Bangla - সামাজিক গল্প

অপরিচিত শহর

Spread the love

কৌশিক দে


অধ্যায় ১: 

সুজন মল্লিক এক সাধারণ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন, যেখানে জীবন ছিল একদম নির্ধারিত, সহজ, এবং পরিচিত। প্রাতঃকালের সূর্য ওঠার সাথে সাথে বাড়ির আঙিনায় গরু-ছাগল বাঁধা, মাঠে কাজের জন্য লোকজনের তাড়া, শীতের সময় কুপি দিয়ে আগুন জ্বালানো এবং বিকেলে পাট ক্ষেতের পেছনে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার দিনযাপন। গ্রামের ছোটখাটো জীবন, যেখানে সমস্যা ছিল না বললেই চলে, একটানা গতিশীল থাকত। তবে সুজনের মনে এক অজানা আকাঙ্ক্ষা ছিল, তার গ্রাম থেকে বেরিয়ে বড় শহরের এক নতুন দুনিয়ার দিকে পা বাড়ানোর। সে জানত, বড় শহরে যদি কাজের সুযোগ পায়, তবে সেখানে তার জীবনের বড় পরিবর্তন ঘটবে। গ্রামে সে যা কিছু জানত, তা ছিল সবার কাছে সাধারণ, কিন্তু শহরের পরিসরে সে নিজেকে আরো বেশি প্রতিষ্ঠিত দেখতে চাইত। পরিবার থেকে কিছু টাকা সংগ্রহ করে, সুজন তার জীবনের প্রথম বড় সিদ্ধান্ত নেয়—শহরে গিয়ে একটা চাকরি খুঁজবে, যেখানে সে নিজের স্বপ্নের পথ তৈরি করতে পারবে। শেষবেলায় বাবা-মায়ের চোখে অনিশ্চয়তার ছাপ ছিল, কিন্তু তারা তাকে উৎসাহিত করেছিল, “তুমি যদি শহরে যেতে চাও, তবে গিয়ে চেষ্টা কর, আমরাও তোমার জন্য অপেক্ষা করব।”

শহরে এসে সুজন তার জীবনের নতুন পথের শুরু দেখে। প্রথমে সে মেট্রো রেলের যাত্রা, উঁচু বিল্ডিং, ব্যস্ত রাস্তায় হাঁটার অভিজ্ঞতা গ্রহণ করতে থাকে। গ্রামের সবকিছু তার কাছে খুব সহজ মনে হলেও, শহরের সেই ভিড়, ঠাসাঠাসি, আর নিঃশব্দ অস্থিরতা তাকে এক ধরনের শূন্যতার মধ্যে ঠেলে দেয়। রাস্তায় চলতে চলতে একে অপরকে ধাক্কা দেয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়, দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভিক্ষুকরা মানুষকে পথ হারিয়ে দেওয়ার মতো এক আকাশ ছোঁয়া দাবি রাখে। প্রথম দিনের কাজের চাপ, সহকর্মীদের অজানা আক্রমণ, অপরিচিত পরিবেশে সবকিছু তাকে অচেনা মনে হতে থাকে। অফিসের টেবিলের উপরে সাদা কাগজের ওপর বড় বড় প্রজেক্ট, ডেডলাইন, সঙ্গী সহকর্মীদের মাঝে এক ধরনের চাপ এবং যন্ত্রণা ছিল। সুজন নিজেকে অসহায় মনে করছিল, কারণ সেখানে তার গ্রাম্য জীবনযাত্রার সরলতা ছিল না। প্রথম দিন শেষে, সে হোস্টেলে ফিরে গিয়ে নিজের অজানা ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতে থাকে। তার কাছে নিজেকে শহরের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া যেন এক অসম্ভব কাজ মনে হচ্ছিল। কিন্তু সে জানত, পেছনে ফিরে যাওয়া তার জন্য কোনো উপায় নয়। গ্রামে তার জায়গা ছিল, কিন্তু শহরে তাকে নিজের একটা জায়গা তৈরি করতে হবে, এখানেই তার জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হবে।

তবে, শহরের কঠিন বাস্তবতার সাথে যে শর্তানুযায়ী সুজন মানিয়ে নিতে হবে, তা সে খুব তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করতে পারে। অফিসে সহকর্মীদের সঙ্গেও তার সম্পর্ক একটু আঁচ করা যায়। সে বুঝতে পারে, শহরের মানুষরা এতটা সরল নয়, তাদের মনোভাব অনেক বেশি প্রতিযোগিতামূলক, এবং তাদের সম্পর্ক অনেকটা স্বার্থসিদ্ধ। সে যা আশা করেছিল, তার থেকেও অনেক বেশি কঠিন ছিল এখানে আত্মস্থ হওয়া। প্রতিদিনের ব্যস্ততা, অফিসের কাজ, সবার মধ্যে ছোট ছোট বৈষম্য এবং এক ধরনের অপরিচিতা অনুভূতি তাকে তাড়িয়ে নিয়ে চলছিল। একদিকে, সুজন যখন গ্রামে থাকত, সেখানে সবকিছু ছিল তার হাতের মুঠোয়, সেখানে ভালোবাসা আর সহানুভূতির সম্পর্ক ছিল। কিন্তু শহরে এসে তাকে অনুভব করতে হয় যে, এখানে সম্পর্কগুলো খুবই ভঙ্গুর এবং মানুষের মাঝে এক অদ্ভুত চুপচাপ ব্যস্ততা বিরাজমান। গ্রামে যেভাবে সবাই একে অপরকে চিনত, সবকিছু ছিল পারস্পরিক, এখানে সবার মধ্যে বিচ্ছিন্নতা এবং নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তবে শহরের এই খোলামেলা বাস্তবতাতেও সুজনের মনোভাব ছিল দৃঢ়—যতই কঠিন হোক, তাকে তার জায়গা তৈরি করতেই হবে।

এই কঠিন যাত্রায় সুজন যখন বুঝতে পারে, তার গ্রাম্য জীবনকে শহরে মানিয়ে নেওয়া শুধুমাত্র একটি প্রক্রিয়া, তখন তার মনোভাব পরিবর্তিত হতে শুরু করে। প্রথমদিকে যা কিছু তাকে অজানা মনে হচ্ছিল, তা এখন একেবারে নতুন পথের প্রেরণা হয়ে উঠতে শুরু করে। প্রথম পদক্ষেপ নেবার পর, শহরের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে থাকে। এখন সে জানে, জীবনের প্রতি তার দৃষ্টিকোণ শুধু গ্রামীণ নয়, শহরের অভ্যস্ততাতেও খাপ খাইয়ে চলতে হবে। তবে সে কল্পনাও করে না, যে শহরের কষ্ট, শ্রম আর দিনরাতের চাহিদার মধ্যে তার অভ্যস্ততা একটি শক্তিতে রূপ নেবে। শহরের কঠিন বাস্তবতা তাকে না ভেঙে, বরং এক নতুন শক্তি ও অঙ্গীকার এনে দেয়।

অধ্যায় ২: 

শহরের প্রথম কিছু দিন সুজনের জন্য ছিল এক নতুন পৃথিবীর অভিজ্ঞতা। সকালে হোস্টেলের রুম থেকে বের হয়ে যখন সে প্রথম শহরের রাস্তায় পা রাখে, তখন তার মনে হয় যেন এক বিশাল সমুদ্রে ঢুকে পড়েছে। পথের দুই পাশে উঁচু বিল্ডিং, রাস্তায় মানুষের ভিড়, দ্রুতগতিতে চলতে থাকা গাড়ি, সাইকেল, বাস—সবকিছুই ছিল অচেনা, অস্পষ্ট। তার পায়ের নিচে যেন জমাট বাঁধা পৃথিবীটা এক লহমায় ভেঙে যায়। চেনা পৃথিবী একপাশে রেখে, তাকে এখন নতুন জীবন শুরু করতে হবে। প্রথমবার যখন মেট্রোতে চড়েছিল, সে একদম থমকে গিয়েছিল। যাত্রীদের মুখাবধি, তাড়াহুড়া, কখনো কখনো একে অপরকে ধাক্কা দিয়ে পাশ কাটানো—সবকিছুই তার গ্রামীণ শুদ্ধতা থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত। কিন্তু সুজন কোনোভাবেই একে পরিত্যাগ করতে চায়নি। প্রতিটি মুহূর্তের মধ্য দিয়ে সে শিখতে চেয়েছিল, জীবনের এই নতুন অধ্যায়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল। তবে শহরের রুক্ষ পরিবেশে এক অজানা আতঙ্ক তাকে তাড়া করছিল।

দ্বিতীয় দিন যখন সুজন তার নতুন অফিসে কাজ শুরু করল, তখন তার মধ্যে এক ধরণের অস্থিরতা প্রবল হতে থাকে। অফিসের মধ্যে আধুনিক প্রযুক্তি, সবকিছুই দ্রুত হয়ে চলছিল। সহকর্মীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা, তাড়াহুড়া, আর একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চাপ—এ সব কিছু ছিল তার জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। অফিসে প্রথম মিটিংয়ের পর সুজন বুঝতে পারল, শহরের কাজের ধরনটা তার গ্রামীণ জীবনের তুলনায় অনেক আলাদা। এখানে সবার কাছে সময় অমূল্য, এবং কোনো কাজ শেষ না হলে সেটা নিজের অসামর্থ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রথমদিকে, সুজন অনুভব করেছিল যে, সে এই দ্রুত গতির জীবন থেকে কিছুটা পিছিয়ে পড়ছে। সহকর্মীরা তাকে দেখেও না দেখে চলছিল, কোনো অস্বস্তি বা সহানুভূতির চিহ্নও নেই। প্রথম দিকে, একাধিক বার সুজন চেষ্টাও করেছিল সহকর্মীদের সাথে একটু বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ হতে, তবে প্রতিটি সময় তার মনে হয়েছে, এখানে মানুষের কাছে সময় নেই, সবাই নিজের জন্য ছুটছে। কোনো এক সন্ধ্যায়, যখন সুজন হোস্টেলে ফিরছিল, তার মনে হয়েছিল—”এখানে কেউ কাউকে বোঝে না, সবাই একে অপরকে ঠেলে এগিয়ে চলে।”

এই পরিস্থিতির মাঝে, সুজন বুঝতে পারে যে, তাকে শুধু তার কাজেই মনোযোগী হতে হবে, তবে সেই সঙ্গে শহরের কঠিন পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে। একদিন, লাঞ্চ ব্রেকে সহকর্মীদের মধ্যে একাধিক আলোচনা শুনে তার মনে হতে থাকে, “এখানে সবাই একে অপরের প্রতিযোগী, কেউ কাউকে কোনো সাহায্য করতে চায় না।” এক এক করে, সে টের পেতে থাকে যে, তার নিজের কাজের দক্ষতা, মনোভাব, এবং একাগ্রতা না থাকলে এখানে টিকে থাকা খুবই কঠিন হবে। শহরের মানুষের মধ্যে এক ধরনের দূরত্ব ছিল, যেন একে অপরের মধ্যে কোনো সম্পর্কের প্রয়োজন নেই। কেউ যদি বিপদে পড়ে, তাহলে কেউ তাদের সাহায্য করবে না, বরং নিজের জায়গা সংরক্ষণে ব্যস্ত থাকবে। এটি ছিল শহরের কঠিন বাস্তবতা, যা সুজন প্রথমবারের মতো বুঝতে পেরেছিল।

তবে, এক সন্ধ্যায় শহরের একটা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সুজন তার গ্রামের কথা মনে পড়ে যায়। গ্রামে একে অপরকে সাহায্য করা, সুখ-দুঃখের মুহূর্তগুলো শেয়ার করা—এই সবকিছু তার মনে এক ধরনের শূন্যতার সৃষ্টি করেছিল। সে নিজেকে শহরের পরিবেশে একদম একা অনুভব করছিল। কিন্তু শহরের এই অদ্ভুততা তাকে আলাদা করে ভাবাতে শুরু করে। শহরের মানুষের মাঝে সম্পর্কের অভাব ছিল, কিন্তু তাদের একে অপরকে শ্রদ্ধা করার যে ক্ষমতা, সেটাও সুজন শিখতে চেয়েছিল। তাই, যে কঠিন পরিস্থিতি তাকে চাপে ফেলেছিল, সেই চাপকে শক্তি হিসেবে নিয়ে সুজন এখন অগ্রসর হওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। প্রথম দিনের অস্থিরতা, অপরিচিততা, আর সহকর্মীদের নিরাসক্ত মনোভাব তার ভেতরে এক ধরনের পরিবর্তন ঘটাতে শুরু করেছিল। সে মনে করেছিল, “যত কঠিন হবে, তত বেশি শিখতে পারব।”

এভাবে, প্রতিদিনের কাজের মধ্যে শহরের নতুন নতুন অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা লাভ করতে করতে সুজন শহরের সাথে পরিচিত হয়ে উঠতে থাকে। তার অস্থিরতা, ভীতির জায়গাগুলো ধীরে ধীরে সরে যেতে থাকে, এবং নতুন কিছু শিখতে তার মধ্যে এক ধরনের আগ্রহ তৈরি হয়। কাজের প্রতি তার মনোযোগ, সহকর্মীদের প্রতি সততা, আর নিজের প্রতি আস্থা—এগুলো তাকে শহরের মধ্যে কিছুটা হলেও শক্তিশালী করে তুলেছিল। এক রাতে, হোস্টেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে, সুজন শহরের অদ্ভুত ছন্দের দিকে তাকিয়ে ভাবছিল, “এটা আমার নতুন পথ, এই পথেই আমি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারব।”

এইসব চিন্তা-ভাবনার মাঝে, সুজন এক ধরনের আশাবাদী দৃষ্টি নিয়ে শহরের জীবনকে গ্রহণ করল। সে জানত, জীবনের এই নতুন পথের জন্য তাকে নিজেকে পরিবর্তন করতে হবে, কিন্তু সে প্রস্তুত ছিল।

অধ্যায় ৩:

শহরের জীবন আসলেই কতটা অদ্ভুত, তা সুজন প্রতিদিন বুঝতে পারছিল। প্রথমদিকে শহরের পরিবেশ তাকে আতঙ্কিত করেছিল, শহরের দৃষ্টিতে তার গ্রামীণ জীবনযাপন ছিল যেন এক ধরনের দুর্বলতা, অথবা পুরনো কিছু। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তার মনোভাব পরিবর্তিত হতে শুরু করেছিল। শহরের কঠিন বাস্তবতায় জীবনের নতুন এক পরিচয় খুঁজতে গিয়ে, সুজন কখনো কখনো নিজের গ্রামকে মনে করত। গ্রামের শীতল হাওয়া, খোলামেলা আকাশ, নীরব মাঠ—এগুলো যেন জীবনের এক ধরনের প্রশান্তি ছিল, যা শহরের অস্থির পরিবেশে তার কাছে দুঃস্বপ্নের মতো লাগত। গ্রামে নিজের মা-বাবা, ভাইবোনদের সান্নিধ্য, পরিচিত মানুষের হাসি—এসব ছিল এক নিরাপদ আশ্রয়, যা শহরের জীবন তাকে একেবারেই দিতে পারছিল না। প্রথম কয়েক সপ্তাহ, সুজন গভীর মনোযোগ দিয়ে শহরের সবকিছু দেখলেও, তার মনে একাকীত্বের অনুভূতি ছিল। যদিও তার লক্ষ্য ছিল নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা, কিন্তু শহরের মধ্যে সেই পরিচিত এবং শান্ত পরিবেশের অভাব তাকে মাঝে মাঝে দিশেহারা করে তুলত।

একদিন অফিসে কাজের পর সুজন এক বন্ধুর সাথে আলাপ করতে গিয়ে জানতে পারে, তার গ্রামের সবাই তাকে নিয়ে কতটা আগ্রহী ছিল। “তুমি তো শহরে গিয়ে বড় কিছু হবে, সবাই তোমার জন্য গর্বিত,” তার বন্ধুটি বলেছিল। এই কথাগুলো শোনার পর সুজনের মনে এক ধরনের অস্বস্তি আসল। গ্রামের মানুষের প্রত্যাশা তাকে আরো বেশি চাপে ফেলছিল। তাকে নিয়ে গর্বিত হওয়া, তার গ্রামে প্রত্যাশার চাপ—এসব তার কাছে খুব ভারী মনে হচ্ছিল। শহরে এসে সে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছিল, কিন্তু তার এই পথটি এতটা কঠিন ছিল যে, গ্রাম থেকে আসা প্রত্যাশার চাপ তাকে আরো বেশি হতাশ করছিল। তার মনে হতে থাকে, “আমি কি শহরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারব? গ্রামে সবাই তো এত সহজভাবে আমার পাশে ছিল, কিন্তু এখানে সবাই আমার প্রতিযোগী, সবাই শুধু নিজের দিকেই তাকিয়ে থাকে।”

এভাবে যখন সুজন দিন দিন শহরের কঠিন বাস্তবতা ও তার গ্রামীণ জীবনের মাঝে এক ধরনের বিভাজন অনুভব করছিল, তখন তার মনে একটি প্রশ্ন জন্ম নেয়—“এটাই কি আমার জন্য সঠিক পথ? আমি কি শহরে এসে নিজেকে খুঁজে পাবো, না হয় আমি হয়তো কখনোই আমার জায়গা খুঁজে পাবো না?” প্রথমদিকে, সুজন গ্রামীণ জীবনের সহজতা এবং শহরের অস্থিরতাকে তুলনা করতে লাগল। গ্রামে মানুষরা একে অপরকে সাহায্য করে, একে অপরের বিপদে পাশে দাঁড়ায়, কিন্তু শহরে সে অনুভব করেছিল যে, কেউ কারো জন্য কোনো কিছু করতে প্রস্তুত নয়। সবাই নিজের সঙ্গেই ব্যস্ত। এটি তাকে এক ধরনের অশান্তি দিয়ে চলেছিল, কিন্তু সে জানত, যদি সে শহরের প্রতিযোগিতা এবং চাপের মধ্যে নিজেকে মেলাতে না পারে, তবে সে কখনোই এগিয়ে যেতে পারবে না। সেই সময়, সুজন নিজের গ্রামীণ জীবন এবং শহরের কঠিন বাস্তবতার মাঝে একটা ভারসাম্য খুঁজতে শুরু করল।

শহরের পরিপ্রেক্ষিতে, সুজনের মনে হতে থাকে, ‘গ্রামে আমি যে শুদ্ধতাটা অনুভব করতাম, শহরে সেটা খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবে, শহরের কঠিনতা এবং অস্থিরতার মধ্যে থেকেই তো নিজেকে শক্তিশালী করা সম্ভব। আমি যদি শহরের সঙ্গে মানিয়ে না চলতে পারি, তাহলে আমি এক ধরনের পরাজয়ই স্বীকার করব। আর এটাই তো আমার জন্য সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ।’ কিছুদিন পর, সুজন এই চিন্তা থেকে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি পেতে শুরু করেছিল—শহরের প্রতিযোগিতার মধ্যে যদি সে নিজেকে অটুট রাখতে পারে, তবে সে আসলে নিজের জন্য একটা নতুন পথ তৈরি করতে পারবে।

তারপর থেকে, সুজন শহরের জীবনের প্রতিটি জটিলতা এবং চাপের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে শুরু করেছিল। তবে, শহরের ভিড়ে একেবারে হারিয়ে না গিয়ে, সে শিখতে শুরু করেছিল—শুধু প্রতিযোগিতার মধ্যে জয়ী হওয়ার জন্য নয়, বরং নিজের মানসিক শক্তি এবং আত্মবিশ্বাস বজায় রাখতে হলে তাকে শহরের শৈলীতে চলতে হবে। গ্রামীণ শুদ্ধতাকে হারিয়ে না, বরং সেই শুদ্ধতাকে নিজস্ব শক্তি হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। এই ভাবনাগুলি তার মনকে এক নতুন প্রেরণায় উজ্জীবিত করেছিল, এবং একদিন, অফিসে সহকর্মীদের মাঝে, সুজন ঠিক বুঝতে পারল—এটাই তার পথ, শহরের কঠিনতার মধ্যে দিয়েই তাকে এগিয়ে যেতে হবে।

তবে, তার জীবনের এই নতুন পথে এখনো অনেক কিছু শিখতে বাকি ছিল। সুজন একদিন সকালে শহরের একটা সিঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে, মনের মধ্যে চিন্তা করতে লাগল—“আমার পেছনে গ্রাম থেকে সবার প্রত্যাশা রয়েছে। আমি যদি সফল না হই, তবে কি তারা আমাকে মেনে নেবে?” তবে সুজন জানত, তার পেছনে গ্রাম আর শহরের মানুষদের প্রত্যাশা থাকলেও, তার পথ তৈরি করতে হবে নিজেকে বিশ্বাস করে। তাই, এই ভীড়ের মধ্যে, নিজের অস্তিত্বটাকে খুঁজে পেতে আরও দৃঢ় মনোবল নিয়ে শহরের পথে চলতে থাকল সে।

অধ্যায় ৪: 

শহরের কাজের চাপ, সহকর্মীদের প্রতি অজ্ঞাত প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং সম্পর্কের অস্থিরতা সুজনের মনকে ক্রমাগত দুঃশ্চিন্তা ও অস্থিরতায় ভরিয়ে তুলেছিল। প্রথমদিকে, শহরে তার সময় কাটানোটা ছিল একেবারে শখের মতো—কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তার মনে হত, কিছুই সে ঠিকমতো করতে পারছে না। অফিসে নিজের দক্ষতা এবং পদক্ষেপের মধ্যে এক অদৃশ্য তফাত দেখা দিতে শুরু করেছিল। সহকর্মীরা নিজের কাজ করে চলে যেত, কিন্তু সুজনের মনে হচ্ছিল, তার জায়গাটা কোথাও ধোঁয়াশায় ছিল। তার মনে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছিল—সে কি ঠিক পথেই আছে? তার গ্রামীণ জীবনযাত্রা কি তাকে এখানে সাফল্য এনে দিতে পারবে না? শহরের এই দ্রুতগতির জীবন থেকে সে কোথাও একা হয়ে যাচ্ছে, এবং নিজের পরিচিতি এবং আত্মবিশ্বাসের সংকটে পড়ছিল।

একদিন অফিসের মিটিংয়ের পর, সুজন তার সহকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের ক্ষুদ্র কিন্তু তীক্ষ্ণ হাসি দেখতে পায়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ঠাট্টা করছিল, কেউ কেউ হালকাভাবে ঠেলা দিয়ে তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল। সুজন প্রথমবারের মতো বুঝতে পারে, শহরের মানুষদের মধ্যে তার অগ্রগতির প্রতি কোনো আগ্রহ ছিল না। তিনি সবসময়ই কৌশলে কিছু খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাদের কাছে সে এক অচেনা গ্রাম্য যুবক ছাড়া কিছু নয়। তার আকাশে যে স্বপ্নগুলো উড়ছিল, সেগুলো যেন ধীরে ধীরে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছিল। প্রথমবারের মতো তার মনে হয়েছিল, “কীভাবে আমি এই জায়গায় পরিণত হবো? এখানে কি আমি কখনোই গ্রামীণ সরলতা, আস্থা এবং বন্ধুত্ব খুঁজে পাবো না?”

এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে, সুজন একদিন সন্ধ্যায় শহরের এক পার্কে হাঁটতে বের হয়। তার মনে হচ্ছিল, কিছু একটা বদলাতে হবে, নাহলে শহরের অস্থিরতায় হারিয়ে যাবে। পার্কে বসে সে ভাবছিল—“গ্রামে আমি খুব সোজা ছিলাম। আমার বন্ধুরা আমাকে জানত, আমার পরিবার জানত, এবং আমি জানতাম, মানুষগুলো কতটা সততার সঙ্গে জীবনযাপন করে। কিন্তু এখানে, আমি কি সব কিছুই ভুল করেছি? সবকিছু কি এতটাই কঠিন ছিল?” সে একবারও যেন নিজের জন্য থামতে পারছিল না। তার ভিতরের ভীতি তাকে ক্রমাগত তাড়া করছিল, তাকে যেন একজন অজ্ঞ, অপরিচিত মানুষ করে তুলে ফেলছিল। কিন্তু সুজন জানত, সে যদি শহরে তার আত্মবিশ্বাস ফিরে না পায়, তবে নিজের শেকড় হারিয়ে ফেলবে। সে নিজেকে একবার ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করল, এবং সে বুঝতে পারল—এই অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা তাকে ভেঙে ফেলবে যদি সে না শিখে যায়।

একদিন অফিসে ফিরে এসে সুজন সহকর্মীদের মধ্যে বসেছিল, যখন তার এক পুরোনো বন্ধু তার সঙ্গে যোগাযোগ করে। সেই বন্ধু তাকে বলল, “তুমি জানো, শহরে আসার পর তুমি সবসময় ব্যস্ত ছিলে। কিন্তু তুমি তো নিজেকে কখনোই তার সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করো না। হয়তো তুমি নিজেকে তোমার গ্রামীণ শুদ্ধতা নিয়ে শহরের সঙ্গে মেলাতে চাচ্ছ, কিন্তু তা খুবই কঠিন।” বন্ধু এর পর কিছু সময় নীরব হয়ে থেকে বলল, “এটা বুঝতে হবে, তোমার স্থান যদি এই শহরে পেতে হয়, তাহলে তোমার কাজের প্রতি মনোযোগ দেওয়া ছাড়া কিছুই করা যাবে না। শহর তোমাকে বিশ্বাস করবে, যদি তুমি নিজে নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখো।” এই কথাগুলো সুজনের মনে গভীরভাবে নেমে আসে। সে নিজেকে আগে কখনো এতটাও বিভ্রান্তি এবং সংকটে অনুভব করেনি, কিন্তু সেই বন্ধু তাকে যে পরামর্শ দিল, তা তাকে এক নতুন দৃষ্টিকোণ দেখাল।

এরপর থেকে, সুজন নিজের কাজে মনোযোগী হতে শুরু করল। সে মনে করল, শহরের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে, তার নিজের আত্মবিশ্বাস এবং শক্তি নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। কিন্তু এর মানে ছিল, তাকে শহরের কঠিন পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে হবে। “গ্রামের সরলতা” যদি শহরে কাজে না আসে, তবে “শহরের আত্মবিশ্বাস” তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। সে নিজেকে নতুন করে দেখতে শুরু করল, নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য নতুন দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা করতে শুরু করল।

এমনকি সুজন এক সময় নিজের শখ এবং স্বপ্নগুলো সম্পর্কে ভাবতে শুরু করল, যা সে শহরে আসার পর ভুলে গিয়েছিল। আগে যখন সে গ্রামে ছিল, সেখানে একটি পুরনো দীনস্থান ছিল যেখানে সে ছবি আঁকতে ভালোবাসত। গ্রামে থাকাকালীন একদম ছোটবেলায়, সে ভেবেছিল একদিন সে একজন চিত্রশিল্পী হবে। কিন্তু শহরে এসে, তার জীবন এতটা বদলে গিয়েছিল যে, তার সেসব পুরনো শখও কেমন যেন হারিয়ে গেছে। এক রাতে হোস্টেলে ফিরে, সুজন আবার ছবি আঁকতে বসে। সে পুরনো ইচ্ছেটাকে মনে করেছিল, এবং সিদ্ধান্ত নেয়—কাজের মাঝে শান্তি পেতে হলে, তাকে তার শখকেও পুনরায় জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে।

শহরের কঠিন পথ ধরে চলতে চলতে, সুজন শিখতে শুরু করল—নিজেকে হারানোর কোন মানে নেই, বরং নিজের পুরনো শক্তি এবং শখগুলোই তাকে এই কঠিন পথে শক্তি দিবে।

অধ্যায় ৫: 

শহরের প্রতিযোগিতার সাথে যুদ্ধ করার পর, সুজন একটা অদ্ভুত রকমের পরিবর্তন অনুভব করছিল। প্রথমদিকে তার মনে হয়েছিল, শহরের পরিবেশে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু সময় গড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথে, সে বুঝতে শুরু করেছিল যে, একমাত্র নিজের ওপর বিশ্বাস ও আত্মবিশ্বাসই তাকে এই কঠিন পথ পাড়ি দিতে সাহায্য করবে। সে এখন শুধুমাত্র তার কাজের প্রতি মনোযোগী নয়, বরং শহরের বিভিন্ন মানুষের মানসিকতা এবং তাদের আচরণ বোঝার চেষ্টা করতে শুরু করেছে। তবে, এটা সহজ ছিল না। সহকর্মীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা, সবার মধ্যে এক অদ্ভুত নির্লিপ্ততা, আর সকলের মাঝে যেন এক অদৃশ্য দৌড়—এসব কিছু সুজনের জন্য ছিল এক নতুন অভিজ্ঞতা। তার আগে, সে গ্রামে ছিল, যেখানে সম্পর্কগুলো ছিল একেবারে নিঃস্বার্থ, একে অপরের সাহায্য ও বন্ধুত্বের ভিত্তিতে তৈরি। কিন্তু এখানে, সে প্রতিদিন মনে করত, “এটা কি সত্যিই জীবন? আমার কি সবসময়ই এই চাপে থাকতে হবে?”

এদিন অফিসে এসে সুজন একটা নতুন প্রকল্পের দায়িত্ব নেয়। সবার মাঝে উত্তেজনা ছিল, কারণ এই প্রকল্পটি একদম নতুন ধরনের ছিল এবং সকলেই জানত যে, এই প্রজেক্টটি সম্পন্ন করা গেলে সবার নজর কাড়বে। সুজন নিজেকে সম্পূর্ণভাবে কাজের মধ্যে ডুবিয়ে দেয়, আর বুঝতে শুরু করে—এটা তার সুযোগ, যেখানে সে নিজেকে নতুন করে প্রমাণ করতে পারবে। কাজের প্রতি তার আগ্রহ, মনোযোগ এবং কষ্টের পরিশ্রম তাকে নতুন শক্তি ও আত্মবিশ্বাস এনে দেয়। সহকর্মীরা একে একে সুজনের প্রতি তার ক্ষমতা এবং পরিশ্রমের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে শুরু করে। একদিন, তার বস তাকে ডেকে বলে, “তুমি ভালো কাজ করেছ, সুজন। তোমার পরিশ্রমের ফল আমরা সবাই দেখতে পাচ্ছি।”

এই প্রশংসা সুজনকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছিল। তবে, এখানে সবচেয়ে বড় বিষয় ছিল, সুজন নিজে থেকে উপলব্ধি করেছিল যে, সে এখন শহরের নিয়মের সঙ্গে তাল মেলাতে শিখে গেছে। কিন্তু এই অর্জন তার জন্য সহজ ছিল না। সে প্রতিদিন তার মধ্যে অস্থিরতা অনুভব করত—একদিকে তার গ্রামীণ শুদ্ধতা, আরেকদিকে শহরের কঠিন বাস্তবতা। সে বুঝতে পারে, যদি সে নিজের আসল পরিচয়কে ছাড়ে, শহরের কাছে নিজেকে একেবারে হারিয়ে ফেলবে। কিন্তু শহরের প্রতিযোগিতার মধ্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে, তাকে একটু একটু করে পরিবর্তিত হতে হবে। তবে সে জানত, এই পরিবর্তন তার শুদ্ধতা এবং আত্মবিশ্বাসের সাথে থাকবে, কারণ তার শেকড় তাকে কখনোই ভুলতে দেবে না।

এক সন্ধ্যায়, যখন সুজন হোস্টেলের ছাদে বসে শহরের আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল, সে ভাবতে থাকে, “এই শহর আমাকে কত কিছু শিখিয়েছে, কিন্তু আমি কখনোই আমার গ্রামের শুদ্ধতা হারাবো না। এই দুই জগতের মধ্যে একটা সংযোগ তৈরি করতে হবে আমাকে। হয়তো এটাই আমার আসল যাত্রা।” সেই রাতে, সুজন ঠিক করে ফেলেছিল—শহরের প্রতিযোগিতা, কাজের চাপ, আর মানুষদের মাঝে সম্পর্কের বিচ্ছিন্নতা, এসব কিছুই তাকে ভেঙে ফেলতে পারবে না। বরং সে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠে শহরের এই কঠিন পথে নিজের পরিচয় প্রতিষ্ঠিত করবে।

এভাবে, প্রতিদিন নিজের প্রতিযোগিতায় শামিল হতে হতে, সুজন তার আত্মবিশ্বাস ফিরে পেল। তার কাজের প্রতি নিষ্ঠা, শহরের কঠিন বাস্তবতার সাথে তার নতুন মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা, এবং নিজের পরিচয় নিয়ে নতুনভাবে ভাবার ক্ষমতা তাকে আরও সামনে নিয়ে গেল। তার কাছে এখন স্পষ্ট ছিল, শহরের জীবন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে শুধু কঠোর পরিশ্রম নয়, সঠিক মনোভাব, আত্মবিশ্বাস এবং পরিবর্তনের মানসিকতা থাকতে হবে। সে এই শহরকে এক নতুন দৃষ্টিতে দেখছিল—এটা তার জন্য শুধুমাত্র একটা চ্যালেঞ্জ নয়, বরং এক নতুন সুযোগ।

সুজন বুঝতে পারল, যত কঠিন পরিস্থিতি আসুক, সে কখনো তার শুদ্ধতা এবং আদর্শগুলো ছাড়বে না। শহরের প্রতিযোগিতার মাঝে সে যেন নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছিল, এবং নিজের ভেতরে শক্তি সঞ্চয় করতে শুরু করেছিল। এখন সে জানত, তাকে শুধু আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে, আর প্রতিটি পদক্ষেপে নিজের সাথে সৎ থাকতে হবে।

অধ্যায় ৬: 

শহরের কঠিন বাস্তবতা এবং প্রতিযোগিতার মাঝে সুজন যখন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে শুরু করেছিল, তখন তার জীবনে এক নতুন পরিবর্তন আসে। একদিন, অফিসে এক নতুন কর্মী যোগ দেয়—রিমা নামের এক মেয়ে, যিনি শহরে সদ্য এসেছেন। প্রথমবার যখন সুজন তাকে দেখেছিল, তখন তার মনে হয়েছিল, রিমা ঠিক সেই মানুষটি, যার মতো সহজ এবং পরিশ্রমী মনের কেউ শহরের এই কঠিন পরিবেশে থাকার সাহস রাখে। রিমা ছিল একেবারে আলাদা, তার মধ্যে এমন একটা শান্ত ও নির্ভীক মনোভাব ছিল, যা সুজনকে অবাক করে দিত। প্রথম দিনে, রিমা সুজনকে জানায় যে, সে গ্রামের মেয়ে, এবং শহরে আসার পর অনেক কিছুরই অভিজ্ঞতা নিতেই সে এখানে এসেছে। রিমার সরলতা এবং মানবিকতা সুজনকে অনেকটা একাগ্র করে তোলে। শহরের কঠিন সময়ে, যখন সুজন নিজেকে একা মনে করছিল, তখন রিমার সাথে আলাপ তার জন্য এক নতুন আশার দিশা ছিল। তাদের মধ্যে দ্রুত একটা সম্পর্ক তৈরি হতে থাকে, যেখানে কথা বলা, পরস্পরের অনুভূতি শেয়ার করা, আর একে অপরের সমস্যায় সাহায্য করা তাদের বন্ধনকে আরও মজবুত করে তোলে।

রিমার সঙ্গে সুজনের সম্পর্ক শুধু বন্ধুত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এটি ছিল এক ধরনের জীবনবোধের শিক্ষা। রিমা যেমন শহরে এসে এক ধরনের অসহায়ত্ব অনুভব করেছিল, তেমনি সুজনও গ্রামে তার শুদ্ধতা এবং শান্তি ভুলে শহরের তীব্র প্রতিযোগিতায় নিজেকে হারাতে বসেছিল। একদিন, অফিসের কাজ শেষে সুজন ও রিমা একসাথে হেঁটে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। হেঁটে যাওয়ার পথে, সুজন রিমার কাছে তার গ্রাম, তার জীবনের শেকড়, এবং শহরের কঠিন বাস্তবতা সম্পর্কে অনেক কিছু শেয়ার করে। রিমা বলেছিল, “শহরে এসেছি, তবে আমি জানি, আমার শেকড় তো এখানে নয়। আমার শুদ্ধতা, আমার সহজতা, সব কিছু গ্রামেই। কিন্তু শহরে থাকতে হলে, আমাদের সেসব কিছু ছাড়তে হয় না, তবে সেগুলোকে যেন আমাদের শক্তি বানিয়ে নিতে হয়।” সুজন জানত, রিমার কথায় তার অজানা কিছু সত্যি লুকিয়ে আছে। সে তখন নিজেও উপলব্ধি করেছিল, শহরের প্রতিযোগিতা ও কঠিন বাস্তবতায় তার অস্থিরতার মধ্যে শুদ্ধতা এবং সরলতা যেন শক্তির রূপ নিতে পারে।

সময় যেতে যেতে, সুজন এবং রিমার সম্পর্ক আরও গভীর হয়ে ওঠে। দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব থেকে ক্রমেই একটা পারস্পরিক সমর্থন এবং বোঝাপড়া তৈরি হয়। শহরের কঠিন বাস্তবতার মাঝে, তারা একে অপরকে প্রেরণা দিত, শক্তি দিত। সুজন রিমাকে অনেক কিছু শিখতে শুরু করে। রিমা তার মধ্যে এক ধরনের সংকল্প, স্থিরতা এবং আস্থার কথা শিখিয়েছে—কীভাবে কঠিন পরিস্থিতিতে হার না মেনে, নিজের অবস্থান দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। একদিন, রিমা সুজনকে বলেছিল, “এটা বুঝতে হবে, সুজন, এই শহরটাতে যতই পরিবর্তন হোক, তুমি যদি নিজের সত্যের উপর বিশ্বাস রাখো, তবে তুমি কখনো হারাবে না।” এই কথাগুলো সুজনের মনকে খুব গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল।

তারপর থেকে সুজন নিজেকে আরও ভালোভাবে বুঝতে শিখেছিল। সে জানত, গ্রাম এবং শহরের মধ্যে একটা বিভাজন থাকা সত্ত্বেও, সে এই দুই জগতের মধ্যে একটা সেতু তৈরি করতে পারে। রিমার সাথে তার বন্ধুত্ব শুধু তার জীবনের গভীরতা বাড়ায়নি, বরং তাকে এমন একটা দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছে, যা তাকে শহরের শীর্ণতাকে অতিক্রম করে নিজের জীবনের পথে এগিয়ে যেতে সহায়তা করেছে। রিমার এই সম্পর্কের জন্য সুজন কৃতজ্ঞ ছিল, কারণ সে জানত, শুধু শহরের কঠিন বাস্তবতার মাঝে নয়, সম্পর্কের মধ্যে আলোর অস্তিত্বও থাকতে পারে।

একদিন, কাজ শেষে সুজন এবং রিমা শহরের একটি ছোট ক্যাফেতে বসে নিজেদের দিনের কথা শেয়ার করছিল। রিমা তখন বলেছিল, “কখনো কখনো, সুজন, শহরের অজানা পথের মাঝে আমাদের ছোট ছোট সম্পর্কই আমাদের পথ দেখায়।” এই কথায় সুজন আরও একবার বুঝতে পারে যে, শহরের অন্ধকারে, কোথাও না কোথাও একটা আলো আছে—আর সেটি সম্পর্কের মধ্যে। সে জানত, তার জীবনে এই সম্পর্ক তার চলার পথের শক্তি হতে চলেছে।

রিমার সাথে সম্পর্কের এই নতুন অধ্যায় সুজনের জীবনের দিক পরিবর্তন করে দেয়। শহরের কঠিন বাস্তবতার মধ্যে, যেখানে অনেকেই একে অপরকে শুধু স্বার্থের ভিত্তিতে চিন্তা করে, সেখানে এই সম্পর্ক সুজনকে এক নতুন শক্তি এবং উদ্দেশ্য দিয়েছিল। সে জানত, যত কঠিনই হোক, সে তার শুদ্ধতা, তার বিশ্বাস এবং তার সম্পর্কের মাধ্যমে জীবনের নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করতে সক্ষম হবে।

WhatsApp-Image-2025-07-02-at-3.56.33-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *