Bangla - প্রেমের গল্প

এক কাপ দুঃখ, চিনি ছাড়া

Spread the love

অর্ণবী চক্রবর্তী


পর্ব ১: কলকাতার স্যাঁতসেঁতে হাওয়া আর একলা বারান্দা
কলকাতার এই বর্ষা আমি কত বছর দেখিনি? নাকি দেখেছি, শুধু মনে রাখিনি? হাত বাড়ালেই জল পড়ে—ছাদের কার্নিশ থেকে, ল্যাম্পপোস্টের মাথা থেকে, পুরনো কালের জানলা থেকে। আর বারান্দা? ওই একলা বারান্দা, যেটার পাশে একটা চেয়ার থাকে, ধূলো জমা, যে চেয়ারে বাবা বসতেন, কাঁধে গামছা, হাতে চায়ের কাপ, আর চোখে শূন্যতা। সেই শূন্যতা আমার চোখেও এসে পড়ে আজকাল, জানো?

এখন আমি একা থাকি। বেলেঘাটার এই পুরনো বাড়িতে। নাম শুনেই বোঝা যায়, রাজবাড়ি নয়, তাও যেন একটা অলিখিত ইতিহাস টিকে আছে দেওয়ালে। মা মারা যাওয়ার পর এই বাড়িটা আমি বেচে দিলাম না কেন, অনেকেই জিজ্ঞেস করেছিল। আমি বলিনি—বাড়ি তো শুধু জায়গা নয়, কিছু সাদাকালো স্মৃতির কোলাজ, কিছু না বলা কথা, কিছু ছেঁড়া কবিতার খাতা।

আজকাল আমি কবিতা লিখি না। কিংবা লিখি, কিন্তু নাম দিই না। সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্টও করি না। এসবের দরকার হয় না, যখন জীবনের সবচেয়ে ভালো কবিতাটা হারিয়ে যায় হঠাৎ একদিন। সেই সন্ধেটার কথা মনে আছে? আকাশটা ধূসর, ভিজে হাওয়া জানলার পাল্লা ঠেলে ঢুকছে। তুমি বললে, “কবিতা ভালোবাসা নয়, কবিতা প্রতারণা।” আমি বুঝিনি তখন। এখন বুঝি।

তুমি চলে যাওয়ার পর প্রথমবার নিজেকে আয়নাতে দেখেছিলাম। চোখের নিচে কালি, ঠোঁটে ফাটল, আর মনের ভিতর একরাশ নৈঃশব্দ্য। কেউ বলে, সময় সব কিছু মুছে দেয়। আমার মনে হয় সময় কেবল আলাদা করে রাখে—স্মৃতিকে এক ঘরে, বাস্তবকে আরেক ঘরে, আর মাঝখানে একটা দরজা, যেটা খুললে শুধু কান্না বেরোয়।

এই বাড়ির বারান্দাটা একটা চরিত্র হয়ে গেছে আমার জীবনে। প্রতিদিন দুপুরবেলা আমি ওই চেয়ারে বসি, এক কাপ লাল চা নিয়ে, চিনি ছাড়াই। তুমি বলেছিলে, “চিনি ছাড়া চা খেতে শিখলে, দুঃখটা সহজে সহ্য হয়।” ঠিক বলেছিলে। দুঃখেরও এক স্বাদ আছে—একটু কষা, একটু তেতো, একটু আগুনের মতো।

তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল বইমেলায়। হাসির মধ্যে যে বিষণ্ণতা লুকিয়ে থাকে, সেটা আমি তোমার চোখে প্রথমবার দেখেছিলাম। বলেছিলে, “আমি লোক দেখানো মানুষ নই।” তখন বুঝিনি তুমি নিজেকেও দেখাও না, এমন মানুষ।

আমার ঘরে আজও তোমার রেখে যাওয়া পুরনো বইগুলো আছে—‘বেকেট’, ‘বোর্হেস’, ‘সার্ত্র’। এমনকী তোমার প্রিয় কবির সেই ছেঁড়া কাব্যগ্রন্থও। মাঝে মাঝে বইগুলোর পাতার মধ্যে তুমি লুকিয়ে আছ বলে মনে হয়। পাতাগুলো খুললে একটা পরিচিত গন্ধ বেরোয়—তোমার গায়ের গন্ধ। বৃষ্টি, কফি আর একটুখানি নাভিমূল থেকে ওঠা আত্মা-গন্ধ।

আজ সকালে যখন চায়ের কেটলিতে জল বসালাম, তখন মনে পড়ল—তুমি বলেছিলে, “ভোরের চা আর রাতের চুমু একসঙ্গে হলে জীবনটা পূর্ণ হয়।” জীবনটা অপূর্ণই থেকে গেল, না? তুমি চলে গেলে রাতের চুমু নিয়েই। ভোরের চা আর কারও সঙ্গে ভাগ হয়নি।

কলকাতা তখন ছিল অন্যরকম। মানুষ রাস্তায় নামত, কাঁধে কাগজের ব্যাগ, মুখে মুখোশ নয়, মুখে কথা। এখনকার মতো গ্যাজেটের গোলকে আটকে পড়েনি কেউ। আর এখন? এখন আমি নিজের বাড়িতেই অথিতি। দরজা বন্ধ থাকলেও বাইরে শব্দ ঢুকে পড়ে—বৃষ্টির, ট্যাক্সির, হাঁসফাঁস করা দূরগামী ট্রেনের, কিংবা পাশের ফ্ল্যাটের বাচ্চাটার চিৎকার।

মাঝে মাঝে ভাবি, আমি কি ভুল সময়ে ভালোবেসেছিলাম? নাকি ভালোবাসাটা নিজের সময় খুঁজে নেয় না, ভুল সময়ে এসে পড়ে, তারপর যন্ত্রণাটা রেখে চলে যায়?

তোমার চলে যাওয়ার পর আমি নতুন কাউকে জায়গা দিইনি জীবনে। কেউ চেয়েছিল, কেউ খুব কাছাকাছিও এসেছিল। কিন্তু বারান্দার ওই চেয়ারটা আজও খালি। ওই চায়ের কাপে আজও তোমার ঠোঁটের দাগ আঁকা আছে আমার কল্পনায়। একেক দিন বৃষ্টি পড়ে, আমি কল্পনা করি তুমি এসেছ। স্যাঁতসেঁতে জামা গায়ে, ছাতা গুটিয়ে, ঢুকে গেলে রান্নাঘরে। তারপর চুপচাপ চা বানালে, আর আমি কবিতা পড়লাম।

কিন্তু না, এসব কল্পনা। বাস্তবে তুমি নেই। বাস্তবে আমি আছি, একা, বারান্দায়, এক কাপ চা হাতে।

আজ তোমার জন্মদিন। আমি কোনো কেক কাটিনি। শুধু দুপুরে তোমার লেখা সেই কবিতার খাতা খুলে দেখলাম, যেটার শেষ পাতায় তুমি লিখেছিলে—“যে মেয়েটা আমার চোখে পড়ে না, সে-ই আমাকে সবচেয়ে বেশি দেখে।”

আমি কি সেই মেয়েটাই? যে আজও তোমাকে দেখছে? চা-এর ধোঁয়ার মধ্যে, ছায়ার মতো।

পর্ব ২: নীল স্যুটকেস, মেঘলা দুপুর আর একটা হারিয়ে যাওয়া কবিতা

নীল রঙের একটা স্যুটকেস আমার খাটের নিচে পড়ে আছে অনেক বছর ধরে। বাইরের কাপড়টা একটু ছেঁড়া, চেনটা এক পাশে আটকে থাকে মাঝেমাঝে। অথচ সেটাই একসময় আমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস ছিল। সেই স্যুটকেসে তোমার হাতে ছোঁয়া ছিল, তোমার ভাঁজ করা জামাকাপড় ছিল, আর ছিল কয়েকটা চিঠি, যেগুলো তুমি কখনও দাওনি—লিখেছিলে, রেখে গেছো, আমার অজান্তে। আমি পেয়েছিলাম অনেক পরে, হঠাৎ একদিন যখন খাটের নিচে ধুলো পরিষ্কার করতে গিয়েছিলাম।

চিঠিগুলো কেমন যেন, খসখসে অনুভব। তোমার হাতের লেখা, একটু বাঁকানো, তবু দৃঢ়। একটা চিঠিতে তুমি লিখেছিলে—“যখন আমার চোখ আর তোমার দিকে তাকাতে পারবে না, তখন চিঠিগুলো খুলে দেখো। হয়তো বুঝবে, আমি চিরকাল তোমার কাছেই ছিলাম, শুধু ছায়ার মতো।”

তখন দুপুর। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। জানলার বাইরে ছোট ছোট জলের ফোঁটা কাচে লেগে একটা অদ্ভুত সঙ্গীত সৃষ্টি করছিল। বৃষ্টির শব্দ আর তোমার লেখা মিলেমিশে একরকম হ্যালুসিনেশনের মতো অনুভূতি হচ্ছিল আমার। আমি চিঠি পড়ে কাঁদছিলাম না, বরং একটা শান্ত হাসি মুখে ছড়িয়ে ছিল। সেই হাসি শুধু তারাই হাসে, যারা হারিয়ে ফেলেছে চিরতরের মতো, তবু মনে করে, “আমার কিছুই হারায়নি।”

তোমার সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছিল দমদম মেট্রো স্টেশনে। ট্রেন এসে দাঁড়িয়েছিল, তুমিও দাঁড়িয়ে ছিলে, চোখে চশমা, হাতে বই। আমি দূর থেকে দেখছিলাম। যেতে পারিনি কাছে। ভেবেছিলাম ডাকব, “ঐ… তময়!” কিন্তু ডাকিনি। শব্দটা গলার কাছেই আটকে গিয়েছিল, যেভাবে অনেক পুরোনো কবিতার লাইনে আটকে যায় ছন্দ। তুমি চলে গিয়েছিলে, ট্রেনের গেটের পাশে দাঁড়িয়ে, পেছন ফিরে তাকাওনি। আর আমি একাই উঠে গিয়েছিলাম পরের ট্রেনে, ভুল পথে।

মাঝেমধ্যে আমাদের সম্পর্কটা একটা অনুবাদ করা কবিতার মতো মনে হয়—আসল অর্থটা কোথাও হারিয়ে গেছে, শুধু শব্দ রয়ে গেছে। সেই শব্দে আবেগ আছে, কিন্তু ব্যাখ্যা নেই। তুমি কি সত্যিই ভালোবেসেছিলে আমাকে? না কি শুধু একটা “সময় কাটানোর” সম্পর্ক ছিল? আমি জানি না, আর হয়তো জানার প্রয়োজনও নেই।

এই বাড়িটার রান্নাঘরে আজও তোমার প্রিয় কাপটা রাখা আছে। সাদা রঙের, পাশে নীল ফুল আঁকা, নিচে লেখা “Poetry is what remains.” তুমি খেয়াল করেছিলে কি না জানি না, সেই লাইনটা আমি তোমার জন্যেই লিখেছিলাম। তুমি বলেছিলে, “যা থেকে যায়, সেটাই কবিতা। বাকিটা তো কেবল অভ্যাস।” হয়তো তাই। তুমি চলে যাওয়ার পর আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি একাকীত্বে, নিঃশব্দ দুপুরে, বারান্দার সেই একরোখা বাতাসে।

আমার বন্ধু রিনা প্রায়ই বলে, “তুই কেন এখনো এই পুরনো জঞ্জাল আঁকড়ে ধরে আছিস? নতুন করে শুরু কর।” আমি শুধু মুচকি হেসে বলি, “সবাই পারে না ভুলে যেতে। কিছু লোক থাকে, যারা হারানোর মধ্যেই বাসা বাঁধে।”

রিনার কথায় যুক্তি ছিল, তবু আমার গলায় যুক্তির কোনো দরকার ছিল না। কারণ, এই ভালোবাসাটা ঠিক সেই কবিতার মতো, যেটা লেখার সময় মনে হয় অসাধারণ, অথচ পড়ে মনে হয় কিছুই বোঝা গেল না। কিন্তু সে কবিতা ফেলা যায় না। তার মধ্যে একটা নিজস্ব বাতাস থাকে। যেমন তোমার মধ্যে ছিল—একটা ছায়া, একটা আকাশ, একটা মেঘ।

আজ দুপুরে হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। ঘরটা অন্ধকার হয়ে গেল এক মুহূর্তে। জানলার কাঁচে মুখ রেখে বাইরের মেঘলা আকাশটা দেখছিলাম। ঠিক তখনই একটা পাখি উড়ে গেল। ছোট, কালো রঙের, হয়তো মুনিয়া বা দোয়েল। জানি না। হঠাৎ মনে হল, তুমি যদি এই মুহূর্তে ফিরে এসে বলতে, “এক কাপ চা হবে?” আমি কী করতাম?

বোধহয় প্রথমে বিশ্বাস করতাম না। তারপর হয়তো হাসতাম, চুপচাপ একটা কাপ এগিয়ে দিতাম। আর বলতাম, “চিনি ছাড়া। তময়ের প্রিয়।”

তুমি অনেক কিছু শিখিয়েছিলে—ধৈর্য, চুপচাপ সহ্য করা, নিজের ভিতরেই নিজের জন্য জায়গা তৈরি করা। তবে একটা জিনিস শেখাওনি—তোমাকে ছেড়ে বাঁচতে হয় কীভাবে।

আমার একটা কবিতা হারিয়ে গেছে। ঠিক কীভাবে, সেটা জানি না। খাতায় ছিল, মনে ছিল, অথচ এখন কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না। হয়তো সেটা সেইদিনই হারিয়ে গেছিল, যেদিন তুমি বলেছিলে, “আর না, এই সম্পর্কটা আমাকে ক্লান্ত করে দিচ্ছে।”

আমরা সম্পর্ককে যেন একটা পুরনো চেয়ার বানিয়ে ফেলি, যেটায় বসা যায় না, তবু ফেলে দেওয়া যায় না। তুমি চলে গেলে, আমি সেই চেয়ারেই বসে রইলাম।

তোমার প্রিয় গান ছিল “আমি চিরদিন তোমারই কাছে ফিরিয়া আসিবো…” আমি এখনো শুনি গানটা। প্লেলিস্টে সেই পুরনো ভার্সনটা আছে। ভর দুপুরে হেডফোন কানে দিয়ে শুনি। তুই তখন ফিরে আসিস না। কিন্তু আমার ভিতরে তোর একটা ছায়া ফিরে আসে, প্রতিদিন।

আজ দুপুরে আবার সেই নীল স্যুটকেসটা খুললাম। পুরনো জামাকাপড়, চিঠি, কয়েকটা বাস টিকিট, আর একটা চুলের ক্লিপ। হ্যাঁ, তোরই ছিল। মনে পড়ল, একবার বৃষ্টিতে ভিজে চুল বাঁধার সময় তুই বলেছিলিস, “এই ক্লিপটা কোথাও হারিয়ে ফেলিস না।” আমি তোদের কথাগুলো হারিয়ে ফেলিনি। শুধু তোকে হারিয়ে ফেলেছি।

আর একটা জিনিস খুঁজে পেলাম—একটা কাগজ, তাতে লেখা, অসমাপ্ত একটা কবিতা। শেষ লাইনে থেমে গেছিস—

“যদি কোনোদিন ফিরে আসি,
তুই কি তখনো এক কাপ চা রাখবি?”

আমি জানি, তুই আসবি না। তবু আমি প্রতিদিন সেই চা বানাই। এক কাপ, চিনি ছাড়া।

পর্ব ৩: কফিশপ, পল্টু দা আর এক বেলা খুশি সাজানো নাটক

আমার বাড়ির মোড় ঘেঁষে একটা ছোট কফিশপ আছে—নাম “চায়ের নৌকা।” নামটা অদ্ভুত, দোকানটা আরও অদ্ভুত। পুরোনো কাঠের বেঞ্চ, দেয়ালে কিছু রঙচঙে পোস্টার—তাতে রবীন্দ্রনাথের পাশেই শাহরুখ খান, আর মাঝখানে অচিন এক বাউল গাইছে বৃষ্টি-ভেজা চোখে। ওই কফিশপেই সন্ধেবেলা আমি বসি—সাধারণত একা, কিন্তু মাঝে মাঝে পল্টু দা এসে বসে পড়ে।

পল্টু দা হলেন এই পাড়ার “সদাই থাকা” মানুষ। কী করেন কেউ জানে না। কখনো বলেন সাংবাদিক, কখনো বলেন কবি, আবার কখনো ট্যাক্সি চালান। কিন্তু মুখে সবসময় একরাশ জীবনদর্শন, আর চায়ের কাপ হাতে মুঠোভরা আকাশ।

“তোর চোখের নিচে কালি পড়েছে, বাচ্চা! বেশি ভাবিস না। দুঃখ কখনোই কারো নিজের না, শুধু সময় ভাড়া নেয়,” পল্টু দা বলেছিল একদিন। আমি হেসে বলেছিলাম, “ভাড়া নেয় কিন্তু ফেরত দেয় না কেন?” উনি বলেছিলেন, “কারণ ভাড়া সময় মতো দিলে জীবন নাটক হয় না, ডকুমেন্টারি হয়ে যায়।” এইসব ছাপোষা দর্শনের মাঝেই সময় কেটে যায়, সন্ধে নামে, পল্টু দা চলে যান, আর আমি একা বসে থাকি কাচের ভেতর দৃষ্টি আটকে দিয়ে।

আজও গেলাম সেই কফিশপে। বৃষ্টির ধোঁয়া মাখা বিকেল, চায়ের কাপ ধরা হাতে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলাম। হঠাৎ মনে হল, পাশের টেবিলে কেউ বসে আছে। ঘুরে দেখি—না, তুমি না। একটা ছেলে, চশমা পরা, কাঁধে স্লিং ব্যাগ। কিন্তু হাবভাব, বসার ভঙ্গি, কফির কাপে আঙুল রাখার ধরন—সবই তোমার মতো। এমনকি হালকা হাসি হেসে সাইডে তাকানোর অভ্যেসটাও। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ।

ছেলেটা বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কিছু বলবেন?” আমি হকচকিয়ে বললাম, “না না, মাফ করবেন। চেনা মনে হল।”
সে হেসে বলল, “অনেকেই বলে, আমি দেখতে কারও না কারও মতো।”
আমি বললাম, “হ্যাঁ, হয়তো আমার অতীতের মতো।”

এইরকম হঠাৎ হঠাৎ মুহূর্ত আসে, যেগুলো একটা পুরনো স্মৃতিকে ধরে টান দেয়। স্মৃতির নিচে লুকিয়ে থাকে না বলা কথা, পুরনো কান্না, কিংবা একটা ‘তুমি’—যাকে হয়তো আর কোনোদিন ফিরিয়ে আনা যাবে না।

আমি এখন মাঝেমাঝেই ভাবি, হয়তো আমি তোর মতো কাউকে খুঁজে বেড়াই রোজকার জীবনে। বাসের জানলায়, বইয়ের দোকানে, লোকাল ট্রেনের কোণে—একটা চোখ, একটা হাতের ভঙ্গি, একটা হালকা পায়ের শব্দ। কিন্তু সবাই শুধু কাছে আসে, তুই হয়েছিস দূর। দূরত্বটাই আমাদের সবচেয়ে বড় সত্যি হয়ে রয়ে গেছে।

আজ সন্ধেয় বাড়ি ফিরে দেখি, পোস্টবক্সে একটা খাম। কেউ হাতে লেখা করে রেখেছে—আমার নামে, ঠিকানাও সঠিক, কিন্তু প্রেরকের নাম নেই। খামটা খুলে দেখি, একটা একপাতার চিঠি—
“আজ আবার তোমার বারান্দাটা দেখলাম। তোমাকে দেখি না বহুদিন, কিন্তু জানালার পাশে চা খাওয়ার সেই অভ্যেসটা নাকি এখনো আছে। আমি চুপচাপ দেখতে থাকি, যেমন আগেও দেখতাম, দূর থেকে।”

চিঠিটা কেউ কবে দিয়েছে, জানি না। লেখাটা পরিচিত মনে হলেও ঠিক শনাক্ত করতে পারিনি। হয়তো এও এক কাকতালীয় সম্পর্কের খেলা। হয়তো কেউ অন্য কেউ, যাকে আমি চিনি না, কিন্তু সে আমাকে জানে। যেমন অনেক গল্পের চরিত্র আমরা চিনি, অথচ লেখক তাদের কখনোই বাস্তবে পায় না।

রাত বাড়ে, বারান্দার বাতি নিভে আসে, আমি একাই বসে থাকি। চায়ের কাপ ফাঁকা হয়ে গেছে অনেক আগেই, তবু হাতে ধরি, যেন উষ্ণতা আবার ফিরবে।

একটা গান বাজছিল আজ পাশের ফ্ল্যাটে—“হৃদয়ের ক্যানভাসে তুমি আঁকা শেষ কবিতা…” আমি জানি না, কাকে মনে রেখে গানটা বাজছিল, কিন্তু আমার ভিতরটা যেন পাগল হয়ে উঠল হঠাৎ। আমি উঠে জানলা বন্ধ করতে গেলাম, কিন্তু হাত থেমে গেল হাওয়ার ধাক্কায়।

তুই গান গাইতিস খুবই বাজেভাবে। সুর ঠিক থাকত না, তাল ছুটে যেত। কিন্তু জানিস, তোর সেই ফসকে যাওয়া সুরের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি আবেগ থাকত। আজকের দিনটা যেমন, হয়তো ঠিক ছিল না কিছুই—কিন্তু মনে পড়ে গেল তোর গলায় ভাঙা “তুমি রবে নীরবে…”

আমি আবার বারান্দায় ফিরে এলাম। বাতাসে তোর গানের ছায়া, চিঠির নিঃশব্দতা আর পল্টু দার মত করে বলা, “জীবনটা একটা নাটক, বাচ্চা! কেউই থিয়েটার থেকে বেরোয় না খালি হাতে।”

হ্যাঁ, আমি হয়তো আর কিছু চাই না। শুধু চাই, কেউ একজন একদিন হঠাৎ এসে বলুক, “তোর চায়ের কাপটা আজও খালি কেন?” আর আমি উত্তর না দিয়ে শুধু কাপটা এগিয়ে দিই—চিনি ছাড়া, এক কাপ দুঃখ, আর একটু ভিজে থাকা স্মৃতি।

পর্ব ৪: ছাদে নোনতা হাওয়া, রাত্রি আর কিছু অসমাপ্ত সংলাপ

ছাদের মেঝেটা কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা হয়ে থাকে সন্ধের পর, বিশেষ করে এই বর্ষার মরসুমে। ছাদের কোণায় সেই পুরনো জং ধরা জল ট্যাঙ্কটা আছে, যেমন ছিল যখন তুমি প্রথম এসেছিলে এই বাড়িতে। মনে আছে? তুমি বলেছিলে, “এই ট্যাঙ্কটার ওপর চাঁদের আলো পড়ে ঠিক যেন বাউলের ইকতারা ঝিকিমিকি করে।” আমি হেসেছিলাম। তুমি একরকম লোক ছিলে—অদ্ভুতভাবে সবকিছুর মধ্যে কবিতা খুঁজে নিতে পারতে। আর আমি, আমি খুঁজে পেতাম তোমার মধ্যে আমার গল্পের পরিণতি।

আজ অনেকদিন পর ছাদে এলাম। মাথার ওপর প্যাঁচপ্যাঁচে আকাশ, একটানা মেঘ ঘন হয়ে আছে, কিন্তু বৃষ্টি নেই। এই সময়টা আমার প্রিয়—যখন আকাশ শুধু অপেক্ষায় থাকে, যেন একফোঁটা কান্না তার চোখে আটকে আছে, ঝরে পড়ছে না, তবু হালকা ভারসাম্য নষ্ট করছে হাওয়ার মধ্যে। এই সময়েই তোমার মুখটা বেশি মনে পড়ে। শুধু মুখ নয়, মুখের কোণে হালকা সেই কুটিল হাসি, যেটা দিয়ে তুমি সব কথা না বলে দিয়েছিলে।

আমি ছাদের কার্নিশে বসেছিলাম। পাশের বাড়ির রান্নাঘর থেকে মাছ ভাজার গন্ধ আসছিল, সেই গন্ধ যে কোনো বাংলা পরিবারকে হাঁটুর ওপর এনে বসিয়ে দিতে পারে—শুধু খাবারের জন্য নয়, স্মৃতির জন্যও। মা বেঁচে থাকতে এই সময়েই এক প্যাকেট মুড়ি আর কাঁচা লঙ্কা নিয়ে ছাদে ডাকত, “এই, বৃষ্টি নামলে আর উঠতে পারবি না। এই বসে থাক।” আমি মাকে খুব মিস করি। আর সবচেয়ে বেশি মিস করি তার চোখের ভিতর ‘জেনে ফেলা’ নামক জিনিসটা। মা জানত—তুই আমাকে ভালোবাসিস না, শুধু অভ্যাস করেছিস।

তবু আমি চুপচাপ ছিলাম। কারণ ভালোবাসার মধ্যেও তো অভ্যাস গড়ে ওঠে, আর অভ্যেসের মধ্যেও ভালোবাসা কখনো কখনো জন্ম নেয়। জানি না, তুই কোন পথে হাঁটছিলি, কিন্তু আমি তো তোর ছায়ার পাশ দিয়েই হাঁটতাম।

ছাদের এক কোণে একটা ভাঙা চেয়ার পড়ে আছে। অর্ধেক প্লাস্টিক উঠে গেছে, কাঠের পায়াগুলোতে সাদা সাদা দাগ। হয়তো পাখির বিষ্ঠা, অথবা পুরনো হয়ে যাওয়ার চিহ্ন। তুই একবার বলেছিলি, “বসবো না ওই চেয়ারে, পড়েই যাব।” আমি বলেছিলাম, “সবচেয়ে অনিশ্চিত জায়গাতেই সবচেয়ে নির্ভার হওয়া যায়।” সেই চেয়ারটা আজও পড়ে আছে, নড়ে না, পড়ে যায় না, শুধু সময়ের মতন দাঁড়িয়ে থাকে।

আজ আমার একটা কবিতা মাথায় এলো। আমি অনেকদিন পর খাতা খুলে লিখলাম—
“তুই বললি, ফিরে আসা মানে হেরে যাওয়া,
আমি বললাম, ফিরে আসাই তো আসল সাহস।”

এই লাইনটা লিখে হাত থেমে গেল। তুই কি সাহস করেছিলি? নাকি পালিয়েছিলি? হয়তো সত্যিটা মাঝখানে কোথাও। আবার ভাবি, তুই যদি আজ থাকতিস, তাহলে হয়তো তুই নিজেও বলতি—“ভালোবাসা একটা ট্রেনের টিকিট, যেটা একপিঠা। ফিরতি পথের ভাড়াটাই সবচেয়ে দামী।”

তোমার কথা ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে গেল, একটা পুরনো অডিও ক্লিপ আছে ফোনে—তোমার গলার। একবার আমার ফোনে রেকর্ড করেছিলে একটা কবিতা, সেই সময় যখন আমরা নিয়মিত দেখা করতাম। খুলে শুনলাম। গলাটা কাঁপা কাঁপা, স্পষ্ট নয়, তবু চেনা। সেই একই ভঙ্গি, থেমে থেমে বলা শব্দ, একেকটা লাইনের পর ছোট্ট নিঃশ্বাস। তুমি বলেছিলে—
“যদি কোনোদিন হারিয়ে যাই,
খুঁজো না আমার শরীরে,
স্মৃতির গন্ধটাই আমার ঠিকানা।”

আমি তো সেই ঠিকানাতেই বাস করি আজও। শুধু সমস্যা হল, ডাকপিয়ন আর চিঠি আনেনা এখন। মোবাইল আসে, অথচ তুমি আসো না। আর যতদিন যায়, আমি নিজের ভিতরেই চুপ করে থাকি, আর বাইরে সবাই ভাবে—“ও ঠিক আছে। ও তো ম্যানেজ করে নিচ্ছে।”

কিন্তু কেউ জানে না, ছাদের ওপর সন্ধ্যে নামলে, আমি এখনো তোমার দেওয়া সেই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজি—যার কোনো উত্তর ছিল না। যেমন, তুমি বলেছিলে, “তুই যদি আমায় ছাড়তে পারিস, তবে তোর ভালোবাসা আসল না।” আমি এখনো ছাড়তে পারিনি। তুই তো অনেক আগেই চলে গেছিস।

আজ ছাদে বসে হঠাৎ মনে হলো, আমার একটাই অনুরোধ ছিল সবসময়—“তুই থাক, কোথাও যাস না।” অথচ তোকে বাধা দিইনি কোনোদিন। মানুষ যখন ভালোবাসে, তখন বাধা দিতে পারে না। শুধু অপেক্ষা করে। আমি সেই অপেক্ষার আয়নায় আজও দাঁড়িয়ে আছি, প্রতিফলন ছাড়া।

চাঁদ ওঠেনি আজ, আকাশ পুরোটাই সীসার মতো ঢেকে গেছে। বাতাসে কেমন একটা নোনা গন্ধ। হয়তো শহরের ভিতর জমে থাকা জল, হয়তো শহরের বাইরে জমে থাকা বিষাদ। আমি বারান্দার দিকে হাঁটছি, মনে হচ্ছে, এই মুহূর্তে যদি তুই সামনে এসে দাঁড়াস, আমি কিছু বলব না। শুধু হাত ধরে রাখব, ঠিক যেমন একদিন বৃষ্টির মধ্যে করেছিলাম—ট্রামের জানলার ধারে দাঁড়িয়ে, তুমি বলেছিলে, “হাতটা ছাড়িস না, হারিয়ে যাব।” আমি বলেছিলাম, “তুই হারালে আমি কবিতা লিখবো না আর।” আর আজ? আমি কবিতা লিখি না। শুধু তোকে লিখি, প্রতিদিন।

পর্ব ৫: শহরের ভিতর একটা চুপচাপ গান আর হারিয়ে যাওয়া নাম

শহরটা মাঝেমাঝে এত চুপ করে যায় যে ভয় লাগে। বিশেষ করে রাত একটা থেকে তিনটার মাঝের সময়টা। তখন শব্দগুলো দূর থেকে আসে—রিকশার ঘন্টি, কোনো কুকুরের কান্নার মতো ডাক, কিংবা ট্রেনলাইনের ধারে পড়ে থাকা কাঁচের বোতল গড়িয়ে যাওয়ার আওয়াজ। এই সবকিছুর মাঝেও শহরের কোথাও একটা গান বাজে—চোখে দেখা যায় না, কানে শোনা যায় না, তবু অনুভব করা যায়। সেই গানটা তোরই মতো, যে ছিলো, আছে, কিন্তু নাম নেই, ঠিকানা নেই, ছায়া আছে।

আজ আবার রাতে ঘুম আসছিল না। জানি না, ঘুম না আসার কারণ নিছক অভ্যেস, না কি তোকে মনে পড়ার কোনো অবচেতন প্রয়াস। বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় এলাম। বাইরে চাঁদ নেই, অন্ধকার যেন আরও ঘন হয়ে উঠেছে। হঠাৎ পাশের ফ্ল্যাটের জানলা দিয়ে আলো এলো, তারপর হালকা গানের সুর। লতা মঙ্গেশকরের পুরনো গান—“রাত একেলা, চাঁদি হে সওদাগর…” সেই গানে আবার তোর কণ্ঠস্বর ভেসে উঠল আমার মনের ভেতর।

তুই বলতিস, গানের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া যায়, ঠিক যেমন একটা ভালোবাসায় ডুবে গেলে নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায় না। আমি বলতাম, “তাহলে গানই ভালোবাসা?” তুই বলতিস, “না, গান তো নিঃশ্বাসের মতো। ভালোবাসা হল দম আটকে আসা।”

তোর প্রতিটা সংলাপ আমার মনে গেঁথে আছে। আমি কখনো ডায়েরি লিখতাম না, অথচ তোর প্রতিটা কথা আমার স্মৃতির পাতায় লেখা হয়ে গেছে। কত সহজে তুই বলে ফেলতিস—“আমি তো চিরকাল থাকব না। আমি হুট করে চলে যাব।” আমি তখন হাসতাম, বলতাম, “তুই গেলে আমার ঘরটা শুন্য হয়ে যাবে।” অথচ আজ সেই শুন্য ঘরেই আমি দিব্যি বেঁচে আছি। হাসছি, বাজার যাচ্ছি, অফিস করছি, বাড়ি ফিরে টিভি চালাচ্ছি। শুধু একটা কাজ করি না—আস্তে করে তোর নাম নিই না আর। কারণ, একবার নাম নিলেই সব ভেঙে পড়ে।

তোর নামটা নিয়ে আজ অনেক ভাবলাম। তময়। ছোট্ট নাম, তবু তার মধ্যে একটা গভীরতা। নামটা ডাকলে মনে হত যেন কোথাও একটা ধুলো জমা দুপুর নড়ে উঠল। নামটা এখন বলি না, কেবল ভেতরে উচ্চারণ করি। মুখে না আনলেই যেন কষ্টটা কিছুটা কম হয়।

আজ রিনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ও এসে বলল, “তোর চোখের চাহনি বদলে গেছে। আগে যা দেখতিস, এখন তা কেবল দেখে না, বুঝতেও চায় না।” আমি বললাম, “সবাই কি সব কিছু বোঝে, রিনা?” ও বলল, “সবাই না, কিন্তু কেউ কেউ পারে। যেমন তুই পারিস না। তুই শুধু বাঁচিস। বুঝিস না।”

আমি আবারও চুপ করে গিয়েছিলাম। সত্যি, আমি বেঁচে আছি—এই শহরের হাওয়ায়, টেবিলের ওপর রাখা কাঁচের জলে, বিছানার চাদরে তোর গায়ের গন্ধে, প্রতিটা সন্ধেবেলায় যে চায়ের কাপ তুই ফেলে গেছিস, সেইখানে।

আজ হঠাৎ পুরনো অ্যালবামের মধ্যে তোর একটা ছবি পেলাম। সাদা-কালো নয়, কিন্তু তার মধ্যেও একরকম বিবর্ণতা। ছবিতে তুই একা, একটা লাল স্কার্ফ গলায়, চোখে সানগ্লাস, হাতে ধরা একটা বই—‘The Unbearable Lightness of Being’। তুই পেছন ফিরে তাকিয়ে ছিলি। ঠিক তেমনই যেমন আমি আজও দাঁড়িয়ে আছি, মুখটা ঘুরিয়ে, কিন্তু চোখে সেই পুরনো ছবি আঁকা। আমি তখনই জানতাম, তুই একদিন সত্যিই চলে যাবি।

কিন্তু কেউ কখনো চলে যায় কি? তুই তো এখনও আছিস, আমার চায়ের কাপের ধোঁয়ায়, শহরের নিঃশব্দ গলিগুলোতে, আমার ছেঁড়া কবিতার খাতায়। শুধু নামটা নেই। ঠিক যেন কে যেন মুছে ফেলেছে একটানে।

আমি মাঝে মাঝে খেলা খেলি নিজের সঙ্গে—তোর নামটা কোনো শব্দে মেলাই, কোনো চিঠির মধ্যে খুঁজি। কখনো বাসস্টপে দাঁড়িয়ে ভাবি, কে যেন ডাকছে—“তময়!” অথচ কেউ ডাকে না, শুধু হাওয়া বয়ে যায়। আমি হাওয়ার দিকেই তাকিয়ে থাকি, যেন বুঝে যাব কখন কোন দিকে তুই ছিলি।

তুই বলেছিলি, “আমরা সবাই গল্প হয়ে যাই একদিন।” আমি বলেছিলাম, “তাহলে তুই কী গল্প হতে চাস?” তুই বলেছিলি, “আমি হতে চাই এমন গল্প, যেটা কেউ শেষ করতে পারে না।”

আজ আমি জানি, তুই সত্যিই সেইরকম একটা অসমাপ্ত গল্প। বারবার ফিরে আসে, শুরু হয়, কিন্তু শেষ হয় না। যেমন আজকের রাত—ঘড়িতে তিনটে বাজে, চারদিকে নিঃশব্দ, অথচ আমার মনের ভিতরে একটা চিরকাল চলা কথোপকথন চলছে। আমি প্রশ্ন করি, তুই উত্তর দিস। আমি চোখ বন্ধ করি, তুই চোখ খুলে তাকাস।

আমার জীবনের গল্পটা এখন তুই ছাড়া কল্পনা করতেই পারি না। অথচ বাস্তবে তুই নেই। এটাই কি জীবন? নাকি এটাই ভালোবাসার সবচেয়ে নির্মম সংজ্ঞা?

আজ এই পর্বটা লিখতে লিখতে জানালার পাশের বাতিটা নিভে গেল। হয়তো কোথাও লোডশেডিং, অথবা কেউ সুইচ বন্ধ করেছে। আমি জানি না। আমি শুধু জানি, অন্ধকারে তোর নামটা আরেকটু জোরে ধ্বনিত হয়। আমি শুনতে পাই না, কিন্তু অনুভব করি।

তুই যেখানেই থাকিস, যদি কোনোদিন এই শহরের মধ্যে হেঁটে আসিস, দেখবি—একটা মেয়ে চুপ করে বসে আছে একটা কফিশপের কোণে, তার চায়ের কাপে চিনি নেই, শুধু এক ফোঁটা দুঃখ আর এক মুঠো নামহীন অপেক্ষা।

পর্ব ৬: জানলার পাশে বসে থাকা মেয়েটি আর সময়ের ব্লটিং পেপার

সকালে উঠে দেখি বৃষ্টি পড়ছে—না, সেই তীব্র বর্ষা নয়, হালকা একরাশ ছিটেফোঁটা, যেন আকাশ মুখ নিচু করে কাঁদছে কিন্তু কেউ শুনতে পাচ্ছে না। চায়ের কেটলিতে জল বসিয়ে আমি জানলার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। এই জায়গাটায় দাঁড়ালে আমি নিজেকে একটা চরিত্র মনে হয়—পুরনো গল্পের, হারিয়ে যাওয়া উপন্যাসের, কিংবা ফেলে রাখা কবিতার মধ্যে আটকে থাকা কেউ।

জানলার বাইরে একটা রিকশা দাঁড়ানো—তার ছাতাটাও ভিজে গেছে। গলির অন্যপাশে ফুচকার দোকান, ঢাকনি দিয়ে ঢাকা, কিন্তু ভিতরে তেল কড়াইয়ে গরম হচ্ছে। এমন চেনা দৃশ্য, অথচ এমন অচেনা লাগছে আজ। কারণ এসব দেখার চোখটা তো আর আগের মতো নেই। আমার চোখে এখন একটা দীর্ঘ অনুপস্থিতি বাস করে—যেটা তুই রেখে গেছিস, অনিচ্ছা আর নির্বিকারতার মাঝখানে আটকে।

কাল রাতে ঘুম আসেনি। সারা রাত আমি ছাদে হাঁটছিলাম, আর মুঠোফোনের গ্যালারিতে পুরনো ছবিগুলো ঘাঁটছিলাম। তোকে নিয়ে আমার তোলা সবচেয়ে প্রিয় ছবিটা হলো সেইটা, যেদিন আমরা কলেজ স্ট্রিট গিয়েছিলাম, বইমেলায়। তুমি একটা ধুতি-পাঞ্জাবি পরেছিলে, অকারণে, কারণ তুমি এমনিই ছিলে—নাটুকে, অথচ গভীর।

ছবিটা দেখে মনে পড়ল, তুমি বলেছিলে, “একদিন আমার ছবি থেকে আমি মুছে যাব, শুধু আবহাওয়া থাকবে।” তখন বুঝিনি কথাটা কী মানে। এখন বুঝি, মানুষ আসলে নিজেই নিজের ছায়া বানিয়ে রাখে অন্য কারও হৃদয়ের কোণে। তারপরে নিজে হারিয়ে গেলে সেই ছায়াটাই থেকে যায়, সময়ের ব্লটিং পেপারের মতো। একের পর এক স্মৃতি তার ওপর ছাপ ফেলে যায়, কিন্তু ছায়াটা মুছে যায় না।

আজ অনেকদিন পরে একটা নতুন জামা পরেছি। চুনী রঙের একটা কুর্তা, যার বুকপকেটে একটা ছোট পেন রাখা আছে। এই পেনটা তুই দিয়েছিলি—সেই জন্মদিনে, যেদিন আমরা আলিপুর চিড়িয়াখানায় গিয়েছিলাম। তুই বলেছিলি, “লেখা থেমে গেলে এই পেনটা খুলে দেখিস। হয়তো চলবে না, কিন্তু পুরনো কালি শুকিয়ে গেলে যেমন একটা গন্ধ থাকে, ঠিক তেমন একটা গন্ধ এই পেনের মধ্যেও তোর জন্য লুকিয়ে আছে।”

আমি পেনটা খুলি না। ভয় হয়, যদি সত্যিই গন্ধ না পাই। যদি সেই পেনও সময়ের ধুলোয় ঝাপসা হয়ে যায়?

আজ রিনার সঙ্গে ক্যাফেতে দেখা হলো। ও বলল, “তুই তময়ের গল্প এখনও লিখছিস?” আমি বললাম, “হ্যাঁ, লিখি। শুধু তময়ের নাম নেই। কখনো ও হয় ‘সে’, কখনো ‘তুমি’, কখনো ‘কেউ না’।”
রিনা একটু থেমে বলল, “তুই জানিস তো, তুই একা ভালোবাসিস। একমুখো ভালোবাসা চায়ের মতো—যত চিনি দাও, তেতোই থেকে যায়।”
আমি মুচকি হেসে বললাম, “তাই তো আমি চিনি ছাড়া চা খাই।”

কথাগুলো বলে নিজের মধ্যেই কেমন একটা হালকা অন্ধকার ঢুকে গেল। আমি জানি, তুই ভালোবাসিসনি আমাকে, অন্তত আমার মতো করে না। তুই আমায় দেখেছিস, ছুঁয়েছিস, সময় কাটিয়েছিস, কিন্তু গভীরে নামোনি কোনোদিন। আমি ডুবেছিলাম, তলিয়ে গেছিলাম, কিন্তু তুই তখনও পাড়ে দাঁড়িয়ে হাঁটছিলি, ঘাটের ধার ধরে।

আজ সন্ধেবেলা একটা চিঠি লিখেছিলাম—তোর নামে। কিন্তু পোস্ট করিনি। জানি না কেন লিখলাম। জানি, ঠিকানাটা তোর নয়, তুই থাকিস না সেখানে। তাও লিখে ফেললাম—
“তময়,
আজ সন্ধেয় বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখছিলাম। হঠাৎ মনে হলো, তুই যদি ঠিক এখন চলে আসিস, তাহলে কী বলব তোকে? বলব, ‘তুই বড্ড বেশি দেরি করে ফেলেছিস।’ কিন্তু সাথেই বলব, ‘আয়, চা তৈরি হয়ে গেছে। শুধু চিনি দিইনি।’
— স্মিতা”

হ্যাঁ, আমার নামটা এখন শুধু স্মিতা নয়। আমি এখন স্মরণিকা। নিজের নামটাকেও পাল্টে নিয়েছি, যেন আমার গল্পটা নতুন করে লেখা যায়। কিন্তু কাগজ পাল্টালেও কলমটা তো একই থাকে, কালি তো পুরনো!

আজকের শহরটা অদ্ভুত নীরবতায় ভরে গেছে। মনে হচ্ছে, শহরের প্রতিটা দেয়ালে কেউ একটা করে কবিতা লিখে দিয়েছে, আর কেউই পড়ছে না। সব ব্যস্ত, সব তাড়াহুড়ো, শুধু আমি একা হাঁটছি মনের রাস্তা দিয়ে, যেখানে প্রতিটা মোড়ে তোর ছায়া দাঁড়িয়ে। কিছু বলে না, কিছু চায় না, শুধু চোখ তুলে তাকায়—যেমন তুই তাকাতি, যেদিন আমায় প্রথম চুমু খেয়েছিলি।

আমার মনে আছে, তুই বলেছিলি, “এই শহরটা চুমুর শহর নয়, বরং চোখের শহর। চোখ দিয়েই যত কিছু হয়।” সেই থেকে আমি চোখ দিয়েই তোর মধ্যে হারিয়ে গেছি। এখন আর কিছু দেখি না—শুধু তোর স্মৃতির প্রিজমে রং পরিবর্তন দেখি, আলো-ছায়ার খেলা দেখি, দেখি একলা দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি, জানলার পাশে।

আজ আবার ঘড়িতে রাত সাড়ে বারোটা বাজে। সবাই ঘুমিয়ে গেছে। শুধু আমি জেগে আছি, একটা টেবিল ল্যাম্পের নীচে, খাতার পাতা খুলে। এক ফাঁকা পৃষ্ঠায় লিখে ফেললাম—

“আমার ভালোবাসা ছিল নিরব,
তুই শুনিসনি,
তাই তো চুপ করে থেকে গেল।”

পর্ব ৭: পুরনো বইয়ের দোকান, একটা হাত ছুঁয়ে যাওয়া হাওয়া আর অজানা চিঠির ঘ্রাণ

কলেজ স্ট্রিটের গলিটা আগের মতোই আছে। ধুলোভরা রাস্তা, গা-ঘেঁষাঘেঁষি করা দোকান, আর বইয়ের পুরু গন্ধে ভরপুর বাতাস। তবে ভিড়টা কমেছে আগের থেকে। আমি আজ বহুদিন পর এখানে এলাম, একরকম অভ্যেসের টানেই।

এখানে একটা ছোট দোকান ছিল—’প্রতিধ্বনি বইঘর’—যেটা তুই খুব ভালোবাসতিস। তোর মতে, এই দোকানটার কাঠের তাকগুলোতে শুধুই বই নেই, একেকটা তাক যেন একেকটা গল্প। আজকে হঠাৎ সেখানে যেতেই চোখে পড়ল—দোকানদার বদলে গেছে। নতুন একটা ছেলে বসে আছে, খুব বেশি বয়স নয়, হয়তো সদ্য কলেজ পাস করেছে। চেহারায় শান্ত, চোখে একধরনের কৌতূহলী বিষণ্ণতা।

আমি দোকানের এক কোণে বসে থাকা রেস্তোরাঁ-বিবরণী, পুরনো বইয়ের খাতা আর গুচ্ছ চিঠির মধ্যে হাতড়াচ্ছিলাম, হঠাৎ একটা খাম পড়ে গেল মেঝেতে। কাগজটা হলুদ হয়ে গেছে, কোণ ছেঁড়া, কিন্তু তাতে লেখা ঠিকানা দেখে থমকে গেলাম।

“তময় মৈত্র, care of প্রতিধ্বনি বইঘর, কলেজ স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০৯”

চোখ যেন স্থির হয়ে গেল। এই চিঠি এখানে এল কীভাবে? আমি তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। তারপর সাহস করে বললাম, “এই চিঠিটা কতদিন ধরে এখানে আছে জানেন?”
ছেলেটা বলল, “মাস ছয়েক হবে। দোকানের ভাঁজে পেয়েছিলাম, কিন্তু নাম-ঠিকানা না থাকায় পাঠানো হয়নি।”

চিঠিটা হাতে নিয়ে খুললাম না। আমার হাত কাঁপছিল। একটা পুরনো কাগজেও যদি কারও উপস্থিতি থাকে, তাহলে সেটা আমি ঠিক টের পাই। তময়ের ঘ্রাণ, তার হাতের চাপ, তার লেখার ধাঁচ—এই সব মিলিয়ে একটা অতল অনুভূতি আমার বুকের ভিতর ঢেউ তুলছিল।

বইঘর থেকে বেরিয়ে এসেই মনে হল, এখন যদি তোকে একটা ফোন করতে পারতাম! কিন্তু তুই তো ফোনও বদলে ফেলেছিস। নম্বর মেলেনা আর। তাই তো সেই পেন দিয়ে, যেটা তুই দিয়েছিলি, আমি চিঠি লিখি—তোর নামে, তোর জন্যে, অথচ পাঠাই না। জমা করি একটা পিতলের ড্রয়ারে, যেন তোর নামে একটা পোস্ট অফিস খুলেছি নিজের ভেতরেই।

রাস্তা ধরে হেঁটে হেঁটে কলেজ স্কোয়ারের পাশ দিয়ে আসছিলাম। জলের গন্ধে ভেসে এল ভিজে কদম ফুলের স্মৃতি। আমি থেমে গেলাম সেই জায়গায়, যেখান থেকে তুই একদিন হঠাৎ বলেছিলি, “এই জায়গাটায় দাঁড়ালেই মনে হয়, শহরটা আমায় ভালোবাসে।” আমি বলেছিলাম, “তুই না থাকলে শহরটাই তো কেমন বেমানান।” তুই তখন হেসেছিলি, বলেছিলি, “আমি থাকি না মানে কি? আমি তোর ভিতরে থাকি। যেভাবে বৃষ্টির গন্ধ থাকে ধুলোর নিচে।”

এইসব কথাগুলোকে আমি ভুলতে চাইনি, তবু সময় জোর করে ভুলিয়ে দেয়। কিন্তু তোর একটা চিঠি, একটা পুরনো বইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে থাকা অক্ষর, আবার সব মনে করিয়ে দেয়।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে আমি খামটা বার করে আবার দেখলাম। এত বছর পর তুই কি আমায় কিছু বলতে চেয়েছিলি? নাকি কারও ভুলে লেখা এই চিঠি আমাকে শুধু আরো একবার অস্থির করে তুলল? উত্তর জানি না, তবু মনে হল, আজ রাতটা কাটবে না।

বাড়ি ফিরে খামটা খুললাম অবশেষে। চিঠিটা হাতে লেখা, কিন্তু হাতের লেখা অপরিচিত। কয়েকটি অক্ষরে তময়ের ছোঁয়া আছে, কিন্তু বাকিটা যেন কারও শেখা লেখার অনুকরণ। তাতে লেখা—

“যদি তুমি এখনো তময়কে ভালোবাসো, তাহলে জেনে রাখো, সে ভালো আছে। একা নয়, কিন্তু শান্ত। সে এখন কবিতা লেখে না, শুধু পড়ে। তোমার লেখা একটা কবিতা এখনও ওর চুপ থাকা ঘরের দেয়ালে ঝুলে আছে। তুমি ভালো থেকো। যদি একদিন আবার দেখা হয়, চোখে চোখ রাখো। উত্তর খুঁজে পাবে।”

চিঠিটা শেষ, কিন্তু আমি থমকে গেলাম। তময় কি কাউকে দিয়ে আমার কাছে এই বার্তা পাঠিয়েছে? নাকি এটা কেবল কোনো ‘সে’—যার নিজের ভালোবাসা নেই, তাই আমারটার ভিতরে নিজেকে গুঁজে দিয়েছে?

আমি চুপ করে বসে থাকলাম খাটের পাশে। জানলার বাইরে এখনও বৃষ্টি পড়ছে, ছাদের কার্নিশ থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরছে, আর আমার চায়ের কাপে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চা—যার স্বাদ তেতো, কিন্তু একেবারে চেনা।

রাতের বেলা বারান্দায় দাঁড়ালে একটা আলাদা শব্দ পাওয়া যায়—যা শুধু একা মানুষেরা শুনতে পায়। সেই শব্দটা কানের নয়, আত্মার ভিতর ঢোকে। আমি আজ সেই শব্দেই তোকে খুঁজছি, তময়। তুই যদি এখন এই শহরের কোথাও থাকিস, তাহলে জানিস, আমি আর কিছু চাই না। শুধু চাই, একবার তুই চোখ তুলে তাকাস—ঠিক যেমন করে তাকিয়েছিলি সেই বইমেলার দুপুরে, ধুলোমাখা মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে।

আমি আজ শুধু চিঠির মতোই হয়েছি—অজানা পাঠক খোঁজে, পাঠানো হয়নি কোথাও, তবু একদিন হয়তো খুলে পড়া হবে, অক্ষরগুলো ফুস করে জীবন্ত হয়ে উঠবে, ঠিক তোর মতো।

পর্ব ৮: পুরনো গানের ক্যাসেট, ছেঁড়া কম্বলের গন্ধ আর এক কাপ নীরবতা

আজ দুপুরবেলায় আলমারি গুছোতে গিয়ে একটা পুরনো ক্যাসেট প্লেয়ার পেলাম। ছোটবেলায় যেটাতে গান শুনতাম, মা মাঝে মাঝে কীর্তন চালাতেন, আর বাবা রবীন্দ্রসঙ্গীত। আমি ক্লাস এইটে থাকতে একটা গান রেকর্ড করেছিলাম—“সে যে অনেক দূরের তারা…”—আমার কণ্ঠে না, তোমার কণ্ঠে। তুমি বলেছিলে, “রেকর্ড করে রাখ, একদিন হয়তো হারিয়ে যাব।” তখন আমরা হেসেছিলাম, বুঝিনি হারানো কতটা নিরব, কতটা অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া।

ক্যাসেটটা বাজিয়ে দেখি—চিড়বিড় শব্দ, মাঝে মাঝে কণ্ঠস্বর অস্পষ্ট, কিন্তু তময় তুমি তো আছ! সেই কাঁপা কাঁপা স্বরে গাওয়া গান, মাঝখানে হেসে ওঠা, “আরে রেকর্ড হচ্ছে বুঝিনি”—সবকিছু যেন এক টুকরো সময়, যেটাকে কেউ পকেটে পুরে রাখতে চেয়েছিল, রেখে গেছে আমার আলমারির কোণে।

বাইরে তখন বিকেলের রোদ নেমে আসছে, জানলার গ্রিল দিয়ে আলো পড়ছে দেয়ালের গায়ে। আমি পেছনের দিকের ঘরে বসে চুপ করে গান শুনছিলাম, এক কাপ কফি পাশে, যদিও আজও চিনি দিইনি। তোমার অভ্যেস আমার অভ্যেস হয়ে গেছে। এতটাই মিশে গেছো, যে তোমার উপস্থিতি ছাড়া আমার নিজের অস্তিত্বটা চিনতে পারি না।

কখনো কখনো ভাবি, আমি কি আদৌ নিজেকে ভালোবাসতে শিখেছি? নাকি তোকেই এত বেশি ভালোবেসে ফেলেছিলাম, যে নিজেকে আর জায়গা দিইনি? তুই চলে যাওয়ার পর নিজের মধ্যেই একটা চৌকোনা ঘর বানিয়ে ফেলেছি, যার চারদিকে শুধু স্মৃতির জানালা। মাঝখানে বসে থাকা আমি—একটা ছেঁড়া কম্বলের মতো, যা কেউ আর ব্যবহার করে না, কিন্তু ফেলে দিতেও পারে না।

কম্বলটা মনে পড়ল এই জন্যে, কারণ সেই শীতে, সেবার দার্জিলিং গিয়েছিলাম আমরা। তুই বলেছিলি, “কম্বলের ভিতর যে গন্ধ থাকে, সেটা মানুষের গায়ের নয়, একসাথে জেগে ওঠার।” সেই গন্ধটা আমি অনেকদিন আমার বালিশে খুঁজতাম। আর এখন? এখন আমি ঘুমোই একা, এমন ঘুম—যা আসেও না, যায়ও না, শুধু বুকে একটা ভার রেখে চলে।

আজ একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। পাড়ার মোড়ে একজন পত্রিকা বিক্রেতা এল, প্রতিদিনের মতো। কিন্তু আজ হাতে একটা পুরনো ম্যাগাজিন—২০০৮ সালের শারদীয়া সংখ্যা। আমি শখ করে কিনে ফেললাম। কারণ, সেই সংখ্যায় তোমার একটা গল্প ছাপা হয়েছিল—“ছায়ার চিঠি।” তুমি বলেছিলে, “এই গল্পটা তোর জন্য, কিন্তু নাম নেই। কারণ তুই গল্পের মতোই বাস্তব, অথচ ধরাছোঁয়ার বাইরে।”

গল্পটা আবার পড়লাম। এত বছর পরেও প্রতিটা শব্দ যেন আমাকেই লক্ষ্য করে ছোড়া। মনে হল, তুই কি জানতিস না, আমি সব বুঝতাম? এমনকি সেইসব চুপচাপ রাতগুলোতেও, যখন তুই আমার পাশে ঘুমিয়ে পড়তিস, আমি জানতাম—তোর ঘুম নেই। তুই কেবল চোখ বন্ধ করেছিলি।

এখন এসব কথা ভাবলেই মনে হয়, আমি কি তোর অনুপস্থিতি ভালোবাসতাম বেশি? তোর থাকা যতটা নিঃশব্দ ছিল, তোর চলে যাওয়া যেন অনেক বেশি জীবন্ত। এতদিন পরেও তোর চায়ের কাপ, তোয়ালে, কলম, এমনকি পড়া না-পড়া বইগুলো আমার চারপাশে গন্ধ ছড়ায়। আমি সেগুলো ছুঁয়ে দেখি না, শুধু পাশে বসে থাকি। ঠিক যেমন কেউ মোমবাতির আলো নিভে যাওয়ার পরও তার চারপাশের উত্তাপটুকু শুষে নেয়।

আজ রাতের বেলা আমি বারান্দায় বসে থাকলাম একটু বেশি। কাঁধে একটা শাল জড়িয়ে, কানে হেডফোনে সেই পুরনো ক্যাসেটের ডিজিটাল রেকর্ডিং চালিয়ে দিলাম। তুই গাইছিস—শব্দ ভাঙছে, সুর কাঁপছে, অথচ সেই দুর্বল গলায় এত তীব্র অনুভব! তুই তখন ঠিক আমার পাশেই বসে ছিলি—মনে হল, একটা হাত এল, আমার আঙুল ছুঁয়ে গেল, কিন্তু আমি জানি, সেটা কেবলই হাওয়া।

এইসব অনুভব লিখে ফেলার মতো নয়। এই শব্দগুলো ডায়েরির পাতায় ফোটে না, এগুলো শুধু বুকের পাঁজরের ফাঁকে গেঁথে থাকে। কেউ দেখেও দেখে না, কেউ ছুঁতেও পারে না। আমি শুধু জানি, ভালোবাসার সবচেয়ে গোপন রূপ এই—যেখানে কেউ কাউকে রাখে না, তবুও কেউ কোথাও হারিয়েও যায় না।

রাত তিনটে বাজে। চায়ের কাপ ফাঁকা, চোখ জ্বলছে, অথচ ঘুম নেই। আমি লেখার টেবিলে বসে একটা লাইন লিখলাম—

“তুই যদি আজ থাকতিস, আমায় কিছু বলতি না, কেবল চুপ করে পাশে বসে থাকতি।”

আমি তো আজও সেই অপেক্ষায় আছি—একটা নীরব পাশে বসে থাকা, এক কাপ চিনি ছাড়া চা, আর একটা জানলার আলো যেটা শুধু তোর ছায়াটাকেই চেনে।

পর্ব ৯: একটা মিথ্যে সকাল, একজোড়া খালি চটি, আর ভোরের শাড়ির গন্ধ

আজ সকালটা অদ্ভুত ছিল। ঘুম থেকে উঠে প্রথম যেটা মনে হল, সেটা বাস্তব নয়—স্বপ্ন। আমি দেখলাম তুই ফিরে এসেছিস। অদ্ভুত নিঃশব্দে ঢুকে পড়েছিস ঘরে, যেন কখনও যাসনি। কাঁধে ব্যাগ, চোখে ক্লান্তি, মুখে সেই চেনা হাসি—আঁচড়ে আঁচড়ে তুই। আমি কিছু বলিনি, তুইও না। শুধু এসে আমার পাশে বসলি, চুপ করে, এক কাপ চা হাতে তুলে নিলি, বললি, “চিনি দিয়েছিস আজ?” আমি বললাম, “না, তুই তো বলতি—চিনি থাকলে দুঃখ বোঝা যায় না।”

স্বপ্নটা এত স্পষ্ট ছিল, যে ঘুম ভাঙার পরও কয়েক মুহূর্ত আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না—তুই সত্যিই এসেছিলি কিনা। মাথার পাশের বালিশে তো এখনও তোর গায়ের গন্ধ লেগে আছে মনে হল। চোখ খুলে দেখি, আলো ফোটেনি পুরোপুরি, জানলার ফাঁক দিয়ে হালকা আলো ঢুকছে, আর জানলার ধারে রাখা শাড়ির ভাঁজে একটা অলীক সুবাস ভাসছে।

হ্যাঁ, এই শাড়িটা তুই কিনে দিয়েছিলি—রানাঘাট থেকে, গামছার দোকানের পাশের ছোট শাড়ির গলি থেকে। বলেছিলি, “এই শাড়ির রঙটা ঠিক তোর মতো—অল্প বিষাদে মোড়া, তবু লুকিয়ে থাকা আলো।” আমি তোকে বলেছিলাম, “তুই বুঝিস কী করে এমন?” তুই হাসতিস, মাথা নিচু করে বলতি, “কারণ আমি তোকে পড়ি, চোখ দিয়ে না, নি:শ্বাস দিয়ে।”

আজ শাড়িটার ঘ্রাণ একরকম তীব্র হয়ে উঠেছে। যেন বারবার জানিয়ে দিচ্ছে, তুই কোথাও আছিস। আমি শাড়িটা খুলে বিছানায় রাখলাম। কিন্তু কিছুতেই পারলাম না সেই স্বপ্ন থেকে বেরোতে। তখনও ভাবছিলাম, হয়তো বাথরুমের আয়নায় গিয়ে দেখা যাবে তুই দাঁড়িয়ে আছিস, দাঁতের ব্রাশ মুখে, চোখে ভোররাত্রির ঘুম আর ঠোঁটে একটা অভিমানী নির্লিপ্তি।

আমি হেঁটে গেলাম বারান্দায়। পায়ের নিচে একজোড়া খালি চটি পড়ে ছিল। আমার নয়। পরিচিত লাগে, তবু এখনকার নয়। মুহূর্তে মনে পড়ল—সেই চটি তো তোর ছিল, মাটির ছাঁটে ভরা, সামনের সেলাইটা একটু আলগা হয়ে যাওয়া। তুমি রেখে গিয়েছিলে বলে নয়, আমি রেখে দিয়েছিলাম। ভাবতাম, একদিন যদি ফিরে আসিস, খুঁজে পাবে।

চটি দুটো একপাশে সরিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বাইরের রাস্তা তখনও ঘুমঘুম, আকাশ ধূসর, হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে গাল, কেমন যেন একটা অভ্যন্তরীণ নৈঃশব্দ্য। এইরকম সময়েই আমার সবটুকু ভেতরের কথা জেগে ওঠে। তখন আমার কবিতা হয় না, হয় শুধু দীর্ঘশ্বাস, যে ভাষা বোঝে না কেউ, শুনেও শোনে না।

আজ একটা ফোন এসেছিল পুরনো বন্ধুর, নাম—অয়ন। কলেজে আমাদের বন্ধু ছিল। সে বলল, “তুই এখনো তময়ের গল্পেই আছিস?” আমি একটু হেসে বললাম, “তুই এখনো গল্প আর বাস্তবের ফারাক করিস?” অয়ন বলল, “তময় তোকে ভালোবাসেনি, এটা তুই জানিস। তুই কি জানিস, সে এখন কোথায় আছে?”

আমি চুপ করে গিয়েছিলাম। আমি জানতাম, তময় কোথায় আছে বা কার সঙ্গে, সেটার চেয়েও বড়ো সত্যি—সে এখন আর আমার জীবনে নেই, কিন্তু আমার ভিতর থেকে যায় প্রতি মুহূর্তে। অয়ন বলল, “ভালোবাসা মানে তো এগোনো, পেছনে ঝুলে থাকা না।” আমি বললাম, “ভালোবাসা মানে কখনোই গন্তব্য নয়, ভালোবাসা মানে হেঁটে চলা, কেউ পাশে থাকুক বা না থাকুক।”

আসলে, মানুষ মাঝে মাঝে এমন কিছু ধরে ফেলে, যা সে নিজেই ছাড়তে পারে না। আমি তময়কে ভালোবেসেছি ঠিকই, কিন্তু তাকে চাওয়ার মতো করে নয়। আমি তাকে নিজের শ্বাসে জড়িয়েছি, গন্ধে, আলোর রেখায়, এমনকী সেই নীরবতার মধ্যেও, যেটা সন্ধেবেলা একা ঘরে ঢোকে।

আজকে দুপুরে আমি সেই চিঠিটার উত্তর লিখলাম, যেটা কেউ পাঠিয়েছিল ‘তময়ের খোঁজ’ দিয়ে। জানি, ঠিকানাটা পৌঁছাবে না, তবু লিখলাম—

“প্রিয় তুমি,
তোমরা বলেছিলে, সে ভালো আছে। আমি জানি, সে ভালোই থাকবে। সে যেভাবে বাঁচে, সেখানে আমি নেই, কিন্তু অনুপস্থিতি আছেই। যদি কোনোদিন তার চোখের সামনে আমার নাম আসে, বলো, আমি এখনো চিনি ছাড়া চা খাই। আর জানলার পাশে বসে যে মেয়েটি সন্ধেবেলায় বৃষ্টির শব্দ গোনে, সে প্রতিদিন তোমার কবিতা না লিখে তবু তোমাকেই লিখে।”

চিঠিটা শেষ করে পেনটা নামিয়ে রাখলাম। তারপর মনে পড়ল, আমি যে গল্প লিখছি, সেটা তো আসলে চিঠিরই মতো। পাঠানো হয় না, কিন্তু প্রতিটি শব্দ কোনো এক অলীক পাঠকের জন্যে। তময়, তুই কি সেই পাঠক?

রাতের দিকে আবার একটা ঝিরঝিরে বৃষ্টি নামে। বারান্দার জানলা খোলা, বাতাসে ঠান্ডা জলীয় গন্ধ, আমি ধীরে ধীরে জানলার ধারে বসে থাকি। পাশে একটা খালি চা-কাপ, এক ফোঁটা জল জমে আছে তলায়। সেই জলে যেন তোর মুখ পড়ে আছে—অস্পষ্ট, কিন্তু স্পষ্টর চেয়েও স্পষ্টতর।

এই শহর, এই জানলা, এই শাড়ি, এই চটি, এই স্বপ্ন, সব যেন একটা গানের মতো হয়ে গেছে। সেই গান যার কোনও সুর নেই, অথচ বাজতে থাকে মনের ভিতর অবিরাম।

পর্ব ১০ (শেষ পর্ব): এক ফোঁটা আলো, এক জোড়া ছায়া, আর যে কথা চিরকাল লেখা রইল না বলা থেকে

আজ সকাল থেকেই মনটা অদ্ভুত ফাঁকা। ঠিক যেন একটা দরজা খুলে গেছে ভিতরে, যেটা এতদিন বন্ধ ছিল। না, কোনো নতুন খবর পাইনি। তময় ফিরেও আসেনি। তবু মনে হল, আজ আমি আর আগের আমি নেই। কিছু একটা শেষ হয়ে গেছে, অথবা শুরু হচ্ছে নতুন করে—যার নাম আমি এখনো জানি না।

বিছানা গুছাতে গিয়ে দেখি তোর দেওয়া কম্বলটা পড়ে আছে—চোখের কাছে টেনে নেই, গন্ধ পাই না আর, কিন্তু অনুভব করি। একটা পুরনো গান চালিয়ে দিলাম—হেমন্তর গলা, “এই পথ যদি না শেষ হয়…” এই গানটা তুই খুব পছন্দ করতিস। বলতিস, “এই গানের কথার মধ্যে আমি নিজেকে খুঁজে পাই।” আমি বলতাম, “তুই এত শেষের কথা ভাবিস কেন?” আর তুই মাথা নিচু করে বলতিস, “কারণ শুরুটাই তো ভুল ছিল।”

আজ আমি বুঝি, আমাদের গল্পটা ভুল ছিল না। শুধু অসমাপ্ত ছিল। আর কিছু গল্প এমনই হয়—তাদের শেষে দাঁড়ানো যায় না, শুধু হাঁটতে হয়, পেছনে আর না তাকিয়ে।

বাইরে বৃষ্টি থেমে গেছে। জানলার ধারে একটা ফড়িং বসে আছে—চুপচাপ। এতক্ষণ ধরে বসে থাকা ফড়িং আমি আগে দেখিনি। মনে হল, তুই বসে আছিস ওর মধ্যে। হঠাৎ ওটা উড়ে গেল, একটানা, নিরুদ্দেশের দিকে। আমার বুকের মধ্যে একটা শূন্যতা রেখে গেল, যেন কেউ চুপ করে বিদায় জানিয়ে গেল।

আজ রিনা আবার ফোন করেছিল। বলল, “তুই শেষমেশ কী করবি তময়ের এই গল্পটা নিয়ে?”
আমি একটু চুপ করে থেকে বললাম, “শেষ করব। কিন্তু ওকে খুন করব না গল্পে। ও থাকবে, যেমন ছিল, তেমনি। আমার ভেতরে। আমার জানলার পাশে। আমার চায়ের কাপে।”
রিনা বলল, “তুই জানিস, তোকে কেউ ভালোবাসলে ওর সঙ্গে থাকা যেত না।”
আমি হেসে বললাম, “ভালোবাসা কি সবসময় থাকার জন্য হয়?”
ও বলল, “না, কিন্তু কিছু তো পাওয়ার কথা!”
আমি বললাম, “আমি পেয়েছি—একটা নীরবতা, যেটা ভাষার চেয়েও বেশি বলেছে। একটা চুপ থাকা, যেটা চিৎকারের চেয়েও বেশি জোরে কেঁদেছে।”

আজ আমি তময়কে আর দোষ দিই না। কারণ, কেউই চিরকাল কথা রাখতে পারে না। মানুষ বদলায়, সময় বদলায়। শুধু কেউ কেউ থেকে যায়—স্মৃতির ফাঁকে, পুরনো শাড়ির গন্ধে, জানলার পাশে রাখা চায়ের কাপে, কিংবা ঘুমের ঘোরে ফিসফিস করে বলা “তুই থাকিস, প্লিজ” কথাটায়।

সন্ধের দিকে একটা খুদে চিঠি লিখে ফেললাম। আর কোনো খামে ঢোকাইনি। শুধু নিজের খাতার শেষ পাতায় রেখে দিলাম—

“তময়,
আজ তোমায় নিয়ে কিছু লিখছি না। আজ শুধু জানালার বাইরে তাকিয়ে ভাবছি, তুমি কেমন আছো। ভাবছি, তোমার পাশে কেউ আছে কি না, যে তোমার হাতে কাপ ধরিয়ে বলে, ‘চিনি ছাড়া ঠিক আছে তো?’ যদি থাকে, আমি খুশি। যদি না-ও থাকে, আমি প্রার্থনা করি, তুমি একদিন বুঝে ওঠো—কেউ একজোড়া চোখ চিরকাল তোমার দিকেই তাকিয়ে ছিল।
ভালো থেকো।
— স্মিতা”

চিঠিটা লেখার পর আমার বুকটা হালকা লাগছিল। যেন এতদিন ধরে আটকে থাকা একটা জমে যাওয়া নদী আজ মুক্তি পেল। তময় এখন কোথায় আছে, কার সঙ্গে আছে, জানি না। কিন্তু তার চেয়েও বড়ো সত্যি হল, আমি তময়কে মুছে ফেলিনি—আমি তাকে বাঁচিয়ে রেখেছি, নিজের ভাষায়, নিজের অভ্যাসে, নিজের নিঃশ্বাসে।

রাত হয়েছে এখন। ঘর অন্ধকার, শুধু টেবিল ল্যাম্পটা জ্বলছে। আমি সেই পুরনো ক্যাসেট চালালাম—যেটায় তময়ের গলা রেকর্ড করা ছিল। এবার আর চোখে জল আসেনি। শুধু হাসি ফুটল ঠোঁটে, কাঁপা গলায় গাওয়া সেই গানটার তালে তালে।

জানলা খুলে দিচ্ছি। হাওয়া ঢুকে পড়ছে ঘরে। তাতে কোনো গন্ধ নেই, কোনো শব্দ নেই। শুধু একটা অনুভব আছে—একটা নামহীন ছায়ার, যে আজও পাশে বসে আছে চুপচাপ। আমরা দুজন, কথা বলছি না, কিছু চাইছি না, শুধু এক কাপ দুঃখ ভাগ করে নিচ্ছি—চিনি ছাড়া।

গল্প শেষ। কিন্তু কিছু ভালোবাসা আর কখনো শেষ হয় না।

শেষ

1000019049.jpg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *