Bangla - প্রেমের গল্প

অচেনা ছায়ার মতো

Spread the love

ঋতুপর্ণা দে


হেমন্তের সেই বিকেল

কিছু সম্পর্কের শুরুটা যেন ঠিক সময়ের ধার ধারে না, ঠিক বয়সের গণ্ডিও মানে না। তার একটাও নিয়ম জানত না অর্ণব। সে শুধু জানত, একটা নারীকে সে প্রথম দেখাতে কেন যেন চিনে ফেলেছিল। কলেজে নতুন ভর্তি হয়েছে তখন, প্রথম সেমিস্টারের ক্লাস, তার প্রিয় বিষয় — ইংরেজি সাহিত্য। লম্বা করিডোর পেরিয়ে যখন সে ক্লাসরুমের সামনে পৌঁছেছিল, তখনও জানত না, ভিতরের ওই একটা মুখ তার জীবনের অনেক হিসেব উলটে দেবে।

সে ক্লাসে ঢুকেই দেখে, এক মহিলা, খুব স্বাভাবিক অথচ তীব্র চোখে তাকিয়ে আছে ক্লাসের প্রতিটি ছাত্রের দিকে। চুলে হালকা পাক ধরা, কিন্তু তাতে কোনো রকম বয়সের ক্লান্তি নেই—বরং এক অদ্ভুত ভার। মুখে মৃদু হাসি, কিন্তু চোখে যেন শতাব্দী ধরে জমে থাকা কিছু না বলা প্রশ্ন।

“Good morning. I’m Meera Sen. I’ll be taking your Romantic Poetry course,” মহিলা বললেন। ক্লাসে একটা হালকা শোরগোল উঠল—তার চেহারা বা পরিচয়ের জন্য নয়, বরং তার বলার ভঙ্গি, তার উচ্চারণে একটা অদ্ভুত ভার ছিল, যেন সে এই কবিতাগুলো নিজে বেঁচে এসেছে একবার।

অর্ণব ঠিক তখনই বুঝেছিল—এই নারীকে নিয়ে কোনো এক অদৃশ্য সময় তাকে ভাবতেই হবে।

মীরা সেন, বয়স প্রায় চল্লিশ। কলেজে পড়ান বছর ছয়েক। বিয়ে হয়নি, সম্পর্ক হয়েছিল দু-একটা—কিন্তু এগোয়নি কিছুই। সে আসলে কাউকে তার ভিতরের ক্যানভাসে আঁকতেই পারেনি। হয়তো সে নিজেই জানত না, ঠিক কী রং সে খুঁজছে। কিন্তু অর্ণব… ছেলেটার চোখে কিছু ছিল। বয়সে অন্তত পনেরো বছরের ফারাক, তবু যখনই সে তাকাত, মনে হত যেন দুটো সময়—একটা ফেলে আসা অতীত আর একটা আসন্ন ভবিষ্যৎ—একসঙ্গে মিশে যাচ্ছে।

শুরুটা হয়েছিল নিছক ক্লাসের নোট শেয়ারিং থেকে। অর্ণব কবিতা ভালোবাসত, সেটা মীরা বুঝেছিল প্রথম অ্যাসাইনমেন্টেই। তার লেখার মধ্যে একটা অদ্ভুত আবেগ থাকত, যেন সে কবিতা নয়—কারো চিঠি লিখছে। মীরা একদিন সরাসরি বলেই ফেলেছিল, “তুমি কি কোনোদিন কাউকে চিঠি লিখেছো?” অর্ণব প্রথমে হেসে ফেলেছিল, তারপর বলেছিল, “না, কিন্তু লিখতে চাই।”

তারপর আস্তে আস্তে কথোপকথন গড়িয়েছিল ক্লাসরুমের বাইরে। প্রথমে কলেজের লাইব্রেরি, তারপর ক্যাফেটেরিয়া, তারপর এক বিকেলে বটতলায়—যেখানে অর্ণব একদিন সাহস করে জিজ্ঞেস করেছিল, “আপনি কখনো কাউকে ভালোবেসেছিলেন?” মীরা প্রথমে থমকে গিয়েছিল, তারপর উত্তর না দিয়ে বলেছিল, “তুমি?”

“হয়তো… জানি না। কিন্তু এখন যা হচ্ছে, সেটা হয়তো ভালোবাসাই।”

মীরা হাসেনি, তবু তার চোখে একটা কম্পন দেখা দিয়েছিল। সে সেদিন রাতে অনেকক্ষণ ঘুমোতে পারেনি। মনে হচ্ছিল, একটা দরজা খুলে গেছে—যেটা বহু বছর ধরে সে নিজেই বন্ধ রেখেছিল।

এরপর যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, সেটা কোনো লেবেল নেয়নি। অর্ণব কখনো মীরাকে ‘তুমি’ বলত না, আবার ‘আপনি’-তেও দূরত্ব থাকত। মীরা কখনো অর্ণবকে ছোঁয়ার চেষ্টা করত না, আবার তার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকত চুপ করে অনেকক্ষণ।

একদিন সন্ধ্যে ছ’টা নাগাদ, কলেজের পেছনের রাস্তার ধারে বই নিয়ে বসে ছিল অর্ণব। মীরা এল হঠাৎ। হাতে ছিল দুটো কফি। বসে বলল, “তুমি কি সত্যি আমাকে বোঝো?”

অর্ণব বলল, “আমি চেষ্টা করি, বুঝতে।”

“তাহলে বোঝো, আমি ভয় পাই।”

“কিসের ভয়?”

“এই সম্পর্কটা যদি ভেঙে পড়ে? যদি আমি নিজেই ভেঙে ফেলি?”

অর্ণব কোনো উত্তর দেয়নি। শুধু বলেছিল, “তাহলে শুরুই না করি। কিন্তু তোমার চোখে তো দেখেছি সেই শুরুটার অপেক্ষা।”

তখনই হঠাৎ এক পাতা এসে পড়েছিল মীরার কাঁধে। হেমন্তের সেই প্রথম পাতা। সে একবার চোখ তুলে তাকিয়েছিল আকাশে, তারপর অর্ণবের দিকে—সেই দৃষ্টিতে ছিল অদ্ভুত এক মিশ্রণ: বেদনা, দ্বিধা, এবং… আশ্চর্য রকমের শান্তি।

সেই দিনটা ছিল তাঁদের গল্পের আনুষ্ঠানিক সূচনা। যেখানে কোনও প্রেম দিবস ছিল না, কোনও প্রপোজাল নয়—ছিল শুধু হেমন্তের আলো, দু’টো কফির কাপ, আর নিঃশব্দে জন্ম নেওয়া একটা অসমবয়সী প্রেম।

অপেক্ষার ভিতর

অর্ণবের জীবনে সেই বিকেলের পর থেকেই যেন একটা অদ্ভুত শান্তি নেমে এসেছিল, আবার সেই শান্তির ভিতরেই ছিল এক অস্থিরতা। যেমন গোধূলি বেলায় সব কিছু নরম আলোয় ঢেকে যায়, তবু ভিতরে জমে ওঠে রাতের অন্ধকার। মীরা সেদিন কিছু বলেনি, কিন্তু তার চোখে স্পষ্ট ছিল একটা নরম সম্মতি। অর্ণব জানত না, এটা কি প্রেম, না কি শুধুই এক অনুভব—কিন্তু সে বুঝেছিল, তার জীবন এই মহিলার চারপাশে এক কুয়াশার মতো ছড়িয়ে পড়ছে।

মীরার জীবন এতদিন ছিল নির্দিষ্ট, গুছোনো, আর বড্ড বেশি একা। বাড়ি বলতে একতলার একটা পুরনো ফ্ল্যাট, পুরনো সোফা, পুরনো বই, আর কিছু গাছ। উইকেন্ডে সে নিজেই রান্না করত, পুরনো হিন্দি গান চালিয়ে বই পড়ত। কলেজ ছিল তার আশ্রয়, ছাত্রছাত্রীরা ছিল তার অস্থায়ী পরিবার। কিন্তু অর্ণব এসে যেন সেই ছাঁদের টবে রাখা গাছগুলো হঠাৎ জল পেয়ে আবার ডালপালা মেলতে শুরু করল।

তাদের দেখা হত প্রায় প্রতিদিনই—কখনো ল্যাংটো বইয়ের লাইব্রেরি রুমে, কখনো সামনের চায়ের দোকানে, কখনো কলেজের টিনশেড ছাতার নিচে। কথার ভিতর একটা লুকোনো টান ছিল, কিন্তু কেউ কাউকে নাম ধরে ডাকত না প্রেমিকের মতো, কেউ কাউকে ছুঁত না অকারণে। তবু সেই না-ছোঁয়া জায়গায় একটা শরীরী উত্তাপ জমে উঠত।

“তুমি আমার জীবনের এমন এক অধ্যায়ে এসেছ,” একদিন মীরা বলেছিল, “যখন আমি পাতাগুলো ছিঁড়ে ফেলতে চাইনি, কিন্তু কেউ পড়তেও আসেনি।”

অর্ণব চুপ করে ছিল। সে জানত, বয়সে এই দূরত্বটাই মীরার মধ্যে একটা দ্বিধা এনে দিয়েছে। সমাজ, সহকর্মী, ছাত্র—সব কিছুই একসঙ্গে চাপ ফেলবে। কিন্তু তারও তো মন ছিল। তারও তো ইচ্ছে হত—একটা নাম, একটা সম্পর্ক, একটুকু অধিকার। তবু সে কিছু বলত না। অপেক্ষা করত।

একদিন ছুটির দিনে অর্ণব সাহস করে মীরার বাড়ির কাছেই একটা পুরনো কফিশপে ফোন করেছিল—“আপনি একটু আসবেন? আমি অপেক্ষা করছি।” প্রথমে মীরা চুপ করে গিয়েছিল। তারপর বলেছিল, “ঠিক আছে, আসছি। কিন্তু এই অপেক্ষাটা বুঝলে? এই ‘তুমি ডাকছো’ আর ‘আমি আসছি’-এর মাঝখানে যে সময়টুকু পড়ে থাকে—সেটাই আসল সম্পর্ক।”

মীরা এসেছিল সেইদিন হালকা হলুদ শাড়িতে, কপালে বিন্দু টিপ, আর চোখে অদ্ভুত এক প্রশ্রয়। কফিশপের এক কোনায় বসে তারা দুজন কথা বলছিল বহুক্ষণ ধরে। বাইরেটা মেঘলা হয়ে উঠছিল। অর্ণব তার দিকে চেয়ে বলেছিল, “আপনি কি জানেন, আমি আপনার জন্য কতটা ভাবি?” মীরা বলেছিল, “জানি। আর সেটাই আমাকে ভয় পাইয়ে দেয়।”

“ভয় কেন?”

“কারণ আমি তোমার জীবনে সেই শুরুর নয়, বরং শেষ অধ্যায়। তুমি বাঁচতে এসেছ, আমি বাঁচাতে নয়—হারাতে শিখেছি।”

“কিন্তু আমি তো তোমার সঙ্গেই শুরু করতে চাই।”

মীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল। বলেছিল, “একটা বয়সের পর, মানুষ ভালোবাসে না, বরং সুরক্ষিত থাকতে চায়। আর ভালোবাসা কখনোই নিরাপদ নয়।”

সেদিন তারা হাঁটতে বেরিয়েছিল। বৃষ্টি শুরু হয়েছিল হালকা করে। ছাতা ছিল না, তবু মীরা ছুঁতে দেয়নি অর্ণবকে। শুধু হেঁটেছিল পাশাপাশি—সেই হাঁটা ছিল এক চুপ থাকা কবিতা। অর্ণবের গায়ে মীরার হাতের গন্ধ লেগেছিল, যদিও সে ছুঁয়েও দেখেনি।

পরদিন ক্লাসে মীরা অর্ণবের দিকে তাকিয়েই কিছু বলছিল না। ক্লাস শেষে বেরিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ বলল, “তুমি কি চাইছো, আমি সব ভুলে গিয়ে তোমার হয়ে উঠি?”

অর্ণব বলল, “আমি চাই, আপনি কিছু না ভুলে আমার পাশে থাকুন। আপনি যেমন আছেন, আমি ঠিক তেমন করেই আপনাকে ভালোবাসি।”

মীরা প্রথমবার মাথা নীচু করে বলেছিল, “তুমি জানো না, এই কথাগুলোর ভিতরে কী বিপদ লুকিয়ে আছে। তোমার বয়স এখন ভালোবাসা শেখার, কিন্তু আমার বয়স সেটা হারিয়ে ফেলবার।”

তবু তাদের দেখা চলছিল। এক ছুটির দিনে অর্ণব একগুচ্ছ চিঠি দিয়েছিল মীরাকে—হাতে লেখা, কালি মাখানো অক্ষরে। মীরা পড়েছিল চুপ করে। তারপর বলেছিল, “এই চিঠিগুলো রেখে দেব। কারণ একদিন যদি ভুলেও যাই, এগুলো আমাকে মনে করিয়ে দেবে—কেউ একদিন আমাকে এমন নিঃশব্দে ভালোবেসেছিল।”

মীরার মধ্যে একটা দ্বৈততা ছিল—সে অর্ণবকে চাইত, আবার ঠেকিয়েও রাখত। তার ভেতরে এক নরম যুদ্ধ চলত—সমাজ আর হৃদয়ের মধ্যে, বয়স আর সাহসের মধ্যে।

অর্ণব আরেকদিন বলেছিল, “আমাদের সম্পর্কটা কি কোনোদিন নাম পাবে?”

মীরা তাকিয়ে বলেছিল, “হয়তো পাবে না। হয়তো আমরা কেবল অপেক্ষা হব একে অপরের। ঠিক যেমন বিকেল অপেক্ষা করে সন্ধের, কিন্তু রাত হয়ে ওঠে না।”

সেই দিন থেকে তারা নতুন করে বুঝেছিল—এটা প্রেম, কিন্তু নামহীন; এটা সম্পর্ক, কিন্তু শূন্যতায় ভরা; এটা উপস্থিতি, অথচ একান্ত অনুপস্থিতিও বটে।

এভাবেই অর্ণব অপেক্ষা করে যেত—একটা না বলা শব্দের, একটা অচেনা ছায়ার মতো প্রেমের, যার কোনো বাঁধন নেই, কিন্তু টান এত গভীর যে হৃদয়ের ভিতরে গেঁথে থাকে।

ভাঙা আয়নার আলো

তৃতীয় সেমিস্টারে পা দিচ্ছিল অর্ণব। সময় গড়িয়ে যাচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু তার দিনগুলো যেন ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে তাল না মেলানো এক আলাদা সময়রেখায় চলছিল—একটা যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত মীরার ছায়া দিয়ে আঁকা। মীরা তখনও তার সেই আগের মতোই—নিয়মিত, গুছানো, শীতল কিন্তু ভেতরে থমথমে। সে অর্ণবকে কখনো কাছে টেনে নেয়নি, আবার দূরে ঠেলেও দেয়নি। একটা মাঝের জায়গায় আটকে রেখেছিল যেন—একটা অসমাপ্ত উপন্যাসের মতো, যেখানে শেষ পাতা কেউ লিখে উঠতে পারে না।

সেই সময় একদিন, অর্ণব তার বন্ধুদের সঙ্গে ক্যাফে থেকে ফিরছিল যখন সে দূর থেকে দেখল মীরা কলেজের সামনের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে কারও সঙ্গে কথা বলছে। লোকটা বছর পঁঁইত্রিশের মতো হবে—চশমা পরা, পরিপাটি পোশাক, কিন্তু মুখে কিছুটা বিরক্তি। মীরা তার সঙ্গে কী বলছে সেটা বোঝা যাচ্ছিল না, কিন্তু তার চোখে একটা অস্থিরতা স্পষ্ট ছিল।

অর্ণব হেঁটে গিয়ে দূর থেকে অপেক্ষা করল। লোকটা চলে গেল কিছুক্ষণ পর, আর মীরা একা দাঁড়িয়ে রইল।

সে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “সব ঠিক তো?”

মীরা চমকে তাকাল, কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “হ্যাঁ, একজন পুরনো পরিচিত… কিছু আর্থিক সমস্যা নিয়ে এসেছিল। তোমার ভাবনার কিছু নেই।”

তবু অর্ণব বুঝেছিল—মীরার মুখের ছায়া বলছে কিছু একটা ঠিকঠাক নেই। কিন্তু সে চেপে গেল, কারণ সে জানত—মীরার ভিতরের দরজা ঠেলতে গেলে খুব সাবধানে পা ফেলতে হয়।

পরদিন ক্লাসে মীরা উপস্থিত ছিল না। এমনটা এর আগে খুব কমই হয়েছে। অর্ণব বুঝল, কিছু একটা ঘটেছে।

সেইদিন সন্ধের দিকে মীরা নিজেই ফোন করল—অর্ণব একপ্রকার অবাক হয়ে গেল। ফোনে মীরা বলল, “একটু সময় হবে আজ তোমার?”

অর্ণব এক কথায় রাজি। তারা দেখা করল একটা পুরনো ট্রামডিপোর পাশে, যেখানে কেউ সাধারণত আসেও না। সন্ধ্যার আলো তখন ধূসর হয়ে এসেছে।

মীরা ধীরে বলল, “তোমাকে কিছু জানাতে চেয়েছিলাম অনেকদিন… কিন্তু সাহস হয়নি। আজ মনে হল, হয়তো বলাই উচিত।”

অর্ণব কাঁধে ব্যাগ ফেলে চুপচাপ তাকিয়ে ছিল। মীরার গলার স্বর তখন কাঁপছিল, যেন ভিতর থেকে উঠে আসছে বহুদিন চেপে রাখা কিছু কথা।

“তুমি যাকে সেদিন দেখেছিলে… সে আমার ছোটবেলার বন্ধু, তারপর প্রেমিক, তারপর… যে মানুষটা আমাকে ভেঙে দিয়েছিল।”

অর্ণব কিছু বলল না। শুধু দৃষ্টি নামিয়ে রেখেছিল।

“আমি তাকে ভালোবাসতাম, চোখ বন্ধ করে। সে একটা সময় আমার উপর নির্ভর করত, তারপর ধীরে ধীরে আমায় দুর্বল করে দেয়। মানসিক নির্যাতন, সন্দেহ, অবিশ্বাস—সব কিছু আমাকে নীচে নামিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।”

মীরা একটানা বলে যাচ্ছিল, “আমার আত্মবিশ্বাস ভেঙে গিয়েছিল। নিজেকে দায়ী করতে শিখেছিলাম। ভেবেছিলাম, আমি যোগ্য না। প্রেম, শরীর, সম্পর্ক—সব যেন একটা ক্লান্তি হয়ে উঠেছিল।”

অর্ণব ধীরে বলে, “আপনি সেই অবস্থান থেকে উঠে এসেছেন। আপনি আজ যিনি—তিনি সাহসী, শক্ত।”

মীরা একবার তাকিয়ে রইল। “তুমি যখন প্রথম দিন ক্লাসে ঢুকেছিলে, আমি ভেবেছিলাম—এই ছেলে ক’দিনেই মাটিতে পড়ে যাবে। কিন্তু তুমি ছিলে আলাদা। আমি ভয় পেয়েছিলাম… আবার মুগ্ধও হয়েছিলাম।”

হালকা বাতাস বয়ে যাচ্ছিল তাদের দুজনের মাঝখান দিয়ে। মীরা হঠাৎ বলল, “জানো অর্ণব, আয়না ভাঙলে প্রতিফলন ভেঙে যায়। কিন্তু কিছু কিছু আয়না থাকে, যা ভাঙার পরও আলো ধরে রাখে। তুমি আমার সেই আয়না।”

অর্ণব প্রথমবার মীরার দিকে হাত বাড়াল। কিন্তু সে ছুঁলো না, শুধু আঙুল ছুঁয়ে বলল, “আপনি যা কিছু ছিলেন, বা হারিয়েছেন, সবকিছু নিয়ে আপনাকে ভালোবাসি।”

মীরা হেসে ফেলল, চোখের কোণে জল। “তুমি জানো না তুমি কী বলছো। তুমি নিজের সময়েই হারিয়ে যাবে একদিন।”

“হয়তো,” বলল অর্ণব, “কিন্তু যতদিন থাকব, আমি থাকব আপনাকে জুড়ে।”

সেই রাতটা অদ্ভুত ছিল। তারা বেশি কথা বলেনি, শুধু পাশাপাশি বসে থেকেছে, নীরবতায় একে অপরের ভাঙাগুলো জোড়া লাগিয়েছে।

পরদিন সকালে অর্ণব যখন কলেজে এল, মীরা ক্লাস নিচ্ছিল, যেন কিছুই হয়নি। কিন্তু ক্লাস শেষে সে হঠাৎ বলে ফেলল, “তুমি আজ একবার আমার সঙ্গে চলো।”

অর্ণব চমকে গেল, কিন্তু কিছু না বলে হাঁটতে লাগল। তারা গেল কলেজের পেছনের ছোট একটা পার্কে। মীরা বলল, “এখানে আমি অনেক সময় কাটাতাম একা। ভেবেছিলাম কাউকে কখনো এখানে আনব না। কিন্তু আজ মনে হল—তুমি এই একাকিত্বটাকে ভাগ করে নিতে পারো।”

অর্ণব বলল, “আপনি কি আমাকে আপনার জীবনে জায়গা দিচ্ছেন?”

মীরা বলল, “আমি তোমাকে আমার ভাঙা আয়নার আলো দেখাতে চাই। সেটা হয়তো ঝলমলে না, কিন্তু সত্যি।”

সেই মুহূর্তে অর্ণব বুঝেছিল—এই সম্পর্কের নাম দেওয়া যাবে না, ছাঁচে ফেলা যাবে না। কিন্তু এই যে একে অপরের পাশে থাকা, ভাঙাগুলো জোড়া দেওয়া—এটাই তো ভালোবাসার সবচেয়ে নিঃশব্দ রূপ।

সন্ধে ছুঁয়ে থাকা হাত

সেই দিনটির পর মীরা আর অর্ণবের মধ্যকার দূরত্ব যেন আরও নরম, আরও অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছিল। যেটা আগে কেবল চোখে চোখ রাখা ছিল, সেটা এখন কিছু কিছু কথায়, নরম হাসিতে, খেয়াল রাখা চুপচাপ ভঙ্গিতে প্রকাশ পাচ্ছিল। তবু, মীরা ছিলেন সাবধান। তিনি জানতেন, সমাজ নামক এই নির্মম দানব অত সহজে এই অসমবয়সী সম্পর্কের ছায়া মেনে নেবে না। এবং তার চেয়েও বড় কথা, মীরা নিজের বুকের ভিতরের সেই নরম জায়গাটিকে সম্পূর্ণরূপে কারো হাতে তুলে দিতে ভয় পেতেন।

সন্ধের পর কলেজ প্রায় ফাঁকা হয়ে যেত। তখন কিছু কিছু দিন অর্ণব মীরাকে একাই খুঁজে পেত শিক্ষক ঘরের বারান্দায়, জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে। একবার মীরা বলেছিলেন, “তুমি কি জানো, সন্ধে একটা সময় নয়, এটা এক ধরণের মনোভাব। আলো আর অন্ধকারের মাঝের যা থাকে, সেটাই আমাদের গল্প।”

সেই দিনের সন্ধে ছিল ঠিক তেমন—আলো-অন্ধকারে মেশানো। শীত পড়তে শুরু করেছে। অর্ণব একটা মাফলার গলায় পেঁচিয়ে মীরাকে দেখতে এসেছিল। কেউ ছিল না চারপাশে। শুধুই তারা দুইজন।

“আপনি বাড়ি যাবেন না?” অর্ণব বলেছিল।

“হ্যাঁ, যাব,” মীরা বলেছিলেন, “কিন্তু কোনো কোনো দিন এমন হয়… মনে হয়, কিছুক্ষণের জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকলে নিজের মনের শব্দগুলো শোনা যায়।”

“আপনার মনের মধ্যে কী শব্দ বাজছে আজ?”

মীরা চেয়ে রইলেন অর্ণবের দিকে। তারপর বললেন, “একটা শব্দ—‘কেন?’”

“আপনি নিজেকেই জিজ্ঞেস করছেন?”

“হ্যাঁ। কেন আমি এমন অনুভব করছি, যেটা আমাকে আবার টেনে নিচ্ছে একটা বিপদের দিকে?”

অর্ণব খুব ধীরে এগিয়ে গিয়ে পাশে দাঁড়াল। বলল, “আপনি যদি সেটা বিপদ ভাবেন, আমি নিজেকেই তুলে দেব আপনার জীবনের বাইরের দিকটায়।”

মীরা হঠাৎ চমকে গেলেন। “না! প্লিজ, এটা বোঝার ভুল করো না। তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে স্বচ্ছ অনুভব।”

তবু তার মুখে ভয় ছিল। ভয়টা বয়সের নয়, সামাজিকতার নয়, বরং নিজেকে নিয়ে—যে হয়তো সে আবার কাউকে নির্ভর করে ফেলছে। দীর্ঘ একাকীত্বের পর কোনও সম্পর্কের ভিতর নেমে যাওয়ার আগে একটা শূন্যতা থেকে টান পড়ে যায়, আর ভয় হয়—এই বুঝি আবার হারিয়ে ফেলব সব।

অর্ণব বলল, “আপনি জানেন তো, আমি আর পাঁচটা ছেলের মতো না। আমি আপনাকে প্রমাণ করতে আসিনি কিছু, আমি শুধু চাই, আপনি আমার পাশে থেকে নিজেকে হারাবেন না।”

মীরা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, “আমি অনেক রাত একা বসে থাকি জানো? একটা চেয়ার আছে আমার বারান্দায়। আমি বসে থাকি, চা নিই হাতে, আর ভাবি, কেউ যদি চুপচাপ এসে পাশে বসত। কথা না বললেও চলত। শুধু তার উপস্থিতি থাকত।”

“আমি কি পারি সেই চেয়ারের পাশে বসতে?”

মীরার চোখে জল চলে এসেছিল—নির্বিষ চোখের কোণে একটা নরম আলোর রেখা। কিন্তু তিনি মুখে কিছুই বলেননি।

তারা একসঙ্গে হাঁটছিলেন। রাস্তার বাতিগুলো একে একে জ্বলছিল। এক জায়গায় এসে অর্ণব হাত বাড়িয়ে দিল মীরার দিকে। খুব স্বাভাবিকভাবে, যেমনটা একজন প্রিয়জন করে।

মীরা প্রথমে থমকালেন, তারপর হাতটা নিলেন। তাদের হাত ছুঁয়েছিল সন্ধের বাতাস। ঠাণ্ডা হাতের ভিতরেও একরকম উত্তাপ জমে উঠেছিল—কোনও স্পর্শ, কোনও অঙ্গীকার নয়, কেবল এক বিশ্বাস।

“আমি তোমাকে ভয় পাই না,” মীরা ধীরে বললেন, “আমি নিজেকেই ভয় পাই।”

“আপনি তো আমায় বলেছিলেন, সন্ধে শুধু আলো-অন্ধকারের সীমা নয়—এটা একটা মনোভাব। তাহলে আমরা সেই মনোভাবেই থাকি, কোনও নাম না দিয়ে, কোনও দাবি না রেখে।”

মীরা হেসে ফেললেন। বললেন, “তুমি আমার চেয়ে অনেক বড় মনের মানুষ।”

“আর আপনি আমার জীবনের সেই বই, যেটা প্রতিদিন নতুন করে পড়তে ইচ্ছে করে। এমনকি যদি জানিও যে শেষটা করুণ হতে চলেছে।”

সেই সময়, মীরা হঠাৎ থেমে গেলেন। বললেন, “তুমি কি জানো, আমি কখনও কাউকে এভাবে হাতে ধরিনি। এমনকি যাদের ভালোবেসেছিলাম, তাদেরও না।”

“তাহলে?”

“তুমি ব্যতিক্রম, কারণ তুমি দাবি করোনি। তুমি শুধু ছিলে।”

অর্ণব সেই হাতটা আরও শক্ত করে ধরল, কিন্তু সেই শক্তিও এমন—যেন কবিতার কোনো লাইনের ভিতর লুকিয়ে থাকা একটা স্পর্শ।

রাত বাড়ছিল। হালকা হিম পড়তে শুরু করেছে। তারা পাশাপাশি হাঁটছিল। কেউ কিছু বলছে না। কিন্তু প্রতিটি পায়ের আওয়াজ যেন একেকটা ছন্দ হয়ে উঠছিল।

সে রাতে অর্ণব বাড়ি ফিরে ঘুমোতে পারেনি। সে জানত, তাদের গল্পটা এমন এক দাগের মতো, যা চাইলেও মুছে ফেলা যায় না। এটা কোনো পারিবারিক স্বীকৃতি পাওয়া প্রেম নয়, কোনো সামাজিক ‘রোমান্স’ নয়—এটা এক ধরনের হৃদয়ের উচ্চারণ, যা কেউ বোঝে না, কিন্তু অনুভব করে।

এবং মীরা? তিনি চুপচাপ নিজের চায়ের কাপ ধরে বসে ছিলেন বারান্দায়। পাশে রাখা ছিল আরেকটা ফাঁকা কাপ। কেউ আসেনি, তবু রাখা ছিল। হয়তো সেই কাপটায় আজ প্রথমবার কেউ চুপচাপ বসেছিল, সন্ধের হাত ছুঁয়ে।

একদিন চলে যেতে হবে

শীত জাঁকিয়ে বসেছে শহরে। কলেজের গাছগুলো কাঁপছে হিম হাওয়ায়, আর মীরার অফিসঘরের জানালার বাইরে সাদা রোদ গড়িয়ে পড়ছে ধুলোয়। অর্ণব ক্লাসে বসে ছিল সামনের বেঞ্চে, মুখ নামিয়ে কিছু লিখছিল, কিন্তু মীরার চোখ ছিল অন্যত্র—তার কলমের চলার গতিতে, তার গালের নিচের হালকা দাড়িতে, আর তার নীরব চোখে যা শুধু তাকিয়ে থেকেও কত কথা বলে।

ক্লাস শেষে মীরা বলল, “আজ একটু সময় হবে?”

অর্ণব মুচকি হেসে বলল, “আপনার জন্য তো সময় নিজে থেকেই তৈরি হয়।”

তারা কলেজ থেকে বেরিয়ে হাঁটতে লাগল। শহরের রাস্তাগুলো ছুটির দিনে শান্ত থাকে, আজও তেমনই। বইয়ের দোকানের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মীরা হঠাৎ থেমে গেল। বলল, “জানো অর্ণব, একদিন তো আমাদের এই হাঁটাগুলো শেষ হবে।”

“সব কিছুই একদিন শেষ হয়,” অর্ণব সহজভাবে বলল।

“না, আমি বলছি আমাদের সম্পর্কটা একদিন… হয়তো এমন হবে, আমি চলে যাব, তুমি ব্যস্ত হয়ে পড়বে নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে, নতুন মানুষ আসবে তোমার জীবনে, আমার বয়স বাড়বে—সব কিছু বদলে যাবে।”

অর্ণব থেমে তাকাল তার দিকে। “আপনি কি আমাকে ভবিষ্যতের নাম করে ছুটি দিচ্ছেন?”

“না, আমি তোমাকে তোমার ভবিষ্যতের জায়গাটা তৈরি করে দিচ্ছি। যেন তুমি কোনও দিন না বলো—তুমি আমাকে নিয়ে তোমার সময় নষ্ট করেছিলে।”

অর্ণব ধীরে ধীরে মীরার সামনে দাঁড়াল। “আপনি কি জানেন, আমি কতবার ভেবেছি আপনাকে হারাব যদি বলি ভালোবাসি? আর আপনি নিজেই আজ বলছেন, ‘একদিন চলে যেতে হবে’?”

“তুমি বুঝতে পারো না, অর্ণব,” মীরা বলল, “একটা বয়সে পৌঁছালে নিজের জায়গাটা ধরে রাখাটা খুব জরুরি হয়ে পড়ে। আমি তোমাকে চিনি, জানি তুমি সত্যি করে অনুভব করো, কিন্তু…”

“কিন্তু?”

“তোমার ভালোবাসাটা ফুলের মতো—নরম, সতেজ, কিন্তু সময়ের সঙ্গে শুকিয়ে যাবে। আর আমি? আমি একটা পুরনো গাছ, যার ডালে এখন আর নতুন পাতা আসে না। কেবল ছায়া পড়ে।”

অর্ণব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল, “আপনি ভুল করছেন। আমি ফুল না, আমি সে গাছের এক নীচের মাটি, যেটা গাছের শিকড় আঁকড়ে রাখে। আপনি আমার ছায়া, আমি আপনার ভিতরেই বেড়ে উঠেছি।”

মীরা নিরুত্তর।

তারা সেদিন শেষ পর্যন্ত গিয়ে বসেছিল একটি ছোট চা দোকানের বেঞ্চে। পাশেই ছিল একটা পরিত্যক্ত রেললাইন, যার উপর দিয়ে আর ট্রেন চলে না। কেবল আগাছা জমেছে, ঘাস উঠে এসেছে।

মীরা চুপ করে বলল, “এই লাইনটার মতোই আমরা। একদিন চলতাম, এখন কেবল ইতিহাস।”

অর্ণব হেসে ফেলল। “আপনি নিজেকে ইতিহাস ভাবেন, কিন্তু আমি আপনাকে ভবিষ্যৎ বলতে চাই।”

“আমাকে নিয়ে তুমি কোনওদিন ভবিষ্যৎ ভাবতে পারবে না। আমি তোমার সঙ্গে একটা নামহীন গল্প হতে পারি, কিন্তু একটা সিধে পরিচিত সম্পর্ক নয়।”

“তাহলে আপনি কি চান, আমি চলে যাই?”

“না, আমি চাই তুমি থেকো। শুধু জেনে থেকো—এই থাকা চিরকালীন নয়। কোনো ঘোষণা ছাড়াই একদিন সব কিছু থেমে যেতে পারে। ততদিন আমরা থাকি, চুপচাপ, ঠিক যেমন আকাশ থাকে রোজ সূর্য ওঠার আগে।”

অর্ণব জানত, মীরা তাকে সরিয়ে দিচ্ছে না—বরং আগেই বলে দিচ্ছে শেষটা, যাতে সেই দিন এলে, দুঃখ হলেও বিস্ময় না থাকে।

তবু অর্ণব মাথা নীচু করে বলল, “আমি কোনও শেষ চাই না। আমি চাই প্রতিটি দিন হোক শেষ দিন, যেন নতুন করে শুরু করার কোনও চাপ না থাকে। আজকের হাত ধরা যদি শেষ হয়, তবে হোক—কিন্তু তাতে আগের অনুভব মিথ্যে হয় না।”

মীরা একবার অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি আমার চেয়ে অনেক বেশি সাহসী। আমি তো শুধু জেনেছি কীভাবে জীবন থেকে পালাতে হয়, তুমি শিখছো কীভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।”

সেদিন তারা ফিরে এসেছিল একসঙ্গে, কিন্তু কথা বলছিল না। শব্দের প্রয়োজন ছিল না আর। সম্পর্ক যখন গভীর হয়, তখন নীরবতাই হয়ে ওঠে ভাষা।

রাতে মীরা ডায়েরি খুলে বসেছিল। সে লিখল—
“আজকে অর্ণবকে বললাম, একদিন চলে যেতে হবে। কিন্তু ও কিছুতেই আমার ভয় বুঝতে চাইছে না। ওর চোখে আমি দেবী নই, আমি মানুষ। আর হয়তো সেই কারণেই আমি ভয় পাই—কারণ মানুষকে মানুষ ভাবলে তাকে হারানো যায়। দেবী হলে সে কেবল দূরের পাথর। ও আমাকে জীবন্ত করে তুলেছে, আর আমি ভাবছি কেমন করে আবার নির্জীব হব।”

অর্ণবও সেই রাতে তার নোটবুকে লিখল—
“ও চলে যাবে একদিন। আমি জানি। তবু আমি তাকে ভালোবাসব। কারণ ভালোবাসা তো চিরন্তন থাকার নাম নয়, ভালোবাসা হলো অপেক্ষা, স্নেহ, মায়া—যেটা কিছু না পেয়েও থেকে যায় বুকের ভিতরে। ও থাকুক বা না থাকুক, আমি থাকব। ওর ছায়ার মতো।”

সেই রাত ছিল অন্যরকম। তারা আলাদা ঘরে, আলাদা বিছানায় শুয়ে ছিল, কিন্তু দুজনেই জানত—তাদের ভিতর একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে যা ভাঙা যায় না। হয়তো তাকে সমাজ মেনে নেবে না, হয়তো তারা একসঙ্গে হাঁটবে না কোনো ভবিষ্যতের দিকে, কিন্তু তারা একে অপরের জীবন রেখায় এমন এক অধ্যায় হয়ে উঠেছে, যা কোনোদিন মুছে যাবে না।

যেদিন মেঘ ছিল না

কলকাতার আকাশ সাধারণত মার্চ মাসে এমন পরিষ্কার থাকে না। একটু না একটু ছায়া, ধুলো, কিংবা অকারণে ধোঁয়া লেগেই থাকে। কিন্তু সেই দিনটা ছিল অন্যরকম। নীল আকাশ, রোদ ঝলমলে, এমন একটা সকাল যা দেখে মনে হয় সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে—মন, সম্পর্ক, এমনকি ভাঙা অতীতও।

মীরা সকাল থেকে অদ্ভুতভাবে প্রশান্ত বোধ করছিলেন। জানালার পাশে বসে চা খেতে খেতে তার মনে হচ্ছিল যেন ভেতরের সমস্ত জট খুলে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। তিনি হয়তো বুঝতে পারছিলেন না, এই প্রশান্তির উৎসটা ঠিক কোথায়, কিন্তু জানতেন—এটা কোনো হঠাৎ পাওয়া মুক্তির মতো।

তিনি নিজেই ফোন করেছিলেন অর্ণবকে।

“আজ কোথাও বেরোবে?”

অর্ণব ঘুমচোখে উত্তর দিয়েছিল, “আপনি বললেই বেরোই।”

“তাহলে তৈরি হয়ে নাও। আজ আকাশ খুব সুন্দর।”

তারা দেখা করেছিল প্রিন্সেপ ঘাটে। গঙ্গার ধারে বসার জায়গায় তখনো বেশি ভিড় হয়নি। মীরা আজ অন্যরকম লাগছিল—লাল-কালো টাঙ্গাইল শাড়ি, খোলা চুল, আর চোখে সেই পুরোনো শান্তি। অর্ণব তাকিয়েই ছিল কিছুক্ষণ, একটাও শব্দ বলার আগে।

“আজ আপনি যেন… নিজেকেই ভালোবেসেছেন,” অর্ণব বলেছিল।

“হয়তো আজ নিজেকে একটু ক্ষমা করতে পেরেছি।”

“কার জন্য?”

“তোমার জন্য।”

ওরা পাশাপাশি বসেছিল। মীরা হালকা গলায় বলল, “তুমি জানো, কতদিন পরে আমি নিজেকে এইভাবে সাজালাম? আগে ভাবতাম, সাজব কেন? কে দেখবে? কাকে দেখাব?”

“এবং এখন?”

“এখন মনে হয়, যদি আমি নিজেই নিজেকে না দেখি, তাহলে কেউ অন্য কেউ কীভাবে দেখবে?”

অর্ণব মুচকি হেসে বলল, “আপনি এত সুন্দর… আপনাকে যে কোনও সময় সাজে, যেকোনও আলোয়।”

মীরা মাথা নেড়ে বলল, “তোমার এই কথাগুলো খুব বিপজ্জনক, জানো?”

“তবু বলি। কারণ আপনাকে ভালোবাসাটা আমার জন্য বিপদের চেয়েও বেশি সত্য।”

বাতাস বইছিল ধীরে ধীরে। গঙ্গার জলেও রোদ পড়ে চিকচিক করছিল। অর্ণব তখন একটা ছোট নীল খাম বের করল ব্যাগ থেকে।

“এটা আপনার জন্য।”

মীরা অবাক হয়ে খামটা নিলেন। খুলে দেখলেন, একটা কবিতা। হাতে লেখা।

“তোমার নামে লিখে রাখি
সন্ধের চা, রোদভরা পথ,
ভাঙা আয়নার কোণে
যে মুখটা আমার জন্য চুপ করে ছিল…”

মীরা পড়ে থেমে গেলেন। গলার স্বর নরম হয়ে এলো।

“তুমি লিখেছ?”

“হ্যাঁ। আমি যখন জানি আপনি একদিন চলে যাবেন, তখন চাই কিছু থাকুক আপনার সঙ্গে—আমার লেখা, আমার হাতের অক্ষর, আমার মনের এক টুকরো।”

“তুমি এত গভীরে গেলে কবে?”

“আপনার চোখে দেখে শিখেছি।”

মীরা এবার মুখ ফিরিয়ে অর্ণবের চোখে তাকালেন। এতদিনের সেই অদৃশ্য বাধাটুকু যেন একটু সরল সেদিন। তার দৃষ্টিতে লুকানো ছিল স্বীকৃতি, প্রশ্রয়, এমনকি একটুকু আহ্বানও।

“তুমি কি জানো, এই আকাশটা ঠিক আজকের মতো নীল ছিল যেদিন আমি প্রথম প্রেমে পড়েছিলাম?”

“তখন আপনার বয়স কতো?”

“তোমার চেয়ে চার-পাঁচ বছর কম। তখন প্রেমটা ছিল স্বপ্ন, এখন প্রেম মানে বাস্তবতা মেনে নেওয়া। তাই তুমি যদি এখন আমাকে ভালোবাসো, তবে জানবে—এই ভালোবাসা মানে দায়িত্ব, দুরত্ব, দ্বিধা, তবু থেকেও যাওয়া।”

“আপনি থাকবেন তো?”

“থাকব। যতদিন পারি। যতদিন তুমি বিশ্বাস করবে এই থাকা অর্থহীন নয়।”

ওরা একসঙ্গে বসে থাকল অনেকক্ষণ। পাশ দিয়ে ছোট ছোট বাচ্চারা দৌড়ে গেল, কেউ গঙ্গার দিকে তাকিয়ে ছবি তুলল, কেউ চিপসের প্যাকেট খুলল। অথচ তাদের দুজনের মাঝখানে এত শব্দের মধ্যে ছিল এক অদ্ভুত শান্তি।

মীরা হঠাৎ বললেন, “আজ একটা কথা বলি?”

“বলুন।”

“আমি তোমার গার্ডিয়ান হতে পারি, শিক্ষক হতে পারি, বয়সে বড়—সব মানি। কিন্তু আমি যদি বলি, আজ আমি শুধু একজন নারী, যে তোমার পাশে কিছুক্ষণ চুপ করে বসতে চায়, বিশ্বাস করবে?”

অর্ণব বলল, “আমি তো আপনাকে সেই চোখেই দেখি সবসময়। আমি আপনাকে প্রেমিকা বলি না, কারণ আপনি তার চেয়ে বেশি কিছু। আপনি আমার সমস্ত হৃদয় জুড়ে থাকা একটা অনুভব, যার কোনো সংজ্ঞা নেই।”

মীরা চোখ বন্ধ করে হেসে ফেললেন। “তুমি আমার অনেক কিছু হয়ে উঠছো অর্ণব। কিন্তু আমিও তো তোমার জীবনে একরকম ছায়া হয়েই থাকব।”

“না। আপনি আলো।”

আকাশে তখনো মেঘ ছিল না। সেদিন আকাশটা ছিল এমনই, যেটা শুধু এক নিখুঁত দিনেই দেখা যায়। কিন্তু ওরা জানত, মেঘ একদিন আসবেই। সেই মেঘ এসে ঢেকে দেবে আকাশ, হয়তো সেই ছায়ায় ওরা একে অপরকে হারিয়ে ফেলবে।

তবু, এই একদিনের জন্য, তারা বিশ্বাস করল—ভালোবাসা একদিনের অনুভবেও থাকতে পারে, ছায়ার মতো পিছু ছাড়ে না, আর কখনো কখনো আলো হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়।

যেখানে তুমি নেই, আমি আছি

সেই পরিপাটি দিনটার পরে হঠাৎ যেন মেঘ জমা শুরু করল বাস্তবের আকাশে। শহরের ধুলোয় যেমন সূর্য হঠাৎ হেরে যায়, তেমনি একদিন অর্ণব ক্লাসে এল না। পরপর দু’দিন। মীরা ভাবলেন হয়তো অসুস্থ বা অন্য কোনো কাজে ব্যস্ত। কিন্তু তৃতীয় দিনে কেমন এক অস্বস্তি জেগে উঠল বুকের ভিতরে।

অর্ণব কখনো এমন করত না। সে সবসময় জানাত, কোথায় আছে, কী করছে। কিন্তু এবার কোনও মেসেজ, কোনও ফোন, কিছুই নেই। মীরা ফোন করতে গিয়েও থেমে গিয়েছিলেন—তার কি আদৌ অধিকার আছে জানতে চাওয়ার? সে তো কেবল একজন শিক্ষিকা, একজন নীরব ভালোবাসার মানুষ।

চতুর্থ দিনে সে নিজেই ফোন করলেন, অর্ণবের নম্বরে। ফোন কাটা গেল। ফের করলেন—সরাসরি সুইচ অফ।

সেদিন সন্ধ্যাবেলা মীরা লাইব্রেরিতে বসে ছিলেন, খুব চেষ্টা করেও কোনো বইয়ের পাতায় মন বসাতে পারছিলেন না। চারপাশের শব্দ ঝাপসা হয়ে আসছিল। ছাত্রদের হাসি, পাতার ওল্টানো আওয়াজ, এমনকি দূরের গাড়ির হর্ন—সব যেন খুব দূর থেকে আসছিল।

তখনই অর্ণব এল। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল কিছুক্ষণ, তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে এল। মুখে ক্লান্তি, চোখে চাপা কষ্ট।

“তুমি?”

“হ্যাঁ। আমি ঠিক আছি। একটু সময়ের জন্য পালিয়ে গিয়েছিলাম।”

“পালিয়ে?” মীরা অবাক হয়ে তাকালেন।

“হ্যাঁ। নিজেকে নিয়ে, আপনাকে নিয়ে, আমাদের এই…অবস্থাটাকে নিয়ে। আমি ভয় পেয়েছিলাম, আপনাকে হারাতে নয়, বরং আপনাকে নিয়ে এগোতে গিয়ে নিজেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি তা বুঝতে পারছিলাম না।”

মীরা অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “তুমি যদি চলে যেতে চাও, আমি বাধা দেব না। কিন্তু আমি জানতাম, তুমি একদিন ফিরে আসবে।”

অর্ণব বসে পড়ল তার সামনে। বলল, “আপনি জানেন, আমি আপনার জন্য কতখানি গভীরে গিয়েছি? আমি আপনার নামটাকে আমার ভবিষ্যতের প্রতিটা সিদ্ধান্তে জড়িয়ে ফেলেছি। আমি ভাবছিলাম, যদি আপনি না থাকেন, আমি কে?”

“তুমি নিজেই একটা স্বতন্ত্র পৃথিবী অর্ণব। তোমার সবটুকু আমার জন্য নয়, তার কিছুটা শুধু আমার সঙ্গে ভাগ করে নিলে—তাই যথেষ্ট।”

“তবু আমি চেয়েছিলাম আপনাকে একটা নাম দিতে। একটা অবস্থান। কিছু একটা, যাতে আপনাকে কেউ প্রশ্ন না করতে পারে।”

মীরা মৃদু হাসলেন। “এই সমাজে এমন কোনও সম্পর্ক নেই যা প্রশ্নবিদ্ধ হয় না। এমনকি বৈধ প্রেম, বৈধ বিয়ে—সবই প্রশ্ন তোলে। আমরা তো সেই রাস্তার মানুষই নই। আমরা তো সেই রেললাইনের মতো—যেখানে এখন আর ট্রেন চলে না, কিন্তু কারও কারও স্মৃতি হয়ে রয়ে যায়।”

“আপনি তাহলে চান, আমরা স্মৃতি হয়ে যাই?”

“না। আমি চাই, তুমি নিজের ভবিষ্যতের আলোয় হাঁটো। আমি পাশে থাকব, হয়তো নয়। কিন্তু আমার উপস্থিতি তোমার সত্তার ছায়া হয়ে থাকুক, যেখানে তুমি নেই, আমি আছি।”

“এতখানি দূরে থেকে ভালোবাসা যায়?”

“হয়। আমি তো সেই ভালোবাসাই শিখেছি। উপস্থিতি দিয়ে নয়, অনুপস্থিতির মধ্যেও প্রেম কীভাবে রয়ে যায়, সেটা জানি। আর আজকের পৃথিবীতে যেটা থেকে যায়—তা-ই সত্য।”

অর্ণব চেয়ে রইল মীরার চোখে। বুঝতে পারছিল, এই প্রেম, এই সম্পর্ক, কোনো প্যাটার্নে ফেলা যায় না। একে সংসার বললে অপমান হয়, বন্ধুত্ব বললে কম পড়ে যায়, প্রেম বললে সমাজ তিরস্কার করে। কিন্তু এই অনুভবটা আছে, গভীরভাবে, রক্তের মধ্যে।

“আপনি কি কখনও আমাকে মনে করে চুপ করে বসে থাকেন?” অর্ণব হঠাৎ জিজ্ঞেস করল।

“প্রতিদিন,” মীরা বললেন। “রাত্রে ঘুমোতে যাওয়ার আগে, চায়ের কাপে ঠোঁট ছোঁয়ানোর মুহূর্তে, এমনকি ট্রামে বসেও তোমার কথা ভাবি। তবে সেসব কথা আমি কারও সঙ্গে ভাগ করি না।”

“তাহলে আপনি আমাকে ভালোবাসেন?”

মীরা হাসলেন। “ভালোবাসা তো জিজ্ঞেস করার বিষয় নয়, ওটা প্রমাণ করারও নয়। ওটা জানার। যদি তুমি জানতে, তাহলে বুঝতে—আমি তো অনেক আগেই ভালোবেসেছি। শুধু বলিনি।”

সেদিন মীরা আর অর্ণব একসঙ্গে হেঁটেছিল কলেজ থেকে বেরিয়ে রাস্তায়, যেমন আগেও অনেকবার হেঁটেছে। কিন্তু আজকের হাঁটার মধ্যে ছিল একটা চুপচাপ সম্মতি। কেউ কিছু চায়নি, কেউ কিছু চায়ওনি। কেবল দু’জন মানুষ, একটানা সম্পর্কের ছায়ায় হাঁটছিল একসঙ্গে, যেন তারা জানে—এই এক হাঁটাই যথেষ্ট।

সেদিন আকাশে মেঘ ছিল, হালকা। তবে বৃষ্টি নামেনি। কিন্তু বাতাসের ভিতরে ছিল একটা ভিজে গন্ধ, যেমন প্রেমের ভিতরেও একটা অনুচ্চারিত বিষণ্ণতা লেগে থাকে।

সেদিন তারা বিদায় নিল বারান্দার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে। অর্ণব বলল, “আমি আবার আসব।”

মীরা বললেন, “তুমি আসবে। কিন্তু যদি না-ও আসো, তবু আমি থাকব। যেখানে তুমি নেই, আমি আছি।”

শেষবারের মতো

প্রতিটি প্রেমের একটা নির্দিষ্ট মুখ আছে, একটা নির্দিষ্ট ঘ্রাণ, এমনকি একটা নির্দিষ্ট ঋতুও। অর্ণব যখন সেই দিন সকালে কলেজ চত্বরে পা রাখল, তখন বুঝতে পারছিল না আজকের দিনটা ঠিক কী নিয়ে আসতে চলেছে। হেমন্ত প্রায় বিদায় নিচ্ছে, শীতের ঝাঁঝ নেমে এসেছে বাতাসে। গাছের পাতাগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, মাটিতে পড়ে একেকটা পাতা যেন একেকটা পুরনো কথা হয়ে ছড়িয়ে আছে।

মীরা আজ কলেজে আসেননি। ক্লাস বাতিল হয়ে গেছে। সহপাঠীরা ব্যস্ত নিজেদের কাজে, কেউ বই পড়ছে, কেউ গল্প করছে, কিন্তু অর্ণব কেবল বসে আছে লাইব্রেরির পুরনো বেঞ্চে—চুপ করে, ভেতরে কেমন এক অজানা আশঙ্কা নিয়ে।

হঠাৎ ফোনটা বাজল। স্ক্রিনে নামটা দেখে তার হৃদস্পন্দন থেমে গেল। “Meera Sen (Home)”

ধীরে ফোন তুলল। ওপারে একজন অচেনা পুরুষের গলা, ভদ্র অথচ ক্লান্ত।

“তুমি কি অর্ণব?”

“হ্যাঁ… কে বলছেন?”

“আমি দীপ, মীরার ছোট ভাই। উনি তোমার কথা অনেক বলতেন। আসলে আজ ভোরে… উনি হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক করলেন। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, কিন্তু…”

অর্ণব কিছু শুনতে পাচ্ছিল না এরপর। ফোনটা কবে কেটে গেছে, কে চলে গেছে পাশ দিয়ে, কে ডাকছে—সব কিছু কেমন থেমে গিয়েছে তার চেতনায়। শুধু মাথার ভিতর একটা কথা বাজছিল, “শেষবারের মতো বলিনি যে আমি ভালোবাসি…”

দুদিন পর, অর্ণব সেই একই পথে হাঁটছিল যেদিন প্রথমবার মীরা তার হাতে কফির কাপ দিয়েছিলেন। সেই বটতলা, সেই করিডোর, সেই ক্লাসরুম—সব ছিল, শুধু মীরা ছিলেন না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, মীরার গন্ধটা যেন ঠিক রয়ে গেছে কোথাও। যেন তার উপস্থিতি এখনও দেয়ালে, জানালায়, কাঠের চেয়ারগুলোতে লেগে আছে।

তারপর হঠাৎ মনে পড়ে গেল—মীরা একবার বলেছিলেন, “আমার বারান্দায় দুটো চেয়ার আছে। একটা আমার জন্য, একটা তোমার জন্য। যদি কোনোদিন আমি না থাকি, তুমি এসো, বসে থেকো। আমার গাছগুলোর সঙ্গে একটু কথা বলো।”

অর্ণব সেদিন বিকেলেই গিয়েছিল মীরার ফ্ল্যাটে। দীপ তাকে চুপচাপ ঢুকতে দিল। ঘরটা সাজানো ছিল যথারীতি—বই, মাটি দিয়ে বানানো প্রদীপ, আর মাঝখানে রাখা একটা চেয়ারে একটা কম্বল ঝুলছে—যেন মীরা কিছুক্ষণ আগেই উঠে গেছেন।

বারান্দায় গিয়ে অর্ণব দেখল—দুটো চেয়ার। একটাতে বসে সে অন্যটার দিকে তাকিয়ে রইল। গাছগুলো নড়ছিল হালকা হাওয়ায়। অর্ণব ধীরে বলল, “আপনি তো বলেছিলেন আমি যদি না আসি, তবু আপনি থাকবেন। কিন্তু আপনি তো সত্যিই চলে গেলেন…”

তারপর সে বের করল সেই কবিতার খাতা, যেটা সে গোপনে লিখে রাখত। মীরাকে উৎসর্গ করা প্রতিটি লাইন আজ যেন ব্যথা হয়ে উঠেছে।

“আজ আমি চুপচাপ বসে থাকি
আপনার ফাঁকা চেয়ারের দিকে,
আপনি নেই—তবু এই দুপুরে
আপনার কপালের টিপ ঝিলিক দেয় আমার চোখে।”

সেই রাতে অর্ণব নিজের নোটবুকে শেষবারের মতো একটা চিঠি লিখল, মীরার উদ্দেশ্যে—

“প্রিয় মীরা,
তুমি চলে গেলে, আর কোনো নামহীন সম্পর্ক থাকল না। তুমি বলেছিলে, আমি যেন তোমাকে কোনো সংজ্ঞা না দিই, কোনো দাবি না রাখি। আমি রেখিনি। কিন্তু আজ, আমি তোমার নামটাই আমার ভিতরে রেখে দিলাম—চুপচাপ, হৃদয়ের কোণে। তুমি হয়তো ভাবতে পারো, এটা কোনো শেষ নয়, কেবল এক বিচ্ছিন্নতা। কিন্তু আমার কাছে এই দূরত্বটাই অনন্ত।

তোমার চা-র কাপের পাশে আমি বসে আছি এখনো। জানি, তুমি ফিরে আসবে না। তবু সন্ধে হলে মনে হয়, তুমি চলে গেছ, না—তুমি রয়ে গেছ এক রাত্রির আলোয়, বারান্দার বাতাসে।

তোমাকে ভালোবাসি। কখনো উচ্চারণ করিনি, আজ করলাম—শেষবারের মতো।

অর্ণব”

ছ’মাস পর অর্ণব কলেজ ছেড়ে দিল। শহর ছেড়ে চলে গেল অন্য এক জায়গায়। শিক্ষকতা শুরু করল একটা ছোট শহরের কলেজে। খুব চুপচাপ জীবন, কোনও জাঁক নেই, কোনও গর্ব নেই। সে এখন ক্লাসে ঢোকে, কবিতা পড়ে—যেমনটা মীরা করতেন।

তবে তার ডেস্কে একটা জিনিস থাকে সবসময়—একটা ছোট ছবির ফ্রেম। তাতে লেখা—
“Where you are not, I am.”

ছাত্ররা জিজ্ঞেস করে না, সে উত্তরও দেয় না। তবু কেউ কেউ জানে, ওটা একটা অসমাপ্ত প্রেমের চিহ্ন। কেউ একজন ছিল, যিনি ছিলেন, আছেন, থাকবেন—চুপ করে, সব শব্দের ওপারে।

এইভাবেই প্রেম থেকে যায়—শেষবারের মতো হলেও।

[সমাপ্ত]

1000019219.jpg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *