অর্পিতা ঘোষ
গ্রীষ্মের দুপুরের রোদ গঙ্গার তীরের বালিতে ঠিকরে পড়ছিল, আর শহরের ধুলো-ধোঁয়ার বাইরে একটা পুরনো বাড়ির দিকে এগোচ্ছিল পাঁচ বন্ধুর ছোট্ট দল – অনির্বাণ, ইরা, তীর্থ, মেঘলা আর রুদ্র। ওদের সবার বুকের মধ্যে মিশ্র উত্তেজনা, কৌতূহল আর অল্প অল্প শঙ্কা একসাথে খেলছিল। এই বাড়িটা একসময় জমিদারদের শান-শওকতের স্মৃতিবাহী ছিল, কিন্তু এখন রোদে ফাটল ধরা ছাদ, কাঁচ ভাঙা জানালা আর মাকড়সার জালে ঢাকা শূন্য বারান্দা যেন ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শহরের কলেজের টানা ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট আর পরীক্ষার চাপ থেকে মুক্তির জন্য এটাই তাদের গ্রীষ্মের অবসরযাত্রা – কিছুটা ভয়ের মায়াজালে মোড়া এক ধরনের রোমাঞ্চ খুঁজতে চেয়েছিল ওরা। রুদ্র তো শুরু থেকেই বলেছিল, “রাতের বেলা ভূতের ডাক না শুনতে পেলে ছুটি কি আর ছুটি!” মেঘলা, যার চোখে সবকিছুই একধরনের নরম আলোয় ভিজে থাকে, চুপচাপ শুধু নদীর দিকে তাকিয়ে ছিল; বয়ে চলা ঢেউ আর দূরের নৌকাগুলো যেন তাকে অদ্ভুত শান্তি দিচ্ছিল। অনির্বাণের হাতে ছিল নোটবুক আর কলম, প্রতিটি দৃশ্য, শব্দ আর অনুভূতিকে লিখে রাখার সেই চিরকালীন অভ্যাস। ইরা ফটোগ্রাফির নেশায় মত্ত, ঢোকার মুখেই তোলা ছবি তার ক্যামেরায় ফ্রেমবন্দি হচ্ছিল, আর তীর্থ, যার ভেতরে সবকিছুতেই যুক্তি খোঁজার প্রবণতা, একেবারে ব্যস্ত হয়ে বাড়ির স্থাপত্য আর দেওয়ালের ফাটলের পেছনের কারণ খুঁজছিল।
দলটি বাড়ির ভেতর ঢুকে একসময়কার অন্দরমহলের ছায়াঘেরা করিডর, সিঁড়ি আর ধুলো জমা কক্ষগুলো পেরিয়ে এগোতে থাকে। ছাদের লোহার গ্রিল দিয়ে সূর্যের আলো ঢুকে নিচে ছায়ার কারুকাজ এঁকে দিচ্ছিল, আর পায়ের নিচে শুকনো পাতা আর ভাঙা কাঠের চিড় ধরে শব্দ তুলছিল। তারা একসাথে সেই বড়ো ডাইনিং হলে গিয়ে দাঁড়াল, যেখানে অর্ধেক ভাঙা এক লম্বা টেবিল আর চারপাশে ছয়-সাতটা ছেঁড়া চেয়ার এখনো কোনওক্রমে দাঁড়িয়ে ছিল, যেন তাদেরই জন্য অপেক্ষা করছে। ইরা ছবি তুলতে তুলতে হঠাৎ বলে উঠল, “ভাবো তো, এক সময় কত জনে বসে গল্প করত এখানে!” মেঘলা জানালার পাশে গিয়ে বাইরের নদীর দিকে তাকিয়ে রইল, ঢেউয়ের ছন্দময় শব্দ শুনে তার মনে হল, এই জায়গার ভেতর লুকিয়ে আছে কিছু না বলা কথা, কিছু দীর্ঘশ্বাস। রুদ্র এক কোণে পুরনো বইয়ের তাক দেখল, বইগুলোর পাতা হলুদ আর পোকায় কাটা, তবু তাদের স্পর্শ করার লোভ সামলাতে পারল না। তীর্থ, এসব দেখে হেসে বলল, “সবই তো অতীত, এখন শুধু ইট-পাথরের কঙ্কাল,” কিন্তু তার কণ্ঠে একটা চাপা কৌতূহলও ফুটে উঠেছিল। অনির্বাণ, চুপচাপ চারপাশের দেওয়ালে হাত বুলিয়ে দেখতে লাগল, যেন সেই দেওয়ালের মধ্যেই লুকিয়ে থাকা স্মৃতির স্পর্শ পেতে চায়।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার ছায়া নামতে নামতে বন্ধুরা নিজেদের জন্য দোতলার একটা বড়ো ঘর ঠিক করল। ঘরটার একপাশে বারান্দা থেকে গঙ্গা দেখা যায়, আর অন্যপাশের দেয়ালে ফাটল জুড়ে ছোট ছোট লতা গজিয়েছে। তাদের শোবার জন্য পাতা বিছানায় ধুলো ঝেড়ে, টর্চ আর ফোনের আলোয় জিনিসপত্র সাজিয়ে ওরা ঘরটাকে অস্থায়ীভাবে নিজের মতো করে নিল। মেঘলা একটা পুরনো কাঠের টুলে বসে নদীর দিকের আলো-আঁধারি দেখতে লাগল, আর ইরা ক্যামেরা নিয়ে বারান্দায় গেল সেই সন্ধ্যার ছবি তোলার জন্য, যেখানে গঙ্গার জলে সূর্যাস্তের সোনালি রঙ মিশে যাচ্ছে। রুদ্র ততক্ষণে প্ল্যান করছে রাতে ভূতের গল্প শোনাবে, আর তীর্থ সেই গল্পে যুক্তির ফাঁক খুঁজে মজা নেবে। অনির্বাণ নিজের নোটবুক খুলে প্রথম পৃষ্ঠায় লিখল, “গ্রীষ্মের ছুটির প্রথম দিন: গঙ্গার ধারের সেই বাড়ি – নীরব, ধুলো জমা, অথচ কোথাও যেন নিঃশ্বাস ফেলে। আমাদের গল্প এখানেই শুরু।” বন্ধুদের হাসি, তর্ক, কৌতূহল আর সেই পুরনো দেওয়ালগুলো মিলেমিশে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চের সূচনা করল; তখনো কেউ জানত না, এই নীরব দেওয়ালের অন্তরালে লুকিয়ে আছে এক নিখোঁজ মেয়ের দীর্ঘশ্বাস আর রহস্য, যা তাদের বন্ধুত্ব, সাহস আর বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ জানাবে। এবং গঙ্গার ঢেউয়ের মতোই সেই রহস্য একের পর এক নতুন গল্প বুনে নিয়ে যাবে তাদের এক অজানা ভোরের দিকে।
–
সন্ধ্যার পরে যখন অন্ধকার আস্তে আস্তে ঘিরে ধরছিল সেই পুরনো বাড়িটিকে, তখন হঠাৎই মেঘলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে নদীর দিকের হাওয়ার মধ্যে একটা কৌটো দেখতে পায়, যেটা হয়তো কারো চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল বছরের পর বছর। কৌটোটা এতটাই ধুলোতে ঢাকা ছিল যে প্রথমে বোঝাই যায়নি ভেতরে কী আছে; কিন্তু কৌতূহলের বশে মেঘলা ও রুদ্র একসাথে সেটা খুলতে গেলে ওদের চোখ কপালে ওঠে। ভেতরে বেরিয়ে এল কিছু পুরনো, প্রায় বিবর্ণ হয়ে যাওয়া ছবি আর অদ্ভুত ভাজ করে রাখা চিঠি। ইরার হাত কাঁপতে থাকে যখন সে ছবিগুলো তুলতে গিয়ে দেখতে পায়, একটাতে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক মেয়ের ছবি – অদ্ভুত দৃষ্টি আর অজানা কষ্টে ভরা চোখ। অনির্বাণ চিঠির ভাঁজ খুলে দেখে, তাতে হাতের লেখা স্পষ্ট নয়, তবে কয়েকটা শব্দ স্পষ্ট বোঝা যায়: “আমার কথা কেউ জানলে তারা ক্ষতি করবে… আমি আর পারছি না…” এই কয়েকটি অর্ধেক-অলিখিত শব্দই যেন ওদের বুকের ভেতর কাঁপন ধরিয়ে দিল। তীর্থ প্রথমে যুক্তির খাঁচায় বন্দি রাখার চেষ্টা করল, “এ হতে পারে কারো কল্পিত গল্প, হয়তো আসল নয়,” কিন্তু ইরা চিঠি আর ছবির দিকে তাকিয়ে জোর গলায় বলল, “দেখো না, এই চোখের দৃষ্টি মিথ্যে হতে পারে?” রুদ্র মজা করে বলল, “এতসব রহস্য থাকলে তো আমাদের ছুটি জমে যাবে!” কিন্তু সবার মধ্যে একটা অদৃশ্য শিহরণ বয়ে যেতে লাগল, যেন কোনো অজানা রহস্য ডেকে নিয়ে চলেছে তাদের।
রাতের খাবারের পর সবাই মেঝেতে গোল হয়ে বসে ছবি আর চিঠিগুলো বারবার দেখছিল। মেঘলা সেই মেয়েটির চোখে অদ্ভুত শূন্যতা দেখে কেমন যেন অস্বস্তি অনুভব করছিল, আর ইরা একে একে ছবিগুলোর পেছনের তারিখ আর লেখা খুঁটিয়ে পড়ছিল – কিছু ছবির পেছনে লেখা ছিল শুধু ‘সায়ন্তিকা, ২০০৮’ আর কোথাও কোনো মন্তব্য: “আমি এখানেই শেষ…”, “আমার কণ্ঠ কেউ শুনবে না…” অনির্বাণ তার নোটবুকে দ্রুত নোট করতে লাগল, যেন কোনো সূত্র হারিয়ে না যায়। রুদ্র তখনো সেই অন্ধকার আর ভূতের গল্পে রোমাঞ্চ খুঁজে পেতে চাইছিল, কিন্তু তীর্থ তার যুক্তি আর বিশ্লেষণে মগ্ন হয়ে খুঁজছিল এই রহস্যের বাস্তব দিক। “কারো ব্যক্তিগত কষ্টও হতে পারে,” বলল সে, “যা আমরা ভাঙা টুকরো টুকরো থেকে দেখছি।” কিন্তু বন্ধুরা বুঝতে পারছিল, এ কেবল কারো কল্পিত দুঃখ নয় – এই চিঠি আর ছবি তাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে এক অজানা অন্ধকারের দিকে, যেখান থেকে ফিরতে নাও পারে সহজে। বারান্দায় গঙ্গার ঢেউয়ের শব্দ যেন আরও গভীর মনে হচ্ছিল, আর সেই শব্দের ফাঁকে ফাঁকে কে যেন খুব দূর থেকে ফিসফিস করে বলছে, “আমাকে খুঁজে পাবে তো?”
রাত আরও গভীর হলে, বন্ধুরা ঘুমোতে গেল, কিন্তু ইরার চোখে ঘুম এল না। সে বারবার ভাবছিল সেই চোখের দৃষ্টি আর চিঠির অস্পষ্ট শব্দগুলো, আর মনে হচ্ছিল অন্ধকার যেন তাদের ভেতরে ঢুকে পড়ছে ধীরে ধীরে। অনির্বাণ বিছানায় শুয়ে শুয়ে সেই রহস্যের সূত্রগুলোর ছক কষছিল মনে মনে, আর তীর্থ কিছুতেই ঠিক করতে পারছিল না, কীভাবে যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করবে এই অদ্ভুত অনুভূতি। মেঘলা জানালার পাশে বসে নদীর দিকে তাকিয়ে কবিতা লিখতে লিখতে হঠাৎ থমকে গেল – যেন নদীর ওপারে কেউ দাঁড়িয়ে আছে, তাকিয়ে আছে ওদের দিকেই। রুদ্র, যে সবসময় সাহস দেখানোর ভান করে, এমনকি তার বুকেও অজানা আশঙ্কা উঁকি দিতে লাগল। সেই রাতে ওদের কানে ভেসে এল হাওয়ার ফিসফিসানি আর পুরনো বাড়ির কাঠের খচখচানি – এক পুরনো, হারিয়ে যাওয়া কণ্ঠস্বরের মতো। এবং তখনই প্রথমবার ওরা টের পেল, এই বাড়ি শুধু ইট-পাথরের নয়; এটা বয়ে নিয়ে চলেছে অসমাপ্ত গল্প, অজানা কান্না আর এক নিখোঁজ মেয়ের ছায়া, যে হয়তো এখনো ওদের মধ্যে কিছু বলতে চায়।
–
রাত গভীর হতেই বাড়ির ভেতরকার নিস্তব্ধতা যেন আরও গাঢ় হয়ে উঠল, আর সেই নীরবতার ফাঁক গলে ঢুকে পড়ল অদ্ভুত সব শব্দ – যেন পুরনো কাঠের দরজার খচখচানি, জানালার কাঁচে হাওয়ার চাপড়ে পড়া স্পর্শ, আর গঙ্গার পাড় থেকে ভেসে আসা এক অস্পষ্ট ফিসফিসানি। অনির্বাণ চোখ বন্ধ করে শোনার চেষ্টা করল, শব্দগুলো সত্যিই হচ্ছে কিনা নাকি তারই কল্পনা, কিন্তু স্পষ্ট শুনতে পেল এক ধরনের নিস্তেজ আহ্বান – যেন কেউ দূর থেকে বলছে, “আমাকে খুঁজে বের করো…” ইরা বিছানায় শুয়ে থেকেও অনুভব করল, নদীর পাড়ে কোনো অদৃশ্য উপস্থিতি দাঁড়িয়ে আছে, তাকিয়ে আছে ওদের দিকেই। মেঘলা টের পেল তার গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেছে, আর বুকের মধ্যে ধুকধুক শব্দ জোরে বেজে চলেছে। রুদ্র, যে সবসময় মুখে বড় বড় কথা বলে, এমনকি সে-ও ঘুম থেকে উঠে বসে গেল, চোখে ভয়ের ছায়া নিয়ে। তীর্থ প্রথমে যুক্তির কথা বলতে গিয়েও থেমে গেল – কারণ এই অনুভূতিটা যুক্তি দিয়ে বোঝানো যায় না, এটা কিছু ভেতর থেকে টেনে আনছে ওদের, ডেকে নিয়ে যাচ্ছে অজানা এক অন্ধকারের গভীরে।
হঠাৎ রুদ্র ফিসফিস করে বলল, “চলো, বারান্দায় গিয়ে দেখি।” ইরা এক মুহূর্ত ইতস্তত করলেও শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেল, মেঘলা নিঃশব্দে তাদের পেছনে পেছনে হাঁটতে লাগল, আর অনির্বাণ নোটবুকটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। তীর্থ একাই থেকে যাওয়ার সাহস পেল না, তাই ওরাও বেরিয়ে এল বারান্দায়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওরা দেখল, নদীর ওপারে কুয়াশার মধ্যে সত্যিই এক ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে, স্থির অথচ অদ্ভুতভাবে স্পষ্ট – যেন বাতাসের মধ্যে গড়া কোনো রূপ। সেই ছায়া কিছু বলছে না, শুধু তাকিয়ে আছে, আর ওদের দিকে হাত বাড়ানোর মতো ভঙ্গি করছে। ইরার মনে হল, এই ছায়ার মধ্যে লুকিয়ে আছে সেই ছবির মেয়েটির চোখের শূন্য দৃষ্টি, সেই নিঃশব্দ কান্না, যা এখনো মুছে যায়নি। অনির্বাণ দ্রুত চোখ নামিয়ে নোটবুকে লিখে রাখল, “ছায়া দেখা গেল, নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে, ডাকে কিনা স্পষ্ট নয়…” মেঘলার হাতে শিরশিরে একটা অনুভূতি বয়ে গেল, আর তার মনে হল, এই ছায়া যেন কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না।
রুদ্র সাহস করে ফিসফিসিয়ে বলল, “চল, ওদিকটায় যাই,” কিন্তু তীর্থ তাকে টেনে ধরল, “এভাবে রাতে নদীর ধারে যাওয়া ঠিক না।” তর্কের মাঝেই হাওয়ার বেগ বাড়তে থাকল, যেন কে যেন ওদের তাড়া দিচ্ছে, আর সেই সঙ্গে বাড়ির ভেতর থেকে এক টুকরো কাগজ উড়ে এসে বারান্দার মেঝেতে পড়ল। ইরা কাগজটা তুলে দেখল – সেটা সেই চিঠিরই অংশ, তাতে লেখা: “যদি আমায় না পাও… আমি নদীর কাছে আছি…” এই কথাগুলো পড়েই ইরার বুক কেঁপে উঠল, চোখ ভিজে এল। সবাই একসাথে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, শুধু গঙ্গার ঢেউয়ের শব্দ আর রাতের হাওয়ার ফিসফিসানি যেন এই বাড়ির পুরনো ইতিহাসের কোনো অজানা কথা বলছে ওদের কানে। সেই মুহূর্তে ওরা টের পেল, এটা শুধু রহস্য নয়, এটা এক নিখোঁজ আত্মার কান্না, যা ওদের ডেকে নিচ্ছে অতীতের আঁধারের মধ্যে – যেখানে বন্ধুত্ব, সাহস আর বিশ্বাস ছাড়া আর কোনো আলো নেই।
–
পরের দিন সকালেই আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুরা আবার একজোট হয়ে বেরিয়ে পড়ল গ্রামের দিকে, এই বাড়ি আর নদীর পাড়ের রহস্যময় ছায়ার সূত্রে সত্যি কী লুকিয়ে আছে, তা জানার তাগিদে। ইরা আগের রাতের ছায়া আর সেই চিঠির টুকরো নিয়ে এখনো ভাবছিল, বারবার মনে হচ্ছিল এই বাড়ির দেয়াল আর গঙ্গার ঢেউ যেন ওদের কিছু বলতে চাইছে। মেঘলা গ্রামের পথের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে দেখল ফেলে রাখা নৌকা, ভাঙা ঘাট আর কুয়াশায় ঢাকা দূরের গঙ্গা, আর মনে মনে ভাবল, এই নদীর বুকেই হয়তো লুকিয়ে আছে সেই মেয়ের না বলা কথাগুলো। অনির্বাণ তার নোটবুকে আগের রাতের সবকিছু লিখে রেখেছিল, আর সেই সূত্র ধরে এবার খুঁজতে চাইছিল গ্রামের কোনো প্রাচীন সাক্ষীর কাছে, যে হয়তো সায়ন্তিকার গল্প জানে। তীর্থ, যিনি সবসময় যুক্তি আর বাস্তবতায় বিশ্বাস করে, এবার চুপচাপ থেকে গেল, তার চোখেও দেখা গেল অদ্ভুত অস্বস্তি আর শঙ্কা। আর রুদ্র, যে সাধারণত হালকা মেজাজের, এবার সত্যিই সিরিয়াস হয়ে গ্রামের বুড়ো নৌকাওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করল, “দাদু, এই বাড়িতে কি কোনো মেয়ে থাকত?”
বৃদ্ধ নৌকাওয়ালা চোখ সরু করে কিছুক্ষণ ওদের দেখলেন, তারপর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “সায়ন্তিকা… হ্যাঁ, বছর দশেক আগে এই বাড়িতেই থাকত। চুপচাপ মেয়ে ছিল, চোখে কষ্ট লুকিয়ে রাখত, কিন্তু কারো সঙ্গে খুলে বলত না কিছুই। একদিন হঠাৎ উধাও হয়ে গেল… কেউ খুঁজে পায়নি। কেউ বলে নদীতে ডুবে গেছে, কেউ বলে নিজেই চলে গেছে দূরে, আবার কেউ বলে ওর নিঃশব্দে হারিয়ে যাওয়ার পেছনে কিছু অন্ধকার সত্যি লুকিয়ে আছে…” বুড়োর কণ্ঠে কেমন যেন দুঃখের সুর, আর সেই কথায় বন্ধুরা অনুভব করল, এই রহস্য শুধু গল্প নয়, এক জীবনের বেদনা। ইরা বুড়োর কথা শুনে গলা শুকিয়ে গেল, মেঘলার চোখ অজান্তেই ভিজে উঠল, আর অনির্বাণ আরও গভীরভাবে ভাবতে লাগল – কে ছিল এই সায়ন্তিকা, কেন তার হারিয়ে যাওয়া? তীর্থ একটু নড়েচড়ে বসে বলল, “কিন্তু কেউ কিছুই জানল না? কোনো সূত্র নেই?” বুড়ো কেবল বললেন, “কেউ যদি শোনার মতো কান রাখত, তাহলে হয়তো পেত…” তারপর নদীর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন।
ফিরে আসার সময় বন্ধুরা কিছুটা চুপচাপ ছিল, সবাই যার যার মনে গুছিয়ে নিচ্ছিল নতুন পাওয়া তথ্যগুলো। বাড়িতে ফিরে ইরা চিঠি আর ছবিগুলো আবার খুলে একদৃষ্টিতে দেখতে লাগল, আর হঠাৎ খেয়াল করল, একটাতে নদীর ঘাটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা সায়ন্তিকার পেছনে দূর থেকে কারো ছায়া দেখা যাচ্ছে – অস্পষ্ট, তবু স্পষ্টতই মানবাকৃতি। মেঘলা সেই ছায়া দেখে আঁতকে উঠল, আর অনির্বাণ খাতায় লিখল, “ছায়া শুধু এখন নয়, ছবিতেও আছে… এর মানে সেই সময়েও কেউ ওকে দেখত।” রুদ্র সেই ছায়ার দিকেই আঙুল দেখিয়ে বলল, “এই লোকটিই কি ওর হারিয়ে যাওয়ার পেছনে আছে?” তীর্থ প্রথমে বিরোধিতা করতে গিয়েও থামল, কারণ এবার যুক্তির চেয়েও বড় হয়ে উঠেছিল অজানা এক অনুভূতি। গঙ্গার তীরের সেই প্রাচীন বাতাস, সেই অদৃশ্য ফিসফিসানি যেন ওদের বলছিল, এই রহস্যের জট ছাড়াতে হলে শুধু যুক্তি নয়, প্রয়োজন সাহস, মন আর অতীতের কান্না শোনার ইচ্ছে। বন্ধুরা একসাথে চুপচাপ চোখাচোখি করে নিল, আর বুঝতে পারল – এই রহস্যের গভীরে নামতে গেলে নিজেদের ভেতরের ভয়কে অতিক্রম করতেই হবে।
–
সন্ধ্যা নামার পর বন্ধুরা আবার সেই পুরনো কুঠুরিতে একসাথে বসে পড়ল, যেখানে সায়ন্তিকার শেষ চিঠিটা লেখা হয়েছিল বলে ওদের মনে হয়েছিল। চারপাশের দেয়ালে সময়ের আঁচড়, ছাদে ঝুলন্ত মাকড়সার জাল আর হাওয়ার ঠান্ডা ছোঁয়া যেন ওদের ভেতরের আতঙ্ককে আরও গভীর করে তুলছিল। রুদ্র ফিসফিস করে বলল, “তোমরা জানো, এই চিঠিটা সত্যি হলে ওকে হয়তো কেউ ইচ্ছে করে হারিয়ে দিয়েছিল…” তীর্থ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “ভূত-টুত না হয় মানলাম না, কিন্তু এর পেছনে মানুষের হাত থাকলেও অবাক হবো না।” ইরা ছবিটা হাতের তালুর মধ্যে শক্ত করে ধরে ছিল, যেন অনুভব করতে চাইছিল সায়ন্তিকার সেই কান্নার কম্পন। মেঘলা হঠাৎ ফিসফিস করে বলল, “আমার মনে হচ্ছে, আমরা যা খুঁজছি, তা কেবল রহস্য নয়, এটা একটা অসমাপ্ত যন্ত্রণা…” অনির্বাণ সবাইকে থামিয়ে বলল, “আমরা যদি সত্যিই জানতে চাই, তবে একসাথে থাকতে হবে। একা একা কোনো সিদ্ধান্ত নিলে শুধু বিপদ বাড়বে।” এই কথা বলেই সে চারপাশে তাকিয়ে বন্ধুবান্ধবের চোখে চোখ রাখল – আর সেই চোখেই ওরা টের পেল, বন্ধুত্বের বাঁধন যতটা গভীর, ততটাই নরম আর ভাঙনপ্রবণ।
রাত যত গাঢ় হচ্ছিল, ওদের ভেতরের ভয় ততই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। বারান্দার বাইরে গঙ্গার ঢেউয়ের ধুপধাপ, অন্ধকারে দূরের শিয়ালের ডাক আর ছাদের কাঠের খচখচানি মিলিয়ে এক অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি করছিল। হঠাৎ ইরা ভয়ের চোটে রুদ্রের হাত চেপে ধরল, আর বলল, “আমার মনে হচ্ছে কেউ দেখছে…” রুদ্র একটু হেসে বলার চেষ্টা করল, “আমরা ভয় পেলে চলবে না…” কিন্তু ওর গলায়ও কাঁপন স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল। তীর্থ চোখ নামিয়ে চুপ করে রইল, যুক্তি আর সাহসের মধ্যে যে লড়াইটা হচ্ছিল, সেটা হয়তো বন্ধুরাও টের পেয়েছিল। মেঘলা তখন একটা পুরনো পেইন্টিং-এর দিকে তাকিয়ে রইল, যেখানে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক মেয়ের মুখ দেখা যায়, চোখে সেই চিরচেনা শূন্যতা আর এক ফোঁটা অশ্রু। অনির্বাণ শান্ত গলায় বলল, “আমরা যদি থামি, তাহলে আর কেউ এই গল্পটা শোনার চেষ্টা করবে না… আমাদেরই শুনতে হবে, জানতেই হবে…” সেই মুহূর্তে বন্ধুরা আবার একবার মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল – ভয় যতই গভীর হোক, একে অপরের হাত ছাড়বে না।
রাতের শেষ ভাগে ওরা ঠিক করল পরের দিন সকালে আবার নদীর ঘাটে যাবে, যেখানে শেষবার সায়ন্তিকাকে দেখা গিয়েছিল বলে বুড়ো নৌকাওয়ালা বলেছিল। সেই ঘাটে হয়তো এমন কিছু আছে যা এখনো ওদের জন্য অপেক্ষা করছে – হয়তো কোনো চিহ্ন, কোনো চিঠির শেষ পৃষ্ঠা, কিংবা নিখোঁজ এক আত্মার স্পর্শ। বারান্দায় দাঁড়িয়ে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে ইরা নিঃশব্দে ফিসফিস করে বলল, “তুমি যদি সত্যিই এখানে থাকো, আমাদের কাছে আসো…” হাওয়ার মধ্যে ভেসে আসা ফিসফিসানি যেন এক মুহূর্তের জন্য উত্তর দিল – বা হয়তো ওরা ওদের মনেই শুনল সেই উত্তর। বন্ধুরা আবার চুপ করে একে অপরের দিকে তাকাল, আর বুঝতে পারল, রহস্য শুধু ভয়ের দেয়াল নয়, বন্ধুত্বের বাঁধনও শক্ত করে – আর সেই বাঁধনেই ওরা খুঁজে পাবে আলো, অন্ধকার যত ঘন হোক না কেন।
–
পরের দিন সকালে বন্ধুরা ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই গঙ্গার পাড়ের সেই পুরনো ঘাটের দিকে রওনা দিল, যেখানে সায়ন্তিকাকে শেষবার দেখা গিয়েছিল বলে বুড়ো নৌকাওয়ালা বলেছিল। রোদ উঠে গেলেও নদীর কুয়াশা তখনও পুরোপুরি সরে যায়নি, আর সেই কুয়াশার ভেতর দিয়ে ওরা দেখতে পেল ফাঁকা ঘাট, ভাঙা সিঁড়ি আর জলে ভিজে থাকা কিছু পাথর। ইরা প্রথমেই পা রাখল ভাঙা ঘাটের সিঁড়িতে, আর হঠাৎই তার নজর পড়ল বালির মধ্যে কিছু ছেঁড়া কাগজের টুকরো আর বিবর্ণ কাপড়ের টুকরায়, যা দেখে মনে হলো কোনো অদৃশ্য হাত ওদের জন্য ফেলে গেছে। মেঘলা কাগজগুলো হাতে তুলে নিল, আর দেখল, সেই চেনা হাতের লেখা: “আমি চাই না কেউ কষ্ট পাক… কিন্তু এই নদীর কাছে আমার সব আছে…” ইরার গলা শুকিয়ে এলো, আর রুদ্র চুপ করে চারপাশে তাকাল – কুয়াশার মধ্যে কে যেন এক ঝলক দৃষ্টি ফেরাল, আবার মিলিয়ে গেল। অনির্বাণ নোটবুকে দ্রুত সব লিখে রাখল, যেন কোনো সূত্র হারিয়ে না যায়। তীর্থ, যে রাত পর্যন্তও সবকিছুতে যুক্তি খুঁজছিল, এবার চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল – তার চোখে স্পষ্ট ভয় আর বিস্ময়ের ছায়া।
সেই সময় ইরা হঠাৎ বলল, “তোমরা শুনছ? কেউ ডাকছে…” প্রথমে কেউ বুঝতে পারল না, কিন্তু খানিক বাদেই সবাই শুনতে পেল – নদীর ঢেউয়ের মধ্যে যেন আস্তে আস্তে মিশে থাকা এক মেয়েলি কণ্ঠস্বর, খুব ক্ষীণ, কিন্তু তাতে ছিল অসীম বেদনা আর আক্ষেপের ছোঁয়া। মেঘলার মনে হলো সেই কণ্ঠ বলছে, “আমাকে খুঁজে বের করো…” রুদ্র বারবার চারপাশে তাকাল, যদি কোথাও সেই ছায়ামূর্তিটা দেখতে পায়, কিন্তু কুয়াশা শুধু ঢেকে রাখল রহস্য, দেখাল না কোনো উত্তর। তীর্থ ফিসফিস করে বলল, “এ তো হতে পারে বাতাসের খেলা…” কিন্তু ওর নিজেরই কথায় জোর নেই। অনির্বাণ চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে সেই ডাক শুনতে চাইল – ওর মনে হলো, এই ডাক শুধু কান দিয়ে নয়, মনে শোনার কথা, কারণ এই ডাক আসছে নদীর ঢেউ আর বাতাসের ভেতর দিয়ে, অতীতের এক হারিয়ে যাওয়া কণ্ঠ থেকে। ইরা নদীর জলে হাত ছুঁইয়ে কাঁপা গলায় বলল, “সায়ন্তিকা, আমরা এখানে আছি… আমরা তোমাকে ভুলে যাইনি…”
একটা মুহূর্তের জন্য চারপাশের কুয়াশা আর ঢেউ থমকে গেল, আর সেই নিস্তব্ধতায় বন্ধুরা টের পেল – ওরা একা নয়। এই নদী, এই বাতাস, এই ভাঙা ঘাটের পাথর, সব যেন সেই নিখোঁজ মেয়ের নিঃশ্বাসে ভিজে আছে। রহস্যের জট যেন আরেকটু খুলে গেল, কিন্তু সাথেই আরও নতুন প্রশ্নের জন্ম দিল: কে হারিয়ে দিল সায়ন্তিকাকে? কেন? বন্ধুরা ফিরে আসার আগে নদীর তীরে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল, আর ওদের মধ্যে তৈরি হলো এক অদৃশ্য প্রতিশ্রুতি – যতই ভয় আসুক, যতই অন্ধকার ঘনাক, ওরা একসাথে এই রহস্যের শেষ পর্যন্ত যাবে। আর সেই প্রতিশ্রুতি গঙ্গার ঢেউয়ে মিলিয়ে গিয়ে যেন একটা মৃদু, অদৃশ্য স্বর ফিরিয়ে দিল: “ধন্যবাদ…”
–
নদীর ঘাট থেকে ফিরে আসার পর বন্ধুরা চুপচাপ বসেছিল সেই পুরনো কুঠুরিতে, চারপাশে শুধুই ফাটল ধরা দেওয়াল, ধুলো আর অদ্ভুত এক চাপা নিঃশ্বাসের গন্ধ; ওরা নিজেরাই টের পাচ্ছিল রহস্যের জালে জড়িয়ে পড়ছে আর সেই জাল থেকে মুক্তি নেই। ইরার চোখে তখনো ভাসছিল নদীর ঢেউয়ের ফাঁকে ফাঁকে শোনা সেই মেয়েলি কণ্ঠ, রুদ্র অনুভব করছিল অদৃশ্য কোনো চোখ যেন এখনো ওদের দিকে তাকিয়ে আছে, আর মেঘলা ভাবছিল, হয়তো এই অদৃশ্য ছায়াই চাইছে ওরা সত্যি জানুক। তীর্থ নিজের যুক্তির দেয়াল টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছিল, কিন্তু নিজের অজান্তেই বিশ্বাস করতে শুরু করেছে কিছু আছে যা চোখে দেখা যায় না, তবু অনুভব করা যায়। অনির্বাণ চুপ করে নোটবুকের পাতা উল্টে লিখছিল, “সায়ন্তিকার গল্প আমাদের যতটা ভয় দেখায়, ততটাই কাছে টানে… সত্যি জানতে হলে আমাদের ভয় পেরোতেই হবে…” শেষ পর্যন্ত ওরা ঠিক করল, রাতের অন্ধকার নামার পরই সেই গুদামঘরে যাবে, কারণ বুড়ো নৌকাওয়ালার কথায় ইঙ্গিত ছিল– সায়ন্তিকার শেষ চিঠি ওই বাড়ির পুরনো ঘরেই কোথাও হারিয়ে আছে, যা হয়তো সব প্রশ্নের উত্তর দেবে।
রাতের গভীরতা যখন বাড়িটাকে ঢেকে ফেলল আর গঙ্গার হাওয়া জানালার কাচে চাপড়ে পড়তে লাগল, তখন টর্চ হাতে ওরা ধীর পায়ে নামল সেই গুদামঘরে, যেখানে দিনের আলো কখনো ঢোকে না। ভাঙা দরজার কড়া ধাক্কা দিতেই ভেতর থেকে বেরোল স্যাঁতসেঁতে গন্ধ, আর দেয়ালের অন্ধকার কোণ থেকে কে যেন দেখছে এমন অনুভূতিতে বুক ধড়ফড় করতে লাগল। হঠাৎ রুদ্র টর্চের আলো ফেলে বলল, “দেখো, ওখানে কিছু আছে…” এক কোণে অর্ধেক ছেঁড়া চৌকির নিচে লুকানো ছিল একটি ডায়েরি, যার মলাট প্রায় গলে গেছে, তবু ভেতরের পাতাগুলোয় অস্পষ্ট কালি আর কষ্টের ছাপ টিকে আছে। ইরা কাঁপা হাতে ডায়েরিটা তুলল, আর বন্ধুরা প্রায় নিশ্বাস আটকে পড়তে লাগল সেই শেষ কথাগুলো, যেখানে লেখা: “আমি জানি, আমার চলে যাওয়ার পর কেউ হয়তো পড়বে… আমি ভয় পেয়েছি, কিন্তু সত্যি বলতে ভয় আমার একার নয়… তাদেরও ছিল… আমি যা জেনে গিয়েছি, সেটা প্রকাশ করলে অনেকের ক্ষতি হতো… তাই আমিই হারিয়ে যাচ্ছি… নদীর কাছে…” এই লাইনগুলো যেন এক মুহূর্তে বন্ধুরা সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পেল, সায়ন্তিকার ভয়, কষ্ট আর শেষ সিদ্ধান্ত।
ওরা চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল, গুদামঘরের অন্ধকারে, চারপাশে কেবল বাতাসের শব্দ আর দূর থেকে নদীর ঢেউয়ের ধ্বনি। তীর্থ ধীরে ধীরে বলল, “তার মানে কেউ সত্যিই চেয়েছিল ওর গল্প চুপ করিয়ে দিতে…” রুদ্র চোখ নামিয়ে বলল, “কিন্তু ওর গল্প আজও বেঁচে আছে…” ইরা ডায়েরিটা বুকের কাছে চেপে ধরল, যেন এক বন্ধুকে জড়িয়ে ধরছে, আর মেঘলার চোখ থেকে চুপচাপ অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। অনির্বাণ কেবল একটাই লাইন লিখল, “আমরা ওর শেষ পাঠক, আর এই গল্প শেষ হতে দেব না…” সেই অন্ধকার গুদামঘরে বন্ধুরা শপথ নিল, যতটুকু জানে, সেটা বলবে, লিখবে, আর সায়ন্তিকার হারিয়ে যাওয়া কণ্ঠস্বরকে ফিরিয়ে আনবে– অন্তত মানুষের মনে, নদীর ঢেউ আর বাতাসের ফিসফিসানিতে যদি না-ও হয়। সেই রাতে ওরা প্রথমবার সত্যিই মুখোমুখি হলো হারিয়ে যাওয়ার, আর টের পেল, ভয়ের অন্ধকারের থেকেও শক্তিশালী কিছু আছে– একে অপরের প্রতি বিশ্বাস আর একজন হারিয়ে যাওয়া মেয়ের নিঃশব্দ আর্তি শোনার সাহস।
–
রাত কেটে গিয়েছিল অদ্ভুত এক নীরবতার মধ্যে, আর ভোরের প্রথম আলোয় বন্ধুরা একসাথে বসেছিল সেই পুরনো বাড়ির বারান্দায়, নদীর দিকে তাকিয়ে। গঙ্গার ঢেউয়ের শব্দে মিলিয়ে যাচ্ছিল গত রাতের দেখা অন্ধকার আর আতঙ্ক, তবু বুকের ভেতর রয়ে গিয়েছিল এক অদ্ভুত ভার। ইরা ডায়েরিটা নিজের হাতে ধরে রাখছিল, যেন হারিয়ে যাওয়া এক আত্মার শেষ স্মৃতিটুকু আঁকড়ে আছে, আর মেঘলা চুপচাপ নদীর ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল– সেই ঢেউ, যা হয়তো সায়ন্তিকার নিঃশ্বাসের মতো বয়ে চলে। অনির্বাণ চোখ বন্ধ করে নিজের নোটবুকের পাতা স্পর্শ করে বুঝতে চাইছিল, এ শুধু তাদের ছুটি নয়, এক নতুন যাত্রা, যা বন্ধুত্বকে ভয় আর অন্ধকারের বাইরে টেনে এনেছে। রুদ্র, যে সবসময় মজা করতে ভালোবাসত, এবার শান্ত গলায় বলল, “তোমরা বুঝতে পারছ? আমরা সত্যিই ওর গল্প শুনতে পেরেছি…” তীর্থ মাথা নাড়ল, আর বলল, “আর সেই গল্প আমরা নিয়ে যাবো… কেউ যাতে ভুলে না যায়।”
বন্ধুরা ঠিক করল, সায়ন্তিকার কথা লিখে ফেলবে, তার ছবি আর ডায়েরির টুকরো নিয়ে তৈরি করবে এক ছোট বই– স্কুলের ম্যাগাজিনে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেবে, যাতে হারিয়ে যাওয়া মেয়েটির নাম বাতাসে থেকে যায়। ইরা ফিসফিস করে বলল, “তোমরা জানো, ও আমাদের খুঁজতে ডাকেনি, আমাদের বাঁচাতে ডাকেছিল… যাতে আমরা ভয় পেলেও থেমে না যাই…” মেঘলা চোখ মুছে বলল, “আমরা থামব না।” অনির্বাণ সেই কথাগুলো নোটবুকে লিখল, আর রুদ্র একবার নদীর দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “ধন্যবাদ, সায়ন্তিকা…” তীর্থ, যে যুক্তির বাইরে কখনো ভাবেনি, এবার বলল, “কিছু কিছু গল্প যুক্তির নয়, হৃদয়ের জন্য…” সেই কথায় বন্ধুরা একসাথে চুপ করে নদীর ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকল, যেখানে আলো আর ছায়ার মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছিল এক মেয়ের হারিয়ে যাওয়া মুখ– কিন্তু ওরা জানত, সেই মুখ আর কখনো হারাবে না।
যখন সূর্য পুরোপুরি উঠল, বন্ধুরা সেই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এল, পায়ের নিচে ধুলো, মাথার ওপর ঝরা পাতার ছায়া আর বুকের মধ্যে এক অদৃশ্য প্রতিশ্রুতি নিয়ে। ভয়, অন্ধকার আর কান্না– সবই ছিল, তবু সেইসব পেরিয়ে বন্ধুত্ব ওদের শিখিয়েছিল হারিয়ে যাওয়া মানেই শেষ নয়, বরং নতুন করে মনে রাখার শুরু। গঙ্গার ঢেউয়ের শব্দে ওরা যেন শুনতে পেল এক মৃদু স্বর, “তোমরা আমার কথা ভুলে যেয়ো না…” আর ওরা জানত, ভুলবে না। নতুন ভোরের আলোয় বন্ধুরা একসাথে পা বাড়াল সামনের দিকে, পেছনে রেখে গেল সেই বাড়ির ফাটল ধরা দেয়াল আর নিঃশব্দ করিডর, তবু সঙ্গে নিল এক মেয়ের অদৃশ্য ছায়া, যার গল্প এখন শুধু তাদের নয়– নদীর, হাওয়ার আর নতুন ভোরের প্রতিশ্রুতির অংশ হয়ে গেল।
***