প্ৰনব দত্ত
এক
পত্রটা এসেছিল একেবারে অচেনা কাগজে, যেন তালপাতার কপি, তাতে আঁচড়ে আঁকা অদ্ভুত সব অক্ষর — সংস্কৃতের মতো, কিন্তু অচেনা ছন্দে বাঁধা। কলকাতার কলেজ স্টাফরুমে বসে চা খেতে খেতে যখন ঋদ্ধিমান ভট্টাচার্য চিঠিখানা খোলে, তখন সে ভাবেনি এমন কিছুর মুখোমুখি হবে। “আপনার পাণ্ডিত্য ও ঋগ্বেদের উপর আপনার বিশেষ জ্ঞান সমীহ জাগায়। অতএব, আপনাকে ত্রয়োদশ তিথির নবচণ্ডী যজ্ঞে উপস্থিত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি — মহাভৈরবী মন্দির, দক্ষিণ নবগ্রাম।” চিঠির নিচে কোনো নাম নেই, শুধু একটা সিলমোহর — গাঢ় লাল, আর তার উপর খোদাই করা এক নারীর মুখ, যার কপালে শূন্য। প্রথমে মজা ভেবেছিলেন ঋদ্ধিমান, কেউ হয়তো বানিয়ে পাঠিয়েছে। কিন্তু জায়গাটার নামটা পরিচিত ঠেকল — দক্ষিণ নবগ্রাম। বহু পুরোনো তান্ত্রিক অঞ্চল বলে শুনেছেন। গুরুদেব একবার বলেছিলেন, “ওখানে দেবী শুধু পূজিত হন না, দাবি করেন।” তাঁর কৌতূহল বেড়ে গেল। কলকাতার অভ্যস্ত ধুলো-ধোঁয়ার বাইরে কোথাও একটা ডুব দেওয়ার ইচ্ছে এমনিতেই ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কিছুদিনের জন্য পিছিয়ে দিয়ে, এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে তিনি রওনা হলেন, পুরোনো এক ট্রাঙ্কে পুরোনো পুঁথি, কাগজপত্র আর কিছু মন্ত্রতন্ত্রের বই নিয়ে। কোলাঘাট হয়ে বাস ধরতে হল নবগ্রাম যাওয়ার জন্য। শহর ছেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা অদ্ভুত নিঃশব্দতা তার চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল — যেন শব্দের গভীরেও কিছু আছে, যা তাকে ডাকছে।
নবগ্রামে পৌঁছানোর পর সন্ধ্যা নামছিল। লাল মাটির রাস্তা, দূরে ধানক্ষেত, আর গা-জমানো ঠান্ডায় কুয়াশার মতো অদৃশ্য কিছু যেন শ্বাস নিচ্ছে বাতাসে। স্ট্যান্ডে কেউ নেই, শুধু এক বৃদ্ধ গাড়োয়ান, যিনি চুপচাপ বললেন, “মহাভৈরবী?” ঋদ্ধিমান কিছু না বলতেই সে গাড়িতে বসাল। গ্রামের রাস্তা ছাড়িয়ে যখন তারা মন্দিরের দিকে যাচ্ছিল, গাছের ডালে ডালে কাক না কুয়োশাপ, বোঝা যাচ্ছিল না। হঠাৎ একটি সাদা কুকুর রাস্তায় নেমে চিৎকার করে কেঁদে উঠল, তারপরে আবার নিস্তব্ধতা। মহাভৈরবী মন্দিরটা প্রথম দেখা দিল এক বাঁকে — বিশাল, মাটির গায়ে চাপা পড়া পাথরের মতো এক গঠন, যার শিখরে কালো পতাকা উড়ছে। প্রবেশপথে কোনো আধুনিক আলো নেই, শুধু কয়েকটা মাটির প্রদীপ জ্বলছে, আর সিঁড়ির উপর ধূপের ধোঁয়া লতিয়ে উঠছে। একজন মানুষ অপেক্ষা করছিল — কাঁধে উত্তরীয়, দীর্ঘ জটা, চোখে তীব্রতা। “আপনি ঋদ্ধিমান ভট্টাচার্য?” তিনি মাথা নাড়তেই লোকটা মৃদু হাসল, “আমরা আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।” তার গলায় না ভয়, না স্নেহ — শুধু গভীর প্রত্যাশা। সেই প্রথম বার মন্দিরের ভিতরে ঢুকে ঋদ্ধিমান বুঝলেন, এ শুধু কোনও ধর্মাচরণ নয় — এটা এক অন্তহীন আয়োজন, যার কেন্দ্রে আছে তিনি নিজেই, অথচ সেটা তিনি তখনও জানতেন না।
মন্দিরের ভিতরকার গঠন ছিল অসম্পূর্ণ, যেন কিছু একদিন গড়ে শেষ করা হয়নি, অথবা ইচ্ছা করেই অর্ধেক রাখা হয়েছে। ভিতরের গর্ভগৃহে তিনি ঢুকলেন এক লালাভ আলোয় মোড়া দেবীমূর্তির সামনে। কোনো চিরচেনা দুর্গা নয়, এটা অন্য — চোখ নেই, হাত নেই, কেবল স্তন ও যোনিদ্বার — পাথরে খোদাই করা এক শক্তির প্রতীক। ঋদ্ধিমান মুখ চাওয়ার আগেই শুনলেন, “এ দেবী কথা বলেন না, কিন্তু দাবি করেন।” আচার্য ত্রিলোচন শাস্ত্রী তখনই সামনে এলেন — বয়স ষাটের ওপরে, তবু তার চোখে এমন ঝিলিক, যেন সে আজও আগুন স্পর্শ করতে পারে। “নবচণ্ডী শুরু হবে আগামী কাল — ত্রয়োদশ তিথিতে। তেরো দিন, তেরোটি সন্ধ্যা, তেরোটি বলি। আপনি আমাদের মুখ্য বাচক — চণ্ডীপাঠের মূল পণ্ডিত।” ঋদ্ধিমান মাথা নীচু করলেন, যদিও মনে কাঁপন লাগছিল। তখনো বুঝতে পারেননি, বলি বলতে কী বোঝানো হচ্ছে, কারা দেবে এই বলি। তবে তাঁর মনে একটা কাঁপুনি জেগে উঠেছিল সেই প্রদীপের আলো দেখে — কারণ তার পাশে পড়ে ছিল একটা ছোট শিশুর হাতের চুড়ি, ভাঙা, কিন্তু রক্তে ভেজা। কে রেখেছে তা কেউ বলল না, কেউ হেলাও করল না। সেই মুহূর্তে ঋদ্ধিমান বুঝলেন, তিনি কোনও ধর্মীয় পূজায় নয়, ঢুকে পড়েছেন এক নিষিদ্ধ তান্ত্রিক বৃত্তে, যেখানে প্রাচীন ইতিহাস আজও রক্ত চায়।
দুই
পরদিন সকাল বেলা ঋদ্ধিমান মন্দিরের পুকুরপাড়ে বসে ভেবে যাচ্ছিল, কোথায় যেন একটি কিছু ছিন্নভাবে ছড়িয়ে পড়ছে তার চারপাশে। পুরোহিতদের ব্যস্ততা, মন্দিরের আনুষ্ঠানিকতা, আর আচার্য ত্রিলোচনের গুরুগম্ভীর মুখাবয়ব — সবকিছুই যেন তাকে আরও বেশি অস্থির করে তুলছিল। কিন্তু সে কিছুই বলতে পারেনি, কারণ তার ভিতরে কিছু একটা স্ফুলিঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। দুপুরের খাওয়া শেষ হওয়ার পর ঋদ্ধিমান জানলেন, যজ্ঞের প্রস্তুতি চলছে। কিন্তু তার সঙ্গে শেয়ার করতে গিয়ে আচার্য ত্রিলোচন চুপ, কিছু বললেন না। তিনি শুধু এক আঙুল দিয়ে মন্দিরের অন্দরমহল দেখিয়ে দিলেন — “এটা পুরোপুরি পূর্ণ হলে, তুমিই সব বোঝবে।” তার চোখে তখন একটা ভীষণ অন্ধকার সাঁই সাঁই করে উঠছিল।
ঋদ্ধিমান দুচোখে অস্বস্তির ছায়া নিয়ে মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করল। মন্দিরের ভিতরে এক বিশাল গর্ভগৃহ ছিল, সেখানেই স্থাপন করা ছিল নবচণ্ডী দেবী। দেবীর অবয়বটি যেন এক ভয়ংকর অশরীরী কল্পনা, সমস্ত প্রথাগত দেবতার ধারণা পাল্টে দেওয়ার মতো। তার চোখে চোখ পড়ল, কিন্তু চোখের মধ্যে কোনো অনুভূতি ছিল না। স্থূল শরীর, বিষাক্ত চোখ, স্তন ও যোনিদ্বার খোদাই করা পাথরের মধ্যে গুঁতিয়ে থাকা এক প্রতীক। মনে হল, যেন সেই দেবীকে পাথরের অন্তর দিয়ে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে — একটা ছায়া, যাকে মানবদেহ কখনও ধরতে পারে না। তার চারপাশে শূন্যতার মতো কিছু ছিল, যেন সে দেহমনের বাইরের এক অন্য অস্তিত্ব। সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই আচার্য ত্রিলোচন তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, “এটি শুধুমাত্র পূজা নয়, এটি এক অভ্যন্তরীণ যাত্রা। আমাদের কালো অগ্নি পুরাণের মতে, তোমার মতো একজন পণ্ডিতকেই এই যজ্ঞে অংশ নিতে হবে।”
ঋদ্ধিমান আরও খানিকটা বিভ্রান্ত হল, কিন্তু মুখে কিছু বলল না। আচার্য বললেন, “তুমি জানো না, কিন্তু এ যজ্ঞের পিছনে রয়েছে এক তান্ত্রিক ইতিহাস। নবচণ্ডী, পিশাচিনী, যে ইতিহাস ভুলে গেছে মানুষ। চণ্ডী পূজা এখনকার যুগে এতটা গুরুতর হয়নি, কিন্তু এই স্থানে শুদ্ধতন্ত্রের শেষ পর্ব পুরাণের নিয়মে চলে আসে — এক পুরানো বিশ্বাস, এক পুরাতন শক্তির পূর্ণতা।” ত্রিলোচনের কথাগুলি এতটাই আড়াল ছিল যে ঋদ্ধিমান কিছুই বুঝতে পারল না। তার মুখে, গলায়, এবং শরীরে এক অস্বস্তির ছোঁয়া ছিল। হঠাৎ করে আচার্য তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “কিছু কথা মনে রেখো — এখানে আমাদের মতো সাধকরা নয়, একে পূর্ণ করতে হবে ঐ ‘অন্য’কে। দেবী যে বলি চায়, তুমি জানো না।”
ঋদ্ধিমান বুঝতে পারল না। এরকম জোরালো কথাবার্তা তার কাছে এক গভীর রহস্যের মতো লাগছিল। সে সেই রাতেই মন্দিরের সন্নিকটে হাঁটতে বেরিয়ে গেল। মন্দির থেকে বেরিয়ে আসার পর, রাস্তায় অদ্ভুত একটা শূন্যতা অনুভব করছিল, যা তার মনে বারবার কেমন একটা কাঁপুনি তৈরি করছিল। সেই অন্ধকারের মধ্যে কোনো এক উড়ে যাওয়া ছায়ার মতো কিছু ছিল — যেন সে শূন্যেই হারিয়ে যাচ্ছিল। তার মনে হল, এমন কিছু ছিল যা তাকে অনুসরণ করছে, কিন্তু সে কিছু দেখতে পাচ্ছিল না। দূরে, একটি সাদা কুকুর কেঁদে উঠল, তারপর আবার নিস্তব্ধতা। ঋদ্ধিমান দ্রুত মন্দিরের দিকে ফিরে গেল, কিন্তু তার মনে অজানা ভয়ের আলোকরেখা উঠে দাঁড়িয়েছিল।
মন্দিরে ফিরে গিয়ে ঋদ্ধিমান সিদ্ধান্ত নিল, তাকে আর দেরি করা উচিত নয়। সে সেই রাতে আচার্য ত্রিলোচনের সঙ্গে একান্তে দেখা করতে চাইল, কিন্তু ত্রিলোচন তখন কোথাও দেখা দিলেন না। মন্দিরের মধ্যে গন্ধবিহীন বাতাস ঝাঁকুনি দিয়ে চলছিল, যেন কিছু দূরে এক অতীন্দ্রীয় অস্তিত্ব অপেক্ষা করছে। তার মনে যেন তখন এমন কিছু কথা আছড়ে পড়ছিল, যা তার ভিতরে এক ভয়ঙ্কর গতি তৈরি করছিল। ঋদ্ধিমান ভাবল, ‘এটি কি এক মন্ত্রমুগ্ধতার চক্রান্ত? না কি একটি নীরব বিপদ?’ এবং ঠিক তখনই তার কানে আসল একটা অদ্ভুত শব্দ — ভৈরবীর ছায়া মন্দিরের দেয়াল থেকে ঘুরে বেরিয়ে আসছিল।
আচার্য ত্রিলোচন কই? কোনো এক অন্ধকারের মধ্যে তিনি রয়েছেন, যেখানে ঋদ্ধিমান কিছুই জানে না, কেবল ভয় এবং রহস্য ঘিরে তাকে ফেলে রেখেছে।
তিন
পরদিন সকালে মন্দিরের ভিতরকার চাতালে কিছু অদ্ভুত চিহ্ন দেখা গেল — ছোট ছোট মাটির প্রদীপের মাঝে লাল দাগ, যেন কেউ রাতভর রক্ত ছড়িয়ে লিখে রেখেছে কোনো সংকেত। ঋদ্ধিমান ভট্টাচার্য দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন মন্দিরের পূর্বাংশে, যেখানে পুরনো ইট আর পাথরের মাঝে সময় থেমে আছে — অথবা ঘুরে ঘুরে সেই একই বিভ্রমে ফিরে আসে। সেই সময়েই প্রথমবার তাঁর দেখা হয় রাণু দত্তর সঙ্গে। এক হাতে নোটবুক, অন্য হাতে ক্যামেরা, চোখে ধুলো-মাখা অবহেলা। “আপনি নিশ্চয়ই ঋদ্ধিমান ভট্টাচার্য? আমি রাণু দত্ত, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অ্যাসোসিয়েট রিসার্চার,” — মৃদু গলায় বললেন মেয়েটি, “এই মন্দির ঘিরে আমার তিন বছর ধরে গবেষণা চলছে। শোনা যায় এখানে এক দেবীর পূজা হয়, যাঁর নাম শাস্ত্র থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।” সে আরও বলল, “এই জায়গাটা শুধু তান্ত্রিকদের পীঠস্থান নয়, এখানে ইতিহাস চাপা পড়ে আছে — মাটি আর রক্তে লেখা ইতিহাস।” তার কথায় একটা রহস্যের ছায়া ছিল, যা সঙ্গে সঙ্গে ঋদ্ধিমানের মনে সাড়া ফেলে দিল। ঠিক তখনই, মন্দিরের দেয়ালের এক কোণে তাঁরা দেখতে পেলেন পাথরে খোদাই করা অদ্ভুত এক লিপি, যা বর্ণের দিক থেকে ব্রাহ্মীলিপির মতো, কিন্তু অর্থহীন মনে হচ্ছিল।
রাণু তার পকেট থেকে একখানি পাতলা কাগজ বার করে লিপির উপর ঘষে তুলতে লাগল। তখনই ঋদ্ধিমান লক্ষ করল, ঠিক লিপির নিচে, একটা পাতায় জমে আছে জমাট রক্ত, একদিন-দু’দিনের নয় — অনেক পুরনো, তবে এখনও তাজা দেখতে লাগে। রাণু বলল, “এটা ওই ‘ভৈরবী কাপ্তা’র নাম। আমি আগেও শুনেছি এই শব্দটা — কিন্তু কোথাও লেখা নেই। শুধু এক পুরনো পুঁথিতে বলেছিল, দেবী ছিলেন না, তিনি ছিলেন ‘ভয়ংকরী’। তাঁকে জাগাতে হলে লাগে তেরোটি বিশুদ্ধ বলি। শাস্ত্র বলে, বলি মানে আত্মার সংবেদনশীল নিঃশেষ — কিন্তু তন্ত্রে এর অর্থ একদম আলাদা।” ঋদ্ধিমানের ভিতরে একটা হিম শীতল স্রোত বয়ে গেল — গতকাল রাতেই এক কিশোর নিখোঁজ হয়েছে, যার কোনো খোঁজ নেই আজও। মন্দির চত্বরের কেউ কিছু বলছে না, যেন এ এক সাধারণ ঘটনা। হরিপদ দাস, যে পাগলের মতো ঝাঁট দিচ্ছিল, বারবার শুধু বলছে, “দেবী নিয়েছে… শুদ্ধ প্রাণ চাই।” কথাটার মধ্যে যেন জ্ঞানের চেয়ে বেশি অন্ধতা জড়িয়ে ছিল। তখনই প্রথম ঋদ্ধিমান বুঝতে পারল, এই নবচণ্ডী যজ্ঞে সে শুধু একজন পুরোহিত নয়, বরং এক চলন্ত যন্ত্রের মতো যাকে ব্যবহার করা হচ্ছে কোনো এক ভয়ংকর অনুশীলনে।
সন্ধ্যার দিকে ঋদ্ধিমান আর রাণু মন্দিরের দক্ষিণ কোণ ঘুরে দেখতে গিয়ে খুঁজে পায় আরও এক অলিন্দ — এক গুহার মতো পথ, মাটির নীচ দিয়ে চলে গেছে কোথাও। রাণু বলল, “এটা হয়তো সেই চক্রস্থল, যেখানে মূল পীঠ স্থাপন করা হয়েছে। পুরনো কাহিনীতে বলা আছে, এখানে মাটির নিচে আছে এক ‘অবিভক্ত যোনি-পীঠ’ — যা দেবীর অনন্ত শক্তির প্রতীক, এবং যার উপর নির্ভর করে এই নবচণ্ডীর সার্থকতা।” শব্দগুলো ঋদ্ধিমানের গায়ে কাঁটার মতো বিঁধল, কারণ তার পুরাতন পুঁথিপত্রেও এমন কিছু ছিল — “যেখানে দেবী কেবল পূজিতা নন, জাগ্রত — আর তাঁর জাগরণ মানেই এক জ্যান্ত বীভৎসতা।” সেই রাতে যজ্ঞের দ্বিতীয় দিন ছিল — আর সেই রাতেই গ্রামের আরেকজন যুবক, পল্লব, নিখোঁজ হল। কোনো পুলিশ এল না, কেউ খোঁজও করল না, কারণ ত্রিলোচন শুধু বলল — “দেবী গ্রহণ করেছেন।” চাঁদের আলোয় পুকুরের জলে তখন এক শিশুর মুখ ভেসে উঠল — কি বাস্তব, কি কল্পনা, তা আলাদা করা যাচ্ছিল না। ঋদ্ধিমান চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল, আর তার কানে আসছিল সেই লিপির প্রতিধ্বনি — “পূজোতে রক্ত চাই, কারণ দেবী এখনো ঘুমিয়ে আছেন।”
চার
তৃতীয় রাতের অন্ধকারটা ছিল অন্যরকম। মন্দির চত্বরের বাতাস থমথমে — যেন আশেপাশের গাছেরা নিশ্বাস ফেলছে না, কাকেরা সরে গেছে রাতের ভিতর, কেবল শোনা যাচ্ছে দূরে কোথাও ঢাকের তাল — ধীরে ধীরে, হৃদস্পন্দনের মতো। ঋদ্ধিমান ভট্টাচার্য সেই রাতে গর্ভগৃহের ঠিক পেছনের অংশে দাঁড়িয়েছিলেন, যেখানে বাতি জ্বলে না, এবং যেখানে মাটির গন্ধ অদ্ভুতভাবে মিশে থাকে গঙ্গাজলে ভেজা চন্দনের মতো। হরিপদ দাস প্রতিদিনের মতোই নিঃশব্দে ধূপ-ধুনো সাজাচ্ছিল, কিন্তু আজ তার চোখে ছিল একরকম অবশতা। সেই মুহূর্তে এসে হাজির হল আচার্য ত্রিলোচন শাস্ত্রী, যিনি মাথা নিচু করে বললেন, “আজ চতুর্থ বলি। দেবীর রোষ প্রশমিত করতে হলে কালতন্ত্র অনুসারে ত্রয়োদশ বলি সম্পূর্ণ হওয়া আবশ্যক।” ঋদ্ধিমান কিছু বলল না, শুধু প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল তার দিকে। ত্রিলোচন নত গলায় বললেন, “তুমি জানো, বলি মানে আত্মা — প্রাণ নয়। কিন্তু নবচণ্ডী অন্য। এখানে বলির মানে পবিত্র আত্মা, যা অনুকম্পাহীন। যদি রক্তে অভিষেক না হয়, দেবী জাগেন না।”
ঋদ্ধিমান বুঝতে পারছিলেন — তাঁকে ব্যবহার করা হচ্ছে এই জাগরণের এক অবিচ্ছেদ্য যন্ত্র হিসেবে। তাঁর পাণ্ডিত্য, শুদ্ধ উচ্চারণ, ছন্দবদ্ধ বাচন — সবটাই জরুরি, কারণ দেবী ‘শব্দ’ দ্বারা প্রজ্বলিত হন। কিন্তু একইসঙ্গে তিনি ভয় পাচ্ছিলেন — যে চক্রের মধ্য দিয়ে যজ্ঞ এগোচ্ছে, তাতে একমাত্র শুদ্ধতা নয়, এক মারাত্মক অন্ধতা কাজ করছে। সেই রাতে রাণু তাকে চুপিসারে একটি কথা জানায় — “আমি কাল সন্ধ্যায় মন্দিরের পেছনে গিয়ে এক লোককে দেখেছিলাম, যার মুখ ঢাকা, আর হাতে একটা শিশুকে নিয়ে সে ঢুকছিল চক্রস্থলে। আর সকালে শোনা গেল ‘চৈতালি’ নামের এক বাচ্চা হারিয়ে গেছে।” কথাটা শোনামাত্র ঋদ্ধিমানের রক্ত হিম হয়ে যায়। সে জানে, মন্ত্রে বলা আছে — ‘চণ্ডীর জাগরণে প্রথমে লাগে নিষ্পাপ বলি, যাতে শব্দভেদে আত্মা কেঁপে উঠে।’ আর তার পরেই লাগে ‘সংযোগকারী পুরুষ’ — যাকে মধ্যস্থ হতে হবে জাগরণের সময়।
ঋদ্ধিমান নিজের হাত ধরে চুলকে চুলকে ভেবে ফেলল, তার পূর্বপুরুষের নাম জড়িয়ে ছিল বহু পুরনো এক তান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে। তার ঠাকুরদা শ্যামানন্দ ভট্টাচার্য ছিলেন সেই শেষ ব্যক্তি যিনি ‘অশুদ্ধ নবচণ্ডী’ বন্ধ করেছিলেন। তাহলে কি এই যজ্ঞ তাকে সেই পূর্বপুরুষের পাপ ঘোচানোর জন্যে টেনে এনেছে? সে নিজেই কি সেই সংযোগকারী? সে ভাবছিল এসব, তখনই বাইরে থেকে একটা আর্তচিৎকার ভেসে এল। সবাই ছুটে গেল মন্দিরের দিক থেকে দক্ষিণ কোণের দিকে, যেখানে এক মা কান্নায় ভেঙে পড়েছেন — তাঁর ছেলে শুভ, কিশোর বয়স, হঠাৎ করে নিখোঁজ। আচার্য ত্রিলোচন সোজাসুজি বললেন, “দেবীর অভিপ্রায়। প্রশ্ন কোরো না।” এই ঔদ্ধত্য ঋদ্ধিমানের হৃদয় কাঁপিয়ে দিল। সে বোঝে, এ সাধনা নয়, এ রক্তের উপাসনা — এক পুরনো পিশাচিনীর জন্য।
সেই রাতে আবারও মন্ত্রোচ্চারণ হল — ঋদ্ধিমান তার সব জ্ঞান কাজে লাগিয়ে পাঠ করলেন “চণ্ডীপাঠ”। কিন্তু এবার প্রতিটি শব্দ যেন তার নিজস্ব রক্ত দাবি করছিল। বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল, প্রদীপ নিভে গিয়ে আপনাআপনি আবার জ্বলছিল। আর যজ্ঞের মঞ্চের নিচে কিছু একটা নিশ্বাস নিচ্ছিল, যেন অজানা পেট থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। সে স্পষ্ট দেখল — হরিপদ দাস শ্মশানের মাটি মেখে একটি চক্র আঁকছে, যার মধ্যে শুয়ে আছে একটি মুরগি — নাড়িভুঁড়ি খুলে ফেলা, আর সেটার চারপাশে লেখা আছে: “আমি জেগে উঠি অন্ধকারে। শুদ্ধতা আমার কাছে প্রহসন।” ঋদ্ধিমান বুঝে গেল, বলির সংখ্যা এখন চার — আর প্রতিটি বলি ক্রমশ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মন্দিরের অতল অন্ধকারে, যেখানে ‘ভৈরবী কাপ্তা’ ঘুমিয়ে আছে, শুধু চোখ খুললেই শুরু হবে মৃত্যু আর পুনর্জন্মের অনন্ত চক্র।
পাঁচ
পরদিন দুপুরের আগে থেকেই মন্দির এলাকায় অদ্ভুত গন্ধ ছড়াতে থাকে — যেন পুড়ে যাওয়া রক্ত, বাসি ধূপ আর ভিজে মাটির এক গলিত সংমিশ্রণ। হরিপদ দাস চুপচাপ ঘোরাঘুরি করছিল গর্ভমন্দিরের পেছনে, মুখ নিচু, পায়ের আওয়াজ নেই, এমনকি তার চায়ের কাপটাও আজ সকালে ভেঙে পড়ে যায় হাতে কাঁপুনি উঠলে — কিন্তু সে কিছু বলে না। রাণু দত্ত সেই সময় ঋদ্ধিমানকে ডেকে নিয়ে গেল এক গোপন পথ ধরে — মন্দিরের দক্ষিণপূর্ব কোণের একটা ভাঙা বারান্দা, যেটা ছিল মূল মন্দির নির্মাণের প্রাচীনতম অংশ। সেই ইটগুলোতে ঠেকানো ছিল এক কাতরতা — যেন তারা শতবর্ষ ধরে বয়ে নিয়ে এসেছে কোনো এক গোপন প্রার্থনা। রাণু একটা শিলার ওপর থামল — “এই জায়গাটা নিয়ে আমি চারটে রেফারেন্স খুঁজেছি,” সে বলল। “সব কিছুর মূলে রয়েছে ‘অবিভক্ত পীঠ’। এটা কোনও দেবীমূর্তি নয়, এটি এক নির্দিষ্ট চক্র — যেখানে নারীশক্তির অনাদি রূপ, যোনিপীঠ, স্থাপন করা হয়েছিল। এক পিশাচিনী, যাঁর পূর্ণ রূপ একবার জাগলে আর থামানো যায় না, কারণ তিনি চণ্ডীর ছায়া, কালী-ত্রিপুরা-ভৈরবীর মিলিত ভয়ংকর রূপ।”
ঋদ্ধিমান হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকল। রাণু তার নোট খুলে দেখাল — কালো কালি দিয়ে আঁকা একটা চক্রের ছবি, যার ঠিক মাঝখানে লেখা: “বিনাশের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়, সৃষ্টি শেষে বিনাশ অপরিহার্য।” নিচে সংক্ষিপ্ত মন্ত্র — “ভৈরবী কাপ্তা জাগ্রত প্রলয়রূপিণী।” এই নামটা আবারও শুনে তার মেরুদণ্ড বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। গত রাতে চতুর্থ বলির পরে সে স্বপ্নে দেখেছিল — গাঢ় ধোঁয়ার ভিতর থেকে উঠে আসছে এক নারী-মূর্তি, যার চোখ দুটো শূন্য, মুখে রক্তের রেখা, আর সে মন্ত্র উচ্চারণ না করে তাকিয়েই শব্দ সৃষ্টি করছে। সে কথা বলতে চায় না, সে শুধু চাই — প্রাণ, চেতনা, রক্ত। “আজ রাতে পঞ্চম বলি,” বলল রাণু, “আর এটা যদি নির্দিষ্ট বিন্দুর মধ্যে হয়, তাহলে শক্তি কেন্দ্রীভূত হবে। তুমি হয়তো জানো না, কিন্তু মন্দিরের চক্ররেখা আসলে এক গণনাশ্রয়ী গাণিতিক নক্সা — একটা যন্ত্র, যার মাধ্যমে দেবীকে ডাকা হচ্ছে।” ঋদ্ধিমান আঁতকে উঠল — দেবীকে ডাকা নয়, তাকে টেনে আনা হচ্ছে। সেই শক্তিকে, যার ঘুম ভাঙলে সময় থেমে যাবে।
ঋদ্ধিমান সেই রাতে সিদ্ধান্ত নেয়, তাকে আচার্য ত্রিলোচনের সঙ্গে মুখোমুখি হতে হবে। আচার্য তখন একা বসে পঞ্চম দিনের বলি-তালিকা ঠিক করছিলেন — একটা তালপত্রের উপর, যেটার কোণায় লাল সীমানা, আর মাঝখানে ত্রিকোণ চিহ্ন। তিনি ঋদ্ধিমানকে দেখে বললেন, “জানো, সব কিছু ঘুরে ফিরে এক কেন্দ্রে চলে আসে — সময়, জন্ম, বিশ্বাস, মৃত্যু, সবই এক কেন্দ্রীভূত সন্ন্যাস। নবচণ্ডী আসলে সময়ের রূপ — তুমি তার ধ্বনি, বাক্য, এবং চেতনা। তুমি না এলে এই যজ্ঞ অসম্পূর্ণ থাকত।” এই কথা শুনে ঋদ্ধিমান বুঝে গেল — তিনিই সেই সংযোগ, যাঁকে দরকার ত্রিলোচনের। সে চিৎকার করে বলল, “তুমি মানুষ বলি দিচ্ছো! এটা কোন ধর্ম?” আচার্য ধীর গলায় বললেন, “মানুষ নয়, আত্মা। আর আত্মা তো শরীরেই বাস করে। তবে বলো, আত্মা মুক্তির জন্য শরীরকে উৎসর্গ করা কি অধর্ম?” ত্রিলোচনের মুখ তখন আর সাধুর মতো নয়, তার চোখে ছিল এক বর্ণহীন অন্ধকার, যা এক বিশুদ্ধ নির্বিচার শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে। ঋদ্ধিমান বুঝে গেল, একমাত্র উপায় — চক্রের মধ্যেই ঢুকে গিয়ে এ যজ্ঞ থামানো। কিন্তু কীভাবে? সেই রাতে পঞ্চম বলি দেওয়ার আগেই, সে সিদ্ধান্ত নেয়, সে প্রবেশ করবে ‘অবিভক্ত পীঠে’ — সেই আধার দ্বারে, যেখানে এক ভৈরবী ঘুমিয়ে আছেন, আর অপেক্ষা করছেন… চোখ খুললেই ইতিহাস বদলে যাবে।
ছয়
রাত গভীর হতে না হতেই মন্দির চত্বর যেন অন্য এক পৃথিবীতে পরিণত হয়। বাতাস ভারী, শব্দ নেই, গাছেরা দুলছে না — কেবল বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে অদ্ভুত এক গন্ধ, যেন পুরনো শবদেহ আর বাসি ফুলের পচা মিলন। সেই রাতে পঞ্চম বলির পরে আরেকবার নিখোঁজ হয় একজন — গ্রামের দুধওয়ালার স্ত্রী, দীপশিখা। কিন্তু ত্রিলোচন কোনো রকম হইচই না করে বললেন, “তিনি নিজেই নির্বাচিত হয়েছেন। দেবীর পছন্দ সহজে বোঝা যায় না।” এই দীপশিখা, যাকে রাণু আগেরদিনই কয়েকবার চোখে পড়েছিল — চুপচাপ ঘোরাঘুরি করছিল মন্দিরের পেছনের বটগাছের নিচে, আর একটা পুরোনো আয়নায় নিজের মুখ দেখছিল বারবার, যেন কারো অন্য চেহারা দেখতে চাচ্ছিল। আজ নিখোঁজ। অথচ কেউ কিছু খোঁজার চেষ্টা করল না, এমনকি তার স্বামীও নয়। সবাই যেন অভ্যস্ত — অথবা সম্মোহিত।
রাণু দত্ত এবার নিশ্চিত — নবচণ্ডী যজ্ঞে এক পিশাচিনীকে জাগানোর আয়োজন চলছে, আর দীপশিখা হয়তো সেই চূড়ান্ত বলির পাত্র। কিন্তু প্রশ্ন হল, কেন? সে চুপিসারে এক রাতে পুরোনো মন্দির লাইব্রেরিতে চলে যায়, যেখানে প্রচুর ছেঁড়া, ছারখার বই, পুঁথি আর দলিলপত্র রাখা আছে — অনেকেই পড়তে জানে না সেগুলো। সেখানে রাণু খুঁজে পায় একটি কালের বিবর্তনে মলিন হয়ে যাওয়া শ্লোক — “যাহা দেবী নয়, তাহাই দেবী। যাহার রূপ লোপ পেয়েছে, তাহার জাগরণই প্রকৃত পূজা।” নিচে লেখা এক নাম — “ভৈরবী কাপ্তা”। রাণুর হাত কেঁপে উঠল — এ সেই নাম, যা ভুলে গেছে ইতিহাস, কিন্তু আজও জেগে আছে কিছু মন, কিছু রক্তে। মন্দিরের পুরোনো চার্ট অনুযায়ী, যেই নারীজন্মে ভয়, অস্থিরতা, ঘোর ও সংযোগের লক্ষণ থাকবে, সে-ই ‘ধারক’। আর দীপশিখা সেই প্রতিটি বৈশিষ্ট্যের প্রতিমূর্তি — ছোটবেলায় মা হারিয়েছেন, বহুবার ঘুমে হাঁটেন, আয়নায় অচেনা প্রতিচ্ছবি দেখেন, আর রাতে ঘুম ভেঙে বলেন, “আমি কে?”
ঋদ্ধিমান তখন নিজের কক্ষে বসে চণ্ডীপাঠের ব্যাখ্যা রচনা করছিল, কিন্তু কিছুতেই মন দিতে পারছিল না। তার মাথার ভিতরে বারবার কুয়াশার মতো ঘুরছিল এক দৃশ্য — দীপশিখা একটা খালি মাঠে দাঁড়িয়ে, সাদা শাড়িতে, মাথায় খুলে রাখা চুলে বাতাস লেগে আছে, আর চোখ বন্ধ। সে কিছু বলছে না, কিন্তু তার ঠোঁট নড়ছে। আর সেই ঠোঁটের গতি পড়ে নিতে গিয়ে ঋদ্ধিমান বুঝল — দীপশিখা উচ্চারণ করছে একটা নাম — “কাপ্তা… কাপ্তা…” আর সেই নাম উচ্চারিত হতেই যেন বাতাসে কোথাও গর্জন বাজল, কিন্তু তা শোনে শুধু সে। হঠাৎ করেই আয়নার কাচে দেখা গেল দীপশিখার প্রতিচ্ছবি — চোখে পলক নেই, মুখে হাসি নেই, কেবল এক স্থিরতা, যা মৃত্যুর থেকে গভীর। সে আয়নার মধ্য দিয়ে তাকিয়ে আছে ঋদ্ধিমানের দিকে।
রাণু তখন ছুটে এসে জানায় — “আমরা দেরি করে ফেলছি। আমি বুঝেছি, এই যজ্ঞে বলি দেওয়া হবে শুধু শরীরকে নয় — আত্মা জাগানো হবে একজন সংযোগীর মধ্যে, আর দীপশিখা সেই সংযোগ। আর তুমি, ঋদ্ধিমান, তুমি সেই উৎসারক — তোমার কণ্ঠ দিয়েই জাগবে সে। ত্রিলোচনের পরিকল্পনা এটা বহু বছর ধরেই ছিল।” ঋদ্ধিমান তখন স্থির চোখে তাকিয়ে রইল রাণুর দিকে। সে বলল, “আমি যদি না পড়ি?” রাণু জবাব দিল, “তাহলে ত্রিলোচন নিজেই নিজের কণ্ঠ দিয়ে শেষ বলি সম্পন্ন করবে, আর তুমি— তুমি থেকে যাবে সেই পীঠে, সিলমোহর হিসেবে। কারণ তন্ত্র বলি চায়, কিন্তু শক্তি চায় ধারক — এক জীবন্ত মানবমূর্তি, যে চিরকাল গেটে প্রহরী হয়ে থাকবে। তুমি যদি জাগরণ না করাও, তাহলে তুমিই জাগরণস্থ।” কথাগুলো যেন চারদিকের বাতাসে লেগে কেঁপে উঠল — যেন শব্দের মধ্যেই আগুন আছে। সেই মুহূর্তে, ঋদ্ধিমান অনুভব করল, সে আটকে গেছে — এক প্রাচীন তান্ত্রিক অভিশাপের চক্রে, যার শুরু হয় শব্দ দিয়ে আর শেষ হয় নৈঃশব্দ্যে।
সাত
রাত্রি গভীর হতে থাকে, যেন সময় তার চলাচল স্থগিত করেছে এই মন্দিরের চারপাশে। সপ্তম বলির পূর্বক্ষণ— সেই সময়, যখন পূর্ণ অন্ধকারকে চন্দ্রের আলোও ভেদ করতে পারে না। গর্ভগৃহের ঠিক নিচে, পাথরের চক্রখচিত কক্ষে বসে আছেন আচার্য ত্রিলোচন, তাঁর সামনে দীপশিখা নিঃশব্দে শুয়ে আছে, কপালে সিঁদুরের বিন্দু নয়, বরং রক্তের দাগ। তার দেহ নিঃসাড়, কিন্তু প্রাণ যায়নি — যেন ঘুমন্ত কোনও দেবীমূর্তি, যার স্বপ্নে চলছে অতীতের অনুরণন। চক্ররেখার ভেতরে আঁকা হয়েছে তান্ত্রিক মণ্ডল, যেটা তৈরি হয়েছে গোমূত্র, রক্ত, ধূম্র এবং ছাই দিয়ে। মণ্ডলের চারদিকে সাজানো তেরোটি প্রদীপ — তার সাতটিতে আগুন জ্বলছে। সপ্তম বলি সম্পন্ন হলেই বাকিগুলো প্রজ্বলিত হবে, আর তারপর… দেবীর জাগরণ। ঋদ্ধিমান দাঁড়িয়ে দেখছিল সব কিছু, যেন একজন দর্শক — অথচ সে জানে, সে-ই মঞ্চের মুখ্য চরিত্র।
“তুমি যদি আজকের পাঠ বন্ধ করো,” বলল ত্রিলোচন ধীরে, “তবে দেবীর ক্রোধে এই ভূমি শ্মশানে পরিণত হবে। আর যদি চালিয়ে যাও, তবে তুমি পূর্ণতা পাবে — আধ্যাত্মিক জাগরণ, ইতিহাসের গভীরতম স্তরের উন্মোচন। এই যজ্ঞ কেবল শাস্ত্র নয়, এটা আত্মার নিষ্কৃতি।” ঋদ্ধিমান চোখ বন্ধ করল, মনে মনে প্রশ্ন করল: “কোন আত্মার নিষ্কৃতি? দীপশিখার? না আমার?” তখনই তার মনে পড়ে গেল সেই স্বপ্নের দৃশ্য — রক্তপথে দাঁড়িয়ে এক নারী হাসছেন, তার চোখে অনন্ত অন্ধকার, আর তিনি বলছেন, “তুমি কথা বললেই আমি ফিরে আসি। আমি তো সবসময়ে তোমার ভেতরেই ছিলাম।” সেই ভয়ানক অনুভব তাকে বলে দেয় — পিশাচিনী শুধু এক শরীর নয়, এক ভাষা, এক উচ্চারণ। এবং সেই চক্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা যে পুরোহিত— সেই কণ্ঠধারীই আসলে পিশাচিনীর আধার।
ঋদ্ধিমান সেই মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নেয় — সে কিছু একটা পাল্টাবে। সে গম্ভীর গলায় বলল, “আজ পাঠ হবে। তবে আমার মতো করে।” ত্রিলোচনের মুখে প্রশ্রয়। চক্রজপ শুরু হল। আগুনে ঘি পড়তেই ধোঁয়া উঠতে লাগল, আর সেই ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে দীপশিখার শরীর ধীরে ধীরে নড়তে লাগল — যেন কেউ ভিতর থেকে জেগে উঠছে। তখনই ঋদ্ধিমান হঠাৎ করে মন্ত্রের সুর বদলে দিল — “ওঁ কল্পপিশাচ্যৈ নমঃ” — এই বীজমন্ত্রটি সাধারণত নিষিদ্ধ, কারণ এর উচ্চারণ মানেই অশরীরীদের জাগরণ। সে একের পর এক উচ্চারণ করতে লাগল মন্ত্রের বিপরীত ধ্বনি — যেমন ‘জাগরণ’ নয়, বলল ‘স্থগন’, ‘চেতনা’ নয়, বলল ‘আচ্ছন্নতা’। ত্রিলোচনের মুখ ঘোর অন্ধকারে দাঁড়িয়ে পড়ল। “তুমি কী করছো?” তিনি গর্জে উঠলেন।
ঋদ্ধিমান থেমে না গিয়ে ধ্বনি চালিয়ে গেল — তার প্রতিটি বাক্যে যেন এক এক করে ভেঙে যাচ্ছে চক্রের কাঠামো। ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে ঘরের চারপাশে, আর তেরোটি প্রদীপ নিভে যাচ্ছে এক এক করে। দীপশিখা কাঁপছে, তার দেহ কাঁপছে না শরীরের কারণে, বরং ভিতর থেকে — যেন কেউ বাইরে আসতে পারছে না। আর সেই সময়— গর্ভগৃহের পাথরের স্তম্ভ থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো এক ছায়া। নারীমূর্তি, কিন্তু তার মুখ নেই, চোখ নেই — কেবল দুটি গভীর গর্ত, যেখান থেকে বেরোচ্ছে কালো ধোঁয়া। পিশাচিনী কাপ্তা। সে চক্রের দিকে এগিয়ে আসছে, তার পায়ের নিচে পাথর গলে যাচ্ছে, প্রদীপের আলো নিভে যাচ্ছে, বাতাস থেমে যাচ্ছে। আর সে থেমে দাঁড়াল ঠিক ঋদ্ধিমানের সামনে।
“তুমি— আমাকে ডাকলে, আবার থামালে। কেন?” তার কণ্ঠ শোনা যায় না, কেবল অনুভব করা যায় মাথার ভিতর। “আমি এসেছিলাম,” সে বলে, “আমি তো তোদেরই রক্তে বেঁচে আছি।” তারপর সে দীপশিখার দিকে তাকাল। বলল, “এই দেহ আমার। কিন্তু যদি বাধা দাও, তবে তুমিই গ্রহণ করো আমার ছায়া।” সেই মুহূর্তে রাণু দৌড়ে এসে দাঁড়াল — হাতে পুরোনো রুদ্রাক্ষমালা আর একটা ধাতব ত্রিশূল, যেটা সে খুঁজে পেয়েছিল মন্দিরের গর্ভভাগে। সে ছুঁড়ে দিল ত্রিশূল চক্রের মাঝখানে। বিস্ফোরণ হল — আলো, শব্দ, ধোঁয়া — আর তারপর নিস্তব্ধতা।
পিশাচিনী অন্তর্হিত। দীপশিখা অজ্ঞান। ঋদ্ধিমান চুপ — তার কণ্ঠ রুদ্ধ। আর চক্র? ধ্বংস। ত্রিলোচন নিখোঁজ। সবাই চুপচাপ মাটির দিকে তাকিয়ে।
যজ্ঞের সপ্তম রাত্রি শেষ। কিন্তু খেলা তো মাত্র শুরু।
আট
মন্দিরে আলো ফিরে এল, কিন্তু সেটা সূর্যের নয় — মলিন, কুয়াশার মতো এক নীলাভ আভা, যা চক্রের ধ্বংসস্তূপের উপর এক অলৌকিক ছায়া ফেলছিল। দীপশিখা তখন নিঃসাড়, তার শরীরে প্রাণের কোনো চিহ্ন নেই, অথচ তার চোখ খোলা — স্থির, বিস্ময়বিহ্বল। রাণু তার কপালে হাত রাখতেই কেঁপে উঠল, “ঋদ্ধিমান, ওর গায়ে শীতলতা নেই, গরম — যেন ভিতরে কেউ আছে।” ঋদ্ধিমান তখন চুপ, তার ঠোঁট শুকিয়ে এসেছে, কণ্ঠ থেকে কোনো শব্দ বেরোয় না। সে বোঝে, যা ঘটেছে তা ক্ষণস্থায়ী — কাপ্তা চলে গেছে, কিন্তু চিহ্ন রেখে গেছে দেহে, সময়ে, যজ্ঞের পবিত্র স্তরে। ত্রিলোচনের কোনও হদিস নেই, তিনি যেন ধোঁয়ার মধ্যে গলে গেছেন। তবে চক্রের ভেতরে রাখা ত্রিশূলটি এখনও গরম — যেন সে দেবীর তেজ এখনো ধরে রেখেছে।
রাত্রির শেষ প্রহরে দীপশিখা জ্ঞান ফিরে পায়। তার প্রথম প্রশ্ন: “আমি কে?” সে নিজেকে চেনেনা, তার স্মৃতি শূন্য। রাণু বুঝে যায়, কাপ্তা তার শরীর ছেড়ে গেলেও কিছু রেখে গেছে — এক ছায়া, এক অনির্বচনীয় সংযোগ। তখনই তারা জানতে পারে, মন্দিরের মূল অংশে হরিপদ দাস উন্মাদ হয়ে গেছে — সে কেবল বারবার বলছে, “দেবী তো ফিরে আসবেনই, ফিরে আসবেনই…” তার চোখ রক্তাভ, মুখে ফেনা, আর সে একটা পুরোনো শ্লোক গুনগুন করে বলছে — “চক্রে জন্ম, চক্রে মৃত্যু, চক্রই নিত্যদেবী”।
ঋদ্ধিমান জানে, চক্রটা ভাঙা হয়নি — কেবল স্থগিত। নবচণ্ডী যজ্ঞ বন্ধ হয়নি, কেবল তার প্রবাহ স্তব্ধ। পিশাচিনী কাপ্তা পরাজিত হননি — তিনি অপেক্ষা করছেন। পরদিন তারা মন্দির ত্যাগ করে — রাণু দত্ত কলকাতায় ফিরে যায় রিপোর্ট নিয়ে, কিন্তু প্রকাশ করে না। ঋদ্ধিমান কোথাও চলে যায়, খোঁজ মেলে না। দীপশিখা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়, যদিও মাঝেমধ্যে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চোখে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ, আর বলে, “আমার ভিতর কেউ কথা বলে।”
দশ বছর পর, সেই অঞ্চলের মন্দির ফের চালু হয়, এক নতুন পুরোহিতের নেতৃত্বে। যজ্ঞ শুরু হয় আবার — নবচণ্ডী। আর সেই পুরোহিত — চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, কণ্ঠস্বর কোমল কিন্তু গভীর, আর তার নাম— ঋদ্ধিমান ভট্টাচার্য।
নয়
দশ বছর কেটে গেছে। গ্রামটা অনেকটাই বদলে গেছে — পাকা রাস্তা হয়েছে, মন্দির চত্বর পাকা করে দিয়েছে স্থানীয় এক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, পাশে তৈরি হয়েছে নবচণ্ডী ভবন, যেখানে সপ্তাহান্তে লোক সমাগম হয়, মিষ্টান্ন বিতরণ হয়, যজ্ঞ হয় নিয়ম করে। কিন্তু সেই মন্দিরের গর্ভগৃহ? তার দরজা আজও অন্ধকারে ঢাকা। শুধু ঋদ্ধিমান ভট্টাচার্য জানেন — এই গর্ভে এখনও রয়ে গেছে এক অসমাপ্ত জাগরণ, এক পিশাচিনী, যিনি নামহীন হয়ে অপেক্ষা করেন “শেষ মন্ত্র”-এর জন্য। ঋদ্ধিমান ফিরেছেন, নতুন পোশাকে, মুখে শান্তির ছায়া, কিন্তু তার চোখের গভীর কালি বলে দেয় — সে এখনও ঘুমায় না। রাত্রি হলেই সে চলে যায় মন্দিরের পুরোনো অলিন্দে, সেখানে সে ধূপ জ্বালে না, মন্ত্র পড়ে না — সে অপেক্ষা করে। কীসের জন্য? অবশিষ্ট বলির। কারণ সে জানে, তেরো বলি এখনও সম্পূর্ণ হয়নি — মাত্র সাতটি হয়েছিল, আর পাঁচটি আত্মার সংযোগের আগেই সেই বিস্ফোরণে যজ্ঞ থেমে গিয়েছিল। কিন্তু কাপ্তা থেমে থাকেন না, তিনি শুধু গায়ে ছায়া গেঁথে রেখে দেন।
এক রাতে — পূর্ণিমার পরদিন — হঠাৎ করেই গ্রামের এক কিশোর হারিয়ে যায়। ছেলেটি স্কুল থেকে ফেরেনি, তার সাইকেল পাওয়া যায় মন্দিরের বটতলায়। ঠিক যেমন হয়েছিল দশ বছর আগে। আবার লোকের মনে ছড়িয়ে পড়ে কানাঘুষো, “পুরোহিতবাবু এসেছেন আর যজ্ঞ শুরু হবে — দেবে বলি, আবার…” কিন্তু এবার কেউ প্রতিবাদ করে না। শুধু একটি মানুষ ফিরে আসে — রাণু দত্ত। সে এখন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক, লিখছে এক পাণ্ডুলিপি — “শুদ্ধতন্ত্রের প্রান্তর: নবচণ্ডী ও নারীত্ব”। সে হঠাৎ করে মন্দিরে ফিরে আসে, একরাশ প্রশ্ন নিয়ে, কিন্তু চোখে সেই পুরনো বিস্ময় আর ভয়। সে মুখোমুখি হয় ঋদ্ধিমানের। বলে, “তুমি ফিরে এসেছো কেন?” ঋদ্ধিমান চুপ করে বলে, “যজ্ঞ তো শেষ হয়নি। আমি যদি না থাকি, অন্য কেউ করবে। অন্তত আমি জানি, কাকে কোথায় থামাতে হয়।” রাণু বলে, “তুমি কি বিশ্বাস করো যে কাপ্তা এখনও এখানে আছেন?” উত্তরে ঋদ্ধিমান তার হাত রাখে মাটিতে — পাথরের চক্রে — এবং বলে, “শোনো, এখনো ভেতরে মন্ত্র ওঠে। আমি জেগে থাকি যাতে অন্য কেউ না জাগে।”
সেই রাতে তারা দু’জনেই গর্ভগৃহের ভিতরে যায় — অনেক বছর পর প্রথমবার। দেওয়ালের ধূপচিহ্ন মুছে গেছে, কিন্তু চক্ররেখা এখনও স্পষ্ট। ত্রিশূল গলে গিয়ে এক ধাতব রেখায় পরিণত হয়েছে — ঠিক যেখানে দীপশিখা শুয়ে ছিলেন একদা। রাণু সেই জায়গায় গিয়ে দাঁড়াতেই হঠাৎ করেই তার নাক দিয়ে রক্ত পড়তে শুরু করে। সে বলে, “আমি গত কয়েকমাস ধরে দুঃস্বপ্ন দেখছি। এক আয়নার ভিতর থেকে কেউ ডাকে — সেই মুখটা আমার, কিন্তু চোখ দুটো তার নয়।” ঋদ্ধিমান দৌড়ে এসে তার হাত ধরে বলে, “তোমার ভিতর দিয়ে সে আসতে চাইছে। কাপ্তা কখনো ছেড়ে যায় না — সে আশ্রয় খোঁজে।” সেই মুহূর্তে চক্রের মধ্যভাগ থেকে ধোঁয়া উঠতে শুরু করে, আর সেই ধোঁয়ার ভিতর দিয়ে শোনা যায় — এক কণ্ঠস্বর, যা নারী নয়, পুরুষ নয় — যেন সময় নিজে কথা বলছে। “শেষ পাঁচটি বলি আমার প্রাপ্য। অথবা তুমিই হবে শেষ।” কণ্ঠ থেমে যায়। রাণু কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আমাকে শেষ বলি করো, যদি তাতে চক্র ভাঙে।” কিন্তু ঋদ্ধিমান জানে — কাপ্তা চায় প্রেম, চায় সংযোগ, আর চায় বিশ্বাসঘাতকতা — যাকে সে সবচেয়ে ভালোবাসে, তাকেই দিতে হবে শেষ বলি।
আর তখনই তারা জানে — যজ্ঞের চূড়ান্ত বলি হতে যাচ্ছে রাণু দত্ত।
দশ
চক্ররেখার মধ্যভাগে দাঁড়িয়ে আছে রাণু দত্ত — চোখ বন্ধ, শ্বাস ধীর, দুই কপালে রক্তের দাগ, আর মুখে নির্ভীকতা, যা জীবনের চেয়ে প্রিয় কিছু হারানোর প্রস্তুতির মতো। চারপাশে ছড়িয়ে আছে তেরোটি প্রদীপ — আজ সবগুলো জ্বলছে, অথচ কেউ আগুন ধরায়নি। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে ধূপ নয়, পচা কাঠ আর বাসি রক্তের গন্ধ। ঋদ্ধিমান চুপ করে বসে আছে মণ্ডলের এক প্রান্তে, তার সামনে খোলা একটি পুঁথি — যেটি লেখা হয়েছিল অনেক শতাব্দী আগে, তার পূর্বপুরুষ শ্যামানন্দ ভট্টাচার্যের হাতে। শেষ পাতায় লেখা: “যজ্ঞের শেষ বলি যদি প্রেম থেকে আসে, তবে দেবী নয়, দেবীত্ব উঠে যায়। তন্ত্র ভেঙে পড়ে। আর যদি বলি হয় দ্বিধায়, তবে পিশাচিনী শুদ্ধ হয় — আর ফিরে আসে চক্রে, নিত্য পুনরাবৃত্তিতে।” অর্থাৎ, কাপ্তা শুধু রক্ত চায় না — সে চায় অনুভব, বিশ্বাসঘাতকতা, আত্মদ্বন্দ্ব। তাই রাণুকে বলি দিলে কাপ্তার শক্তি অমর হবে, না দিলে কাপ্তা জেগেই যাবে এক অনন্ত বৃত্তে।
ঋদ্ধিমান কাঁদতে কাঁদতে উঠে দাঁড়ায় — “আমি পারব না, রাণু। আমি পারব না তোমাকে দিতে। তুমি তো আমার চোখ, আমার বিশ্বাস। আমি দেব না!” রাণু এক পা এগিয়ে এসে বলে, “তুমি দেবে না, আমি নিজেই যাব।” সে হাঁটতে থাকে চক্রের কেন্দ্রে, এবং তখনই গর্ভগৃহের দেয়াল কাঁপতে শুরু করে — যেন মন্দির নিজেই থেমে যেতে চায়, অথবা নিজেকে সমর্পণ করতে চায় এক ভয়াল শক্তির কাছে। ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে ভেসে ওঠে সেই ছায়ামূর্তি — কাপ্তা, যার মুখে এখনো নেই চোখ, নেই মুখ, কিন্তু শরীরে এসেছে এক অদ্ভুত কোমলতা। সে বলে, “শেষ বলি আজ পাবে না আমি, বরং তোমরা পাবে আমার অভিশাপ — অথবা মুক্তি।”
ঠিক তখন, রাণু চক্রের মাঝখানে বসে পড়ে ধ্যানস্থ অবস্থায় — এবং তার ঠোঁটে ভেসে আসে এক মন্ত্র, যা সে আগে কখনো শোনেনি, কিন্তু যা তার ভিতর থেকেই জন্ম নিচ্ছে:
“জাগ্রতং নয়, নির্জীবং করো।
তন্ত্রং নয়, চেতনা ভরো।
ভৈরবী নয়, নারী করো।”
ঋদ্ধিমান তখন এগিয়ে এসে তার কপালে ছুঁয়ে দেয় পুরোনো ত্রিশূল — সেই ত্রিশূল, যা একসময় চক্র ভেঙে দিয়েছিল। মুহূর্তেই আলো বিস্ফোরিত হয় — এবং কাপ্তার ছায়ামূর্তি কেঁপে কেঁপে গলে যেতে থাকে। সে আর্তনাদ করে, “তোমরা আমাকে নারী করেছো — আমি তো ছিলাম ভয়। ভয়কে নারী করলে, আমি থাকব না।” এবং সেই শেষ মুহূর্তে সে বলে ওঠে, “চক্র ভাঙা গেল — কারণ কেউ ভালোবেসে বলি দিল না, বরং বিশ্বাস দিয়ে রোধ করল।”
চক্র থেমে যায়। সব প্রদীপ একে একে নিভে যায়। ধোঁয়া থেমে যায়। রক্ত শুকিয়ে যায়।
রাণু চেতনার ঘোরে পড়ে থাকে কিছুক্ষণ — তারপর সে উঠে দাঁড়ায়, চোখে জল, কিন্তু মুখে হাসি। ঋদ্ধিমান তাকে জড়িয়ে ধরে — তারা জানে, যজ্ঞ শেষ, চক্র থেমেছে।
কিন্তু কোথাও, কোনও পাথরের ফাঁকে, আজও লেখা থাকে কাপ্তার নাম — ভৈরবী কাপ্তা — আর মাঝে মাঝে, নবচণ্ডী মন্দিরের পুরোনো গর্ভগৃহে আয়নায় এক নারী দাঁড়িয়ে থাকে নিঃশব্দে, চোখে অন্ধকার, ঠোঁটে হাসি। সে কিছু বলে না। শুধু চায় — আবার এক সংযোগ।
—
শেষ




