অসিত মল্লিক
১
শীতের প্রান্তে পৌঁছানো কলকাতা শহর একটু বেশিই নীরব হয়ে পড়ে ভোরের দিকে, বিশেষ করে উত্তর কলকাতার পুরনো লেনে—যেখানে দিনের বেলা হইচই করলেও, রাত গড়ালে শুধু হাওয়ার শব্দ আর পুরনো ঘরদোরের কঁকিয়ে ওঠা শোনা যায়। ঠিক তেমনই এক গলির শেষে দাঁড়িয়ে আছে মিত্র পরিবারের ঠাকুরবাড়ি—এককালে কলকাতার সমাজে যাদের নাম ছিল অতিশয় সম্মানের। আজ সেই বাড়ির দেওয়ালে স্যাঁতসেঁতে ছোপ, কার্নিশে কাকের বাসা, আর বন্ধ জানালার ফাঁকে ধুলোমাখা আলো ঢোকে। এই বাড়িতেই ফেরেন বিপ্রতীক মিত্র, বছর দশেক বিদেশে থাকার পর। শহরের সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে এক আন্তর্জাতিক হেরিটেজ প্রকল্পের অংশ হিসেবে ফিরে এসে সিদ্ধান্ত নেন, ঠাকুরদার রেখে যাওয়া এই ভাঙাচোরা বাড়িটাই তাঁর বাসস্থান হবে—কিছুটা আবেগ, কিছুটা নস্টালজিয়া, কিছুটা নিজের শিকড়ে ফিরে আসার চেষ্টা। দিন কাটে কাঠের জানালায় পলিশ, পুরনো বইয়ের ধুলো ঝাড়া, আর সন্ধ্যাবেলা বেলগাছানার মোড়ে চা খাওয়ার মধ্যেই। কিন্তু সবকিছু পালটে যায়, যখন এক রাতে, হঠাৎ করেই, ঠিক ৩টে বেজে ৩৩ মিনিটে দরজায় ঠকঠক শব্দ হয়। প্রথমে ভেবেছিলেন, হয়তো পাড়া কুকুর বা বাতাসে দুলে ওঠা কাঠের দরজা—তাই অবহেলা করেন। কিন্তু পরের রাতেও, আর তার পরের রাতেও, এক অদ্ভুত নিয়মে সেই দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ ঠিক সেই সময়েই ফিরে আসে। দরজা খুলে দেখেন, বাইরের নিঃস্তব্ধতা ছাড়া কিছুই নেই—না কোনো পদচিহ্ন, না বাতাসে কোনো হালকা দুলুনি।
তবে সবচেয়ে অস্বস্তিকর ঘটনাটা শুরু হয় তার পর থেকেই। দরজার সেই আওয়াজ থামার কিছু মুহূর্ত পরেই, ঘরের ভেতরে শুরু হয় কিছু একটার কান্না—একটি নারীকণ্ঠ, যেটা চিৎকার নয়, বরং দমবন্ধ করা দীর্ঘশ্বাসের মতো ভেসে আসে ঘরের চারপাশে। সেই কান্নার ফাঁকে কখনো থালা-বাসনের ঠনঠন শব্দ, যেন রান্নাঘরে কেউ হঠাৎ বালিশ ফেলে হাঁড়ি খুঁজছে, আবার কখনো দরজার কপাটে হালকা চাপ দেওয়ার শব্দ। প্রথম দু’তিন দিন নিজের কল্পনা বলে উড়িয়ে দিলেও, একটা রাতে ঘুম ভেঙে গিয়ে চোখের সামনে স্পষ্ট দেখেন রান্নাঘরের দরজাটা খোলা, যদিও রাতে সেগুলো সব বন্ধ করে ঘুমোতে যান তিনি। লাইট জ্বালিয়ে এগিয়ে গিয়ে দেখেন, ভেতরে কেউ নেই, কিন্তু মাটিতে পড়ে থাকা একটা লোহার থালায় হালকা ঘাম জমে উঠেছে, যেন কেউ সদ্য হাত ছুঁয়েছে সেটায়। সেই মুহূর্তে এক অস্পষ্ট গন্ধ ভেসে আসে—পুরনো পঞ্চফোড়নের, ধূপের, আর কিছুটা যেন পুরনো মানুষের শরীরের গন্ধ—এক ধরনের বাসি ঘামের নোনতা ঘ্রাণ। সেই রাতের পর থেকে বিপ্রতীক বুঝে যান, এ কেবল পুরনো বাড়ির শব্দ নয়, কল্পনা নয়—এ কিছু অন্যরকম।
এই অদ্ভুত ঘটনার কথা কাউকে বলা তো দূরের কথা, নিজেই নিজের ওপর সন্দেহ করতে শুরু করেন তিনি। তবে একদিন তাঁর পুরনো পরিচিত নীলাঞ্জনা সেনকে ফোন করেন—একদা কলেজের বিশেষ বন্ধু, যার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও নামটা শুনেই মনের ভেতর একটা নির্ভরতার ছোঁয়া আসে। পেশায় সাইকোথেরাপিস্ট হলেও নীলাঞ্জনা প্যারানর্মাল সাইকোলজি নিয়েও কাজ করে—তার কাছে বলা মানে নিজের সত্তাকে সম্পূর্ণ মেলে ধরা। বিপ্রতীক বলে বসেন সব—ঘটনার সময়, ঘর থেকে আসা কান্না, রান্নাঘরের বদলে যাওয়া জিনিসপত্র, এমনকি তার নিজের স্বপ্নেও এখন একজন বয়স্কা মহিলাকে দেখেন, যিনি শুধু বলেন, “ব্রহ্মমুহূর্তে থালা ধুয়ে রাখিসনি… তাই আজও ফিরি।” কথাটা শুনেই চুপ করে যায় নীলাঞ্জনা। সে জানে, এই ধরনের সংলাপ নিছক মানসিক অবচেতনের খেলাও হতে পারে, আবার কোনো না কোনো গভীর পারিবারিক চিহ্নের ছায়াও। সে বিপ্রতীকের অনুমতিতে সেই বাড়িতে এক রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নেয়। আর ঠিক তখনই, রাত তিনটে বেজে ৩৩ মিনিটে দরজায় আবার ঠকঠক আওয়াজ হয়—এইবার তারা দুজনেই চোখ মেলে বসে থাকে, দরজার ওপারে কারও পায়ের ছায়া দেখা যায় না, অথচ ভেতর থেকে স্পষ্ট শোনা যায় এক বৃদ্ধা কণ্ঠ—”ঘরে ঢোকা যাবে তো? আজ ঠাকুর আছে…”
২
পরদিন সকালটা ছিল অসম্ভব ভারী। শীতের রোদ উঠলেও, ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে সেই আলো ঢুকতে যেন কুণ্ঠাবোধ করছিল। নীলাঞ্জনা কিছু না বলে ঠাকুরঘরের কাছে রাখা পুরনো রেজিস্টার বইগুলো ঘাঁটছিল—সেই পাণ্ডুলিপির মতো মোটা খাতা যেখানে লেখা থাকত বছরের পর বছর ধরে বাড়ির উৎসব, গৃহপ্রবেশ, বিয়ে, মৃত্যু, পুজো ও অনুষঙ্গ। বিপ্রতীক তাকে বিস্ময়ের চোখে দেখছিল—একজন আধুনিক মনস্তত্ত্ববিদ হয়েও কী নিখুঁত ধৈর্যে সেই সাদা-হলুদ পাতাগুলো উলটে যাচ্ছিল নীলাঞ্জনা। অনেক খুঁজে, এক জায়গায় এসে থেমে গেল সে—১৯৭১ সালের শেষভাগ, শারদীয়া দুর্গোৎসবের আগের সময়, খাতায় নীল কালি দিয়ে লেখা—“সরোজিনী দেবীর আচরণে প্রগাঢ় পরিবর্তন, ভোর রাতে রান্না ঘরে একা অবস্থান, কারও সঙ্গে কথা না বলে, কেবল পুজোর থালা ঘষে চলেছেন। শারীরিক অবস্থা সংকটজনক।” পাশে ছোট হরফে লেখা—“৩ নভেম্বর—মৃত্যু কালে সময় ৩:৩৩।”
নীলাঞ্জনা খাতাটা বন্ধ করে বলে, “বিপ্রতীক, তোমার দিদিমার কিছু না বলা কথা থেকেই যাচ্ছে এখানে। এটা নিছক মানসিক ভারসাম্যহীনতা নয়, বরং সে কারও জন্য অপেক্ষা করছিল—হয়তো কারও কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য বা কেউ তাঁকে স্বীকৃতি দিক, সেই আশায়। এমন অনেক ঘটনা আছে, যেখানে মানুষের মৃত্যু একটা অসমাপ্ত আকাঙ্ক্ষার মধ্যে হয়, আর সেই মানসিক আবেগ ওই স্থানে রয়ে যায়। এই বাড়ির সেই রান্নাঘর, আর সেই সময়—৩:৩৩—সেটা তো নিছক কাকতালীয় নয়।” বিপ্রতীক কিছু বলতে পারে না। তার মনে পড়ে, ছোটবেলায় রাতে ঠাকুমা নাকি রান্না করতেন পঞ্চমী থেকে দশমী অবধি, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, “ঠাকুরের প্রসাদ ভোরে তৈরি হতে হবে।” কিন্তু সে তখন এই বিশ্বাসকে পাত্তা দেয়নি, কারণ শহরের ছেলেরা যেমন হয়, পুরনো রীতিনীতিকে কুসংস্কার বলেই মনে করত। এখন যখন ঠিক সেই সময়েই বাড়ি গুমোট হয়ে ওঠে, এক অচেনা কান্না প্রতিধ্বনিত হয়, তখন নিজের সন্দেহকে আর যুক্তি দিয়ে চাপা রাখা যায় না।
সন্ধের পর থেকেই যেন বাড়ির বাতাস ঘন হয়ে উঠল। মণিকা, পুরনো গৃহপরিচারিকা, কোনোদিন যা করেন না, আজ হঠাৎ রান্নাঘরের দরজাটা বন্ধ করে বললেন—”মেমসাহেব যদি ভেতরে যেতে চান, এখনি যান। তারপর আমি তালা লাগিয়ে দেব। অনেক হয়েছে। ওর ভয় পাওয়া কষ্ট সহ্য হচ্ছে না আর।” কথাটা শুনে নীলাঞ্জনা বুঝে গেল, অনেকদিন ধরেই কিছু একটা ঘটে চলেছে, যা এই বৃদ্ধা দেখেও মুখে কিছু বলেননি। নীলাঞ্জনা রান্নাঘরে ঢোকে, সঙ্গে বিপ্রতীক। একদিকে লোহার ওভেন, ধুলোমাখা থালা, কিছু গর্ত হয়ে যাওয়া কাঠের তাক—সবকিছুই যেমন ছিল, তেমনই আছে। কিন্তু এক কোণে হঠাৎ চোখে পড়ে, একটি রুপোর থালা রাখা, যার উপর জমেছে পাতলা ধুলো, আর পাশে পড়ে আছে একটি প্রাচীন ঘন্টা—যা সাধারণত পুজোর সময় ব্যবহার করা হয়। সেই থালার গায়ে আঁচড়ের দাগ—যেন কেউ নিয়মিত সেটি ঘষেছে বারবার।
নীলাঞ্জনা নিচু হয়ে থালাটা ছুঁয়ে দেখে এবং ফিসফিস করে বলে, “এটা যে ছুঁয়েছে, সে আজও ভাবে… এখনও পুজো বাকি, এখনও কেউ আসেনি খেতে।” সেই মুহূর্তে দরজার ওপাশ থেকে আবার সেই শব্দ—ঠক ঠক ঠক। আবারও ঠিক ৩টা ৩৩ মিনিট। কিন্তু এইবার নীলাঞ্জনা দরজা খুলতে বলেন না। বরং বলেন, “চোখ বন্ধ করো। মনটা মুক্ত করো। ভাবো, যেন তুমি দিদিমার পাশে দাঁড়িয়ে বলছো—‘তুমি মুক্ত, ঠাকুর এসেছেন, পুজো শেষ হয়েছে।’ বলো, বিপ্রতীক, বারবার বলো।” বিপ্রতীক প্রথমে হোঁচট খেলেও, একসময় বলে উঠল সেই কথাগুলো, বারবার। এবং সেই মুহূর্তে, যেন কোনও চাপা কষ্টের দীর্ঘশ্বাস ভেসে আসে রান্নাঘর থেকে। কান্নার আওয়াজ থেমে যায়। থালা-বাসনের ঠনঠন বন্ধ হয়। বাতাসটা হালকা হয়ে যায় একেবারে।
৩
পরের দিন ভোরবেলা যেন এক অন্য আলোর স্পর্শে ভিজে ছিল ঠাকুরবাড়ির ভেতরটা। জানালার ফাঁকে আসা সোনালি আলো এবার যেন ঘরের দেওয়ালে আটকে যায়নি, বরং ছড়িয়ে পড়েছে ছাদের ফাটলে, কাঠের মেঝেতে, এমনকি সিঁড়ির নিচে জমে থাকা সেই পুরনো ধুলোতেও। মণিকা একবার রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁপা গলায় বললেন, “আজ সকালে সেই গন্ধটা নেই… আর থালাও যেন ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।” বিপ্রতীক কিছু না বলেই রান্নাঘরে ঢুকে পড়ে। আগের রাতে যে থালাটায় অদৃশ্য আঁচড়ের দাগ ছিল, তা আজ কেমন চকচকে, পরিষ্কার। যেন কেউ এসে নিজের দায়িত্ব শেষ করে গেছে। কিন্তু এই শান্তি যেন সম্পূর্ণ নয়, বরং কিছুটা অস্থায়ী। কারণ নীলাঞ্জনা ঠিকই বলেছিল—যে আবেগের আবরণে আত্মা আটকে থাকে, সে যদি কোনোদিন মুক্তি না পায়, তবে তার ছায়া থেকে যায়, স্মৃতি হয়ে। এবং স্মৃতির থেকেও শক্তিশালী ভয় আছে না-জানা প্রত্যাশার। সেদিন দুপুরে, নীলাঞ্জনা বাড়ি ছাড়ার আগে এক বাক্য বলেছিল—“তোমার দিদিমা হয়তো চলে গেছেন, কিন্তু এই বাড়িতে আরেকজন আছে… যে এখনও অপেক্ষা করে, দরজার ওপারে।”
সে রাতে কেমন যেন নিস্তব্ধতা। এতটাই নিস্তব্ধ যে, সেকেন্ড হ্যান্ড ঘড়ির টিকটিকিও বড় মনে হয়। বিপ্রতীক এবার একা। নীলাঞ্জনা পরদিন ফিরে আসবেন বলেই জানিয়েছেন, তবে আজ রাতে কিছু একটা তার পরীক্ষা করার ছিল—সে বাইরে থেকে রাত ৩টা ৩৩-এ সেই দরজার কড়া নাড়ার উৎস বুঝতে চায়। দরজা খোলা রেখে, ক্যামেরা সেট করে, সে নিজের শোবার ঘরে অপেক্ষা করছিল। রাত ৩টা বাজতে না বাজতেই যেন বাতাস ভারী হয়ে আসে, ঘরের মধ্যে তাপমাত্রা কমে যায় অনেকটা, যেন শীতকাল ঢুকে পড়ে হাড়ের গভীরে। এবং ঠিক ৩:৩৩-এ, ক্যামেরার লেন্সে ধরা পড়ে এক মুহূর্তের জন্য এক ছায়া—অপরিচিত, ধূসর, একটি দীর্ঘ শরীর, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে দরজার ঠিক বাইরে, জানালার রেলিং ছুঁয়ে। তারপর হঠাৎ ঘরজুড়ে শোনা যায় খটখট আওয়াজ, যেন কেউ মেঝেতে কাঠের ছড়ি দিয়ে টোকা দিচ্ছে। বিপ্রতীক তড়াক করে উঠে আসে, দরজার কাছে পৌঁছেও খুলতে সাহস পায় না। কেবল দেয়ালে কান পেতে শোনে, এক মৃদু কণ্ঠ বলছে—“খোল… এইবার আমায় খোল।”
সকাল হলে ক্যামেরা রিভিউ করে সে যা দেখে, তাতে তার শ্বাস বন্ধ হয়ে যায় কিছুক্ষণ। সেই ছায়াটি স্পষ্ট নয়, কিন্তু ভিডিও-ফ্রেমে ধরা পড়ে এক জোড়া পা, উঁচু পায়জামা পরা, এক হাতে ধরা কাঠের ছড়ি। ছড়িটার মাথায় একটি পিতলের কাজ। এবং সবচেয়ে ভয়ংকর, ক্যামেরার অডিওতে শোনা যায়, একজন কণ্ঠ বলছে—“সরোজিনী এখনও আসেনি, আজ সে থালা দেবে না?” কণ্ঠটা নাক সিঁটকোনো ধরণের, পুরুষ, বয়স্ক, স্পষ্টতই রাগে টনটন করছে। বিপ্রতীক তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারে, সরোজিনী শুধু একা ছিলেন না এই বাড়ির স্মৃতিতে, কেউ যেন তাঁকে প্রতিরাতেই খুঁজে ফিরছে, কোনো অধিকারবোধ নিয়ে। সেই “অতিথি” এখনও এসে দরজায় দাঁড়ায়, এখনও ঠাকুর প্রসাদ খেতে চায়, এবং সেই অপেক্ষা যেন নতুন এক ভয় জন্ম দিচ্ছে এই বাড়ির গর্ভে।
৪
নীলাঞ্জনা যখন পরদিন সকালবেলা ফিরে এলেন, বিপ্রতীকের চোখের তলায় গভীর কালি দেখে বুঝে গেলেন—গত রাতে কিছু ঘটেছে। কথা না বাড়িয়ে সে সোজা গিয়ে বসে রান্নাঘরের সামনের পুরনো কাঠের টেবিলটায়, আর বিপ্রতীক তুলে ধরল সেই ফুটেজ। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে ছায়া, পায়ের রেখা, আর সেই ভয়াল কণ্ঠ—“সরোজিনী এখনও আসেনি… আজ সে থালা দেবে না?” শুনেই নীলাঞ্জনার চোখ লাল হয়ে ওঠে। সে বলে, “এই কণ্ঠটা শোনার পর, আমার মনে পড়ছে এক চরিত্রের কথা—তোমার ঠাকুরদা বালিগঞ্জের কোর্টে কাজ করতেন তো? তাঁর এক কাকাতো দাদা ছিল, হরিচরণ মিত্র, যিনি ১৯৫০-এর দশকে এই বাড়িতেই থাকতেন, কিন্তু পরিবারের বাইরে ছিলেন একেবারেই স্বেচ্ছাচারী ও হিংস্র প্রকৃতির। সে নিয়মিত বাড়ির মেয়ে-গৃহস্থদের উপর দাপট খাটাত, এমনকি সরোজিনী দেবীর ওপরও মানসিক নিপীড়ন করত বলে শোনা যায়। একবার তো শোনা গিয়েছিল, পুজোর দিন নাকি প্রসাদ না পেয়ে সে রেগে গিয়ে থালা ছুঁড়ে মেরেছিল, আর সরোজিনী দেবী সেই অপমান ভুলতে পারেননি কখনো।”
বিপ্রতীক চুপচাপ শোনে। এতদিন ধরে সে জানত, ঠাকুরবাড়ির ইতিহাস মানেই গোঁড়ামি, রীতি, বনেদিয়ানার নামে প্রচ্ছন্ন অমানবিকতা। কিন্তু আজ যেন সে অতীতকে স্পর্শ করে দেখছে একেবারে নিজের চামড়ায়। “তাহলে… এই ছড়ির মালিক কি হরিচরণ?” সে জিজ্ঞেস করে। নীলাঞ্জনা মাথা হেঁট করে বলে, “সম্ভব। কারণ যেভাবে সে কণ্ঠে দাবির সুর, সেটা কেবল এক ‘অধিকারী আত্মা’-র হয়। সে এখনও ভাবে, এই বাড়ির নিয়ম অনুযায়ী সরোজিনীকে তাকে খাওয়াতে হবে। তার অভিপ্রায় স্পষ্ট—প্রতিদিন একই সময়ে এসে দাঁড়ায়, দরজায় কড়া নাড়ে, আর সরোজিনী যদি সাড়া না দেয়, তাহলে বাড়িকে নাড়িয়ে দেয়।” এইসব কথার ফাঁকে বিপ্রতীক খেয়াল করে, রান্নাঘরের এক কোণার কাঠের তাক হালকা সরে আছে—যা আগে সে দেখেনি। ভিতরে পাওয়া যায় একটি কাঠের বাক্স, যার মধ্যে রাখা একটি পুরনো ছড়ি—পিতলের মাথা, নীলাভ কাঠ, হাতের ছোঁয়ায় কালো হয়ে যাওয়া অংশ।
নীলাঞ্জনা ধীরে বাক্সটা খোলে। ভেতরে ছড়ির নিচে পাওয়া যায় এক পুরনো চিঠি—হাতের লেখা অস্পষ্ট, কিন্তু বোঝা যায় এটি সরোজিনী দেবী লিখেছিলেন, কাউকে উদ্দেশ্য করে নয়, বরং নিজেরই অভিমানে। তাতে লেখা:
“এই বাড়িতে আমি রাঁধি, খাইয়ে দিই, কিন্তু কখনো খাইনি নিজের মুখে। একদিন এক ঠাকুর বলে গিয়েছিল, এই বাড়ির যে ছায়ার হাতে ছড়ি, সে শুধু নিজের চাহিদা বোঝে। আমি প্রতিদিন থালা সাজিয়ে দিই তার জন্য, কিন্তু কোনোদিন সে আমার কথা জিজ্ঞেস করেনি। সে আমায় দেখেনি, শুধুই খেতে চায়। তাই এই ছড়ি আমি ফিরিয়ে রাখলাম, যেন আর কেউ তাকে খাওয়াতে না আসে।”
এই চিঠি পড়ে দুই বন্ধু বুঝে যায়, ভয় আসলে একটা অসমাপ্ত সম্পর্কের উত্তরাধিকার—যেখানে এক পক্ষ শুধু অধিকার কায়েম করতে চেয়েছে, অন্য পক্ষ কখনো স্বীকৃতি পায়নি। বিপ্রতীক সিদ্ধান্ত নেয়—এই ছড়িকে মাটিচাপা দেওয়া হবে, যেন তার স্মৃতি আর দাপট ভবিষ্যতের দুঃস্বপ্নে না ফিরে আসে। এবং ঠিক সেই সিদ্ধান্তের রাতে, প্রথমবার, রাত ৩:৩৩-এ কোনো দরজায় ঠকঠক শব্দ হয়নি। যেন কে যেন বুঝে গেছে—তার সময় ফুরিয়েছে।
৫
রাতের নিস্তব্ধতা এবার যেন শান্তির ছিল, আতঙ্কের নয়। বহুদিন পর ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে যেন নিঃশব্দ একটা প্রার্থনা বয়ে চলেছে বাতাসে—কারও চিৎকার নয়, কারও দাবি নয়—শুধু এক নিঃশেষ নিঃশ্বাস, যা মুক্তি চায়। বিপ্রতীক সেদিন রাতটা কাটাল খোলা জানালার সামনে বসে, কাঁধে চাদর জড়িয়ে, এক কাপ জলখাবারের চা হাতে। কাঁচের বাইরে পুরনো পেঁচানো রেলিংয়ে চাঁদের আলো পড়ে এক নরম রুপালি ছায়া ফেলেছে। ঘড়ির কাঁটা যখন তিনটে ছুঁলো, তার হৃদস্পন্দন একটু বেড়ে গেল। তিনটে পেরিয়ে গেল, তারপর তিনটে বেজে ৩৩ মিনিট—কিন্তু এবার কোনো শব্দ নেই। কোনো ঠকঠক, কোনো ছড়ির টোকা, না কোনো হাঁসফাঁস করা কণ্ঠস্বর। সারা বাড়ি যেন এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে হালকা হল।
সকালে নীলাঞ্জনা এসে দেখে, রান্নাঘরের সামনে এক জায়গায় সাদা আলপনা ফুটে উঠেছে নিজে থেকেই—কেউ আঁকেনি, অথচ নিখুঁত রকমের একটি পূজার চিহ্ন, যার কেন্দ্রস্থলে একটি রুপোর থালা আর একটি ছোট্ট প্রদীপ, নিভে যাওয়া। সে কিছুক্ষণ স্তব্ধ দাঁড়িয়ে থাকেন, তারপর বলে, “এটা কোনো বিদায় নয় বিপ্রতীক, বরং গ্রহণ। তুমি এই বাড়িকে গ্রহণ করেছ—তার ইতিহাস, যন্ত্রণা, স্মৃতি। এখন এই বাড়ি তোমাকে আপন করে নিচ্ছে।” বিপ্রতীক কিছু বলে না। কেবল মাথা নাড়ে। ভিতরে ভিতরে জানে, এই বাড়ির অতীত একদিন তারই পরিবারের গর্ব ছিল, কিন্তু সেই গর্বের আড়ালে ছিল অসম্মান, আত্মত্যাগ, আর চাপা কান্না। আজ হয়তো সরোজিনী দেবী স্বস্তিতে। হয়তো হরিচরণও বোঝেন, থালার অধিকার নয়, ভালোবাসার অভাবই তাঁকে এইখানে আটকে রেখেছিল।
দিন কয়েক পর, বিপ্রতীক সেই বাড়িতে একটি ছোট প্রদর্শনীর আয়োজন করে। নাম দেয়—”আত্মার আঙ্গিনা: ঠাকুরবাড়ির অন্দরকথা”। সেখানে দর্শকদের জন্য তুলে ধরা হয় এক ঘরের কোণে বসে থাকা রুপোর থালা, পাশে প্রিন্ট করা সেই চিঠি—সরোজিনী দেবীর লেখা। কিছু কেউ বুঝতে পারে, কেউ না। কেউ দেখে যায় শুধু পুরনো বাড়ির অভিজ্ঞান, কেউ আবার দাঁড়িয়ে পড়ে বেশিক্ষণ রান্নাঘরের সামনে, যেন কেউ ডাকছে তাদের। সেইদিন সন্ধ্যায় একজন প্রবীণ ভদ্রমহিলা, যিনি ছিলেন এককালে সরোজিনীর পরিচিতা, কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “ও বলত—আমার থালা কেউ নিতে চায় না। আজ দেখি, সবাই ওটাই দেখতে চায়। তাহলে এবার সে নিশ্চিন্তে যেতে পারবে।” এই কথার মধ্যে দিয়ে যে আতিথেয়তার শেষ পালা শেষ হয়—ভোররাত্রির সেই অদৃশ্য অতিথি, যার দাবি ছিল থালা, আর যাঁর দায় ছিল তা দিয়ে যাওয়ার—তাঁরা দুজনেই যেন একে অপরকে ক্ষমা করে দিয়ে চলে গেলেন… চিরতরে।
৬
ঠাকুরবাড়ির দালানে বসে এখন আর কণ্ঠস্বর ওঠে না হঠাৎ, কোনো অলৌকিক ঠকঠকাও ভেসে আসে না বাতাসে, কিন্তু তবু বিপ্রতীকের রাতগুলো একেবারে শান্ত নয়। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ঘটে যাওয়া ঘটনা যেন কোথাও এক অদৃশ্য রেশ টেনে নিয়ে চলে তাকে প্রতিদিনের ঘুমে। সে এখন প্রায় রাতেই স্বপ্ন দেখে—ঘরের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছেন এক জননীমূর্তি, তার হাতে রুপোর থালা, ঠোঁটে এক প্রশান্ত হাসি, আর চোখে অদ্ভুত গভীরতা। সেই চোখ তার দিকে তাকিয়ে বলে না কিছুই, শুধু দেখেই যায়। ঘুম ভাঙলে বিপ্রতীক অনুভব করে, স্বস্তি আছে বটে, কিন্তু সেই সঙ্গে আছে এক অদ্ভুত টান, যেন তার নিজের জীবন এই বাড়ির অতীতের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে অবিচ্ছিন্নভাবে। যে অস্থিরতা সে নিয়ে এসেছিল শহরে ফিরে এসে, এখন যেন তা ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের নীরবতার সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে।
নীলাঞ্জনা মাঝে মাঝে আসে—চুপচাপ বসে থাকে, অনেক কিছু না বলেই যেন অনুভব করে ফেলে ওই বাড়ির নতুন ছন্দ। একদিন সন্ধ্যায় সে বলে, “এই বাড়ির ভিতরে যেটা সবচেয়ে মূল্যবান, সেটা কোনো রক্তের সম্পর্ক নয়, বরং ক্ষমা।” বিপ্রতীক তাকিয়ে থাকে সিঁড়ির ধুলোয় জমে থাকা পায়ের ছাপে—যা হয়তো তার, কিংবা হয়তো সেই কারও, যার অস্তিত্ব শুধু এক সময় ছিল। সে জানে, হয়তো এই বাড়ি পুরোপুরি স্বাভাবিক হবে না কোনোদিন। হয়তো মাঝেমধ্যে বাতাস ভারী হবে, হয়তো রান্নাঘরের ঘড়ি একদিন থেমে যাবে ঠিক ৩:৩৩-এ। কিন্তু এও সে জানে, সব কিছু থেকে পালানো সম্ভব নয়। কিছু কিছু সম্পর্ক বয়ে নিয়ে যেতে হয়, যতটা না রক্তের কারণে, তারচেয়ে বেশি স্মৃতির কারণে।
একদিন রাতে, ঠিক এক মাস পরে, বিপ্রতীক একা বসে পিয়ানো বাজাচ্ছিল—বাড়ির একমাত্র প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র, যা বহু বছর বন্ধ ছিল। সেই সুর ভেসে যাচ্ছিল দালানের ওপর দিয়ে ছাদ পর্যন্ত, যেখানে চাঁদের আলোয় ছায়া নেমে আসছিল ধীরে। আচমকাই, তার সামনে পড়ে থাকা একটা পুরনো চিঠির খামে চোখ যায়—চিঠিটা লেখা হয়েছিল তার ঠাকুরদার হাতে, যেটা আগে সে দেখেনি। খুলে পড়ে সে বিস্মিত হয়—চিঠিতে লেখা, “তুই যদি কোনোদিন এই বাড়িতে ফিরে আসিস, মনে রাখিস, একেকটা দেয়াল শুধু ইট নয়, ক্ষমা চাওয়া মানুষের কান্নাও ধরে রাখে।” সেই রাতেই তার মনে হয়, সেই অতিথির বিদায় হলেও, যে আতিথেয়তা সে একদিন প্রত্যাখ্যান করেছিল, আজ সেই আমন্ত্রণ সে গ্রহণ করেছে। “ভোররাত্রির অতিথি” আর অজানা নয়—সে এবার ঘরের মানুষ।
৭
ঠাকুরবাড়ির দ্বিতীয় তলার উত্তর-পশ্চিম কোণের যে অলিন্দটি বছরের পর বছর তালা বন্ধ ছিল, সেখানে ঢোকার ইচ্ছা কোনোদিন হয়নি বিপ্রতীকের। ছোটবেলায় শুনেছিল, সেই অংশে একবার আগুন লেগেছিল—পুরনো কাপড়, কাঠের বাক্স, কিছু ছাপানো পুরনো ঠাকুরের ছবি সব পুড়ে গিয়েছিল। সেই থেকে অলিন্দটি অনাঘ্রাত হয়ে ছিল, দরজার বাইরে ধুলো জমে ছিল বছরের পর বছর। কিন্তু হঠাৎ এক ঝড়ের রাতে ছাদের কিছু অংশ ধসে পড়ে, এবং তার ফলেই সেই দরজার তালা আলগা হয়ে যায়। পরদিন সকালে মণিকা এসে জানায়—”সেই দরজা খুলে গেছে বাবু, এখন বুঝি সময় হয়েছে…” বিপ্রতীক চুপচাপ উঠে গিয়ে সেই অলিন্দে ঢোকে। ভেতরে এক অন্যরকম গন্ধ—পোড়া কাঠ, পুরনো কালি, ধুলোর গন্ধ, আর তার মাঝখানে এক খণ্ড নীরবতা যা সময়কে ঠেকিয়ে রেখেছে। অন্ধকারে টর্চ ফেলতেই সে দেখে, এক কোণে একটা কাঠের ট্রাঙ্ক পড়ে আছে, অর্ধেক পুড়ে গিয়েছে, কিন্তু ভেতরে রাখা আছে এক পুরনো ছেঁড়া ডায়েরি।
ডায়েরির পাতাগুলো অর্ধেক পোড়া, কিছু লেখা অস্পষ্ট। কিন্তু কিছু কিছু বাক্য এখনো স্পষ্টভাবে পড়া যায়। তারিখ দেওয়া ১৯৪৯—লেখকের নাম নেই, কিন্তু লেখা থেকে বোঝা যায়, এটি কোনো এক গৃহবধূর নিজস্ব অনুভব। “আমি আজ রান্নাঘরে বসে কেঁদেছি… হরিচরণ বাবু আবার থালা ছুঁড়ে ফেললেন। মা কিছু বলেন না, শুধু আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলেন—’সহ্য কর, মেয়েমানুষের কপালে এ-ই আছে।’ কিন্তু কেন, আমি কি কেবল রান্নার যন্ত্র? আমি কি চাই না, কেউ একবার বলুক—’তুই খেয়েছিস তো?'” আরও এক জায়গায় লেখা—”আজ ভোররাত্রি, ৩টা পেরিয়ে গেছে। আমি থালা মুছে রাখছি। কেউ বলেছে, ব্রহ্মমুহূর্তে রান্না করলে পুণ্য হয়। আমি পুণ্য চাই না, শুধু শান্তি চাই।” সেই শব্দগুলো পড়ে শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা নেমে আসে বিপ্রতীকের—এই লেখক কি সরোজিনী দেবী? নাকি আরও কেউ? তাহলে কি শুধুই সরোজিনী ছিলেন না সেই প্রেত-যন্ত্রণার শিকার? ঠাকুরবাড়ির নারীরা হয়তো একের পর এক কষ্টের ভারে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন—কেউ পাগল হয়ে, কেউ নিঃশব্দে।
নীলাঞ্জনা সেই ডায়েরি পড়ার পর কেবল বলে, “এই বাড়ি শুধু ইট-কাঠ নয়, এক আর্কাইভ… মনের, শরীরের, এবং নীরবতা কীভাবে মানুষের রক্তের সঙ্গে মিশে যায় তার দলিল।” বিপ্রতীক সিদ্ধান্ত নেয়, সে শুধু ইতিহাসবিদ হিসেবে এই বাড়িকে গবেষণার জায়গা বানাবে না, বরং একটি নতুন প্রকল্প শুরু করবে—‘অলিন্দ স্মৃতি সংগ্রহশালা’—যেখানে ঠাকুরবাড়ির হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের গল্প, পোড়া চিঠি, রান্নাঘরের থালা, ডায়েরির পাতা একত্রে সংরক্ষিত থাকবে। কারণ সে এখন জানে, আতিথেয়তা কেবল খাবার দেওয়া নয়, একে অপরের ব্যথা অনুভব করাও। সেই অলিন্দ, যে আঁধারে এতকাল জমেছিল নীরব অভিমান, আজ তা পরিণত হবে আলোয় মোড়া এক স্মৃতি-আঙিনায়—যেখান থেকে কেউ আর দরজায় কড়া নাড়বে না, কারণ সেই দায়িত্ব, এবার নিজেরাই নিয়েছে বাড়ির মানুষ।
৮
শহর কলকাতার ধুলোচাপা অলিগলি মাঝে মাঝে চমকে ওঠে এমন কোনও অভিজ্ঞতায়, যা ইতিহাস নয়, কিন্তু ইতিহাসের থেকেও বেশি জীবন্ত। “অলিন্দ স্মৃতি সংগ্রহশালা” নামে বিপ্রতীকের তৈরি সেই ছোট প্রদর্শনী উত্তর কলকাতার মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে নিঃশব্দে। কেউ ঠাকুরবাড়ির অতীত জানার আগ্রহে আসে, কেউ আবার আসে নিজের হারানো সময় খুঁজে পেতে। রান্নাঘরের এক কোণে রাখা সেই রুপোর থালা, তার পাশে চিঠির প্রতিলিপি, আর পোড়া ডায়েরির পাতা—সবকিছুই যেন দর্শনার্থীদের এক মুহূর্তের জন্য থমকে দেয়। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে থাকেন দীর্ঘক্ষণ, যেন শব্দহীন চিৎকার শুনতে পান তারা। এমনই এক রবিবার দুপুরে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক এসে দাঁড়ালেন থালার সামনে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, “এই থালাটা আমি আগেও দেখেছি… অন্য এক বাড়িতে, অন্য এক মৃত্যুর রাতে।” চারপাশ হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায়।
নীলাঞ্জনা, যিনি সেই সময় গাইডের ভূমিকায় দর্শকদের ইতিহাস ব্যাখ্যা করছিলেন, চমকে তাকালেন তাঁর দিকে। ভদ্রলোক নিজের পরিচয় দিলেন—সুধীরচরণ গুহ, বয়স প্রায় ৭৮, কালীঘাটের কাছের এক পুরনো বাড়ির বাসিন্দা। তাঁর ঠাকুমা ছিলেন মিত্র পরিবার থেকে বিয়ে যাওয়া এক কন্যা—স্বর্ণলতা। স্বর্ণলতার মৃত্যুও হয়েছিল এক ভোররাত্রিতে, রান্নাঘরের এক কোণে, থালা হাতে। সুধীরবাবুর কথায় জানা যায়, স্বর্ণলতা আজীবন একটাই কথা বলতেন—“মায়ের থালা যেন আমার সঙ্গে থাকে।” মৃত্যুর সময়ও সেই থালার গায়ে হাত রেখেছিলেন তিনি। সেই কথা শুনে বিপ্রতীক হঠাৎ বুঝতে পারেন, এই থালাটা শুধু সরোজিনী দেবীর নয়—এটি সম্ভবত ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের চিহ্ন বহন করে একটি প্রতীক, যেটি প্রজন্মের পর প্রজন্ম বয়ে চলেছে—যেন মনের ভার, না বলা কথা, অসমাপ্ত আত্মত্যাগের দলিল হিসেবে। এই থালা বয়ে নিয়ে চলেছে শুধু স্মৃতি নয়, দায়।
পরদিন, ডায়েরির আরও কিছু ছেঁড়া পাতার পেছনে পাওয়া যায় একটি ছোট বংশপরম্পরা তালিকা—যেখানে স্বর্ণলতার নাম সত্যিই রয়েছে। তার পাশে কালি দিয়ে টানা দাগ—“অন্য পাড়ায় বিয়ে, কিন্তু মনের বন্ধন অটুট।” এবার বুঝে যায় নীলাঞ্জনা, যে থালা এই বাড়িতে ফিরেছে, সেটি কেবল প্রেতাত্মার ঘরঘটনার উৎস নয়, বরং এক নারীর হৃদয় থেকে আরেক নারীর হৃদয়ে পৌঁছানো এক নিরব ব্যথা, যা শিকড় গেড়ে বসেছিল উত্তর কলকাতার একাধিক রান্নাঘরের মেঝেতে। বিপ্রতীক সুধীরবাবুকে অনুরোধ করেন, যদি তিনি চান তবে তাঁর ঠাকুমার শেষ চিঠি বা স্মৃতিচিহ্ন সংগ্রহশালায় রাখতে পারেন। সুধীরবাবু চুপচাপ মাথা নাড়েন, বললেন, “আমার মনে হয়… এবার মা ঘরে ফিরলেন। এবার তাঁর থালা এইখানেই থাক।” সেই কথা শোনার পর রাতে আবার দেখা দেয় সেই পুরনো স্বপ্ন—বিপ্রতীক দেখে, অনেক নারী, ঘোমটা ঢাকা মুখে, নিঃশব্দে হাঁটছেন অন্দরের দিকে, এক একজনের হাতে রুপোর থালা, আর সরোজিনী দরজায় দাঁড়িয়ে বলছেন, “এসো… এবার আমরা নিজেরাই খাই।”
৯
“অলিন্দ স্মৃতি সংগ্রহশালা”-র খবর ছড়িয়ে পড়ে দেশ-বিদেশে, এবং এক সময় কলকাতায় পা রাখে ইউরোপের একটি গবেষণা সংস্থা, যারা “Haunting Domesticities” নামে দক্ষিণ এশিয়ার পরিত্যক্ত বাড়ি ও আত্মীয়-আত্মার স্মৃতি নিয়ে গবেষণা করে। গবেষণা দলের প্রধান এলিসা গ্রেহ্যাম, ভারতীয় শিকড়সম্পন্ন ব্রিটিশ নাগরিক, যিনি নিজের ঠাকুমার মুখে শুনেছিলেন এমনই এক বাড়ির কথা—যেখানে প্রতি রাত ৩টে বেজে ৩৩ মিনিটে কেউ কড়া নাড়ত, অথচ দেখা যেত না কাউকে। এলিসা কলকাতায় এসে সেই স্মৃতিকে সত্য রূপে আবিষ্কার করেন মিত্র পরিবারের ঠাকুরবাড়ির অলিন্দে। তাঁর দল স্মৃতি, নথি, আর প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ একত্র করে তৈরি করে এক নতুন ব্যাখ্যা—যা কেবল অতৃপ্ত আত্মার গল্প নয়, বরং এক দলিত ইতিহাসের পুনরুদ্ধার। তারা জানায়, এই ধরনের ঘটনার পেছনে থাকে যুগের পর যুগ জমে থাকা অবদমিত নারীকণ্ঠ, যাদের কথা কখনও লেখাজোখায় ওঠে না। এই থালা, এই সময়, এই কান্না—সবই আত্মার চিহ্ন নয়, বরং প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে অবহেলিত ইচ্ছের বর্ণময় দলিল।
এলিসার দল বাড়ির উত্তর দিকের একটি পুরনো পাথরের নিচে একটি তাম্রলিপি খুঁজে পায়, যেখানে প্রাচীন বাংলা হরফে লেখা—
“এ যে ঘর, এ যে আশ্রয়, রান্নার গন্ধে জেগে উঠুক হৃদয়।
যে এসে থালা হাতে বসবে, সে হোক আপন, সে হোক সদয়।”
এই লিপিটি বাড়ির ইতিহাসে অনুপস্থিত ছিল এতদিন। এটা সম্ভবত কোন এক গৃহিণী নিজেই খোদাই করিয়েছিলেন, হয়তো একান্ত নিজের অন্দরের কথা রেখে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। গবেষকদল এটিকে “কিচেন রিচ্যুয়াল পলেস” বা “রান্নাঘরের ধর্মীয় স্তম্ভ” বলে আখ্যা দেয়। এলিসা বলেন, “It’s not just about ghosts. It’s about memory seeking release. The kitchen became a temple where forgotten goddesses once lived.” এ কথাগুলো শোনার পর নীলাঞ্জনা ও বিপ্রতীক বুঝে যান, এতদিন যা তাঁরা ভয় ভেবেছিলেন, তা আসলে এক চেপে রাখা গলার আকুতি—নিঃশব্দে কেউ বলতে চেয়েছিল, “আমাকেও মনে রাখো।” সেই রাতেই বিপ্রতীক সিদ্ধান্ত নেয়, অলিন্দ স্মৃতি সংগ্রহশালাকে বড় করা হবে, সংরক্ষণ করা হবে শুধু স্মৃতি নয়, বরং অনুভব—যা মানুষের ইতিহাসের গভীরে ছড়িয়ে থাকে।
গবেষণার শেষ দিনে এলিসা তাঁকে হাতে তুলে দেন একটি হস্তলিপি অনুবাদ, যাতে সরোজিনীর শেষ লেখা সংরক্ষিত ছিল। “আমি চাই, কেউ যদি কখনো আবার এই বাড়িতে আসে, সে যেন ভয় না পায় রান্নাঘরের গন্ধে। আমি চাই, কেউ যদি থালা না ধোয়, তার দোষ না হোক। আমি শুধু চাই—একবার কেউ এসে বলুক, ‘তুমি ছিলে। তুমি আছো।’” এই লেখাটা পড়ে বিপ্রতীক আর কিছু বলতে পারে না। সেই রাতে ঠাকুরবাড়ি নিঃশব্দে আলোয় ভরে ওঠে—একটি ঘর নয়, বরং গোটা বাড়িটা যেন প্রাপ্তির প্রান্তরে দাঁড়িয়ে বলে, “এবার আমি মুক্ত।” সরোজিনীর আত্মা নয়, তাঁর উপস্থিতি এবার আর অতৃপ্ত নয়—এবার সে ইতিহাসে রূপান্তরিত।
১০
শেষরাতের কালো কুয়াশা সরিয়ে যখন প্রথম সূর্যের আলো ঠাকুরবাড়ির জীর্ণ জানালা দিয়ে ঢোকে, তখন বাড়িটার চেহারাই যেন অন্যরকম লাগে। অতীতের সেই ভারী নিঃশ্বাস, চাবির গোছার ঠকঠক, রান্নাঘরের কান্না—সব কিছু যেন এখন এক স্মৃতির আভায় নরম হয়ে গেছে। ঠাকুরবাড়ির গায়ে আগেও সূর্য উঠত, কিন্তু আজ যেন সেই আলো শুধু দেয়ালে নয়, ভিতরের মানুষগুলোর হৃদয়েও পড়ছে। বিপ্রতীক এখন নিয়ম করে প্রতিদিন সকালে রান্নাঘরে যায়। সেখানে কোনো ভয় নেই আর—শুধু শ্রদ্ধা, স্মরণ, আর এক অভ্যন্তরীণ শান্তি। সে রান্নাঘরের কোণে ছোট একটি প্রদীপ রাখে, যে প্রদীপ তার দিদিমা সারাজীবন জ্বালাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সময়ের অভাবে পারেননি। সে জানে, অতীতকে পাল্টানো যায় না, কিন্তু স্মৃতি ও শ্রদ্ধার মাধ্যমে তাকে সম্মান জানানো যায়। সেই একটাই উপায়, যাতে ভোররাত্রির অতিথি চিরতরে অতিথি না থেকে ঘরের মানুষ হয়ে ওঠেন।
নীলাঞ্জনা শেষবারের মতো শহর ছাড়ার আগে বলে গেলেন, “তোমার বাড়িটা এখন আর Haunted house নয়, এটা এখন Healing House।” তাঁর কথায় কেবল একটা গবেষকের কণ্ঠস্বর ছিল না, ছিল এক স্নেহময় বন্ধুর অনুভব, যে জানে কতটা গভীর যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে এই বাড়ি আবার শ্বাস নিতে শিখেছে। সেই দিন বিকেলে, অলিন্দ স্মৃতি সংগ্রহশালার সামনে দাঁড়িয়ে বিপ্রতীক দেখল, দু’জন শিশু একে অপরের হাত ধরে রান্নাঘরের দেয়ালে টাঙানো চিঠি পড়ছে। তারা কী বোঝে সেই ভাষা, বলা কঠিন। কিন্তু তাদের চোখে ভয় নেই, কৌতূহল আছে। এতেই বোঝা যায়, ভয় যদি ইতিহাস হয়, তবে ভালোবাসা হতে পারে তার উপশম। কেউ আর প্রশ্ন করে না এখন—“রাত ৩টে বেজে ৩৩ মিনিটে কি কিছু শোনা যায়?” বরং প্রশ্ন করে—“এই রুপোর থালা কার ছিল?” উত্তরগুলো যতই অস্পষ্ট হোক, সে খোঁজটুকুই যথেষ্ট। কারণ, যতদিন খোঁজ থাকবে, অতীত কখনও অভিশাপ হয়ে থাকবে না—তখন সে হবে গল্প, আর গল্পই তো শেষ পর্যন্ত আত্মার ঘর।
পরিশেষে, সেই রান্নাঘরের দেওয়ালে টাঙানো একটি নতুন ফলকে লেখা হল—
“ভোররাত্রির অতিথি, তুমি শুধু আতিথ্য চাইনি,
তুমি চেয়েছিলে স্বীকৃতি।
এই বাড়ি এখন তোমার নয়—তুমি নিজেই বাড়ি।”
বিপ্রতীক যখন লেখাটা পড়ে শেষ করে, তখন ঘড়ির কাঁটা ঠিক ৩:৩৩ ছুঁয়েছে—কিন্তু এবার তা কেবল এক সময়, আর কিছু নয়। কোনো কান্না নেই, কোনো ছায়া নেই। শুধু ছায়ার গল্প।
__




