ঋষভ চট্টোপাধ্যায়
পর্ব ১
পথঘাট যেন ধূলোর স্তুপে ঢাকা পড়ে গেছে। মাথার ওপর রোদের আগুন, পায়ের তলায় খসখসে গরম, আর মাঝখানে দাঁড়িয়ে ঋদ্ধি—একটি কাপড়ে মুখ বাঁধা, চোখে ভোঁতা সানগ্লাস, কাঁধে বাবার পুরনো হ্যান্ডহেল্ড ডেটা রিডার। আজ ‘ডে-৩৫৫’। টানা ৩৫৫ দিন বৃষ্টি হয়নি। সরকার যাকে বলে “জল-ঘাটতির স্বাভাবিক পর্যায়,” মানুষ তাকে বলে মৃত্যু-সপ্তাহ।
কলকাতা এখন আর সেই ছায়াঘেরা গাছতলার শহর নয়। রাস্তায় হাইব্রিড বাস চলে না, ট্রামের ট্র্যাক মরচে পড়ে ঝরে যাচ্ছে। মানুষ জল কিনে খায়, বাতাস ফিল্টার ছাড়া শ্বাস নেওয়া অসম্ভব। সন্ধ্যা নামলেই বন্ধ হয়ে যায় শহরের বিদ্যুৎ। লোডশেডিং এখন আর নিউজে আসে না—এটা এখন স্বাভাবিক।
ঋদ্ধির বয়স আঠারো, কিন্তু চোখে-মুখে সেই আঠারোর নির্ভারতা নেই। ওর বাবা ছিলেন ডঃ দিব্যেন্দু সেন, একজন পরিবেশবিজ্ঞানী, যিনি এক দশক আগে নিখোঁজ হয়ে যান এক গোপন গবেষণার সূত্র ধরে। সরকার বলেছে, “বিপর্যয়ে নিখোঁজ, সম্ভবত মৃত।” কিন্তু ঋদ্ধির মা আজও বিশ্বাস করেন—তিনি কোথাও আছেন। মা জানলার ধারে বসে থাকেন, বাতাসে নীরব আশার পসরা মেলে।
বাবার রেখে যাওয়া একমাত্র জিনিস হল সেই ডেটা রিডার—এক ধরনের হ্যান্ডহেল্ড প্রোটোটাইপ, যা ভূ-পরিবেশ ও আবহাওয়ার সংবেদনশীলতা বিশ্লেষণ করতে পারে। ঋদ্ধি এটা নিয়েই কাজ করে। স্কুল ছেড়ে দিয়েছে, কলেজে ভর্তি হয়নি—সে জানে, বই পড়ে এখন কিছু হবে না। বরং, সত্যিটা খুঁজে বের করতে হবে। কেন হঠাৎ করে সমস্ত প্রাকৃতিক চক্র ভেঙে গেল? কেন একসময় বর্ষার শহরে আজ ৩৫৫ দিন ধরে বৃষ্টি নেই?
ওর পাশে আছে তিনজন বন্ধু—নাফিস, অপর্ণা আর তৃষা। ওরা একে অপরকে “লাস্ট ক্লাইমেট জেনারেশন” বলে ডাকে।
নাফিস একটা হ্যাকিং টিম চালায়। স্কুলে থাকতে চুপচাপ ছেলে ছিল, এখন সে “ডার্ক গ্রিড” নামে পরিচিত এক ফোরামে ডেটা স্নিফ করে। অপর্ণা একজন কিশোরী বিজ্ঞানী—ভারতীয় বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে পুরস্কার পাওয়া মেয়ে, এখন ঘরে বসেই ওয়েদার সিমুলেশন তৈরি করে। তৃষা ছিল জুনিয়র রিপোর্টার, কিন্তু প্রচার-মাধ্যমের মুখোশ দেখে এখন নিজের ব্লগ চালায়—‘ব্লু ডেজ’। তারা সবাই জানে, সরকার কিছু লুকাচ্ছে। শহরের আকাশে যে কৃত্রিম মেঘ উড়ছে, সেগুলো বৃষ্টি আনছে না—বরং ঢেকে দিচ্ছে আসল আকাশ।
সেইদিন সকালে, ঋদ্ধির ডেটা রিডার হঠাৎ এক সংকেত ধরল। কনসোল স্ক্রিনে ভেসে উঠল—
“ARC-13: Activated // Signal Source: 22.56°N 88.35°E // Status: Dormant since Y+10”
তার মানে সেই সংকেত এসেছে একটা নির্দিষ্ট জায়গা থেকে—কলকাতার এক পুরনো জলবায়ু সংগ্রহশালার ভূগর্ভস্থ চেম্বার থেকে, যেটা গত সাত বছর ধরে ‘সিকিউরিটি রিস্ক’ বলে বন্ধ।
ঋদ্ধি ঠিক করল, আজ রাতেই ওখানে যাবে। বন্ধুদের জানাতেই, নাফিস চোখ টিপ মেরে বলে, “পুরনো সরকারী দরজা খুলতে হলে আমার সফটওয়্যার আছে।” অপর্ণা বলে, “আমি পোর্টেবল পাওয়ার সেল নিয়ে আসছি।” আর তৃষা বলে, “আমি ক্যামেরা আনব। খবরের ভিডিও না হলে কেউ বিশ্বাস করবে না।”
সন্ধ্যায় তারা চারজনে বেরিয়ে পড়ে। শহরের উত্তর প্রান্তে, এক আধা-ভেঙে পড়া রাস্তায় দাঁড়িয়ে সেই দরজা—মিউজিয়ামের প্রবেশপথ। দেওয়ালের ওপর কালি মাখানো, পুরনো লোহার গেট। পেছনে লেখা—“ইন্ডিয়ান ক্লাইমেট হিস্ট্রি মিউজিয়াম।” গেট প্রায় বন্ধ। কিন্তু নাফিস তার মিনি-ডিভাইস দিয়ে এক মিনিটে লক খুলে ফেলে।
ভিতরে ঢুকতেই চারপাশ নিস্তব্ধ। দেওয়ালে জং ধরা বোর্ড, ছাদে ঝুলে থাকা ভাঙা পাখা, আর সবথেকে বড় কথা—মাটির নিচে নামা সিঁড়ি, যা সোজা নিয়ে যায় সেই সংকেত উৎসে।
ওরা নিচে নামে। চারদিকে ঠান্ডা, ভিজে পাথরের গন্ধ, আর দূরের কোথাও ছুঁয়ে থাকা পানির আওয়াজ। অপর্ণা ডিভাইস লাগিয়ে বিদ্যুৎ জোগায়। পুরনো স্ক্রিন জ্বলে ওঠে।
ভিডিও ফুটেজে এক পুরুষ মুখ দেখা যায়—বাড়িয়ে ওঠা গোঁফ, ক্লান্ত চোখ, লাল লম্বা কোটে জর্জরিত মুখ। তিনি বলতে শুরু করেন—
“যদি এই বার্তা কেউ দেখে, বুঝবে আমি হয়তো আর নেই। জল নেই, বায়ু বিষাক্ত, শহর মরছে। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি। আমার প্রকল্পের নাম ‘আর্ক’। এটা শহরের শেষ সুযোগ। কিন্তু এটা শুরু করা যাবে শুধুমাত্র তখনই, যখন শেষ বৃষ্টি পড়বে। কোডটা আছে আমার রিডারে। যদি কেউ আমার পথ ধরে হাঁটে, তাহলে যাবে ‘হিমালয়ের ছায়া’র দিকে। ওখানেই চাবি লুকোনো আছে।”
ভিডিও থেমে যায়।
সবার নিঃশ্বাস আটকে থাকে। তৃষা ফিসফিস করে বলে, “হিমালয়ের ছায়া মানে কি?”
অপর্ণা মেলায়, “হয়তো সিকিম, বা উত্তরবঙ্গের কোনো সাব-জিরো অঞ্চল।”
নাফিস বলে, “ডেটা টেনে বের করতে হবে। কিন্তু একটা কথা ঠিক—ওখানে যেতে হবে।”
ঋদ্ধির চোখ ছলছল করে ওঠে। ওর বাবা—আজও বেঁচে না থাকলেও—এই সংকেত দিয়ে গেছে আশার পথ।
ওরা জানে, এবার আর ফেরার পথ নেই। শহর মরবে—কিন্তু তারা মরতে চায় না। বরং যদি বাঁচার কোনো রাস্তা থাকে, তা এই সংকেতের মধ্যেই আছে।
ওরা চারজন হাতে হাত রাখে। আগামিকালই রওনা হবে উত্তরের পথে।
পর্ব ২
রাতের শহরটা যেন বেঁচে থেকেও মৃত। লোডশেডিংয়ে ঢেকে আছে গোটা উত্তর কলকাতা। কাঁটাতারের ওপাশে হাওয়া গুনগুন করে বয়ে যায়, পাখিরা বহুদিন আগেই উধাও। মাটির নীচের সেই মিউজিয়ামের ঘরে দাঁড়িয়ে চারজনের চোখে তখন ভেসে উঠছে একটাই দৃশ্য—ঋদ্ধির বাবার ক্লান্ত মুখ আর তার সেই বার্তা, “যদি বাঁচতে চাও, হিমালয়ের ছায়ার দিকে যাও।”
তৃষা চুপ করে ছিল এতক্ষণ। এখন বলল, “কিন্তু আমরা জানি না কোথায় যাব। কীভাবে যাব। ট্রেন বন্ধ, বাস চলে না, জ্বালানি নেই।”
অপর্ণা বলে, “জ্বালানি নেই ঠিকই, কিন্তু পুরনো রেলপথ এখনো আছে। টানেলের ভিতর দিয়ে গিয়ে কোনোভাবে দার্জিলিং লাইনের দিকে পৌঁছানো সম্ভব।”
নাফিস চোয়াল শক্ত করে বলে, “আমার চেনা কয়েকজন রেইল স্কেভেঞ্জার আছে। ওরা মাঝেমধ্যে গোপনে ট্রলি চালায় জলের খোঁজে। আমি যোগাযোগ করব।”
সিদ্ধান্ত হয়ে যায়—আগামী রাতেই ওরা রওনা দেবে উত্তরের দিকে। লক্ষ্য: “হিমালয়ের ছায়া”—যেখানে এক সময় ঋদ্ধির বাবা কোনও গোপন প্রজেক্ট ‘আর্ক’ শুরু করেছিলেন।
ঘরে ফেরার পথে তৃষা ফোনে তার ব্লগে লিখে ফেলে—
“শেষ বৃষ্টির আগে, আমরা যাচ্ছি সেই জায়গায় যেখানে হয়তো বেঁচে থাকার শেষ সুত্র আছে। যদি না ফিরি, জানবে—আমরা শেষ হয়ে যাইনি, বরং শুরু করেছিলাম।”
এই পোস্ট একটা আগুন ছড়িয়ে দেয়। হাজার হাজার কমেন্ট, কেউ বলে, “প্লিজ লাইভ স্ট্রিম করো”, কেউ লিখে, “আমরাও চাই তোমরা বাঁচো”, আবার কেউ কুৎসা করে বলে, “তোমরা পাগল, সরকার তোমাদের খুন করবে।”
তৃষা কেবল একটা লাইন উত্তর দেয়—“আমরা ছায়ার দিকে যাচ্ছি, আলোর সন্ধানে।”
পরদিন রাত দুটো। ওরা চারজনে হাজির হয় শিয়ালদা স্টেশনের পুরনো প্ল্যাটফর্মে—যেটা এখন ব্যবহার হয় না। নাফিসের সংযোগে আসে একজন কুলি-কাম-স্কেভেঞ্জার—নাম তার গৌতম, বয়সে পঁয়ত্রিশ, কাঁধে লোহার দণ্ড, আর গলার স্বরে আতঙ্কের সঙ্গে অভিজ্ঞতা মেশানো।
“তোরা এতটা উত্তরে যেতে চাস? ওইদিকে এখন কেউ যায় না… বরফের নিচে লুকিয়ে আছে অন্ধকার। গুহা বন্ধ হয়ে যায় নিজে থেকেই,” গৌতম বলে।
অপর্ণা এগিয়ে আসে, “আমরা জানি ঝুঁকি আছে। কিন্তু এই শহরে পড়ে থাকলে আমরা মরব নিশ্চিত। অন্তত চলতে তো পারি।”
একটা ছয়চাকার ট্যাকেল-ট্রলি বের হয় স্টোরেজ ঘর থেকে। জ্বালানির জায়গায় লাগানো হয়েছে সৌর প্যানেল ও ব্যাটারি প্যাক। নাফিস সেটিংস করে দেয়। গতি কম, কিন্তু চলবে। নকশা অনুযায়ী, ওরা যাবে রানাঘাট, তারপর গোপন একটি টানেল ধরে মালবাজার, সেখান থেকে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে শিলিগুড়ি—তারপর হিমালয়ের পাদদেশ।
ট্রলি ছেড়ে দেয় রাত তিনটেয়। সামনে অন্ধকার টানেল, চারপাশে পাথরের দেওয়াল। মাঝে মাঝে ইঁদুর ছুটে যায়, কোথাও কোথাও ধ্বসে পড়া ইটপাথর। শব্দ নেই, শুধু ট্রলির ধাতব আওয়াজ আর হৃদস্পন্দন।
রাস্তায় যেতে যেতে অপর্ণা বলে, “জানো, পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়লেও কিছু অঞ্চল বরফে চাপা পড়ে গেছে। এই ডেটা আমরা বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে পাইনি। সরকারি রিপোর্টে শুধু বলা হয়, ‘অবসারভেশন চলছে’—তাহলে কেন এই পরিবর্তন?”
তৃষা উত্তর দেয়, “কারণ সরকার চায় না আমরা ভাবি। তারা শুধু চায়, আমরা মানি। বৃষ্টি না হওয়া, গাছ কাটা, জল নষ্ট—এসব যেন শুধু আমাদের দোষ, অথচ আসল নিয়ন্ত্রণে যারা, তারা নিশ্চুপ।”
হঠাৎ ট্রলি থেমে যায়।
নাফিস চমকে ওঠে, “শিট! পাওয়ার ড্রপ! হয়তো ব্যাটারি ওভারলোড!”
অপর্ণা নিচু হয়ে দেখে, “নাহ, এটা ওভারলোড না। কেউ জ্যামার চালিয়েছে।”
ঋদ্ধি সামনে আলো ফেলে দেখে—দু’জন লোক টানেলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে। মুখে স্কার্ফ বাঁধা, হাতে রড।
“তোমরা কোথায় যাচ্ছ?”—একজন গর্জে ওঠে।
তৃষা সাহস করে বলে, “আমরা উত্তরে যাচ্ছি। এক বন্ধুকে খুঁজতে।”
লোকটা হেসে ওঠে, “বন্ধু? না কি তথ্য?”
নাফিস চিৎকার করে, “আমরা সাধারণ মানুষ! আমাদের কিছু লাগবে না, যেতে দাও!”
একজন এগিয়ে আসে, চোখে লালচে গ্লো। “তোমরা যদি প্রকল্প ‘আর্ক’ খুঁজতে যাও, তাহলে ফিরে এসো। ওইদিকে গেলে শুধু বরফ না, মৃত্যু অপেক্ষা করছে।”
ঋদ্ধি চুপ করে ছিল। এবার সে বলে, “আমার বাবা ডঃ দিব্যেন্দু সেন। তোমরা যদি জানো এই নাম, বুঝবে—আমাদের আটকানো যাবে না।”
দু’জন লোক একে অপরের দিকে তাকায়। তারপর ধীরে ধীরে সরে যায়। “তাহলে যাও, পিছুটান থাকলে আজই ফিরে এসো।”
ট্রলি আবার চলতে শুরু করে। সবার চেহারায় এবার আর আতঙ্ক নেই—বরং এক অদ্ভুত দৃঢ়তা।
ট্রলি চলতে চলতে এক সময় পাহাড়ি রাস্তায় উঠে আসে। গাছ গুলো কালো ছায়া ফেলে রাখে, আর দূরে কোনো এক জায়গায় একটা অদ্ভুত কুয়াশা জমে আছে—চোখে ধরা দেয় না, কিন্তু অনুভবে বোঝা যায়।
সেই কুয়াশার মধ্যেই হয়তো আছে সেই হিমালয়ের ছায়া। হয়তো আছে বাঁচার রাস্তা। হয়তো…
তৃষা আবার লিখে ফেলে ব্লগে—
“রেললাইন মুছে গেছে, কিন্তু দিক ঠিক আছে। সামনে কুয়াশা, পেছনে মৃত্যু। আমরা ঠিক করেছি—এই পথেই হাঁটব, যতদূর যাই।”
তাদের চারপাশে ছায়া ঘন হয়, কিন্তু তাদের ভিতর আলোর বিন্দুটি এবার একটু বড়, একটু উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
পর্ব ৩
রাত তখন প্রায় শেষ। ট্রলির আলো কুয়াশা ভেদ করে চলেছে উত্তরের পথে। তারা যখন মালবাজারের অদূরে পৌঁছোয়, চারপাশে শুরু হয়েছে শীতলতা। বাতাসে আর্দ্রতা বেড়েছে, গাছপালা ঘন হচ্ছে, আর কোথাও যেন দূরে জল পড়ার ক্ষীণ শব্দ—যেটা স্বপ্ন বলে মনে হয়, কারণ শহরে তারা অনেক দিন কোনো জল পড়তে দেখেনি।
ঋদ্ধি ডেটা রিডার নিয়ে বসে আছে। সেটার ডিসপ্লে-তে একটা ম্যাপ ধরা পড়েছে—পুরনো এক হিমালয় গবেষণা কেন্দ্রের রেকর্ড, যেটা ২০৩৮ সালের পর আর আপডেট হয়নি। সেই ফোল্ডারে লেখা: “Project ARC — Contingency Shelter Location.” মানচিত্রটা ধীরে ধীরে খুলে যায়: নীল রেখা টেনে নিয়ে গেছে শিলিগুড়ি থেকে একটি গোপন ঘাঁটির দিকে—জায়গাটার নাম চিয়াবাং।
“চিয়াবাং?” অপর্ণা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করে, “এই নাম তো আমি কোনো মানচিত্রে দেখিনি।”
নাফিস বলে, “হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবে মুছে ফেলা হয়েছে। গুগল ম্যাপ তো আর সব দেখায় না।”
তৃষা ফোনে সার্চ করে কিছুই পায় না। “জায়গাটা বাস্তবের বাইরে,” সে বলে, “কিন্তু ওদের বাস্তবটা তো আমরাও জানি না।”
ঋদ্ধি চুপ করে থাকে। তার মনে পড়ে যায় বাবার মুখ—একবার তাকে বলেছিলেন, “সবচেয়ে বড় গবেষণাগুলো প্রকাশ হয় না, বরং চাপা পড়ে যায়। কারণ যদি মানুষ সত্যটা জানতে পারে, তাহলে যারা ক্ষমতায়, তারা কাঁপতে শুরু করে।”
ট্রলি এবার পাহাড়ের পাদদেশে এসে দাঁড়ায়। সামনে একটা পুরনো মিলিটারি রোড, যেটা এখন ভেঙে পড়েছে। গাছপালা গ্রাস করেছে রাস্তাটিকে।
গৌতম বলে, “এখান থেকে আমি যেতে পারব না। এই রাস্তা আমি চিনি না। ওদিকে রেডিয়েশন লেভেল বেড়ে যায় মাঝে মাঝে। লোক উধাও হয়েছে।”
তৃষা তার পিঠে হাত রাখে। “তুমি অনেক সাহায্য করেছো। এবার আমাদের যাত্রা নিজেরাই শেষ করব।”
ওরা ব্যাগ কাঁধে তোলে। ব্যাগে আছে জল, শুকনো খাবার, সৌরচার্জার, ও কিছু গোপন ডিভাইস। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ, ঋদ্ধির কাছে বাবার রিডার।
হাঁটতে হাঁটতে পথ যেন আরো রহস্যময় হয়ে ওঠে। গাছের পাতাগুলো অস্বাভাবিকভাবে সাদা হয়ে আছে, যেন পুড়ে গেছে। কোথাও কোথাও গন্ধ আসে কেমিক্যালের। ওপরে মেঘ জমেছে, কিন্তু কোনো বৃষ্টির লক্ষণ নেই। আলো-ছায়ার খেলা চলে পাহাড়ের গা বেয়ে।
একটা মোড় পেরিয়ে তারা যখন এক নির্জন উপত্যকায় ঢোকে, তখন ডেটা রিডার আবার সংকেত ধরে। স্ক্রিনে একটা লেখা ভেসে ওঠে—
“ARC Access Code Detected – Encryption Level: Legacy Prime – Unlock with Voice Print of Dr. D. Sen.”
সবার মুখ থমকে যায়।
অপর্ণা বলে, “মানে, এটা খুলবে না যদি না তোমার বাবার কণ্ঠস্বরে খোলা যায়।”
ঋদ্ধির গলা শুকিয়ে যায়। “কিন্তু বাবা তো… আর নেই।”
নাফিস হঠাৎ বলে, “তোমার কাছে কি কোনো পুরনো রেকর্ডিং আছে? ভিডিও, অডিও?”
ঋদ্ধি মাথা নাড়ে। “মা’র ফোনে ছিল একবার, যেখানে বাবা জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছিল।”
তৃষা বলে, “চলো ফোনটা আনাই। ফোনের ব্যাকআপ হয়তো ক্লাউডে আছে।”
ঋদ্ধি বলে, “কিন্তু মা শহরে, অনেক দূরে। আর ক্লাউড তো এখন অচল।”
সবার মন খারাপ হয়ে পড়ে।
অপর্ণা ভাবে কিছুক্ষণ। তারপর বলে, “কিন্তু তোমার বাবার সেই ভিডিও বার্তাটা? যেটা আমরা মিউজিয়ামে দেখেছিলাম?”
ঋদ্ধি চমকে ওঠে। “হ্যাঁ! ভিডিওটা আমি সংরক্ষণ করেছিলাম পেনড্রাইভে।”
সে ব্যাগ থেকে ডিভাইস বার করে, অপর্ণার ল্যাপটপে সংযুক্ত করে। ভিডিও প্লে করে। সেখানে বাবার কণ্ঠস্বরে ভেসে আসে—“যদি এই বার্তা কেউ দেখে, তার মানে আমি হয়তো আর নেই…”
অপর্ণা সাথে সাথে সেই অংশটা ট্রিম করে আলাদা করে নেয়, তারপর একটা ভয়েস রিপ্লিকেটর সফটওয়্যার চালায়—যা সেই কণ্ঠস্বরের বেস টোন তৈরি করতে পারে।
তিনবার চেষ্টা করার পর, ডেটা রিডার ভিজিয়ে ওঠে সবুজ আলোয়। স্ক্রিনে লেখা ভেসে ওঠে—
“Welcome, Dr. D. Sen. Access Granted.”
এক মুহূর্তে একটা নতুন মানচিত্র খুলে যায়। চিয়াবাং-এর পথ আরও স্পষ্ট হয়। সেখানে লাল বিন্দুতে চিহ্নিত একটি জায়গা—ARC Dome। লেখা আছে, “Contingency Vault | Temperature Stabilizer | Aquifer Source | Human Capsule Reserve – Max 150 People.”
ঋদ্ধির চোখে জল এসে যায়। বাবা শুধু গবেষণা করেননি, একটা পৃথিবীর বিকল্প তৈরি করেছিলেন।
নাফিস ফিসফিস করে বলে, “এটাই তাহলে শহরের শেষ শ্বাস। বাঁচার একমাত্র রাস্তা।”
তৃষা ফোনে ব্লগ খুলে আবার লিখে দেয়—
“আমরা হেঁটে চলেছি এমন এক জায়গায়, যেখানে জল জমে আছে পাহাড়ের নিচে, সময় জমেছে গুহার ভিতরে। Project ARC—এটাই আমাদের পৃথিবীর লাস্ট ব্যাকআপ।”
ঋদ্ধি এবার চুপ করে ডেটা রিডারে বাবার নামটা স্পর্শ করে। “তুমি আজও আছো, বাবা। আমাদের ভেতরে।”
চোখের সামনে সূর্য উঠে এসেছে ধূসর আকাশের কোণে। অদ্ভুত হলুদ আলো পড়ছে গাছের পাতায়, যেন তারা ঠিক ঠিক সবুজ নয়, কিন্তু বেঁচে আছে। বাতাসে কুয়াশার গন্ধ, আর কোথাও যেন দূর থেকে একটা কাচ ভাঙার শব্দ আসছে।
তারা জানে, এখনো পথ অনেক। কিন্তু মানচিত্র আছে, সংকেত আছে, আর আছে বিশ্বাস।
পর্ব ৪
চিয়াবাং—এ নামটার কোনো অস্তিত্ব নেই বর্তমান মানচিত্রে, কিন্তু ঋদ্ধিদের ডেটা রিডার সেটা সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করেছে। মানচিত্র বলছে, হিমালয়ের উপত্যকার পাথুরে পাঁজরের নিচে একটা গোপন সাব-আর্কেটিক সেল্টার আছে, যেটার নাম ‘ARC Dome’। সেখানে আছে হাইড্রোঅ্যাকুইফার, মানে—ভূগর্ভস্থ বিশুদ্ধ জলাধার। আর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা—যার সাহায্যে বাইরে তীব্র ঠান্ডা বা তাপের মধ্যেও মানব শরীরের পক্ষে সহনীয় একটা পরিবেশ টিকে থাকতে পারে।
“বেশি দূর নেই,” অপর্ণা স্ক্রিনে তাকিয়ে বলে, “আর দশ কিলোমিটার মতো।”
তৃষা খোলা গায়ে জ্যাকেট চাপায়। “ঠান্ডাটা বাড়ছে। গাছের রঙগুলোও বদলাচ্ছে। কেমন যেন ধূসর সবুজ।”
নাফিস পেছন ফিরে দেখে—দূর পাহাড়ে কুয়াশার চাদর নেমে আসছে। “চলো, যত তাড়াতাড়ি পারি পৌঁছোই। এই কুয়াশা প্রাকৃতিক না হলে বিপদ আছে।”
পথ এক সময় একটা সংকীর্ণ গিরিখাতে গিয়ে ঠেকে। সেখানে দাঁড়িয়ে একটা ছোট ঝরনা। তার পাশে লতাগুল্মে ঢাকা এক পাথরের দরজা। মনে হয়, কোনো এক পুরনো বৌদ্ধ মঠের ধ্বংসাবশেষ। কিন্তু ডেটা রিডার বলছে—এইটাই প্রবেশপথ। ARC Dome-এর একমাত্র প্রবেশদ্বার।
ঋদ্ধি হাতে তুলে নেয় রিডার। স্ক্রিনে লেখা—“Manual Authentication Required – Retinal or Thumbprint of Authorized Personnel”
তৃষা কপাল ঠুকে বলে, “অথচ আমাদের কাছে আছে কেবল একটা পুরনো ভিডিও। তোমার বাবার চোখ বা আঙুল তো আমাদের কাছে নেই!”
অপর্ণা ভাবে কিছুক্ষণ, তারপর বলে, “তুমি বলেছিলে, তোমার বাবার ল্যাবের একটা প্রোটোটাইপ ছিল—ঐ রিডারটাই। সম্ভবত সেটার মধ্যে আংশিক বায়োমেট্রিক সিগনেচার এনক্রিপ্টেড আকারে রয়ে গেছে।”
নাফিস বলে, “আমি ট্রাই করে দেখি এনক্রিপশন ব্রেক করতে পারি কিনা।” সে তার পোর্টেবল হ্যাকিং রিগ বসিয়ে ফেলে।
অপর্ণা সাহায্য করে অ্যানালগ লাইনের ইনফারফেস পোর্টে সংযোগ দিয়ে। সেকেন্ড কুড়ির মাথায় স্ক্রিনে লেখা আসে—
“Genetic Fragment Verified – Limited Access Granted”
পাথরের দরজা হালকা কেঁপে ওঠে। বাতাসে ধাতব ঘর্ষণের একটা কর্কশ শব্দ। তারপর ধীরে ধীরে দরজাটা সরে যায়। তার পেছনে দেখা যায় সিঁড়ির মতো একটা পাথরের পথ, যা নিচের দিকে নেমে গেছে। আলো নেই, বাতাস থমকে গেছে।
“এটাই তাহলে সেই জায়গা,” ঋদ্ধি ধীরে বলে ওঠে।
ওরা চারজন মোবাইল লাইট জ্বালিয়ে ভিতরে ঢোকে। নিচে নামার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডাটা কাঁপিয়ে দেয় শরীর। দেয়ালের গায়ে ছত্রাকের দাগ, কোথাও কোথাও লালচে ছোপ। তৃষা মুখ ঘুরিয়ে বলে, “এই জায়গাটা যেন সময়ে জমে আছে। অনেক বছর ধরে কেউ আসেনি।”
একটা বিরাট কক্ষের দরজায় পৌঁছেই তারা থেমে যায়। সেই দরজায় লেখা—“ARC DOME: Contingency Shelter Alpha-1”
তাদের হৃদস্পন্দন থেমে আসে কয়েক মুহূর্তের জন্য।
ঋদ্ধি হাত বাড়িয়ে দেয়াল ঘেঁষে একটা স্ক্যানারে হাত রাখে। স্ক্যানার আলো জ্বালে, তারপর দরজাটা খুলে যায়।
আর ভিতরে দেখা যায়—আলো। হ্যাঁ, সত্যিকারের আলো, কৃত্রিম না, যেন কোনও প্রাকৃতিক আলোর প্রতিফলন। ভিতরে বিশাল গম্বুজ। দেয়াল জুড়ে গাছের মতো দেখতে কিছু হাইড্রো অ্যারোগার্ডেন, জল চলাচলের স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা, এবং ছাদের ওপরে এক বিশাল আলোক-ভবন, যা বাইরে সূর্যের আলো প্রতিফলিত করে ভিতরে এনে দিচ্ছে।
তৃষা চোখ বড় করে বলে, “এটা তো একটুকরো পৃথিবী, যেটা আর বাইরে নেই!”
নাফিস এক কোণে গিয়ে দেখে—সোলার স্টোরেজ ইউনিট, স্যাটেলাইট লিংক, আর পুরনো কম্পিউটার টার্মিনাল। সে চালু করার চেষ্টা করে। অপর্ণা ততক্ষণে হাইড্রো সিস্টেম পরীক্ষা করে জানায়, “এখানে বিশুদ্ধ জল আছে! পাম্পিং ইউনিট এখনো সচল। এতদিন পরেও!”
ঋদ্ধি একটা দেয়ালের কাছে এসে বসে পড়ে। সেখানে একটা ছোট মেটালিক প্যানেলে খোদাই করে লেখা—
“For Riddhi – If the world fails, you must begin again.”
– Dr. D. Sen
ঋদ্ধির গলা বুজে আসে। এতদিন পর, এত ঝড়ঝাপটার পর, সে বুঝতে পারে—তার বাবা শুধু একটা বৈজ্ঞানিক ছিলেন না, একজন স্বপ্নদ্রষ্টাও ছিলেন। একটানা ভাবতে থাকা এই ধ্বংসের মধ্যে, তিনি রেখে গেছেন জীবনকে নতুন করে গড়ে তোলার ছাঁচ।
তৃষা, অপর্ণা আর নাফিস একে একে এসে তার পাশে বসে। চারজনের চোখেই একরাশ বিস্ময়, কিছুটা শ্রদ্ধা, আর প্রচণ্ড আবেগ।
“এখানে ১৫০ জন মানুষ থাকতে পারে,” অপর্ণা বলে, “তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত, বাতাস বিশুদ্ধ, জল আছে, আলো আছে… মানে এই জায়গাটা টিকে আছে একটা ছোট্ট পৃথিবী হিসেবে।”
নাফিস বলে, “কিন্তু আমরা শুধু চারজন। বাকি ১৪৬ জন কোথা থেকে আসবে?”
তৃষা বলে, “আমরা জানি না, তবে হয়তো অন্যরাও আসবে। হয়তো যারা তৃষ্ণায়, বিষে, অসহায়তায় ছটফট করছে, তাদের জন্য এই আশ্রয় দরজা খুলে রাখতে হবে।”
ঋদ্ধি মাথা তোলে। “আমরা এটাকে ‘চিহ্নিত’ করব না। কেউ দখল করবে না। এটা হবে পৃথিবীর উত্তরাধিকার—বাঁচার জন্য নয় শুধু, ভালোভাবে বাঁচার জন্য।”
ডোমের মধ্যে আলো হালকা হলুদ হয়ে আসে। দেয়ালের ওপরে ডিজিটাল ক্লক জ্বলে ওঠে—
“ARC Status: LIVE | Dome Temp: 22°C | Water Supply: STABLE | External Sync: DISABLED”
অর্থাৎ, বাইরের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। কিন্তু ভিতরের জীবন এখনো স্পন্দিত।
বাইরে কুয়াশা ঘন হয়ে এসেছে। কিন্তু গম্বুজের ভিতর যেন একটা নতুন সকাল জন্ম নিচ্ছে।
পর্ব ৫
ডোমের ভিতর এক অন্যরকম নিস্তব্ধতা। কোনো গাড়ির শব্দ নেই, কোনো মানুষের গলার আওয়াজ নেই, শুধু সিস্টেমে চলা একটানা হালকা ভোঁ ভোঁ শব্দ, আর মাঝে মাঝে জলের ছিটেফোঁটা টপ টপ করে পড়ার শব্দ। ঋদ্ধি অনেকক্ষণ কিছু বলে না। ও চুপচাপ বসে আছে সেই ছোট ধাতব ফলকের সামনে—যেখানে খোদাই করা বাবার শেষ বার্তা: “If the world fails, you must begin again.”
তার মানে এই ছিল প্রকল্প ‘আর্ক’-এর উদ্দেশ্য। একটানা পতনের মধ্যে থেকে শুরু করার জন্য একটা আশ্রয়স্থল—ভবিষ্যতের মানুষদের জন্য রেখে যাওয়া এক উত্তরাধিকার।
আর সেই দায়িত্ব এসে পড়েছে এখন এই চারজনের কাঁধে।
তৃষা ধীরে ধীরে হাঁটছে ডোমের ভিতর। গাছের সারির দিকে তাকিয়ে বলে, “এই গাছগুলো হাইড্রোপনিক, কিন্তু ফুল দিচ্ছে না। হয়তো বীজ দরকার।”
অপর্ণা একটি সিস্টেম খুলে দেখে। “তাপমাত্রা ঠিক আছে, জল ঠিক আছে, কিন্তু কয়েকটা সেগমেন্ট নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। অনেকদিন দেখভাল হয়নি। আমাদের এখানে থেকে এগুলো আবার সচল করতে হবে।”
নাফিস ইতিমধ্যে ডোমের নেটওয়ার্কিং ইউনিট চালু করার চেষ্টা করছে। এক প্রাচীন স্যাটেলাইট রিসিভার টাওয়ার এখনও দাঁড়িয়ে আছে গম্বুজের বাইরের পাহাড়চূড়ায়। অপর্ণা হেল্পার-বট গুলোর মধ্যে একটা চালু করে, যাতে সেই টাওয়ারে পৌঁছে ইমারজেন্সি সিগন্যাল পাঠানো যায়।
“যদি কেউ শুনতে পায়, যদি কেউ জীবিত থাকে, আমরা চাই তারা এখানে আসুক,” অপর্ণা বলে।
তৃষা বলে, “কিন্তু যদি ভুল লোক আসে? যারা এই জায়গাটা নিজেদের করে নিতে চায়?”
নাফিস মাথা তুলে বলে, “তাহলে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। শুধু প্রযুক্তি না, আমাদের মধ্যে সিদ্ধান্তের শক্তিও থাকতে হবে।”
ঋদ্ধি এবার উঠে দাঁড়ায়।
“আমরা বেছে নিতে পারি না কে আসবে। আমরা শুধু দরজা খুলে রাখতে পারি। কারণ আর্ক তৈরিই হয়েছিল সহমর্মিতার ভিত্তিতে। যারা আসবে, তাদের মধ্যে থেকেই ভবিষ্যৎ তৈরি হবে।”
ওরা সকলে একমত হয়।
পরের দিন তারা চারজন কাজ শুরু করে। তৃষা সিস্টেমে রেজিস্ট্রেশন লগ আপডেট করে—যাতে যারা পরে আসবে, তারা নিজেদের তথ্য লিখতে পারে।
নাফিস ARC Dome-এর বাইরের ক্যামেরা সিস্টেম নতুন করে চালু করে—ভবিষ্যতের জন্য নিরাপত্তা দরকার।
অপর্ণা পানির বিশুদ্ধিকরণ ইউনিটে বায়োফিল্টার যুক্ত করে, যাতে জল আরও নিরাপদ থাকে।
আর ঋদ্ধি সেই কেন্দ্রীয় তথ্যঘরে বসে বাবার সমস্ত গবেষণা খুলে পড়তে থাকে—ডেটা, রিপোর্ট, এনক্রিপ্টেড নোট। এক ফোল্ডারে সে খুঁজে পায় একটি নাম—“Phase Two: The Rain Algorithm.”
তার চোখ স্থির হয়ে যায়। “বৃষ্টির অ্যালগোরিদম”? এটা কী?
ফাইল খুলতেই একটা ভিডিও ভেসে ওঠে। তাতে ডঃ দিব্যেন্দু সেন বলছেন—
“এই অ্যালগোরিদম জলীয় বাষ্পের চলাচল পর্যবেক্ষণ করে মাইক্রো-ওয়েদার সিস্টেম তৈরি করতে পারে। এর সাহায্যে আমরা সীমিত অঞ্চলে কৃত্রিম বৃষ্টি ঘটাতে পারি। কিন্তু এখনো এটা পরিপূর্ণ নয়। নিরাপত্তার কারণে আমি Phase Two বন্ধ রেখেছি। যদি কেউ কখনো এটা খুলতে চায়, মনে রাখবে—বৃষ্টি আনার মানে শুধুই জল নয়, তা সঙ্গে করে নিয়ে আসে ইতিহাস, শুদ্ধতা, এবং কখনো কখনো ধ্বংস।”
ঋদ্ধির মুখ থেমে যায়। তার মানে বাবা শুধু গম্বুজ বানাননি, একদিন বৃষ্টি ফেরানোর স্বপ্নও রেখে গেছেন।
সে বন্ধুদের ডাকে। তারা সবাই আসে সেই কন্ট্রোল রুমে।
“এই দেখো, বৃষ্টির অ্যালগোরিদম। এটা চালু হলে হয়তো আমরা আকাশ থেকে জল নামাতে পারি।”
অপর্ণা উত্তেজিত হয়ে বলে, “মানে নিজেরা কৃত্রিম বর্ষা আনতে পারব? কিন্তু এতে কি ক্লাইমেট রিস্ক বাড়বে না?”
নাফিস বলে, “অ্যালগোরিদমটা কতটা স্ট্যাবল?”
ঋদ্ধি মাথা নাড়ে, “শেষবার এটা চালু হয়েছিল ২০৪২ সালে, মাত্র একবার। তারপর থেমে যায়। বাবার নোটে লেখা আছে, এর কিছু সাইড ইফেক্ট হতে পারে—অভ্যন্তরীণ বায়ুচাপ ভেঙে পড়া, মেঘের রাস্তা বদলে যাওয়া, বা রেইন শ্যাডো তৈরি হওয়া। আমরা যদি এটা চালু করি, ঝুঁকি আছে।”
তৃষা বলে, “কিন্তু যদি এটা সফল হয়, তাহলে আমরা শুধু ডোম না, বাইরের মাটিকেও জীবিত করতে পারি।”
ঋদ্ধি চুপ করে থাকে। তারপর ধীরে বলে, “এই সিদ্ধান্ত আজ নেব না। প্রথমে আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। যারা আসবে, তাদের জন্য জায়গা করতে হবে। তারপর ঠিক করব, বৃষ্টি ফেরানোর চেষ্টা করব কিনা।”
তাদের চারজনের হাতে কাজের তালিকা চলে আসে—বাঙ্কার পরিষ্কার করা, অন্ন সঞ্চয় স্থান আপডেট করা, বীজশস্য সংরক্ষণ, এবং একটা সংবিধান তৈরি—যেখানে লেখা থাকবে কাদের প্রবেশাধিকার থাকবে, কেমন আচরণ প্রত্যাশিত, আর এই আশ্রয়স্থলের নীতিগুলি কী হবে।
তৃষা সেই রাত্রে একটি নতুন পোস্ট লেখে—
“যারা আসবে, তারা জানুক—এই জায়গা বেঁচে থাকার জন্য নয় শুধু। এটা বিশ্বাসের, দায়িত্বের, আর নতুন শুরুর জায়গা। ARC Dome তোমাদের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু মনে রেখো, প্রকৃতি আমাদের ঋণ দিয়েছে—আমরা যেন তা অপচয় না করি।”
পোস্টের নিচে একটা ছবিও জুড়ে দেয় সে—চারটে সিলুয়েট দাঁড়িয়ে আছে বিশাল গম্বুজের নিচে, মাথার ওপরে নীল কাচের ছাদ, যেখানে একফোঁটা জল জমে আছে। তারা জানে না সেটা অভ্যন্তরীণ ঘনত্বের ফোঁটা, না কি সত্যিই বাইরে আকাশে ভেসে আছে বৃষ্টির সম্ভাবনা।
তাদের চোখে এখন অন্ধকার নেই। শুধুই প্রতীক্ষা।
পর্ব ৬
ARC Dome-এর ছাদজুড়ে যখন সূর্যের কাচঘেরা আলো ছড়িয়ে পড়ছে, তখন ভিতরে কেউ জানত না, বাইরে সেই আলো ঢেকে ফেলেছে আরও গাঢ় এক ছায়া। নীচের উপত্যকার জঙ্গল যেন থমকে গেছে। পাখি নেই, বাতাস নেই, শুধু নীরবতা। এই নিঃশব্দতা ভেদ করেই হঠাৎ ডোমের এক ক্যামেরা ঘোরে—দূরে, খুব দূরে পাহাড়ি ছায়ার গায়ে একটা ছোট ছায়ামূর্তি নড়ছে।
ঋদ্ধি তখন কন্ট্রোল রুমে বসে বাবার ফাইল ঘাঁটছিল। হঠাৎ নাফিস হুড়মুড় করে ঢোকে, কণ্ঠে উত্তেজনা, “একটা সিগন্যাল আসছে! কেউ আমাদের সাড়া দিচ্ছে!”
ঋদ্ধি উঠে দাঁড়ায়। “সিগন্যাল মানে?”
“সিগন্যাল মানে একজন… বা একটা দল আমাদের স্যাটেলাইট পিং-এ রেসপন্ড করেছে। আমরা ইমারজেন্সি ব্রডকাস্ট পাঠানোর ৩৬ ঘণ্টার মাথায় প্রথম সাড়া পেলাম। সেটা শহর থেকে না। বরং পাহাড়ের ওপর দিয়ে আসা একটা মোবাইল ট্রান্সমিশন।”
তৃষা ঘরে এসে পড়ে, “মানে, আমাদের মতো কেউ হয়তো অন্যত্রও লুকিয়ে আছে?”
নাফিস সিগন্যাল ট্র্যাক করে। স্ক্রিনে একটা স্পষ্ট লোকেশন আসে—রংবুল নামের এক পরিত্যক্ত পাহাড়ি স্কুল। সরকারি ভাবে সেটা ‘বন্দী শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র’ নামে পরিচিত ছিল, কিন্তু প্রায় ১২ বছর আগেই সেটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
“ওখানে এখন কীভাবে কেউ আছে?” অপর্ণা অবাক হয়।
“তাই তো বুঝতে হবে,” ঋদ্ধি ভাবে, “আমরা কি সাড়া দেব?”
নাফিস বলে, “সিগন্যালে একটা প্যাটার্ন আছে, যা দেখে মনে হচ্ছে তারা বারবার বলছে—‘বেঁচে আছি, জল চাই, সাহায্য চাই।’ বার্তা রেকর্ডেড না—লাইভ।”
তৃষা জানালার ধারে দাঁড়িয়ে পাহাড়ের দিকে তাকায়। “তাহলে দেরি করলে ওরা হয়তো বাঁচবে না।”
পরিকল্পনা তৈরি হয়। অপর্ণা এবং নাফিস ডোমে থাকবে—সিস্টেম রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য। আর ঋদ্ধি ও তৃষা যাবে রংবুলের দিকে। তারা দুজনের পিঠে পোর্টেবল রেডিও, জিপিএস ট্র্যাকার, কিছু খাদ্য, ফার্স্ট-এইড, জল, এবং একটা হাত-চালিত ছোট ড্রোন ক্যারি করা ব্যাগ থাকে।
পরদিন ভোরে, তারা বেরিয়ে পড়ে।
রংবুলের পথে ধ্বংসপ্রাপ্ত পাহাড়ি রাস্তা। ঘন ছায়া, কুয়াশা, কোথাও কোথাও ঝোড়ো হাওয়া আর ভাঙা বৈদ্যুতিক খুঁটি। তবে সেই রাস্তা জীবনের থেকেও আশার কাছে পৌঁছানোর রাস্তা।
হাঁটতে হাঁটতে তৃষা বলে, “জানো, ছোটবেলায় আমি ভেবেছিলাম আমি বড় হয়ে সাংবাদিক হব, মানুষের দুঃখ তুলে ধরব। এখন আমি শুধু চাই, কেউ যেন আমাদের দুঃখ না দেখে, বরং তাকে পাল্টানোর ক্ষমতা রাখে।”
ঋদ্ধি মাথা নাড়ে। “আমার শুধু মনে পড়ে, বাবা আমায় বলতেন—সত্যের জন্য ত্যাগ করো, কিন্তু ত্যাগ যেন না হয় ব্যর্থ।”
তাদের সামনে একটা গিরিখাত। পুরনো একটা সেতু ছিল, যা পুরোপুরি ভেঙে গেছে।
তৃষা বলে, “এখন?”
ঋদ্ধি ব্যাগ থেকে ছোট ড্রোনটা ছেড়ে দেয়। সেটার সাথে যুক্ত ক্যামেরা দিয়ে সে আশপাশের এলাকা স্ক্যান করে। ড্রোনটা ৩০০ মিটার উড়ে গিয়ে একটা গাছের ভাঙা গুঁড়ির উপর টিন-ঢাকা রাস্তা দেখায়।
“ওটাই পথ। সেটা ধরেই ঘুরে গেলে পেছনের ঢালু বেয়ে পৌঁছানো যাবে,” ঋদ্ধি বলে।
তারা ঘুরপথে এগিয়ে চলে।
চার ঘণ্টার টানা চড়াইয়ের পরে তারা পৌঁছায় সেই স্কুলের ধ্বংসাবশেষের সামনে। বোর্ডে রং চটে গেছে, লেখা কেবলটা মাত্র দেখা যায়—“Shishu Vikas Kend…”
তৃষা ফিসফিস করে বলে, “এখানে কি কেউ আছে?”
ঋদ্ধি রেডিও চালায়।
“আমরা ARC Dome থেকে এসেছি। আপনি যদি আমাদের শুনতে পান, দয়া করে সাড়া দিন। আমরা সাহায্য করতে এসেছি।”
দশ সেকেন্ড, বিশ সেকেন্ড… তারপর কড় কড় আওয়াজ।
একটা ভাঙা জানালা থেকে এক নারীকণ্ঠ—কাঁপা, ক্লান্ত, তবু শক্ত—উচ্চারণ করে,
“আমরা সাতজন। চারজন শিশু। জল ফুরিয়ে আসছে। আমরা তিন সপ্তাহ ধরে আটকে। আগুন জ্বালাতে পারি না, সিগন্যাল পাঠিয়ে গেছি… আপনি… আপনারা কি সত্যিই মানুষ?”
তৃষা চোখে জল সামলে বলে, “হ্যাঁ, আমরাই। আমরা বাঁচতে শিখেছি। এখন বাঁচাতে চাই।”
তারা ভিতরে ঢোকে। এক ছোট ঘরে, মাটির ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে আছে কয়েকজন। দুই ছোট মেয়ে, চোখে জ্বরের ছায়া। এক বালক—রক্তাক্ত হাঁটু। আর এক বৃদ্ধা নারী, সম্ভবত শিক্ষক। তাদের সঙ্গে আরও দুজন তরুণী, মুখ শুকিয়ে গেছে, কিন্তু চোখে এখনও ভয় কাজ করে।
ঋদ্ধি ও তৃষা ফার্স্ট-এইড দেয়, জল দেয়, শুকনো খাবার খাওয়ায়।
মেয়েটি, যিনি কথা বলেছিলেন, জানান—“আমরা জল আনতে গিয়েছিলাম, পাহাড় ধসে পথ বন্ধ হয়ে যায়। তারপর এখানে আশ্রয় নিই। জানতাম, কেউ বাঁচলে উত্তর দিকে থাকবে। রেডিও চালু রেখে সিগন্যাল পাঠিয়ে গেছি। আর কিছু জানতাম না।”
ঋদ্ধি বলে, “আমরা ফিরে যাব, আপনাদের নিয়ে। ARC Dome আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে।”
তৃষা আবার ব্লগে লেখে—
“আজ আমরা প্রথম অতিথি পেলাম। সাতজন শরীর ভেঙে গেলেও মন ভাঙেনি। তারা বাঁচতে চায়, আর আমরা সেই সুযোগ দিতে পেরে ধন্য। পৃথিবী মরেনি, কারণ কিছু মানুষ এখনও বিশ্বাস করে অন্য মানুষের পাশে দাঁড়াতে।”
ডোমে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা নামে। কিন্তু সেই সন্ধ্যা আর অন্ধকার নয়। তার মাঝে ফুটে থাকে প্রতিশ্রুতি, পুনর্জন্ম আর প্রমাণ—যে সিগন্যাল পেয়েছে মানুষ, তাদের গল্প এখনও শেষ হয়নি।
পর্ব ৭
ডোমের মধ্যে আলোটা আগের তুলনায় যেন আরও নরম, আরও উষ্ণ। ছাদের উপরের কাঁচে সূর্যরশ্মি প্রতিফলিত হয়ে পড়ছে গাছের পাতায়, আর পাতাগুলো মাথা নুইয়ে যেন সাড়া দিচ্ছে সেই আলোকে। নিচে এখন আর শুধু চারজন নয়—সাতজন নতুন মুখের পদচারণায় ভরে উঠেছে পরিবেশ। তৃষা আর ঋদ্ধি ফিরেছে রংবুল থেকে। তারা নিয়ে এসেছে বেঁচে থাকা কিছু আশা, কিছু ক্লান্তি, কিছু প্রশ্ন।
ঋদ্ধি ফেরার পরদিন সকালেই বাবার পুরনো ল্যাপটপ খুলে বসে।
সে লক্ষ্য করেছে—প্রতিটা বৃষ্টির অ্যালগোরিদম কোডের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু প্যাটার্ন আছে, যেগুলো জলীয় বাষ্পের মাইক্রো-চক্রকে উত্তেজিত করতে পারে। কোডের নাম—“Rain Protocol R-9”।
এই কোড ব্যবহার করলে নির্দিষ্ট এলাকা জুড়ে কৃত্রিম মেঘ তৈরি হতে পারে, যেগুলো থেকে নির্ধারিত পরিমাণে বৃষ্টিপাত সম্ভব।
কিন্তু ফাইলের এক কোণে বাবার হাতে লেখা একটা নোটেশন ছিল—
“R-9 এর সীমাবদ্ধতা: একাধিকবার ব্যবহার করলে জলীয়বাষ্প অনিশ্চয়ভাবে ছড়িয়ে যেতে পারে, ফলে বাতাসে রাসায়নিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হবে। প্রথম ব্যবহার হতে হবে সীমিত পরিসরে। না হলে প্রতিক্রিয়া অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়বে।”
অপর্ণা তখন ঋদ্ধির পাশে বসে আছে। সে মন দিয়ে কোডগুলো পড়ে বলে, “এটা একটা হাইব্রিড অ্যালগোরিদম। অ্যানালগ ও ডিজিটাল উভয় উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে। আধুনিক কোনো সিস্টেমে এটা একদম মেলে না। বাবার কাজ ছিল নিজস্ব ধাঁচে তৈরি—পুরোপুরি বিকল্প ধারা।”
নাফিস ওদিকে রিসিভার চেক করছে। “গত তিন দিনে আমরা আটটা নতুন সংকেত পেয়েছি,” সে বলে। “তিনটি স্পষ্ট, পাঁচটি অত্যন্ত দুর্বল। আর শহরের দিক থেকে এখনও কিছু নেই।”
তৃষা এসে বলে, “আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে—এই প্রযুক্তি ব্যবহার করব কি না। কারণ মানুষ আসছে, কিন্তু জল নেই। যদি ডোমের বাইরে বৃষ্টি এনে জমি ভেজাতে পারি, তাহলে চাষ হতে পারে। আশ্রয় বাড়ানো যাবে।”
ঋদ্ধি চুপ করে থাকে। তার বাবার সেই ভিডিও বার্তা ঘুরে ফিরে মাথায় আসে—
“বৃষ্টি আনার মানে শুধুই জল নয়, তা সঙ্গে করে নিয়ে আসে ইতিহাস, শুদ্ধতা, এবং কখনো কখনো ধ্বংস।”
“আমরা যদি ভুল করি?” ঋদ্ধি ধীরে বলে ওঠে।
অপর্ণা বলে, “তাহলে শুধরে নেওয়ার মতো ক্ষমতা থাকতে হবে। বাঁচতে গেলে ঝুঁকি নিতেই হয়। সব সিস্টেমই তো একদিন পরীক্ষিত হয়।”
তাদের একটি মিটিং হয় ডোমের কেন্দ্রস্থলে। আশ্রয়প্রার্থীরাও অংশ নেয়। একজন মা, যিনি তার দুই কন্যাকে কোলে নিয়ে বসেছিলেন, বলেন, “আমরা বাইরে থেকে এসেছি। আমরা কিচ্ছু জানি না। কিন্তু আমরা বাঁচতে চাই। যদি আকাশ থেকে জল নামানো যায়, তাহলে এই মরুভূমি আবার সবুজ হতে পারে।”
ঋদ্ধি, অপর্ণা, তৃষা, আর নাফিস—চোখাচোখি করে। আর কোনো দেরি করা যায় না।
সন্ধ্যায় তারা Dome-এর কমান্ড সেন্টারে বসে বৃষ্টির কোড এক্সিকিউট করার প্রস্তুতি নেয়। সিস্টেমে কোড ইঞ্জেক্ট করা হয়:
Initiate: Rain Protocol R-9 | Target Grid: 500m Radius | Duration: 3 mins | Phase: I
অপর্ণা ডাটা স্ট্যাবিলাইজ করে।
নাফিস ব্যাকআপ তৈরি করে।
তৃষা ক্যামেরা সেট করে রাখে যাতে প্রথম বৃষ্টির ছবি রেকর্ড হয়।
ঋদ্ধি চূড়ান্ত “EXECUTE” বোতামে হাত রাখে।
মুহূর্তের জন্য যেন সময় স্থির হয়ে যায়।
তারপর—একটা গম্ভীর গুঞ্জন ওঠে ছাদের ওপরে। ডোমের বাইরের আকাশে কালচে মেঘ জমে উঠতে শুরু করে। দূর আকাশে বিদ্যুতের লম্বা রেখা দেখা যায়।
পাহাড়ের গা বেয়ে নিচে নামা বাতাসে এক অচেনা শীতলতা এসে লাগে গায়ে।
তৃষা হাঁ করে ছাদের দিকে তাকায়।
“ওটা কি… সত্যি?”
একটা… দুইটা… তারপর হঠাৎ করেই টিপ টিপ করে নামতে শুরু করে জল। প্রথম ফোঁটা পড়ে গম্বুজের কাঁচের ওপরে।
সেই শব্দ—প্লাস্টিক নয়, লিকেজ নয়—সত্যিকারের বৃষ্টির শব্দ।
তারপর… মেঘ ফেটে নামে এক নীরব জলের অভ্যর্থনা।
ডোমের বাইরের পৃথিবী যেন কেঁদে ওঠে।
মানুষেরা ছুটে আসে। শিশুরা হাত বাড়িয়ে রাখে। এক বৃদ্ধা, যিনি কেবল মাথা ঝুঁকিয়ে বসে থাকতেন এতদিন, ধীরে মাথা তোলে আর ফিসফিস করে বলেন, “আমি বৃষ্টির গন্ধ ভুলে গিয়েছিলাম।”
ঋদ্ধি গেট খুলে বাইরে দাঁড়ায়। গায়ে পড়ে শীতল জল। চোখে অশ্রু—আনন্দে, বিস্ময়ে, স্বস্তিতে।
অপর্ণা সিস্টেমের গ্রাফে নজর রাখে। “স্ট্যাবিলিটি মেইনটেইন হচ্ছে। কেমিক্যাল রিডিং নরমাল। আমরা পেরেছি।”
তৃষা ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে ব্লগে লাইভ করে—
“বৃষ্টি এসেছে। বহুদিন পর, বহু যন্ত্রণা পেরিয়ে। এটা কোনো দৈব নয়, এটা বিজ্ঞান, মনুষ্যত্ব, এবং প্রতিজ্ঞার ফল। এই বৃষ্টি আমাদের শুধুই ভিজিয়ে দেয় না, আমাদের আবার মানুষ করে তোলে।”
নাফিস শেষবারের মতো কোড লগ করে ফেলে ডেটা স্টোরেজে।
“Rain Protocol R-9 | Status: SUCCESS”
তাদের চারজনের মধ্যে আর কোনো কথা নেই। কেবল একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকা, আর জলের ধ্বনির মাঝে নিঃশ্বাস ফেলার প্রশান্তি।
ঋদ্ধির মনে পড়ে, বাবা বলেছিলেন—”যদি পৃথিবী ব্যর্থ হয়, তুমি আবার শুরু করবে।”
আজ, সে সত্যিই শুরু করেছে।
পর্ব ৮
বৃষ্টি থেমে গেছে। চারপাশ ভিজে, ধোয়া, পরিষ্কার। পাতার গায়ে এখনও জলের ফোঁটা টলমল করছে, বাতাসে কাদা আর শ্যাওলার সেই পুরোনো, হারিয়ে যাওয়া গন্ধ ফিরেছে। পাহাড়ের ঢালে একটানা ঝরনার মতো রিনরিন শব্দ বয়ে যাচ্ছে নিচের উপত্যকায়। ডোমের ভিতরের সবার মুখে যেন নতুন এক আলো।
তবু, এই আনন্দের মাঝেও ঋদ্ধির মনে জমে আছে এক অজানা ব্যথা। একটা ফাঁকা জায়গা, যেটা কোথাও ভরছে না। বৃষ্টি এসেছে ঠিকই, কিন্তু তার বাবার সেই “Rain Protocol R-9” ফাইলের এক লাইন বারবার ফিরে ফিরে আসে—
“বৃষ্টি কেবল জল নয়, বৃষ্টি আত্মার বার্তাবাহক।”
সেই রাতে সবাই যখন ঘুমোতে যায়, ঋদ্ধি চুপিচুপি উঠে ডোমের কনট্রোল রুমে যায়। অন্ধকারে ল্যাপটপ জ্বলে ওঠে এক ম্লান আলোয়। সে আবার খুলে দেখে বাবার সেই ফোল্ডার: “Legacy Logs”। এর আগে সে কখনো এই ফাইল খোলেনি। ভেবেছিল, এতে হয়তো শুধুই গবেষণা থাকবে। কিন্তু এখন, বৃষ্টির পরে, সে বুঝতে পারছে—এই ফোল্ডার শুধুই বিজ্ঞান নয়, কিছু ব্যক্তিগত আত্মকথাও লুকিয়ে থাকতে পারে।
ফোল্ডার খুলতেই প্রথমে আসে একটা অডিও ফাইল:
“Message_To_Riddhi_2070.mp3”
ঋদ্ধির হাত কেঁপে ওঠে।
প্লে বাটনে চাপ দিতেই বাবার গলা শোনা যায়—ক্লান্ত, গম্ভীর, অথচ আশ্চর্য কোমল।
“রিদু… যদি এই মেসেজটা তুমি শুনে থাকো, তাহলে হয়তো আমি বেঁচে নেই। বা হয়তো আমি এমন একটা জায়গায় চলে গেছি, যেখান থেকে ফেরা যায় না। এই আর্ক ডোম আমি বানিয়েছি শুধু তোমার জন্য নয়—তোমার প্রজন্মের জন্য। যারা একদিন হয়তো নিজেই বুঝবে যে পৃথিবী বাঁচাতে গেলে কেবল প্রযুক্তি নয়, হৃদয়ও দরকার হয়।
আমি জানি, তুই একা এই পথ পেরিয়ে আসবি না। তোর মতো মানুষেরা সবসময় একা থাকেনা। যারা তোর পাশে থাকবে, তারা-ই হোক ভবিষ্যতের বীজ।
আর রিদু, মনে রাখিস—প্রকৃতি কখনো পুরোপুরি মরে না। সে শুধু অপেক্ষা করে… কারোর কাছে নিজের গল্পটা শোনাতে। আমি চেষ্টা করেছিলাম সেই গল্প শুনতে, বুঝতে। যদি তুই পারিস, তবে সেটাকে আরেকবার বলা শুরু করিস… বৃষ্টির ভাষায়। তোর বাবা।”
ঋদ্ধির চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। এতদিন পরে, এতকিছুর পরেও সে যেন বাবার স্পর্শ পেল এই কণ্ঠে।
সে চোখ মুছে আবার কম্পিউটার খুলে বসে। আরেকটা ফাইল, নাম—“SoulMap_v0.9”।
এইটা ছিল এক অদ্ভুত ফাইল। মডেলিং সফটওয়্যারের ভিতরে বানানো একটা থ্রি-ডি গ্লোব, যাতে জলবায়ুর ডেটা গেঁথে তৈরি হয়েছে একটা জৈব চক্রের ম্যাপ। কিন্তু এই ম্যাপ ছিল যেন একটু বেশি “জীবন্ত”। প্রতি দশ মিনিটে ম্যাপ আপডেট হয়ে নতুন আকার নিচ্ছে, নতুন সংযোগ তৈরি করছে। এবং প্রতিটি সংযোগের নামের পাশে লেখা—“Pulse Active | Essence Detected”
অপর্ণা তখন ঘুমিয়ে পড়েনি। সে কফি হাতে এসে দাঁড়ায় পিছনে। স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে বলে, “এটা তো জিও-বায়ো কনটিনিউয়াস ম্যাপ। মানে, পরিবেশের প্রাণস্পন্দন। কিন্তু এইটা তো একদম এআই জেনারেটেড নয়, এখানে ‘Essence’ ট্যাগ কেন আসছে?”
ঋদ্ধি চুপ করে বলে, “বাবা বলতেন, প্রকৃতির একটা আত্মা আছে। হয়তো সেটা কেবল বিশ্বাস, কিন্তু দেখো—এই ম্যাপ বলছে আমাদের চারপাশে কিছু আছে। কিছু যা আমরা কেবল অনুভব করতে পারি।”
তারা ম্যাপের একটা বিন্দুতে ক্লিক করে। সেখানে লেখা—“Zone: Upper Teesta | Status: Reviving | Energy Sync: High | Identity: Unknown”
অপর্ণা চমকে ওঠে। “মানে, ওখানে প্রকৃতির প্রাণশক্তি ফিরে আসছে?”
ঋদ্ধি ভাবে, “হয়তো এই বৃষ্টির পরেই ওখানে কিছু জেগে উঠেছে। হয়তো মাটি, জল, আর বাতাসের মধ্যে একটা পুরোনো স্মৃতি আবার জেগেছে। প্রকৃতি নিজেই তার হারানো আত্মাকে খুঁজে নিচ্ছে।”
সকালে ঋদ্ধি এই ম্যাপের কথা বলে বাকিদের। তৃষা বলে, “তাহলে হয়তো শুধু ডোম নয়, বাইরের পৃথিবীও ধীরে ধীরে প্রাণ ফিরে পাবে।”
নাফিস বলে, “তবে আমাদের ওখানে যেতে হবে। Upper Teesta অঞ্চলে। দেখতে হবে—এই ম্যাপ শুধু সিমুলেশন, নাকি সত্যিকারের রেনেসাঁ।”
তারা ঠিক করে, আবার অভিযানে বেরোবে—এইবার উত্তর-পূর্বের দিকে, যেখানে ম্যাপ বলছে মাটি আবার নিঃশ্বাস নিচ্ছে।
তৃষা আবার ব্লগ লেখে—
“আজ বৃষ্টির পরে প্রথম সকাল। কিন্তু এর চেয়েও বড় আশ্চর্য—প্রকৃতির গোপন ভাষা যেন জেগে উঠছে। একটি অদৃশ্য আত্মা আবার পৃথিবীকে জড়িয়ে ধরছে। আমরা তাকে খুঁজতে বেরোবো। তার গল্প শোনার জন্য। কারণ এই গল্পটা আমরা লিখিনি—শুধু তার সাক্ষী হতে চলেছি।”
ডোমের দরজা আবার খুলে যায়।
আকাশ এবার অন্ধকার নয়, রৌদ্রজ্বল।
কিন্তু সেই রোদের মাঝে কোথাও যেন এক অদৃশ্য সুর বাজে।
ঋদ্ধি জানে—এইবার পথটা শুধুই বৈজ্ঞানিক অভিযানের নয়। এটা সেই আত্মার খোঁজে যাত্রা, যা একদিন হারিয়ে গিয়েছিল মানুষে-মানুষে, প্রকৃতি আর প্রযুক্তির মাঝে।
পর্ব ৯
উত্তর-পূর্বের দিকে পথে বেরনোর পর বুঝতে পারল, পাহাড়েরা শুধু নীরব নয়—তারা স্মরণশক্তিও ধরে রাখে। একসময় যেখানে তিস্তা নদী গর্জে নামত, আজ সেইখানে কেবল শুকনো নদীর পেটের আঁকাবাঁকা রেখা। পাথরের গায়ে লেগে থাকা পুরনো শ্যাওলা, আগের জলস্তরের দাগ, আর কোথাও কোথাও কিছু পরিত্যক্ত কাঠের সাঁকো—যা সাক্ষ্য দিয়ে যায় এক হারানো জলের সভ্যতার।
ঋদ্ধি, তৃষা, আর অপর্ণা তিনজনে এগিয়ে চলেছে। নাফিস ডোমে থেকে গিয়েছে নতুন অতিথিদের দেখভাল আর রেডিও ট্রান্সমিশনের দায়িত্বে। সঙ্গে আছে রেইন ড্রোন, ম্যাপ রিডার, আর একটি বিশেষ যন্ত্র—‘Essence Sensor’—যেটা তৈরির সময় অপর্ণা বলেছিল, “বাতাসে থাকা জৈব স্পন্দন মাপতে পারবে। যদি সত্যিই প্রকৃতি জেগে ওঠে, তার নিঃশ্বাস ধরতে পারবে এই যন্ত্র।”
যতই ওপরে উঠছে, বাতাসের গন্ধ বদলে যাচ্ছে। সূর্যের আলো বেশি সাদা, মাটি নরম হয়ে আসছে। তারপর হঠাৎ এক বাঁক পেরিয়ে তারা দাঁড়িয়ে পড়ে।
সামনে এক বিস্ময়!
তিস্তার পুরনো শাখা যেখানে ছিল, সেখানে এখন আবার জল! স্বচ্ছ, সবুজাভ, ধীরে বয়ে চলেছে পাহাড়ের গা ঘেঁষে। পাথরের নিচ থেকে ফুটে উঠছে একাধিক জলধারা। আর আশেপাশে গাছের ডালপালা যেন হঠাৎই সবুজ হয়ে উঠেছে—এক সপ্তাহ আগেও যেগুলো ছিল মরা কাঠের মতো, আজ সেগুলোয় নতুন কুঁড়ি।
অপর্ণা সেন্সরটা চালু করে। যন্ত্র কাঁপতে শুরু করে—এক অদ্ভুত রিদমে। স্ক্রিনে লেখা ওঠে—
> “Essence Level: Elevated | Biopulse Detected | Environmental Rebirth in Process”
তৃষা ফিসফিস করে বলে, “এটা কি সত্যি? এটা কি আমাদের বৃষ্টির প্রভাব?”
ঋদ্ধি মাথা নাড়ে। “হয়তো আর্ক ডোমের বাইরে প্রকৃতি নিজে থেকেই পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত ছিল। শুধু দরকার ছিল একটা প্রথম ধাক্কা। সেই প্রথম বৃষ্টি।”
ওরা হাঁটু গেড়ে বসে, জল ছুঁয়ে দেখে। ঠান্ডা, জীবন্ত। ঋদ্ধি বাবার একটা কথা মনে করে—“জল একমাত্র উপাদান যা মৃত্যু আর জন্ম দুটোই জানে।”
অপর্ণা বলল, “দেখো ঐ ডাঙার উপর একটা কাঠামো। আগুনের ধোঁয়া উঠছে।”
তারা দ্রুত পৌঁছায় কাঠামোটার কাছে। দেখতেই পায়, একটা ছোট ঘর বানানো হয়েছে গাছের গুঁড়ি আর পলিথিন দিয়ে। ভিতরে বসে আছে একজন লোক—চুল এলোমেলো, কাঁচা পাকা দাঁড়ি, চোখে পাগলামির ছায়া। কিন্তু গায়ে আছে আধা-পরিষ্কার ল্যাব কোট।
ঋদ্ধি এগিয়ে যায়। “আপনি এখানে থাকেন?”
লোকটা মুখ তুলে চেয়ে দেখে। একটু চমকে যায়। তারপর বলে, “তোমরা এসেছ? ডোম থেকে?”
তৃষা বলে, “আপনি জানেন আমাদের?”
লোকটা মৃদু হেসে বলে, “আমি জানি, কারণ আমি এই জেগে ওঠার অপেক্ষায় ছিলাম। আমি নিজেও এক সময় ডঃ সেনের সহকারী ছিলাম। আমার নাম অনিরুদ্ধ বর্মন।”
ঋদ্ধি অবাক। “আপনি বাবার সহকারী ছিলেন?”
“হ্যাঁ, আমি ‘R-9’ প্রজেক্টের ফিল্ড টেস্টিং দলে ছিলাম। আমি এখানে আসি এক্সপেরিমেন্ট চালাতে, কিন্তু তখনই প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায়। আমি থেকে যাই—নিজের সিদ্ধান্তে। মনে হয়েছিল, প্রকৃতি একদিন ফিরে আসবে। আমি তার সাক্ষী হতে চেয়েছিলাম। এখন বুঝতে পারছি, সেই দিন এসেছে।”
অপর্ণা বলে, “আমরা ম্যাপিংয়ে দেখেছিলাম এই অঞ্চলে কিছু জৈব পরিবর্তন ঘটছে।”
অনিরুদ্ধ মাথা নাড়ে। “আমি জানি। আমি দিনের পর দিন দেখি কীভাবে পাথরের ফাটল থেকে গন্ধ আসে, কীভাবে বাতাসের আর্দ্রতা ধীরে ধীরে বাড়ে, কীভাবে শুকনো গাছে পাতার ছায়া পড়ে। আমি এইসব ‘Essence’ টের পাই, কারণ আমি ‘মেশিন’ ছাড়াই শিখেছি প্রকৃতির ভাষা।”
ঋদ্ধি বলে, “তাহলে আপনি এখানে আছেন প্রকৃতির আত্মা খোঁজার জন্য?”
“আত্মা?”—সে হেসে ওঠে, “প্রকৃতির আত্মা কোনো রহস্য না। এটা হলো পুনর্জন্মের সম্ভাবনা। যখন মাটি আর জল আবার একসাথে কাঁদতে শেখে, তখন আত্মা কথা বলে।”
তৃষা বলে, “আপনি কি আমাদের সাথে আসবেন? ডোমে?”
অনিরুদ্ধ চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে, “আমি একদিন আসব, কিন্তু এখন নয়। এখনও পাহাড় কিছু বলছে, আমি তা শোনার চেষ্টা করছি।”
তারা কিছু শুকনো খাবার আর ওষুধ দিয়ে আসে।
ঋদ্ধি তাকে একটি ছোট ট্রান্সমিটার দেয়। “যদি কখনও আমাদের প্রয়োজন পড়ে, বা আপনি আসতে চান, এই সিগন্যাল দেবেন।”
অপর্ণা ফিরে যাওয়ার আগে শেষবার Essence Sensor ঘুরিয়ে স্ক্যান করে। স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে—
“Soul Signature Stable | Nature Sync Achieved | Regeneration Phase: I”
তাদের ফেরার পথে আকাশ এক অদ্ভুত রঙে রাঙা হয়। একদিকে সূর্য, অন্যদিকে মেঘের ফালি, মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ক্ষীণ রেখা। এই রঙ আগে দেখা যায়নি। হয়তো কখনোই যায়নি।
তৃষা ব্লগে লেখে—
“আমরা তিস্তার জলকে আবার চলতে দেখেছি। আমরা এক ‘পাগল বিজ্ঞানী’র কথা শুনেছি, যিনি প্রকৃতির আত্মা নিয়ে কথা বলেন। আমরা যন্ত্র দিয়ে সেই আত্মার গতি মাপতে পেরেছি। কিন্তু আমাদের হৃদয়ে আজ যা ঘটেছে, তার কোনো সেন্সর নেই। সেই অনুভবই হয়তো আমাদের নতুন যুগে পৌঁছে দিচ্ছে।”
ঋদ্ধি চুপ করে থাকলেও তার ভিতরে যেন এক পাহাড়ী নদীর মতো শব্দ বাজছে—বাবার শেষ কথার প্রতিধ্বনি:
“তুমি যদি বিশ্বাস করো, পৃথিবী নিজেই ফিরে আসবে।”
পর্ব ১০
তিস্তার জলধারার পাশে দাঁড়িয়ে অপর্ণা বলেছিল, “মনে হচ্ছে, এই মুহূর্তটা ইতিহাস নয়—ভবিষ্যৎ।” এখন, ফিরে আসার পরে, ডোমের সবাই বুঝতে পারছে—প্রকৃতি আর মানুষের এই সখ্যতা এক নতুন গল্পের শুরু।
এক সপ্তাহ কেটে গেছে শেষ বৃষ্টির পর। ডোম এখন শুধু আশ্রয় নয়—এটা হয়ে উঠেছে এক চলমান গোষ্ঠী। নতুন মানুষ আসছে—কেউ এসেছেন নদীর তীরে ধ্বংসপ্রাপ্ত গ্রাম থেকে, কেউ গাড়ির চাকার উপর রাত কাটিয়ে শহর ছেড়ে এসেছেন, আবার কেউ এসেছে শুধু এক চিলতে গন্ধের খোঁজে—যে গন্ধ একদিন বৃষ্টির ফোঁটায় মাটির উপর নেমে এসেছিল।
ঋদ্ধি আর তৃষা মিলে তৈরি করেছে ‘ওরাল আর্কাইভ’—যেখানে সবাই নিজের গল্প বলে যেতে পারে। কেউ নিজের গ্রামের কথা বলে, কেউ পরিবারের হারানোর কথা, কেউ শুধু বলে—”আমি একা ছিলাম, এখন আর নই।” এসব গল্প জমে, গাছের পাতার মতো, যার একটাও ফেলনা নয়।
নাফিস এখন এক নতুন সিস্টেম বানাচ্ছে—ডোমের সঙ্গে বাইরের পৃথিবীর নিয়মিত সংযোগ রক্ষা করার জন্য। “আমরা বাঁচব একা নয়, সংযোগে,” সে বলে। সে এমন এক নেটওয়ার্ক তৈরি করছে, যেখানে প্রতিটি জীবিত আশ্রয় একে অপরের অস্তিত্ব টের পাবে, যেকোনো সময়।
অপর্ণা, সেই রেইন অ্যালগোরিদমের আরও পরবর্তী সংস্করণ নিয়ে কাজ করছে। সে এবার এক সীমিত চক্রে মেঘ তৈরি করে বৃষ্টিকে শুধুই ঘটনার নয়—প্রয়োজনের ভিত্তিতে ডাকা শিখেছে। এবার তার লক্ষ্য, “মাটি বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া, মেঘকে না ডেকে নিজে আসতে শেখানো।” প্রকৃতিকে সহকারী নয়, সাথী হিসেবে ভাবা—এটাই তার দর্শন।
তৃষা একটি পোস্ট করে—
> “আজ আমরা ডোমের বাইরে প্রথম ফসলের বীজ পুঁতেছি। এটা কোনো কৃষি আন্দোলন নয়। এটা আত্মবিশ্বাসের বীজ। যারা একদিন শুধু জল খুঁজেছিল, তারা এখন আলোও খুঁজছে। আর আমরা জানি, আলো সবসময় ওপরে থাকে না—কখনও সেটা আমাদের ভেতরে জন্মায়।”
ঋদ্ধি প্রতিদিন সকালে সেই ধাতব ফলকের পাশে গিয়ে বসে। আজকাল সে আর কান্না পায় না। তার বাবার কণ্ঠস্বর এখন তার নিজের চিন্তার মধ্যে মিশে গেছে। এখন সে জানে, প্রকল্প ‘আর্ক’ কোনো একক পরিকল্পনা ছিল না—এটা ছিল উত্তরাধিকারের কাঠামো।
একদিন সকালে, হঠাৎ বাইরে আকাশে দেখা যায় একটা উজ্জ্বল রেখা—কোনো উপগ্রহ না, কোনো প্লেনও নয়। অনেকেই বলে, “এটা হয়তো পোলার কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট, বহু বছর পর আবার সক্রিয় হয়েছে।” সিগন্যাল আসে—স্পষ্ট।
একটি নারী কণ্ঠ ভেসে ওঠে—
> “এখানে ইউনিট 04—আর্ক সাউথ ক্যালকাটা জোন। আমরা সাড়া পেয়েছি। আমাদের অবস্থান: ব্যারাকপুরের কাছে। আমরা আছি ৬৫ জন, আংশিকভাবে সচল। আপনাদের সাহায্য চাই।”
নাফিস মুখ তুলে চায়। তৃষা বলে, “তাহলে আমরা একা নই।”
অপর্ণা বলে, “আরো আর্ক তৈরি হয়েছিল, ছড়িয়ে ছিটিয়ে। আমরা শুধু প্রথম ছিলাম যারা আবার শুরু করতে পেরেছি।”
ঋদ্ধি উঠে দাঁড়ায়। তার কণ্ঠ শক্ত, চোখে প্রশান্তি।
“তাহলে এখন আমাদের কাজ শুধু বেঁচে থাকা নয়, যুক্ত হওয়া। আর্ক থেকে আর্ক, গল্প থেকে গল্প। আমরা পৃথিবীকে আবার জোড়া দেব। ভাঙা পৃথিবীর জায়গায় একটা গলা তোলা পৃথিবী।”
সেদিন রাতে ডোমের ছাদে বসে সবাই মিলে আকাশ দেখে। তারা জানে না, আগামী দিনে কী অপেক্ষা করছে। আবার যুদ্ধ হতে পারে, রোগ ছড়াতে পারে, প্রযুক্তি ভুল পথে যেতে পারে। কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে, তারা জানে—তারা একসাথে। এবং এই একতাই নতুন পৃথিবীর বীজ।
বৃষ্টি হয় না আর সেই রাতে। কিন্তু বাতাসে যে গন্ধ, তা যেন বৃষ্টির থেকেও গভীর।
ঋদ্ধি মাথা ঘুরিয়ে চায় ডোমের দিকে।
সে হাসে। তার মনে হয়, শেষ বৃষ্টি হয়তো প্রকৃতির—
কিন্তু “শেষের পরে শুরু” হয় মানুষের।
তৃষা তার ব্লগে শেষ পোস্ট লেখে—
শেষ বৃষ্টির পরে, আমরা শুরু করেছি আবার। এবার আর শুধু বাঁচার জন্য নয়, ভালোভাবে বাঁচার জন্য। আমরা যারা ছিলাম শেষ প্রজন্ম, এখন হয়তো হয়ে উঠছি প্রথম প্রজন্ম—নতুন পৃথিবীর, নতুন ব্যাখ্যার।
[সমাপ্ত]




