Bangla - প্রেমের গল্প

তোমার অপেক্ষায় কাশফুল

Spread the love

সৌমিতা বিশ্বাস


অধ্যায় ১:

বছর দশেক পর গ্রামে ফিরলো জয়ন্ত। কলকাতার কোলাহল আর ক্লান্ত শ্বাসের শহর থেকে শরতের এক হিমেল সকালে সে যখন লোকাল বাসে চেপে নামল, তখন মাথার ওপর আকাশ যেন ঢেলে দিয়েছে শিশিরভেজা কাশফুলের রাজ্য। বাসস্ট্যান্ডের পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা সেই পুরনো বটগাছটা দেখে বুকের মধ্যে কিছু একটা ধক করে উঠল — অনেকদিন আগে যেখানে দাঁড়িয়ে কুসুম তার স্কুলব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বলেছিল, “একদিন তুমি যদি চলে যাও জয়ন্ত, আমি কিন্তু ঠিক এই গাছটার নীচে দাঁড়িয়ে তোমার অপেক্ষা করব।” সময় তার কাজ করেছে — গাছটা আজও আছে, তবে তার নিচে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেবেলার কুসুম নেই। গ্রামের মাটিতে নামার সঙ্গে সঙ্গে এক আশ্চর্য নীরবতা এসে জয়ন্তর মনকে আচ্ছন্ন করে দিল — চারপাশে কেউ নেই, শুধু বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে কাশফুলের ডালগুলো, আর দূরে দেখা যাচ্ছে ধানক্ষেতের সোনালি প্রান্তর। হাঁটতে হাঁটতে সে স্কুলের দিকটায় গেল, সেই পুরনো মাটির রাস্তা দিয়ে, যার একদিকে ছিল বাঁশঝাড়, আর অন্যদিকে জোৎস্নায় রূপ নিতো পুকুরপাড়। মনে পড়ল, স্কুলে শেষ দিন ছিল শরৎকাল, তখনও এমনই কাশফুল ফুটেছিল। কুসুম বলেছিল— “তুই শহরে চলে যাচ্ছিস, ঠিক আছে, কিন্তু কাশফুলের মতো ভুলে যাস না আমায়।” সে হেসেছিল, কিছু বলেনি, কারণ তখনকার জয়ন্ত ভাবত ভালোবাসা আসলে সিনেমার ব্যাপার, জীবনে তার কাজ নেই।

চায়ের দোকানে গিয়ে বসল সে, গণেশ কাকার দোকান — আগের মতোই কুঁড়ে ঘরের চালে পাটকাঠি, কাপে এখনো জলসিদ্ধ চা, কিন্তু মুখগুলো অনেকটাই বদলে গেছে। কেউ চিনল, কেউ চিনল না। “এই যে জয়ন্ত!”— পিছন থেকে ডাক শুনে ঘুরে দাঁড়াল সে। কাঁধে ঝোলা, শাড়ি পরা এক যুবতী মেয়ে — চোখে ঝিলমিল হাসি, কিন্তু গলার স্বরে এক মিশ্র অনুভূতির টান। কুসুম। হ্যাঁ, তাকেই দেখতে ঠিক এমনই কল্পনা করেছিল জয়ন্ত — বছর দশেক আগের সেই ছেলেমানুষী চোখ, এখন অনেক পরিণত, অনেক শান্ত, তবু ভেতরে কোথাও যেন ঝাঁপসা অভিমান। দুজন দাঁড়িয়ে, কথার কোনো হড়বড়ানি নেই, শুধু চোখে চোখ রেখে সেই পুরনো দিনগুলো যেন ফিরে এল। “তুই বদলায়নি,” বলল কুসুম। জয়ন্ত হেসে বলল, “তুই তো হয়েছিস একদম মাস্টারমশাই।” কুসুম বলল, “না, এখন তো আমি মাস্টারম্যাডাম। ওখানে আমাদের স্কুলঘর, এখনও সকাল আটটায় ঘণ্টা বাজে।” কথার ফাঁকে মাঝে মাঝেই বাতাসে কাশফুল নড়ে উঠছে, যেন তাদের মুখোমুখি কথোপকথনে আড়াল থেকে সম্মতি দিচ্ছে। চায়ের কাপ শেষ হলে তারা হাঁটতে লাগল— পুরনো রাস্তায়, সাথের নীরবতাটাও যেন অনেক চেনা। পুকুরপাড়ের সেই জায়গাটায় গিয়ে দাঁড়াল তারা, যেখানে আগে কাগজের নৌকো ভাসাতো, কিংবা জলকাদা নিয়ে মারপিট। কুসুম বলল, “তুই তো আর চিঠি লিখিসনি, ফোনও করোনি।” জয়ন্ত একবার চোখ নিচু করে বলল, “তোর কোনো ঠিকানাই তো ছিল না কুসুম… তোর খোঁজ নেওয়ার সাহসও হয়নি।” কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকেও তারা কিছু বলেনি, কারণ অনেক কথা হয়তো চুপ থেকেও বলা যায়।

সন্ধ্যে নামছিল ধীরে ধীরে। আকাশে গোলাপি ছায়া, আর দূর থেকে ভেসে আসছে ঢোলের আওয়াজ — পুজোর প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে গ্রামের কালীমন্দিরে। জয়ন্ত হাঁটতে হাঁটতে স্কুলের পুরনো ভবনের দিকে গেল। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রোদ গায়ে মেখে বসে থাকা বাচ্চাদের দেখে মনের মধ্যে অদ্ভুত প্রশান্তি এল। কুসুম ভিতরে পড়াচ্ছে— তার গলায় সেই পুরনো ছন্দ, অথচ এক দৃঢ়তা, যা শহুরে মেয়েদের মধ্যে কদাচ দেখা যায়। জয়ন্ত জানত না কিভাবে বলবে— “আমি তো তোকেই খুঁজতে এসেছি।” সে শুধু বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে তার ক্লাস শেষের অপেক্ষা করল। ক্লাস শেষে কুসুম বেরিয়ে এসে বলল, “চল, তোর জন্য ডায়েরিটা রেখে দিয়েছি।” জয়ন্ত অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কি ডায়েরি?” কুসুম ব্যাগ থেকে একটা পুরনো খাতা বের করে বলল— “তুই চলে যাবার পর, প্রতিদিন কিছু লিখতাম, ভেবেছিলাম, যদি কোনোদিন ফিরিস, তাহলে দিয়ে দেবো।” সেই ডায়েরির পাতায় লেখা — “আজও কাশফুল ফুটেছে, জয়ন্ত আসেনি”, কিংবা “জানালার ধারে আজ আর কেউ দাঁড়ায় না”— এই লাইনগুলো পড়ে জয়ন্তর চোখ ভিজে উঠল। কুসুম বলল না কিছুই, শুধু পেছন ফিরে ধীরে হেঁটে চলে গেল কাশফুলের মাঠের দিকে। জয়ন্ত দাঁড়িয়ে রইল, হাতে সেই পুরনো খাতা, বুকভরা অপরাধবোধ, আর বাতাসে ভেসে বেড়ানো একরাশ কাশফুল— যেন বলছে, “এখনও দেরি হয়নি জয়ন্ত, এখনো অপেক্ষা শেষ হয়নি।”

অধ্যায় ২:

পরদিন সকালে সূর্যের নরম আলোয় গ্রাম জেগে ওঠে এক ভেজা, কাশফুলের গন্ধমাখা শান্তিতে। জয়ন্ত খুব ভোরে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে— চোখে ঘুমের রেশ থাকলেও মনে অদ্ভুত এক আকর্ষণ, যেন এই মাটির রং, বাতাসের গন্ধ, আর রোদ মেশানো নিস্তব্ধতা তার আত্মাকে ধুয়ে দিচ্ছে। সে হাঁটে মেঠো রাস্তায়, যেখানে আগের মতো গরু-ছাগল চরানো মানুষ নেই, কিন্তু কাঁচা রাস্তার প্রতিটি ধুলো তার স্মৃতিকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। শালিক ডাকে গাছের মাথায়, আর দূরের বাঁশঝাড় থেকে ভেসে আসে কোকিলের কণ্ঠস্বর। চায়ের দোকানের সামনে পৌঁছতেই দেখে, গণেশ কাকা আগের মতোই দোকানের সামনে ঝাড়ু দিচ্ছে— পাকা চুল, একটু কুঁজো হয়ে যাওয়া শরীর, কিন্তু গলায় সেই পুরনো সুর। জয়ন্তকে দেখে একবার তাকিয়ে বলে, “তুই ফিরে এসেছিস? ছুটিতে?” জয়ন্ত হাসে, চুপ করে বসে পড়ে বাঁশের মোড়ায়। কাকা এক কাপ লাল চা এগিয়ে দেয়— সেই আগের মতো টিনের কাপ, ধোঁয়া ওঠা চায়ের সঙ্গে মিশে থাকে স্মৃতির সুগন্ধ। পাশে বসে থাকা কিছু তরুণ মুখ চিনে না জয়ন্তকে, তবু হাসিমুখে কৌতূহল নিয়ে বলে, “কলকাতা থেকে এসেছেন দাদা?” সে মাথা নাড়ে। এই ছোট কথোপকথনের মাঝেই কেউ বলে ফেলে, “এই জায়গাটায় নাকি আগে একটা দারুণ কাশফুলের মাঠ ছিল?” জয়ন্ত কিছু বলে না, শুধু দূরে তাকিয়ে দেখে— হ্যাঁ, ছিল, আজও আছে, শুধু চোখে লেগে আছে সময়ের পরত।

ঠিক তখনই দোকানের পেছন থেকে ভেসে এল সেই পরিচিত কণ্ঠ— “আরে জয়ন্ত, তুই এখানে?” জয়ন্ত ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে— কুসুম। আজ সে পরেছে একটা হালকা নীল সুতির শাড়ি, খোঁপায় ফুল নেই, কাঁধে ব্যাগ ঝোলানো, চোখে ক্লান্তির ছায়া— হয়তো স্কুলে যাবার পথে। জয়ন্ত কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই কুসুম এসে সামনে বসে বলল, “ভেবেছিলাম চলে গেছিস। শহরের মানুষ তো বেশিক্ষণ মাটিতে দাঁড়াতে পারে না।” কথায় একরাশ কটাক্ষ, কিন্তু চোখে হাসির রেখা। গণেশ কাকা হাসতে হাসতে বলে, “তোমরা দু’জন একসাথে বসলে দোকানেই একটা সিনেমা শুরু হয় মনে হয়।” জয়ন্ত চুপ করে, আর কুসুম তার চা তুলে নিয়ে বলল, “সত্যি করে বল, তুই কি শুধু ঘুরতে এসেছিস, না কি কিছু বলবি?” জয়ন্ত মাথা নিচু করে বলে, “জানি না, অনেক কিছু ভাবতে পারিনি কুসুম। এই গ্রাম, তুই, আমার ফেলে আসা জীবন— সব কিছু একসাথে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।” কুসুম চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর চোখ নামিয়ে বলে, “তুই একবারও ফেরার কথা ভাবিসনি?” — সেই প্রশ্নে শব্দের বদলে নীরবতা ভেসে ওঠে, আর চায়ের কাপ থেকে উঠে আসে উষ্ণ ধোঁয়া। চারপাশে লোকজন থাকা সত্ত্বেও তারা যেন এক নিভৃত কাহিনির মধ্যে আটকে পড়ে— কেবল দু’জন, এক টুকরো অতীত, আর কিছু অনুচ্চারিত অভিমান।

সেই মুহূর্তেই একপাশে বসে থাকা এক ছোট ছেলে এগিয়ে এসে কুসুমকে বলে, “দিদিমণি, চলুন, দেরি হয়ে যাবে স্কুলে।” কুসুম উঠে দাঁড়ায়, কিন্তু যাওয়ার আগে জয়ন্তর দিকে তাকিয়ে বলে, “আজ স্কুল ছুটি হলে একবার এস, আমাদের পুরনো মাঠটায়। কিছু দেখাবো তোকে।” জয়ন্ত মাথা নাড়ে, আর কুসুম চলে যায় ধুলো উড়তে থাকা রাস্তা ধরে— স্কুলের পথে, তার চলার ছন্দে এখনো সেই আত্মবিশ্বাস, যা একদিন জয়ন্তকে মুগ্ধ করেছিল। জয়ন্ত বসে থাকে কিছুক্ষণ— পাশে গণেশ কাকা হাসে, আর বলে, “ভালোবাসা একবার গেঁথে গেলে, শহরের কংক্রিটও তাকে শুকিয়ে ফেলতে পারে না।” জয়ন্ত উঠে দাঁড়ায়, কাঁধে ঝোলা ব্যাগটা সামলায়, আর ভাবে— কী দেখাবে কুসুম? সেই মাঠটা, না কি সেই সময়টাকে, যা কেবল তার ভেতরেই বেঁচে আছে? সে ধীরে পা বাড়ায় পুরনো স্কুলঘরের দিকে— যেন সামনে একটা নতুন পথ নয়, বরং একটা অসমাপ্ত কাহিনি অপেক্ষা করে আছে শেষ হয়ে ওঠার। বাতাসে আবার দুলে ওঠে কাশফুল— একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে, যেন বলে, “তোমাদের দু’জনের অপেক্ষায় তো আমি আজও ঝিরিঝিরি দুলছি জয়ন্ত…”

অধ্যায় ৩:

সন্ধ্যে নামছে ধীরে ধীরে। আকাশে সোনালি আভা, চারপাশে হালকা শিউলি ফুলের গন্ধ। স্কুল শেষে মাঠের পাশের পুরোনো বটগাছটার নিচে এসে দাঁড়ায় জয়ন্ত, পেছনে পড়ে থাকা ডায়েরির পাতাগুলো তখনও তার বুকপকেটে ভাঁজ করা। বাতাসে কাশফুলের মাথাগুলো দুলছে, ঠিক যেমন দুলত এক সময় তাদের শৈশবের স্বপ্নগুলো। মাঠের ওপাশ থেকে কুসুমকে আসতে দেখে, ধীরে ধীরে তার কাছাকাছি এগিয়ে আসে সে— হাতে একটা ছোট বাক্স, আর চোখে সেই পুরনো চিন্তা-ভরা আলো। জয়ন্ত দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ চুপচাপ, তারপর বলে, “তুই তো আগেও এই জায়গায় আমাকে ডাকতিস, কিন্তু আমি তো কখনো আসিনি…” কুসুম হাসে হালকা করে, তারপর বলে, “আজ তুই এসেছিস। এটাই সবথেকে বড় কথা।” তারা পাশাপাশি হাঁটতে থাকে মাঠের পাশ ধরে, কাশফুলের গায়ে গায়ে লাগছে তাদের হাত, গন্ধে ভরে যাচ্ছে মন। জয়ন্ত হঠাৎ করে বলে ফেলে, “তুই জানিস, তোকে না বলেই চলে যাওয়াটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।” কুসুম থেমে যায়, চোখে একরাশ বিস্ময়, তারপর বলে, “তুই কি সত্যিই বিশ্বাস করিস, আমি অপেক্ষা করিনি?” সেই প্রশ্নে জয়ন্ত মাথা নিচু করে ফেলে। সে আর কোনো উত্তর দিতে পারে না— শুধু ভাবে, কতো রাত জেগে ও হয়তো সেই কাশফুলের দুলুনি দেখে অপেক্ষা করেছে, আর কতো অজানা দিনে লিখেছে সেই ডায়েরির পাতাগুলো।

বাঁশঝাড়ের পাশে দাঁড়িয়ে কুসুম একটা পাথরে বসে পড়ে। জোৎস্না তখন ধীরে ধীরে নামছে। নদীর শব্দ দূর থেকে শোনা যাচ্ছে, আর পেছনে মাঠের ওপর ছড়িয়ে আছে কাশফুলের সাদা, তুলোর মতো শরৎ। জয়ন্ত তার পাশে এসে বসে। কুসুম খুলে দেয় সেই ছোট বাক্সটা— তার ভেতর কিছু পুরনো ছবি, একটা স্কুলব্যাজ, আর একটা ছোট্ট কাগজের ফুল— জয়ন্তর তৈরি করা, সেই ক্লাস সিক্সে। কুসুম বলে, “জানিস, আমি এগুলো এখনো রেখেছি। তোর চলে যাওয়ার পর, এটাই ছিল আমার একমাত্র সম্বল।” জয়ন্ত কিছু বলতে পারে না— শুধু ওই কাগজের ফুলটায় হাত রাখে। ছোট্ট করে বলে, “আমি ভেবেছিলাম সময় সব মুছে দেয়।” কুসুম চোখ তুলে তাকায়, তারপর বলে, “সময় হয়তো অনেক কিছু মুছে দেয়, কিন্তু যেটা সত্যি, সেটাকে শুধু আড়াল করে রাখে। যতবার এই মাঠে এসেছি, এই কাশফুলগুলোর ভেতর তোর ছায়া দেখেছি। তুই আমার ভুলতে পারিসনি, আমি তা জানতাম।” বাতাসে তখন এক ধরণের ভারী নীরবতা, শব্দহীন আত্মস্বীকৃতির মতো কিছু ঘোরাফেরা করছে। কুসুমের কণ্ঠ একটু কাঁপে, “তুই জানিস, আমি বিয়েও করতে পারিনি। পাত্র এসেছিল, কিন্তু মনে হয় কেউই তোকে টপকাতে পারেনি।” জয়ন্ত এবার চোখ তুলে তাকায়— গভীরভাবে, দীর্ঘক্ষণ, আর সেই চোখে যে অনুভব, তা এতদিন ছড়ানো ছিল ডায়েরির পাতায়, এখন কুসুমের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

সন্ধ্যার জ্যোৎস্না তাদের গায়ে পড়ে, কাশফুল তাদের চারপাশে এক নরম চাদরের মতো ছড়িয়ে পড়ে। জয়ন্ত আস্তে করে কুসুমের হাতে হাত রাখে— অনেকদিনের না বলা কথা যেন এবার তার হাতের উষ্ণতায় মিশে যায়। কুসুম কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, “তুই তো আবার চলে যাবি জয়ন্ত… আমি জানি। শহরের চাকরি, জীবন, সব তোকে টেনে নেবে।” জয়ন্ত থামে, গলায় এক ধরনের অনিশ্চয়তা, “যদি বলি, আমি আর যেতে চাই না?” কুসুম কিছু বলে না। তার চোখে জল আসে, কিন্তু সে তা লুকায় না। কাশফুলের ঢেউয়ের মতো তার অনুভূতিগুলো মাথা উঁচু করে দুলছে— সত্য, স্বচ্ছ আর সাহসী। দু’জন বসে থাকে পাশাপাশি, আর রাতের কুয়াশা ধীরে ধীরে তাদের ঘিরে ধরে। দূরে একটা পেঁচা ডাকে, মাঠের ওপাশে কিছু আলো জ্বলে ওঠে— গ্রামের ছোট কালীমন্দিরে আরতি চলছে হয়তো। কুসুম আস্তে করে বলে, “কাল যদি আবার এখানে আসিস, তাহলে বিশ্বাস করব, তুই থাকবি। আর যদি না আসিস, তাহলে কাশফুলদের বলব— তোর অপেক্ষা এবার শেষ।” জয়ন্ত মাথা হেঁট করে, আর ভাবে, কতো বছর পর এই সন্ধ্যাটা তার জীবনে একটা সত্যিকারের প্রশ্ন রেখে গেল— সে কি ফিরে যাবে, নাকি থেকে যাবে, সেই মেয়েটার পাশে, যে দশ বছর আগেও বলেছিল— “তুই গেলে ঠিক ফিরে আসবি, কাশফুল ফুটলে।”

অধ্যায় ৪:

পরদিন সকালটা এক অদ্ভুত দ্বিধার সঙ্গে ভোর হয়। জয়ন্ত জানে, তার প্রতিটি সিদ্ধান্ত এখন আর একার নয়— মনে হয় যেন প্রতিটি পা ফেললেই কেউ একজন দূর থেকে তাকিয়ে আছে, তার প্রতিটি না বলা কথার প্রতিধ্বনি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাতাসে। গ্রামের রাস্তাগুলো আজ যেন আরও পরিচিত মনে হয়, কিন্তু সেই চেনা গন্ধের ভেতরেও এক ধরণের অপরিচিত টান। সে ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় সেই স্কুলঘরের দিকে, যেখানে সে আর কুসুম একসময় পাশাপাশি বসে অঙ্ক করত, কবিতা মুখস্থ করত, আর মাঝে মাঝে একজন আরেকজনকে ছোট ছোট চিরকুট লিখে দিত। স্কুল এখন অনেক বদলে গেছে— রঙের ছোপ লেগেছে দেয়ালে, দেয়ালের কোণে নতুন নোটিস বোর্ড। কিন্তু সেই পুরোনো ক্লাসঘরটা ঠিক আগের মতোই রয়ে গেছে— কাঠের বেঞ্চ, জানালার ধারে গাঁদা ফুল গাছ, আর এক কোণে পুরোনো ঘন্টার দড়ি। জয়ন্ত জানালার ধারে গিয়ে বসে— এখানেই একসময় বসত কুসুম, মুখ গম্ভীর করে প্রশ্নের উত্তর দিত, কিন্তু চুলের ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে তাকাতো জয়ন্তর দিকে। হঠাৎ তার চোখে পড়ে দেয়ালের এক কোণে এখনও একটা ম্লান লেখা — “J + K”। বুকটা কেঁপে ওঠে। এত বছর কেটে গেছে, তবুও এই তিন অক্ষর যেন সময়ের গায়ে খোদাই হয়ে আছে, মুছে যায়নি।

ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে জয়ন্ত মাঠের দিকে এগোয়। দূর থেকে দেখতে পায়, কুসুম বাচ্চাদের নিয়ে গান শেখাচ্ছে— হাততালি, ছড়া, আর হাসির শব্দে ভরে উঠেছে চারপাশ। কুসুমকে এমন প্রাণবন্ত দেখে জয়ন্তর ভিতরে এক অন্যরকম প্রশান্তি জন্মায়। ক্লাস শেষে কুসুম তাকে দেখে হালকা হাসে। কিছু বলে না, শুধু তাকায়— সেই নীরব দৃষ্টিতে, যা হাজার শব্দের চেয়ে গভীর। তারা পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে স্কুলের এক কোণে বসে পড়ে। কুসুম ব্যাগ থেকে বের করে একটা পুরোনো খাতা— “তোর জন্য রেখে দিয়েছিলাম,” সে বলে। জয়ন্ত খাতা খুলে দেখে তার মধ্যে পাতায় পাতায় লেখা — কিছু কবিতা, কিছু একপাক্ষিক চিঠি, আর কিছু অনুভব যেগুলো কেবল নিজের ভেতরেই জমা হয়েছিল কুসুমের। “এইটা লিখেছিলাম যেদিন তুই প্রথম শহরে গেলি… আর এইটা যেদিন শুনলাম তুই চাকরি পেয়ে গেছিস।” — কুসুম প্রতিটি পাতার সঙ্গে কিছু না কিছু স্মৃতি জুড়ে দেয়, আর জয়ন্ত ধীরে ধীরে বুঝতে পারে, সময় কেবল তাকে সরিয়ে দেয়নি, বরং কুসুমকে অনেক গভীরভাবে তার দিকে বেঁধে রেখেছে। সে একটা পাতা পড়ে— “আজ বৃষ্টি হচ্ছে। জানালার পাশে বসে আছি। তোর জন্য কাশফুল এনেছিলাম, কিন্তু তুই তো এলি না। জানি না তুই এখন কোথায়, কার সঙ্গে হাসিস, তবু তোর গলার আওয়াজ এখনো কানে বাজে।”

জয়ন্তর গলা শুকিয়ে যায়। এত কিছু ছিল, যা সে জানত না, যা সে বোঝেনি, কিংবা বোঝার সুযোগ নেয়নি। সে আস্তে করে বলে, “তুই যদি একবার বলতি, কুসুম… আমি হয়তো ফিরে আসতাম।” কুসুম বলে, “তুই গেলে আমি চুপ করে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, যদি তোর ভাগ্যে আমি থাকি, তুই নিজেই একদিন ফিরে আসবি।” কিছুক্ষণ তারা চুপ করে থাকে। বাতাসে আবার কাশফুলের গন্ধ ভেসে আসে, এইবার সেই গন্ধে মিশে থাকে নতুন একটা অনুভব — এক গভীর গ্রহণযোগ্যতা। কুসুম হঠাৎ বলে, “তুই কি ফিরে যেতে চাস জয়ন্ত? আবার সেই শহরের কোলাহলে?” জয়ন্ত মাথা নিচু করে, তারপর বলে, “এই গ্রামে ফেরা আর ফিরে যাওয়া এক জিনিস নয় কুসুম। আমি যদি ফিরে যাই, তবে আবারও কিছু রেখে যাব, যেটা এবার আর ফিরে পাব না। কিন্তু আমি যদি থেকে যাই, তাহলে অনেক কিছু পেতে পারি, যেটা এতদিন হারিয়ে ভেবেছিলাম।” কুসুম কিছু বলে না, কেবল তার ডায়েরির খোলা পাতায় চোখ রাখে— যেখানে লেখা ছিল, “তুই যদি না আসিস, তাও আমি রোজ ওই মাঠে যাব, কারণ কাশফুল জানে, আমি কার জন্য অপেক্ষা করছি।” দূর থেকে স্কুলঘরের ঘণ্টা বাজে, কিন্তু তাদের মধ্যে তখন সম্পূর্ণ অন্য এক সময়ের হিসেব শুরু হয়ে গেছে।

অধ্যায় ৫:

সপ্তাহান্তের হাট বসেছে গ্রামে— এ যেন কেবল বাজার নয়, বরং গ্রামজীবনের এক রঙিন মেলবন্ধন। জয়ন্ত আর কুসুম পাশাপাশি হাঁটছে গরুরহাট, ফল-মূলের সারি, পাটের বস্তা আর হাতে বাঁধা হাঁসের মধ্য দিয়ে— দু’জনের মাঝখানে শব্দ নেই, অথচ এক অদ্ভুত নিবিড়তা যেন একে অপরকে জড়িয়ে রেখেছে। জয়ন্ত বিস্মিত চোখে দেখে, কুসুমের সঙ্গে পিছু পিছু চলা ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ‘দিদিমণি’ বলে ডাকছে — তার ভিতরের সেই মায়াবতী সত্তা যেন গ্রামে একটা আলাদা আলো জ্বেলে রেখেছে। মাঝেমাঝে গ্রামের পরিচিত মুখরা এসে জিজ্ঞেস করছে, “জয়ন্ত, শহরে তোদের কেমন চলে?” কেউ কেউ ঠাট্টা করে বলে— “কুসুম আর তুই আবার জোট বাঁধলি বুঝি?” — কথাগুলোতে হাসির সুর থাকলেও, ভিতরে একটা অমোঘ সত্য লুকিয়ে থাকে। জয়ন্ত চুপ করে থাকে, শুধু দেখে, কুসুম কীভাবে হাঁটে, কথা বলে, দামাদামি করে — যেন দশ বছরের অনুপস্থিতিকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে মুছে দিচ্ছে তার চোখের সামনে। একটা হাঁড়ি হাতে নিয়ে কুসুম হঠাৎ বলে ফেলে— “তুই কি এটা নিয়ে ফিরবি শহরে? রান্না করবি?” জয়ন্ত হাসে, “তুই যদি থাকিস, আমি কিছুই করতে পারি।” কথাটা হালকা হলেও, দু’জনেই টের পায়, ভেতরে তার গভীরতা আছে। কুসুম একটু চুপ করে যায়, তারপর অন্যদিকে ঘুরে বলে, “মজা করিস না। এইসব মাটি, গন্ধ, ঝামেলা — তোদের শহুরে জীবনের জন্য নয়।”

বিকেলের দিকে হাট ভাঙে। কুমোর পাড়ার পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তারা এসে দাঁড়ায় সেই পুরনো পুকুরঘাটে, যেখানে জল আজও স্বচ্ছ, আর কাশফুলের ঝোপে বাতাসে দুলছে সাদা সাদা তুলোর মতো পাপড়ি। কুসুম বসে পড়ে ঘাটের ধাপে। একরাশ ক্লান্তি যেন ওর মুখে এসে ভর করেছে— হয়তো দিনের, কিংবা দশ বছরের। জয়ন্ত পকেট থেকে সেই ডায়েরির ভাঁজ করা পাতা বের করে বলে, “আজও পড়ি রোজ। তোর শব্দগুলো যেন আমাকে নতুন করে চিনতে শিখিয়েছে।” কুসুম হাসে না, শুধু বলে, “শব্দ তো নিঃশব্দতাই বোঝায় জয়ন্ত। তুই ছিলি না বলেই তো লিখেছিলাম।” জয়ন্ত তার পাশে বসে বলে, “এইসব স্মৃতি নিয়ে আমি আর শহরে ফিরতে পারবো না কুসুম। আমি জানি, তুই ভাবিস আমি থাকবো না, কিন্তু সত্যি বলছি, আমি থাকতেই চাই।” কুসুম চোখ নামিয়ে বলে, “তুই যে ফেরার কথা বলছিস, তার মানে তো হতে পারে, তুই এখনও ঠিক করিসনি।” জয়ন্ত থেমে যায়। হঠাৎ সেই নিঃশব্দ কথাগুলো আবার দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে পড়ে তাদের মধ্যে। বাতাস থমকে যায় যেন। দূরে গণেশ কাকার দোকানে বসে থাকা কানাই চোখ টিপে হাসে— সে জানে, কিছু কিছু সম্পর্ক মেঘের মতো, ছুঁতে গেলেই ফস্কে যায়, অথচ মাথার ওপর ঠিক থাকেই।

রাতের দিকে হালকা ঠান্ডা পড়তে শুরু করে। গ্রামের ছোট কালীমন্দির থেকে ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসে, পুজোর প্রস্তুতি তুঙ্গে। জয়ন্ত কুসুমকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দেয়। সে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ, কুসুম দরজায় দাঁড়িয়ে বলে, “শোন, তোকে যদি কাল সন্ধ্যায় এই পুকুরঘাটে দেখি, তাহলে বিশ্বাস করবো তুই এবার সত্যিই থাকবি।” জয়ন্ত কিছু বলে না, শুধু তাকিয়ে থাকে। বাতাসে তখন কাশফুলের গন্ধ ঘন হয়ে উঠেছে, ঠিক যেমন ঘন হয় কোনো সম্পর্কের অসম্পূর্ণ কথা। কুসুম ঘরের ভেতরে ঢোকে, দরজা বন্ধ করে না, শুধু জানালাটা খুলে রাখে। জয়ন্ত ধীরে ধীরে পেছন ফিরে হাঁটতে শুরু করে, কিন্তু মাথার ভেতর গুঞ্জন করতে থাকে কুসুমের সেই কণ্ঠস্বর — “তুই যদি কাল থাকিস, তাহলে বিশ্বাস করব।” সেই রাতে জয়ন্ত ঘুমাতে পারে না। বিছানায় পেছন ফিরে শুয়ে চোখ বন্ধ করেও কেবল ভাবে— তার শহরের ফেলে আসা কাজ, বন্ধুবান্ধব, ব্যস্ততা… সব কেমন নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে হঠাৎ। এই গ্রাম, এই শরতের সন্ধ্যা, আর একটা মেয়ের না বলা অপেক্ষা— এগুলোর থেকে বড় কোনো ডাকে কি সাড়া দেওয়া উচিত নয়? কাশফুল জানে, তার মন আজ তীব্রভাবে দুলছে— ঠিক যেমন বাতাসে দুলে ওঠে কুসুমের ওড়নার ছায়া, প্রতিশ্রুতির মতো।

অধ্যায় ৬:

পরদিন সকালে আকাশটা অদ্ভুতভাবে ধূসর ছিল। শরতের সেই নীল আকাশ, যে আকাশ গত কয়েকদিন ধরে কাশফুল আর জোৎস্নায় সাজানো ছিল, আজ যেন তার রঙ হারিয়েছে। জয়ন্ত জানে, আজ তার জন্য সিদ্ধান্তের দিন— যাওয়া না যাওয়ার দ্বন্দ্বটা আজ আর অব্যক্ত নয়, বরং মাথার মধ্যে ছায়ার মতো গেঁথে গেছে। সে জানে, যদি আজ সন্ধ্যার আগে পুকুরঘাটে না যায়, কুসুম আর কখনো ফিরে তাকাবে না। কিন্তু তবুও তার পা দুটো থমকে থাকে। সে সারা দিন ঘুরে বেড়ায় গ্রামের আনাচে কানাচে— সেই মাঠে যায় যেখানে তারা ছোটবেলায় খেলত, পুরনো পাঠাগারের পাশে দাঁড়ায় কিছুক্ষণ, এমনকি স্কুলঘরের জানালায় চোখ রাখে একবার, কিন্তু কুসুমের সঙ্গে দেখা করতে যায় না। এমনকি গণেশ কাকার দোকানেও সে এড়িয়ে চলে— যেন চারপাশে ছড়িয়ে থাকা প্রত্যেকটা মানুষ কুসুমের চাহনিতে পরিণত হয়ে গেছে, যারা প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দিচ্ছে, “তুই কি সত্যিই চলে যাবি?” তার মনটা অস্থির হয়ে থাকে, স্মৃতি আর বাস্তবতার লড়াইয়ে। ফোনে এক পুরোনো সহকর্মীর মেসেজ আসে— “কাল তোমার ক্লাস, ফেরার সময় মনে রেখো।” সেই সময় জয়ন্তের মনে হয়, এ যেন তার জীবনের একটা সুস্পষ্ট সংকেত, যেন সব কিছু তাকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে তার পুরোনো ছকে।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, কালীমন্দির থেকে ঢোলের হালকা শব্দ ভেসে আসে। গ্রামের মাটির রাস্তা ধরে চলেছে লোকজন— কেউ পুজোর আলপনার জিনিস আনছে, কেউ প্রদীপ কিনছে, শিশুরা মেতে উঠেছে কাগজের পুতুলে। কিন্তু সেই কাশফুলের মাঠের পাশের পথটা আজ শুনশান। জয়ন্ত দূর থেকে দেখে, কুসুম পুকুরঘাটে দাঁড়িয়ে আছে— একলা, নিঃশব্দ, যেন বাতাসও তার পাশে বসে অপেক্ষা করছে। কুসুমের চোখ ঘন হয়ে আছে, জয়ন্ত দেখে না— সে দুরে দাঁড়িয়ে, অন্ধকারে, পা ফেলছে না সামনে। হয়তো অভিমান তাকে আগলে রেখেছে, হয়তো ভয়। তার মনে হয়, যদি সে যায়, আর কুসুম তার চোখে প্রশ্ন খোঁজে— “তুই সত্যিই থাকবি তো?”— সে যদি সেই প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে, তার জবাব কি সত্যিই তার ভিতরে আছে? এই ভাবনার ভারে সে পেছনে ফিরে হাঁটতে শুরু করে, যেন নিজেকে নিজেই আড়াল করছে। ঠিক তখনই ঝড়ের একটা হাওয়ার দমকা গায়ে এসে লাগে, পেছনে পড়ে থাকা কাশফুলের ডাঁটা থেকে ছিঁড়ে গিয়ে একগুচ্ছ ফুল উড়ে এসে তার পায়ে পড়ে। সে দাঁড়িয়ে যায়। এই নির্জন সন্ধ্যায়, কাশফুল যেন নিজের ভাষায় তাকে ডাকছে— “তুই কি সত্যিই চলে যাবি, জয়ন্ত?”

কুসুম ফিরে তাকায় না। সে বুঝে গেছে— জয়ন্ত আজ আসেনি। তার চোখে জল নেই, কিন্তু বুকের মধ্যে এক অদৃশ্য দরজা বন্ধ হয়ে যায়। সে আস্তে পেছন ফিরে ঘরে চলে যায়, জানালাটা বন্ধ করে দেয় প্রথমবারের মতো— যে জানালা দিয়ে এতদিন কাশফুল, বাতাস আর একটা অসমাপ্ত স্বপ্ন ঢুকে পড়ত নীরবে। তার মাথার মধ্যে প্রতিধ্বনির মতো বাজে— “তুই যদি থাকিস, আমি আর অপেক্ষা করবো না।” অথচ আজ সে জানে, তার অপেক্ষা, তার বিশ্বাস, তার বলা-না-বলা চিঠিগুলো সব হয়তো ব্যর্থ হয়ে গেল। জয়ন্ত সেই রাতটা কাটায় অস্থিরতায়— বিছানায় এলোমেলো হয়ে থাকা ডায়েরির পাতাগুলো চোখের সামনে পড়ে থাকে, পাখার নিচে বাতাস ঘোরে, কিন্তু মন শান্ত হয় না। গভীর রাতে সে উঠে জানালার দিকে তাকায়, বাইরে কুয়াশায় ঢাকা পুকুরঘাট, আর তার বুকের ভিতর জমাট বাঁধা একটা প্রশ্ন— “সে কি সত্যিই হারালো?” সে জানে, অভিমান ভাঙার মতো সাহস পেলে তবেই সম্পর্ক টেকে, আর হয়তো সে সেই সাহসটা আজ হারিয়ে ফেলেছে… অথবা হয়তো কাল সূর্য উঠলে, কাশফুল আবার তাকে একটা নতুন পথ দেখাবে।

অধ্যায় ৭:

সকালের আলোটা আজ অন্যরকম। আগের দিনের অভিমান, দুঃখ আর অপ্রকাশ্য যন্ত্রণার মতোই আকাশের রংটাও যেন ফিকে। কুসুম ঘুম থেকে উঠে চুপচাপ জানালার ধারে এসে দাঁড়ায়। আজও সেই কাশফুলের মাঠ, পুকুরঘাট, মাটির রাস্তা — সব আছে, শুধু অপেক্ষার ছায়াটা আর তার ঘরের দেয়ালে নেই। জানালাটা সে আজ খুলতে চায় না, তবুও এক অদৃশ্য টানে সে জানালার কপাট ঠেলেই দেয়। বাইরে শীতের হালকা কুয়াশা, কাশফুল দুলছে নিঃশব্দে, ঠিক যেমন হৃদয়ের ভেতরে জমে থাকা স্মৃতি দুলে ওঠে কখনো-কখনো। সে ভাবতে থাকে— জয়ন্ত কি সত্যিই চলে গেল? কুসুম নিজেকে প্রশ্ন করে, হয়তো উত্তর জানেও, তবুও বিশ্বাস করতে চায় না। তার চোখ চলে যায় সেই বাঁশঝাড়ের পথটার দিকে, যেখানে দিয়ে তারা হেঁটেছিল হাটের দিন, যেখানে সে প্রথমবার নিজের অনুচ্চারিত অভিমানটা মুখে বলেছিল। হঠাৎ, তার বুকের ভিতরে হালকা কাঁপন অনুভব হয়— কে যেন এসে দাঁড়িয়েছে পেছনে, অথবা কোনো অতীত স্পর্শ করে গেছে নীরবে। সে চোখ বন্ধ করে মনে মনে জয়ন্তর মুখটা কল্পনা করে— সেই চোখ, যেটা বলে উঠতে পারে না, কিন্তু ভেতর থেকে কাঁপিয়ে দেয়। “সে কি এখনও কাছেই আছে?”— মনে হয় যেন বাতাসে আজও সে প্রশ্ন উড়ে বেড়ায়।

জয়ন্ত সেই রাতটা ঘুমাতে পারেনি। শরীর ক্লান্ত হলেও মন একটা অদৃশ্য ভারে চুপচাপ বসে থাকে। সকাল হতেই সে নিজের ব্যাগটা গুছিয়ে নেয়— কিন্তু কোথাও যাওয়ার কোনো ছক করে না। শুধু ডায়েরির পাতাগুলো গুছিয়ে নিয়ে একটা পাতায় লিখে— “আজ যদি তুই থাকিস, তবে আমি আবার অপেক্ষা করব।” সে হাঁটতে থাকে গ্রামের রাস্তা ধরে, মাথার ভিতরে কুসুমের মুখ, সেই ডায়েরির অক্ষর, আর এক অসমাপ্ত প্রতিশ্রুতির ছায়া। আজ আর গণেশ কাকার দোকানে বসে চা খায় না, কাউকে দেখে হাসে না— শুধু এক মনে চলে যায় পুকুরঘাটের দিকে। গিয়ে দেখে, কুসুম নেই। কাশফুল দুলছে, পুকুরে জল থেমে আছে, বাতাসও কেমন যেন চুপ করে গেছে। জয়ন্ত পাশে বসে পড়ে, ডায়েরির পাতাগুলো মেলে রাখে, যেন বাতাসে তাদের ওড়াতে চায়। ঠিক সেই সময়েই তার চোখ পড়ে, বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে আসছে কুসুম— শাড়ির আঁচল এক পাশে, মুখে না বলা কথা, চোখে অপেক্ষার হালকা ছায়া। জয়ন্ত উঠে দাঁড়ায়। কুসুম একটু থেমে বলে, “তুই তো আসবি না ভেবেছিলাম।” জয়ন্ত মাথা নিচু করে বলে, “আমি আসিনি, কারণ ভয় পেয়েছিলাম। যদি তুই জানালাটা বন্ধ করে দিস… যদি তুই আর আমাকে ক্ষমা না করিস…”

কুসুম আস্তে কাছে এসে দাঁড়ায়, আর বলে, “তুই ভয় পেয়েছিস, তবু এসেছিস— এটাই তো সবচেয়ে বড় প্রমাণ যে তুই বদলেছিস।” জয়ন্ত তার দিকে তাকায়— এই প্রথম, সত্যিকারের চাওয়া আর নির্ভরতার চোখে। পুকুরের পাশে দাঁড়িয়ে দুই মানুষ, দুটো জীবনের ভেতর থেকে উঠে আসা দুটি গল্প, যেন আজ মিলিয়ে যেতে চায় একটাই বাক্যে— “আমি আছি, তুই থাক।” বাতাসে হঠাৎ হালকা দুলে ওঠে একগুচ্ছ কাশফুল— সাদা তুলোর মতো উড়ে যায় বাতাসে। কুসুম বলে, “জানিস জয়ন্ত, কাশফুল শুধু শরতের প্রতীক নয়, ওরা জানে কীভাবে অপেক্ষা করতে হয়।” জয়ন্ত হেসে বলে, “তাই তো তোকে আর কাশফুলকে আলাদা করতে পারিনি।” সন্ধ্যার আভা নামতে শুরু করে, আর তারা পাশাপাশি বসে থাকে জানালার ধারে, এক নতুন গল্পের পাতা খুলে। পেছনে মাঠে কাশফুলেরা দুলে ওঠে আবার— যেন দীর্ঘ অপেক্ষার শেষে তারা দু’জনের জন্য নিঃশব্দে হাততালি দেয়।

অধ্যায় ৮:

গ্রামের সেই শরৎকালীন পটভূমিতে এবার সত্যিই অন্যরকম একটা আলো এসে পড়েছে— যেন বাতাসে আর কেবল স্মৃতি নেই, আছে নতুন শুরুর গন্ধ। জয়ন্ত আর কুসুম এখন প্রতিদিন দেখা করে— কখনো স্কুলের ছুটির পর, কখনো বিকেলের বাঁশঝাড়ের পাশে, আবার কখনো কাশফুলের মাঠে বসে থাকে দুইজনে, শব্দের প্রয়োজন পড়ে না তাদের মধ্যে। একদিন জয়ন্ত চুপচাপ কুসুমকে নিয়ে যায় সেই পুরনো পাঠাগারে, যেটা এখন অল্প ব্যবহৃত হলেও তার দেওয়ালে এখনও ইতিহাসের গন্ধ আছে। ভিতরে গিয়ে dusty একটা তাক থেকে সে বের করে সেই বইটা, যার ভাঁজে অনেক বছর আগে সে রেখেছিল নিজের লেখা একটা কবিতা— “তুই গেলে, আমি থাকব না”— সেই পঙক্তি পড়ে কুসুম হালকা হেসে বলে, “তুই তো থেকেছিস, আমার ভেতরে।” জয়ন্ত এবার আর পিছিয়ে থাকে না— তার হাতে তখন এক পাতার চিঠি, যেটা সে লিখেছিল আগের রাতে, খুব ভোরে, কুসুমের জন্য। চিঠিতে লেখা— “এই গ্রামের মাটি, এই কাশফুলের গন্ধ, আর তোর চোখের চাহনি— এসব ফেলে আমি আর কিছুতেই ফিরতে পারি না। আমি যদি থেকে যাই, তবে তুই কি আমার পাশে থাকবি?” কুসুম চোখ তুলে চিঠিটা পড়ে, কিছু বলে না, শুধু আস্তে করে চিঠিটা বুকপকেটে রেখে দেয়— যেন উত্তরটা সে শব্দে নয়, কাজে দিতে চায়। পাঠাগারের বাইরে দাঁড়িয়ে তারা দেখে— মাঠ জুড়ে শরতের শেষ বিকেল, আর কাশফুলগুলো সেই সোনালি আলোয় দুলছে, ঠিক যেমন তাদের মনে এখন দুলছে একরাশ নিশ্চিত ভালোবাসা।

দিন যায়, আর জয়ন্ত আর শহরে ফেরে না। তার কলেজ থেকে একদিন ফোন আসে, সে বলে— “আমার দরকার কিছুটা সময়”— অথচ সে জানে, সময় তার নয়, সে এখন সময়ের স্রোতে একটা ঘর বাঁধছে। কুসুমের সঙ্গে সে স্কুলে যায়, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের দেখে, যারা তাদের ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়ায়। কেউ বলে “জয়ন্তদা আবার গল্প বলবে?” — কেউ বলে “কুসুম দিদিমণি, ওর সঙ্গে আপনার বিয়ে হবে?” — হাসির রোল ওঠে, আর জয়ন্ত কুসুমের চোখে চেয়ে থাকে, যেন এই শিশুদের সরল প্রশ্নেই লুকিয়ে আছে তাদের ভবিষ্যতের ছায়া। সন্ধ্যেবেলায় তারা হাঁটে পুকুরঘাটের ধারে, জানালার পাশে বসে কুসুম আবার কবিতা লেখে, আর জয়ন্ত সেই ডায়েরির পাতায় নতুন করে নিজের নাম লেখে— এইবার আর একা নয়, পাশে কুসুমের নামও লেখে, পাশাপাশি, যেন এই গল্পটা এবার চিরস্থায়ী হয়। এক রাতে, পূর্ণিমার আলোয় কুসুম বলে— “তুই কি জানিস, এই কাশফুলগুলো কিন্তু একটা ঋতু শেষ হলে ঝরে যায়।” জয়ন্ত বলে— “তাই তো তাদের আবার ফিরে আসতে হয়, ঠিক যেমন আমি ফিরেছি তোর কাছে।” আর কুসুমের চোখে জ্বলে ওঠে অশ্রুসিক্ত আনন্দের দীপ্তি— কারণ সে জানে, এ ফিরে আসা শুধু ভালোবাসার নয়, এটা প্রতিশ্রুতির ফিরে আসা।

শেষে গ্রামের কালীমন্দিরে পুজোর দিন, আলোর রোশনাইয়ে ভরে যায় চারপাশ। পুকুরের ধারে ছোট একটা ঘর ভাড়া নেয় জয়ন্ত— জানালার পাশে টেবিল, বই, আর জানালার বাইরে কাশফুলের সারি। কুসুম আসে বিকেলে, হাতে দেওয়া একটা ছোট্ট পুঁটলি— ভেতরে কাগজে মোড়া একটা শঙ্খ, আর পাশে জয়ন্তর নাম লেখা কাঁথা— “তোর জন্য সেলাই করেছি,” সে বলে। জয়ন্ত কিছু বলতে পারে না, শুধু জানালার ধারে বসে থেকে বলে, “এই জানালাটার সামনে বসে আমি তোর জন্য অপেক্ষা করেছিলাম।” কুসুম হাসে, আর আস্তে পাশে এসে বসে। দূরে ঢাক বাজছে, বাতাসে ধূপের গন্ধ, আর গায়ে এসে পড়ছে কাশফুলের শেষ রাতের দোল। জয়ন্ত বলে— “তোর ডায়েরির শেষ পাতায় আমার নাম ছিল না, এবার রাখবি তো?” কুসুম একবার চোখ বন্ধ করে, তারপর বলে— “শেষ পাতায় নাম থাকে, কিন্তু গল্পটা তো শুরু হয়ে গেছে।” আর তাদের পাশে দুলে ওঠে কাশফুল— সাদা, নরম, জ্যোৎস্নার মতো— যেন বলছে, “অবশেষে অপেক্ষার গল্পটা নাম পেল… ভালোবাসা।”

– সমাপ্ত –

1000036349.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *