অরিত্র বসু
১
প্রাগের হিমেল সন্ধ্যায়, কার্ল ব্রিজের নীচে দাঁড়িয়ে এক তরুণী তার হাতের মোবাইলটা বন্ধ করে পকেটে ঢুকিয়ে দিল। তার নাম লায়লা সেন, কলকাতা থেকে ইউরোপে স্কলারশিপে পড়তে আসা, কিন্তু এখন সে আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নয়—সে একজন পালিয়ে বেড়ানো মানুষ, যার হাতে আছে এক রহস্যময় কোড, যা পুরো ইউরোপের সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলতে পারে। এই কোডটি তার কাছে এসেছে তার প্রাক্তন প্রেমিক মার্টিনের মাধ্যমে, যে ছিল এক হ্যাক্টিভিস্ট, NSA আর EU-র ডিজিটাল ফায়ারওয়ালের মাঝে লুকিয়ে থাকা এক ভূতের মতো অস্তিত্ব। লায়লার চোখে আজ সন্ধ্যার আলো যেন আরও ঘোলাটে, যেন বাতাসে মিলিয়ে আছে রক্ত আর বিশ্বাসঘাতকতার গন্ধ। চার দিন আগে মার্টিন খুন হয়েছে। ঠিক তার ফ্ল্যাটের সামনে থেকে। আর তার মরদেহের পাশে ছিল একমাত্র জিনিসটা—একটা ছোট্ট ইউএসবি ড্রাইভ, আর তার গায়ে লেখা ছিল: “To Laila. Only you can finish what I started.”
লায়লা বুঝতে পারেনি সে কেন এর মধ্যে জড়িয়ে পড়ল, কিন্তু এখন তার আর পেছনে ফেরার উপায় নেই। সেই ইউএসবি খুলতেই তার সামনে খুলে যায় এক এনক্রিপটেড ফোল্ডার—যার মধ্যে একেকটা ফাইল একেকটা দেশের গোপন ডেটাবেসে প্রবেশের জন্য ডিকোডিং স্ট্রাকচার। NSA, BND, Mossad, DGSE—সব। সেই সঙ্গে ছিল এক ফোল্ডার, নাম Confession, যার ভিতরে একটা ভিডিও—যেখানে মার্টিন বলেছে, “If you’re seeing this, I’m dead. And what I found… changes everything. Trust no one. Especially not the embassy.”
এই ভিডিও-বার্তার পর থেকেই লায়লার পেছনে লেগে আছে দুটো লোক—একজন চেক ইন্টেলিজেন্সের এজেন্ট, তার নাম টমাস ডব্রোভস্কি। আর অন্যজন, অজানা, মুখ ঢাকা হুডির তলায়। এই মুহূর্তে, কার্ল ব্রিজের নিচে সে ঠিক বুঝতে পারছে না কে তার কাছাকাছি চলে এসেছে। তার বাম পকেটে হাত রাখা, মোবাইলের রেকর্ড বাটন অন করা, আর ডান হাতে সে জ্যাকেটের ভিতরে ছোট ছুরি ধরে রেখেছে। ছায়াময় পথ ধরে কেউ একজন আসছে—ধীরপায়ে, যেন জানে তাকে কোথায় পাওয়া যাবে।
“লায়লা সেন?”—কঠিন গলা, কিন্তু ইংরেজিতে নয়, বাংলা। সে চমকে ওঠে। “তুমি কে?” প্রশ্ন করে সে। “তোমার কাছে যা আছে, সেটা আমাদের প্রাপ্য। মার্টিন যা করেছে, সেটা একা তোমার বোঝার কথা না।” লায়লা আর এক মুহূর্ত দেরি না করে ছুরিটা বের করে হাতের তালুর নিচে আড়াল করে রাখে। “আমাকে একটা কারণ দাও তোমার কথা বিশ্বাস করার।” ছায়াময় ব্যক্তিটা এবার মুখোশ খুলে ফেলে—না, মুখোশ না, এক টুকরো স্কার্ফ। উনি একজন বাঙালি পুরুষ, বয়স পঁইত্রিশের কাছাকাছি, চোখে তীক্ষ্ণতা আর ঠোঁটে ঠান্ডা ব্যঙ্গ। “আমি ইন্ডিয়ান কনস্যুলেট থেকে। নাম আমার অর্জুন বিশ্বাস। তোমার যা আছে, সেটা ভারতেরও নিরাপত্তা প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ। তুমি এখন শুধু নিজেকে না, গোটা উপমহাদেশকে বিপদের মুখে ফেলেছ।”
লায়লা কিছুটা ঘাবড়ে যায়, কিন্তু ভরসা করতে পারে না। “আমি কাউকে বিশ্বাস করি না,” সে কড়া গলায় বলে। “বিশ্বাস ঠিক করেছ। কারণ তোমার চারদিকে যে খেলা শুরু হয়েছে, সেখানে প্রতিটা খেলোয়াড়ের মুখে মুখোশ।” হঠাৎই দুজনের পাশের গলির মাথায় একটা ছায়া দৌঁড়ে পালায়। অর্জুন চিৎকার করে ওঠে, “স্নাইপার! নিচু হও!”
এক মুহূর্তেই কার্ল ব্রিজ কেঁপে ওঠে এক গুলির শব্দে। গুলিটা যায় ঠিক লায়লার মাথার পাশ দিয়ে। সে মাটিতে পড়ে যায়, অর্জুন টেনে তোলে তাকে। “তুমি আমাকে বিশ্বাস করো বা না করো, এখনই এখান থেকে পালাতে হবে। এক মুহূর্ত দেরি মানেই মৃত্যু।” তারা ছুটে ওঠে নদীর পাড় বরাবর, যেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছোট্ট নৌকা, ঠিক যেন কেউ তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। “কে ওদের পাঠিয়েছে?” চিৎকার করে লায়লা। অর্জুন উত্তর দেয় না। সে শুধু বলে, “আগে বেরোই। তারপর বলব।”
নৌকাটা ছাড়ে রাতের অন্ধকারে। দূরে, ব্রিজের মাথায় দাঁড়িয়ে এক ব্যক্তি মোবাইল কানে নিয়ে বলে—“Target escaped. They are heading to Vltava south. Prepare checkpoint.” অন্যদিকে, লায়লার বুকের ভিতর কেবল একটা শব্দ গুঞ্জন করে চলেছে—Confession।
২
ভলটাভা নদীর হিমশীতল জলে ভেসে চলেছে ছোট্ট নৌকাটা। লায়লা কাঁপছে, ঠাণ্ডায় নয়, আতঙ্কে। তার চোখে এখনো ঝাপসা হয়ে আছে কার্ল ব্রিজের পাশের সেই গুলির ঝলক। পাশে বসে আছে অর্জুন, তার চোখে সজাগ সতর্কতা। নৌকাচালকটি চেক, মুখে কথা নেই, শুধু চোখে ঘন জলের দিকেই তাকিয়ে আছে। চারপাশে শুধু নৌকার ছপ ছপ শব্দ, তার মাঝখানে কেউই কিছু বলছে না। একটানা দশ মিনিট কেটে যায়। এরপর নৌকাটা একটা ছোট পিয়ারে থামে, যা শহরের একটু বাইরের দিকে।
“আমরা কোথায় এলাম?”—লায়লা জিজ্ঞেস করে।
“একটা পরিত্যক্ত গ্লাস ফ্যাক্টরির পিছনে। এখানেই কিছুক্ষণ লুকিয়ে থাকতে হবে,” অর্জুন বলে, নৌকা থেকে লাফিয়ে নামতে নামতে।
চারদিকে ভাঙা কাঁচ, ধূলোমাখা ইটের স্তূপ, আর গাছের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সেই পরিত্যক্ত ভবন। ভিতরে ঢুকতেই দেখা যায় কয়েকটা পুরনো যন্ত্রপাতি পড়ে আছে, আর একটা ছোট কাঠের ঘরে অস্থায়ী ক্যাম্প সেটআপ করা হয়েছে। ভেতরে ঢুকে অর্জুন একটা ব্যাকপ্যাক থেকে বের করে দেয় কম্বল, কফি আর একটা ছোট মেডিকিট।
“তুমি আমার পরিচয়ে এখনও সন্দেহ করছ, বুঝতে পারছি,” অর্জুন বলে।
লায়লা চুপচাপ কফির কাপটা ধরে, তার গায়ে কাপকেকের ছাপ। এত ছোট একটা মুহূর্তেও অদ্ভুত মায়া লেগে থাকে।
“তুমি যদি সত্যি ভারতীয় কনস্যুলেটের এজেন্ট হও, তাহলে বলো—এই ফাইলটা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? কেন মার্টিনকে খুন করা হল?”
অর্জুন সোজা হয়ে বসে। তার চোখ দুটো শীতল। “কারণ ওই ফাইলে আছে প্রাগ-ভিত্তিক একটা ব্ল্যাক অপস প্রজেক্টের তথ্য—যেটা ইউরোপের একাধিক দেশের গোপনচরদের তথ্য ফাঁস করে দিতে পারে। প্রজেক্টটার নাম ‘The Confession’। এই প্রজেক্টের মাধ্যমে NSA এবং কিছু প্রাইভেট কনসালট্যান্সি মিলে এমন একটা কোড তৈরি করছিল, যা বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের প্রাইভেট লাইফ, দুর্নীতি, এমনকি ব্যক্তিগত চিকিৎসা রেকর্ড—সব একসঙ্গে এনক্রিপ্টেড ব্লকে ধরে রাখতে পারে। একটা সময়ে তা দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করা সম্ভব। মার্টিন এটা জেনে ফেলে, আর চুরি করে নিয়ে যায় ফাইলটা। ওর পরিকল্পনা ছিল এই ফাইলটা Whistleblower Network-এ দেওয়া, যাতে এটা পুঁজিবাদী ক্ষমতার হাত থেকে রক্ষা পায়। কিন্তু ওর আগে ওকে হত্যা করা হয়।”
লায়লার হাত কাঁপছে। “মানে এই ফাইলটা একটা ডিজিটাল বোমা?”
“ঠিক তাই। আর এখন সেটা তোমার হাতে। তুমি জানোও না তুমি কত বড় একটা খেলায় ঢুকে পড়েছ। এই ফাইলের খোঁজে এখন CIA, Mossad, MI6, এমনকি ভারতের RAW-ও পেছনে লেগে আছে। কারণ, এখানে শুধু আন্তর্জাতিক তথ্য নয়, ভারতেরও বহু স্পর্শকাতর ডেটা রয়েছে।”
“তুমি আমার কাছ থেকে এটা নিতে চাও?”
“না,” অর্জুন একটুখানি হাসে, “আমি চাই তুমি নিজেই ঠিক করো কোথায় এটা যাবে। কিন্তু তার আগে জানতে হবে, কে মার্টিনকে খুন করল। আর কে সেই Confession-এর মূল রচয়িতা।”
ঠিক তখনই একটা শব্দ হয় বাইরে। জানালার কাঁচে টক্করের মতো আওয়াজ। অর্জুন সঙ্গে সঙ্গে টর্চ নিভিয়ে দেয়। দুজনেই মাটিতে শুয়ে পড়ে। ছায়ার মতো কেউ একজন ঘরের বাইরে ঘোরাফেরা করছে। এক, দুই, তিন… তিনজন।
অর্জুন খুব ধীরে একটা সাইলেন্সার লাগানো পিস্তল বের করে। চোখে সিগনাল দেয়—‘চুপ’।
বাইরের লোকগুলো চেক ভাষায় কিছু বলছে, যেটা সম্ভবত রেডিও যোগাযোগ।
হঠাৎই একজনে ফিসফিস করে বলে—“Confirm visual. Target is here.”
লায়লার বুকের ভিতরটা যেন ধ্বংস হয়ে যায়। “ওরা জানে আমি এখানে?”
অর্জুন ফিসফিস করে, “তুমি মোবাইল অন রেখেছিলে?”
লায়লা মাথা নাাড়ে—“না! আমি ফ্লাইট মোডে রেখেছিলাম।”
“তাহলে কেউ ট্র্যাক করেছিল নৌকাটাকে।”
হঠাৎই বাইরের দরজায় গুলি চলে। জানালার কাঁচ ভাঙে। অর্জুন লাফিয়ে উঠে ঘরের পেছনের দেয়ালটা ঠেলে দেয়—একটা গোপন দরজা খুলে যায়।
“চল, এখনই বেরোতে হবে।”
তারা ছুটতে ছুটতে সেই সরু করিডোর পেরিয়ে ফ্যাক্টরির পেছন দিকে আসে। কিন্তু ঠিক তখনই সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে একজন—বেশি লম্বা নয়, মাথায় হুড, হাতে একটা বন্দুক। মুখ দেখা যায় না। সে বলে, “Hello, Laila. You don’t remember me, do you?”
লায়লা স্তব্ধ। গলা শুনেই সে জমে যায়। এই গলাটা সে চেনে।
“তুমি তো মারা গিয়েছিলে…!”
হুড খুলে পড়ে যায়। সেই লোকটি—মার্টিন!
৩
ফ্যাক্টরির পেছনের সরু গলিতে দাঁড়িয়ে ছিল মার্টিন, জীবন্ত, অথচ তার মুখে একটা অন্যরকম শূন্যতা। লায়লার মনে হচ্ছিল বুকের ভিতর কিছু একটা থেমে গেছে। সে কিছু বলতে পারছিল না, শুধু তাকিয়ে ছিল তার সেই প্রাক্তনের চোখে—যে চারদিন আগেই মৃত্যু হয়েছে বলেই বিশ্বাস করছিল সবাই। অর্জুন চুপচাপ তার পিস্তলের ট্রিগার স্পর্শ করে, মুখে কোনও শব্দ নেই। মার্টিন হাসে, সেই পুরোনো ঠোঁটটিপে হাসি, কিন্তু আজ তার চোখে কোনও উষ্ণতা নেই। “Don’t worry, Laila. I didn’t rise from the grave. I never died.”
লায়লা ফিসফিস করে, “তুমি… কিন্তু তোমার মরদেহ… পুলিশ… ভিডিও… সব ছিল—”
“Body ছিল, কিন্তু সেটা আমার না। গুলিটা আমি চালাইনি। বরং, ওরা চেয়েছিল আমি মরে যাই—তারপর ফাইলটা নিয়ে নিরাপদে চলে যায়। কিন্তু আমি জানতাম এই দিনটা আসবে, তাই একটা পলান পরিকল্পনা করেছিলাম।”
অর্জুন এবার গলা খাকে খেকে বলে, “তুমি কাকে বোঝাচ্ছো ‘ওরা’?”
মার্টিন তাকিয়ে থাকে তার দিকে। “EUROSEC Alliance। NSA, BND, Mi6, DGSE—সবচেয়ে শক্তিশালী সাইবার ইন্টেলিজেন্স ব্লক। ওরা প্রথম থেকেই চায় Confession ফাইলটা বাইরের জগতে না যায়। কারণ এটা শুধু তথ্য না, এটা প্রমাণ—কীভাবে রাষ্ট্রগুলো নিজেদের নাগরিকদের ব্যক্তিগত মুহূর্তগুলোকে ব্ল্যাকমেইলের অস্ত্রে পরিণত করেছে।”
লায়লার মাথায় যেন ঝড় বইছে। “তুমি তাহলে আমার কাছে ফাইলটা পাঠিয়েছিলে কেন? তুমি তো নিজেই বাঁচতে পারতে…”
মার্টিন হালকা হাসে, কিন্তু সেই হাসিতে আত্মবিশ্বাস কম, অপরাধবোধ বেশি। “Because I knew they would come for me. আমি জানতাম আমার সময় শেষ। আমি ভাবছিলাম যদি আমি না পারি, তুমিই পারো। তুমি বিশ্বাস করো স্বাধীনতায়, ন্যায়ে। আমি সব সময় বিশ্বাস করতাম তুমি একদিন সত্যিটা সামনে আনবে।”
অর্জুন এবার স্পষ্ট করে বলে, “তাহলে এখন আমাদের কী করতে হবে? তুমি বেঁচে আছো, ভালো কথা। কিন্তু এর মধ্যে লায়লা আছে বিপদের মুখে, আমি আছি পলাতক, আর পিছনে ওরা শিকারি কুকুরের মতো লেগে আছে।”
মার্টিন কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, “আমাদের যেতে হবে ‘Vyšehrad tunnels’-এ। শহরের নিচে এক প্রাচীন সুড়ঙ্গ ব্যবস্থা, যা Second World War-এর সময় ব্যবহার করা হত। ওখানে আমার একটা সাব-মডিউল আছে, যেটা দিয়ে ফাইলটা পুরোপুরি ডিক্রিপ্ট করা সম্ভব।”
“তাহলে আগেই ওখানে যাওনি কেন?”—জিজ্ঞেস করে অর্জুন।
“কারণ ওরা আমাকে ফলো করছিল। আমি জানতাম একবার ফাইলটা ওপেন হলে তার লোকেশন ট্রেস হবে। তাই চেয়েছিলাম তুমি, অর্থাৎ লায়লা, সেটা বহন করো। ওদের দৃষ্টি সরিয়ে রাখতে।”
লায়লার চোখে জল চলে আসে—রাগে না, হেরে যাওয়ার এক ধরণের বিষণ্নতায়। “তুমি আমাকে একটা পন করেছিলে। ভালোবাসা, বিশ্বাস… সব মিথ্যে ছিল?”
মার্টিন এবার কিছু না বলে মুখ ফিরিয়ে নেয়। “I didn’t lie about loving you, Laila. But in war, trust is the first casualty.”
ঠিক তখনই পেছন থেকে কাচ ভাঙার আওয়াজ আসে। গুলি না, কিন্তু পায়ের শব্দ। অর্জুন সঙ্গে সঙ্গে লাইট নিভিয়ে দেয়। “ওরা এখানে পৌঁছে গেছে। এখন আর কথার সময় নেই। চল।”
তারা তিনজন ছুটে যায় সেই পাথরের টানেলের দিকে। ভাঙা দেয়াল পেরিয়ে, কাঁচের ধ্বংসাবশেষ টপকে, তারা পৌঁছে যায় পুরোনো গ্যারেজের পেছনে একটা লোহার ঢাকনার কাছে। মার্টিন সেটার মুখ খুলতেই একটা সিঁড়ি দেখা যায়, যা নেমে গেছে শহরের গভীর বুকে।
“এই সুড়ঙ্গ Second World War-এ জার্মানরা বানিয়েছিল। এখন আর কেউ ব্যবহার করে না। কিন্তু আমি করেছি। এখানে আমি ‘mirror node’ তৈরি করেছি, একটা আলাদা সার্ভার, যেটা দুনিয়ার কোনও নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত নয়,” মার্টিন ব্যাখ্যা করে।
ভিতরে ঢুকে তারা দেখতে পায় একটা সিমেন্টের গুহার মতো ঘর, যার ভিতরে একটাই টেবিল, ল্যাপটপ, পাওয়ার ব্যাটারি, আর কয়েকটা হার্ডড্রাইভ। সব জিনিস মাটির নীচে, কিন্তু ঝকঝকে।
“Give me the USB,”—মার্টিন বলে।
লায়লা তাকে সন্দেহের চোখে দেখে। অর্জুনও মুখ শক্ত করে বলে, “Don’t try anything stupid.”
“আমি ফাইলটা ওপেন করব না। আমি শুধু ডিসকানেক্টেড সার্ভারে কপি করব, যাতে একটা ব্যাকআপ থাকে। এরপর আমি লায়লাকেই সিদ্ধান্ত নিতে দেব, ওটা কার কাছে যাবে—press, human rights orgs, বা UN।”
লায়লা ধীরে ধীরে পকেট থেকে USB ড্রাইভটা বের করে।
সেই মুহূর্তেই সুড়ঙ্গের দেয়ালে একটা কম্পন অনুভূত হয়। তিনজনেই থেমে যায়।
তারপর শব্দ—জলের নিচ দিয়ে আসছে বুটের ধাপ।
মার্টিন ফিসফিস করে, “Impossible. এটা কেউ জানে না…”
অর্জুন তখনই লাইট নিভিয়ে দেয়।
মার্টিন দ্রুত ল্যাপটপ খুলে ফাইল কপি করতে শুরু করে।
৮%… ১২%… ১৭%…
পেছনের সুড়ঙ্গে আলো পড়ে। লাল লেজার ডট ঘোরে দেয়ালে। কেউ একজন ফিসফিস করে বলে, “They’re here.”
লায়লার চোখে জল এসে পড়ে।
২৩%… ২৮%…
মার্টিন বলে, “আমাকে একটু সময় দাও। আর মাত্র মিনিট দুই।”
অর্জুন চিৎকার করে, “না! আমরা এখানে মরতে আসিনি।”
তখনই গুলি চলে। সুড়ঙ্গের ভিতরে প্রতিধ্বনি বাজে। দেয়ালে রক্তের ছিটে। কেউ একজন চিৎকার করে পড়ে যায়।
মার্টিন ফাইল ছেড়ে দিয়ে লায়লার দিকে একটা চিপ ছুঁড়ে দেয়—“Run!”
“তুমি…?”
“এখন তুমি সত্যিকারের লায়লা, যুদ্ধের ভিতর জন্ম নেওয়া মানুষ। Go!”
তারা ছুটে বেরিয়ে যায় সেই সুড়ঙ্গের অন্য মুখ দিয়ে। পেছনে পড়ে থাকে রক্তাক্ত টেবিল, অর্ধেক কপি হওয়া ফাইল, আর মার্টিনের ফিসফিস করা কণ্ঠ—“Confession… must live…”
৪
সুড়ঙ্গের বাইরে আসতেই ভোরের আলো কুয়াশার মধ্যে ধীরে ধীরে ভেসে উঠছে। প্রাগ শহর তখনও ঘুমে, কিন্তু লায়লা আর অর্জুনের জন্য ঘুম বলে কিছু নেই। তারা দৌড়ে একটা পরিত্যক্ত ট্রামের পিছনে এসে দাঁড়ায়, দম নিতে নিতে লায়লার চোখ দুটো জলময়। সে পেছনে তাকায় না। পেছনে আছে মার্টিন, বা যা বাকি আছে তার। অর্জুন তার কাঁধে হাত রাখে, কিন্তু কিছু বলে না। একধরণের নীরবতা এসে পড়ে তাদের মাঝে, যেন শহরের কুয়াশাও এই নীরবতাকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে।
“এই চিপটা…” লায়লা কাঁপা হাতে ছোট্ট মেমোরি কার্ডটা তুলে ধরে। “এটা কি শেষ কপি?”
“সম্ভবত,” অর্জুন জবাব দেয়। “আমাদের এটাকে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে হবে, যেখানে এটা নিরাপদ থাকবে—অন্তত যতক্ষণ না আমরা ঠিক করি কার হাতে এটা যাবে।”
ওরা দুজন আবার পথ ধরে, হেঁটে হেঁটে পৌঁছে যায় প্রাগের এক পুরনো জার্মান ক্যাফেতে—ক্যাফে নোভাক। অল্প আলো, কাঠের পুরোনো আসবাব, আর এক কোণে রাখা পিয়ানো। একটা বুথে গিয়ে বসে পড়ে তারা। ওয়েটার আসে না, কারণ এই ক্যাফে গত দুবছর ধরে বন্ধ। অর্জুন জানে, এটা ইউরোপীয় গুপ্তচরদের এক প্রাক্তন ‘dead drop’ জোন। সে নিজের পকেট থেকে একটা চাবি বের করে নিচের ফ্লোর বোর্ড খুলে ফেলে। সেখানে একটি ছোট্ট লকবক্স।
চিপটা সেখানে রাখার আগেই লায়লা বলে, “না। এটা আমাদের সাথে থাকতেই হবে।”
অর্জুন বিস্ময়ে তাকায়। “তুমি বুঝেছো এই চিপটার জন্য কে মরেছে?”
“হ্যাঁ। আমি দেখেছি। কিন্তু আমি মার্টিনকে শুধু একটা ভালোবাসা বলে জানতাম না, আমি জানতাম ও বিশ্বাস করে—আমার মধ্যে একটা শক্তি আছে যা ওর মধ্যে ছিল না। এখন আমি জানি কেন।”
অর্জুন মাথা হেলায়। “ঠিক আছে। তাহলে এই চিপটাকে এখন ‘shard encode’ করতে হবে—মানে এটা এমনভাবে সাজাতে হবে যেন কেউ একে চুরি করলেও ব্যবহার করতে না পারে। আমাদের ভাগ করে রাখতে হবে তথ্যটা।”
“তুমি কি এমন কাউকে চেনো যার ওপর ভরসা করা যায়?”
“একজন—অভি কুলকার্নি। MIT-trained cryptographer, এখন মাদ্রিদে থাকে। ওর কাছে একটা এনক্রিপশন ডিভাইস আছে যেটা কোয়ান্টাম ফ্র্যাকশনাল স্টোরেজ করতে পারে। কিন্তু ওকে শুধু আমিই চিনি। তুমি না।”
লায়লা সঙ্গে সঙ্গে বলে, “তাহলে একপথে যাবে তুমি, অন্যপথে আমি।”
“না, ওরা তোমার পেছনে বেশি। আমি চাই না তুমি একা যাও।”
ঠিক তখনই বাইরে একটা ভ্যানে বসে থাকা মানুষটা রেডিওতে বলে ওঠে—“Target reacquired. Female subject spotted near Náměstí Republiky. Send intercept.”
দুই ব্লক দূরে, তিনজন লোক স্যুট পরে ক্যাফের দিকে হাঁটছে। তাদের মধ্যে একজনের কানে ইন-ইয়ার কমিউনিকেশন, অন্যজনের হাতে ছোট্ট ডিভাইস—RF locator।
ক্যাফের ভিতরে অর্জুন হঠাৎ টেবিলের তলা থেকে একটা পোর্টেবল EMP ডিভাইস বের করে বলে, “ওরা আমাদের লোকেশন পেয়েছে। এখন এটা ছাড়া উপায় নেই।”
লায়লা চমকে যায়, “EMP মানে সবকিছু…?”
“সব। মোবাইল, রেডিও, ট্র্যাকার, ক্যামেরা… কিছুই কাজ করবে না। আমরা ৯০ সেকেন্ডে অদৃশ্য হয়ে যাব। এরপর আমাদের আলাদা হতে হবে।”
অর্জুন ডিভাইসটা অন করতেই ক্যাফেটা এক মুহূর্তের জন্য আলোতে ঝলসে ওঠে, তারপর পুরোপুরি অন্ধকার। বাইরের লোকেরা ভ্যানে বসে চিৎকার করে ওঠে—“Signal lost! We’ve lost all feeds!”
ভেতরে অর্জুন লায়লার হাতে একটা খাম ধরিয়ে দেয়—“এটা ইউরোপ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার রুট। তিনদিনের মধ্যে স্লোভেনিয়া হয়ে গিয়ে এই চিঠিটা দেখালে তুমিই চিপের একমাত্র হোল্ডার হিসেবে রেকগনাইজ হবে।”
“আর তুমি?”
“আমি মাদ্রিদে যাচ্ছি অভির কাছে। আমার কাছে চিপের একটি এনক্রিপ্টেড ক্লোন আছে—ফ্র্যাকশনাল। তুমি ওটা না আনলে তা কাজ করবে না। দুই টুকরো, দুই শহর, এক সত্যি।”
EMP-র পরে ৯০ সেকেন্ড। তারা আলাদা হয়ে যায়। লায়লা ক্যাফের পিছনের দরজা দিয়ে সরে পড়ে, আর অর্জুন অন্যদিকে গলির ভেতর ঢুকে যায়। কুয়াশার ভিতর তাদের মুখ আর দেখা যায় না।
একটা ফাস্ট ট্রেন ছুটে চলেছে প্রাগ থেকে ব্রনোর দিকে। লায়লা এখন এক সাধারণ বাঙালি পর্যটকের সাজে, কাঁধে ছোট ব্যাগ, চোখে সানগ্লাস। চিপটা গোপন করে রেখেছে ব্যাগের রিমের ভেতর, একটি টু-ওয়ে ছেঁড়া সেলাইয়ের ভিতরে। মাথার মধ্যে মার্টিনের শেষ কথা ঘুরে চলেছে—“Confession… must live.”
সে জানে, আগামী কয়েকদিন হবে এক যুদ্ধ—নিজের সঙ্গে, রাষ্ট্রের সঙ্গে, আর অতীতের সঙ্গে। কিন্তু সে জানে, এখন সে পালিয়ে বেড়ানো কেউ নয়। এখন সে একজন প্রত্যক্ষদর্শী, একজন বাহক, একজন পরিবর্তনের প্রতিনিধি।
ঠিক তখনই ট্রেনের জানালার পাশে বসা একজন প্রৌঢ় জার্মান ভদ্রলোক হঠাৎ বলে ওঠেন—“Miss Sen, you are braver than you think.”
লায়লা চমকে তাকায়।
“Do not worry. I am not here to harm you.”
“Then who are you?”
তিনি মৃদু হাসেন—“Someone who once believed in the system… and was betrayed.”
তিনি পকেট থেকে একটা ছোট কাগজ বের করেন। তাতে লেখা:
“Trust no embassy. Meet me in Graz. Midnight. The truth needs a witness.”
লায়লার হাত কেঁপে ওঠে। সামনে জানালার কাঁচে নিজের প্রতিবিম্বে সে দেখে এক অন্য লায়লা—একজন যে আর শুধু প্রেমিকা নয়, একজন যে হয়ে উঠেছে ইতিহাসের সাক্ষী।
৫
গ্রাৎস শহরের মাঝখানে, হাওয়ায় ঝুলে থাকা রাতের ঘ্রাণে মিশে আছে উৎকণ্ঠা আর অপেক্ষা। আল্পসের কোলে এই ছোট্ট অস্ট্রিয়ান শহর যেন চুপচাপ নিঃশব্দে কোনো ষড়যন্ত্র লুকিয়ে রাখে। রাত ঠিক বারোটা, এবং লায়লা সেন এখন দাঁড়িয়ে আছে কালেনবার্গের পাহাড়ঘেরা পাথুরে অলিতে, যেখানে রাস্তার বাতিগুলো কেমন যেন জ্বলছে-নেভার মতো। তার কাঁধে পুরোনো ব্যাগ, ভিতরে সেলাই করা চিপ, আর বুকের ভেতরে দাউ দাউ করে জ্বলছে প্রশ্ন—কে এই অচেনা প্রৌঢ়? কী জানে সে? কেন সে বলল, “The truth needs a witness”?
একটা পুরোনো ঘড়ির দোকানের সামনে থেমে সে মোবাইল বের করে সময় দেখে—১২:০২। চারপাশে কেউ নেই। ছায়ার মতো একটা বিড়াল রাস্তা পার হয়ে যায়। সেই মুহূর্তে, তার ডান দিকের অন্ধকার গলির ভিতর থেকে এক ধরণের টুকটাক আওয়াজ আসে—চাবি ঘোরার শব্দ, দরজা খোলার মতো। লায়লা ঘুরে তাকাতে দেখে সেই প্রৌঢ় লোকটি—কোর্ট পড়া, হাতে ছোট্ট চামড়ার ব্যাগ, আর চোখে সেই একই শীতল দৃষ্টি।
“Come,” তিনি বলেন। “We don’t have much time. Surveillance window resets at 00:20.”
লায়লা চুপচাপ তার পিছু নেয়। গলির ভিতরে একটা লোহার সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে তারা পৌঁছায় একটা বেসমেন্ট ঘরের সামনে। দরজা খোলার পর দেখা যায় ভিতরে ছোট একটা ঘর, দেয়ালে ম্যাপ, একটা সোলার প্যানেল চালিত কনসোল, আর এক কোণে রাখা পুরোনো প্রিন্টার। ভিতরে ঢুকেই লোকটা বলে, “My name is Friedrich Engel. I worked for Bundesnachrichtendienst—the German foreign intelligence—for twenty-three years.”
“আপনি তাহলে একজন স্পাই?”
“Former. Now I prefer to be a historian of hidden truths.”
তিনি হাত বাড়িয়ে বলেন, “May I see the chip?”
লায়লা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর ব্যাগের সেলাই থেকে আস্তে করে ছোট্ট কার্ডটা বের করে দেন। ফ্রিডরিখ সেটা নিয়ে একটা এয়ার-গ্যাপড ল্যাপটপে বসান। স্ক্রিনে একটা লোডিং বার, সঙ্গে লেখা: Shard Signature Detected. Awaiting Sync Key.
“তুমি যদি ভাবো, তুমি এখন নিরাপদ, তাহলে ভুল করছ। এই চিপ ফ্র্যাকশনাল এনক্রিপশন মডিউলে আটকে আছে, যেমন মার্টিন বলেছিল। তুমি একা এটা আনলক করতে পারবে না। তোমাকে অর্জুনের সাথে দেখা করতে হবে মাদ্রিদে। ওর কাছে আছে সিগনেচার ফ্র্যাগমেন্ট।”
লায়লা চমকে ওঠে—“আপনি কীভাবে জানেন অর্জুনের কথা?”
“Because I was the one who recruited him. He’s not just an attaché from Indian Consulate. He’s a RAW field operative—Special Cyber Ops unit. His mission was to track Martin and secure the file. Only he decided not to return it to Delhi.”
লায়লার মাথা ঘুরে যায়। অর্জুন? RAW? মিথ্যে… নাকি সত্য?
“তাহলে সে… আমার ওপর নজর রাখার জন্য…”
“At first, yes. But he broke protocol. He chose you. He disobeyed orders to save you.”
ফ্রিডরিখ এবার একটা ম্যাপ টেনে এনে বলেন, “Look, Laila. This file—it’s not just a threat to Europe. It contains covert data dumps about covert operations in Kashmir, Chinese cyber-infiltration in Indian banks, and even targeted surveillance on Indian journalists. If this comes out, it will burn everyone—Europe, India, Russia, the USA. No country wants that. They’ll kill for it. They already have.”
“তাহলে আমার কী করা উচিত?”
ফ্রিডরিখ একটু থেমে বলেন, “There are two choices. You go to Madrid, meet Arjun, combine the keys, and decide what truth the world deserves. Or… you destroy it. Bury it. Let history forget.”
লায়লা জানে তার জীবনের এই মুহূর্তটাই সত্যিকারের মোড়। চোখের সামনে পেছনের কয়েকদিন ভেসে ওঠে—মার্টিনের মৃত্যু, অর্জুনের বিশ্বাসঘাতকতা, ছায়ার মতো অনুসরণ, গুলি, পলায়ন। আর সেই ভিডিও—“Trust no embassy.”
তবু তার মনের মধ্যে একটাই জিনিস গুঞ্জন করে—“Confession must live.”
ঠিক তখনই সিকিউরিটি অ্যালার্ম বেজে ওঠে। স্ক্রিনে লাল আলো। ফ্রিডরিখ চিৎকার করেন—“Shit! We’ve been breached. Someone just pinged this location using directional RF.”
লায়লা জিজ্ঞেস করে, “How? This place is off-grid!”
“Someone local. Maybe Mossad, maybe BND itself. I warned too many people. They’re coming.”
ফ্রিডরিখ দ্রুত একটা ট্রাঙ্ক খুলে দুটো পাসপোর্ট, কিছু ইউরো, আর একটা ডেটা শার্ড পেনড্রাইভ বের করেন।
“Take this. Arjun’s signal triangulated from Madrid. He’s using codename ‘Karma Dev’. Go to Estación de Atocha. There’s a bookstore called ‘La Segunda Página.’ He’ll find you.”
“আপনি?”
“Too old to run. And anyway… I’ve seen too much.”
একটা বোমার মতো শব্দে দরজার বাইরে বিস্ফোরণ হয়। ধোঁয়া আর ধুলো ছড়িয়ে পড়ে বেসমেন্টে।
ফ্রিডরিখ লায়লাকে সিঁড়ির দিকে ঠেলে বলেন, “Now go! Run! And remember, only truth can survive the lie.”
লায়লা ছুটে ওঠে সিঁড়ি বেয়ে, কানে তখনও বাজছে ফ্রিডরিখের শেষ চিৎকার। রাস্তায় উঠে এসে সে দেখে দুটো কালো ভ্যান দূর থেকে ছুটে আসছে। পেছনে ছুটছে দুজন বন্দুকধারী। লায়লা কোনদিকে যাবে বুঝতে না পেরে একপাশে একটা ট্রামের পেছনে লাফিয়ে পড়ে। ভ্যানে থাকা লোকেরা রেডিওতে বলে—“She’s on the move. Graz southeast. Repeat—she has the shard.”
আরও একবার সে পালায়। কাঁধে ব্যথা, মনে আতঙ্ক, কিন্তু চোখে এখন স্থির বিশ্বাস—সত্যি যতটাই বিপজ্জনক হোক, তা ঢেকে রাখার থেকে অনেক বেশি বিপদ তার বিকৃতি।
মাদ্রিদের দিকে ছুটছে এখন এক উড়ন্ত ট্রেন, তার ভিতরে বয়ে চলেছে ইতিহাসের সবথেকে অন্ধকার ফাইলের শেষ বাঁচা। আর সেই ফাইলের প্রহরী এখন একজন ভারতীয় তরুণী, যার জীবন আর কোনও ভালোবাসার গল্প নয়—এ এক লড়াই, রাষ্ট্র বনাম সত্যের।
৬
মাদ্রিদের আকাশে তখন সোনালি আলো ছড়িয়ে পড়ছে, যেন শহরটা তার সমস্ত ধোঁয়াটে ছায়া মুছে ফেলে নতুন করে জেগে উঠছে। কিন্তু লায়লা সেনের চোখে সেই আলো কেবলই জ্বলন্ত—কারণ তার সামনে এখন সময় নেই, কেবল দৌড়, কেবল শ্বাস আর পালিয়ে বাঁচা। গ্রাৎস থেকে পালিয়ে এসে সে ট্রেন বদল করেছে দু’বার, রাত কাটিয়েছে একটা মহিলা শেল্টারে, চুল কেটে ফেলেছে, নিজের পরিচয় লুকিয়েছে, আর আজ—আজ সে এসেছে মাদ্রিদের এস্তাসিওন দে আতচা রেলস্টেশনের ঠিক বাইরে, যেখানে ফুলের বাজার আর কাচের গম্বুজের নিচে দাঁড়িয়ে সে তাকিয়ে আছে একটাই দোকানের দিকে—La Segunda Página।
এই ছোট বইয়ের দোকানটা সাদা দেয়ালের মধ্যে, কাঠের খোলা জানালা, এক কোণে অ্যান্টিক ঘড়ি, আর দরজার ঠিক উপর লেখা তিনটা শব্দ—Truth Lies Within।
লায়লা জানে, যদি অর্জুন এখানে থাকে, সে জানবে ও এসেছে।
দোকানের ভিতর ঢুকতেই তার মনে হয় যেন সময় থেমে গেছে। পুরোনো বইয়ের গন্ধ, একটা বাচ্চা মেয়ে কোণে বসে কমিক্স পড়ছে, আর কাউন্টারে বসে থাকা মহিলা তাকে দেখে বলে, “¿Busca algo especial, señorita?”
লায়লা জবাব দেয়, স্প্যানিশে নয়, ইংরেজিতে, “I’m looking for Karma Dev.”
মহিলার চোখ একবার কেঁপে ওঠে। তারপর সে বলে, “Please wait.”
কাউন্টারের নিচে একটা বোতাম টিপে, সে দরজার পাশের একটা পর্দা সরিয়ে দেয়। লায়লা ভেতরে ঢুকতেই দেখে ছোট্ট একটা গ্যালারি ঘর—দেয়ালে পিনআপ করা ছবি, ম্যাপ, আর এক কোণে রাখা সিসিটিভি মনিটর। সেই মনিটরের সামনে দাঁড়িয়ে অর্জুন—অথবা, তার আসল পরিচয়ে—কর্মা দেব।
“তুমি এসেছো,”—অর্জুন বলে, যেন তার গলায় ক্লান্তি, অপরাধবোধ, আর পুনর্জন্ম একসঙ্গে।
“তোমার পরিচয়টা একটু বেশিই পালটে গেল না?”—লায়লা কঠিন গলায় বলে।
অর্জুন এগিয়ে এসে টেবিলে রাখা একটা ফোল্ডার সামনে রাখে। “আমার সব কেস ফাইল, কোডনেম, অপারেশন প্ল্যান। সব সত্যি। আমি তোমাকে মিথ্যে বলেছিলাম, কিন্তু একটা জিনিস কখনও না—আমি তোমার পাশে ছিলাম, আছি, আর থাকব।”
“তুমি আমাকে ব্যবহার করেছো,”—লায়লার চোখে আগুন।
“না। শুরুতে হয়তো তাই ছিল। কিন্তু তুমি আমার নিয়ম বদলে দিয়েছো। আমি প্রথমবার কাউকে রক্ষা করতে চেয়েছি আদেশের বাইরে গিয়ে।”
লায়লা ফোল্ডারটা বন্ধ করে। “ফ্রিডরিখ মারা গেছে। তার আগে সে বলেছিল, এই চিপটা একসঙ্গে না আনলক করলে কিছুই হবে না। আর বলেছিল, তোমার কাছে আছে অন্যটা।”
অর্জুন টেবিলের নিচে থেকে একটা ছিপছিপে ডিভাইস তুলে দেয়। “এটা আমার shard। এবার দুটো মিলে একসঙ্গে ফাইলটা আনলক হবে। কিন্তু… আনলক করলেই সেটা ট্রেস করা যাবে। আমাদের সময় থাকবে সর্বোচ্চ ছ’মিনিট।”
“কিন্তু আমরা কি করব সেটা? পুরোটা ফাঁস করে দেব? সবাইকে?”
অর্জুন চুপ করে থাকে। তারপর বলে, “এই ফাইলে এমন কিছু আছে যা ভারত, ইউরোপ, আমেরিকা—সবাইকে কাঁপিয়ে দেবে। সাংবাদিকদের মারাও হয়েছে, অ্যাকটিভিস্টরা নিখোঁজ। এর মধ্যে এমন প্রমাণ আছে যে কেউ চাইলে যুদ্ধ বাঁধাতে পারে। তাই শুধু ফাঁস করাই সমাধান নয়। আমাদের বেছে নিতে হবে—কে পাবে এটা, আর কতটা পাবে।”
লায়লা একবার চিপটা হাতে নিয়ে তাকিয়ে থাকে। মার্টিন, ফ্রিডরিখ, সব হারানো মানুষের মুখ যেন ভেসে ওঠে। সে জানে, এখন আর সে সেই ছাত্রীটি নেই যে বই আর প্রেজেন্টেশনে ডুবে থাকত। এখন সে একজন সিদ্ধান্তগ্রহণকারী—একজন সাক্ষী।
“তাহলে আমরা করি,” সে বলে। “তবে এক শর্তে—তুমি আমায় প্রতিশ্রুতি দাও, যদি শেষ মুহূর্তে লাগে, তুমি আমাকে ছেড়ে দেবে। আমি যদি ফাঁসি খাই, তুমি পালাবে না। সামনে থাকবে।”
অর্জুন একটু থেমে বলে, “তোমার জন্য আমি শেষ পর্যন্ত দাঁড়াব। কিন্তু আশা করি, সেটা লাগবে না।”
তারা ডিভাইসদুটো কনসোলে ঢুকিয়ে দেয়। স্ক্রিনে ভেসে ওঠে একটি পাসফ্রেজ চাওয়া বক্স।
লায়লা কিবোর্ডে টাইপ করে—CONFESSION MUST LIVE
একটা কম্পন অনুভূত হয়। স্ক্রিনে খুলে যায় encrypted ফাইলের ভিতরকার তথ্য—ভিডিও ক্লিপ, অডিও রেকর্ড, এজেন্ট লিস্ট, মেডিকেল রিপোর্ট, বায়োমেট্রিক লগ।
একটা ক্লিপে দেখা যায় এক ভারতীয় মন্ত্রী একটি ইউরোপীয় সিক্রেট ডিল সাইন করছেন—ড্রোন সারভেইল্যান্সের নামে নাগরিকদের ডেটা বেচা হচ্ছে প্রাইভেট কোম্পানিকে।
অন্য একটি ভিডিওতে এক আন্তর্জাতিক সাংবাদিক, যে পরে আত্মহত্যা করেছিল বলে ঘোষিত হয়েছিল, মুখ খুলে বলছে—”If you see this, know that I did not die by choice. I found the file. They came for me.”
লায়লা ও অর্জুন চুপ করে তাকিয়ে থাকে।
ঠিক তখনই স্ক্রিনে টাইমার শুরু হয়—5:59… 5:58… 5:57…
অর্জুন বলে, “কোথায় পাঠাবো এটা? Wikileaks? The Guardian? Human Rights Watch?”
লায়লা বলে, “Split it. Not all to one. Truth should not be owned by one hand. Give it in fragments. Let the world piece it together.”
তারা কাজ শুরু করে—সিগন্যাল রিডাইরেক্ট করে, টর নেটওয়ার্ক ঘুরিয়ে, একেকটা ফাইল একেকটা সংস্থায় পাঠাতে শুরু করে।
3:45… 3:44… 3:43…
বাইরে স্যুট পরা একদল লোক দোকানের দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের মধ্যে একজন মোবাইলে বলে—”Package is inside. Lockdown initiated.”
2:00… 1:59…
ভিতরে অর্জুন আর লায়লা শেষ ক্লিপটা পাঠাচ্ছে—একটা মুখাবয়বহীন সরকারি রিপোর্ট, যার নিচে লেখা—
“India: Operation Lakshmanrekha—Unreported Surveillance Since 2012”
0:15… 0:14…
অর্জুন কনসোল খুলে ফেলে সব ডিভাইস ভেঙে ফেলে। লায়লা ব্যাগে চিপের খালি কেস ঢোকায়।
তারা দুজনে পরস্পরের দিকে তাকায়—জানে, সত্য এখন মুক্ত। কিন্তু তার মূল্য দিতে হবে।
দরজা ধীরে ধীরে খুলে যায়।
সামনে দাঁড়িয়ে এক গম্ভীর মুখের অফিসার।
তিনজনের চোখ একসময়ে মিলিত হয়।
৭
দরজা খুলতেই ভিতরে ঢোকে তিনজন—সুট-বুট পরা, নির্লিপ্ত চোখের মানুষ। মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা অফিসারটি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে, তার নাম হান্স গ্রেগর, EUROPOL-এর সাইবার ইন্টেলিজেন্স উইং-এর সেকেন্ড ইন কমান্ড, যার একমাত্র কাজ—বিশ্বের প্রতিটি “leak” শুরু হওয়ার আগেই তা স্তব্ধ করা। সে একবার অর্জুনের দিকে তাকিয়ে বলে, “Karma Dev, RAW always had a reputation for being unpredictable. I see now why.” তারপর তার চোখ পড়ে লায়লার দিকে। “And you must be the infamous Laila Sen. The girl who carried Europe’s greatest liability in her jacket seam.”
লায়লা কিছু বলে না। তার চোখে আতঙ্ক নেই, শুধু তীক্ষ্ণ এক ধরণের ক্লান্তি। সে জানে, এই মুহূর্ত থেকেই তাদের ভবিষ্যৎ একটা সম্পূর্ণ নতুন খেলার ভিতর ঢুকে পড়েছে—এখানে নৈতিকতা একটা টেবিল টপ আর সত্যের পেছনে ছুটছে লোকেরা যারা কেবল তা মুছে ফেলতে চায়।
“Where is the chip?” হান্স প্রশ্ন করে।
অর্জুন ঠান্ডা গলায় বলে, “Destroyed. The data’s already gone live. Fragments sent to over twenty nodes across the globe—journalists, lawyers, whistleblowers.”
হান্সের ঠোঁটে মৃদু এক হাসি খেলে যায়। “Then you already signed your death certificates.”
তার পাশের লোকেরা এগিয়ে আসে, বন্দুক টেনে। কিন্তু ঠিক সেই সময়, বাইরের রাস্তায় একটা হাই-ফ্রিকোয়েন্সি সাইরেন বেজে ওঠে। হান্স একটু চমকে ওঠে, রেডিওতে কিছু শুনে বলে—“What? Who breached the perimeter?”
দোকানের পিছনের দরজা তখন খুলে যায়। ঢুকে আসে দুজন—একজন মধ্যবয়সী মহিলা, ইউএন-এর Human Rights Council-এর ইন্টারভেনশন ইউনিটের স্পেন প্রতিনিধি—ডা. এলেনা ভার্গাস, আর তার সঙ্গে একজন ভারতীয় সাংবাদিক—রুশীল দত্ত, যিনি আগে NDTV-তে কাজ করতেন, এখন আন্তর্জাতিক সাংবাদিক ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত।
“Drop your weapons,” এলেনা দৃঢ় কণ্ঠে বলেন। “You’re standing on neutral diplomatic ground. La Segunda Página is under protection of the UN Interventions Protocol, Clause 4-A. Any hostile seizure of a political whistleblower within this perimeter is an international violation.”
হান্স দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “This is a leak case. Classified information. This girl has destabilized—”
রুশীল চিৎকার করে বলে, “She has exposed what your governments were doing behind citizens’ backs—surveilling, manipulating, selling biometric data to corporate lobbies. She has not destabilized anything. She has revealed your own rot.”
এই উত্তেজনাময় মুহূর্তে হঠাৎ লায়লার স্মৃতিতে ফিরে আসে সেই মুহূর্ত—প্রাগের ব্রিজের নীচে দাঁড়িয়ে থাকা একটা মেয়ে, যার হাতে ছিল কেবল একটি পেনড্রাইভ, আর বুকের মধ্যে ছিল একটা ভাঙা ভালোবাসা।
এখন সে এক নতুন স্তরে পৌঁছেছে—তার নাম এখন শুধু ইতিহাসের পাতায় নয়, নীতির পাতায়ও লেখা থাকবে।
অর্জুন পাশে দাঁড়িয়ে বলে, “We’re ready to surrender. But to the UN only. We demand a fair international hearing under whistleblower protection.”
হান্স একটু থেমে বলে, “You may think you’ve won. But truth is a slow weapon, and public memory is even slower.”
এলেনা এগিয়ে এসে বলেন, “And yet, history remembers the firestarter, not the extinguisher.”
তিনদিন পর। জেনেভা, UN Headquarters।
বিশ্বব্যাপী একটা অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে। The Confession Files—এই নামে একেকটা টুকরো তথ্য প্রতিদিন ফাঁস হচ্ছে বিভিন্ন দেশের পত্রিকায়, ওয়েব পোর্টালে। প্রতিদিন নতুন নতুন নাম উঠে আসছে, নয়া ষড়যন্ত্র, লুকনো লেনদেন, চুক্তির ছায়া। ইউরোপীয় পার্লামেন্টে প্রশ্ন উঠছে, আমেরিকায় সিনেট শুনানি ডাকা হয়েছে, ভারতে একাধিক সংবাদমাধ্যম তা প্রচার করছে, যদিও কিছু বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
লায়লা সেন এখন একটা ঘরের ভিতরে বসে, তার সামনে আইনজীবীরা, তার পাশে অর্জুন—আসল নাম এখনও গোপন।
একজন ইউএন প্রতিনিধি বলে, “Miss Sen, are you aware that by triggering this leak, you may have triggered diplomatic fallout across three continents?”
লায়লা চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে, “Yes. And I also know that silence would have meant complicity.”
“Do you have any regrets?”
সে উত্তর দেয়, “Only that I couldn’t save the ones who brought the truth to me.”
এই সাক্ষাৎকারের ফুটেজ বিশ্বজুড়ে ভাইরাল হয়—একজন মেয়ে, তার চোখে আঘাত, তবুও ভয় নেই। এক বিশাল দানবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, সে তার স্বাক্ষর রাখে ইতিহাসের গায়ে।
মার্চ মাসে, এক বছর পর।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের একটা ছোট্ট ক্যাফেতে একজন তরুণী চা খাচ্ছে, তার পাশে একজন ছদ্মবেশী ভদ্রলোক। কেউই জানে না তাদের পরিচয়। তারা নিজেদের পরিচয় বদলে ফেলেছে, দেশ ছেড়েছে, আবার ফিরে এসেছে অন্য নামে।
তবে একবার যখন অন্ধকার ছুঁয়ে যায় চোখ, তখন আলো ফিরে পাওয়াটাই সবচেয়ে বড় যুদ্ধ।
“এখন?” অর্জুন ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে।
“এখন আমরা লিখব। একটা নতুন গল্প। যেখানে রাষ্ট্র নয়, মানুষ কেন্দ্রে থাকবে,”—লায়লা বলে।
তার ঠোঁটে একটুকরো শান্তি। সেই শান্তি যেটা আসে, শাস্তি আর স্বাক্ষরের পরেও।
৮
দুই বছর পর, এক বসন্ত বিকেল। দক্ষিণ ফ্রান্সের পাহাড়ঘেরা ছোট্ট শহর লুবারোঁ। গোলাপি পাথরের দেয়ালে সূর্য ঢলে পড়েছে, বাতাসে ল্যাভেন্ডারের হালকা ঘ্রাণ। এক নির্জন কুটিরের ছাদে বসে একজন নারী, কানে ছোট্ট হেডসেট, সামনে খোলা ল্যাপটপ, আর তার স্ক্রিনে ভেসে উঠছে কিছু এনক্রিপ্টেড নোট—যেখানে লেখা আছে মানুষের নাম, স্থান, সময়, এবং কিছু অদৃশ্য সত্য। সে আর কেউ নয়—লায়লা সেন।
তার চুল আজ ছোট, মুখে চোখের চশমা, পরিচয় বদলে এখন সে “মাদাম লি”—একজন সাংবাদিক, যে গোপন ফ্যাক্টস যাচাই করে স্বাধীন গণমাধ্যমে পাঠান। তার কাজ এখন রাষ্ট্রের বিপরীতে নয়, রাষ্ট্রের অন্তর্গত মিথ্যাকে আলাদা করা।
তিন বছর আগে যে সত্যের আগুন সে জ্বালিয়ে ছিল, তা এখনও নিভে যায়নি। The Confession Files এখন এক বৈশ্বিক জার্নাল—যেখানে গোটা দুনিয়ার whistleblower-রা অনামিকা থেকে পরিচিত হয়, আর তথ্য নিয়ে আসে যা অন্যরা চাপা দিতে চায়।
আজও ঠিক তেমনই একদিন। তার হেডসেটে কথা বলে উঠল এক পরিচিত কণ্ঠ—অর্জুনের।
“মাদাম লি, আমাদের নতুন ইনফর্মেন্ট টার্কি থেকে রিপোর্ট পাঠিয়েছে। নাম—ডেনিজ হালিস। সে বলেছে, Syrian refugee camp-এ biometric data চুরি করে আমেরিকান কর্পোরেটদের বিক্রি করা হচ্ছে। প্রমাণ আছে। আমাদের এটা তুলতে হবে।”
লায়লা মাথা নাড়ে। “তুমি ওকে রুট করে দাও। আমি রাতের মধ্যে প্রতিবেদন লিখে ফেলব। আর স্ক্যান্ডিনেভিয়া নেটওয়ার্কে পোস্ট করব।”
অর্জুন চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর বলে, “তুমি জানো তো, লায়লা… এই জার্নালটা তৈরি হয়েছে এমন মানুষদের জন্য যারা জীবনে একবার হলেও সত্য বলেছিল। কিন্তু তাদের কেউ বিশ্বাস করেনি।”
“সত্য সব সময় চেঁচিয়ে কথা বলে না, অর্জুন,”—লায়লা হালকা হেসে বলে। “ওটা অপেক্ষা করে, একজনকে… শুধু একজনকে, যে সেটা শুনতে রাজি।”
ঠিক তখনই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হয়। সে জানালার দিকে তাকিয়ে দেখে, পাহাড়ের পথ বেয়ে উপরে উঠছে একটা কুরিয়ার বাইক। সে নিচে নেমে আসে, দরজা খুলতেই দেখতে পায় বাইকারটা একখানা মোটা খাম তার দিকে বাড়িয়ে দেয়।
প্রেরক: La Verité Foundation, Geneva
বিষয়: Invitation to International Whistleblower Summit, 2027
প্রাপক: Ms. Laila Sen
খামের ভিতর থেকে বের হয় একটি সোনালি ছাপা চিঠি—সুইজারল্যান্ডে UN-এর নতুন সভায় তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এবারের প্রতিপাদ্য: “Data as Freedom: Reimagining Democracy in the Age of Surveillance.”
চিঠির নিচে একটি বিশেষ লাইন লেখা—
“Some truths are not just revealed, they must be carried.”
সে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর উঠে যায় ছাদে, অর্জুনকে কল করে।
“আমি যেতে চাই,”—সে বলে।
“জানতাম বলবে,”—অর্জুনের কণ্ঠে হালকা হাসি। “আমরা এবার সামনে দাঁড়াব। মুখ দেখিয়ে বলব—হ্যাঁ, আমরাই ছিলাম। আমরাই বলেছিলাম, রাজ্য মিথ্যে বলছে।”
—
দুই সপ্তাহ পর। জেনেভার আন্তর্জাতিক সম্মেলনকেন্দ্র।
বিশ্বজুড়ে নানান সাংবাদিক, অ্যাকটিভিস্ট, আইনজীবী, আর তথ্যবিজ্ঞানীরা উপস্থিত। বিশাল পর্দায় ভেসে উঠেছে লায়লার ছবি—কার্ল ব্রিজের ছায়া থেকে শুরু করে মাদ্রিদের সেই কাফে পর্যন্ত তার যাত্রা।
মঞ্চে দাঁড়িয়ে লায়লা বলে—
“আমি শুধু একজন কেরানি ছিলাম। আমার প্রথম বিশ্বাসঘাতকতা শুরু হয়েছিল ভালোবাসা দিয়ে। দ্বিতীয়টা সত্য দিয়ে। তৃতীয়টা নিজের সঙ্গে। কিন্তু আমি বুঝেছি—যতবার একটা রাষ্ট্র মিথ্যে বলে, ঠিক ততবারই একজন মানুষ সত্যি বলার সাহস পায়। আজ আমি তাদের প্রতিনিধিত্ব করছি, যারা ভয় পায়, কিন্তু তবুও থেমে থাকে না।”
চারপাশে হাততালি পড়ে, ক্যামেরা ঝলসে ওঠে, কিন্তু তার মুখে নেই কোনও অহংকার—শুধু সেই একই শীতল, স্থির চাহনি।
অর্জুন তখন অডিটোরিয়ামের শেষ সারিতে দাঁড়িয়ে। তার চোখে ভিজে আসা আলো। কেউ তাকে আর কর্মা দেব নামে চিনে না। এখন সে শুধু সেই ছায়ামানব, যে একদিন ভালোবাসার মুখে দাঁড়িয়ে বলেছিল—“আমি তোমার পাশে থাকব।”
লায়লার বক্তৃতার শেষে, একজন তরুণ উঠে দাঁড়ায়, প্রশ্ন করে—“Miss Sen, are you afraid they’ll come for you again?”
সে একটু হাসে। “তারা তো এসেছিল, বারবার। কিন্তু আমি রয়ে গেছি। কারণ এখন আমার নাম শুধু লায়লা নয়—আমার নাম এখন প্রতিটি সেই মানুষ, যে জানে সত্যি কেমন ভারী, আর তবুও সেটা বয়ে নিয়ে চলে।”
—
ফেরার সময় বিমানবন্দরে, অর্জুন পাসপোর্ট চেকের লাইনে দাঁড়িয়ে। পেছন থেকে লায়লা এসে বলে, “এই প্রথম কোনও সম্মেলন শেষে আমার মনে হচ্ছে—আমরা একটু এগোলাম।”
অর্জুন ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, “এগোলাম ঠিকই, কিন্তু সামনে রাস্তাটা আরও খাড়াই।”
“তবু হাঁটতে হবে।”
“সত্যিই হাঁটতে হবে।”
আরো একবার দুজন দুদিকে চলে যায়, এক ছায়া আর এক আলো। কিন্তু জানে—তাদের ভবিষ্যতের ঠিকানা, একদিন আবার মিলে যাবে।
৯
শীতকাল এসে গেছে লুবারোঁ-র পাহাড়ে। সকালের কুয়াশায় আঙুল রাখলে জমে যায়, আর চুপচাপ পাতাঝরা গাছের ছায়ায় কেমন যেন গোপন গন্ধ—পুরনো স্মৃতির, অনুজ্জ্বল আলোয় লেখা প্রতিজ্ঞার। লায়লা আজ বসে আছে তার কুটিরের ভেতরে, সামনের কাচের জানালার ওপারে পাখির মতো উড়ে যাচ্ছে শাদা মেঘ। কিন্তু তার মন আজ অতীত থেকে বিচ্যুত নয়—বরং গভীরভাবে আটকে আছে একটি অদ্ভুত খবরের কণায়।
গতকাল রাতে সে যে মেইলটা পেয়েছিল, সেটা শুধুই একটা লাইন—
“The Ghost is back in Vienna.”
প্রেরক—অজানা। অ্যাকাউন্টটি ‘burner id’, যার উৎস ট্রেস করা অসম্ভব।
লায়লা প্রথমে ভেবেছিল এটা হয়তো আরেকটা গুজব। কিন্তু তারপর সে নিজের পুরোনো ইনফো-নেটওয়ার্ক থেকে ক্রস-চেক করে জানতে পারে, ভিয়েনার এক আর্কাইভ সেন্টারে সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে একজন ব্যক্তি—চেহারায় অদ্ভুতভাবে পরিচিত। হাইট, গেট, হাঁটার ছন্দ—সব মিলিয়ে যেন এক চেনা মুখ। কিন্তু সম্ভব নয়, কারণ সেই মুখ—মার্টিন—মারা গিয়েছিল চার বছর আগে, প্রাগের সেই সুড়ঙ্গের ভিতর।
তবু লায়লার শরীর জমে যায়, পায়ের নিচে মাটি যেন সরতে থাকে।
সেদিন সেই সুড়ঙ্গে শেষবার দেখা হয়েছিল তাদের। মার্টিন বলেছিল, “Confession must live.” তারপর শুধু গুলি, রক্ত, আর অন্ধকার। কিন্তু সেই শরীর… কি সেটা সত্যিই মার্টিনের ছিল? নাকি, সেই শেষ মুহূর্তেও ছিল আরেকটা চাল?
অর্জুনকে কল করে সে। কয়েক রিংয়ের পর অর্জুন বলে, “তুমি জানো আমি এখন দোহায়। কী হয়েছে?”
“মার্টিন ফিরেছে,”—লায়লা নিঃশ্বাস আটকে বলে।
দূরে কিছুক্ষণের নীরবতা। তারপর অর্জুন ফিসফিস করে, “Are you sure?”
“না, আমি শুধু বিশ্বাস করতে চাই না। কিন্তু যদি হয়? যদি সে বেঁচে থাকে? তাহলে পুরো খেলাটা আবার নতুন করে শুরু হবে। কারণ ফাইলটা তো শেষ হয়নি, অর্জুন। আমরা শুধু প্রথম স্তরটা খুলেছিলাম। মার্টিন বলেছিল, একাধিক লেয়ার আছে। তখন মনে হয়েছিল ওর প্যারানোয়া।”
“তুমি যেতে চাও ভিয়েনা?”—অর্জুনের গলা জোরালো।
“হ্যাঁ। একা। তুমি আসবে না।”
“লায়লা…”
“Please, অর্জুন। আমি জানি, তুমি বাঁচাতে পারবে। কিন্তু এবার আমি নিজেই দেখতে চাই, কে বেঁচে আছে, আর কে মিথ্যে বলেছিল।”
—
ভিয়েনা। সেই শহর, যার রাজপথ সোনার কারুকাজে মোড়ানো, কিন্তু ছায়াগুলো অতীতের মতোই ঠান্ডা। লায়লা এখন একটি বেসমেন্ট হোস্টেলে ওঠে, ছদ্মনামে। সে জানে ইউরোপে তার পা রাখার খবর কারও না জানলেও, মার্টিন যদি সত্যিই বেঁচে থাকে, তবে সে জানবেই। তাদের ইতিহাস এমনই।
সে পৌঁছে যায় সেই আর্কাইভ সেন্টারে। সেখানে যে ফাইলটা আছে, সেটার ফুটেজে দেখা যায়—একজন লোক, মুখ ঢাকা, কিন্তু হাঁটার ধরণ হুবহু এক, মাথা নিচু, পকেটে হাত, একটা নির্দিষ্ট দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে, ঠিক যেমন মার্টিন একসময় দাঁড়াত।
“এই দরজা কি মার্টিনের প্রাক্তন গবেষণা অফিস ছিল?”—লায়লা জিজ্ঞেস করে অফিস স্টাফকে।
“হ্যাঁ,” তারা জানায়, “তিন বছর ধরে বন্ধ। কিন্তু গত সপ্তাহে স্ক্যান করা হয়েছে অ্যাক্সেস কার্ডে—যেটা তো বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা!”
লায়লার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। সে বলে, “সিসিটিভি কপিটা আমাকে দিন। আর দরজার পাশের মেটাল ট্রে-টা খুলে দেখান।”
তারা ট্রে খুলতেই দেখা যায়, ভিতরে পড়ে আছে একটা ছোট্ট কাগজ, তাতে হাতের লেখা—
“Some ghosts never leave, Laila.”
এই লাইনটাই একসময় মার্টিন তার নোটবুকে লিখেছিল, যখন তারা প্রথম বের করেছিল NSA’র surveillance প্যাটার্ন।
এইবার আর ভুল নেই। সে বেঁচে আছে। অথবা, কেউ তার ছায়া হয়ে খেলছে।
—
হোস্টেলে ফিরে লায়লা চুপ করে বসে থাকে অনেকক্ষণ। জানে, এবার শুধু তথ্য নয়, অনুভবের প্রশ্ন। যদি মার্টিন সত্যিই বেঁচে থাকে, তবে কেন সে লুকিয়ে আছে? আর যদি না থাকে, তবে কে এই খেলাটা চালাচ্ছে তার নামে?
তখনই দরজার নিচ দিয়ে সরে আসে আরেকটা খাম। সে খুলে দেখে, তাতে একটা ছবির কপি—একটি ট্রেন স্টেশনের বেন্চে বসে থাকা একজন লোক, মুখ ঢাকা হুডিতে, পাশে একটা বই: La Segunda Página।
পেছনে লেখা—“Meet me in two nights. Same bridge. Same city. Come alone.”
কার্ল ব্রিজ। প্রাগ।
চক্র যেন আবার পূর্ণ হতে চলেছে।
লায়লা জানে, শেষটা এখনও আসেনি।
শেষের আগেও অনেক কিছু থাকে।
১০
প্রাগে আবার ফিরে এসেছে লায়লা সেন। চার বছর আগে যেখান থেকে শুরু হয়েছিল সবকিছু, ঠিক সেই শহরে—যেখানে কার্ল ব্রিজের নীচে এক সন্ধ্যায় সে প্রথমবার মৃত্যুর ঘ্রাণ পেয়েছিল, যেখানে একটি পেনড্রাইভ বদলে দিয়েছিল তার জীবন, ভালোবাসা, পরিচয়।
এবারও রাত। বাতাস ঠান্ডা, নদীর জলে কুয়াশা। কার্ল ব্রিজ এখনও সেই পুরোনো মতোই দাঁড়িয়ে—সময়ের ওপরে এক চুপ করে থাকা সাক্ষী।
লায়লা ধীরে ধীরে হেঁটে আসে ব্রিজের মাঝ বরাবর। তার মাথায় হুড, চোখে গভীর মনোযোগ। পাশের ছায়াগুলো দেখতে স্বাভাবিক, কিন্তু সে জানে কেউ না কেউ দেখছে তাকে। প্রতিটি মুহূর্ত এখানে শুধুই নাটকের প্রস্তুতি, এক প্রেক্ষাগৃহ যেখানে পর্দা নামার আগেই শুরু হয়ে যাবে শেষ খেলা।
হঠাৎ সে টের পায় পেছনে কারও নিঃশ্বাস। ঘুরে তাকায় না, শুধু বলে, “তুমি কি মার্টিন?”
কোনও উত্তর আসে না। ধীরে ধীরে পেছনের ছায়া তার পাশে এসে দাঁড়ায়। মুখ ঢাকা, চোখে শীতলতা। তারপর মুখোশ সরায়।
সত্যিই—মার্টিন।
চোখে খানিক কালি, চুল কিছুটা ছোট, কিন্তু মুখটা একইরকম। যেন সময় তাকে ছুঁয়েছে কিন্তু বদলাতে পারেনি।
“তুমি মরোনি,”—লায়লা ফিসফিস করে।
“প্রকাশ্যে না,”—মার্টিন হালকা হাসে। “আমরা যারা সিস্টেমের ভিতরে যুদ্ধ করি, তাদের মৃত্যু হয় বহুবার। আমি মরেছিলাম, আবার জেগেছিলাম। কারণ আমার শেষ কাজটা এখনও শেষ হয়নি।”
“তুমি আমাকে মিথ্যে বলেছিলে। আমাকে সামনে রেখে তুমি নিজের মৃত্যু সাজিয়েছিলে।”
“আমি জানতাম, তোমার ভেতরে যা আছে, সেটা আমার নেই। আমি সত্যটাকে শুধু দেখাতে পারি, কিন্তু তুমি সেটা বহন করো। তুমি সাহস করেছিলে।”
লায়লা চোখ সরিয়ে নেয়। “তুমি জানো আমি কী হারিয়েছি?”
“সবই জানি। কিন্তু তুমি যা পেয়েছ, সেটা গোটা প্রজন্মের ভবিষ্যৎ।”
“তুমি এখন ফিরে এসেছো কেন?”
“কারণ ফাইলটা শেষ হয়নি, লায়লা। প্রথম স্তরটা ছিল শুধু চাবি। দ্বিতীয় স্তরে আছে নাম—গভীর রাষ্ট্রের এমন সব চর, যারা এখনও সক্রিয়। এমন তথ্য যা সামনে এলে শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। সেই স্তরটা এখনও এনক্রিপ্টেড ছিল। এখন, শুধু তুমি আর আমি সেটা আনলক করতে পারি।”
“আবার?”—লায়লার গলায় বিষণ্ন হাসি।
“শেষবার,”—মার্টিন বলে। “এবার আর পালাবো না।”
“আমার বিশ্বাস নেই তোমার ওপর,”—সে ফিসফিস করে।
“আমারও নেই আমার ওপর,”—মার্টিন উত্তর দেয়। “তবে আমাদের সেই বিশ্বাসেই সব দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে আমরা কেউ নিখুঁত নই। কিন্তু তবুও চেষ্টা করি।”
তারা দুজনে ব্রিজ থেকে সরে যায়। হেঁটে যায় সেই পুরোনো ফ্যাক্টরির দিকে, যেখানে একদিন মারা গিয়েছিল একটা সম্পর্ক, শুরু হয়েছিল এক বিপ্লব।
ভিতরে ঢুকেই মার্টিন ব্যাগ থেকে বের করে দুইখানা চিপ—একটা তার, একটা লায়লার।
“এটা শেষ বার মেলানো হবে। ফাইলটা খুললেই সমস্ত নাম, অপারেশন কোড, আন্তর্জাতিক প্ল্যান সামনে আসবে। আর তখন আমাদের আর কোনও জায়গা থাকবে না পালানোর।”
“আমরা কেন করব এটা?”—লায়লা জিজ্ঞেস করে।
“কারণ যদি এটা না করি, তাহলে যারা আমাদের মতো সাহস করে, তারা একদিন আর সাহস করবে না।”
তারা চিপ দুটো স্লট-এ বসায়। স্ক্রিনে ভেসে ওঠে—
UNLOCKING FINAL LAYER: OPERATION ORPHEUS
PASSCODE REQUIRED: ENTER SIGNATURE
লায়লা টাইপ করে—The Ghost Still Lives
ক্লিক।
ফাইল খুলে যায়। পর্দায় ভেসে ওঠে শতাধিক নাম—বিশ্বজুড়ে সাংবাদিক হত্যার আদেশদাতা, NGO-র আড়ালে চালানো গোপন Surveillance Cell, এমনকি এমন কয়েকজন ভারতীয় আমলা যাদের নাম কখনও কারও কল্পনাতেও আসেনি।
ঠিক সেই মুহূর্তে, দেয়ালে বসানো সেন্সর বেজে ওঠে। দূর থেকে গাড়ির শব্দ।
মার্টিন চোখ বন্ধ করে বলে, “They’re here.”
“তুমি আবার পালাবে?”—লায়লা প্রশ্ন করে।
“না,”—মার্টিন ঠান্ডা গলায় বলে। “আজ নয়।”
সে পেনড্রাইভে ডেটা কপি করে, তারপর একটা ছোট্ট ড্রোনের মধ্যে বসিয়ে দেয়। ড্রোনটিকে জানালার বাইরে ছেড়ে দিয়ে বলে, “এটা পৌঁছাবে La Verité HQ-তে। সত্য এবার মুক্ত। আমরা না থাকলেও, ওটা থাকবে।”
বাইরে গাড়ি থামে।
লায়লা আর মার্টিন পরস্পরের দিকে তাকায়। কোনও কথা নয়, শুধু চোখের ভিতর পড়ে থাকা কিছু না বলা কথা।
দরজায় শব্দ হয়—“Laila Sen and Martin Gessner. Step out with your hands visible.”
মার্টিন বলে, “We walk out. Not as fugitives. But as witnesses.”
লায়লা মাথা হেলায়। “একসঙ্গে।”
তারা দরজা খুলে বাইরে আসে। আলো ঝলসে ওঠে, ক্যামেরা ক্লিক করে। দূর থেকে কেউ বলে, “We got them. But they already let the truth fly.”
তিন মাস পর।
এক আন্তর্জাতিক আদালতে চলেছে শুনানি। ফাঁস হওয়া ফাইল Operation Orpheus আজ পৃথিবীর বহু গোপন সত্যকে আলোর মুখ দেখিয়েছে। রাষ্ট্র স্তব্ধ, মানুষ জেগে উঠেছে।
লায়লা ও মার্টিন—দুজনেই বন্দি নয়, বরং নিরাপত্তা চুক্তির অধীনে স্বাক্ষ্য প্রদানকারী।
কর্মা দেব অর্থাৎ অর্জুন, প্রকাশ্যে আসেনি। সে এখনও ছায়ার ভেতর কাজ করছে—এই কাহিনির একমাত্র সাক্ষী হয়ে।
আর লায়লা?
সে এখন ‘The Confession Journal’-এর মুখ্য সম্পাদক। তার চোখে নেই অহংকার, কণ্ঠে নেই জোর—কেবল একটুখানি শান্তি, যা আসে যখন কেউ জানে, সে শেষ খেলাটা খেলেছে। আর বাঁচতে পেরেছে, কারণ সত্য শেষ পর্যন্ত মুক্ত হয়।
সমাপ্ত