অরিত্র চক্রবর্তী
পর্ব ১: আগমনের দিন
আকাশটা ছিল ধূসর, পাহাড়ের কোলে জমে থাকা কুয়াশা গড়িয়ে পড়ছিল রাস্তার ধারে। কালিম্পং শহরের মূল অংশ থেকে গাড়ি ছুটেছে প্রায় পঁচিশ মিনিট, তখনই প্রথম দেখা মিলল সেই বাংলোর—একটা কাঠের দু’তলা বাড়ি, পাহাড়ের কিনারে দাঁড়িয়ে। নাম তার “শিল কালিম্পং”—একটা লেখকদের রেসিডেন্সিয়াল প্রোগ্রাম, যেখানে দেশের নানা প্রান্ত থেকে দশজন লেখক এসে জড়ো হয় প্রতিবছর, দশ দিনের জন্য।
গাড়ি থেকে প্রথম নেমেছিলেন সুচেতা ব্যানার্জি—পঁয়ত্রিশ পেরোনো, শহর কলকাতার কবি, মুখে গম্ভীর ছায়া। পাহাড়ের নিঃশব্দতা তাকে কেমন অসহ্য লাগছিল প্রথমে, তারপর হঠাৎ শব্দ শুনলেন—ঝিঁঝিঁ পোকার, পাতা নড়ার, দূরের ঝরনার। মনে পড়ল কোনো এক কবিতার লাইন, “যেখানে ভাষা থেমে যায়, সেখানে শব্দেরা বসবাস করে।”
দ্বিতীয় যে নেমেছিলেন, তিনি মল্লার সাঁতরা—মুম্বাইয়ের নাট্যকার, মুখে সদ্য সিগারেট ছোঁয়া, হাতে পত্রিকা। “এটাই বুঝি সেই কবিদের আশ্রম?” তিনি হেসে বললেন। সুচেতা তাকিয়ে ছিলেন তার দিকে, একরকম অনীহা নিয়ে—নাটকের লোকেরা কেমন আত্মভোলা হন, সেই নিয়ে তার আলাদা এক রাগ ছিল।
চলে এল একে একে আরও মানুষ—অরিজিৎ ঘোষ, বহরমপুরের স্কুলশিক্ষক ও ছড়াকার, স্বপন মিত্র, দমদমের প্রবীণ অনুবাদক, তানিয়া নাভেদ, চণ্ডীগড়ের তরুণ গল্পকার, যার চেহারাতেই একটা দূরত্ব ছিল, যেন এই জগতের নয়।
সবচেয়ে চমক এনে দিল যে, সে হল ইরা দত্ত। তার বয়স কেউ আন্দাজ করতে পারেনি প্রথমে—সাদাচুলো, পাতলা চোখের ফ্রেম, আর একরকম নিঃশব্দ চোখ, যেন প্রতিটি আগতকে আলাদা করে দেখে নিচ্ছেন তিনি। পরিচালক কৌশিক বাবু বললেন, “এই হলেন আমাদের বিশেষ অতিথি—ইরা দত্ত, যিনি গত দশ বছর কোথাও প্রকাশ করেননি কিছু, তবু যার নাম আজও সাহিত্যচক্রে কিংবদন্তি।”
ইরা হাসলেন না, শুধু মাথা নাড়লেন। তারপর সেই কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলেন উপরতলায়, যেন বাকিদের সঙ্গে তার কোনো বিশেষ সম্পর্ক নেই।
বাংলোটা ছিল প্রায় শতবর্ষ পুরোনো। কাঠের মেঝে হাঁটলেই শব্দ করত, যেন ভূগর্ভ থেকে কেউ কিছু বলতে চাইছে। ঘরগুলো আলাদা, জানালার পাশে লেখার টেবিল, একটা ছোট বইয়ের তাক, আর দেয়ালে জংধরা খোপ। বাইরের বারান্দা থেকে দেখা যায় তিস্তা নদীর হালকা রূপ, আর তার ওপারে নেপালি গ্রাম।
প্রথম সন্ধ্যায় সবাই মিলে বসেছিল নীচতলার ডাইনিং রুমে—একটা গোল টেবিল ঘিরে। আলো কম, জানালার ওপারে কুয়াশা নেমে এসেছে। কে যেন জিজ্ঞেস করল, “এই বাড়িটা কী কারো ছিল আগে?”
স্বপন মিত্র বললেন, “একটা সুনামি কবির নাম শুনেছিলাম… নাম ছিল মীরা কুন্দন। উনি এখানে এসেছিলেন লিখতে। তারপর…” থেমে গেলেন।
“তারপর?” অরিজিৎ কৌতূহলী হয়ে উঠল।
স্বপন একটু মুচকি হেসে বললেন, “বলা যায় না। কেউ বলেন উনি আর ফেরেননি।”
একটা নিস্তব্ধতা নেমে এল। তারপর মল্লার বলল, “বাহ, তাহলে এই জায়গাটা নাটকের জন্য উপযুক্ত।”
তানিয়া একা বসেছিল জানালার ধারে। তার হাতে ছিল একখানা নোটবুক, খুলে সে লিখছিল, “নীরবতা এখানে অনন্ত নয়, বরং সচেতন। প্রতিটি দেওয়াল, প্রতিটি জানালা—দেখে ফেলে আমার চুপ থাকা।”
ডিনার শেষে সবাই নিজ নিজ ঘরে চলে গেলেন। পাহাড়ি হাওয়া ছিল শীতল, বাতাসে মিশে ছিল ছেঁড়া পাতার গন্ধ। সুচেতা তার ঘরের জানালা খুলে বসে ছিল, বাইরের অন্ধকারে, হঠাৎ তার মনে হল যেন কেউ ডাকছে—একটা স্তব্ধ অথচ মৃদু কণ্ঠ।
সে জানালার পাশে রাখা পুরনো তাকটা খুলে দেখল, সেখানে একটা পুরনো ডায়েরি। ধুলোমলিন, তবু সুস্পষ্ট হাতে লেখা প্রথম লাইন:
“এই বাংলো শব্দে গড়া নয়, নীরবতায় বাঁধা।”
সে চমকে উঠল। কার লেখা? কে রেখে গেছে?
বাইরে পাহাড় নীরব।
শুরু হল শব্দ ও নীরবতার এক অদ্ভুত সহাবস্থান। এই প্রথম দিনের শেষে, রেসিডেন্সিয়ালের কেউ টের পেল না, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটা অদৃশ্য পরত ফাঁক খুলেছে, যার ভিতর ঢুকে পড়ছে প্রত্যেকটা লেখক—অজানা কোনো গল্পের পৃষ্ঠা ধরে।
পর্ব ২: ডায়েরির দ্বিতীয় পাতা
সুচেতা সারারাত ঘুমোতে পারেনি। অদ্ভুত ছিল ডায়েরিটার গন্ধ—ধুলোর ভেতরেও যেন এক ধরনের সজীবতা ছিল। মরা পাতার মতো নয়, বরং সদ্য ছেঁড়া ফুলের পাপড়ির মতো। সে রাত একটা নাগাদ আবার সেই ডায়েরি খুলেছিল, জানালার পাশে বসে, পাহাড়ি হাওয়া গায়ে মেখে।
প্রথম পাতার নিচেই লেখা ছিল দ্বিতীয় লাইন:
“যে ঘর শব্দ চেনে না, সে ঘরেও গল্প জন্মায়।”
সুচেতা লেখিকা হলেও, কবিতার বাইরের লেখা সে খুব একটা বিশ্বাস করত না। তার মতে, মানুষ শব্দ খোঁজে না—ভয় থেকে পালায় শব্দে আশ্রয় নিতে। তবু এই লাইন তাকে যেন ঝাঁকুনি দিয়ে তুলেছিল। কে এই মীরা কুন্দন? কোথায় গিয়েছিলেন তিনি? সত্যিই কি এই বাংলোতে থেকেছিলেন?
পরদিন সকালের আলো যখন পাতার ফাঁক গলে ঘরের ভিতর পড়ছিল, তখনই বারান্দায় দেখা গেল অরিজিৎ ঘোষকে। একহাতে কফির কাপ, আরেকহাতে ছড়ার খাতা। সে বারান্দা ধরে হাঁটছিল, হঠাৎ থেমে বলল, “আপু, ঘুম হয়নি বুঝি?”
সুচেতা মাথা নাড়ল।
অরিজিৎ বলল, “গত রাতে অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলাম। বাংলোর নিচে যেন একটা গোপন ঘর আছে। কেউ একজন নিচে বসে লিখে চলেছে। শব্দ শুনলাম না, কিন্তু পাতার আওয়াজ ছিল।”
সুচেতা চমকে উঠল, কিন্তু কিছু বলল না।
নিচের খাবার ঘরে তখন সকালের চা তৈরি হচ্ছিল। চায়ের গন্ধে একে একে এসে জড়ো হলেন বাকিরা। ইরা দত্ত নিঃশব্দে চায়ের কাপ নিয়ে সিঁড়ির ধাপে বসে পড়লেন, তাঁর চেহারায় আগের দিনের মতোই এক নিবিড় অচেনা শান্তি।
তানিয়া চুপচাপ ঘরে ঢুকে বলল, “গতকাল একটা পুরনো ট্রাঙ্ক দেখেছিলাম, ঘরের পাশের বারান্দার নিচে। খুলতে সাহস হয়নি।”
মল্লার বলে উঠল, “কেউ কি জানে এই বাংলোর আসল ইতিহাস? কৌশিক বাবুকে তো ঠিকমতো জিজ্ঞেসও করা যায় না। সব সময় ফোনে ব্যস্ত।”
স্বপন মিত্র মুখ তুললেন, “আমি গত রাতে একটু খোঁজ করছিলাম। ডাইনিং রুমের পাশে একটা পুরনো বইয়ের তাক আছে, সেখানে একটা খাতা পাওয়া গেছে—পুরনো রেজিস্টার, যেখানে একেক বছরের অংশগ্রহণকারীদের নাম লেখা। ১৯৯৭ সালে একটাই নাম, শুধু: মীরা কুন্দন।”
ঘরে মুহূর্তেই নিস্তব্ধতা।
সুচেতা বলল, “আমি গত রাতে একটা ডায়েরি পেয়েছি। জানালার পাশে একটা খোপে রাখা ছিল। হয়তো মীরার লেখা। তাতে কিছু এমন লাইন ছিল… যেগুলো কেমন যেন…”
তানিয়া জিজ্ঞেস করল, “একটু পড়ে শোনাবেন?”
সুচেতা ডায়েরি এনে প্রথম ও দ্বিতীয় পাতার লেখা পড়ে শোনাল। সবাই যেন কেমন স্তব্ধ হয়ে শুনছিল। বাইরে তখন রোদ উঠেছে, পাহাড়ের পেছনে আলোর রেখা ছড়িয়ে পড়েছে বাংলোর ছাদে।
ইরা দত্ত হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন, তারপর বললেন, “আমি মীরাকে চিনি।”
সবাই চমকে তাকাল তার দিকে।
“চিনতাম মানে?”—মল্লার বলল।
ইরা বললেন, “অনেক বছর আগে, শিলচর সাহিত্য সম্মেলনে দেখা হয়েছিল। ও একা ছিল, চুপচাপ। কারো সঙ্গে বেশি কথা বলত না। তবে একবার বলেছিল—‘আমি এমন এক জায়গায় যেতে চাই, যেখানে শব্দেরা আর লিখতে বাধা দেয় না। যেখানে তারা নিজেই লেখে।’ আমি তখন ঠিক বুঝিনি।”
স্বপন মৃদু স্বরে বললেন, “তাহলে উনি এখানে এসেছিলেন ঠিকই।”
তানিয়া তখন ট্রাঙ্কটার কথা আবার তুলল। সবাই মিলে গেল বারান্দার নিচে। পাথরের চাতালের পাশে অর্ধেক ঢাকা অবস্থায় একটা লোহার ট্রাঙ্ক পাওয়া গেল। উপরে ছিল জং, কিন্তু তালা ছিল না।
সুচেতা ধীরে ধীরে খুলল সেই ট্রাঙ্ক। ভিতরে কিছু পুরনো পাণ্ডুলিপি, একটা পার্চমেন্ট কাগজে লেখা কিছু কবিতা, আর এক কোণে ছোট একটা কাঁচের শিশি।
তানিয়া শিশিটা হাতে নিয়ে বলল, “এটা তো কালি!”
স্বপন বললেন, “না, এটা অদ্ভুত গন্ধের কোনো তরল… লেখা মুছে ফেলার কালি নয়, বরং হয়তো লেখা ধরে রাখার জন্য?”
সেই পুরনো কবিতাগুলোর একটি পড়তে গিয়ে সুচেতার গলা থেমে গেল—
“যে কাগজে গল্প লিখি, সে কাগজও কি কখনো আমাকে পড়ে?”
মল্লার হেসে বলল, “এটা তো একেবারে মেটা!”
কিন্তু ইরা দত্ত তখন চুপ করে ছিলেন। তাঁর চোখ চলে গিয়েছিল এক কোণে রাখা পুরনো এক খামে, যার ওপর লেখা ছিল:
“যদি কেউ ফিরে আসে…”
সুচেতা বলল, “ফিরে আসা মানে?”
ইরা ধীরে বলে উঠলেন, “মীরা বলেছিল, ‘যদি আমি একদিন হারিয়ে যাই, কেউ যদি সত্যিই বোঝে কীভাবে শব্দ হারায়, সে-ই আমাকে ফিরিয়ে আনতে পারবে।’”
বারান্দার পাশে দাঁড়িয়ে সুচেতা দেখল, কুয়াশার পর্দা একটু একটু করে সরছে। পাহাড়ের গায়ে যেন লেখা আছে—একটা গল্প, একটা অক্ষর, একটা নামহীন প্রশ্ন।
এই ডায়েরি, এই ট্রাঙ্ক, এই শিশি—সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল, এ কোনও সাধারণ রেসিডেন্স নয়। এটা একটা যাত্রা—নিজের ভিতরের লেখককে খোঁজার, সেই লেখক যার কথা কেউ শোনেনি, যার লেখা প্রকাশ পায়নি, যে শুধু পাহাড়ে রেখে গেছে কিছু চিহ্ন।
সুচেতা মনে মনে বলল, “আমি ফিরিয়ে আনব, মীরা। যদি সত্যিই তুমি হারিয়ে গিয়ে থাকো, আমি তোমার গল্পটা শেষ করব।”
তারপর সে ডায়েরির তৃতীয় পাতা উল্টালো।
পর্ব ৩: একটি কালি, একটি প্রতিজ্ঞা
ডায়েরির তৃতীয় পাতার কাগজ ছিল আলগা, যেন বাতাসে ভেসে আসা একটি বৃষ্টিভেজা চিঠি। তবু তার প্রতিটি অক্ষর ছিল স্থির, স্পষ্ট, আর কেমন এক ছোঁয়াচে স্তব্ধতা মিশে ছিল লেখার গভীরে।
সুচেতা ধীরে ধীরে পড়তে লাগল—
“যে কালি দিয়ে আমি লিখি, তা আমার রক্ত নয়, সময়ের দ্রবণ। প্রতিটি শব্দ যাকে স্পর্শ করে, সে আমার একটা অতীত হয়ে ওঠে।”
পড়েই সে থমকে গেল। সময়ের দ্রবণ? শব্দের ভিতরে সময় জমে থাকে বুঝি? পাহাড়ের নিরবতা যেন আরও ঘন হয়ে এল তার চারপাশে।
সেই মুহূর্তে বারান্দায় এসে দাঁড়াল মল্লার। হাতে কফির মগ, মুখে আগের দিনের হাসি নেই। বলল, “তুমি ঠিক করেছো কি করবে ওই ডায়েরির লেখাগুলো নিয়ে?”
সুচেতা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “না, করিনি। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমাদের এখানে আসাটা কাকতালীয় নয়।”
“মানে?”
“মানে এই রেসিডেন্সিয়াল, এই দশদিন—সবটা যেন শুধু লেখালিখির ছুতো। আমরা কেউই বোধহয় ঠিক সেই লেখাগুলো লিখছি না, যেগুলো আমাদের লেখা উচিত ছিল। হয়তো মীরার মতো কারও কথা লিখে যাওয়া দরকার ছিল, কিন্তু কেউ করেনি।”
মল্লার একটু ভ্রু কুঁচকে বলল, “তুমি তো ভাবছো ওটা সত্যি লেখা, অলৌকিক কিছু!”
সুচেতা মৃদু হেসে বলল, “তুমি কি লেখক হয়ে অলৌকিকতাকে একেবারে অস্বীকার করো? একটা শব্দ তো নিজেই অলৌকিক, কারণ সেটা কোথা থেকে আসে জানো না, তবু বিশ্বাস করো। যেমন তুমি বিশ্বাস করো, তুমি যখন লেখো, কেউ পড়বে। সেটা অলৌকিক নয়?”
মল্লার চুপ করল।
ওইসময় ইরা দত্ত এলেন নিচে, হাতে সেই শিশিটা। সবাই তখন একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। তিনি এসে বললেন, “আমি এটা অনেক বছর আগে দেখেছিলাম। একবার মীরা তার কবিতা পড়ছিল এক বন্ধুমহলে। তার কলমে কালি শেষ হয়ে গিয়েছিল। সে এই শিশি থেকে কিছু ঢালল, তারপর লিখল—একটি চার লাইনের কবিতা। কিন্তু কাগজে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। আমরা ভেবেছিলাম, ও বুঝি কিছুই লেখেনি। বছরখানেক পরে, তার মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে, হঠাৎ সেই কবিতাটা কাগজে ফুটে উঠল। আলো পড়তেই। শুধু সূর্যাস্তের সময়ে। কালির নাম ছিল—‘সূর্যকালি’। মীরা নিজেই নাম দিয়েছিল।”
স্বপন মিত্র পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ধীরে বলে উঠলেন, “এই রকম কালি আমি একটা পুরনো পুঁথিতে পড়েছিলাম। মহাভারতের অনুবাদের সময় কিছু সন্ন্যাসী নাকি ব্যবহার করত। কিছু লেখা একদম নির্দিষ্ট সময়ে দেখা যেত, যেমন পূর্ণিমার রাতে, বা বিশেষ কোন শব্দ উচ্চারণে।”
তানিয়া বলল, “তাহলে কি মীরা নিজের গল্পকে এমন কিছুর ভিতর রেখেছে যা সাধারণ চোখে ধরা পড়ে না?”
ইরা মাথা নাড়লেন, “শুধু ধরা পড়ে না বললে কম বলা হয়। মীরা নিজে বলত—‘আমি চাই আমার পাঠকও খোঁজ করুক, যেমন আমি করেছি।’”
হঠাৎই মল্লার বলল, “আমাদের কি উচিত নয় কিছু লিখে দেখা এই কালিতে?”
তানিয়া সন্দিহান মুখে বলল, “কিন্তু আমরা তো জানি না এটা কীভাবে ব্যবহার করতে হয়। না জানে কী প্রভাব।”
সুচেতা চুপচাপ ছিল। তারপর বলল, “আমি লিখব।”
সবাই চমকে তাকাল তার দিকে।
সে নিজের লেখার খাতা থেকে একটা পাতা ছিঁড়ে নিল। কলমটা শিশিতে ডুবিয়ে ধীরে ধীরে লিখল:
“যদি শব্দেরা আমায় চেনে, তবে আমি কি হারিয়ে যেতে পারি?”
তানিয়া সামনে এসে দাঁড়াল, কাগজটা দেখে বলল, “কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না!”
সুচেতা বলল, “তোমরা সবাই কাগজটা সূর্যের সামনে ধরো।”
সকাল তখন গড়িয়ে গেছে। সূর্যের আলো ছিল হালকা, রুক্ষ, আর জানালার কাঁচে ছড়িয়ে পড়েছিল কুয়াশা। ইরা নিজে কাগজটা নিয়ে বারান্দার রেলিঙে দাঁড়িয়ে রোদে ধরলেন। ধীরে ধীরে, এক অদ্ভুত বেগুনি-নীল রঙে, সেই লেখাটা ভেসে উঠল কাগজের বুকজুড়ে।
সবাই স্তব্ধ। যেন ঠিক সেই মুহূর্তে বুঝে গিয়েছিল—মীরা কুন্দন হারিয়ে যায়নি। তিনি শুধু লুকিয়ে রেখেছিলেন নিজেকে অন্য এক ভাষায়, অন্য এক আলোয়।
সুচেতা চোখ বন্ধ করল। তার মনে হল সে কোনও শব্দ লিখেনি, বরং কোনও শব্দ তাকে লিখেছে।
মল্লার ধীরে বলল, “এটা তো কালি নয়, এটা তো এক ধরনের দীক্ষা।”
ইরা দত্ত বললেন, “ঠিকই বলেছো। এটা এক প্রতিজ্ঞা। যে এই কালিতে লিখবে, তাকে সত্যিকারের শব্দের পাশে দাঁড়াতে হবে। আর মীরার শেষ লেখাটা—সেই ‘হারিয়ে যাওয়া গল্প’—ওই প্রতিজ্ঞার পথেই পাওয়া যাবে।”
তানিয়া তখন বলল, “তাহলে কি আমাদের এই রেসিডেন্সিয়াল শুধুই সাহিত্য কর্মশালা নয়? এটা কি একটা চর্চা? এক অন্তর্জাত্রা?”
সুচেতা কাগজটা হাতে নিল। তার মনে হচ্ছিল, যেন পাহাড়ের ঢালে কোনো অদৃশ্য পাথরে খোদাই হয়ে আছে সেই উত্তর, যেটা সে এতদিন খুঁজছিল।
“হ্যাঁ,” সে বলল, “এটা একটা যাত্রা। নিজের গভীরে ডুব দিয়ে ফিরে আসার। হয়তো ফিরে না আসারও।”
দূরে তখন ঝিঁঝিঁর ডাক জেগে উঠেছে, ঝরনার শব্দে মিশে গিয়েছে সকালের স্থিরতা। একখণ্ড কুয়াশা হেলে পড়েছে বারান্দার কাঠে।
আর সেই কাঠের বুকের নিচে কোথাও, অদৃশ্য কোনো ভাষায়, একটা নাম লেখা আছে—
মীরা।
পর্ব ৪: হারিয়ে যাওয়া কবিতার নোটবুক
রাত নেমে এসেছিল শিল কালিম্পং-এর উপরে, নিঃশব্দে, ধীরে। পাহাড়ের কুয়াশা নেমে এসে ঢেকে ফেলেছিল বাংলোর ছাদ, বারান্দা, জানালার কাঁচ—সবই যেন অনর্গল ঢেউয়ে ভেসে যাচ্ছিল। বাতাসে অদ্ভুত এক ঘ্রাণ ছিল—পোড়া কাঠ, ভেজা পাতার আর অপ্রকাশ্য শব্দের।
সেই রাতে, যখন সবাই নিজের ঘরে ফিরে গিয়েছিল, সুচেতা কেবল বসে ছিল তার লেখার টেবিলের সামনে। একদিকে খোলা ছিল মীরার ডায়েরি, অন্যদিকে তার নিজের খাতা, আর মাঝখানে সেই ছোট কাঁচের শিশি। কালি যেন শুকিয়ে যায়নি, তবু তার গাঢ়তা কিছুটা বদলে গিয়েছে—মেশানো নীল, কিসের যেন ক্লান্তি।
সে নিজের খাতার পাতায় আবার একটা লাইন লিখল, সেই কালি দিয়েই—
“আমি যা লিখি, তা কি আমি নই?”
এইবার আলোয়ও ফুটে উঠল না কিছু।
হঠাৎ, তার চোখ গেল টেবিলের নিচে।
একটা পাতলা খাতার প্রান্ত যেন বেরিয়ে আছে কাঠের ফাঁক দিয়ে। সে টেবিলটা একটু টেনে নিয়ে খাতাটা বের করল। খুব পুরোনো, মলিন, পাতাগুলো প্রায় খুলে আসছে, তবু ভেতরে লেখা ছিল। লেখা, কবিতার ছন্দে, মীরার হাতের লেখায়।
“আমার ছায়া খুঁজে বেড়ায় এক নদীর কাছে
যেখানে ভাষা আর জল একসঙ্গে বয়ে চলে
যেখানে পাথরের বুকেও শব্দ জন্মায়
আর নিঃশ্বাসে লেখা হয় নীরবতা।”
সুচেতা চমকে উঠল। এই তো সেই ছন্দ, সেই ভাষা, যা তার নিজের লেখাতেও হঠাৎ হঠাৎ এসে পড়ে। কখনো ব্যাকরণ মানে না, কখনো ছন্দ ভেঙে দেয়—তবু হৃদয় ছুঁয়ে যায়। এই কবিতা কি তবে সে পড়ে ফেলেছিল আগে? না কি সেই ছায়া তার ভেতরেই ছিল এতদিন?
নিচে নামার সময় সে দেখল বারান্দায় বসে আছেন ইরা দত্ত, কাঁধে একটা কাঁথা চাপানো, চোখে সেই চিরচেনা স্তব্ধতা। সুচেতা কাছে গিয়ে বলল, “আমি একটা কবিতার খাতা পেয়েছি।”
ইরা চমকায় না। বলেন, “মীরার শেষ সময়টা ও চুপ করে লিখেই কাটাতো। কেউ তখন জানত না সে ঠিক কী লিখছে। শুধু এই বাংলোয় থাকার সময় নাকি সে একটা কবিতার সংকলন শুরু করেছিল—‘ছায়ার নদী’। কেউ দেখেনি বইটা, কেউ জানেও না কোথায় হারাল।”
সুচেতা খাতা এগিয়ে দেয়। ইরা পাতা উল্টে দেখে—তৃতীয় পাতায় লেখা একটা কবিতা দেখে সে থেমে যায়।
“পাহাড় নীচু হলে শব্দ পড়ে যায়
আর পাহাড় উঁচু হলে শব্দ চেপে যায়
তাই আমি সমতল খুঁজি না,
আমি শব্দের ভার খুঁজি।”
ইরার চোখ ছলছল করে ওঠে। “এই লাইনটা একবার সে আমায় বলেছিল মুখে। আমি লিখিনি, কিন্তু মনে রেখেছিলাম। ভাবিনি—ও সত্যিই লিখে গেছে!”
পেছন থেকে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসে তানিয়া। বলল, “আমিও কিছু পেয়েছি।”
সবার চোখ তার দিকে ঘুরল।
তানিয়া হাতে তুলে ধরল এক টুকরো কাগজ—মোটেই কবিতা নয়, বরং একরকম চার্ট বা নকশা। তাতে লেখা—
“পথ: শিলঘর → শব্দবৃক্ষ → কূপ → পাথরের দরজা → নিরালাপাঠ”
মল্লার তখন এসে জুড়ল, “এটা কি কোনো গোপন পথের মানচিত্র?”
স্বপন বলল, “না, এটা হয়তো এক অভ্যন্তরীণ যাত্রার প্রতীক। হয়তো মীরার লেখা খুঁজে পেতে হলে আমাদের সেই পথেই হাঁটতে হবে। কূপ মানে আত্মগহ্বর, শব্দবৃক্ষ মানে আমাদের স্মৃতির উৎস।”
তানিয়া বলল, “কিন্তু ‘নিরালাপাঠ’ মানে কী?”
সুচেতা বলল, “হয়তো সেই স্থান, যেখানে লেখা আর পাঠ—দুটোই থেমে যায়, শুধুই অনুভব থাকে। নিঃশব্দে পাঠ।”
ইরা তখন বললেন, “আমি জানি শিলঘরটা কোথায়। এই বাংলোর পেছনে একটা ছোট ঘর আছে, এখন বন্ধ। বলা হয় এককালে পাহাড়ি শিক্ষক থাকতেন সেখানে, যিনি শব্দহীন শিক্ষা দিতেন শিশুদের।”
সেই মুহূর্তে, যেন আকাশে বিদ্যুৎ কাঁপল, কুয়াশার পেট ফুঁড়ে হাওয়া এসে ঢুকল বারান্দায়। শিশিটা টেবিল থেকে গড়িয়ে এসে পড়ল কাঠে—এক ফোঁটা কালি ছিটকে পড়ল তানিয়ার আঙুলে।
সে চমকে উঠল, “ইশ! লাগল…”
কিন্তু পরক্ষণে তার চোখ বড় হয়ে গেল।
“আমার চোখের সামনে একটা শব্দ ফুটে উঠছে… লেখা নয়… যেন মনে ভেসে আসছে… ‘দুয়ার খুললে শব্দ আসবে না, ফিরে যাবে সময়।’”
স্বপন বললেন, “এই কালি শুধু দেখায় না, শোনায়ও। মনের ভাষায়।”
সুচেতা চুপ করে ছিল। তার মনে হচ্ছিল, সময়ের ভাঁজ খুলছে একে একে। মীরার কবিতার খাতা, তার ডায়েরি, সেই কালির শিশি—সব যেন এক রহস্যময় রচনার সূচনা।
“আমরা কি তবে তৈরি হচ্ছি?” সে বলল।
ইরা দত্ত মাথা নাড়লেন। “তুমি তৈরি হওনি। তুমি ঢুকে পড়েছ। বাকিরা এখনও প্রান্তে দাঁড়িয়ে।”
তানিয়া বলল, “তবে চল, শিলঘরের দরজা খুলি। দেখি—যেখানে মীরা একদিন গিয়েছিলেন, আমরা তার পথে কতটা হাঁটতে পারি।”
সেই রাতে চাঁদ উঠল না। কিন্তু পাহাড়ের অন্ধকারে কোথাও এক অদৃশ্য কবিতা যেন লিখে চলেছিল নিজেকে।
পর্ব ৫: শব্দবৃক্ষের ছায়ায়
সকালের আলো ছিল দমিত, যেন কুয়াশার পর্দা একরকম গ্লানি মেখে রেখেছে শিল কালিম্পং-এর গায়ে। সুচেতা, তানিয়া, ইরা, মল্লার আর স্বপন হাঁটছিল পাহাড়ি রাস্তা ধরে, বাংলোর পেছনের দিকে, যেখানে অল্পবিস্তর গুল্ম আর ঘন বাঁশঝাড়ের ফাঁকে নাকি ছিল সেই ‘শিলঘর’—ডায়েরির মানচিত্রে যেখান থেকে যাত্রা শুরু হয়।
সুচেতার মনে হচ্ছিল, তারা কেউ আর ঠিক সেই লেখক নেই, যারা মাত্র তিনদিন আগে এসে পৌঁছেছিল এই বাংলোয়। প্রত্যেকে যেন এখন এক একটি পাতায় পরিণত হয়েছে—যেখানে নিজস্ব লেখা নেই, কিন্তু সময়ের ছাপ আছে।
ইরা বলছিলেন, “এই পথটা প্রায় কেউ ব্যবহার করে না। একসময় পাহাড়ি গাইডরা যেত জল আনার জন্য, পরে বন্ধ হয়ে যায়। আমি কয়েক বছর আগে এসেছিলাম এখানে, তখনো এদিকে কেউ আসত না।”
তানিয়া সজাগ চোখে তাকাচ্ছিল চারপাশে। তার মনে হচ্ছিল, শব্দ যেন ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাতার নিচে, ঘাসের মাথায়। তারা যেখান দিয়ে হাঁটছে, সেই পথই যেন আরোহন করে চলেছে এক ভাষাহীন গন্তব্যের দিকে।
হঠাৎ মল্লার থেমে গেল। আঙুল তুলে বলল, “ওই যে দেখছো, ওটাই শব্দবৃক্ষ।”
একটি বিশাল পুরোনো গাছ—তাকিয়ে মনে হয় ওক অথবা আলংকারিক তিস্তা-ডুমুর। তার ডালপালা নেমে এসেছে এমনভাবে, যেন শীতল ছায়ার চাদর মেলে দিয়েছে পাথরের ওপর। গাছের গায়ে খোদাই করা একরকম প্রতীক—দুটি অসমান রেখা, একটিকে ঘিরে অন্যটির প্রতিচ্ছবি।
স্বপন নিচু হয়ে দেখলেন, “এই চিহ্নটা পুরনো নেপালি ফোক শিলচিত্রের মতো। শব্দের উত্সের প্রতীক বলা যেতে পারে।”
গাছের নিচে পাথরের আসন। সাদা ধুলোর মধ্যে অর্ধেক ঢাকা একটা কাঠের বাক্স। তানিয়া ধীরে ধীরে সেটা টেনে বার করল। খুলতেই দেখা গেল কিছু পাতাহীন খাতার মলাট, কাঠের পেনসিল, আর একটা ছোট কাঁচের ঘণ্টা।
ঘণ্টা বাজাতেই যেন বাতাস স্তব্ধ হয়ে গেল। একটা মৃদু ধ্বনি—না, সেটা শুধু শব্দ ছিল না, মনে হচ্ছিল ভাষাহীন এক আশ্চর্য নৈঃশব্দ্যের কম্পন, যা শরীর নয়, আত্মায় ধাক্কা দেয়।
সেই ধ্বনি থামার পর, সুচেতা গাছের গা স্পর্শ করল। হঠাৎই যেন তার চোখের সামনে ঝাপসা একটা ছবি ভেসে উঠল—একজন নারী, সাদা শাল জড়ানো, বসে আছেন এই গাছের নিচে। চোখ বন্ধ, হাতে লেখা কাগজ, বাতাসে উড়ে যাচ্ছে। আর পাশে বসে আছে এক কিশোরী, কিছু বলছে না, শুধু শুনছে।
“আমি কিছু দেখলাম…” সুচেতা ফিসফিস করে বলল।
“আমি ওর গলা শুনতে পেলাম,” বলল তানিয়া। “সেই নারী বলছিলেন—‘তুমি যদি শব্দ খুঁজে পাও, তাকে স্পর্শ কোরো না। শুধু থাকো তার পাশে। শব্দের পাশে থাকা মানেই তাকে শ্রদ্ধা করা।’”
মল্লার বলল, “এটা কি সম্মিলিত অনুভব? নাকি শব্দবৃক্ষ শুধু স্পর্শ করলেই তার স্মৃতি খুলে যায়?”
ইরা দত্ত তখন গাছের গায়ে বসে পড়েছেন। চোখ বন্ধ করে বললেন, “মীরা একবার আমায় বলেছিল, শব্দের জন্ম হয় ছায়ায়, আলোতে নয়। কারণ ছায়াই বহন করে প্রকৃত ব্যঞ্জনা। আলো তো কেবল পৃষ্ঠ।”
স্বপন মৃদু গলায় বলেন, “এই গাছটাই হয়তো ছিল মীরার প্রথম আস্তানা এখানে। তার ডায়েরির প্রথম অংশ যেখানে লেখা হয়েছিল, যেখানে ‘সময় দ্রবীভূত হয়’। যে কালি দিয়ে সে লিখেছিল, হয়তো এখানেই তার উৎস।”
তানিয়া বলল, “আমার মনে হচ্ছে, এখানে কিছু লেখা উচিত। যেন গাছের ছায়ায় আমাদের উপস্থিতি লিপিবদ্ধ হয়।”
সুচেতা সেই বাক্স থেকে একটা পাতাহীন খাতার মলাট তুলে নিল। সেই কাঁচের শিশি থেকে কালি বের করে সে প্রথম লিখল—
“শব্দবৃক্ষের ছায়ায় আমি শুধু নীরবতা লিখি। কারণ শব্দ আমার নয়, আমি শব্দের।”
তারপর তানিয়া লিখল,
“আমি যা শুনেছি, তা বলা যায় না। কিন্তু আমি তা অনুভব করেছি। শব্দ আমার কাছে এসে বসেছে, পাশে।”
মল্লার লিখল,
“নাটক যেখানে থামে, সেখানে শব্দবৃক্ষ জন্ম নেয়। রঙ মিশে যায়, বর্ণ হয় ছায়া।”
সব শেষে স্বপন লিখলেন,
“আমি অনুবাদক, কিন্তু আজ আমি ভাষাহীন। আজ আমি শুধু সেই শব্দের কণ্ঠস্বর, যা কোনোদিন উচ্চারিত হয়নি।”
সেই পাতা গাছের গোড়ায় রেখে তারা উঠে দাঁড়াল। হাওয়ায় পাতাগুলো কেঁপে উঠল, যেন গাছ নিজে তাদের স্বীকৃতি দিল।
তারপর ইরা বললেন, “এখন চল, পরবর্তী গন্তব্য—কূপ। সময় কম। এই যাত্রা আমাদের বাইরে যেমন, তেমনি ভেতরেও। মীরার গল্প সম্পূর্ণ হওয়ার আগে হয়তো আমাদের নিজ নিজ গল্পও ফুরিয়ে যাবে। তাই এখন থামা যাবে না।”
সুচেতা একবার পেছন ফিরে দেখল। শব্দবৃক্ষের ছায়া তখনও পড়ে আছে তাদের খালি পায়ের ছায়ায়। কুয়াশা জমতে শুরু করেছে ফের। পাহাড় নিঃশব্দ। কিন্তু সেই নিরবতায় কোথাও যেন ফুটে উঠছে এক অদৃশ্য কবিতার ছন্দ।
পর্ব ৬: কূপের নীচে যে ভাষা
পাহাড়ের শরীর বেয়ে যখন তারা নিচে নামতে শুরু করল, তখন বেলা প্রায় পড়ন্ত। শব্দবৃক্ষের ছায়া পেছনে পড়ে রইল, কিন্তু তার ভার যেন সঙ্গী হয়ে উঠল। ইরা দত্ত হাঁটছিলেন সামনের দিকে, হাতে মীরার কবিতার পাতাগুলো। বাকিরা নিঃশব্দে অনুসরণ করছিলেন, যেন কোনও গূঢ় অনুশীলনের অন্তর্গত পথে এগিয়ে চলেছে একাধিক আত্মা।
পাহাড়ি ঘাসের মধ্যে হঠাৎ ছোট একটা রাস্তা দেখা গেল, প্রায় গাছের শিকড়ে ঢাকা। ইরাই প্রথম বললেন, “এই পথটাই যায় সেই কূপের দিকে। অনেক পুরোনো, কিন্তু কখনো শুকায় না। জল দেখা যায় না, শুধু শব্দ শোনা যায়।”
তানিয়া অবাক চোখে তাকাল, “শব্দ শোনা যায় মানে?”
ইরা বললেন, “কূপটা জীবন্ত নয়, স্মৃতিতে ভরা। তুমি যে শব্দ কখনো উচ্চারণ করোনি, যা মনে গেঁথে ছিল অথচ ভাষা পায়নি—তা-ই নাকি শোনা যায় এই কূপে।”
সুচেতার মনে হলো, এ যেন এক আত্মার গভীরে নেমে পড়া। তার নিজের ভেতরে এমন কত অর্ধেক শব্দ আছে—যা বলা হয়নি, লেখা হয়নি, শুধু অনুভবেই কেটেছে।
কিছুক্ষণ পর তারা পৌঁছল এক খোলা জায়গায়। ঘন ঝোপঝাড়ের ভেতরে চওড়া এক পাথরের বৃত্ত, তার মাঝখানে অন্ধকারে ডোবা একটা কূপ। জল দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু কুয়াশা যেন ধোঁয়ার মতো উঠছে।
কূপের ধার ঘেঁষে একটা পাথরের ফলকে লেখা কিছু চিহ্ন—এটা কোনও ভাষা নয়, যেন বর্ণের আকারহীন ছায়া। সুচেতা হাঁটু গেড়ে বসে বলল, “এগুলো কি মীরার লেখা?”
ইরা বললেন, “না, এগুলো মীরা বলত—‘পূর্ব-ভাষা’। এমন এক ভাষা যা মানুষ উচ্চারণ করার আগেই অনুভব করে। প্রতিটি শব্দ আসলে তার একটি ছায়া মাত্র।”
মল্লার বলল, “তাহলে এই কূপ কি সেই ছায়ার উৎস?”
স্বপন বললেন, “হয়তো। আমি অনেক পুরোনো বৌদ্ধ অনুশীলনে পড়েছি, যেখানে ধ্বনি নয়, নিঃশ্বাসই ছিল প্রার্থনার মাধ্যম। শব্দ আসত না, শুধু তার প্রতীক্ষা।”
সুচেতা কূপের ধারে গিয়ে বসল। কুয়াশা তার চুলে মেখে থাকল। সে চোখ বন্ধ করল। কিছু না বলেও যেন ভিতর থেকে এক ধরনের ছন্দ উঠে আসছিল।
হঠাৎ সে শুনতে পেল—একটা শব্দ। না, শব্দ নয়—একটা অনুভূতির ঢেউ। যেন কেউ বলছে,
“তুমি যাকে ভয় পাও, সেই শব্দই তোমার প্রকৃত ভাষা।”
সে চমকে চোখ খুলল। চারপাশে কুয়াশা ঘনীভূত, কিন্তু বাকিরা যেন স্তব্ধতার এক প্রতিমা হয়ে দাঁড়িয়ে।
তানিয়া ফিসফিস করে বলল, “আমি আমার বাবার গলা শুনেছি… আমি যেটা কখনো বলিনি তাঁকে… সে বলছিল, ‘তুমি কি আজও সেই প্রথম কবিতাটা লুকিয়ে রেখেছো?’”
মল্লার বলল, “আমিও… আমি শুনেছি আমার সেই ছাত্রের কণ্ঠস্বর… যে একবার বলেছিল, ‘আপনি তো আমার কথা লেখেন না।’ আমি লিখিনি। সেই অপরাধ ফিরে এলো শব্দে।”
স্বপন বললেন, “আমার মাথায় শুধু একটা অক্ষরের মতো দৃশ্য ঘুরে বেড়াচ্ছে… কিন্তু তার উচ্চারণ নেই। শুধু আমি জানি, ওটা আমার মায়ের মুখে শেষ দেখা হাসির ছায়া।”
ইরা তখন চোখ বন্ধ করে বললেন, “তোমরা বুঝছো তো, এই কূপে জল নেই, ভাষা আছে। এবং সেই ভাষা শুধুই তোমার নিজস্ব। কেউ পড়তে পারে না, কেউ লিখতে পারে না, শুধুই অনুভব করা যায়।”
সুচেতা চুপ করে ছিল। তারপর সে নিজের খাতা বের করল। সেই সূর্যকালি দিয়ে একটা লাইন লিখল—
“যে ভাষা আমি উচ্চারণ করিনি, আজ সে আমার কাছে এসে বসেছে।”
কাগজে কিছু দেখা গেল না। সে কূপের ধারে কাগজটা ধরে রাখল। কুয়াশা এসে বসে গেল পাতার গায়ে, আর অদ্ভুতভাবে সেই অদৃশ্য অক্ষর ফুটে উঠল বেগুনি রঙে।
তানিয়া অবাক হয়ে বলল, “এই ভাষা কেবল তোমার নয়, এটা যেন আমাদের সবার। আমাদের না-বলা কথার সংহতি।”
ইরা বললেন, “এই জায়গা সেই নিরালাপাঠের পূর্বসূচনা। যেখানে পড়া হয় না চোখে, শোনা হয় না কানে, কিন্তু লেখা হয় হৃদয়ে।”
মল্লার বলল, “আমাদের কি সেই পাথরের দরজার পথেই এগোতে হবে এখন?”
স্বপন মাথা নোয়ালেন, “হ্যাঁ। কিন্তু এবার থেকে আমাদের প্রত্যেকের হাতে শুধু খাতা থাকবে না—থাকবে নিজস্ব না-বলা কথার ভার। এই কূপ যাকে ছুঁয়েছে, সে আর আগের মতো কথা বলতে পারে না। এখন তার প্রত্যেকটি বাক্য হয়ে উঠবে প্রতিশ্রুতি।”
সুচেতা পেছনে তাকাল। কূপের ধারে তাদের রেখে যাওয়া কাগজগুলো বাতাসে দুলছে। না, উড়ছে না। কারণ তারা এখন আর কেবল কাগজ নয়, তারা হয়ে উঠেছে স্মৃতির ছাপচিত্র—যেখানে লেখা হয় না, ধরা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়।
পর্ব ৭: পাথরের দরজা
পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামতে নামতে চারপাশটা বদলে যাচ্ছিল—পাতার রঙ, হাওয়ার স্বর, এমনকি আলোর চরিত্রও। একরকম ধূসর আলো, সূর্যের নয়, যেন মাটির ভিতর থেকে উঠে আসা কোনো স্মৃতির জ্যোতি। তারা পাঁচজন—সুচেতা, তানিয়া, মল্লার, স্বপন ও ইরা—চুপচাপ এগিয়ে চলেছে। কূপের স্তব্ধতা এখনও সঙ্গী, কিন্তু এবার একটা অদ্ভুত টান অনুভব করছিল সকলে—যেন সামনে কিছু অপেক্ষা করছে, যা শব্দ নয়, চিত্র নয়, বরং অস্তিত্ব।
ইরা বারবার পেছন ফিরে তাকাচ্ছিলেন। কুয়াশা যেন পিছনে পথকে গিলে নিচ্ছে। তানিয়া মৃদু গলায় বলল, “এখন কি আমরা ফিরে যেতে পারব?”
ইরা থেমে বললেন, “ফেরা বলে কিছু নেই এই পথে। একবার যারা শব্দের ছায়া দেখেছে, তারা আর পূর্বজন্মে ফেরে না। এখন আমরা সময়ের গভীরে হাঁটছি, সেখানে পথ কেবল সামনে খোলে।”
মল্লার হেসে বলল, “মানে এইটা অলৌকিক ট্রেকিং ট্যুর!”
কেউ হাসল না। কারণ, সত্যিই, তারা আর বাইরে ছিল না।
কিছুদূর এগোতেই দেখা গেল পাহাড়ের ঢালে এক অদ্ভুত গঠন—দুই পাশ থেকে উঠে আসা পাথরের প্রাকৃতিক দেয়াল, মাঝে একটা ফাঁকা, আড়াআড়ি দাঁড়িয়ে থাকা পাথরের দরজা। ঠিক দরজা নয়, বলা যায় একপ্রকার প্রবেশপথ—কিন্তু তাতে কোনো খিল, চৌকাঠ, বা দরজার পাট নেই। শুধু একটি সিল্যুয়েট, যেন কেউ একসময় এখানে দাঁড়িয়ে ছিল, তারই ছায়া চিরকালীন হয়ে আছে।
সুচেতা বলল, “এটাই সেই পাথরের দরজা?”
স্বপন মাথা নাড়লেন, “হ্যাঁ। অনেক পাহাড়ি লোক এই জায়গাটিকে ‘ভাষাপথ’ বলে চেনে। অনেকে বলে, এখানে দাঁড়ালে নিজের হারিয়ে যাওয়া বাক্য ফেরত আসে।”
তানিয়া একটু ভয় পেয়ে বলল, “কিন্তু যদি আমি এমন কিছু শুনি, যা আমি শুনতে চাই না?”
ইরা শান্ত স্বরে বললেন, “তবে শুনবে না। এই দরজা কারও ওপর কিছু চাপিয়ে দেয় না। শুধু যাকে সত্যিই দরকার, তাকে ফেরায়। আর বাকিদের চুপ করে থাকার অনুমতি দেয়।”
তারা একে একে গিয়ে দাঁড়াল সেই দরজার মুখে। দরজার গায়ে খোদাই করা কিছু শব্দ দেখল সুচেতা, যেগুলো এতদিন কোথাও লেখেনি সে—তবু যেন তার মনেরই কথা। লেখা ছিল—
“তুমি যা লিখতে চাওনি, সেইটিই তোমার সত্যিকারের লেখা।”
সুচেতার চোখ ভিজে উঠল। তার মনে পড়ল সেই এক বিকেল, কলকাতার চায়ের দোকানে বসে সে একটি কবিতা লিখতে গিয়ে ভেঙে ফেলেছিল কলম—কারণ, কবিতাটা প্রেম নিয়ে ছিল, এবং সে সেই প্রেম স্বীকার করতে চায়নি।
তানিয়া এগিয়ে এসে দরজার ফাঁকে দাঁড়াল। হঠাৎ চোখ বড় হয়ে গেল তার। “আমি একটা ছবি দেখতে পাচ্ছি,” সে বলল, “একটা পুড়ে যাওয়া খাতার পাতা, তার মধ্যে একটা লাইন স্পষ্ট—‘আমি যে গল্প লিখিনি, সে-ই আমাকে লিখে ফেলেছে।’”
মল্লার বলল, “এটা তো আমার নাটকের শেষ দৃশ্য! যেটা আমি কাটিয়ে দিয়েছিলাম, কারণ সেটা নাকি দর্শকের মনোজগৎ বুঝবে না।”
স্বপন বললেন, “এই দরজা কোনো বস্তু নয়। এটা প্রতিফলন। তুমি যেটাকে চাপা দিয়েছো, সেটা ফিরিয়ে দেয়।”
ইরা এবার ধীরে পা বাড়ালেন দরজার দিকে। কেউ জানে না তিনি কী দেখলেন, তবে তাঁর চোখ থেকে দুটো অশ্রু গড়িয়ে পড়ল, নিঃশব্দে।
তিনি বললেন, “আমি মীরাকে দেখেছি। সে বলছিল, ‘আমি আমার শেষ কবিতাটা এখানে রেখেছি। তবে সেটা শুধুমাত্র সেই ব্যক্তি পড়তে পারবে, যে নিজেকে লেখার থেকে কম মনে করে। যে নিজেকে ‘লেখক’ ভাবে না, শুধু একজন শ্রোতা ভাবে।’”
সুচেতা বলল, “তাহলে কি আমাদের সেই শেষ গন্তব্যে—‘নিরালাপাঠ’-এ যাওয়ার আগে দরজার এই অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে নিয়ে যেতে হবে?”
ইরা বললেন, “না, এটা কোনও অভিজ্ঞতা নয়। এটা হচ্ছে পরিত্যাগ। নিজের সেই সমস্ত পঙক্তি ফেলে যাওয়ার সময়, যেগুলো তুমি গোপন করেছিলে। যেন তুমি খালি হাতে ঢুকতে পারো নিরালাপাঠে।”
তানিয়া একটা পাতায় লিখল—
“আমি যে মাকে ভালোবাসি, সেটা আমি কখনও বলিনি। কারণ শব্দ সেখানে ব্যর্থ হয়ে যেত। আমি আজ সেই ব্যর্থতাটাকেই রেখে গেলাম এই দরজার সামনে।”
মল্লার লিখল—
“আমি নাটকে কেবল অন্যদের গল্প বলেছি। নিজেরটা কখনও বলিনি। আজ প্রথম স্বীকার করলাম, আমি একবার মঞ্চে কাঁদতে গিয়ে সত্যিই কেঁদেছিলাম। নাটক ছিল না, সেই ছিল আমার প্রথম স্বীকারোক্তি।”
স্বপন লিখলেন—
“অনুবাদ করতে করতে আমার নিজের ভাষা হারিয়ে গিয়েছিল। আজ এই দরজার সামনে এসে বুঝলাম, হারিয়ে যাওয়া ভাষাও ফিরে আসে, যদি কেউ মন দিয়ে শুনে।”
সুচেতা লিখল না। সে শুধু দরজার দিকে তাকিয়ে ছিল, আর মনের ভিতরে বলছিল—
“আমি প্রস্তুত। আমি আর লেখক হতে চাই না। আমি শুধু শব্দের পথিক হতে চাই। যেন মীরার শেষ কবিতাটা আমায় ছুঁয়ে যেতে পারে।”
দরজার ওপারে তারা পা রাখল। পেছনে রয়ে গেল কিছু না-বলা কথার পাতা, কিছু অশ্রু, কিছু ছায়া, আর একটা দরজা—যা আসলে পথ, আর যা অতিক্রম করার মানে, ফিরে না যাওয়া।
পর্ব ৮: নিরালাপাঠ
পাথরের দরজা পেরোতেই বাতাসের চরিত্র বদলে গেল। এখানে শব্দ ছিল না, এমনকি ঝিঁঝিঁর ডাকও থেমে গিয়েছিল, পাখির পাখা ঝাপটানোর আওয়াজও না। যেন প্রকৃতি নিজেই নিঃশব্দে ধ্যানস্থ। পায়ের নিচে শুকনো পাতাও নড়ত না, পাথর এতটাই শান্ত যে মনে হতো, তারা কোনো এক অনন্ত নিঃশ্বাসে নিমগ্ন।
তানিয়া প্রথম বলল, “এখানে কেউ যেন চোখ বেঁধে দিয়েছে আমার মনের।”
সুচেতা উত্তর দিল না। সে এখন আর শব্দ খুঁজছিল না—শব্দ যেন তার থেকে নিজেই সরে যাচ্ছিল।
এমন এক সমতল জায়গায় এসে তারা দাঁড়াল, যেখানে ছোট একটা পাথরের চাতাল—চৌকোনা, মাটি থেকে সামান্য উঁচু। চারদিকটা ঘিরে রাখা ক্ষুদ্র পাথরের স্তম্ভ, যেন একটা ছায়ামণ্ডল। আর চাতালের কেন্দ্রে একটা সাদা বালির বৃত্ত—তার মাঝখানে একটি চিরুনির মতো কাঠের বস্তু। ইরা বললেন, “এই জায়গাটাকেই বলা হয় ‘নিরালাপাঠ’। এখানে বসে কেউ কিছু পড়ে না, কেউ কিছু লেখেও না। এখানে শুধু থাকা হয়।”
মল্লার ফিসফিস করে বলল, “কিন্তু এইরকম স্থিরতা কি সহ্য হয়? আমি যেন আমার মনের শব্দ শুনতে পাচ্ছি এত জোরে, যেন তারা আমাকে ধাক্কা দিচ্ছে।”
ইরা বললেন, “তাই তো এটা পাঠ। লেখারও পাঠ, পঠনেরও নয়—নিজেকে একেবারে শব্দবর্জিত করে ফেলা, যতক্ষণ না তুমি নিজেকে লেখার উপযুক্ত মনে করো। শুধু তখনই তুমি শুনতে পারবে সেই শেষ কবিতা। যেটা মীরা রেখে গিয়েছিল।”
তারা চুপ করে বসল চারপাশে। কেউ চোখ বন্ধ করল, কেউ দৃষ্টিহীন চেয়ে রইল দূরে।
তানিয়ার মনে হচ্ছিল, তার বুকের ভেতরে অন্ধকারে কেউ একটা পাথর নামিয়ে দিচ্ছে বারবার, আবার তুলছে। যেন কোনো চাপ নেই, অথচ ভারী হয়ে উঠছে সমস্ত শরীর।
সুচেতা চোখ বন্ধ করতেই দেখতে পেল সেই ছোট্ট বালকবেলায় শোবার ঘরের কোণে বসে থাকা নিজেকে—দেয়ালের পাশে, হাতে একটা খাতা, আর মা বলছেন, “তুমি তো আর লেখা শিখোনি, কী লিখবে?” সে মিথ্যে বলেছিল—“না, আমি কিছু লিখছি না।” অথচ সে লিখছিল। তার জীবনের প্রথম কবিতা—যেটা সে কাউকে কখনও দেখায়নি।
আজ এত বছর পর, সেই কবিতার লাইন যেন তার কানে ফিসফিসিয়ে উঠল।
“আমার চুপ থাকা মানেই লেখা নয়
আমার চুপ থাকা মানেই ভাষা।”
সে চোখ খুলে চমকে উঠল। কারণ সে অনুভব করছিল—মীরার ভাষা তার ভিতর দিয়ে বইছে। যেন মীরা সেই কবিতাটাই শুরু করেছিল যা সুচেতা আজ শেষ করতে পারবে।
মল্লার তখন বলল, “আমি বুঝতে পারছি—আমার লেখা কখনই আমার ছিল না। আমি আসলে নাটককে বলি, ‘তুমি বলো, আমি লিখে দিই।’”
স্বপন বললেন, “আজ এখানে বসে আমি বুঝলাম, আমি যত অনুবাদ করেছি, তার মধ্যে আমার নিজের কণ্ঠ হারিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু এখানেই প্রথমবার, আমি নিজেই নিজের ভাষায় কিছু শুনছি। আমার নিজের ভিতরের অনুবাদ।”
ইরা দত্ত কণ্ঠ নীচু করে বললেন, “মীরা বলত, ‘নিরালাপাঠে কেউ আসে না লেখক হয়ে। আসে পাঠক হয়ে, আর ফিরে যায় এক শূন্য লেখায়।’ আমি প্রথম এই জায়গায় বসে বুঝেছিলাম, আমি যা লিখি তা শুধু প্রকাশের জন্য নয়, হারানোর জন্যও।”
তানিয়া হঠাৎ একরাশ শ্বাস নিয়ে বলল, “আমার ভিতরের গল্পগুলো নিজেই আমাকে বলছে—‘তুমি আর পালাতে পারবে না। তুমি আমাদের লিখতে হবে।’”
সুচেতা ধীরে ধীরে সেই চত্বরের মাঝখানে গিয়ে বসল। খালি বালির বৃত্তের কেন্দ্রস্থলে বসে সে চোখ বন্ধ করল। বাতাস তার চুলে, আঙুলে, হৃদয়ে নেমে এলো। তারপর সে বলল, নিঃশব্দে, ঠোঁট নাড়ালেও শব্দ উচ্চারিত হল না—
“আমি প্রস্তুত, মীরা। যদি তুমি আমার ভিতর দিয়ে শেষ করতে চাও তোমার কবিতা, আমি হবো সেই অবয়ব। আমি তোমার শেষ লাইন।”
ঠিক তখনই বাতাসে একটা বদল হল। বালির ওপরে লেখা হল এক লাইন—কারও হাতে নয়, যেন বাতাস নিজেই লিখে দিল।
“আমি যেখানেই থেমে গিয়েছিলাম, তুমি সেখান থেকেই শুরু করো।”
তারা সবাই দৌড়ে এসে দেখল সেই লেখা। কেউ কিছু বলল না। শুধু মনের গভীর কোথাও যেন জানল, মীরার কবিতা এখনও শেষ হয়নি। সে চলবে, বহমান থাকবে নতুন কণ্ঠে, নতুন লেখায়।
সুচেতা সেই বৃত্তে বসে রইল। বাকিরা ধীরে ধীরে দূরে সরে গেল, যেন তাকে তার ভাষা নিজে আবিষ্কার করতে দেয়।
সূর্য তখন নেমে আসছে পাহাড়ের কোলে। নিরালাপাঠের আকাশে এক অদ্ভুত স্নিগ্ধতা। শিল কালিম্পং-এর সেই পুরোনো বাংলো এখন আর শুধু কাঠ ও জানালার গড়া নয়। সে এখন শব্দের এক নিঃশব্দ মন্দির।
পর্ব ৯: শেষ কবিতার খোঁজে
নিরালাপাঠের বালিতে বসে সুচেতার মনে হচ্ছিল—সে যেন আর শরীরে নেই। তার চারপাশে কোনও দৃশ্য নেই, কোনো শব্দ নেই, কেবল একটা অনন্ত স্পর্শ, একটা ভাষাহীন আদ্রতা। সে জানত না কতক্ষণ বসে আছে, শুধু অনুভব করছিল—একটা অদৃশ্য উপস্থিতি তার ভিতরে ক্রমশ প্রবেশ করছে, যেন সে নিজেই আর ‘সে’ নয়—সে হয়ে উঠছে একজন ‘লেখা।’
আকাশ তখন গাঢ় হয়ে এসেছে। পাহাড়ের ছায়া গড়িয়ে পড়ছে পাতার গায়ে, বাতাসে এসে জড়িয়ে আছে অজানা গন্ধ। এই সব কিছু যেন মুখে বলে না, কানে শোনায় না—শুধু ভেতরে একটা কাঁপুনি ফেলে রেখে যায়।
তানিয়া, মল্লার, স্বপন আর ইরা তখন দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিল সুচেতাকে। কেউ কিছু বলছিল না। কারণ সবাই বুঝেছিল—শেষ কবিতার দরজা এই মুহূর্তে কেবল সুচেতার জন্য খোলা। এই পথ তারা চলেছে একসঙ্গে, কিন্তু শেষ বাক্য—তা শুধুই একার।
ইরার চোখে একরাশ বিস্ময় আর শ্রদ্ধা। তিনি ফিসফিস করে বললেন, “এমন অনেকেই এসেছেন এই নিরালাপাঠে, কিন্তু কেউ শেষ কবিতার ছায়াটুকুও খুঁজে পাননি। সুচেতা পাচ্ছে—কারণ ও নিজেকে কবি ভাবেনি, ভাবেনি লেখকও। শুধু শ্রোতা হয়ে এসেছিল, নিজের ভিতরের নিঃশব্দতা শুনতে।”
সুচেতা হঠাৎ চোখ খুলল। তার পাথরের মতো নির্লিপ্ত মুখে জেগে উঠল হালকা আলো। সে দাঁড়াল না, উঠে আসেনি হাঁটু গেড়ে বসা অবস্থা থেকে। শুধু তার ঠোঁট থেকে নিঃশব্দে বেরোল কয়েকটি শব্দ—
“আমি দেখেছি তাকে। মীরাকে।”
তানিয়া এগিয়ে এল, “কোথায়?”
“আমার ভিতরে,” সুচেতা বলল, “আমি নয়নে নয়, শব্দে নয়—আমি অনুভবে তাকে দেখেছি। সে লিখছিল। তার শেষ কবিতাটা। এবং…”
সবাই অপেক্ষা করছিল।
সুচেতা বলল, “সে থেমে গিয়েছিল। কারণ সে জানত, শেষ পঙ্ক্তিটি তার একার নয়। কেউ একজন এসে লিখবে, যিনি তাকে আত্মস্থ করবেন। আমি তার খোঁজ পাইনি। বরং সে আমাকে খুঁজেছে।”
মল্লার অবাক হয়ে বলল, “তুমি কি জানো শেষ কবিতাটার পঙ্ক্তিগুলো কী ছিল?”
সুচেতা বলল, “জানি না। কারণ ওটা কোনও পৃষ্ঠা নয়, কোনও খাতাও নয়। সেটা একটা যাত্রা। প্রতিটি যাত্রাপথের শেষে একটা শব্দ থাকে, যেটা উচ্চারণ করলে কবিতা শেষ হয়। সেই শব্দটিই ওর শেষ কবিতা।”
স্বপন বললেন, “তাহলে আমরা কি পুরো কবিতাটা লিখব না?”
ইরা মৃদু স্বরে বললেন, “না। আমরা শুধু শব্দটা খুঁজব। সেই এক শব্দ, যা মীরাকে সমাপ্ত করবে, আবার সুচেতাকে শুরু করবে।”
সুচেতা বলল, “আমার মনে হচ্ছে শব্দটা এখানেই কোথাও আছে। এই পাহাড়, এই বাতাস, এই নীরবতায় লুকিয়ে আছে। শুধু শুনতে হবে খুব গভীর করে।”
তারা সবাই নিরালাপাঠের কেন্দ্রে ফিরে এল। সেই বালির বৃত্তে সূর্যের শেষ রশ্মি এসে পড়েছে। হঠাৎই পাথরের চাতালের উপর একটা বর্ণ জ্বলে উঠল—না, কোনও চেনা অক্ষর নয়, কোনও ভাষার হরফ নয়। একটা প্রতীক। যেন দুই রেখার মাঝে লুকিয়ে থাকা অনন্ত।
তানিয়া ধীরে বলে উঠল, “এটা কি সেই শব্দ?”
ইরা বললেন, “না। এটা সেই শব্দের প্রতিচ্ছবি। নিজেকে হারিয়ে দিতে হলে প্রথমে তার প্রতিচ্ছবিতে দাঁড়াতে হয়। তারপর তবেই আসল উচ্চারণ হয়।”
সুচেতা চোখ বন্ধ করল। তার মনে হতে লাগল, ছোটবেলার সেই বিকেলগুলো ফিরে আসছে। মা পাশে বসে গল্প বলতেন, সে চুপ করে শুনত। কখনও কিছু বলত না, শুধু মনে রাখত। তারপর একদিন মা চলে গেলেন। আর সে জানত, যা বলা হয়নি, সেটাই আসল গল্প ছিল।
সে মনে মনে বলল,
“মীরা, আমি প্রস্তুত। যদি এই শব্দ সত্যিই আছে, যদি তুমি আমার ভিতর দিয়ে সেটা প্রকাশ করতে চাও, তবে আমাকে ব্যবহার করো।”
ঠিক তখনই, বাতাস থমকে গেল। যেন সময় থেমে গিয়েছে কয়েক মুহূর্তের জন্য। তারপর সেই প্রতীকের মাঝখানে, বালিতে, একেবারে সূর্যের শেষ আলোয়, ফুটে উঠল সেই শব্দ—
“নিভৃতি”
তানিয়া কাঁপা গলায় বলল, “এর মানে কি?”
সুচেতা ধীরে বলে উঠল, “নিভৃতি মানে… আলো নিভে যাওয়ার পরে যে স্থিরতা আসে, শব্দ থেমে যাওয়ার পরে যে অনুরণন, লেখা শেষ হওয়ার পরে যে শ্বাস ফেলা… সেটাই শেষ কবিতা।”
ইরা তখন বললেন, “তুমি সেই শব্দ পেয়ে গেছো, সুচেতা। তুমি হয়ে উঠেছো মীরার শেষ কবিতার পঙ্ক্তি।”
পাহাড় তখন গাঢ় নীল। পাখিরা নিঃশব্দে ফিরে যাচ্ছে বাসায়। বাতাসে শুধু একটিমাত্র শব্দ ভাসছে—
নিভৃতি।
পর্ব ১০: যে গল্প লেখা হলো না
রাত ঘনিয়ে এসেছিল শিল কালিম্পং-এর পাহাড়ঘেরা সেই নিরালাপাঠে। পাখিদের দল গাছে ফিরে গেছে, দূরের কুয়াশা আর নীরব পাহাড় যেন একটি গভীর মৌনতার পর্দা টেনে দিয়েছে চারপাশে। মীরার শেষ শব্দ—”নিভৃতি”—সেই বালির বৃত্তে এখনও স্থির হয়ে জ্বলছে, যদিও বাতাসে আলো নেই, আর সূর্য অস্ত গেছে বহুক্ষণ আগেই।
সুচেতা সেই প্রতীকটার দিকে তাকিয়ে বসে ছিল। তার মুখে কোনও অভিব্যক্তি নেই, চোখে জেগে আছে একরাশ দূরত্ব, যেন তার দৃষ্টি এখন আর বাইরের কোনও দৃশ্যের নয়—পুরোটাই ভিতরের এক অদৃশ্য জগতের দিকে।
মল্লার, তানিয়া, স্বপন ও ইরা তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল, কেউ কিছু বলছিল না। যেন তারা বুঝে গিয়েছে—এই মুহূর্তটা শুধুই সুচেতার, অথবা বলা ভালো, সেই ‘না-লেখা গল্প’-এর।
সুচেতা হঠাৎ বলল, “আমরা লেখক বলেই হয়তো সব গল্প লিখে ফেলতে পারি না। কিছু গল্প থাকে, যা শুধু টের পাওয়া যায়। তারা কখনও শব্দ চায় না। তাদের শুধু মনে রাখতে হয়, ঠিক যেন চোখ বন্ধ করে সিঁড়ি ভাঙা।”
স্বপন মৃদু স্বরে বললেন, “তোমার কি মনে হয় এই যাত্রা আমাদের প্রত্যেকের জন্য ছিল? নাকি শুধু তোমার?”
সুচেতা চুপ করল কিছুক্ষণ। তারপর মাথা নাড়িয়ে বলল, “এটা প্রত্যেকের যাত্রা ছিল। শুধু আমরা সবাই পৌঁছলাম আলাদা সময়ে, আলাদা পথে। কেউ শব্দ খুঁজল, কেউ হারানো ভাষা, কেউ নিজের না-বলা কথা। আমি পেয়েছি একটা কবিতা। কিন্তু সেটা আসলে আমার নয়। আমি শুধু শেষ পঙ্ক্তিটা লিখেছি। বাকি কবিতা ছিল মীরার, আর তার আগে—এই পাহাড়ের, এই নীরবতার।”
তানিয়া ধীরে বসে পড়ল সুচেতার পাশে। বলল, “তুমি কি জানো মীরা কেন শেষ কবিতাটির মাঝে থেমে গিয়েছিলেন?”
সুচেতা একটু ভেবে বলল, “হয়তো তিনি বুঝেছিলেন, কোনও কোনও লেখা শেষ হতে হয় না। শেষ হয়ে গেলেই সে মাটির হয়ে যায়। জীবন্ত থাকে না। তাই তিনি লেখাটা অপূর্ণ রেখে গিয়েছিলেন। যেন কেউ এসে সেটা টের পায়, নিজের ভাষায় না, অনুভবে।”
ইরা এবার বললেন, “তোমাদের কেউ কি জানো, মীরার মৃত্যুর খবর কোথাও ছাপা হয়নি? কেউ জানতও না সে কখন নিখোঁজ হল। আমি কেবল তার সেই শেষ চিঠিটা পেয়েছিলাম—‘আমি যাচ্ছি শব্দের বাইরে, যেখানে ভাষাও থেমে যায়। যদি কখনও কেউ চুপ থাকা শিখে ফেলে, সে আমাকে খুঁজে পাবে।’”
মল্লার অবাক হয়ে বলল, “তাহলে আমরা… মানে, সুচেতা… সেই মানুষ?”
ইরা হাসলেন, “সুচেতা চুপ থাকতে শিখেছিল বলেই আজ সে শব্দ পেয়েছে। আমরা বাকিরা শুধু তার পাশে হাঁটতে পেরেছি।”
সুচেতা এবার নিজের খাতা খুলে শেষ পৃষ্ঠায় লিখল—
“এই গল্প আমি লিখিনি। এই গল্প আমাকে লিখেছে। আমি শুধু শেষ পঙ্ক্তিটা হয়ে থেকেছি। আমার নাম না থাকলেও, আমার নীরবতা থাকবে।”
তারপর সে উঠে দাঁড়াল, সেই বালির বৃত্তে লেখা ‘নিভৃতি’ শব্দটির দিকে তাকিয়ে বলল, “এটাই ছিল মীরার শেষ কবিতা। কিন্তু আজ থেকে এটা আমারও প্রথম গল্প। যে গল্প আমি লিখিনি, শুধু অনুভব করেছি। এই অনুভবই তো আসল লেখার শুরু।”
তানিয়া বলল, “আমরা কি এখান থেকে ফিরে যাব? নাকি এখানেই থেকে যাব?”
ইরা বললেন, “ফেরা বলতে কিছু নেই। ফিরে যাওয়ার পথ নেই, কারণ আমরা আর আগের মানুষ নই। এই রেসিডেন্সিয়াল যেমন শব্দ নিয়ে শুরু হয়েছিল, এখন শেষ হল নীরবতায়। শিল কালিম্পং আমাদের প্রত্যেককে নতুন করে লিখে দিয়েছে।”
মল্লার, স্বপন, তানিয়া—তিনজনেই যেন বুঝে গেল, ফিরে গেলেও, তারা আর সেই মানুষ থাকবে না, যারা প্রথমদিন এসেছিল কাঠের সেই বাংলোয়, পায়ের নিচে শব্দ করা মেঝে পেরিয়ে যার যার ঘরে ঢুকেছিল।
সুচেতা বলল, “আমরা এই পাহাড়ে আসিনি গল্প লেখার জন্য। এসেছিলাম গল্প শোনার জন্য। যে গল্প লেখা হয়নি, হয়তো হবেও না। কিন্তু তার অস্তিত্বই আমাদের ভিতরের লেখককে প্রশ্ন করেছে। সেটাই যথেষ্ট।”
একটি পাতা উড়ে এসে পড়ল পাথরের উপর। কে জানে কোথা থেকে। কেউ লিখেনি পাতাটায় কিছু। কিন্তু সবাই অনুভব করল, সেটিই আসল পাতাটি—যেটা না-লিখেও লেখা।
তারা ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করল ফিরে যাওয়ার দিকে। শব্দ ফিরে এল ধীরে ধীরে—পাতার নড়াচড়া, পায়ের আওয়াজ, দূরের ঝরনার সুর। যেন পাহাড় বলল, “তোমরা শোনো পেরেছো, এখন আবার লিখতে পারো।”
কিন্তু তাদের সবার ভেতরে একটা গল্প থেকে গেল।
যে লেখা হয়নি, তবু ছিল।
যে বলা হয়নি, তবু গলা জুড়ে ছিল।
যে গল্প লেখা হলো না—তবু পাঠক পেয়ে গেল।
শেষ




