Bangla - ভূতের গল্প

সন্ন্যাসিনীর কুটির

Spread the love

জয়ন্ত কুমার চক্রবর্তী


অধ্যায় ১: আগমনী ছায়া

অক্টোবরের শেষভাগ। পাহাড়ি হাওয়ার কাঁপন তখন নতুন করে জানান দিচ্ছিল আসন্ন শীতে পাহাড়ের নিঃসঙ্গতা কেমন হতে চলেছে। অনির্বাণ রায়, এক শহুরে গ্রাফিক ডিজাইনার, ছুটির ফাঁকে একা একাই বেরিয়েছিল উত্তরবঙ্গের দূরবর্তী একটি পাহাড়ি গ্রামে। লোকাল ট্রেনের স্টেশন থেকে তিন ঘণ্টা জিপে চড়েই যেতে হয় সেই গ্রামে, নাম দারগাঁও। এই জায়গাটি এখনও গুগল ম্যাপেও পুরোপুরি চিহ্নিত নয়, অথচ স্থানীয় ট্রেকার আর পুরনো লোককথা শুনতে ভালোবাসা মানুষের মধ্যে এটি একটি গোপন রত্নের মতো। তার সফরের উদ্দেশ্য ছিল প্রকৃতি দেখা, পাহাড়ি ধ্বংসাবশেষ ঘোরা আর একটু নির্জনতা খোঁজা। কিন্তু লজে পৌঁছনোর পর প্রথম সন্ধ্যাতেই এক বৃদ্ধা, ললিতা মল্লিক নামে, সতর্ক করে দিয়েছিলেন—“সন্ধ্যার পরে কুটিরপথে যেও না বাবা, ওখানে মা অনিমার ধ্যান ভাঙলে আর কেউ ফেরে না।” অনির্বাণ হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল কথাটা, গ্রামে এলেই এসব অলৌকিক লোককথা পাওয়া যায়। সে যুক্তিবাদী, আর্ট আর আলো-ছায়ার খেলায় বিশ্বাস করে, অশরীরী চেতনায় নয়। তবে ললিতাদির চোখের গভীর রঙে যে একটা নিঃশব্দ আশঙ্কা ছিল, তা আর অস্বীকার করতে পারেনি।

পরদিন সকালবেলা, পাহাড়ের ঝরনার পাশে বসে স্কেচ করছিল অনির্বাণ। রামু, স্থানীয় এক কিশোর, গাইড হিসেবে তার সঙ্গে ঘুরছিল। রামু তার কথায় কথায় বলছিল—“দাদা, আপনি বুঝতে পারছেন না। আমরা এই জায়গাটার পাশে খেলতাম না। কুটিরের ভেতরে কেউ ঢুকলে আর কেউ ফিরে আসে না। আমার মামা একবার গিয়েছিল বন্ধুরা মিলে, তারপর তিনজন নিখোঁজ, আর মামা এখন কথা বলতে পারে না ঠিক করে।” অনির্বাণ তার ক্যামেরা বের করে গাছের আড়ালে থাকা কুটিরের কিছু ছবি তুলল। বাঁধানো পাথরের গায়ে গাঢ় শ্যাওলার আস্তরণ, ভাঙা দরজা, আর ছাদের উপরে এক অদ্ভুত ঘন্টা—যা হাওয়ায় নড়ে না, অথচ মাঝে মাঝে নাকি বেজে ওঠে। দুপুরের দিকে সে একা এগিয়ে যায় সেই ধ্বংসাবশেষের দিকে। রামু মাঝপথে দাঁড়িয়ে পড়ে, ভয়ে। কুটিরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অনির্বাণ অনুভব করে যেন বাতাস থেমে গেছে, পাখির ডাক নেই, ঝরনার আওয়াজ যেন ঢেকে গেছে কোনো অদৃশ্য স্তব্ধতায়। কৌতূহল জাগে তার মধ্যে, ক্যামেরা হাতে ঢুকে পড়ে ভেতরে। ধূলায় ঢাকা পুরনো ধ্যানমঞ্চ, তার চারপাশে ছেঁড়া মাদুর, আর এক কোণে কিছু প্রাচীন ধূপদানি। হঠাৎই তার মনে হয়, এই জায়গাটা সে চেনে—কিন্তু কীভাবে? সামনে থাকা আয়নায় সে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে গিয়ে চমকে ওঠে—কারণ সেই ছায়ায় তার মুখের জায়গায় আরেকজনের মুখ! এক মাথা জটা, গেরুয়া বসন, কপালে ভস্মতিলক। সেই মুহূর্তে কুটিরজুড়ে এক দমকা ধূপের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে, আর যেন দূর থেকে এক নারীকণ্ঠ শোনায়—“তুমি আবার ফিরলে, গিরিশ…”

অভ্যস্ত কোনো স্বপ্নের মতই দ্রুত সবকিছু মিশে যেতে থাকে কালো ছায়ায়। অনির্বাণ আর বুঝতে পারে না, সে জেগে আছে না ঘুমোচ্ছে। কুটিরের দেয়ালের ছায়াগুলো যেন নড়ছে, আর তার দিকে এগিয়ে আসছে। দরজার দিকে দৌড়াতে গিয়ে সে খেয়াল করে দরজাটা আর খোলা নেই, পাথরের মতো ভারী হয়ে গেছে। দেয়ালের এক কোণায় সে দেখতে পায় সেই নারীকে—যার মুখ ঘোমটায় ঢাকা, বসে আছে ধ্যানমগ্ন হয়ে। তার পাশেই পড়ে আছে একটি পুরনো ঘণ্টা, আর মাটিতে লেখা কিছু সংস্কৃত মন্ত্র। সেই মন্ত্রের ভাষা সে বোঝে না, অথচ হৃদয়ের মধ্যে অদ্ভুতভাবে কিছু অর্থ উঁকি দেয়—যেন এক সময় সে নিজেই এই মন্ত্র উচ্চারণ করত। সময় যেন থেমে যায়। তখন বাইরে থেকে কারো কণ্ঠস্বর শোনা যায়, “অনির্বাণদা! আপনি আছেন? রামু এসেছি, ললিতা দিদিও এসেছেন!” কিন্তু তার গলা বের হয় না, হাতও নড়ে না। কুটিরের মধ্যে সে এক যাত্রায় ঢুকে পড়ে—যেখান থেকে ফিরে আসা মানে শুধু জীবিত ফেরা নয়, ফিরে আসা মানে নিজের আরেক রূপের মুখোমুখি হওয়া। সেই সন্ধ্যায় রামু আর ললিতা মল্লিক অনেক খোঁজ করেও অনির্বাণকে খুঁজে পায় না। তারা শুধু দেখে কুটিরের ঘন্টা আপনমনে বাজছে—যা বাতাসে নড়ার কথা নয়, কিন্তু আজ যেন কেউ ধ্যানভঙ্গ করেছে বলে সে আত্মা জেগে উঠেছে। পাহাড় তখন ধীরে ধীরে আঁধারে ডুবে যায়, আর এক অজানা গল্প আবার নতুন করে জন্ম নেয়।

অধ্যায় ২: পূর্বজন্মের প্রতিধ্বনি

পরদিন ভোরবেলা, কুয়াশার চাদরে মোড়া পাহাড়ের কোলে, দারগাঁওয়ের আশ্রমে এক অস্বস্তিকর নীরবতা ছড়িয়ে পড়ে। রামু রাতভর জেগে ছিল, আর ললিতা মল্লিক চোখ বন্ধ করে ধূপ জ্বালিয়ে বসে ছিলেন আশ্রমের প্রাচীন দেবমন্দিরে। আগুনের আগুনের লোহা লাল হয়ে ওঠে, ধূপের গন্ধে বাতাস ভারী, আর পাথরের মাটিতে আঁকা এক যজ্ঞচক্রের মাঝে বসে ললিতা বিড়বিড় করে জপছিলেন এক দুর্বোধ্য মন্ত্র। দীর্ঘদিন আগে তিনি এই গ্রামে সন্ন্যাসিনীর শিষ্যা ছিলেন—তখন তাঁর নাম ছিল অর্ণা। সন্ন্যাস গ্রহণের পর তিনি হয়ে উঠেছিলেন ললিতা মল্লিক। মা অনিমার মহাতপস্যার দিনগুলোর সাক্ষী ছিলেন তিনি। সেই অনিমা—যার ধ্যান একদিন ভঙ্গ হয়েছিল, আর যার অভিশাপ ছড়িয়ে পড়েছিল পাহাড়ের উপত্যকায়। সেই রাতে অনির্বাণের নিখোঁজ হওয়া যেন সেই পুরনো অভিশপ্ত ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। ভোর হতেই ললিতা একটি পুরনো পুঁথি বের করলেন, যার পাতায় অদ্ভুত ছায়া-মুদ্রা আর প্রতিসংহারের বিধি লেখা ছিল। তাতে লেখা ছিল—“যে নিজেই ভেঙেছিল ধ্যান, সেই পুনর্জন্মে ফিরে এসে পুনরায় বন্দী হবে, যতক্ষণ না আত্মা মুক্তি পায়।” তাঁর চোখ ছলছল করছিল—কারণ তিনি চিনে ফেলেছেন অনির্বাণের চোখের সেই চেনা দৃষ্টিকে। বহু বছর আগে, সেই তরুণ গিরিশানন্দই ছিল মা অনিমার প্রধান শিষ্য—যিনি প্রেম ও অহংকারের দোলাচলে পড়ে ভেঙে দিয়েছিলেন সেই চিরতপস্যার নীরবতা। তখন মা অনিমা তারই শাস্তি দিয়েছিলেন, ধ্যানের কুটিরে চিরতরে বন্দী করে।

ওদিকে, কুটিরের ভিতরে অনির্বাণ রায় আটকে পড়ে এক অদ্ভুত সময়চক্রে। তার চারপাশে যেন বাস্তব আর অবাস্তবের মাঝে কোনো রেখা নেই। কখনও সে দেখে নিজের আধুনিক রূপ আয়নায়—জিনস আর পুলওভারে মোড়া আধুনিক মুখ, আবার কখনও সেই মুখ গলে গিয়ে উঠে আসে একটি জটা-বাঁধা, কপালে তিলক-কাটা মুখ—যা তারই অন্য রূপ, তারই অন্য আত্মার ছায়া। কুটিরে আলো-আঁধারির খেলা চলছিল, আর মাঝেমাঝে দূর থেকে ঘণ্টার শব্দ ভেসে আসছিল। সেই ধ্যানমঞ্চে বসে থাকা সন্ন্যাসিনীর মুখ এখন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে—মা অনিমা। অনির্বাণ জানে না কীভাবে, কিন্তু তার মন বলছে—এই নারীর কাছে তার কোনো অপরাধ আছে, এক পাপ যাকে সে আজও বহন করে চলেছে। “গিরিশ… তুমিই ছিলে, তুমিই আবার এসেছ,” অনিমা বলে উঠল চোখ না খুলেই। “তুমি প্রেমের নামে আমাকে ভাঙতে চেয়েছিলে। ধ্যান, ব্রত—সবকিছুর মাঝে তুমি রেখে দিলে মানবিক আকাঙ্ক্ষা। আমি ভেবেছিলাম, আমি মুক্ত। কিন্তু তুমি আমায় বন্ধন দাও, আর সেই মুহূর্তে আমার সব সঞ্চিত শক্তি ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।” অনির্বাণ হাঁপাতে থাকে। তার মস্তিষ্কের ভেতর যেন দুই সময় একসঙ্গে কথা বলছে। “আমি তো… আমি তো সেই মানুষ নই,” সে বলার চেষ্টা করে, কিন্তু অনিমার কণ্ঠে আসে ধীর, অথচ ভারী আওয়াজ, “তুমি সেই মানুষ, পুনর্জন্ম তোমাকে ফিরিয়ে এনেছে—তুমি আমায় মুক্ত করবে না, ততক্ষণ এই কুটির তোমাকেও মুক্তি দেবে না।”

গভীর সেই মুহূর্তে, এক অপার্থিব আলো ছড়িয়ে পড়ে কুটিরের মেঝেতে। অনির্বাণ দেখতে পায় এক চক্র, যা তার চোখের সামনে ঘূর্ণি তৈরি করছে। সেই চক্রে সে দেখতে পায় বহু দৃশ্য—সে ও অনিমা এক পাহাড়ি পথে হাঁটছে, হেসে কথা বলছে, অথচ সে জানে, সন্ন্যাসে এই সব অনুচিত। সে তাকে এক সন্ধ্যায় ছুঁতে গিয়েছিল, আর সেদিনই ধ্যান ভেঙে গিয়েছিল। মা অনিমা তখন কেঁদে উঠেছিলেন, এক নিঃশব্দ ক্রোধে। সে মুহূর্তে স্বর্গীয় মন্ত্রপাঠ থেমে গিয়েছিল, আর পাহাড়ে শুরু হয়েছিল বজ্রপাত, ঝড়। সেই চক্রে আরও এক দৃশ্য—মা অনিমা তার শিষ্যদের সামনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করছেন—“এই পুরুষটি আমার আত্মশৃঙ্খলা ভেঙেছে। আমি নিজেই শাস্তি দেব। যেন ভবিষ্যতে এমন আর না ঘটে।” তারপর সে দণ্ড স্থাপন করেছিল—এক ধ্যানমণ্ডলের ভেতরে তাকে বন্দী করে রেখেছিল চক্রবুহ্যে, যতক্ষণ না আত্মা অনুতাপের আলোয় শুদ্ধ হয়। সেই পাপ যেন এখনই পুনরাবৃত্তি হয়েছে, কারণ এই পুনর্জন্মে গিরিশ হয়ে আবার এসেছে অনির্বাণ। আর তার মুক্তি একমাত্র সম্ভব হবে যদি সে নিজের মধ্যে সেই ঋণ স্বীকার করে নেয়, ক্ষমা চায়, এবং সত্যি সত্যি অনুতপ্ত হয়। তার গলা শুকিয়ে আসে, বুক ধকধক করে ওঠে। তারপর এক তীব্র আলো ঝলকে সে মাটিতে পড়ে যায়, অচেতন হয়ে। বাইরে তখন কুয়াশা একটু একটু করে সরে যাচ্ছে, আর আশ্রমের পথে ললিতা মল্লিক এগিয়ে আসছেন ধূপ ও পুঁথি হাতে। তিনি জানেন—এই কাহিনির দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হয়ে গেছে, এবং এখন সময় এসেছে সন্ন্যাসিনীর কুটিরে শেষবারের মতো প্রবেশ করার… সেই প্রবেশ, যা হয়তো কারও মুক্তি আর কারও চিরবন্ধন হয়ে উঠবে।

অধ্যায় ৩: যজ্ঞচক্রের প্রবেশপথ

পাহাড়ের ঢালে দিনের আলো সবে ছড়িয়ে পড়েছে। পাখিরা ডাকছে, গাছের পাতায় শিশির ঝরছে, অথচ সেই সৌন্দর্যের ভেতরেও আজ এক চাপা অস্থিরতা। ললিতা মল্লিক, আশ্রমের সবচেয়ে বয়স্ক সেবিকা, কপালে তিলক দিয়ে ধূপ হাতে পাথরের পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছিলেন সন্ন্যাসিনীর কুটিরের দিকে। তার মুখে স্তবধ মন্ত্র, গলায় ঝুলছিল এক পুরনো রুদ্রাক্ষ মালা, আর হাতে ধরা ছিল সেই পুঁথি—যা সাধারণ চোখে ধরা পড়ে না, যেটির নাম “অভিশপ্ত চক্রপাঠ”। পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল রামু, যাকে আশ্রমের অন্যরা আগলে রেখেছিল রাতভর। কিন্তু ছেলেটির চোখে ভয় আর কৌতূহলের অদ্ভুত সংমিশ্রণ। ললিতা জানেন, অনির্বাণ রায় এখন আর শুধুই একজন মানুষ নয়—সে এক আত্মা, এক ঋণ, এক অনুতপ্ত পুনর্জন্ম। আর এই শুদ্ধিকরণ, এই প্রতিসংহার ছাড়া কেউ সন্ন্যাসিনীর কুটির থেকে ফিরে আসতে পারে না। তিনি কুটিরের দরজার সামনে পৌঁছে মাথা নিচু করে ধূপ জ্বালান, মাটিতে বসে শুরু করেন যজ্ঞচক্রের পাঠ। ধ্যানমঞ্চের চারদিক ঘিরে আঁকা হয় মাটির উপরে পাঁচটি ত্রিকোণ, যার প্রতিটিতে রাখা হয় একটি করে বীজমন্ত্র, আর একটি পদ্মফুল। বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, ধূপের ঘ্রাণে কুটিরের বাইরের গাছপালাও যেন নিঃশ্বাস থামিয়ে শোনে সেই স্তব। তখনই হঠাৎ ঘন্টার শব্দ শোনা যায় ভিতর থেকে—যা স্পষ্ট, ভারী এবং অদৃশ্য কারও হাতেই নাড়ানো।

অভ্যন্তরে অনির্বাণ ধীরে ধীরে চেতনায় ফিরছিল। তার গা ভার হয়ে আসছে, চোখ খুললেই দেখছে চারপাশে লালাভ আলো, আর মাঝখানে ধ্যানরত মা অনিমা—ঘোমটার নিচে তার মুখ, কিন্তু চোখজোড়া খোলা আর সেই চোখে এক অনন্ত সময়ের রূঢ় শূন্যতা। সে বুঝতে পারে, এখান থেকে সে তখনই মুক্তি পাবে যদি সে নিজের ভুল শোধরায়। কিন্তু কীভাবে? অতীত তো ফিরে আসে না, আর বর্তমান ভুল শুধরানোর সুযোগ কি থাকে? হঠাৎই মা অনিমা কথা বলেন—“পাপের বোঝা আত্মায় লেখা থাকে। গিরিশ, আজ তুমি অনির্বাণ হয়েছ, তবু আত্মা সেই। তুমি আমার ধ্যান ভেঙেছিলে, আর আজও আবার ফিরে এসেছ ধ্যান ভাঙতে।” অনির্বাণ হালকা গলায় বলে—“আমি বিশ্বাস করতাম না পুনর্জন্মে, বিশ্বাস করতাম না আত্মার বোঝায়। কিন্তু আজ আমার সমস্ত যুক্তি ভেঙে গেছে। আমি শুধু চাই, এই চক্র থেকে মুক্তি।” অনিমা চোখ বন্ধ করে বলে—“মুক্তি আসে আত্মস্মরণে, আত্মদহনেই হয় প্রতিমুক্তি। তুমি যদি সত্যিই অনুতপ্ত হও, যদি পূর্বজন্মের স্মৃতিকে সম্মান করো, তবে একটাই পথ খোলা—তুমি আমার ধ্যানরক্ষায় নিজেকে উৎসর্গ করবে।” সেই মুহূর্তে মেঝেতে খচিত চক্রের কেন্দ্রবিন্দুতে আগুন জ্বলে ওঠে, আর অনির্বাণ দেখে এক ঝলক দৃশ্য—সে নিজেই ধ্যানমঞ্চে বসে আছে, আর অনিমা মুছে যাচ্ছেন কুয়াশায়। সে নিজেই কি হতে চলেছে সেই নতুন সন্ন্যাসী, যার ধ্যান আর কেউ ভাঙতে পারবে না?

ঠিক তখনই বাইরে থেকে ভেসে আসে ললিতা মল্লিকের মন্ত্রপাঠের আওয়াজ। সেই শব্দ যেন দেয়াল ভেদ করে ভিতরে পৌঁছে যায়, আর কুটিরের ভেতর আলো ধীরে ধীরে বদলে যায়। অনির্বাণ উঠে দাঁড়ায়, ধ্যানমঞ্চের চারপাশ ঘিরে থাকা মন্ত্রলিপি আর প্রতিচ্ছবি যেন তার পথ নির্দেশ করে। সে একপা এগিয়ে যায় আগুনের দিকে, হাত তুলে চোখ বন্ধ করে বলে—“আমি গ্রহণ করছি আমার পূর্বজন্মের পাপ, আমি চাই ধ্যানভঙ্গের বদলে এবার ধ্যানরক্ষক হই। যদি এই আত্মা তা মেনে নেয়, তবে আমি প্রস্তুত।” আচমকা চারপাশের দেয়ালে আঁকা প্রতিমূর্তি একে একে কেঁপে উঠে যেন তাকে আশীর্বাদ জানায়। মা অনিমা দাঁড়িয়ে পড়েন, চোখ দুটি ভরে ওঠে এক রহস্যময় প্রশান্তিতে। তিনি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসেন অনির্বাণের দিকে, তার কপালে ছোঁয়ান দুই আঙুল, আর বলেন—“আজ থেকে তুমি এই স্থানের রক্ষক, চক্রবন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে আবার বন্ধনে বাঁধা হলে।” ঠিক সেই সময় এক প্রচণ্ড আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, আর এক মুহূর্তে কুটিরের দরজা খুলে যায়। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ললিতা আর রামু বিস্মিত হয়ে দেখে, অনির্বাণ বেরিয়ে আসছে ধূপমাখা বাতাসে ঘেরা আলোয় মোড়া এক আশ্চর্য নীরবতায়। তার মুখ শান্ত, চোখে ঘুমঘুম ভাব, কিন্তু কপালে আঁকা এক নতুন তিলক। পাহাড় তখন যেন হালকা শ্বাস নেয়, কুয়াশা ধীরে ধীরে সরে যায়, আর “সন্ন্যাসিনীর কুটির” ফিরে পায় এক নতুন রাখাল, এক নতুন গল্পের শুরু।

অধ্যায় ৪: অরূপ সংলাপ

যে পাহাড় কাল পর্যন্ত রহস্য আর ভয়ের প্রতীক ছিল, সেদিন তার বাতাসে যেন এক অদ্ভুত ভারমুক্ত প্রশান্তি ভেসে বেড়াচ্ছিল। অনির্বাণ রায়, যার চোখে রাতের ঘোর এখনো পুরোপুরি মুছে যায়নি, চুপচাপ বসেছিল আশ্রমের পাথরের উঠোনে, মুখ তুলে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে। রামু দূর থেকে জল এনে দিয়েছিল, কিন্তু সে কিছু খায়নি, কিছু বলেওনি। ললিতা মল্লিক পাশে বসে ছিলেন, মুখে তীক্ষ্ণ নীরবতা আর ভেতরে চলছিল এক পুরোনো চেনা সময়ের প্রতিধ্বনি। তিনি জানতেন, যে যজ্ঞচক্রের মধ্য দিয়ে গিরিশানন্দ একদিন অনিমার ধ্যানভঙ্গ করেছিল, সেই চক্র আবার পূর্ণ হলো অনির্বাণের আত্মবোধে। কিন্তু প্রশ্ন ছিল—এই আত্মবোধ কি যথেষ্ট? অনির্বাণ ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে বলল, “আমি সেই মানুষ নই, কিন্তু সেই পাপ আমার ভেতরেই। আমি নিজেকে বাঁচাতে চাইনি, শুধু এই জায়গাটাকে আর তার আত্মাকে মুক্ত করতে চেয়েছিলাম।” ললিতা তখন তার হাত ধরে বললেন, “তোমার ভেতরের যে অপরাধবোধ, সেটাই তোমার পুণ্য। কিন্তু এখনো কিছু কাজ বাকি। ধ্যানের অভিশাপ শুধু একজনের পাপ থেকে নয়, সময়ের পাঁজর থেকে মুক্তি চাই। তোমাকে কুটিরে আরেকবার ফিরতে হবে। এবার শুধু নিজের মুক্তির জন্য নয়, তার জন্য, যিনি আজও নীরব ধূপের ঘ্রাণে বন্দী।”

সেই রাতে, অনির্বাণ আবার কুটিরে ফিরে আসে, একা, ধূপের ডালি হাতে। কুটির এখনো ঠান্ডা, কিন্তু সেই ঠান্ডায় আর নেই ভয়ের কাঁপুনি। তার বদলে যেন গভীর শোক, গভীর অপেক্ষা। সে ধ্যানমঞ্চের সামনে বসে পড়ে, ঠিক যেভাবে মা অনিমা বসতেন—কিন্তু এবার তার উদ্দেশ্য ছিল আলাদা। সে চোখ বন্ধ করে, মন্ত্র উচ্চারণ না করে, নিজের ভিতরের ভাষায় বলতে থাকে—“তুমি যদি আমাকে শাস্তি দিয়েছিলে, আমি তা স্বীকার করেছি। কিন্তু তুমি নিজেও তো বন্দী হয়ে আছ এই চক্রে, এই মাটিতে, এই অভিশাপে। আমি চাই তোমারও মুক্তি হোক। আমি জানি না কেমন করে, কিন্তু যদি আমার অন্তরের সত্যই তোমার ধ্যান ভেঙেছিল, তবে আজ আমার অন্তরের আত্মদানের মধ্য দিয়েই তোমার মুক্তি হোক।” এক মুহূর্তে কুটির জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ধূপের ঘন ঘ্রাণ। সামনে ধোঁয়ার ভেতর দাঁড়িয়ে যায় এক ছায়া—নীরব, স্থির, এবং স্নিগ্ধ। মা অনিমা এবার প্রথমবারের মতো মুখ খোলেন, কিন্তু শব্দ আসে না। তার ঠোঁট নড়ে, কিন্তু ভাষা একরকম অরূপ—যা শোনা যায় না, অনুভব করা যায়। সেই অনুভবে অনির্বাণ কেঁপে ওঠে—কারণ তিনি কিছু বলছেন না, শুধু দেখাচ্ছেন, এক সময়ের ছবি। সেই সন্ধ্যা, সেই চোখের জল, সেই মন্দিরের দেওয়ালে আঁকা প্রতিজ্ঞা, আর এক শিষ্যের অবাধ্যতা। অনির্বাণ এবার স্পষ্টভাবে দেখছে গিরিশানন্দ কীভাবে সেই নির্জনতাকে প্রশ্ন করেছিল ভালোবাসার নাম দিয়ে—আর সেই প্রশ্নই হয়ে উঠেছিল এক সন্ন্যাসিনীর শেষ মানবিক পাপ।

ছায়া আস্তে আস্তে এগিয়ে আসে। মা অনিমা হাত বাড়ান, আর অনির্বাণ তার হাত ধরে। স্পর্শ হয় না, কিন্তু হৃদয়ে প্রবল কম্পন ছড়িয়ে পড়ে—যেন শিকড়ের গভীর থেকে কিছু ছিঁড়ে যাচ্ছে। কুটিরের ছাদ দিয়ে এক ফালি চাঁদের আলো এসে পড়ে তাদের দুজনের ওপর। একসাথে, ধ্যানমঞ্চের উপর, তারা বসে পড়ে। অনির্বাণ জানে না কত সময় কেটে যায়—এক ঘন্টা, এক যুগ, না কি এক অনন্তকাল। হঠাৎই কুটিরের গায়ে গাঢ় ছায়া নেমে আসে, কিন্তু তাতে ভয় নেই—বরং শান্তি। ধূপ শেষ হয়ে আসে, অনির্বাণের হাতের মালা মাটিতে পড়ে যায়, আর সে বুঝতে পারে—কেউ যেন চলে গেল, চিরতরে। মা অনিমা উঠে দাঁড়ান না, ছায়ার মতো ধীরে ধীরে মিলিয়ে যান ধোঁয়ার ভেতর। তার মুখে একবারের জন্য দেখা যায় হাসি—অত্যন্ত কষ্টের, কিন্তু মুক্তির হাসি। কুটির তখন নিস্তব্ধ, আর সেই নির্জনতায় অনির্বাণ বোঝে, এই জায়গার ধ্যান সম্পূর্ণ হলো—এবার কেউ আর ধ্যানভঙ্গ করতে পারবে না, কারণ ধ্যান আর শাস্তি নয়, ধ্যান হয়ে উঠেছে ক্ষমার প্রতীক। সে উঠে দাঁড়ায়, ধুলো মুছে নেয় গায়ের থেকে, আর ধীরে ধীরে ফিরে আসে পাহাড়ের ঢালে। পেছনে একবারও তাকায় না, কারণ সে জানে—“সন্ন্যাসিনীর কুটির” এখন ইতিহাস নয়, মুক্ত আত্মার এক প্রাচীন মন্দির।

অধ্যায় ৫: মুক্তির সোপান

দ্বিতীয় দিনের সূর্যোদয় আসার আগেই দারগাঁওয়ের পাহাড়ে এক নতুন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। কুটিরের কাছ থেকে কিছু দূরেই একা দাঁড়িয়ে ছিল অনির্বাণ। তার চোখে অদ্ভুত শান্তি, তবে ভিতরে এক গভীর রহস্য এবং প্রশ্নবোধক উত্থান ছিল। কুটিরের অন্ধকার কোণে মা অনিমার উপস্থিতি ছিল কি না, সে নিজেও জানত না। এক সপ্তাহের ভেতরে তার পুরো জীবন বদলে গিয়েছিল, আর এখন যেন সে তার নিজস্ব অতীত এবং ভবিষ্যতের সাথে এক অদৃশ্য সেতু তৈরি করেছে। রামু, যে এখনও আতঙ্কিত ছিল, তাকে দেখে সেদিন অনির্বাণ হাসল। মনে মনে এক অদ্ভুত শান্তি লেগেছিল, যেমন কিছু অশুভ গোপনতা শেষ হয়ে গেছে। তবে সে জানত, কিছু ছায়া এখনও পাহাড়ের আড়ালে সেঁটে রয়েছে—যেগুলির মুছতে আরও অনেক সময় লাগবে।

ললিতা মল্লিক তার দিকে হাঁটছিলেন। আজ তার মুখে কিছুটা অদ্ভুততা ছিল, যেন কিছু ঘটনা তার মন থেকে অস্থিরতা নিয়ে চলে গিয়েছিল। অনির্বাণ জানত, আজকের এই সকাল তার জন্য একটি সংকেত নিয়ে এসেছে, এবং সেই সংকেতেই ললিতা তাকে টেনে নিয়ে যাবে এক নতুন পথে। ললিতা কাছে এসে বললেন, “আজ রাতের অন্ধকারে পাহাড়ের কোণে কিছু ঘটতে যাচ্ছে। তুমি এখনো প্রস্তুত নও, অনির্বাণ। তোমার যে মুক্তি হয়েছে, তা শুধু তোমার জন্য নয়—এটা এই স্থান, এই আশ্রমেরও মুক্তি। মা অনিমার শরণ নিলে, এ বার তোমাকে এই স্থানে আরও এক পবিত্র কাজ করতে হবে।” অনির্বাণ কিছু বুঝতে না পেরে বলল, “এটা কী হচ্ছে? আমি তো শুধু এই জায়গার শাস্তি ভোগ করেছিলাম।” ললিতা একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, “শাস্তি নয়, তবে তুমি যে একা, একান্ত নিজের জন্য মুক্তি চেয়েছিলে, সে ভুল ছিল। এখন, তোমাকে সেই শরণ দিতে হবে, যাদের সন্ন্যাসিনীর মতো বন্ধী অবস্থায় থাকা উচিত ছিল। তবেই শুদ্ধির প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হবে।”

ললিতার কথা শেষ হওয়ার পর, অনির্বাণের মনে কেমন এক চাপ চাপ অনুভব হচ্ছিল। সে ভাবছিল, মা অনিমা তাকে সত্যিই একা মুক্তি দিয়েছিলেন নাকি তাকে একটি দায়িত্বে বন্দী করেছেন, যাতে সে বেঁচে থাকতে পারে? এখন তাকে যে কাজের জন্য প্রস্তুত হতে হবে, তা কি তার কাছে আরও বড় এক পরীক্ষা হবে? সে জানত, সন্ন্যাসিনীর কুটিরের ধ্যানভঙ্গের পর, মা অনিমা এক আধ্যাত্মিক দিক থেকে নীরব হয়ে ছিলেন। তবে তার কুটিরে কিছু ছিল—এক নিরব অতীত, এক অমীমাংসিত দায়, যা কোনো এক সময় তাকে পূর্ণ করতে হবে। ললিতা তখন আবার কথা বলেন, “এখন তোমার প্রয়োজন সেই পথ অনুসরণ করা, যা এক সময় গিরিশানন্দ করেছিল। তোমাকে তার মত অতীতের পাতাগুলো উল্টে দেখতে হবে, কারণ এই স্থান, এই সময়, আর তোমার বর্তমান জীবন একে অপরের সাথে সম্পৃক্ত।”

রাতে, পাহাড়ের অন্ধকারে যখন পৃথিবী আরও গভীর হয়, ললিতা মল্লিক এবং অনির্বাণ রামুর সহায়তায় কুটিরের দিকে এগিয়ে যান। তাদের হাতের মধ্যে কিছু পবিত্র মালা ছিল, আর পাথরের পথে চলতে চলতে ললিতা বললেন, “আজ রাতেই সেই সময় আসবে, যখন সন্ন্যাসিনীর শরণার্থীদের মুক্তির পথ সঠিকভাবে খোলা হবে। তুমি যা দেখবে, তা তোমার অজানা অতীতকে স্পষ্ট করবে।” তারা কুটিরের কাছে এসে দাঁড়িয়ে, পাথরের ওপর এক পবিত্র অগ্নিপূজার ব্যবস্থা করেন। ধূপের তীব্র গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, আর কুয়াশার মধ্যে কেমন যেন এক অদ্ভুত আলো ফুটে ওঠে। অনির্বাণ বুঝতে পারে, আজ রাতের শেষ প্রহরেই তার দৃষ্টির সামনে কিছু এক ভয়ংকর সত্য উন্মোচিত হতে চলেছে, যা এক সময়ে সেই পাপী গিরিশানন্দেরও অজানা ছিল।

হঠাৎ, কুটিরের ভিতর থেকে কোনো এক অব্যাখ্যেয় শব্দ শোনা যায়। অনির্বাণ চমকে ওঠে, আর কুটিরের দরজা ধীরে ধীরে খুলে যায়। সেখানে কেবল একটা প্রাচীন পুরোনো দেহের ছায়া দেখা যায়, যার চোখে এক চিরস্থায়ী শূন্যতা। সে বুঝতে পারে, মা অনিমার আত্মা এখনো এখানে রয়েছে, এবং তাকে শেষবারের মতো শাস্তি বা মুক্তির পথ জানাতে আসছেন। তবু অনির্বাণ এক পা এগিয়ে যায়, এবং ধীরে ধীরে কুটিরের মধ্যে প্রবেশ করে।

কুটিরের ভেতর, মা অনিমার ছায়া তাকে এক চিরন্তন পথে পরিচালিত করে, যেখানে সত্যিই তার শেষ মুক্তি কিংবা বন্দী হওয়া নির্ভর করবে তার অন্তরের বিশ্বাসের ওপর।

অধ্যায় ৬: কুটিরের অন্তঃশব্দ

পাথরের মেঝেতে পা রাখতেই অনির্বাণ যেন অনুভব করল, কুটিরের ভিতরকার সময় আর বাইরের সময় এক নয়—যেন এই চারটি দেওয়ালের ভেতরে প্রবেশ করলেই সমস্ত কল্পনা, স্মৃতি, পাপ আর প্রার্থনা একসাথে ঘুরপাক খেতে থাকে। তার নিশ্বাস ভারী হয়ে উঠছিল, কানের পাশে কে যেন নিঃশব্দে কিছু ফিসফিস করছে—তবে কোনো শব্দ নেই, শুধু বাতাসের ভেতর এক অজানা মানে খেলা করে। চারদিকে ধূপের গন্ধ, কিন্তু তার ভেতরে ছিল তীব্র করুণার সুর, যেন অনন্তকাল ধরে কেউ কাঁদছে, আর কেউ অপেক্ষা করছে কোনও প্রতিশ্রুত মুক্তির। কুটিরের কেন্দ্রস্থলে সেই ধ্যানমঞ্চ—যেখানে একসময় মা অনিমা বসতেন, এবং বহু বছর পরে যেখানে বসে অনির্বাণ নিজের অন্তরের আগুনে শুদ্ধ হয়েছিল। এবার সেই মঞ্চের ঠিক সামনে, ধূলায় ঢাকা একটি পুরনো আয়না পড়ে ছিল, যার কাচে ফাটল আর ধুলো, তবু যেন কিছু প্রতিচ্ছবি গোপনে জমে আছে। অনির্বাণ সে আয়নার দিকে তাকাতেই তার হৃদস্পন্দন যেন থেমে যায়—কারণ সেখানে সে দেখতে পেল শুধুমাত্র নিজের প্রতিফলন নয়, দেখতে পেল আরও কয়েকটি মুখ… অচেনা, পুরনো, এবং অসমাপ্ত। এক কিশোরী—যার চোখ ভীত, এক বৃদ্ধ—যার মুখে প্রার্থনা, এবং আরও দু’একজন মুখ—যাদের গায়ে ছিল সন্ন্যাসের চিহ্ন। এরা কারা?

হঠাৎ মনে পড়ে যায় ললিতা মল্লিকের বলা কথা—“সন্ন্যাসিনীর অভিশাপ শুধু গিরিশানন্দের ওপর পড়েনি, পড়ে গিয়েছিল তাদের ওপরও যারা তার ধ্যান ভাঙার পেছনে ছিল—যারা আশ্রমের নিরবতা ভেঙেছিল, যারা স্পর্শ করেছিল সেই নিষিদ্ধ চক্র।” অনির্বাণ ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করে, মা অনিমার আত্মার মুক্তি পুরোপুরি হয়নি—কারণ যারা তার ধ্যানভঙ্গের পর নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল, তারা এই কুটিরেই রয়ে গেছে। এই কুটির এক আত্মিক কারাগার হয়ে উঠেছিল, যেখানে সময়ের বাইরে বন্দী আত্মারা অপেক্ষা করছিল একমাত্র সেই মানুষের জন্য, যে এই অভিশপ্ত কাহিনির উৎস ছিল। আয়নার সামনে বসে অনির্বাণ এবার চোখ বন্ধ করে বলে—“যারা এখানে রয়েছ, আমি তোমাদের কথা শুনতে এসেছি। আমি এসেছি তোমাদের মুক্তির পথ খুলতে। যদি আমার ভেতরে সামান্য পবিত্রতা থেকে থাকে, তবে তা তোমাদের হয়ে ব্যবহৃত হোক।” হঠাৎই কুটিরের ভেতর তাপমাত্রা কমে যায়, বাতাস কেঁপে ওঠে, এবং আয়নার কাচ ফাটতে ফাটতে এক মুহূর্তে ভেঙে পড়ে। আয়নার কাচের পেছনে, মাটি ফেটে উঠে তৈরি হয় এক রহস্যময় ঘূর্ণি—যেখানে ধোঁয়ার ভেতরে যেন সেই মুখগুলোর করুণ আর্তনাদ শোনা যায়।

এই সবকিছু দেখে অনির্বাণ এক মুহূর্তের জন্য থেমে যায় না, বরং সে হাঁটু গেড়ে বসে মাটিতে ছুঁয়ে রাখে নিজের কপাল। সেই মুহূর্তে তার মনে পড়ে যায়, সেই সময়ের কথা—যখন গিরিশানন্দ ও আরও কিছু শিষ্য গোপনে মা অনিমার ধ্যানস্থানে প্রবেশ করেছিল, হাস্য-বিদ্রুপে ধ্যান ভেঙে দিয়েছিল, আর তারপর ঘটেছিল সেই অলৌকিক প্রতিশোধ। যেসব শিষ্য তখন ঘৃণা আর ভয় নিয়ে পলায়ন করেছিল, তাদের আত্মাই হয়তো এখানে থেকে গিয়েছিল। “তোমরা বাঁচো,” অনির্বাণ ফিসফিস করে বলে, “তোমরা এবার যাও।” হঠাৎ সেই ঘূর্ণির ভেতর থেকে এক এক করে মুখগুলো মিলিয়ে যেতে থাকে, বাতাস ভারী হয়ে ওঠে ধূপের মত এক আত্মিক শূন্যতায়। মা অনিমার ছায়া আবার একবার ধ্যানমঞ্চের পাশে দেখা যায়, এবার তার চোখ বেয়ে পড়ে একফোঁটা জল—এক চিরদিনের শোক, নাকি এক অনন্ত কৃতজ্ঞতা—বুঝে ওঠা যায় না। অনির্বাণ বুঝতে পারে, সেই অভিশপ্ত সন্ধ্যার সমস্ত ছায়া আজ অন্ধকার থেকে আলোয় ফিরেছে।

বাইরে তখন ভোরের আলো ফোটে, আর কুটিরের পেছনের গাছপালায় পাখিরা ডানা ঝাপটায়। কুটিরের দরজা খুলে যায় আপনমনে, আর অনির্বাণ এক নিঃশ্বাসে বেরিয়ে আসে। ললিতা আর রামু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু এবার তারা এগিয়ে আসে—কোনো প্রশ্ন ছাড়াই তারা বুঝে যায়, কাজ শেষ। পাহাড়ের বুকে, বহু বছরের এক লোককাহিনি আজ পরিণতি পেল। “সন্ন্যাসিনীর কুটির” এবার আর ভয়ঙ্কর নয়, সে এক স্মৃতি, এক শিক্ষা, এবং এক আত্মার চিরতর মুক্তির নিঃশব্দ মন্দির।

অধ্যায় ৭: ছায়ার শেষ প্রদীপ

দারগাঁওয়ের আশেপাশের গ্রামগুলোতে কানাঘুষো শুরু হয়েছিল—”কুটির থেকে আর ঘণ্টার শব্দ শোনা যায় না,” “ধূপের গন্ধ আর ভেসে আসে না বাতাসে,” “নতুন সেই ছেলেটা কিছু একটা করেছে, যার পর থেকে রাতের ঘুম গভীর হয়েছে সবার।” কিন্তু অনির্বাণ রায় জানত, এই নিস্তব্ধতা কোনো অলৌকিক ঘটনার সমাপ্তি নয়, বরং তার শুরু। এক গভীর অভিশাপমুক্ত স্থান কেবল তখনই পবিত্র হয়, যখন সে নিজেই তার অতীতের ভার সরিয়ে ফেলতে পারে। সেই কুটির, যেটি একসময় মানুষের কৌতূহল আর ভয়কে একসাথে টানত, এখন তার প্রাচীরের গায়ে নতুন রোদ এসে পড়ে। অনির্বাণ দিনগুলো কাটাচ্ছিল ললিতা মল্লিকের সঙ্গে আশ্রমে, রামু কখনও কচুর লতি তুলত, কখনও পাহাড়ি পথ দেখিয়ে দিত পর্যটকদের। কিন্তু অনির্বাণ জানত, তার কাজ এখানেই শেষ হয়নি। কেননা প্রতি রাতে ঘুমের ঘোরে সে শুনতে পায় সেই পুরনো মন্ত্র, দেখতে পায় সেই জটা চুল, গেরুয়া বসন, আর মা অনিমার সেই করুণ চোখ—যা বলে যায়, “মুক্তি পাওয়ার পরও তোমার দায়িত্ব শেষ হয়নি।”

একদিন সকালে, আশ্রমের পুরনো পুঁথির ঘরে ললিতা ডেকে পাঠাল অনির্বাণকে। ঘরটা ঠান্ডা, ধূপ আর নীল ল্যাভেন্ডারের গন্ধে ভরা। এক কাঠের বাক্স থেকে তিনি বের করলেন একটি পুরনো তালপাতার পুঁথি, যার চারপাশ ছেঁড়া, কালি ফিকে, অথচ প্রতিটি পাতায় মুদ্রিত অদ্ভুত এক ভাষা—যা অনির্বাণ আগে কখনো দেখেনি। “এটাই সেই শাপবদ্ধ পাণ্ডুলিপি,” বললেন ললিতা, “যার প্রতিটি শব্দ আত্মাবন্ধনের চাবিকাঠি। মা অনিমা যখন ধ্যানরতা ছিলেন, এই পুঁথির মন্ত্রই তাঁকে স্থির করত। আর যেদিন ধ্যান ভাঙে, সেই পাণ্ডুলিপির মন্ত্র বিকৃত হয়ে যায়, ছড়িয়ে পড়ে অভিশাপের মতো।” অনির্বাণ পৃষ্ঠা উল্টে দেখে, আর তার মনে হয় সে ভাষাটা কোথাও শুনেছে। তার মনে পড়ে, আয়নার সামনে বসে থাকা সেই অদৃশ্য মুখগুলি যেন ঠিক এই মন্ত্রগুলোই বলছিল। “তাহলে আমি কেন বুঝতে পারছি এর মানে?” প্রশ্ন করতেই ললিতা উত্তর দেন, “কারণ তুমি শুধু অনির্বাণ নও, তুমি সেই গিরিশ, যে একসময় এই মন্ত্র নিজে উচ্চারণ করত। পুনর্জন্ম শুধু শরীর পাল্টায়, আত্মা নয়।” অনির্বাণ ধীরে ধীরে বুঝে নেয়—এই পুঁথির মাধ্যমে কিছু পুরনো আত্মাকে ফিরিয়ে আনা যায়, কিছু পাপকে পুনরায় পূর্ণতা দিয়ে সরিয়ে দেওয়া যায়।

তাই সেই রাতেই, পাহাড়ের মাথায় চন্দ্রালোকের তলায়, অনির্বাণ এক নতুন যজ্ঞ শুরু করে। চারদিকে রেখেছে ধূপ, পদ্মফুল, আর সেই পুঁথির পাতাগুলো, যেগুলো ললিতা নিজের হাতে পাথরের উপর সাজিয়ে দিয়েছে। বাতাস থমকে থাকে। রামু দূরে মশাল হাতে দাঁড়িয়ে, আর ললিতা মন্ত্র উচ্চারণ করছেন ধীর স্বরে। অনির্বাণ চোখ বন্ধ করে সেই পাণ্ডুলিপির প্রথম শ্লোক পড়তে থাকে—প্রতিটি শব্দ যেন তার হৃদয়ের গভীর থেকে বেরিয়ে আসে, যেন সেই ভাষা তার মজ্জাগত, যেন সেই ধ্বনি সে একসময়ই রচনা করেছিল। তখনই, কুটির থেকে ধোঁয়ার মতো কিছু একটার আবির্ভাব ঘটে। প্রথমে অস্পষ্ট, তারপর ধীরে ধীরে দেখা যায় কয়েকটি ছায়া—বিভিন্ন বয়স, বিভিন্ন মুখাবয়ব, কেউ কিশোর, কেউ বৃদ্ধ, কেউ তরুণী। তারা নিঃশব্দে এগিয়ে আসে যজ্ঞচক্রের দিকে। অনির্বাণ থামে না। তার কণ্ঠে চলে আসে শেষ স্তব, যার অর্থ—”তোমরা যারা অর্ধেক পাথরে আঁকা হয়ে রয়ে গিয়েছ, এবার সময় এসেছে ফিরে যাওয়ার, অথবা আসার—যেদিকে তোমাদের মুক্তি।” ছায়াগুলো থেমে দাঁড়ায় যজ্ঞের ত্রিভুজে, একে একে চোখ মেলে, আর এক এক করে হাওয়ার মতো মিলিয়ে যেতে থাকে। পেছনে পড়ে থাকে শুধু শূন্যতা, আর পুঁথির পাতায় একটি পাতাও আর নড়ে না—যেন সব কথা শেষ, সব বোঝাপড়া সম্পূর্ণ।

সেই রাতে অনির্বাণ ঘুমায় এক অনির্বচনীয় প্রশান্তির সঙ্গে। তার স্বপ্নে মা অনিমা আসেন না, কোনো ছায়াও নয়, কোনো অতীতও নয়। শুধু ভোরের আগে সে অনুভব করে—তার হৃদয়ে যেন কেউ একটি প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়ে গেল, একটি দিশা, একটি নতুন পথ। কারণ সে জানত—সন্ন্যাসিনীর কুটির শুধু তার গল্প নয়, এটি তাদের গল্প যারা অধরাকে স্পর্শ করে আবার ধরণীতে ফেরে, বোঝার জন্য যে প্রকৃতি, আত্মা আর পাপ কখনো কোনো একক মানুষের সম্পত্তি নয়—সব কিছুই সময়ের হাতে বাঁধা, আর সেই সময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা মানেই পরম সত্যের দিকে পা বাড়ানো।

অধ্যায় ৮: প্রস্থান ও প্রতিশ্রুতি

সকালের প্রথম রোদ এসে পড়েছিল আশ্রমের ছাদে, পাহাড়ের মাথা তখনো কুয়াশার চাদরে মোড়া। পাখিরা ডেকে উঠছিল, পাতার ফাঁকে ফাঁকে আলো সরে যাচ্ছিল ধীরে। কিন্তু অনির্বাণ রায়ের মনে ছিল গভীর স্থিরতা—এক দীর্ঘ সাধনার পর যেন সে পৌঁছেছে এমন এক সীমান্তে, যেখানে আর কোনো প্রশ্ন নেই, নেই কোনো ভয়, কেবল আছে এক কণ্ঠহীন দায়িত্বের ধ্বনি। আশ্রম এখন আর আগের মতো নিষিদ্ধ নৈঃশব্দ্যের অধিকারী নয়, বরং তার বুক জুড়ে পাতা খোলে নতুন শ্বাসের মতো। কুটিরের দরজা এখন খোলা, সেখানে কেউ ধ্যানস্থ নেই, নেই কোনো ছায়া, নেই আতঙ্কের গন্ধ। সেখানে শুধু রয়ে গেছে কিছু ধূলিধূসর পুঁথি, কিছু বীজমন্ত্র, আর একটি ছায়াহীন স্পন্দন—যা বলে যায়, এক প্রাচীন সময় শেষ হয়েছে।

ললিতা মল্লিক সেই সকালের ভেতরেই অনির্বাণকে বললেন, “তুমি এবার যেতে পারো। কুটির এখন আর তোমাকে আটকে রাখবে না। মা অনিমা চলে গেছেন।” অনির্বাণ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “কিন্তু কুটির কি শুধুই পাথরের চার দেওয়াল? যদি আমি চলে যাই, তবে এই জায়গার স্মৃতি, তার ছায়া কি আমায় অনুসরণ করবে না?” ললিতা হাসলেন। “স্মৃতি তোমার ভেতরে থাকবে, কিন্তু ভয় নয়। তুমি শিখেছ কীভাবে ভয়কে বুঝতে হয়, আর তাতেই তোমার মুক্তি। অনেকে পাহাড়ে এসে সন্ন্যাস খোঁজে, তুমি এসে খুঁজে পেলে আত্মসত্য।” রামু এসে দাঁড়ায়, হাতে এক থলে, তার চোখে শিশুর মতো মুগ্ধতা। সে বলে, “দাদাভাই, আপনি কি আবার আসবেন?” অনির্বাণ তার মাথায় হাত রেখে বলে, “এই পাহাড় ডাকে—যখন ডাকে, আমি ফিরব। তবে এবার আমি আসব অতিথি হয়ে, পাপী নয়।” তিনজনে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিল কুটিরের বাইরে, পাহাড়ের কোলের বাতাস যেন তাদের শিরায় নতুন রক্ত প্রবাহিত করছিল। কিছু জায়গা শুধু গন্তব্য নয়, সেগুলো হয়ে ওঠে প্রেতকালীন দর্পণ—যেখানে দাঁড়িয়ে মানুষ নিজেকে দেখে নতুন চোখে।

অনির্বাণ পাহাড় থেকে নেমে যায় এক শঙ্খমুখ ভোরে। পেছনে রয়ে যায় ধূপের ঘ্রাণ, কিছু অলিখিত শ্লোক, আর ছড়িয়ে পড়া সেই বিশ্বাস—যে ভালোবাসা যদি পরিণত না-ও হয়, তার আত্মিক উপস্থিতিও এক দহন হয়, এক দীক্ষা হয়। কোলকাতার ট্রেন ধরে ফিরে যাওয়ার সময় তার পাশে বসে এক বৃদ্ধ যাত্রী জিজ্ঞেস করেন, “আপনি কোথা থেকে আসছেন?” অনির্বাণ শুধু মৃদু হেসে বলেন, “এক পাহাড়ি আশ্রম থেকে।” বৃদ্ধ আরেকটু আগ্রহ নিয়ে বলেন, “সেই কুটিরের কথা শুনেছি—যেখানে এক সন্ন্যাসিনী ধ্যানভঙ্গের পর অভিশাপ দিয়েছিলেন?” অনির্বাণ জানালেন না তিনি সেই কাহিনির কতটা অংশের সাক্ষী। তিনি শুধু জানালেন, “হ্যাঁ, শুনেছি। তবে এখন কুটিরে কেউ নেই। আর যারা ছিল, তারা মুক্ত।” ট্রেন জানালার ধারে বসে, যখন পাহাড় ক্রমশ ক্ষীণ হতে থাকে দূরত্বে, অনির্বাণ চোখ বন্ধ করে শেষবারের মতো শোনে এক প্রতিধ্বনি—এক মন্ত্র, যা আর অভিশাপ নয়, এক প্রতিশ্রুতি, যা বলে যায়—

“যে ধ্যান ভেঙেছিল, সে-ই আবার রক্ষা করুক ধ্যান। যে পাপ করেছিল, সে-ই হয়ে উঠুক পথের দীপ্তি।”

এবং সেই দীপ্তিতেই, “সন্ন্যাসিনীর কুটির” হয়ে ওঠে শুধুই একটি লোককথা নয়—এক আধ্যাত্মিক বিবরণ, যা অতীত ও বর্তমানের মাঝে পুল গড়ে দেয়… এক জীবনের থেকে অন্য জীবনে।

[সমাপ্ত]

1000034311.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *