Bangla - প্রেমের গল্প

ই-মেইলে ভালোবাসা

Spread the love

সোহম বসু


প্যারিসের এক শীতল সকালের আলো এসে পড়ছিল অন্বেষা দত্তর জানলার কাঁচে। জানলার ধারে রাখা ছোট কাঠের ডেস্কের ওপর ছড়িয়ে ছিল কাগজ, নোটপ্যাড, আর দু’টি পুরনো পত্রিকা। ঘড়ির কাঁটা আটটা ছুঁই ছুঁই করছিল, আর অন্বেষা তখনও সাদা মগে অর্ধেক শেষ না-হওয়া কফিতে চুমুক দিচ্ছিল। ঘুমভাঙা চোখে স্ক্রিনে তাকিয়ে সে লক্ষ্য করল, ইনবক্সে একটা নতুন ই-মেইল এসেছে — প্রেরক: “Sourav Laha.” বিষয়: “Your comment on my paper – Thank you.” হালকা বিস্ময় নিয়ে সে ক্লিক করল মেইলটা। কদিন আগেই সে এক আন্তর্জাতিক জার্নালে অজানা এক লেখকের গবেষণাপত্রে মন্তব্য করে দিয়েছিল—কিছু পরামর্শ, কিছু প্রশ্ন। মেইলটা ছিল ভদ্র, বিনীত, আর অনেকটা যেন ব্যক্তিগতও। “আপনার মন্তব্যগুলো অত্যন্ত সহায়ক ছিল,” সৌরভ লিখেছে, “বিশেষ করে আপনি যে অংশটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, তা নিয়ে আমি ভাবিনি কখনো।” এরপর দু-চার লাইনের মধ্যে সে লিখেছে তার বর্তমান কাজের কথা, আর শেষে হালকা করে জুড়ে দিয়েছে, “আপনার কাজগুলো কি কোথাও পাব?” এই শেষ লাইনটাই যেন অন্বেষাকে আটকে দিল। এতদিন ধরে শুধু গবেষণাপত্র, ডেটা, রেফারেন্স আর ল্যাবের ব্যস্ততার মধ্যে সে একটিবারও ভাবেনি—পৃথিবীর অন্য প্রান্তে কেউ তার লেখা মন দিয়ে পড়ছে, ভাবছে, প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে।

 

সেই একটা মেইলের পর তাদের যোগাযোগ শুরু হলো, প্রথমে সপ্তাহে এক-দু’বার, পরে দিনে একবার। অন্বেষার মনে পড়ে সেই এক সন্ধ্যেবেলা, যখন সে বারান্দায় বসে থাকা অবস্থায় সৌরভ প্রথম ভিডিও কলে আসতে চায়। একটু দ্বিধা নিয়ে সে হ্যাঁ বলেছিল, আর স্ক্রিনে যখন প্রথম সৌরভের মুখটা ফুটে উঠল—কালো রিমের চশমা, হালকা দাড়ি, শান্ত গলা—তখন কিছু অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল তার। সৌরভের কণ্ঠে ছিল ভারী কোমলতা, যেন প্রতিটি শব্দ সে মেপে মেপে উচ্চারণ করে। আলোচনা শুরু হয়েছিল গবেষণার ভাষায়—‘ecological displacement,’ ‘community trauma’—কিন্তু কথোপকথন কখন যে কবিতায় চলে গেছে, সেকথা তারা নিজেরাও বুঝতে পারেনি। সৌরভ হঠাৎ বলেছিল, “আপনি কি কখনো রাত তিনটেয় কিছু না বলে কাঁদেন?” অন্বেষা প্রথমে কিছু বলতে পারেনি, তারপর নিঃশব্দে মাথা নেড়েছিল। সেই মুহূর্তটা ছিল নিঃশব্দের ভিতর সবচেয়ে উচ্চারণযোগ্য অনুভব। তারা একে অপরের সময় জোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতে শুরু করল, দিনের শেষে যখন পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়ত, তখন অন্বেষা আর সৌরভ জেগে থাকত—স্ক্রিনের দুই প্রান্তে। কথার ফাঁকে একদিন অন্বেষা বলেছিল, “তুমি কি জানো, তুমি আমার জীবনে প্রথম এমন একজন, যার সঙ্গে আমি কখনো দেখা করিনি, তবুও মনে হয় যেন বহুদিনের পরিচিত?” সৌরভ হেসেছিল, সেই গলায় যে গোপন ক্লান্তি আর মায়া লুকিয়ে ছিল, তা অন্বেষা বুঝেছিল।

 

তবে সেই গভীর সংযোগের মাঝেও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছিল। বাস্তবের অভাব কখনো কখনো তাদের আড়ালে এনে ফেলত—সৌরভের বিষণ্ণ দুপুর, যখন সে আমেরিকার ক্যাম্পাসে একা বসে থাকত; অন্বেষার নিঃসঙ্গ উইকেন্ড, যখন ফরাসি সহপাঠীরা নিজেদের মধ্যে হারিয়ে যেত। ভিডিও কলে হাসি, চা নিয়ে গল্প, পড়া নিয়ে ঠাট্টা—এসবের ফাঁকে একটা মৌনতা মাঝেমধ্যে ঢুকে পড়ত, যাকে কেউ উচ্চারণ করত না। “আমরা কি কখনো একসঙ্গে বসে চায়ের কাপ ভাগ করে নিতে পারব?”—এই প্রশ্নটা সৌরভ একদিন হোয়াটসঅ্যাপে টাইপ করে আবার মুছে দিয়েছিল। একইভাবে অন্বেষা অনেকবার ভাবত—এই সম্পর্কটা কি সত্যিই আছে? নাকি শুধু ইন্টারনেটের বুদ্বুদ? কিন্তু আবার যখন স্ক্রিনে সৌরভের চোখের নিচে ক্লান্তির রেখা দেখতে পেত, বা তার কণ্ঠে চিন্তার ছায়া অনুভব করত—তখন যেন সত্যি মনে হতো, সে ভালোবেসে ফেলেছে। হয়তো স্পর্শহীন, হয়তো অলক্ষ্যে গড়া, কিন্তু ভালোবাসা তো শুধু কাছে থাকাটাই নয়—ভালোবাসা মানে তো বোঝাপড়া, নির্ভরতা, আর দুটো হৃদয়ের মৌন সেতুবন্ধন। অন্বেষা জানত, এই গল্পটা কোথায় যাবে, জানত না—তবু একটা ই-মেইলে শুরু হওয়া বার্তালাপ তার জীবনের কেন্দ্র হয়ে উঠছিল, নিঃশব্দে, নিভৃতে, আর একধরনের অপেক্ষার ছায়ায়।

***

ক্যালিফোর্নিয়ার রৌদ্রোজ্জ্বল বিকেলে সৌরভ লাহা বসেছিল বার্কলের লাইব্রেরির কোণার ডেস্কে, জানলার ঠিক পাশে। বাইরে সবুজ ঘাসে বসে কেউ গিটার বাজাচ্ছিল, আর লাইব্রেরির ভেতরে ছড়িয়ে ছিল ঠান্ডা নিরবতা, মাঝে মাঝে টাইপিংয়ের শব্দ ছাড়া সবটাই নিস্তব্ধ। সৌরভের সামনে খুলে থাকা ছিল দুটো স্ক্রিন—একটায় তার পরবর্তী গবেষণাপত্রের নোটস, অন্যটায় অন্বেষার সঙ্গে চ্যাটবক্স। সে টাইপ করে থামল, আবার লেখার চেষ্টা করল—“আজ তোমার গলার স্বর শুনতে ইচ্ছে করছে।” কিন্তু না, এই লাইনটা যেন খুব কাছের, খুব সাহসী। মুছে দিয়ে লিখল, “তোমার কালকের প্রেজেন্টেশনের লিংকটা পাবে?” কিন্তু মনের ভিতরে জমে থাকা শব্দগুলোকে আর চেপে রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। প্রায় পাঁচ মাস ধরে কথা বলছে তারা—প্রথমে মেইল, তারপর মেসেঞ্জার, এরপর নিয়মিত ভিডিও কল—তবু আজ হঠাৎ একটা অদ্ভুত দূরত্ব সৌরভ অনুভব করছিল। যেন কোনো কাচের দেয়ালের ওপারে দাঁড়িয়ে আছে অন্বেষা, খুব কাছেই আছে কিন্তু ছোঁয়া যায় না। সে জানত, তাদের সম্পর্কটার ভিতর একটা অলিখিত ব্যাকরণ কাজ করছে—যেখানে স্পর্শ নেই, নিঃশ্বাস নেই, কিন্তু আছে হৃদয়ের এক অদ্ভুত সংবেদন। এ সম্পর্ক কোথাও লেখা নেই, কোনো অভিধানে সংজ্ঞা নেই। তবু তার ভেতরে প্রতিদিন নতুন নতুন সংলাপ জন্ম নিচ্ছে, যা সে বলে না, শুধু অনুভব করে।

সেদিন রাতে অন্বেষা যখন ভিডিও কলে এল, সৌরভ একটু থেমে বলল, “তুমি কি জানো, আমি প্রতিদিন সকালবেলায় তোমার শেষ মেসেজটা আবার পড়ে দেখি? কারণ জানি, দিনের মাঝখানে তুমি ঘুমিয়ে থাকবে। আমার সময় অনুযায়ী দুপুর, তোমার রাত।” অন্বেষা হেসে বলেছিল, “আমি ঠিক উল্টোটা করি। তুমি যখন ঘুমোও, তখন আমি তোমার ভাঙা ইংরেজিতে লেখা চিঠির মতো ম্যাসেজগুলো পড়ে থাকি।” দুজনেই জানত, এই কথাগুলোর মাঝে এমন কিছু আছে যা সাধারণ বন্ধুত্বের গণ্ডি ছাড়িয়ে গেছে। অন্বেষা মাঝে মাঝে প্রশ্ন করত নিজেকে, কেন সে সৌরভের সঙ্গে এত কথা বলে? কেনই বা দিনের শেষে তার মনের ভিতর এক অদৃশ্য অপেক্ষা থাকে—একটি স্ক্রিনে একটি মুখ দেখার? বাস্তবে দেখা হয়নি, একই সময়ে বসে একই আকাশ দেখাও হয়নি—তবু তাদের মনে প্রতিনিয়ত একসাথে হেঁটে যাওয়ার অনুভূতি জন্মাচ্ছিল। অন্বেষা বুঝত, এই সম্পর্কের নিজস্ব ছন্দ আছে—যেখানে শব্দেরা ভারী হয়ে ওঠে, আর মৌনতা হয়ে যায় কবিতার মতো। সেদিন সৌরভ হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি কখনো ভাবো, আমাদের এই সংলাপটা যদি বন্ধ হয়ে যায়, যদি একদিন আর কথা না হয়?” অন্বেষা থেমে গিয়ে বলল, “ভাবি না, কারণ আমি জানি, আমরা কেউই এটা থামাতে পারব না। বন্ধুত্ব হয়তো টিকে না সবসময়, কিন্তু এই সংবেদনটা—এটা কিছুটা অমোঘ।”

পরদিন সকালে অন্বেষা তার জার্নাল খুলে লিখছিল—”Virtual connection, yet so real that even silence carries weight.” তারপর সে কিছুক্ষণ চুপচাপ জানালার ধারে বসে রইল। বাইরে রুয়ে দে রিভোলিতে গাড়ির শব্দ, হালকা মেঘলা আকাশ। তার হঠাৎ মনে হলো, তারা যেন একধরনের আকাশ-সংলাপ করছে—দুজনেই আলাদা মেঘের নিচে, তবু তাদের মনের ভেতর একই রকম আলোর রেখা। হঠাৎ স্ক্রিনে সৌরভের মেসেজ ভেসে উঠল—“একটা গান শুনো—‘Bhalobashi bhalobashi ei shurey bhalobashi’।” অন্বেষা অডিওটা চালিয়ে দিল, রবীন্দ্রসঙ্গীতের করুণ কোমলতা ভেসে এল প্যারিসের সকালের বাতাসে। সে জানত না, এ ভালোবাসা কী নামে ডাকা যায়—প্রেম, না কি শুধু গভীর যোগাযোগ? সে জানত না, এটা চলবে কতদিন, দেখা হবে কি না, কেউ বাস্তবে এসে তার হাতে ধরা দেবে কি না। কিন্তু সে এটা নিশ্চিত জানত—সৌরভ তার জীবনে এমন একটি নাম, যা হয়তো অনুপস্থিত থেকেও সবচেয়ে বেশি উপস্থিত। এটাই বোধহয় সেই অলিখিত ব্যাকরণ—যেখানে ভালোবাসা কথায় ধরা পড়ে না, কিন্তু প্রতিটি দৃষ্টির আড়ালে, প্রতিটি শব্দহীন রাতের ভিতর তার উপস্থিতি ঝিকিয়ে ওঠে। অন্বেষা জানালার বাইরে তাকিয়ে হাসল, আর মনের ভিতর একরাশ নিরব গান বাজতে লাগল—ক্লান্ত নয়, দুঃখী নয়—একধরনের মৌন ভালোবাসার গান, শুধু তাদের দু’জনের জন্য।

***

প্যারিসের জানুয়ারির হিমেল বাতাসে ঘরের ভেতরও কাঁপন ধরাচ্ছিল। অন্বেষা ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলেও চোখ ছিল অন্য কোথাও—হয়তো মন। আজ তিন দিন হয়ে গেছে, সৌরভ কোনো মেসেজ করেনি। না কোনও “গুড মর্নিং,” না “আজ তোমার হাসিটা মনে পড়ছে”—কিছুই না। প্রথম দিন অন্বেষা ভেবেছিল হয়তো ক্লাস ব্যস্ত, দ্বিতীয় দিন ভাবল হয়তো অসুস্থ, কিন্তু তৃতীয় দিন এসে মনে হচ্ছিল, কোথাও কি কোনো ছেদ পড়ল? সে স্ক্রিনে মেসেঞ্জারের ইনবক্স খুলে সৌরভের শেষ মেসেজটা দেখতে থাকল—“কাল কথা হবে, একটু ঘুম পাচ্ছে আজ।” তারিখ ছিল তিন দিন আগে। সে হাজারবার নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল যে এটি স্বাভাবিক, যে মানুষের জীবনে একেকদিন একেক রকম হয়। কিন্তু নিজের হৃদয়ের কাঁপুনিটা থামাতে পারছিল না। সে বুঝতে পারছিল, সৌরভের অনুপস্থিতি মানে এখন শুধু নিস্তব্ধতা নয়, বরং একধরনের শূন্যতা, একধরনের অপেক্ষার ভিতরে চাপা হাহাকার। অন্বেষা বারান্দায় এসে দাঁড়াল, দেখল প্যারিসের আকাশটা আজ মেঘে ঢাকা—যেমন তার মন। হঠাৎ নিজের অজান্তেই সে ফিসফিস করে বলে ফেলল, “তুমি কি সত্যিই ও প্রান্তে আছো?”

ওদিকে ক্যালিফোর্নিয়ায় সৌরভ সত্যিই নিঃশব্দে গুটিয়ে নিচ্ছিল নিজেকে। ল্যাবের প্রেজেন্টেশন, ফান্ডিং অ্যাপ্লিকেশন, আর বাড়ি থেকে আসা এক মেইল—মা’র হঠাৎ অসুস্থতার খবর সবকিছু যেন একসাথে হঠাৎ করে মাথার ওপর নেমে এসেছিল। সে চেয়েছিল অন্বেষাকে জানাতে, কিন্তু একইসাথে তার মনে হচ্ছিল, এতো দূরের সম্পর্কের ভিতর এসব খবর জুড়ে দিলে হয়তো ভার তৈরি হবে, হয়তো অন্বেষা বিরক্ত হবে, হয়তো এই ভার্চুয়াল ভালোবাসার সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার ভয় ছিল। সৌরভ চুপ করে গিয়েছিল, নিজের আবেগগুলোকে শব্দে বাঁধতে পারেনি। তবু যখন সে রাতে একবার ঘুম থেকে জেগে উঠে ফোনটা হাতে নিয়েছিল, তখন তার চোখ গিয়েছিল অন্বেষার প্রোফাইল ছবির দিকে—তুলনায় সামান্য এক ছবি, চুল এলোমেলো, চোখে একরাশ অব্যক্ত ক্লান্তি—কিন্তু সেই ছবির ভেতরেই ছিল একধরনের টান, যা তাকে জাগিয়ে রেখেছিল। সে মেসেজ টাইপ করতে গিয়েও থেমে গিয়েছিল—”অনেক কিছু বলতে পারি না, কিন্তু ভাবি প্রতিদিন।” এই লাইনটা সে লিখল না, শুধু নিজের ডায়েরির পাতায় লিখে রাখল। তার সেই পাতায় এক কোণে লেখা ছিল, “অদ্ভুত এক মেয়ে, অদ্ভুত এক সংযোগ, যার ব্যাখ্যা নেই, নাম নেই, কিন্তু অনুপস্থিতি সহ্য হয় না।”

অবশেষে চতুর্থ দিন রাতে, সৌরভ একবার সাহস করে অন্বেষাকে ভিডিও কল দিল। ল্যাপটপের স্ক্রিনে অন্বেষার মুখ ভেসে উঠতেই সৌরভ বলল, “আমি জানি, অনেকদিন হয়ে গেল… একটু হারিয়ে গিয়েছিলাম।” অন্বেষা কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে রইল তার দিকে, তারপর একধরনের ক্লান্ত হাসি দিয়ে বলল, “তুমি কি জানো, এই কয়েকদিন আমি শুধু ভাবছিলাম—তুমি কি ঠিক আছো?” সৌরভ বুঝতে পারল, দূরত্ব যতই থাকুক, এই মেয়েটা তার মনের আওয়াজ শুনতে পায়। এরপর তারা কিছুক্ষণ কোনো কথা না বলে তাকিয়ে ছিল একে অপরের দিকে, দুই স্ক্রিনের মাঝে যেটুকু স্পেস, তাতে যেন নিঃশ্বাসও জমে ছিল। অন্বেষা হঠাৎ বলল, “আমাদের এই সম্পর্কটার জন্য কি কোনও নাম আছে?” সৌরভ একটু থেমে বলল, “আছে না, আর দরকারও নেই। কিছু কিছু সংযোগ কেবল অনুভবের জন্য হয়, সংজ্ঞার জন্য নয়।” অন্বেষা মাথা নেড়ে বলল, “তবু আমি চাই, তুমি আর কখনও এমন নিখোঁজ হয়ো না। আমার অপেক্ষার ভেতর কেবল শব্দ নয়, স্পন্দন জমে থাকে।” সেই রাতে দুজনেরই ঘুম এল না, তারা কথা বলল অনেকক্ষণ—কাজের কথা, পরিবারের কথা, প্রিয় সিনেমার কথা, এমনকি মেঘলা আকাশের নিচে চা খাওয়ার কল্পনার কথাও। তারা জানত না ভবিষ্যতে কী আছে, দেখা হবে কি না, ভালোবাসা সত্যিই স্পর্শ ছাড়াই টিকে থাকবে কি না। তবু তারা জানত, এই সংযোগে একটা আলাদা জাদু আছে—যা প্রতিদিন ক্লিকের অপর পাশে অপেক্ষায় থাকে, জেগে থাকে, ভালোবেসে ফেলে নিঃশব্দে।

***

প্যারিসে বসন্ত এসে গেছে, গাছের ডালে ডালে কুঁড়ি ফুটছে, রাস্তাঘাটে মানুষের হাঁটাচলা বেড়েছে, ক্যাফেগুলোয় আবার কফির গন্ধে মুখরতা। কিন্তু অন্বেষার মনে বসন্ত আসেনি। মন তার আজকাল খুব ভার হয়ে থাকে—একা, নিশ্চুপ, যেন প্রতিটি দিনের ভেতর কোথাও একটা ফাঁকা ঘর পড়ে থাকে সৌরভের নাম দিয়ে চিহ্নিত। আগের মতো নিয়মিত কথা হয় না, মেসেজের উত্তরও মাঝে মাঝে দেরি করে আসে, আর কখনও কখনও আসে-ই না। কাজের চাপ আছে, সেটা সে বোঝে; তবে তার থেকেও বেশি যা সে টের পায় তা হলো—একটা অদৃশ্য দূরত্ব গড়ে উঠছে। একদিন রাতের দিকে, ক্যাম্পাস থেকে ফিরে ক্লান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে সে সৌরভকে একটা মেসেজ পাঠিয়েছিল—“আজ খুব মন খারাপ। শুধু তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকতে ইচ্ছে করছিল।” পাঁচ ঘণ্টা পর উত্তর এলো—“সরি, একটু বিজি ছিলাম। কাল কথা হবে?” এই “কাল” শব্দটা যেন কেমন একরকম ঠাণ্ডা শোনাল অন্বেষার কানে। কোথায় যেন সেই উষ্ণতা নেই, সেই আন্তরিকতা নেই, যার জন্য সে অপেক্ষা করে থাকত ঘন্টার পর ঘন্টা। সে জানালার ধারে বসে এক কাপ ক্যামোমাইল চা নিয়ে ভাবছিল—এই সম্পর্কটা কি ধীরে ধীরে ভেঙে যাচ্ছে? স্পর্শ তো ছিল না, দেখা তো হয়নি, শুধু শব্দ আর স্ক্রিন ছিল—এবার কি শব্দগুলোও হারিয়ে যাচ্ছে? সে জানে না, উত্তর নেই তার কাছে, তবু একটা ব্যথা চেপে বসে আছে বুকের মধ্যে।

ওদিকে সৌরভ নিজের ভেতরেই আটকে গেছে। মা’র চিকিৎসা নিয়ে দিনগুলো আর আগের মতো নয়। ক্যালিফোর্নিয়ার আলোঝলমলে বিকেল এখন তার কাছে কেবল একঘেয়ে রুটিন, হাসপাতালের রিপোর্ট, ফোনালাপ, আর চাপা দুশ্চিন্তার পর্দা। সে চায় অন্বেষাকে সবকিছু খুলে বলতে, জানাতে, শেয়ার করতে তার দুর্বল মুহূর্তগুলো। কিন্তু হঠাৎ তার মনে হয়—কেনই বা মেয়েটিকে এসব বোঝাবে? এত দূরের এক সম্পর্ক, যেখানে কোনো স্পর্শ নেই, ছায়াও নেই, শুধু কিছু কথা, কিছু চোখের দিকে তাকানো—সেখানে বাস্তবের যন্ত্রণার ভার জুড়ে দিলে সম্পর্কটা ভেঙে যেতে পারে। তাই সে চুপ থাকে। মেসেজ পড়ে দেখে, উত্তর না দিয়েই রাখে। সে জানে অন্বেষা অপেক্ষা করে, জানে মেয়েটি তার প্রতিটি চুপকে বোঝে, কিন্তু তারপরও তার নিজের কণ্ঠে যেন শব্দ উঠে আসে না। একদিন রাতে অন্বেষা তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “তুমি কি এখন আর আমার সঙ্গে কথা বলতে চাও না?” সে উত্তর দিতে পারেনি, শুধু দীর্ঘক্ষণ পর লিখেছিল, “তুমি জানো না, আমি প্রতিদিন তোমার কথা ভাবি, কিন্তু বলার মতো ভাষা খুঁজে পাই না।” সেই মেসেজের পর আর কিছু লেখেনি সে, কেবল ডায়েরির পাতায় লিখে গিয়েছিল একের পর এক বাক্য, যেগুলো হয়তো অন্বেষা কোনওদিন জানবেও না—“তুমি আমার প্রিয় অপেক্ষা, কিন্তু আমি জানি না তোমায় কোনোদিন ছুঁতে পারব কিনা।”

এক সন্ধ্যায়, শহরের এক নির্জন রাস্তা ধরে হেঁটে ফিরছিল অন্বেষা, হাতে বই, কাঁধে ব্যাগ, আর মনে নিঃশেষ এক অভিমান। হঠাৎ তার ফোনে একটা নোটিফিকেশন এল—সৌরভ একটা ছোট ভিডিও পাঠিয়েছে। সে অবাক হয়ে কানে হেডফোন গুঁজে ভিডিওটা চালাল। ভিডিওর শুরুতেই দেখা গেল সৌরভ একটা পার্কে বসে আছে, সূর্যের শেষ আলো মুখে পড়ছে। গলায় গিটার ঝুলছে, আর সে বলতে শুরু করল, “তোমায় অনেক কিছু বলা হয়নি, বলার সাহস পাইনি। কিন্তু আজ আমি গাইছি তোমার জন্য।” এরপর সে গাইতে শুরু করল—”এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলো তো?” গলার স্পন্দনে ছিল কাঁপুনির মতো অনুভূতি, প্রতিটি শব্দে যেন জমে থাকা সমস্ত মৌন অভিমানের প্রকাশ। অন্বেষা চুপচাপ দাঁড়িয়ে শুনতে থাকল, বুকের মধ্যে জমে থাকা কান্না যেন ধীরে ধীরে গলে পড়ছিল। গানের শেষে সৌরভ তাকিয়ে বলল, “আমাদের মধ্যে যেটা আছে, তার কোনো নাম নেই—তবু সেটা থেকে যায়, থেকে যাবে। তুমি যদি চাও, আমি আবার প্রতিদিন মেসেজ পাঠাব। আর না চাও, তবুও জানবে, আমি প্রতিদিন অপেক্ষা করি—একটা মেসেজের জন্য, একটা হাসির জন্য, তোমার নিঃশব্দ ভালোবাসার জন্য।” অন্বেষা তখন প্যারিসের রাস্তায় দাঁড়িয়ে, গলার কাছে কিছু আটকে থাকা নিয়ে চুপচাপ হাসল। বুঝতে পারল—ভালোবাসা হয়তো সবসময় উপস্থিত থাকে না, কিন্তু যেটুকু থেকে যায়, সেটাই সত্যি। অপেক্ষারও একটা ঠিকানা থাকে, হয়তো মেইলের ইনবক্সে, হয়তো কারও প্রতিদিনকার প্রার্থনায়। অন্বেষা জানত, তাদের সংযোগটা এক নতুন ব্যাকরণে গড়া, যেখানে ছুঁয়ে দেখা যায় না, কিন্তু হৃদয় স্পর্শ পায়—প্রতি ক্লিকে, প্রতি অপেক্ষায়।

***

প্যারিসের গ্রীষ্মকালের আলোয় শহর যেন একটু বেশি উজ্জ্বল, একটু বেশি জীবন্ত লাগে। রাস্তায় রাস্তায় জ্যাজ সঙ্গীত, খোলা ক্যাফেতে হাসির হুল্লোড়, আর বইয়ের দোকানে তরুণ-তরুণীদের কণ্ঠে কবিতার সুর। কিন্তু অন্বেষা দত্তর পৃথিবী যেন ঠিক এই রঙের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। কিছু একটা যেন ভিতর থেকে ফাঁপা হয়ে গেছে। সৌরভ নিয়মিত মেসেজ করে, সময় পেলেই ভিডিও কল করে, হেসে কথা বলে, এমনকি গত সপ্তাহে অন্বেষার জন্মদিনে সে একটা ভার্চুয়াল গিফট পাঠিয়েছিল—একটা অ্যানিমেটেড ই-বুক যেখানে ছোট ছোট লাইন লেখা ছিল: “তোমার হাসি আমার সকাল,” “তোমার ঘুম আমার রাতের শেষে আলোর মতন।” এসব দেখে মন ভরে যায়, কিন্তু তবু কোথাও একটা শূন্যতা রয়ে যায়। এখন আর কথা বলতে বলতে গলা কাঁপে না, চোখ জ্বলে ওঠে না। সম্পর্কের একটা সময় থাকে, যেখানে অনুভূতির গভীরতা শব্দের ওপরে চলে যায়; কিন্তু সেই গভীরতা ধরে রাখতে গেলে মাঝে মাঝে বাস্তবতার আশ্রয় দরকার হয়। অন্বেষা বুঝতে পারছিল, তাদের সম্পর্ক যেন একটা সুন্দর গল্পের মতো—যার ভাষা অসাধারণ, সংলাপ অতুলনীয়, কিন্তু ছুঁয়ে দেখার মতো পাতা নেই। তবু সে ভালোবেসে যাচ্ছে, প্রতিটি রাতে সৌরভের মেসেজের অপেক্ষায় থেকে যাচ্ছে, প্রতিটি সকালে তার নামের প্রথম আলোয় দিন শুরু করছে। সে নিজের কাছে স্বীকার করে নিয়েছে—ভালোবাসার সংজ্ঞা বদলেছে, এখন আর ছুঁয়ে দেখা নয়, একে অপরের অস্তিত্ব অনুভব করাই পরম সত্য।

ওদিকে বার্কলেতে সৌরভ ধীরে ধীরে নিজের ভিতরের জট ছাড়াতে পারছিল না। মায়ের চিকিৎসা কিছুটা স্থিতিশীল হলেও, তার নিজের ভিতরে যেন কোনো ওষুধ কাজ করছিল না। প্রতিদিনের কাজের ভিড়ে, ল্যাব রিপোর্ট, থিসিসের ডেডলাইন, সব মিলিয়ে এক অবর্ণনীয় চাপ। কিন্তু এই চাপে যে জিনিসটা তাকে টিকিয়ে রেখেছিল, সেটা ছিল অন্বেষার সঙ্গে তার কথা বলা। এমনকি একদিন ক্লাস শেষে লনে বসে সে শুধু অন্বেষার মেসেজগুলো পড়ে গিয়েছিল, একের পর এক। তাতে হয়তো খুব বেশি কথা ছিল না—“খেয়েছো?”, “আজ আকাশটা খুব মেঘলা”—তবু প্রতিটি শব্দে একধরনের আত্মীয়তা ছিল, যা পরিবারের বাইরে অন্য কোথাও সে পায়নি। একদিন নিজের অজান্তেই সে ক্যাম্পাসের এক কোণে বসে ডায়েরির পাতায় লিখে ফেলেছিল, “ভালোবাসা কি আসলে যোগাযোগ? যদি তাই হয়, তবে আমি প্রতিদিন তোমার সঙ্গে প্রেম করি—তোমার একেকটা বাক্যের সঙ্গে, তোমার নীরব অভিমানের সঙ্গে, এমনকি তোমার দীর্ঘশ্বাসের বিরতিগুলোর সঙ্গেও।” কিন্তু সেই কবিতার মতো ভালোবাসাও মাঝেমাঝে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়—“এই যে আমরা এতটা দূরে থেকেও এতটা কাছে, এ কি চিরকাল থাকবে?” সে জানত না। অন্বেষার হাসির পেছনে কি কোনো চাপা কষ্ট আছে? তার প্রতিদিনকার গল্পে কি কোনো না বলা কান্না আছে? অথচ সে বলতে পারে না। শুধু নিরবে বসে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে, অপেক্ষা করে সেই এক ঝলক মুখটা দেখার, যে মুখ তার সমস্ত অভাব পূরণ করে দেয়—কেবল উপস্থিতির বিনিময়ে।

সেদিন একরাশ সাহস সঞ্চয় করে সৌরভ হঠাৎ অন্বেষাকে মেসেজ করল—“তুমি কি চাও, আমি তোমার শহরে আসি?” অন্বেষা তখন বিছানায় শুয়ে ছিল, বই পড়ছিল, মনের ভিতর চলছিল হাজারটা ভাবনা, কিন্তু এই একটি লাইন পড়ে সে উঠে বসল। কয়েক সেকেন্ডের জন্য মনে হলো সময় থেমে গেছে। সে আবার বারবার মেসেজটা পড়তে লাগল। চোখে জল এসে গেল। এতদিন ধরে তারা শুধু ভেবেছে, বলেছে, কল্পনা করেছে, কিন্তু কখনোই বলার সাহস পায়নি কেউ—যে বাস্তবেই দেখা হতে পারে, যে এই স্ক্রিনের ওপারে থাকা মানুষটা একদিন সামনে এসে দাঁড়াতে পারে। অন্বেষা কিছু না বলে কল করল। সৌরভ কল রিসিভ করতেই অন্বেষা চুপ করে থাকল কয়েক মুহূর্ত, তারপর বলল, “তুমি যদি আসো, আমি অপেক্ষা করব। আমি হয়তো কিছু বলতে পারব না, হয়তো শুধু দাঁড়িয়ে থাকব, কিন্তু জেনো, আমার সমস্ত অপেক্ষা তোমার জন্যই।” সৌরভও চুপ করে থাকল, শুধু চোখের কোণটা একটু চিকচিক করছিল। তারা দুজনই জানত, এ সম্পর্কের কোনো সংজ্ঞা নেই—না প্রেম, না বন্ধুত্ব, না চেনা শব্দের কোনো বাঁধন। এটা একটা স্পর্শহীন স্পর্শ, যা সময়, দূরত্ব আর বাস্তবতার সীমা ছাড়িয়ে গিয়ে হৃদয়ের গভীর থেকে জন্ম নেয়। এবং সেটাই হয়তো ভালোবাসার সবচেয়ে সত্য রূপ—যা কেবল ভালো থাকার জন্য নয়, বরং ভালো থাকার প্রয়োজনেই জন্মায়।

***

চারদিন আগেই সৌরভের ফ্লাইট টিকিট কনফার্ম হয়েছিল—San Francisco থেকে Paris Charles de Gaulle, ১৪ ঘন্টা ২৫ মিনিটের যাত্রা। তবে তার অপেক্ষা যেন সেই মুহূর্তে শুরু হয়নি, শুরু হয়েছিল আরও আগে—যেদিন অন্বেষা নির্দ্বিধায় বলেছিল, “আমি অপেক্ষা করব।” এই বাক্যটার পর থেকে প্রতিটা দিনই সৌরভের কাছে গাণিতিক সময় ছিল না, বরং একেকটা হৃদয়ের ধ্বনি, একেকটা দুলতে থাকা চুম্বকের মতো মুহূর্ত। উড়োজাহাজে বসে যখন জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল, তখন তার মনে হচ্ছিল যেন বহু বছর ধরে জমে থাকা নিঃশ্বাসটা আজ ধীরে ধীরে মুক্তি পাচ্ছে। সে জানত না, সামনে কী অপেক্ষা করছে—দুই মানুষের মুখোমুখি হওয়ার পর ভার্চুয়াল ভালোবাসা টেকে কি না, কিংবা তাদের মধ্যকার দূরত্ব আর বাস্তবতা একে অপরকে গ্রহণ করতে দেবে কি না। তবু তার চোখে ছিল একরাশ আলো, মনে ছিল সেই অন্বেষার ক্লান্ত চোখ, সেই গলায় জমে থাকা অভিমান, সেই অপেক্ষার সংজ্ঞাহীনতা—যা তাকে এই দীর্ঘপথে টেনে এনেছে। ফ্লাইট ল্যান্ড করার সময়, তার বুকের মধ্যে কেমন একটা কাঁপুনি হচ্ছিল, ঠিক যেমন প্রথম প্রেমে হয়, যখন প্রথমবার হাতে ছোঁয়া হয় কারও—হয়তো ভুল করে, হয়তো ইচ্ছেতে।

চার নম্বর টার্মিনালের বাইরে দাঁড়িয়ে অন্বেষা দত্তের হাতের তালুতে ঘাম জমেছিল। সে বারবার ফোনে সময় দেখছিল, লোকজনের মুখে তাকিয়ে সৌরভকে খুঁজছিল, অথচ জানত না কোন পোশাকে আসবে, জানত না ওর চোখে আজ ক্লান্তি থাকবে, নাকি উত্তেজনা। যদিও তারা একে অপরকে স্ক্রিনে অসংখ্যবার দেখেছে, কিন্তু বাস্তবের আলো, বাস্তবের বাতাসে মানুষ আলাদা হয়ে যায়—হয়তো আরও আপন, হয়তো অচেনা। তার বুকের ভিতর কি ছন্দহীন কিছু বাজছিল? নাকি সেই ভালোবাসার শব্দ, যা এতদিন ধরে শব্দহীন থেকেছে? ঠিক সেই সময়, দরজা দিয়ে ধীরে ধীরে এক পরিচিত মুখ এগিয়ে এলো—কালো জ্যাকেট, কাঁধে ব্যাগ, চোখে ক্লান্তির রেখা, তবু ঠোঁটে সেই শান্ত হাসি। অন্বেষা কিছুক্ষণের জন্য স্থির হয়ে গেল। সৌরভও দাঁড়িয়ে গেল কয়েক কদম দূরে, যেন একসঙ্গে এগোনোর আগে সময়কে একটু থামতে দিতে চাইছে। তারপর ধীরে ধীরে দুজনই একে অপরের দিকে এগিয়ে এল। কথা হয়নি, কোনো আলিঙ্গন হয়নি, শুধু দাঁড়িয়ে থাকা—দুই চোখে দুই প্রশ্ন, দুই জলে এক গভীরতা। অন্বেষার চোখে জল চলে এসেছিল, সে নিচু গলায় বলেছিল, “তুমি এসেছো।” সৌরভ কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলেছিল, “আমি আসতেই চেয়েছিলাম। অনেক আগে থেকেই। কিন্তু সাহস পাইনি।” সেই মুহূর্তটা যেন সময়ের বাইরে ছিল—না অতীত, না ভবিষ্যৎ—শুধু সেই একটুকু বর্তমান, যেখানে শব্দ ছিল না, কিন্তু অনুভব ছিল, ঠাণ্ডা বাতাসে একটি উষ্ণ নিরবতা।

তারা দুজন হাঁটতে লাগল—শহরের দিকে, ক্যাফের দিকে, সেই পুরোনো লাতিন কোয়ার্টারের গলি ধরে, যে গলির ছবি অন্বেষা আগে পাঠিয়েছিল একদিন, বলেছিল, “এখানটায় বসে চা খেলে ভালো লাগে।” তারা আজ সত্যিই বসেছিল সেই ক্যাফেতে, দুই কাপ কফি নিয়ে, দুটি হাত একে অপরের দিকে রাখা—যেখানে কোনো আলিঙ্গন নেই, তবু একে অপরকে ছুঁয়ে আছে চোখের গভীরতায়। সৌরভ বলল, “জানো, আমি তোমার ছবি কখনো পূর্ণভাবে দেখিনি, শুধু চোখের দিকে তাকিয়ে থেকেছি বারবার। এখন দেখছি, পুরো মুখটাই তোমার মতো।” অন্বেষা হেসে বলল, “তুমি বাস্তবে আরও বেশি নিঃশব্দ, আর সেই নিঃশব্দতার ভেতর আরও বেশি উচ্চারণ লুকিয়ে আছে।” সেই দিন, সেই বিকেল, সেই প্যারিসের নরম রোদ যেন দুজনকে আলতো করে জড়িয়ে ধরেছিল। তারা কিছুক্ষণ গল্প করল, কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকল, তারপর হেঁটে চলল—সেই দৃশ্যের মতো যা কেবল সিনেমায় হয়, কিন্তু আজ বাস্তবে ঘটছে। তারা জানত না এরপর কী হবে, সম্পর্ক কোন দিকে যাবে, সময় তাদের কতটুকু জায়গা দেবে একে অপরের কাছে থাকার। কিন্তু এতটুকু তারা নিশ্চিত জানত—এই প্রথমবারের দেখা ছিল সেই বহুদিনের অদেখার সবচেয়ে পরিচিত রূপ, আর এই দেখা ভালোবাসাকে সংজ্ঞা দিল না, বরং তাকে ছুঁয়ে দেখা সুযোগ দিল। সংজ্ঞাহীন ভালোবাসা আজ বাস্তবে দাঁড়িয়েছে, নিঃশব্দে, নিভৃতে, অথচ নিখুঁতভাবে।

***

প্যারিসের শরৎকাল তখন নিজের সমস্ত রঙে সেজে উঠেছে। গাছের পাতায় হলুদ-কমলা ছোঁয়া, রাস্তায় শুকনো পাতা উড়ছে হাওয়ার ছন্দে, আর সেই হাওয়ার মাঝেই সৌরভ আর অন্বেষা হাঁটছে—হাত ধরাধরি নয়, তবে পাশাপাশি। দেখা হওয়ার পর সাত দিন কেটে গেছে। প্রতিদিন তারা শহরের একেকটা গলি ঘুরেছে—কখনও বুকশপ, কখনও নদীর ধারে বসে দীর্ঘ চুপ, আবার কখনও ছোট্ট রেস্তোরাঁয় বসে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে বিতর্ক। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার ছিল—যেখানে তারা ভার্চুয়াল জগতে প্রতি মুহূর্তে কথা বলত, সেখানে বাস্তবে এসে কথাগুলো যেন কেমন থেমে যেতে চাইছে। যেন চুপ করেই তারা একে অপরকে বেশি ভালোভাবে বুঝতে পারছে। প্রথম দিনকার উত্তেজনা ও আবেগ পেরিয়ে আজ তারা বসেছিল মন্টপারনাসের এক পুরনো কাফেতে, কফির কাপে ধোঁয়া উঠছে, চারপাশে গুঞ্জন, আর তাদের মধ্যে এক ধরনের শান্ত নিরবতা। অন্বেষা কাপটা হাতে নিয়ে বলল, “একটা কথা ভাবছি—যখন তুমি থাকবে না, আমি কি এই ক্যাফেতে একা এসে বসব?” সৌরভ নিচু গলায় বলল, “তুমি চাইলে এই মুহূর্তটাই চিরকাল রেখে দিতে পারো।” তারপর তারা চুপ করে রইল—তাদের কথা যেন আজ শব্দের বাইরেও কিছু বলছিল, এমন কিছু যা বোঝা যায় শুধু অনুভবে।

তাদের দেখা হওয়াটা ছিল বাস্তবের এক নিঃশব্দ বিপ্লব। এতদিন ধরে স্ক্রিনে দেখা, শব্দে প্রেম, অভিমানে নিরবতা—সব যেন ধীরে ধীরে একটি আলোর রেখায় এসে মিলেছে, যেটা ছুঁয়ে দেখা যায়, অনুভব করা যায়, কিন্তু কোনো গন্তব্যে পৌঁছায় না। তারা দুজনই জানত, সৌরভকে ফিরে যেতে হবে। এই শহর তার ঘর নয়, যেমন বার্কলে অন্বেষার বাড়ি নয়। তবু এই সাময়িকতার মাঝেও তারা প্রতিটি মুহূর্তকে পূর্ণ করে তুলতে চেয়েছিল—না নাটকীয় করে, না কোনো প্রতিশ্রুতি দিয়ে, বরং প্রতিটি শ্বাসে, প্রতিটি দৃষ্টিতে। এক সন্ধ্যায়, অন্বেষার ঘরে বসে তারা একটা পুরনো ফরাসি সিনেমা দেখছিল। দৃশ্যের পর দৃশ্যে সংলাপ কমছিল, চোখে জল আসছিল, অথচ কেউ কিছু বলছিল না। হঠাৎ সৌরভ বলল, “আমরা কি খুব বেশি ভাবি?” অন্বেষা তাকিয়ে বলল, “আমরা খুব কম বলি।” সৌরভ হাসল, “তবেই তো এতটা বোঝা সম্ভব হয়। বেশি বলা মানেই হয়তো বেশি গুলিয়ে ফেলা।” অন্বেষা চুপ করে জানালার দিকে তাকিয়ে ছিল। বাইরে একটা শীতল বাতাস বইছিল, সেই সঙ্গে ভেসে আসছিল কোথা থেকে যেন বেহালার সুর। তারা দুজনেই অনুভব করল—এই সঙ্গীত, এই নিঃশব্দতা, এই সন্ধ্যা তাদের অনেককিছু বলে দিচ্ছে, যা তারা নিজেরাই উচ্চারণ করতে পারে না।

শেষদিন সকালে, সৌরভের ফ্লাইটের কয়েক ঘণ্টা আগে, তারা নদীর ধারে এক বেঞ্চে বসে ছিল। সামনে দিয়ে বড় জাহাজ যাচ্ছে, বাতাসে একটা হালকা স্যাঁতস্যাঁতে ভাব। সৌরভ বলল, “এই নদীটা কিছুটা আমাদের সম্পর্কের মতো—প্রবাহিত, অবিচ্ছিন্ন, কিন্তু কোথাও যেন একটা গোপন দিক আছে, যা কেউ জানে না।” অন্বেষা মাথা নিচু করে বলল, “তুমি চলে গেলে আমি কি আবার সেই আগের মতো হব? সকালবেলা তোমার মেসেজ না পেলে মন খারাপ করব, কিন্তু জানব—তুমি আমার শহরে নেই। আমি কীভাবে সেই অভ্যেস ভাঙব?” সৌরভ তার দিকে তাকিয়ে বলল, “ভাঙার দরকার নেই। তোমার অভ্যেস আমি হয়ে থাকব, এমনভাবে যেন উপস্থিত থাকি, অথচ অনুপস্থিত।” তারপর তারা একে অপরের দিকে তাকাল, কোনো প্রতিশ্রুতি দিল না, কোনো ভবিষ্যতের কথা বলল না—শুধু সেই অনুচ্চারিত সংলাপেই সব রেখে দিল। এ ভালোবাসা হয়তো সবার বুঝে ওঠার নয়। এটা চিঠির মতো, যার প্রতিটি লাইনের মাঝে বিরতি আছে, তবু তাতে অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়। তারা জানত—দূরত্ব থাকবে, সময় তাদের ঠেলে দেবে বাস্তবতার মুখোমুখি, কিন্তু তারা একে অপরকে ছুঁয়ে গেছে এমনভাবে, যা সময়ের ধরাছোঁয়ার বাইরে। ভালোবাসার এই সংজ্ঞাহীন অধ্যায় তাদের জীবনের সবচেয়ে নিঃশব্দ অথচ সবচেয়ে উজ্জ্বল সংলাপ হয়ে রয়ে যাবে—একটি ক্যাফের কাপে, একটি শহরের নদীর ধারে, অথবা দুটি চোখে জমে থাকা সেই না-বলা কথার ভিতরে।

***

সৌরভের ফিরে যাওয়া যেমন ছিল অবধারিত, তেমনি ছিল অন্বেষার একাকিত্বে আবার ফিরে যাওয়া—নিজের পুরনো জীবনে, ক্লাসের মধ্যে, ক্যাফের চেনা মুখগুলোর ভিড়ে, আর সেই চুপচাপ জানালার ধারে বসে থাকার অভ্যেসে। তবু কিছু যেন বদলে গিয়েছিল। সে এখন আগের মতো প্রতিটা মেসেজে আবেগ খোঁজে না, ফোনের স্ক্রিনে অপেক্ষা করে না অস্থিরভাবে। বরং অপেক্ষা এখন তার জীবনের একটা স্থির নদী হয়ে গেছে, যেখানে শব্দের তাড়া নেই, শুধু প্রতিদিনকার প্রবাহ আছে। অন্বেষা বুঝে ফেলেছে, সম্পর্কের গভীরতা কখনো কখনো অভ্যেসের মতো হয়ে দাঁড়ায়, কিন্তু এই অভ্যেস একঘেয়ে নয়—বরং জীবনের সব থেকে বেশি নির্ভরযোগ্য অংশ হয়ে দাঁড়ায়। সে প্রতিদিন সৌরভের পাঠানো ছবিগুলো দেখে—সান ফ্রান্সিসকোর সকালের সূর্য, লাইব্রেরির জানালার বাইরের আকাশ, বা রাতের খাবারে তার প্রিয় পাস্তা—এইসব ছোট ছোট জিনিসের মধ্যে দিয়ে সৌরভ যেন তার দিনগুলোর পাশে থেকে যায়। আর অন্বেষা, তার নিজের শহরের বিকেলের আলো, পাতাঝরার রাস্তা বা ভেজা ক্যাফে টেবিলের ছবি তুলে পাঠায় সৌরভকে, যেন বলে—“আমি এখানেই আছি, তুমি ছিলে, আছো, থাকবে।” দুজনেই জানে, এই দূরত্বের মাঝেও তারা একটা সত্যি সংসার গড়ে তুলেছে—যেটা ছুঁয়ে দেখা যায় না, তবু টের পাওয়া যায় প্রতিদিন।

অন্যদিকে সৌরভের ভেতরেও এক ধরনের আশ্চর্য স্থিরতা এসে গিয়েছে। জীবনের সব দৌড়ঝাঁপের মাঝেও সে এখন প্রতি রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে অন্বেষার মেসেজ দেখে, তার গলায় একবার ‘গুডনাইট’ শুনে তবেই চোখ বন্ধ করে। ল্যাবের কাজ, থিসিস জমা দেওয়া, এমনকি মায়ের চিকিৎসা—সবকিছুর মাঝেও অন্বেষা যেন তার জীবনের একমাত্র অবিনাশী কণ্ঠস্বর, যার প্রতি একটুকরো নির্ভরতা সে খুঁজে পায়। একদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ করে তার খুব মনে পড়ল—প্যারিসে সেই প্রথম সন্ধ্যার কথা, যখন তারা নিরবে একসঙ্গে বসেছিল, কিছু না বলে অনেক কিছু বলেছিল। সেই স্মৃতিটা এতটাই জোরালোভাবে তাকে স্পর্শ করেছিল যে সে সেই মুহূর্তে ঠিক করল—“আমি আবার যাব। আর শুধু ঘুরতে নয়, থাকতে।” সে জানত না কাজের সুযোগ হবে কি না, বা অন্বেষার শহরে থাকার অনুমতি মিলবে কি না, কিন্তু তার মন বলছিল—এই ভালোবাসা শুধু স্মৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার নয়। সে ইমেইল করল প্যারিসের এক ইউনিভার্সিটিতে, গবেষণার সুযোগ আছে কি না জিজ্ঞেস করে। তার ঠিক পাঁচদিন পরে উত্তর এলো—“আপনার থিসিস আমাদের ইন্টারডিপার্টমেন্টাল স্কলারশিপের জন্য উপযুক্ত হতে পারে।” সৌরভ ফোনটা নিয়ে অন্বেষাকে কল করল, কিছু না বলেই শুধু হেসে বলল, “হয়তো আমি ফিরে আসছি। এবার অন্যভাবে, নতুন করে।”

সেই রাতটা অন্বেষার কাছে ছিল নিঃশব্দ আনন্দের এক বিস্ফোরণ। কিছুই ঠিক হয়নি, সবই অনিশ্চিত, কিন্তু শুধুমাত্র এই সম্ভাবনাটাই যে সে আবার আসবে, তাদের সম্পর্ককে আবার বাস্তব ছুঁতে পারবে—এই ভাবনাটাই যেন তার ভিতরে আলো জ্বালিয়ে দিল। সে জানত না ভবিষ্যত কী, তবে জানত, কারও জন্য অপেক্ষা করার মতো অনুভব পৃথিবীতে বিরল। সেই অপেক্ষার যদি ঠিকানা থাকে, তবে সম্পর্কটা শুধুই প্রেম নয়, একধরনের শিকড়। তাদের কথাবার্তা আবার নিয়মিত হতে লাগল, কিন্তু এবার আর মেসেজ বা ভিডিও কলে শুধু কল্পনা নয়, বরং পরিকল্পনার ছায়াও জুড়ে গেল। তারা দুজনেই বুঝতে পারছিল, ভালোবাসার সংজ্ঞা বদলেছে না, বরং পরিপূর্ণ হয়েছে—প্রথমে ই-মেইল, পরে ভিডিও কল, তারপর প্রথম দেখা, এবার হয়তো একসঙ্গে হাঁটার সুযোগ। অন্বেষা একরাতে তার জার্নালে লিখল—“ভালোবাসা যেন একধরনের চিঠি, যা মাঝে মাঝে দেরিতে পৌঁছায়, কিন্তু পৌঁছলে নিজের সবটা খুলে দেয়।” আর সৌরভ, তার ফাইলের ভিতরে রাখল অন্বেষার পাঠানো সেই ছবিটা—সেখানে লেখা ছিল: “তুমি ফিরলে, আমরা আবার শুরু করব। তবে এবার শব্দের বাইরে থেকেও ভালোবাসা লিখব, শুধু চোখের দিকে তাকিয়ে।”

***

বৃষ্টিভেজা এক সকাল ছিল সেটা, অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ, যখন অন্বেষা দত্ত আবার চার নম্বর টার্মিনালের সামনে দাঁড়িয়েছিল। এইবার হাত ঘামছিল না, বুক কাঁপছিল না, মুখে ছিল একধরনের শান্ত উদ্ভাস, চোখে অপেক্ষার আত্মবিশ্বাস। সে জানত সৌরভ আজ ফিরে আসবে, আর এবার কেবল অল্প ক’দিনের জন্য নয়—এইবার সে থাকবে। সত্যিই থাকবে, এই শহরে, এই জীবনে, এই প্রতিদিনের ভেতরে। তাদের দীর্ঘ সময়ের ভার্চুয়াল ভালোবাসা এবার বাস্তবের জালে আটকা পড়বে—একটি নতুন জটিলতা, আবার এক নতুন সম্ভাবনা। ফ্লাইট ল্যান্ড করেছে, সৌরভ আসছে, এইসব ভাবনার ভেতর হঠাৎ করে অন্বেষার চোখে পড়ল সেই মুখ, কালো জ্যাকেটে পরিচিত সেই হাঁটার ছন্দ। সৌরভ! সে হাসল, ঝাপটে ধরল না, দৌড়ে গেল না—শুধু শান্তভাবে এগিয়ে গিয়ে বলল, “তুমি এবার সত্যিই ফিরেছো।” সৌরভ ব্যাগ নামিয়ে রেখে বলল, “হ্যাঁ, ফিরেছি। আর এবার যাওয়ার কথা ভাবছিও না।” তাদের দুজনের মধ্যে যে নীরবতা তৈরি হয়েছিল, সেটা ছিল না-বলা কৃতজ্ঞতা, সংজ্ঞাহীন একটা বোধ—যেখানে কোনো নাটক নেই, নেই অতিরিক্ত উচ্ছ্বাস, শুধু দুটি মানুষের পরিণত হয়ে ওঠা ভালোবাসা।

সৌরভ এবার প্যারিসের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্টডক ফেলো হিসেবে যোগ দিল। কাজের চাপ যথেষ্ট, তবু প্রতিদিন অন্বেষার সঙ্গে দেখা হয়, কখনও সন্ধ্যাবেলা বইয়ের দোকানে, কখনও লুক্সেমবার্গ গার্ডেনে হাঁটতে হাঁটতে, কখনও একই টেবিলে বসে দুজন নিজের নিজের ল্যাপটপে কাজ করছে। ভালোবাসার ধরন বদলে গেছে—আগের মতো উদ্দীপনা নয়, বরং প্রাত্যহিকতার এক অংশ হয়ে উঠেছে সম্পর্কটা। অন্বেষা প্রথমে একটু অবাক হয়েছিল, এই বাস্তবতাকে মানিয়ে নিতে একটু সময় লেগেছিল। সৌরভের একটু দেরি করে আসা, কাজ নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকা—এইসব ছোট ছোট ব্যাপারগুলো সম্পর্কের একটা নতুন অধ্যায় লিখছিল। কিন্তু তবু একটা সত্যি কথা বুঝে গিয়েছিল অন্বেষা—যার সঙ্গে তুমি আগে মনের স্তরে ঘর বেঁধেছো, তার সঙ্গে দৈনন্দিনতা কেবল একটা স্বাভাবিক রূপান্তর। একদিন বিকেলে, ক্যাফের কোণায় বসে অন্বেষা বলেছিল, “জানো, আমি ভয় পাচ্ছিলাম, তুমি যখন সত্যি এসে থাকবে, তখন হয়তো আমি তোমায় ঠিক আগের মতো ভালোবাসতে পারব না।” সৌরভ থেমে তাকিয়ে বলেছিল, “ভয় আমি ওদিকেও পেয়েছিলাম—এই বাস্তব আমরা ধরতে পারব তো? কিন্তু ধরা তো পড়েছি, এতটা গভীরভাবে, যেখানে আর আলাদা হওয়ার পথ নেই।” তারা দুজনেই হাসল—একটা পরিণত প্রেমের মৃদু অথচ নির্ভরযোগ্য হাসি।

সপ্তাহ কেটে গেল, মাস ঘুরে গেল, ঋতু বদলাতে লাগল, কিন্তু এবার তাদের সম্পর্ক বদলাল না—বরং দৃঢ় হলো। অন্বেষা তার ঘরের জানালায় নতুন করে পর্দা টাঙালো, এক কোণে ছোট্ট একটা চেয়ার রাখল যেখানে সৌরভ বসে কবিতা পড়ে। সৌরভ অন্বেষাকে তার লেখালেখির জন্য একটা নতুন ল্যাপটপ গিফট করল, যেটার ব্যাক প্যানেলে ছোট্ট করে লেখা—“From Words to Warmth.” তারা সিনেমা দেখে, ঝগড়া করে, অভিমান করে, কিন্তু তারপর দুজনে চুপ করে একটা হাঁটা দিয়ে সব মুছে ফেলে। সম্পর্ক এখন আর ই-মেইলে গড়ে ওঠা দূরের এক কল্পনা নয়, বরং এই শহরের প্রতিটি শ্বাসে, প্রতিটি শব্দে ছড়িয়ে থাকা এক সহজ, নিখুঁত ভালোবাসা। স্ক্রিনে শুরু হওয়া প্রেম এবার খোলা জানালার হাওয়ায় দাঁড়িয়ে, আর তাদের দুজনের মুখে একটাই কথা—“এই ভালোবাসার ঠিকানা একদিন ছিল মেইলবক্স, আজ তা এই ঘরের প্রতিটি নিঃশ্বাস।”

***

প্যারিসের শীতে সেদিন হালকা তুষারপাত হচ্ছিল—আকাশ সাদা, রাস্তাঘাট কুয়াশায় ঢাকা। এমন এক সকালে অন্বেষা ঘুম থেকে উঠে সৌরভের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, “তুমি কি জানো, এতদিন পরেও আমি মাঝেমাঝে ভয় পাই—এইসব কেমন যেন স্বপ্নের মতো লাগে। তুমি, আমি, এই ঘরটা, আমাদের সকাল-রাত।” সৌরভ তখন জানালার কাচে জমে ওঠা শিশিরের ওপর আঙুল দিয়ে লিখছিল ‘A+S’, হাসিমুখে বলেছিল, “ভয় পাওয়াটাই তো প্রমাণ, এটা সত্যি।” সম্পর্কের শুরুতে তাদের যা ছিল অদৃশ্য—ভাষা, অনুভব, অপেক্ষা—এবার তা ধরা দিয়েছে ছোঁয়ার মধ্যে, অভ্যেসের মধ্যে, এমনকি একে অপরের নীরবতার মধ্যেও। তবু ভয় থেকেই যায়। মানুষ যখন সত্যিকারের ভালোবাসে, তখন সে কখনো নিশ্চিত হতে পারে না—এই পাওয়াটা চিরকাল থাকবে কি না। অন্বেষাও জানত না, কিন্তু সে এটুকু বুঝেছিল—ভালোবাসা মানে সব সময় উত্তর পাওয়া নয়, বরং সেই প্রশ্নগুলো নিয়ে যাপনের সাহস রাখা। আর সৌরভ, যিনি একসময় মেইলের শেষ লাইনে “তোমারই” লিখে থেমে যেতেন, এখন আর লিখেন না, শুধু অন্বেষার কপালে একটা চুমু দিয়ে বলেন, “তুমি আছো, সেটাই যথেষ্ট।”

একদিন, সেই একই নদীর ধারে, যেখানে প্রথম দেখা হয়েছিল, তারা আবার গিয়েছিল। এইবার শীতের কুয়াশায় নদীটা ছিল আরেকরকম—চুপচাপ, ধোঁয়াচ্ছন্ন, অথচ ভেতরে একটা উষ্ণতা। অন্বেষা বলল, “আমরা এখন কোথায় দাঁড়িয়ে আছি, সৌরভ? প্রেমের কোথায়?” সৌরভ চুপ করে রইল কিছুক্ষণ, তারপর বলল, “শব্দের বাইরেও কিছু জায়গা থাকে, যেখানে প্রেম আর ব্যাখ্যার দরকার হয় না। আমরা সেখানেই।” সম্পর্কটার বিশেষত্ব ছিল এইখানেই—এটা কখনোই আত্মবিশ্বাসে তৈরি হয়নি, বরং প্রশ্ন, ভয়, দূরত্ব, আর নৈঃশব্দ্যের ভিতর দিয়ে তারা একে অপরকে ধীরে ধীরে চিনেছিল। সৌরভ জানত, সে অন্বেষার জীবনের সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না, তবু সে থাকবে। অন্বেষা জানত, এই থাকা মানেই সবসময় ছুঁয়ে থাকা নয়, বরং একে অপরের প্রয়োজনের গভীরে নেমে যাওয়া। তাদের সম্পর্ক এখন আর মেইলে লেখা শব্দ নয়, স্ক্রিনে দেখা মুখ নয়, বরং দুটো কফির কাপের মাঝে শেয়ার করে নেওয়া এক ধরনের অসম্পূর্ণতা—যেটা ভীষণ সুন্দর, ভীষণ মানবিক।

এক রাতে, আলো-আঁধারিতে ঘরের ভেতর বসে অন্বেষা একটা কবিতা লিখছিল—শিরোনাম “ই-মেইলে ভালোবাসা”। কবিতার শেষ লাইনে সে লিখল, “তোমার অপেক্ষায় আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অধ্যায় লেখা হয়েছিল, অথচ তুমি কাছে এসে বুঝিয়ে দিলে—প্রেম মানে শুধু অপেক্ষা নয়, প্রেম মানে প্রতিদিনের নিঃশব্দ জেগে থাকা।” কবিতা পড়ে সৌরভ কাঁধে মাথা রেখে বলেছিল, “তোমার শব্দগুলো আমায় চুপ করিয়ে দেয়। আগে ভাবতাম, আমাদের প্রেমটা অসম্পূর্ণ। এখন বুঝি, ওটাই তো সৌন্দর্য।” তারপর দুজনেই জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল, প্যারিসের সেই নিঃশব্দ, তুষারে ঢাকা রাতের দিকে—যেখানে সব শব্দ থেমে গিয়েছে, কিন্তু হৃদয়ের ভাষা থেকে গেছে। ভালোবাসা হয়তো মেইল দিয়ে শুরু হয়েছিল, স্ক্রিনের ভেতর দিয়ে তাদের একে অপরকে চিনেছিল, কিন্তু এখন সেটা ভাষাহীন, শব্দহীন, উত্তরহীন—তবু পরিপূর্ণ। কারণ, ভালোবাসা সবসময় শব্দ খোঁজে না; কখনো কখনো সে শুধু পাশে বসে থাকা মানুষটার নিঃশ্বাসে নিজেকে খুঁজে নেয়।

___

 

1000033313.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *