখা: “যে দেখে, সে আর আগের মতো থাকে না। যে থাকে, সে আর ফিরে যায় না।” রোহিনী ধীরে বলল, “আমরা কি তাহলে এখন নিজেরাই মণির এক অংশ?” অনিরুদ্ধ হাসলেন না, মাথা নোড়ালেন। “সম্ভব। কারণ এই রহস্য শুধু ইতিহাস নয়, এ এক আয়না, যেখানে অতীত, ভবিষ্যৎ আর বর্তমান একসাথে ধরা পড়ে। আর এই আয়নায় একবার চোখ রাখলেই, মানুষ আর আগের মতো থাকতে পারে না।” তখনই তাঁরা শুনতে পেলেন, নিচে কেউ আর্তচিৎকার করছে। গগন বলল, “আরও কেউ ঢুকে পড়েছে। হয়তো সেই সন্ন্যাসী আবার কাউকে ডেকেছে।” আর তখনই মনে পড়ল—সুদীপ হাজরা এখনও নিখোঁজ। হয়তো তিনিই এখন সেই আয়নার অন্য পারে—এক নতুন চক্রের শুরুতে।

আট

রাত গভীর হলেও ছাতনীডি গ্রামে ঘুম নেই। গগনের বাড়ির আলো জ্বলছিল, আর তিনজনে বসে ছিল মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা সেই পুরনো পুঁথির চারপাশে। বাইরে হালকা বৃষ্টি শুরু হয়েছে, যেন আকাশও গোপনে কাঁদছে। অনিরুদ্ধ চুপচাপ বসে ছিলেন, চোখে ক্লান্তির চেয়ে বেশি একটা ভেতরের দহন। রোহিনী তার সামনে এসে বলল, “স্যার, আমাদের ওখানে ফেরা উচিত না?” অনিরুদ্ধ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, “ফিরে যেতে হবে, কারণ মণি আমাদের ডাকে না—সে বেছে নেয়। আর যাকে সে নেয়, সে থেকে যায়। কিন্তু কেউ যদি নিজে থেকে চলে আসে, তাহলে চক্র ভাঙে।” গগন তখনি বলল, “আমরা তাহলে সুদীপকে খুঁজব?” অনিরুদ্ধ মাথা নাড়লেন। “খুঁজতে হবে, কারণ যদি সে ফিরে আসে নিজে ইচ্ছায়, তাহলে এই প্রাচীন অভিশাপের চক্রে একটা ছেদ তৈরি হবে।”
পরদিন সকালবেলায়, পঞ্চায়েত অফিস থেকে খবর এল—গ্রামের উত্তর-পূর্ব প্রান্তের খড়ের মাঠে কেউ একজন অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। তাঁরা ছুটে গিয়ে যা দেখলেন, তা সম্পূর্ণরূপে তাদের ধারণাকে চূর্ণ করে দিল।

সুদীপ হাজরা মাটিতে পড়ে আছে—চোখ খোলা, কিন্তু দৃষ্টি ফাঁকা। তার গায়ে কাদা লেগে আছে, জামা ছেঁড়া, হাতে আঁচড়ের দাগ, কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর—তার ডান হাতের তালুতে খোদাই হয়ে আছে একটি ছোট্ট চক্রচিহ্ন, সেই ‘নাগচক্র’। সে কথা বলছিল না, নড়ছিল না, শুধু একভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। অনিরুদ্ধ তার কপালে হাত রাখলেন, সর্দি নেই, কিন্তু শরীর জ্বলন্ত গরম। রোহিনী তার পাশে বসে ধীরে ধীরে বলল, “সুদীপ, তুমি আমাকে চিনতে পারছো?” ছেলেটি কিছু বলল না, শুধু একটা শব্দ ফিসফিস করে বলল—“আয়না…।” গগন ভয়ে থেমে গেল। “স্যার,” সে বলল, “এই ছেলেটা মণির আয়নায় কিছু দেখেছে। হয়তো তার নিজের ভবিষ্যৎ, হয়তো আমাদের সকলের অতীত।” তাঁরা সুদীপকে গগনের ঘরে নিয়ে এলেন, কিছু সময় পর ধীরে ধীরে তার চেতনা ফিরতে শুরু করল। সে খুব ধীরে বলল, “আমি গিয়েছিলাম মন্দিরের পিছনে, ওখানে একটা আওয়াজ ডেকেছিল আমাকে। তারপর আমি পড়েছিলাম… আর যেন একটা ঘোরে চলে যাই। আমি দেখতে পাই একটা বিশাল ফণা, আর আমার চারপাশে মানুষ নেই, কেবল আলো, আর আমার গায়ের ছায়া।”

সুদীপ যা বলল, তা ছিল পাথরের মতো কঠিন। “আমি দেখি, আমি সেখানে দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু আমি একা না। আমার মতো আরেকটা আমি, আর তার চোখ দুটো কেবল আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি পালাতে চাই, কিন্তু তার চোখে আমি আটকে যাই। তারপর হঠাৎ আমি বুঝি, আমি বাইরে থেকে নয়, ভিতর থেকে তাকাচ্ছি নিজেকেই। আমি সেই আয়নায় নিজেকে হারিয়েছি।” অনিরুদ্ধ তখন বুঝতে পারলেন, ‘নাগমণি’ শুধু অতীত নয়, ভবিষ্যতের দরজাও খুলে দেয়—তবে সেটা সময়ের ধারাবাহিকতা ধরে নয়, বরং একটি মানসিক প্রতিফলনের মাধ্যমে। যে আয়নায় মানুষ নিজের গভীরতম ভয়, বাসনা, এবং নিয়তি দেখতে পায়। রোহিনী বলল, “স্যার, যদি এই মণি সত্যি নিজস্ব চেতনা রাখে, তবে এটি নির্দিষ্ট কাউকে বেছে নেয় না, বরং তাকে কাছে টানে যে নিজের মধ্যেই হারিয়ে যেতে চায়।” তখন অনিরুদ্ধ মৃদু হেসে বললেন, “তাহলে আমরাই কি আগামী নিখোঁজ?” সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। এক মুহূর্তে যে অনুভব হলো, তাদের উপস্থিতি, তাদের চেতনা, এবং এই গবেষণার নেশা—সব মিলিয়ে তারা হয়তো সেই চক্রের মধ্যেই হাঁটছে। ঠিক তখন বাইরে আকাশ ফেটে বৃষ্টি নামে, আর গগনের কুপি বাতি নিভে যায় হঠাৎ। তাদের ঘরে তখন শুধু একটাই আলো—নাগমণির রংধনুর মতো সবুজ ছায়া, যা মেঝেতে রেখে যাওয়া পাথরের পৃষ্ঠ থেকে ছড়িয়ে পড়ছে নিঃশব্দে।

নয়

বৃষ্টিভেজা সেই সকাল যেন অস্বাভাবিকভাবে দীর্ঘ লাগছিল। গগনের কুটিরে সুদীপ নিঃশব্দে শুয়ে আছে, তার চোখ বন্ধ, কিন্তু নিশ্বাস অসম। চারদিকে একটা অজানা ভার ছড়িয়ে আছে—যেন আকাশও বুঝতে পারছে, মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা প্রাচীন কোনো অভিশাপ এবার জেগে উঠেছে। অনিরুদ্ধ মণির চারপাশে একটি বৃত্ত এঁকে তা পুঁথির নির্দেশ অনুযায়ী ঢেকে দিলেন একটি কাপড়ে। রোহিনী ধীরে ধীরে তার ডায়েরিতে লিখে চলেছিল প্রতিটি ঘটনার লিপিবদ্ধ রূপ—কিন্তু প্রতিটি শব্দ লেখার সময়ই তার মনে হচ্ছিল, যেন কোনো অদৃশ্য চোখ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। গগন হঠাৎ গলা নিচু করে বলল, “আমার দাদুর একটা কথা মনে পড়ে যাচ্ছে… তিনি বলতেন, মণির কাছে গেলে তার কণ্ঠ শুনতে পাওয়া যায়। কিন্তু যে তার সত্য কণ্ঠ শুনে ফেলে, সে আর কখনো নিজের কণ্ঠে কথা বলতে পারে না।” অনিরুদ্ধ একমুহূর্তে থেমে গিয়েছিলেন, তাঁর মনে পড়ছিল সেই মুহূর্ত—যখন তিনি মণির কাছে নিজের আত্মাকে ভেসে যেতে দেখেছিলেন। তার পর থেকে যেন তাঁর মধ্যে কিছু বদলে গেছে, সিগারেটের টানেও আর সেই আরাম নেই, কথা বলার গলাতেও কোথাও যেন কাঁপুনি জমে আছে।

ঠিক দুপুর নাগাদ, হঠাৎ সুদীপ উঠে বসল। চোখের দৃষ্টি সোজা সামনের দেয়ালে, ঠোঁট নড়ে, কিন্তু কথা নেই। সে ধীরে ধীরে বলল, “সে আসছে।” সবাই থমকে গেল। “কে?” রোহিনী ফিসফিস করল। সুদীপ উত্তর দিল না, কিন্তু তার হাত আবার কাঁপতে লাগল। তখন গগন ঘরের দরজা খুলে বাইরে তাকাল, আর দাঁড়িয়ে রইল স্থিরভাবে। সামনের মাঠে একটা ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছিল ধীরে ধীরে। কেউ বলতে পারছিল না সে মানুষ, না অন্য কিছু—তবে গগন ফিসফিস করে বলল, “ওই লোকটাই… যাকে আমার দাদু বলতেন ‘নাগসেবক’। ও কখনো বৃদ্ধ হয় না, কখনো মরে না, শুধু অপেক্ষা করে—নতুন কারো জন্য, যাকে মণির অভিশাপ সে হস্তান্তর করবে।” ছায়ামূর্তি মাটিতে পড়া জল এড়িয়ে আসছিল, যেন তার পদচিহ্ন মাটি ছোঁয় না। অনিরুদ্ধ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে গেলেন, হাতে পুঁথির এক পাতা, আর তার মুখে একটা প্রাচীন মন্ত্রের গুঞ্জন। ছায়ামূর্তিটি বাড়ির কাছে এসে থেমে গেল। তার চোখ দুটি চকচক করছিল, যেন সময়ের বাইরে এক স্থির দৃষ্টি। সে কিছু বলল না, শুধু ডান হাত তুলল, আঙুলের মাথায় একটি অদ্ভুত কালো দাগ। ঠিক সেই সময় রোহিনী বুঝে ফেলল—এই দাগটা একইভাবে পুঁথির চতুর্থ পাতায় ছিল, যেটা বলা হয় “অভিশপ্ত স্পর্শ”—যার ছোঁয়া লাগে, তার আত্মা মণির মালিকানা হয়ে যায়।

ছায়ামূর্তিটি হঠাৎ বলল, “তোমরা ওকে জাগিয়ে তুলেছো। এখন সে আবার নতুন পথ খুঁজবে। এখন কেউ একজন থাকা চাই… যাকে সে গ্রহণ করবে।” অনিরুদ্ধ চুপচাপ বললেন, “আমরা কিছু চাইনি। আমরা কেবল সত্য খুঁজতে চেয়েছি।” ছায়ামূর্তি মাথা নেড়ে বলল, “সত্য কখনো নিঃস্বার্থ হয় না। তোমরা চেয়েছো খ্যাতি, ইতিহাস, চিরস্থায়ী চেতনা। আর মণি তা দিতে পারে—কিন্তু বিনিময়ে সময় নিতে হয়, আত্মা নিতে হয়।” হঠাৎই বাতাস থেমে গেল। মেঝেতে রাখা সেই কাপড়ে মোড়া মণি নিজে থেকেই কেঁপে উঠল। কাপড় সরে গিয়ে মণির ভিতরের সবুজ আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল, আর সেই আলোয় যেন ছায়ামূর্তির শরীর কুয়াশায় মিশে যেতে লাগল—ধীরে ধীরে, নিঃশব্দে। তখন অনিরুদ্ধ অনুভব করলেন, তাঁর ভিতরের কোথাও কিছু কাঁপছে। মাথার ভেতরে কেউ যেন বলছে, “তুমি পারবে না ফেরত যেতে। তুমি জেনে গেছো, দেখেছো, এবং জেগে উঠেছো।” সেই মুহূর্তে, সুদীপ ধীরে উঠে এসে মণির সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি থাকব। আমি এই চক্র ভাঙতে চাই।” সবাই স্তব্ধ। মণি তখন তীব্র আলো ছড়িয়ে আবার স্তব্ধ হয়ে গেল। আর ছায়ামূর্তিও মিলিয়ে গেল আকাশের আলোয়।

দশ

ছাতনীডির আকাশ আজ নিঃসঙ্গ, যেন কোন মহাশক্তির গর্জনের পর নিস্তব্ধতা ফিরে এসেছে। মেঝেতে স্থিরভাবে রাখা ‘নাগমণি’ আর কোনো আলো ছড়াচ্ছে না, অথচ সবাই অনুভব করছিল, তার ভেতরে এক বিশাল শক্তি ঘুমিয়ে আছে, অপেক্ষায় আছে ‘শেষ বলিদান’-এর। সুদীপ মঞ্চের মতো কাঠের খাটের ওপর বসে ছিল, চোখে অদ্ভুত স্থিরতা, ঠোঁটে কোনো ভয়ের ছাপ নেই। সে বলেছিল—”আমি থাকব”, কিন্তু তার মুখে সেই সময় যেন নিজের নয়, কারও অন্য কণ্ঠস্বর ছিল। অনিরুদ্ধ ও রোহিনী পাশে বসে ছিল চুপচাপ। গগন তখন পুঁথির শেষ পৃষ্ঠায় চোখ রাখছিল, যেখানে লেখা ছিল:
“যদি কেউ স্বেচ্ছায় আত্মা উৎসর্গ করে, তবে মণি বিশ্রামে যায় শত বর্ষের জন্য। না হলে সে নিজেই বেছে নেয়, আর অভিশাপ অনন্তকাল ঘোরে।”

রোহিনী ধীরে ধীরে বলল, “স্যার, ও কি মরতে চায়?”
অনিরুদ্ধ কিছু বললেন না, চোখ বন্ধ করে মাথা নিচু করে রাখলেন। সুদীপের দিকে তাকালে বোঝা যেত না সে ভয় পাচ্ছে না, না কী জেগে থেকে কোনো অনন্ত ঘুমে প্রবেশ করছে। হঠাৎ মেঝেতে রাখা নাগমণি আবার হালকা করে কাঁপল। ঘরের বাতাস ভারী হয়ে এল, এক অদ্ভুত গন্ধ—ধূপ, সাপের গায়ে মাটি লেগে থাকার গন্ধ, আর তার সঙ্গে এক অবর্ণনীয় পচা রক্তের ঘ্রাণ। বাতাস ধীরে ধীরে ঘুরতে লাগল, যেন কারও নিঃশ্বাস এ ঘরে ঢুকে পড়েছে। ঠিক তখনই, পেছনের জানালায় আবার সেই ছায়া—ফণা তোলা, দাঁড়িয়ে আছে স্থিরভাবে। গগন উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠল, “ও এসেছে… শেষ বারের জন্য… বলিদান নেওয়ার জন্য।”
রোহিনী তখন হঠাৎ বলল, “কিন্তু বলিদান যদি জ্যান্ত না হয়ে আত্মিক হয়?”
অনিরুদ্ধ চমকে তাকালেন। “মানে?”
“মানে,” রোহিনী বলল, “সুদীপ যদি মনের ভিতরে নিজেকে মণির কাছে উৎসর্গ করে, তার দেহ নয়—তাহলে হয়তো অভিশাপ ঘুমিয়ে যাবে, এবং সুদীপ বেঁচে থাকতে পারবে। কিন্তু মণির মধ্যে সে থাকবে—চিরকাল।”

সুদীপ হঠাৎই বলল, “আমি প্রস্তুত। আমাকে হাত ধরতে বলেছে।”
সে নাগমণির পাশে গিয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসে, এবং তার ডান হাত মণির ওপর রাখে। সেই মুহূর্তে ঘরের সব আলো নিভে যায়। পেছনের জানালার ছায়া এগিয়ে আসে সামনে, এক হাতে সে ছুঁয়ে দেয় সুদীপের কপাল। তখন এক ঝলকে সেই ছায়া উজ্জ্বল হয়ে ওঠে—সুদীপের মুখে আসে এক প্রশান্তি, যেন সে ঘুমিয়ে পড়ছে খুব গভীর কোনো বর্ণহীন স্বপ্নে। বাতাস স্থির হয়ে আসে। গগন ফিসফিস করে বলে, “বলিদান সম্পন্ন।”
তারপর নাগমণির আলো নিভে যায়। ছায়ামূর্তি মিলিয়ে যায়, আর চারদিক নিঃশব্দ।
সুদীপ ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায়। সে বেঁচে আছে। কিন্তু তার চোখের গভীরে আর আগের সেই ছেলেটা নেই—কোথাও যেন এক পুরনো কালপুরুষ বসে আছে ভিতরে।

পরদিন সকালে, অনিরুদ্ধ সেই পুঁথির পাতাগুলো জ্বালিয়ে দেন। রোহিনী জিজ্ঞেস করেছিল, “আপনি সব পুড়িয়ে ফেলছেন?”
উত্তরে অনিরুদ্ধ শুধু বলেছিলেন, “কিছু জিনিস ইতিহাসের পাতায় থাকা ভালো, মানুষের চেতনায় নয়।”
সুদীপ আবার স্বাভাবিক হয়ে ফিরে যায় কলকাতায়। সে লিখে ফেলে একটি প্রবন্ধ, “The Serpent Mirror” নামে, যেখানে সে ইঙ্গিতমাত্র দেয় তার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে, কিন্তু কারও নাম নেয় না, জায়গাও উল্লেখ করে না। গগন আবার ফিরে যায় তার নির্জন জীবনে, আর মন্দির চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
তবে কাহিনি এখানেই শেষ হয় না।

শেষ দৃশ্য—এক শত বছর পরে, কোনও এক গবেষক, পুরুলিয়ার জঙ্গলে ঘোরার সময় এক ভাঙা শিবমন্দির খুঁজে পায়। সেখানে, এক পুরনো পাথরের ওপর খোদাই করা একটা সবুজ চোখ ঝিলমিল করে উঠেছিল একবার, তারপর নিঃশব্দে মিলিয়ে যায়।

“নাগমণি” আবার অপেক্ষায় থাকে—পরবর্তী বলিদানের।

[সমাপ্ত]

1000036354.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *