Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

ডিজিটাল কনফেশন

Spread the love

পিউ সেনগুপ্ত


এক

সকালটা ছিল একেবারে ঘড়ির কাঁটার মতো। মিনতি সেন জানে—৮টা নাগাদ স্বামী দেবজ্যোতির অফিসের ফাইল রেডি, ছেলের টিফিন, দুধ, সংবাদপত্র; এই তালিকাটা গত কুড়ি বছর ধরে অটুট। তবে আজ তার ভেতরে একটা ক্ষীণ অস্থিরতা ছিল। পেঁয়াজ কাটার সময় চোখ জ্বলছিল ঠিকই, কিন্তু আজ সেই জ্বালা শুধুমাত্র গন্ধের কারণে নয়—একটা জমে থাকা ক্লান্তির জলছবিও। রান্নাঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে পুকুরের পাড়ে রোদে গা গুজে বসে থাকা বেড়ালটা দেখতে পেত মিনতি, অথচ আজ সে জানালার দিকে তাকায়নি একবারও। নিজেকে আজ একটু অচেনা লাগছে। হয়তো এই কারণেই, দুপুরবেলায় কপালে ঘাম নিয়ে বালিশে মাথা রাখার বদলে সে মোবাইলটা হাতে তুলে নেয়। ফেসবুকে পরিচিতদের রান্নার ছবি, মেয়েদের মেহেদির ডিজাইন, আর ছেলেদের রিল ভিডিও দেখে বিরক্ত লাগে। “সবাই এত কিছু বলতে পারছে, আমি তো চিৎকার করেও কারও কানে পৌঁছোতে পারছি না,” নিজেকে মনে মনে বলে উঠল সে। তখনই মাথায় আসে একটা চিন্তা—যদি সে অন্য নামে কিছু লিখতে পারে? নিজের সব কথা, নিজের অপ্রকাশিত অনুভূতি, যেগুলো কারো সঙ্গে বলা হয়নি, সেগুলো যদি অন্য কেউ হয়ে বলা যায়?

রাত দশটার পর বিছানায় শুয়ে থাকা স্বামী আর মেসেঞ্জারে ব্যস্ত ছেলেকে পাশ কাটিয়ে মিনতি টয়লেটে ঢোকে। আলোটা নিভিয়ে মোবাইলের হালকা আলোয় সে একটা নতুন ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট খোলে—Mira99। মিরা নামটা তার স্কুল জীবনের এক বান্ধবীর, যে প্রায়ই বলত—“তোর ভেতরে অনেক কথা আছে রে, লিখতে শেখ।” আর ৯৯ তার বিবাহবার্ষিকীর সাল—১৯৯৯। ইনস্টাগ্রাম তাকে নাম মেলে যায় কি না দেখে নেয়, তারপর একটা ডিম-প্রোফাইল ছবি রেখে সে প্রথম পোস্ট লেখে: “আমি সেই, যে সব শুনেছে, কেউ শুনেনি। যে প্রতিদিন নিজেকে আড়াল করে গেছে, কারণ চেনা মুখেরা অচেনা হয়ে উঠেছে। আজ আমি লিখব। লিখব তাদের হয়ে, যারা বলতে পারেনি।” পোস্টটা শেয়ার করে কাঁপা আঙুলে মোবাইল রেখে দেয়। অনেকক্ষণ পরে নিঃশব্দে একটা হাঁপ ছাড়ে সে। পরদিন সকালে নাস্তার ফাঁকে মোবাইল হাতে তুলে দেখে একটা মেসেজ—“আপনি কি আমার মনের কথা লিখেছেন?” মিনতির গা কাঁপে। কে এই মেয়ে? কোথা থেকে এল সে? সে কি চেনে তাকে? না, প্রোফাইলে শুধু একটা চোখের ছবি আর লেখা—“Rekha_hope13”। মিনতির মনে হয়, এই নামে কেউই তো নেই তার চেনাজানায়। আরও দুইটা লাইক এসেছে, তিনটে ফলো। তার অদেখা, অশ্রুত গলাটাকে কেউ শুনছে—এই সত্যে সে কেঁপে ওঠে, আবার সাহসও পায়। এই ছোট্ট ফোনের ভেতর একটা গোপন জানালার মতো খুলে গেল—যেখানে সে মিনতি নয়, মিরা।

পরের কয়েকদিনে সে নিয়মিত পোস্ট দিতে থাকে—ছোট ছোট গল্প, যন্ত্রণার মুহূর্ত, অবহেলার ছায়া। এক গল্পে সে লিখে, “একদিন রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে ভেবেছিলাম, কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি ঠিক আছো তো?’—তবে আমি কী বলতাম?” রেসিপির ভিড়ে এই লেখা ভাইরাল না হলেও একদল অদৃশ্য নারী তাকে ইনবক্সে বার্তা পাঠাতে শুরু করে। কেউ বিবাহিত জীবনের নিঃসঙ্গতা, কেউ অবাঞ্ছিত মাতৃত্ব, কেউ নিজের শ্বশুরবাড়ির মানসিক নির্যাতনের কথা বলে। “আপনি কি সত্যিই বোঝেন, কেমন লাগে প্রতিদিন নিজের চাওয়া মুছে ফেলতে?”—এই প্রশ্নে মিনতির চোখ ভিজে যায়। সে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ, বুঝি। কারণ আমিও প্রতিদিন মুছে ফেলি।” এমনকি সে নিজেও নিজের অজান্তে লিখতে শুরু করে সেই স্মৃতি, যেগুলো ধূলায় ঢাকা পড়ে গিয়েছিল—একটা পুরনো ছাদবাগান, একটা অপূর্ণ কবিতা, একটা অপ্রকাশিত ভালোবাসা। তার পোস্টে লাইক বাড়ে না, কমেন্টেও কেউ হুল্লোড় করে না, কিন্তু ‘Seen by 47’ এই ছোট্ট লেখাটা দেখে সে শান্তি পায়। এই ৪৭টা চোখ, ৪৭টা মন, ৪৭টা একাকীত্ব যেন মিরার সঙ্গে হাত ধরছে। সে বুঝতে পারে, এই প্রোফাইলটা আর শুধু একটা অ্যাকাউন্ট নয়—এ এক কনফেশনাল রুম, যেখানে চেনা মুখগুলো নেই, কিন্তু অচেনা মনের দরজা খুলছে প্রতিদিন। মিনতির জীবনে প্রথমবার, সে ভাবে—নিজেকে নিজের মতো করে জানানোটা অপরাধ নয়। হয়তো আজই শুরু হল এক নতুন গল্পের, যেটা সে নিজেই লিখবে, একা—তবুও অনেকের হয়ে।

দুই

দুপুর গড়াতে না গড়াতেই মিনতির মোবাইলে একটা নতুন মেসেজ আসে—“আমি যদি আমার গল্পটা আপনাকে বলি, আপনি সেটা লিখে দিতে পারবেন?” প্রোফাইলটির নাম ছিল ‘tulika_reborn’। প্রোফাইল পিকচারে ছিল শুধু একটা জলছাপ দেওয়া কফির কাপ আর তার পাশে পড়ে থাকা বই। মেসেজটি খোলার পর মিনতির মনে হয় যেন কেউ তার বুকের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ছে—এক অচেনা বিশ্বাস নিয়ে। তুলি নামে মেয়েটি লেখে, “আমি কলকাতার মেয়ে, ৩২ বছর বয়স। ডিভোর্স হয়েছে দু’বছর আগে। অফিসের সবাই ভাবে, আমি বেশ আনন্দে আছি। কিন্তু আমার চেহারায় হাসি থাকলেও ভিতরটা আজো ফাঁকা। কাউকে বলতে পারি না, রাতে একা বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাঁদি। কেউ শুনতে চায় না।” এই লেখাগুলো পড়ে মিনতির হাত থমকে যায়। সে নিজের পুরনো সময় মনে করে, যখন দেবজ্যোতির সংসারে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল, নিজেকে খুঁজে পায়নি—মা, বউ, বৌমা, সবকিছুই ছিল, শুধু মিনতি ছিল না। ‘তুলিকা’ সেই মুহূর্তে আর অচেনা থাকে না; যেন তাদের ব্যথার স্বর এক হয়ে যায়। সে উত্তর দেয়, “তোমার গল্প আমি লিখব। শুধু তুমি বোলো।” সেই রাতেই মিরার নতুন পোস্ট যায়—“একটা মেয়ের কান্না শুনেছিলাম আজ রাতে, ফোনের ওপারে নয়, শব্দে নয়—শুধু তার নিরবতায়। সে বলল, ‘আমি ভালো আছি’—কিন্তু তার চোখের কোণ বলছিল, ‘আমি আর থাকতে পারছি না।’”

পোস্টটির নিচে দুই ঘণ্টার মধ্যেই আসে ১৫টা লাইক আর চারটি ম্যাসেজ। একজন লেখেন, “আপনার লেখাগুলো পড়লে মনে হয় আমি নিজের মুখ শুনছি।” আরেকজন, ‘ananya_stillwaiting’, তার বার্তায় লেখেন, “আমার প্রেমটা চার বছর চলেছিল। কিন্তু ছেলেটা হঠাৎ বলে দিল—‘তোমার মধ্যে spark নেই’। সেই থেকে আমি আয়নায় তাকাতে ভয় পাই।” মিনতির মাথায় চকিতে একটা কথা আসে—“এই মেয়েগুলো কাউকে বলতে পারে না, কিন্তু আমায় বলছে। আমি তো শুধু লিখছি, কিন্তু ওরা যেন আমাকে ধরে বাঁচতে চাইছে।” দেবজ্যোতি এসব কিছুই জানে না। সে এখনও মোবাইলে খবর দেখে, টিভিতে ক্রিকেট দেখে, রাতে খেতে বসে বলে, “আজ দেরি হয়ে গেল মিটিংয়ে।” ছেলেও জানে না মায়ের এই গোপন প্রোফাইলের কথা, অথচ তারা প্রতিদিন তার মুখের সামনে হেঁটে যায়। মিনতির মনে হয়, সত্যিই কি সে এতদিন মুখোশ পরে থেকেছে? না, হয়তো মুখোশ না—সমাজ তাকে মুখের জায়গায় নীরবতা পড়তে শিখিয়েছে। এখন, এই ইনস্টাগ্রাম যেন সেই নীরবতাকে শব্দে পরিণত করছে।

একদিন হঠাৎ করে একটা নতুন কমেন্ট নজরে পড়ে তার—“আপনি কি শুধু নারীদের গল্প নেন? আমি একজন পুরুষ, কিন্তু আমারও কিছু বলা আছে।” মিনতি থমকে যায়। প্রোফাইল: ‘lostson_87’। মিনতি দ্বিধায় ভোগে, ‘এটা যদি কোনো প্র্যাঙ্ক হয়?’ কিন্তু সে আবার ভেবে দেখে—ব্যথা কি লিঙ্গ দেখে আসে? সে ইনবক্সে সাড়া দেয়, “আপনি লিখুন, আমি শুনব।” সেই রাতে যখন সবার ঘুম নেমে আসে, মিনতি লেখে, “আজ একজন বলেছে, আমি ছেলেমেয়ে চিনি না, শুধু ব্যথা চিনি। আমার প্রোফাইলটা নারীদের জন্য নয়, মানবিকতার জন্য।” এই পোস্টে লাইক হয় মাত্র ৩৯, কিন্তু ইনবক্স ভরে যায়—“আপনি আমাকে বোঝেন”, “আজ মনে হচ্ছে কেউ শুনছে”, “আপনার লেখা আমাকে বাঁচায়”। মিনতি বুঝতে পারে, সে একাই নয়। আর তার মতো অনেকেই ছিল যারা চুপ করে থেকেছে। এখন, যখন সে লেখে, তখন তা শুধু লিখে রাখার জন্য নয়—বরং বলা হয় সেইসব কণ্ঠের হয়ে, যাদের মুখ নেই, কিন্তু গল্প আছে।

তিন

রবিবার সকাল। দেবজ্যোতি তখন হালকা পেঁপে দিয়ে ডায়াবেটিক খাবার খাচ্ছেন, আর ছেলেটা মোবাইলে PUBG খেলছে। মিনতি তাদের পাশ দিয়ে চা হাতে হেঁটে গিয়ে বারান্দার এক কোণায় বসল—যেখানে পুরনো তুলসী গাছটা একা পড়ে থাকে, জল দেওয়ার অপেক্ষায়। আজকের সকালে সে মিরার পোস্ট দিতে চায় না, শুধু চুপ করে বসে থাকতে চায়। কিন্তু ইনবক্সটা খুলতেই একটা দীর্ঘ চিঠি এসে পড়ে তার সামনে। প্রোফাইল: sharada_burntinside, বয়স ৫৩, কলকাতার বাইরের একটি শহরের স্কুলশিক্ষিকা। সে লিখেছে, “আমি এখনও মেয়েদের শিখাই, কিন্তু নিজের মেয়েকে বিশ্বাস করাতে পারিনি যে বিয়ে মানেই পাখির খাঁচা নয়। আমি নিজে একসময় আগুনে পুড়েছিলাম—না, শরীর নয়, আত্মা। স্বামী, সংসার, সমাজ—তিনটে ‘স’ মিলিয়ে আমায় গিলে ফেলেছে। আপনি লিখুন আমার হয়ে, আমি বলতে পারি না।” লাইনগুলো পড়তে পড়তে মিনতির চোখের কোণ কেঁপে ওঠে, বুকের ভেতর যেন কেউ হাত দিয়ে পাথর রেখে দেয়। সে ভাবে, “শরীর পুড়লে সবাই দেখে, কিন্তু আত্মা পোড়ার কি কোনো চিহ্ন থাকে?” এ প্রশ্নই সে মিরা হিসেবে লেখে সেই রাতের পোস্টে: “আত্মা যখন পুড়ে যায়, তখন কণ্ঠ শুকিয়ে যায়। তখন শুধু দরজা বন্ধ হয়, জানালাগুলোও বন্ধ হয়ে থাকে। আমি চাই, অন্তত একটাও জানালা খুলুক, হাওয়ার মতো কথা ঢুকুক।”

পোস্টটা অদ্ভুতভাবে ছড়িয়ে পড়ে—প্রথমবারের মতো ১০০ লাইক ছাড়ায়। বেশিরভাগই মহিলা, কিন্তু দু’তিনজন পুরুষও ‘Bravo’, ‘Needed this’ লিখে মন্তব্য করেছে। একটা মেয়ে, যার নাম ‘priyanka_stranger’, কমেন্ট করে: “আপনার প্রতিটা লাইন যেন আমার মুখে আটকে থাকা কথাগুলো।” মিনতি বুঝতে পারে, তার প্রতিটি শব্দ যেন অন্য নারীর আত্মার দরজায় কড়া নাড়ে। সে ভাবতেও পারেনি—একটা ফোনের ভেতরে তৈরি করা এই ছোট্ট প্রোফাইল, যার পেছনে সে লুকিয়ে আছে, সেটাই কারও কাছে জানালার মতো খুলে যাচ্ছে। অথচ, বাস্তব জীবনে তার নিজের ঘরের জানালাগুলো প্রায় বন্ধই থাকে। দেবজ্যোতির কাছে সে এখনও নিত্য অভ্যাসের তালিকা—“ছোট কাঁচা লঙ্কা এনেছো?”, “কাল মুদির দোকানটা খোলা থাকবে তো?”—এইসব দৈনন্দিন প্রশ্নে আটকে থাকা সম্পর্ক। ছেলেটাও ফোন আর কোচিং-এর মাঝে জড়িয়ে গেছে। কারও মনে হয় না, মা নিজেও কারো কথা শুনতে চায়। অথচ অচেনা মিরা হয়ে, সে এখন শত শত নারীর কান হয়ে উঠেছে—আর কী আশ্চর্য! এখন যেন মিরাই তার নিজেরও শ্রোতা হয়ে উঠছে।

রাতে খাওয়ার পরে দেবজ্যোতি বলে, “তুমি এই ক’দিন ধরে কী যেন ভাব ভাব লাগছো! শরীর ঠিক আছে তো?” মিনতি একটু চমকে ওঠে। এতদিনে কেউ জিজ্ঞেস করল, সে কেমন আছে। কিন্তু সে মুখে হাসি এনে উত্তর দেয়, “ভালো আছি।” দেবজ্যোতি তার চোখের দিকে না তাকিয়েই মোবাইলে নজর ফেরায়। মিনতির মনে হয়, এ-ও তো এক প্রকার অভ্যাস—জিজ্ঞাসা করলেও উত্তর শোনার প্রয়োজন হয় না। তাই সে রাতের অন্ধকারে আবার ইনস্টাগ্রামে ফিরে যায়। সেখানে আজও কিছু নতুন মেসেজ: কেউ লিখেছে তার ডিপ্রেশনের কথা, কেউ যৌন হয়রানির অভিজ্ঞতা, কেউ নতুন প্রেমে পড়ে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার গল্প। মিরা তাদের নাম না বলেই গল্প বানিয়ে দেয়—একটা অস্পষ্ট মুখ, একটি কণ্ঠহীন মেয়ে, একটি রুদ্ধ জানালার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা আত্মা। এবং সে টের পায়—এই জানালাগুলো যত খুলবে, তত আলো আসবে। শুধু সেই আলোটা সে এখনও নিজের বাড়ির ঘরে আনতে পারেনি, কিন্তু অন্যদের অন্ধকারে সে মোমবাতির মতো জ্বলছে।

চার

দিনটা ছিল সোমবার, কিন্তু ঘড়ির কাঁটার মতো নিষ্প্রাণ এক দুপুর। মিনতি জানালার পাশে বসে পোস্ট লেখার আগেই ইনবক্সটা চেক করতে গিয়েই দেখতে পায় অজস্র নতুন মেসেজ—কেউ তার নিজের কাহিনী বলছে, কেউ আগের গল্প পড়ে কেঁদে ফেলেছে, কেউ আবার তার অনুমতি চায়—”আমি কি আমার সত্যি কথাটা এখানে লিখতে পারি?” মিনতির মধ্যে যেন এক নতুন মিনতি জন্ম নিচ্ছে, যে কাউকে মুখ দেখায় না, কিন্তু তার লেখাগুলো মুখ হয়ে উঠছে শত নারীর। হঠাৎ তার মাথায় আসে—এই গল্পগুলো কেবল মাটির তলায় চাপা দিয়ে রাখার জন্য নয়। তার একা কণ্ঠ আজ শত নারীর গল্প বলছে, তবে তারা একসঙ্গে এগিয়ে এলে কী হতে পারে? সেই ভাবনা থেকেই সে লিখে: “আমরা কেউই একা নই। তোমার চোখের জল আরেকজনের গল্প। যদি একা মনে হয়, পোস্ট করো—#WeAreNotAlone দিয়ে। লিখে ফেলো নিজের কাহিনী—নাম নয়, গল্পটাই মুখ।” পোস্টটা সে দেয় ঠিক দুপুর ২টোয়। বিকেলের মধ্যে ৮০টি ইনবক্স আসে, যাদের মধ্যে ২০ জন নিজেদের গল্প লিখে পাঠায় হ্যাশট্যাগসহ। মেয়েরা নিজের ভয়, লজ্জা, কান্না—সব কিছু লিখে প্রকাশ করছে, যেন এই ছোট্ট ডিজিটাল জগতে কেউ কাঁধে হাত রাখছে।

একটি কাহিনী আসে ‘Sutapa_redink’ নামের একটি প্রোফাইল থেকে—সুতপা, ৪০ বছরের স্কুলশিক্ষিকা, নিজের শ্বশুরের হাতে কিশোর বয়সে শারীরিক নিগ্রহের শিকার হয়েছিলেন, কিন্তু কোনওদিন কাউকে বলেননি। তিনি লিখেছেন, “আজ প্রথম মনে হল কাউকে বললে লজ্জা আমার নয়, তার, যে অন্যায় করেছিল।” আরেকজন, রিমঝিম নামে এক মেয়ে, লেখে, “আমার প্রেমিক আমায় মোটা বলে ছেড়ে দিয়েছে। আমি নিজেকে আয়নায় দেখতে পারি না। কিন্তু আজ লিখে মনে হল—আমার শরীর আমার লজ্জা নয়।” মিনতির চোখ জলে ভরে যায়। সে রাতে সে একটি ভিডিও তৈরি করে—কোনও মুখ নয়, শুধু হাত দিয়ে লেখা কথাগুলো স্ক্রিনে ভেসে ওঠে: “তোমার কান্নার শব্দ হয়তো তুমি একা শুনেছো, কিন্তু আমি শুনছি, আমরা শুনছি। তুমি একা নও।” ভিডিওটা সে পোস্ট করে তার ইনস্টাগ্রামে। মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে ভিডিওতে ৭০০ ভিউ, ৩১৫ লাইক, ১৪৭ শেয়ার আর ২০০টির বেশি নতুন ফলোয়ার। এক নারী লেখেন, “আপনি শুধু একজন ব্যক্তি নন, আপনি এখন একটা আশ্রয়।”

সেদিন রাতে ঘুমোতে যেতে যেতে মিনতির মনে হয়, সে আর আগের মতন নেই। মিনতি এখন শুধু মিনতি নয়—সে হয়ে উঠেছে মিরা, একটা ছায়া যার স্পর্শে নারীরা নিজের ছায়াকে খুঁজে পায়। তার ভেতরের অস্পষ্ট ব্যথা আজ গানের মতো বাজছে অন্যদের হৃদয়ে। সকালবেলা ঘুম ভাঙতেই সে দেখে, কিছু জনপ্রিয় ইনফ্লুয়েন্সার—যারা রান্না, বই, কিংবা ফ্যাশনের পোস্ট করেন—তারা রি-শেয়ার করেছেন মিরার লেখা। এক নামী কবিও তার ইনস্টাগ্রামে ‘#WeAreNotAlone’ দিয়ে একটি কনফেশন লিখেছেন—“আমার মা নিজের কষ্ট কখনও বলেননি। মিরার লেখা পড়ে বুঝলাম, আমরা কখনও জিজ্ঞেসও করিনি।” দেবজ্যোতি এসব খবর জানে না। তার কাছে মিনতি এখনও সেই একই, যাকে সে মাঝে মাঝে বলে, “আজ ভেজা কাপড়গুলো টাঙিয়ে দিয়েছো তো?” কিন্তু মিনতি জানে, এই সামান্য প্রশ্নের বাইরে যে পৃথিবী সে তৈরি করেছে, সেখানে সে নিজেই নিজের মালিক। মোবাইলের স্ক্রিনে সে আবার নিজের অ্যাকাউন্ট খুলে দেখে—ফলোয়ার ৩৫,০০০ ছাড়িয়েছে। সে চুপচাপ বলে ওঠে, “তুমি একা নও”—নিজেকেই, আবার সবাইকেও।

পাঁচ

রবিবার রাতে দেবজ্যোতির ভাইপোর বিয়েতে যাবার সময় মিনতির সাদা শাড়িটা পরার কথা ছিল, কিন্তু সে আজ হঠাৎ করেই একটুকরো নীল টাঙ্গাইল পরে এলোমেলো করে চুল বেঁধে বেরিয়ে পড়েছিল। আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে নিজেই একটু চমকে উঠেছিল—এ কি মিনতি? না কি মিরা একটু একটু করে বাইরে বেরিয়ে আসছে? গাড়িতে বসে দেবজ্যোতি একটু অবাক হয়েও বলে উঠল, “তোমার নতুন সাজটা বেশ অন্যরকম লাগছে।” কিন্তু কথার মধ্যে সেই আগ্রহ ছিল না, ছিল যেন একটা নির্দিষ্ট প্রশ্নের অভ্যাসবশত উচ্চারণ। মিনতি মৃদু হাসে, কিছু বলেনা। কিন্তু সে জানে, আজকে তার চোখে একটা আলাদা আলো, যেটা কেউ না দেখলেও সে নিজে টের পায়। বিয়ের অনুষ্ঠানে বেশ কিছু আত্মীয়-স্বজনের মাঝে সে নিজেকে দূরের কেউ মনে হচ্ছিল। কথা, হাসি, ছবি তোলার ঝলক—সব কিছুতেই সে যেন একা। ঠিক তখনই এক কিশোরী, তার বড় মেয়ের মতো বয়স, সামনে এসে দাঁড়ায়। মুখে লাজুক ভঙ্গি, কিন্তু চোখে কিছু বলার তাগিদ। সে মিনতির কানে কানে বলে, “আপনি কি ‘Mira99’?” মিনতির গা হিম হয়ে আসে।

“আপনি লিখেছিলেন ‘আমার শরীর আমার ঘৃণার বস্তু নয়।’ আমি সেটা পড়ে কেঁদেছিলাম। তারপর থেকেই আপনার সব পোস্ট পড়ি। আমি কাউকে বলিনি। আজ আপনাকে দেখে মনে হল আপনিই। বলুন না, আপনি মিরা তো?”—মেয়েটি জিজ্ঞেস করে, হাতে ফোনের স্ক্রিনে সেই পোস্টের স্ক্রিনশট দেখিয়ে। মিনতির বুক ধড়াস করে ওঠে। এভাবে কেউ চিনে ফেলবে ভাবেনি সে কখনো। চারপাশে আত্মীয়দের চোখ যেন হঠাৎ তার দিকে ঘুরে গেছে, যদিও বাস্তবে কেউ খেয়ালই করেনি। সে মৃদু গলায় বলে, “তুমি কেমন আছ?” মেয়েটির চোখ ছলছল করে। সে বলে, “আজকাল আয়নাতে ভয় লাগে না। আপনি আমাকে সাহস দিয়েছেন।” মিনতির মুখে একটা নিঃশব্দ হাসি ফুটে ওঠে। সে মেয়েটির কাঁধে হাত রাখে। ওই রাতেই বাড়ি ফিরে মিনতি যখন বিছানায় শুয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করছে, তার মনের মধ্যে উথালপাথাল এক অনুভূতি। সে কী এখন মুখোশহীন হয়ে পড়ছে? নিজের নাম, নিজের মুখ—সব কিছু তো এতদিন সে আড়াল করে রেখেছিল। এখন যদি সবাই জেনে যায় যে সে-ই মিরা?

কিন্তু তার ভয়টা বাস্তব হয়ে দাঁড়াল পরদিন সকালে। দেবজ্যোতি তার টেবিলের সামনে বসে আছে, পাশে ছেলের জামাইতুল্য ত্রিদিব। তার হাতে মোবাইল, স্ক্রিনে খুলে আছে ‘Mira99’-এর একটি সাম্প্রতিক পোস্ট—“তুমি আমার শরীরের পাশে থেকেও আমার কান্নার শব্দ শুনতে পাওনি।” দেবজ্যোতির মুখ থমথমে, চোখ কঠোর। “এটা কি তুমি লিখেছো?”—তার প্রশ্নে যেন বাড়ির দেওয়ালটাও কেঁপে ওঠে। মিনতি দাঁড়িয়ে থাকে, চুপচাপ। ত্রিদিব বলল, “মেসোমশাই, এই অ্যাকাউন্টটা এখন ভাইরাল। স্কুল, কলেজের মেয়েরাও ফলো করে। অনেকেই বলছে এই লেখা নোংরা, ব্যক্তিগত জিনিস অনলাইনে ছড়ানো ঠিক নয়। জানি না কে লিখছে, কিন্তু কেউ বলল—এই লেখাগুলোর পেছনে নাকি আপনি।” দেবজ্যোতি মিনতির দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি? তুমি এসব করছো?” তার স্বর তাতে বিস্ময়ের চেয়ে বেশি অবিশ্বাস। মিনতির ঠোঁট কাঁপে। সে বলে, “আমি লিখি। কিন্তু সেটা কারো নামে নয়, সব নামহীন ব্যথার গল্প। ওরা আমায় খুঁজে পেয়েছে, আমি শুধু তাদের ভাষা দিয়েছি।” দেবজ্যোতির কণ্ঠ রাগে কাঁপে, “তুমি কি জানো, এতে আমাদের পরিবারের নাম ডুবে যাবে? এসব আবেগের কথা প্রকাশ্যে বলা যায়? নারী হয়ে তুমি যদি এই উদাহরণ হও, তাহলে বাকি মেয়েরা কী শিখবে?” মিনতি চোখ তুলে বলে, “যে কথা না বললে মেয়েরা মরে যায় ভিতরে ভিতরে, সে কথা যদি না বলি, তাহলে বাঁচব কী করে?” ঘরটা নিঃশব্দ হয়ে যায়। ত্রিদিব থ হয়ে যায়। দেবজ্যোতির মুখ শুকিয়ে আসে, যেন এত বছর ধরে দেখা সেই স্ত্রীকে সে চিনতেই পারেনি।

সে রাতে মিনতি ইনস্টাগ্রামে আরেকটি পোস্ট লেখে—নিজের একটা ছবিসহ, মুখ ঢাকা নয়, চোখে আত্মবিশ্বাস, ঠোঁটে একটুকরো হাসি:
“আজ প্রথম নিজের মুখ দেখালাম। এতদিন শব্দে ছিলাম, আজ ছবিতে আসছি। আমি মিনতি সেন। আমি Mira99। আমি লিখি, কারণ আমায় বলা হয়নি। আমি বলি, কারণ কেউ না বললে কিছু বদলায় না। আজ ভয় করল না। আজ সত্যিই মনে হল—আমি একা নই।”
এই পোস্টের নিচে মাত্র পাঁচ ঘণ্টায় ১১ হাজার লাইক, ৩ হাজার শেয়ার, এবং ৭০০-র বেশি মন্তব্য আসে—“আপনিই সাহস”, “আপনিই মুখ”, “আপনার জন্য আজ আমি প্রথমবার নিজের গল্প লিখলাম।” সেই রাতে মিনতি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে চাঁদের আলোয় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে। মুখে বলের রেখা, চোখে অভিজ্ঞতার ছায়া, কিন্তু সেই চেহারায় আজ একটি নতুন আলো। মিরা আর মুখোশের পেছনে নেই। সে মুখ তুলে দাঁড়িয়েছে, সকলের সামনে, সকলের জন্য।

ছয়

মিনতি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। ভোরের আলো জানালার ফাঁক দিয়ে এসে পড়েছে তার গালে, যেখানে বয়সের ছাপ স্পষ্ট, কিন্তু আজ তা লজ্জা নয়—তৃপ্তির মতোন। আজ অনেকদিন পরে সে নিজেকে ‘সুন্দর’ মনে করল—না, প্রসাধনে নয়, বরং আত্মবিশ্বাসে। গতরাতে পোস্ট করার পর যখন হাজার হাজার মানুষ তার নামসহ মিরাকে গ্রহণ করল, একটাও কটূক্তি তাকে দমিয়ে রাখতে পারল না। “তুমি তো আমাদের মুখ”, “তুমি আমাদের গলা”—এই সব মন্তব্য পড়তে পড়তে তার মনে হচ্ছিল, যেন একটা স্তব্ধতা ভেঙে পড়েছে। অথচ ঘরের মধ্যে নীরবতা এখনও জমে আছে। দেবজ্যোতি আজও চোখে তাকায় না। নাশতার টেবিলে বসে শুধু চায়ের কাপ ঠেলে দিয়ে বলেছিল, “আজকাল তুমি বড্ড অন্যরকম হয়ে গেছো।” মিনতি কোন প্রতিবাদ করেনি। শুধু মৃদু গলায় জবাব দিয়েছিল, “নিজের মতো হয়ে উঠেছি, সেই আমি, যে এতদিন তোমার চায়ের কাপের পাশে বসেও নিজেকে খুঁজে পায়নি।” ছেলে এখনও জানে না তার মা দেশের নারীদের আশ্রয় হয়ে উঠেছে। ঘরের চার দেওয়ালে কেউ আজও তাকে ‘মিরা’ বলে ডাকেনি, কিন্তু দেশের বিভিন্ন প্রান্তের অসংখ্যা নারীর বার্তায় আজ মিরা এক প্রতীক—বিপ্লবের, সাহসের, ব্যথার শব্দের।

মিনতির ইনবক্স আজ ভোরেই ভরে গেছে। একটা চিঠি এসেছে রাজস্থানের এক বৃদ্ধা থেকে—“আমি ৬৫। আজ প্রথম বুঝলাম আমার জীবনটা অপচয় হয়নি, শুধু কথাগুলো মুখে আসেনি। এখন আমি লিখছি, আপনার জন্য।” অন্য একজন, উত্তরাখণ্ডের তরুণী, লিখেছে—“আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল, কিন্তু ছেলেটার পরিবার আমার মোটা চেহারায় অসন্তুষ্ট। আপনি যে পোস্ট করেছিলেন ‘আমার শরীর নিয়ে তোর কি অধিকার?’ সেটা আমার বাঁচার মন্ত্র হয়ে গেছে। আমি না বলেছি। আপনি না থাকলে পারতাম না।” আরেকজন ক্যানসার আক্রান্ত মা লিখেছে, “চুল পড়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমার মেয়ে আপনার পোস্ট পড়ে বলেছে, ‘মা, তুমি সবচেয়ে শক্তিশালী।’” মিনতির চোখ ছলছল করে ওঠে। সে বুঝে যায়, সে আর শুধুই একজন গৃহবধূ নয়—সে হয়ে উঠেছে একটা আন্দোলনের স্পর্শ। তার লেখা মেয়েদের কাঁধে হাত রাখে, পিঠে সাহস রাখে, চোখে চোখ রেখে বলে, “চলো, ভয় নয়।” এই উপলব্ধির মধ্যে দিয়েই সে সিদ্ধান্ত নেয়—আজকের পোস্টটা শুধুমাত্র নিজের জন্য হবে, নিজেকে নতুন করে পরিচিত করার জন্য।

রাতের বেলা সাদা কাগজে একটা হাতে লেখা চিঠির ছবি তোলে সে। ক্যাপশন দেয়—
“প্রিয় মিনতি,
তুমি আজ আর শুধু রান্নাঘরের মহিলা নও, ছেলের মা বা কারও স্ত্রী নও। তুমি তোমার মনের কথা বলতে পেরেছো, সেই মেয়েদের কণ্ঠ হয়েছো যাদের মুখ ছিল না। তুমি আজ আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে দেখেছো—আর কেঁদে ফেলোনি। তুমি নিজেকে জড়িয়ে ধরেছো। এই তো জয়।
ভালোবাসা,
মিরা।”

এই চিঠির ছবি রাতের মধ্যেই ভাইরাল হয়ে যায়। ‘#LetterToSelf’ ট্রেন্ড শুরু হয় ইনস্টাগ্রামে। মেয়েরা নিজেদের নামেই নিজের কাছে চিঠি লিখে পোস্ট করছে, হাজার হাজার গল্প—সবার উদ্দেশ্য একটাই: আত্মার কাছে ফিরিয়ে আনা নিজেকে। একজন লেখে, “এই চিঠি না পেলে আমি আজও ভাঙা আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকতাম।” একজন কিশোরী প্রথমবার তার মা-কে হাগ করে বলেছে, “মা, আমি তোকে ভালোবাসি।” একজন বিধবা মেয়ে লেখে, “আজ আমি স্বামীর ছবির নিচে নয়, নিজের ছবির পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদলাম, কারণ আমি নিজেকেও ভালোবাসি।” মিনতির চোখে আজ আবার নতুন আলো। আজ আর মিরা শুধু সে নয়—মিরা এখন শত শত নারীর আত্মপ্রকাশের নাম। আর এই যাত্রায় সে বুঝে গিয়েছে—নিজেকে ভালোবাসতে শেখা মানেই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিপ্লব শুরু করা।

সাত

শীতের এক ঝুপসা সকালে মিনতি জানালার ধারে বসে আঙুল ছুঁইয়ে মোবাইল স্ক্রল করছে। বাইরে কুয়াশা, ভেতরে আলো—ঠিক যেমন তার বর্তমান জীবন। হঠাৎ করেই সে আবিষ্কার করে যে একদল মেয়ে তাকে ট্যাগ করেছে ইনস্টাগ্রামে একটি নতুন পেইজে—নাম “Confession Circle”। পেইজটির বায়োতে লেখা: “Inspired by Mira99. We are not alone. We speak, we heal, we rise.” মিনতির বুকের ভিতরটা কেঁপে ওঠে। এ যেন তার লেখার থেকেও বড় কিছু—এ এক চলমান বিপ্লব। সে দেখে পেইজটিতে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের নারীরা তাদের অভিজ্ঞতা লিখে দিচ্ছে। কেউ অন্ধ্রপ্রদেশের ছোট গ্রাম থেকে, কেউ কলকাতার কলেজের মেয়ে, কেউ হিমাচলের শিক্ষক। মিরার লেখা এখন তাদের অনুপ্রেরণার বাতিঘর। কেউ কেউ ভিডিও বানিয়ে নিজেদের কনফেশন জানাচ্ছে, কেউ আর্ট ও কবিতার মাধ্যমে প্রকাশ করছে চাপা ব্যথা। এই সমস্ত পোস্টে একটিই কমন হ্যাশট্যাগ—#ConfessionCircle #WeAreNotAlone #MiraInspired। আর কেউ কেউ তো মিরাকে ‘দিদি’, কেউ লিখছে ‘মা’র মতো, কেউ বলছে—“তুমি যদি না লিখতে, আমি হয়তো আত্মহত্যাই করে ফেলতাম।”

তবে এই আলোয় আগুনও আসে। কিছু পুরুষতান্ত্রিক গোষ্ঠী মিরার বিরুদ্ধে পোস্ট করা শুরু করে। মিরাকে “সংসার ভাঙা মহিলা”, “আধুনিকতার নামে কুপ্রবৃত্তির প্রচারক” বলে অভিযুক্ত করা হয়। এক ধর্মীয় গোষ্ঠী তো সরাসরি লিখে, “নারীদের এইভাবে উস্কে দেওয়া মানেই পরিবার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যুদ্ধ।” মিনতির ইনবক্স ভরে যায় গালাগালি, হুমকি, এমনকি কেউ কেউ বলে, “তোমার ছবি পোস্ট করে দিব, তোমার ছেলে যেন দেখে কোন মা তাকে জন্ম দিয়েছে।” প্রথমে সে ভয়ে চুপ হয়ে যায়। মন খারাপ হয়, শরীর ভারী লাগে, মনে হয় সব বন্ধ করে দেয়। কিন্তু ঠিক সেই সময় ইনবক্সে আসে একটি ভিডিও মেসেজ—এক চোখে ট্যাঁড়া, কৃষ্ণবর্ণের মেয়ে বলছে, “আপনার জন্য আমি আজ কলেজে প্রথমবার নিজের সঙ্গে দাঁড়ালাম। আপনি থামবেন না, প্লিজ। না হলে আমরা আবার হারিয়ে যাব।” ভিডিওটা দেখে মিনতি আর পিছিয়ে থাকতে পারে না। সে জানে, এই আগুন শুধু তাকে পোড়াবে না, আলোও দেবে।

সেই রাতে সে মিরা নামে একটি ভিডিও পোস্ট করে—মুখ ঢাকা নয়, চোখে আগুন, কণ্ঠে শান্তি। “আমি যদি থেমে যাই, তাহলে তোমরা অনেকেই আবার চুপ করে যাবে। তাই আমি আছি। আমি থাকব। আমি লিখব, আমি শুনব, আমি জ্বলব—কারণ এই আগুন একা পোড়ায় না, উষ্ণতা দেয়। আজ আমি শুধু লেখক নই, আমি তোমাদের আত্মার ঢাল।” এই ভিডিওটা ছড়িয়ে পড়ে আগুনের মতো। দেশের বিভিন্ন নারী সংগঠন তাকে সমর্থন জানায়। এমনকি একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তাকে আমন্ত্রণ জানায়—‘কনফেশন সার্কেল’ কে নিয়ে একটি ওয়েব-সেমিনারে অংশ নিতে। সেখানে সে প্রথমবার মুখ খোলে নিজের পরিচয় সহ—“আমি মিনতি সেন। আমি গৃহবধূ, আমি একজন মা, আমি একজন মেয়ে। আমি লিখি কারণ আমি ভালোবাসি, আমি অনুভব করি। এবং সবচেয়ে বড় কথা, আমি ভয় পাই না।” তার কথা শুনে অনলাইনে চোখ ছলছল করে বসে থাকা মেয়েরা চুপ করে চেয়ে থাকে—কেউ হাসে, কেউ কাঁদে, কেউ নিজেকে খুঁজে পায়।

সেদিন রাতে মিনতি ঘুমোতে যাওয়ার আগে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। চুলে রূপার রেখা, মুখে বয়সের ছাপ, কিন্তু চোখে আগুনের মতো দীপ্তি। বালিশে মাথা রাখার আগে সে শুধু ভাবে—“একসময় চার দেওয়ালের মধ্যে রাঁধতে রাঁধতে ভাবতাম, আর কি কোনোদিন নিজের কথা বলতে পারব? আজ আমি বলছি, আর সেই কথা ছড়িয়ে পড়ছে লক্ষ মুখে। আগুন জ্বলছে বৃত্তের মাঝখানে, কিন্তু সেটা ধ্বংস নয়—নতুন আলো।”

আট

বিকেলের দিকে কলকাতার এক মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমন্ত্রণপত্র আসে। বিষয়: “Digital Confession & Silent Revolution: A Talk by Mira99”. মিনতি প্রথমে দ্বিধায় পড়ে। এতদিন সে ছিল মোবাইলের পর্দার আড়ালে, শব্দের ছায়া হয়ে, নিজেকে এক রকম অদৃশ্য রেখেই জাগিয়েছে হাজার হাজার নারীর মন। আজ যদি তার সামনে দাঁড়িয়ে পড়তে হয়? আলো, ক্যামেরা, মাইক্রোফোন—সেই কাঁচের গায়ে কবে নিজের মুখ দেখেছে শেষ, মনে পড়ে না। অথচ যেন ভেতর থেকে কেউ বলে উঠল—“তুই তো মিথ্যে বলিসনি। ভয় কিসের?” ছেলেকে বলতেই সে অবাক হয়ে বলে, “মা, তুই Mira99? আমায় আগে বলিসনি কেন?” মিনতি মুচকি হেসে বলে, “তোদের কথা শোনাতে গিয়েই নিজের কথা ভুলেছিলাম। এখন আমার কথা শোনার মানুষ আছে।” ছেলে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে, বলে, “তুই একাই তো একটা আন্দোলন। আমি গর্বিত।” সেই মুহূর্তে মিনতি জানে—এই পথ একা হলেও শেষটা আর নিঃসঙ্গ নয়।

সেই দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটোরিয়ামে ঢোকার সময় তার গায়ে হালকা একটা নীল সিল্কের শাড়ি, মুখে একটুকরো লিপস্টিকের সাহস, আর চোখে আলো। ছাত্রীরা গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে হাততালি দেয়। কেউ বলে, “মিরা দিদি এসেছে!” কেউ আবার ছুটে এসে বলে, “আজ যদি আপনি থাকতেন না, আমার জীবনের সব গল্প হয়তো কবরে চলে যেত।” মিনতি মঞ্চে উঠে দাঁড়ায়। চারদিকে ক্যামেরা, লাইভ স্ট্রিম, চোখে জলভরা মেয়েদের সারি। সে মাইকটা হাতে নিয়ে বলে, “আজ আমি তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে এসেছি, কিন্তু তার আগে আমার নিজের সঙ্গে একটু কথা বলা দরকার ছিল। এতদিন আমি লিখেছি তোমাদের হয়ে, এখন বলতে চাই—তোমরাও লেখো, বলো, নিজের ঘরের দরজায় কড়া নাও, আরশির সামনে দাঁড়াও আর বলো—আমি আছি। আমরা কেউ একা নই।” তার কথা শেষ হতেই পুরো হল হাততালিতে কেঁপে ওঠে। কেউ দাঁড়িয়ে পড়ে, কেউ কাঁদে। এক ঘর মেয়ে যেন নিজেকে খুঁজে পায়—একটা গৃহবধূর চোখে, যার নাম ছিল মিনতি, আর পরিচয় মিরা।

পরের কিছুদিনে দেশজুড়ে ‘Confession Circle’–এর বিভিন্ন চ্যাপ্টার খোলা হয়—কলেজ, হোস্টেল, শহর, গ্রাম সর্বত্র। মেয়েরা নিজেদের জন্য নিজেদের কণ্ঠ হয়ে ওঠে। কেউ আঁকে, কেউ লেখে, কেউ চুপ করে বসে শুধু অন্যদের শুনে যায়। সোশ্যাল মিডিয়ার বাইরে এই বিপ্লব ছড়িয়ে পড়ে মহল্লার মেয়েদের আড্ডায়, স্কুলের সহপাঠিনীদের মাঝে, এমনকি রান্নাঘরের কথোপকথনেও। এক সময় যে মিনতি ফোন হাতে চাপা কাঁপা গলায় লিখত “আমি লিখব”—আজ সে ঘরের মেঝেতে বসে নবাগত মেয়েদের শেখাচ্ছে, “কীভাবে নিজের যন্ত্রণাকেও শব্দে বদলে সাহস বানিয়ে নিতে হয়।” দেবজ্যোতি এখনো পুরোপুরি মেনে নিতে পারেনি, তবে অন্তত সে প্রতিবাদ করে না। একদিন মিনতির ছেলেই তাকে এনে দিল একটা মগ—যেখানে লেখা: “My Mom is a Firefly in the Dark.”

শেষ রাতে মিনতি বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চোখে নিজের মুখ দেখে। একসময় যেখানে শুধু চাপা অভিমান ছিল, এখন সেখানে রয়েছে দৃপ্তি, শান্তির রেখা। সে ফোন খুলে ‘Mira99’ অ্যাকাউন্টে শেষ একটি পোস্ট দেয়—
“আমার নাম মিনতি সেন। আমি একা ছিলাম, কিন্তু লিখতে লিখতে একা থাকা ভুলে গেছি। আমার গল্প এখন শুধু আমার নয়—এটা আমার মতো লক্ষ নারীর। তারা এখন জানে, ভয় নয়, ভালোবাসা দিয়ে নিজেকে তুলে ধরা যায়। যদি আমার মতো কেউ আড়াল থেকে এই পোস্টটা পড়ো—জানবে, তুমি একা নও। লিখো। বলো। হাঁটো। কারণ আমরা এখন সবাই মিলে মিরা।”

পোস্টটি ভাইরাল হয় না—তাতে তার কিছু আসে যায় না। কারণ সে জানে, তার আলো ছড়িয়ে পড়েছে অগণন ঘরের জানালায়। আরশিতে এখন অসংখ্য মুখ, প্রতিটি নিজের গল্প বলছে। মিনতি জানে, এখন তারা একা নেই—এক ঘরের মেয়েরা, এক দেশে, এক বিপ্লবে।

সমাপ্ত

1000033334.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *