অমর্ত্য ভট্টাচার্য
রথের দিন, রক্তের রেখা
পুরীর বাতাসে আজও শঙ্খ আর কাঁসরের ধ্বনি মিশে আছে, যেমন মিশে থাকে বালি আর ঘাম। সকাল সাড়ে সাতটা থেকে শহরের প্রতিটি অলিগলি ঠাসা মানুষে—ভক্ত, পর্যটক, পুলিশ, পুরোহিত, বিদেশি সাংবাদিক, দালাল, দলাল—সবাই যেন এক অদৃশ্য শক্তির টানে গড়িয়ে যাচ্ছে গ্র্যান্ড রোডের দিকে। জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার তিনটি বিশাল রথ অলরেডি দাঁড়িয়ে আছে, কাঠের চাকায় লাল-হলুদ-সবুজের প্যাঁচানো চাদরে ঢাকা। হাজারো লোক টানবে সেই রথ, আর ঠিক সেই উৎসবের মধ্যেই—মন্দির চত্বরের দক্ষিণ কোণায়, একটি কাঠের কুঠুরির সামনে, আবিষ্কৃত হল এক নিথর দেহ। মৃত, চোখ দুটো ফ্যাঁকাসে খোলা, এক হাত তুলে থাকা যেন কাউকে শেষ মুহূর্তে কিছু দেখাতে চেয়েছিল।
ডিউটি কনস্টেবল প্রথম দেখে রক্তের দাগ। মনে হয়েছিল কেউ হয়তো পায়ে আঘাত পেয়েছে। কিন্তু খানিক এগোতেই দেখে শরীরটা অদ্ভুত ভঙ্গিতে পড়ে আছে, কপাল আর ঘাড়ের মাঝে জমে থাকা ঘন রক্ত শুকিয়ে গিয়েছে সকাল রোদে। সাথে সাথেই খবর যায় কোস্টাল থানায়। কিন্তু যেহেতু মৃত ব্যক্তির পরিচয় মেলে একজন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস গবেষক—প্রফেসর সৌগত নন্দী, তাই তদন্তের দায়িত্ব পাঠানো হয় কলকাতার বিশেষ গোয়েন্দা শাখাকে। টিম টডেন্টে।
তিন জনের দল।
প্রধান—অরিন্দম শংকর, ইন্সপেক্টর, ঠান্ডা মাথার, চোখে কাচ ফ্রেমের চশমা, পড়াশোনা নিয়ে অন্যমনস্ক থাকলেও খুনের কেসে রীতিমতো জন্ত্রর মতো সঠিক।
দ্বিতীয়—বিনায়ক দত্ত, সাব-ইন্সপেক্টর, মুখে সারাক্ষণ চুইংগাম, একমাত্র লোক যে পুরাণ আর পুলিশি রিপোর্ট একসাথে গিলে ফেলতে পারে।
তৃতীয়—রূপসী কর, কনস্টেবল থেকে র্যাঙ্কে উঠে আসা, মাথায় ফেড করা চুল, হাঁটার ছন্দে আত্মবিশ্বাস।
টডেন্টে পৌঁছায় বিকেল তিনটের সময়, শহরের উৎসব তখন তুঙ্গে, কিন্তু মন্দিরের সেই দক্ষিণ কোণ ঘেরা হল বাঁশের ব্যারিকেডে, কাঁটাতারে, আর চুপচাপ পুলিশের হাঁটা চলায়। মৃতদেহ সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কুঠুরির মেঝেতে এখনও রক্তের গাঢ় ছাপ, যেন কেউ কিছু বলার আগেই থেমে গিয়েছিল।
“সৌগত নন্দী? ও কি এখানেই থাকছিল?” অরিন্দম প্রশ্ন করে স্থানীয় ইনচার্জ এসআই অজিত কায়ালকে।
“না স্যার, উনি রয়েছেন ‘নিলাচল হেরিটেজ হোম’-এ। কিন্তু উনি প্রায় রোজই মন্দির চত্বরে যেতেন। বলেছিলেন, রথযাত্রার সময় পুরীর কিছু গোপন ইতিহাস খুঁজছেন। আমরা ভাবতাম রিসার্চ।”
রূপসী ইতিমধ্যে কুঠুরির ভেতরের ছবি তুলছে, বিনায়ক হঠাৎ ঘরের এক কোণে একটা কাঠের বাক্স দেখে এগিয়ে যায়। ধুলো মুছে খুলে দেখে কয়েকটা পুরনো কাগজ—ভাঙা ওড়িয়া হস্তাক্ষরে লেখা কিছু। একটার মাথায় অদ্ভুতভাবে লেখা আছে—“বিধ্বস্ত রথ: ১৮৭৯”।
“স্যার,” বিনায়ক ফিসফিসিয়ে বলে, “এই নামটা আগে শুনেছি। ১৮৭৯ সালে একটা রথ মিছিলে হঠাৎ আগুন লেগেছিল। বলির দাবি উঠেছিল। কেউ বলেছিল সেটা দুর্ঘটনা না, পরিকল্পিত হত্যা। ঘটনা চাপা পড়ে যায়।”
অরিন্দম চোখে চশমা ঠিক করেন, “তবে কি সেই ইতিহাস খুঁড়তেই খুন হলেন নন্দী?”
“তা হলে খুনী আজকের দিনটাই কেন বেছে নিল?” প্রশ্ন করে রূপসী, “ভিড়, সিকিউরিটি, মিডিয়া—সব কিছু তো ছিল!”
অরিন্দম দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর বলে, “কারণ ওইটুকুই। খুন করে নিশ্চিন্তে হারিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে ভাল দিন রথের দিন।”
নিলাচল হেরিটেজ হোম-এ গেলে জানা যায় সৌগতবাবু গত কয়েকদিন ধরে প্রায় প্রতিরাতে ফিরেছেন দেরিতে। কেউ কেউ দেখেছে তাঁকে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পড়া এক মাঝবয়সী পুরোহিতের সঙ্গে কথা বলতে।
“ওঁর নাম মনে আছে?”
“না স্যার, ওঁকে প্রায়ই দেখা যায়, কিন্তু কেউ নাম জানে না। উনি কথা খুব কম বলেন।”
“তবে আমরা জানাব,” বলে অরিন্দম, “পথ আছে।”
সন্ধ্যা নামে পুরীতে, রথ ঠেলতে ঠেলতে শহর নেমে আসে ক্লান্তিতে, আলো ঝলমলে ভিড় আর ঢাকের শব্দ স্তিমিত হয়, শুধু দক্ষিণ কোণের সেই কুঠুরি থেকে যেন একটা নিঃশব্দ আর্তনাদ ভেসে আসে।
টিম টডেন্টে হোটেলে ফিরে প্ল্যান করে পরের দিনের কাজ—নন্দীর রিসার্চ নথি ঘেঁটে দেখা, পুরী মন্দিরের পুরনো নথি খোঁজা, আর খুঁজে বার করা সেই সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পড়া রহস্যময় পুরোহিতকে।
কিন্তু তারা জানত না, ঠিক সেই সময় পুরী কোস্টাল পুলিশের অফিসে ঢুকে পড়েছে এক অচেনা লোক, হাতে একটা বাদামী খাম, আর খামের গায়ে শুধু লেখা—“পরের খুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে, যদি…”
তদন্ত শুরু হল, কিন্তু রহস্য তখনও নিজের আসল মুখ দেখায়নি।
বাদামী খাম ও অজানা ছায়া
পূর্ব উপকূলের বাতাসে তখনও কাঁচা ঘামের গন্ধ আর প্রসাদে ভেজা কলাপাতার গন্ধ লেগে আছে। রাত দশটা ছুঁই ছুঁই, শহরের অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ হলেও পুরী কোস্টাল থানায় আলো জ্বলছে। ইন্সপেক্টর মহেশ পট্টনায়েক, আজ রাতের ডিউটিতে, চা হাতে দাঁড়িয়ে ছিল বাইরে। সে-ই প্রথম দেখতে পায় ছায়াময় ফিগারটিকে—গায়ে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি, মাথায় গামছা, মুখ ঢাকা প্রায় গলা অবধি। লোকটি নীরবে এগিয়ে এসে তাকে একটা খাম ধরিয়ে দিয়ে বলে, “শুধু স্যারের হাতে দেবেন, কাল ভোরে রথের ছায়া পড়ে যেখানে, সেখানেই লুকিয়ে আছে ইতিহাস,” বলে অদৃশ্য হয়ে যায় অন্ধকারে।
খামটি খুলতেই ধরা পড়ে তিন লাইন ইংরেজিতে লেখা এক অদ্ভুত বার্তা—
“Another death in 48 hours, unless the stone that remembers is returned.”
তলাতে কোনো নাম নেই, কোনো দাবিও না, শুধু এক কোণে আঁকা একটি ছোট্ট চিহ্ন—একটি অর্ধচন্দ্র, যার মধ্যে খোদাই করা একটি চোখ।
মহেশ আর দেরি না করে ফোন করে অরিন্দম শংকরকে। মাত্র পঁচিশ মিনিটের মধ্যেই টিম টডেন্টে থানায় এসে পৌঁছায়।
“এটা কী ধরনের খেলার শুরু?” রূপসী চোখ কুঁচকে বলে।
“না, এটা খেলা না,” অরিন্দম গম্ভীর, “এই চিহ্ন আমি চিনি। ‘নয়ন রত্ন’ নামে এক গোপন সংগঠন ছিল ওড়িশায় ব্রিটিশ আমলে, যাদের মতে রথযাত্রা আসলে দেবতাদের নয়, কিছু হারানো প্রাচীন প্রযুক্তির রূপক। তারা বিশ্বাস করত মন্দিরে আছে এক ‘চোখের পাথর’ যা সব দেখতে পায়, স্মৃতিতে ধরে রাখে।”
“Stone that remembers?” বলে উঠে বিনায়ক, “তবে কি সত্যিই ওই গবেষক সেই পাথর খুঁজে পেয়েছিলেন?”
“আর সে জন্যই হয়তো খুন হয়েছেন,” অরিন্দম শান্ত গলায় বলেন।
পরের দিন সকাল। টিম টডেন্টে পৌঁছায় সৌগত নন্দীর ঘরে। ঘরটা ছোট, ছিমছাম, তবে খাটের নিচে পাওয়া যায় একটা চামড়ার ব্যাগ, যার ভেতরে নোটবুক, কিছু স্ক্যান করা প্রাচীন কাগজ, আর একটা ছেঁড়া মানচিত্র।
মানচিত্রের এক কোণে লাল কালিতে গোল করে দেওয়া হয়েছে একটা জায়গা—“Ratna Vedi—Lower Crypt”
বিনায়ক চোখ ঘুরিয়ে বলে, “এটা তো মন্দিরের নিচের গোপন কুঠুরি। রত্নবেদির নিচে এক সময়ে নাকি জলের সুড়ঙ্গ ছিল।”
রূপসী বলে, “সেখানেই কি রাখা আছে সেই ‘চোখের পাথর’?”
অরিন্দম গম্ভীর। “এখনই কিছু বলা যাবে না। তবে এত বছর পরে আবার যদি কেউ সেটা খুঁজে পেয়ে থাকে, এবং তার জন্য কেউ খুন করতে পারে—তাহলে এটাকে রথযাত্রার ছায়ায় ঘটা এক ‘পুরাতত্ত্ব হত্যাকাণ্ড’ বলা যেতেই পারে।”
ঠিক তখনই আসে আরেক খবর। পুরীর সি বিচের কাছে সকালে জগদ্ধাত্রী ঘাটের এক সাধু হঠাৎ এক হ্যান্ডবিল পান, যাতে লেখা—
“The tide will return what the priests buried. The second death comes with low tide.”
এসব মেলানো যতটা রহস্যময়, ততটাই গা ছমছমে।
টডেন্টে ভাগ হয় তিন দিকে—
অরিন্দম যাচ্ছেন পুরী মন্দিরের লাইব্রেরি ঘাঁটতে,
রূপসী যাচ্ছেন ঘাটে সাধুদের সঙ্গে কথা বলতে,
বিনায়ক যাচ্ছেন স্থানীয় পুরোহিতদের সংগঠনে, সেই সাদা ধুতি-পাঞ্জাবিওয়ালা লোকটির সন্ধানে।
পুরো শহর যেন ভেসে যাচ্ছে অতীত আর বর্তমানের এক অদৃশ্য টানে।
আর সেই টানের উৎস এক গোপন ইতিহাস, এক গুপ্ত রত্ন, আর এক হত্যাকারীর মন—যার কাছে রথ শুধু বিশ্বাস নয়, প্রতিশোধের একমাত্র মাধ্যম।
সন্ধে নাগাদ আবার আসে খবর।
সি বিচে এক পর্যটক নিখোঁজ—শেষবার তাকে দেখা গিয়েছিল জলের ধারে, এক বৃদ্ধ পাণ্ডার সঙ্গে কথা বলতে।
সেই পাণ্ডা কে? কোথায় সে এখন?
কিছুতেই বোঝা যাচ্ছে না—তবে সময়ের ঘড়ি টিক টিক করে এগোচ্ছে সেই ‘৪৮ ঘণ্টা’র দিকেই।
রত্নবেদির ছায়া ও নিখোঁজ পর্যটক
পুরীর আকাশে তখন রঙিন পেঁজা মেঘ, অথচ নিচের শহরে ছড়িয়ে পড়ছে একটা অস্পষ্ট আতঙ্কের কুয়াশা। নিখোঁজ পর্যটক শুভব্রত সেন, বয়স তেত্রিশ, কলকাতা থেকে এসেছিলেন পুরীর রথযাত্রা কভার করতে ফটোজার্নালিস্ট হিসেবে। শেষবার তাকে দেখা গিয়েছিল জগদ্ধাত্রী ঘাটের কাছাকাছি এক পাণ্ডার সঙ্গে কথা বলতে, যার গায়ে ছিল সাদা ধুতি আর কপালে তিলক। চোখে সানগ্লাস, মুখ ঢাকা ছিল মুখোশে, যা তীর্থস্থানগুলোয় প্রায়ই দেখা যায়।
রূপসী কর সকালবেলা সেই জায়গায় পৌঁছায়, ভাটার সময়। স্থানীয় এক নারকেলজল বিক্রেতা জানায়—“ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ছিলেন বেশ কিছুক্ষণ। তারপর একজন এসে কানে কিছু বলল, আর দুজনে হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে গেল ওই কাঠের নৌকা ঘাটের দিকে।”
“কী চেহারা ছিল লোকটার?”
“মুখ দেখিনি। কিন্তু হাতে ছিল একটা ধাতব বাঁশি। অদ্ভুত ঠাণ্ডা গলায় কথা বলছিল।”
এই বর্ণনা শুনেই রূপসীর মাথায় গুলি খেলে যায়—ধাতব বাঁশি, ঠাণ্ডা গলা—এগুলো পুরাতন পুরাণ অনুযায়ী সেই ‘নয়ন রত্ন’ গোষ্ঠীর সংকেত বহনকারী চিহ্ন। তারা বলত, যে রত্ন চোখ দিয়ে দেখে, তাকে আহ্বান করতে হয় শব্দ দিয়ে। আর সেই শব্দ ‘বাঁশি’র সুরেই আসে।
অন্যদিকে অরিন্দম মন্দিরের লাইব্রেরিতে পুরোহিতদের সহায়তায় খুঁজে পায় এক সেকেলে তালপাতার পুঁথি, যেখানে রথের মূল কাঠামো তৈরির আগে আগে লেখা হয়েছিল—“রত্ন যে দেখে, সে কথা বলে না। কথা বললে ছায়া নামে। ছায়া মানেই মৃত্যুর আহ্বান।”
অরিন্দম ফোনে সব জানায় বিনায়ককে, যে তখন স্থানীয় পুরোহিতদের সংগঠনে গিয়ে খুঁজে পেয়েছে সেই সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পড়া লোকটির একটা পুরোনো ছবি—তোলা ২০০১ সালের মন্দিরের বার্ষিক সভায়। তার পাশে নাম লেখা—“অচ্যুত দাস, ইতিহাস রক্ষক।”
কিন্তু এই নামের কোনো পুরোহিত বর্তমানে সক্রিয় নেই। রেকর্ডে তার মৃত্যু ঘটেছে ২০০৪ সালে, এক ঘূর্ণিঝড়ের সময়।
“তবে কি এই লোকটি মৃত হয়েও ঘুরে বেড়াচ্ছে?”—রূপসীর প্রশ্নে অরিন্দম জবাব দেয়, “না, কেউ অচ্যুত দাসের পরিচয় ব্যবহার করছে। পুরোনো মুখে নতুন উদ্দেশ্য নিয়ে।”
এদিকে কোস্টাল পুলিশ পায় আরেকটি খাম, diesmal সি বিচের ধারে রাখা, যার ভেতরে শুধু একটা স্কেচ—একটি সুড়ঙ্গ, যার ওপরে লেখা “The Mouth Beneath the Chariot.”
এটা স্পষ্ট যে দ্বিতীয় খুন এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা, আর তার সঙ্গে জড়িত সেই পুরোনো সুড়ঙ্গ—রত্নবেদির নিচে থাকা গোপন পথে।
টিম টডেন্টে সিদ্ধান্ত নেয়—যতক্ষণ না রত্নবেদির নিচে থাকা সেই সুড়ঙ্গ খুঁজে বের করা যায়, ততক্ষণ তারা সামনে এগোতে পারবে না। পুরীর ইতিহাসে এই জায়গার কথা কোথাও নেই, কিন্তু সৌগত নন্দীর চামড়ার ব্যাগে পাওয়া মানচিত্রে সেই জায়গাটা স্পষ্ট।
রূপসী, বিনায়ক আর কোস্টাল পুলিশের দুই সদস্য নিয়ে রাতে তারা প্রবেশ করে মন্দির চত্বরের এক পুরনো মহন্তের ঘর হয়ে সেই কুঠুরি পর্যন্ত—যেখান থেকে শুরু হয়েছিল প্রথম খুন। কুঠুরির পেছনের দেয়ালে চাপা একটা অংশ খুলে মেলে এক সংকীর্ণ পথ, নীচের দিকে সিঁড়ি, আর তার মুখে রাশি রাশি বাদুড়ের শিস। বাতি জ্বালিয়ে তারা নামে ধীরে ধীরে।
নীচে একসময়ে ব্যবহার করা হত এমন একটা চেম্বার, যার চারপাশে প্রাচীন ওড়িয়া হরফে লেখা—“জীবন যদি দৃষ্টি হয়, তবে মৃত্যু স্মৃতি।”
ঠিক মাঝখানে এক পাথরের বেদি, আর তাতে রাখা আছে কিছু ধুলো, কাঁচের গুড়ো, এবং সেই প্রতীক—অর্ধচন্দ্রের মধ্যে চোখ।
“কেউ আগেই এসেছিল এখানে,” ফিসফিস করে বিনায়ক।
“তবে রত্ন কোথায়?” রূপসী আগায়।
অরিন্দম বলে, “আমরা দেরি করে ফেলেছি।”
ঠিক তখনই উপরে কারও পায়ের শব্দ।
রূপসী সিগন্যাল দেয় উপরে থাকা কনস্টেবলকে।
কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে কনস্টেবল পালিয়ে নেমে আসে, চিৎকার করে—“স্যার, উনি… উনি নেই। লোকটা একটা কথা বলে অদৃশ্য হয়ে গেল।”
“কী বলল?”
“বলল, দ্বিতীয় রথের ছায়া যখন সাগরের দিকে যাবে, তখন রক্ত আবার পড়বে… আর তার পরেই তারাই ফিরে আসবে—যারা চেয়েছিল ইতিহাস মুছে যাক।”
ঘড়ির কাঁটা তখন রাত দশটা বাইশ। আর দ্বিতীয় রথের ছায়া পড়তে শুরু করেছে সমুদ্রের গায়ে।
দ্বিতীয় রক্তপাত ও পাথরের জবানবন্দি
পুরী তখন কেবল রাত নয়, এক গভীর অন্ধকারে ডুবে থাকা ইতিহাসের ভেতর। দ্বিতীয় রথ—বলরামের—ছায়া ধীরে ধীরে সমুদ্রের গায়ে পড়ছে, আর ঠিক সেই মুহূর্তে সি বিচের পাশের বালির উপর পাওয়া গেল দ্বিতীয় মৃতদেহ। মুখ থুবড়ে পড়া, বালি আর রক্তে একাকার হয়ে যাওয়া শরীর।
নজর টানল মৃতদেহের বুকের উপর রাখা একটা ছোট্ট পাথরের টুকরো—চকচকে কালো, প্রায় চোখের মতোই দেখতে। পাশে ওড়িয়া ভাষায় লেখা ছিল এক চিরকুট:
“আমি সব দেখেছিলাম, কিন্তু কাউকে কিছু বলতে পারিনি। সেই জন্য শাস্তি পেয়েছি।”
অরিন্দম দাঁড়িয়ে পড়ে।
“এটা কি সেই Stone that remembers?”
রূপসী হাতের গ্লাভস পরে পাথরটা তুলে নেয়। ওটা নীলাভ কালো, ঘষলে তাপ ছড়ায়।
“একধরনের স্ফটিক। কিন্তু কীভাবে এটা ‘সব দেখেছে’? এটা কি প্রতীক, না প্রযুক্তি?”
“বা হয়তো উভয়ই,” বলে বিনায়ক, “যদি সত্যিই এই পাথর সেই পুরাতন সংগঠনের নিদর্শন হয়, তবে এটাই তাদের ‘নয়ন’, আর যারা এর মুখোমুখি হয়, তারা হয় দৃষ্টির মধ্যে বন্দি অথবা নিশ্চিহ্ন।”
মৃতদেহের পরিচয় মেলে কিছু সময় পর—নাম ছিল বাসুদেব হালদার, কলকাতারই এক অ্যান্টিক ডিলার, যিনি সৌগত নন্দীর সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করেছিলেন গত ছয় মাসে। হোটেল রেজিস্ট্রার খতিয়ে দেখা যায়, সৌগত নন্দীর আগমনের একদিন আগেই বাসুদেব পুরীতে ঢুকেছিলেন।
টডেন্টে বুঝে যায়—এই খুন নিছক হত্যা নয়, এটা ইতিহাসকে ঢাকা দেওয়ার প্রচেষ্টা। অতীতকে সামনে তুলে আনার চেষ্টা যে করেছে, তাকেই সরিয়ে দেওয়া হয়েছে একে একে।
ঠিক তখনই খবর আসে—সাধুদের পাড়ায় অচ্যুত দাস নামে এক অদ্ভুত পুরোহিত কয়েকদিন ধরে বসবাস করছে, যার চোখ দুটো কেমন যেন কাঁচের মতো ঝকঝকে। লোকজন বলে সে কারও চোখের দিকে তাকায় না, কিন্তু তাকালেই লোকজন ভাবে, সে সব বুঝে গেছে।
রূপসী ছদ্মবেশে গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলে।
“আপনি অচ্যুত দাস?”
“না, আমি শুধু তার ছায়া।”
“আপনি কি জানেন ‘চোখের পাথর’ কোথায়?”
“পাথর তো নিজের চোখেই চায় সব দেখতে। কিন্তু সবাই কি দেখতে পারে? আপনি পারবেন?”
এই বলে সে হঠাৎ এক টুকরো কাচ তুলে দেয় রূপসীর হাতে।
“এটা নিয়ে রত্নবেদির নিচে ফেরত যান। দেখবেন… কে সব জানে, কে কিছুই জানে না।”
রূপসী কাঁচের টুকরোটি টিম টডেন্টেকে দেখায়।
অরিন্দম চশমা খুলে তার ওপর রাখলে দেখেন—এক অদ্ভুত প্রতিচ্ছবি: সেই পুরনো কুঠুরি, এক পুরোহিত, আর একজন মানুষ যাকে দেখা যাচ্ছে খুন করতে।
“এটা কি তাহলে কোনো প্রযুক্তি?”
“না, হয়তো এটা হল এক ধরণের হ্যালুসিনেশন-সৃষ্ট কারিগরি, অথবা এমন কোনো পাথর যা রেকর্ড করে আলোর মাধ্যমে।”
“প্রোজেকশন স্টোন,” ফিসফিস করে বিনায়ক। “স্মৃতির প্রোজেকশন। নাকি এটাই সেই Stone That Remembers?”
তবে তারা যা-ই বলুক, বাসুদেব হালদারের খুন থেকে স্পষ্ট—খুনী জানে তার পরবর্তী টার্গেট কারা।
এবং সবচেয়ে ভয়ের বিষয় হল—সেই তালিকায় টিম টডেন্টের একজনের নামও থাকতে পারে।
ঘড়ি তখন রাত একটা।
রত্নবেদির নিচে ফেরার আগে, অরিন্দম বলে ওঠেন—
“আমাদের সময় শেষ হয়ে আসছে। কিন্তু খুনীর ছায়া আমরা এখনো পুরোটা দেখিনি। যে ছায়া এখনো ছায়া নয়, সে হয়তো আমাদের থেকেও এক ধাপ এগিয়ে।”
ছায়ার ফাঁদ ও ছিন্ন সত্য
পুরীর রাত ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ছে সেই গভীর স্তরে, যেখানে আলো আর ছায়ার মাঝখানে জন্ম নেয় ষড়যন্ত্র। টিম টডেন্টে এবার রত্নবেদির নিচের গোপন চেম্বারে ফেরে সেই কাচের টুকরো নিয়ে, যা নাকি দেখায় সেই সব ঘটনা—যা কেউ দেখেনি, শুনেছে শুধু দেয়াল।
চেম্বারের মধ্যে ঢুকতেই বাতাস ভারি লাগে। মেঝের এক কোণায় দেখা যায় মৃদু আলোর ছায়া, যেন অদৃশ্য কেউ ঘুরে বেড়াচ্ছে।
অরিন্দম হাতে নেয় কাচের টুকরো, চোখের সামনে ধরে। সাথে সাথে দেখা যায় চেম্বারের ভেতর এক দৃশ্য ভেসে উঠছে—একজন মানুষ, মুখে মুখোশ, হাতে কিছু একটা খুঁড়ে তুলছে বেদির নিচ থেকে। আর তারপর—হঠাৎ আঘাত! এক পুরোহিত ধপ করে পড়ে যাচ্ছে। মুখ দেখা যায় না, কিন্তু গলায় ঝোলানো গলায় লাল রুপোর তাবিজের মত কিছু।
রূপসী বলে, “এটাই তাহলে প্রথম খুন।”
বিনায়ক নোট নিচ্ছিল, হঠাৎ বলে, “তাবিজটা তো সেই চোখ প্রতীকের মতই দেখতে!”
“হ্যাঁ, অর্ধচন্দ্রের ভেতর চোখ। যার মানে দাঁড়ায় খুনী নিজেকে ‘চোখের রক্ষক’ বলে মনে করে। অর্থাৎ নয়ন রত্নের পুনর্জন্ম।”
হঠাৎ শব্দ হয় বাইরে। ধাতব দরজার ওপারে কেউ হাঁটছে। অস্ত্র হাতে বেরিয়ে আসে দল। কিন্তু কেউ নেই। শুধু একখানা ছোট কাগজ পড়ে থাকে সিঁড়ির মুখে, লেখা:
“তোমরা যা দেখেছ, তা সব নয়। স্মৃতির পাথর শুধু চায় দেখা হোক। সত্য নয়। সত্যের ছায়া যখন বড় হয়ে যায়, তখন খুনও আড়াল হয়ে পড়ে।”
রূপসী ফিসফিস করে বলে, “এটা আমাদের বিপথে চালানোর চেষ্টা।”
অরিন্দম মাথা নেড়ে বলেন, “না, এটা আসলে আমাদের সতর্ক করা। খুনী তার খেলা খেলছে, কিন্তু তার ভিতরেও আছে এক দুর্ভেদ্য লজিক। তার লক্ষ্য শুধু রত্ন নয়—একটা নির্দিষ্ট বার্তা ছড়ানো।”
এরই মাঝে বিনায়ক জানায়, সে খুঁজে পেয়েছে বাসুদেব হালদারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল এক পুরনো অধ্যাপকের, নাম—দিগন্ত মহাপাত্র, যিনি এখন থাকেন পুরীর এক হেরিটেজ বাড়িতে—‘মণিকুঠি’।
সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে পৌঁছায় টিম।
মণিকুঠি বাইরের দিক থেকে যেন ইতিহাসের ফ্রেমে বাঁধানো একটা বাড়ি—চুন-সুরকির দেয়াল, বারান্দায় ঝুলছে লণ্ঠন, ভেতরে নীরবতা।
দিগন্তবাবু, প্রৌঢ়, চোখে মোটা চশমা, কাঁপা গলায় বলেন,
“সৌগত আমাকে বলেছিল, সে কিছু পেয়ে গেছে—একটা পাথর, যা না কি শুধু ছবি রাখে না, অনুভূতি ধরে রাখে। ও বলেছিল এটা শুধু ইতিহাস নয়, এটা এক ধরনের প্রতিরোধ।”
“কিসের প্রতিরোধ?”
“ভুল ইতিহাসের বিরুদ্ধে। মন্দিরে এমন কিছু লুকানো আছে যা কেউ জানতে চায়নি, কারণ জানতে গেলে প্রশ্ন উঠে যাবে, বিশ্বাসে আঘাত লাগবে। আর বিশ্বাসে আঘাত লাগলে রক্ত পড়ে। ও সেটা জানত, তাও থামেনি।”
এই কথার মাঝেই একজন পরিচারক চুপিচুপি অরিন্দমের হাতে দেয় একটা ছোট খাম।
ভেতরে আছে একটা স্কেচ—একটা মূর্তি, যার চোখে বসানো এক পাথর। নিচে লেখা:
“She sees everything.”
রূপসী বলে, “এটা কি সেই রত্নের আসল জায়গা?”
অরিন্দম বলে, “সম্ভবত। এবং হয়তো সেই পাথর এখনও ওখানেই রয়েছে। কিন্তু খুনী সেটা চায় না… সে চায় পাথর নষ্ট হোক, যাতে অতীত চিরতরে হারিয়ে যায়।”
ঠিক তখনই ফোন আসে পুরী কোস্টাল থানায়—
একজন পাণ্ডা নিখোঁজ, নাম বিষ্ণুবাবু। এবং—তার ঘরে পাওয়া গেছে একটি রক্তমাখা ধুতি ও সেই একই প্রতীক খোদাই করা এক ধাতব তাবিজ।
এবার নিশ্চিত টডেন্টে—খুনী শুধু ছায়া নয়, এখন সে ঘুরে বেড়াচ্ছে নাম নিয়ে, রূপ নিয়ে, এবং ভবিষ্যৎ নিয়েও।
মূর্তির চোখ ও ইতিহাসের গলিঘুঁজি
ভোরের আলো পুরীর সাদা বালিতে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু টিম টডেন্টের চোখে ঘুম নেই। অরিন্দম শংকর টেবিলে ছড়ানো স্কেচ, চিরকুট, ও কাচের টুকরোগুলো দেখতে দেখতে বলে উঠলেন, “যদি এই পাথর সত্যিই একটা মূর্তির চোখে বসানো থাকে, তাহলে সেটা কার মূর্তি হতে পারে? কে সেই ‘She’—যিনি সব দেখেন?”
রূপসী বলল, “পুরীতে নারীদেবীর মূর্তি এমনিতে বিরল। কিন্তু উপকূল অঞ্চলে জগন্নাথ উপাসনার পাশাপাশি কোনো এক ‘বিষ্ণুময়ী’ রূপের গোপন পূজার প্রচলন ছিল বলে কিছু তথ্য সৌগতবাবু খুঁজে পেয়েছিলেন।”
বিনায়ক হাত দিয়ে চুল এলোমেলো করে বলল, “আমরা কী বলছি জানো? একটা খুনীর খোঁজ করতে গিয়ে একটা হারিয়ে যাওয়া লোকবিশ্বাস আর তার সঙ্গে যুক্ত প্রযুক্তির অনুসন্ধানে নামছি।”
“ঠিক তাই,” অরিন্দম থেমে বললেন, “আর এটাই আমাদের সামনে সেই মুহূর্ত যেখানে খুনের মোটিভটা শুধু ব্যক্তিগত নয়, সাংস্কৃতিকও।”
তারা পৌঁছায় পুরীর পুরাতন মিউজিয়ামে। সেখানে সংরক্ষিত আছে বহু পরিত্যক্ত দেবমূর্তি, ভগ্নপ্রায় অথচ মহিমান্বিত। কিউরেটর বললেন, “আপনারা ওই নারীমূর্তির খোঁজ করছেন যার চোখে বসানো ছিল নীলচে পাথর?”
“আপনি জানেন?”
“আমরা একে বলি ‘মায়ার মুখ।’ এই মূর্তিটা পাওয়া গিয়েছিল ১৯১১ সালে সমুদ্রতটে, ঝড়ে উলটে যাওয়া এক পুরনো খুঁটির নিচে। অনেকে বলে এটি দেবীর নয়, এক সময়কার রক্ষিকা—এক ‘সাক্ষী’ রূপ, যার কাজ ছিল শুধু দেখা, কিছু না বলা। ওর একটা চোখ খসে গেছিল। আরেকটা তখন থেকেই ঝিলমিল করত। কিন্তু…”
“কিন্তু?”
“কয়েক বছর পর মূর্তিটা সরিয়ে রাখা হয়, কারণ কিছু দর্শনার্থী অভিযোগ করে ওর দিকে তাকিয়ে মনে হয়, যেন কেউ নিজেকে দেখছে অন্য কারও চোখে। কিছু লোক ভয় পেয়ে যায়, কেউ কেউ অসুস্থও হয়ে পড়ে।”
অরিন্দম এক মুহূর্ত থেমে বলেন, “আমরা কি সেই মূর্তিটা দেখতে পারি?”
মিউজিয়ামের পিছনের গুদামে তারা দেখে সেই মূর্তিটি—কালো পাথরের গড়া, মুখে অদ্ভুত এক প্রশান্তি আর শীতলতা, বাম চোখে গর্ত, আর ডান চোখে বসানো সেই রহস্যময় চকচকে নীল পাথর।
রূপসী হাতে তুলে নেয় মোবাইল ক্যামেরা।
ক্লিক করার ঠিক পরেই তার শরীর কেঁপে ওঠে।
“কী হল?”
“আমি… আমার মনে হল কেউ আমার দিকে তাকিয়ে বলছে—‘মিথ্যা বলো না’। এই কথাটা শুধু মাথার ভেতর বাজছিল।”
বিনায়ক বলে, “এটা কি হ্যালুসিনেশন? না কি পাথরের মধ্যে ধরা আছে কোনো প্রবল আবেগ—যেটা শুধু চোখের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে?”
“এটাই সেই রত্ন,” অরিন্দম ধীরে ধীরে বলেন, “যার জন্য খুন হচ্ছে, যা শুধু দেখা নয়, দর্শনের শাস্তি বহন করে।”
ঠিক তখনই ফোন আসে—পাণ্ডা বিষ্ণুবাবুর মৃতদেহ পাওয়া গেছে সমুদ্রতটে, সেই একইভাবে, চোখের উপর নীলচে দাগ আর মুখে লেখা—“She saw me lie.”
রূপসী বলে, “তাহলে খুনী মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে তাকে প্রতিপক্ষ ভাবছে। সে কাউকে মিথ্যে বলতে দেখলেই… খুন করছে।”
অরিন্দম বলেন, “না, এটা খুনী নয়, এটা তার বার্তা। সে বিশ্বাস করে, এই রত্ন বা মূর্তি হল শেষ সাক্ষী, যাকে ভয় পায় সেই সব মানুষ যারা ইতিহাসকে নিজেদের ইচ্ছেমত বাঁকাতে চেয়েছিল।”
“তা হলে এখন কী করব?”
“মূর্তিটা হস্তান্তর করতে হবে সরকারি হেফাজতে। আর তার আগে, আমরা খুনীর ছায়াকে শেষবারের মত সামনে আনতে চাই।”
ঠিক তখনই মিউজিয়ামের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা এক বৃদ্ধ নিরাপত্তাকর্মী কাগজের টুকরো দেয়।
তাতে লেখা:
“যা সত্যি তা নয়, যা নয় তাই সত্যি। চোখ দেখবে না, ছায়া দেখাবে।”
আর নিচে এক জায়গার নাম—”নিলবরণ মঠ, রাত ৩টে”
টিম টডেন্টে বুঝে যায়—এইবার খেলা শেষের দিকে, এবং তারা যদি না পৌঁছায় ঠিক সময়মতো, পরবর্তী খুন হয়তো তাদের কাউকে নিয়েই লেখা হয়ে যাবে।
নিলবরণ মঠ ও ছায়ার মুখোমুখি
পুরীর উপকণ্ঠে অবস্থিত ‘নিলবরণ মঠ’ শহরের চেনা পথের বাইরে, জঙ্গলঘেরা এক পুরনো ভগ্নাবশেষ, যেটাকে এখন কেউ মঠ বলে না, কেউ ডাকে “ভূতের বাড়ি”, কেউ বলে “সন্ন্যাসীদের ছায়াপথ”। রাত তিনটের ঠিক দশ মিনিট আগে টিম টডেন্টে পৌঁছাল সেই পরিত্যক্ত স্থানে। চারপাশ নিঃশব্দ, মাঝে মাঝে কেবল বাতাসে তালপাতার মড়মড় শব্দ।
অরিন্দম, রূপসী আর বিনায়ক, সশস্ত্র কোস্টাল পুলিশ সহ প্রবেশ করল মঠের চৌকাঠ পেরিয়ে, টর্চের আলোয় তাদের সামনে ফুটে উঠল শতাব্দী পুরোনো এক অন্ধকার—ভাঙা দেওয়াল, পাথরের শিবলিঙ্গ, আর একটা ঢালু মেঝে যা নিচে নেমে গেছে অন্ধকারে।
“এখানেই সেই পাথর তোলা হয়েছিল,” ফিসফিস করে বলল বিনায়ক, “এখানেই হয়তো প্রথম সেই ‘নয়ন রত্ন’-এর গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল। আর এখানেই তারা হয়তো তাদের শেষ বার্তাটা রেখে যেতে চায়।”
তারা যখন নিচে নামছে, তখন আচমকাই ভেসে এল এক বাঁশির টানা সুর—না বেমানান, না ভীতিকর, কিন্তু হাড়ে কাঁপুনি ধরিয়ে দেওয়ার মতো নির্লিপ্ত।
রূপসী চোখে সিগন্যাল দেয়, সবাই প্রস্তুত। বাঁশির সুর যেন কোথাও কাছাকাছি থেকে আসছে।
একটা ঘরের দরজার সামনে পৌঁছাতেই তারা দেখতে পেল—একজন দাঁড়িয়ে, মুখে মুখোশ, হাতে সেই তাবিজ, যার মধ্যে অর্ধচন্দ্র আর চোখ খোদাই। কাঁধে পিঠব্যাগ।
“খুনের জন্য নয়, স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এসেছি,” লোকটা বলল। “তোমরা যা খুঁজছ, সেটা খুঁজে পাবে না, যদি না জানতে পারো কেন তা হারানো হয়েছিল।”
অরিন্দম সাবধানী গলায় জিজ্ঞেস করল, “তুমি কে?”
“আমি সেই মুখোশ, যাকে চায়নি কেউ মুখ দিতে। আমি সেই ছায়া, যাকে কেউ ইতিহাসে রাখেনি, তবুও সে থেকেই গেছে।”
“তুমি কি সৌগত নন্দীকে খুন করেছিলে?”
“আমি কাউকে খুন করিনি। আমি শুধু তুলে দিয়েছি তার চোখের সামনে সত্য, আর তাতেই সে মারা গেছে।”
“বাসুদেব?”
“সে পাথর বিক্রি করতে চেয়েছিল। বলেছিল এটার দাম কোটি কোটি টাকা। আমি বাধা দিয়েছি। সেটাই খুন?”
লোকটা মুখোশটা খুলল। তিরিশের শেষের দিকে, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, কিন্তু দৃষ্টিতে অনুতাপ নেই।
“আমার নাম অনির্বাণ। আমি সৌগত নন্দীর ছাত্র ছিলাম। আমি বিশ্বাস করি, ইতিহাস কেবল বইয়ে থাকা নয়, তা একটা দায়। যদি কোনো বস্তু সত্য ধরে রাখতে পারে, তবে তা রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব।”
“তাহলে এই পাথর নিয়ে তুমি কী করতে চাও?”
“ফেলে দিতে চাই সাগরের অতল জলে, যাতে কেউ আর কখনও সত্য বিক্রি করতে না পারে।”
বিনায়ক সামনে এগিয়ে গিয়ে বলল, “কিন্তু তুমি জানো না, তুমি নিজেই একটা খুনের সূত্র হয়ে দাঁড়িয়েছ। তুমি হয়তো মারনি, কিন্তু তুমি ভেবেছ তুমি ঈশ্বর—সত্য রক্ষা করার ভার একা নিয়েছ।”
“যারা ঈশ্বর হয়ে মিথ্যা রচনা করেছে, তাদের কেউ শাস্তি দেয়নি। আমি শুধু ভারসাম্য ফেরাতে চেয়েছি।”
অরিন্দম শান্তভাবে বললেন, “পাথরটি আমাদের দিতে হবে। তারপর বিচার হবে রাষ্ট্রীয় নিয়মে। সত্য কোনটা, ইতিহাস কোনটা, তা আমরা দেখতে চাই—কিন্তু হত্যা করে নয়, জীবন রক্ষা করে।”
অনির্বাণ একটু থেমে ব্যাগ খুলে তুলে দিল সেই চকচকে পাথর।
“এই পাথরে শুধু আলো নেই, কিছু মুখও ধরা আছে—তাদের চিৎকার, তাদের প্রতারণা, আর তাদের ভয়। ওদের মনে রাখবেন।”
তাকে গ্রেপ্তার করা হয়—অস্ত্র ছাড়াই, কোনো প্রতিবাদ ছাড়াই।
সে শুধু একবার বলে, “রত্ন হারাবে না, হারালে মানুষ ভুলে যাবে নিজেকে। তাই আমি চাইছিলাম রত্ন থেকে যাক ছায়া, শুধু থাকুক আলো।”
টিম টডেন্টে জানত—তাদের তদন্ত শেষ হয়নি। সত্য প্রকাশে এখনো অনেক বাঁধা।
কিন্তু তারা যা পেয়েছে তা শুধু খুনের কেস নয়—এটা ছিল এক দীর্ঘ, চাপা দেওয়া ইতিহাসের মুখোমুখি হওয়ার সময়।
রত্নের স্বর আর জনতার মুখোমুখি
পুরীর সেই সকাল ছিল অন্যরকম—রথের কাঠে যেন জমে ছিল অতৃপ্ত আত্মার নিঃশ্বাস, আর সমুদ্রের ঢেউ ছিল স্নিগ্ধ নয়, বরং কেমন যেন রুক্ষ, কপালে ভাঁজ ফেলা। অনির্বাণ বন্দি, রত্ন প্রশাসনের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, আর গোটা শহরে ছড়িয়ে পড়েছে কল্পনা, কৌতূহল আর আতঙ্ক।
“এই পাথরটা যদি সব দেখে, তাহলে সরকার কি আমাদের ওপর নজর রাখবে?”
“নাকি এটা ভগবানের চোখ?”
“খুনটা কি আসলে ঈশ্বর-অপমানের প্রতিশোধ?”
টিম টডেন্টে তাদের হোটেলের কনফারেন্স রুমে বসে রত্নের সামনে দাঁড়ায়। কাচের বাক্সে রাখা সেই নীলচে চোখ, তীক্ষ্ণ আলো ফেলে যেন নিজের মূর্তি বানিয়ে নেয় দেয়ালে। অরিন্দম খুব ধীরে বলে, “এটা পাথর নয়। এটা একটা পোর্টাল। যেটা আমাদের নিজেদের চোখে ফিরিয়ে দেয় আমাদের মুখ। নিজের মুখ সহ্য করতে না পারার যন্ত্রণাতেই খুনগুলো ঘটেছে।”
রূপসী চুপচাপ একটি ভিডিও চালায়—যেখানে সৌগত নন্দীর একটি ফাইল ক্লিপিং আছে। তিনি ক্যামেরার সামনে বলছেন—
“যদি এই রত্ন সত্যিই ইতিহাস ধরে রাখতে পারে, তবে সেটা কোনো সরকারের নয়, কোনো ব্যক্তিরও নয়। এটা জনতার—যারা সত্য জানতে চায়। কিন্তু যদি তারা ভয় পায়, তবে এই রত্ন অভিশাপ।”
বিনায়ক বলে ওঠে, “তা হলে কি রত্নটাকে জনসমক্ষে আনা উচিত?”
“সেটাই প্রশ্ন,” বলে অরিন্দম, “আমরা চাই সত্য উদ্ভাসিত হোক। কিন্তু যদি সত্যই ভয়ংকর হয়?”
“সত্য কখনো ভয়ংকর নয়,” বলে রূপসী, “ভয়ংকর হয় আমাদের সত্যকে লুকিয়ে রাখার ইচ্ছেটা।”
টডেন্টে সিদ্ধান্ত নেয়—একটি পাবলিক এক্সিবিশন করা হবে পুরী মিউজিয়ামে। পুরো ঘটনা তুলে ধরা হবে, যাতে মানুষ জানে আসল ইতিহাস কী, কীভাবে রত্ন পাওয়া গেল, কেন মানুষ খুন হল, আর কীভাবে সত্য বিকৃত করা হচ্ছিল।
দিনটা ঠিক হয় রথের শেষ দিন—নবমী। শহর আবার আলোয় ভরে ওঠে, কিন্তু এবার আলো অন্য অর্থে জ্বলে।
পুরী মিউজিয়ামের সেই বৃহৎ গ্যালারিতে রাখা হয় রত্ন, মূর্তির চোখে বসানো অবস্থায়। মানুষের লাইন পড়ে যায়, সবাই দেখতে চায় সেই পাথর যা ‘সব দেখে।’
একটা ছোট্ট নোট বোর্ডে অরিন্দম লিখে দেন—
“এটা কোনো জাদু নয়, এটা আপনার চোখ। আপনি কী দেখেন, কী বিশ্বাস করেন, সেটা আপনার বিবেচনার ওপর।”
অনির্বাণকে চার্জশিট দেওয়া হয় তথ্য গোপন ও হত্যা প্ররোচনার অভিযোগে। সে সব মেনে নেয়, একবারও প্রশ্ন করে না। তার জবানবন্দিতে লেখা ছিল—
“আমি খুনি নই, আমি সেই অরণ্য যাকে আগুন দিয়েছিল শহর। আমি শুধু চাই, যেন কেউ আর আলোকে ভয় না পায়।”
পুরো তদন্তের শেষ রিপোর্টে টডেন্টে লিখল—
“এই হত্যাগুলি ছিল রক্তাক্ত নিঃশ্বাস, যারা ইতিহাসের চাপা গলিতে আটকে পড়া স্মৃতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিল। আমরা হয়তো খুনী ধরেছি, কিন্তু যারা তাকে তৈরি করেছিল—সেই সমাজ, সেই ভয়ের সংস্কৃতি—তাদের মুখ এখনো অন্ধকারে।”
সন্ধ্যার দিকে, টিম টডেন্টে বিদায় নেয় পুরী থেকে। ট্রেন ছাড়ার আগে রূপসী সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলে,
“এই সমুদ্রটা শুধু জলে নয়, চুপ করে ইতিহাসও ধরে রাখে, তাই না?”
অরিন্দম চুপ করে মাথা নাড়ে।
বিনায়ক হেসে বলে, “পরের কেসে হয়তো সমুদ্র বলেও দেবে।”
ট্রেন ধীরে ধীরে ছাড়ে। বাইরে বালি, সমুদ্র আর রথের চাকার দাগ মিলিয়ে যায় কুয়াশায়।
আর সেই কুয়াশার ভেতরেও থেকে যায় সেই চোখ—যা হয়তো এখনো চেয়ে আছে।
ছায়ার বাইরে, আলোয় ফেরা
কলকাতায় ফিরেছে টিম টডেন্টে। অরিন্দম শংকরের টেবিলের উপর পুরীর ফাইলগুলো ধীরে ধীরে স্তরে স্তরে স্তব্ধ হয়ে আছে। কিন্তু সেই কাচের বাক্সে বন্দি চোখের পাথরটা—যেটা এখন ‘প্রমাণের সামগ্রী’ হিসেবে সরকারি হেফাজতে আছে—তা যেন এখনও তাকিয়ে রয়েছে সময়ের এক অদৃশ্য রেখায়।
দু’সপ্তাহ কেটে গেছে। অনির্বাণ এখনও বিচারাধীন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে জনমত একরকম দ্বিধাগ্রস্ত। কেউ বলছে সে খুনি, কেউ বলছে সে ‘একজন স্মৃতি-রক্ষক’।
এই সময় অরিন্দম ডাক পান ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সমিতি থেকে—একটি বিশেষ আলোচনায় ‘Ratna That Remembers’ নিয়ে বক্তব্য রাখার জন্য।
তিনি রাজি হন না প্রথমে। কিন্তু রূপসী বলেন, “যদি সত্যিকে সামনে না আনি, তাহলে যারা ভবিষ্যতে প্রশ্ন করবে, তাদের জন্য আমরা কোনো উত্তর রেখে যেতে পারব না।”
বিনায়ক নিজে একটা ছোট তথ্যচিত্র তৈরি করছে—“রত্ন, রক্ত আর রথ: এক ইতিহাসের পুনর্জন্ম”—যেটা ইউটিউবে মুক্তি পাওয়ার পরে দেশজুড়ে আলোড়ন ফেলে দেয়।
সেখানে সে তুলে ধরে পুরীর সেই রহস্যময় রত্নকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো, যেখানে খুনের ছায়া থেকে জন্ম নেয় আত্মজিজ্ঞাসার আলো।
হঠাৎ একদিন অরিন্দম ডাক পান একটি অজানা নম্বর থেকে।
“আপনারা যা দেখেছেন, তা পুরোটাই ছিল না। কিছু এখনও বাকি।”
“আপনি কে?”
“আমি সেই সংগঠনের শেষ উত্তরাধিকারী, নয়ন রত্নর প্রকৃত ধারক। অনির্বাণ শুধু বাহক ছিল।”
“আপনি কী চান?”
“আমি চাই, আপনারা বুঝুন—পাথর শুধু অতীত নয়, ভবিষ্যতের নির্দেশকও। একটা দ্বিতীয় রত্ন আছে। পশ্চিমে। গোপালপুর-অন-সি-র উপকূলে। সেটা আমাদের মতো কাউকে খুঁজে পাওয়ার আগে আপনারা বের করুন।”
ফোনটা কেটে যায়।
অরিন্দম একটু নীরব থেকে চশমা খুলে তাকান বারান্দার বাইরে।
রূপসী বলে, “এই কি তবে শেষ নয়?”
“না,” অরিন্দম বলেন, “এই তো শুরু। ইতিহাস নিজেই তার সাক্ষী খোঁজে—আমরা শুধু সেই চোখের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়া।”
টিম টডেন্টে আবার প্রস্তুত হয়।
নতুন কেস, পুরোনো ছায়া, নতুন পথ।
তারা জানে—সব খুন ব্যক্তিগত নয়, কিছু খুন হয় ইতিহাসকে কবর দিতে। আর কিছু মানুষ জন্মায় সেই ইতিহাস খুঁড়ে তোলার দায়ে।
পুরীর বালিতে সেই রথের চাকা নেই আর, কিন্তু একটা দাগ রয়ে গেছে—চোখের আকারে, নীলচে রঙে।
সেই দাগেই লেখা আছে—”যারা দেখেছে, তারা ভুলে যেতে পারে না। যারা ভুলে গেছে, তারা আর চোখে
চোখ রাখতে পারে না।”
শেষ