Bangla - রহস্য গল্প

চিত্রগুপ্তের খাতা

Spread the love

শঙ্খ সেন


কলকাতার গরমটা যেন এ বছর আগের থেকেও একটু বেশি বেয়াড়া হয়ে উঠেছে। স্টেট আর্কাইভস বিল্ডিং-এর ভেতরে যদিও পাখার শব্দ আর পুরনো কাগজের গন্ধ ছাড়া কিছু নেই, তবুও ঘাম চুঁইয়ে পড়ে অনির্বাণ মিত্রর কপাল দিয়ে। সে কাজ করে ৩ নম্বর সেকশনে — যেখানে ফাইল নম্বর, শ্রেণি, মাইক্রোফিল্মের ক্যাটালগ এইসব ঘেঁটে দিনের পর দিন কাটে। অনির্বাণ একজন আর্কাইভ অ্যাসিস্ট্যান্ট, বয়স ত্রিশের কাছাকাছি, চোখে চশমা, গলায় ঝুলে থাকা একটা আইডি কার্ড আর স্যাঁতসেঁতে ফাইল ঘাঁটার অভ্যেস।

সেদিনও ছিল একটা ক্লাসিক বুধবার। দুপুর নাগাদ অনির্বাণকে ডাকা হয় ৫ নম্বর ভল্টে, যেখানে এক কলেজের অধ্যাপক এসেছেন ১৯৭৬ সালের এক বিশেষ ফাইল খুঁজতে। কাজটা সহজ — ইনডেক্স দেখে, খাতা দেখে, ফাইল বার করে দেওয়া। কিন্তু সমস্যা শুরু হয় যখন সেই নির্দিষ্ট ফাইল — “Civil Administration East 1976 / File No. 487-C” — খুঁজে পাওয়া যায় না।

অনির্বাণ তখন নিজের মতো করে র‍্যাকের খোপ ঘেঁটে চলেছে। পুরনো কাগজের ফাঁকে হঠাৎ চোখে পড়ে একটা চামড়ার মোড়া খাতা — নাম নেই, নম্বর নেই, ফাইল কোড নেই। শুধু কাঁপা হাতে কালিতে লেখা — “চিত্রগুপ্তের খাতা”।

সে কৌতূহল সামলাতে না পেরে খাতা খুলে ফেলে।

প্রথম পাতায় লেখা —
“এই খাতায় যাদের নাম লেখা থাকবে, তারা ভবিষ্যতের নির্দিষ্ট দিনে মারা যাবে। এই লেখা মুছে ফেলা যাবে না, বদলানো যাবে না।”
তারপর একেকটা নাম, জন্মতারিখ, ঠিকানা, এবং মৃত্যুর তারিখ।

প্রথম নাম:
সঞ্জয় বসু — ৩৮ বছর, স্কুল শিক্ষক, বাঁশদ্রোণী। মৃত্যুর তারিখ: ১৭ জুন ২০২৫।

তারপর কয়েকটি নাম, যাদের অধিকাংশের মৃত্যু ২০২৫ সালের জুন ও জুলাই মাসে লেখা।

প্রথমে মনে হয় এটা হয়তো কোনো লেখকের বানানো নোট — কাল্পনিক চরিত্র নিয়ে। কিন্তু পরদিন যখন অনির্বাণ কৌতূহলবশত গুগল করে “সঞ্জয় বসু বাঁশদ্রোণী মৃত্যু”, সে দেখে ১৭ জুনে সত্যিই এক স্কুল শিক্ষক বাঁশদ্রোণীতে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। বয়স ৩৮। নাম — সঞ্জয় বসু।

অনির্বাণের মুখ শুকিয়ে যায়।
সে আবার খাতার পাতাগুলো উলটে দেখতে শুরু করে। এবার দ্বিতীয় নাম:
নন্দিনী রায় — বয়স ৪৫, সরকারি কর্মচারী, সল্টলেক। মৃত্যুর তারিখ — ২১ জুন ২০২৫।

এইবার সে অপেক্ষা করে।

২১ জুন, সকালে সে নিউজনেট, আনন্দবাজার সব খুঁজে দেখে — খবরে আসে, সল্টলেক সেক্টর ৩-এ এক মহিলা সরকারি কর্মচারী অফিসে ঢোকার মুখেই গাড়ির ধাক্কায় মারা গেছেন। নাম — নন্দিনী রায়। বয়স — ৪৫।

অনির্বাণের গা ঠাণ্ডা হয়ে আসে।
সে বুঝতে পারে — এই খাতা যেন ভবিষ্যতের মৃত্যুর দিনলিপি।
কিন্তু কে লিখেছে? কিভাবে এল এই খাতা স্টেট আর্কাইভে? এবং সবচেয়ে ভয়ানক কথা, খাতায় কতগুলো নাম আছে?

পরের কয়েকদিন অনির্বাণ অফিসে নিয়মিত আসা বন্ধ করে দেয়। সে বাড়িতে বসে খাতার নামগুলো গুনে। মোট ৩৪টি নাম। এর মধ্যে ৫টি মৃত্যুর তারিখ অতীত — সে পরে খবরের কাগজের রেকর্ড ঘেঁটে দেখে সেগুলোও সত্যি। খাতার তথ্য একটাও ভুল নয়।

অনির্বাণ ভয় পায়, কিন্তু কৌতূহলও বাড়ে। তার মাথায় আসে—এই খাতার সাহায্যে সে কি পুলিশের কাছে যেতে পারে? কিন্তু প্রমাণ কই? কেউ কি বিশ্বাস করবে? বরং তাকে উলটে পাগল ভাববে। তাছাড়া খাতায় যাদের নাম আছে, তাদের কারো মৃত্যুও তো থামাতে পারছে না।

তবে, খাতার শেষ পাতায় এসে, সে যা দেখে, তার শ্বাস বন্ধ হয়ে যায় কিছুক্ষণের জন্য।

লেখা —
“অনির্বাণ মিত্র — ৩১ বছর, ৪৬/বি গোবিন্দপুর রোড, কলকাতা। মৃত্যুর তারিখ — ১ জুলাই ২০২৫।”

তারিখটা তখন ২৪ জুন।

মাত্র ৭ দিন বাকি।

অনির্বাণের পা যেন হঠাৎ ঠেকছে না মাটিতে। গলা শুকিয়ে কাঠ। তার চোখ এখনও সেই পাতায় আটক — যেখানে স্পষ্টভাবে লেখা তার নাম, ঠিকানা এবং মৃত্যুর তারিখ। ১ জুলাই ২০২৫। আজ ২৪ জুন। এক সপ্তাহ বাকি। একটা অস্পষ্ট শব্দ যেন মাথার ভেতর ধ্বনিত হতে থাকে — “তুই মরবি, তুই মরবি…”

সে খাতাটা বন্ধ করে দেয় তাড়াতাড়ি। বুকের মধ্যে কাঁপুনি। সিগারেট ছেড়েছিল বছরখানেক আগে, এখন ইচ্ছে হচ্ছে তিনটা একসাথে টানতে। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়, নিচের রাস্তার লোকজনের চলাফেরা দেখে। কারও মুখে কোন চিন্তা নেই, কোন শঙ্কা নেই — অথচ সে জানে, ঠিক সাত দিনের মধ্যে সে নেই।

সে নিজের ফোন হাতে নেয়। গুগল করে “চিত্রগুপ্ত”। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, চিত্রগুপ্ত হচ্ছেন মৃত্যুর দেবতা যমরাজের সহকারী — যিনি মানুষের জীবনের পাপ-পুণ্যের হিসাব রাখেন। নামের পাশে একেকটা মৃত্যুর হিসেব। যমদূতের হাতে ওই খাতা ধরিয়ে দেওয়া হয়, যাতে ঠিক সময়ে ঠিক মানুষ মরে।

অনির্বাণ হেসে ফেলে — “এগুলো তো পুরাণের গল্প, কিন্তু আমার টেবিলে রাখা খাতাটা কি তবে সত্যি?”

পরদিন সকালে অনির্বাণ অফিসে যায়, কিন্তু তার চোখে ঘুম নেই। ফাইল খুলছে, ক্লায়েন্টের অনুরোধ শুনছে, কিন্তু মনটা খাতায় আটকে। দুপুরবেলা সে নিজের বস, ডেপুটি ডিরেক্টর অরিন্দম স্যারের ঘরে যায়।

“স্যার, একটা অদ্ভুত ফাইল পেয়েছি। নাম নেই, কোড নেই। খুব পুরনো।”
অরিন্দমবাবু কফির কাপ হাতে তাকান, “পুরনো তো অনেক ফাইল পাওয়া যায়। কী আছে তাতে?”
“ভবিষ্যতের মৃত্যু লেখা আছে, একেকটা নাম, তারিখ…”

অরিন্দম একটু হেসে ফেলেন। “তুই বেশি হরর গল্প পড়িস অনির্বাণ। যা তোর টেবিলে রেখে দে। অফিসিয়ালি এগুলো রিপোর্ট করিস না। এমনিতে আর্কাইভে এসব নথি আসে অনেক রকম।”

অনির্বাণ বুঝে যায়, তার কথায় কেউ বিশ্বাস করবে না। সে বিকেলেই চুপচাপ খাতা নিয়ে যায় বাড়ি। এবার সে ঠিক করে, নামগুলো কাউন্টারচেক করবে — সত্যি কি না। খাতায় আগামী ৩ দিন যে নামগুলো লেখা রয়েছে, সেগুলোর তথ্য নিয়ে সে খবরের কাগজের ডিজিটাল আর্কাইভ খুঁজে দেখে, সোশ্যাল মিডিয়াতে ওই মানুষগুলোর অ্যাকাউন্ট খোঁজে, কোনোভাবে যুক্তি খুঁজে পায় না।

২৬ জুনের নাম:
সৌগত পাল — ২৮ বছর, বাইক মেকানিক, হাওড়া।
২৭ জুনের নাম:
শর্মিলা দে — ৬০ বছর, স্কুল রিটায়ার্ড, উল্টোডাঙা।

সে সিদ্ধান্ত নেয়, ২৬ জুন সে হাওড়া যাবে, সৌগত পালকে খুঁজবে। যদি তাকে সময়মতো সতর্ক করা যায়, তাহলে মৃত্যুর এই অদ্ভুত ভবিষ্যদ্বাণীকে রোখা যায় কি না, সেটা বোঝা যাবে।

২৬ তারিখ সকালে সে হাওড়া ময়দান এলাকার ওই গ্যারেজে পৌঁছে যায় — সকাল ৯টা। লোকজনের ভিড়, মেকানিকেরা কাজ শুরু করেছে। সে ছবি দেখিয়ে খোঁজ করে — একজন বলে, “ও তো এই গ্যারেজেই কাজ করে, একটু পরে আসবে। সোনালী বাইকের দোকানে থাকে।”

সাড়ে নয়টার মধ্যে সৌগত আসে — একটা পুরনো কালো বাইকের সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাচ্ছিল। অনির্বাণ তার সামনে গিয়ে বলে, “আপনিই কি সৌগত পাল?”

সৌগত অবাক, “হ্যাঁ, আপনি কে?”
“আমি অনির্বাণ। আপনাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে এসেছি। প্লিজ, আজ সারাদিন বাইক চালাবেন না। কোথাও যাবেন না। আপনার কিছু হতে পারে।”

সৌগত হেসে ফেলে, “আপনি অ্যাস্ট্রোলজার না ডিটেকটিভ?”
“না। আমি… আমি একটা খাতা পেয়েছি। তাতে লেখা আপনার মৃত্যুর তারিখ আজ। দয়া করে, আমি জানি এটা অদ্ভুত লাগছে, কিন্তু বিশ্বাস করুন। অন্তত আজ সাবধানে থাকুন।”

সৌগতের মুখ পড়া যায় না। শেষমেশ সে বলে, “আচ্ছা, আপনি যেহেতু এতটা অনুরোধ করছেন, আজকের দিনটা দোকানের পেছনের ঘরে কাটিয়ে দেব।”

অনির্বাণ কিছুটা হালকা হয়। সে গ্যারেজের সামনের চায়ের দোকানে বসে থাকে সারা দুপুর। সময় যায়, দুপুর গড়ায়। বিকেল ৫টা বাজে, সৌগত এখনো ঠিক আছে।

৬টায় একটা পুলিশ ভ্যান এসে দাঁড়ায় গ্যারেজের সামনে। দোকানের মালিক ছুটে যায়। ৫ মিনিটের মধ্যে খবর আসে — সৌগত পেছনের ঘরের ফ্যানের হুক থেকে ঝুলছে। আত্মহত্যা। কোনো চিরকুট নেই।

অনির্বাণের মাথায় যেন ঘুরে ওঠে ঝড়। সে চিৎকার করতে চায় — “না! আমি তো তাকে বাঁচিয়েছিলাম! আমি সাবধান করেছিলাম!” কিন্তু কেউ তার দিকে তাকাচ্ছে না। তার গলা যেন শুনতে পাচ্ছে না কেউ।

সে রাতেই বাড়ি ফিরে আসে। দরজা বন্ধ করে, আলো নিভিয়ে বসে থাকে চুপচাপ। এরপর সে দেখে — খাতায় সৌগত পালের নামের পাশে ছোট করে লেখা হয়েছে —
“সতর্কতা ব্যর্থ, মৃত্যু নিশ্চিত।”

কিন্তু কে লিখল এই লাইন? তো সে তো খাতা খুলে দেখেছে সকালেই। তখন তো এটা ছিল না।

তার মনে পড়ে — চিত্রগুপ্ত তো শুধু হিসেব রাখেন না, তিনি সংশোধনও করেন।

সে খাতার পাতা উলটে যায় কাঁপা হাতে। আজ রাত ১২টা পার হলে নতুন দিনের পাতায় নাম উঠবে। এবং ১ জুলাই তার নামের পাতা সেদিনই শেষবারের মতো খুলবে।

অনির্বাণ রাতে ঘুমোতে পারল না। চোখে ঘুম নেই, মনজুড়ে এক অদ্ভুত আতঙ্ক। সে জানে, খাতায় যেসব নাম উঠেছে, তারা সবাই মারা গেছে—সৌগত পাল পর্যন্ত। অথচ সে চেষ্টাও করেছিল তাকে বাঁচাতে। যদি মৃত্যুই পূর্বনির্ধারিত হয়, তাহলে কি চেষ্টাও বৃথা?

সকালে উঠে সে নিজেকে আয়নায় দেখে—চোখের নিচে কালো দাগ, চুল এলোমেলো। কিন্তু আজকের দিনটা সে শুধু ঘরে বসে কাটাতে পারে না। খাতার উৎস না খুঁজলে এই ছায়া তার গলা টিপে ধরবে।

সে ঠিক করে স্টেট আর্কাইভে ফিরে যাবে। খাতাটা কোথা থেকে এল, কোন ফাইল কেসের মধ্যে ছিল, সেটা খুঁজে বের করতে হবে। সে খাতাটিকে আবার সেই ফাইলে ঢুকিয়ে নেয়—যেখান থেকে তুলেছিল: “Civil Admin East 1976 / File No. 487-C”।

সে অফিসে গিয়ে চুপচাপ ফাইল ট্র্যাকিং রেজিস্টার খুলে বসে। খাতাটা যদি কোনো দানবিক ছায়া হয়, তাহলে তার ছায়াও কোথাও না কোথাও পড়ে আছে—ডকুমেন্ট ট্রেইলে।

সে দেখে, ফাইল 487-C শেষবার রিকোয়েস্ট হয়েছিল ১৯৯১ সালে। একজন নাম লেখা রয়েছে: প্রফেসর বিনয় সেনগুপ্ত, প্রেসিডেন্সি কলেজ। অনির্বাণ তার নাম গুগলে সার্চ করে দেখে—এই নামের একজন ইতিহাসবিদ ২০০১ সালে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন। তার ডায়েরির শেষ এন্ট্রি ছিল “পত্রিকা নয়, খাতা—চিত্রগুপ্তের খাতা”।

অনির্বাণ কাঁপতে থাকে। তাহলে এটা আগেও কারও হাতে পড়েছিল! এবং সেই মানুষটিও হারিয়ে গিয়েছিলেন।

সে প্রফেসরের বাড়ির ঠিকানা বের করে, উত্তর কলকাতার রামদুলাল সরকার স্ট্রিট। দুপুরেই সেখানে পৌঁছে যায়। একটা পুরনো বাড়ি, রঙ চটকে গেছে, দেয়ালে শেওলা। দরজা খুলে এক বৃদ্ধা বের হন।
“আমি অনির্বাণ মিত্র। প্রফেসর বিনয় সেনগুপ্তর বিষয়ে কিছু জানতে এসেছি।”

বৃদ্ধা তাকিয়ে থাকেন খানিকক্ষণ, তারপর বলেন, “আমি ওনার স্ত্রী। তিরিশ বছর আগে হঠাৎ উনি নিখোঁজ হন। শুধু একটা খাতা নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন। তাতে নাকি অদ্ভুত কিছু লেখা ছিল। আমি তখন ভাবতাম, উনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন।”

“তারা কি সেই খাতার নাম বলেছিলেন?”

“হ্যাঁ,” বৃদ্ধা বলেন, “চিত্রগুপ্তের খাতা।”

অনির্বাণ স্তব্ধ।

বৃদ্ধা বলে চলেন, “সেই খাতা উনি বারবার পড়তেন। কখনও হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠতেন, কখনও কাঁদতেন। বলতেন, ‘আমার নামও লেখা হয়েছে। সময় বাকি নেই।’ তারপর একদিন সকালে বাড়ির দরজা খোলা পাওয়া যায়, উনি নেই। খাতাও নেই। কোনো চিহ্ন নেই।”

“আপনার স্বামীর নাম কি সত্যিই লেখা ছিল সেই খাতায়?” অনির্বাণের গলা কাঁপে।
“তিনি নিজে তাই বলতেন। আমি তো খাতা পড়িনি। এখন তো আর কিছু বোঝার উপায় নেই।”

অনির্বাণ ফিরে আসে। সে বুঝতে পারে, এই খাতা কেবল ভবিষ্যৎ বলে না—এই খাতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে কিছু অদৃশ্য শক্তি।

সেদিন রাতে, সে খাতাটা আবার খোলে। আজ ২৭ জুন। আগামী নামটি শর্মিলা দে। অনির্বাণ ঠিক করে, আবার চেষ্টা করবে। এইবার ব্যর্থ হবে না।

সে খুঁজে পায় শর্মিলার ফেসবুক প্রোফাইল—একটি অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষিকা, মাঝে মাঝে কবিতা পোস্ট করেন, কিছু রান্নার ছবি। ঠিকানা পেয়েই সে পৌঁছে যায় উল্টোডাঙা।

শর্মিলার সঙ্গে কথা বলা কঠিন হয় না। অনির্বাণ নিজেকে একজন গবেষক বলে পরিচয় দেয়, যিনি “ভবিষ্যৎপূর্বানুমান ও মানবচেতনা” নিয়ে কাজ করছেন।

“ম্যাডাম, আমি জানি এটা অবিশ্বাস্য শোনাবে। কিন্তু আপনার জীবনে একটা বড় বিপদ আসতে চলেছে। আপনি বিশ্বাস না করলেও আমি অনুরোধ করছি—আজ কোথাও যাবেন না, একা থাকবেন না।”

শর্মিলা দে কিছুটা কৌতূহলী, কিছুটা চিন্তিত। “আপনি ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারেন?”

“না, আমি শুধু জানি যে আজ আপনার জন্য খুব খারাপ কিছু লেখা আছে। আমি চাই আপনি সুরক্ষিত থাকুন।”

অবশেষে শর্মিলা রাজি হন। বলেন, “ঠিক আছে, আপনি যদি বিশ্বাস করেন, তাহলে আজ আমার এক বান্ধবীকে ডেকে নিয়ে ঘরেই থাকব।”

অনির্বাণ সেদিন সন্ধে পর্যন্ত কাছাকাছি এক ক্যাফেতে বসে থাকে। সময় কেটে যায়। রাত আটটা, কিছুই ঘটে না। সে একটু স্বস্তি পায়। রাত দশটায় ফোন করে শর্মিলা ম্যাডামের খোঁজ নেয় — উনি ভালোই আছেন।

অনির্বাণ আনন্দে চোখে জল নিয়ে ভাবে — এবার বুঝি খাতা ভাঙল। এবার বুঝি ভবিষ্যৎ বদলানো সম্ভব।

কিন্তু পরদিন সকালে আনন্দবাজার খুলে সে দেখে হেডলাইন —
“রাত এগারোটায় উল্টোডাঙায় আগুন, এক বৃদ্ধা ও তার বান্ধবীর মৃত্যু”

ছবি দেখে অনির্বাণ বুঝে যায়—দুটো মুখই পরিচিত। শর্মিলা দে ও তার বান্ধবী। পুলিশের অনুমান—গ্যাস লিক থেকে বিস্ফোরণ।

সে স্তব্ধ।

সে এখন বুঝতে পারে, সতর্কতা শুধুই ধোঁকা। এই মৃত্যু আটকানো যায় না। বরং মৃত্যু আসে আরেক রাস্তা বেছে।

আর একবার খাতাটা খোলে সে — আবারও নতুন লাইন জুড়েছে:
“পথ বদলানো যায়, গন্তব্য নয়।”

এবার অনির্বাণ মনে মনে একটি প্রশ্ন তোলে—“তবে কি আমি শুধু দর্শক? কেবল চুপচাপ দেখে যাওয়ার জন্য আমাকে এই খাতা দিয়েছে কেউ?”

তখনই, খাতার পেছনের সাদা পাতায় উদয় হয় একটা অদ্ভুত প্রশ্ন:
“তুমি কি শুধু দেখবে, না খেলার ভিতরে নামবে?”

অনির্বাণ আঁতকে ওঠে। এ তো তার মনে চলা কথারই উত্তর!

খাতাটা কি… তাকে দেখছে? না, লিখছে?

অনির্বাণ গভীরভাবে তাকিয়ে থাকে সেই লাইনটির দিকে—“তুমি কি শুধু দেখবে, না খেলার ভিতরে নামবে?”
তার গা শিরশির করে। এতক্ষণ সে ভেবেছিল এই খাতা ভবিষ্যৎ বলে। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে খাতা তাকে প্রশ্ন করছে। তাকে অংশগ্রহণ করতে বলছে।

সে মাথা নাড়তে নাড়তে ফিসফিস করে, “আমি কোনো খেলার অংশ নই।”

ঠিক তখনই ঘরের জানালার পর্দা যেন হাওয়ার ঝাপটায় হঠাৎ উঠলো। অথচ জানালা বন্ধ। আলোটা নিভে যায় এক মুহূর্তের জন্য। ঘর অদ্ভুত ঠাণ্ডা হয়ে ওঠে।

অনির্বাণ দাঁড়িয়ে থাকে স্তব্ধ, হাতের তালুতে ঘাম। খাতাটা সে ধীরে ধীরে বন্ধ করে। এবার সে বুঝে গেছে, এটা শুধু ভবিষ্যৎবাণী করা কাগজ নয়। এটা জীবন্ত।

রাত একটা। কিন্তু তার ঘুম আসে না।

সে ফোনে সার্চ করে “occult death books”, “prophetic ledgers”, “death lists ancient”—তেমন কিছু খুঁজে পায় না।

তবে একটা ওয়েবসাইটে পড়ে একটা ছোট তথ্য:
“In 1943, a similar ‘death book’ was reportedly found in Lahore by a postmaster. The book disappeared after five people on its list died mysteriously.”

সে ভাবে — তাহলে কি এই বই বহু বছর ধরে ঘুরছে, শহর বদলেছে, মালিক বদলেছে? যে বই একসময় পাকিস্তানে ছিল, আজ কলকাতার স্টেট আর্কাইভে?

হঠাৎ মাথায় আসে — এই বই যদি এতটা সচল হয়, তবে কি এটা নিজেই তার পথ তৈরি করে? মানুষের হাতে এসে পড়ে, আবার মিলিয়ে যায়। তাহলে তার হাতে এল কেন? সে কি কেবল ভবিষ্যতের সাক্ষী? নাকি… বিচারক?

অনির্বাণ টেবিলে বসে খাতার পাতাগুলো আবার উল্টাতে থাকে। এবার সে খেয়াল করে—কিছু কিছু নামের পাশে বিশেষ চিহ্ন আছে। যেমন, এক নামের পাশে রয়েছে ‘×’, অন্য পাশে ‘✓’।

সে খেয়াল করে—যেসব ক্ষেত্রে সে কাউকে সতর্ক করেছে (যেমন সৌগত, শর্মিলা), সেগুলোর পাশে ‘×’ দেওয়া। কিন্তু যাদের সে স্পর্শ করেনি, যেমন সঞ্জয় বসু, নন্দিনী রায়—তাদের পাশে ‘✓’।

এতদিনে অনির্বাণ উপলব্ধি করে—এই খাতা চাইছে কাউকে না বাঁচাতে। সে যত কাউকে বাঁচাতে যাবে, মৃত্যু তত নিষ্ঠুর হবে। খাতা যেন প্রতিবার প্রমাণ করে দিতে চাইছে—“তুমি কিছুই করতে পারো না।”

সে এবার ভয় পায় না, সে রেগে যায়। একরাশ বিদ্রোহ মাথায় চেপে বসে।

সে গলা চড়িয়ে বলে ওঠে, “তাহলে খেলবো! কিন্তু আমার নিয়মে!”

সে ঠিক করে খাতার পরবর্তী নামের সঙ্গে দেখা করবে, কিন্তু এবার সতর্ক করবে না। শুধু অবজার্ভ করবে। খাতা কি তাকে আসলেই বাধ্য করছে? নাকি এটা তারই ভয় তৈরি করছে?

২৮ জুন — খাতায় লেখা রয়েছে:
“বিক্রমজিৎ ঘোষ, বয়স ৫০, চাকরিজীবী, গড়িয়াহাট। মৃত্যুর সময়: বিকেল ৪টা।”

অনির্বাণ সকাল সকাল বেরোয়। সে বিক্রমজিৎবাবুর ঠিকানায় পৌঁছয় দুপুর ২টায়। এক বহুতল অ্যাপার্টমেন্টের ৫ তলার ফ্ল্যাট। সে নিচে দাঁড়িয়ে থাকে, দূর থেকে নজর রাখে।

বিক্রমজিৎবাবু বেরোন ৩টা নাগাদ। শার্ট-প্যান্ট পরে অফিসের ব্যাগ হাতে। সিঁড়ির বদলে লিফট নেয়।

অনির্বাণ তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে—মেঘ করেছে।

৪টের একটু আগেই বিক্রমজিৎবাবুকে দেখা যায় ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করতে। হঠাৎ রাস্তার ওপার থেকে একটা পিকআপ ভ্যান নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সোজা এসে ধাক্কা মারে তাকে।

রক্ত ছিটকে পড়ে পিচে। পাশের দোকানদার ছুটে আসে। অনির্বাণ দৌড়ে যায়, দেখে লোকটা তখনও শ্বাস নিচ্ছে। কিন্তু তার চোখে ভয়। শেষবারের মতো মুখ থেকে শব্দ বেরোয়—“কিছু থামবে না…”

সেই রাতে খাতায় লেখা হয় —
“✓ মৃত্যু নিশ্চিত। পর্যবেক্ষক নির্লিপ্ত। খেলা স্বীকৃত।”

এইবার অনির্বাণ আর কাঁপে না। সে বুঝে গেছে, খাতা তাকে একটা খেলায় টানছে — না বাঁচাতে, না বাঁচার আশ্বাস দিতে — বরং যেন জজমেন্ট নিতে।

পরদিন, ২৯ জুন, নাম লেখা — “সুবর্ণা দাস, বয়স ২৫, গায়িকা, বালিগঞ্জ।”
একজন তরুণী। অনির্বাণ ভাবতে থাকে — সে কি এবারও শুধু পর্যবেক্ষণ করবে? নাকি কিছু করবে?

তখনই খাতার পেছনের পাতায় আবার লেখা হয় —
“তুমি যখন চুপ থাকো, আমি এগিয়ে যাই। যখন তুমি বাঁচাতে চাও, আমি নিষ্ঠুর হই। কিন্তু যখন তুমি বিচার করো — আমি চলতে থেমে যাই।”

এই বার্তা নতুন।

অনির্বাণ মনে মনে ভাবে — বিচার করো মানে কী? আমি কি তাহলে ঠিক করতে পারি, কে বাঁচবে, কে মরবে?

তখনই আরেকটা লাইন উদয় হয় —
“তিন দিন পরে তুমি নিজেই হবে তালিকার শেষ নাম। কিন্তু আজ থেকে শুরু হবে তোমার সিদ্ধান্তের পরীক্ষা।”

অনির্বাণ বুঝে যায় — তার হাতে একটা শক্তি এসেছে। সে যেন একজন আধা-দেবতা, আধা-দর্শক।

সুবর্ণার মৃত্যু ঠেকাবে? না, শুধু দেখবে? নাকি… নিজের নিয়মে বিচার করবে?

সে প্রথমবার ভাবে — খাতা যদি অন্যায়ভাবে কাউকে মারছে, তবে তার উচিত বিচার করা। কিন্তু বিচার মানেই কি মৃত্যু নির্বাচন?

আর তার নিজের নামও তো এখনও আছে — ১ জুলাই।

৩০ জুন সকালবেলা। আকাশে হালকা মেঘ। রোদটা যেন অনির্বাণের চোখে ধরা পড়ে খুব কড়া রঙে। আজ খাতায় নাম যে মেয়েটির — সুবর্ণা দাস, বয়স ২৫, একজন গায়িকা — তাকে শুধু দেখে আসবে নাকি কিছু বলবে, সেই দ্বন্দ্বে পড়ে আছে সে।

সকালে উঠে আয়নায় নিজের মুখ দেখে অনির্বাণ। মুখে দাড়ির ছাপ, চোখের নিচে কালি, কিন্তু আজ সে একটু অন্যরকম অনুভব করছে। যেন কোনো অজানা শক্তি তার ভিতরে জেগে উঠেছে।

সে মনে মনে বলল, “আজ আমি ঠিক করব — সুবর্ণা মরবে কি বাঁচবে। এবার আমি বিচার করব।”

গুগলে সার্চ করে সে খুঁজে পায় সুবর্ণার ইউটিউব চ্যানেল — সেখানে সুবর্ণার কণ্ঠে কিছু আধুনিক বাংলা গান, রবীন্দ্রসঙ্গীত, আর একটিতে একটা কবিতা আবৃত্তি। তার চোখে পড়ে, এই মেয়ে জীবন নিয়ে গান করে, বিষাদ নয়।

খাতায় সময় লেখা নেই, শুধু মৃত্যুর দিন — আজ।

সে ঠিক করে, আজ কথা বলবে সুবর্ণার সঙ্গে। বিচার করার আগে জানবে মেয়েটি কেমন মানুষ।

বিকেল নাগাদ সে পৌঁছে যায় বালিগঞ্জের এক পুরনো বাড়ির সামনে। একতলা বাড়ি, সামনে বাগান, জানালা দিয়ে বের হচ্ছে গানের আওয়াজ — সম্ভবত রেওয়াজ চলছে।

দরজায় বেল বাজাতেই দরজা খোলে — একজন সাদামাটা, হালকা শাড়ি পরা, হাসিমুখ মেয়ে।
“আপনি?”
“আমি অনির্বাণ। আমি আসলে আপনার গান শুনেছি ইউটিউবে। খুব ভালো লেগেছে। হঠাৎ এসে পড়লাম…”

সুবর্ণা প্রথমে একটু অবাক হলেও পরে হেসে বলে, “ভেতরে আসুন।”

ঘরের ভেতরে ঢুকেই অনির্বাণের চোখে পড়ে ছোটো হারমোনিয়াম, বইয়ের তাক, আর দেয়ালে একটা পুরনো ক্যানভাসে আঁকা রবীন্দ্রনাথ। সব মিলিয়ে গানের ঘর।

সুবর্ণা জল নিয়ে আসে, বলে, “আপনি গান ভালোবাসেন?”
“খুব।”
“গান তো একমাত্র যা বাঁচিয়ে রাখে। বাকিটা তো কোলাহল।”

অনির্বাণ চুপ করে থাকে। সে লক্ষ করে মেয়েটির চোখে জীবন আছে — ভয় নেই, দুঃখ নেই।

তখনই অনির্বাণ বলে বসে, “আপনার কি মনে হয়, জীবন একটা নির্ধারিত তালিকা?”
সুবর্ণা হেসে ফেলে, “মানে?”
“মানে, সবকিছু কি আগেই লেখা থাকে?”

সুবর্ণা একটু চুপ করে থেকে বলে, “না। আমি বিশ্বাস করি, গান যেমন তাল মিলিয়ে বদলায়, জীবনও তাই। তবে কেউ কেউ বলে, মৃত্যু ঠিক লেখা থাকে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না। মৃত্যু আসে যেমন ইচ্ছা, কিন্তু জীবনের মানে আমরা তৈরি করি।”

অনির্বাণ থমকে যায়। এই মেয়ে কি জানে না, আজ তার মৃত্যু লেখা আছে? কিন্তু সে বলে না কিছুই। খাতার নীতি অনুযায়ী, বাঁচাতে চাইলে মৃত্যু নিষ্ঠুর হয়।

তবে সে এবার আর সাবধানে বসে থাকতে চায় না।

সে সরাসরি জিজ্ঞেস করে, “আপনি যদি জানতেন, আজ আপনি মারা যাবেন, তাহলে কী করতেন?”

সুবর্ণা একটু চমকে যায়, তবে মুখে ভয় আসে না। সে হাসে, “আমি গান গাইতাম। গাইতে গাইতে মরতে চাই।”

একটা দীর্ঘ নীরবতা।

অনির্বাণ এবার উঠে দাঁড়ায়।
“আমি যাচ্ছি। শুধু একটা কথা মনে রাখবেন — কেউ যদি আপনার জীবনের বিচার করে, তাকে আগে আপনার গান শুনতে বলা উচিত।”

সুবর্ণা হেসে বলে, “বাহ! দারুণ কথা।”

সন্ধ্যা নামছে। বাড়ির সামনের গাছগুলো ছায়া ফেলছে রাস্তায়। অনির্বাণ পকেট থেকে খাতাটা বার করে। নতুন পাতায় কিছু লেখা হয়নি এখনও।

সে কলম বের করে। এই প্রথমবার সে নিজের হাতে কিছু লিখবে সেই খাতায়।
খাতার নিচে লেখে —
“বিচারক মন্তব্য: সুবর্ণা দাস — জীবনবান, সংবেদনশীল, অপরাধহীন। মৃত্যু স্থগিত।”

কলম শেষ হতেই পাতাটা যেন একটু কাঁপে। অদ্ভুতভাবে লেখা মুছে যায়। তারপর ভেসে ওঠে —
“বিচার গৃহীত। মৃত্যু বাতিল।”

অনির্বাণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার বুকটা যেন হালকা হয়ে যায়। হঠাৎ মনে হয় — সে যদি আগে জানত যে এমন কিছু লেখা সম্ভব, তাহলে সৌগত বা শর্মিলাও হয়তো বাঁচত!

সে তড়িঘড়ি খাতার পরের পাতাগুলো দেখে — সৌগতের, শর্মিলার, বিক্রমজিতের নাম এখনও লেখা। কিন্তু তার নিচে লেখা —
“বিচার হয়নি, মৃত্যু চূড়ান্ত।”

অনির্বাণ চোখ বন্ধ করে শ্বাস নেয়। তারপর খাতা বন্ধ করে বাড়ি ফিরে আসে।

সে এখন জানে — খাতা শুধু বলে দেয় না, সে জিজ্ঞেস করে, এবং শোনে।

রাতে খাওয়া শেষ করে সে আবার খাতাটা খোলে — এবার নিজের নামের পাতা।

“অনির্বাণ মিত্র — ১ জুলাই ২০২৫”

আজ ৩০ জুন। আর মাত্র একদিন বাকি।

কিন্তু আজ, সেই পাতার নিচে ছোটো করে লেখা ভেসে ওঠে —
“বিচারক নিজেই বিচারাধীন। সিদ্ধান্ত আগামীকাল।”

তার মানে, এবার নিজের জীবনের রায় তাকেই দিতে হবে।

রাত গভীর। ঘড়িতে ১২টা বাজে। ১ জুলাই ২০২৫। আজ অনির্বাণ মিত্রর মৃত্যুর দিন।

সে জানালার পাশে বসে আছে, খাতাটা সামনের টেবিলে খুলে রাখা। বাতি জ্বলছে ধুসর আলোয়, পেছনে একটি কুকুরের ডেকে ওঠা ছাড়া শহর প্রায় নিস্তব্ধ। কিন্তু এই নিস্তব্ধতা অনির্বাণের মনের ভেতর কোনও শান্তি আনছে না।

তার চোখ স্থির হয়ে আছে খাতার পাতায়—
“অনির্বাণ মিত্র — বয়স ৩১ — মৃত্যুর তারিখ: ১ জুলাই ২০২৫”
তার নিচে কালো কালিতে লেখা —
“বিচারক নিজেই বিচারাধীন। সিদ্ধান্ত আজ।”

সিদ্ধান্ত? কাদের জন্য? তার নিজের?

অনির্বাণ চুপচাপ চোখ বন্ধ করে ভাবে — যদি খাতাটি তাকে শক্তি দিয়েছে অন্যদের বিচার করার, তবে সে কি নিজের ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকতে পারবে?

তার মৃত্যুর দিন আজ — কিন্তু কিভাবে মৃত্যু আসবে, জানা নেই। আত্মহত্যা? দুর্ঘটনা? অসুখ? না কি… কেউ মারবে তাকে?

এমন সময় খাতার পেছনের সাদা পাতায় অদ্ভুতভাবে অদৃশ্য কালি ভেসে ওঠে —
“তুমি যদি নিজেকে বাঁচাতে চাও, তবে প্রমাণ দাও তুমি বাঁচার যোগ্য।”

অনির্বাণ কিছুটা ঘাবড়ে যায়। তার মাথায় আসে — বাঁচার যোগ্যতা কি কেবল এই যে সে খাতা দেখে ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারে? নাকি সে মানুষ হিসেবে বাঁচার যোগ্য?

তার চোখে ভেসে ওঠে সেই মানুষগুলোর মুখ — সঞ্জয় বসু, নন্দিনী রায়, সৌগত পাল, শর্মিলা দে, বিক্রমজিৎ ঘোষ… এবং সুবর্ণা।

সবাই মারা গেছে, একমাত্র সুবর্ণা ছাড়া। আর সুবর্ণাকে সে বাঁচাতে পেরেছে কারণ সে বিচার করেছিল।

তাহলে কি নিজেকে নিয়েও তাকে বিচার করতে হবে? নিজের পাপ-পুণ্য মাপতে হবে?

সে নিজের পুরনো জীবন ঘাঁটতে শুরু করে —

সে তো কখনও চুরি করেনি, কাউকে মারেনি। কিন্তু সে কি সত্যি নির্দোষ?
সে ভাবে — ছোটোবেলায় সে এক বন্ধুকে ঠকিয়ে পরীক্ষায় পাশ করেছিল। একবার প্রেমে মিথ্যে কথা বলেছিল এক মেয়েকে। বাবা-মায়ের সঙ্গে বহুবার দুর্ব্যবহার করেছে।

সত্যি কি এগুলো মৃত্যুর যোগ্য পাপ?

সে আবার খাতার দিকে তাকায়। পেছনের পাতায় লেখা —
“বিচার ফর্ম:
১. নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য লেখো।
২. নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল লেখো।
৩. নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় সত্যিকারের ভালোবাসা কী ছিল, বলো।”

অনির্বাণ বিস্মিত হয়ে বসে পড়ে। এবার খাতা প্রশ্ন করছে — অথচ উত্তর দিতে হবে তাকে।

সে কলম হাতে নেয়।

১. সত্য:
“আমি জানতাম আমি সাধারণ। আমি বিশেষ কেউ নই। কিন্তু আমি চাইতাম, আমি এমন কিছু পেতাম যা আমাকে বিশেষ করে তোলে। সেই চাহিদা থেকেই আমি খাতার খেলা খেলেছি।”

২. ভুল:
“সৌগত পালকে বাঁচাতে গিয়েও আমি ভয় পেয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস করিনি যে আমি কিছু পাল্টাতে পারি। আমি যদি সাহসী হতাম, তার মৃত্যু হয়তো ঠেকানো যেত।”

৩. ভালোবাসা:
“মা। ছোটোবেলায় প্রতিদিন রাত ৯টার খবরের পরে মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলত — ‘তুই একদিন খুব বড় হবি।’ আমি বড় হইনি। কিন্তু মা কখনও আশা ছাড়েনি।”

লেখা শেষ হতেই খাতা কাঁপে একবার। বাতি ঝাপসা হয়ে ওঠে।

তারপর খাতায় লাল কালি দিয়ে ভেসে ওঠে —
“তুমি সত্য বলেছো। তুমি ভুল স্বীকার করেছো। তুমি ভালোবাসা চিনেছো।
এই তিনে জন্ম — মৃত্যু — পুনর্জন্ম।
তোমার রায়: মৃত্যু স্থগিত।”

অনির্বাণ নিঃশ্বাস ফেলল। বুকের ভেতর থেকে যেন শত বছর পুরনো বোঝা সরে গেল।

কিন্তু সে খেয়াল করল — পাতার একদম নিচে ছোট করে লেখা —
“তুমি এখনো বিচারক। কিন্তু খেলা শেষ নয়। এবার খাতা অন্য পথ খুঁজবে। এবং তুমি এখন তার অভিভাবক।”

ঘড়িতে ১২টা ৪৫ বাজে।

তখনই ফোনে একটা বার্তা আসে —
“Unknown: You passed. But others are waiting.”

অনির্বাণের গায়ে কাঁটা দেয়।

সে বুঝে যায়, এই খাতা তার হাতে চিরকাল থাকবে না। তবে যতদিন থাকবে, যতজন মানুষ খাতায় লেখা থাকবে, সে এখন বিচারক। এবং এই দায়িত্ব চিরন্তন, নিঃসঙ্গ, এবং… বিপজ্জনক।

সে খাতাটা বন্ধ করে টেবিলের ড্রয়ারে রেখে দেয়।

ঠিক তখন, জানালার বাইরে এক বিড়াল ডেকে ওঠে। আর খাতার ভেতরে পাতার ভাঁজে একটা নতুন নাম ভেসে ওঠে —
“রাহুল চক্রবর্তী — বয়স ১৮ — মৃত্যুর তারিখ: ২ জুলাই ২০২৫”

খেলা আবার শুরু।

১ জুলাই গভীর রাত।
অনির্বাণ বিছানায় শুয়ে আছে, কিন্তু ঘুম আসছে না। যদিও খাতা জানিয়েছে তার মৃত্যু ‘স্থগিত’ হয়েছে, তবুও বুকের গভীরে একটা অস্বস্তি ঠিক রয়ে গেছে।

সে উঠে বসে, ড্রয়ার খুলে খাতাটা বের করে। পাতার শেষদিকে এখন ভেসে উঠেছে নতুন নাম —
“রাহুল চক্রবর্তী, ১৮ বছর, ছাত্র, হাওড়া। মৃত্যুর তারিখ: ২ জুলাই ২০২৫।”

অনির্বাণ খেয়াল করে, খাতার ভেতরের লেখার ধরন বদলে গেছে। আগের পাতাগুলো ছিল পেটানো কাঠামোয় — নাম, বয়স, ঠিকানা, মৃত্যুর তারিখ। কিন্তু এখন প্রতিটি নামের পাশে আরেকটি ছোট বাক্য জুড়ে যাচ্ছে — যেন একটা সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন।

রাহুলের নামের পাশে লেখা —
“সন্দেহজনক চরিত্র, নিয়ন্ত্রণের বাইরে, অপরাধে জড়িত হতে পারে।”

এটা নতুন। এই প্রথম খাতা কাউকে নিয়ে মতামত দিয়েছে।

অনির্বাণ ভাবে — এই ছেলেটির বিষয়ে তাকে বিচার করতে হবে। কিন্তু সে নিজেই কি যথেষ্ট জানে কোনো কিশোরের জীবন নিয়ে এমন রায় দিতে?

সে তার ল্যাপটপ খুলে রাহুল চক্রবর্তীর খোঁজ করতে থাকে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, সংবাদ — হালকা-পাতলা তথ্য মেলে। সে ছাত্র, হাওড়া সরকারি স্কুলে পড়ে, কিছু মাস আগে স্কুল থেকে শাস্তি পেয়েছিল—বাকি এক বন্ধুকে মারধরের অভিযোগে। কিছু ছবিতে রাহুলকে দেখা যায় বাইকে, হাতে সিগারেট, চোখে চড়া দৃষ্টি।

কিন্তু অনির্বাণ জানে, ছবি দিয়ে মানুষ বোঝা যায় না।

সে সিদ্ধান্ত নেয়, সরাসরি দেখা করতে হবে।

২ জুলাই সকালে সে পৌঁছে যায় হাওড়ার ঘুসুড়ি এলাকায়। রাহুলের বাড়ি পুরনো, দোতলা। নিচে একটা টিনের ছাউনি দেওয়া চায়ের দোকান। সেখানে রাহুলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে — কালো টি-শার্ট, মোবাইলে গেম খেলছে।

অনির্বাণ কাছে গিয়ে বলে, “তুই কি রাহুল?”
ছেলেটা তাকিয়ে বলে, “হ্যাঁ। আপনি কে?”
“আমি তোর বাবার বন্ধু। তোকে কিছু দরকারি কথা বলতে এসেছি।”

রাহুল অবিশ্বাসের চোখে তাকায়। “আমার বাবার তো তেমন কোনো বন্ধু নেই।”
“তাই বলছি, আমি আসলে… একটু অদ্ভুত কাজ করি। ভবিষ্যৎ দেখি।”

রাহুল হেসে ফেলে, “তাহলে আমার লটারি নম্বরটা বলে দিন।”

অনির্বাণ ধীরে বলে, “আজ তুই মারা যাবি। যদি কিছু না করিস, সন্ধ্যার মধ্যে।”

ছেলেটা থমকে যায়, মুখে চঞ্চলতা হঠাৎ স্থির। “আপনি কে আসলে?”
“আমি জানি, তুই ঝামেলা করিস, তোর স্কুল তোকে সতর্ক করেছিল। কিন্তু আমি এটা জানতে চাই না। আমি শুধু জানতে চাই — তুই মরতে চাস?”

রাহুল কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলে, “জানি না। কখনও কখনও মনে হয় সব শেষ করে দিই। কিন্তু আবার মা’র কথা মনে পড়ে।”

“তোর কোনো বড় ভুল হয়েছে?”
“বন্ধুদের সঙ্গে মিলেমিশে কিছু বাজে কাজ করেছি। একবার মোবাইল চুরি করেছিলাম। কিন্তু এখন শুধরোতে চাই।”

অনির্বাণ তাকিয়ে থাকে ছেলেটার চোখে। চোরা ক্ষোভ আছে, কিন্তু সেই ক্ষোভের নিচে একটা অব্যক্ত ভয়, আর একটা সুযোগের খোঁজ।

সে ভাবে, এই ছেলেটি যদি অপরাধের দিকে এগিয়ে যায়, তাহলে একদিন হয়তো কাউকে মারবে। এখনই মৃত্যু হলে সে হয়তো রক্ষা পাবে, আবার অন্যরাও রক্ষা পাবে। কিন্তু…

তার মনে পড়ে, সুবর্ণাকেও সে বাঁচিয়েছিল কারণ সে গান গাইত। রাহুলের গান নেই, কিন্তু তার চোখে একটা দ্বিতীয় সুযোগের ইচ্ছা আছে।

অনির্বাণ এবার খাতা খুলে রাহুলের পাতায় কলম চালায় —
“বিচারক মন্তব্য: রাহুল চক্রবর্তী — অপরিণত, তবে পরিবর্তনের সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ। মৃত্যুর বদলে সুযোগ দেওয়া হোক।”

লেখা শেষ হতেই খাতা কেঁপে ওঠে। তারপর ভেসে ওঠে নতুন লাইন —
“মৃত্যু স্থগিত। পর্যবেক্ষণে অন্তর্ভুক্ত।”

এটা আবার নতুন।

“পর্যবেক্ষণ মানে?” — অনির্বাণ ভাবতে থাকে।

ঠিক তখনই, হাওড়ার সেই গলির মুখে হঠাৎ একটা গাড়ি এসে দাঁড়ায়। জানালা খুলে একজন লোক বলে, “রাহুল, আয়, বুবুন তোকে খুঁজছে।”

রাহুল চমকে যায়। অনির্বাণ দেখে, রাহুল ইতস্তত করছে।

“কে?”
“তুই চিনিস না? আয়।”

রাহুল পেছনে তাকায় অনির্বাণের দিকে।

“ওরা কারা?”
“আমাদের পাড়ার লোক। মাঝে মাঝে বাজে জিনিসে নামিয়ে নেয়। মাকে বলিনি। কিন্তু আমি এখন যাচ্ছি না।”

গাড়ির লোক গাল দিয়ে চেঁচায়, “ভীষণ ভাব নিচ্ছিস, আজকে গেলে ভালো কিছু পেতি।”

রাহুল পিছিয়ে আসে। গাড়ি চলে যায়।

অনির্বাণ বুঝে যায় — এই মুহূর্তটাই ছিল বিচার। এবং রাহুল পাশ করেছে।

রাহুল ফিসফিস করে বলে, “আপনি কে জানি না। কিন্তু আজ যদি আমি ওদের সঙ্গে যেতাম, জানি না কি হত। থ্যাঙ্ক ইউ।”

অনির্বাণ শুধু হাসে। “খুব ভালো থেকো।”

সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে এসে সে খাতাটা খোলে। রাহুলের পাতার নিচে নতুন লাইন —
“জীবন তখনই অর্থ পায়, যখন মৃত্যু পিছিয়ে যায়।”

এবং তার নিচে উঠেছে পরবর্তী নাম —
“ডা. রিমা রায়, বয়স ৪২, মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, পার্ক সার্কাস। মৃত্যুর তারিখ: ৩ জুলাই ২০২৫।”

আরও অদ্ভুত — পাতার পাশে ছোট করে লেখা —
“এই মৃত্যু পূর্বনির্ধারিত নয়। এই মৃত্যু ডাকা হবে।”

ডাকা হবে?

মানে কী?

খাতা কি এবার মৃত্যুর নিয়ন্ত্রণ বাইরে ছড়িয়ে দিচ্ছে?

৩ জুলাই, সকাল সাড়ে আটটা।
অনির্বাণ ধীরে ধীরে টেবিলের সামনে বসে, খাতা খুলে। পাতায় লেখা —
“ডা. রিমা রায়, বয়স ৪২, পেশা: সাইকিয়াট্রিস্ট, পার্ক সার্কাস। মৃত্যুর তারিখ: ৩ জুলাই ২০২৫।”
আর তার পাশে লাল কালিতে লেখা —
“এই মৃত্যু পূর্বনির্ধারিত নয়। এই মৃত্যু ডাকা হবে।”

এই লাইনটি তার ঘাড়ের পেছনে ঠাণ্ডা বাতাস বইয়ে দেয়।
ডাকা হবে — মানে কি?

মানে কি কেউ ডাকলেই মৃত্যু নেমে আসবে? তবে সেই ডাক কার থেকে আসবে? কার ইচ্ছায় মৃত্যু আসবে — খাতার, কারো শত্রুর, নাকি… অনির্বাণের নিজের?

সে নিজের চোখে পড়ে — নিচে ছোট করে লেখা —
“তোমার সিদ্ধান্তই ডাক। আজ তুমি বিচারক নও, তুমি ঘণ্টাবাদক।”

অনির্বাণ গভীরভাবে বুঝে ফেলে, আজ তার সিদ্ধান্ত বাঁচাবে না, বরং মৃত্যু ডাকবে কি না সেটা নির্ধারণ করবে।
আজ তার হাতেই বেঁচে থাকার শেষ ঘণ্টা।

সে নিজের ভিতর জিজ্ঞেস করে — “আমি কি এই ক্ষমতা পাওয়ার যোগ্য? আমি কি বোঝাতে পারব, কে বাঁচবে, কে মরবে?”

ডা. রিমা রায় — একজন মানসিক চিকিৎসক। মানুষের মানসিক জট খুলে জীবন ফেরানোর কাজ করেন।

অনির্বাণ গুগলে খোঁজ করে, রিমা রায় একজন প্রতিষ্ঠিত সাইকিয়াট্রিস্ট, পিয়ার-রিভিউড জার্নালে লেখেন, অবসাদ নিয়ে প্রচুর কাজ করেছেন, কিছু সেশনে আত্মহত্যা প্রবণ রোগীদের রক্ষা করেছেন — আবার কিছু সেশনে অভিযোগও উঠেছে তিনি নাকি ওষুধের ডোজ বেশি দেন, কাউকে কাউকে ভয় দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণ করেন।

সব কিছু মিলিয়ে — মানবিক, কিন্তু নির্ভুল নয়।

অনির্বাণ এক মুহূর্ত ভাবে, “এই কি সেই মানুষ, যার মৃত্যুর ডাক আসা উচিৎ?”

সে দুপুরে রিমা রায়ের ক্লিনিকে যায়—একজন রোগী সেজে।

“আপনার নাম?” — রিসেপশনে জিজ্ঞেস করা হয়।
“অনির্বাণ ঘোষাল।”

রিমার চেম্বারে ঢুকে দেখে — এক টেবিল, কিছু বই, একপাশে হালকা মিউজিক চলছে। রিমা রায় বসে আছেন—গম্ভীর, আয়রন-প্রেসড শাড়ি পরা, মুখে কড়া চশমা।

“বসুন, বলুন কী সমস্যা?”

অনির্বাণ বলে, “আমি ঘুমাতে পারি না। প্রায়ই দেখি আমি মরে যাচ্ছি। একটা খাতা আছে, যেখানে নাম লেখা থাকলেই লোকজন মরে যায়। এবার সেই খাতায় আমার নাম উঠেছে।”

রিমা একটু থেমে বলেন, “আপনার এই কল্পনার উৎস কোথায়? আগে কখনও এমন অনুভব করেছেন?”

“না। কিন্তু খাতা যেমন লোক মরে গেছে, তেমনই দেখেছি।”

রিমা লিখে রাখেন — Delusional Paranoia with symbolic fixation।

“আপনার বাস্তবতা আর কল্পনার মধ্যে পার্থক্য হারিয়ে গেছে।”

অনির্বাণ একবার জিজ্ঞেস করে, “আপনি কি কখনও ভেবেছেন, কেউ যদি বিচারক হতো — কে বাঁচবে, কে মরবে — তাহলে কী করতেন?”

রিমা ঠাণ্ডা গলায় বলে, “আমি প্রতিদিন সেই কাজ করি। কোন রোগীকে ছাড় দেব, কাকে হাসপাতালে ভর্তি করাব, কার ওপর ওষুধের ডোজ বাড়াব — আমি সিদ্ধান্ত নিই। এই দায়িত্ব ভারী, কিন্তু আমি এড়িয়ে যাই না।”

“আপনি কি কখনও ভুল করেননি?”

রিমা একটু থমকে যায়। “ভুল? হ্যাঁ, হয়তো করেছি। একজন রোগী ছিল — নাম রাখি রোহিত। খুব ভালো ছেলে ছিল, কবিতা লিখত। আমি ডায়াগনোসিসে ভুল করেছিলাম। ওষুধের সাইড ইফেক্টে আত্মহত্যা করে। তারপর আমি নিজেকে প্রশ্ন করি — আমি কি তাকে মেরেছি?”

একটা নীরবতা।

রিমা বলেন, “আমরা সবাই বিচার করি। কিন্তু কেউই ঈশ্বর নই। তবে যদি আপনার কথার খাতা সত্যি হয় — আর আমি যদি তাতে থাকি — তাহলে সেই খাতা কাকে দিয়েছে এমন শক্তি?”

অনির্বাণ আস্তে উত্তর দেয়, “আমাকে।”

রিমা হাসেন, “তাহলে আপনি এখন ঈশ্বর?”

“না। কিন্তু খাতাটা বলে আমি আজ ঘণ্টা বাজাতে পারি। আপনি বাঁচবেন না মরবেন, সেটা আমার ইচ্ছায়।”

রিমা এবার আর হেসে না। চুপ করে বলে, “তাহলে বাজান। যদি মনে করেন আমার মৃত্যু কারও ভালো করবে, তো আমি প্রস্তুত।”

অনির্বাণ তার দিকে তাকায়। রিমার চোখে ভয় নেই। কিন্তু একধরনের ক্লান্তি আছে। যেন প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের জীবনের ভার নিজের উপর টানতে টানতে আজ নিজেকে হারিয়েছেন।

সে চুপচাপ খাতা খুলে রিমার নামের পাতায় কলম ছোঁয়ায়। একটু অপেক্ষা করে। তারপর লেখে —
“বিচারকের সিদ্ধান্ত: মৃত্যু বাতিল। কারণ — এই মৃত্যুর দায় রিমার নয়, সময়ের। সে পরিশ্রম করে, বিচার করে। কখনও ভুল করলেও সে মৃত্যু ডেকে আনে না।”

খাতায় লেখা হয় —
“মৃত্যু প্রত্যাহার। বিচারক কর্তৃক ঘণ্টা নিরব।

অনির্বাণ ফিরে আসার পথে দেখে — আকাশ পরিষ্কার।

রাতে খাতার পেছনে লেখা হয় —
“তুমি রায় দিতে শিখেছো। এবার শিখবে — হারাতে।”

অনির্বাণের গা কেঁপে ওঠে। ঠিক তখনই খাতার শেষ পাতায় তার মায়ের নাম ভেসে ওঠে —
“মিতা মিত্র — বয়স ৬১ — মৃত্যুর তারিখ: ৪ জুলাই ২০২৫”

সে হতবাক। মায়ের নাম?

সঙ্গে লেখা —
“এই মৃত্যু তোমার সমস্ত শক্তি বিনিময়ে রোখা যাবে।”

সেই রাতে, খাতার পাশে বসে, চোখে জল নিয়ে অনির্বাণ লেখে —
“আমি সমস্ত ক্ষমতা ছেড়ে দিচ্ছি। খাতা, তোমাকে ফিরিয়ে দিলাম। যদি মা বাঁচে, আমি আর কিছু চাই না।”

পরদিন সকালে খাতা উধাও। শুধু টেবিলের ওপর রাখা এক চিরকুট —
“বিচারকের সময় শেষ। এখন সে শুধুই পুত্র। মা ঠিক আছেন।”

অনির্বাণ জানে, খেলা শেষ হয়নি। কিন্তু তার জন্য সেই খেলা থেমে গেছে।

[সমাপ্ত]

1000025026.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *