অর্পণ মিত্র
অধ্যায় ১:
নদীয়া জেলার শেষপ্রান্তে, যেন জগতের চিহ্নহীন কোলঘেঁষে টিকে থাকা এক গ্রাম—ঘোনা। মাটির ঘর, সরু কাঁচা রাস্তা, ছেলেপুলেদের পায়ে ধুলো আর মহিলাদের দুপুরবেলার জলে কলস নামানো—সব কিছুতেই একটা ধীর, অলস অথচ স্থির সময় জমে আছে। এই গ্রাম ঘিরে রয়েছে বিশাল এক বাঁশবন, যার গভীরে সূর্যের আলো ঢোকে না ঠিকঠাক। সেই বাঁশবনকেই ঘোনা গ্রামে লোকে ডাকে “অভিশপ্ত বন” নামে। একসময় সেই বনের ভেতরে কেউ যদি হারিয়ে যেত, মানুষ বলত, বাঁশের দেবতা রেগে গেছে। যেই বন মানুষের দুঃস্বপ্ন, সেই বনেই এক ভোরবেলা খবর ছড়িয়ে পড়ে আগুনের মতো—নন্দু পাল মারা গেছে। কাঠমিস্ত্রি হিসেবে চেনা, চুপচাপ জীবনযাপন করত। কিন্তু ভোরে জঙ্গলে গরু খুঁজতে গিয়ে চাষা রতন মণ্ডল দেখে—নন্দুর দেহ পড়ে আছে বাঁশের পাতায় ছাওয়া এক জায়গায়। গলা শক্ত হয়ে আছে, চোখ দুটো ফাঁক করা, যেন মৃত্যুর আগে কোনো অসম্ভব ভয়ের দিকে তাকিয়েছিল। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়—তার গলায় বাঁশের পাতার তৈরি মালা। মুহূর্তেই গোটা গ্রাম ছুটে আসে সেই জায়গায়। কেউ গঙ্গাজল ছিটিয়ে পাথরে নাম লিখে সরে যায়, কেউ আবার কাঁদতে কাঁদতে বলে—”শুধু শুরু হয়েছে, বাঁশবাবার অভিশাপ এবার সবার ঘাড়ে পড়বে।”
অমল দত্ত ঠিক সেদিনই বাঁশঝাড়ের ধারের খালের ধারে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন। অবসরপ্রাপ্ত পুলিশের চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন বছর পাঁচেক আগে। কলকাতা ছেড়ে এই দূরদূরান্তের শান্ত গ্রামে এসে একা থাকেন। স্ত্রীর মৃত্যুর পর শহরের কোলাহল তার কাছে বিষাক্ত মনে হয়েছে। কিন্তু আজ এই ঘটনায় তার দীর্ঘ দিনের অভ্যাস, সন্দেহের চোখ, যুক্তির চিন্তা—সব এক লাফে জেগে উঠল। তিনি এক কোণ থেকে ঘটনাটা লক্ষ করলেন, দেখলেন মৃতদেহ, গ্রামের মানুষের মুখে কুসংস্কারের গুঞ্জন। অমলবাবুর চোখে ধরা পড়ে একটা অদ্ভুত অমিল—নন্দুর পা দুটো শক্ত হয়ে গিয়েছে, দেহে ছিল না কোনো দাগ বা রক্তের চিহ্ন, আর বাঁশপাতার মালাটা ছিল এমনভাবে বাঁধা, যেন তা রীতিমতো সাজিয়ে পরানো হয়েছে। কেউ কি এত নিখুঁতভাবে একটা কুসংস্কারের ছায়া ব্যবহার করে খুন করতে পারে? পঞ্চায়েত প্রধান হারানবাবু এলেন, থানা থেকে একজন কনস্টেবল এসে ছবি তুলে চলে গেল। কিন্তু কোনো ময়নাতদন্ত, কোনো সন্দেহ, কোনো অপরাধের ইঙ্গিত নেই—সবাই বলছে, “বাঁশের দেবতা রুষ্ট।” অমলবাবু সেই রাতে খাটে শুয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখলেন বাঁশবনের গায়ে একটা সাদা কাপড় বাতাসে দুলছে, যেন কেউ সঙ্কেত দিচ্ছে অদৃশ্য অন্ধকারের দিকে।
পরের দিন সকাল হতেই অমলবাবু গ্রামে ঘুরে ঘুরে খোঁজ নেওয়া শুরু করলেন। তিনি জানেন, কুসংস্কার যেমন মানুষকে অন্ধ করে, তেমনই সুযোগসন্ধানীরা সেই অন্ধকারে লুকিয়ে থাকে। রতন মণ্ডলের সঙ্গে কথা বলে জানলেন, নন্দু বনপথে যাওয়ার কোনও কারণ ছিল না সেই ভোরে। কেউ যদি তাকে জোর করে সেখানে নিয়ে যায়, তবে তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল সেই ব্যক্তির। কিন্তু নন্দু তো গ্রামে কারো সঙ্গেই বিশেষ মিশত না। তবে একটা গুঞ্জন আছে—নন্দু নাকি বছর তিনেক আগে কারো সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে জেল খেটেছিল। অমলবাবু সেই ফাইলে হাত দিতে চান, কিন্তু স্থানীয় থানা বলছে, “মামলাটা পুরোনো, কাগজপত্র ফাইলেই নেই।” এর মধ্যেই গ্রামের ভিতরে ছড়িয়ে পড়েছে আরো গুজব—”নন্দুর মৃতদেহ বাঁশবাবার গাছের নীচে পড়ে ছিল, ওখানে কেউ যাওয়া তো দূর, তাকালেও নাকি পাপ লাগে!” অমলবাবু চুপচাপ ভাবে, পাপের সংজ্ঞা যারা বানায়, খুনিরা তাদের মধ্যেই কোথাও লুকিয়ে থাকে। সেই রাতে অমলবাবু বাঁশবনের ধারে বসে থাকেন অনেকক্ষণ, পায়ের কাছে পড়ে থাকে এক টুকরো ভেজা পাতা, আর অদূরে থেকে ভেসে আসে একটা কিশোর কণ্ঠস্বর—ভোলা—”বাবু, আমি কিছু দেখেছিলাম ওই রাতে… কিন্তু কেউ বিশ্বাস করবে না।”
অধ্যায় ২:
নন্দুর মৃত্যুর রেশ কাটতে না কাটতেই ঠিক পাঁচদিন পর, এক সকালে আবার ছড়িয়ে পড়ল চাঞ্চল্যকর খবর—একটি মেয়ের মৃতদেহ পাওয়া গেছে বাঁশবনের ভেতর, ঠিক সেই একই স্টাইল, গলায় বাঁশের পাতার মালা। নাম ঝর্না মণ্ডল, স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রান্নার কাজ করত। বছর বাইশের শান্ত স্বভাবের মেয়ে, গ্রামের অধিকাংশ মানুষই তাকে পছন্দ করত। সে নিয়ম করে স্কুলে যেত, দুপুরে মিড-ডে মিল রান্না করত, তারপর দুপুরে মাঠে বসে বাচ্চাদের গল্প বলত। তার কোনো শত্রুতা নেই, কারো সঙ্গে ঝামেলা নেই—তাহলে সে কেন? পুলিশ এসে দেহ উদ্ধার করে, এবং আবার একই কথা: “দেবতা রুষ্ট, ও বাঁশবনের গাছের কাছেই তো গেছিল।” কেউ কেউ বলে, সে বুঝি গিয়েছিল গোপনে কারও সঙ্গে দেখা করতে, তাই এত সকালে জঙ্গলে ঢুকেছিল। চৈতালি হালদার, গ্রামের স্কুলশিক্ষিকা, এই মৃত্যুর পর প্রথমবার মুখ খুললেন সভায়—“এটা খুন, অভিশাপ নয়। গলায় একই মালা, মুখে ভয়ের ছাপ—একই পদ্ধতিতে, একই স্থানে মৃত্যুর ঘটনাকে কাকতালীয় বলা যায় না।” কিন্তু হারানবাবু, পঞ্চায়েত প্রধান, কথা কাটালেন, “এইসব শহুরে যুক্তি গ্রামে চলে না, চৈতালি। বাঁশবাবার বিধান মানতেই হবে।”
অমলবাবু এবার দৃঢ়ভাবে তদন্ত শুরু করলেন নিজের মতো করে। তিনি লক্ষ্য করলেন—নন্দুর আর ঝর্নার মধ্যে কোনো সরাসরি যোগাযোগ নেই, কিন্তু দুজনেই গ্রামে কিছুটা একা এবং সমাজের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন। নন্দুর অতীত ঘোলা, আর ঝর্না ছিল অনাথ—মামার বাড়িতে মানুষ। কিছু কিশোর-কিশোরীর মুখে গুজব শোনা যায়, ঝর্নার কেউ একজনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল—কে সেই ব্যক্তি, কেউ বলতেই চায় না। চৈতালিকে আলাদা করে জিজ্ঞাসা করলে সে চোখ নিচু করে বলে, “ঝর্না একবার আকারে-ইঙ্গিতে বলেছিল, কেউ একজন স্কুলের বাইরেই তাকে রোজ দেখে যায়, কিন্তু সে ভয় পায় বলেই কিছু বলে না।” এই কথার সূত্র ধরেই অমলবাবু রাতের বেলা বাঁশবনের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন, একা। গভীর রাতের নিস্তব্ধতায় বাঁশের পাতায় হাওয়ার শব্দেও যেন কারো ফিসফিসানি শোনা যায়। ঠিক তখনই দূরে একটা আলো ভেসে উঠল, মাটির দিকে ঝুঁকে রাখা টর্চ। সাথে একটা সাদা কাপড়, যেন কারো কাঁধে ঝোলানো। যখন তিনি ছায়ামূর্তিটির দিকে এগিয়ে গেলেন, তখন সেটা হঠাৎ করেই অদৃশ্য হয়ে গেল বাঁশের ভেতরে। পেছনে পড়ে থাকল একটা আধা-ঘষা বাঁশপাতা, যেটি একপাশে আলগা হয়ে পড়েছিল, যেন কেউ মালা বানাতে গিয়ে ফেলে গেছে।
পরের দিন সকালে যখন গোটা গ্রাম আবার মৃতদেহ নিয়ে ব্যস্ত, অমলবাবু নীরবে ঘুরে ঘুরে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন — কে কী বলছে, কার চোখে আতঙ্ক, কার মুখে অস্বস্তি। তিনি লক্ষ্য করলেন, কিছু মুখ ঝুলে আছে, যেন তারা জানে কিছু, বলতে চায় না। ঠিক সেই মুহূর্তে এক কোণে বসে থাকা ভোলা, সেই ষোলো বছরের কিশোর, চোখ ফাঁক করে তাকিয়ে বলল, “বাবু, আমি আবারও কিছু দেখেছি। কিন্তু কিচ্ছু বললে সবাই বলবে আমি ভূত দেখেছি।” অমলবাবু ওকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলেন, চুপচাপ চা খেতে খেতে জানতে চাইলেন—কি দেখেছিল? ভোলা বলল, “আমি সেদিন ভোরবেলা বাঁশবনের ধারে ঘাস কাটছিলাম, হঠাৎ শুনি পাতার ভেতর কিছু নড়াচড়া। আমি দেখলাম একটা লম্বা মানুষ, সাদা কাপড়ের পেছনে মুখ ঢেকে, বাঁশের পাতার মতো কিছু গাঁথছে। গলায় মুখোশ। তারপর সে কিছুক্ষণ বসে থেকে এক জায়গায় কিছু রেখে চলে গেল।” অমলবাবুর বুকের মধ্যে ধাক্কা লাগল—খুনি তার পরবর্তী হত্যা পরিকল্পনা বানিয়ে গেছে। ভোলার চোখের ভয় সত্য বলে মনে হলো। আর সবথেকে বড়ো ব্যাপার—খুনি জানে, গ্রামের লোকেরা ভয় পায়, তাই সে সেই ভয়কে নিজেই হাতিয়ার করে তুলেছে। এবার খুনি আর নিজেকে লুকিয়ে রাখবে না, বরং নিজের পরিকল্পনার পরবর্তী স্তরে যাচ্ছে—আর হয়তো খুনও করবেই। অমলবাবু জানেন, সময় কম।
অধ্যায় ৩:
ঘোনার মানুষজন তখন দুটো মৃত্যুর পর এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছে, যেখানে কুসংস্কারই বাস্তবের চেয়ে প্রভাবশালী। নন্দুর মৃত্যুকে কেউ একজন ‘অভিশাপ’ বললেও, ঝর্নার মৃত্যুর পর তা রূপ নেয় নিছক আতঙ্কে। গ্রামের প্রাচীন বাঁশবাবার গাছের সামনে মোমবাতি, প্রদীপ, নারকেল, ধূপকাঠি দিয়ে নিয়মিত পুজো শুরু হয়, যেন রক্তের গন্ধে জেগে ওঠা দেবতাকে ঠান্ডা রাখা যায়। এর মাঝেই ওঝা শংকর মালো দৃশ্যপটে এসে ঘোষণা দিলেন—”তিনটে শাস্তি আসবে, তিনটে মৃত্যুর দ্বারা—এই অভিশপ্ত বাঁশবনের মধ্যেই। কারণ পাপ ছিল তিনজনের। আমি দেবতার ভাষা বুঝি, আর ওনার রোষ এখনো থামেনি।” গ্রামের লোক যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল—কোনো যুক্তির ব্যাখ্যা নয়, বরং ওঝার জ্যোতিষ-ভবিষ্যৎই তারা বিশ্বাস করতে চায়। অমলবাবু আশ্চর্য হয়ে দেখেন, শংকর এই তিনটি মৃত্যু ‘পুরনো পাপের প্রতিশোধ’ বলে প্রচার করতে শুরু করেছে, যেন সে নিজে কোনো অদৃশ্য মহাজ্ঞানের বাহক। অথচ, একদা এক অসুস্থ মহিলাকে জ্বিন ঢুকেছে বলে জোর করে পুজো করিয়ে অসুস্থতাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল সেই শংকর—এই মানুষটাই এখন দেবতার ভাষ্যপাঠক! কিন্তু তার আচরণে হঠাৎ যেন একটা অস্বাভাবিক শীতলতা এসেছে। সে নিজেই আর বাঁশবনের কাছে যেতে চায় না। অমলবাবু ঠাওর করতে পারেন, সে কাউকে ভয় পাচ্ছে—হয়তো নিজের তৈরি করা ‘দেবতা’র থেকেও বড় কোনো বাস্তব শত্রুকে।
এক রাত গভীর ঘুমের মধ্যে গ্রামের উপান্তের এক মহিলা চেঁচিয়ে উঠলেন, “বাঁশবনের দিক থেকে কেউ ডাকছে!” সকালে যখন খবর ছড়ায়, তখন আর কেউ আশ্চর্য হয় না—তৃতীয় খুন হয়ে গেছে। এবং মৃত ব্যক্তি আর কেউ নয়, শংকর মালো নিজেই। তার মৃতদেহ পাওয়া গেল বাঁশবনের ঠিক মধ্যে, যেখানে বাঁশবাবার পুরনো পুজোর স্থান ছিল। মুখ থেঁতলে দেওয়া, কিন্তু গলায় আবার সেই একই বাঁশপাতার মালা। আশ্চর্যের বিষয়—তার কপালে সিঁদুরের দাগ, যেটা গ্রামের রীতিতে শুধুমাত্র ‘পঞ্চপাত্রে শাস্তি’-র প্রতীক হিসেবে ব্যবহার হয়। কেউ কেউ ফিসফিস করে বলল—“তিন নম্বর পূর্ণ হলো। এখন শান্তি হবে।” কিন্তু অমলবাবুর মাথায় প্রশ্নের পর প্রশ্ন। শংকর তো নিজেই বলেছিল তিনজন মরবে, অথচ সেই তৃতীয় জন হয়ে গেল সে নিজেই? সে কি জানত নিজের মৃত্যুও আসন্ন? নাকি সে কিছু ‘দেখে ফেলেছিল’? বাঁশপাতার মালা এবার গলায় শুধু নয়—তার ডান হাতে শক্ত করে পেঁচানো ছিল, যেন সে কিছু ধরতে চাইছিল, বা কাউকে থামাতে চাইছিল। এই অদ্ভুত পরিস্থিতি দেখে থানার ইনচার্জ বিপ্লব রায় পর্যন্ত নড়ে বসেন—তিনি এতদিন এই কেসকে শুধুই ‘লোকাল কুসংস্কার’ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, এখন বুঝতে পারেন এর পেছনে ঠান্ডা মাথার কোনো মন কাজ করছে। অমলবাবু বলেন, “তিনজন খুন হয়েছে, আর আপনি এখনো ময়নাতদন্ত না করে বসে থাকেন? শুধু বিশ্বাস না, যুক্তিও চলতে হবে।” বিপ্লব এবার সহানুভূতির সুরে বলেন, “আপনি কেসটা ভালো বুঝছেন, দয়া করে সাহায্য করুন।”
ওই রাতেই চৈতালি আর অমলবাবু বসে থাকেন বাঁশবনের পাশে। তাদের মনে একটা সন্দেহ ঘনিয়ে আসে—তিনটি খুনের পেছনে একটা নির্দিষ্ট নকশা আছে। প্রতিটি খুন হয়েছে বাঁশবনের আলাদা অংশে, কিন্তু দূরত্বের দিক থেকে দেখলে একটা ত্রিভুজের মতো গঠন করে। এবং সেই ত্রিভুজের কেন্দ্রবিন্দুতে পড়ে গ্রামের এক পুরনো তালাবদ্ধ ভাঙা কুটির, যেটা এক দশক ধরে বন্ধ। কুটিরটি ছিল এক সময়কার স্কুল শিক্ষক বিশ্বজিৎ সরকারের বাবার। কথিত আছে, তার একমাত্র মেয়ে ছোটোবেলায় সবার অপমান সয়ে একদিন বাঁশবনের কাছেই আত্মহত্যা করেছিল। আর তারপর থেকেই ও বাড়িতে কেউ থাকত না। চৈতালি ধীরে বলে, “তিনটে খুন, তিনটে বাঁশপাতার মালা, তিনজনের কোনো যোগসূত্র বাইরে নেই—কিন্তু ভিতরে?” অমলবাবুর চোখে ততক্ষণে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে এক প্রশ্ন—এই তিনজন কি সেই পুরনো আত্মহত্যা মামলার কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ জড়িত ব্যক্তি? তাহলে কি এই খুন শুধুই খুন নয়—এ এক প্রতিশোধ? হয়তো পরবর্তী খুনের প্রস্তুতিও চলেছে, শুধু অপেক্ষা চলছে ‘ভয়’কে আরও দৃঢ় করে তোলার জন্য।
অধ্যায় ৪:
তিনটি খুনের পর গ্রামে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল, যেন কোনো অশরীরী উপস্থিতি চারদিকে ছায়ার মতো ঘুরছে। বাঁশবনের ধার দিয়ে হাঁটার সাহস কেউ আর করত না। ছোটো ছেলেমেয়েদের সন্ধ্যার আগেই ঘরে ডেকে আনা হতো, আর রাত নামলেই পুরো গ্রাম জেগে থাকত আশঙ্কায়। কিন্তু এসবের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল চৈতালি হালদার—এই গ্রামের স্কুলশিক্ষিকা, বছর আটাশের শহুরে মেয়ে, যাকে গ্রামের মানুষ “পড়া-পাগলি মাই” বলেই ডাকত। তার মনে হচ্ছিল, এই ভয়, এই অন্ধবিশ্বাস আসলে এক বিশাল পর্দা—যার আড়ালে চলছে এক নিষ্ঠুর খেলার পরিকল্পনা। তিনি অমলবাবুকে নিয়ে আবারও যেতে চাইলেন সেই পুরনো স্কুলঘরের পেছনের ভাঙা কুটিরটায়, যেটা তাদের সন্দেহের কেন্দ্রে ছিল। বিকেলের শেষ আলোয় কুটিরে ঢুকে দুজনেই লক্ষ্য করলেন—মেঝেতে এক কোণায় ছাই পড়ে আছে, যেন সম্প্রতি সেখানে আগুন জ্বালানো হয়েছে। একটা কাঁচের বোতল, আধখালি বাতির ঘাঁটি, আর বাঁশপাতার শুকনো স্তূপ… যেন কেউ এখানে মালা বানিয়ে গেছে। চৈতালি নিচু গলায় বললেন, “এইখানে কেউ বসে রীতিমতো পরিকল্পনা করছে। যে ব্যক্তি এই সব করছে, সে হয় এই গ্রামেই থাকে, অথবা খুব কাছের কেউ।” অমলবাবুর মুখের অভিব্যক্তি তখন অদ্ভুত রকম কঠিন হয়ে আছে। তিনি মনে মনে বুঝতে পারছিলেন—তিনটি মৃত্যুর কোনো না কোনোভাবে একটাই মূল সূত্র আছে, শুধু তাকে জোড়া দিতে পারলেই রহস্য ফাঁস হবে।
চৈতালির স্মৃতিতে ভেসে উঠছিল ঝর্নার শেষ কয়েকটা দিনের কথোপকথন। একদিন স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঝর্না তাকে বলেছিল, “আপু, আপনি তো বুঝবেন… কারো কিছু বললে যদি পুরো গ্রামই আমার শত্রু হয়ে যায়, তবু কি বলা উচিত?” চৈতালি তাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলেও ঝর্না নাম বলেনি। এখন সব মিলিয়ে সেই কথাগুলোর মানে আরও বেশি করে অনুভব করতে পারছেন তিনি। হয়তো ঝর্না কিছু জেনে গিয়েছিল, হয়তো সে কারো ভয়ানক গোপন কথা জানত—আর সেই কারণেই তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর এই ‘সরিয়ে দেওয়া’—কোনো তাৎক্ষণিক রাগের খুন নয়, বরং সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। চৈতালি আর অমলবাবু দু’জনে মিলে স্থানীয় থানার পুরনো ফাইল ঘেঁটে জানার চেষ্টা করলেন, দশ বছর আগের কোনো আত্মহত্যার রেকর্ড আছে কি না। অবশেষে, অনেক কষ্টে একটি প্যাচানো পুরনো ডায়েরিতে একটি নোটিশ খুঁজে পাওয়া গেল—“মীনাক্ষী সরকার, বয়স ১৫, আত্মহত্যা করেছে বাঁশবনের গাছে ঝুলে।” আত্মহত্যার কারণ হিসেবে লেখা—“পারিবারিক মানসিক চাপ।” কিন্তু ওই ফাইলের পাতার পাশে একটি দাগ কাটা নাম পাওয়া গেল—নন্দু পাল, ঝর্না মণ্ডলের মামা শিবনাথ, ও তান্ত্রিক শংকর মালো—যাদের বয়ান নেওয়া হয়েছিল তখন। অমলবাবুর মুখ তখন ছায়ায় ঢাকা পড়ছে, কিন্তু চোখে ধরা পড়ছে বিদ্যুতের মতো স্পষ্টতা—এরা তিনজনই এখন মৃত।
অমলবাবু গভীর রাতে ফিরে আসার পর নিজের নোটবুক খুলে লিখে চললেন নামগুলো, সংযোগগুলো, প্রতিটি খুনের ধরন। চৈতালি তখন পাশে বসে ধীরে বলে উঠলেন, “আপনি কি ভাবছেন, এই তিনজনই কোনোভাবে দায়ী ছিল সেই কিশোরীর মৃত্যুর জন্য?” অমলবাবু চুপ করে মাথা নাড়লেন। চৈতালি যুক্তি করে ভাবলেন—যদি কোনো আত্মীয় বা ঘনিষ্ঠ সেই কিশোরীর মৃত্যুকে এত বছর মনে রেখে প্রতিশোধ নিচ্ছে, তবে সে ব্যক্তি হতে পারে বয়সে তরুণ, কিন্তু মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ও ঠান্ডা মাথার। এমন একজন, যাকে গ্রামে সবাই হয়তো চেনে, কিন্তু কেউ সন্দেহ করে না। ঠিক তখনই দরজার নিচে দিয়ে গড়িয়ে আসে এক টুকরো কাগজ—তাতে লেখা, “শেষ খেলা এখনো বাকি আছে।” অমলবাবু তৎক্ষণাৎ ছুটে যান বাইরে, কেউ নেই, শুধু দূরে বাঁশবনের দিকে কোনো অচেনা ছায়া সরে যায়—আর সেই বাতাসে বাঁশপাতার কড়কড় শব্দ যেন হয়ে ওঠে কণ্ঠস্বর… “শেষ মালা কার গলায় যাবে, সেটা তুমি ঠিক করতে পারবে না।”
অধ্যায় ৫:
ঘোনার মাটিতে যেন অতীত আর বর্তমান একই সুতোয় জড়িয়ে পড়ছে। তিনটি মৃত্যু আর একটি আত্মহত্যার ছায়া যখন একে একে মেলতে শুরু করেছে, তখন অমল দত্ত বুঝলেন—তাঁর সামনে কেবল খুনের কেস নয়, এটা এক মানসিক পুনর্নির্মাণ, যেখানে কেউ আইন বা আদালতের প্রতীক্ষা না করে নিজেই শাস্তি দিচ্ছে সেইসব ‘অপরাধী’দের, যাদের বিরুদ্ধে হয়তো কোনোদিন প্রমাণ মেলেনি। চৈতালির বিশ্লেষণে উঠে এসেছিল একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট—তিনজন মৃতের প্রত্যেকেই ছিল কোনো না কোনোভাবে জড়িত সেই বছর দশেক আগে ঘটে যাওয়া আত্মহত্যা মামলায়। নন্দু পাল সেই সময়কার স্থানীয় বখাটে হিসেবে পরিচিত ছিল, ঝর্নার মামা শিবনাথ ছিলেন মেয়েটির মামলায় নীরব চাপদাতা—যে তাকে পরিবারে ‘লজ্জা’ বলে ট্যাগ করেছিল। শংকর ছিল এক ধরনের তান্ত্রিক সন্ত্রাসের অস্ত্র, যে মেয়েটির পরিবারকে বোঝায়—ওর শরীরে অপদেবতা ঢুকেছে। ফলে সেই আত্মহত্যার দায় হয়তো আইনের চোখে কেউ নেয়নি, কিন্তু কেউ একজন মনের ভিতরে সেই বিচার কোর্ট খুলে বসেছিল—আর এখন, একে একে রায় কার্যকর করছে। অমলবাবু সেই কিশোরীর নাম বারবার নোটবুকে লিখে যাচ্ছিলেন—মীনাক্ষী সরকার। তাঁর পাশের চেয়ারে বসা চৈতালি হঠাৎ বলে উঠলেন, “আপনি লক্ষ্য করেছেন? এই তিনটি খুনে একজন ব্যক্তির নাম কোথাও উচ্চারিত হচ্ছে না, অথচ হয়তো সে-ই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—মীনাক্ষীর দাদা, বিশ্বজিৎ।” সেই নামেই যেন সময় থেমে যায়। অমলবাবু ধীরে বলেন, “হ্যাঁ, আমি তাকেই খুঁজছিলাম।”
বিশ্বজিৎ সরকার—যার কথা আজ আর কেউ বলে না, আর কেউ মনে রাখেও না। সে ছিল মীনাক্ষীর দাদা, শহরে পড়াশোনা করতে গিয়েছিল, আর মেয়েটির মৃত্যুর এক মাস পর গ্রামে ফিরে এসেছিল, তারপর হঠাৎ হারিয়ে যায়। কেউ বলে, সে নাকি মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিল, কেউ বলে সে বাইরে কাজ করতে চলে যায়। চৈতালি বললেন, “আমি গ্রামের এক বৃদ্ধার মুখে শুনেছি, ও এখনো মাঝেমধ্যে গ্রামে আসে, কিন্তু কেউ ঠিকমতো তাকে চিনে না। মুখে দাড়ি, চোখে কালো চশমা, একা একা বাঁশবনের ধারে বসে থাকে। কেউ কাছে গেলে সরে যায়।” অমলবাবুর মনে পড়ে গেল ভোলা তাকে বলেছিল এক মুখোশপরা লোককে পাতার মালা গাঁথতে দেখেছে। তাহলে কি এই বিশ্বজিৎ-ই সেই ছায়ামূর্তি? নিজের বোনের আত্মহত্যার বিচার সে নিজেই করছে? অমলবাবু এবার পুরো গ্রামজুড়ে খোঁজ নিলেন, কিন্তু কেউ সরাসরি বিশ্বজিৎ সম্পর্কে কিছু বলতে রাজি নয়। সেই প্রাচীন কুটির, যার ভেতরে সাম্প্রতিক আগুন জ্বালানোর প্রমাণ ছিল, সেটাই একমাত্র যোগসূত্র হয়ে ওঠে। তারা আবারও সেখানে ফিরে যান—এবার খুঁজে পান মাটির নিচে চাপা দেওয়া একটি পুরনো ডায়েরি, যেটি ছিল মীনাক্ষীর। ছেঁড়া পাতায় লেখা আছে—“আমি কাউকে বলার সাহস পাই না। তারা আমার মুখ বন্ধ করতে চায়। আমি থাকলে পরিবার কলঙ্কিত হবে, আর না থাকলে হয়তো সবাই মুক্তি পাবে। কিন্তু দাদা জানলে কি বলবে?” চৈতালির চোখ ছলছল করে ওঠে, আর অমলবাবু ডায়েরিটি শক্ত করে ধরে থাকেন, যেন তার মুঠোয় এখন শুধু প্রমাণ নয়, বিচারও আছে।
রাত তখন গভীর। অমলবাবু একাই হাঁটছেন বাঁশবনের পথ ধরে। এবার তিনি ভয় পান না, বরং তিনি অপেক্ষায় আছেন সেই ব্যক্তির, যে এতকিছুর নেপথ্যে। ঠিক তখনই সামনের ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল একজন লোক, মাথায় পাগড়ি, মুখে মুখোশ। হাতের আঙুলে বাঁশপাতা গাঁথার সুতা। সে কিছু না বলে দাঁড়িয়ে থাকে। অমলবাবু ধীরে বলেন, “তুমি বিশ্বজিৎ, তাই তো? আমি তোমার বোনের ডায়েরি পড়েছি। সে তোমার কাছে সত্য চেয়েছিল, তুমি কি এখন তাকে শান্তি দিতে পারছো?” মুখোশ খুলে ফেলল লোকটা। মুখ জ্বলে ওঠে ম্লান চাঁদের আলোয়—হ্যাঁ, সে-ই, চোখে এক গভীর শূন্যতা, ঠোঁটে রক্তশূন্য হাসি। “আমি কাউকে খুন করিনি, শুধু শাস্তি দিয়েছি। ওরা মরেছিল বহু আগেই, আমি শুধু তাদের সময় দিলাম শেষ সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর।” অমলবাবু বুঝলেন, এই মানুষটিকে আইনের শৃঙ্খলায় ফেলা যাবে না সহজে—তাঁর নিজের মধ্যে যে ক্ষত, তা কোনো জেল, কোনো ধারা সারাতে পারবে না। কিন্তু তবু তিনি বললেন, “শাস্তি দেওয়ার কাজ রাষ্ট্রের, ব্যক্তির নয়।” বিশ্বজিৎ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, তারপর বলল, “শেষ মালা তো এখনো তৈরি হয়নি। ওটা কার গলায় যাবে, জানেন?” অমলবাবু কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই দূরে আবার ভেসে এল বাঁশপাতার কড়কড় শব্দ—যেন আবার কারো গলার চারপাশে জড়িয়ে পড়তে চলেছে সেই অভিশপ্ত পাতার মালা।
অধ্যায় ৬:
বিশ্বজিতের মুখোমুখি হওয়ার পর অমল দত্তের ভেতরে যে আবেগ, রাগ, কৌতূহল আর দায়বোধ গড়ে উঠেছিল, তা সারারাত তাঁকে ঘুমোতে দেয়নি। তার চিন্তার কেন্দ্রে ছিল শুধু একটি প্রশ্ন—”শেষ মালা” কার জন্য? বিশ্বজিৎ যে এখানেই থামবে না, তা নিশ্চিত। সকালে চৈতালি এলেন বাড়িতে। অমলবাবুর মুখ দেখে বুঝে গেলেন—কিছু একটা ঘটেছে। তিনি ধীরে ধীরে সবটা বললেন, মুখোশের আড়ালে থাকা সেই চোখ, সেই কণ্ঠস্বরের ভার, আর সবচেয়ে ভয়ানক সেই কথাটি—“শেষ মালা এখনো গাঁথা হয়নি।” চৈতালি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “তাহলে কি… আমি?” এক মুহূর্তের নিস্তব্ধতায় ঘরের বাতাস ভারী হয়ে উঠল। অমলবাবু বললেন, “তুমি কোনোভাবেই দায়ী ছিলে না, কিন্তু হয়তো তুমি এখন সত্যের সবচেয়ে কাছে চলে এসেছ। বিশ্বজিৎ বুঝে গেছে তুমি তাকে চিনে ফেলেছ।” ঠিক তখনই দরজার বাইরে থেকে ভেসে এল একটি কণ্ঠস্বর—ভোলা। কিশোরটি কাঁপতে কাঁপতে বলল, “বাবু… আমি এবার সবটা বুঝে ফেলেছি। আপনি না জানলে আমারও শেষ হয়ে যাবে।”
অমলবাবু আর চৈতালি ভোলাকে নিয়ে বসলেন ঘরের ভিতরে। ছেলেটি একটানা বলতে শুরু করল—“আমি ওই রাতগুলোতে অনেক কিছু দেখেছি, কিন্তু ভয় পেয়েছিলাম বলে কিছু বলিনি। নন্দু কাকু মারা যাওয়ার আগের দিন রাত দশটার সময় আমি বাঁশবনের পাশে গিয়েছিলাম, কারণ আমার একটা ছাগল হারিয়ে গিয়েছিল। তখন দেখি, একটা আলো জ্বলছে একটা কুটিরের জানালা দিয়ে। আমি আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে দেখি—একজন লোক, মুখে মুখোশ, একপাশে কিছু পাতার স্তূপ নিয়ে মালা গাঁথছে। আর তার সামনে তিনটা ছবি—নন্দু কাকু, ঝর্নাদি আর শংকর ওঝা। তিনটে ছবির সামনে আগরবাতি জ্বলছিল।” অমলবাবু শিউরে উঠলেন। “তিনজন আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল?” ভোলা মাথা নাড়ল। “আর হ্যাঁ, বাবু… আমি আরও একটা জিনিস দেখেছিলাম—তার পাশে একটা লাল রঙের খাতায় লেখা ছিল কিছু নাম, আর তার ঠিক নিচে একজন মহিলার ছবি। ওই ছবিটা আমি চিনে ফেলি—ওটা আমাদের স্কুলের মাইস্যার।” চৈতালি ধীরে চোখ বন্ধ করে ফেলেন, যেন মৃত্যুর হাওয়া গায়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। ভোলা হঠাৎ অমলবাবুর হাত চেপে ধরে বলল, “আরও একজনের ছবি ছিল, বাবু… ওটা আপনার ছিল।”
এই বিস্ফোরক তথ্যের সামনে দাঁড়িয়ে অমলবাবু প্রথমবার ঘামে ভিজে গেলেন। তাঁর নিজের নাম—একটি প্রতিশোধপরায়ণ খাতার পাতায়? চৈতালি কিছু বলার আগেই অমলবাবু ধীরে বলে উঠলেন, “তাহলে বিশ্বজিৎ শুধুই বোনের হত্যার প্রতিশোধ নিচ্ছে না। সে মনে করছে, আমরা যারা সত্যের কাছে পৌঁছাচ্ছি, তারাও তার পথের বাধা।” চৈতালি বললেন, “তার মানে ও শুধু অপরাধীদের খুন করছে না—ওর বিচার নিজেই বিকৃত হয়ে গেছে। এখন সত্য জেনেও যদি কেউ সামনে আসে, সেও শাস্তির উপযুক্ত।” অমলবাবু ভাবলেন—এখন আর সময় নেই। পুলিশকে পুরো তথ্য দিয়ে ধরার চেষ্টা করতে গেলে সময় লেগে যাবে। বিশ্বজিতের পরবর্তী আঘাত যে কোনও মুহূর্তে আসতে পারে। চৈতালি একরকম দৃঢ় হয়ে বললেন, “আমাদের ওকে থামাতেই হবে। আমাকে টোপ করতে দিন। আমি কাল স্কুল থেকে ফিরেই ও কুটিরে যাব, আমি জানি ও খেয়াল রাখে।” ভোলাকে একপ্রকার জোর করেই পাঠিয়ে দেওয়া হয় গ্রামের বাইরে কাকার বাড়িতে। অমলবাবু জানেন, এরপরে আর কোনো ভুলের সুযোগ নেই। চৈতালির সামনে দাঁড়িয়ে তিনি কেবল এটুকু বললেন, “যদি কিছু হয়, শুধু মনে রেখো, তুমি ছিলে সাহসের প্রতীক। আমি শেষ অবধি পাশে থাকব… যতদূর যাওয়া যায়।”
অধ্যায় ৭:
পরদিন দুপুরে চৈতালি স্কুল থেকে ফেরার পর সবেমাত্র ব্যাগটা নামিয়ে এক কাপ চা নিয়ে বারান্দায় বসেছেন, এমন সময় ঘরের জানালার ফাঁক দিয়ে তিনি বুঝলেন—কে যেন দূর থেকে তাকিয়ে আছে। পেছনের গলিপথ ধরে সাদা শার্টে ঢাকা লম্বা এক ছায়া, মুখে কাপড়, হাতে কিছু একটা ধরা। চৈতালি বুক ঠুকে গেলেও সাহস হারালেন না। ঘড়িতে তখন সাড়ে চারটা। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে তিনি হাঁটতে লাগলেন বাঁশবনের দিকে—সরাসরি সেই কুটিরের পথ ধরে। অমলবাবু আগেই তাকে জানিয়েছিলেন, তিনি একটু দূরে লুকিয়ে থাকবেন, সঙ্গে থাকবে থানা থেকে বিপ্লব রায়। যদিও পুলিশের উপস্থিতি চৈতালির পছন্দ হয়নি, তবুও অমলবাবুর অনুরোধে রাজি হয়েছিলেন। চৈতালি বুঝতে পারছিলেন—এটাই হয়তো তার জীবনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হাঁটাপথ, যেখানে একপাশে ঘন বাঁশ আর অন্যপাশে এক অন্ধকার কুটির। কুটিরের দরজা ছিল অর্ধেক খোলা। চৈতালি সাহস করে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। চারপাশে স্যাতস্যাতে গন্ধ, মেঝেতে ছেঁড়া পাতা, পুড়ে যাওয়া মোমবাতির শেষাংশ। আর ঠিক এক কোণে বসে সেই মুখোশপরা মানুষ—বিশ্বজিৎ। তার সামনে রাখা আছে একটি নতুন বাঁশপাতার মালা, পাশে রাখা অমলবাবুর ছবি। মুখোশের ফাঁক দিয়ে ঠোঁটের নিচে ক্ষীণ হাসি, “আপনিই এসেছেন, জানতাম।”
চৈতালি কাঁপা গলায় বললেন, “বিশ্বজিৎ, আর কতজন মরলে তোমার প্রতিশোধ শেষ হবে?” বিশ্বজিৎ ধীরে মুখোশ খুলল। তার মুখে ক্লান্তি, চোখে সাদা লাল রক্তবর্ণের সুর। “তুমি জানো না ওদের কীভাবে মেরে ফেলা হয়েছিল। আমার বোন মীনাক্ষী আত্মহত্যা করেনি। ওকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল মৃত্যুর মুখে। যারা তাকে ঘিরে ধরেছিল, অপমান করেছিল, চরিত্রহীন বলেছিল, তন্ত্র-তাবিজে শাস্তি দিতে চেয়েছিল—তাদের কেউই তো ক্ষমা চায়নি। ওর মৃত্যুর পর সবাই আবার নিজের কাজে ফিরে গিয়েছিল, কেউ এক ফোঁটা জল ফেলেনি।” চৈতালি এক পা এগিয়ে বললেন, “তুমি কি জানো, ওর মৃত্যুর পরে আমিও কিছু খুঁজেছি? আমি তখন কলেজে ছিলাম, কিন্তু ফিরে এসে দেখেছি একটা গোটা সমাজ ভুল করে তাকে গিলেছে। আমি যদি তখন এখানে থাকতাম, হয়তো ওকে বাঁচাতে পারতাম।” বিশ্বজিতের চোখ এবার কেঁপে ওঠে। “বাঁচাতে পারতে?”—তার গলায় দুঃখ আর হতাশার মিশ্র সুর। “তাহলে এখন কেন পুলিশ নিয়ে এসেছ?” ঠিক তখনই বাইরে একটা আওয়াজ। বিশ্বজিৎ চট করে বাঁ হাতে কিছু একটা বের করে চৈতালির দিকে তাক করে ধরে, “তুমি ওদের এনেছো, তাই না? তাহলে তোমারও বিচার হবে। তুমি সত্য জানো, কিন্তু তুমি চুপ ছিলে।” চৈতালি ফিসফিস করে বলেন, “তুমি যদি আমাকে বিশ্বাস করো, তাহলে এই মালা আমার গলায় পরিয়ে দাও। দেখো আমি পালাচ্ছি না।”
চৈতালির সেই সাহসিকতায় মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায় বিশ্বজিৎ। মালা হাতে তুলে নেয় সে, কিন্তু সেই মালা চৈতালির গলায় না দিয়ে নিজের মুখের উপর রাখে, চোখ বন্ধ করে বসে পড়ে। সেই মুহূর্তে অমলবাবু আর পুলিশ ভেতরে ঢুকে পড়ে। বিপ্লব রায় বন্দুক তাক করে চেঁচিয়ে উঠলেন, “হাত তুলুন!” কিন্তু বিশ্বজিৎ নড়ল না, বরং ধীরে গলায় বলল, “আমি শাস্তি চেয়েছিলাম, কিন্তু এখন বুঝলাম, আমি নিজের বোনকেই খুন করে ফেলেছি… এতগুলো বছর ধরে। যদি প্রতিশোধই শান্তি দিত, তাহলে এতদিনেও ঘুম আসত।” তার হাত থেকে পড়ে যায় মালা। অমলবাবু ধীরে কাছে গিয়ে তাকে ধরে বসান, আর বলেন, “তুমি বিচারে বিশ্বাস করনি, নিজেই বিচারক হয়েছিলে, কিন্তু যাদের তুমি মারলে, তারা সমাজের ভুলের প্রতিনিধি ছিল—তোমার রাগ ঠিক ছিল, পথটা ভুল।” বিশ্বজিৎ চুপ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আমাকে জেলে নিয়ে যান, বাবু। আমি তো বাঁচতে এসেছিলাম, কিন্তু মরেই গেলাম বহু আগেই।” সেই বিকেলটা ঘোনার ইতিহাসে সবচেয়ে নিঃশব্দ বিকেল হয়ে রয়ে গেল। বাঁশপাতা কেবল আর একবার হালকা হাওয়ায় নড়ল, যেন মীনাক্ষীর আত্মা আজ তার দাদা আর সমাজ দুজনকেই ক্ষমা করে দিয়ে চলে গেল।
অধ্যায় ৮:
ঘোনা যেন ধীরে ধীরে আবার স্বাভাবিকতার দিকে ফিরছে, অন্তত উপরে উপরে। বাঁশবনের পাশ দিয়ে মানুষ আবার হাঁটতে শুরু করেছে, যদিও প্রতিটি পদক্ষেপেই এখনো ভয় লেগে থাকে। ওখানটায় এখনো কেউ সন্ধ্যার পর যায় না, কেউ পেছন ফিরে বাঁশপাতার শব্দ শুনলে গলা শক্ত করে নেয়। কিন্তু প্রকৃত শান্তি এসেছে একজন মানুষে—অমল দত্ত, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার, যিনি নিজের জীবনের শেষতম তদন্তে এক অনভিপ্রেত সত্য খুঁজে পেয়েছিলেন। বিশ্বজিতকে জেলে পাঠানো হয়েছে, এবং সরকারিভাবে তিনটি খুনের কেসে তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু সেই সাথে চৈতালি আর অমলবাবু পুলিশ রিপোর্টে আলাদা করে লিখেছেন মীনাক্ষীর ঘটনার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট—যা হয়তো দেশের আইনের কাঠামোয় জায়গা পাবে না, কিন্তু মানবিকতায় বিবেচ্য। বিচারকের রায়ে অন্তত এই কথা বলা হয়েছে—“এই কেস আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, সমাজের নীরবতা কেমনভাবে একজন মানুষকে খুনির পথে ঠেলে দিতে পারে।” কিন্তু অমলবাবু জানতেন, এত সহজ নয় শেষ কথা বলা। সেইজন্যই তিনি বসেছিলেন নিজের পুরনো ডেস্কে, পুরনো খাতায়, কলম হাতে।
তিনি লিখছেন, যেন পাঠক একজন—সমাজ। তার ভাষা নরম, কিন্তু প্রশ্ন।
“আমি বহু বছর ধরে বহু খুনি দেখেছি—কেউ টাকার জন্য মারে, কেউ জমির জন্য, কেউ ভালোবাসার জন্য। কিন্তু বিশ্বজিত সেই দলে পড়ে না। ও খুন করেছে, কারণ ও বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিল। আর বিশ্বাস যখন মরে যায়, তখন মানুষ আইন মানে না। মীনাক্ষীর মতো হাজার মেয়ে প্রতিদিন চোখের সামনে হারিয়ে যায়—কারো আত্মহত্যা, কারো নিঃশব্দ মৃত্যু। তারা বাঁচতে চায়, কিন্তু সমাজ তাদের কণ্ঠ রোধ করে। যারা নির্যাতনের শিকার হয়, তাদের চেয়ে বড় শাস্তি হয়, যারা সব জেনেও চুপ থাকে। চৈতালি হালদার যদি চুপ থাকত, তাহলে আরেকটা খুন হতো—হয়তো আমি নিজেও সেই তালিকায় থাকতাম। আমরা যাঁরা সত্য জানি, তাদের চুপ থাকা মানে অপরাধীদের পাশে দাঁড়ানো। সমাজে যদি একটাও চৈতালি থাকে, তাহলে আশা বাঁচে। আমি আজ লিখে রাখলাম এই কথা—আমরা সবাই দোষী, যদি না সময়মতো মুখ খুলি।”
সেই লেখা শেষ করে অমলবাবু চুপ করে জানালার দিকে তাকিয়ে রইলেন। বাঁশবনের দিক থেকে আসা হাওয়ায় আবার পাতার মৃদু কড়কড় শব্দ। কিন্তু এবার সেটা আর কানে বিষিয়ে ওঠা শব্দ নয়—এ যেন এক দীর্ঘশ্বাসের মতো, যেন দীর্ঘকাল পরে কেউ স্বস্তি পেয়েছে। চৈতালি স্কুলে ফিরে গেছেন, আবার ক্লাস নিচ্ছেন, বাচ্চাদের পড়াচ্ছেন, তবে মাঝে মাঝে হঠাৎ থমকে দাঁড়ান… কেউ জিজ্ঞেস করলে বলেন, “আজও বাঁশপাতা একটু বেশি শব্দ করল।” ভোলা এখন শহরের স্কুলে ভর্তি হয়েছে, অমলবাবু ওর পড়ার খরচ দিচ্ছেন। আর বিশ্বজিৎ… সে এখন জেলের ভেতর, কিন্তু মনোরোগ বিশেষজ্ঞের নজরে। জানা গেছে, প্রতিদিন রাতে সে তার খাটের পাশে তিনটি ছবি রাখে—নন্দু, শংকর, আর ঝর্না। কিন্তু মাঝখানে রাখে মীনাক্ষীর একটি চিঠি, যেখানে লেখা—“তুমি যদি দাদা হয়ে আমাকে ভালোবাসতে, তাহলে এই সমাজকে বদলাতে চাইতে, আমাকে মারতে নয়।” এই চিঠি হয়তো সত্যি ছিল না, হয়তো অমলবাবু নিজে লিখে রেখেছিলেন বিশ্বজিতের জন্য, যেন তার মনে জীবনের শেষটায় একটু অনুতাপ জন্মায়।
আর আজ, অমলবাবু তাঁর ডায়েরির শেষ পাতায় এই লাইন লিখলেন—
“শেষ খুনটি করেছিল সমাজ। শাস্তি কি এখনও বাকি?”
অধ্যায় ৯:
ঘোনার বাঁশবন একদিনের জন্য আবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠল, যেদিন পুলিশ কাস্টডির মধ্যে বিশ্বজিৎ হঠাৎ নিজের ব্যাগ থেকে একটি পুরনো কাঠের পুতুল বের করে আদালতের সামনে বসে চুপচাপ তাকিয়ে রইল। কারও কিছু বলার আগেই সে সেই পুতুলটা এক পুলিশকর্মীর হাতে দিয়ে বলল, “এইটা মীনাক্ষীর, সেটা আমার বোনের শেষ খেলনা ছিল।” এই পুতুলের কথা কেউ কোনো রিপোর্টে পড়েনি, কেউ তার অস্তিত্ব জানত না। আদালত অবাক, সাংবাদিক অবাক, কিন্তু অমলবাবু জানতেন—এটা শুধু পুতুল নয়, এটা এক কিশোরীর শৈশব, যেটা হত্যা করেছিল সমাজের নির্মমতার কাঠামো। এই ঘটনাটির খবর ছড়িয়ে পড়ে সংবাদমাধ্যমে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রেন্ড হতে থাকে #JusticeForMeenakshi। চৈতালি সেইদিন তার স্কুলে শিশুদের নিয়ে একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনী করেন—‘ভাঙা খেলনার গল্প’ নামে, যেখানে পুতুল, কাপড়ের বল, কাগজের পাখা দিয়ে তৈরি একটা কোণ ছিল, যার নাম দেওয়া হয়েছিল “নীরবতার প্রতিকৃতি।”
চৈতালির হাতে তখন একটা চিঠি আসে—বিশ্বজিতের লেখা। সেটা শুধু তার জন্য নয়, পুরো গ্রামের জন্য, সমাজের জন্য। চিঠিতে লেখা—
“চৈতালি মাইস্যার,
তুমি জানো, আমি খুনি। কিন্তু আমি জন্মেছিলাম একজন ভাই হয়ে, একজন ছাত্র হয়ে। এই সমাজ আমাকে খুনি বানিয়েছে, ঠিক যেমন আমার বোনকে বানিয়েছিল আত্মঘাতী। আমি ক্ষমা চাইছি না। আমি চাই, কেউ যেন আর পুতুলের চোখে নেমে না আসে ভয়। আমার বোনের নামে যদি তুমি কোনো পাঠাগার বা কোণ তৈরি করো, ওর সেই খেলা যেন কেউ ভুলে না যায়।
-বিশ্বজিৎ সরকার”
চৈতালি সেই চিঠি পড়ে অশ্রু সামলাতে পারেননি। অমলবাবুকে নিয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নেন—স্কুলের এক কোণকে “মীনাক্ষী স্মৃতি পাঠকক্ষ” বানাবেন, যেখানে রাখা থাকবে সেই কাঠের পুতুল, আর একটি খোলা খাতা, যেখানে যেকোনো ছাত্র বা ছাত্রী তাদের ‘অবলুপ্ত স্বপ্ন’ লিখে রাখতে পারবে। পাঠাগারের দেওয়ালে লেখা থাকবে—“ভয় পেলে বলবে, চুপ থাকবে না।” গ্রামে প্রথমবার কেউ মুখ খুলে বলছে—“আমারও একটা সময় ছিল, যখন আমি চুপ ছিলাম। কিন্তু এখন থেকে আমি কিছু দেখলে বলব।” এই ছোট ছোট পরিবর্তনের ঢেউ যেন নদীয়ার বুক ছুঁয়ে সমাজে এক দাগ কেটে দিচ্ছে।
অমলবাবু তাঁর ডায়েরির পাতায় লেখেন, “যে সমাজ কিশোরীর স্বপ্ন মারে, সে সমাজের বুকেও প্রশ্নচিহ্ন এঁকে যেতে হয়। আমরা যদি ভুলের পুনরাবৃত্তি থামাতে চাই, তবে শুধু অপরাধী ধরলেই হবে না, অপরাধ জন্মানো পথগুলো বন্ধ করতেই হবে।”
চৈতালি একদিন একা হাঁটতে হাঁটতে বাঁশবনের দিকে গেলেন। এবার তিনি ভয় পান না। বরং মনে হয়, পাতার কড়কড় শব্দে কেউ বলছে—“ধন্যবাদ।” বাঁশবনের মাঝে সেই পুরনো কুটির এখন আর ব্যবহার হয় না, তার দেওয়ালে সাদা কাগজে লেখা কিছু ছেলের কবিতা, কারো চোখে আঁকা মেয়ের ছবি, কেউ লিখেছে—“আমি চুপ থাকব না।”
বিশ্বজিৎ আজও জেলে, কিন্তু সে এখন পুতুল তৈরি করে। প্রতিটি পুতুলের গায়ে লেখা থাকে—“ভয় পেও না।”
অমলবাবুর সেই ডায়েরি একদিন চৈতালি শিক্ষামন্ত্রীকে পাঠালেন। প্রথম পাতায় লেখা—“এই গল্পে তিনটি খুন ছিল, কিন্তু তার আগে ছিল একটি আত্মা, যাকে আমরা কেউ বাঁচাতে পারিনি। এবার হয়তো পারব।”
অধ্যায় ১০:
সেদিন ঘোনার আকাশে হালকা বৃষ্টির ছিটেফোঁটা পড়ছিল, আর গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে পুরনো বাঁশবনের মাথায় জমা হচ্ছিল কুয়াশা। অমল দত্ত ধীরে ধীরে হাঁটছিলেন সেই একই পথ ধরে, যেটা তাকে একদিন নিয়ে গিয়েছিল তিনটি খুনের রহস্যের গভীরে। তার পাশে চৈতালি, একহাতে ছাতি ধরা, অন্য হাতে ছোট্ট একটা লাল ফাইল। সেই ফাইলে আছে ‘মীনাক্ষী স্মৃতি পাঠকক্ষ’-এর সরকারি অনুমোদন, পাঠ্যক্রমে ‘সমাজ সচেতনতা’ নামে একটি নতুন ক্লাস চালুর প্রস্তাব, আর সাথে একটি বিশেষ শংসাপত্র—বিশ্বজিৎ সরকারের তৈরি করা পুতুলের জন্য রাজ্য পুরস্কার, “সৃজনশীল মানসিক পুনর্গঠনের প্রতীক” হিসেবে। আজ তারা দুজনই জানেন, এই কাহিনি এখানেই শেষ নয়। মীনাক্ষী নামটা এবার কেবল কাগজে থাকবে না, থাকবে অনেক হৃদয়ের গভীরে।
অমলবাবুর হাতে একটা বাঁশপাতা পড়ে গেল, সেটা কুড়িয়ে নিয়ে তিনি বললেন, “এটাই সেই পাতার শেষ কাহিনি, তাই তো?” চৈতালি মৃদু হেসে বললেন, “হয়তো নয়। হয়তো কোথাও আবার কেউ চুপ করে আছে। আর কেউ কেউ হয়তো এখন চুপ থাকবে না।” অমলবাবু মাথা নাড়লেন, “চুপ থাকা তো আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যাধি। আমার বিশ্বাস, মীনাক্ষীর কাহিনি অনেক মুখ খুলবে।”
সে মুহূর্তে পেছন থেকে ছোট্ট ভোলা ছুটে এল, এখন সে দশম শ্রেণির ছাত্র, চোখে চকচকে আত্মবিশ্বাস। সে হাতে তুলে দিল একটা খাম, বলল, “মাইস্যার, এটা আমাদের পুরো ক্লাস মিলে বানিয়েছে। মীনাক্ষী দিদির জন্য।” খামে লেখা ছিল—”বাঁশপাতার পত্র – যারা আর কখনো চুপ থাকবে না, তাদের তরফে।” চৈতালি ও অমলবাবু দুজনেই চোখ মুছে ফেলেন।
চিঠির প্রথম লাইনে লেখা ছিল:
“আমরা যারা গল্প শুনেছি, এবার তারা নিজেরাই গল্প বলব। আমাদের গল্প কেউ গলায় দেবে না মালা বানিয়ে—আমরা গড়ে তুলব এমন একটা সমাজ, যেখানে কান্নার জায়গায় থাকবে কথা বলার সাহস।”
ঘোনা গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে, যেখানে বাঁশবনের শেষ মাথায় একসময় কুয়াশা গড়িয়ে পড়ত, এখন সেখানে তৈরি হয়েছে ছোট্ট একটা স্মৃতিস্তম্ভ। নাম—“শেষ বাঁশপাতা”। প্রতিটি বছর মীনাক্ষীর মৃত্যুবার্ষিকীতে ওখানে ফুল দেয়া হয়, পুতুল রাখা হয়, আর পড়া হয় ছাত্রছাত্রীদের লেখা গল্প, যেগুলো উঠে আসে নীরবতা ভাঙার প্রয়াস থেকে।
চৈতালি সেখানে দাঁড়িয়ে থাকেন প্রতিবার, পাশে থাকে ভোলা, নতুন নতুন শিশুর দল। আর দূরে বসে থাকেন অমল দত্ত, তার পুরনো খাতার নতুন পাতায় নতুন লাইন লেখেন—
“এই রহস্যের শেষ পাতায় কোনো রক্ত নেই।
আছে একটা প্রতিজ্ঞা—ভুল দেখে মুখ ফিরিয়ে নেব না আর।”
এটাই ছিল বাঁশবনের শেষ সত্য।
না, একে অভিশাপ বলা যাবে না। এ এক অবচেতন সমাজের নিরব ঘুম ভাঙার ডাক।
এ এক নতুন ভোরের প্রতিশ্রুতি।
সমাপ্ত